বুড়ো লোকটা
লোকটাকে তুই চিনিস?
না, মা চিনি না।
চিনিস না তো কথা বললি কেন? তোকে না আমি পইপই করে বলে দিয়েছি রাস্তায় অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবি না। বলিনি?
আমি তো কথা বলিনি মা।
তা হলে তুই কী করেছিস?
আমি শুধু শুনেছি।
শুনেছি! শুনেছি মানে? চিনিস না, জানিস না এমন একটা লোকের কথা তুই শুনবি কেন?
তুমি কথা বলতে বারণ করেছ, শুনতে তো বারণ করোনি।
গাধার মতো কথা বলবে না রন্টু। ক্লাস সেভেনে পড়ো। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করলে গাধারাও কিছুটা মানুষ হয়ে যায়। তুমি দেখছি হওনি। এখনও পুরোটাই গাধা রয়ে গেছ। তুমি হলে ক্লাস সেভেনে পড়া গাধা।
মানুষ রেগে গেলে কাঁপে। কণিকাদেবী এত রেগে গেছেন যে কাঁপার কথা তিনি ভুলে গেছেন। আজ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর ছেলে একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। এই সাংঘাতিক ঘটনা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। নামী ইংরেজি স্কুল, সাত জন প্রাইভেট টিউটর, গাদাগুচ্ছের ইংরেজি বই, কম্পিউর, সিডি, জন্মদিনের পার্টি— সবই কি তা হলে তুচ্ছ হয়ে গেল?
হ্যাঁ, হয়ে গেল। খেতে বসে রন্টু যা বলল তাতে কণিকাদেবীর সেটাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বড় ধরনের কোনও সর্বনাশ ঘটতে চলেছে।
লোকটার বয়স বেশি। বুড়োই বলা যেতে পারে। চুল পাকা। গায়ে নীল রঙের জামা। ফ্যাকাশে নীল রঙের এই জামার হাতা কনুই পর্যন্ত। জামার সঙ্গে ছিল ধুতি। ধুলো-মাখা সেই ধুতির হাঁটুতে তাপ্পি। ভয়ংকর ব্যাপার এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। ধুতির সঙ্গে পায়ে পরা উচিত চটি। অথচ লোকটা পরেছিল কেড্স জুতো। তাও আবার মোজা ছাড়া। পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেই কেড্সের রং ঠিক বুঝতে পারেনি। হলুদ হতে পারে, আবার বাদামিও হতে পারে। তবে হাতে বন্ধ থাকা ছাতাটার একটা শিক যে ভাঙা সেটা স্পষ্ট দেখেছে।
এই পর্যন্ত শুনে কণিকাদেবীর দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। তিনি ছেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, আর মুখটা? মুখটা কেমন মনে আছে?
রন্টু চামচ দিয়ে খানিকটা কাস্টার্ড তুলে মুখে দিল। কাস্টার্ড খাওয়ার সময় রন্টু সাধারণত কোনও কথা বলে না। খুব বেশি ধরনের ভাল জিনিস খাওয়ার সময় কথা বললে সেই খাবারে স্বাদ কমে যায়। কিন্তু উপায় নেই মায়ের জন্য এখন বলতে হচ্ছে। সে বলল, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে আছে। মুখটা হাসিহাসি।
কণিকাদেবী সোজা হয়ে বসলেন। সর্বনাশ যতটা হয়েছে মনে করা যাচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে তার থেকে অনেকটা বেশিই হয়েছে। বিশ্বের যাবতীয় খারাপ লোকের মুখ হাসিহাসি। রন্টু যে তাদের একজনের পাল্লায় পড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কী বলল বুড়োটা?
আজ আর মনে হচ্ছে না নিশ্চিন্তে খাওয়া যাবে। রন্টু বিরক্ত হয়ে বলল, বললাম তো।
কণিকাদেবী কঠিন চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আবার বলো। দরকার হলে একশোবার, হাজারবার বলবে। লোকটার উদ্দেশ্য আমায় বুঝতে হবে।
অচেনা, অজানা, নোংরা ধরনের মানুষটা রন্টুকে সত্যি বড় অদ্ভুত একটা কথা বলেছে। আগামী রবিবার রন্টুকে তেঁতুলডাঙার মোড়ে যেতে বলেছে। ঠিক বিকেল চারটে বেজে পনেরো মিনিটে নাকি সেখানে পৌঁছোতে হবে!
সারা দুপুর ছটফট করলেন কণিকাদেবী। রন্টুর বাবাকে মোট ন’বার মোবাইল ফোনে ধরবার চেষ্টা করলেন। পাওয়া গেল না। মোবাইল বন্ধ। নিশ্চয় মিটিং চলছে। কণিকাদেবীর কেমন পাগল পাগল লাগছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তেঁতুলডাঙার মোড়, তেঁতুলডাঙার মোড়।
কোথায় সেটা? কী আছে সেখানে? রন্টুকে লোকটা কেন সেখানে যেতে বলল?
কণিকাদেবীরা পূর্ব কলকাতার এই পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে এসেছেন মাত্র বছর দেড়েক হল। পাড়ার কিছুই চেনেন না। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জিম, বিউটি পার্লার, কমিউনিটি হল, লাইব্রেরি, সাইবার কাফে, চিনা রেস্তোরাঁ, বুটিক— সব। পাড়া চেনার দরকার কী? এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কণিকাদেবী রন্টুর ঘরে উঁকি দিলেন। রন্টু অঙ্ক করছে। বিকেলে অঙ্কের স্যার আসবে। সময়টা নিয়ে রন্টু একটু গাঁইগুঁই করেছিল। কণিকাদেবী শোনেননি। অঙ্ক শেখার শ্রেষ্ঠ সময় হল বিকেল। তারপর আসবেন ইংরেজি লিটারেচার এবং কম্পোজিশনের দিদিমণি। ইতিহাসের জন্য অনেক খুঁজে পেতে একজন বয়স্ক মানুষকে রাখা হয়েছে। ইতিহাস বয়স্ক মানুষ ছাড়া হয় না। তাঁর আসতে সন্ধে। তিনি চলে গেলেই রন্টুকে যেতে হবে পিয়ানো ক্লাসে। সেই ক্লাস হাউজিং কমপ্লেক্সের মধ্যে, ফলে অসুবিধে কিছু নেই। ফিরে আসতে-না-আসতে জেনারেল নলেজ আর আই কিউ স্যারের কোচিং। সপ্তাহে মাত্র দু’দিন। ফলে কিছুতেই কামাই করা যাবে না। ভদ্রলোককে বাড়িতে এসে পড়াবার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। রাজি হননি। লিফ্টে উঠলে ওনার নাকি মাথা ঝিমঝিম করে। মনে মনে ছেলের রুটিন ঝালিয়ে নিয়ে কণিকাদেবী খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
সন্ধের মুখে রন্টুর বাবাকে ফোনে ধরা গেল। সুনীলবাবু সেই সময় দিনের আঠারো নম্বর মিটিং শেষ করে উনিশ নম্বরে ঢুকছেন। স্বাভাবিক কারণে মেজাজ তেমন ভাল নয়। বিরক্ত গলায় ফোন তুললেন।
তুমি তেঁতুলডাঙা চেনো?
কী ডাঙা?
তেঁতুলডাঙা। তেঁতুলডাঙার মোড়।
সুনীলবাবু চাপা গলায় বললেন, দেখো কণিকা, আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত। এটা নিশ্চয় রন্টুর কোনও জি কে প্রশ্ন। ছেলের উদ্ভট উদ্ভট সব জি কে নিয়ে তুমি আমাকে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত করো। টেল হিম টু কনসাল্ট ইন্টারনেট, গ্লোব, আটলাস ডিরেক্টরি। সবই ওর আছে। কোথায় কোন ডাঙা, কোথায় কোন জল আমি কি সব মুখস্থ করে রাখি?
আহা, তুমি ব্যাপারটা শোনোই না।
কী শুনব? কিছু শুনব না। আজ আঠারোটা মিটিং করেছি, আরও সাতটা করব। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। লগন রন্টুকে কোচিংয়ে পৌঁছে দেবে। আমার ফিরতে রাত হবে।
কণিকাদেবী রেগে বললেন, ছেলের সর্বনাশ হতে চলেছে আর তুমি রাত করে বাড়ি ফিরবে!
সর্বনাশ! কী হয়েছে রন্টুর?
কণিকাদেবী কাঁপাকাঁপা গলায় জানালেন কী হয়েছে। সুনীলবাবু শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, চিন্তা কোরো না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফিরছি।
কণিকাদেবী চিন্তা করবেন না ভেবেছিলেন। কিন্তু পরপর এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল যে চিন্তা বেড়ে গেল কয়েকশো গুণ। চিন্তায় মাথা দপদপ করছে। ঘাড়ের কাছে হালকা ব্যথা।
ঘটনা এক। ড্রাইভার লগন তাঁকে খানিক আগে জানিয়েছে, তেঁতুলডাঙা সে বিলক্ষণ চেনে। হেঁটে যেতে পনেরো মিনিট। গাড়িতে মিনিট সাতেক। তবে যেহেতু সে পৃথিবীর সেরা গাড়ি চালকদের একজন, ইচ্ছে করলে পাঁচ মিনিটে পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করবে না। জায়গাটা অতি নোংরা। কেউ যেতে চায় না। তেঁতুলডাঙার মোড়েই রয়েছে কুখ্যাত আবর্জনার মাঠ। গত পঁয়ত্রিশ বছর সেখানে আশপাশের পাঁচ এলাকার ময়লা ফেলা হয়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ময়লা-ভরতি লরি ছুটেছে ধোঁয়া ছেড়ে। সেখানে কার যেতে ইচ্ছে করবে?
ঘটনা দুই। রতনের মা বাসন মাজতে এসে বলল, শত বললেও তেঁতুলডাঙার মোড়ে সে যাবে না। তার কাছে খবর আছে নরকও অমন নোংরা নয়। সেখানে যাওয়ার জন্য বেশি চাপাচাপি করলে সে বাসন মাজার চাকরি ছেড়ে দেবে। বাসন মাজার চাকরি ছেড়ে দিলে তার কোনও অসুবিধে নেই। সে ছেলের চায়ের দোকানে পাউরুটি আলুর দমের ব্যাবসা দেবে।
তিন নম্বর ঘটনা সবথেকে মারাত্মক।
বিকেলে কণিকাদেবী চকোলেট পাউডার কিনতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়েছিলেন। এখানকার জিনিস নয়। জিনিস বিলেতের। অর্ডার দিয়ে আনাতে হয়। রোজ রাতে রন্টুকে চকোলেট-গোলা দুধ দেওয়া হয়। কণিকাদেবী বিজ্ঞাপন পড়ে জেনেছেন দুধে বিলিতি চকোলেট মেশালে স্মৃতিশক্তি নাকি আড়াই গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, বিজ্ঞাপনে নির্দিষ্ট করে সময়ের কথা কিছু বলা ছিল না। তাই স্মৃতিশক্তি না-বাড়লেও চকোলেট পাউডার কেনা বন্ধ করা যাবে না। সেই চকোলেট কিনতে গিয়ে কণিকাদেবীর সঙ্গে দেখা হল রাধা, তমালিকা, শ্যামলী, মন্দিরাদের। প্রত্যেকেই এই কমপ্লেক্সের বাসিন্দা। কেনাকাটা করতে এলে রোজই এদের সঙ্গে দেখা হয়। এদের ছেলেরাও কম-বেশি সকলেই রন্টুর বয়সি। দেখা হলে ছেলে মানুষ করা বিষয়ক নানাবিধ জরুরি আলোচনা হয়। কিন্তু আজ সকলেরই মুখ শুকনো। দুশ্চিন্তায় থমথমে। কারণ, একজন বুড়োমতো অচেনা লোক এদের ছেলেদেরও সঙ্গে আজ কমপ্লেক্সের বাইরে দেখা করেছে। শুধু দেখা করেছে না, হাসিহাসি মুখে তাদের সকলকে তেঁতুলডাঙায় রবিবার বিকেলে নেমন্তন্ন করেছে!
কণিকাদেবীর শরীর খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। কোনওরকমে লিফ্টে উঠে ফ্ল্যাটে ফিরলেন। রন্টুকে বললেন, পিয়ানো এবং জি কে ক্লাস আজ আর তার যাওয়ার দরকার নেই। ফ্ল্যাট থেকে সে যেন বের না হয়।
ক্লাস বাতিলের কথায় রন্টু একটু অবাক হল। তার থেকে অনেক বেশি অবাক হল ফ্ল্যাট থেকে বের না-হওয়ার আদেশ শুনে। স্কুল আর পড়তে যাওয়া ছাড়া এই কমপ্লেক্সের ছেলেরা ফ্ল্যাট থেকে বের হয় না। সময় নেই। সুযোগও নেই। যে যার ফ্ল্যাটের মধ্যেই ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল খেলে: একা-একা। কম্পিউটার অথবা ভিডিও গেমসে। সুতরাং মায়ের এই কথা অর্থহীন।
অফিসের চারটে মিটিং বাতিল করে সুনীলবাবু রাত আটটায় ফিরে এলেন। কমপ্লেক্সে ঢোকার আগে গেটের দারোয়ানদের ডেকে জানতে চাইলেন, নীল শার্ট, ধুতি আর নোংরা কেড্স পরা কোনও বুড়ো মানুষকে তারা চেনে কিনা।
তারা চিনতে পারেনি।
ঠিক রাত নটার সময় তপোব্রত, কুন্তল, সেলিম, জয়ন্ত, দেবব্রত, অসীম, দেবাঙ্কুরের বাবা-মায়েরা থমথমে মুখে কণিকাদেবীদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন। এঁদের ছেলেরা প্রত্যেকেই তেঁতুলভাঙার আবর্জনা-মাঠে রবিবার নেমন্তন্ন পেয়েছে। এই কমপ্লেক্সের রীতি অতিথি এলে কফি দিতে হবে। কফির বদলে চা বা ঘোল দিলে খুব নিন্দে হয়। বাধ্য হয়ে কণিকাদেবী কফি বানালেন। কফির নিয়ম হল, চিন্তিত মনে এ জিনিস তৈরি করলে চিনির পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। এবারও তাই হল। কিন্তু অতিথিরা আরও বেশি চিন্তিত থাকায় বেশি চিনির ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না। আলোচনা শুরু হল। দেখা গেল এঁরা কেউই কখনও তেঁতুলডাঙার মাঠের ধারেকাছে যাননি। জায়গাটা সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা নেই। দেবব্রতর মা প্রস্তাব দিলেন, আজ রাতেই ওখানে যাওয়া উচিত। কুন্তলের বাবা জানতে চাইলেন, ছেলেদের স্কুল যাওয়া কি কদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজন? সেলিমের বাবা বললেন, স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কালই কথা বলা যাক। জয়ন্তর মা বললেন, রবিবার আমরা নিজেরা ওই তেঁতুল না কী যেন জায়গাটায় যেতে পারি না? কণিকাদেবী বললেন, খেপেছ? তুমি জায়গাটা দেখোনি বলেই যাওয়ার কথা বলছ। ওটা সিমলা না উটি? একটা ভ্যাট। নিশ্চয় বড় কোনও ফাঁদ পাতা হয়েছে। জয়ন্তর মা এটা শুনে আরও ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, আমি ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। ছেলেটা একা আছে।
শেষ পর্যন্ত সুনীলবাবুর প্রস্তাবই মেনে নেওয়া হল। ঠিক হল, একেবারে দেরি নয়। আজ রাতেই থানায় যাওয়া হবে। পুলিশকে জানানো হবে সব। নিশ্চয় বুড়ো লোকটার কোনও বড় ফন্দি আছে। বড় ধরনের কোনও ক্রাইম। সেটা ছেলেধরা, ড্রাগ, চোরাকারবারি যা খুশি হতে পারে। একমাত্র পুলিশ বুড়োটাকে ধরতে পারলে রহস্যের সমাধান হবে।
ওসি নিজে সুনীলবাবুর কাছ থেকে সব শুনলেন। বললেন, আপনারা চিন্তা করবেন না। আজ শুক্রবার। হাতে তো একটা দিন সময় আছে। এই একটা দিন একটু অ্যালার্ট থাকুন। ছেলেদের নজরে রাখুন। মনে হচ্ছে, আমরা লোকটাকে ধরে ফেলব।
সত্যি সত্যি রবিবার সকালে তেঁতুলডাঙার মোড় থেকে একটা বুড়ো লোক ধরা পড়ল। তার পরনে নীল শার্ট, ধুতি। পায়ে কেড্স। হাতে শিক-ভাঙা ছাতা।
থানা থেকে ফোন পেয়ে সুনীলবাবু নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন। ওসি তাঁকে দেখে হাসলেন। বললেন, আসুন আসুন সুনীলবাবু। চা খান। বিস্কুট দিতে বলি? আপনাদের সেই খারাপ লোকটাকে আমরা ধরেছি। সুনীলবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ধন্যবাদ। খুবই ধন্যবাদ আপনাকে। লোকটা কিছু বলেছে?— বলেছে। বড় অদ্ভুত কথা বলেছে লোকটা। আমার অফিসার খোঁজ নিয়ে এসেছে। তারাও বড় অদ্ভুত কথা বলছে সুনীলবাবু।
সুনীলবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, অদ্ভুত কথা! কী কথা?
ওসি হেসে বললেন, চলুন আমরা নিজেরা একবার দেখে আসি। জিপ রেডি আছে। আসামিকে জিপে বসিয়ে রেখেছি।
তেঁতুলডাঙার মোড়ে পুলিশের জিপ থেকে নেমে সুনীলবাবু চমকে উঠলেন! এ কোথায় এসেছেন তিনি? এ কি সত্যি? যা দেখছেন তা ঠিক তো। নাকি চোখের ভুল?
না, চোখের ভুল নয়। কোথায় আবর্জনার মাঠ! এ মাঠ তো একেবারে ঝকঝক তকতক করছে! সবুজ ঘাস উঁকি দিচ্ছে এদিক-ওদিক! চারপাশে রঙিন কাগজের বেড়া। সাদা চুনের দাগ। সেই দাগ ধরে ফুলের টব সাজাচ্ছে একদল ছেলে। সামনে নতুন সাইনবোর্ড। তাতে বেঁকা বেঁকা করে করে লেখা— ময়লা সরিয়ে এই মাঠ আজ থেকে খেলার মাঠ হিসেবে চালু করা হল। আমরা চাই, এলাকার সব ছোটরা বিকেলে এখানে চলে আসুক। খেলুক। আর আবর্জনা দেখলে রে রে করে তেড়ে যাক সারাজীবন। বিনীত, আবর্জনা সরানো সঙ্ঘ।
জিপ থেকে নেমে এসেছে বুড়ো মানুষটা। হাত কচলে হেসে বলল, এক সপ্তাহ লেগেছে স্যার। ওনলি ওয়ান উইক। ছেলেপিলে জোগাড় করে, চাঁদা তুলে…। জানেনই তো, এখানে খেলার মাঠের বড্ড টানাটানি পড়েছে। তাই একটা চেষ্টা আর কী। ছোট চেষ্টা। বিকেলে ফুটবল ম্যাচ দেখতে কিন্তু আসতেই হবে। না বললে শুনব না।
বিস্মিত সুনীলবাবু এতক্ষণ বিড়বিড় করে শুধু বলছিলেন— বাঃ অপূর্ব! চমৎকার! এবার ওসি-র দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা অনুরোধ ছিল। যদি পারেন জিপটা পাঠিয়ে আমার ছেলেটাকে একটু নিয়ে আসুন। বলবেন ওর ফুটবলটাও যেন আনে। ওটা আলমারিতে ভোলা আছে। একেবারে ওপরের তাকে জামা-কাপড়ের পেছনে। খুঁজে না-পেলে সে যেন তার মাকে বলে।