বাড়ির কর্তা
সুমথনাথ ঘোষ
বৈঠকখানার পাশে যে ছোট ঘরটা তাতে থাকেন মহেশবাবু। ঐশ্বর্য দূরে থাক, বিলাসিতার তুচ্ছতম উপকরণও একটা চোখে পড়ে না কোথাও। এত বড় বাড়ি, যার দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে বারো-তেরোখানা ঘর, তার কর্তা যে ওইভাবে বাস করতে পারেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। বাস্তবিক ঘরটার মধ্যে ঢুকলে মনে হয় না যে এ বাড়ির কর্তা ওই মহেশবাবু, আর ওরই পয়সায় তৈরি এই প্রাসাদোপম অট্টালিকা। লেক অঞ্চলের ওই অতি আধুনিক পরিবেশের মধ্যে এ যেন একটা সাক্ষাৎ ছন্দ-পতন! খাটো ধুতির ওপর সাদা ফতুয়া গায়ে ও পায়ে একজোড়া চটি দিয়ে মহেশবাবু একটা হাতলভাঙা ইজিচেয়ারে দিনের বেশির ভাগ সময় শুয়ে থাকেন মুখে গড়ার লম্বা নলটা লাগিয়ে। আর চোখে চশমা দিয়ে সংবাদপত্র, ধর্মগ্রন্থ। প্রভৃতি পড়েন।
বিলাসিতার মধ্যে আছে ওই তামাক খাওয়াটুকু। চাকরি জীবনের সর্বোচ্চ শিখরে যখন উঠেছিলেন তখন যে তামাক যে দোকান থেকে কিনে খেতেন আজো সেই দোকানের সেই তামাক খাওয়ার অভ্যাসটুকু শুধু ছাড়তে পারেন নি যদিও এ নিয়ে স্ত্রী মনোরমার সঙ্গে তাঁর উঠতে বসতে ঠোকাঠুকি লাগো মনোরমা বলেন, এত দামী তামাক খেয়ে মিছিমিছি পয়সা। পুড়িয়ে দেওয়ার কোন অর্থ হয় না! অর্থ হয় কি না হয় তা নিয়ে বৃথা তর্কাতর্কি করেন না মহেশবাবু। শুধু ফি-মাসে পেনসন নিয়ে ফেরবার পথে একেবারে তামাকের ঠোঙ্গা হাতে করে নিয়ে বাড়ি ঢোকেনা অম্বুরী তামাকের সুগন্ধ সমস্ত বাড়িটার আবহাওয়ার সঙ্গে এমন ভাবে মিশে থাকে যে পা দিলেই আগে যেন তা স্মরণ করিয়ে দেয় বাড়ির কর্তার কথা।
কিন্তু ওই পর্যন্ত যারা আসে তারা নিচের সেই ঘরটার দিকে পিছন করে ওপরে উঠে যায়। মহেশবাবুর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনিদের কলগুঞ্জন মুখরিত সংসার। সেখানে তাদের কত হাসি-উচ্ছ্বাস, কত পরিচিত-অপরিচিতের নিত্য আনাগোনা। সে যেন একটা স্বতন্ত্র জগৎ, যার সঙ্গে মহেশবাবুর কোন যোগাযোগ নেই। সত্যি, মহেশবাবুকে দেখলে দুঃখ হয়। তার নিজের সংসারে নিজের অস্তিত্বটা এখন বড় অদ্ভুত এক বিরাট বৃক্ষের মূলের মত তিনি যেন আছেন শুধু অদৃশ্যে, কেউ তাঁকে দেখে না, গ্রাহ্য করে না, অথচ তাঁরই যারা ডালপালা ফুল-ফল তাদের নিয়ে যত মাতামাতি, সংসারের যত প্রয়োজন। এমন কি স্ত্রী, যাঁর ওপর তাঁর দাবি সবচেয়ে বেশি, তিনিও এখন কেমন করে যেন সবচেয়ে বেশি পর হয়ে গিয়েছেন। নাতি-নাতনীদের দিয়ে পাঁচবার ডেকে পাঠালেও একবার তাঁর সময় হয় না, ওপর থেকে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করার। হয়তো কখনো কাউকে দিয়ে বলে পাঠান, কি দরকার ঠাকুমা বলতে বলে দিয়েছেন—এখন তাঁর সময় হবে না আসবার!
কি দরকার! বলে মহেশবাবু একটু ইতস্তত করে আবার বলেন, না থাকা কোন দরকার নেই! হয়ত বা একটা গভীর নিশ্বাস বুকের মধ্যে চেপে নিতে নিতে গড়ার নলটা আবার মুখে তুলে দেন। মনোরমাও সংসারের নানা ঝঞ্চাটে সে কথা ভুলে বসে থাকেন, তিন-চারদিন চলে গেলেও হয়ত খেয়াল হয় না কর্তা কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ঠাকুর-চাকর আছে—তারা তাঁকে খেতে দেয়, তাঁর ঘর সাফ করে—তাঁর ফাইফরমাশ খাটো
শুধু টাকার প্রয়োজন হলে আর ডাকতে হয় না মনোরমাকে একেবারে সোজা স্বামীর ঘরে তিনি এসে হাজির হন। আর কারুর কাছে হাত পাতাতে তাঁর যেন মাথা কাটা যায়। রোজগারী ছেলে, বিবাহিতা মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনী সকলকে যেন তখন পর বলে মনে হয়। অন্তত ঠিক তা মনে না হলেও নিঃসঙ্কোচে তাদের কাছে হাত পেতে টাকাপয়সা চাইতে যেন তাঁর কেমন বাধ বাধ ঠেকে। অথচ তিনি অনায়াসে মহেশবাবুর কাছে গিয়ে জুলুম করার ভঙ্গীতে বলেন, দেখি। পঁচিশটা টাকা শিগগির!
কোথায় পাবো, এত টাকা! পেনসনের টাকা সব তোমার হাতে এনে দিয়েছি, এর মধ্যে সব খরচা হয়ে গেল? বলে মহেশবাবু গঙ্গড়ার নলটা হাতে টেনে নিতে নিতে তার মুখের দিকে তাকান।
রাগতসুরে মনোরমা বলেন, খরচ হয়ে না গেলে কি তোমার কাছে আবার টাকা চাইতে আসতুম?
কিন্তু কিসে এত টাকা খরচ করলে শুনি? এই ত গেল মাসে সত্তরটা টাকা দিলুম, বললে মেয়েদের কলেজ যাওয়ার ভাল শাড়ী ছিল না বলে ধার করে কিনেছিলে, এখন কাপড়ওয়ালা তাগাদা করছে! আবার এ মাসে কি?
এবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন মনোরমা–তোমার মেজ মেয়ে যে বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে এসে রয়েছে এখানে আজ একমাস, তা কি চোখে দেখতে পাও না? তাদের জন্যে যে বেশি দুধ নিতে হয়েছে তার দাম দিতে হবে না?
তাই বলো! ও মিনু এখানে রয়েছে বটে, ভুলেই গিয়েছিলুম! বলে মহেশবাবু সুড়সুড় করে উঠে গিয়ে বাক্স থেকে পঁচিশটা টাকা এনে স্ত্রীর হাতে গুঁজে দেন।
টাকাটা হাতে নিয়ে এবারে মনোরমা বলেন, মেয়েরা বিয়ে হলে পর হয়ে যায় শুনেছি, কিন্তু বাপ-মার কাছে ত তারা চিরকাল তেমন থাকে। আমি তো কই কোনদিন তাদের ভুলতে পারি না! আর তুমি বাপ হয়ে কি করে যে মেয়ের কথা ভুলে থাকো এভাবে তা ঈশ্বর জানেন! বলতে বলতে মহেশবাবুর ঘাড়ে সমস্ত অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মনোরমা।
অবশ্য মহেশবাবুকেও এর জন্যে দোষ দেওয়া যায় না। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। তাছাড়া যে মেয়ে যেদিন প্রথম বাপের বাড়ি আসে সেদিন একবার বাপের ঘরে ঢুকে তাঁকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কেমন আছো, তোমার শরীর এখন কেমন? তিনিও তার উত্তরে যথারীতি সংক্ষেপে শুধু এইটুকু প্রতিবার বলেন, আর শরীর! এখন কি আর ভাল থাকার কথা মা—এখন গেলেই হয়!
কি যে বলো বাবা, তোমার এমন কি বয়েস হয়েছে! বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েরা সেই যে ওপরে মায়ের ঘরে গিয়ে ওঠে, তারপর আর বাপের সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কই থাকে না। মা-ই যেন তাদের সব। মায়ের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, সিনেমা দেখা, এখানে ওখানে ট্যাক্সি করে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যেদিন সেই মেয়ে আবার শ্বশুরবাড়ি যায়, ফটকে ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেজেগুঁজে বাপের ঘরে ঢুকে একবার ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ভারী গলায় শুধু বলে, বাবা আমি যাচ্ছি!
‘এসো মা’ বলে তিনি যখন আশীর্বাদ করেন, তখন মেয়ে আক্ষেপের সঙ্গে বলে, একবার ত তুমি আমার ওখানে গেলে পায়রা বাবা—তোমার জামাই কত দুঃখু করে! বলে এতদিন বিয়ে হয়েছে একবারও এলেন না আমাদের এখানে! মেয়ে-জামাই ত তোমার পর নয় বাবা?
তা ঠিক। আচ্ছা দেখি মা, এবার যাবার চেষ্টা করবো। এই বলে মহেশবাবু বিদায় দেন। মেয়েকে। কিন্তু ওখানেই শেষ। তারপর মেয়েও আর বাপের খবর নেয় না—বাপও মেয়ের কথা ভুলে বসে থাকেন।
ছোট মেয়ে দুটো বাড়িতেই আছে কিন্তু তাদের সঙ্গেও তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তারা কলেজে পড়ে। তাছাড়া তাদের আছে গানের ক্লাস, নাচের স্কুল, সেতার শেখা, জলসা, সিনেমা, ইদানীং আবার অতিরিক্ত উপদ্রব বেড়েছে ছেলেদের মত খেলার মাঠে যাওয়া—আজ ফুটবল, কাল ক্রিকেট, পরশু এন.সি.সি. তার পরদিন অলিম্পিক ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা কখন বাড়িতে থাকে বা কখন না থাকে, তার খোঁজই রাখেন না মহেশবাবু বা তাঁর রাখবার উপায় নেই। তবু যদি কোনদিন জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁগো, কাল তোমার ছোট মেয়ে সন্ধ্যের পর সেজেগুঁজে একটি ছোকরার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিল? গিন্নীর কাছ থেকে হয়ত তখনই জবাব আসে, তা জেনে তোমার লাভ কি?
মহেশবাবু গড়ার নলটা মুখ থেকে নামিয়ে নিয়ে বলেন, না, মানে ছোকরার চালচলনটা আমার ভাল মনে হলো না, সোমত্ত মেয়ে আমার—ওর সঙ্গে বেশি মেলামেশা করাটা আমি পছন্দ করি না। তুমি রেবাকে ডেকে বলে দিয়ো।
ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে মনোরমা থমকে দাঁড়িয়ে বলেন, ওমা, তুমি কার সম্বন্ধে কি বলছো। জানো? ও যে আমাদের ব্যারিস্টার রায়ের ছেলে অতনু! সামনের সেপ্টেম্বরে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা যাচ্ছে! আমাদের এ অঞ্চলে অমন ভাল ছেলে কটা আছে!
মহেশবাবু সব শুনে বললেন, ভাল ছেলে হলেই যে একেবারে ভীষ্ম কি যুধিষ্ঠির হবে তার কি মানে আছে! অপবাদ একটা রটতে কতক্ষণ! তাই বলছিলুম, তুমি মেয়েকে একটু সাবধান করে দিয়ো—অন্তত আমার নাম করে!
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মনোরমা বলেন, থাক, ও নিয়ে আর তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না —তোমার মেয়ে কচি খুকি নয়—আজ বাদে কাল বি.এ. পাশ করবে! বলতে বলতে তিনি গৃহান্তরে চলে যান।
মহেশবাবুর কর্তৃত্ব এ সংসারে কেউ মেনে না নিলেও তিনি যে বাড়ির কর্তা, এবাড়ির প্রতিটি সুখ-দুঃখের দায়িত্ব যে তাঁর স্কন্ধে, কেউ না মানলেও সে কথা তিনি যেন কিছুতেই ভুলতে পারেন না।
হঠাৎ কোনদিন ডাক্তারবাবুকে ব্যাগ হাতে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলে তাঁর বুকটা ধড়াস করে ওঠো চাকরবাকর বা ছেলেপিলে যাকে সামনে দেখতে পান ডেকে জিজ্ঞেস করেন, এই শোন, কার অসুখ করেছে রে!
হয়তো শোনেন মেজ ছেলের বড় মেয়েটার প্যারাটাইফয়েড কিংবা বড় মেয়ের ছোট ছেলেটার বুকে সর্দি বসেছে! নাতি-নাতনীর অসুখ শুনে বিচলিত হয়ে পড়েন মহেশবাবু, তখনই মনোরমাকে ডেকে পাঠান। তিন-চারবার ডেকে পাঠাবার পর হয়তো তাঁর সময় হয়, তিনি এক সময় ঘরে ঢুকে বলেন, কি হয়েছে, এত ডাকাডাকি করছো কেন?
মহেশবাবু চিন্তিত মুখে বলেন, ‘হ্যাঁগো, শুনলাম বাবলুর নাকি বুকে সর্দি বসেছে—তাই বলছিলুম কি, হোমিওপ্যাথি না দেখিয়ে ভালো একজন এলোপ্যাথকে দেখালে কেমন হয়?
কোন ডাক্তারকে দেখালে ভালো হয় সে তার মা-বাপ রয়েছে, তারা বুঝবে তোমাকে তা নিয়ে কে মাথা ঘামাতে বলেছে তা ত জানি না! তুমি তোমার নিজের চরকায় তেল দাও! বলে ‘মার চেয়ে ব্যেথিনী তারে বলি ডান’! বলতে বলতে স্বামীর মুখের ওপরে একটা তীক্ষ্ণ কটাক্ষ হেনে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান মনোরমা।
কিন্তু তবু তাঁর ভাবনা যায় না। তিনি ডাক্তারের আসা-যাওয়া লক্ষ্য করেন, তেমনি উদ্বেগের সঙ্গে রোগীর অবস্থা জিজ্ঞেস করে বেড়ান বাড়ির ছোট-বড় সকলকে। হ্যাঁরে, কেমন আছে। আজ বাবলু?
ওদিকে বড় বা মেজ ছেলের দর্শন পাওয়াও মহেশবাবুর কাছে একটা দুর্লভ সৌভাগ্য বিশেষ! যদি কোন কারণে কোনদিন তাদের ডেকে পাঠান ত তারা চেষ্টা করে বাপকে এড়িয়ে যেতে! তারা মনে ভাবে, বাবা বুঝি টাকার তাগাদা করবেন বলে এত ডাকাডাকি করছেন! বড় ছেলে ছোট আদালতে ওকালতি করো ছেলে-মেয়েদের হাওয়া বদলাতে বিদেশে নিয়ে যাবার সময় মহেশবাবুর কাছ থেকে তিন মাসের কড়ারে পাঁচশো টাকা নিয়েছিল কিন্তু তিন বছর কেটে গেছে সে টাকা আজো শোধ দেয়নি। তাই বাপকে ভুল বুঝে লুকিয়ে বেড়ায়। আর মেজ ছেলে ব্যবসায়ী। বি.এ. ফেল করে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কারবার করে মোটা লাভের অর্ডার দেখিয়ে মহেশবাবুর কাছ থেকে একাধিকবার টাকা চেয়ে নিয়েছে। মোটা লাভও হয়তো সে করেছে কিন্তু মহেশবাবুকে তাঁর টাকা শোধ দেওয়া আজো পর্যন্ত তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে মজা, কোনদিন যদি এ নিয়ে তিনি গিন্নীকে কিছু বলতে যান ত উল্টো ফল হয়। তাড়া দিয়ে ওঠেন মনোরমা বলেন, ছেলেরা কি তোমার পর যে কাবলিওয়ালার মতো তাদের কাছে টাকার তাগাদা দিতে হবে?যখন তাদের সময় হবে তখন নিশ্চয়ই তারা তোমায় দিয়ে দেবে।
ছেলেমেয়েরা না এলেও নাতি-নাতনীরা আসে বৈকি। এক-একদিন নাতি-নাতনীগুলোর জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েন মহেশবাবু। কোন দিন খবরের কাগজ খুঁজে পান না, কোনদিন বা চশমা, কখনো বা ফাউনটেন পেনটা হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করেন ছোট ছেলের নাম ধরে। বাপি, ওরে বাপি?
তিনতলার চিলকুঠুরীতে বসে টেস্ট-পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে করতে ছুটে নেমে আসে বাপি। তারপর এঘর ওঘর খুঁজে খুঁজে কাগজটা এনে দিয়ে যায় মহেশবাবুর হাতে। মহেশবাবু নাতি-নাতনীদের শাসন করেন, ফের যদি কোন দিন তোরা কেউ আমার জিনিসে হাত দিবি ত মেরে গায়ের ছাল-চামড়া তুলে দেবো!
ছেলেমেয়েগুলো দাদুকে ভেংচি কাটতে কাটতে তাঁরই কথার পুনরাবৃত্তি করে লুকিয়ে পড়ে আনাচে কানাচে। একদিন চশমাটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে না পেয়ে মহেশবাবু একেবারে রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলেন একটা নাতির হাত ধরে বললেন, এ নিশ্চয়ই তোর কাজ, শিগগিরি বের করে দে কোথায় রেখেছিস, তা না হলে মেরে হাড় ভেঙে দেবো।
দাদুর ক্রদ্ধ মুখের দিকে চেয়ে ভ্যাঁ করে সে কেঁদে ফেললো তারপর চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললে, আমি বুঝি নিয়েছি! দুলু তো নিয়েছিল!
সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছেড়ে দিয়ে মহেশবাবু চীৎকার করে উঠলেন, দুলো—এই দুলো হারামজাদা, শিগগির শোন এদিকে!
শঙ্কর ছুটে গিয়ে সিঁড়ির নিচ থেকে দুলুকে টানতে টানতে এনে হাজির করে দাদুর কাছে। বলে, এই যে দাদু লুকিয়েছিল ও সিঁড়ির তলায়! তারপর তার হাফপ্যান্টের পকেট থেকে শঙ্কর চশমাটা টেনে বার করে যেই মহেশবাবুর হাতে দিলে অমনি তিনি দুলুর কান মলে দুই গালে দুই চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন, হারামজাদা, ফের আমার জিনিসে হাত দিয়েছিস! সেদিন না আমার কলমের নিবটা তুই ভেঙেছিস!
কাঁদতে কাঁদতে দুলু একেবারে ওপরে মার কাছে চলে গেল।
মা ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে ভোলাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ মনোরমা সেখানে গিয়ে পড়লেন। বললেন, কি হয়েছে রে মেজবৌ, ও এত কাঁদছে কেন?
মেজবৌ একটু চুপ করে থেকে বললে, দেখুন না, বাবা ওকে কি রকম মেরেছেন, দুটো গাল একেবারে লাল হয়ে উঠেছে। তারপর আবার একটু থেমে আপন মনেই বলে ছেলেকে, তুই যাস কেন দাদুর কাছে দাদু তোকে দু’চোখে দেখতে পারে না, জানিস ত?
মনোরমা প্রতিবাদ করে বলেন, ওকি কথা গা মেজবৌ, ওর সামনে ওসব বলতে আছে! ও বালক, ওর কি মনে হবে বল দেখি!
যা সত্যি তা আর কতদিন চেপে রাখব মা? ও বালক বলে কি এটুকু বোঝবার শক্তি ওর নেই? এখনো কি রকম ফোঁপাচ্ছে দেখুন না? বলতে বলতে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আবার গর্জে উঠলো, আমি বরাবর লক্ষ্য করেছি, বাবা একেবারে আমার ছেলেকে দেখতে পারেন না! কোন অন্যায় কোন দোষ কেউ করলে, তিনি আগে বলে ওঠেন, এ ঠিক সেই দুলোব্যাটার কাজ!!
ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে তখনি মনোরমা একেবারে মহেশবাবুর ঘরে নেমে গেলেন। তারপর বললেন, তুমি কেন দুলুকে অমন করে মেরেছো? দিন-দিন তোমার যেন ভীমরতি হচ্ছে!
মহেশবাবু স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, বারে, ওরা যা তা অসভ্যতা শিখবে, আর আমি চোখে দেখেও ওদের শাসন করতে পারবো না?
মনোরমা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলেন, না। এই আমার দিব্যি রইল, আজ থেকে যদি আর কোন ছেলের গায়ে হাত দিয়েছো, তাহ’লে হয় তুমি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে, নয় আমি!
এর ওপর আর কোন কথা বলতে না পেরে মহেশবাবু শুধু অস্ফুটস্বরে বললেন, বেশা। তোমাদের ভাল হোক, মন্দ হোক, কখনো সেদিকে আর আমি ফিরেও তাকাবো না। তবে এর ফল পাবে একদিন, মনে থাকে যেন। সেদিন আমি দেখতে আসবো না কিন্তু তখন বুড়োটার শাসনের কি মূল্য বুঝবে হাড়ে হাড়ে।
মহেশবাবু এর পর থেকে চুপ করেই থাকেন, কোন কথা কন না। নিজের ইজিচেয়ারটায় বসে গঙ্গড়ার নলটা মুখে দিয়ে ভুড়ুক ভুড়ুক আওয়াজ তুলতে তুলতে কখনো ঝিমোন, কখনো বা খবরের কাগজটা বুকের ওপর দিয়ে নাক ডাকাতে থাকেনা নলটা কিন্তু সব সময়ই তাঁর হাতে। ধরা থাকে—তাঁর জীবনের ঐ বুঝি শেষ সম্বল।
সেদিন চাকরটাকে ডেকে ডেকে তাঁর গলা ধরে গেল। ওরে হারা, কোথায় গেলি, তামাকটা দিয়ে যা—হারা–-ও হারা!
বার আষ্টেক-দশ ডেকেও কিন্তু ও তরফের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। এ ব্যাটার গায়েও এ বাড়ির হাওয়া লেগেছে দেখছি! বলে আবার একটু পরে তিনি হারা—ও হারা তামাক দিয়ে যা’ বলে বারকতক হাঁক পাড়লেনা তখনো হারাধনের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে স্টুষের আগুনের মত ভেতরে ভেতরে তিনি জ্বলতে লাগলেন ঘর থেকে বাইরে এবং বাইরে থেকে ঘরে বারকতক পায়চারি করে সবে ইজিচেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসেছেন এমন সময় হারাধন কলকে হাতে প্রবেশ করলো।
তাকে দেখেই মহেশবাবু একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, হারামজাদা, আমার ডাক কি তোর কানে যায় না! আমাকে মনিব বলে গ্রাহ্য করিস না—কে ডাকছে ত কে ডাকছে!
হারাধন কি বলতে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিলেন মহেশবাবু। বললেন, চোপরও বদমায়েশ কোথাকার, আবার মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা হচ্ছে। বেরোও, আভি নিকালো, এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে—এই মুহূর্তে আমার হুকুম!
চাকর গম্ভীর মুখে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল বটে তবে বাইরে নয়। একেবারে সোজা তেতলায় গিন্নীমার কাছে গিয়ে হাজির হলো। তার মুখ থেকে বাবুর হুকুমের কথা শুনে তখনি। দ্রুতপদে নেমে এলেন মনোরমা। তারপর স্বামীর ঘরে ঢুকে গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি নাকি হারাধনকে জবাব দিয়েছো বলেছে—এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে?
মহেশবাবুর রাগ তখনো কমেনি জোরালো স্বরে বললেন, হ্যাঁ, দিয়েছি ত, ওকে ভয় করবো নাকি? ব্যাটা চাকর, তার এতবড় আস্পদ্দা যে ডেকে ডেকে আমার গলা ধরে গেলেও তবু আমার কথার উত্তর দেয় না! মনিব বলে তার মনে এতটুকু ‘সমীহ’ নেই! এখনি ওর যা মাইনে বাকি আছে ওকে চুকিয়ে বিদেয় করে দাও—ও চলে যাক!
মনোরমা এবার চড়াস্বরে উত্তর দিলেন, তোমার হুকুম মেনে কাজ করতে গেলে ত আমার চলে না। বলি তোমার তামাক সাজবার জন্যে ত আর আমি চাকর রাখিনি। সকালবেলা তোমার তামাক সাজাটা আগে না বাসন-কোসন মাজাটা, তাই শুনি?ঠাকুরের ওদিকে উনুন জ্বলে যাচ্ছে, তাকে যোগাড় না দিলে ছেলে-মেয়েদেরই স্কুল-কলেজের, আপিস-আদালতের ভাত সময়ের মধ্যে হয় কি করে? বলি, এতটুকু আক্কেল-বিবেচনাও কি তোমার নেই? আমি বলে কতদিন ধরে সাধ্যিসাধনা করে জামাইবাবুকে খোশামোদ করে তাঁর কাছ থেকে এই চাকর আনিয়েছি—এখন তাকে না তাড়ালে তোমার বুঝি চলছে না? বলি ও চলে গেলে আমার সংসারের কাজগুলো কি তুমি করে দেবে?
একটা দুরন্ত রাগ ভেতরে ভেতরে চেপে নিয়ে মনোরমা বললেন, ফের যদি কোনদিন আমার চাকরের ওপর কোন মেজাজ করেছো ত তোমার একদিন কি আমার একদিন! উনি বাড়ির কর্তা —মনিব! শুধু বসে বসে তামাক খাওয়া ছাড়া আর কিছু বোঝেন না! অত যদি তামাক খাবার শখ ত নিজে সেজে খেতে পারো না? তারপর কতকটা স্বগতভাবেই বলে উঠলেন, এত বড় সংসারের কাজ করতে বলে দুটো লোক হিমসিম খেয়ে যায়—তাই একা ওই হারাধন হাসিমুখে করে দিচ্ছে, তা বুঝি তোমার সহ্য হচ্ছে না? এত যদি অসহ্য বোধ হয় ত অন্য কোথাও গিয়ে থাকো
গে! তোমার ওই মনিবগিরি এখানে ফলাতে এসোনা, তা আমি স্পষ্টই বলে দিচ্ছি! মনোরমা ঘর থেকে চলে যেতে চুপচাপ ইজিচেয়ারে শুয়ে মহেশবাবু ভাবতে থাকেন। তাঁর জীবনে কোথায় যেন কি একটা গোলমাল ঘটেছে। তা নাহলে একদিন এই বাড়ির চাকরবাকর থেকে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, মাছিমশা পর্যন্ত তাঁর হুকুমে উঠতো বসততা, অথচ আজ আর তারা কেউ তাঁকে মানে না কেন?