লাল রঙের চুড়ি

লাল রঙের চুড়ি

আই ঘোতন ওঠ, ওঠ, শিগগির। চোখ খুলে তাকা। এই দ্যাখ আমি এসেছি।

উফ মা, আবার সেই ঘুমের সময় এলে? তোমায় না ঘুমের মধ্যে বিরক্ত করতে বারণ করেছি। করিনি?

বোকার মতো কথা বোলো না ঘোতন। তুমি দেখছি যত বড় হচ্ছ তত বোকা হচ্ছ। দশ বছর বয়সের যে-কোনও ছেলেমেয়ের বুদ্ধি তোমার থেকে বেশি। তোমাকে তো বলেছি, আমাদের আসা-যাওয়ার একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম ইচ্ছেমতো বদলানো যায় না। ঘুমের মধ্যে ছাড়া আমি তোমার কাছে আসতে পারি না। কেমন আছ বলো।

না, বলব না।

কেন বলবে না? তুমি কি কোনও কারণে আমার ওপর রাগ করেছ?

না, রাগ করিনি, খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি। আগেরবার তুমি যখন এসেছিলে তখন তোমায় কী বলেছিলাম? বলেছিলাম, আমাকে একটা বল এনে দিয়ে। সেই বল আজও তুমি আনোনি। এর পরেও তোমার ওপর খুশি না-হয়ে থাকা যায়? তুমি কি জানো এই গ্রামের ছেলেরা আমাকে আর খেলায় নিচ্ছে না। পটলা বলেছে, যে কোনওদিন বল-ব্যাট কিছু আনতে পারে না তবে আর খেলায় নেওয়া হবে না।

সবসময় বায়না করবে না। ভাল ছেলেরা কখনও বায়না করে না। এ কী! তোমার কনুইয়ের কাছে ওটা কীসের দাগ, ঘাতন?

বলব না।

মনে হচ্ছে পুড়ে গেছে। ইস, হাতটা ঘোরাও তো। ও মা! এ তো অনেকটা পোড়া! আহা রে, কী করে অমন হল?

তোমাকে আর ইস ইস করতে হবে না, মা। তুমি যেন জানো না। পরশু রাতে ভাত পুড়িয়ে ফেলেছি বলে মামিমা উনুনের কাঠ তুলে ছ্যাঁকা দিল। তুমি দ্যাখোনি? তুমি যে বলেছিলে, দূর থেকে সবসময় আমার ওপর নজর রাখো। বলোনি?

সে কী! আগুনে পুড়িয়ে দিল! ঘোতন, তোর মাথার পেছনটাও ফুলে আছে না? নিশ্চয়ই বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করেছিস? সত্যি কথা বলবি কিন্তু।

অমন চোখ বড় বড় কোরো না, আমার ভয় করছে। মনে নেই, ছোটবেলায় তুমি চোখ বড় করলে আমি কেঁদে ফেলতাম? আমার ফোলাটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। কয়লা ভাঙতে ভাঙতে কাল দুপুরে ঘুমে ঢুলছিলাম। ছুটকিদিদি এসে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিল। ছুটকিদিদি মাঝে মাঝেই আমার মাথা ঠুকে দেয়। আমার মাথা ঠুকতে ছুটকিদিদি ভালবাসে। এই দ্যাখো না, কত জায়গায় ফোলা। ঠিক যেন মাথায় আলু পটলের দোকান। হি হি। দেখবে?

না, দেখব না। কই এসব কথা আগে তো আমাকে বলিসনি।

তোমাকে বলব? খেপেছ নাকি? ছুটকিদিদির নামে নালিশ করব? নালিশ করলে কী হয় তুমি তো জানো না। দাঁড়াও একটা গল্প বলি। একদিন দুপুরে ছুটকিদিদি আর আমি রান্নাঘরে খেতে বসেছি। গরম গরম ফ্যানাভাত। আর কী বলো তো? পারলে না তো? সঙ্গে ছিল আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ। আস্ত ডিম যে কতদিন খাইনি। প্রাণে ধরে খেতেও পারছি না। গরম গরম ডিমটাকে একবার পাতের এ-পাশে রাখি, একবার পাতের ও-পাশে রাখি। এমন সময় ছুটকিদিদি আমার পাত থেকে ডিমটা তুলে নিয়ে বলল, তোকে ডিমের বদলে একটা আস্ত কাঁচালঙ্কা দিলাম। খানিক পরে আলুটা তুলে নিয়ে বলল, আলুর বদলে তুই পেলি এক চিমটে নুন। আমি ভাতের থালা ফেলে মামিমাকে গিয়ে বললাম। মামিমা বলল, কী, এত বড় সাহস! বড়দিদির নামে নালিশ! তোকে দু’দিন খেতে দেব না। দোহাই মা, ও কথা বলবে না। মারধর সহ্য হয় কিন্তু খেতে না-দিলে খুব কষ্ট। এরা মাঝে মাঝে আমাকে খেতে না-দিয়ে ঘরে আটকে রাখে। তুমি কিন্তু পরেরবার যখন আসবে অবশ্য করে আমার জন্য একটা বল আনবে। রবারের বল। গ্রামে ঢোকার মুখে দেখবে বাঁ দিকেই ভোলাকাকুর দোকান। সেখানেই বল পাওয়া যায়। আনবে তো? চুপ করে আছ কেন মা? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আনবে না। মামা-মামিমা ঠিকই বলে। বলে, বাবা-মা যাকে কিছু দেয়নি তার কপালে অনেক দুঃখ। মা, আমার কপালে কি অনেক দুঃখ?

ছিঃ ঘোতন, অমন করে বলে না। তুমি আমার ফুলের মতো সুন্দর ছেলে। তোমার কপালে দুঃখ হবে কেন? এই দ্যাখো, আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

আমার ভয় করে। রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে উঠে বসি। গলা শুকিয়ে যায়।

ওমা, বোকা ছেলে, ভয় পেলে কাউকে ডাকিস না কেন?

কাকে ডাকব মা?

কেন মামা, মামিমা? ছুটকিদিদিকেও তো ডাকতে পারিস।

কী যে বলো না। আমি কোথায় শুই তুমি জানো না বুঝি? দ্যাখোনি কখনও? সেই উঠোন পেরিয়ে গুদাম ঘর। সেই গুদাম ঘরের বারান্দায় একটা তক্তপোশ আছে। নড়লেচড়লে সেটা আবার ঘটর ঘটর করে। শক্ত হয়ে আমি তার ওপর শুয়ে থাকি। তুমি আমার কাছে থাকবে, মা?

দুর পাগল ছেলে, আমি তোর কাছে থাকতে পারি? বললাম না, আমরা সব পারি না। ইচ্ছে করলেও পারি না। তবে এখন আমি ঠিক করেছি, আমার একটা জিনিস তোকে দিয়ে যাব।

কী জিনিস মা?

দ্যাখ না মজা। নে ভাল করে তাকা দেখি আমার দিকে। না, না, ওরকম করে নয়। চোখের পাতা আরও বড় করে খোল। বাঃ, এবার আমার মণির দিকে তাকিয়ে থাক। আর একটু, আর একটু। ব্যস, হয়ে গেছে।

কী হয়ে গেছে?

তোর চোখের মধ্যে আমার চোখের কিছুটা রেখে গেলাম। তুই আর একদম চিন্তা করিস না ঘোতন। যখন দরকার হবে তুই শুধু তাকবি। তারপর যা করবার আমি করব।

কী করবে?

সে এখন বলব না। যখন করার সময় হবে তখন করব।

খুব মজা হবে, না?

হ্যাঁ, খুব মজা হবে। নে এবার ঘুমো।

তুমি এখন যেয়ো না মা। আর একটু বোসো। তোমার জন্য আমার খুব মন কেমন করছে।

এ মা, এত বড় ছেলে কাঁদে নাকি? আমি চলে যাচ্ছি কোথায়? এই তো আজ থেকে আমি তোর চোখের মধ্যেই রয়ে গেলাম। অনেক রাত হল, এবার ঘুমিয়ে পড় তো দেখি।

শেষ রাতে প্রবল কাঁপুনি দিয়ে ঘোতনের জ্বর এল। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন তার গা ভরতি জ্বর। তবে রাতের স্বপ্নের কথা তার কিছু মনে নেই।

কিছুক্ষণ আগে ঘোতনকে তার মামিমা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

গোলগাল, মোটাসোটা মামিমার মুখখানা ভারী মিষ্টি। সবসময় একটা হাসিহাসি ভাব। একবার তাকালে মুখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, সবসময় তাকিয়ে থাকি। মামিমা হাসিমুখে ঘোতনকে ডাকলেন। বললেন, অনেক হয়েছে বাছা, আর নয়। এবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি এ-বাড়ি থেকে বিদায় হও বাপু। পারলে এখনই, না-পারলেও এখনই। বাপ-মা মরা ছেলেকে কোলে টেনে খাইয়েছি, পরিয়েছি। শত অন্যায়, শত দোষ, মুখ বুজে সহ্য করেছি। নিজের পেটের মেয়েকে বকেছি, মেরেছি, তবু তোমাকে কিছু বলিনি। গায়ে হাত তুলিনি কখনও। মায়ের মতো ভালবাসা দিয়ে মানুষ করবার জন্য কী না করেছি। তুমিই নিজের মুখে বলো না কী না করেছি তোমার জন্য। এই পর্যন্ত বলে মামিমা থামলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছলেন। নাক টানলেন। মনে হচ্ছে এখনই কেঁদে ফেলবেন। কাঁদলেন না। আবার হাসিমুখে বলতে শুরু করলেন, কিন্তু বাছা, আমার সব চেষ্টাই জলে গেছে। তোমাকে মায়ের আদর দিলাম, কিন্তু মানুষ করতে পারলাম না। সেই প্রথমদিন থেকেই আমার সন্দেহ ছিল। মুখে কিছু বলিনি। তোমার পাশে পাশে যে শয়তান ঘুরে বেড়ায় তা বুঝতে পারতাম। নইলে অত শয়তানি তুমি কী করে করতে বলো বাছা? কাজেকম্মে মন নেই, শুধু খাবদাব, খেলব আর মোষের মতো ঘুমোব। এ জিনিস শয়তানের দান কিনা তুমিই বলো, নিজের মুখেই বলো না। মামিমা আবার থামলেন। মেয়েকে গলা তুলে বললেন, ছুটকি, অ্যাই ছুটকি, চুন হলুদের হল কী? গরম করতে এত সময় লাগে নাকি? ফের ঘোতনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হ্যাঁ বাছা কী কথা বলছিলাম যেন?

ঘোতন উৎসাহের সঙ্গে বলল, শয়তানের কথা বলছিলেন মায়েমা।

হ্যাঁ, শয়তানের কথা। সেই শয়তান এখন আর পাশে পাশে না-ঘুরে একেবারে সটান তোমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ক’দিন ধরে যেসব কাণ্ড ঘটেছে সেগুলো শয়তানি কাণ্ড ছাড়া কী বলব? ওই শয়তান যে তাড়ানো যায় না তা নয়, ইচ্ছে করলে ওঝা ডেকে ঝেড়ে বের করে দেওয়া যায়। কিন্তু পরের ছেলেকে নিয়ে ওসব ঝামেলায় যেতে আমি রাজি নই। তার উপর পয়সাকড়ির ব্যাপার আছে। ওঝা তো এমনি এমনি ভূত তাড়াবে না। ভূতের আর কী বলো। তিনি তো বিনিপয়সায় তোমার মধ্যে ঢুকে বসে পড়েছেন। তোমার মুখে খাচ্ছেন, তোমার পায়ে হাঁটছেন, তোমার চোখে মানুষের সব্বনাশ করছেন। কিন্তু তাকে বের করতে তো খরচখরচা আছে। বাছা, সে-খরচ দেবে কে? তোমার বাপ, মা মরার আগে কি ভূত তাড়ানোর টাকা দিয়ে গেছে? মোটেই নয়, কিছুই দেয়নি তারা। দুটো কানাকড়িও নয়। অসুখ করেছে আর পটাপট মরেছে। ঠিক কিনা?

ঘোতন মাথা নেড়ে সায় দিল।

মামিমা খুশিমুখ আরও খানিকটা হাসিহাসি করে বললেন, আমি চাই না তোমার মামা তোমার পেছনে আর একটি কানাকড়ি খরচ করুক। তাই কলকাতা থেকে উনি ফেরবার আগেই ভালয় ভালয় তুমি বাছা বিদায় নাও দেখি। তোমার বয়স দশ হল। দশ বছর বয়স কম কিছু নয়। এই বয়েসে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সামনে অনেক পথ খোলা থাকে। চুরি, ডাকাতি, ভিক্ষে— অনেক কিছু। আমার বিশ্বাস তুমি যদি ঠিকমতো মন দাও, এগুলোর যে-কোনও একটায় নাম করতে পারবে। চিন্তা কোরো না, মানুষের সঙ্গে আর কেউ না-হক ভগবান থাকেন। আর তোমার সঙ্গে আছেন শয়তান। শয়তানের চোখ। সবার কপালে বাবা এমন শয়তানভাগ্য জোটে না। সুতরাং আর দেরি না-করে তুমি বেলা থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়ো। তোমাকে চোখের সামনে দেখলে আমাদের ভয় করছে। ছুটকি তো এদিকে আসতেই চাইছে না।

বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অনেক গোছগাছ লাগে। সুটকেস নামাও রে, ট্রাঙ্ক গোছাও রে, গোল করে বিছানা বাঁধো রে। পথে খাওয়ার জন্য নিতে হবে চিঁড়ে মুড়ি। বৃষ্টিবাদলার জন্য ছাতা নিলে ভাল। সবমিলিয়ে বলা যায়, বাড়ি ছাড়ার ছরকট্ অনেক।

ঘোতনের এ-সমস্যা নেই। তার না-আছে সুটকেস ট্রাঙ্ক, না-আছে চিঁড়ে মুড়ি। সঙ্গে নেওয়ার মতো কিছুই নেই তার। ঘোতন মন দিয়ে নিজেই সাজগোজ করছে। তার একমাত্র ফুলহাতা জামাটা পরেছে। জামার রং নীল। পুরনো হলেও রং বেশ ভালই আছে। শুধু ঘাড়ের কাছটা সাদা দেখায়। তা দেখাক। কালো রঙের হাফপ্যান্টে সেই নীল জামা গুঁজে হাতার বোতাম আটকেছে সে। প্যান্টে একটা বোতাম কম ছিল। মামিমার কাছে সেফটিপিন চেয়ে লাগিয়েছে। পায়ে দিয়েছে তার প্রিয় কেড্স জুতো। চার বছর ধরে এই জুতো পরছে সে। কেড্সের সাদা রং এখন আর সাদা নেই। হলদেটে লাগে। তা ছাড়া দুই পায়ে ছোট বড় মিলিয়ে মোট ছ’জায়গায় ফুটো। এর মধ্যে দুটো ফুটো আবার বেশ বড়। ঘোতনের কোনও মোজা নেই। মোজা না-থাকায় জুতোর ফুটোয় খুব সুবিধে হয়েছে। ফুটো দিয়ে জুতোর মধ্যে হাওয়া খেলে। এই জুতোজোড়ার সবচেয়ে বড় গুণ হল, গত চার বছরে ঘোতনের পা বড় হয়েছে, কিন্তু এরা ছোট হয়নি। সম্ভবত ছেঁড়া, রং-চটা এই জুতো বিশেষ কোনও কারণে ঘোতনকে ভালবেসে ফেলেছে। তাকে ছাড়তে চাইছে না।

জামাকাপড় পরা হলে ঘোতন পরিপাটি করে চুল আঁচড়াল। একটু তেল হলে ভাল হত। চুলগুলো বড় শুকনো লাগে। মামিমার কাছে চাইবে? না, থাক। পরিস্থিতি যা তাতে তেল চাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। একটু জলহাত বুলিয়ে নিলেই হবে।

বেরোবার সময় মামিমাকে প্রণাম করতে গেল ঘোতন। মামিমা বললেন, থাক, থাক, ব্যথা পায়ে আর হাত দিতে হবে না। আমি তোমাকে দূর থেকেই আশীর্বাদ করছি, এদিকে তোমাকে যেন আর কোনও দিন আসতে না হয়।

ছুটকিদিদির সঙ্গে দেখা করলে ভাল হত। হাতের খবরটা একবার নেওয়া উচিত। গরম ফ্যানের পোড়া ভাল জিনিস নয়। চট করে শুকোতে চায় না। ছুটকিদিদিকে ধারেকাছে পাওয়া গেল না। মনে হয়, ভয় পেয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। কালকের পর থেকেই ওকে এড়িয়ে চলছে। কী আর করা যাবে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ঘোতন।

কোথায় যাবে সে জানে না। একটু কোথাও গেলেই হল। সত্যি কথা বলতে কী, কোথাও যাওয়ার যে খুব কিছু তাড়া আছে তেমনও নয়। এলোমেলো হাঁটতে ঘোতনের ভালই লাগে। এই মাঠ, ধানখেত, তাল, সুপুরি, পাকুড় গাছ, অচেনা পাখির চেনা চেনা ডাক, ভারী ভাল লাগে। এর সঙ্গে আছে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একফালি নদী, আর তার উপর ঝুঁকে-থাকা একটুকরো আকাশ। ঝরনা নদীর পাড়ে বসে থাকার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। ঘোতনের ইচ্ছে, বড় হয়ে নদীর পাড়েই থাকবে। গ্রামের পুকুরগুলোতেও অনেক মজা। সাঁতার কাটার মজা, ঢিল ছোড়ার মজা। এসব ছেড়ে চলে যেতে যে খারাপ লাগছে না তা নয়, কিন্তু কী আর করা যাবে। যেতে যখন হচ্ছেই তখন আর দুঃখ করে লাভ কী? ঘোতন ঠিক করল, না, সে কিছুতেই দুঃখ করবে না।

আকাশে মেঘ নেই একটুও। রোদ খুব। গরমও লাগছে। গরমের মধ্যেই ঘোতন খুশি মনে হাঁটতে লাগল।

এই উসুলপুর গ্রামে মামার বাড়িতে যখন এসে উঠেছিল ঘোতন তখন তার বয়স ছিল পাঁচ। গত ফাল্গুনে দশে পা দিয়েছে। এই পাঁচ বছরে কম করে পাঁচ হাজার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে। খুশির কথা হল, কোনও অভিযোগই কখনও ঝুলে থাকেনি। সবকটারই বিচার হয়েছে। বিচার শেষে চড়, কিল, কানমলা, খেতে না-দেওয়া, ঘরে আটকে রাখা জাতীয় নানা ধরনের কঠিন শাস্তি তাকে পেতে হয়েছে। বিচার কেন একতরফা হল অথবা অকারণে কেন বারবার তাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে— এই ধরনের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঘোতন কখনও মাথা ঘামায়নি। আজও ঘামাচ্ছে না। সহজভাবেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার শাস্তি মেনে নিয়েছে।

তবে সে বুঝতে পারছে এবার তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা শুধু গুরুতর নয়, ভয়ংকরও।

ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছে পরশু বিকেল থেকে।

পটল, হারু, গোপাল, নন্তুরা দলবেঁধে খেলতে এসেছে মাঠে। দুপুরের মধ্যে জ্বর নেমে যাওয়ায় বিকেল হতেই মামিমাকে লুকিয়ে মাঠের ধারে চলে এল ঘোতন। ছেলেরা যদিও আগেই ঘোষণা করে দিয়েছে, খেলা থেকে ঘোতন বাদ, তবু মনে আশা, যদি নেয়। নিতেও তো পারে। মানুষের মত কি বদলায় না? সে নয় কাকুতিমিনতিই করবে। বেশি নয়, একটু নিলেই হবে। আসলে আজ একটা বিশেষ ব্যাপার আছে। পটলের কাকা কলকাতা থেকে ফুটবল এনে দিয়েছে। চামড়ার ফুটবল। দেখার মতো জিনিস। হাওয়া দিয়ে সেই বল ফোলাতে হয়। হাওয়া ভরার জন্য আলাদা যন্ত্র। সেই বলের লোভেই ঘোতন আজ মাঠে এসেছে।

মাঠে এসে দেখল, পটলের হাতে সেই আশ্চর্য সাদা কালো বল। বেশিরভাগ সময়ই সেটাকে পটল চেপে ধরে আছে বুকের কাছে। রাখবেই তো। অমন একটা বলের মালিক হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। আজকের খেলায় সে-ই আজ সব। হাবভাব তার পালটে গেছে। চেলা হিসেবে সে বেছে নিয়েছে নন্তুকে। পটল আস্তে হাঁটছে, গলা নামিয়ে নন্তুর সঙ্গে কথা বলছে। আঙুল নেড়ে কখনও কখনও হারুকে কাছে ডাকছে। এমনকী, প্যান্টের পকেটে করে একটা ছোট্ট চিরুনি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে সে। মাঝেমধ্যে সেটা বের করে চুল আঁচড়াচ্ছে। ছেলেরা তাকে ঘিরে আছে। অনেক করে চাইলে নস্তুর সঙ্গে কানে কানে পরামর্শ করে পটল একবার করে বলটা ছুঁতে দিচ্ছে। তবে দেওয়ার আগে কঠিন গলায় বলছে, সাবধানে মারবি কিন্তু। বল একবার ফেটে গেলে তোদের মাথা ফাটাব। এই বল নষ্ট হলে কিচ্ছুটি করার থাকবে না। সেই কলকাতায় গেলে তবে সারানো যাবে। হুঁ হুঁ বাবা, এ-বল সারানো এখানে কারও কম্ম নয়।

অন্যের কাছ থেকে বল ফেরত এলে প্রথমে নিচ্ছে নন্তু। হাত দিয়ে বলের গা ভাল করে মুছে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে পটলের হাতে। মনে হচ্ছে পটলের চেয়ে নন্তুর দরদ বেশি।

ঘোতন মুগ্ধ হয়ে পটলকে দেখছে। আহা, এমন একটা বল যদি তার থাকত!

খানিক পরেই খেলা প্রায় শুরু হল। দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে, সবাই মাঠে নেমে গা গরম করছে। কিন্তু তাকে কেউ ডাকল না। তখন ঘোতন হারুর কাছে গেল। ফিসফিস করে বলল, অ্যাই হারু, আমাকে একটু খেলতে নিবি? নে না রে। বেশি খেলব না, একটু খেলেই চলে যাব। সত্যি বলছি।

হারু ভুরু কুঁচকে বলল, আবার তুই খেলতে এসেছিস? তোকে না বলেছি, বল না-আনলে খেলায় নেব না। বলিনি? ঠিক আছে, তুই দাঁড়া, আজকে একটা অন্যরকম দিন। অন্যরকম দিনে নিয়ম না-মানলেও চলে। আমি পটলকে জিজ্ঞেস করে নিই।

হারুর কথা শুনে পটল এগিয়ে এল। সঙ্গে এল চ্যালা নন্তুও। সে কিছু বলায় নন্তু বলল, ই-ই আবদার নাকি? যা যা ভাগ এখান থেকে।

পটল নন্তুকে বলল, তুই চুপ কর। তারপর ঘোতনের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, তুই খেলতে চাস? ঠিক আছে, আগে তোর পা দুটো দেখি তো। নিজেই মাথা নামিয়ে ঘোতনের পা পরীক্ষা করল। তারপর নন্তুকে বলল, এবার তুই দ্যাখ। নন্তু দেখল, ঘোতনের কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল। পটল নন্তুর ফিসফিসানিতে মাথা নাড়ল, তারপর নাক মুখ কুঁচকে বলল, ইস, এরকম ইটের মতো পা নিয়ে আমার বলে লাথি মারবি? তুই কি খেপেছিস? যা ভাগ এখান থেকে। ভাগ এখুনি। এই বলে খেলতে গেলে আগে ঝামা দিয়ে ঘষে পা নরম করবি, তারপর আসবি। ঘোতনের মুখ দেখে হারুর যেন একটু দুঃখ হল। সে বলল, ঠিক আছে, তুই বরং মাঠের বাইরে বসে থাক। বল বেরিয়ে গেলে এনে দিবি।

পটল মুঠি পাকিয়ে বলল, কিন্তু খবরদার, বলে পা লাগাবি না বলে দিলাম। যদি লাগিয়েছিস…।

এই ব্যবস্থায় হোতন খুব খুশিই হল। একেবারে বাদ যাওয়ার চেয়ে এই ভাল। মহা উৎসাহে মাঠের বাইরে ছুটোছুটি করতে লাগল সে। বল এলেই ধরছে। ধরে ছুড়ে দিচ্ছে মাঠে। এই বা কম কীসের? সত্যি তো ওরা তাকে নেবে কেন? তার হল নোংরা হতকুচ্ছিত ফাটাফুটি পা। এই পা কি অমন অত দামি বলে লাগানো উচিত? একেবারেই উচিত নয়। এই বেশ ভাল। এও অনেকটা খেলার মতোই হল।

গোলমাল হল খানিক পরে। খেলা দেখতে দেখতে একসময় পটলের হুঁশিয়ারি ভুলে গেল ঘোতন। বেরিয়ে আসা ফুটবল মাঠের ভিতর ফেরত দিতে গিয়ে জোরে একটা লাথি কষাল। আকাশে ভেসে বল গিয়ে পড়ল একেবারে মাঠের মাঝখানে, পটলের সামনে। দু’হাত দিয়ে বল চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সটান মাঠের বাইরে চলে এল পটল। সপাটে চড় কষাল ঘোতনের গালে। বলল, তোর তো সাহস কম নয়। ওই নোংরা পা আমার বলে লাগালি? অ্যাঁ, তোকে না বারণ করেছিলাম। কথা বলতে বলতে আবার চড়। ঘোতন মাঠের পাশে ছিটকে পড়ল। চড়ের দাপটে চোখে ধাঁধা লেগে গেছে ঘোতনের। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার টলে পড়ে গেল। ছেলেরা হো হো করে হেসে উঠল। পটল হাত ঝেড়ে, চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার বলছি, আর যদি একবারও বল ছুঁয়েছিস দেখবি কী করি।

মার খেয়ে কান্নাকাটি করার কথা ঘোতন ভুলে গেছে বহুদিন। এটা একটা ভাল জিনিস। যে-ছেলে সবসময় মার খাওয়ার উপরেই থাকে তার মোটেও কান্নাকাটি মানায় না। তা হলে তো ঘোতনের সারাদিনই চোখে জল থাকত।

কিন্তু আজ একটা বড় অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে শুরু করল।

পটলের চড় খেয়ে ঘোতনের চোখ জ্বালা করতে শুরু করেছে। কান্না পাচ্ছে কি? কপালের কাছে দপদপ করছে। সেই দপদপানি ধীরে ধীরে সারা মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, আগুন লেগেছে! মাথার মধ্যে আগুন লেগেছে! একেই কি রাগ বলে? ঘোতন জানে না। আগে এমন কখনও হয়নি তার। জ্বরের সময় মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে পড়েছে। ছুটকিদিদি যখন দেওয়ালে বা দরজায় মাথা ঠুকে দেয় তখনও কম লাগে না। কিন্তু আজকের এই জিনিস তার অচেনা। শুধু তাই নয়, তার কানের মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, তাকা, ঘোতন, তাকা। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে থাক তুই। কে বলছে? চেনা গলা, খুব চেনা গলা। কিন্তু কই চিনতে পারছে না তো!

ঘোতন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাঠের দিকে।

খেলা দারুণ জমে উঠেছে। হারু বল নিয়ে পৌঁছে গেছে বিপক্ষ দলের গোলের সামনে। চাঁদুকে টপকে সে বাঁ পায়ে বল এগিয়ে দিল গোপালকে। গোপাল দু’জনকে পাশ কাটিয়ে বল তুলেছে পটলের মাথায়। পটল হেড দিলেই একেবারে নিশ্চিত গোল। সবাই চিৎকার করে উঠল, গোল, গোল, পটলা, হেড দে। ততক্ষণে পোলপোস্ট ছেড়ে গোপাল এগিয়ে এসেছে। তাকে গোল বাঁচাতে হবে। এই সময় লাফিয়ে উঠে পটল হেড দিল। হেড করতেই পটলের দিকে ছুটে-আসা গোপাল উলটে পড়ল। পটলার হেড বলে লাগেনি, লেগেছে গোপালের কপালে। পটলও ছিটকে পড়েছে। গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে তার কপালের মাঝখানটা ফুলে ছোটখাটো একটা ঢিপির মতো হয়ে গেছে। পটলের টিমের লোকরা রে রে করে গোপালকে মারতে ছুটে গেল, এত বড় সাহস, আমাদের ক্যাপ্টেনকে মেরে মাথা ফুলিয়ে দিয়েছিস। তার থেকেও বড় কথা হল, যার বল নিয়ে খেলছিস তাকেই মারছিস? দেখাচ্ছি তোদের মজা।

গোপালের দলও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বল এনেছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে? গোল দিতে আসবে আর আমরা বাঁচাতে পারব না? ভেবেছিসটা কী, অ্যাঁ? তা ছাড়া তোদের পটলই তো আগে আমাদের গোলকিপারকে মাথা দিয়ে মারল। এবার ওর শিং ভাঙব।

মুহূর্তে দু’দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেল মারপিট। চড়, কিল, চুলের মুঠি ধরে টানাটানি। বাপ রে, মা রে, গেলাম রে, মরলাম রে। হুলুস্থূল কাণ্ড। একসময় ভিড়ের মধ্যে থেকে ছুটে বেরিয়ে এল নন্তু। নাকের উপরটা ফুলে আছে। মনে হচ্ছে, কে যেন সেখানে একটা আলু বসিয়ে দিয়েছে। আসলে ওটা হল পটলার ঘুসির আলু। বোঝাই যাচ্ছে, মারামারির সময় নন্তুকে চিনতে পারেনি পটল। অথবা একটু আগে পর্যন্ত নন্তু যে একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমানের মতো তার পাশে পাশে ছিল সে-কথাটা বেমালুম ভুলে গেছে। ভুলে গিয়ে চেলার নাকেই ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। যতটা না ঘুসির ব্যথা, অপমানের জ্বালা তার থেকে অনেক বেশি। এতক্ষণ বলের অত যত্ন করল, তার এই পুরস্কার!

দৌড়ে এসে মাঠের একপাশে পড়ে থাকা বলটা তুলে নিল দু’হাতে। চিৎকার করে বলল, অ্যাই পটলা, তুই ব্যাটা বেশি বল দেখাচ্ছিস, না? নতুন বলের জন্য তোর গায়ে বেশি বল হয়েছে মনে হচ্ছে। দ্যাখ, এবার তোর বলের কেমন দফা রফা করি। নন্তু এবার গোলপোস্ট লক্ষ করে গায়ের জোরে লাথি কষাল বলে।

মাঠের মাঝখান থেকে কে যেন চোখ সরিয়ে দিয়েছে ঘোতনের! সে এখন তাকিয়ে আছে নন্তুর লাথি-মারা বলের দিকে। স্থির চোখে। একমনে। বল ভাসতে ভাসতে গোলপোস্টের দিকে চলেছে। ঘোতন তাকাল গোলপোস্টের দিকে। ডান দিকের উপরে পেরেকের মতো কী একটা বেরিয়ে আছে না? হ্যাঁ, পেরেকই তো। সুঁচলো মুখ, ধারালো শরীর। বিকেলের রোদ পড়ে চকচক করছে। পটলের কাকার কলকাতা থেকে আনা দামি বলটাকে উসুলপুর গ্রামের সামান্য পেরেক যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আয়, আয়, আমার কাছে আয়।

ফ্যাঁস, ফ্যাঁস, ফ্যাঁস। ঘোতন চমকে উঠল। চামড়ার বল ফাটলে এমন মজার শব্দ হয় নাকি?

তবে এখানে আর থাকাটা মনে হয় না ঠিক হবে। ঘোতন দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

খেলার মাঠ থেকে বাড়ি যাওয়ার দুটো পথ। একটা পথ গেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে, আর একটা নদীর পাড় ধরে এঁকেবেঁকে। গ্রামের ভিতরের পথটা ধরলে তাড়াতাড়ি ফেরা যায়, আর নদীর পথটা বেশ খানিকটা দূরে। সময়ও বেশি লাগে। ঘোতনের বিচ্ছিরি স্বভাব হল, সুযোগ পেলেই সে নদীর পথটা ধরবে। আজও ধরল।

উসুলপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া এই নদীটা খুবই ছোট, সারা বছরই এখানে জল। ইচ্ছে করলে হেঁটেই পার হওয়া যায়। এমনকী, বর্ষাকালেও জল এমন কিছু বাড়ে না। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, নদী নয়, একটা ঝরনা। ঝরনাটা ভুল করে নদী হয়ে গেছে। উসুলপুরের মানুষ তাই এর নাম রেখেছে ঝরনা নদী। ঝরনা নদীতে গুম গুম শব্দ হয়। গ্রামের অনেকে বলে এই শব্দ নাকি পাহাড় থেকে নেমে আসার শব্দ। এখান থেকে পাহাড় যে কত দুরে তার কোনও ঠিক নেই। তা হলে নদীতে পাহাড়ের শব্দ আসবে কীভাবে? নদী, বাতাস এরকম পারে, অনেক দূরের শব্দ বয়ে আনতে পারে। তবে তা সবাই শুনতে পায় না, যার শোনার ইচ্ছে আছে সেই কেবল পায়।

ঘোতন সুযোগ পেলেই পাহাড়ের শব্দ শুনতে চলে আসে। নদীর পাড়ে তার একটা নিজের জায়গা আছে। এই জায়গাটার খবর কেউ জানে না। লুকোনো জায়গা। শ্মশান থেকে আর একটুখানি যেতে হবে। তারপর একটা ঝাঁকড়া পাকুড় গাছ। একগাদা ডালপাতা নিয়ে গাছটা ঝুঁকে আছে নদীর উপর। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ঝরনা নদীর সঙ্গে কোনও দরকারি কথা সারছে। সেই গাছের আড়ালেই ঘোতনের প্রিয় জায়গাটা, ছোট্ট একটা ঘাট। বহু বছর আগে কেউ বোধহয় এটা বানিয়েছিল। ঘাট বলতে দশ-বারোটা ছোট ছোট সিঁড়ি জল পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়িগুলো এতই ছোট যে, ইচ্ছে থাকলেও সেখানে একজনের বেশি দাঁড়ানো যাবে না। সিঁড়িগুলো শ্যাওলাতে সবুজ আর সবসময়েই ভিজেভিজে। বৃষ্টির সময় জলে ঢেকে থাকে, অন্যসময়ে পড়ে থাকে একা একা, পাকুড় গাছের ডালপাতার মধ্যে লুকিয়ে। এই ঘাটে কেউ আসে না। আসলে কী, দেখতেই তো পায় না। আসে শুধু ঘোতন। কখনও সকালে, কখনও দুপুরে, কখনও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে বিকেলবেলা। ক’টা ধাপ নেমে গিয়ে সিঁড়ির উপর বসে থাকে চুপ করে। জল এসে ছোট্ট সিঁড়িতে মাঝেমধ্যে ধাক্কা দেয়, মনে হয় ফিসফিস করে কিছু বলছে। কী বলছে? ঝুঁকে-থাকা পাকুড় গাছ থেকে কয়েকটা হলুদ সবুজ পাতা জলে পড়ে নাচতে থাকে। তাদের গায়ে-লোগে-থাকা জল আলোয় চিকচিক করে। মনে হয় আলোর ফোঁটা। নদীর জলে আলোর ফোঁটা পড়ে নাচতে নাচতে চলেছে। ঘাতনের এত ভাল লাগে যে, মনে হয়, এখানেই থেকে যাই। কিন্তু সত্যি সত্যি তো থাকা যায় না। তাই একটু ফাঁক পেলেই এখান থেকে ঘুরে যায়।

শ্মশান ছাড়িয়ে একটু হাঁটতেই ঘোতন দূর থেকে ওদের দেখতে পেল। কারা ওখানে? দুটো লোক না? হ্যাঁ, লোকই তো। ওখানে কী করছে? এ কী, গাছটা কোথায়! চমকে উঠল ঘোতন। এতদিনের চেনা জায়গাটা চিনতে পারছে না যে! সে কি ভুল দেখছে? তাই হবে। পাকুড় গাছ তো আর ফিঙে বা দোয়েল পাখি নয় যে, উড়ে চলে যাবে। ঘোতন ছুট মারল।

না, ভুল নয়। ঘোতন ঠিকই দেখছে।

পাকুড় গাছটা পুরোটাই কাটা হয়ে গেছে। এখন ডালপালা ছাঁটার কাজ চলছে। বিশাল গুঁড়িটা একপাশে শুয়ে আছে। ঠিক যেন মরা একটা মানুষ। খানিক দুরে একটা ঝোপের আড়ালে ঘোতন থমকে দাঁড়াল।

দুটো লোক কাটা গুঁড়িটার উপর বসে পা দোলাচ্ছে। একজন মোটাসোটা ষণ্ডামার্কা দেখতে। সে প্যান্ট আর একটা লাল গেঞ্জি পরে আছে। প্যান্টের উপর আবার একটা গামছা জড়ানো। মুখে বিড়ি। এই লোকটার পাশে একটা কুড়ল রাখা। অন্যটা লুঙ্গি পরে আছে। খালি গা। হাতে একটা বড় করাতের মতো কী যেন! এরও একটা গামছা রয়েছে। সেটা কাঁধের উপর।

প্যান্ট-পরা মুখ থেকে ভক করে খানিকটা বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলল, অ্যাই, অনেক আরাম হয়েছে, নে, এবার ওঠ তো। কাঠগুলো ঝটপট বেঁধে ফেলা।

লুঙ্গি পরাটা কাঁধ থেকে গামছা নামিয়ে ভাল করে মুখ মুছল। বলল, দাঁড়ান দেখি, অত ছটফট করেন না। এত বড় গাছ কাটা কি মুখের কথা? তা ছাড়া ভাল করে আঁধার না-নামলে যাবেন কেমন করে? লোকে দেখে ফেললে কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন আপনে? তখন আর আপনেরে গাছ কেটে তক্তা বানাতে হবে না। লোকেরা মেরেই তক্তা বানিয়ে দেবে।

প্যান্ট-পরা ধমক দিয়ে বলল, আহা রে, তক্তা বানাবে, আহ্লাদ আর কী। বললেই হল। এই কুড়ুলটা দেখছিস না? গোটা গ্রামের লোক এলেও সামলে দেবে। তুই বা অত ভয় পাচ্ছিস কেন? করাতটার ধার কমে গেছে নাকি? শুধু একবার তুলে দেখাবি, তা হলেই সব পালাবে। তা ছাড়া এত কাঠ কি তোর ঘাড়ে করে নিয়ে যাব ভেবেছিস? গাধা কোথাকার। জলে ভাসিয়ে ওপারে নিয়ে গেলেই ব্যস, কেউ টিকিও ছুঁতে পারবে না। আর এই কাজটা যদি ঠিকমতো হাসিল করতে পারি তা হলে একেবারে কেল্লা ফতে। এদিককার সবকটা গাছকে কেটে নিয়ে যাব।

অত লোভ করবেন না। ছোট কাঠচোর আছেন, ছোটই থাকেন। বড় চোর হতে গেলে অনেক হ্যাপা। এই জায়গাটা লোকজন কম বলে নিশ্চিন্তে কাজ করা গেল। সব জায়গায় হবে নাকি? তা ছাড়া গাছ তো কাটলেই হবে না, পাচার করতে হবে। সেটা একবার চিন্তা করেছেন? লোভের হল গিয়ে এই একটা দোষ। চিন্তাভাবনা থাকে না, মাথার মধ্যে শুধু লোভ থাকে।

প্যান্ট-পরা লোকটা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, চুপ কর। এক্কেবারে চুপ কর দেখি। হুঁ, ব্যাটা আমারে জ্ঞান দেয়। আমার সব ভাবনাচিন্তা করা আছে। এই জায়গাটা কি এমনি এমনি বেছেছি ভাবছিস। এই ছোট্ট ঘাটটা দারুণ। ঠিক যেন আমাদের জন্য কেউ বানিয়ে রেখেছে। কাঠ পাচারের কাজ এখান দিয়েই হবে। গাছ কাটব আর দড়ি দিয়ে বেঁধে ভাসিয়ে দেব। ভাসতে ভাসতে ওপারে পৌঁছোলে ঝপাঝপ তুলে নেব। কেউ বুঝতেই পারবে না। হা হা।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধের আলো এসে পড়েছে। প্যান্ট-পরা লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে ঘোতনের। এই গ্রামেই দেখেছে মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গেরটা কে? নদীর ওপার থেকে এসেছে? যে-ই হোক না কেন, এরা দু’জনে মিলে খুব খারাপ একটা কাজ করেছে। অত সুন্দর গাছটাকে কেটে ফেলেছে। ঘোতনের খুব খারাপ লাগছে। দিনের পর দিন সে এই গাছটার তলায় কত না সময় কাটিয়েছে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে কোনও কোনও দিন ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। পাখিরাই আবার চেঁচামেচি করে তুলে দিয়েছে তাকে। পড়িমড়ি করে বাড়ির দিকে ছুটেছে। আসলে গাছটা তার বন্ধু ছিল।

হঠাৎ প্যান্ট-পরা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় হিসহিস করে বলল, অ্যাই, ঝোপের আড়ালে কে রে? বেরিয়ে আয়। বেরিয়ে আয় বলছি। বাসুদেব করাতটা নিয়ে আয় তো। দ্যাখ তো কে লুকিয়ে আছে।

লোকটা দু’পা এগিয়ে এল। বাসুদেব ডাক শুনে লুঙ্গি-পরা লোকটাও গাছের গুঁড়ি ছেড়ে চট করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর করাতটা বাগিয়ে ধরে এগিয়ে এল ঝোপটার দিকে। বলল, কোনদিকে বিশুদা?

ঘোতন কী করবে? সে কি চিৎকার করবে? কোনও লাভ হবে না। নদীর পাড়ে এই জায়গাটা সবচেয়ে ফাঁকা। তার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না। আর শুনলেই বা কী হবে? ঘোতনের মতো একটা সামান্য ছেলের চিৎকারে উসুলপুরের মানুষ একেবারে পড়িমড়ি করে ছুটে আসবে সে-কথা ভাবাটাও বোকামি। ঘোতনের ভয় করছে। কাঠচোরদুটো তাকে মেরে ফেলবে না তো?

গুটি গুটি পায়ে ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এল ঘোতন। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, আমি, আমি ঘোতন।

এরকম একটা ছোট ছেলের জন্য এতখানি ভয় পাওয়ায় লোকদুটো বোধহয় লজ্জা পেল। বিশুদা নামের ষণ্ডাটা দু’পা পিছিয়ে ফের কাটা গাছের গুঁড়ির উপর ধপাস করে বসে পড়ল। বলল, ঘোতন? ঘোতনটা কে?

আমি বিশ্বনাথ দামের ভাগনে শ্রীমান ঘোতন।

কী? শ্রীমান ঘোতন? বাসুদেব নামের লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, তা শ্রীমান ঘোতন, তুমি বুঝি খুব ঘোঁত ঘোঁত করো? তাই বুঝি তোমার নাম ঘোঁতন? চিমসেটার হাসি আর কথা শুনে ঘোতনের শরীরের ভিতর কেমন যেন হচ্ছে! কী হচ্ছে? জ্বরটা আবার আসছে নাকি?

প্যান্ট-পরা ষণ্ডাটা জোর এক ধমক দিয়ে বলল, তুই এখানে কী করছিলি? লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলি?

আমি রোজ এখানে বেড়াতে আসি।

এইটুকু ছোকরা, এত রাতে নদীর ধারে বেড়াতে আসিস কী করে? মিছে কথা বললে মারব একটা থাপ্পড়। মনে হয় চড়থাপ্পড় বহুদিন কপালে জোটেনি। তাই না?

খানিক আগেই খেলার মাঠে পটলের থাপ্পড় খেয়ে এসেছে ঘোতন। সে চুপ করে রইল। গাছ কেটে এত বড় একটা অন্যায় করেছে লোকগুলো, তার উপর আবার হম্বিতম্বি করছে! ঘোতনের রক্তের ভিতর দিয়ে কী যেন একটা শনশন করে ছুটছে! কী ছুটছে? মাথাটা গরম গরম লাগছে কেন?

বাসুদেব নামের লোকটা বলল, ভালই হয়েছে ওস্তাদ, ঘোতন যখন এসেই পড়েছে তখন ওকে কাজে লাগিয়ে নিন। অন্ধকার নামল বলে। আর এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।

বাঃ, আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে তোরও একটু বুদ্ধি বেড়েছে দেখছি। অ্যাই ছোকরা, হাত-পা গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এই নে দড়ি। কাঠের টুকরোগুলো ঝটপট বেঁধে ফেল দেখি। চার আনা পয়সা পাবি।

ঘোতন মাথা নামিয়ে বলল, আমার পয়সা লাগবে না।

বাসুদেব নামের লোকটা আবার খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। বলল, বাবা, পয়সা লাগবে না? পয়সা লাগবে না কেন ঘোতনবাবু? আপনি কি এই গ্রামের সম্রাট? তারপর চোখ পাকিয়ে বলল, এক্ষুনি কাজ শুরু কর, নইলে এই গুঁড়িটার সঙ্গে তোকেও বেঁধে নদীর জলে ফেলে দেব।

ধমক, মার, হুমকি আর কাজ নিয়ে ঘোতনের ভাবলে চলে না। সামান্য কয়েকটা কাঠের টুকরো বেঁধে ফেলা তার কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। অন্যের বাড়িতে যাকে আশ্রিত থাকতে হয় তাকে এর থেকে ঢের শক্ত কাজ করতে হয়। ঘোতনও করে। তবে আজ তার এমন হচ্ছে কেন? মাথা নামিয়ে সে কাঠের টুকরোগুলো জড়ো করে বাঁধছে ঠিকই কিন্তু তার গা হাত পা জ্বালা জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে তার প্রিয় বন্ধুকে কারা যেন টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছে। সেই টুকরোগুলো তাকে জড়ো করতে হচ্ছে।

দুটো চোখ কট কট করে উঠল ঘোতনের। সে হাত দিয়ে মুছল। আবার কট কট করে উঠল। চোখে কিছু পড়েছে নাকি? কই, না তো! কিছু তো পড়েনি!

উসুলপুরের সন্ধেবেলাটা ভারী সুন্দর। নদীর যেদিকে সূর্য ডুবে যায় সেখান থেকে চাপা একটা হলুদ আলো আকাশে ছড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। ছেলেমেয়েদের ডাকাডাকি করতে করতে পাখিরা ঘরে ফেরে ডানা ঝাপটে। ঘরে ঘরে শাঁখ বাজে। হারিকেন, হ্যাজাক জ্বলে ওঠে।

ঘোতন যতক্ষণ কাজ করল পাজি লোকদুটো বসে বসে বিড়ি টানল। তারপর গাছের গুঁড়িটাকে ঠেলতে ঠেলতে নদীর পাড়ে সিঁড়ির কাছে নিয়ে এল নিঃশব্দে।

বাসুদেব বলল, ওস্তাদ, নদীতে আপনার কুমিরটুমির নেই তো?

ওস্তাদ প্যান্ট গুটিয়ে বলল, খেপেছিস! এইটুকু জলে কুমির! আগে গুঁড়িটাকে ভাসিয়ে দে। তারপর কাঠগুলোকে নামা। দেখিস, শব্দ যেন না হয়।

বাসুদেব সিঁড়ি দিয়ে জলে নেমে দাঁড়াল। বলল, ইস, কী ঠান্ডা! পরেরদিন একটা টর্চফৰ্চ আনবেন কিন্তু।

গাছের গুঁড়িটাকে টেনে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে দিল গুন্ডাটা। ফিসফিস করে বলল, চুপ কর হতচ্ছাড়া। তাড়াতাড়ি কর। অ্যাই ছোকরা, তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা পালা। দাঁড়া, এই নে। পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে ছুড়ে দিল ঘোতনের দিকে। পায়ের কাছে পড়ে ঠং করে শব্দ হল। লোকটা বলল, পরশু আসবি। আরও পয়সা পাবি। যা পালা।

এই অন্ধকারেও মাথার উপর দিয়ে ক’টা পাখি ঘুরপাক খেয়ে গেল। আহা রে, বেচারিরা নিশ্চয়ই ঘর খুঁজে পাচ্ছে না। পাবে কী করে? গাছটাই তো কেটে ফেলা হয়েছে।

ঘোতনার দেরি হয়ে গেছে। তা ছাড়া সে বুঝতে পারছে তার কিছুই করার নেই। এই দুষ্ট লোকগুলোর খপ্পর থেকে যখন ছাড়া পেয়েছে তখন ছুটে পালানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু তার এ কী হল! সে যে নড়তে পারছে না! পা দুটো মনে হচ্ছে গাছের শিকড়ের মতো মাটিতে ঢুকে গেছে। কানের মধ্যে শোঁ শোঁ করে শব্দ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, চোখ। এই অন্ধকারেও সে লোকদুটোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে! ওই যে সিঁড়ির উপর ষণ্ডাটা দাঁড়িয়ে আছে। চিমসেটা গাছের গুঁড়িটাকে টানছে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে।

ঘোতন চোখের পাতা টানটান করে মেলে ধরল। বড় করে, আরও বড় করে।

অত বড় গুঁড়িটা পড়ল প্রথমে। জলে শব্দ হল, ঝপাস। আবার শব্দ হল। গুঁড়ির টানে এবার পড়েছে প্যান্ট-পরা ষণ্ডামার্কাটা। বাসুদেবটাকে তো দেখাই যাচ্ছে না! ঘোতন চিন্তিত মুখে নদীর দিকে এগিয়ে গেল কয়েক পা। তার প্রিয় সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ নেমে এল। জলের তলা দিয়ে চিঁচিঁ ধরনের একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গাছের গুঁড়ি ঘাড়ে পড়লে মুখ দিয়ে চিঁচিঁ আওয়াজ বের হয় নাকি? আর মোটাটার কী অবস্থা? তার ঘাড়ে কিছু হল নাকি? না, না, ঘাড়ে কিছু হয়নি। ওই তো জলে খাবি খাচ্ছে। কিন্তু উঠতে পারছে না। মনে হয়, পা দুটোই ভেঙেছে।

ঘোতনের একটু দুঃখ হচ্ছে। তার আগে থেকেই লোকদুটোকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল। ওইটুকু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা কি সহজ কথা? তার উপর সঙ্গে যদি চুরি-করা অতবড় একটা জিনিস থাকে।

আর না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঘোতন বাড়ির দিকে ছুট লাগাল।

ঘোতনের তাড়াহুড়ো দেখে মনে হচ্ছে, সে বাড়ি ফিরে, মুখ-হাত ধুয়ে পড়ার বই খুলে বসবে। পাশে থাকবে ছুটকিদিদি। মামিমা একটা বাটিতে খানিকটা মুড়ি আর গুড় দিয়ে যাবেন। বলবেন, ভাই বোনে মিলে খা। পড়তে পড়তে ঘোতন দু’মুঠো মুড়ি আর এক কামড় করে গুড় খাবে। ছুটকিদিদি চোখ পাকিয়ে বলবে, অ্যাই ঘোতন, এক কামড়ে অতটা গুড় খাচ্ছিস কেন রে? পড়তে পড়তে একসময় ঘুম ঘুম পাবে। উঠে গিয়ে চোখে জল দিয়ে এসে আবার পড়তে শুরু করবে ঘোতন। মামিমা রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে ডাকবেন, অ্যাই ঘোতন, অ্যাই ছুটকি খেতে আয়। রুটি হয়ে গেছে। ছুটকিদিদি পড়িমড়ি করে দৌড়োবে। যোতন আস্তে ধীরে বইখাতা গুছিয়ে উঠবে।

আসলে কিন্তু সেরকম কিছুই হবে না।

পড়াশোনা করতে নয়, বাড়ি ফিরে ঘোতন বসে যেত কাঠ চিরতে আর কয়লা ভাঙতে। সেই কাঠ, কয়লা আর ঘুঁটে দিয়ে উনুন সাজায়। উনুনে আগুন দিয়ে জোরে জোরে হাওয়া দেয়। উনুন ধরার সময় ভক ভক করে সাদা ধোঁয়া বের হয়। ধোঁয়ার জ্বালায় ঘোতনের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। গড়াতেই থাকে। অনেকক্ষণ জল গড়ালেও কোনও অসুবিধে নেই।

তিন বছর আগে কিন্তু এরকম ছিল না। তখন সত্যি সত্যি ঘোতন সকালবেলা স্কুলে যেত। তার হাতে থাকত দুটো টিনের সুটকেস। একটা তার নিজের, অন্যটা ছুটকিদিদির। ছুটকিদিদি হাঁটত সামনে সামনে। সে একদম স্কুলে যেতে চাইত না। মামিমা তাই রোজই তার হাতে কিছু-না-কিছু লোভনীয় জিনিস ধরিয়ে দিত। কোনওদিন পাকা পেয়ারা, কোনওদিন কুলের আচার, কোনওদিন লাড্ডু। ছুটকিদিদি খেতে খেতে হাঁটত। ঘোতনের জিভে জল আসত। মনে মনে ভাবত, ভালই হয়েছে। ভাগ্যিস, মামিমা তাকে কিছু দেন না। দিলে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হত। সে খেত কী করে? তার তো মোটে দুটো হাত। দুটো হাতেই সুটকেস ধরা। তা হলে খাবে কোন হাত দিয়ে? মামিমা নিশ্চয়ই অনেক ভেবেচিন্তেই তাকে কিছু খেতে দেন না। কিন্তু তাকে তো স্কুলে যেতে দেন, সেটাই অনেক বড় কথা।

উসুলপুর বাজারের গায়ে স্কুল। উসুলপুর রমাকান্ত স্মৃতি বিদ্যালয়। পাকা ঘর, মাথায় টালির চাল। বড় বড় জানলা। টানা বারান্দা। বারান্দা থেকে নামলে খেলার মাঠ। মাঠের পাশে একফালি ফুলের বাগান। ভারী সুন্দর। সমস্যা হল স্কুলে ঘর একটাই। সেই একটা ঘরেই ভাগাভাগি করে ক্লাস হয়। আবার কোনও কোনও সময় একসঙ্গে তিন-চারটে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ঘর আর বারান্দায় ছড়িয়ে বসে। যেদিন শুধু ঘরে স্কুল হয় সেদিনটাকে ছেলেমেয়েরা বলে ‘আজ ঘর-স্কুল’। আর যেদিন ঘরে আর বারান্দায় মিলিয়ে ক্লাস হয় সেদিনটাকে বলা হয় ‘ঘরবারান্দা-স্কুল’। ঘরবারান্দা-স্কুলের দিনটা গোলমেলে দিন। মাস্টারমশাই কখনও ঘর, কখনও বারান্দায় ঘুরে ঘুরে পড়ান। তিনি ঘরে ঢুকলে বারান্দার ছেলেরা গোল্লাবল খেলতে শুরু করে। গোল্লাবল হল কাগজের বল বানিয়ে ছোড়াছুড়ি। ঘরে-বসা ছেলেরা সাধারণত তেমন ঝামেলা করে না। সেখানে গোলমাল পাকায় মেয়েরা। মাস্টারমশাই হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় গেলেই তারা চিমটিযুদ্ধ লাগায়। চিমটিযুদ্ধ খুব ভয়ংকর জিনিস। সত্যিকারের যুদ্ধে গায়ে গুলি বোমা লাগলে চিৎকার আর্তনাদ করার নিয়ম আছে। কিন্তু চিমটিযুদ্ধে সেই নিয়ম নেই। সবাইকে চুপ করে চিমটি হজম করতে হবে।

এরকম একটা ঘরবারান্দার-স্কুলের দিনে ঘোতনদের নতুন ক্লাসে উঠবার ফল বের হল।

কাচুমাচু মুখে বাড়ি ফিরল ঘোতন। খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে সে। ক্লাস টু থেকে থ্রি-তে উঠতে গিয়ে ফার্স্ট হয়েছে। অন্যদিকে ছুটকিদিদির ওঠার কথা ছিল ফাইভে। সে সেলাই বোনা ছাড়া সব বিষয়ে ফেল। মাস্টারমশাই ফলের কাগজ হাতে দেওয়ার সময় বলেছেন, খুকি, তুমি কাল বাবাকে দেখা করতে বলবে। আমার মনে হয় না স্কুলে এসে তোমার মোটেই সময় নষ্ট করা উচিত। তুমি বাড়িতে বসে সেলাই বোনায় মন দাও।

বাড়ি ফেরার পর ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে মামিমার হাসিহাসি মুখ আরও হাসিহাসি হয়ে গেল। মামাকে বললেন, স্কুল না ছাতা। ছেলেমেয়েদুটোকে এখানে পাঠিয়ে আর কাজ নেই। স্কুলের আসল পরিচয় হল তার ফলাফলে। যে-স্কুলে ফলাফলে গোলমাল, সেই স্কুলে সবে গোলমাল। আমার মেয়ে ফেল করেছে এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল ঘোতনার ফার্স্ট হওয়া। ঘোতনের মতো গবেট মাথার ছেলে যদি ফার্স্ট হয় তা হলে সেই স্কুলে ওকে পাঠানোও যা, হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়াও তা। ভাল ছেলে পরীক্ষায় যেমন ভাল করবে, তেমনিই গাধা ছেলে পরীক্ষায় গাধা ফল করবে। তুমি কী বলো?

মামিমার সব কথাতেই সায় দেন মামা। দেখলে মনে হয় মামিমা যা বলছেন, সেই কথাটা মামা বলবেন বলে অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। আজও তাই হল। মামা ঘাড় নেড়ে বললেন, ঠিকই বলেছ। একেবারে ঠিক কথা। মামিমা বললেন, উঁহুঁ, এটা তোমার বড্ড বাজে স্বভাব। আমি যে ঠিক বলেছি তার প্রমাণ কী? ধরো, গবেট বলে ঘোতনের স্কুলে পড়া তুমি বন্ধ করে দিলে, তারপর এই ছেলেই একদিন বলবে, অনাথ ভাগনেকে না-পড়িয়ে তুমি খুবই খারাপ কাজ করেছিলে। সেদিন তুমি কী উত্তর দেবে? তোমার কাছে কোনও উত্তর আছে?

মামা আবার ঘাড় নেড়ে বললেন, আশ্চর্য তো, এটাও তুমি ঠিক কথা বলেছ! একেবারে ঠিক কথা। তা হলে?

এমন সময় ছুটকিদিদি বলল, মা, তোমরা ঝগড়া পরে করবে। আগে আমাকে খেতে দাও। খিদে পেয়েছে। খেতে দেবে কিনা বলো?

মামিমা একমুখ হেসে বললেন, নিশ্চয়ই খেতে দেব মা। একটু অপেক্ষা করো মা, একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। খাওয়াদাওয়া তারপর হবে। হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম— ঘোতন যে গবেট সেটা এখনই গরম গরম দেখে নেওয়া ভাল, তাই না? তাতে কী হবে জানো, তাতে আমরা নিশ্চিন্ত মনে আজ থেকেই ওর স্কুলযাত্রা বন্ধ করে দিতে পারব। মনে কোনও খুঁতখুঁত থাকবে না। ঘোতনও জানতে পারবে না কেন ওকে স্কুলে যেতে হয় না। বোকা ছেলেকে যে-স্কুল পরীক্ষায় ফার্স্ট বানায় সেখানে যাওয়াও যা, না যাওয়াও তাই। আমি ঠিক বলছি না?

ঠিক বলেছ। একেবারে ঠিক কথা। কিন্তু কেমন করে প্রমাণ হবে?

মামিমা আবার একমুখ হেসে বললেন, সে আমার ব্যাপার। এখুনি সব জলের থেকেও স্পষ্ট হয়ে যাবে। আচ্ছা, ছুটকি, তুই নামতা শিখেছিস?

ছুটকিদিদি মুখ বাঁকিয়ে বলল, তুমি আবার পড়া ধরতে শুরু করলে কেন?

আহা, রাগ করিসনি ছুটকি। রাগ করিসনি। পড়া ধরব কেন? তুই শুধু বল নামতা শিখেছিস কি না।

মামা বললেন, বল না, লজ্জা কীসের বল, বল।

ছুটকিদিদি ফের মুখ বেঁকিয়ে বলল, ওমা, লজ্জা করব কেন? একশোবার নামতা শিখেছি, হাজারবার নামতা শিখেছি। সন্ধেবেলা গলা ফাটিয়ে আমি কী পড়ি? শুনতে পাও না, কালা নাকি? নামতাই তো পড়ি। কী রে, চুপ করে আছিস কেন? বল, বল নামতা পড়ি না? কালই তো তেরোর নামতা পড়লাম।

ঘোতন লম্বা করে মাথা নাড়ল।

মামিমা বললেন, বাঃ, আচ্ছা বল তো ছুটকি সাত তেৱোং কত হয়?

সাত তেরোং? সাত তেরোং তো? কী বললে সাত তেরোং? দাঁড়াও বলছি। এটা কোনও নামতা হল? সাত এক্কে সাত, সাত দুগুনে চোদ্দো, তিন সাত্তে একুশ, চার সাত্তে, চার সাত্তে, চার সাত্তে, চার সাত্তে…। যাক, চার সত্তেটা ভুলে গেছি। ছেড়ে দাও মা, একটা ভুললে কিছু এসে যায় না। পাঁচ সাত্তে তিরিশ, ছ’সাত্তে চল্লিশ, সাত সাত্তে হল গিয়ে তোমার ঊনচল্লিশ… এরকম করে গিয়ে তোমার সাত তেরোং, সাত তেরোং ছাপান্ন।

মামিমা বললেন, ঠিক আছে ছুটকি, তুই চুপ কর। এবারই আসল পরীক্ষা। ঘোতনের গবেট পরীক্ষা। ঘোতনা, সাত তেরোং কত হয় তুম কি জানো বাবা?

ঘোতন একমুখ হেসে বলল, আমাদের ক্লাসে পড়ানো হয়নি, কিন্তু আমি জানি মায়েমা। ছুটকিদিদির পড়া শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। বলব মায়েমা?

মামিমা মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলে তুমি? দেখলে গাধাটার গাধামি? দাঁড়াও, আরও দেখাচ্ছি। ঘোতনা বল তো।

মায়েমা, সাত তেরোং হল গিয়ে একানব্বই। ছুটকিদিদি পাঁচ সাত্তে, ছয় সাত্তে, সাত সাত্তে ভুল বলেছে। আমি ঠিক করে দেব?

মামিমা একগাল হেসে বললেন, না, না, আর ঠিক করতে হবে না। এই যথেষ্ট হয়েছে। তুমি যে কত বড় গবেট তা বাবা আমরা এতেই বুঝে গেছি। যে বাড়ির খাচ্ছ, পরছ, থাকছ, সে-বাড়িরই মেয়ের নামতার ভুল ধরছ। বাঃ, বড় গবেট না হলে কি এরকম কেউ করে? কেউ করে না। থাক বাবা, যে-স্কুলের মাস্টাররা এই সামান্য জিনিসটুকু বুঝতে পারে না সে স্কুলে আর গিয়ে কাজ নেই। তুমি বাবা দুঃখ কোরো না। ওখানে গেলে যে তোমার নিজেরই বড় ক্ষতি সেটা বুঝতে পারছ তো?

ঘোতন মাথা নেড়ে বলল, বুঝতে পারছি মায়েমা।

সেই থেকে স্কুল বন্ধ। সন্ধেবেলা পড়তে বসা বন্ধ। এখন সন্ধেবেলা উনুন ধরাও, আটা মাখো, রুটি সেঁকো। দিনেদিনে রুটি বানানোতে ঘোতন বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে। প্রথম দিকে টেরাবেঁকা হত। এখন একেবারে গোল।

হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িতে ঢুকে ঘোতন দেখল, ছুটকিদিদি উনুনের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছে। হাতে হাতপাখা। উনুনে হাওয়া করে করে তার হাত টনটন করছে। আজ কয়লা কেমন ভিজেভিজে ছিল। তাই পাখাও নাড়তে হয়েছে বেশি। জ্বলন্ত উনুনের আঁচ আর রাগ মিলে ছুটকির মুখ গনগনে লাল। রাগ হওয়াটা অন্যায় কিছু নয়। বাড়ির কাজকর্ম করার অভ্যেস তার অনেকদিনই চলে গেছে। বয়েসে ছোট হলে কী হবে, ঘোতনই একা হাতে সব সামলায়। ঘোতনের দেরি হওয়ার জন্যই আজ তাকে উনুন ধরাতে হয়েছে। খুব বিচ্ছিরি একটা কাজ। হাত নোংরা হয়ে যায়। চোখে ধোঁয়া ঢোকে।

ঘোতন কাঁচুমাচু মুখে বলল, দেরি হয়ে গেল দিদি। তুমি সরো, আমি দেখছি।

ছুটকিদিদি চোখ পাকিয়ে বলল, কোথায় গিয়েছিলি? খেলতে? তোর না পরশু রাতে জ্বর এসেছিল? তুই আজ খেলতে গেলি কোন আক্কেলে?

ঘোতন চুপ করে রইল। সে মারের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঠিক কোন ধরনের মার হবে সেটা বুঝতে পারছে না। কিল, চড় না পিঠের উপর হাত পাখার বাড়ি?

চুপ করে আছিস কেন? কয়লা না-ভেঙে কেন গিয়েছিলি মাঠে? বলতে বলতে হাতপাখা ঘুরিয়ে ঘোতনের পিঠে জোরে এক ঘা বসাল ছুটকি। তারপর বলল, সেদিনের কথা ভুলে গেছিস নাকি? সেই যে গরম চ্যালাকাঠ দিয়ে মা হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছিল, ভুলে গেছিস সে-কথা? আজ আবার দিতে হবে?

হাতপাখার ঘা খেয়ে ঘোতনের কিছু হয়নি, কিন্তু ছ্যাঁকার কথা মনে করিয়ে দিতেই ঘোতনের ভিতরে হঠাৎ কী যেন একটা হতে শুরু করল। কেমন যেন একটা অস্বস্তি। শরীরটা ভারী হয়ে আসছে। কী হচ্ছে ঘোতন বুঝতে পারছে না। পিঠের বাঁ পাশে শিরশির করছে। চোখে মনে হচ্ছে উনুনের ধোঁয়া ঢুকে গেছে। চোখ বুজতে চেষ্টা করল ঘোতন। পারছে না। ঘোতন খুব চেষ্টা করছে চোখের পাতা ফেলতে, খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। জোর করে কে যেন তার চোখদুটো খুলে রেখেছে। দু’চোখের মণি আটকে গেছে। সে একদৃষ্টিতে তার মামাতো দিদির দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টি গভীর এবং ঠান্ডা।

অল্প কিছুক্ষণ পরেই ফ্যান ফেলতে গিয়ে গরম ভাতের হাঁড়ি উলটে গেল। ছুটকিদিদির ডান হাতের উপর গরম ফ্যান পড়ে পুড়ে গেল অনেকটা। ছুটকিদিদি লাফাচ্ছে আর বলছে, জ্বলে গেলুম, পুড়ে গেলুম।

মামিমা ঘরে ছিলেন। মেয়ের চিৎকার শুনে ছুটে বেরিয়ে এলেন। তারপর ছুটকিদিদির চেয়েও বেশি লাফাতে লাগলেন। হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকারও জুড়ে দিলেন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ছুটকিদিদির নয়, হাত পুড়েছে মামিমার।

ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটেছে আজ ভোরে। খুব ভোরে। তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি।

রাতে ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল, তাড়স দিয়ে জ্বর এসেছে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে ঘোতন দেখল, জ্বরটর নেই বরং বেশ ঝরঝরে লাগছে। এই সময়টা ঝরনা নদীর দিক থেকে একটা শিরশির হাওয়া আসে। ভারী সুন্দর লাগে সেই হাওয়া। ঘোতন এ-বাড়ির কেউ নয়, সামান্য একজন আশ্রিত মাত্র, তবু বারান্দায় শোয় বলে নদীর এই সুন্দর হাওয়া প্রথমে তার কাছেই উড়ে আসে। ঘুম ভাঙায়।

বিছানা থেকে নেমে পড়ল ঘোতন। সন্ধের সময়টা যেমন চাপা হলুদ রঙের, তেমনই ভোরের আলোয় একটা নরম সবুজ সবুজ ভাব থাকে। এই আলোয় সবকিছু সবুজ দেখায়। মামিমাকেও দেখাচ্ছে। তবে তাঁকে অবশ্য অন্য কারণে সবুজ দেখাচ্ছে। এই ভোরেই মামিমা খুব সেজেছেন। সবুজ রঙের শাড়ি পরেছেন। হাতে সবুজ চুড়ি, কপালে সবুজ টিপ। আজ তাঁর বোনের বাড়ি নেমন্তন্ন। খুব খাওয়াদাওয়া হবে। কাল রাতে মামিমা বললেন, ছুটকি, তোর আর অতদূর গিয়ে কাজ নেই। অতখানি হাত পুড়ে গেছে। তুই ঘোতনের সঙ্গে বাড়িতে থাক। এ-কথা শুনে ছুটকিদিদি মরাকান্না শুরু করল। ওর এই একটা ব্যাপার আছে। বায়নার জন্য এমনভাবে কাঁদতে শুরু করবে যে, মনে হবে বাড়িতে এইমাত্র কেউ মারা গেল। অবশ্য ভাল ভাল সব খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে, যেতে না-পারলে কান্নাকাটি তো করবেই। মামিমার মনটা খুবই নরম। মেয়ের চোখে জল একদম সহ্য করতে পারেন না। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে, কাঁদিস না। তোকে নিয়েই যাব। আহা রে, বাচ্চামানুষ, ভালমন্দ খাবারের জন্য তো কাঁদবেই।

ছুটকিদিদিও তার মায়ের মতো ভোরবেলাতেই সাজগোজ করে নিয়েছে। মুখে পাউডার লাগিয়েছে। চুলে ফিতে দিয়েছে। সুন্দর লাগছে। শুধু পোড়া হাতটা কেমন যেন বেমানান।

ঘোতন দেখল, মামিমা পা টিপে টিপে খুব সাবধানে উঠোন পেরিয়ে এদিকে আসছেন। সাবধানে হাঁটার কারণ আছে। জল পড়ে পড়ে উঠোনের এদিকটা খুব পিছল। সাবধান না হলেই হড়কে পড়তে হবে।

ঘোতনকে দেখতে পেয়ে মামিমা চিৎকার করে বললেন, এই যে লাটসাহেব, ঘুম ভাঙছে তা হলে? তোমাকে ডাকতেই তো যাচ্ছিলাম। আমরা চললাম। আজ আর খাওয়াদাওয়া নিয়ে একদম বাড়াবাড়ি করবে না। রান্নাবান্নার দরকার নেই। কালকের ভাতে জল দেওয়া আছে, দুপুরে নুন-লঙ্কা দিয়ে সোনামুখ করে খেয়ে নিয়ো। আর শোনো বাছা, দয়া করে আজ বেলা করে খাবে, তা হলে রাতে কিছু না-খেলেও চলবে। ছোট ছেলের অত খাই খাই ভাল নয়। বাপ-মা মরা ছেলে, পেটের ব্যামো হলে কে দেখবে?

ঘোতন চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে মায়েমা! আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আমি দেরি করেই খাব।

চিন্তা করব না কী, চিন্তা না-করে কি কিছু উপায় আছে? তোমার খাদ্য জোগাতে জোগাতে তো মামা ফতুর হয়ে গেল দেখছি।

পিছন ঘুরে মামিমা গজগজ করতে করতে হাঁটতে লাগলেন। মাঝপথে মুখ ফিরিয়ে বললেন, আর এই যে ছোকরা, একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখো বাপু, বাড়ি থেকে কিন্তু একটা পা-ও বেরোবে না। সারাদিন ঘরদোরের ধুলো ময়লা ঝাড়বে, ঘষে ঘষে উঠোনের শ্যাওলা তুলবে, বিছানা রোদে দেবে, বাসনকোসন মাজবে, কুয়ো থেকে জল তুলবে। আর যদি ফিরে এসে শুনি, কাজ না-করে বাইরে খেলতে গিয়েছিলে তা হলে দুটো পা-ই ভেঙে দেব। চলি, আমার দেরি হয়ে গেল।

ধমক দিয়ে মামিমা হাঁটতে লাগলেন হনহন করে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘোতন একদৃষ্টিতে মামিমার চলে যাওয়া দেখতে থাকে। বড় বড় চোখে দেখতে থাকে। খুব বড় বড় চোখে।

পিছল উঠোনে অত জোরে আছাড় খাওয়ার পরেও ঠিক বোঝা যায়নি, মামিমার কতটা লেগেছে। কারণ মামিমার মুখটা যে হাসিহাসি। হাসিমুখে থাকলে ব্যথা সহজে ধরা যায় না। তবে মিনিট কয়েকের মধ্যে বাঁ পা-টা ফুলে ফেঁপে ঢোলকের মতো হয়ে গেল। বোনের বাড়ি যাওয়া মাথায় উঠল। হাসিমুখে মামিমা কাঁদতে লাগলেন। ছুটকিদিদিও কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে চুন-হলুদ গরম করতে ছুটল। আহা, কাঁদবেই তো। অত ভাল ভাল সব খাবার ছিল। এখন বাড়িতে পান্তা ভাত খেয়ে থাকতে হবে।

এর পর ঘোতনকে বাড়ি থেকে তাড়ানো ছাড়া মামিমার আর কীই-বা পথ ছিল? আজ নিজের পা ভাঙছে, কাল মেয়ের হাত পুড়েছে। ছুটকির বাবা ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত না যে তা নয়। কিন্তু সেটা বড় ঝুঁকি হয়ে যাবে। ছোকরা আগামীকাল যে আরও বড় ক্ষতি করবে না কে বলতে পারে? না, এ-ছেলেকে আর বাড়িতে রাখা যায় না।

বাইরে ঠাঠা রোদ। চোখ মেলে তাকানো যায় না। মনে হয়, তাকালেই সর্বনাশ। চোখে ফোসকা পড়ে যাবে। গরমের দাপটে রাস্তা ফাঁকা। মাঠ, ধানখেত পেরিয়ে বাস ছুটছে হুহু করে।

আজ হাটবার। হাটবারে বাস বোঝাই থাকে। তখন মানুষ ছাদে ওঠে। মানুষের সঙ্গে ওঠে ঝুড়ি, বস্তা, সাইকেল আর মুরগি। এমনকী, ছাগলও ওঠে। চলন্ত বাসের ছাদ থেকে তারা অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকায়।

হাটের দিন হওয়া সত্ত্বেও কোনও অদ্ভুত কারণে আজ এই বাসটায় ভিড় কম। ফলে ঘোতন বসবার জায়গা পেয়েছে। একেবারে হাত পা ছড়িয়ে বসবার মতো জায়গা নয়, তবে চেপেচুপে হয়ে যাচ্ছে। পাশের গোঁফওলা লোকটা কটমট করে কয়েকবার তাকাল। মনে হয়, ছেঁড়া জুতো পরা ছেলে পাশে বসায় সে বিরক্ত হয়েছে। ঘোতন আরও একটু সরে বসল।

বাসে চড়বার অভিজ্ঞতা ঘোতনের প্রায় নেই বললেই চলে। সোনারপুর থেকে যখন মামার বাড়িতে এসেছিল তখনকার কথা তার মনে নেই। পরে একবার মামার সঙ্গে বাসে চেপেছিল ঠিকই, কিন্তু কোথায় গিয়েছিল তা জানে না। আর সে-ঘটনাও তার মনে আছে আবছা আবছা। মনে পড়ে, সেই বাসটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করছিল আর ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। একদম ভাল লাগছিল না। একসময় কাঁদতে শুরু করে ঘোতন। মামা বাসেই কষিয়ে এক চড় লাগায়। বলে, চোপ, একদম চোপ, কাঁদবি যদি তো টান মেরে ফেলে দেব।

এই বাসটা কিন্তু আজ ঘোতনের ভাল লাগছে। বাস ছোটার তালে তালে নিশ্চিন্তে পা দোলাচ্ছে। বাঃ, চলন্ত বাসে পা দোলানো তো দারুণ ব্যাপার। এরকম নয় যে সে তার এই দশ বছরের জীবনে আগে কখনও পা দোলায়নি। বহুবারই দুলিয়েছে। গাছের ডালে বসে শুধুমুধু পা দোলানো তার প্রিয় কাজগুলোর একটা। বহু দুপুরই তার সেভাবে কেটে যায়। তবে ছুটন্ত বাসে বসে পা দোলানোর অভিজ্ঞতা ঘোতনের জীবনে এই প্রথম হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এতে অন্যরকম মজা হচ্ছে। দোলনা দোলনা মজা। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তবু দোলনার আরামে চোখ বুজে এল ঘোতনের। ঘুমিয়েই পড়ল সে।

এই যে খোকা, টিকিট দাও।

কনডাক্টরের ঝাঁকুনিতে ধড়মড় করে উঠে বসল ঘোতন। টিকিট। টিকিট কোথা থেকে দেবে? তার কাছে কি পয়সা আছে যে টিকিট কিনবে? এত লোক থাকতে কনডাক্টর বেছে বেছে তার কাছ থেকেই টিকিট চাইতে এল। বাস কনভাক্টরদের ভগবান নিশ্চয় তিন নম্বর একটা চোখ দেয়। সেই চোখ দিয়ে তারা পকেটের ভিতর পর্যন্ত দেখতে পায়। তারপর যার পকেটে পয়সা থাকে না তার কাছ থেকে টিকিট চায়।

ঘোতনকে চুপ করে থাকতে দেখে কনডাক্টরের এবার বোধহয় সন্দেহ হল। সে আর দেরি না করে তুই তোকারি শুরু করল। ধমক দিয়ে বলল, কী হল? চুপ করে আছিস কেন? টিকিট দিবি না? কোথায় যাবি? ঘোতন চুপ করেই রইল। চুপ করে থাকা ছাড়া তার উপায়ই বা কী? কোথায় যাবে সে কি জানে? বাস পেয়ে উঠে বসেছে। কনডাক্টর এবার চোখ পাকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল। বলল, অ্যাই ছোঁড়া, কোথা থেকে উঠেছিস?

ঘোতন বলল, উসুলপুর।

উসুলপুর মানে? উসুলপুর পর্যন্ত তো বাস যায় না। মিথ্যে বলছিস?

প্রথমে বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে এসেছি। তারপর বাস পেয়ে উঠে পড়েছি।

ইঃ, বাস পেয়ে উঠে পড়েছি। মামার বাড়ির আবদার পেয়েছেন। পকেটে ভাড়ার পয়সা নেই, কিন্তু উনি বাস পেয়ে উঠে পড়েছেন।

পাশে-বসা গোঁফওলা লোকটা বোধহয় ঘুমোচ্ছিল। নাকে ফোরত্ করে একটা শব্দ করে বলল, আঃ, এত কতার কী আছে? অ্যাঁ? কতার কী আছে হে? ছোকরাকে কান ধরে নামিয়ে দাও দিকি। রোদে হাঁটলে বিনি পয়সায় বাসে চড়ার মজা টের পাবে। বাবু আবার দেখি তখন থেকে পা দোলায়। ব্যাটা পা দোলানোর নবাব এয়েচেন। যত্তসব ছোটলোক। গাল দেওয়া শেষ করে গোঁফওলা লোকটা আবার চোখ বুজে ফোরত্ ফোরত্ করে নাক ডাকতে লাগল।

ঘন্টি বাজিয়ে সত্যি সত্যি বাস থামিয়ে দিল কনডাক্টর। ঘোতনের হাত ধরে টেনে বলল, অ্যাই ছোঁড়া, নাম। নেমে যা এখানে। ঘোতন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যি লোকটা তাকে নামিয়ে দেবে নাকি? বাসের খোলা জানলা দিয়ে আগুনের হলকা আসছে। রোদ তো নয় যেন আগুন। রাস্তার দু’পাশে খেত শুকিয়ে হলুদ হয়ে আছে। না, না, এরকম একটা জায়গায়, রোদের মধ্যে তাকে কি কখনও নামিয়ে দিতে পারে? আসলে তাকে ভয় দেখাচ্ছে।

কনডাক্টর এবার ঘোতনের হাত ধরে জোরে টান দিল।

বাসের কয়েকটা লোক চেঁচিয়ে বলল, কী রে ছোঁড়া, হলটা কী তোর? নাম, নাম তাড়াতাড়ি। দেখছিস না দেরি হয়ে যাচ্ছে?

ঘোতনকে সত্যি সত্যি নামিয়ে দেওয়া হল।

ঘোতনের নেমে যাওয়া দেখে দু’-পাঁচজন জোর গলায় হেসে উঠল। ভাবটা এমন, দশ বছরের এক বালককে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো মজার ঘটনা খুব কমই পাওয়া যায়।

বাসের সিঁড়ি থেকে কেউ একজন সামান্য ঠেলা দিল। পথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল ঘোতন। কোনওরকমে নিজেকে সামলাল সে। দরজা থেকে দাঁত বের করে কনডাক্টর বলল, যা, টিকিট না দিয়ে বাসে ওঠবার মজা টের পা এবার।

ঘণ্টির আওয়াজ পেয়ে ভোঁস ভোঁস করে অনেকটা কালো ধোঁয়া বের করে বাস আবার রওনা দিল।

ঘোতন দু’হাতে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে চলে-যাওয়া বাসের দিকে তাকাল। কী অদ্ভুত! চোখ ফেরাতে পারছে না কেন? নিজের চোখের ওপর নিজেরই যেন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই তার! পাতা পড়ছে না। চোখ কাঁপছে না। মণিদুটো আঠা দিয়ে কেউ যেন লাগিয়ে দিয়েছে চোখের ঠিক মাঝখানে। মনে হচ্ছে, শুধু চোখ নয়, ঘোতন বুঝি আরও অন্য কিছু দিয়ে তাকিয়ে আছে! তাকিয়ে আছে ছুটে-যাওয়া বাসের দিকে।

ঠিক এমন সময় বিকট শব্দ। কানে তালা লাগার জোগাড়। হুঁশ ফিরল ঘোতনের। চমকে উঠে দু’কানে হাত চাপা দিল। নির্ঘাত বাজ পড়ল। না, বাজ নয়, বাসের টায়ার ফেটেছে। একটা নয়, একসঙ্গে দু’-দুটো চাকা একেবারে কেতরে পড়েছে। টাল সামলে বাস কোনওমতে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার পাশে।

ঘোতন মাথা নামিয়ে হাঁটছে। যে-বাস থেকে তাকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে তার এই দুর্দশা দেখে ঘোতনের আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু তার ভয় করছে। কী হচ্ছে এসব? ফুটবল খেলা পণ্ড হয়ে গেল, দিদির হাত পুড়ে যাচ্ছেতাই ব্যাপার, মামিমা উঠোনে পড়ে কাতরাচ্ছেন। শেষমেষ এই বাসের ঘটনাটাই বা কেমন? চাকা ফাটিয়ে পড়ে আছে। এই ঠাঠাপোড়া রোদে অতগুলো লোকের এখন কী ভোগান্তিটাই না হবে। আর এসব ঘটনা যখন ঘটছে তখন তার চোখের ভিতর কী যেন হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই চোখটা যেন তখন আর তার নিজের থাকছে না, অন্য কারও হয়ে যাচ্ছে।

না, এ ভাল জিনিস নয়। সে মোটেও কারও খারাপ চায় না। বকাঝকা, মারধর আর গলাধাক্কা খেয়েই বড় হচ্ছে সে। কই এমন তো হয়নি কখনও। চোখ জ্বালাও করেনি, শিরদাঁড়া বেয়ে আগুনও নামেনি, মাথাও গরম লাগেনি। এখন মনে হচ্ছে, মামিমা ঠিকই বলেছেন, তার মধ্যে নিশ্চয় ভূত ঢুকেছে। কী হবে তা হলে?

ঘোতন যখন হাটে এসে পৌঁছোল তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। হাটের সময় শেষ। জিনিস গুছিয়ে লোকে ফিরে যাচ্ছে। ভাঙা হাট দেখলে মনখারাপ লাগে। ঘোতনের মনও খারাপ হয়ে গেল। সে কোনওদিন হাট দেখেনি। তার ইচ্ছে হয়েছিল, আজ ঘুরে ঘুরে হাট দেখবে। সে ইচ্ছে পূরণ হল না। ঘোতনের ক্লান্ত লাগছে খুব। হাঁটতে হয়েছে অনেকটা। একটা কোথাও বসতে পারলে ভাল হত।

পথের পাশে ছোটমতো একটা চায়ের দোকান। দাঁড়িয়ে পড়ল ঘোতন। টিনের চাল, দরমার দেওয়াল। দু’-তিনখানা কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসে কেউ ভাঙা কাপে চা খাচ্ছে, কারও হাতে নোংরা প্লেট। তাতে লাল ঘুগনি। উসুলপুর গ্রামের ভিতরেও এরকম দোকান আছে। সেখানেও ঘুগনি পাওয়া যায়। চামচ দিয়ে খেতে হয়। এখানে কিন্তু ঘুগনি খাওয়ার জন্য কোনও চামচ দেওয়া হয়নি। সবাইকে প্লেটে চুমুক দিয়ে খেতে হচ্ছে। সুপ সুপ শব্দ হচ্ছে। বাঃ, ভারী মজা হতো।

ঘুগনির গন্ধ আর শব্দে ঘোতনের পেটে খিদে মোচড় দিয়ে উঠল। কাল রাতের পর পেটে কিছু পড়েনি।

এখানে কিছু খাবার পাওয়া যাবে কি? মনে হয় না পাওয়া যাবে। পকেটে একটাও পয়সা নেই। পয়সা ছাড়া কেন তাকে খেতে দেবে? ঘোতন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল।

একটা ধুমসোমতো মোটা আর কালো লোক একা হাতে দোকান সামলাচ্ছে। ঘোতন কখনও ডাকাত দেখেনি, কিন্তু গল্প শুনেছে অনেক। এই লোকটাকে দেখতে সেই গল্পে শোনা ডাকাতদের মতো। খালি গা। কাঁধে গামছা। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর লাল লাল চোখ। এরকম ভয়ংকর চেহারার লোকেরা মোটেই ভাল হয় না। কোনও দয়ামায়া থাকে না। এ-লোকের কাছে বিনি পয়সায় খাবার চাইলে নির্ঘাত বিপদ হবে। খাবার তো দেবেই না, উলটে ধরে বেঁধে রাখতে পারে। পরে কালীঠাকুরের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দিয়ে দেবে। ডাকাতদের মানুষ বলি দেওয়ার গল্পও ঘোতনের শোনা আছে। এখান থেকে ভালয় ভালয় সরে পড়াটাই মনে হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

কিন্তু আর যে হাঁটা যাচ্ছে না। ঘোতন পালাতে চাইলেও তার পা দুটো নড়বে না কিছুতেই। তারা বসতে চায়। অগত্যা কী আর উপায়? ঘোতন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দোকানের এক কোণে ফাঁকা একটু জায়গা দেখে বসে পড়ল। যা থাকে কপালে। ভেবেচিন্তে এবার একটা পথ বের করতে হবে।

নড়বড়ে একটা বাঁশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘোতন ভাবতে শুরু করল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। খিদে নিয়ে জেগে থাকলে যেমন কষ্ট তেমনই আবার খিদে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে খুব মজা। খিদের ঘুমে ভাল ভাল সব খাবারের স্বপ্ন দেখা যায়। ঘোতন জীবনে বহুবার এরকম স্বপ্ন দেখেছে। সাদা সাদা ভাত, মুগের ডাল, গোল গোল আলুভাজা, মাছের মাথা। শেষপাতে আমড়ার চাটনি। আহা ঘুমের মধ্যেই জিভে জল এসে যায়।

ঘোতন আজ খাবারের স্বপ্ন দেখল না। দেখল চোখের স্বপ্ন। মায়া-ভরা দুটো চোখ। সেই চোখ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। স্বপ্নের মধ্যে মানুষ মজা পায়, খুশি হয়, আনন্দ পায়, দুঃখ পায়, কিন্তু কখনও অবাক হয় না। ঘোতন আজ অবাক হল।

অমন করে কে তাকিয়ে আছে? কার ওই চোখ? ভাসাভাসা মায়া-ভরা চোখদুটো কেনই বা তার দিকে তাকিয়ে অমন মিটিমিটি করে হাসছে?

তবে এ আর কী এমন অবাক হওয়া? অবাক হওয়ার মতো অনেক বড় ঘটনা ঘটল ঘুম ভাঙার পর।

এক কামড় কলা, দু’কামড় পাউরুটি। আবার এক কামড় কলা, দু’কামড় পাউরুটি।

এই পদ্ধতিতে ঘোতন দুটো কলা এবং চার টুকরো পাউরুটি শেষ করে ফেলেছে। তারপর এক গেলাস জল খেয়েছে। বাঁ হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছেছে।

আর কিছু খাবি?

ঘোতন মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ, খাবে। ডাকাত লোকটা এবার এক প্লেট ঘুগনি এনে টেবিলে রাখল। আশ্চর্যের কথা, তার বেলায় ঘুগনির সঙ্গে চামচও এসেছে। এই ধুমসো বিচ্ছিরি লোকটা কি জানে তার কাছে পয়সা নেই? নিশ্চয় জানে না। জানলে ঘুম থেকে তুলে এত খাতির যত্ন করে খাওয়াত না। দুটো চড়, একটা গাঁট্টা দিয়ে দোকান থেকে বের করে দিত। চড়গুলো পাউরুটির জন্য, আর ঘুগনির জন্য গাঁট্টা। চড় দেওয়ার সময় অবশ্য এখনও ফুরিয়ে যায়নি। পরেও দেওয়া যাবে। তবে তখন চড়ে অনেক জোর থাকবে। খাবারের যত দাম, চড়েও তত জোর হবে। তা হোক, রাতের মতো খাওয়া তো হয়ে গেল। সেটাই আসল। পেট ভরা থাকলে মার সহ্য করা আর এমন কী ব্যাপার?

বাইরে অন্ধকার। সন্ধে নেমেছে। বাবা, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে? দোকানও ফাঁকা হয়ে গেছে। দূরে দু’-একটা আলো টিমটিম করছে।

ধুমসো লোকটা কাপ-ডিশ ধুয়ে গোছগাছ সেরে ফেলেছে। গায়ে একটা ফতুয়া পরেছে। তবে সেটার অবস্থাও অনেকটা ঘোতনের কেড্স জুতোর মতো, অনেকগুলো তাপ্পি। দেওয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনটা খুলে লোকটা হাতে নিয়েছে। এই আবছা আলো আর আবছা অন্ধকারে লোকটাকে এখন আর শুধু ডাকাত নয়, ভূতের মতোও লাগছে। ঘোতনের বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল।

ডাকাত-ভূতটা ঘোতনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার নিশ্চয় মারবে। মার খাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হল ঘোতন। চোখ বুজল সে৷ ভূত নরম গলায় বলল, কী রে, পেট ভরেছে? নে ওঠ, সন্ধে হল, বাড়ি যাবি না?

চমকে উঠল ঘোতন। ডাকাতটা বলে কী? চড়ের বদলে নরম গলা। পেট ভরার কথা জানতে চাইছে। ভুল শুনছে না তো? তাই হবে। ভুল শোনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সকাল থেকে যা সব ঘটছে তাতে ভুল শোনার আর দোষ কী? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তো ছোটখাটো কোনও ঘটনা নয়। তার উপর এতটা পথ হাঁটা হয়েছে। শরীরের বড় রকমের ধকল হলে ভুল শোনা তো সাধারণ ব্যাপার, অনেক সময় মানুষের ভুল দেখার ঘটনাও ঘটে। তার মামারই তো হয়েছিল। সেবার কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে মামা আর নিজের বাড়ি চিনতেই পারে না। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না। পথে যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বলে, কী ব্যাপার বিশ্বনাথ, ঘুরে বেড়াও কেন? মামা গদগদভাবে হেসে বলে, এই একটু গ্রামটা ঘুরে দেখি।

গ্রাম ঘুরে দ্যাখো মানে! এই রোদে গ্রাম ঘুরে দ্যাখো?

কত কিছুই তো দ্যাখা হয়। এই দেখেন না কলকাতার চিড়িয়াখানা, গড়ের মাঠ, পাতাল রেল দেখলাম। উসুলপুরে পৌঁছে মনে হল, আহা রে, নিজের গ্রামটাকে তো ভাল করে দেখা হল না।

উঁহুঁ, এ তো ভাল লক্ষণ নয় বিশ্বনাথ। মোটই ভাল লক্ষণ নয়। গ্রাম দ্যাখা বাদ দিয়ে ঘরে যাও। বউরে বলো নুন, লেবু দিয়ে শরবত বানায়ে দিক। এক ঢোকে খেয়ে শুয়ে পড়ে গিয়ে। তোমার মাথায় নিশ্চয় নুন কম হয়ে গেছে। শুনেছি, গরমে নুন শর্ট হয়ে গেলে এইসব আবোলতাবোল ইচ্ছে করে। যাও, যাও, বাড়ি যাও বিশ্বনাথ।

আরে বাড়ি যাও বললেই কি বাড়ি যাওয়া যায়? বাড়িটা তো খুঁজে পেতে হবে। মামা, সারাদিন ধরে এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরে বেড়ায়। শেষ পর্যন্ত পথের মাঝে হঠাৎ মামিমার সঙ্গে দেখা। মামা জোড়হাত করে বলল, কিছু মনে করবেন না দিদিভাই, বিশ্বনাথ দামের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?

বিরাট কেলেঙ্কারি। নিজের বউকে ‘দিদিভাই’ ডাকা কি আর সহজ ব্যাপার? শেষ পর্যন্ত কুয়ো থেকে তুলে মাথায় বালতি বালতি জল ঢেলে সেবার মামার হুঁশ ফেরাতে হয়েছিল। ঘোতন ছুটল ভুজনদাদুর মুদিখানায়। ভুজনদাদু মুদি দোকান চালায়, আবার হোমিওপ্যাথিও করে। মানুষটা বড় ভাল। গ্রামের মানুষজনের অসুখ বিসুখ হলেই ওষুধ দেয়। পয়সাকড়ি নেয় না। জোর করে দিলেও না। ঘোতনকে দুটো শিশি দিয়ে সেদিন বলেছিল, চিন্তার কিসু নাই। খুব খাটাখাটনি হইলে এমন ঘটে। মান্‌সে ভুল শোনে, ভুল দেখে। ওইডা অত ধরতে নাই।

ঘোতনেরও আজ সেরকম হল নাকি? মাথায় জল ঢালতে হবে?

ডাকাতটা একমুখ হেসে বলল, কী রে ব্যাটা, হাঁ করে কী দেখছিস? বাড়ি যাবি না?

ঘোতন তড়বড় করে উঠে দাঁড়াল। ডাকাতরা এমন সুন্দর করে হাসতে জানে? থতমত খেয়ে সে বলল, জানি না স্যার। ঘাবড়ে গেলে মানুষজনকে স্যার বলতে হয়। তার মামার কাছ থেকেই এ জিনিস শেখা।

স্যার। হা হা। স্যার কী রে? আর জানিসই না বা কী? বাড়ি যাবি কিনা সেটাই জানিস না? খুব ঘাবড়ে গেছিস মনে হচ্ছে। হা হা।

ডাকাতটা আবার অন্ধকার কাঁপিয়ে হাসল। বলল, তুই হলি সুবলের ছেলে ঘোতন, তুই আমাকে স্যার ডাকিস কী রে? আমি তোর বাবার বন্ধু রে ব্যাটা। আমি হলাম অমলকাকু। মনে নেই আমাকে? তোর অবশ্য মনে থাকার কথাও নয়। মাত্র দু’-একবার তোদের সোনারপুরের বাড়ি গেছি। সে অবশ্য অনেক আগের কথা। তখন তুই খুব ছোট, এইটুকু। কোলে কোলে ঘুরিস আর হামাগুড়ি দিস। খুব দুষ্ট ছিলি। তোর মা আমায় খেতে দিত, তুই খাবার তুলে পালাতিস। তারপর তোদের সঙ্গে অনেক বছরের ছাড়াছাড়ি। কাজের খোঁজে কত জায়গা ঘুরলাম। বছরখানেক হল ফিরে এই দোকানটা দিয়েছি। কিছুদিন আগে সোনারপুরের দিক থেকে এই হাটে এসেছিল কয়েকজন। আমার দোকানে বসে চা খেল, বিস্কুট খেল। আমি তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা চিনতেই পারল না। গাধার দল, নইলে নিজের গাঁয়ের লোকাকে চিনতে পারে না।

ঘোতন এতই অবাক হয়ে রয়েছে যে তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না মনে হচ্ছে। সে কথা বলতে ভুলে গেছে। এসব নিশ্চয় সত্যি নয়। নিশ্চয় সে এখনও ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙলে দেখবে মামিমা দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি, হাতে গরম লোহার শিক। সেই শিক বাড়িয়ে বলছেন, তোর চোখদুটোই দেখছি যত নষ্টের গোড়া। আয় ঘোতন, তোর চোখদুটো নষ্ট করে দিই।

অমলকাকু ঘোতনের পিঠে হাত রেখে বলল, কত বড় হয়ে গেছিস তুই। বড় হয়ে গেলে কী হবে, তোর মুখ দেখে ঠিক চিনতে পেরেছি। তুই তখন ঘুমোচ্ছিলি। দেখে মনে হল, এটারে যেন চেনা চেনা লাগে। কাছে গেলাম। আরে সুবলের ব্যাটা না? লণ্ঠনটা কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলাম। ঠিক তাই। সেই কপাল, সেই থুতনি। সেই গালের উপর তিল। শেষ পর্যন্ত তুই জাগতে একেবারে নিশ্চিন্তি হলাম। তোর চোখদুটো একেবারে তোর মায়ের চোখের মতো। তোর বাবা-মা কেমন আছে রে? তুই এখানে এলি কার সঙ্গে? হাটে এসে পথটথ হারিয়ে ফেলিসনি তো? মুখ দেখে কেমন কেমন লাগছে।

অমলকাকু ঘোতনের মাথায় হাত দিল। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, কী রে বাড়ি থেকে পালিয়েটালিয়ে আসিসনি তো বাবা?

এতক্ষণে ঘোর কেটেছে ঘোতনের। তবে তার কান্না পাচ্ছে। জোর কান্না পাচ্ছে। বকুনির বদলে আদর পেলে এমন হয় নাকি? কান্না পায়? ভূতের মতো দেখতে এই মানুষটা এত ভাল। নামটাও কী সুন্দর, অমল।

কোনওরকমে কান্না সামলে নিয়ে ঘোতন বলল, হ্যাঁ অমলকাকু, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।

অমলকাকু ধপাস করে বসে পড়ল। বলল, অ্যাঁ বলিস কী। চলে এসেছিস? সর্বনাশ। কেলেঙ্কারি। এইটুকুন ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে এলি? বাবা-মা মারধর করেছে নাকি?

না, তাড়ায়ে দেছে।

তাড়ায়ে দেছে। কে তাড়িয়ে দিল তোকে? তোর বাবা-মা তো এমন মানুষ নয়।

বাবা-মা নয়, মায়েমা তাড়ায়ে দেছে।

বড় রাস্তা ছেড়ে মাঠ। সেই মাঠ পেরিয়েও আধাঘণ্টাটাক হাঁটা। তারপর রেললাইন। রেললাইন পেরোলে স্টেশন। স্টেশনের গায়ে ছোট্ট বাজার। সেখানে গুটিকয়েক দোকান। কেউ হ্যাজাক জ্বেলে বসে আছে। কারও দোকানে হলুদ রঙের টিমটিমে ইলেকট্রিক আলো। বাজার ছাড়িয়ে একটুখানি গেলে অমলকাকুর বাড়ি। বাড়ি না বলে ভাঙাচোরা একটা ঘর বলাই ভাল। সেই ঘরের সামনে লম্বা একটা বারান্দা।

বাড়ির সামনে এসে অমলকাকু থমকে দাঁড়াল। হাতের লণ্ঠনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে আপনমনে বলল, সবই তো শুনলাম ঘোতন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, না-শুনলেই ভাল হত। বড় বিপদে ফেললি রে বাছা। বড় বিপদে ফেললি। এখন তোকে নিয়ে কী করি বল দেখি? তোর কাকিমা আজ তিন বছর ধরে রোগে ভুগছে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারে না। ওষুধ আর ডাক্তারের খরচে একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে মরোমরো হয়ে যায়। তখন আরও কড়া ওষুধ দিতে হয়। সে ওষুধের দাম অনেক। কোনও কোনওদিন মনে হয়, আর পারব না। আর বাঁচাতে পারব না। একটুখানি থামল অমলকাকু। বড় করে শ্বাস ফেলে আবার শুরু করল, ছেলেমেয়েগুলোকে দু’বেলা ঠিকমতো খেতে দিতে পারি না। ওইটুকু দোকান থেকে আর ক’টা টাকা হয়। এর মধ্যে আবার কোথা থেকে তুই এসে জুটলি। তোকে থাকতেই বা দেব কোথায়, খেতে দেবই বা কী? এতটুকু ছেলেকে এসব বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু না-বলে পারছি না। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না বাছা।।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই অমলকাকুকে দারুণ পছন্দ করে ফেলেছে ঘোতন। খারাপ দেখতে একটা মানুষ এত ভাল হতে পারে? মনে হচ্ছে, অমলকাকু কতদিনের পরিচিত। সে বলল, তুমি কোনও চিন্তা কোরো না কাকু। আমি কাল সকালে উঠেই চলে যাব। তোমাদের কোনও অসুবিধে হবে না।

চলে যাবি। কোথায় যাবি? মামাবাড়ি ফিরে যাবি?

যেতেও পারি। তবে একটা সমস্যা আছে।

মানুষটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একগাল হেসে বলল, কোনও সমস্যা নেই। আমি নিজে উসুলপুর গিয়ে তোকে দিয়ে আসব। যতই হোত নিজের মামা-মামি তো। আচ্ছা, ওদের না হয় বলে দিয়ে আসব, আই খবরদার কেউ আমার ভাইপোর গায়ে হাত দেবে না বলে দিলাম। আমার চেহারাটা দেখেছ তো? একেবারে ডাকাতের মতো কিন্তু। গায়ে হাত দিলে সমস্যা আছে। সবাই ভয় পেয়ে যাবে। ভাববে, ওরে বাবা, ডাকাতের ভাইপোকে মেরে কাজ নেই। হা হা।

ঘোতনও হাসল। অমলকাকু জানে না, মারধর তার কাছে কোনও সমস্যা নয়, সমস্যা হল চোখ। জ্বালাতন শুরু করেছে চোখদুটো। মামা-মামিকে দেখলে আবার যে কী করে বসবে। এসব কথা এখানে বলা যাবে না। বলা গেলেও বোঝানো যাবে না। তাই সে হাসছে। ঘোতনের হাসি দেখে অমলকাকু আরও হাসছে।

বাড়িতে ঢুকতেই দু’জনের হাসি থেমে গেল। পায়ের শব্দে বাচ্চা একটা মেয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর অমলকাকুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা, মা মরে যাচ্ছে।

সে কী রে মণি! বলছিস কী? মরে যাচ্ছে মানে।

মণি নামের মেয়েটি নাক টানতে টানতে বলল, হ্যাঁ বাবা। খুব নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে আর হেঁচকি তুলছে। বেটু বলছে, মা এখুনি মরে যাবে। মরে যাওয়ার আগে মানুষ হেঁচকি তোলে। মা-ও তুলছে।

অমলকাকু হন্তদন্ত হয়ে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকল। পেছনে ঘোতন।

আবছা অন্ধকার ঘর। ভ্যাপসা একটা অসুখ-অসুখ গন্ধ। এ বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই। দেওয়ালে হ্যারিকেন ঝোলানো। দপদপ করছে। মনে হয় তেল কমে এসেছে।

ঘরের এক কোণে একটা তক্তাপোশ পাতা। সেখানে গলা পর্যন্ত কাঁথা দিয়ে কেউ একজন শুয়ে আছে। কোনও শব্দ নেই। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, মানুষটা হাঁপাচ্ছে। তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে একটা পেতলের গেলাস। সম্ভবত জল খাওয়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে। অন্ধকারে এদের কারও মুখই তেমন ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তবে ভীষণ ভয় পেয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, কারণ তারা কেউই নড়াচড়া করছে না। ছোটরা ভয় পেলে স্থির হয়ে যায়।

ঘোতনের খুব খারাপ লাগছে। ইস, খুব বাজে একটা সময় সে এ-বাড়িতে এসে পড়ল। কতগুলো ছোট ছেলেমেয়ের চোখের সামনে তাদের মা মারা যাচ্ছে। তার মা-ও কি তার চোখের সামনেই মারা গিয়েছিল? মনে নেই, কিছুই মনে নেই। ঘোতনের ইচ্ছে করছে, ছুটে পালাই। একটু সুযোগ পেলে সেটাই করতে হবে।

এমন সময় সবচেয়ে বাচ্চা ছেলেটা পিছন দিকে মুখ ঘোরাল। তারপর বাবাকে দেখতে পেয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল।

অমলকাকু ধমক দিয়ে বলল, চুপ, একদম চুপ। কিল দিয়ে মরাকান্না বের করে দেব হতচ্ছাড়া। বাবার বকুনিতে ছেলেটা কয়েক পা পিছিয়ে এল। ঘোতনের পেছনে লুকিয়ে পড়ে জামার হাতাটা চেপে ধরল।

কী রে, তোরা সব মরাকান্না জুড়েছিস কেন? অ্যাঁ, কেন জুড়েছিস? তোদের মা কি মরে গেছে যে, কাঁদছিস? মানুষটা তো এখনও মরেনি। অ্যাই মণি, ওষুধ দিয়েছিস?

মণি বলল, ওষুধ নেই। ফুরিয়ে গেছে।

ওষুধ নেই। কী রে গোবিন্দ, সকালে যে তোকে ওষুধ আনতে বলেছিলাম, মনে নেই? আনিসনি ওষুধ? চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে।

গোবিন্দ নামের ছেলেটি ঘোতনের বয়সিই হবে। বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে মুখ নামিয়ে নিল। অমলকাকু এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির ঘাড় চেপে ধরল। বলল, কী রে, চুপ করে আছিস কেন? এখনই ওষুধ না দিলে তোর মা তো মরে যাবে। তোরা তো ভাল করেই সে-কথা জানিস। নিশ্চয় ভুলে গিয়েছিস।

ঘোতন বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। ছেলেটার ঘাড়ে নিশ্চয় খুব লাগছে। লাগবারই কথা। তার মামা কতবার রেগে গিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরেছে। তখন ব্যথায় মনে হয় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। না, ছুটে পালিয়ে যাওয়ার যে কথাটা সে ভাবছিল সেটা এখন বাদ রাখতে হবে মনে হচ্ছে। তার একটা কিছু করা উচিত। এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়।

ঘোতন এগিয়ে এসে অমলকাকুর হাতটা ধরল। অমলকাকু চমকে উঠে গোবিন্দর ঘাড় থেকে হাত নামিয়ে নিল। বলল, কে রে? ঘোতনের দিকে চেয়ে বলল, ও তুই। তোর কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। হতচ্ছাড়াগুলোর কাণ্ড দেখেছিস। মায়ের ওষুধটা পর্যন্ত এনে রাখেনি।

মণি এবার মুখ খুলল। বলল, বাবা, দাদার কোনও দোষ নেই। দাদা তো ওষুধ আনতে গিয়েছিল।

মণি ঠিকই বলেছে। দাদা ওষুধ আনতে গিয়েছিল। কিন্তু দোকান থেকে তাড়িয়ে দিল।

অমলকাকু গোবিন্দর দিকে ফিরে বলল, তাড়িয়ে দিল! কেন তাড়িয়ে দিল?

গোবিন্দ মাথা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ, তাড়িয়ে দিল। বলল, শোনো খোকা, দোকানে চাল, ডাল ধারে পাওয়া যায়, ওষুধ পাওয়া যায় না। তোমার বাবাকে গিয়ে বলো, গতবারের একশো টাকা এখনও বাকি আছে। তার আগেরবারের টাকাও পুরোটা দেয়নি।

অমলকাকু গম্ভীর হয়ে বলল, আর কী বলল?

গোবিন্দ বলল, আমার সঙ্গে বেটুও গিয়েছিল। আমার কথা বিশ্বাস না-হলে ওকে জিজ্ঞেস করো। কী রে বেটু, বল। বল বাবাকে।

বেটু ঘোতনের থেকে কিছুটা ছোট। সে নাক টেনে বলল, খালি ওষুধের শিশিটা দেখিয়ে বললাম, এবারের মতো এই ওষুধটা দিয়ে দাও। মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওষুধ না-দিলে হয়তো মরেই যাবে। বাবা ফিরে এসে দাম দিয়ে যাবে। দোকানদারকাকু তখন আমার গালে এক চড় মেরে বলল, মরলে মরুক। দাম দিয়ে দেবে না কচু দেবে। যা, ভাগ এখান থেকে।

অমলকাকু ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, নাঃ, আর পারলাম না, আর কোনও আশা নেই। কথাটা বলতে বলতে মাটিতেই বসে পড়ল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল।

ঘোতন মাথা নামিয়ে নিয়েছে। সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। এত বড় চেহারার মানুষটাকে কী অসহায়ই না দেখাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো ফ্যালফ্যাল করে তাদের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখলে মনে হচ্ছে, তারা যেন অপেক্ষা করছে। একটু পরেই তাদের বাবা চোখ খুলবে এবং মাকে বাঁচাবার মন্ত্র বলে দেবে।

পায়ে পায়ে ঘোতন বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। তার মনখারাপ লাগছে। অমলকাকু, গোবিন্দ, মণি, বেটুদের সে ভাল করে চেনেই না। এদের জন্য তার মন খারাপ লাগার কোনও কারণ নেই। তাও লাগছে। এমনকী, চোখ বুজে শুয়ে থাকা মণি-বেটুদের মায়ের জন্যও তার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার। অচেনা অজানা বাড়ির জন্য তার কষ্ট হবে কেন?

ভিতর থেকে মহিলার গোঙানির শব্দ ভেসে এল। এই গোঙানি ঘোতনের চেনা। মামাবাড়ির পাশেই এক বুড়ি থাকত। মারা যাওয়ার আগের দিন সারারাত এরকম আওয়াজ করেছিল। মামিমা তখন বলেছিলেন, জানলা- দরজা ভাল করে দিয়ে দে তো ঘোতন। বুড়িটা মরবার আগে কাঁদছে। মরবার আগে মানুষ কাঁদে? তার বাবা মা-ও নিশ্চয় কেঁদেছিল৷ কাঁদবেই তো। ঘোতনকে ছেড়ে যাচ্ছে, কাঁদবে না।

চাপা ফেঁপানির আওয়াজে ঘোতন ফিরে তাকাল। মণি এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটার একমাথা এলোমেলো চুল। ফ্রকের পাশটা ছেঁড়া। ফোঁপাতে ফোঁপাতে মণি বলল, কী হবে দাদা, মা মরে যাবে?

মরে যাবে? মা মরে যাবে? অন্ধকারেই ঘোতনের চোখদুটো যেন ঝলসে উঠল। এ কী আবার তার দৃষ্টি যে স্থির হয়ে যাচ্ছে। সে যে পাতা ফেলতে পারছে না।

ঘোতন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, মণি, দৌড়োতে পারবি?

হাঁ, পারব।

তা হলে চল।

ছেঁড়া কেড্সের ফিতে টানটান করে বেঁধে উঠোন থেকে নিঃশব্দে নেমে এল ঘোতন। তাকে যেন ভূতে পেয়েছে! নিজে যেন সে আর নিজে নয়, অন্য কেউ, অন্য কোনও ঘোতন! তার একটা হাত মণি নামের একটা ফুটফুটে মেয়ের হাত ধরে আছে।

বাজার সুনসান। সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি শুধু এই ওষুধের দোকানটা। তবে সেখানেও বন্ধের তোড়জোড় চলছে। লিকপিকে রোগা দোকানদার আর তার আরও রোগা এক কর্মচারী দোকান ঝাড়পোঁছের কাজ করছে। সামনে-রাখা টেবিলটার উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে ওষুধের শিশি-বোতল। পাশে বড় বড় লোহার তালা। দোকান বন্ধের পর তালাগুলো মনে হয় দরজায় লাগানো হবে। একদিকে ট্রানজিস্টার রেডিয়োতে গুনগুন করে গান চলছে। গানের তালে তালে লিকপিকে দোকানদারটা মাথা নাড়ছে।

খানিকটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’জনে।

ঘোতন ফিসফিস করে বলল, কোন ওষুধটা রে মণি? দেখিয়ে দে তো।

ওই তো টেবিলে সাজানো রয়েছে। বাঁদিকের হলুদ রঙের শিশি।

ঠিক আছে, তুই এখানে দাঁড়া। আমি বললেই বাড়ির দিকে ছুট লাগাবি।

দাদা, কিছু হবে না তো? আমার কিন্তু ভয় করছে।

দূর বোকা মেয়ে। ভয়ের কী আছে? আমার চোখ আছে না?

কী আছে?

সে তুই বুঝবি না।

মণিকে রেখে খুব শান্তভাবে ঘোতন ওষুধের দোকানের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। যে-কাজ করতে সে যাচ্ছে তার জন্য তার ভয় হওয়ার কথা। কিন্তু তার ভয় করছে না। কারণ এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে, সে একা নয়। তার পাশে পাশে আরও একজন হাঁটছে। কে হাঁটছে? মা? চুড়ির হালকা শব্দ হচ্ছে না? মা কি হাতে চুড়ি পরেছে? মা কি চুড়ি পরত? ঘোতন মনে করবার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। কী রং ছিল সেই চুড়ির? নিশ্চয় লাল। লাল ঘোতনের খুব প্রিয় রং।

এর পর যা ঘটল সেটা যেন সত্যি নয়। সেটা যেন গল্প। ছোট্ট একটা মানুষের বড় একটা সাহসের গল্প।

নির্বিকার মুখে দোকানে ঢুকে পড়েছে ঘোতন। যেন এই দোকান তার বহুদিনের চেনা। টেবিল থেকে ওষুধের শিশি তুলে নিল। অবাক হয়ে দেখছে দোকানদার। হতভম্ব ভাবটা কাটতে মিনিটখানেক সময় লেগে গেল। হচ্ছে কী? এটা কে?

অ্যাই ছোঁড়া, কী করছিস? আরে, আরে, করছিসটা কী? কে তুই? দোকানে ঢুকেছিস কোন সাহসে?

ঘোতন মুখ না ঘুরিয়েই বলল, দেখছেন তো ওষুধ নিচ্ছি। আরও এক শিশি দিন। বলা তো যায় না, কাল যদি আবার লাগে। আমার মামা বলে, জরুরি জিনিস বাড়িতে বেশি করে রাখা ভাল।

দোকানের কর্মচারী ছেলেটি তার মালিকের থেকেও বেশি ঘাবড়ে গেছে। বেচারি এত ঘাবড়ে গেছে যে, নড়তেও পারছে না। বোধহয় কী করে নড়তে হয় সেটাই ভুলে গেছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ঘোতন নয়, দোকানে একটা শার্ট-প্যান্ট পরে দশ বছরের একটা ভূত ঢুকেছে। মন্ত্রের মতো আরও একটা বড় শিশি ঘোতনের হাতে তুলে দিল সে।

ঘোতন হেসে বলল, ভাববেন না, হাতে টাকাপয়সা এলে দাম দিয়ে যাওয়া হবে। আজ তা হলে চলি, কেমন?

ঘোতন কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দোকানদারের হুঁশ ফিরল। আরে, ব্যাপারটা কী হল? একটা পুঁচকে ছেলে রাতদুপুরে এসে, দোকানে ঢুকে জিনিস নিয়ে চলে গেল, আর তারা দু’জন ধেড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখল?

লিকপিকেটা চিৎকার করে উঠল, চোর, চোর।

সঙ্গের লোকটা গলা মিলিয়ে চেঁচাতে লাগল, চোর পালাল, চোর পালাল।

ঘোতন ঘুরে দাঁড়াল। শরীরে এমন অসুবিধে লাগছে যে, মনে হচ্ছে, চোখদুটোতে কে যেন কয়লা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারা বড় বড় হয়ে উঠছে।

ওই তো লোকদুটো দোকানের সামনে রাখা টেবিলটার উপর উঠে পড়েছে। এবার লাফ দিয়ে রাস্তায় নামবে। তারপর ঘোতনকে তাড়া করবে। ধরেবেঁধে রাখবে সারারাত। সকালে সবাই মিলে মারবে। তারপর পুলিশের হাতে তুলে দেবে।

ঘোতন ভাল করে চোখ মেলল। খুব বড় করে। যত বড় সে পারে।

লাফ দেওয়া হল না লোকদুটোর। লাফ দেওয়ার আগেই টেবিল, টেবিলের উপর সাজিয়ে-রাখা ওষুধের শিশি-বোতল, বড় বড় লোহার তালা সমেত তারা উলটে পড়েছে।

আরে, লোকদুটো গেল কোথায়? ওই তো, ওই তো টেবিলের তলায় চাপা পড়ে আছে। থাকুক, যারা মানুষের মৃত্যুর সময়ও টাকার হিসেব করে আর রেডিয়োর গান শুনে মাথা দোলায় তাদের কিছুক্ষণ টেবিলের তলায় চাপা পড়ে থাকাই উচিত।

ঘোতন মণির কাছে এসে একগাল হাসল। বলল, মণি, এবার ছুট লাগা। যত জোরে পারিস তত জোরে।

১০

ঝন্টি ঘোতনের কাছে ঘেঁষে এসেছে। বেটু বলল, অ্যাই ঝন্টি, তুই ঘোতনদার কাছে সরে গেলি কেন? তোর নিশ্চয় ভয় করছে। ঝন্টি বলল, মোটেই না। পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে বলে আমি সরে গেলাম। আর তুই? তুই তো ভয়ের চোটে একেবারে ঘোতনদার ঘাড়ের উপর উঠে গেছিস।

গোবিন্দ এতক্ষণ ভাই বোনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। এখন সেও নড়েচড়ে বসেছে। বলল, আঃ, থামবি তোরা? ঘোতনদাকে বলতে দিবি? নাও ঘোতনদা, বলো তো।

মণি মেয়ে এবং বয়েসে ছোট হলেও এদের সকলের থেকে সাহসী। তবু সে মুখ ফিরিয়ে ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। নিয়ম হল, ভূতের গল্প শোনার সময় আলো দেখতে হয়। এমনি আলো নয়, আগুনের আলো। আগুনের আলো দেখলে গল্পের ভূত গল্পের মধ্যেই আটকে থাকে। সত্যি হতে পারে না।

ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বসে থাকা এই পাঁচজনকে এখন যদি কেউ দেখে তা হলে ভাববে এরা নিশ্চয় পাঁচ ভাই বোন। আসলে তো তা নয়। ঘোতন এ-বাড়িতে এসেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয়েছে। কিন্তু এরা ‘ঘোতনদা’কে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছে না। একটু আগে ঘোতনের সঙ্গে শোয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে বড় ধরনের গোলমাল হয়েছে। বেটুর সঙ্গে ঝন্টির সামান্য হাতাহাতিও হয় এবং ঝন্টি বেটুকে খিমচে দিয়েছে। শেষপর্যন্ত ঠিক হয়েছে, বারান্দায় লম্বা বিছানা হবে। সেখানে পাঁচজনে একসঙ্গে শোবে।

খানিক আগে রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে। খাওয়া বলতে শুধু খিচুড়ি। অমলকাকুর রান্না। খিচুড়ি বেশ খানিকটা কম পড়েছে। তাতে অবশ্য অসুবিধে হয়নি। কতদিন পরে যে অনেকের সঙ্গে বসে ঘোতন খেল। সবার সঙ্গে খেলে খাবার কম পড়লে খুব কিছু ক্ষতি হয় না।

সবচেয়ে বড় কথা, ওষুধ খাওয়ার পর বেটু-মণিদের মা অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। তিনি ঘোতনকে দেখেছেন। কাছে বসিয়েছেন। কথা বলতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। মণি আর গোবিন্দ মিলে তাদের মাকে চামচে করে একটু খিচুড়িও খাইয়ে দিল। বাইরের মানুষ হলেও সেই সময় ঘোতন তাদের সাহায্য করেছে। সে ভিজে কাপড় দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়েছে।

ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঘোতনকে আলাদা করে কাছে ডাকল অমলকাকু। মণি বলল, বাবা, আমিও শুনব। অমলকাকু ধমক দিয়ে বলল, এক থাবড়া দেব। যা এখান থেকে। মণি লাফ দিয়ে পালাল।

বুঝলি ঘোতন, আমি ভেবে দেখলাম, তুই এখানে থেকেই যা। কষ্ট খানিকটা হবে ঠিকই, তা হোক। সবাই মিলে আধপেটা খেয়ে চলে যাবে। ঝন্টি, বেটুর সঙ্গে স্কুলেও ভরতি হয়ে যেতে পারবি। আসলে আমার জন্য তো বলছি না। বলছি এই গাধাগুলোর জন্য। ছোটদের খুশি হতে দেখলে যে কী ভাল লাগে তা তুই এখন বুঝবি না। বড় হ, তারপর বুঝবি। তা ছাড়া তোর কাকিমাও যদি তোকে খোঁজে— সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে। যতই হোক একটা রোগী মানুষ। সবার কথা ফেলা যায়, কিন্তু রোগী মানুষের কথা ফেলা যায় না। চিন্তা করিস না, আমি উসুলপুরে লোক পাঠিয়ে তোর মামাকে খবর দিয়ে দেবখন। সেরকম হলে নিজে যাব। পড়ার বই, জামা-কাপড় সব নিয়ে আসব। কোনও চিন্তা করিস না।

অমলকাকু বারণ করলেও ঘোতন চিন্তা করছে। তবে এসব নিয়ে নয়। তার চিন্তা হচ্ছে প্রিয় কেড্স জোড়া নিয়ে। সারাদিন হাঁটাহাঁটি, দৌড়ঝাঁপ তো কম হল না। বেচারির উপরে আজ খুব চাপ পড়েছে। কাল ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকোতে হবে।

১১

কেমন আছিস?

ভাল আছি মা। খুব ভাল আছি। আবার ঘুম ভাঙানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কেমন আছ মা?

আমাদের নিয়ম হল, ছেলেমেয়ে ভাল থাকলে আমাদেরও ভাল থাকতে হবে। তাই তুমি যখন ভাল আছ, আমিও ভাল আছি।

বাঃ, এবার একটা কথা মন দিয়ে শোনো। দয়া করে কয়েকটা জিনিস যদি তুমি আমাকে এনে দাও তা হলে আমি আরও ভাল থাকব।

উফ, আজ আবার বায়না? তুমি দেখছি কিছুতেই স্বভাব বদলাবে না। সেদিন এত করে বলে গেলাম, ভাল ছেলেরা বায়না করে না। আবার কী চাই? রবারের বল চাই তো?

না, রবারের বল নয়।

মিটিমিটি হাসছ কেন? হাসি থামিয়ে বলো কী চাই।

লক্ষ্মী মা, তুমি রাগ কোরো না। তুমি রাগ করলে আমার ভয় করে, মণির একটা ফ্রক না-হলেই নয়। দেখেই তো ওর ফ্রকটার কী বিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। ছিঁড়ে একদিকটা ঝুলছে। আর গোবিন্দর খুব লাট্টুর শখ। কাঠের লাট্টু, সঙ্গে এক ফুট লেত্তি। কাল গোবিন্দ চুপিচুপি বলছিল, ঘোতনদা, বাবাকে বলো না, আমাকে একটা লাট্টু কিনে দিক। কী পাগল ছেলে বলো তো দেখি। আমি বললে কি অমলকাকু ওকে লাট্টু এনে দেবে? উলটে একটা চড় দেবে। ওসব মারধরের মধ্যে গিয়ে কাজ নেই, তার চেয়ে বরং তুমিই এনে দিয়ো মা। সেটাই ভাল হবে।

বাপ রে, এত জিনিস। ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর কিছু নয় কিন্তু।

আর কিছু নয় কী গো? কী বলছ মা? বেটুর জন্য একজোড়া চল্পল তো লাগবেই। বেচারি নাকি কয়েকমাস ধরে খালি পায়ে হাঁটছে। ভয়ে ওর বাবাকে বলতে পারছে না। কী কাণ্ড বলো তো? পায়ে যদি কাঁটাটাটা ফুটে যায়? তখন কী হবে? উসুলপুরে আমার একবার হয়েছিল। সারারাত টাটানো ব্যথা। ওহো, ঝন্টিটা বাদ রয়ে গেল। থাক, ঝন্টিকে কিছু দিতে হবে না। কাল ঝন্টি আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। তুমি বরং একটা মুখোশ এনে দিয়ে তো। রাক্ষসের মুখোশ। ভাঁটার মতো চোখ আর বড় বড় দাঁত। রাতে মুখে পরে ওকে ভয় দেখাব। আমার সঙ্গে ঝগড়া করবার মজা টের পাবে। হাসছ কেন মা?

হাসছি কেন? সে তুই বুঝবি না, ঘোতন। আচ্ছা, তোর রবারের বলটা লাগবে না? নাকি বলের কথা ভুলেই গেলি।

না, না, ভুলব কেন? তবে তোমাকে আর কষ্ট করে বল আনতে হবে না। গোবিন্দ বলেছে, ওর একটা পুরনো চামড়ার বল আছে, দু’জনে মিলে ওটাই সারিয়ে নেব। এই রে, আসল জিনিসটার কথাই তো তোমাকে বলতে ভুলে গেছি মা।

আসল জিনিস! আসল কী জিনিস?

কাউকে বলবে না কিন্তু। বললে তোমার সঙ্গে জন্মের আড়ি। বলবে না তো? ঠিক আছে কাছে এসো, কানে কানে বলছি। মা, কয়েকটা লাল রঙের চুড়ি আনতে পারবে?

লাল রঙের চুড়ি! কেন? লাল রঙের চুড়ি কেন রে খোকা?

সে তোমায় পরে বলব, আগে তুমি আনবে বলো।

ঠিক আছে আনব।

কী মজা, সত্যি আনবে তো?

ওমা, সত্যি না তো কি মিথ্যে বলছি? মা কখনও ছেলেকে মিথ্যে কথা বলে?

তুমি খুব ভাল মা।

তুমিও খুব ভাল সোনা। কিন্তু তোমার চোখে জল কেন ঘোতন? তুমি কি কাঁদছ?

হ্যাঁ মা কাঁদছি। আজ আমার খুব ভাল লাগছে, তাই আমি কাঁদছি। তুমি কি যাওয়ার আগে আমার পাশে একটুখানি বসবে?

পরদিন ভোরে ঘোতনের ঘুম ভাঙল টুং টুং শব্দে। বিছানা ছেড়ে উঠে সে ভাঙা ঘরে উঁকি দিল। মণি-বেটুদের মা আজ আরও ভাল হয়ে গেছেন। বিছানায় উঠে বসেছেন। ঘোতনকে দেখে তিনি হাত নেড়ে ডাকলেন।

সেই হাতে কয়েকটা লাল রঙের চুড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *