চাঁদ পড়ে আছে
আমি কেন বাইরে যাচ্ছি?
মানুষ বাইরে যায় দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ কাজ, দু-নম্বর কারণ বেড়ানো। আমি যাচ্ছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমার বাইরে যাওয়ার কারণ হল ‘যাতে ভুলে না যাই’। ‘যাতে ভুলে না যাই’ কারণে বাইরে যাওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে সম্ভবত এই প্রথম ঘটতে চলেছে। অবশ্য এই তথ্যে অবশ্য আমার কিছু আসে যায় না। প্রথম, দ্বিতীয় বা দশমে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। প্রথম পর্বতশৃঙ্গ জয়ী বা দ্বিতীয় সমুদ্র অভিযাত্রী ধরনের কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডস’-এ নাম তোলবার বাসনা আমার নেই। খবরের কাগজে ছবি ছাপানো বা টিভিতে ইন্টারভিউও দেওয়ার মধ্যে থাকতে চাই না। এই ধরনের টিভি ইন্টারভিউগুলো যেমন হাস্যকর, তেমন ভয়ংকর। কে জানে, আমার কল্পিত ইন্টারভিউ হয়তো এরকম হত—
টিভির সাংবাদিক : নমস্কার সাগরবাবু। সংক্ষেপে যদি আপনার পরিচয় দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন বাধিত হব।
আমি : কী পরিচয়?
সাংবাদিক : আপনি কী করেন? কোথায় থাকেন? আপনার হবি কী? জীবনের লক্ষ্যই বা কী?
আমি : আমার নাম সাগর। আমি একজন বেকার যুবক। স্বেচ্ছা নির্বাসনের মতো স্বেচ্ছাবেকার হয়ে আছি। চাকরি পেলেও করি না। টাকাপয়সার খুবই টানাটানি। তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। যাদের প্রচুর টাকাপয়সা তাদেরও দেখেছি সুখে নেই। খামোকা আমি মরতে কেন মাথা ঘামাব? টিউশন এবং প্রুফ দেখে কিছু অর্থ উপার্জন করি। বাকিটা চলি ধারে। থাকি একা। এক কামরার ঘরে। তিনমাসের ভাড়া বাকি আছে। বাকি না বলে ধারে থাকি বলা ভালো। আমার হবি অলস ভাবে শুয়ে এবং বসে থাকা। আমার লক্ষ্য বাকি জীবনটা যেন বেকারভাবে কাটাতে পারি।
সাংবাদিক (গদগদ ভঙ্গিতে) : খুবই সুন্দর। সাগরবাবু, আপনার অনুভূতি কেমন হচ্ছে?
আমি : কীসের অনুভূতি?
সাংবাদিক : এই যে ‘যাতে ভুলে না যাই’ কারণে আপনি বাইরে ঘুরে এলেন তার অনুভূতি।
আমি (উৎসাহ নিয়ে) : ভীষণ ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। এই দেখুন, আনন্দে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার বড়মামার কথা খুব মনে পড়ছে।
সাংবাদিক (অতি উৎসাহ নিয়ে) : বড়মামা! কেন বড়মামা কী আপনাকে এই কাজে উৎসাহ দিতেন? নাকি উনিও ‘যাতে ভুলে না যাই কারণে’ বাইরে গিয়েছিলেন? তিনিই কি আপনার অনুপ্রেরণা?
আমি : না, না, সেসব কিছু নয়। আসলে ইন্টারভিউতে দেখেছি কারও নাম করতে হয়। বড় বড় মানুষরা করে। পিতা-মাতা, শিক্ষক। কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও করেন। একবার টিভির এক রান্নার অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, বিশিষ্ট সিনেমা স্টার মধুমালিকা বারবার রবীন্দ্রনাথের নাম করছিলেন আর রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছছিলেন। ওর নাকি খাবার দেখলেই রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। এই মুহূর্তে দুম করে আমার কাউকে মনে পড়ছে না, তাই বড়মামার কথা বললাম। সত্যি কথা বলতে কী বড়মামা তো দূরের কথা, আমার কোনও মামা-ই নেই।
এই ধরনের ইন্টারভিউ কল্পনাতে যদি ভয়ংকর হয়, তাহলে সত্যিতে ডবল ভয়ংকর। এসবের মধ্যে আমি নেই। আমি বাইরে যেতে পারলেই খুশি। তবে আসল সমস্যা অবশ্য ইন্টারভিউ নয়, আসল সমস্যা অন্য। ‘যাতে ভুলে না যাই’ বিষয়টা কি কাউকে বোঝানো যাবে? মনে হয় না। যদিও সবাইকে বোঝানোর দরকার নেই। দুজনকে বোঝাতে পারলেই আমার কাজ মিটে যাবে। একজন তমাল এবং অন্যজন বিধুরা মিত্র।
তমাল আমার বন্ধু। সমানে সমানে থাকার মিথ্যে বন্ধু নয়, সমানে অসমানে থাকার সত্যি বন্ধু। তমাল বড় চাকরি করে। মোটা বেতন পায়। আমি কাঠ বেকার। তমাল উদ্যোগী। আমি অলস। তমাল কর্মঠ। আমি অকর্মণ্য। তমাল কেরিয়ারের জন্য পরিশ্রম করে। আমি পরিশ্রম করি যাতে কেরিয়ার করতে না হয়। তমাল আমার কাজকর্মের জন্য খুবই চেষ্টা করে। তিনবার ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি তিনবারই কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। না, একবার পালাইনি। আমার এক কামরার ভাড়া বাড়ির বাইরে ফলস তালা লাগিয়ে, উলটো দিকের চায়ের দোকানে গা ঢাকা দিয়ে বসেছিলাম। তমাল সংসারী। আমি একা। আমার সঙ্গে দেখা হলেই তমাল ‘খ্যাক খ্যাক’ করে কথা বলে। ভাবটা এমন আজই সে আমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দিতে চায়। অকর্মণ্য, অলস, স্বেচ্ছাবেকার এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার জন্য সে লজ্জিত, অনুতপ্ত। এই সম্পর্ক এখনই ছিন্ন করতে হবে। সম্পর্ক ভাঙার জন্য তমাল আমাকে নানা ধরনের অপমানও করে। সবশেষে একটা মুখ বন্ধ খাম এগিয়ে দেয়। আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলি, ‘এতে কী আছে?’
তমাল তেড়ে ফুঁড়ে বলে, ‘তোর মতো গাধার সঙ্গে কেন আর মেশা উচিত নয়, ওয়ান, টু থ্রি করে তার পয়েন্ট লেখা আছে। খাম নিয়ে বিদায় হ। নইলে সিকিউরিটি ডেকে ঘাড় ধাক্কা দেব।’
খাম পকেট নিয়ে নিশ্চিন্ত মুখে আমি বিদায় হই। বাইরে এসেও খাম খুলি না। কারণ আমি জানি, খামে কী আছে। খামে আছে টাকা। আমার মুখ দেখেই সে আমার দুর্দশা টের পেয়েছে। খামে ভরে টাকা দিয়েছে। তমাল আমাকে টাকা দিয়ে আসলে একজন অলস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি জানি, সে শুধু আমাকে ভালোবাসে না, হিংসেও করে। মানবজীবনের এটাই রহস্য। খুব কেজো মানুষের ভিতর আর একটা হিংসুটে মানুষ বাস করে। সেই হিংসুটে লোক আমার মতো রামকুঁড়ে। মুখে যাই বলুক, কেজো মানুষ আসলে এই রামকুঁড়েকে ভালোবাসে।
এবার বিধুরা মিত্র। নাম ভারিক্কি। মনে হয়, মোটা চশমা আছে। কিন্তু এই মেয়ের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। চোখে চশমাও নেই। সম্পর্কে তমালের শালি হয়। পিসতুতো বা মাসতুতো। বেশি সুন্দরী এবং বেশি লেখাপড়া জানা। তমালের বিবাহবার্ষিকীতে একবার মাত্র দেখেছি। দেখেছি না বলে, শুনেছি বললেই ভালো হয়। আমার পাশে বসে খাচ্ছিল। আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে উলটো দিকে বসা এক মোটা মহিলার সঙ্গে বকবক করছিল একটানা। বকবকানির ফাঁকেই জানলাম, মধুপুর না দেওঘরে ওই মেয়ের অফিসের হলিডে হোম আছে। হলিডে হোম নাকি খুবই সুন্দর। সামনে বাগান। পিছনে শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের একপাশে বড় পাতকুয়ো। সন্ধের পর মাদুর পেতে সেখানে দারুণ আড্ডা দেওয়া যায়। জ্যোৎস্নায় উঠোন ভেসে যায়। দূরের পাহাড় থেকে ফুরফুরে বাতাস আসে। আমি তখন আধবোঁজা চোখে মাংসের হাড় চুষছিলাম। হাবিজাবি গল্প কানে ঢোকবার কথা নয়। তবু ঢুকল। তার কারণ হলিডে হোম। আধুনিকযুগের এক তরুণী আগ্রহ নিয়ে হলিডে হোমের উঠোন, বাগান, পাতকুয়ো, জ্যোৎস্না, জঙ্গলের বাতাস নিয়ে কথা কেন বলবে! সে বলবে হংকং, সিঙ্গাপুর, ইউরোপের কথা। দেশের মধ্যে কোথাও হলে সিকিম বলবে। না হলে ডুয়ার্স। এই মেয়ে যে আমাকে চমকে দিল!
আমি হাড় চিবোনো বন্ধ করে বিধুরার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ এই অবস্থা চলল। মেয়েটি বুঝতে পেরে আমার দিকে তাকায়। আমি আলতো হাসি। এই ধরনের হাসির একটাই অর্থ। ‘ওগো মেয়ে, তুমি কি জানো তুমি কত সুন্দর?’ এই হাসিতে মেয়েদের কুপোকাত হয়ে যাওয়া উচিত। বিধুরা আমার দিকে আগুন চোখে কটমট করে তাকায়। তারপর মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরে আমি তমালের কাছ থেকে মেয়েটির পরিচয় জানতে পারি। তবে ভুলেও যাই। হলিডে হোম, উঠোন, পাতকুয়ো ভালোবাসা একটি মেয়েকে দীর্ঘক্ষণ মনে রাখবার কোনও কারণ নেই।
প্রায় ছ’মাস পরে আবার মনে পড়েছে।
বিধুরা মিত্রকে আমার দরকার। সুতরাং আগে দরকার তমালকে। তমালকে ধরে সেই মেয়ের কাছে আমাকে পৌঁছোতে হবে। ডাইরেক্ট তমালকে দিয়ে কাজটা করা যায়। তাতে ঝুঁকি আছে। না হলে কেলেঙ্কারি।
তমাল আমাকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল, ‘সাগর, তোকে না অফিসে আসতে বারণ করেছি?’
আমি এই কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘তোর পিসতুতো শালি বিধুরার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েনমেন্ট করে দে।’
তমাল ভুরু কুঁচকে সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘কেন?’
‘মনে হচ্ছে, আমি ওর প্রেমে পড়েছি। আমার প্রেমের চামড়া গন্ডারের মতো, তাই এতদিন পরে বুঝতে পারলাম।’
তমাল চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘প্রেমে পড়েছিস মানে! ফাজলামি হচ্ছে?’
আমি বললাম, ‘কেন? ফাজলামি কেন হবে? আমি কি প্রেমে পড়তে পারি না? বেকার, অলস যুবকদের প্রেমে পড়ায় বারণ আছে? তুই জানিস বিপ্লবের আগে ফরাসি দেশে তরুণীদের মধ্যে অলস যুবকদের ডিমান্ড ছিল সবথেকে বেশি। তার মধ্যে আবার যারা ছিল বেকার তাদের নিয়ে সুন্দরীরা টানাটানি করত। তোর ওই শালি কি ফরাসিকন্যাদের থেকেও বেশি সুন্দরী?’
তমাল চাপা গলায় হুংকার দিয়ে উঠল, ‘চোপ। চোপ বলছি।’
‘অ্যাপয়েনমেন্ট করে দে তাহলে চুপ করব। নইলে ঠিকানা জোগাড় করে সটান ওই মেয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হব। বলব, তুমি রাজি না-হলে আমি সুইসাইড করব।’
তমাল দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করে বলল, ‘আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোর মতো একটা ফালতু ছেলের সঙ্গে অমন সুন্দর একটা মেয়ের অ্যাপয়েনমেন্ট করিয়ে দেব? তুই কি মদ, গাঁজা কিছু খেয়ে এসেছিস সাগর?’
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে মুচকি হাসলাম। বললাম, ‘খাইনি, কিন্তু এবার খাব। বিধুরা যদি আমাকে রিফিউজ করে তবে দেবদাসের মতো মদ খেতে শুরু করব।’
তমাল বলল, ‘এনাফ ইজ এনাফ। কী চাস সরাসরি বল। বিধুরাকে তোর কী জন্য দরকার?’
আমি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে নীচু গলায় ‘একটা উঠোন আর একটা কুয়ো চাই। আমি জানি তোর ওই শালির কাছে দুটো জিনিসই আছে।’
তমাল হতাশ গলায় বলল, ‘আবার ঠাট্টা? উঠোন আর পাতকুয়ো বিধুরার কাছে আছে! এর মানে কী সাগর?’
‘মানে জেনে তোর দরকার নেই। আমার আছে। শুধু এইটুক জেনে রাখ, আমি বাইরে যাব।’
তমাল আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘তুই বাইরে যাবি? বেড়াতে?’
আমি অন্যমনস্ক গলায় বললাম, ‘না, আমি বাইরে যাব অন্য কারণে। আমার এই ট্যুরের নাম হল যাতে ভুলে না যাই। নে ফোনটা তুলে বিধুরা মিত্রকে ফোন কর। চিন্তা করিস না, ময়দান, গঙ্গার ঘাট বা কফিশপে নয়। আমি ওই মেয়ের সঙ্গে তার অফিসেই দেখা করতে চাই। তার অফিসেই আমার কাজ। পনেরো মিনিটে হয়ে যাবে।’
বিধুরা মিত্র মুখ রাগি রাগি করে রেখেছে। সম্ভবত গোড়া থেকেই আমাকে বুঝিয়ে দিতে চায়, সে আমাকে পছন্দ করছে না। নেহাত তমাল অনুরোধ করেছে তাই…। সুন্দরী মেয়েরা ভাবে রাগি রাগি মুখ করে থাকলে পুরুষরা ভয় পাবে। সবসময় তাদের এই ধারণা ঠিক হয় না। অন্তত আমার বেলাতে তো নয়ই। আমি সুন্দরী রাগি মেয়ে দেখলে মজা পাই। হেসে বললাম, ‘কেমন আছ বিধুরা?’
মেয়েটির মুখ রাগের সঙ্গে এবার কঠিন হয়ে গেল। বলল, ‘কী চান?’
‘কেমন আছ বললে না?’
বিধুরা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোঁস ধরনের রাগি নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার কাছে এসেছেন কেন সেটা বলুন? কাম টু দ্য পয়েন্ট।’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তমালের বিবাহবার্ষিকীতে মটনের প্রিপারেশনটা তেমন জমেনি। ইলিশের পাতুরি বরং বেটার ছিল। আমি তো দুটো খেয়ে ফেললাম। তোমার কী মনে হয়?’
বিধুরা সম্ভবত সত্যিকারের রেগে গেল। সে হাতের ফাইল সরিয়ে রেখে বলল, ‘আমার কিছু মনে হয় না। অতদিন আগের কিছু আমি মনে রাখি না।’
আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ‘আমি মনে রাখি। যেমন তোমাকে রেখেছি।’
বিধুরার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সে মুহূর্তখানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। নিশ্চয় আমার স্পর্ধা দেখে থতমত খেয়ে গেছে। গলা চড়িয়ে বলল, ‘হোয়াট! আপনি কী বলতে চান? আমাকে মনে আছে মানে! মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। তমালদা ফোন করেছেন বলে আমি আপনাকে এখানে আসতে অ্যালাও করেছি। তার মানে এই নয় আপনি যা খুশি বলার অনুমতি পেয়ে গেছেন। সেদিন ওই বাড়িতে আমি আপনাকে খেয়াল করেছি। আমার দিকে বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে ছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, দিদি-জামাইবাবু কীভাবে এরকম একটা বাজে লোককে বাড়িতে অ্যালাউ করে! পরে তমালদার কাছে জেনেছি, আপনি একজন ভ্যাগাবন্ড, গুড ফর নাথিং লোক। যাক, সেসব কথা। কেন আমার কাছে এসেছেন বলুন। আর শুনুন, আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না। আমি এটা পছন্দ করছি না।’
আমি খুশি হলাম। মেয়েটি আমাকে মনে রেখেছে। কাজটা করতে সুবিধে হবে। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘বিধুরাদেবী, মধুপুরে আপনাদের অফিসের একটা হলিডে হোম আছে।’
‘বিধুরাদেবী’ ডাক শুনেও বিধুরা খুশি হল বলে মনে হল না। বিরক্ত গলায় বলল, ‘মধুপুর নয়, গিরিডিতে। কেন?’
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘গিরিডিতে হলেও সমস্যা নেই। সেই বাড়িতে উঠোন আর সেই উঠোনের পাশে একটা কুয়ো আছে কিনা সেটাই বড় কথা।’
বিধুরা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমি যাইনি, শুনেছি আছে। কেন? আপনি যাবেন? আপনার কুয়ো দরকার?’
আমি বললাম, ‘শুধু কুয়ো নয়, সঙ্গে একটা উঠোনও দরকার। বিধুরাদেবী, আপনি আমাকে দুদিনের জন্য হলিডে হোমে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিন।’
মেয়েটি আমার কথা শুনে এবার ঘাবড়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘কুয়ো, উঠোন! কী বলছেন এসব? কুয়ো খুঁজতে গিরিডি যাবেন! সাগরবাবু আপনি কি সুস্থ?’
এতক্ষণ পর আমি আবার হাসলাম। বললাম, ‘ঠিকই বলছি বিধুরাদেবী। আমার একই সঙ্গে কুয়ো এবং উঠোন দরকার। সেই সঙ্গে লাগবে একটা পূর্ণিমা। ফুলমুন। কুয়ো-উঠোন দেবেন আপনি, ক্যালেন্ডার থেকে আমি পূর্ণিমা দেখে নেব।’
‘মানে!’ বিধুরার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
‘আমি অনেক খোঁজ করেছি। ইনফ্যাক্ট গত একমাস ধরেই খুঁজছি। উঠোন এবং কুয়োর সন্ধানে অতদূর না গেলেও হত…খরচের ব্যাপারও তো আছে। কিন্তু হল না। কুয়ো পাই তো, কাছাকাছি উঠোন জোটে না। উঠোন পাই তো কুয়ো নেই। ভবানীপুরের একটা পুরোনো বাড়িতে দুটোই পেলাম। কিন্তু আশপাশের ফ্ল্যাটবাড়ির দাপটে সেখানে চাঁদের টিকি দেখা যায় না। বিধুরাদেবী, তখন আপনাকে মনে পড়ল।’
বিধুরা পুরোপুরি ঘাবড়ে গেছে। ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে!’
এটাই আমি চাইছিলাম। ঘাবড়ে যাওয়া মানুষের কাছে আবদার করতে সুবিধে। আমি মুচকি হাসলাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনাকে। তমালের বাড়িতে আপনি হলিডে হোমের গল্প বলছিলেন। আপনার মনে পড়ে? বাগান, বড় উঠোন, পাতকুয়ো, জ্যোৎস্না। পূর্ণিমা দেখে চলে গেলেই হবে। তাই তো? মনে হল, আমি ফালতু জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি কেন? আপনাকে ধরতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে। আপনি কি অফিস থেকে দুদিনের জন্য ওই হলিডে হোমের ব্যবস্থা করে দেবেন?’
কথা শেষ করে আমি বোকার মতো হাসলাম। বিধুরা শান্ত গলায় বলল, ‘আপনি বেড়াতে যাবেন?’
‘না, বেড়াতে নয়। যাতে ভুলে না যাই তাই যাব।’
বিধুরা ভাসা ভাসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ভুলে না যান?’
আমি একটু চুপ করে থাকলাম। তারপর মাথা নামিয়ে নীচু গলায় বললাম, ‘শুনলে আপনি হাসবেন।’
‘তবু বলুন। যদি অবশ্য আপত্তি না থাকে।’
বিধুরার গলা বলে দিচ্ছে, সে আমার কন্ট্রোলে চলে আসছে। এটাই মজা। চেষ্টা করলে রাগি মানুষকে কন্ট্রোলে আনা যায়, শান্ত মানুষকে আনা যায় না। আমি চাপা গলায় বললাম, ‘একটা কবিতা। একটা কবিতা যাতে ভুলে না যাই তাই ওখানে যাব। ভাগ্যিস তমালের বাড়িতে সেদিন আপনি জায়গাটার গল্প করছিলেন। আপনার মতো বয়েসের মেয়ের মুখে উঠোন, পাতকুয়োর গল্প শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।’
বিধুরার চোখেমুখে মুগ্ধতা। খানিকটা ঘোরের মধ্যে থেকে বলল, ‘কোন কবিতা? কার লেখা? আপনি কবিতা লেখেন?’
আমি ডান কানে হাত ছুঁয়ে বললাম, ‘ছি-ছি। আমি কী কবিতা লিখব! আমি লেখালিখি পারি না। আমি কিছুই পারি না। এই কবিতা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনও কবিতা কি আপনি পড়েছেন বিধুরাদেবী?’
বিধুরা সোজা হয়ে বসল। মাথা নীচু করে কম্পিউটারের মাউস নিয়ে অল্পক্ষণ নাড়াচাড়া করে মুখ তুলল। বলল, ‘আপনি আমাকে বিধুরাদেবী বলবেন না। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’
‘তাহলে কী বলব?’
বিধুরা নিমেষের জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ফের মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আপনি…আপনি ইচ্ছে করলে আমার নাম ধরে এবং তুমি সম্বোধনে কথা বলতে পারেন।’
যাক, হলিডে হোম আমি পাচ্ছি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘ধন্যবাদ।’
বিধুরা বলল, ‘কবিতাটি কী আমি জানতে পারি?’
আমি বিধুরার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘বিধুরা, তুমি যদি হলিডে হোমের ভাড়া কমিয়ে দাও আমার পক্ষে সুবিধে হয়। সেরকম হলে আমাকে ঘর দিতে হবে না। বারান্দা বা দারোয়ানের ঘরেও রাত কাটাতে পারি। তবে শনিবারই আমাকে যেতে হবে। সেদিন পূর্ণিমা।’
খুব অল্প টাকায় বিধুরা হলিডে হোমের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিল। কাগজ হাতে উঠবার সময় বললাম, ‘চলি।’
বিধুরা মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমি, দিদি আর তমালদাকে নিয়ে যদি ওখানে গিয়ে আপনার সঙ্গে জয়েন করি, আপনার আপত্তি আছে?’
আমি দুপাশে মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, আপত্তি নেই। তবে না গেলে খুশি হব। যাতে ভুলে না যাই ট্রিপটা আমি একাই করতে চাই।’
সত্যি চমৎকার হলিডে হোম। শহরের ভিড় থেকে দূরে। নির্জন, একা। এখন সন্ধে হব হব। ঝকঝকে শান বাঁধানো উঠোনে, কুয়োর পাশে, মাদুর পেতে শুয়ে আছি চিৎ হয়ে। অপেক্ষা করছি। একটু পরেই জ্যোৎস্না ভাসিয়ে চাঁদ উঠবে। সেই চাঁদের ছায়া দেখা যাবে কুয়োর টলটলে কালো জলে। মনে হবে, অনন্ত কুয়োর নিস্তরঙ্গ জলে চাঁদ এসে পড়েছে। তাকে চুমু খাচ্ছে উন্মাদের মতো। আর বিড়বিড় করে বলছে ‘ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে / অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে।’
আমি এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।