বাঈজী

বাঈজী
হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আনোয়ারীবাঈ ঘরে ঢুকতেই মনোহরপ্রসাদ উঠে দাঁড়াল। হাত কপালে ঠেকিয়ে অভিবাদন করল, তারপর নিজের মেহেদীপাতার রংয়ে ছোপানো শাড়িতে হাত বোলাতে লাগল।

আনোয়ারীবাঈ কার্পেটের ওপর বসলেন। মনোহরপ্রসাদের মুখোমুখি আজকাল বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। কোমর টন টন করো বাতের মরসুম শুরু হয়েছে। ভরা শীতকালে আর উঠে হেঁটে বেড়াতে দেবে না। মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈয়ের খুবই আশ্চর্য লাগে। মনেই হয় না, বছর বারো আগে হাঁটু মুড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গেয়েছেন। রাত ভোর হয়ে গিয়েছে ঠুংরী আর গজলে। এখন একটা দুটো গান গাইতে গেলেই হাঁপ ধরে।

কি ব্যাপার ভাইসায়েব, ভোর ভোের? আনোয়ারীবাঈ চুল-সরু খাঁজ ফেললেন কপালে। এত ভোরে ঘুম ভাঙানোতে মেজাজ খুশনয় মোটেই।

একটা জরুরী খবর ছিল, মনোহরপ্রসাদ দাড়ি ছেড়ে হাঁটুতে হাত বোলাতে আরম্ভ করল। মুখে একটু হাসি হাসি ভাবা

আগের দিন ঠিক এমনিভাবেই মনোেহরপ্রসাদ খবর আনতা ছিপছিপে ফরসা চেহারা, হাতের ছোঁয়ায় তবলা যেন কথা বলতা মুজরো নিয়ে বাইরে যাবার সময় আনোয়ারীবাঈ সব সময়ে মনোহরপ্রসাদকে সঙ্গে নিতে কোন ঝামেলা নেই, বদ অভ্যাস নয়। ঘাড় হেঁট করে নিজের কাজ করে যেত। আনোয়ারীবাঈয়ের শুধু তবলচীই ছিল না মনোহরপ্রসাদ, এধার ওধার থেকে খবরের টুকরোও সেই সংগ্রহ করত।

আজ রায়-বেরিলির খানসায়েব এসেছেন। এখানে থাকবেন হপ্তা খানেক। খানসায়েব ঠুংরীর বড় ভক্ত, দেখি একবার যোগাযোগ করে। কাল পরশু আপনার কোন বায়না নেই তো কোথাও?

মনোহরপ্রসাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে চাইত আনোয়ারীবাঈয়ের দিকে না, বায়না আর কোথায়, আনোয়ারীবাঈ ঘাড় নাড়তেন, বায়না থাকলে আর তুমি জানতে পারতে না?

তা ঠিক। মনোহরপ্রসাদও ঘাড় নেড়েছে। এমনি নানা খবর।

আজ রাতে মীর্জা হোসেন আসবেন গান শুনতে সন্ধ্যার ঝোঁকে মনোহরপ্রসাদ সংবাদ আনল।

আজ রাতে? সর্বনাশ! বিস্ময়ে আনোয়ারীবাঈ চোখ কপালের মাঝ বরাবর তুলেছেন,…আজ যে ডাক্তার জনার্দন সুকুল আসবেন, তিনদিন আগে খবর পাঠিয়েছিলেন।

ও ঠিক আছে, নিস্পৃহ গলায় উত্তর দিয়েছেন মনোহরপ্রসাদ আমি তাঁকে বারণ করে এসেছি। বলেছি আপনার তবিয়ৎ খারাপ দিন সাতেক পরে আসর বসবো

কিন্তু কাজটা কি ঠিক হল ভাইসায়েব? আনোয়ারীবাঈ আমতা আমতা করেছেন।

মীর্জা হোসেন কাল সকালে হায়দ্রাবাদ ফিরে যাচ্ছেন। বছর খানেকের আগে আর এ মুখো হবেন না। আর সুকুল সায়েব তো ঘরের লোকা।

আনোয়ারীবাঈ রাজী। কোনদিন মনোহরপ্রসাদের কথার ওপর কথা বলেন নি। এটুকু জানতেন, মনোহরপ্রসাদ যা করবে আনোয়ারীবাঈয়ের ভালোর জন্যেই নিজের দিকে চাইবে না, গায়েও মাখবে না দুঃখ কষ্ট। সুকুল সায়েবের চেয়ে মীর্জা হোসেন পয়সা কম ঢালবে বলে নয়, হোসেন সায়েব গানের অনেক বেশি সমঝদার। ঠিক জায়গায় তারিফ করতে জানেন, বুঝতে পারেন গলার সূক্ষ্ম কাজের কেরামতি সুকুল সায়েবের এ সবের বালাই নেই। গান শুরু হতেই তাকিয়া ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়েন। ঠিক গান শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে ঘাড় নেড়ে বলেন, কেয়াবাত! কেয়াবাত! বড় মিঠে গলা বাঈজীরা ভারি মিঠো।

আজ নিশ্চয় এ সব কথা বলতে মনোহরপ্রসাদ আসে নি। গান ছেড়ে দিয়েছেন আনোয়ারীবাঈ। মনোহরপ্রসাদও আর তবলা ছোঁয় না। গান-বাজনার সম্পর্ক নেই, কিন্তু হৃদয়ের সম্পর্ক ঘোচে নি। সময় পেলেই মনোহরপ্রসাদ ঘুরে যায় একবার পা মুড়ে বসে ফেলে আসা সুখ-দুঃখের গল্প চলে। জমানা বিলকুল বদলে গেছে, সে সম্বন্ধে আক্ষেপ।

আনোয়ারীবাঈ বিস্মিত হলেন, হেসে বললেন, আর জরুরী খবরে দরকার কি ভাইসায়েব। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এবার যা কিছু জরুরী খবর আসবে একেবারে ওপার থেকে।

মনোহরপ্রসাদ এ কথার কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে কার্পেটের একটা ফুল খুঁটতে খুঁটতে আস্তে বলল, মোতি এসেছে শহরে।

মনোহরপ্রসাদের কথার টুকরো কানে যেতেই আনোয়ারীবাঈ টান হয়ে বসলেন। একটা হাত রাখলেন কানের পাশে মনোহরপ্রসাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, কে এসেছে? কে এসেছে শহরে?

মনোহরপ্রসাদ মাথা তুলল, গলাও চড়াল একটু, মোতি এসেছে, মোতি। খবরের কাগজে বেরিয়েছে মেজর বর্মা লক্ষ্ণৌতে বদলি হয়েছেন।

বুঝতে বেশ একটু অসুবিধা হল আনোয়ারীবাঈয়েরা অস্পষ্ট কতকগুলো হিজিবিজি রেখা। অর্থহীন, সামঞ্জস্যহীন। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন কিছুক্ষণ, মোতি, মোতিবাঈ, মোতিবাঈ এসেছে শহরে।

দু’একদিনের কথা নয়। দেড় যুগের বেশি, তখন কত বয়স মোতিরা বড় জোর পাঁচ কি ছয়। দু পাশে বেণী দোলানো, রঙিন সালোয়ার পাজামা পরা ফুটফুটে মেয়ে। ছুটে ছুটে বেড়াত এ বাড়ি থেকে ও-বাড়ি। দুনিয়ার লোকের সঙ্গে দোস্তি চেয়ে চেয়ে আনোয়ারীবাঈয়ের আশ আর মিটত না। কোনদিন যে মনের মানুষের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল আনোয়ারীবাঈ, পাতানো নয়, সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রী, পরের যুগের গজল-ঠুংরী-খেয়ালের সুরে বাঁধা জীবন নয়, পা ফেলা নয় তবলার বোলের তালে পা মিলিয়ে, মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখে ঘেরা জীবন, সামাজিকতার গণ্ডীর মধ্যে সাবধানে পা ফেলে চলা, মোতি আনোয়ারীবাঈয়ের সেই ফেলে আসা জীবনেরই চিহ্ন।

শুধু মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈ চমকে উঠতেন। আগুন জ্বলে উঠত মাথায়। যখন দু’ একজন গানের ওস্তাদ, আশপাশের দু’একজন রসিক আদমি মোতিকে আদর করতে করতে বলত, আর কেন আনোয়ারী, এবার মেয়েকে গান বাজনা শেখাতে আরম্ভ করা এখন থেকে শুরু করলে তবে বয়সকালে মা’র মতন মিঠে গলা পাবে, নাম রাখবে লক্ষৌরা।

মুখে আনোয়ারীবাঈ কিছু বলেন নি, কিন্তু মনে মনে শিউরে উঠেছেন মানুষজন সব সরে যেতে বাড়ি খালি হয়ে যেতে মোতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছেন মোতির ঠোঁটে গালে চুমু খেতে খেতে বলেছেন, না, তোকে আমি কিছুতেই এ পথে নামতে দেব না। কিছুতেই না।

মনের ইচ্ছাটা আড়ালে ডেকে মনোহরপ্রসাদকে বলেওছিলেন অনেকবার।

মোতিকে আমি সরিয়ে দিতে চাই এখান থেকে নাচ গান হৈ হল্লা এসব যেন ওর জীবনে কোনদিন না আসে।

মনোহরপ্রসাদ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এ আবার কি কথা! আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে গান বাজনা শিখবে না তো বেনারস গিয়ে মালা জপবে বসে বসে?তীর্থধর্ম শুরু করবে উঠতি বয়সে?

তীর্থধর্ম করবে কেন এ বয়সে সংসার করবো মনের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঘর পাতবে।

নিজের ফেলে আসা সাজানো সংসারের কথা ভেবেই আনোয়ারীবাঈ উদগত নিশ্বাস চাপলেন।

ঘর সংসার করবে মেয়ে। তা বেশ, কিন্তু জেনে শুনে চকের আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়েকে কে এগিয়ে আসবে বিয়ে করতে ওড়না ফেলে কে মাথায় ঘোমটা দেওয়াবো দু একজন কাঁচা বয়সের কচি ডানা মেলে সবে উড়তে শেখা ছোকরা হয়তো রাজী হতেও পারে। বিয়ের ভড়ং করে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করবে কদিন। তারপর শখ মিটলে কিংবা বাপের দেওয়া মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেলে পালাবে ফেলে মোতিকে। তখন!

কাজটা যে সোজা নয়, তা আনোয়ারীবাঈ ভালই জানেন। আর জানেন বলেই মনোহরপ্রসাদকে ডেকেছেন শলা-পরামর্শ করতে।

একটা উপায় আছে। আনোয়ারীবাঈ এগিয়ে এসে একটা হাত রাখলেন মনোহরপ্রসাদের হাতের ওপর।

কি উপায়?মনোহরপ্রসাদ নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসল।

বার কয়েক ঢোঁক গিললেন আনোয়ারীবাঈ। কপালে জমে ওঠা ঘামের বিন্দু সুরভিত রুমাল নিয়ে মুছে নিলেন, তারপর বললেন, এমন করা যায় না ভাইসায়েব, আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে নয় মোতি ছেলেবেলায় মা-বাপ-হারা কোন অনাথ তিন কুলে দেখবার কেউ নেই! কোন ভদ্রলোক যার ছেলেপিলের সাধ অথচ ভগবান কিছু পাঠান নি কোলে, তেমন কেউ মোতিকে নিতে পারে না? নিজের মেয়ের মতন মানুষ করতে পারে না?

সর্বনাশ, বিলিয়ে দেবেন মেয়েকে! কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে আনোয়ারীবাঈ বাঁচবেন কি করে?

আনোয়ারীবাঈ বাঁচতে চায় না মেয়েকে বাঁচাতে চায়। আনোয়ারীবাঈয়ের গলা ধরাধরা।

মনোহরপ্রসাদ বোঝাতে চেষ্টা করলা ব্যাপারটা আনোয়ারীবাঈ ভাল করে ভেবে দেখুন হঠাৎ উচ্ছাসের ঘোরে এমন একটা কাজ করলে আপসোসের অন্ত থাকবে না। শেষ জীবনে যখন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নামবে, দেহ জরাগ্রস্ত হবে, হাজার চেষ্টাতেও গলায় মিঠে সুর ফুটবে না, তখন এই মেয়েকে আশ্রয় করেই তো বাঁচতে হবে। এরই রোজগারে দিন কাটাতে হবে আর কি অবলম্বন থাকবে?

অবলম্বন? আনোয়ারীবাঈ হাসলেন। করুণ হাসি মনোহরপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললেন, শেষ জীবনে মেয়ের চেয়ে আরো বড় কিছু অবলম্বনের খোঁজ করব ভাইসায়েবা সারাটা জীবন তো ছিনিমিনি খেললাম নিজেকে নিয়ে, তখন মালেকের কথা ভাবব তাঁর হাতেই ছেড়ে দেব নিজেকে

এর ওপর আর কথা চলে না। তবু মনোহরপ্রসাদ একবার শেষ চেষ্টা করল, কিন্তু মোতি থাকতে পারবে আপনাকে ছেড়ে?

আনোয়ারীবাঈ আবার হাসলেন, মানুষের পরমায়ুর কথা কেউ বলতে পারে?হঠাৎ যদি মারাই যায় আনোয়ারীবাঈ, তাহলেও তো আমাকে ছেড়ে থাকতে হবে মোতিকে। হাজার কাঁদলেও আমাকে ফিরে পাবে না। না, ভাইসায়েব, আনোয়ারীবাঈ গলার সুর নরম করলেন, ভেজা ভেজা। স্বর, একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে। মোতিকে আমি এ নরকে বাড়তে দেব না। ওকে কোথাও। সরিয়ে দিতেই হবে। তুলে দিতে হবে কোন ভদ্রমানুষের হাতে।

মনোহরপ্রসাদ ঘাড় নেড়েছিল বটে, কিন্তু কোন সুবিধা করতে পারে নি।

আনোয়ারীবাঈ ভোলেন নি কথাটা। গান-বাজনার শেষে ক্লান্ত দুটি চোখ তুলে সেই এক মিনতি জানিয়েছিলেন মনোহরপ্রসাদকে। আর দেরি নয়, মেয়ে বড় হচ্ছে। বুঝতে শিখছে। যা কিছু করতে হয়, এই বেলা গাছ একটু বড় হয়ে গেলেই তাকে ওপড়ানো মুশকিল। মাটির গভীরে চলে যায় শিকড়, ডালপালা বিস্তৃত হয় দিকে দিকে, তখন টানাটানি করতে গেলে ক্ষতিই হয়। লক্ষ্ণৌতে সে রকম কেউ না থাকে, মনোহরপ্রসাদ আশপাশে ঘুরে দেখুক। ঘোরবার সব খরচ আনোয়ারীবাঈ দেবেন, কিন্তু আর দেরি নয়।

বরাত ভাল মনোহরপ্রসাদের। এদিক ওদিক ঘুরতে হয়নি কাছেপিঠেই খোঁজ পাওয়া গেল সুন্দরবাগে নতুন এক ভদ্রলোক এসেছেন, স্ত্রীকে নিয়ে। যে বাড়িতে উঠেছেন, সেই বাড়িওয়ালা মনোহরপ্রসাদের দোস্ত। কথায় কথায় ব্যাপারটা তার কাছ থেকেই জানা গেল।

ভদ্রলোক সরকারের বড় চাকরে। সারা ভারতবর্ষে চাকরির অন্ন ছড়ানো ঘুরে ঘুরে সেই অন্ন খুঁটে তুলতে হয়। বছর তিনেক পর বদলি হন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। পয়সাকড়ি, ইমানইজ্জত সব আছে, কেবল সুখ নেই। বছর চারেকের ফুটফুটে একটি মেয়ে ছিল, আজমগড়ে দুদিনের জ্বরে মেয়েটি শেষ। চিকিৎসার সুযোগও পাওয়া গেল না। সেই থেকে ভদ্রলোকের স্ত্রী অনবরত কাঁদেন আর বুক চাপড়ানা অভিশাপ দেন ভগবানকো ভদ্রলোক এসব কিছু করেন না। অফিসের সময়টুকু ছাড়া চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন দরজা জানলা বন্ধ করে।

মনোহরপ্রসাদ আসমানের চাঁদ পেল হাতের মুঠোয়। তকলিফ করে আসমানে চড়তে হল না, চাঁদ নিজেই যেন নেমে এসে ধরা দিল।

দোস্তের মারফত আলাপ হল। প্রথম প্রথম দু-একটা সান্ত্বনার মোলায়েম কথা, মিঠে মিঠে উপদেশ, দুনিয়ার কিছুই স্থায়ী নয় সে সম্বন্ধে দার্শনিক আলোচনা। তারপর আসতে আসতে কথাটা পাড়ল। খুব সাবধানে

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মনোহরপ্রসাদের দিকে, তারপর ধীর গলায় বললেন, কিন্তু যাদের মেয়ে তারা ছাড়বে কেন?

ছাড়বে কেন! মনোহরপ্রসাদ কপালে হাত চাপড়ালেন, বাপ গেছে অনেকদিন, মা যে অবস্থায় আছে, দুবেলা দুখানা রুটিও দিতে পাচ্ছে না মেয়েকে কোনদিন দেখব মা আর মেয়ে দুজনেই খতম হয়ে গেছে। নয়তো মা কি আর অত সহজে ছাড়তে চায় মেয়েকে!

ভদ্রলোক উঠে ভিতরে গেলেন, বোধহয় পরামর্শ করলেন স্ত্রীর সঙ্গে, তারপর বাইরে এসে বললেন, একবার দেখাতে পারেন মেয়েটাকে?

বহুৎ খুব, বলেন তো কালই নিয়ে আসতে পারি।

বেশ তাই নিয়ে আসবেন।

সোজা মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈয়ের সঙ্গে দেখা করলা সব ঘটনা জানালা পরের দিন সকালে মোতিকে নিয়ে যাবে তাও বলল।

মনোহরপ্রসাদ ভেবেছিল, সব ঠিকঠাক হলে আনোয়ারীবাঈ বোধহয় রাজী হবেন না। প্রাণ ধরে ছাড়তে পারবেন না মেয়েকে। কিন্তু আনোয়ারীবাঈ একটুও আপত্তি করলেন না। সামান্য বাধাও নয়। কেবল বললেন, তোক বেশ ভাল তো ভাইসায়েব? মোতির কোন কষ্ট হবে না?

নিজের পেটের মেয়ে হারিয়েছে, এখন যাকে নেবে, তাকে নিজের মেয়ের মতনই মানুষ করবে। আর তাছাড়া তোক খুব ভদ্র। খানদানী ঘরের ছেলে, শুনলাম লেখাপড়াও খুব জানো।

আনোয়ারীবাঈ আর কিছু বললেন না, কিন্তু পরের দিন মনোহরপ্রসাদ মোতিকে নিতে গিয়েই অবাক। দামী শালোয়ার, দোপাট্টা, পায়জামায় ঝলমল করছে মেয়ে। গলায় মুক্তার মালা, কানে। পান্নার দুল পায়ে ভেলভেটের নাগরা।

সর্বনাশ, এই বুঝি অভাব অনটনে দিন কাটানো মেয়ের পোশাকের বহর!

কথাটা মনোহরপ্রসাদ বলল আনোয়ারীবাঈকে।

এত সব দামী জামা গয়না পরিয়েছেন কেন? গরিবের মেয়ে, এই কথাই তো জানানো হয়েছে।

তবে? এই এতক্ষণ পরে একটু যেন ছলছলিয়ে এল আনোয়ারীবাঈয়ের চোখ ভিজে ভিজে গলা।

সব খুলে ফেলব?

মনোহরপ্রসাদ ভাবল দু-এক মিনিট, তারপর বলল, শালোয়ার পাজামা না হয় থাক, গয়নাগুলো খুলে নিতে হবে।

আনোয়ারীবাঈ এক এক করে সব খুলে নিলেন মেয়েকে সারারাত ধরে বুঝিয়েছেন। নতুন জায়গায় গিয়ে বেফাঁস কিছু না বলে ফেলে, কান্নাকাটি না করে বাইরে যাবেন আনোয়ারীবাঈ। তীর্থধর্ম করতো সেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের যেতে নেই। ফিরে এসে মোতিকে তিনি নিয়ে আসবেন।

কার কাছে যাব মা! মোতি অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করেছে।

তোমার কাকা-কাকীর কাছে। দেখবে কত যত্ন করবে, ভালবাসবে, জিনিস কিনে দেবে।

মোতি আর কথা বলে নি। এখানে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কমা মাঝে মাঝে আনোয়ারীবাঈ শহরে যান মুজরো নিয়ে খুব দূরে কোথাও নয়, ধারে কাছেই। কানপুর, বেরিলি, ফয়জাবাদা সেই সময় মোতি থাকে বুড়ি ঝির কাছে। এখানে থাকলেও আনোয়ারীবাঈ ধারে কাছে ঘেঁষতে দেন না মেয়েকে। গান বাজনার আসরে এসে কাজ নেই। সারেঙ্গীর সুর আর তবলার বোলে শুধু সুর নয়, বিষও আছে। একবার নেশা ধরলে আর রক্ষা নেই।

মোতিকে নিয়ে যাবার সময় ধারে কাছে আনোয়ারীবাঈকে দেখা গেল না। এদিক-ওদিক চেয়েও মনোহরপ্রসাদ তাঁর খোঁজ পেলেন না।

ভদ্রলোকের নাম ব্রজবিলাস শকসেনা। আদি নিবাস মজঃফরপুরা বিলেতে ছিলেন বছর চারেক। স্ত্রী পর্দানসীন নন, কেবল আনকোরা শোক পেয়ে বাইরে বেরোনো বন্ধ করেছেন। মোতিকে দেখে ব্রজবিলাসবাবুর স্ত্রী পর্দা ঠেলে সদরে চলে এলেন। দু হাতে মোতিকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। ব্রজবিলাসবাবু কাঁদলেন না বটে, কিন্তু তাঁর মুখ চোখের ভাবে মনে হল, মেয়ের শোকটা আবার নতুন করে যেন দেখা দিল

মোতিকে তাঁরা ছাড়লেন না। কথা হল মনোহরপ্রসাদ বিকেলে এসে মোতিকে নিয়ে যাবে, আবার পরের দিন সকালে মোতির জামাকাপড় বিছানাপত্র যা আছে সবসুদ্ধ নিয়ে আসবে। সেই সঙ্গে মোতিকেও।

যাবার মুখে ব্রজবিলাসবাবু মনোহরপ্রসাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন।

একটা কথা ছিল।

বলুন।

কিছু টাকা ওর মাকে দিতে চাই। যদি আপনি নিয়ে যান সঙ্গে করে।

মনোহরপ্রসাদ দুহাত জোড় করলা বিনীত গলায় বলল, কসুর মাফ করবেন। টাকা নিতে ওর মা হয়তো রাজী হবেন না। তাহলে মেয়েকে বিক্রি করার সামিলই হবে মেয়েকে মানুষ করে তুলুন আপনারা, তাতেই উনি খুশি হবেন।

তারপর থেকে মেয়ের সঙ্গে আর আনোয়ারীবাঈয়ের দেখা হয়নি। দেখা হয়নি বটে, তবে খোঁজখবর পেয়েছেন মনোহরপ্রসাদের মারফত। বছর তিনেক পরেই ব্রজবিলাস বদলি হলেন মীরাট, সেখান থেকে দেরাদুন ছুঁয়ে গেলেন আগ্রা সব জায়গা থেকেই চিঠিপত্রে যোগাযোগ রেখেছিলেন মনোহরপ্রসাদের সঙ্গে চিঠিতে বেশির ভাগই মোতির কথা। মোতির মা যে বাঈজী ছিলেন, সেকথা মোতির কাছ থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু তাঁদের কোন আক্ষেপ নেই। পিছন দিকে চাইতে আর তাঁরা রাজী নন। পুনর্জন্ম হয়েছে মোতিরা আনোয়ারীবাঈয়ের মেয়ে নয় মোতি, এখন সে মোতিকুমারী শকসেনা, ব্রজবিলাস শকসেনা, সিনিয়র অফিসরের একমাত্র মেয়ে।

তারপর বছর কয়েক কোন খবর নেই। পুরনো ঠিকানায় চিঠি দিয়েও মনোহরপ্রসাদ কোন উত্তর পায়নি। হঠাৎ চিঠি এল মজঃফরপুর থেকে লিখেছেন মায়াবতী শকসেনা, ব্রজবিলাসের বিধবা স্ত্রী সামনের মাসে মোতির বিয়ে, আর্মি অফিসর মোহনচাঁদ বর্মার সঙ্গে তাঁর স্বামী হঠাৎই মারা গেছেন। অফিসের টেবিলে হার্টফেল করে। এই বিয়েতে মনোহরপ্রসাদ অনুগ্রহ করে যদি পায়ের ধুলো দেন তো সবাই কৃতাৰ্থ বোধ করবে।

মনোহরপ্রসাদ যেতে পারেনি, কিন্তু আনোয়ারীবাঈকে পড়িয়ে শুনিয়েছিল সে চিঠিা তখন আনোয়ারীবাঈয়ের অবস্থা পড়তির মুখো রোগে ধরেছে। লোকের আসা-যাওয়া অনেক কম। প্রায় খালিই পড়ে থাকে জলসাঘর। বাড়িভাড়াও কিছু কিছু বাকি পড়েছে। ভাবছেন সরে গিয়ে কোথাও আরো ছোট বাড়ি ভাড়া করবেন। চকের আরো ভিতরের দিকে।

সেদিন বাক্স হাতড়ে একটা মুক্তার মালা বের করেছিলেন আনোয়ারীবাঈ। ঝুটো নয়, খাঁটি মুক্তা। বোম্বাইয়ের আমীর মকবুল আলির উপহার। খুব বড়ো বড়ো জায়গায় যেতে আসতে আনোয়ারীবাঈ গলায় দিতেন মোতির বিয়েতে সেটাই পাঠিয়ে দিলেন।

বিয়েতে মনোহরপ্রসাদ যায় নি, কিন্তু দিন পাঁচেক পরে বিয়ের বিস্তারিত বিবরণ পড়েছিল খবরের কাগজের পাতায়। খুব ধুমধাম। দু হাজারের ওপর মাননীয় অতিথি জাঁদরেল সব অভ্যাগতের লিস্টা সে খবরও মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈকে শুনিয়েছিলা। আজকাল কি যে হয়েছে আনোয়ারীবাঈয়ের! বোধহয় বয়স হয়েছে বলেই, একটুতেই জল জমা হয় চোখের কোণে, দুটো ঠোঁট থরথরিয়ে কাঁপে, আর ঠিক বুকের বাঁ পাশে অসহ্য যন্ত্রণা। নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়।

আনোয়ারীবাঈ বিড় বিড় করে বললেন একবার মোতিকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে। দূর থেকে একটু দেখে আসা।

মনোহরপ্রসাদ এ কথার কোন উত্তর দেয়নি। অবশ্য মায়াবতী শকসেনাকে চিঠিপত্র লিখে মোতির সঙ্গে যোগাযোগ হয়তো করা যায়, কিন্তু মেয়ে সুখী হয়েছে, ভালো ঘরে, ভালো বরে পড়েছে, এই তো যথেষ্টা চোখে দেখতে যাওয়া মানেই তো মায়া বাড়ানো। আরো কষ্ট পাওয়া।

মনোহরপ্রসাদ লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে গিয়েছিল।

তারপর কয়েক বছর আর কোন খোঁজখবর নেই। কোন চিঠিপত্রও দেননি মায়াবতী শকসেনা।

মাঝে মাঝে দেখা হলেই আনোয়ারীবাঈ বলেছেন, আর কটা দিনই বা বাঁচব, যাবার আগে বড় দেখতে ইচ্ছা করছে মোতিকে

মনোহরপ্রসাদ আমল দেয়নি। বলা যায় না মেয়েমানুষের মন। এমনিতে আনোয়ারীবাঈ খুব শক্ত, বাইরে কাঠিন্যের দুর্ভেদ্য আবরণ, কিন্তু চোখের সামনে নিজের মেয়েকে দেখতে পেলে, সে নির্মোক হয়তো খসে পড়বো কেঁদে ফেলবেন আনোয়ারীবাঈ। অযথা একটা গোলমালের সৃষ্টি। আর্মি অফিসার মোহনচাঁদ বিরক্ত হবেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হওয়াও বিচিত্র নয়া।

হঠাৎ সকালে খবরের কাগজটা ওলটাতে ওলটাতে মনোহরপ্রসাদের চোখে পড়ে গেল। বার বার পড়ল খবরটা, কাগজটা চোখের কাছ বরাবর নিয়ে, তারপরই খবরটা নিয়ে গেল আনোয়ারীবাঈয়ের কাছে।

মেজর মোহনচাঁদ বর্মা জলন্ধর থেকে বদলী হয়েছেন লক্ষৌ সামনের সোমবার থেকে নতুন জায়গার কার্যভার গ্রহণ করবেন

আনোয়ারীবাঈ এগিয়ে এসে একেবারে মনোহরপ্রসাদের দুটো হাত জড়িয়ে ধরলেন।

আমি মোতিকে দেখব। চুপচাপ দেখে চলে আসব। ওর বাড়ির রাস্তায় বসে থাকব, ও বাইরে বেরোবার সময়ে একবার শুধু চোখের দেখা দেখবা ভাইসায়েব, এইটুকু উপকার করতেই হবে। আমি বুঝতে পারছি, আর আমি বেশিদিন নেই।

কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারীবাঈ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

আচ্ছা দেখি মনোহরপ্রসাদ হাত ছাড়িয়ে বাইরে চলে এল।

বাইরে চলে এল বটে, কিন্তু কথাটা ভুলল না। বিকেলের দিকে টাঙ্গায় চড়ে হাজির হল। বাদশাবাগো বেশি ঘুরতে হল না। রাস্তার ওপরেই খাসা ঝকঝকে দুতলা। বোগেনভিলার গেট, নিচু পাঁচিল আইভি-জড়ানো রাস্তা থেকেই পুরো লন নজরে আসে। বাহারে গাছের ছিটে দেওয়া মখমল-নরম লন।

এগিয়ে গিয়ে তকমা-আঁটা দরোয়ানের সঙ্গেও মনোহরপ্রসাদ আলাপ জমিয়ে ফেলল। মেহমান আদমি, ঘুরে ঘুরে দেখছে সারা শহর। চমৎকার বাড়ি যেমন বাড়ি তেমনি বাগান ভাগ্যবান মালিকটি কে?

মালিক আডভানি সায়েব, দরোয়ানের ভাগ্যে এমন শ্রোতা সচরাচর জোটে না, টুলে বসে আয়েস করে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল, উপস্থিত ভাড়া নিয়েছেন মেজর বর্মা। নতুন এসেছেন এখানে সামনের রবিবার খানাপিনা আছে। শহরের জাঁদরেল লোকদের আমন্ত্রণ। এখানকার সমাজে পরিচিত হতে চান মেজর সায়েবা

বটে, মনোহরপ্রসাদ কল্পিত বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল, খানাপিনা হবে কোথায়? কার্লটন হোটেলে?

উঁহু, হোটেলে কেন, সায়েব এই লনে বন্দোবস্ত করতে বলেছেন। বাইরের লনই তো ভালা দরোয়ান বিজ্ঞের মতন ঘাড় নাড়ল।

তা তো নিশ্চয়! সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল মনোহরপ্রসাদ, তারপর একটু থেমে বলল, বিবিজী নেই বাড়িতে, না সায়েব একা?

হ্যাঁ। বিবিজী আছেন বই কি জিনিস কিনতে হজরতগঞ্জ গেছেন। বিবিজীই তো সব। তিনি ঘোরান, সায়েব ঘোরেন।

দরোয়ানের গলা পরিহাস-তরল। মনোহরপ্রসাদ আর কথা বাড়াল না। ধন্যবাদ জানিয়ে টাঙ্গায় এসে উঠল।

ওই কথাই ঠিক হল। সন্ধ্যার ঝোঁকে মনোেহরপ্রসাদ টাঙ্গা নিয়ে আসবে। আনোয়ারীবাঈ সঙ্গে যাবেন নিচু পাঁচিল, রাস্তা থেকে দেখার কোন অসুবিধা নেই। আর তেমন হলে বেড়ার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেই চলবে। দরোয়ানের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ভিতরে না ঢুকতে দিতে পারে, বেড়ার বাইরে দাঁড়ালে আপত্তি করবে না। খানাপিনার ব্যাপার যখন, লনে আলোর বন্দোবস্ত নিশ্চয় থাকবে। আনোয়ারীবাঈয়ের দেখতে কোন অসুবিধা হবে না। ঠিক চিনতে পারবেন আত্মজাকে। চোখ ভরেই শুধু নয়, মন ভরেও দেখতে পাবেন।

টাঙ্গায় উঠেই আনোয়ারীবাঈ অস্বস্তি বোধ করলেন। বুকের বাঁ দিকে তীব্র ব্যথা! টনটন করে উঠল চোখের দুটো পাতা।

কি হল, কষ্ট হচ্ছে?মনোহরপ্রসাদ আনোয়ারীবাঈয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

না, ঘাড় নাড়লেন আনোয়ারীবাঈ, কোন কষ্ট হচ্ছে না। কেবল বুকের ভিতর অসহ্য দাপাদাপি। এত বছর পরে মেয়েকে দেখতে পাবেন, যে মেয়েকে দু হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন পঙ্কিল পরিবেশ থেকে, বাঈজীর ঘৃণ্য জীবন থেকে উন্নীত করেছেন গৃহবধূর পর্যায়ে। তাই বুঝি হৃদয় অধৈর্য হয়ে পড়েছে, অপেক্ষা করতে মন সরছে না।

টাঙ্গা যখন গিয়ে পৌঁছল তখন অতিথি-অভ্যাগতেরা সবাই এসে গিয়েছেন। জোর বাতির নিচে ঝলমলে রঙিন পোশাকের সার। এতদূর থেকেও প্রসাধনের উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল, মদির সুবাসা কিছু কিছু লোককে মনোহরপ্রসাদ চিনতে পারল, শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবার। আমিনাবাদের রিটায়ার্ড জজ কেশরী সুকুল থেকে শুরু করে নবাবের বংশধর আমিনউদ্দিন। সেরা ব্যবসায়ী মিস্টার মোদির পাশাপাশি ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার হেনরী উড। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন আত্মীয়া আর বান্ধবীর দলা কলরবে জায়গাটা সরগরমা মাঝখানে মেজর বর্মাকে দেখা গেল। ঘুরে ঘুরে তদারক করছেন, মাঝে মাঝে চোখ ফেরাচ্ছেন বাড়ির দিকে স্ত্রীর আসার প্রত্যাশায়।

দরোয়ানই বলল, মেমসায়েব এখনও নামেন নি, বোধ হয় সাজছেন।

আনোয়ারীবাঈ একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন গাড়ি-বারান্দার দিকে। ঐখান দিয়েই তো মোতি আসবে। আনোয়ারীবাঈয়ের আত্মজা, তাঁরই রক্ত-মাংসে গড়ে তোলা স্বতন্ত্র সত্তা।

হঠাৎ আলোড়ন উঠল অতিথিদের মধ্যে সবাই দাঁড়িয়ে উঠলেন। মেজর বর্মা এগিয়ে এলেন দু-এক পা।

পাতলা ফিনফিনে ব্লাউজ কটি উদঘাটিনী, হালকা সবুজ রংয়ের আরো পাতলা শাড়ি। অন্তর্বাস দিনের আলোর মতন স্পষ্ট। আঁকা, ঠোঁটে কৃত্রিম লালিমা, দু-গালে রুজের রক্তিম আমেজ, সুর্মাটানা দুটি চোখকে আয়ত করার দুর্লভ প্রচেষ্টা, চুড়ো-বাঁধা কটা চুলের রাশা

চেয়ে চেয়ে দেখলেন আনোয়ারীবাঈ। সেদিনের সে মেয়েটির সামান্যতম পরিচয়ও নেই মিসেস বর্মার মধ্যে শান্ত সুন্দর মেয়েটা কি মন্ত্রে রূপান্তরিত হল আজকের এই উৎকট বিলাসিনীতে! যে পোশাক পরে আনোয়ারীবাঈ নিভৃতে বিশেষ কোন অতিথির সামনে আসতেও লজ্জা পেতেন, কি করে মোতি হাজার অতিথির মাঝখানে এসে দাঁড়াল সেই পোশাকে!

মিসেস বর্মাকে নিয়ে যেন লোফালুফি শুরু হল। অপূর্ব ভঙ্গীতে মোতি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে সরে সরে যেতে লাগল। কোথাও কোন পুরুষের চটুল উক্তিতে নিচু হয়ে তার গালে আলতো করাঘাত করে বলল, Naughty boy, আবার কোথাও কোন পুরুষের বাটনহোল থেকে গোলাপ তুলে নিয়ে নিজের কবরীতে গাঁথলা কারো টেবিলে বসে হেসে গড়িয়ে পড়ল অতিথির গায়ের ওপর, লিপস্টিক-রক্তিম ঠোঁট দুটো ফাঁক করে মোহিনী হাসি উপহার দিয়ে আবার সরে গেল অন্য টেবিলে।

মনোহরপ্রসাদের টনক নড়ল আচমকা মণিবন্ধে টান পড়তে হাত দিয়ে মুখ ডেকে আনোয়ারীবাঈ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। থর থর করে কাঁপছে গোটা শরীর।

টাঙ্গা অপেক্ষা করছিল, আর দেরি করল না মনোহরপ্রসাদ। সাবধানে আনোয়ারীবাঈকে ধরে গাড়িতে নিয়ে এল। কি ভাগ্যিস, জোর ব্যান্ড শুরু হয়েছে লনে, আনোয়ারীবাঈয়ের উচ্ছ্বসিত কান্নার আওয়াজ কারো কানে যায়নি।

কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? মনোহরপ্রসাদ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল।

এতদিন পরে নিজের মেয়েকে চোখের সামনে দেখলে কষ্ট হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। এইজন্যই আনতে চায় নি আনোয়ারীবাঈকে।

না, না, শরীর আমার খুব ভাল আছে। কিন্তু কি হল ভাইসায়েব! বাঈজীর মেয়ে বাঈজীই হয়ে রইল! ছেলেবেলা থেকে কাছছাড়া করেও রক্তের দোষ ছাড়াতে পারলাম না! পোশাক-আশাক, রং-ঢং, চালচলন—এ সবে চকের রাস্তায় দাঁড়ানো বাঈজীদেরও যে হার মানাল! এ কি হল ভাইসাব, এ আমার কি হল!

দু-হাতে মুখ ঢেকে আনোয়ারীবাঈ আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *