একটি খুনের গল্প
কাজটা গোপালবাবু সাবধানে এবং ঠান্ডা মাথায় করবেন বলে ঠিক করেছেন। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হয়ে গেলে যে-কোনও কাজই সাবধানে এবং ঠান্ডা মাথায় করা উচিত। এক-পা ফেলার আগে দশবার ভাবা উচিত। এই কাজের বেলায় গোপাল সান্যাল ভেবেছেন একশোবার। তার পরও বারবার পিছিয়ে এসেছেন। তার কারণ কাজটা কঠিন। শেষ পর্যন্ত সুযোগ এসেছে। গোপালবাবু নি:খুতভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চান।
গোপালবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, কাজ করাবেন ‘প্রফেশনাল’ দিয়ে। পেশাদার খুনি। সুপারি কিলার। সেইমতো একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই লোকের বায়োডাটা ভালো। এই লাইনে দীর্ঘদিন আছে। পয়সা বেশি নেয় তবে কাজে ত্রুটি রাখে না। গোপালবাবু তবু অতিরিক্ত সাবধান হয়েছিলেন। বড় লেভেলের চেনাজানা ধরে সেই লোকের কাছে হাজির হলেন। লোকটার নিতাই নাম। চেহারা চকচকে, গোলগাল। পরনে ধুতি, গায়ে উড়নি। পেট পর্যন্ত লম্বা পৈতে, গলায় কন্ঠির মালা। কপালে মাটি লেপটানো চন্দন। এই ধরনের লোক ধুতি, উড়নি, মাটির টিপ পরে থাকলে মনে হয় ভান করছে। সাজানো ভক্ত। গোপালবাবু গোড়াতে সেরকম ভেবেছিলেন। পরে জানলেন, ঘটনা সেরকম নয়। নিতাই সত্যিকারের একজন ভক্ত মানুষ। বেলা পর্যন্ত পুজোআচ্চা নিয়ে থাকে। সন্ধেতে নামগান। নামগান শেষে শনিবার শনিবার করে বাতাসা বিতরণ। ঠিক বিতরণ নয়, কাঁসার জাম বাটি থেকে মুঠো করে বাতাসা নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। একেই সম্ভবত হরির লুঠ বলে। ভক্তরা লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে হরির লুঠের বাতাসা গ্রহণ করে। না ভেঙে আস্ত বাতাসা লোফা বিশেষ পুণ্যির বিষয়।
বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড—তিন জায়গায় নিতাইয়ের লোক আছে। সপ্তাহের মাঝামাঝি এলে তারা শনিবার পর্যন্ত থেকে যায়। একেবারে ‘কাজ’ সেরে হরির লুঠের বাতাসা নিয়ে দেশে ফেরে। ‘সুপারি’ নেওয়ার সময় নিতাই পার্টির সঙ্গে চট করে দেখা করে না। সেটাই স্বাভাবিক এবং উচিত। এই কাজে রিস্ক খুব। পুলিশের খোঁচড় পার্টি সেজে ঢুকে পড়ে। তাই সোর্সের ব্যবস্থা আছে। সোর্স ধরে নিতাইয়ের কাছে পৌঁছোতে হয়। শুধু সোর্স ধরলে হবে না। সোর্সের কাছ থেকে কোড জেনে আসতে হয়। পাসওয়ার্ড। সকাল বিকেল নিতাই কোড বদলায়। গোপালবাবু সোর্স ধরলেন, বড় লেভেলের চেনাজানা ধরলেন এবং সবশেষে ‘কোড’ জেনে তবে নিতাইয়ের কাছে পৌঁছোলেন। সেদিন সকালেকোড ছিল, ‘চিনি বেশি খাই। চায়ে দু-চামচ চিনি দিতে বলবেন।’ দুপুরের পর কোড বদলে গেল। তখন কোড হল, ‘চিনি খাই না। সুগার আছে। চিনি ছাড়া চা বলুন।’
গোপালবাবু এলেন বিকেলে। নিতাই খাতির করে বসাল। খুন-জখম অপহরণ যাই হোক, পার্টি তো। পার্টি মানে লক্ষ্মী।
‘কী খাবেন? সরবত দিতে বলি? এরা আম পোড়া সরবত ভালো করে।’
গোপালবাবু বললেন, ‘না, সরবত নয়। চিনি খাই না। সুগার আছে। আপনি বরং এক কাপ চা বলুন। চিনি ছাড়া।’
চায়ের অর্ডার দিয়ে নিতাই বলল, ‘পাখির বয়স কত?’
গোপালবাবু বললেন, ‘আমার বয়স। একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। কয়েকমাসের এদিক ওদিক হতে পারে।’
‘স্বভাবচরিত্র কেমন? চালাক না বুদ্ধিমান?’
গোপালবাবু প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন না। একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘চালাক না বুদ্ধিমান মানে!’
নিতাই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘চালাক পাখি মারবার একরকম কায়দা, বুদ্ধিমান পাখি মারবার আরেকরকম কায়দা। চালাক পাখি আকাশে উড়তে উড়তে ভল্ট দেয়। ভাবে এতে শিকারির গুলি ফসকে যাবে। বোকা জানে না শিকারি সবসময় পাখির ভল্ট হিসেব করেই গুলি ছোঁড়ে। যাকে দুই ভল্টে মারবে তাকে সেই কায়দায় গুলি, যাকে আড়াইতে মারবে তাকে সেই কায়দায়। বুদ্ধিমান পাখি এটা জানে। তাই তার ডিগবাজি ফাজিতে না গিয়ে স্ট্রেট উড়ে যায়। শিকারির হিসেব গুলিয়ে দেয়। সে ডিগবাজির হিসেব করে গুলি ছোঁড়ে, সেই গুলি গায়ে লাগে না। তাই বুদ্ধিমান পাখিকে গুলি করতে হয় ভেবেচিন্তে।
গোপালবাবু খুশি হলেন। তিনি ঠিক লোকের কাছে এসেছেন। চালাক, বুদ্ধিমানের ফারাক করা সহজ কথা নয়। খুব কম লোক পারে। এই লোক তাদের একজন। গোপালবাবু বললেন, ‘ভবেশ চালাক বা বুদ্ধিমান কোনওটাই নয়। সে বোকা। সহজ সরল প্যার্টানের।’
নিতাই ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ভবেশ! পাখির নাম?’
গোপালবাবু মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভবেশ পোড়েল।’
নিতাই ইন্টারোগেশনের কায়দায় বলল, ‘ভবেশ পোড়েলকে আপনার সহজ সরল কেন মনে হয়?’
গোপালবাবু মুখ তুলে সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘ভবেশ আমার শুধু ছোটবেলার বন্ধু নয়, বারো বছরের বিজনেস পার্টনার। সে বোকা না চালাক, আমি জানব না? তার মানুষকে বিশ্বাস করবার অভ্যেস আছে। বোকা অভ্যেস।’
নিতাই গোপালবাবুর চোখের ওপর চোখ রেখে বলল, ‘আপনাকে বিশ্বাস করে?’
গোপালবাবু চুপ করে রইলেন। কী উত্তর দেবেন? ভবেশ তাকে শুধু বিশ্বাস করে না, বাড়াবাড়ি ধরনের বিশ্বাস করে। না করলে কি আর এভাবে টানা পাঁচ বছর বিজনেস থেকে লাভের অংশ সরিয়ে রাখতে পারতেন? হিসেবপত্র দেখতে বললে গাধাটা বলে, আমি ওসব হিসেব-টিসেবে নেই গোপাল। বিজনেস শুরুর সময়ই তো কথা হয়ে গিয়েছিল বাপু, গায়ে গতরে খাটব আমি, অফিসে বসে কাগজপত্র নিয়ে কর্মকাণ্ড তোর। সেই মতো আমি ঘুরে ঘুরে অর্ডার আনি, তুই হিসেব করিস।’
পার্টনারশিপ ব্যবসার শুরুতে এসব নেকা কথা হতে পারে। পরে হয় না। লাভ আসতে শুরু করলে তো একেবারেই হয় না। ব্যবসায় বাপও নিজের ছেলেকে বিশ্বাস করে না। তবে এখানে শুধু কি আর ব্যবসা? আর কিছু নেই? হ্যাঁ, আছে। আরও বিশ্বাসের ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারের নাম মন্দিরা। ভবেশের বউ। গোপালবাবুর সঙ্গে মন্দিরার আলাপ ভবেশের বিয়ের সময়ে। পাত্রী ফাইনালের সময় গোপালবাবু নিজে উপস্থিত ছিলেন। পরে বিয়ের যাবতীয় ব্যবস্থা, কেনাকাটা, খাটাখাটনি সবই করেছেন। এমনকি ফুলশয্যার খাট পর্যন্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাজিয়েছিলেন। সবাই বলেছিল, বন্ধুর বিয়ে দিয়ে গোপাল হাত পাকাচ্ছে। এরপর নিজে বিয়ে করবে। এখন স্টেজ রিহার্সাল চলছে।
বিয়ের বছর খানেক পর মন্দিরা বলল, গোপালদা, এবার আপনি বিয়ে করুন।’
গোপালবাবু বললেন, ‘কেন? তোমার সমস্যা কী বাপু। নিজেরা বিপদে পড়ে এখন আমাকে ফেলতে চাইছ?’
মন্দিরা হেসে বলল, ‘বা:, বয়েস হয়ে যাচ্ছে না। বিয়ে না করলে চলবে?’
গোপালবাবুও হেসে বললেন, ‘বেশ তো চলছে। খুব ভালো চলছে। স্বাধীন, ফুরফুরে। রোজগার করছি, খাচ্ছিদাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি।’
মন্দিরার গায়ের রং কালোর দিকে হলেও একধরনের সৌন্দর্য আছে। চোখা সৌন্দর্য। চোখেমুখে বুদ্ধির ভাব। শুধু ভাব নয়, গোপালবাবুর বিশ্বাস মেয়েটার সত্যি বুদ্ধি আছে। রূপবতী থেকে বুদ্ধিমতী মেয়ে তার সবসময়েই বেশি পছন্দ। এই কারণে গোড়া থেকেই তিনি বন্ধুর পত্নীকে বেশি নম্বর দেন। মন্দিরা চোখ কপালে তুলে, নাটকীয় গলায় বলল, ‘এটা কি চলা হল নাকি? হোটেলে তেল, ঝাল-মশলার খাবার খাচ্ছেন, যখন খুশি বাড়ি যাচ্ছেন। অসুখ-বিসুখ করলে দেখার লোক পর্যন্ত নেই। ভগবান না করুন, যদি সেরকম কিছু হয় কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন?’
গোপালবাবু হেসে বললেন, ‘কবে অসুখ করবে তার জন্য এখন থেকে বিয়ে করে বসে থাকতে হবে? অসুখ সামলাতে মানুষ ইনসিওরেন্স করে শুনেছি। হেলথ ইনসিওরেন্স। বিয়ে করে বলে তো শুনিনি।’
‘ঠাট্টা করবেন না গোপালদা। বিয়েটা সত্যি করে নিন। আপনার জন্য না করলে অন্তত আমার জন্য করুন।’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আমি বিয়ে করব! কথাটার মানে কী! তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি!’
মন্দিরা গোপালবাবুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিল। বলল, ‘আমার একজন সঙ্গী দরকার। আপনার বিয়ে হলে আপনার গিন্নি আমার সঙ্গী হবে। তার সঙ্গে গল্প করব, শপিং করব, সিনেমায় যাব। সারাদিন একা থাকি। আপনার বন্ধু তো মাসের আদ্দেক দিন বাইরে বাইরে ঘোরে।’
গোপালবাবু খুব একচোট হাসলেন। বললেন, ‘ও এই কথা। সেটা আগে বলবে তো। আসলে ভবেশ বিজনেসের জন্য ট্যুরে যায় বলে তোমার প্রবলেম হচ্ছে। ইউ ফিল লোনলি। আজই আমি ওকে বলব, এবার থেকে তুই অফিসে থাকবি, বাইরের কাজ আমি করব। বিয়ে করা থেকে বাইরে ঘুরে কাজ করা অনেক সহজ। ভবেশকে দেখে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’
কথাটা বলে আবার এক চোট হাসলেন গোপালবাবু।
মন্দিরা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দেখুন যদি পারেন। মনে হয় না পারবেন।’
মন্দিরাই ঠিক বলেছে। গোপালবাবু বন্ধুকে রাজি করাতে পারলেন না। ভবেশ পোড়েল হাত-পা ছুড়ে বললেন, ‘খেপেছিস! ওসব ঘরে বসা কাজে আমি নেই। তাহলে রইল তোর বিজনেস, আমি চললাম।’
গোপালবাবু বললেন, ‘আহা, তুই মন্দিরার কথাটা তো একবার ভেবে দেখবি। বেচারির একা লাগে।’
ভবেশ পোড়েল তেড়ে ফুঁড়ে বললেন, ‘এ আর কেমন কথা। বিয়ের আগে জানত না, আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। ওটাই আমার কাজ। ওর কথা বাদ দে তো। অনেকদিন পরে বিজনেস খানিকটা স্পিড পেয়েছে। কোম্পানির নামডাক হয়েছে। এখন যত অর্ডার ধরে আনতে পারব তত লাভ। ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলার সময় নয়।’
গোপালবাবু বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘তবু, মেয়েটার কথা তো একটু ভাববি।’
গোপালবাবুকে থামিয়ে দিয়ে ভবেশ পোড়েল বললেন, ‘ওসব ফালতু ভাবনা নিয়ে তুই বসে থাক। মন্দিরার একা লাগলে তুই সামলাবি। আমাকে টানবি না। আমাকে মন দিয়ে কাজ করতে দে।’
‘তুই অকারণে উত্তেজিত হচ্ছিস। ব্যবসা তো আমিও করছি। মন দিয়েই করছি।’
ভবেশ পোড়েল হাত ছুঁড়ে বললেন, ‘বলছি, তোর বিষয় তুই বোঝ। আমাকে জড়াবি না।’
গোপালবাবু নিজের ‘বিষয়’ নিজে বুঝলেন। শুধু গোপালবাবু নন, মন্দিরাও বুঝল। ভবেশ পোড়েল ট্যুরে গেলে গোপালবাবু মাঝেমধ্যে ‘একা মন্দিরা’র কাছে চলে আসেন। গল্প করেন। ডিভিডি চালিয়ে সিনেমা দেখেন। উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা। পথে হল দেরি, শেষ রক্ষা, শাপমোচন। মন্দিরা এটা-সেটা করে এনে গোপালবাবুর পাশে রাখে। গরম গরম বেগুনি, মাছের ডিমের বড়া, গাজরের হালুয়া। গোপালবাবু বলেন, ‘মন্দিরা তুমিও এসো না। আমার সঙ্গে সিনেমা দেখবে।’
মন্দিরা হেসে বলে, ‘দাঁড়ান আসছি।’
মন্দিরা ফিরে আসে। হাতে তোয়ালে সাবান। বলে ‘যান আগে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসুন তো। অফিস করে এসেছেন। মাগো! গায়ে বিটকেল গন্ধ।’
গোপালবাবু গদগদ গলায় বলেন, ‘স্নান করলে ভালো হত।’
মন্দিরা স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘ওমা করুন না। কে বারণ করেছে? আমাদের জলের কোনও প্রবলেম নেই। আপনি বরং এক কাজ করুন গোপালদা, আপনার বন্ধুর একটা লুঙ্গি নিয়ে যান। স্নান সেরে পরে নেবেন। হ্যাঙার দিচ্ছি নিজের প্যান্ট-শার্টটা ঝুলিয়ে রাখুন। বেরোবার সময় চেঞ্জ করে নেবেন। আর শুনুন মশাই, স্নানের পর একটু পাউডার ব্যবহার করতে শিখুন দেখি। বিয়ে করেননি বলে পাউডারও দূরে সরিয়ে রাখবেন নাকি?’
মন্দিরা হি-হি করে হাসে। গোপালবাবুর ভালোই লাগে। স্নান সেরে, পাউডার মেখে তিনি বন্ধু ভবেশ পোড়েলের লুঙ্গি পরে সিনেমা দেখতে বসেন। মন্দিরা পাশে এসে বসে। নাক টেনে বলে, ‘আ:, কী সুন্দর।’
গোপালবাবু হেসে বলেন, ‘আমি নই, সুন্দর তোমার সাবান, পাউডার মন্দিরা।’
মন্দিরা হাসতে হাসতে গোপালবাবুর গায়ে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। কিন্তু পড়ে না। কাঁধ, বুক, পেট, থাইয়ের ছোঁয়া লাগে। একটু নরম নরম, একটু পাপ পাপ, একটু শিরশিরানি। গোপালবাবু ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন। নারী শরীর বুঝি এরকম! তিনি সরে বসবেন ভাবেন। সরেন না। ঠিক করেন, পরেরদিন হাসির কোনও সিনেমা আনবেন। মন্দিরা আবার হাসতে হাসতে গায়ে পড়বে।
এই যে বউকে বন্ধুর হাতে রেখে ঘন ঘন বাইরে চলে যাওয়া এটাও কি ভবেশ পোড়েল এক ধরনের বিশ্বাস থেকে করে না? অবশ্যই করে। গোপালবাবু জানেন। এর জন্য মাঝেমধ্যে বন্ধুর ওপর তার রাগও হয়। তিনি মনে করেন, একে বলে গাধার বিশ্বাস।
নিতাই বলল, ‘কী হল? বললেন না, আপনার বন্ধু আপনাকে বিশ্বাস করে?’
গোপালবাবু মুখ নামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, করে। খুবই করে। ভবেশকে কেন সরাতে চাইছি আপনি কী জানতে চান নিতাইবাবু?’
নিতাই মুখ দিয়ে চুকচুক ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘না। তাতে কাজের কোনও হেরফের হয় না। কারণ হাজারটা হতে পারে, কাজ একটাই। ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুর বউকে নিয়ে ভাগতে চান সেই কারণে বন্ধুকে শেষ করতে চাইছেন। অথবা ব্যবসা থেকে দীর্ঘদিন টাকা সরিয়ে এখন ভয় পেয়ে গেছেন। বুঝতে পারছেন এবার পার্টনারকে ছিক করতে না পারলে বিপদ। সে ধরে ফেলবে।’
কথাটা বলার সময় গলার কাছে হাত তুলে গলা কাটার ভঙ্গি করল নিতাই। তারপর আবার শুরু করল।
‘কিছু মনে করবেন না গোপালবাবু। কিছু না জেনে, দুটো কারণ বানিয়ে বললাম। এরকম আরও হাজারটা কারণ বলতে পারি। একে পুলিশের ভাষায় বলে মোটিফ। কজ অব ক্রাইম। আমাদের কজ জেনে লাভ নেই। কারণ বানানো হোক, কল্পনা হোক, সত্যি হোক, কাজের কোনও তফাত হবে না। গুলি চালালে গুলি, ছুরি চালালে ছুরি। সুতরাং আমরা কখনোই কারণ জানতে চাই না।’
গোপালবাবুর চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তার বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। নিতাই কারণ জানল কী করে! মনের কথা পড়তে পারে নাকি লোকটা? হয়তো পারে। এরা ভক্ত মানুষ। ধম্মকম্ম করে। কতরকম ক্ষমতা আছে কে জানে। একটা নয়, নিতাই যে দু-দুটো কারণ বলল, দুটোই ঠিক! তবে মন্দিরাকে নিয়ে পালানোর কোনও পরিকল্পনা নেই। রয়ে সয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনার কথা মন্দিরা কিছু জানে না। তাকে বলাও হয়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর বছরখানেক শোকের মধ্যে থাকুক। তারপর ঝোপ বুঝে বললেই চলবে। তাড়াহুড়ো করলে মন্দিরা সন্দেহ করবে। তবে ঘটনার কয়েকমাস পরই ওকে ব্যবসায় পার্টনার করে নেওয়ার কথা ভাবা হয়ে গেছে। ভবেশ পোড়েলের জায়গায়। সহানুভূতি পার্টনার। বাইরের লোক খুশি হবে। বলবে, মানুষটা বন্ধুকে সত্যি ভালোবাসত। চিন্তা একটাই। মন্দিরা বিজনেসের কাজ কতটা পারবে? কেনই বা পারবে না? মেয়েরা আজকাল সব পারে। তাছাড়া মন্দিরা বুদ্ধিমতী। তার সবকাজেই ইন্টারেস্ট আছে। ব্যবসাতেও আছে। ইতিমধ্যে একটু-আধটু জানতে শুরু করেছে। লাভ কত? লোকসান কত? এই সব।
গোপালবাবু একদিন জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যবসার লাভ-লোকসানের খবর নিয়ে তোমার লাভ কী মন্দিরা?’
মন্দিরা দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে। তার আড়মোড়া ভাঙা নিয়ে গোপালবাবুর আগে কখনও মাথা ব্যথা ছিল না গোপালবাবুর। আড়মোড়া ভাঙা কোনও মাথাব্যথার জিনিস নয়। কেন জানি ইদানিং হয়েছে। মন্দিরা দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলেই আড়চোখে দেখতে ইচ্ছে করে।
মন্দিরা বলল, ‘বা:, সতীন কেমন জানব না?’
গোপালবাবু বোকার মতো হেসে বললেন, ‘সতীন! সতীনটা আবার কে?’
‘আপনাদের ওই পোড়ার ছাই ব্যবসাই তো আমার সতীন। যার জন্য স্বামী হারিয়ে বসে আছি।’
এই কথায় গোপালবাবু মজা পেয়েছিলেন।
নিতাই বলল, ‘নিন চা খান।’ গোপালবাবু চায়ের কাপ হাতে নিলেন, কিন্তু মুখে দিলেন না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে নিতাই বলল, ‘এই কাজের খরচখরচা সম্পর্কে কিছু জানা আছে আপনার? কোনও আইডিয়া?’
গোপালবাবু দুপাশে আলতো মাথা নাড়লেন। নিতাই বলল, ‘তা তো ঠিকই। আইডিয়া হবে কী করে। এ তো কাগজে, টিভিতে বিজ্ঞাপন হয় না। যাক ওসব কথা। আপনি জানাশোনা ধরে আমার কাছে এসেছেন। সাধারণ জানাশোনা নয়। হাই লেভেল জানাশোনা। আগেই খরচাপাতির কথা আপনার জেনে রাখা ভালো। দেখুন গোপালবাবু, এই সব কেসে খরচ অনেক। যারা বলে আজকাল কম পয়সাতেই মানুষ মারা যায় তারা ফালতু কথা বলে। ঠাকুরের কৃপায় সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল তো ঠিক আছে, গোলমাল কিছু হলে কিন্তু খরচ ডবল।’
গোপালবাবু বললেন, ‘গোলমাল মানে?’
নিতাই চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে বলল, ‘ধরুন, শিকারি ধরা পড়ে গেল। তখন পুলিশ কান টানতে টানতে মাথা পর্যন্ত যাবে। একসময় আপনাকে ধরেও ফেলবে। সেই মামলা আপনাকে লড়তে হবে। তার জন্য টাকা আলাদা করে রাখতে হবে। আপনি তো তখন বলতে পারবেন না, নিতাইবাবু আমাকে আগে বলেনি, আমিও টাকা সরিয়ে রাখিনি। এখন আমার টাকা নেই, আমি মামলা লড়তে পারব না। আমি জেলে পচে মরব। কি পারবেন বলতে?’
গোপালবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ভয় দেখাচ্ছেন?’
নিতাই বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে কী করতে বলছেন।’
এবার চায়ের কাপের চুমুক দিলেন গোপালবাবু। চা ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। সেই জলই গোপালবাবু খেতে লাগলেন ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে। যেন খুব গরম।
নিতাই স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কাজটা নিজে করুন।’
হাত কেঁপে উঠল গোপালবাবুর। চা চলকে পড়ল টেবিলে। বললেন, ‘নিজে করব!’
নিতাই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, নিজে করবেন। শিকার বিশ্বাস করলে এবং বোকা হলে কাজ অনেক সহজ। জলের মতো। খরচও বেঁচে যাবে। সবথেকে বড় কথা কী জানেন গোপালবাবু?’
‘কী?’
নিতাই সামান্য হেসে বলল, ‘নিজে কাজ করলে ধরা পড়বার রিস্ক কমে যায়। মাঝখানে কান থাকে না। টান দিয়ে মাথা পাওয়া যাবে না। তদন্তে নেমে পুলিশ জলে পড়ে। একজনও সঙ্গে না থাকলে সবথেকে ভালো। আপনি হাই লেভেলের চেনাজানা ধরে আমার কাছে এসেছেন। তাই এত কথা বলছি। ছোট লেভেলে চেনাজানা হলে বলতাম না। নিজের ব্যবসা নষ্ট করতাম না। দেখুন, দুদিন ভাবনাচিন্তা করুন। যদি না পারেন, যদি সাহসে না কুলোয় আবার আমার কাছে আসবেন। আমি তো রইলাম। আর হ্যাঁ, আসার আগে নতুন কোডটা জেনে আসবেন। মাপ করবেন, আজ আমায় উঠতে হবে। আমার নামগানের সময় হয়ে গেল।’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আবার কোড লাগবে কেন? আমার মুখ তো চিনে রাখলেন।’
নিতাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাসল। বলল, ‘মুখ এক থাকে, কিন্তু মানুষটা বদলে যায়। সেই কারণে কোড লাগবে।’
দুদিন নয়, গোপালবাবু একদিন ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলেন, কাজ তিনি নিজে করবেন। কিন্তু কীভাবে? গুলি করে মারবেন? কোথায় নিয়ে গিয়ে গুলি করবেন? ময়দানে? দূর এসব নাটক, সিনেমায় হয়। আচ্ছা, মন্দিরাকে কাজে লাগালে কেমন হয়? ধরা যাক বিষের ব্যবস্থা করা হল। ভবেশের খাবারে মন্দিরা মিশিয়ে দেবে। না, এটাও গোলমালের। মন্দিরা সাক্ষী থেকে যাবে। তাছাড়া কথাটা মন্দিরা কীভাবে নেবে কে জানে। ‘গোপালদা’র সঙ্গে ফাঁকা বাড়িতে হালকা-পলকা ঘনিষ্ঠতা আছে ঠিকই, কিন্তু ‘গোপালদা’ যে তার স্বামীকে সরিয়ে তাকে বিয়ে করে সংসার পাতবে এখবর তার জানা নেই। জানার পর যদি বেঁকে বসে। যদি স্বামীকে বলে দেয়? থাক, মন্দিরা বাদ। তাহলে কীভাবে?
‘কীভাবে’ নিয়ে বেশি ভাবতে হল না গোপালবাবুকে। ভবেশ পোড়েল নিজেই পথ করে দিলেন। এক বিকেলে অফিসে বসে বললেন, ‘গোপাল, এবার পাটনার ট্যুরটায় তুই আমার সঙ্গে যাবি।’
গোপালবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি ট্যুরে যাব! কেন?’
ভবেশ পোড়েল বললেন, ‘আমাদের যে অর্ডার দেয়, তার সঙ্গে আলাপ করবি। ফেরার সময় রাঁচি হয়ে আসব। সেখানেও আলাপ করিয়ে দেব।’
গোপালবাবু বললেন, ‘আমি আলাপ করে কী করব?’
‘শুধু পাটনার কম্পানি নয়, এক এক করে সবার সঙ্গেই তোর পরিচয় করিয়ে দেব। শিলিগুড়ি, আসানসোল, গুয়াহাটি।’
গোপালবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো ভবেশ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
ভবেশ পোড়েল হেসে বললেন, ‘দুম করে যদি মরে যাই তখন কী হবে? কীভাবে ব্যবসা চলবে? তার আগেই তোর সঙ্গে পার্টিদের আলাপ করিয়ে দিতে চাইছি।’
গোপালবাবু চমকে উঠলেন। ভবেশ মরার কথা বলছে কেন! কিছু বুঝতে পেরেছে? নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘ছি:, এসব কী কথা। খামোকা মরবি কেন?’
ভবেশ পোড়েল আরও জোরে হাসলেন। বললেন, ‘বা:, দুম করে মরতে পারি না? হার্ট অ্যাটাক কী আর বলে কয়ে হয়? তারপর ধর যদি অ্যাক্সিডেন্ট ট্যাক্সিডেন্ট কিছু ঘটে। সবসময়ই তো ট্রেনে যাতায়াত করছি। কতদিন মাঝরাতে গার্ডকে ম্যানেজ করে লুকিয়ে লুকিয়ে চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে সিগারেট টানি। হঠাৎ যদি পড়ে যাই। হা হা…।’
গোপালবাবু শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি মাথা নামালেন। তার কি ভেতরে ভেতরে ঘাম হচ্ছে? চলন্ত ট্রেন থেকে পড়া…সত্যি যদি এমন ঘটে… যদি ফেলে দেওয়া হয়…সবাই বলবে অ্যাক্সিডেন্ট…। মন্দিরা কী বলবে?
ভবেশ পোড়েল এগিয়ে এসে বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, ‘ঘাবড়ে গেলি নাকি?’
গোপালবাবু ঢোঁক গিলে বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কী আজেবাজে বকছিস ভবেশ! মন্দিরা যদি শোনে?’
ভবেশ পোড়েল হেসে বললেন, ‘মন্দিরার জন্যই তো ভাবছি। ভাবছি, এবার ক’টাদিন ট্যুর থেকে সরে অফিসে বসে কাজ করব। বাড়িতে মন্দিরাকে টাইম দেব। ঘোরাঘুরির কাজ তুই সামলাবি। তুই বলেছিলি না?’
গোপালবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। চওড়া হেসে বললেন, ‘এ তো খুব ভালো কথা। আগে থেকেই তোর করা উচিত ছিল। কিছুদিন বাইরের কাজ তুই অফ কর। আপাতত আমি করে দিচ্ছি পরে অন্য কাউকে শিখিয়ে নেওয়া যাবে। আমাদের বিজনেসের তো এখন একটা গুড উইল তৈরি হয়ে গেছে। পাটনার টিকিট কাট। প্লেনে যাবি? চল প্লেনে যাই। তাড়াতাড়ি হবে।’
ভবেশ পোড়েল নাক-মুখ কুঁচকে বলল, ‘না, না, প্লেন-ফ্লেন নয়, ট্রেনে যাব। এসি টু-টায়ারে দুজনে আড্ডা মারতে মারতে চলে যাব।’
দুই বন্ধুর ট্যুরের কথা শুনে মন্দিরা ঠোঁট ফোলাল। গোপালবাবুর সামনেই আবদার ধরল, ‘আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।’
ভবেশ পোড়েল রেগে গিয়ে বললেন, ‘পাগলামি কোরো না মন্দিরা। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি না। কাজ করব।’
মন্দিরা বলল, ‘তোমরা কাজ করবে, আমি বেড়াব।’
ভবেশ পোড়েল আরও রেগে গেলেন। বললেন, ‘বোকার মতো কথা বলছ কেন? পাটনা শহর বেড়ানোর মতো কিছু জায়গা নয়। আমরা আগ্রা যাচ্ছি না যে তুমি তাজমহলের সামনে গিয়ে বসে থাকবে।’
গোপালবাবু বানিয়ে হাসলেন। বললেন, ‘আমরা তো দু-তিনদিনের মধ্যে চলে আসছি মন্দিরা। তাছাড়া এরপর থেকে তুমি তোমার পতিঠাকুরকে সবসময় পাশে পাবে। আমরা তার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি। উনি আমাকে কাজ বুঝিয়ে দেবেন। আগে যখন বলেছিলাম তখন শোনেনি। এখন বউয়ের জন্য মন কেমন করছে।’
গোপালবাবু বোকা বোকা রসিকতা করে হাসলেন। মন্দিরা গজগজ করতে লাগল। এই রসিকতা তার পছন্দ হয়নি।
রাত একটা বেজে দশ মিনিট। দশ না, বারো মিনিট। ট্রেন ছুটছে। ছুটছে দিগবিদিগ জ্ঞান হারিয়ে। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজার সামনে। দুজনের হাতেই সিগারেট। হাওয়া ঢুকছে ঝড়ের মতো। কাচের ঘেরাটোপের ওপাশে এসি কোচের যাত্রীরা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। এমনকি কম্পার্টমেন্টের গার্ড পর্যন্ত। ফলে তাকে আর আলাদা করে ম্যানেজ করতে হয়নি। ভবেশ পোড়েলের পাঞ্জাবি উড়ছে।
‘মনে আছে গোপাল, কলেজ জীবনে কেমন লোকাল ট্রেনে দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতাম?’
গোপালবাবু অন্যমনস্ক। বললেন, ‘মনে আছে। তখন এত রেসট্রিকশন ছিল না। এখন কত নিয়মকানুন।’
ভবেশ পোড়েল এক হাত দিয়ে দরজা ধরে আছেন। মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। অন্ধকারের দিকে। ট্রেনের সঙ্গে তার শরীরটা হালকা দুলছে। সিগারেট ধরা হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করতে করতে বললেন, ‘রাখ তোর রেসট্রিকশন, মাঝরাতে ট্রেনের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার মতো আরাম আর কিছুতে নেই। আমি তো প্রতিবারই নিয়ম ভাঙি। একবার দু-হাজার টাকা ফাইন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। ট্যুর বন্ধ করলে এই একটা দু:খ থাকবে।’ একটু থামলেন ভবেশ, ফের গলার স্বর বদলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে বললেন, ‘গোপাল, এইবার একটা ব্রিজ আসবে… দেখবি হাওয়াটা ঝট করে কেমন ঠান্ডা হয়ে যাবে…। নদীর হাওয়া তো। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা কর। শেষ টান দিয়ে ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দেব…।’
ঠিকই। দু-মিনিটের মধ্যে ঝোড়ো বাতাস ঠান্ডা করে নদীর ওপর ট্রেন উঠে পড়ল। লোহা ইস্পাতের গমগম আওয়াজ ভেঙে ছুটতে লাগল স্পিড কমিয়ে। অন্ধকারে একটার পর একটা বিম সরে যাচ্ছে নকশার মতো। গোপালবাবু মনকে শক্ত করলেন। মনে মনে দ্রুত হিসেব কষে নিলেন। একটা বিমের পর অন্যটা আসছে সেকেন্ডেরও কম ব্যবধানে। এর অর্থ, একটা বিম লক্ষ্য করে কাজটা করতে হবে। তবেই পরেরটায় গিয়ে ধাক্কা লাগবে। ভালো হয় সরাসরি মাথাটা লাগলে। মুখ থেঁতলানো, ছিন্নভিন্ন বডি উদ্ধারের পরও চেনা যাবে না। বেশিরভাগ সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে চালান হয়ে যায়। এই দেশে ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা রোজ বিশটা করে ঘটছে। তার বেশিও হতে পারে। কেউ খবর রাখে না। এখানে অবশ্য খবর রাখতে হবে। মন্দিরাকে এনে রেল পুলিশের মর্গে বডি আইডেনটিফাই করতে হবে। সরকারি খাতায় মৃত ঘোষণা না হলে পরে বিয়েতে ফ্যাকড়া হবে।
সিগারেটে শেষ অংশ ঘন ঘন টান দিতে লাগলেন গোপালবাবু। কাজ হয়ে গেলে কি মন্দিরাকে একটা ফোন করা যাবে?
‘মন্দিরা, আমি গোপালদা বলছি। ঘুমোচ্ছিলে? শোনো একটা খারাপ খবর আছে। মন শক্ত করো…খানিক আগে চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে ভবেশ সিগারেট খাচ্ছিল…ও নাকি প্রায়ই এই ছেলেমানুষিটা করত…মন শক্ত করো মন্দিরা…আমি তো আছি…।’
ভবেশ পোড়েল খোলা দরজার দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন, ‘ওই যে নদী, দেখ দেখ, ওই যে…।’
এক হাতে দরজার শিক ধরে এক পা এগোলেন গোপালবাবু।
আওয়াজ হল। ভারী কোনও জিনিস ছিটকে পড়লে যেমন হয়। তবে ব্রিজের গমগম আওয়াজের তলায় সেই চাপা আওয়াজ চাপাও পড়ল খুব সহজে।
শান্ত ভাবে লোহার ভারী দরজাটা আটকালেন ভবেশ পোড়েল। লক তুললেন। ছিটকিনি লাগালেন। রুমাল বের করে হাত মুছলেন। তারপর মোবাইলের নম্বর টিপলেন।
‘হ্যালো, মন্দিরা? ঘুমিয়ে পড়নি তো? হ্যাঁ, কাজ হয়ে গেছে।’