লজ্জাহর
বিমল মিত্র
রামায়ণের যুগে ধরণী একবার দ্বিধা হয়েছিল। সে-রামও নেই, সে-অযোধ্যাও নেই। কিন্তু কলিযুগে যদি দ্বিধা হতো ধরণী, তো আর কারো সুবিধে হোক আর না-হোক—ভারি সুবিধে হতো রমাপতিরা।
সত্যি, অমন অহেতুক লজ্জাও বুঝি কোনও পুরুষ-মানুষের হয় না।
মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সবাই গল্প করছি—
হঠাৎ চীকার করে উঠলোননীলাল। বললে—ঐ আসছে রে—
কিন্তু ওই পর্যন্ত। আমরা সবাই চেয়ে দেখলাম—রমাপতি আমাদের দেখেই আবার নিজের বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। সবাই বুঝলাম রমাপতির যত জরুরী কাজই থাক, এখনকার মতো এ-রাস্তা মাড়ানো ওর বন্ধ। বাড়িতে ফিরে গিয়ে হয়তো চুপ করে বসে থাকবে খানিকক্ষণ তার পর হয়তো চাকরকে পাঠাবে দেখতে চাকর যদি ফিরে গিয়ে বলে যে রাস্তা পরিষ্কার তখন আবার বেরুতে পারবে!
বললাম—চল আমরা সরে যাই, ওর অসুবিধে করে লাভ কি?
ননীলাল বললে–কেন সরতে যাবো? এ-রাস্তা কি ওর? লেখাপড়া শিখে এমন মেয়েছেলের বেহদ্দ—আমরা কি ওকে খেয়ে ফেলবো?
এমনই রমাপতি! রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে পাছে কেউ জিজ্ঞেস করে বসে কেমন আছ, তখন যে কথা বলতে হবে মুখ তুলতে হবে চোখে চোখ রাখতে হবে!
সমবয়সী বৌদিরা হাসো বলে—ছোট ঠাকুরপো বিয়ে হলে কী করবে…
মেজ বৌদি বলে—আমাদের সামনেই মুখ তুলে কথা বলতে পারে না, তো বউ-এর সঙ্গে কী করে রাত কাটাবে, ভাই—
বাড়িতে অনেকগুলো বৌদি কেউ কেউ কমবয়সী আবার। তারা নিজের নিজের স্বামীর কথাটা কল্পনা করে নেয়। যত কল্পনা করে তত হাসে অন্য সব ভাইরা সহজ স্বাভাবিক মানুষ। ব্যতিক্রম শুধু রমাপতি।
শুনতে পাই বাড়িতেও রমাপতি নিজের নির্দিষ্ট ঘরটার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। ঘরের মধ্যে বসে কী করে কারো জানবার কথা নয়। খাবার ডাক পড়লে একবার খেয়ে আসে। তরকারিতে নুন না হলেও বলবে না মুখো জলের গ্লাস দিতে ভুল হলেও চেয়ে নেবে না। পৃথিবীকে এড়িয়ে চলতে পারলেই যেন ভালো।
এক এক দিন হঠাৎ বাড়ি আসার পথে দূর থেকে দেখতে পাই হয়তো রমাপতি হেঁটে আসছে। সোজা ট্রাম রাস্তার দিকেই আসছে। তার পর আমাকে দেখতে পেয়েই পাশের গলির ভেতর ঢুকে পড়লো। পাঁচ মিনিটের রাস্তাটা ত্যাগ করে পনেরো মিনিটের গলিপথ দিয়েই উঠবে ট্রাম-রাস্তায়।
কিন্তু তবু অতর্কিতেও তো দেখা হওয়া সম্ভব!
গলির বাঁকেই যদি দেখা হয়ে যায় কোনও চেনা লোকের সঙ্গে! হয়তো মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন পাড়ার প্রবীণতম লোক। জিজ্ঞেস করে বসলেন—এই যে রমাপতি, তোমার বাবা বাড়ি আছে নাকি?
নির্দোষ নির্বিরোধ প্রশ্ন। আততায়ী নয় যে ভয়ে আঁতকে উঠতে হবে। পাওনাদার নয় যে মিথ্যে বলার প্রয়োজন হবে একটা হাঁ’ বা ‘না’—তাও বলতে রমাপতির মাথা নীচু হয়ে আসে, কান লাল হয়ে ওঠে, কপালে ঘাম ঝরে। সে এক মর্মান্তিক যন্ত্রণা যেন তার পর সেখান থেকে এমন ভাবে সরে পড়ে, যেন মহা বিপদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে।
ছোটবেলায় রমাপতি একবার কেঁদে ফেলেছিল।
তা ননীলালেরই দোষ সেটা।
একা-একা রমাপতি চলেছিল কালীঘাট স্টেশনের দিকে ও-দিকটা এমনিতেই নিরিবিলি। বিকেলবেলা ট্রেন থাকে না। চারিদিকে যতদূর চাও কেবল ধূ-ধূ ফাঁকা বড় প্রিয় স্থান ছিল ওটা রমাপতিরা আমরা জানতাম না তা
দল বেঁধে আমরাও ওদিকে গেছি। ধূমপানের হাতেখড়ির পক্ষে জায়গাটা আদর্শস্থানীয়। হঠাৎ নজরে পড়েছে সকলের আগে বিশ্বনাথের। বললে—আরে, রমাপতি না?
সকলে সত্যিই অবাক হয়ে দেখলাম—দূরে রেললাইনের পাশের রাস্তা ধরে একা-একা চলেছে রমাপতি। আমাদের দিকে পেছন ফেরা। দেখতে পায় নি আমাদের।
দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চাপলো ননীলালের। বললে—দাঁড়া, এক কাজ করি—ওর কাছা খুলে দিয়ে আসি—
যে-কথা সেই কাজ। তখন কম বয়েস সকলেরা একটা নিষিদ্ধ কাজ করতে পারার উল্লাসে সবাই উন্মত্ত। ননীলালের উপস্থিত টের পায় নি রমাপতি ননীলালের রসিকতার সিদ্ধিতে সবাই মাঠ কাঁপিয়ে হো-হো করে হেসে উঠেছি।
কিন্তু রমাপতির কাছে গিয়ে মুখখানার দিকে চেয়ে ভারি মায়া হলো। রমাপতি হাউ হাউ করে কাঁদছে।
সে-গল্প বিয়ের পর প্রমীলার কাছেও করেছি।
প্রমীলা বলে—আহা বেচারা, তোমরাই ওকে ওমনি করে তুলেছ—
সেদিন প্রমীলা বললে—ওই বুঝি তোমাদের রমাপতি—এসো এসো—দ্যাখো—দেখে যাও–
বললাম—ওকে তুমি চিনলে কী করে?
প্রমীলা বললে—ও না হয়ে যায় না, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—একবার মুখ তুলে পর্যন্ত চাইলে না ওপর দিকে, ও বয়সে এমন দেখা যায় না তো—
বারান্দার কাছে গিয়ে দেখি সত্যি ঠিকই চিনেছে। রমাপতিই বটে।
বললাম—সরে এসো, নইলে মূৰ্ছা যাবে এখনি—
তা অন্যায়ও কিছু বলি নি আমি।
ক্লাস সেভেন-এ গুড-কনডাক্টের প্রাইজ পেয়েছিল রমাপতি। মোটা মোটা তিনখানা ইংরিজি ছবির বই। সেই প্রথম আমাদের স্কুলে ও-প্রাইজের প্রচলন হলো। স্কুলের হল-এ লোকারণ্য। আমরা স্কুলের ছাত্ররা সেজেগুঁজে গিয়ে একেবারে সামনের বেঞ্চিতে বসেছি। আমরা খারাপ ছেলের দল সবাই। কেউ প্রাইজ পাবো না। কমিশনার ম্যাকেয়ার সাহেব নিজের হাতে সবাইকে প্রাইজ দিচ্ছেন। এক এক জন করে বুক ফুলিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর প্রাইজ নিয়ে প্রণাম করে নিজের জায়গায় এসে বসছে।
তার পর ম্যাকেয়ার সাহেব ডাকলেন—মাস্টার রমাপটি সিনহা…
কেউ হাজির হলো না।
সাহেব আবার ডাকলেন—মাস্টার রমাপটি সিনহা—
সেক্রেটারি পরিতোষবাবু এদিক ওদিক চাইতে লাগলেন। হেডমাস্টার কৈলাসবাবুও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন আমাদের দিকে, তার পর নীচু গলায় কী বললেন সাহেবকে গিয়ে তার পর থেকে গুড-কনডাক্টের প্রাইজটা বরাবর রমাপতিই পেয়ে এসেছে। কিন্তু কখনও সভায় এসে উপস্থিত হয় নি। সে-সময়টা কালীঘাট স্টেশনের নিরিবিলি রেল-লাইনটার পাশের রাস্তা ধরে একা-একা ঘুরে বেড়িয়েছে সে।
এর পর আমরা একে একে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে ঢুকেছি। একা রমাপতি আই. এ. পাশ করেছে, বি. এ. পাশ করেছে। আমাদের সঙ্গে কৃচিৎ কদাচিৎ দেখা হয়। দেখা যদিই বা হয় তো সে একতরফা!
দেখা না হলেও কিন্তু রমাপতির খবর নানাসূত্রে পেয়ে থাকি। চুল ছাঁটতে ছাঁটতে কানাই নাপিত বলেছিল—ছোটবাবু, দাড়িটা এবার কামাতে শুরু করুন—আর ভালো দেখায় না—
আমরা তখন সবাই ক্ষুর ধরেছি। কিন্তু রমাপতি তখনও একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে দিব্যি মুখ ঢেকে বেড়ায়।
কানাই এ-বাড়ির পুরনো নাপিত। পৈতৃক নাপিতও বলা যায়। রমাপতিকে জন্মাতে দেখেছে।
বললে নতুন ক্ষুরটা আপনাকে দিয়েই বউনি করি আজ কী বলেন ছোটবাবু?
রমাপতি মুখ নীচু করে খানিকক্ষণ ভেবে বলেছিল—নানা, ছি—লোকে কী বলবে—
কানাই নাপিত বলেছিল—লোকের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তো—আপনার দাড়ি নিয়ে যেন মাথা ঘামাচ্ছে সব—
–না থাক রে, সামনে গরমের ছুটি আসছে সেই সময় কলেজ বন্ধ থাকবে—তখন দিস বরং কামিয়ে—
হঠাৎ যেদিন প্রথম দাড়ি-গোঁফ-কামানো চেহারা দেখলাম—সেদিন ঠিক চিনতে পারি নি। ছাতার আড়ালে মুখ ঢেকে চলেছে রমাপতি আমাকে দেখে হঠাৎ গতিবেগ বাড়িয়ে দিলো নতুন জুতো পরতে লজ্জা! নতুন জামা পরতে লজ্জা! ওর মনে হয় সবাই ওকে দেখছে যেন!
উমাপতিদার বিয়েতে বৌভাতের নিমন্ত্রণে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—সেজদা, রমাপতিকে দেখছি না যে—সে কোথায়—
সেজদা বললে সে তো সকালবেলা খেয়ে-দেয়ে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে, সব লোকজন বিদেয় হলে রাত্তিরের দিকে বাড়ি ঢুকবে—
এ পাড়ায় মেয়েরা পরস্পরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাসটা রেখেছে। যেদিন দুপুরবেলা কেউ এল বাড়িতে, রমাপতি বাইরের সিঁড়ি দিয়ে টিপি-টিপি পায়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে কোনও রকমে ট্রামে-বাসে উঠে পড়তে পারলেই আর ভয় নেই। সব অচেনা লোক। অচেনা লোকের কাছে বিশেষ লজ্জা নেই তার।
বড় যদুপতির শ্বশুর এ বাড়িতে কাজে-কর্মে ছাড়া বড় একটা আসেন না। মেজ ঊষাপতির শ্বশুরমশাই মারা গেছেন বিয়ের আগে সেজ ভাই উমাপতিদার শ্বশুর নতুন মেয়ে এখানে থাকলে রবিবার রবিবার দেখতে আসেন। তিনি আবার একটু কথা বলেন বেশি।
বাড়ির সকলকে ডাকা চাই। সকলের সঙ্গে কথা কওয়া চাই। সকলের খোঁজখবর নেওয়া চাই। মেয়েকে বলেন—হ্যাঁরে, তোর ছোট দেওরকে তো কখনও দেখতে পাই না—এতদিন ধরে আসছি—
মেয়ে বলে—ছোট ঠাকুরপোর কথা বোলো না বাবা, তুমি রবিবারে আসবে শুনে সকালবেলাই সেই যে বেরিয়ে গেছে বাইরে—আর আসবে সেই দুপুরবেলা বারোটার সময়, তা-ও বাড়ির বাইরে থেকে যদি বুঝতে পারে তুমি চলে গেছ—তবে ঢুকবে, নইলে একঘণ্টা পরে আবার আসবে—
উমাপতিদার শ্বশুর হাসেনা বলেন—কেন রে, আমি কী করলাম তার?
মেয়ে বলে—তুমি তো তুমি, বাড়ির লোকের সঙ্গেই কখনও কথা বলতে শুনি নি ছোট ঠাকুরপো বাড়িতে থাকলেই টের পাওয়া যায় না ঘরে আছে কি নেই—
উমাপতির শ্বশুর কী ভাবেন কে জানে! কিন্তু এ বাড়ির লোকের কাছে এ ব্যাপার গা-সওয়া।
মা বলেন—তোমরা কিছু ভেবো না বৌমা, রমা আমার ওই রকম—আমার সঙ্গেই লজ্জায় বলে কথা বলে না—
কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও একেবারে মিথ্যে নয়।
স্বর্ণময়ীর সেবার ভীষণ অসুখ হয়েছিল। ছেলেরা রাতের পর রাত জেগে মায়ের সেবা করতে লাগলো। বউদেরও বিশ্রাম নেই। ডাক্তারের পর ডাক্তার আসে। ইনজেকশন, ওষুধ, বরফ–অনেক কিছু।
একটু সেরে উঠে স্বর্ণময়ী চারদিকে চেয়ে দেখলেন। বললেন–রমা কোথায়?
রমাপতি তখন ঘরে বসে বই পড়ছিল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে।
বড়দা একেবারে ঘরে ঢুকে বললেন—মার এতবড় একটা অসুখ গেল আর তুমি একবার দেখতে গেলে না—
দাদার কথায় রমাপতি অবশ্য গেল দেখতে মাকে। রোগীর ঘরে তখন বাড়ির লোক, আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ। রমাপতি কিন্তু কিছুই করলো না। কিছু কথাও বেরুল না তার মুখ দিয়ে চুপচাপ গিয়ে খানিকক্ষণ সকলের পেছনে দাঁড়ালো সসঙ্কোচে। তার পর কেউ দেখে ফেলবার আগেই পালিয়ে এসেছে আবার নিজের ঘরে।
স্বর্ণময়ীর সে কথা এখনও মনে আছে। বলেন—তোমরা ভাবো ওর বুঝি মায়া-দয়া কিছু নেই —আছে বৌমা, সেদিন নিজের চোখে দেখলাম যে—দোতলার বারান্দায় মেজ বৌমার ছেলে ঘুমোচ্ছিল, কেউ কোথাও নেই, রমু আমার দেখি ছেলের গাল টিপে দিচ্ছে—মুখময় চুমু খাচ্ছে, সে যে কী আদর কী বলবো তোমাদের, রমু যে আমার ছেলেপিলেদের অমন আদর করতে পারে আমি তো দেখে অবাক…তার পর হঠাৎ আমায় দেখে ফেলতেই আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে গেল—
প্রতিবেশীরা বেড়াতে এসে বলে তোমার ছোট ছেলের বিয়ে দেবে না, দিদি–?
স্বর্ণময়ী বলেন—রমুর বিয়ের কথা ভাবলেই হাসি পায় মা,—ও আবার সংসার করবে, ছেলেপিলে হবে! যার কাছা খুলে যায় দিনে দশবার, তরকারিতে নুন না হলে বলবে না মুখ ফুটে, এক গেলাস জল পর্যন্ত চেয়ে খাবে না, একবারের বদলে দু’বার ভাত চেয়ে নেবে না…
তা এই হলো রমাপতি। রমাপতি সিংহ। একে নিয়েই আমাদের গল্প।
আমার এক আত্মীয় একদিন টেলিফোনে ডেকে পাঠালেন বাড়িতে।
বললেন—তোমাদের পাড়ার রমাপতি সিংহ বলে কোনো ছেলেকে চেন?
বললাম—চিনি, কিন্তু কেন?
তিনি বললেন—ছেলেটি কেমন? আমার রেবার সঙ্গে মানাবে?
রেবাকে চিনতাম আই.এ.-তে দশ টাকার স্কলারশিপ পেয়েছিল। থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বেশ স্মার্ট মেয়ে বাবার কাছে মোটর চালানো শিখে নিয়েছে। অটোগ্রাফের খাতায় জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে কোনও লোকের সই আর বাদ নেই। নিজে ক্যামেরায় ছবি তোলে। ভায়োলিন বাজিয়ে মেডেল পেয়েছে কলেজের মিউজিক কমপিটিশনে। মোট কথা, যাকে এল কালচার্ডা।
আমি সেদিন সম্মতি দিলে বোধহয় বিয়েটা হয়েই যেত। পাত্র হিসেবে রমাপতি খারাপই বা কী! নিজে শিক্ষিতা কলকাতায় নিজেদের তিনখানা বাড়ি সংসারে ঝামেলা নেই কিছু। বোনেদেরও সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। চার ভাই-ই বেশ উপার্জনক্ষম ভাইদের মধ্যে মিলও খুব।
রেবার মা বলেছিলেন কিন্তু কেন যে তুমি আপত্তি করছো বাবা, বুঝতে পারছি না—
আমি বলেছিলাম—রেবাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন মাসীমা, এ-সব শুনেও যদি মত দেয় তো…
কিন্তু রেবাই নাকি শেষ পর্যন্ত মত দেয় নি।
আজ ভাবছি সেদিন সম্মতি দিলেই হয়তো ভালো করতাম। শেষ পর্যন্ত রেবার বিয়ে হয়েছিল এক বিলেত-ফেরত অফিসারের সঙ্গে, তার পর সে ভদ্রলোক শেষকালে…কিন্তু সে-কথা এ-গল্পে অবান্তর।
এর পর ননীলাল এসে খবর দিয়েছিল—ওরে, রমাপতির বিয়ে হচ্ছে যে—
আমরা সবাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম সে কি? কোথায়?
ননীলাল বললে—খবর পেলাম, এবার আর কলকাতায় সম্বন্ধ নয়—জব্বলপুরে—
জব্বলপুরে কার মেয়ে, মেয়ে কী করে—সব খবর ননীলালই বার করলে।
শেষে একদিন বললে—ভাই, চোখের ওপর নারীহত্যা দেখতে পারবো না—আমি ভাঙচি দেবো—সত্যিসত্যি-ই ননীলাল ঠিকানা যোগাড় করে বেনামী চিঠি দিলে একটা আপনারা যাকে পছন্দ করেছেন তার সম্বন্ধে কলকাতায় এসে পাড়ার লোকের কাছে ভালো করে সংবাদ নেবেন। নিজেদের মেয়েকে এমন করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেবেন না ইত্যাদি অনেক কটু কথা।
বিয়ে ভেঙে গেল।
শুধু সেবারই প্রথম নয়। যতবার ননীলাল বা আমরা কেউ সংবাদ পেয়েছি, চিঠি লিখে বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। আমাদের সত্যিই মনে হয়েছে রমাপতির সঙ্গে বিয়ে হলে সে মেয়ের জীবনে বিড়ম্বনার আর অবধি থাকবে না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন বিনা-ঘোষণায় রমাপতির বিয়ে হয়ে গেল।
কেউ কোনও সংবাদ পায় নি মাত্র একদিন আগে আমার কানে এল খবরটা।
প্রমীলাও বহরমপুরের মেয়ে। বললাম–বহরমপুরের কমল মজুমদারকে চেন নাকি, খুব বড় উকিল? তাঁর মেয়ে প্রীতি মজুমদার?
প্রমীলা চমকে উঠলো।
—প্রীতি? আমরা তাকে ডাকতাম বেবি বলল বহরমপুরের বেবি মজুমদারকে কে না চেনে —একটা চোদ্দ বছরের ছেলে থেকে শুরু করে ষাট বছরের বুড়ো সবাই চিনবে তাকে, বেবি টেনিসে তিনবার চ্যাম্পিয়ন, ওকে চিনবো না—
কিন্তু তখন আর উপায় নেই। চিঠি লিখে জানালেও একদিন পরে খবর পাবো ননীলাল শুনে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।
তবু যেন কেমন সন্দেহ হলো তারা শেষকালে আর পাত্র পেল না খুঁজে! শেষে এই আকাট ছেলেটার হাতে পড়বে! আর কোনও প্রীতি মজুমদার আছে নাকি বহরমপুরে?
প্রমীলা বললে—মজুমদার অবিশ্যি আরো আছে ওখানে কিন্তু খবর নাও দিকিনি ওর নাম বেবি কিনা—
তখন আর খবর নেবারই বা সময় কোথায়?
প্রমীলাও যেন বিমর্ষ হয়ে গেল। বললে—বেবির সঙ্গে বিয়ে হবে শেষকালে তোমাদের রমাপতির—সে-যে ভারি খুঁতখুঁতে মেয়ে-গোঁফওয়ালা ছেলেদের মোটে দেখতে পারতো না, ওর প্রাইভেট টিউটার ছিল বদ্যিনাথবাবু, তাকেই ছাড়িয়ে দিলে! আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম— তোর মাস্টারকে ছাড়ালি কেন? ও বলেছিল—বড্ড বড় বড় গোঁফ বদ্যিনাথবাবুর, ওই গোঁফ দেখলে আমার ভয় পায়—তা তুমিও তাকে দেখেছ তো—
বললাম—কোথায়?
—কেন, সেই যে বাসরঘরে?
বাসরঘরে কত মেয়েই এসেছিল, সকলকে মনে থাকার কথা নয় আজ। তবু মনে করতে চেষ্টা করলাম।
প্রমীলা আবার মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করলে—মনে পড়ছে না তোমার? সেই যে কালো জমির ওপর জরির কাজ করা শিফন শাড়ি পরে এসেছিল লং স্লিভের সাদা লিনেনের ব্লাউজ পরা —খুব কথা বলছিল ঠেস দিয়ে দিয়ে—মনে নেই?
তবুও মনে পড়লো না।
প্রমীলা আবার বলতে লাগলো বিয়ের পরদিন মা জিজ্ঞেস করেছিল—কেমন জামাই দেখলে, বেবি? বেবি বলেছিল—ভালো। কিন্তু আমাকে বলেছিল—তোর বর ভালোই হয়েছে মিলি, কিন্তু আর একটু লম্বা হলে ভালো হতো—
যে মেয়ে এত খুঁতখুঁতে, তার সঙ্গে রমাপতির কিছুতেই বিয়ে হতে পারে না!
প্রমীলাও সন্দেহ প্রকাশ করলো। না না, সে মেয়ে হতেই পারে না—অন্য কোনো প্রীতি মজুমদার হবে দেখো—
কখন বিয়ে করতে গেল রমাপতি—কেউ জানতে পারলো না। ভোরের ট্রেন রাত থাকতে থাকতে উঠে একজন পুরুত আর দু’চারজন আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে দলবল বেরিয়ে গেছে। বউ যখন এল তখনও বেশ রাত হয়েছে। অনেকেই তখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বার ব্যবস্থা করছে। শাঁখের আওয়াজ পেয়ে প্রমীলা উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো একবার। আমিও উঠে গেলাম।
বাড়ির লোকজনের ভিড়ের ভেতর ঘোমটা-টানা বউটিকে দেখতে পেলাম না ভালো করে। আর রমাপতিও যেন টোপরের আড়ালে নিজেকে গোপন করে ফেলতে চেষ্টা করছে। মনে হলো–লজ্জায় চোখ দুটো বুজিয়ে ফেলেছে। কোনও রকমে এতদূর এসেছে সে বরবেশে, কিন্তু পাড়ার চেনা লোকের ভিড়ের মধ্যে সে যেন মর্মান্তিক যন্ত্রণা অনুভব করছে।
আমাদের বাড়ি থেকে একা আমারই নিমন্ত্রণ ছিল।
অনেক রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি ফিরতেই প্রমীলা ধরলে কেমন বউ দেখলে— আমাদের বেবি নাকি?
বললাম—কী জানি, চিনতে পারলাম না—কিন্তু যার বিয়ে তারই দেখা পেলাম না—
—সে কি?
—সে যে কোথায় লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে—অনেক চেষ্টা করলাম দেখতে, কিছুতেই দেখা পেলাম না।
পরদিন সেই কথাই আলোচনা হলো।
ননীলালকে জিজ্ঞেস করলাম—বউ দেখলি রমাপতির?
ননীলাল যেন কেমন গম্ভীর-গম্ভীর। বললে—বউটার কপালে দুঃখু আছে ভাই-বেচারি ওর হাতে পড়ে মারা যাবে দেখিস—
জিজ্ঞেস করলাম রমাপতিকে দেখলি কাল?
কেউ দেখতে পায় নি। সমস্ত লোকজন আত্মীয়-স্বজনের দৃষ্টি থেকে সরে গিয়ে কোথায় যে লুকিয়ে রইল রমাপতি, সেই-ই এক সমস্যা। বিশ্বনাথ বললে সে-ও দেখে নি।
কিন্তু কনক বললে—আমি দেখেছি।
—কোথায়?
—দেখলাম, মিষ্টির ভাঁড়ারে গেঞ্জি গায়ে ওর পিসির কাছে তক্তপোশের ওপর বসে রয়েছে— জানলার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিলে—
কানাই নাপিতকে চেপে ধরলাম। সে বরের সঙ্গে গিয়েছিল।
সে তো হেসে বাঁচে না। বলে—ছোটবাবুর কাণ্ড দেখে সবাই অবাক সেখানে—
—সে কী রে—
—আজ্ঞে, সবাই বলে বর বোবা নাকি? কনের বাড়ির ছেলেমেয়েরা খুব নাকাল করেছেন। ছোটবাবুকে সারা রাত, মাঝরাতে বাসরঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছোটবাবু আমার কাছে হাজির! আমি ছাতের এক কোণে ঘুমুচ্ছিলাম, ছোটবাবু চৌপর রাত সেই ছাতে বসে কাটাবে আমার কাছে—কিন্তু মেয়েছেলেরা শুনবেন কেন? তাঁরা আমোদ-আহ্বাদ করতে এয়েছেন…
কিন্তু পরদিন প্রমীলার কাছে যা শুনলাম তাতে আমার বাকরোধ হয়ে এল। প্রমীলা ভোরবেলা উঠেই ওদের বাড়ি গিয়েছিল আর ফিরে এল বেলা দশটার সময়
বললাম—এত দেরি হলো? দেখা হয়েছে?
প্রমীলা বললে—গেছি বউ দেখতে আর না দেখে ফিরে আসবো? গিয়ে বললাম—মাসিমা, তোমার বউ দেখতে এলাম কাল শরীর খারাপ ছিল আসতে পারি নি–
মাসিমা বললে—ছেলে-বউ তো এখনও ঘুমুচ্ছে—তা বোস মা একটু–
তা দরজা খুললো বেলা ন’টার সময় তোমার বন্ধু তো আমাকে দেখেই পালিয়ে গেল কোথায়। বেবি কিন্তু ঠিক চিনতে পেরেছে। আমাকে দেখেই বললে—মিলি, তুই–
তার পরে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো আমায় দেখলাম সমস্ত বিছানাটা একেবারে ওলোট-পালোটা নতুন খাট-বিছানা নয়নসুখের চাদর, বালিশের ওয়াড়া পাশাপাশি দুটো বালিশ একেবারে সিঁদুরে মাখামাখি বেবির মুখে-গালেও সিঁদুরের দাগ। …বিছানায় শুকনো ফুল ছড়ানো–
আমি হাসছিলাম দেখে বেবি জিজ্ঞেস করলে—হাসছিস যে?
বললাম—সারা রাত ঘুমোস নি মনে হচ্ছে—
বেবি বললে—ঘুমোতে দিলে তো বলে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলো।
আমিও স্তম্ভিত। বললাম—বললে ওই কথা?
—তার পর শোনোই তো—
প্রমীলা আবার বলতে লাগলো—তার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম—তোর বর কেমন হলো? তা শুনে কী উত্তর দিলে জানো?
বললাম—কী?
প্রমীলা বললে—প্রথমে বেবি কিছু বললে না, মুখ টিপে হাসতে লাগলো, তার পর আমার কানের কাছে মুখে এনে হাসতে হাসতে বললে বড় নির্লজ্জ, ভাই…