গোঘ্ন

গোঘ্ন
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

চারু মাস্টারের বেহালা শুনে দোলাই বড় কেঁদেছিল। দোলাই ছিল নরম মনের ছেলে। বলেছিল, আপনার যন্তরে কী জানি কী যাদু আছে, কলজে টাটায়। হেই মাস্টেরবাবু, আপনার বিটির বিভায় যত কুমড়ো লাগবে, হামি দিবো। যত কলাই লাগবে, তাও দিবো।

চারু মাস্টারের বিটির ফাগুন মাসে বিভা। দোলাই তার আগেই গাবতলার গোরে ঘুমোতে গেছে। নীচে ধু ধু পদ্মার জল ছুঁয়ে শেষ মাঘের হাওয়া এখন চারু মাস্টারের বেহালার সুরে বাজে। তাই শুনে ভাই হারাইয়ের মনে টান বেজেছিল। ফাগুন মাসে মাস্টোরের বিটির বিভা। যত কুমড়ো লাগে দেবে বলেছিল দোলাই। যত কলাই লাগে, তাও দিতে চেয়েছিল।

উঠোনের কোণায় বসে শালপাতায় ভাত খেতে খেতে হারাই ভাইয়ের কথা বলে। চারু মাস্টার মোড়ায় বসে গায়ে রোদ নেন। যে বিটির বিভা হবে, সে খঞ্জনীর মতো মিঠে স্বরে বলে—ও চাচা, লজ্জা কোরো না। পেট পুরে খাও।

বাঁ হাতের আঙুলে নাক ঝেড়ে পাছায় মোছে হারাই। মাথা নেড়ে বলে—খাছি মা, খুব খাছি। বড় মিঠা আপনারঘে রাঢ়দাশের ভাত।

ফাগুন মাসে বিভা। ভাঁড়ার ঘরে দু বস্তা কলাই, কুড়িটে বড় বড় কুমড়ো—ভিতরটা নাকি লাল বিরিং! এই সুখে আদী মেয়েটা খিলখিল করে হাসে।–ও চাচা! তোমাদের দেশের ভাত বুঝি তেতো?

হারাইও হাসে—দানাগুলান মোটা, বিটি রে! বাবাকে পুছো, হামারঘে দ্যাশে রাঢ়ী চালের ভাত খায় শুধু আমির-বড়লোকে। পুছো মাস্টেরবাবুকে, বিটি রে!

চারু মাস্টার চোখ বুজে ঝিমোচ্ছেন। তাঁর মেয়ে অবাক হয়ে বলে—তোমরা কী খাও চাচা?

–ইয়া মোটা মাসকলাই আটার লাহারি। ছাতু ভুজা। গেঁহু উঠলে দুটা মাস সুখ আম কাঁঠালের সঙ্গে গেঁহুর আটার চাপড়ি। বলে হারাই ফের নাকের ডগা মোছে। ভাত মাখো পরম নিষ্ঠায় সে মুখে তোলে, সাবধানে।

মেয়ে মুখে দুঃখ রেখে বলে-ভাত খাও না তোমরা, চাচা?

—অল্পস্বল্প খাই। আউষের ভাতা সেও মাসে আর ক’দিন? হারাই উজ্জ্বল মুখে পাঁচিল ঘেঁষে রাখা ধানের তিনটে বস্তার দিকে তাকায় একবার ফের বলে—বিটি রে! তুমারঘে দ্যাশের ধান লিতেই তো ফি বছর কষ্ট করে আসি। হামারঘে কষ্ট, জানোয়ারেরও কষ্ট। বাঁওয়ালি বলদটার হালগতিক খারাপ।

তার উজ্জ্বল মুখে দ্রুত ছায়া নামে। ভাঙা পাঁচিলের ও-পাশে নিমতলায় গাড়ি রেখেছে। বলদ দুটো দু চাকায় বাঁধা। চারু মাস্টার কিছু খড় দিয়েছেন তাদেরও কপাল হারাইয়ের কপালে বাঁধা। হারাই যখন আমন ধানের সুন্দর ভাত খাচ্ছে, তারাও কত সুখে নাড়া খড় চিবুচ্ছে। তবে বাঁয়েরটা রাত থেকে কেমন ঝিমন্ত। নাড়ির লক্ষণ গোলমেলে। পাকা রাস্তা থেকে এই গাঁয়ে ঢুকতে পা টেনে হাঁটছিল আর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছিল।

চোখ বুজে রেখে চারু মাস্টার বলে—এ গাঁয়ে গোবদ্যি নেই। একঘর বেদে ছিল, মরে হেজে গেছে। হারাই, তুমি সানকিভাঙার কাছে গাড়ি রেখো রেখে পিরিমল হাড়িকে ডেকে এনো। আমার নাম কোরো, কম পয়সায় কাজ হবে।

কান করে কথাটা শোনে হারাই। তারপর বলে—জী হ্যাঁ।

—জী হ্যাঁ না, অবশ্যি করে দেখিয়ে নিও। চারু মাস্টার এবার চোখ খোলেন। মোটাসোটা মানুষ। পিঠে কাঁচা-পাকা লোম। পুরু গোঁফা লুঙির ভেতর হাত ঢুকিয়ে জাং চুলকে বলেন, ফের —তোমরা বাঘড়ে গাড়োয়ানরা বড় আলসে মাইরি! দোলাইকে গতবার বললুম, দোলাই, পথেই ততা ইকরোল পড়বো ভুতু কোবরেজের কাছ হয়ে যাস দোলাই বললে যাবা পরে ভুন্দার সঙ্গে দেখা হল গিয়ে কাঁদির বাজারে জিগ্যেস করলাম। বললেন, না তো! তেমন কেউ যায় নি তো!

ভুতু কোবরেজের কাছে গেলে দোলাই মরত না, এ বিশ্বাস হারাইকে অস্থির করে। বাকি ভাতগুলো কোন রকমে গিলে সে এঁটো কুড়োতে থাকে। তারপর শালপাতাটা সাবধানে বাইরে নিয়ে যায়। রাস্তার ধারে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়। ও পাশে ছোট্ট পুকুর ঘাটে লোক আছে দেখে সে আঘাটায় নামে।

এটা হিঁদুর গাঁ। ছোঁয়াছুঁয়ির হালহদিস সবই জানে হারাই, সে দেশচরা মানুষ। এ গাঁয়ে মোছলমান থাকলে সে চারু মাস্টারের বাড়ি ভাত খেত না। তার কপালে নমাজ পড়ার ঘেঁটো ফতুয়ার পকেটে তালপাখার শিরে তৈরি একটা গোল টুপি আছে। পথেই সময় হলে গাড়ি বেঁধে রেখে সে নমাজ পড়তে ভোলে না। ছোট ভাই দোলাই প্রথম তার সঙ্গে এসে খুব ভড়কে গিয়েছিল। হেঁদুর বাড়ি খাবা? ও বড়ভাই, হেঁদুর বাড়ি খাবা? হেঁদুর বাড়ি খাবা? খালি ওই কথা। চোখ রাঙিয়ে হারাই ধমক দিয়েছিল—জান বাঁচানো ফরজ (অবশ্যপালনীয়) কাম, জানিস গে ছোকড়া? খালি বকর বকর! মুখে কুলুপ দেদিনি!

পরে যত বয়েস হল দোলাই পাকলা বড় শৌখিন ছেলে ছিল সো। চারু মাস্টারের গাঁয়ে আসার জন্যে প্রতি মাঘে আনচান করত মাঘে ঈশানদেবের চত্বরে শিবচতুর্দশীর মেলা শুরু। গাঁয়ের যাত্রা দল পালা গায়। চারু মাস্টার বেহালা বাজায়। তাঁর বেহালার সুরে কী যাদু, কলজে বড় টাটায়। চোখে ঘোর লাগো আর সামিয়ানার তলায় শব্দহাবা মানুষজন ঘিরে কী এক চিরকালের দুঃখস্রোত বয়ে যায়। মাস্টের গে, হেই মাস্টের! এ বড় যাদুর খেলা। নিশুতি রাতে নির্জন দূরগামী সড়কে ক্লান্ত পা-টেনে-চলা বলদের বোবা অবোলা চোখের কোণায় যেন চারু মাস্টারের বেহালার ছড়-টানা রেখা আর আতেলা ধুরির চারদিক ঘুরে ঘুরে কালের চাকার মতো এই গাড়ির দুই চাকায় সেই করুণ সুর নিরন্তর বাজে। মাঠ পারের গাঁয়ে হঠাৎ ঘুম ভাঙা মানুষজনের কানে ছড়িয়ে যায় হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো চাকা-গড়ানো গুরুগুরু গভীর গম্ভীর দূরের ধ্বনিপুঞ্জের সঙ্গে কোঁ কোঁ বেহালার সুর। মাস্টের গে, হেই মাস্টের! তুবি বড় যাদুকর এই বয়েসেই কী দুঃখু চিনিয়ে দিয়েছিলে পদ্মার কোলের এক আপনভোলা ছেলেকে। তাই নিয়েই সে গোরে ঘুমুতে গেল। …

নিমতলায় দাঁড়িয়ে ভাইয়ের কথা মনে পড়ে হারাইয়ের। দোলাই থাকলে এবার ফের বাড়ি ঢুকত গলা খাঁকারি দিয়ে। মাস্টারের মেয়েকে ডেকে বলত—ও বহিন, বহিন গে! ইবার একখিলি পান দ্যাও, খাই।

হারাই পান খায় না। বিড়িতামাক খায় না। সন্ধ্যায় মসজিদে গিয়ে ধর্মকথা শোন। দুটো কাঁঠাল আর তিনটে আম গাছ আছে। সতের কাঠা জুঁই আছে। দুটো বলদ গরু আছে। একটা গাড়ি আছে। শীতের শেষে দূরের এই রাঢ়ে গেরস্থরা যখন ধান ঠেঙিয়ে মড়াইতে তোলে, হারাই তখন চনমন করে ওঠো সতের কাঠা ক্ষেতের খন্দকী সবজি, গাছের ফল-মাকড় বোঝাই করে সন্ধ্যা থেকে গাড়ির সব বাঁধন আঁটো করেছে বিকেলো ধুরিতে রেডির তেল মাখানো হয়ে গেছে। প্রথম পহর শেষ হলে আদাড়ে শেয়াল ডাকে। লম্ভ হাতে পাটকাঠির বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তার বউ আর ঘুম-ঘুম চোখে ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকটি মুখে প্রত্যাশা ঝকমক করো বাপ ফিরে এলে রাঢ়ী মিঠা ধানের ভাত খেতে পাবো যে-ভাত পালায়-পরবে খায় মোন্নাজীরা, মিয়াসায়েবরা, বাবুমশাইরা। সেই ভাত-সাদা ঝকঝকে মিহি স্বাদু শাহদানা’। মোন্নাজী বলে, শাহদানা। শ্রেষ্ঠ দানা বা শস্যা রাঢ়ে শাহদানার মরশুম এলে সারা বাঘড়ী অঞ্চলে শিহরণ ঘটে যায়। ভাগীরথী-ভৈরবী-পদ্মার পলিতে ভরাট নরম মাটির এই সমতল দেশে সাড়া পড়ে যায়। খদ-ফলমূল গরু-মোষের গাড়িতে বোঝাই করে দলে দলে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে সোনার রাঢ়ের দিকে এগিয়ে চলো চাকায় চাকায় সদ্য তেলমাখানো ধুরির শব্দহীন চাপা আবেগ তখন থরথর করো ভাগীরথী পেরিয়ে কতক দূরে কেউ এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে পরখ করে। এ মাটির রঙ সোনালী এই মাটি শাহদানা ফলায়। সাদা, ঝকঝকে, মিহি চিকন স্বাদু ভাত। ভাপের গন্ধে মন ভরে যায়। ভুখ মিছিলের মুসাফির মাটির গন্ধ শোঁকে। যেন সেই ভাতের গন্ধ পায়।

হারাই সেই ‘মুসাফির’ নয়। মাঙতে আসে না রামুলুকে। খন্দ ফলমূল সবজির বদলে ধান মেপে নেয় তারাজুতে। এই শেষ মাঘে সে এসেছে মরা ভাইয়ের কথা রাখতে কিন্তু চারু মাস্টার বড় দয়ালু ভালমানুষ। তিন বস্তা ধান দিয়েছেনা বলদের জন্যে দু তড়পা খড়ও দিয়েছেন। দু রাতের রাস্তা। আর বাঘড়ীর এসব মানুষজনের সঙ্গে রাঢ়ী মানুষের বংশ-পরম্পরা কুটুম্বিতো হারাইয়ের বাপও মরশুমে এলে চারু মাস্টারকে দেখা না দিয়ে যেত না। ফি বছর আম-কাঁটাল দিয়ে যেত সেধো চারুবাবুর মা বুড়োকে জোর করে এক পুটুলি মুড়ি গুছিয়ে দিতেন। বুড়িমা আর বেঁচে নেই। থাকলে হারাইকে একখানা নতুন গামছাও দিতেন বইকি।

বেলা হু হু করে পড়ে এল। শেষ শীতের রুক্ষ ক্ষয়াখবুটে রাঢ়ী গাছপালা আর শুখা শুখা ন্যাড়াটে ঘরবাড়ির গায়ে রোদের রঙ তেলতেলে দেখাচ্ছে। বস্তা তিনটে বয়ে এনে গাড়িতে চাপায় এবং বাঁধাছাদা করে হারাই। চারু মাস্টারের মেয়েটা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাসো ও চাচা, তোমাদের দেশে আম পাকলে আনবে তো? আসবে তো, চাচা?

—আসব বিটি, আসবা…হারাই ডাইনের বলদটাকে চাকা থেকে খুলে এনে জোয়ালে দড়ি আটকায়। বাঁ দিকেরটা খুলতে গিয়ে ফের বলে তো ও গে ভালমানুষের বিটি! ফাগুন মাসে তুমার বিভা। চাচাকে বিভা খেতে তো ডাকলে না! হেই মা, আমি কি তুমারঘে পর?

লজ্জায় রাঙা হয়ে বিটি দরজার আড়ালে ঢোকে। তার বাবা নিমতলায় বলেন—ডাকলেও কি আসতে পারবে, হারাই?আর তো মোটে দিন দশেক আছে। পারলে অবশ্যি এসো।

হারাই বাঁওয়ালি বলদটাকে ওঠাতে ব্যস্ত। ইররর-হেট হেট হেট! হিই! দেখছ, দেখছ?ঃঃ! সে লেজ ধরে টানাটানি করে। গর্জায় বার বার দুশমন! জোভিয়াঃ (জবাইযোগ্য)! জবাই করব

বুলছি, হুঁ! উঠল? উঠল এখনও? তারপর একটু ঝুঁকে আদুরে স্বরে হামার বাপথোন রে! সোনা। রে! মানিক রে! এটুকুন কষ্ট কর বাছা! সানকিভাঙা পজ্জন্ত চুক চুক করে গেলেই খালাস। ইররর হেট হেট! ওরে, আর জ্বালাসনে বাপ! বাড়ি যাব—আমরা বাড়ি যাব।

এই রকম আদর, ছেলেভুলোনো কত কথা, কখনও কসাই ডাকার শাসানি, জবাই করার হুমকি—ফের গায়ে হাত বুলিয়ে নেমকহারামী করিস নে সোনা! এ্যাটুকুন থেকে পুষেপেলে এত বড়টা করনু তার এই ফল রে?

চারু মাস্টার হো হো করে হাসেনা –ওরে উতুরে ভূত! ও হারাই! বরং এক কাজ করা গাড়ি থাকা তুই সানকিভাঙা চলে যা পিরিমল বদ্যিকে ডেকে নিয়ে আয়। দেখছিস না, ছ্যারানি হয়েছে গরুটার?

তা তো দেখতেই পাচ্ছে। খড়ের গোছা মুখে ধরা। চোখের কোণায় কালি কালো ধারা আঁকা। হাড়ের সারা ঠেলে উঠেছে রাতারাতি হারাই উঠে দাঁড়ায়—বরাবর একটুকুন বদমাইসিও আছে, মাস্টেরবাবু। বুঝলেন? হ্যাঁকাৎপনাও আছে। ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়াল তো দাঁড়াল। তবে পা ফেললে থামানো যায় না। ব্যাটার এই বড় গুণ। তখন পংখিরাজ ঘোড়া।

ঘুরে সূর্যটা দেখে নিয়ে ফের সে লেজে মোচড় দেয় এবং পাঁজরে পাচনের গুতো মারো চারু মাস্টারকে অবাক করে গরুটা হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়। বস্তায় হাতের গোবর মুছে হারাই একটু

হেসে বলে-দেখলেন?

—তা তো দেখলাম। কিন্তু পিরিমলকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যাস বাপু।

হারাই জোতা পরায়। অবোলা জানোয়ারা বুঝতে পেরেছে এবার ঘরে ফেরার সময়। রোগা পা-টেনে-চলা বলদের এখন যেন পিঠে ডানা গজায়। সব গাড়োয়ানই তা টের পায়। হারাই গাঁয়ের পথে ধুলো উড়িয়ে যেতে যেতে খুশিতে চ্যাঁচায়হামার পংখিরাজের বাচ্চারে! হামার। এরুপ্লেলেন রে! হেই মাস্টেরবাবু, ফাগুন মাসে বিটির বিভায় যদি আসি, হামার ধনাকে পাঁচ তড়পা খ্যাড় দিতে হবে—এ—এ–!

চারু মাস্টার বেহালা বাজানো কোমল হাত তুলে নাড়েনা আহুদী মেয়ে দৌড়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে হারাই চাচার গাড়ি যদূর যায়, দেখতে থাকে। শূন্য মাঠের বুকে শেষ মাঘের বিকেলে ধুলো উড়িয়ে যেতে যেতে গাড়িটা পাকা সড়কে পৌঁছুলে সে বলে—ও বাবা! হারাইচাচাকে নেমন্তন্ন করলে না? তুমি ভারি ভুলো মন। …

একটা মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে ক’ঘর লোকের বাসা পাকা রাস্তার ধারে একলা এক লম্বা নির্জন গাছ। দোনামোনা করে গাড়ি বাঁধে হারাই। সূর্য পাটে বসতে আর বিঘৎখানেক দূরত্ব। গাড়িতে তিন বস্তা ধান আছে। হারাই দৌড়ে যেতে যেতে বার বার পিছু ফেরে। সামনের মেয়েটাকে বলে—বিটি, ইখানে গোবদ্যি কে আছে রে?

মেয়েটা ঝোপের আড়ালে কম্ম করতে এসে তলপেটে আস্তে আস্তে থাপ্পড় দিচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়ে বলে—হুই দেখ না। পিরিমলখুড়ো দাঁড়িয়ে আছে।

চেহারায় সেটা মালুম বটে। বেঁটেখাটো লিকলিকে কালো গোবদ্যির জটা আর ডগডগে সিঁদুর হু হু জ্বলছে। রুক্ষু লাল চোখে কিসের ঘোর। এক শুকনো গাছের ডগায় দাঁড়কাক ডাকলে হাতের সাপমুখো বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে নাকি স্বরে বলল—যা, যা! ইখনে কী? পুবে যা, পছিতে যা। উত্তরে দখিণে যা! ইভেনে কী?

হারাই কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে—বিষম বিপদ। চণ্ডীতলার চারু মাস্টের বুললেন…

–বুঝিছি। শিসটানা, না বাঘতড়পা?মুসকোনা ছ্যারানি?

–ছ্যারানি।

—ডাইনালি, না বাঁওয়ালি?

—বাঁওয়ালি।

—মরেছে!…বলে পিরিমল হাড়ি ঘরে ঢোকে। একটু পরে বেরিয়ে এসে বলে—তা মাস্টেরের খাতির, পাঁচ সিকে লাগবে।

হারাই চোখ কপালে তোলে অত তো নাই বদ্যিমশাই। আনা বারো আছে। দয়া করুন, বড় বিপদে পড়ে এনু।

পিরিমল হাড়ি বকের ঠ্যাঙ বাড়িয়ে হাজার কথা বলে তোমাদের বাঘড়ে গাড়োয়ানদের ওই এক দোষ বাপু নেয্য পয়সাটা দেবে না। খালি মাস্টেরের খাতির! মাস্টের কি আমার অন্নদাতা, না মুনিব? ভারি তো ক্যাঁই কোঁ কোঁ বাজনা শিখেছেন। আমি কি মেয়েমানুষ যে মজিছি? যেতে যেতে তিন পুরুষের নামধাম, গরুদুটোর জীবনচরিত জেরা করে জেনে নেয় পিরিমল বদ্যিা তারপর অর্জুনতলায় গিয়েই লাফিয়ে ওঠো —এঃ হে হে হে হে! করিছিস কী! ওরে ফুটুকচাঁদ! ওরে বাঘড়ে ভূত! এইখেনে গাড়ি বেঁধিছিস? হায় হায় হায় হায়! আবাগীর বেটা করিছে কী গো!

সূর্য পাটে বসেছে। দুপাশে প্রসারিত শস্যশূন্য মাঠে বুনো পায়রার ডানার রঙ ঘনিয়ে আসছে —এই পৃথিবীটাকে মনে হয় মুখ গুঁজে থাকা বুনো পায়রার মতো ঝিম। উত্তরের হাওয়ার দাপট একটু কমেছে এই দিনশেষে শেষ মাঘের হিম চোঁয়াতে শুরু হয়েছে আকাশ থেকে অনেক দূরে আলের আড়ালে দাঁড়িয়ে একবার একটা শেয়াল ডেকেই চুপ করে গেল। ধরা গলায় হারাই বলে—ইখানে গাড়ি বাঁধলে কী দোষ, বদ্যিমশাই?

পিরিমল হাড়ি গাছের শেকড়ের বাঁকাচোরা লাঠিটা তুলে বলে–হুই দেখছিস একটা শুকনো ছালছাড়া ডাল। দেখতে পাচ্ছিস?

ভয়ে ভয়ে দেখে নিয়ে হারাই বলে–হুঁ।

–কালুদিয়াড় চিনিস কুথা?

—সে তো ভৈরব নদীর পাড় ভগরথপুরের ধারে।

–কালুদিয়াড়ের ইসমিলকে চিনতিস?

–না, বদ্যিমশাই।

 —ইসমিল ইভেনে গাড়ি রেখে কী করেছিল জানিস?

–না, বদ্যিমশাই।

—আপ্তহত্যে।

হারাই শিউরে উঠে তাকায় শুধু মন কেন খালি কু গায়? ধনা ফের শুয়ে পড়েছে। একরাশ ছ্যারানিতে এরই মধ্যে অনেকটা জায়গা নোংরা। কটু গন্ধ ছোটো মনা ডান দিকের জোয়াল থেকে এক ঠ্যাং বাড়িয়ে ধনার কপাল চাটছে। আহা, অবোলা জন্তু। একসঙ্গে ওঠাবসা গতায়াত খাওয়া-দাওয়া। একের কষ্ট অন্যে টের পায় বইকি।

পিরিমল ফের বলে—আপ্তহত্যা। ডালটা সেই তাতে শুকিয়ে যেয়েছে। তা যাক গে, না জেনে যা করিছিস, করিছিস! কই চাট্টি খ্যাড় দে।

চারু মাস্টারের দেওয়া তড়পা থেকে এক গোছা খড় আনে হারাই। বদ্যি খড়গুলো দু দিকে মুড়ে তার মধ্যে একটা শেকড়-বাকড় ঢোকায়। তারপর ধনার মাথায় বুলিয়ে বলে—ভাললামোন। বাপ রে! যাদু রে! গোজন্মের বড় কষ্ট, তা কি জানি না? ইবারে খেয়ে ফেলল। দিকিনি! চিবিয়ে চিবিয়ে খাও। আলন্দে জাওর কাটো। একটুখানি জিরিয়ে লাও। তাপরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও…ওরে, বালটিন আছে সঙ্গে?

হারাই ব্যস্ত হয়ে বলে—ডোলচি আছে।

পিরিমল খিক খিক করে হাসে।–তোরা বুলিচ ডোলচি, আমরা বুলি বালটিনা একই কথা। যা বাপ, আঘাটার জল নিয়ে আয়। এক লিঃশ্বেসে ভরবি। সাবাধান!

বালতি নিয়ে হারাই দৌড়ে যায়। দম আটকে আঘাটার জল ভরে অর্জুনতলায় এসে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলে হাঁফায়। পিরিমল বদ্যি খড়ের নুড়োটা ধনার মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ধনা আস্তে আস্তে চোয়াল নাড়ছে। তারপর পিরিমল কোমর থেকে একটা শুকনো লতানে ঘাস বের করে। সেটা ধনার মাথা থেকে লেজ অবধি বারকতক বোলায়। তারপর বলে— জল কই?

বালতির সামনে বসে সে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে। ফু দেয় জলে। শেষে বলে—ইবারে একটুখানি খাইয়ে দে। বাকি জলটা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর খাওয়াবি বাপ। সাবোধান, রাতটো কিছু খেতে দিবি নো সকালে শুকনো দুব্বোর সঙ্গে এই ওষুধটা খাওয়াবি। তারপর পারিস তো একটুকুন ভাতের ফ্যান দিসা হুঁ, পয়সাটা দে চলে যাই। এক জায়গায় ভূতে ধরা রুগী দেখতে যেতে হবে।

কাঠের হাতে বারো আনা পয়সা এগিয়ে দেয় হারাই। পিরিমল উঠে দাঁড়িয়ে বলে—জল দে মুখো আর শোন বাপ, ইভেনে থাকিস নে। শালা ইসমিল জ্বালাবে। কাজটা ভাল করিস নাই। বরঞ্চ মেদীপুরের বাজারে গিয়ে জিরেন দিসা রাতটুকু।

বকের ঠ্যাং ফেলে পিরিমল হাড়ি চলে গেল। আলোর রঙ ধূসরতরা হারাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর বালতির জল আঁজলা করে তুলে ধনাকে খাওয়াবার চেষ্টা করে। গড়িয়ে যায়। ফের দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে ওঠো তার একটু পরেই আচমকা অর্জুনের ডালে প্যাঁচা চ্যাঁচায়—ক্রাঁও ক্রাঁও ক্র্যাঁও! শরীর ভারি হয়ে যায় হারাইয়েরা বিড় বিড় করে দেওয়া আওড়ায়। মাঝে মাঝে একটা করে মোটরগাড়ি উজ্জ্বল আলো ফেলে চলে যায়। সেই আলোয় গরু দুটোর চোখ থেকে নীল রঙ ঠিকরে বেরোয়, আর হারাই হিমে ও ত্রাসে ঠকঠক করে কাঁপে …

হারাই কাঁপে, কারণ সামনে এক ভয়ের রাত হাঁ করেছে দেখতে পায়। তার লকলকে কালো জিভ থেকে হিমের লালা গড়িয়ে পড়ছে খোদাতালার দুনিয়ায়, আর বিকেল ও সন্ধ্যা দু-দুবার নমাজ না-পড়ার গোনাহ হারাইয়ের কপালে আঁকা পুণ্যের দাগটাকে যেন ঘষে তুলে ফেলছে। হারাই বার বার চমকায়। ধূসর আলোয় শেষ পাখির ঝাঁক মাঠে শস্যদানা খুঁটে খেয়ে ফিরে আসে অর্জুনের ডালে। তারা চাপা স্বরে কী বলাবলি করে। চারপাশে চক্রান্ত চলতে থাকে সামনে ওই ভয়ের রাতের মুখের হাঁ বড় হতে থাকো মাকড়সার জালে আটকে পড়া পোকার মতো নিঃসাড় হয়ে জুলজুলে চোখে বসে থাকে বাঘড়ীদেশের গাড়োয়ানা।

ফের সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইসমিলের শুকনো ডালটা দেখো পশ্চিমের লালচে একটুখানি ছটা, আর কী হল বলে আগ বাড়িয়ে দেখতে আসা হঠকারী এক নক্ষত্রের ক্ষীণ ছুঁচলো আলোয় বাকুলছাড়া ডালটা এখনও আবছা দেখা যায়। কালুদিয়াড়ের ইসমিল কি হারাইয়ের দশা দেখে মিটিমিটি হাসছে?…তা হারাই অনেক ইসমিল দেখেছে। দিনের রোদে দূরের পথ ভাঙতে অবোলা জানোয়ারের কষ্ট বলেই বাঘড়ে গাড়োয়ান রাতচরা। দিনে জিরেন, রাতে গড়িয়ে চলা। কত রকম ভূত আর জিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কত ইসমিল গাড়ির সঙ্গ ধরে পাশে, সামনে বা পিছু পিছু হেঁটে আসে। কখনও মানুষের রূপ, কখনও শেয়াল কী বেড়াল। আবার কখনও পাখি হয়ে কানের পাশে ডানা ঝাপটে যায়। একবার তো দোলাইয়ের বাঁ কানের ডগা রক্তারক্তি করে দিয়েছিল। গাড়োয়ানকে কান-মাথা ঢেকে গামছা জড়িয়ে রাখতে হয়। আনাড়ী দোলাই তা জানত না। খুব শিক্ষে হয়েছিল ছোকরার।

আর ভয় রাহাজানিরা তাই সঙ্গে হেতেরপাতি রাখতে হয়। দল বেঁধে যাতায়াত করতে হয়। সামনের গাড়ির বলদজোড়া খুব ‘ছিক্কিত’ আর মদৰ্মান’—অর্থাৎ কিনা বলবান হওয়া চাই তার গাড়োয়ানও হবে দলের সেরা অভিজ্ঞ আর সাহসী মানুষ আবার পেছনের গাড়ির বলদ ও গাড়োয়ানও তেমনি হওয়া দরকার। এর নাম গাড়োয়ানী বিদ্যো অনেক ঠেকে ঠকে ও দেখেশুনে এই বিদ্যের ধার বাড়ে তবে কথা কী, হারাই চিরাচরিত সেই মরসুমী সওদাগরীতে এবার আসে নি। ফাগুন মাসে চারু মাস্টারের বিটির বিভা। তাই দোলাই বলেছিল, যত কুমড়া লাগে দিব। যত কলাই লাগে দিবা হারাই ভাইয়ের কথা রাখতে এসেছিল।

আসন্ন অন্ধকার ভয় দেখানো রাতের সামনে বসে মোহ্যমান বাঘড়ে গাড়োয়ান এতক্ষণে ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়ে একটু শোক কিংবা অসহায়তা প্রকাশ করল। মেদীপুর চটি সামনে ক্রোশ দুই পথ গাড়িটা সেখানে নিয়ে যেতেই হবে। এই নির্জন ভয়ঙ্কর জায়গায় আর থাকা উচিত নয়। তিন বস্তা ধান নয়, তিন বস্তা সোনা। রাঢ়ী ভাতের সাদা ঝকঝকে স্বাদু সুগন্ধময় কণা বউছেলেমেয়েদের খিলখিল করে খুশীতে হেসে ওঠার মতো দেখতে পেল হারাই মনের কোণায়। এই শাহদানার প্রত্যাশায় এখন বাঘড়ীর কত দুঃখী হাভেতে ছেলেমেয়ে ঘরে ঘরে অপেক্ষা করে আছে। হারাই চঞ্চল হল এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর রুগণ গরুটার গায়ে হাত রাখল স্নেহে। —বাপ ধনা রে!

হারাই ধনার পিঠের কাঁপন টের পায়। কষ্ট করে এটু গা তোল বাছা! বদ্যির ওষুধ খেয়েছিস, আর ভয় কিসের? ওরে বেটা, না না ভাবছিস তোকে গাড়ি টানাব ফির (ফের)? আমি কি লিয়া মানুষ? সোনা হামার, ওঠ দিকিনি!

হারাই আরও আদর ও সান্তনায় জিভ চুকচুক করে বলে বুঝি রে বুঝি! সেই ছুটো থেকে মাগমরদে পেলেছি, তু হামারঘে বেটা। হামারঘে কলিমদ্দি ছলিমদ্দি আসিরদ্দি যেমন ব্যাটা, তোরা ধনা-মনাও হামারঘে দুই ব্যাটা ওঠ বাপ। হুই মেদীপুর! হুই দ্যাখ!

সে ধনার মুখটা তুলে ধরে। ধনা জোরে মাথাটা নাড়ো শিঙের গুঁতো লাগে হারাইয়ের হাঁটুর কাছে। অমনি ক্ষেপে ওঠে বাঘড়ে গাড়োয়ানা গর্জায়—জোভিয়ে! জবাই করব! কলজে খাব শালার ব্যাটা শালার! কেমন বেইমান দেখছ?

সে পেটের খোঁদলে পাচনের গুঁতো মারে বার বার। তখন ধনা সামনে দুই পা বাড়িয়ে মাটি আঁকড়ায় এবং ওঠার চেষ্টা করো হারাই গোবরমাখা লেজটা টেনে পেছন দিকটা তোলে। মুখে গাড়োয়ানী বুলি বলতে থাকে ইরররর হেট হেট হেট! লে লে লে লে! হুদ্দে হুদ্দে হুদে! হে হে হে হেঃ!

ধনা দাঁড়িয়েছে। কয়েক মুহূর্ত তার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে হারাই। তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তাকে গাড়ির পেছনে নিয়ে যায়। বেঁধে দেয় পাছোটের বাঁশের সঙ্গে। তারপর মনাকে ডাইনের জোয়ালে জুতে দিয়ে নিজে বাঁ দিকের জোয়াল ধরে দু হাতে বুকের সঙ্গে জোয়ালটা চেপে গর্জন করে টানে সো চাকা গড়ায়।

পীচে উঠে একটু দম নেয়। তারপর পা বাড়ায়। গাড়ির পিছনে বাঁধা রোগা বলদটা এখন ভারমুক্ত। দড়িতে টান পড়ে আর নড়বড় পা ফেলে সামনে রাস্তায় চাকার সেই পুরনো শব্দ ওঠে ধারাবাহিক—গভীর এবং চাপা গম্ভীর শব্দ, হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো আর তেল-শুকনো ধুরি থেকে এতক্ষণে কেমন একটা রুগণ কোঁ কোঁ শব্দ শোনা যায়। হারাই শোনে চারু মাস্টারের বেহালা বাজছে।

হারাই গাড়ি টানে আর চারু মাস্টারের বেহালা বাজতে থাকে।

ধীরে ফুটে ওঠে মাথার ওপর নক্ষত্রমালা। উত্তরের রাতচরা ডাকিনীর মাঠে মাঠে ঘেঁড়াখোড়া খড়নাড়া, মরা শামুক ও ঝিনুকের খোল আর শুকনো পাতার ওপর হাল্কা পা ফেলে হেঁটে আসো ভয়ে ও কষ্টে চেঁচিয়ে ওঠে দূরের শেয়ালা নক্ষত্রের তাপ নিতে নিতে হিম ডানা নেড়ে উড়ে যায় বুনো হাঁসের ঝাঁকা হারাই শ্বাস টেনে একবার মুখ তুলে দেখে নেয়া কখনও হাঁপাতে হাঁপাতে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে—আয় বাপ, জিরেন খেতে খেতে আয়। আর হারাইয়ের মনে কত কথা এখন। এ তো মাঘ মাস, বেটা ধনা! ডাকপুরুষের বচনে আছে, ‘আধা মাঘে কম্বল কাঁধো’ কিন্তুক ডাকপুরুষ যে ডাকপুরুষ, সেও কি জেনেছিল গোজন্মের কী কষ্ট? হুঁ, গোজন্মে বড় কষ্ট বাপা আজ খোদাতালা হামাকে সিটা জানান দিলো বড় কষ্ট, ধনা। এখন তো জাড় কমে এল। কিন্তুক আঘুন পোষের জাড়? হায় বাপ, বুঝি নাই। সেকথা এই মানবজন্মোতে ঠাউর করি নাই। এখন করনু গোজম্মের ঘাটে ঠেকে, ধনা, (আর মনা তুইও শোন) সব ঠাউরানু ক্রিমে ক্রিমে। এই দ্যাখ বাছা, আমি মানুষ। হামি তোর মতন জানোয়ার হয়ে গেনু!

দুঃখে হেসে ওঠে হারাই। শ্বাসপ্রশ্বাস মিশিয়ে হাসে। …হাসছিস না বেটা? জান ভরে হাস। তবে কথা কী, ভেবে দেখলে দুনিয়ার অনেক মানুষও তোদের মতন অবোলা জানোয়ার বইকি। ঠাউর করে দেখবি, তাদেরঘে পিঠে ওজনদার ছালা চাপানো আছে ধনা। তাদেরঘেও ছালা বহিতে হয়, বাপা, ঠাউর করে দ্যাখা হাসিস না। তাদেরঘে ভি কষ্ট। ঘাড়ে কালো দাগ পড়ে। গোস্ত দড়কচা পড়ে যায়। শাঁস (শ্বাস) ফেলতে হাঁপানি, পা ফেলতে জাংয়ে বেথা, পিছের ভার টেনে হাঁটো তাদেরঘে ভি মুনিব আছে। ঠাউর করে দ্যাখ।

হাঁ করে নিঃশ্বাস নেয় হারাই। ফের বলে গোজমে বড় যন্তন্না। আর তার এই অর্ধস্ফুট বাক্য নতুন এক প্রজ্ঞার মতো আবছা অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হতে হতে দূরের জনপদে ছড়িয়ে যায়। আর চাকায় চাকায় চারু মাস্টারের বেহালা বাজতে থাকে করুণ সুরো আকাশে মুখ তুলে। ভারবাহী গাড়োয়ান ফের সেই প্রজ্ঞা উচ্চারণ করে—গোজন্মে বড় যন্তন্না।

মেদীপুর চটি কি মুছে গেছে দুনিয়া থেকে? সানকিভাঙা থেকে বড়জোর দু ক্রোশ পথা অথচ এখনও সামনে হাঁ-করা অন্ধকার রাত। হারাই থমকে দাঁড়ায় বার বার আর কতদূর মেদীপুর? অবোধ জন্তুর চোখে তাকায় সে বুঝতে পারে না, কতকাল সে তিন বস্তা রাঢ়ী ধান টেনে আনছে। মনার সঙ্গে। ঠাওর হয় না কিছু যেন কত বছর মাস দিন রাত আর গ্রীষ্ম বর্ষা শীত কেটে গেল। গাড়ি টানতে টানতে হারাইয়ের কালো চুল দাড়ি কি সাদা হয়ে গেল। হা খোদা! এভাবে গাড়ির জোয়ালে আটকে থেকেই কি তার মউত হবে? ভয়ার্ত গাড়োয়ানের কানে ভেসে আসে যেন মৃত্যুদূত আজরাইলের ডানার শব্দ। সে বার বার আকাশ দেখো নক্ষত্রভরা আকাশের দিগন্তে এক ছবি দেখতে পায়। তার ছোট্ট বাড়ির সামনে ওই যে পাটকাঠির বেড়ার ধারে লম্ভ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলেপুলের মা! আসবার সময় ধনা মনার পা ধুইয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে মেয়েটা বলেছিল—ভালয় ভালয় ফিরিয়ে আনিস মানুষটাকে। তোদের হাতে ওনাকে জিম্মা দিনু আর বাছারা, তোরাও যেন ভালয় ভালয় ফিরে আসিসা এমনি লম্ভ হাতে দাঁড়িয়ে পিতিক্ষে করব দোরগোড়ায়। হামারু নিদ হবে না, বেটা রে।

…বহু গে! হামি ভালয় ভালয় ফিরে এনু। এই দ্যাখ তোর ধনা, এ দ্যাখ তোর মনা। বড় গুণের বেটা তোর, বহু…হারাই হাসবো ধনাকে দেখিয়ে বলবে—বেটা বহুৎ কষ্ট দিয়েছিল বহুগো তোর বেটাটো বড় হারামজাদা। ভাল করে পা ধুইয়ে দে। ক্যাশ দিয়ে ভি মুছিয়ে দো …হুঁ, তা তো দেবেই মুছিয়ে। বাছুর-বয়সে ধনা যেদিন ঘরে এল, সেদিন, বহু কেশ দিয়ে চার পা মুছিয়ে দিয়েছিল। পদ্মার জল মাটির কলসীতে ভরা। অবেলায় এনে রেখেছে মায়েঝিয়ে। সেই জলে অজু করে নমাজ পড়েছে কলিমুদ্দির মা। মঙ্গল কামনা করেছে। আর সেই পদ্মার জল মাটির জল মাটির বেদনায় ভরে দোরগোড়ায় পায়ের কাছে রেখে রোজ শেষরাতে অবদি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েটা। গোহিলে (গোয়ালঘরে) ভুষির জাবনা ভেজানো থাকবে।

হঠাৎ চমকায় হারাই। বাঁ পাশে ধনার পেছনে এক মূর্তি ভেসে উঠেছে। হারাই ভয় পাওয়া গলায় বলে—কে, কে গে? সাড়া নাই শব্দ নাই! কে আসে গে?

লোকটা লম্বা পা ফেলে পাশে এসে একটু হাসে।–বাড়ি কোথা গাড়োয়ান-ভাইয়ের?

সন্দিগ্ধ গলায় হারাই জবাব দেয়—বাঘড়ী, ভাইজান।

–আসসালামু আলাইকুম।

মুহূর্তে হারাই আশ্বস্ত। কিন্তু কষ্টে জবাব দেয়—ওয়া আলাইকুম আসসালাম।

—গরুটার কী হল? বেমার নাকি?

কথা বলার লোক পেয়ে হারাই দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাইজানা হঠাৎ ওবেলা থেকে ছ্যারানি। বড় মুশকিলে পড়নু সানকিভাঙায় বদ্যি দাওয়াই দিয়েছে। তাই ভাবনু…মানুষের সামনে পড়ে একটু লজ্জাও পেয়েছে হারাই। গরুর মতো গাড়িটানার লজ্জা। সে অপ্রস্তুত হাসে।

লোকটা বলে–লণ্ঠন নাই সঙ্গে? এমন করে আঁধার ভেঙে যাচ্ছ দেখি! রোঁদের পুলিস ধরবে যে!

সঙ্গে সঙ্গে হারাই গাড়ির জোয়াল থেকে ছিটকে বেরোয়া এক পাশে টেনে মনার কাঁধ থেকে জোয়াল নামায়। তারপর—এ হে হে, কথাটো মোনেই ছিল না, আমার মাথায় বজ্জাঘাত ভাই রে, বলে হাঁটু গেড়ে গাড়ির তলা থেকে হেরিকেনটা আনো কোঁচড় থেকে দেশলাই বের করে জ্বালো হাওয়া বেড়েছে, নিবে যায়। তখন লোকটা নিজের পকেট থেকে দেশলাই বের করে বলে—এ জন্যেই তোমাদের বলে বাঘড়ে! কই দেখি, জ্বেলে দিই।

কাচ ভাঙা লণ্ঠন যথেষ্ট আলো দেয় না। ফাটলে কাগজ গোঁজা। সেই হেরিকেন তুলে লোকটা ধনাকে দেখতে থাকে। সামনে থেকে পেছন অবদি দেখে এবং গায়ে একটা হাত রাখো ধনা কেন যেন নড়াচড়া করে। শিঙ নাড়ে। পা ঠোকো হারাই মনে আশা নিয়ে ভাবে, এও এক বদ্যি। লোকটার পরনে চেককাটা লুঙি, গায়ে হাফশার্ট, কাঁধে গামছা ঝুলছে। টেরিকরা তেল চুকচুকে চুল। চিবুকে দাড়ি আছে একটুখানি পানের রসে ঠোঁট লাল। তার পায়ে পাম্পসু জুততা আর কাঁধে ঝোলা ঝুলছে। হারাই বুঝতে পারে, কাঁদির টাউনে গিয়েছিলা বাড়ি ফিরছে। বাসভাড়া ফুরিয়ে গেছে হয়তো হারাই বিবেচনা করে। হু লোকটা সুখী লোক। মুখের ভাবে সেই ভাবা আর রাঢ়ে তো সবাই সুখী। রাঢ় দ্যাশ সোনার দ্যাশা সাদা ঝকঝকে স্বাদু সুগন্ধ শাহদানা খায় দুবেলা। রো-ও-জ খায়! ভাবা যায়? দুবেলা ভাত, তিরিশ দিন বারো মাস বছরের পর বছর!

রাঢ়ী লোকটা ধনাকে দেখার পর শুকনো ঘাসগজানো একরাশ পাথরকুচির ওপর হেরিকেন রাখো তারপর বসে হাঁটু দুমড়ো হারাইও বসে লোকটা পকেট থেকে বিড়ি বের করে বলে— চলে ভাই?

হারাই মাথা দোলায়।

সে বিড়িটা ধরিয়ে বলে—আমার নাম দিলজান। মেদীপুরের পাশেই বাড়ি। গাড়োয়ানভাইয়ের নাম?

–জী, হারুন আলি। হারাই বলে ডাকো হারাই তার দিকে ব্যাকুল চোখে তাকায়। ফের বলে —কেমন দেখলেন, ভাইজান?

দিলজান একটুকরো পাথরকুচি কুড়িয়ে বলে—গরুটার গতিক ভাল না। রাত পেরোয় কিনা।

আঁতকে ওঠে হারাই। বোবায় ধরা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে–বাঁচবে না?

—তাই মোনে হয়।

–সানকিভাঙার বদ্যি…

—আরে থোন ভাই পিরিমলার কথা শালো গোবদ্যি! ফাঁকির কারবার! দিলজান বাঁকা মুখে বুলতে থাকে। গাঁজাখোর শালো প্যাটের জ্বালায় গোবদ্যি সেজেছে। আমি যা দেখলাম ভাই, আপনার গরু বাঁচবে না। এক কলম লেখে দিতে বোলেন তাও দিবা

দিলজানের পকেটে কাগজকলম আছে। হারাই ধুলোয় আঙুলের দাগ টানে আর জুলজুলে চোখে তাকায়। কী বলবে ভেবে পায় না।

দিলজান বলে—এক কাজ করুন, ভাই আপনিও মোছলমান, আমিও মোছলমান। জাতভাই বলেই বুলছি।

খুব আগ্রহে হারাই বলে–কহেন! কহেন জী!

–বুলছি কী, গরুটা আমাকে দেনা দু পয়সা আপনার হোক, আমারও হোক।

হারাই দম আটকে বলে—জী?

দিলজান হাসে খুক খুক করো —গরুটা দেন আমাকে হালাল করি।

অমনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় হারাই। বুকফাটা চিৎকার করে বলে— ন্না! তারপর হাঁফাতে থাকে। তার নাকের ডগায়, চিবুকে, কপালে এই শীতেও ঘামের ফোঁটা চকচক করে। সে ফের। ধরা গলায় বলে কান্না! এবং মাথাটা জোরে দোলায়। সে ভূতের মতো অঙ্গভঙ্গী করে।

দিলজান হা হা করে হাসে–তিরিশ টাকা দাম পাবেন ভাই। দিলজানের নগদানগদি কারবার। আপনি জাতভাই, রাস্তার মধ্যে বিপদে পড়েছেন বুলেই বুলছি। আপনার গরু বাঁচবে না। এ দিলজান দেখে দেখে বুড়োতে চলল, ভাই রে। তামাম এলাকার লোক সেটা জানে।

হারাই মুখ নামিয়ে ঘাড় গোঁজ করে বলে—মাফ দিবেন, ভাইজান আপনি আমার কলজে কিনে লেন, দিবা ধনা হামার বড় কষ্টের ধোনা হামার বহু ধনাকে বেটার মতন পেলে বড় করেছে। সে ফের জোরে মাথা দোলায়।

—শেষ কথা। চল্লিশ টাকা। দ্যাখেন ভেবে।

হারাই দ্রুত হেরিকেন তুলে নেয়। হাঁটু দুমড়ে গাড়ির তলায় ধুরিতে আটকে দেয়া তারপর জোয়ালে যায়। মনাকে জুতে দিয়ে আগের মতো ধনার জায়গায় বুকে জোয়াল তোলে। পা বাড়ায়। গাড়ি গড়াতে থাকে। আবার চারু মাস্টারের বেহালা বেজে ওঠে করুণ সুরে।

দিলজান পাশে হাঁটে।–খুব ঠকলেন, ভাই। মোছলমান বলেই…

হারাই ভয়ঙ্কর গর্জন করে চেরা গলায়–হামার কলজে!

আর দিলজান অন্ধকার ফাটিয়ে হা হা হা হা হাসে আপনার কলজে হারাম, ভাইজানা আমি হালাল জিনিস কিনতে চেয়েছি। রাগ করবেন না। মাথাটা এটু ঠাণ্ডা করুন আপনার ‘ডাহিনালি গরুটা তো কিনতে চাইছি না আপনার ‘বাঁওয়লি’টা মরে যাবে। চল্লিশ টাকা!

হারাই মুখ ঘুরিয়ে রাগী চোখে তাকায় শুধু তারপর অস্পষ্ট হাঁকরানি দিয়ে জোয়াল টানে।

—দেখছেন! আর বেচারী হাঁটতে পারছে না। ওই…ওই দেখুন থুবড়ে পড়ল!

হ্যাঁ, ধনা বার বার হাঁটু মুড়ে টাল খাচ্ছে। শুকনো পীচে খটাখট আওয়াজ উঠছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হারাই ফের বলে—ক্ষমা দিবেন হামাকো, আপনি আপনার ঘাঁটায় যান, হামি হামার ঘাঁটায় (রাস্তায়) হাঁটি।

দিলজান তবু সঙ্গ ছাড়ে না। পকেট থেকে নোট বের করে, আর সেই একই কথা কিন্তু মেদীপুর আর কতদূর? হা খোদা! হারাই যে বুড়ো হয়ে গেল, তবু পৌঁছতে পারল না মেদীপুরে! যত চলে, দূরে সরে যেতে থাকে মেদীপুর। পেটে টান বাজে। বত্রিশ নাড়িতে টান লাগে। আহা, গোজন্মের বড় কষ্ট, ধনা রে! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে বাঘড়ে গাড়োয়ানের। হেই বাপ! আর পারি। নে। হামি তো মানুষ বটি। হামি জানোয়ার লই। এই ভার টানার তাকত হামার নেই। আঃ! বড় তিয়াসে গলা শুখা। বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। জিভ হয়ে গেছে খড়ের গুছি। মেদীপুরে গিয়ে পানি খাব। ধনা তোকেও খাওয়াব। আর মনা, তুইও খাবি। আর এটু কষ্ট করি দুজনায়।

—শেষ কথা ভাইজান, পঞ্চাশা এই নেন।

দিলজান হারাইয়ের ফতুয়ার পকেটের দিকে হাতটা নিয়ে আসে। আর ফের হারাই গর্জন করে ওঠে—হামার কলজে বেরহম (নির্দয়)! পাষাণ! আপনার দেলে দয়া নাই! হারাই শ্বাস টেনে বলে—আপনি আজরাইল!

দিলজান আর সহ্য করে না অশ্লীল গাল দিয়ে বলে—এ জন্যেই বলে বাঘড়ে ভূতা শালোর মাথায় ভূত ঢুকেছে। জাতভাই বলে দয়া হল আর শালা বোলে কি না আজরাইল! মুখ সামলে কথা বলবি, শালো!

রাগী দিলজান হন হন করে হেঁটে সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। হারাই দু কাঁধে দুই চোখ ঘষে নেয়। তারপর তার চমক খেলে। কলজে সিরসির করে ওঠো ও কে এসে তাকে লোভ দেখাচ্ছিল? সে ভয়ে ভয়ে পিছু ফিরে ধনাকে দেখে নেয়। কে ওই লোকটা, অন্ধকারে কখন তার পিছু নিয়েছিল? ও কে? হারাই বিড়বিড় করে বলে—ধনা! ডর পাসনে বেটা। হামি আছি। তারপর থেকে বারবার তার চমক খেলে মনে হঠাৎ পিছনে, পাশে, সামনে অদৃশ্য দিলজান এসে দাঁড়ায়। তার হাতে ছোরা চকচক করে। ক্রমে অন্ধকারে তার মূর্তিটিও যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠো হারাই তখন বিড় বিড় করে দেওয়া আবৃত্তি করে রাতবিরেতে রাস্তায় চলা যাদের জীবন, তারা। ‘দোওয়া গঞ্জেল আরশ’ মুখস্থ রাখো হারাইয়ের বাপ হারাইকে ছেলেবেলায় এই দোওয়া শিখিয়ে দিয়েছিল পথেঘাটে বিপদ-আপদে পড়লে এই দোওয়া আওড়াস বেটা বালা-মুসিবত দূর হয়ে যাবে। ভূত-ভূতিনী, জিন-পরী কী চোর-ডাকাত একতিল ক্ষেতি করতে পারবে না। বিপদ যত বেশি হবে, তত জোরে জোরে পড়বি ‘গঞ্জেল আরশ’।

সুতরাং হারাই ভয়-কান্না-ক্ষোভ মেশানো কাঁপা কাঁপা সুরে জোরালো গলায় ‘গঞ্জেল আরশ উচ্চারণ করতে থাকে। আর চাকায় চাকায় বাজতে থাকে সুরে সুরে মিলিয়ে চারু মাস্টারের বেহালা। নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ছড়িয়ে আসে পরম করুণামাখা আশ্বাস।

হারাই যখন মেদীপুর চটির কাছাকাছি, তখন কৃষ্ণপক্ষের আধমরা চাঁদটা মাঠের ওপর ভেসে উঠেছিল সেই ক্ষয়াটে জ্যোৎস্নায় সামনে দূরে যেন একবার দিলজানকে দেখেছিল—চোখের ভুল হতেও পারে। পিছনে তখন ধনার খুরের শব্দটা বেশি করে শোনা যাচ্ছিল। বার বার ঘুরে দেখছিল, ধূর্ত কসাইটা পিছন ঘুরে গিয়ে ধনার দড়ি খুলে দিচ্ছে নাকি! কিন্তু পিছনে খুরের শব্দ জোরালো আর ধারাবাহিক। ধনা আর হাঁটতেও পারছে না, তাই ওই শব্দ। তবু ওই শব্দেই তো সে তখনও বেঁচে আছে। বার বার তাকে সাহস দিচ্ছিল হারাইডর কী? আমি তো আছে!

চটির ধারে বটতলায় একদঙ্গল বাঘড়ে গাড়োয়ান ছিল, তার প্রমাণ ছড়ানো তারা সন্ধ্যায় চলে গেছে। একলা হারাই গাড়ি রেখে রাত জেগেছে। চোখের পাতা কষ্টে খুলে রেখেছে। কী জানি কখন দিলজান কিংবা কেউ গরু খুলে নিয়ে যায়! আর এই তিন বস্তা সোনা গাড়ির ওপর রাখা!

কিন্তু খিদেয় পেট চোঁ চোঁ। পিরিমল বদ্যি পকেট খালি করে দিয়েছে। অগত্যা বস্তা খুলে কিছু ধান গামছায় বেঁধে চিঁড়ের দোকানে গিয়েছিল সে। চিড়ে আর ভেলি গুড় কিনে খেয়েছিল। শুয়ে পড়েছিল ধানের বস্তায় ঠেস দিয়ে। ধনা আরও কাহিল হয়েছে। ছ্যারানি বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে মন্ত্রপড়া জলটা খাইয়েছে হারাই। আশায় থেকেছে, শেষ রাত নাগাদ গরুটা নিশ্চয় ভাল হয়ে যাবে।

ভোরে কোথায় আজানের শব্দ শুনতে পেলা কী একটা স্বপ্ন দেখছিল, মনে পড়ল না হারাই হুড়মুড় করে উঠে বসলা সারা শরীরে ব্যথা। জ্বর ভাব। আর শেষ রাতে বেজায় জাড় পড়েছিল। গরু দুটোর পিঠে ছালা চাপানোর কথা মনেই ছিল না। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে আগে ধনার দিকে তাকায়। কলজে চিরিক করে ওঠো গরুটা দু পায়ের ওপর মুখ রেখে শুয়ে আছে। চোয়াল অল্প অল্প নড়ছে। পিঠে হাত বোলায় কিছুক্ষণ তারপর মন্ত্রপূত এক আঁজল জল ফের ঠোঁটের কাছে ঝাপটানি মেরে ছুঁড়ে দেয়া কষায় গড়িয়ে পড়ে।

আর সেই আজানের কাঁপা কাঁপা সুরে অসহায় হারাইকে ঈশ্বরের দিকে মুহুর্মুহু ডাকতে থাকে। সে ঝটপট পাশের পুকুরে অজু (প্রক্ষালন) করে গাড়ির একটু তফাতে পরিষ্কার জায়গা বেছে নেয়। শুকনো ঘাসে দাঁড়িয়ে নমাজ পড়ে মাথা কোটো হুহু করে কেঁদে বলে—হামার বেটার জান মাঙি হুজুর আর কিছু মাঙি না সংসারে তারপর কী এক হঠকারিতায় আচ্ছন্ন গাড়োয়ান চুপি চুপি ফের বলে—হেই পরোয়ারদিগার! হামরা মাগমরদ বাঁজা লই তুমার মেহেরবানিতে। তুমি এক ব্যাটার জানের বদলে হামারঘে আরেক ব্যাটার হায়াত (আয়ু) দাও!

ব্যাটা মরবে, ব্যাটা জন্মাবে। কিন্তু গরু মলে গরু কোথায় পাবে হারাই! একটা গরুর দাম যোগাতে আদ্ধেক জমি বেচতে হবে। খোদা কি এটা বোঝেন না? একটা গরুর অভাবে তার গাড়োয়ানী বন্ধ হবে চাষবাস বন্ধ হবে। খন্দ ফলমূল ফিরি করতে আসা হবে না রাঢ়ে। বাঘড়ীমুলুকে কে এসব কিনবে? না খেয়ে মারা পড়বে হারাইয়ের বহু-বেটা-বিটিরা। ‘মুসাফির’দের মতো তাদেরও যে মরসুমে ভিখ মাঙতে যেতে হবে রাঢ়ে। ঠিক এমনি করে একটা গরুর অভাবে বাঘড়ীর কত মানুষ মুসাফির ভিখিরী হয়ে গেছে। তাই ভেবে হারাই কাঁদে। নমাজে বসে থাকে অনেকক্ষণ খোদাতালাকে ইনিয়ে বিনিয়ে সব কথা বোঝাতে চায়।

রোদের ছটা ফুটেছে মেদীপুরের গাছগাছালির মাথায় হারাই যখন গাড়ির কাছে এল, তখন একটা দুটো করে লোক জমেছে দোকানপাটে। তারপর ভিড় বাড়তে থাকে। সূর্য উঠল। আবার কিছু ধান দিয়ে হারাই চিড়ে গুড় এনে খেলা ধনা তেমনি শুয়ে আছে।

তারপর যত বেলা বাড়ে, একটা দুটো করে লোক এসে হারাইয়ের গাড়ির কাছে দাঁড়ায়। ওরা কীভাবে টের পেয়ে গেছে বুঝতে পারে না হারাই। আসলে গাঁ-গেরামের মানুষ গরু-অন্ত প্রাণ। গরুর কিছু হলে ভিড় করে আসবেই। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে হারাই কোণঠাসা। নানান জনে। নানান ওষুধ বাতলায়। কেউ বলে—বাঁচবে না। কেউ বলে—বাঁচতেও পারে। অনেকে রোগা গরুর কাহিনী শোনায়। হারাই চুপচাপ বসে থাকে। আশা-নিরাশায় টানাপোড়েন চলতে থাকে মনের ভেতরে।

আজ হাটবার। মেদীপুর চটির হাটতলা ক্রমশ ভরে উঠছে মানুষে। বটতলায় একটা দুটো করে গাড়িও এসে জুটছে। আশেপাশের গাঁ থেকে এসেছে হাট সারতে। তারা হারাইকে হাজার কথায় উপদেশ দেয়া আর কেউ কেউ বলে—বেচে দাও কসাইকে হালাল করুক। অমনি রাগী লাল চোখে তাকায় হারাই। মাথাটা দোলায়। কেউ বলে—বাঘড়ীর গাড়ির ঝাঁক আসবে যখন, তাদের গাড়িতে বস্তাগুলো তুলে দিও। আর গাড়িটা একটা গাড়ির পেছনে বেঁধে দিও। তবে রোগা গরুটা…

একজন হেসে বলে—রোগা গরুটা আর কতক্ষণ? হুই দ্যাখো, কাছেই পুকুরপাড়ে ভাগাড়।

হারাইয়ের ঠোঁট কাঁপো কথা বলে না। চারপাশে এই ভিড় তার দমকে আটকে দিয়েছে। ধনারও দম আটকে দিচ্ছে। হাওয়া চাই, অনেক হাওয়া। দোহাই বাবাসকল, একটু ঘুরে দাঁড়াও। হামারঘে এটু হাওয়া বাতাস দাও। মনে এই করুণ মিনতি বুজকুড়ি তোলে। চোখ দিয়ে জল গড়ায় নিঃশব্দে একটি অসহায় মানুষ আর একটি রুগণ জানোয়ারের। ক্রমে বেলা বাড়ে। কোলাহল বাড়ে। একের পর এক মানুষজন এসে ভিড় করে আর চলে যায়। শেষ কথা বলে যায়। তারপর ভিড় ঠেলে আসে কেউ। –আসসালাম আলাইকুম, ভাইজান!

হারাই তাকায়। সেই দিলজান! টেরি করা তেলচুকচুকে চুল চিবুকে দাড়ি। গায়ে হাফ শার্ট, বুকপকেটে কাগজ কলম। পরনে চেককাটা লুঙি আর পায়ে পাম্পসু কাঁধের গামছায় ঠোঁটের পানের রস মুছে হাসে। হারাই চোখ নামিয়ে ধুলোয় আঁক কাটে। কাল রাতে এই লোকটাই কি তাকে গালমন্দ করেছিল? বিশ্বাস হয় না। মুখে মিঠে হাসি।

–কী ভাই? কী ঠিক করলেন?…দিলজান পাশে এসে বসে। কাল সন্ধেবেলা বুলেছিলাম পঞ্চাশ। তখন অবস্থা ভাল ছিল। এখন তিরিশেও রাজী হব কিনা বলা কঠিন। বলুন তাড়াতাড়ি

হারাই গলার ভেতর বলে–কী?

—ভুল করবেন না তিরিশ টাকা কম নয়। লিয়ে যেতে যেতে যদি জান বেরিয়ে যায়, সব টাকা বরবাদ কি না বলুন! আমি ‘রিসিক’ লিচ্ছি। দেরী যত করবেন, তত দুজনারই ক্ষেতি।

চার পাশ থেকে সবাই সায় দেয়া এক গলায় বলে–দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। কেউ বলে— হালাল জিনিস। মানুষের ভোগে লাগুক। ক্যানে শেয়াল শকুনকে খাওয়াবে বাপু! এবং ফের দিয়ে দাও, দিয়ে দাও, এই কোরাস ব্যুহের মতো ঘিরে ফেলে হারাইকে। দিলজান পকেট থেকে টাকা বের করো লেন। হাত পাতুন। তারপর সে হারাইয়ের আড়ষ্ট হাতে তিনটে নোট গুঁজে দেয়। মুঠোটাও চেপে বুজিয়ে দেয় এবং ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ায়। কাকে ডেকে বলে—শিগগিরি গাড়ি জুতে আন। হাঁটতে পারবে না। জলদি যাবি। তারপর সে ব্যস্তভাবে ধনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

হারাই টাকা মুঠোয় নিয়ে বসে থাকে। দু চোখে শব্দহীন জল বয়ে যায়। একজন বলে—আহা! আর কেঁদে কী হবে, ভাই? গোজন্মে খালাস পেল। বেঁচে গেল, তাই মোনে করো। তবে হ্যাঁ, বেথা তো হবে। পালা জন্তি কত আদর খেয়েছে। বেথা বাজবে বই কি। ওরে ভাই, নিজের জোয়ান ব্যাটা যে মরে যায়, তার বেলা?

হারাই লোকটাকে দেখতে থাকে। লোকটা ঢ্যাঙা গোঁফ আছে মস্তো খালি গা, পরনে মালকোচ করা ধুতি বগলে তেল পাকানো লাঠি। কোমরে লাল গামছা জড়ানো। খৈনি ডলছে। লোকটা হিন্দু তা বুঝতে পারে হারাই। খৈনি জলে সে তালুতে চটাস শব্দ করে ফু দিতে দিতে ফের বলে—দিলজান আছে বলে অ্যানেক লোকসান বাঁচে। যা পাওয়া যায় দু দশ টাকা, এ বাজারে তাই লাভা বরঞ্চ ওই টাকায় একটা বাছুর কেনো। ইচ্ছে থাকলে ইভেনেও কিনতে পারো আমার কাছে। সস্তা করে দেব। দেখবে নাকি হে?

হারাই মুখ নীচু করে শুধু বলে—বাছুর বড়ো হতে হতে মনা গোরে যাবে, হামি ভি গোরে যাব, দাদারে!

ভট্টমাটির বদর হাজি মাঠে গিয়েছিলেন। দেড় বিঘে জমির আখ কাটা হচ্ছে। আজই দুপুর বেলা মোষের গাড়িতে মাড়াইকরা কল আর কড়াই আনা হয়েছে মউলে থেকে। বাড়ির পাশে বাঁশবনের ভেতরে বসানো হচ্ছে। হাজি গিয়েছিলেন আখ কাটার তদারকে। মাঝ রাত নাগাদ তাঁরই আখ দিয়ে মরসুমের গুড় তৈরির পালাটা শুরু হবে। ইমানদার তীর্থফেরত মানুষ আল্লার নেকনজর তাঁর ওপর। গাঁয়ের সব কাজ তাঁকে দিয়েই শুরু হয়। বিশেষ করে গুড় তৈরিতে আবার। পয়-অপয় বা ভাল-মন্দ সাইতে’র ব্যাপার আছে। জ্বাল দিচ্ছে তো দিচ্ছে, রসে আঠা ধরে না। কিংবা আঠা ধরল তো এমন ধরা ধরল, চিটে হয়ে গেল। সু-কুয়ের দৃষ্টি আছে। দোয়াদরুদ। পড়তে হয়। শয়তান খেদাতে হয়। সে অনেক ঝক্কি। বদর হাজি মক্কা থেকে পবিত্র আবে-জমজম (জমজম নামক কুয়োর জল) এনে রেখেছেন। ফুটন্ত রসে একটু ছেটালেই বরণ ধরে উজ্জ্বল সোনালী। আর কী স্বাদ! বদর হাজির মুখের বচনের মতো স্নিগ্ধ আর মিঠো ওঁর মনের মতো নরম।

হাজির পরনে হাঁটু অবদি ঝুল পাঞ্জাবি। গোড়ালির ওপর থেকে লুঙ্গির ঝুল। পায়ে থ্যাবড়া চটিা কাঁধে বিহারের দেওবন্দ শরীফের হলুদ ডোরাকাটা গামছা—এক মৌলবির কাছে কেনা। তিনি সেখানকার বিখ্যাত মাদ্রাসায় সবে পাস দিয়ে এসে ভট্টমাটিতে মক্তব খুলেছেন। ডেরা। গেড়েছেন হাজিসায়েবের দলিজ ঘরে।

আর বদর হাজির মাথায় আরবী গোল টুপি। মক্কার বাজারে কেনা। হাতে এনামেলের বদনা। আখ কাটা মুনিষদের মিঠে কথায় তম্বি করে চলে এসেছেন রাস্তার ধারে পুকুরপাড়ে। তালগাছগুলো ন্যাড়া করে পাতা কাটা হয়েছে। সেগুলো দিনমান রোদে ক’দিন ধরে শুকোচ্ছে। গুড়ের চুলোয় জ্বালানী হবে। হাজি রোজ দুবেলা এসে একটা একটা করে গুনে যান। একটু আগে। বিকেলের নমাজ সেরে পাতা গুনছেন। হঠাৎ চোখ গেল রাস্তায়। থমকে দাঁড়ালেন।

একটা গাড়ি আসছে। তার জোয়ালের একদিকে গরু, অন্যদিকে মানুষ।

গাড়ির ধুরিতে তেল পড়েনি কোঁ কোঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে।

লোকটা রোগা। পরনের ময়লা লুঙিটা বেশরমভাবে কাছা মারা দুই জাং আর পাছার অনেকটা উদোম কবর থেকে মরা মানুষ উঠে এসে যেন গাড়িতে বাঁওয়ালি’ টানছে। এ বড় তাজ্জব!

বদর হাজি নানা জায়গা ঘোরা মানুষ। কলকাতায় মানুষটানা ঠেলাগাড়ি আর রিকশো দেখেছেন কিন্তু ভট্টমাটির পথে এমন কখনও দেখেন নি জিভ চুকচুক করে বললেন—আহা বেচারা! তাঁর মন এমনিতে নরম গরীব-মিশকিনকে ভিক্ষে দেনা মুসাফির দেখলে ডেকে খাওয়ানা ভাই রে! এ সংসার ক’দিনের? এক পা গোরে দিয়েছি।

নাদুস-নুদুস শরীর ধুপধুপিয়ে বদর হাজি উঁচু পুকুরপাড় থেকে রাস্তায় নেমে গেলেন। মিঠে গলায় বললেন—বাড়ি কোথা, বাপ?

হারাই দাঁড়ায়। শুকনো ঠোঁটে একটু হেসে সালাম বলে ক্ষীণ স্বরে। চোখের কোণায় গর্তা ফের নাম বলল। ধাম বলে। মেদীপুরের বাজার থেকে গাড়ি ছেড়েছে দুপুরের নমাজ পড়ে। চিড়ে গুড় দিয়ে ক্ষিদে মিটিয়েছে। সেই সব কথাও বলে। বদর হাজিকে তার মেহেরবান মনে হয়। মনের সব দুঃখ খুলে বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শরমের চাপে ধনাকে বেচার কথাটা লুকোয়। শুধু বলে, বাঁওয়ালি গরুটা রাস্তায় মারা পড়েছে।

বদর হাজি সব শুনে জিভ চুকচুক করে বলেন—আহা! তাহলে তো বড়ই মুশকিল কিন্তু বাড়ি বুললে তো সেই পদ্মার ধারে শিমূলে-কেষ্টপুর! সে তো কমপক্ষে বিশ কোশের মাথা! দু লদীর পার, তিন লদীর কিনারে!

—জী হাঁ! জী হাঁ। হারাই খুব সায় দেয়।

বদর হাজি একটু রাগ করে বলেন—বুলছ তো জী হাঁ! তুমরা বাঘড়ে গাড়োয়ানরা বেজায় বোকা!

হারাই খালি দাঁত বের করে।

—এক কাম করো।

—কী?মুশকিলআসান হাজিসায়েবের কথা শুনে হারাই বড় প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকে।

হাজি বলেন—আমার উখানে তুমাদের বাঘড়ীর একদল গাড়োয়ান এসেছে। আজ রেতেই উয়ারা চলে যাবে বুলছিলা বুঝলে?

—জী, জী।

—আমি বুলে দিব উয়াদের। কারুর পেছনে জুতে দিও গাড়ি। ওই তো কখান বস্তা কী আছে ওতে?

—ধান, বাপজী।

বাপজী শুনে দয়ালু বদর হাজি বলেন—দেখ দিকিনি কী বিপদ! অমন একলা দলছাড়া হয়ে আসে রে, বাবা?

সুখে দুঃখে আবেগাপ্লুত হারাই বলে—চণ্ডীতলার চারু মাস্টেরের বিটির বিভা হবে ফাগুন মাসে। হামার একটা ভাই আছিল। তিনি কথা দিয়ে এসেছিল, বিভার কুমড়া-কলাই যা লাগে দিবো ভাইয়ের জবান, বাপজী হাজিসায়েব! সেই ভাই হামার এখুন গোরে! সে চোখ মোছে। নাক ঝাড়ে।

হাজি বলেন—এস, এস কপালের ফের আর কী! আর কক্ষনো অদূর থেকে অমন করে একা। এসো না। শিমূলে-কেষ্টপুর সে কি ইকেনে? দুই লদীর পার। তিন লদীর কিনারে। সেই লালগোলার মুখে ওপারে গোদাগাড়ি ঘাট জেলা রাজশাহী এই সেদিনেও ইস্টিমার চলত। কী সব হেঁদু-পাকিস্থান করে গোল বাঁধালে। …

বদর হাজি আগে আগে হাঁটেন। পদ্মাপারের গল্প বলেন। পাকা মানুষ কত দেশ ঘুরেছেন। আরও দ্যাখ বাপ, দ্যাশচরা মানুষের কাছে সব বিদ্যাশীই আপন। কত জায়গায় গিয়ে ঠেকেছি। আলাপ-পরিচয় হয়েছে। কুটুম্বিতে করেছি। তাই বিদ্যাশী সবাই আমার মেহমান। অতিথি যা আছে, খোদার ফজলে, তাই খেতে দিই। চাট্টি ডালভাত খাবি, বাপ। শরম করিস না তুই আমার মেহমান …

দলিজ ঘরের সামনে মস্তো চটান। খামার বাড়ি। শীতের ধানটা ওখানেই ঠ্যাঙানো হয়েছে। চকচকে গোবরলেপা মাটি এক পাশে খড়ের পালা সার সারা খামারের কোণার দিকে বাঘড়ে গাড়োয়ানদের গাড়িগুলো রয়েছে। মাথার ওপর ডালপালা ছড়ানো শিরীষ গাছ। ইটের উনুন জ্বালিয়ে গাড়োয়ানরা রান্নাবান্না করছে। রাতের নমাজের পর খেয়েদেয়ে গাড়ি ছাড়বে। হারাই কিন্তু নিরাশই হল। ওরা যাবে কাতলামারির দিকে। বহরমপুর থেকে ছাড়াছাড়ি হবে। তখন ফের হারাইকে গাড়ি টানতে হবে। শেষে ভাবল, যদূর যাওয়া যায়। পথে যদি কপালগুণে নিজের এলাকার কোনও দল পেয়ে যায়, ভালই হবে

দল বেঁধে সবাই নমাজ পড়ে এল পাশের মসজিদে। তারপর ওরা খেতে বসল গাড়ির কাছে। হারাই বদর হাজির মেহমান বড় আশায় সুখে মনটা চনমন করছে। ঘরের ভেতর তক্তপোশে নকশাআঁকা সাদা দস্তরখানা পড়ল। মৌলবি হাত ধুয়ে তৈরী হয়ে বসলেন। বদর হাজি ডাকলেন—আয় বাপ হারুন আলি! হারাই সংকোচে এক পাশে বসলা আমির-বড়লোকের সঙ্গে জীবন। এই প্রথম সে খাচ্ছে। জীবনের সব দুঃখ, বঞ্চনা, হারানোর শোক ক্ষোভ আর ধনার মৃত্যুর কথা সে ভুলে গেল। তার সামনে বিশাল খাঞ্চায় ভরা শাহদানার পা সাদা ঝকমকে স্বাদু সুগন্ধ রাঢ়ী অন্ন। বাড়ি ফিরে বউছেলেপুলের কাছে কত গল্পই না করবে হারাই! তার বংশে এটা একটা গল্প হয়েই থাকবে বইকি—এই বংশের এক পুরুষ আমির-বড়োলোকের সঙ্গে বসে একই খাঞ্চা থেকে ভাত আর একই বাটি থেকে তরকারি তুলে খেয়েছিল!

শরীয়ত মতে খেতে বসে খামোকা কথা বলতে নেই। তবু বদর হাজি একটু গপ্পে মানুষ। হঠাৎ হেসে মৌলবিসায়েবকে বলেন—আপনার বরাতে ছিল! তারপর মেহমান হারাইয়ের দিকেও তাকান।–তোরও বরাত, বাপ!

হারাই মুখ তোলে। মৌলবি বলেন—জী?

বদর হাজি একটা প্রকাণ্ড চীনেমাটির বাটি থেকে চামচে কী একটা তরকারি তুলে আগে মৌলবির থালায় দেন। তারপর কয়েকটা টুকরো তুলে হারাইয়ের থালায়, শেষে নিজে থালায় নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বলেন—আমাদের গাঁয়ে এই এক জ্বালা হেঁদু জমিদারের মাটি। বাপপিতেমোর আমল থেকে চলে আসছে এই নিয়ম এ মাটিতে হালাল হয় না।

মৌলবি বলেন—বলেন কী! এ তো বেআইনী! তা ছাড়া এখন জমিদার কোথা?

—আইন-বেআইনের কথা লয়, মৌলবি সাহেব। বদর হাজি বলেন, জমিদারের সাথে প্রোজার বাপ-ব্যাটার সম্পর্ক ছিল। বাপ-দাদো জবান দিয়ে গেছে তেনার কাছে। সেটাই হল গে বড় কথা। তা ছাড়া এই ভট্টমাটিতে পেরায় সব লোকই পরোজি’—গোরুর গোশতো খায় না। আপনি লতুন এসেছেন। বিয়ে-সাদির খানা হলে দেখবেন। বলবে—ভাইসকল! কে কে ‘পরোজি আছ হাত তোলো। দেখবেন একশোটা হাত খাড়া হবে আসমানে।

বদর হাজি হা হা করে হাসেনা মৌলবি সায়েব গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন—এটা বে-শরা। ঠিক না।

হাজি বলেন–তো কী আর করা! মাঝে মাঝে সেই মেদীপুরে হালাল হয়। লুকিয়ে-চুরিয়ে কেউ কিনে এনে খায়। আমার ভাগ্নেব্যাটা একেবারে গো-খাদ (খাদক)। আজ হাটবার ছিল। দিলজান একটা হালাল করেছে শুনে নিয়ে এসেছিল। তা দেখেছি, ভালই হল। আপনি আছেন। আর এই আমার মেহমান বেডা আছে। মেহমানেরও খাতির হল।

হারাই টুকরোটা মুখে পুরেছিল। আচমকা নড়ে ওঠে তারপর তক্তপোশের নীচে থুথু করে। ফেলে দেয়।

হতবাক হাজি বলেন—ও বাপ! তুইও পারোজি নাকি? তা বুলিস নাই ক্যানে?তা ছি ছি ছি!

হারাই মুখে হাত চেপে নেমে যায় আসন ছেড়ো ছিটকে বাইরে যায়। বাইরে তার ওয়াক তোলার শব্দা খাওয়া ফেলে বদর হাজি দৌড়ে যান।

গিয়ে শোনেন, যেন বমিতোলার ওয়াক নয়। তাঁর আধবুড়ো বাঘড়ে মেহমান বুকে হাত দিয়ে বারান্দার ধারে বসে হা হা করে বুক ফেটে কাঁদছে। হাজি বলেন—ও বাপ! তোর কী হল? শরীল খারাপ?

হারাই ভাঙা গলায় বলে হেই হাজিসাব! হামাকে হারাম খাওয়ালেন!

অমনি ভেতর থেকে মৌলবি বেরিয়ে এসে গর্জন করেন—এ্যাই কমবখত! এ্যাই বে-শরা উল্লুক! তোর মুখ, না পায়খানা? ও কী বলছিস? হালালকে হারাম বলছিস! তওবা তওবা! নাউজুবিল্লাহ!

হারাই কথা কানে নেয় না। বারান্দা থেকে নীচে নেমে রাতের আবহমণ্ডল এফেঁড় ওফেঁড়ি করে বলে—হামাকে হামারই বেটার গোশতো খাওয়ালেন! হেই হাজিসাব! হামার ভেতরটা জ্বলে খাক হয়ে গেল গে! এক-পদ্মার পানিতেও ই আগুন নিভবে না গো!

বদর হাজি হাসতে হাসতে বলেন—বাঘড়ে ভূত কাঁহেকা! মৌলবি বলেন—জাহান্নামী কাঁহেকা! হাদিসে লেখা আছে হালালকে হারাম, আর হারামকে হালাল করে যে, তার পিঠে চল্লিশ কোড়া (কশা) মারো! বাঘড়ে গাড়োয়ানের দল লণ্ঠনের আলোয় ভাত খেতে খেতে এদিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারে না। দলিজঘরের নীচে আবছা আলো-অন্ধকারে একটা লোক জবাইকরা প্রাণীর মতো ধড়ফড় করছে। … পশ্চিম দেশ থেকে চলেছে এই পথ পূবের দেশে, সোনালী মাটির এলাকা থেকে সাদা গুঁড়ো দুধের মতো নরম মাটির এলাকায়। কালো পীচে ঢাকা এই আঁকাবাঁকা পথ চলেছে ভাগীরথী পেরিয়ে, ভৈরব পেরিয়ে পদ্মাসীমান্তের দিকে। আজ রাতে এই পথে চারু মাস্টারের বেহালা বাজছে করুণ সুরে। চারু মাস্টারের বিটির বিভা হবে ফাগুন মাসে দোলাই বলেছিল সেই বিভার সব কুমড়ো আর কলাই দেবো দোলাই এখন পদ্মার পাড়ে গাবগাছের তলায় মাটির ভেতরে শুয়ে আছে। তার বড়ভাই হারাই ফিরে আসছে সেই কুমড়া আর কলাই দিয়ে নিয়ে আসছে কিছু রাঢ়ী ধান আর চারু মাস্টারের বেহালার সুর। সে দেখছে, নক্ষত্ৰভরা আকাশের ঈশাণ কোণে এক ছবি। দূরের গাঁয়ে পাটকাঠির বেড়ার ধারে লম্বা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কলিমদ্দিরের মা। হারাইয়ের বহু। তার পায়ের কাছে মাটির বদনায় পদ্মার জল। ধনা-মনার পা ধুয়ে দেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট দেখা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *