জানলা
আলু, কুমড়ো আর সজনে ডাঁটার সঙ্গে উমানাথবাবু আজ বাজারে এসে একটা জানলা কিনে ফেলেছেন।
ঘটনা বিশ্বাস করার মতো নয়। উমানাথবাবু নিজেও বিশ্বাস করছেন না। বাজার জানলা-দরজা কেনার জায়গা নয়, আলু-পটল কেনার জায়গা। মানুষ হয় দু-ধরনের। ‘ভাবিয়া’ ধরন এবং ‘না ভাবিয়া’ ধরন। উমানাথবাবু হলেন ‘ভাবিয়া’ ধরনের মানুষ। তিনি যা করেন ভাবনাচিন্তার পর করেন। যদিও নানা ধরনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘ভাবিয়া’ ধরনের মানুষের কাজে গোলমালের পরিমাণও সবথেকে বেশি হয়। কাজের কোয়ালিটিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নমানের। লোককে বলার মতো নয়। পশু, পাখি এবং প্রকৃতি কাজের আগে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করে না বলে তাদের ভুল কম। একথা প্রকাশ পেলে মানব সভ্যতায় গোলমাল হয়ে যেতে পারে বলে এই ধরনের সমীক্ষা রিপোর্ট সাধারণত গোপন রাখা হয়। তাই মানুষ বেশি ভাবে এবং ভুল করে। উমানাথবাবু ব্যতিক্রম নন। আজ যে তিনি আলু-কুমড়ো এবং সজনে ডাঁটা কিনেছেন তার পিছনেও ভাবনা আছে। গত তিনদিন ধরে তাকে ডাঁটা-চচ্চড়ি টানছিল। বয়স বাড়লে এরকম হয়। খাবার টানে। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো আইটেম। কখনও নিম বেগুন, কখনও বড়ি দিয়ে লাউ, কখনও ভাজা মুগের ডাল, কখনও ছোট মাছের টক। সেরকমই ডাঁটা-চচ্চড়ি টানছিল। তবে উমানাথবাবু দুম করে ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না।
উমানাথবাবু ‘হেড’ সমস্যা আছে। বাড়িতেও আছে, আবার অফিসেও আছে। সহজ করে বললে, দুটো জায়গাতেই তিনি ‘হেড’, কিন্তু হেডের ‘ফাংশন’ নেই। তিনি যে ফ্যামিলিতে থাকেন, তিনি সেই ফ্যামিলির ‘হেড’। যাকে বলে ‘হেড অব দ্য ফ্যামিলি’। আবার অফিসের যে দপ্তরের কাজ করেন তারও ‘হেড’। ডিপার্টমেন্টাল হেড। ফ্যামিলি চলার ব্যাপারে চাকরি করে টাকা আনা ছাড়া ‘হেড’ উমানাথবাবুর কোনও কাজ নেই। ফ্যামিলি চলে স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যার ইচ্ছেতে। তাদের ব্যক্তিত্ব প্রখর। নিজেদের ইচ্ছের বাইরে অন্য কোনও ইচ্ছে তারা পছন্দ করে না। বিরক্ত হয়, অপমানিত বোধ করে এবং শেষ পর্যন্ত রেগে যায়। তারা ইতিহাস বইতে লেখা বড় বড় রাজা-বাদশাদের স্বভাব পেয়েছে। অফিসের ঘটনাও এক। বয়েসের কারণে এবং নিয়ম অনুযায়ী সরকারি অফিসে প্রাোমোশন পেয়ে পদে বসলেও উমানাথবাবুকে চলতে হয় অধস্তনদের চোখ রাঙানিতে। তারাও নিজেদের ইচ্ছেকে খুবই গুরুত্ব দেয়। ইচ্ছে মতো ফাঁকি দেয়। ইচ্ছে মতো হিসেবের খাতায় গরমিল করে। ইচ্ছে মতো ট্রান্সফার আটকায়। ইচ্ছে মতো দুটোর বেশি তিনটে ফাইল দেখতে বললে বিদ্রোহের হুমকি দেয়। উমানাথবাবু স্ত্রী, এবং পুত্র-কন্যার স্বভাব যদি ইতিহাস বইতে লেখা রাজা-বাদশার মতো হয়, অফিস কর্মীদের স্বভাব ইতিহাস বইতে লেখা উচ্ছৃঙ্খল প্রজার মতো। জীবনে একই সঙ্গে মেজাজি রাজা-বাদশা এবং উচ্ছৃঙ্খল প্রজা পাওয়া কোনও সহজ কথা নয়। এই কারণে উমানাথবাবুর নিজের প্রতি চাপা একটা গর্বও আছে। আত্মীয়মহলে, পাড়ায়, অফিসে বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি আছে। তারা আড়ালে নানা রকম কথা বলে। কেউ বলে ‘মেরুদণ্ড নেই’, কেউ বলে ‘ব্যক্তিত্বহীন’, কেউ বলে ‘ভীতু’, কেউ বলে ‘অযোগ্য’। আড়ালে বললেও এসব কথা কানে আসে। এই ধরনের আড়ালকে বলে ‘কানে আসা আড়াল’। উমানাথবাবু গা করেন না। তিনি ছাপোষা মানুষ। জীবনে কষ্ট করে বড় হয়েছেন। পরিবারে ‘রাজা-বাদশা’ এবং অফিসে ‘উচ্ছৃঙ্খল প্রজা’ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এদের সমঝে এবং রক্ষা করে চলতে গেলে ভাবনাচিন্তা করে কাজ করতে হয়। উমানাথবাবুও করেন। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ লাগে, ছটফটানি হয়। তা হোক। সব গর্ব করার জিনিসেই কষ্ট আছে।
এই মানুষ বলা নেই, কওয়া নেই নিজের ইচ্ছেতে দুম করে একটা জানলা কিনে বসবেন! কে বিশ্বাস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে না। তবু ঘটনা সত্যি।
জানালার চেহারা লম্বাটে। আড়াই ফুট বাই চার ফুট। বডি সেগুন কাঠের। ফ্রেম গামা। পাল্লায় আছে রবীন্দ্র খড়খড়ি। রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের ঘটি হাতা জামা পরা নায়িকারা যে-ধরনের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাইরের জগৎ দেখলে মানায় সেই ধরনের খড়খড়ি। সঙ্গে খিল, লোহার হুক, পিতলের ছিটকিনি। জানলার রং সবুজ। সাধারণ সবুজ নয়, পুরোনো কুয়োর গায়ে জমা শ্যাওলা সবুজ। উমানাথবাবু এই জিনিস ঠিক বাজার থেকে কেনেননি, আবার কিনেছেনও। বাজারের গায়েই তিনটে দোকান। আজকাল দোকানের নাম হয় কিম্ভুত ভাষায়। নামে ধাঁধার প্যাঁচ থাকে। নাম দেখে দোকান কীসের চট করে বোঝা গেলে চলবে না। ধরা যাক দোকানের নাম ‘মস্তি জাং’। ‘জাং’ দেখে জামাকাপড় ভেবে ঢোকার পর দেখা গেল জামা-টামা কিছু নয়, দোকানে নানা ধরনের ঝাড়ু বিক্রি হয়। ফুল ঝাড়ু, হাফ ঝাড়ু, দেশি ঝাড়ু, বিদেশি ঝাড়ু, হস্তশিল্পের ঝাড়ু, কর্পোরেট ঝাড়ু। দোকানের নাম ‘মস্তি জাং’ কেন! দোকানি বিনয়ের হাসি দিয়ে বলবে, ‘আমাদের ঝাড়ুতে ঘর ঝাঁট দেওয়ার মজা আছে ম্যাডাম। একবার ঝাঁট দেওয়ার পর মনে হয়, আবার দিই। কোমোর টনটন করে না, হাত ঝিমঝিম করে না। তাই মস্তি।’
‘আর জাং? জাং মানে কী?’
দোকানি হাসি চওড়া করে। বলে ‘এইটা বলতে পারব না ম্যাডাম। মানে জানি না। শুনেছি চিনা শব্দ। লাগিয়ে দিয়েছি। মার্কেটে এখন চিন খুব যাচ্ছে। চিনা মাল শুনলেই সস্তা ভেবে কাস্টমার ঝাঁপিয়ে পড়ছে।’
এই বাজারের লাগোয়া তিন দোকানের নাম কিন্তু সেরকম নয়। সেগুলো বাংলা এবং সহজ। কোনও ধাঁধার কারবার নেই। নাম যা, ভেতরে জিনিসও তাই। ‘বালতি হাঁড়ি’, ‘লেপতোশক’, ‘খাট-পালঙ্ক’। বাজারে ঢোকা বেরোনোর সময় এই তিন দোকানের সামনে দিয়ে যেতে আসতে হয়। ফার্নিচারের দোকান ‘খাট-পালঙ্ক’ যেমন নতুন জিনিস বেচে তেমন সেকেন্ড হ্যান্ডের ব্যবসাও আছে। প্রাোমোটর বাড়ি ভাঙলে পুরোনো দরজা, জানলা, কড়িবরগা চলে আসে। সেদিন দোকানের বাইরে রাখা এরকম একটা জানলা উমানাথবাবুর নজর কাড়ল। জানলা গাছের ফুল বা মহিলার বুক থেকে সরে যাওয়া আঁচল নয় যে নজর কাড়বে। দরজা, জানলা, খাট-আলমারিতে তখনই চোখ পড়ে যখন দরকার হয়। উমানাথবাবুর দোতলা বাড়িতে জানলার কোনও দরকার নেই। নতুন জানালা বসানোর জায়গাও নেই। তবু জানলায় নজর পড়ল। পড়ল না জানলাই নজর কাড়ল। উমানাথবাবু থমকে গেলেন।
জিনিসটা দরজার মুখে পড়ে আছে কাত হয়ে। ঠিক যেন একটা মানুষ! ইজি চেয়ারে শুয়ে সকালের রোদ পোয়াচ্ছে। আলতো বাতাসে পাল্লাদুটো নড়ছে অল্প। পাল্লা নয়, মানুষের হাত। হাত নেড়ে ডাকছে। কী কাণ্ড!
প্রাথমিক থতমত ভাব কাটলে উমানাথবাবু বিরক্ত হলেন। বাজার করতে এসে বেগুনের নধর শরীর, কুমড়োর ফালিতে আটকে থাকা বিচি, শুকনো ডাঙায় রাখা তেলাপিয়ার নড়াচড়া দেখে থমকে যাওয়ার কথা। জানলার হাত-পা নাড়া দেখার কথা নয়। মাথাটা একেবারে গেল নাকি! মুখ ফিরিয়ে রওনা দিলেন উমানাথ। মন দিয়ে বাজার করলেন। অনেক ভেবেচিন্তে ঢেঁড়শ, পালং শাক, কাটা পোনা কিনলেন। বেশি ভাবনাচিন্তার কারণে দামে এবং ওজন দুটোতেই ঠকলেন। বাড়ি ফিরলে সাবিত্রী আজও বকুনি দেবে। রোজ স্ত্রীর বকুনি একটা মন খারাপের বিষয়। উমানাথবাবু ঠিক করলেন মন খারাপ করবেন না। বকুনি ছাড়া স্ত্রীর দাপট বোঝা যায় না। হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ফেরার পথে আবার জানলাটা চোখ পড়ল। একই ভাবে চিৎ হয়ে আছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এবার আর শুধু পড়ে নেই, উমানাথবাবুর দিকে তাকিয়ে খড়খড়ি চোখে মিটিমিটি হাসছেও!
চমকে ওঠেন উমানাথবাবু। চোখের ভুল? চোখের ভুল তো বটেই, মনের ভুলও। মনের ভুল না হলে সাতান্ন বছরের একটা মানুষ জানলার হাসি দেখতে পায় না। এবার শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হল। উমানাথবাবু দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল থেকে আর কিছুতেই ‘খাট-পালঙ্ক’ দোকানের দিকে তাকাবেন না। মরে গেলেও নয়।
তিনদিন সত্যি সত্যি তাকাননি উমানাথ। যতবারই বাজারে গেছেন মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন। তাকাতে ইচ্ছে যে করেনি এমন নয়, করেছে। মনে হয়েছে আড়চোখে দেখে নিই এক ঝলক। কী হবে? কে দেখবে? আর দেখলেই বা কী? দোকানের বাইরে তো শুধু জানলাই রাখা নেই, ভাঙা দরজা আছে, দেরাজ আছে, চারদিকে চেয়ার সাজিয়ে ঝকঝকে ডাইনিং টেবিলও পাতা আছে। ঠিক যেন একটু পরেই প্লেট সাজিয়ে খেতে ডাকা হবে। উমানাথবাবু মন শক্ত করলেন।
চতুর্থ দিন একটা কাণ্ড হল। ভয়ংকর কাণ্ড। শক্ত করে রাখা মন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল উমানাথবাবুর। কোনওরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জানলাটা নিয়ে নেবেন। যত দামই হোক। গোপনে টাকা জোগাড় করবেন।
সেদিন বাজারে যেতে খানিকটা বেলাই হয়ে গিয়েছিল। সাবিত্রীদেবী লিস্ট বলতে সময় নিচ্ছিলেন। ছেলেমেয়ে কী খাবে খোলসা করে বলছিল না। একটা তানা-না-না চলছিল। এটা হচ্ছে। ছেলে একরকম বলছে, মেয়ে আরেকরকম। তাদের মা লিস্ট ফাইনাল করতে পারছে না। উমানাথবাবু থলি হাতে অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা না করা ছাড়া উপায় নেই। দুদিন হল তার হাত থেকে বাজার করার যাবতীয় স্বাধীনতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্ডার হয়েছে কাঁচালঙ্কা বা ধনে পাতাও কেনা চলবে না। অর্ডারে সই করেছে স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যা। বাজার থেকে আনা জিনিসপত্রের মান এবং মূল্য কোনওটাই তাদের পছন্দ হচ্ছে না। ঠিক হয়েছে সবটাই লিস্ট করে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন ইনা বলল, চিংড়ি মাছ খাবে। চিংড়ি মাছের মালাইকারি দিয়ে ভাত খেয়ে কলেজে যাবে। আজ তার ক্লাস টেস্ট। এই কারণেই চিংড়ি মাছের মালাইকারি। চিংড়ি তার প্রিয় নয়, কিন্তু পরীক্ষার ব্যাপারে শুভ। অভিজ্ঞতা বলছে, পরীক্ষার দিন চিংড়ি মাছ খেলে তার নাকি কোয়েশ্চন কমন আসে। মাছের সাইজ যত বড় হবে সাজেশন কমন পাওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। এর আগে হিস্ট্রি পরীক্ষায় এই ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
উমানাথ নীচু গলায় বললেন, ‘ক্লাস টেস্ট কত নম্বরের ইনা মা?’
ইনা বলল, ‘কুড়ি নম্বর।’
উমানাথবাবু ঢোঁক গিললেন। বললেন, ‘মাত্র কুড়ি নম্বরের জন্য চারশো টাকার চিংড়ি মাছ! বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’
সাবিত্রীদেবী ধমক দিয়ে বললেন, ‘হলে হবে। কুড়ি কুড়ি করে চারশো হতে কতক্ষণ লাগে? বলো কতক্ষণ লাগে?’
উমানাথবাবু ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘তা ঠিক। বেশিক্ষণ লাগে না।’
কুন্তল ঘুম ভাঙা গলায় জানিয়েছে, সে আজ মাংস, মাছ, ডিম কিছুই খাবে না। শুধু দইয়ের ওপর থাকবে। বাবা যেন বাজার থেকে দই নিয়ে বাড়ি ফেরে। কয়েক মাস ধরে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে তার শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে। সেই গরম কমাতে সে এখনই দই ট্রিটমেন্টের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। টক এবং মিষ্টি দু-ধরনের দই-ই তার চাই।
উমানাথবাবু অবাক গলায় ছেলেকে বললেন, ‘দু-ধরনের দই দিয়ে কী হবে! মেখে খাবি?’
কুন্তল মায়ের দিকে অপমানিত চোখে তাকাল। সাবিত্রীদেবী ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘দরকার হলে তাই খাবে। তোমার অসুবিধে কী? দুয়ের বদলে দই যদি তিন রকমের পাওয়া যায় তাই আনবে। ছেলে সামান্য দই খাবে তাই নিয়ে এত কথার কী আছে?’
বাজারে বেরোনোর মুখে ডেপুটি সেক্রেটারি ফোন করলেন। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন উমানাথবাবু। সাতসকালে বাড়িতে ফোন!
‘গোলমাল কিছু হয়েছে স্যার?’ উমানাথবাবু আমতা আমতা করে বললেন।
ডেপুটি সেক্রেটারি শান্ত ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘না, গোলমাল কিছু হয়নি। কাল যে তিনটে ফাইল সেক্রেটারি সাহেবের কাছে পাঠানো হয়েছিল সেগুলোতে মেজর ভুল পাওয়া গেছে। একটু আগে সেক্রেটারি সাহেব আমাকে ঘুম থেকে তুলে জিগ্যেস করেছেন, কোন জেলায় ট্রান্সফার হলে আপনার সুবিধে হয়? আমি বলেছি, সুন্দরবনের দিকে হলে বেটার। উমানাথবাবু ভোলাভালা মানুষ, অধস্তনদের কড়া কথা বলতে পারেন না, মানুষের থেকে জীবজন্তুর সঙ্গে থাকাটাই ওর পক্ষে সেফ। আপনি কি বলেন?’
রোদ বাড়ছে। উমানাথবাবু ছাতা নিয়েই বাজারে বেরিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন যাওয়ার সময় না লাগুক, ফেরার সময় লাগবে। যাওয়ার সময়েই লাগিয়ে ফেললেন। ‘খাট-পালঙ্ক’-এর সামনে এসে ছাতা খুলে হেলিয়ে ধরলেন। ‘ওদিকে’ চোখ না যায়। জিনিসটা কি আছে? নাকি নিয়ে গেছে কেউ? যা খুশি হোক।
যা খুশি হল না। দোকানের সামনে আসার পর উমানাথবাবু শুনলেন, কে যেন নাম ধরে ডাকছে! ভারী অথচ ফ্যাসফ্যাসে গলা।
‘উমানাথ, অ্যাই উমানাথ।’
গলায় একটা ঘড়ঘড়ে ভাবও আছে। বয়সকালে রোদে জল লেগে সর্দি-টর্দি হলে যেমন হয়। উমানাথবাবু বুঝলেন ভুল শুনেছেন। তিনি দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালেন না। এক পা এগোতে আবার ডাক। এবার খানিকটা ফিসফিসানির মতো।
‘কী হল…শুনতে পাচ্ছো না…অ্যাই উমানাথ…এদিকে…উমানাথ…।’
বাজারের হট্টগোলের মাঝখানে ফিসফিসানি শুনতে পাওয়ার কথা নয়। এটা পাওয়া গেল। খানিকটা বাধ্য হয়েই উমানাথবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। কে? কে ডাকছে? ছাতার আড়াল সরিয়ে পিছনে তাকালেন। পাশ থেকে গম্ভীর এবং চাপা গলার ধমক।
‘এ তো বড্ড বোকা দেখছি হে। আরে বাপু, তোমার বাঁ পাশে… লেফটহ্যান্ড। তাকাও একবার…।’
বাঁ-দিকে তাকাতেই শরীর ঝিমঝিম করে উঠল উমানাথবাবুর। জানলাটা আজ সোজা করে রাখা। দোকানের গায়ে হেলান দেওয়া। ঝাঁড়পোচও হয়েছে। পুরোনো রঙের জেল্লা বেরিয়েছে। পাল্লাদুটো চকচক করছে। খড়খড়িগুলো কে যেন খুলে রেখেছে। দোকানের ছেলেটা নিশ্চয়। মনে হচ্ছে, খড়খড়ি নয় দাঁত। বেরিয়ে পড়ার জন্য রেডি হয়ে হারামজাদা দাঁত বের করে হাসছে!
উমানাথের মনে হল তিনি পাথরের স্ট্যাচুর মতো হয়ে গেছেন। বাজারে থলি আর ছাতা হাতে এক অতি সাধারণ মানুষের স্ট্যাচু। সহজ সরল, ভীতু আর বোকা মানুষ।
টাকাপয়সা জোগাড় করতে তিনটে দিন সময় লাগল। গোপনে জোগাড় করতে হয়েছে বলে সময় বেশি লাগল। তাও অনেকটাই পারেননি উমানাথবাবু। খাট-পালঙ্কের মালিকের নাম শশী। পরিচিত লোক। বলল, ‘টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না উমাদা। যখন আপনার মনে ধরেছে নিয়ে যান। দত্তদের বাড়ি ভাঙা জিনিস। জানেনই তো ওই বাড়ি কত পুরোনো। ষাট-সত্তর বছর তো বটেই, একশোও হতে পারে। আমি তো জন্মের পর থেকেই দেখছি। কতদিন যে পড়েছিল তালা বন্ধ হয়ে। শরিকি ঝগড়া না কী সব ঝামেলা ছিল। সব ক্লিয়ার করে মাসখানেক হল প্রাোমোটর নিয়েছে। আমি বলেছিলাম, ভাঙার কাজ শুরু হলে কিছু জিনিস দিও। চলে কিনা দেখব। এই জানলাটা পাঠিয়ে দিয়েছে।’
উমানাথবাবু লাজুক হেসে বলল, ‘দাম কত রেখেছ শশী?’
শশী বলল, ‘আপনি দুশো-পাঁচশো যা আছে দিয়ে এখন নিয়ে যান দেখি। বাকিটা পরে দেবেনক্ষণ। এতদিনের চেনা…। রঙের লোক পাঠিয়ে দেব। জানলাটা লাগাবেন কোথায়? নতুন ঘর তুলছেন? ছাদে? পিছনে এক্সটেনশন হচ্ছে?’
উমানাথবাবু মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘দেখি। এখনও ভাবিনি কিছু।’
রিকশার পাদানিতে জানলা দাঁড় করিয়ে উমানাথবাবু এখন বাড়ি ফিরছেন। দু-হাত দিয়ে পরম যত্নে ধরে আছেন। যেন জড়িয়ে আছেন। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় রিকশা লাফাচ্ছে। জানলার পাল্লা দুটো হাওয়ায় দুলছে। উমানাথবাবুর মুখে হাসি। সেই হাসি একই সঙ্গে লজ্জা এবং সুন্দর। এ ধরনের হাসির কারণ আছে। উমানাথবাবুর মনে হচ্ছে, সেই কারণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। সমস্যা হল, কারণ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কারণ কি? যা খুশি করার সাহস? নাকি শখ মেটানোর আনন্দ? এই জানলাটা দিয়ে যে আলো-বাতাস বা বৃষ্টির ছাঁট আসবে তাদের জন্য নয় তো? যারা বলবে, ‘স্যার, আপনি কি জানেন আমরা আপনাকে কতটা পছন্দ করি? মনে হয় না আপনি জানেন।’ সেই কারণে লজ্জা?
উমানাথবাবুর বিশ্বাস যে-কোনও সময় কারণ মনে পড়তে পারে। বুকে একটা খোলা জানলা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করে আছেন।