জামগাছের ডাল
মফস্সল স্কুলে পড়ার অনেকরকম সুবিধে আছে। আমাদেরও ছিল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত—এই তিন ঋতুতেই আমাদের নানারকমের বাড়তি ছুটির ব্যাপার ছিল। প্রথমে বলি গরমকালের কথা।
আমাদের স্কুলের মাঠটা এত বড় যে, সেখানে একসঙ্গে তিনটে করে ফুটবল ম্যাচ হত। এইসব ম্যাচ চলত পুরো গরমের সময়টা ধরে। তিনটে বাজতে-না-বাজতেই একেবারে হইচই ব্যাপার। জেলার দূর দূর ক্লাবের ছেলেরা সব খেলতে আসত। খেলা বিকেলে হলে হবে কী, দুপুর থাকতে থাকতেই প্লেয়াররা গা গরম করতে মাঠে নেমে যায়। তাদের সঙ্গে আসত সমর্থকের দল। সংখ্যায় অনেক। তারা মাঠের ধারে ছায়ায় বসে খুব মন দিয়ে চ্যাঁচানো প্র্যাকটিস করত। এই অবস্থায় স্কুল চলা খুবই মুশকিলের। বইয়ের দিকে মুখ থাকলেও মন থাকত মাঠের দিকে। একসময় স্যারেরা আমাদের মাথায় গাঁট্টা দিয়ে পড়ায় মন ফিরিয়ে আনতেন। কিন্তু ততক্ষণে মাঠে ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে এবং স্যারেদের মন চলে গেছে মাঠে। একসময় দেখা যেত, ক্লাসে বসে আমরা ভূগোলের ম্যাপ আঁকছি আর তাঁরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ‘গোল, গোল’ বলে চিৎকার করেছেন। এই সমস্যার সমাধান করা সহজ ব্যাপার নয়। স্কুলবাড়ি বা মাঠ কোনওটাকেই সরানো যায় না। সুতরাং ফাইনাল বা সেমিফাইনালের মতো বড় বড় খেলার দিন আমরা ছুটি পেয়ে যেতাম। এটা ছিল আমাদের ‘ফুটবল-ছুটি’।
শীতের সময়ও বাড়তি ছুটির মজা পেতাম। কোনও কোনও দিন খুব ঠান্ডা পড়ত। উত্তর থেকে শিরশির করে হাওয়া দিচ্ছে। সবাই বলছে, ‘কোল্ড ওয়েভ’। ফুলহাতা সোয়েটার ভেদ করে সেই হাওয়া ঢুকে পড়ছে গায়ের ভেতরে। সেই সময় টিফিনের পর আমাদের অনেক ক্লাসঘরই ‘হাড়-কাঁপানো’ ধরনের হয়ে যেত।
অঙ্কের স্যার সুশীলবাবু ছিলেন বেজায় রাগী প্রকৃতির মানুষ। অঙ্ক না-পারলে তিনি আমাদের ওপর ভয়ানক রেগে যেতেন। হুংকার দিতেন। বলতেন, তোদের মাথা গবেটদের থেকেও খারাপ। নইলে এত সোজা অঙ্ক পারিস না। আবার অঙ্ক পারলেও রেগে যেতেন। তখন রাগতেন অঙ্কের ওপর। গজগজ করতেন আর বলতেন, ছিঃ, এত সোজা অঙ্ক! গবেটগুলো পর্যন্ত করে দিচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সুশীল-স্যার ক্লাসে এলে আমাদের শরীরে একটা কাঁপুনি আসত।
খুব শীতের দিনগুলোতে এই কাঁপুনি আর আলাদা করা যেত না। আমরা বুঝতে পারতাম না, কাঁপছি কেন, শীতে না ভয়ে?
এইসব দিনে রোদ পড়ে গেলে স্যারেরা আর ক্লাসে থাকতেন না। আমাদের পড়া দিয়ে তাঁরা বারান্দায় গিয়ে রোদে দাঁড়াতেন। সেখান থেকে রোদ সরে গেলে তাঁরা গুটিগুটি পায়ে রোদের খোঁজে যেতেন ছাদে। একসময় সেখান থেকেও রোদ চলে যেত। তখন বাধ্য হয়েই তাঁদের স্কুলমাঠে গিয়ে গোল হয়ে বসতে হত। আর আমরা ক্লাসঘরে গা-গরম করবার জন্য কাগজের বল বানিয়ে লোকালুফি খেলতাম।
এমন সময় হেডস্যার আসতেন টহল দিতে। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে গম্ভীর মানুষ। গম্ভীর হয়ে বলতেন, ছেলেরা, এক-একটা কাজের জন্য এক-একটা জায়গা। যেমন, ক্লাসরুম হল পড়ার জায়গা। মাঠ হল খেলার জায়গা। তোমাদের জায়গা সম্পর্কে ধারণা এখনও পরিষ্কার হয়নি, তোমরা পড়াশোনা করবে কী? তোমাদের কান টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত। কিন্তু এখন সে-কাজ আমি করব না। কারণ এখন তোমরা মাঠে যাবে এবং একটু খেলাধুলো করে গা-গরম করবে। তোমাদের কান গরম করবার ব্যবস্থা আমি পরে করব।”
এটা হল গিয়ে আমাদের শীতের বাড়তি ছুটি। বছরে দিন দুই-তিন উত্তরে হাওয়ার কল্যাণে আমাদের কপালে এই বাড়তি ছুটি জুটত।
আমাদের স্কুলে বৃষ্টির ছুটি অর্থাৎ রেনি-ডে ব্যাপারটা ছিল বেশ শক্ত।
এটা দেখতেন আমাদের ড্রিল কাম হেল্থ টিচার। কলকাতা শহরে যেমন বৃষ্টির জলে বাস-ট্রাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে স্কুল ছুটি হয়ে যায়, আমাদের ওখানে সেসব বালাই ছিল না। ড্রিলস্যার কোনও বৃষ্টিতেই আমাদের ছুটির ব্যবস্থা করতেন না। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে এলেও না। ড্রিলস্যারের মত হল— মাঝেমধ্যে বৃষ্টিতে ভেজা স্বাস্থোর পক্ষে শুধু ভালই নয়, বিশেষরকম জরুরি। এতে সর্দিজ্বর হবে। তা হোক। ভেতরের ভাইরাসটা বেরিয়ে যাক। বৃষ্টিতে ছুটি হবে না, আবার কামাই করাও চলবে না। উপস্থিতির ওপর ড্রিলস্যারের কড়া নজর থাকত। ছুটি পেলে ভেজায় মজা আছে, কিন্তু ছুটি না-পেলে ভেজায় মজা নেই। জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকার দুঃখ আছে। সুতরাং আমরা চেষ্টা করতাম স্কুলে ঢোকার আগে যতটা কম পারা যায় ভিজতে। মাথায় ছাতা ঢেকে, রেনকোটে গা মুড়িয়ে নিতাম।
একবার খুব মুশকিল হল।
আগের দিনের সারারাত বৃষ্টিতে স্কুলের সামনের রাস্তায় এক হাঁটু জল জমেছে। জুতো মোজা জলে একেবারে চুপচুপে। স্কুলসুন্ধু সবাই বারান্দার রোদে সেগুলো খুলে শুকোতে দিলাম। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। তিনশো ছেলের ছশোখানা কালো জুতো, ছশো পিস কাদামাখা সাদা মোজা। নানা সাইজের সেসব জুতো দেখে মনে হচ্ছে যেন জুতোর কারখানা খোলা হয়েছে।
বিরাট গোলমাল দেখা দিল ছুটির পর। আমরা জুতো মোজা পায়ে গলাতে গিয়ে দেখি কেলেঙ্কারি হয়েছে। জুতোয় বই-খাতার মতো নাম লেখা থাকে না। ফলে কেউ আর দু’পাটি মেলাতে পারছি না। কেউ পেয়েছে দুটো ডান পায়ের জুতো, কারও বাঁয়েরটা ডান পায়ের থেকে পাক্কা দু’সাইজের বড়। কেউ আবার হাতে দুটো ডান পায়ের জুতো নিয়ে দাড়িয়ে আছে কাদোকাদো মুখে। মোজার ক্ষেত্রে সমস্যা আরও ভয়ংকর। ভিজে মোজা শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে স্বাধীনভাবে ওড়াওড়ি করেছে। করতে গিয়ে তারা সংখ্যায় প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ড্রিলস্যার জুতো-সমস্যার সমাধান করতে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হল। ডান-বাঁয়ের হিসেবে জট পাকিয়ে একাক্কার কাণ্ড। অনেকেই সারের ধমকধামক খেয়ে ভুল জুতো নিয়ে বাড়ি যেতে বাধ্য হল। সবাই যে পায়ে করে নিয়ে যেতে পারল তা নয়, অনেককেই জুতো পায়ের বদলে হাতে বহন করতে হল। ক্লাস ফাইভের বিক্রমের কপালে জুটল ক্লাস নাইনের সুমনের জুতো। ক্লাস টেনের তমালের ডানপায়ের পাটিটা আসলে ক্লাস সিক্সের প্রতিমের এবং বাঁ পায়েরটা ক্লাস এইটের বিজয় বক্সীর। এই কম্বিনেশন তো আর পায়ে দেওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে হাতে নিতে হল।
জুতো-বিভ্রাট চলল টানা পনেরো দিন। ছাত্রদের মধ্যে খুব ঝগড়া লেগে গেল। এ বলছে, তুই আমার জুতো নিয়ে গেছিস। ও বলছে, তুই আমার জুতো পরেছিস। সেই ঝগড়া ছড়াল বড়দের মধ্যেও। জুতোর খোঁজে বাড়ি থেকে বাবা-মা’রা হেডস্যারের কাছে এলেন। তাঁরা এত বিরক্ত করতে শুরু করলেন যে, শেষপর্যন্ত স্কুল-অফিসে ‘জুতো অনুসন্ধান কেন্দ্র’ খোলা হল। সেখানে সকাল ন’টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত জুতো বিষয়ক কমপ্লেন নেওয়া হল। ছাত্রদের জন্য কড়া নোটিস পড়ল, ‘ভুল জুতো জমা না দিলে ক্লাস-প্রমোশন আটকে দেওয়া হবে।’
এই নোটিসে ভয় পেয়ে অনেকে বাড়ি থেকে পুরনো জুতো, এমনকী, কেউ কেউ ছোট ভাই, বোনের জুতো পর্যন্ত জমা দিয়ে ফেলল। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল অফিসের এক কোণে ছোটখাটো একটা জুতোর পাহাড়!
সেই পাহাড় কীভাবে সরানো হল আমাদের জানা নেই, তবে আমরা জানতে পারলাম, বৃষ্টিতে ছুটি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ড্রিলটিচারের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে বৃষ্টিতে ভেজা তো দূরের কথা, সেরকম কালো করে মেঘ করলেই আমরা ছুটি পেয়ে যেতাম।
আমরা এই ছুটির নাম দিলাম, ‘মেঘ-ডে’। এই ছুটি হল আমাদের বাড়তি ছুটি। রেনি-ডের পাশাপাশি মেঘ-ডে’র ছুটি। এই ছুটি অন্য স্কুলের ছাত্রদের কপালে জোটে না।।
মফস্সল স্কুলের এত সুবিধের মধ্যেও, ক্লাস এইটে উঠে আমরা একটা বড় অসুবিধের মধ্যে পড়ে গেলাম।
আমাদের ক্লাসঘরটা ছিল দোতলায় পেছন দিকে, স্কুলের মধ্যে থেকেও যেন স্কুল থেকে একটু বাইরে। নির্জন, চুপচাপ। বড় রাস্তার চেঁচামেচি, অন্য ক্লাসের হট্টগোল চট করে আমাদের ঘরে এসে পৌঁছোত না। মাস্টারমশাইরা বলতেন, “পড়াশোনার পক্ষে একেবারে আদর্শ।” কথাটা মিথ্যে নয়। পড়ায় মন দেওয়ার জন্য এমন শান্ত ক্লাসঘর স্কুলবাড়িতে আর একটাও ছিল না। যদিও অ্যানুয়াল পরীক্ষাগুলোতে দেখা যেত, ক্লাস এইটেই ফেলের হার সবচেয়ে বেশি। তবে সেটা ঘরের দোষ নয়। দোষ ছাত্রদের। ঘরের গুণটাকে সম্ভবত তারা ঠিকমলে নিতে পারত না। যাক, সে আলাদা কথা।
আমাদের এই ঘরে ছিল খুব বড় বড় কয়েকটা জানলা। জানলাগুলো দিয়ে ক্লাসঘরে দারুণ আলো-হাওয়া ঢুকত। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যেত অনেকটা করে। বাবরের জন্মদিন বা সালোকসংশ্লেষের সূত্র আটকে গেলে আমরা সেই নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম। কিছুক্ষণ তাকালে পড়া ভুলে যাওয়ার দুশ্চিন্তা দূর হত। মনের মধ্যে একটা উদাস উদাস ভাব তৈরি হত। মনে হত এমন চমৎকার আকাশের কাছে দু’-চারটে কানমলা আর এমন কী ব্যাপার?
এইসব জানলা আটকানো হত না। খুব ঝড়-বৃষ্টি হলে একমাত্র অন্য কথা। তখন আমরা হুটোপাটি করে বন্ধ করতাম।
বৈশাখ মাসের গোড়ায় সমস্যাটা প্রথম খেয়াল হল।
কালবৈশাখীর ঝড় সাধারণত হয় বিকেলে। সন্ধের মুখোমুখি। সেদিন বিকেলের ঝড় এল দুপুরেই। সবে থার্ড পিরিয়ড শুরু হয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই, ঝুপ করে আকাশ কালো করে শোঁ শোঁ হাওয়া। জানলা আটকাতে গিয়ে দেখা গেল মাঝের দিকে একটা কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। একটা ঝাপসা জামগাছ তার বেশ মোটাসোটা একটা ডাল জানলার গরাদ দিয়ে ক্লাসঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই ডাল জানলার কোনও কপাটই বন্ধ করতে দিচ্ছে না। একগাদা সবুজ পাতা নিয়ে সে একেবারে নাছোড়বান্দা। কিছুতেই নড়বে না। ক্লাসের তাগড়াই ছেলে হিসেবে যারা নাম করেছে, সেই পটল, গদা আর রতন বিস্তর ঠেলাঠেলি করেও কিছু করতে পারল না। জামগাছের ডাল একেবারে গোঁ ধরেই রইল। অগত্যা ঝড়ের হাওয়া আর ধুলোতে ঘরের ভেতরে একেবারে তছনছ অবস্থা। খাতা উড়ে যাচ্ছে, বইয়ে মলাট রাখা যাচ্ছে না। ভুগোলস্যার ম্যাপ পয়েন্টিং শেখাচ্ছিলেন। দেওয়ালে টাঙানো সেই ম্যাপ যেন ডানা পেয়েছে। তাকে সামলায় কার সাধ্যি?
স্যার খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, এ কী! ব্যাপারটা অনেক আগেই দেখা উচিত ছিল। একটা গাছের ডাল এত বড় হয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে, অথচ এতদিন কারও চোখে পড়ল না!
আমাদের ক্লাসের মানস ছিল সাহসী ধরনের। সে বলল, স্যার, এতদিন তো ঝড় হয়নি তাই চোখে পড়েনি।
স্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, “কেন? গাছ কি হাওয়া যে, ঝড়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়েছে? মূর্খের মতো কথা বোলো না। নিলডাউন হয়ে যাও।”
টিফিনের সময় সেদিন আর আমরা কেউ ক্লাসঘর থেকে বেরোলাম না। বেরোনোর প্রশ্নও ওঠে না। ঘরে-ঢুকে-পড়া গাছের ডাল নিয়ে আমাদের তখন প্রবল উৎসাহ। মফস্সলে থাকি, এখানে বাড়ির থেকে গাছপালা বেশি। সুতরাং তাদের নিয়ে আদিখ্যেতা করার মতো কিছু নেই। কিন্তু এই ভাল না বলে কয়ে ক্লাসঘরে ঢুকে পড়েছে। শুধু ঢুকে পড়েনি, ঢুকে পড়ে একেবারে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে। এর পরেও আগ্রহ না দেখিয়ে উপায় কী? তার ওপর খুব তাড়াতাড়ি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি, মোটা ডালটা একা ঢোকেনি, সঙ্গে বেশ ছোটখাটো কয়েকটা শাখা-প্রশাখাও এনেছে। তারা জানলার লোহার গরাদ এবং কাঠের পাল্লা জড়িয়ে ধরেছে।
একটু পরে স্কুলের তিন বেয়ারা গম্ভীর মুখে এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে গাছ ঢোকার অপরাধে বেচারিদের ভূগোলস্যারের কাছে খুবই বকুনি খেতে হয়েছে। তারা জানলার পাশ থেকে আমাদের সরিয়ে দিয়ে সরেজমিনে তদন্ত শুরু করল। তদন্তের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও করল।
আলোচনা ছিল এরকম:
গাছ ঢুকেছে তো আমাদের কী দোষ?
ঠিকই, ডাল কি আমরা টেনে হিঁচড়ে ঢুকিয়েছি?
তা ছাড়া এই গাছ তো আমরা পুঁতিনি। কম করে কুড়ি বছর আগের গাছ। পঁচিশও হতে পারে। তখন তো এই ইস্কুলই হয়নি। তা হলে আমাদের বলা কেন?
অত বকবক না-করে ডালটা ভেঙে দে।
খেপেছিস? ফুল ছাঁটার এই কাঁচি দিয়ে জাম গাছের ডাল কাটবি? করাত লাগবে। বাইরে থেকে গাছে উঠে তবে করাত দিয়ে কাটতে হবে।
সে অনেক ঝক্কি। হেডসারের অর্ডার হোক, তাপর দেখা যাবে।
অর্ডার হলেই তো হবে না। আমি গাছে উঠব না। আমি গাছে ওঠার চাকরি করি না। আমি ঘণ্টা বাজানোর চাকরি করি। গাছ থেকে পড়ে কোমর ভাঙলে ঘণ্টা বাজাবে কে?
আলোচনা-শেষে তিনজনেই চিন্তিত মুখে ঘর ত্যাগ করল।
চিন্তা আরও বাড়ল পরের দিন। গাছের ডাল রাতারাতি কোথা থেকে একটা কাকের বাসা জোগাড় করে ফেলল। আমরা জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, বাসার মধ্যে ব্ল্যাকবোর্ড মোছর ডাস্টার, তিন টুকরো চক এবং দুটো বেগুনি ডিম।
বাসার মালিকরা গোড়ার দিকে শান্ত থাকলেও যথেষ্ট গোলমাল শুরু করল অঙ্কক্লাসে। সুশীলবাবু যেই পাটীগণিত শুরু করতে যান, কাকেরা পরিত্রাহি চেঁচাতে শুরু করে। হয়তো পাটীগণিত তাদের তেমন পছন্দের বিষয় নয়। কাকেরা ক্লাস এইটের ছাত্র নয়। তারা স্যারের লাল চোখের পরোয়া করল না। তাড়াতে গেলে উলটে তেড়ে এল। ক্লাসে ঢুকে পড়ে আর কী! হাল ছেড়ে দিয়ে একসময় স্যার ক্লাস ছাড়লেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ব্যাকগ্রাউন্ডে কাকের ডাক নিয়ে অঙ্ক শেখানো যায় না। যতদিন না গাছের ঝামেলা দূর হবে ততদিন আমি এই ক্লাসে ঢুকছি না। সে তোমরা যতই দুঃখ পাও।
দুঃখ কোথায়? এরকম আনন্দের ঘটনা আমাদের ক্লাস এইটের জীবনে আর কখনও ঘটেনি। আমরা অভিভূত হয়ে কাক-পরিবারকে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিস্কুট এবং মাখন পাউরুটি খেতে দিলাম। এদিকে দু’দিনের মধ্যে স্কুলে ছড়িয়ে পড়ল, ক্লাস এইটের ক্লাসঘরে অঙ্কস্যারকে কাকে ঠুকরেছে। এতদিন মাস্টারমশাইরা ক্লাসে এলে আমরা ভয় পেতাম। জামড়ালের দৌলতে এবার মাস্টারমশাইরা আমাদের ক্লাসে আসতে লাগলেন ভয়ে ভয়ে।
কিন্তু এইভাবে তো আর বেশিদিন চলতে পারে না। একদিন হেডস্যার নিজে এলেন। এসে খুব গম্ভীর গলায় বললেন, “শুনলাম, তোমাদের এই ঘরে গাছের ডাল নিয়ে কী সব ঝামেলা হয়েছে। টিচাররা কেউ পড়াতে পারছেন না। আমি আজ নিজে তোমাদের ক্লাস নেব। হাতে-কলমে ব্যাপারটা দেখতে চাই। তবে চিন্তার কোনও কারণ নেই। এই বাঁদরামি তোমরা বেশিদিন চালাতে পারবে না। আজ বিকেলেই এই ডাল কেটে ফেলা হবে। সদর থেকে গাছ কাটার লোক আসছে। মোটা ডাল তো, দড়িটড়ি বেঁধে ব্যবস্থা করতে হবে। বলেছি, ডালটার একেবারে গোড়া থেকেই কাটতে হবে। নইলে কোনদিন দেখব আবার বেড়ে গেছে। নাও, তোমরা সব গ্রামার বই বের করে দেখি।
খুবই দুঃসংবাদ। ক’দিন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়া জামগাছের ডাল আমাদের খুবই দেখাশোনা করেছে। তবে ক্লাস এইটে পড়া ছাত্রদের ভাগ্য বেশিদিন ভাল যায় না। তার ওপর কাকেরা দু’দিন আগে ছানাপোনাদের নিয়ে চলে গেছে। টিফিন খাইয়ে তাদের ধরে রাখা যায়নি। এতই অকৃতজ্ঞ যে, যাওয়ার আগে আমাদের দিকে একবারও ফিরেও তাকায়নি। মানস পরামর্শ দিয়েছে, ওই ডালে যদি একটা মৌচাকের ব্যবস্থা করা যায়। এতে নাকি কিছুদিনের জন্য স্যারদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। পরামর্শ ভাল, কিন্তু কার্যকর করা খুবই জটিল ব্যাপার। যদি-বা কোনওভাবে করাও যায়, তা হলেও প্রশ্ন আছে। হুল ফোটানোর সময় মৌমাছিরা কি মাস্টারমশাই আর ছাত্রদের আলাদা করতে পারবে? মানস এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারেনি। যাক, এখন আর সেসব ভেবে লাভ নেই। ডাল তো আজই কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বাঁচার আর কোনও পথ নেই। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্রামার বই খুললাম।
কাক মুখ ফিরিয়ে না-তাকালেও আকাশ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের দিকে তাকাল। আগের দিন ছিল শুধু ঝড়। আজ শুরু হল শুধু বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। একেবারে চারদিক সাদা করে দিল। ভোলা জানলা দিয়ে প্রথমে এল বৃষ্টির ছাঁট। কিছুক্ষণের মধ্যেই জামগাছের ডাল বয়ে আনল বড়বড় জলের ফোঁটা। অল্পক্ষণেই ঘর জলে থইথই। আমরা বেঞ্চে পা গুটিয়ে বসলাম। বেঞ্চের তলা দিয়ে গাছের হলুদ, সবুজ পাতা জলে নৌকোর মতো ভেসে যেতে লাগল।
এসব দেখে হেডস্যার আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। গাছের ডাল দেখলেন, ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশের মেঘ দেখলেন, বৃষ্টি দেখলেন। জলের ফোঁটা তাকেও ভিজিয়ে দিল। চশমা মুছতে মুছতে বললেন, হুঁ, যা শুনেছিলাম দেখছি তার চেয়ে খারাপ। ভেরি ব্যাড। এ তো আর ক্লাসরুম নেই, গাছতলা হয়ে গেছে। না, ভাবছি শুধু ডাল নয়, গাছটা পুরোই কাটিয়ে দেব। ছি ছি, এ আবার কী কাণ্ড! নাও, তোমরা গ্রামারে মন দাও। একটা ভুল হলে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
আমরা খাতায় মন দিলাম, হেডস্যার দাঁড়িয়ে রইলেন জানলার সামনে পাহারাদারের মতো। মন আমাদের আরও খারাপ হয়ে গেছে। এক তো গ্রামারের ধাক্কা, তার ওপর গোটা গাছ কেটে ফেলার ঘোষণা।
ক্লাস-শেষের ঘণ্টা পড়লে বড় আশ্চর্য এক দৃশ্য দেখলাম! মুখ তুলে দেখি হেডসার তখনও সেই না-আটকাতে-পারা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে! তাঁর মুখ গম্ভীর, থমথমে। বৃষ্টি থেমে গেছে। নিজে থেমে গেলেও সে রেখে গেছে চমৎকার ভেজাভেজা একটা হাওয়া। জামগাছের পাতায় জলের বড়বড় ফোঁটা। ভেজা হাওয়ায় সেই জলের ফোঁটা দোল খাচ্ছে।
ঘণ্টার শব্দে স্যার আমাদের দিকে ফিরলেন।
বললেন, “কী ছেলেরা, কাজ সব হয়েছে।”
আমরা বললাম, হ্যাঁ, হয়েছে।
ঠিক আছে, তা হলে এবার এক-এক করে এদিকে এসো। দেখে যাও, কতবড় রামধনু উঠেছে। সাধারণত এত ঝকঝকে রামধনু দেখা যায় না। এইরকম সুন্দর জিনিস দেখতে পাওয়া একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আজ তোমরা সেই সৌভাগ্যবান। শুধু তোমরা কেন, জানলা খোলা না থাকলে আমিও দেখতে পেতাম না। তবে মনে রাখবে, এক-এক করে দেখবে, কোনওরকম বাঁদরামি করলে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
বিকেলে সদর থেকে গাছ কাটার লোক এল ঠিকই, কিন্তু তাকে গাছ না-কেটেই ফিরে যেতে হল। কোনও এক রহস্যময় কারণে হেডস্যার সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। গাছ তার ডালপালা নিয়ে নিজের মতোই থাকবে।
পরদিন জামগাছের ডাল ক্লাস এইটের ছাত্রদের রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে একটা ছোট্ট কাঠবেড়ালি উপহার দিয়ে বসল। সে আমাদের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করত। আমাদের কাছ থেকে টিফিন খেত। অঙ্কক্লাসের সময় ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে ঘুমোত। একসময় আবার ডাল বেয়ে গাছে ফিরে যেত।