নতুন মাস্টারমশাই
একটা আনন্দের জিনিস হল ছুটি। ছুটির সময় মন থাকবে ফুরফুরে, মুখ থাকবে হাসিহাসি৷ কিন্তু গরমের ছুটি পড়লেই আমরা ক্লাস সেভেনের ছেলেরা সব মুখ ব্যাজার করে ফেলি। সকালে কান্নাকান্না মুখ করে ঘুম থেকে উঠি। দুপুরে গম্ভীর মুখে সাঁতার কাটতে যাই। ভাতের পাতে যখন মিষ্টি আম খাই তখন আমাদের দেখলে মনে হবে উচ্ছে খাচ্ছি। এমনকী, বিকেলে ফুটবল খেলার সময়ও আমাদের কপালে থাকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। সন্ধে নাগাদ অবস্থা একেবারে চরমে ওঠে। আমরা অনেকেই সেইসময় লুকিয়ে চোখের জল মুছি।
এর কারণ হোমটাস্ক। হোমটাস্ক দিয়ে যদি গিনেস বুকে নাম তোলার কোনও ব্যাপার থাকত তা হলে আমাদের এই স্কুল সেখানে অনায়াসে নাম তুলে ফেলত। শুধু নাম নয়, সঙ্গে একটা ছবিও থাকত। সেই ছবিতে দেখা যেত আমরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে হাঁটুমুড়ে বসে আছি। আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন মাস্টারমশাইরা। তাঁদের মুখ গম্ভীর। ব্যাকগ্রাউন্ডে স্কুল-বাড়ি দেখা যাচ্ছে।
আসলে আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাইরা গরমের ছুটির আগে ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। কেউ শ’য়ের কমে কথাই বলতে চান না। ছুটিতে তিনশো অঙ্ক, দুশো ট্রানস্লেশন, একশো বাক্য রচনা করতে দেন। এর সঙ্গে ভূগোল, বিজ্ঞান, ইতিহাস তো রয়েছেই। ছুটিতে মজা করব কী, গরমের ছুটিতে হোমটাস্কের ছ্যাঁকা খেতে খেতেই আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়।
এবার অবস্থা একেবারে অন্যরকম। একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে। হোমটাস্কের যতই বোঝা থাকুক না কেন আমরা ছুটি কাটাচ্ছি একটা দুর্দান্ত উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে। মজার উত্তেজনা। এরকম গরমের ছুটি আমরা আগে কখনও পাইনি। অন্য স্কুলের কেউ কখনও পেয়েছে কি না তাও জানা নেই।
আসলে মাসতিনেক হল আমাদের স্কুলে একজন নতুন মাস্টারমশাই এসেছেন। তিনি অমলস্যার। তিনি একজন অন্যরকম মানুষ। গরমের ছুটিটাকেও তিনি অন্যরকম করে দিয়েছেন।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রথমদিকে নতুন মাস্টারমশাইরা একটা রাগী রাগী মখ করে ঘোরাফেরা করেন। দেখলে মনে হয়, এতদিন ধরে আমরা অনেক বেয়াদপি করে এসেছি, আর নয়। শুধুমাত্র আমাদের শায়েস্তা করতেই তিনি এই পাড়াগাঁয়ের স্কুলে আসতে রাজি হয়েছেন। এই সময়ে নতুন মাস্টারমশাইরা ছাত্রদের ছোট অপরাধেও বড় ধরনের কান মলে দেন। কম হট্টগোলে বেশি জোরে ধমক দেন। পাটীগণিতের সবচেয়ে কঠিন অঙ্কগুলো খুঁজে বের করে বোর্ডে করতে বলেন।
তাই নতুন কেউ এলে প্রথম ক’টা দিন আমাদের বুক দুরদুর করে।
অমলস্যার আমাদের চমকে দিলেন। তিনি প্রথমদিন আমাদের ক্লাসে যখন ঢুকলেন তখন তাঁর মুখে মিটিমিটি হাসি। আমাদের চোখ বড় হয়ে গেল। কী ভয়ানক ঘটনা! তমাল আমার পাশে বসে। সে ফিসফিস করে বলল, কী ব্যাপার বল তো?
আমি বললাম, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, ভয়ংকর কোনও বিপদ হবে।
অমলস্যার টেবিলের ওপর চক-ডাস্টার রেখে চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, কী হল? তোমাদের ক্লাসে কোনও দুঃখের ঘটনা ঘটেছে নাকি, সবার মুখ এমন থমথমে কেন? আশ্চর্য তো! তারপর ফাস্ট বেঞ্চে বসা প্রশান্তর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এই যে ছেলে, স্ট্যান্ড আপ। প্রশান্ত কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল।
কী হয়েছে তোমাদের? সবাই এরকম কাঁদোকাঁদো কেন?
প্রশান্ত আমতা আমতা করে বলল, স্যার কিছু হয়নি।
স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, কিছু হয়নি! অদ্ভুত ব্যাপার তো৷ কিছু না হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস সেভেনের ছেলেরা এমন চুপ করে বসে আছে! তোমাদের কারও মুখে হাসি নেই কেন?
তপন সাহস করে উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যার, আমাদের হাসি পাচ্ছে না। তপনের কথা শুনে আমরা তো দম বন্ধ করে ফেললাম। এবার সত্যি ভয়ংকর একটা কিছু ঘটবে।
স্যার অবাক হয়ে বললেন, বলো কী! হাসি পাচ্ছে না? ক্লাস সেভেনে পড়ো অথচ বলছ হাসি পাচ্ছে না! আমরা যখন তোমাদের ক্লাসে পড়তাম তখন তো সবসময়ই হাসি পেত আমাদের। মাস্টারমশাইরা বলতেন, এদের ক্লাসের হাসি রোগ আছে। আর আজ তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে, তোমাদের ক্লাসে গোমড়া রোগ আছে। ভারী চিন্তায় ফেললে দেখছি।
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছি। বুঝতে পারছি না ঘটনা কোনদিকে এগোচ্ছে।
এবার উঠে দাঁড়াল গদাই। আমরা প্রমাদ গুণলাম। গদাই হল পাগল ধরনের ছেলে। তাকে আমরা কি পাগলা গদাই বলে। তার স্বভাবই হল দুমদাম করে এমন সব কথা বলা, এমন সব কাজ করা যা কখনওই বলা বা করা উচিত নয়। এর জন্য বেশিরভাগ সময়ই তাকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গদাই বলল, স্যার, আপনাকে আমাদের ভয় করছে, তাই আমরা হাসছি না।
নতুন স্যার অল্প হেসে বললেন, তোমাদেরকেও আমার খুব ভয় করছে। কেন করছে জানো? হাসি, কান্না, এগুলো হল এক ধরনের ভাইরাসবাহিত অসুখ। সর্দি-কাশির মতো ছোঁয়াচে জিনিস। চট করে অন্যকে ধরে ফেলে। আমার মনে হচ্ছে, তোমাদের ক্লাসে বেশিক্ষণ থাকলে আমার মুখটাও একসময় গোমড়া হতে হতে প্যাঁচার মতো হয়ে যাবে। তোমরা তখন আড়ালে আমাকে ‘প্যাঁচা স্যার’ বলে ডাকবে। সংক্ষেপে বলবে পি. এস। এবার আর আমরা সামলাতে পারলাম না। খুব জোরে হেসে ফেললাম।
অদ্ভুত কাণ্ড কিন্তু এখানেই শেষ হল না।
এরপর অমলস্যার বললেন, দ্যাখো ছেলেরা, আজ আমি কিন্তু পড়াতে পারব না। তার চেয়েও একটা জরুরি কাজ আছে। সেই কাজটার জন্য তোমাদের সাহায্য চাই। আমি জানি, ক্লাস সেভেনের ছেলেরা এই কাজে সবচেয়ে ভাল সাহায্য করতে পারবে।
আমাদের ভয় ততক্ষণে কেটে গেছে। আমরা চিৎকার করে উঠলাম, কী কাজ স্যার?
স্যার বললেন, দাঁড়াও দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসি। কাজটা গোপন। কেউ দেখে ফেললে বিপদ হতে পারে। এরপর আমাদের অবাক করে স্যার সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে এলেন। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, দ্যাখো, আমি আজ নতুন এসেছি। স্কুলের অন্য মাস্টারমশাইদের কাউকেই আমি চিনি না। কে কম রাগী, কে বেশি রাগী কিছুই জানা নেই। এমনকী কে অঙ্ক করান, কে ভূগোলের স্যার তাও বলতে পারব না। তোমরা যদি চট করে একটু বলে দাও আর দেখিয়ে দাও তা হলে আমার উপকার হয়। তোমরা কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?
আমরা তো লাফিয়ে উঠলাম। বললাম, নিশ্চয় স্যার, খুব পারব।
নতুন স্যার বললেন, আমি জানতাম তোমরা পারবে। এরপর একে একে আমরা স্যারদের নকল করে দেখাতে লাগলাম।
প্রশান্ত দেখাল ভূগোলস্যারের গলাখাঁকারি। অশোক দেখাল বিজ্ঞানস্যার কীভাবে ভৌতবিজ্ঞান রিডিং পড়তে বলে ঘুমিয়ে পড়েন। সিদ্ধার্থ দেখাল অঙ্কস্যারের ধমকানি। গদাই দেখাল হেডমাস্টারমশাইয়ের পিছনে হাত রেখে পায়চারি। আমরা তো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লাম। নতুন স্যারও আমাদের হাসিতে যোগ দিলেন। ক্লাসের শেষের ঘন্টা পড়তে স্যার বললেন, ধন্যবাদ ছেলেরা, তোমাদের পারফরম্যান্স খুবই ভাল হয়েছে। তবে গুরুজনদের নকল করে দেখানোর কাজটা ভাল জিনিস নয়। বেশ খারাপ জিনিস। আর সেই কারণে আমি সব মাস্টারমশাইয়ের কাছে আলাদা আলাদা ভাবে ক্ষমা চেয়ে নেব। তোমরা কোনও চিন্তা কোরো না।
যেদিন অমলস্যারের ক্লাস থাকে সেদিন আমরা পারতপক্ষে স্কুল কামাই করি না। একশো এক জ্বর হলেও না। বাড়িতে বারণ করলেও শুনি না। ছাত্ররা স্কুল পালায় আর আমরা বাড়ি পালিয়ে স্কুল চলে আসি।
না এসে উপায় কী? অমলস্যার কোনওদিন এসে বলেন, “আজ তোদের বাবরের কীর্তি পড়াব। কিন্তু তার আগে পনেরো মিনিট হবে ধাঁধার ক্লাস।”
আমরা হইহই করে উঠলাম। স্যার তখন এক-এক করে ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে থাকলেন। আমরা কেউ উত্তর দিতে পারলাম, কেউ পারলাম না। কিন্তু আনন্দ একই রকম হত।
তমাল, বল তো এটা কী— জল নেই জলাশয়/ চার অক্ষরে বাঁধা/ কাদা নেই শুধু বালি/ চোখে দেখি ধাঁধা। পারলি না তো? শুধু অঙ্কে নম্বর পেলে তো হবে না, ধাঁধাও পারতে হবে। ঠিক আছে এটা কে পারবে? পা মিলিয়ে হাঁটি/ বর্ষা এলে ফুটি। ভেরি গুড প্রশান্ত। আমি জানতাম তোর মাথায় কিচ্ছু নেই। এখন দেখছি ঘটনা ঠিক নয়। আচ্ছা বিশ্বনাথ বল তো, পথের মাঝে আছেন তিনি/ পা কাটলে মরুভূমি। জিনিসটা কী? কাছাকাছি গেছিস। বাকিটা পরে ভেবে বলিস। নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই।
একদিন আকাশে মেঘ করেছে। অমলস্যার গম্ভীর মুখে ক্লাসে ঢুকে বললেন, আজ একটা মুশকিল হয়ে গেছে।
আমরা বললাম, কী মুশকিল স্যার?
স্যার বললেন, এখন বর্ষাকাল নয়, তবু আজ দেখছি মেঘ করেছে। অসময়ে মেঘ করলে ঘরে থাকার নিয়ম নেই। শুনেছি এতে মেঘেদের নাকি অপমান করা হয়। তারা ভাবে তাদের পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। তখন আর তারা ঠিক সময়েও আসতে চায় না।”
আমরা এরকম অদ্ভুত কথা কখনও শুনিনি। সুরজিৎ বলল, স্যার, তা হলে কী হবে?
অমলস্যার ব্যাজার মুখে বললেন, কী আর হবে? ভেবেছিলাম আজ তোদের মুঘল সাম্রাজ্যের সন-তারিখগুলো মুখস্থ করাব। কিন্তু উপায় নেই। বাধ্য হয়ে সবাইকে এখন মাঠে যেতে হবে।
আমাদের আর পায় কে? হইহই করে সবাই ছুটলাম। মেঘলা মাঠে সবাই মিলে দারুণ মজা করলাম। অমলস্যার নিজে পর্যন্ত আমাদের স্কুল-মাঠের জামগাছটায় চড়ে বসেছেন। সেই স্যারের স্কুল কামাই করার কোনও উপায় আছে!
গরমের ছুটি পড়বার দু’দিন আগে অমলস্যার ক্লাসে এসে বললেন, দ্যাখো ছেলেরা, সব মাস্টারমশাই তোমাদের হোমটাস্ক দিয়েছেন। তোমরা ভেবো না, আমি তোমাদের হোমটাস্ক দেব না। আমিও দেব। খুবই কঠিন হোমটাস্ক দেব। আমি ঠিক করেছি, ছুটির পর স্কুল যেদিন খুলবে সেদিন ক্লাস সেভেনের ছাত্রদের নিয়ে একটা কম্পিটিশন করব। মিউজিক কম্পিটিশন। হেডমাস্টারমশাইকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। বলেছি, ক্লাস সেভেনের ছেলেদের দারুণ প্রতিভা স্যার। ওরা প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু বাজাতে পারে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রদের একটা মিউজিক সেন্স থাকা দরকার। উনি বললেন, সেদিন থাকবে হাফ ছুটি, ছুটির পর হলঘরে কম্পিটিশন হবে। এই গরমের ছুটির সময় তোমরা প্রত্যেকে বাড়িতে কিছু-না-কিছু একটা বাজনা প্রাকটিস করবে। সবাইকে যে ফার্স-সেকেন্ড হতে হবে তা নয়। বাজনা বাজানোর ইচ্ছেটাই আসল। অংশ নেওয়াটাই বড় কথা। মনে রাখবে, এমন কিছু করবে না, যাতে আমায় লজ্জায় পড়তে হয়। যাও এটাই তোমাদের হোমটাস্ক। কথা শেষ করে স্যার মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।
আমরা কপালের উপর চোখ তুলে ইয়া বড় হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
অমলস্যারের হোমটাস্ক আমাদের গরমের ছুটির মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে ঘটল আর এক জমজমাট ঘটনা। বাড়িতে আমরা কে কোন বাজনা প্র্যাকটিস করছি, আদৌ করছি কিনা, করলে কতটা এগিয়েছি, শিখছিই বা কার কাছে—সবই একে অন্যের কাছে গোপন করতে শুরু করলাম। বন্ধুদের মধ্যে দেখা হলেই অঙ্ক, ভূগোল, ট্রানস্লেশনের হোমটাস্ক নিয়ে জোর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাজনার হোমটাস্ক নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। সবাই ভাবতে লাগলাম, বললেই কেলেঙ্কারি। ফাঁস হয়ে যাবে। ছুটির মধ্যে একদিন বাজারে আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় অনুভবের সঙ্গে দেখা হল। বাজনার কথা তুলতেই মুখ গম্ভীর করে বলল, প্লিজ, এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। মা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
তমাল একদিন দুপুরে এসে বলল, খবর শুনেছিস? ভয়ংকর খবর। অসীম কলকাতায় মামাবাড়ি চলে গেছে। ওখানে নাকি মিউজিক স্কুলে ভরতি হয়েছে।
অভিজিৎ একদিন দুপুরে এসে খবর দিল, তপন এই সময়টা নাকি রেওয়াজ করছে। অভিজিৎকে দেখতে পেয়ে তপন অপমানজনকভাবে দরজা জানলা মুখের ওপর বন্ধ করে দিয়েছে। কানাঘুষোয় শোনা গেল, ওর বড়মামা নাকি হংকং থেকে একটা সিনথেসাইজার কিনে এনেছে। এই দুঃসংবাদ শুনে সকলের মন খুব ভেঙে গেল। সিনথেসাইজারের পাশে আমরা যে কেউই দাঁড়াতে পারব না, বুঝতে পারলাম।
স্কুল খোলার দিন একেবারে হইহই কাণ্ড। হাফ ছুটির পর সব ক্লাসের ছেলেরা ভিড় করল হলঘরে। এরকম ঘটনা তো কখনও ঘটেনি। অমলস্যার দারুণ ব্যবস্থা করেছেন। টেবিলে সাদা চাদর পাতা হয়েছে। পাশে ফুলদানি। ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, সামনের আসনে বিচারকরা বসে আছেন। অঙ্কস্যার আর পি টি স্যার। তাঁদের হাতে কাগজ, সেই কাগজে নম্বর দেওয়া হবে। বিশেষ অতিথি হেডমাস্টারমশাইয়ের জন্য আলাদা চেয়ার। তাতে তোয়ালে পাতা। সাদা তোয়ালের খোঁজ হয়েছিল, পাওয়া যায়নি বলে নীল তোয়ালে পাততে হয়েছে। স্যারেদের পর ক্লাস সেভেনের বাবা-মা’রা বসেছেন। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে হেডমাস্টারমশাই সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। বললেন, এর আগে আমরা স্কুলে ফুটবল, নাটক এবং আবৃত্তির প্রতিযোগিতা করেছি। কিন্তু বাজনার প্রতিযোগিতা এই প্রথম। যদি ভাল হয় তা হলে সব ক্লাসেই করব। না হলে করব না।
এর পর পি টি স্যার খালি গলায় উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন, আন গো তোরা কার কী আছে/ দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে…
পি টি স্যার আরও একটা গান গাইতে গিয়েছিলেন, কিন্তু উদ্বোধনী সংগীত সাধারণত একটাই হয় বলে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর শুরু হল প্রতিযোগিতা।
একজন করে বাজনা নিয়ে আসছে, বাজাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট করে সময়। ঘটনা যে কী ঘটতে লাগল তা না-দেখলে, না-শুনলে বোঝানো মুশকিল। একটু বলছি। প্রশান্ত বাজাল তবলা। মনে হল যেন ধাঁই ধপ ধপ করে ইট ভাঙছে। শুভময় কোথা থেকে একটা আড় বাঁশি নিয়ে এসেছে। খুব কায়দা করে ধরে চোখ বুজে ফুঁ দিল তাতে। কিন্তু আওয়াজ কোথায়? গলা ফুলিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কোনও শব্দ বের করতে পারল না। তপন হারমোনিয়ামের বেলো টিপে বাজাল, রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে…। দু’-একবার অন্য গানের সুর চলে এলেও হারমোনিয়াম বাজানো খুব একটা মন্দ হল না। সবাই হাততালি দিল। বিক্রম এনেছিল খঞ্জনি। টুং টাং শব্দে একটা মজা ছিল। তাপস যে গিটার বাজাতে পারে তা আমরা জানতাম। ও যখন এল তখন আমরা নিশ্চিন্ত। একটা প্রাইজ ও নিচ্ছে। কিন্তু কী কাণ্ড! ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটা সে শুরু করল চমৎকার। কিন্তু ‘যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা’ লাইনটায় পৌঁছেই বেচারির গিটারের তার গেল পটাং করে ছিঁডে। একটা তার নয়, দুটো তার। সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। অনুভব খুব কায়দা করেছে। সে শিখে এসেছে একতারা। শুধু শিখে আসেনি, নিজে বাউলও সেজেছে। আমাদের তো চোখ ট্যারা। সাধে কি অনুভব ক্লাসে ফার্স্ট হয়। এ ছেলে আজ বাজনাতেও ফার্স্ট হবে। আনন্দের বিষয় তার একতারা থেকে কী পিড়িং পিড়িং করে আওয়াজ বের হল শোনাই গেল না। একতারার চেয়ে ওর পায়ে বাঁধা ঘুঙুরের আওয়াজই বেশি করে শুনতে পেলাম। হেডমাস্টারমশাই গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কী বাজালে অনুভব, একতারা না ঘুঙুর? তুমি বাজনার চেয়ে সাজগোজে বেশি মন দিয়েছ দেখছি।
অনুভব কাঁদোকাঁদো গলায় নার্ভাস হয়ে বলল, স্যার, একতারা বাজালাম। না না ঘুঙুর। না না একতারা। না না…।
এর পর এল তপনের সিনথেসাইজারের সময়।
বিরাট কাপড়ের ব্যাগে করে তপন নিয়ে এসেছে জিনিসটাকে। আমরা সব উঠে দাঁড়ালাম। এ জিনিস আমরা অনেকেই দেখিনি কখনও। সত্যি বাজনা বটে। তাক লেগে যায়। মাস্টারমশাইরাও চমকে গেলেন। দূর থেকেই বোঝা গেল গর্বে তপনের বুকের ছাতি ফুলে উঠেছে। সে গম্ভীর মুখে টেবিলের দু’পাশে ছোট ছোট দুটো সাউন্ড বক্স সাজিয়ে ফেলল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে বাজনাটার সঙ্গে এই তার সেই তার জুড়ল। এতক্ষণ আমাদের বাজনার প্রতিভা দেখে হেডমাস্টারমশাইয়ের মুখ রাগে ফুলছিল। অমলস্যার ক্রমশ কাঁচুমাচু হয়ে পড়ছিলেন। তপনের সিনথেসাইজার দেখার পর তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছে। সাজানো গোছানোর পর তপন মুখ তুলে বলল, প্লাগ পয়েন্ট কোথায়? সিনথেসাইজার বাজাতে গেলে তো কারেন্ট চাই।
অমলস্যার বললেন, ঠিকই তো, প্লাগ পয়েন্ট কোথায়?
আমরা বললাম, কোথায়?
দেওয়ালে তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্লাগ পয়েন্ট পাওয়া গেল না সুইচবোর্ডে। এ ঘরে আলো, পাখা আছে, কিন্তু প্লাগ পয়েন্ট নেই। তপন আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা প্রায় সকলেরই। অমলস্যারকে দেখে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। বিচারকরা উঠে পড়েছেন।
হেডমাস্টারমশাইকে দেখে মনে হতে লাগল, মানুষটার এতক্ষণ রাগে শুধু মুখ ফুলছিল। এবার হাত পা-ও ফুলতে শুরু করেছে। এমন সময় পাগলা গদাই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। তার হাতে একটা মস্ত বড় মাটির হাঁড়ি। একশো রসগোল্লা কিনলে মিষ্টির দোকানে যেরকম হাঁড়ি দেয় সেরকম। অমলস্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, এটা কী?
গদাই হাসিহাসি মুখে বলল, হাঁড়ি স্যার। রসগোল্লার হাঁড়ি। জ্যাঠামশাইয়ের মিষ্টির দোকান থেকে নিয়ে এসেছি।
হেডমাস্টারমশাই অমলস্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসবের মানে কী? রসিকতার একটা সীমা আছে। এই ছেলে কি এখন হাঁড়ি বাজাবে আর আমাদের বসে বসে তা শুনতে হবে?
আমরা তো ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। গদাইয়ের জন্য গোটা ক্লাস সেভেনের ভাগ্যে যে ভয়ংকর শাস্তি ঝুলছে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। পাগলাটাকে হাত ধরে টেনে আনার সুযোগও পাচ্ছি না।
গদাই টেবিলের উপর হাঁড়ি রেখে বাজাতে শুরু করল। তারে কেটে তাক তাক, তারে কেটে তাক।
মুহূর্তের মধ্যে সকলের চোখমুখের অবস্থা বদলে গেল… যে-মাটির হাঁড়ি কোনও বাজনাই নয়, তার থেকে এত চমৎকার বাজনা তৈরি করা যায়! তারে কেটে তাক তাক, তারে কেটে তাক। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। বিচারকরা আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। আরে, হেডমাস্টারমশাই পা ঠুকে তাল দিচ্ছেন যে! পাঁচ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর গদাইকে আরও পাঁচ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেওয়া হল। অমলস্যারের দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর চোখে জল।
মাটির হাঁড়ি আমাদের প্রাণ বাঁচাল।