ডানা
এত মার খেয়েও বিরজুর মন খারাপ লাগছে না। বরং ভালই লাগছে।
একটু আগে সে হাত থেকে একটা প্লেট ফেলেছে। নীল রঙের সস্তা প্লেট। মাটিতে পড়বার পর টুকরো টুকরো হয়ে সেই প্লেট দোকানময় ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু প্লেট নয়, প্লেটে ছিল আলুরদম। সেই আলুরদমও পড়েছে। ভাঙা কাচে মাখামাখি হয়ে চারিদিকে ছিটকে গেছে আলু আর ঝোল। এই আলুরদম সাধারণ আলুরদম নয়, স্পেশাল আলুরদম। এমনি আলুরদমে থাকে চার পিস আলু। স্পেশাল আলুরদমে ছ’পিস। ওপরে ছড়ানো হয় গরমমশলা। পাশে একটা গোটা কাঁচালঙ্কা। খেয়াল রাখতে হয় সেই কাঁচালঙ্কার সাইজ যেন ছোট না হয়। অ্যালমুনিয়মের চামচ দিয়ে গরমমশলা সরিয়ে সরিয়ে স্পেশাল আলুরদম খেতে হয়। এক চামচ আলুরদম, এক কামড় লঙ্কা। আবার এক চামচ আলুরদম, এক কামড় লঙ্কা।
তিন নম্বর টেবিলের মোটা লোকটা প্রথমে স্পেশাল আলুরদমের সঙ্গে দু’পিস পাউরুটির অর্ডার দিয়েছিল। অর্ডার আসবার ঠিক আগের মুহূর্তে হাঁক মেরে বলল, পাউরুটি লাগবে না। শুধু আলুরদমেই চলবে। এই দোকানে এটাই মজা। স্পেশাল আলুরদম এত চমৎকার খেতে হয় যে অনেকেই সঙ্গে অন্য কিছু খেয়ে মুখ নষ্ট করতে চায় না। খিদে পেলেও নয়।
মাঝপথ পর্যন্ত চলে এসেছিল বিরজু। আবার পাউরুটি ফেরত দিতে গেল। ফেরত দিয়ে তিন নম্বরের টেবিলের সামনে এসে এই কাণ্ড। হাত ফসকে প্লেট মেঝেতে। প্লেট তো গেলই, সঙ্গে গেল আলুরদম। এমনি আলুরদমের দাম দেড় টাকা। স্পেশালের দাম চার টাকা। এর সঙ্গে আছে প্লেটের দাম। সব মিলিয়ে বড় ক্ষতি।
এরপর রামপ্রসাদ দোকান-ভরতি খদ্দেরদের সামনে বিরজুকে কিল, চড় মারতে মারতে বের করে দেবে এতে আশ্চর্যের কী আছে? কিছুই নেই। সে এই দোকানের মালিক। ক্ষতি তো তার। তবে অন্য সময় হলে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে বিরজু চুপিচুপি কাঁদত, কান্না শেষ হলে ফের ঢুকত দোকানে। মালিক রামপ্রসাদ বিরজুকে মারতে খুবই পছন্দ করে, কিন্তু কান্নাকাটি একেবারে পছন্দ করে না। চোখে জল দেখলে তার মাথায় আরও রাগ চড়ে যায়। আরও মারে। সুতরাং ভাল করে চোখের জল মুছে নিতে হয় বিরজুকে। ফের কাজ শুরু করতে হয়।
আজ কিন্তু বিরজু কাঁদেনি।
কাঁদেনি দুটো কারণে। এক নম্বর কারণ হল, এখন তার বয়স দশ বছর। কষ্ট হলেও দশ বছরের ছেলেদের দুমদাম কাঁদতে নেই। দু’নম্বর কারণ, আজ সে অন্যমনস্ক। এত অন্যমনস্ক যে সকাল থেকেই দোকানের কোনও কাজে মন দিতে পারছিল না। উনুন ধরানো, চায়ের কাপ সাজানো, বাসন ধোয়া, সবকিছুতেই ছোটখাটো ভুল করে বসছিল। প্লেট ভেঙে বড় ভুল করল এবং কাজ থেকে রেহাই পেল।
রামপ্রসাদ মারধর করে বের করে দেওয়ায় আরও ভাল হয়েছে। আজ আর সে দোকানে ফিরবে না। এখানে কাজের নিয়ম হল, রাত এগারোটা পর্যন্ত কাজ না-করলে রাতের খাওয়া বন্ধ। এটা কোনও ব্যাপার নয়। রাতে না-খাওয়ার অভ্যেস বিরজুর অনেক ছোটবেলা থেকেই আছে। সুতরাং আসল কাজের জন্য অনেকটা সময় পাওয়া গেল। আসল কাজের জন্য এই সময়টা বিরজুর খুবই দরকার ছিল। হাতে মোটে বেশি সময় নেই।
অন্ধকারে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দোকানের পেছনে চলে এল বিরজু। একফালি একটা গুদাম ঘরের মতো। ছেঁড়া চট দিয়ে দরজা। চট সরিয়ে ঢুকলে ভাঙা টেবিল, ফেলে দেওয়া মাটির উনুন আর কয়লা। এটাই বিরজুর বেডরুম। একপাশে মাদুর গোটানো। মাথার কাছে দড়িতে জামা, প্যান্ট, গামছা। রামপ্রসাদ দোকানে শোয়, বিরজু এখানে। জায়গা কম বলে গুটিসুটি মেরে শুতে হয়। বিরজুর এই গুদাম বেডরুমে আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই। এতে অবশ্য কোনও অসুবিধে নেই। রাস্তার আলো এই পর্যন্ত চলে আসে। রাত যত বাড়ে ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা ল্যাম্পপোস্টগুলো বিরজুর ঘরে আলো দেওয়ার জন্য ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কে জানে, ওরা হয়তো ভাবে অন্ধকারে বিরজু ভূতের ভয় পাবে। বিরজু মনে মনে হাসে। আচ্ছা, বোকা তো। কতদিন হয়ে গেল সে একা একা শুচ্ছে। সে কখনও ভয় পায়নি। আর পাবেই বা কেন? যেসব ছোটদের সঙ্গে শোওয়ার মতো কোনও বড় থাকে না, ভূতেরা তাদের কখনও ভয় দেখায় না।
ঘরে ঢুকে চট খানিকটা সরিয়ে দিল বিরজু। আজ যেন আলো একটু বেশি! ভাঙা উনুনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা জিনিসদুটো বের করল। দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো। বিরজু খেলার জন্য তির ধনুক বানাচ্ছে নাকি? না, তা তো নয়! ধনুক হলে তো মাঝখানটা ফাঁকা থাকত। এই দুটো তো সেরকম নয়! তা ছাড়া ছোটদের খেলার ধনুকের তুলনায় কিছুটা যেন বড়। দুটো কঞ্চি বেঁকিয়ে দড়ি দিয়ে আটকানো হয়েছে শক্ত করে। কঞ্চি আর দড়ির মাঝখান খবরের কাগজ সাঁটা। বিরজু আলাদা আলাদা করে কঞ্চিদুটো টেনে দেখল। না, শক্তই আছে। চট করে ভেঙে যাবে না।
বিরজু নিচু হল। নিচু হওয়ার সময় বুঝতে পারল, বাবার কিলগুলো খুব খারাপ ছিল না। ডানদিকের কাঁধটা টনটনিয়ে উঠছে। তা উঠুক। ওদিকে মন দেওয়ার সময় নেই। এখনও অনেক কাজ। কয়লা ভাঙার হাতুড়ি, ঘুঁটে রাখার ঝুড়ির খাঁজখোঁজ থেকে হাতড়ে টেনে বিরজু বের করে আনল দড়ি, আঠা, খবরের কাগজ। সবশেষে নিজের ছেঁড়া হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বের করা হল ‘আসল জিনিস।’ এই ‘আসল জিনিস’ বের করবার সময় বিরজুর মুখে বিজয়ীর হাসি।
অনেকগুলো রাংতার টুকরো। গত তিন দিন ধরে সিগারেট প্যাকেট কুড়িয়ে এই রাংতা জোগাড় করেছে বিরজু। রুপোলি আর সোনালি।
বিরজু একটুও দেরি না করে ঝটপট কাজে বসে গেল। রাংতাগুলোকে গোল করে ছিঁড়তে লাগল আর আঠা দিয়ে সাঁটতে লাগল কঞ্চির সঙ্গে লাগানো খবরের কাগজের ওপর। সবকটা রাংতা যে গোল হল তা নয়। অনেকগুলোই ছেঁড়া হয়েছে তেরা বেঁকা। তবু ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। রাংতার চাকতি লাগানো শেষ হলে বিরজু খানিকটা লাল, নীল আর সবুজ রঙের সুতো পেঁচিয়ে দিল কঞ্চিদুটোর গায়ে।
সাজগোজ শেষ হতে অনেকটা সময় চলে গেল। রাত কত এখন? ভোর হতে কত দেরি? প্যান্টে আঠার হাত মুছে উঠে দাঁড়াল বিরজু। মুখ-ভরা হাসি। চটের পরদা সরিয়ে মাথাটা বের করল। ভাল করে দেখে নিল দু’পাশ। না, কেউ কোথাও নেই। চারপাশ অন্ধকার। দূরে দূরে টিমটিম করছে আলো। বিরজু তৈরি হল। অনেকটা দড়ি গুটিয়ে। এবার যেতে হবে। কিন্তু জিনিসদুটো নিয়ে যাবে কীভাবে? ঢাকা দিয়ে না নিলে কেউ দেখে ফেলতে পারে। খেলার মাঠ খুব দূরে নয়। মিনিট দশেকের হাঁটা। দৌড়ে গেলে আরও কম। তবু সাবধান হওয়াই ভাল। ঘরের এক কোণে একটা জং-ধরা ট্রাঙ্ক আছে। বিরজু সেটা খুলল। পুরনো কাপড়ে বোঝাই। সেখান থেকে হাতড়ে হাতড়ে মায়ের একটা শাড়ি বের করল বিরজু। খুব চেনা গন্ধ। বিরজু প্রাণ ভরে সেই গন্ধ বুকে টেনে নিল। কতদিন আগে মা মারা গেছে এখন আর মনে নেই বিরজুর। তবে মায়ের গায়ের গন্ধ মনে আছে।
মলিন, শতছিন্ন সেই শাড়ি দিয়ে জিনিসদুটো ঢেকে বিরজু পা টিপে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে।
নির্জন পথ পেরিয়ে মাঠে যখন পৌঁছোল বিরজু তখন পূব দিকে আবছা আলো ফুটছে। ভোর হল বলে।
এবারই আসল কাজ।
বিরজু দড়ি দিয়ে তার দুটো কাঁধের সঙ্গে শক্ত করে জিনিসদুটো বেঁধে ফেলল। বাঁধা শেষ হতেই আকাশের কোনা থেকে উঁকি মারল আলো। ভোরের প্রথম আলো। সেই আলোয় ঝলমল করে উঠল সোনালি, রুপোলি রাংতা। লাল, নীল সুতো!
আরে, এ যে দুটো ডানা! রঙিন দুটো ডানা!
সেই ডানা কাঁধে বিরজু ছুটতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে। তারপর জোরে, আরও জোরে, আরও আরও জোরে। এরোপ্লেন যেভাবে আকাশে ওড়বার আগে ছোটে সেইভাবে।
নির্জন সবুজ মাঠ, ভোরের আলো, ঘাসের ওপর আলগোছে পড়ে থাকা শিশিরকণা বিরজুর দিকে হাত নাড়তে লাগল আর ফিসফিস করে বলে উঠল— ওড়ো, উড়ে যাও, তোমায় উড়তে হবে বিরজু…।