রজনী হলো উতলা

রজনী হলো উতলা
বুদ্ধদেব বসু

মেঘনার ঘোলা জল চিরে স্টিমার সামনের দিকে চলছে তার দু-পাশের জল উঠচে, পড়চে, দুলচে—তারপর ফেনা হয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্চে, জলকন্যার নগ্নদেহের মতো শুভ্র, দ্রাক্ষারসের মতো স্বচ্ছ। একদিকে তরুপল্লবের নিবিড় শ্যামলিমা, অন্যদিকে দূর দিগন্তরেখার অস্পষ্ট নীলিমা!

খুব জোরে বাতাস বইছে কোন দিক থেকে, ঠিক করতে পারছিনো এখানে-ওখানে ছোটো ছোটো নৌকাগুলি তীরবেগে ছুটে চলেছে ওরা সব পাল তুলে দিয়েছে—বাউলের গাত্রবাসের মতো নানা রঙের তালি-দেওয়া পাল। আমাদের স্টিমার এদের মধ্যে পরিচারিকা-বেষ্টিতা রানীর মতো চলছে, সামনের দিকে চলছে।

এইমাত্র সূর্য অস্ত গেলো। আমাদের সামনে পুব দিক—সন্ধ্যারানীর লাজনম্র রক্তাভ মায়াটুকু আমরা দেখতে পাচ্ছিনে—আমরা দেখছি খুব মস্ত এক টুকরো আকাশ কুয়াশার মতো অস্পষ্ট—তার রংটা ঠিক চেনা যাচ্ছে না—মনে হচ্ছে, কে যেন তার মুখ থেকে সমস্ত রঙের ছোপ মুছে নিয়েছে—অমন বিবর্ণ, বিশ্রী, ম্লান চেহারা আমাদের দেশে আকাশের বড়ো-একটা হয় না।

আমরা দুজন পাশাপাশি ডেক-চেয়ারে বসে আছি, কারো মুখে কথা নেই। ওদিকে হয়তো রঙের হোলিখেলা চলছে—কিন্তু আমাদের দিকে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নেমে এলো—নিখিল গগনব্যাপী এক নিষ্ঠুর নিশাচর পাখির ডানার মতো। নদীর ঘোলা রং কালো হয়ে উঠলো—বিবর্ণ আকাশের বুকে একটি তারার মণিকা ফুটে উঠলো।

আমি মুখ ফিরিয়ে ওর চোখের দিকে চাইলুম—আশ্চর্য! ওর চোখের কোনো রং আমি আজ অবধি ঠিক করতে পারলুম না। ও যেন ক্ষণে-ক্ষণে বদলায়! কখনো সন্ধ্যার এই ছায়াটুকুর মতো ধূসর, কখনো ঐ সুদুর তারকার মতো সবুজ, কখনো নদীর জলের মতো কালো, কখনো দিগন্তরেখার অপরূপ ভঙ্গিমার মতো নীলা

নীলিমা ফিক করে হেসে ফেললে, কী দেখছো?

আমি তার মাথাটি কাছে টেনে এনে তার ঐ মায়াময় চোখ দুটির উপর ঠোঁট রেখে নিঃশব্দে। জবাব দিলুম। নীলিমার চোখ দুটি অবশেষে মুদিত হয়ে এলো। আমি এই অবসরে তার সারা দেহের উপর একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে গেলুম। অপরূপ! বিশ্বশিল্পী তাঁর কত স্নেহ, কত সুধা, কত মমতা দিয়েই না এই নারীদেহ গড়েছেন! এ যেন একটি বীণা—তা আপনা-আপনি বাজে না—তাকে কোলে তুলে নিয়ে কোনো সুররসিক সুরসাধনা করবে, এই তার সার্থকতা। আমি আর পারলুম না সন্তর্পণে ওকে একেবারে বুকের কাছে টেনে তুলে নিয়ে বিপুল আবেগে জড়িয়ে ধরলুম।

নীলিমা আস্তে আস্তে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে তার চেয়ারটি আমার কাছে আরো একটু এগিয়ে এনে বললে তোমার সেই কথাটা বলবে না?

কোন কথাটা?

সেই যে একদিন বলেছিলে—মনে নেই?

এই উত্তেজনার ফলে তখনো সে একটু-একটু কাঁপছিলো। ওর বুক তীব্র নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে দুলছিলো—এক-একবার ফুলে-ফুলে উঠে ব্লাউজের নির্দিষ্ট বন্ধনের সীমা প্রায় অতিক্রম করে। যাচ্ছিলো—মনে হচ্ছিলো, যেন পাত্র বেয়ে সুরা উছলে পড়তে চাচ্ছে!

আমি অনিচ্ছাসত্বেও সেদিকে চোখ রেখে বললুম, হেঁ।

নীলিমা ছোটো মেয়ের মতো আবদারের সুরে বলে উঠলো, না গো!

হঠাৎ যেন আমার স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলো। আমি গলার সুরটা যথাসম্ভব সহজ করবার চেষ্টা ক’রে বললুম, আমার একটা অনুরোধ, নীলিমা—তুমি এই একটি কথা আমার কাছ থেকে কোনোদিন শুনতে চেয়োনা।

ওর তরল আঁখির করুণ কামনা একসঙ্গে মিনতি ও অভিযোগ জানালে

আমি পাশের একটা ইজি-চেয়ারের দিকে চেয়ে বললুম, আচ্ছা, বলছি। কিন্তু যখন বুঝবে, এ কথাটা তোমার না-শোনাই উচিত ছিলো, তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবে না।

নীলিমা মাথাটা একটু পেছন দিকে হেলিয়ে বললে, আহা—তোমায় আবার দোষ দেবো! তুমি যে আমার বর!

আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো বর বটে কিন্তু এখনো তো স্বামী হইনি! আমি এখন যা বলবো, তা শোনবার পর বর হবার সম্ভাবনাই লোপ পেতে পারে।

সেইজন্যেই তো আরো বেশি করে শুনতে চাচ্ছি।

* * * *

ছ-বছর আগে আমি যখন প্রথম কলকাতায় যাই, তখনো আমাদের সেখানে বাড়ি হয়নি। কাজে-কাজেই ভবানীপুরের এক ব্যারিস্টারের আতিথ্য স্বীকার করতে হ’লো। বাবার সঙ্গে ওঁদের পুরোনো বন্ধুত্ব ছিলো। নামও কি শোনা দরকার, নীলিমা?

নাম না হ’লে কি গল্প চলে?

অন্য কোনো গল্প না চলতে পারে, কিন্তু আমার এ গল্প চলবে।

আচ্ছা ব’লে যাও।

তখন গ্রীষ্মের ছুটি। কলেজ থেকে সবে আই.এ. পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমার বয়স কাঁচা দেহ-মনে সবে নব যৌবনের রং ধরেছে। পৃথিবীর অনেক কিছুই তখন আমার কাছে রহস্যময় আর তার মধ্যে সবচেয়ে রহস্য হলো—

নারী?

হ্যাঁ, নারী। মনে রেখো, নীলিমা, তখন আমার সেই বয়স, যে বয়সে একটুখানি শাড়ির আঁচল দেখলেই বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, একটু চুড়ির রিনিঝিনি শোনবার জন্যে মনটা যেন তৃষিত হয়ে থাকে—যে-বয়সে মানুষ অঙ্কশাস্ত্র ছেড়ে কাব্যচর্চা শুরু করে, ফিজিক্সের এক্সপেরিমেন্টের চেয়ে বায়োস্কোপের অভিনয় বেশি পছন্দ করে।

সত্যি কথা বলবো নীলিমা? তখন যখনই যেখানে কাঁচা বয়সের মেয়ে দেখতুম, ইচ্ছে হতো ছুটে গিয়ে ওকে আমার নিজের ঘরে টেনে নিয়ে আসি, তারপর—ওর সঙ্গে কথা কই, ওকে খুব আদর করি। আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে মেয়ে-ইস্কুলের গাড়ি আসা-যাওয়া করতো— কতদিন তাদের কারো সঙ্গে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় করবার ব্যর্থ চেষ্টা আমি করেছি। আমার মগজের মধ্যে তখন অহর্নিশ যে-সব চিন্তা ঘুরে বেড়াতো, তা শুনলে এখন নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে না।

আমার সেই সদ্যজাগ্রত প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে আমি সে-বাড়িতে গিয়ে একেবারে অগাধ জলে পড়ে গেলুম। বাবার বন্ধুটি তিন পুরুষ যাবৎ সাহেবি চালে থাকেন—তাঁর বাড়ির সব কায়দাকানুন, রীতি-নীতি আমার জন্মগত সংস্কারে কেমন বিসদৃশ ঠেকতে লাগলো। হাজার হোক, খাঁটি ব্রাহ্মণের ছেলে তো আমি! প্রথম-প্রথম দু-চারদিন চলতে-ফিরতে পদে পদে এমন অসোয়াস্তি বোধ হতে লাগলো, যেন আমি জলের মাছ ডাঙায় উঠে এসেছি। তারপর ক্রমেক্রমে সবই এমন স’য়ে গেলো, যেন আমি জন্মাবধি এই আবহাওয়াতেই বেড়ে উঠেছি। সত্যের খাতিরে বলতে হচ্ছে, দিনগুলো দিব্যি সুখেই কাটছিলো।

আমি হঠাৎ চুপ করে গেলুম। নদীর জল আর দেখা যাচ্ছে না—রাত্রির কালোয় সব কালো হয়ে গেছে। পুবের আকাশে যেখানে ছোটো মণিকাটি জ্বলছিলো, সেখানে অনেক তারা দেখা দিয়েছে ওরা বুঝি অমরাবতীর দুয়ারে জ্যোতির্ময়ী ঊষার ললাটের শিশিরবিন্দু! ডেকের উপর ইলেকট্রিক আলোগুলো দুলছে। নীলিমার কণ্ঠ শুনতে পেলুম ব’লে যাও না! চুপ করে রইলে কেন?

আমি তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না, নীলিমা একটু আলোতে এসোনা! অন্ধকারে মুখ ঢেকে আছো কেন?

নীলিমা আমার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে কোমল সুরে বললে, এই যে আমি আমি তো দূরে সরে যাইনি। তুমি হাত বাড়ালেই যে আমায় ছুঁতে পাও।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। মনে হলো, যেন আমি জলের নিচে ডুবে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ উঠে এসে আবার নিশ্বাসের সঙ্গে বাতাসের অমৃত সেবন করছি। চেয়ারের হাতলের উপর ঝুঁকে পড়ে তার মুখের অত্যন্ত কাছে মুখ নিয়ে বললুম, আঃ এই যে তুমি নীলিমা! এত কাছে! আমি তোমার কেশের সৌরভ পাচ্ছি, তোমার নীল চোখ দুটির মধ্যে আমার নিজেরে চোখের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। আমার আর ভয় নাই—আঃ নীলিমা, তুমি কত সুন্দর!

নীলিমা শান্তকণ্ঠে বললে, তারপর, কী হ’লো?

দম-দেওয়া গ্রামোফোনের মতো আমি হঠাৎ অস্বাভাবিক উত্তেজনার সহিত বলতে লাগলুম— ও-বাড়ি তো বাড়ি নয়—যেন রূপের মেলা! যেন ফুলের বাগান! তাতে কত ফুল ফুটে রয়েছে— তারা রূপের জৌলুসে চাঁদনি রাতকে হার মানিয়ে দেয়, সৌরভের মাদকতায় বাতাসকে মাতাল করে তোলো বলেইছি তো, আমার সেই সদ্যজাগ্রত অসীম তৃষ্ণা নিয়ে আমি তাদের মধ্যে গিয়ে পড়লুম। প’ড়ে হঠাৎ যেন জীবন-সূত্রের খেই হারিয়ে ফেললুম।

গৃহস্বামীর নিজের সাতটি মেয়ে, তার মধ্যে তিনটি বিবাহযোগ্যা। তাছাড়া, তাঁর দূর সম্পর্কিত নবযৌবনা আত্মীয়ার সংখ্যাও কম নয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে মোট সংখ্যা বোধহয় বারো কি তেরোতে পৌঁছেছিলো। তখন রোজই একবার ক’রে শুনতুম, তবু ঠিক সংখ্যাটা এখন আর মনে নেই।

এই মেয়ের দল আমাকে নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলতে লাগলো। অনায়াসে নাচিয়ে বেড়ানোর পক্ষে আমার মতো অমন সুপাত্র বোধহয় তখন পর্যন্ত পায়নি। তাছাড়া আমার বাপের টাকা আছে, নিজের চেহারাটাও নেহাৎ মন্দ নয়—কেউ-কেউ যে আমার সম্বন্ধে কোনো বিশেষ অভিপ্রায় পোষণ না করতেন, এমনও মনে হয় না। মাঝে-মাঝে চাউনির বিজলি হেনে তাঁরা সে-কথাটা আমায় জানিয়ে দিতেও ছাড়তেন না। ওদের লীলাচাতুরী, কলা-ছল-ছলনাই বা কত ছিলো! কথা কইবার সময় মুখটাকে খামকা খুব কাছে এনে হঠাৎ সরিয়ে নেওয়া, চলতে চলতে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে চাবির গোছা দুলিয়ে আমার গায়ে ছোট্ট চড় মারা, ড্রেসিং রুম থেকে চুল বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎ দরজার আড়াল থেকে আমায় ডেকে নিয়ে কানে-কানে একটা নেহাৎ অর্থহীন কথা বলে চট করে সরে যাওয়া—এ-সব তো ছিলো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সন্ধান যে একটিরও ব্যর্থ হয় নি, তা আমি স্বীকার করবো। এদের কৌতুকলীলার মধ্যে পড়ে আমি যেন একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলুম—কী যে হচ্ছে তা ঠিক ভালোমতো বোঝবার চেষ্টাও করলুম না। সে উদ্দাম বন্যায় নিজেকে একেবারে নিঃসহায় ক’রে ভাসিয়ে দিলুম। কী করবো বলো? তখন তো আমার নিজের ওপরে কোনো হাত ছিলো না।

গলার স্বর হঠাৎ নামিয়ে ফেলে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলুম, আরো শুনতে চাও?

নীলিমা রুদ্ধস্বরে জবাব দিলো—চাই।

আমার কলকাতায় আসবার পর দিনকতক কেটে গেছে। একদিন রাত্রে খুব আস্তে আস্তে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। খুব আস্তে আস্তে কী রকম জানো? মধ্যরাতে দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ যেমন ধড়ফড় ক’রে জেগে উঠে খুব জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, সে-রকম নয়। ভোরবেলা শোবার ঘরে কেউ কথা বললে বা চলাফেরা করলে যেমন তা প্রথম স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যায়—তারপর ধীরে ধীরে বাস্তব হয়ে উঠে মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে যায়—সে জেগে উঠে চুপি চুপি হেসে নিয়ে আবার চোখ বুজে পাশ ফিরে শোয়, অনেকটা সেই রকম খুব আস্তে আস্তে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি চোখ মেলে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালুম—তাকাতেই মনে হ’লো। —

মনে হলো, প্রকৃতি চলতে-চলতে যেন হঠাৎ এক জায়গায় এসে থেমে গেছে—যেন উৎসুক আগ্রহে কার প্রতীক্ষা করছে। নাটকের প্রথম অঙ্কের যবনিকা উঠবার আগমুহূর্তে দর্শকরা কেমন হঠাৎ স্থির, নিঃশব্দ হয়ে যায়, সমস্ত প্রকৃতিও যেন এক নিমেষে সেইরূপ নিঃসাড় হয়ে গেছে। তারাগুলো আর ঝিকিমিকি খেলচে না, গাছের পাতা আর কাঁপচে না, রাত্রে যে-সমস্ত অদ্ভুত অকারণ শব্দ চারদিক থেকে আসতে থাকে, তা যেন কার ইঙ্গিতে মৌন হয়ে গেছে, নীল আকাশের বুকে জ্যোছনা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে—এমনকি, বাতাসও যেন আর চলতে না-পেরে ক্লান্ত পশুর মতো নিস্পন্দ হয়ে গেছে—ওঃ নীলিমা, অমন সুন্দর, অমন মধুর, অমন ভীষণ নীরবতা, অমন উৎকট শান্তি আর আমি দেখিনি। আমি নিজের অজানিতে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলুম—কেউ আসবে বুঝি?

অমনি আমার ঘরের পর্দা সরে গেল। ঘরের বাতাস মূর্ভূিত হয়ে পড়লো, আমার শিয়রের উপর যে-একটু চাঁদের আলো পড়েছিলো, তা যেন একটু নড়ে-চড়ে সহসা নিবে গেলো—আমার সমস্ত দেহ-মন এক স্নিগ্ধ অবসাদে শ্লথ হয়ে এলো—আমি যেন কিছু দেখছি না, শুনছি না, ভাবছি না—এক তীব্র মাদকতার ঢেউ এসে আমাকে ঝড়ের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো—তারপর—

নীলিমা, তোমার মুখ অমন শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? তোমার চুলের ফুলটি যে মাটিতে লুটোচ্ছে! তোমার আঁচল যে ধুলোয় খসে পড়েচে! নীলিমা–

তারপর? আজ এতদিন পর সবই কোমল স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। যেন অনেক দিন আগে দেখা স্বপ্ন হাজার বছর, লক্ষ বছর আগেকার—গত জন্মের স্মৃতি! আমার কি তখন চৈতন্য ছিলো? আমি কি তখন পরিষ্কারভাবে সব বুঝতে পেরেছিলুম? কী জানি! কিন্তু আজকে কিছুই সত্য বলে মনে হচ্ছে না—সব আবছায়া, বাসি ফুলের মতো ম্লান, অপূর্ণ চোখে দেখা জিনিসের মতো ঝাপসা!

হ্যাঁ—তারপর হঠাৎ আমার মুখের উপর কী কতগুলো খশখশে জিনিস এসে পড়লো—তার গন্ধে আমার সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম ক’র উঠলো। প্রজাপতির ডানার মতো কোমল দুটি গাল, গোলাপের পাপড়ির মতো দুটি ঠোঁট, চিবুকটি কী কমনীয় হয়ে নেমে এসেছে, চারুকণ্ঠটি কী মনোরম, অশোকগুচ্ছের মতো নমনীয়, স্নিগ্ধ শীতল দুটি বক্ষ কী সে উত্তেজনা, কী সর্বনাশা সেই সুখ, তা তুমি বুঝবে না, নীলিমা।

তারপর ধীরে ধীরে দু-খানি বাহু লতার মতো আমায় বেষ্টন করে যেন নিজেকে পিষে চূর্ণ। ক’রে ফেলতে লাগলো আমার সারা দেহ থেকে থেকে কেঁপে উঠতে লাগলো—মনে হ’লো আমার দেহের প্রতি শিরা বিদীর্ণ ক’রে রক্তের স্রোত বুঝি এখুনি ছুটতে থাকবে!

বিপুল উত্তেজনার পর যে-অবসাদ আসে, তার মতো ক্লান্তিকর বোধহয় জগতে আর-কিছু নেই। বাহুবন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো।

সত্যি বলছি, তখন আমার মুহূর্তের তরেও মনে হয় নি যে, এ-ঘটনার মধ্যে কিছু আশ্চর্য বা। অস্বাভাবিক আছে বা থাকতে পারে আমারও মনের মধ্যে তখন কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠলো— এ কে? কোনটি? এ ও না সে? তখন নামগুলো জপমলার মতো মনে-মনে আউড়ে গেছলুম, কিন্তু আজ একটি নামও মনে নেই। সুইচ টিপবার জন্য হাত বাড়াতেই আরেকটি হাতের নিষেধ তার উপর এসে পড়লো। আমার কণ্ঠের জড়তা কেটে গিয়েছিলো—বেশ সহজভাবেই বললুম— তোমার মুখ কি দেখাবে না?

চাপা গলায় উত্তর এলো—তার দরকার নেই।

কিন্তু ইচ্ছে করচে যে!

তোমার ইচ্ছে মেটাবার জন্যেই তো আমার সৃষ্টি! কিন্তু ঐটি বাদে!

কেন? লজ্জা?

লজ্জা কিসের? আমি তো তোমার কাছে আমার সমস্ত লজ্জা খুইয়ে দিয়েছি।

পরিচয় দিতে চাও না?

না, পরিচয়ের আড়ালে এ-রহস্যটুকু ঘন হয়ে উঠুক।

আমার বিছানায় তো চাঁদের আলো এসে পড়েছিলো—

আমি জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।

ও, কিন্তু আবার তো খুলে দেওয়া যায়।

তার আগে আমি ছুটে পালাবো।

যদি ধ’রে রাখি?

পারবে না।

জোর?

জোর খাটবে না।

একটু হাসির আওয়াজ এলো। শীর্ণ নদীর জল যেন একটুখানি কূলের মাটি ছুঁয়ে গেলো।

তুমি যেটুকু পেয়েছে, তা নিয়ে কি তুমি তৃপ্ত নও?

যা চেয়ে নিইনি, অর্জন করিনি, দৈবাৎ আশাতীতরূপে পেয়ে গেছি, তা নিয়ে তো তৃপ্তি-অতৃপ্তির কথা ওঠে না।

তবু?

তোমার মুখ দেখতে পাওয়ার আশা কি একেবারেই বৃথা?

নারীর মুখ কি শুধু দেখবার জন্যেই?

না, তা হবে কেন? তা যে অফুরন্ত সুধার আধার!

তবে?

আমি হার মানলুম।

আমি আবার দু-হাত বাড়িয়ে ওর লতায়মান দেহটি সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে লাগলুম নিঃশব্দে ও আমার বুকের উপর এলিয়ে পড়লো।

আমাদের মাথার উপরে কোথায় যেন চাঁদ উঠেছে। নদীর কালো বুক হলদে হয়ে উঠেছে— এখানে-ওখানে রূপোর ছিটা। নীলিমা বুকে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। ও কি আমার সমস্ত কথা শুনেছে! ওর ঠোঁট দুটি পাপড়ির মতো শুকিয়ে গেছে। ও আমার পানে অমন করে তাকিয়ে আছে কেন? কী যেন বলতে চায়, অথচ বলতে পারছে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছে। না জানি ও কী ব’লে বসে! জলেতে জ্যোছনায় মিলে যেখানে ছুটোছুটি করছে সেই দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালুম। ধোঁয়াগুলো উঠছে, নীল, মসৃণ, সরু রেখার মতো স্টিমারটা কী বিশ্রী শব্দ করছে! ও কি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে? কোনোখানেই কি থামবে না?নীলিমার মুখখানা যে মরুভূমির উপরকার আকাশের মতো শুষ্ক হয়ে উঠছে।

নীলিমা বললো, এইখানেই কি তোমার গল্প শেষ হলো?

মাস্টারের কাছে ছাত্রের পড়া-বলার মতো ক’রে জবাব দিলুমনা, এইখানে সবে শুরু হ’লো। কিন্তু এর শেষেও কিছু নেই—এই শেষ ধরতে পারো।

নীলিমা আর কিছু বললে না। আমি ব’লে যেতে লাগলুম—সেইভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। জেগে দেখি, বিছানার উপর রোদ এসে পড়েছে। সমস্ত বালিশে, চাদরে সারা বিছানায় গত রজনীর তার গায়ের সৌরভটুকু প্রিয় স্মৃতির মতো লেগে রয়েছে।

পরের দিন সকালে আমার কী লাঞ্ছনাটাই না হ’লো! রোজকার মতো ওরা সব চারদিক দিয়ে আমায় ঘিরে বসলো—রোজকার মতো ওদের কথার স্রোত বইতে লাগলো জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি সুরে, ওদের হাসির রোল ঘরের শান্ত হাওয়াকে আকুল ক’রে ছুটতে লাগলো, হাত নাড়বার সময় ওদের বালা চুড়ির মিঠে আওয়াজ রোজকার মতোই বেজে উঠলো—সবাকার মুখই ফুলের মতো রূপময়, মধুর মতো লোভনীয়। কিন্তু আমার কণ্ঠ মৌন, হাসির উৎস অবরুদ্ধ। গত রাত্রির পাগলামির চিহ্ন আমার মুখে, আমার চোখের কোণে লেগে রয়েছে মনে করে আমি চোখ তুলে কারো পানে তাকাতেও পারছিলুম না। তবু একবার লুকিয়ে প্রত্যেকের মুখ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলুম—যদিও বা ধরা যায়! যখন যাকে দেখি, তখনই মনে হয়, এই বুঝি সেই। যখনই যার। গলার স্বর শুনি, তখনই মনে হয় কাল রাত্রিতে এই কণ্ঠই না ফিসফিস করে আমায় কত কী বলছিলো! অথচ কারো মধ্যেই এমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখলুম না, যা দেখে নিশ্চিতরূপে কিছু বলা যায়! সবাই হাসছে, গল্প করছে। কে? কে তাহ’লে? আমি কি স্বপ্ন দেখছিলুম? তখন স্বপ্ন ব’লে সত্যি-সত্যি বিশ্বাস করতে পারতুম, যদি না তখনও আমার সর্বাঙ্গে একটা গভীর অবসাদ অপ্রকাশ্য বেদনার মতো জড়িয়ে থাকতো।

আমার অবস্থা দেখে একজন বলে উঠলেন, আপনার কাল রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি নাকি?

আর-এক জন বললেন, তাই তো! আপনার চেহারা যে ভারি শুকনো দেখাচ্ছে!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো আমি তাড়াতাড়ি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলুম। এই তো সুযোগ এ-সময়ে কারো মুখ যদি একটু শুকিয়ে যায় বা একটু লাল হয়ে ওঠে যদি কেউ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বা একটু বিশেষভাবে হাসতে থাকে, তাহ’লেই তো আর বুঝবার কিছু বাকি থাকে। না। কিন্তু সবাই ঠিক একভাবে ঠোঁটের এক কোণে একটু হাসচে—কাউকে আলাদা করে নেবার জো নেই। আমার মনে হলো, ওরা সবাই যেন আমার গোপন রহস্য জেনে ফেলেছে, যেন সবাই মিলে পরামর্শ করে আমায় নিয়ে একটু রসিকতা করছে। কিন্তু এ কোন ধারা রসিকতা? আমি কি একটা খেলবার পুতুলনা, কি? তারপর প্রত্যেকের প্রত্যেকটি চাউনি, প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেক অঙ্গভঙ্গি আমার এই সন্দেহকে দৃঢ় হ’তে দৃঢ়তর করে তুললো—ঘরের মধ্যে অসহ্য গরম বোধ। হ’লো, আমি অভদ্রের মতো কাউকে কিছু না বলে ছুটে বাগানে চলে গেলুম—একটু খোলা হাওয়ায় থাকবার জন্য।

দুপুর পর্যন্ত আমার সময়টা যে কী ভাবে কেটে গেলো, তা আর মনে করতে ইচ্ছে করছে না। রাস্কলনিকফ বোধহয় খুনী হয়েও এমন দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেনি উঠতে-বসতে, চলতে ফিরতে আমার গায়ে সর্বদা যেন কাঁটা ফুটতে লাগলো কারো সঙ্গে কথা কইতে পারলুম না— যখনই যে কাছে আসে, মনে হয়, এই বুঝি সে!

প্রত্যেকের সম্বন্ধেই সন্দেহ অন্যের চেয়ে দৃঢ়তর হয়ে ওঠো আমার ঘরের মধ্যেও থাকতে পারিনো মেঝের কার্পেট থেকে দেওয়ালের চুনকাম পর্যন্ত সব যেন আমার দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর হাসি হাসতে থাকে—অথচ সবাকার দৃষ্টি হ’তে নিজেকে লুকিয়ে রাখাও তো চাই। কাজের অছিলা ক’রে সারাটা দিন কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলুম।

কিন্তু দুপুরের পর থেকে আর-এক নতুন সংশয় আরম্ভ হ’লো। আজ রাত্রেও কি সে আসবে? আমার মধ্যে যা-কিছু ভদ্র ও মার্জিত ছিলো, সমস্ত একযোগে বলে উঠলোনা, আর আসবে না। আঃ বাঁচা গেলো! আমার আহত দর্প বললে,যাক, অপমান থেকে রেহাই পেলুম। কিন্তু আমার পিতৃপুরুষের রক্ত অস্থির হয়ে বলতে লাগলো না, আসবে, আসবে, নিশ্চয়ই আসবে। যাও ফেরো বাসায় ফেরো।

আমার মন ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করলে—না, যাবো না নীলিমা, তুমি আমার অস্তিত্ব বিশ্বাস করো? Jane Eyre বহু দূরে থেকেও তার প্রিয়তমের আকুল আহ্বান শুনতে পেয়েছিলো, এ তুমি সম্ভব মনে করো?…এখন অবশ্য আমিও করি না–কিন্তু তখন–তখন আমার বাস্তবিক মনে হয়েছিলো, সমস্ত ইট-পাটকেলের বেড়া যেন স্বচ্ছ হয়ে গেছে—আমি তার ভিতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, কে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকচে, রাস্তার সমস্ত কোলাহল ছাপিয়ে একটি ক্ষীণ, মধুর আহ্বান আমার কানে ভেসে আসলো—সে কী অদ্ভুত, কী বিপুল, কী ভয়ানক, নীলিমা, তা মনে ক’রে এখনো আমার বুক কেঁপে উঠছে। আমি ছুটে গেলুম–দিনের আলো নিভে যাবার আগে ছুটে গিয়ে গেলুম আমার সেই ধরে—সে-আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলুম না, নীলিমা।

আমার কণ্ঠস্বর হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে এলো। নীলিমার মুখের পানে তাকাতে সাহস হচ্ছে না—ইচ্ছে ক’রে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সোজা সামনের দিক থেকে বাতাস আসছে, আমার চুল উড়ে-উড়ে কপালে এসে পড়ছে নীলিমার শাড়িও বোধ হয় নড়ছে—দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি। ও চেয়ারের দুই হাতলে হাত রেখে স্থির হয়ে বসে আছে নিশ্বাস পড়চে না, চোখের পলক নড়ছে না। স্টিমারের গতি বোধহয় ঘুরে গেছে—একাদশীর চাঁদের আধখানা আমার চোখে পড়ছে, কামধেনুর স্বর্ণশৃঙ্গের মতো। ডাইনিং সেলুনে ব’সে সাহেব-মেমগুলি ডিনার খাচ্ছে—মদের বোতল খোলার শব্দ, সোডার বোতল ভাঙার শব্দ, কাঁটা চামচে প্লেটের শব্দ, ভাঙা-ভাঙা কথাবার্তার টুকরো—সব ভেসে আসছে—সব কান পেতে শুনচি। নীলিমা স্টিমারে ডিনার খেতে ভারি ভালোবাসে—ওকে কি জিজ্ঞেস করবো? কী জানি! আঘাত যা দেবার, তা তো দিলুম, এখন কি অপমানেরও কিছু বাকি রাখবো না? অথচ আজকেই সূর্য অস্ত যাবার আগে ওকে বলছিলুম, নীলিমা, তোমার মতো কাউকে কখনো ভালোবাসিনি।

অনেক দূরে দিগন্তরেখার কোলে কিসের একটা আলো জ্বলে উঠলো। আর-একটা। আর একটা পাঁচ নয়—তেরো—আর গুনতে পারছি না। কিসের এত আলো! অতলশায়ী বাসুকীদেব কি আজ চিরন্তন শয্যাতল ছেড়ে তাঁর সহস্র মাথায় সস্র মণি জ্বালিয়ে উঠে এলেন? না, এ বুঝি গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটের আলো! স্টিমারের গতিও কমে আসছে—আমরা যে প্রায় এসে পড়লুম। আর তো সময় নেই।

অকস্মাৎ ক্ষিপ্তের মতো ব’লে উঠলুম-নীলিমা, এতখানি যখন শুনলে, তখন দয়া করে বাকিটুকুও শুনবে না কি? এইটুকু দয়া আমায় করো, নীলিমা। বাকিটুকু না বলতে পারলে আমি পাগল হয়ে যাবো।

–বলো।

চমকে উঠলুম। এ-কণ্ঠস্বর যে একেবারে অপরিচিত। এ কি নীলিমার?

ভেবেছিলুম, সমস্ত রাত জেগে থাকতে হবে। মনের সে-অবস্থায় সচরাচর ঘুম আসে না। কিন্তু অত্যন্ত মানসিক উত্তেজনার ফলেই হোক বা পায়ে হেঁটে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর দরুন শারীরিক ক্লান্তিবশতই হোক, সন্ধ্যার একটু পরেই ঘুমে আমার সারা দেহ ভেঙে গেলো—একেবারে নবজাত শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়লুম। তারপর আবার আস্তে আস্তে ঘুম ভেঙে গেলো—আবার প্রকৃতির সেই স্থির, প্রতীক্ষমাণ, নিষ্কম্প অবস্থা দেখতে পেলুম—আবার আমার ঘরের পর্দা স’রে গেলো-বাতাস সৌরভে মুর্ভূিত হয়ে পড়লো—জ্যোছনা নিভে গেলো—আবার দেহের অণুতে-অণুতে সেই স্পর্শসুখের উন্মাদনা—সেই মধুময় আবেশ—সে ঠোঁটের উপর ঠোঁট ক্ষইয়ে ফেলা–সেই বুকের উপর বুক ভেঙে দেওয়া—তারপর সেই স্নিগ্ধ অবসাদ—সেই গোপন প্রেমগুঞ্জন —তারপর ভোরবেলার শূন্য বিছানায় জেগে উঠে প্রভাতের আলোর সাথে দৃষ্টিবিনিময়!

আবার দুপুর পর্যন্ত এই রহস্যময়ী গোপনচারিণীর পরিচয় জানবার অদম্য লালসা আমাকে যেন টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতো—তারপর, বিকেল হ’তেই সেই নিষ্ঠুর কামনা, সেই অলঙ্নীয় আহ্বান, সেই অপরাজেয় আকর্ষণ! দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটতে লাগলো। এর মধ্যে আমার চেহারা এত বদলে গেলো যে আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আমি চমকে উঠতে লাগলুম। দেহের সে লাবণ্য শুকিয়ে গেছে, সে স্নিগ্ধ শ্রী ঝরে পড়ে গেছে। কিন্তু তখন আমার স্বভাবত শান্ত চোখ দুটি নিরন্তর কোন উত্তট তৃষ্ণায় হিংস্র পশুর মতো ধকধক ক’রে জ্বলতো। সে-ভীষণ চাউনি মনে হ’লে এখনো আমার গা শিউরে ওঠো।

ক্রমে আমার এমন অবস্থা হলো যে আমার সমস্ত সত্তা রাত্রির সেই অল্প সময়টুকুর মধ্যে বন্দী হয়ে পড়লো—কেবল ঐটুকু সময়ের জন্য আমি প্রাণ পেয়ে বেঁচে উঠতুম, অন্য সব সময় আমার অস্তিত্বের কোনো লক্ষণ আমি নিজে পেতুম না। সে সময় কে আমার সম্বন্ধে কী ভাবছে, কী বলছে, ও-সব কথা আমার মনের ধার দিয়েও আসতো না—আমাকে যেন সারাদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। আমার মনের সমস্ত চিন্তা, প্রাণের সমস্ত আবেগ, দেহের সমস্ত বৃত্তি ঐ একটি বাঞ্ছিত মুহূর্তের প্রতীক্ষায় একেবারে নিশ্চল হয়ে যেতো—ঐ একটি মুহূর্তের মধ্যে যেন অনন্তকাল বাঁধা পড়েছে—ওরই মধ্যে যেন বিশ্বজগতের ছায়া! ওর বাইরে সময় নেই, জগৎ নেই, আকাশ নেই, বাতাস নেই, প্রাণ নেই, মৃত্যু নেই, সুখ-দুঃখ কিছু নেই, শূন্যও নেই! রহস্যময়ীর রহস্য মোচন করবার জন্যে মনের যে কৌতূহল একটা স্বাধীন চিন্তার রূপে, অস্তিত্বের একটু ক্ষীণ সাড়ার মতো আমার মধ্যে ঝিলমিল করছিলো—তা-ও মিলিয়ে গেলো—সে-কৌতূহলও আর রইলো না। — এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে যে তখন নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলুম—এ-ও যদি পাগলামি না হয়, তবে আর পাগলামি কী?

এই উন্মত্ত লীলা কতদিন চলেছিলো মনে নেই, কিন্তু কী ক’রে হঠাৎ একদিন চিরতরে থেমে গেলো, তা বলছি। সে-রাত্রে শোবার ঘরে ঢুকবার সময় চৌকাঠে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলুম— সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো—মধুর অন্ধকার নিবিড় হয়ে এলো ক্লান্তি নীলিমা—অসম্ভব ক্লান্তি! বিছানায় উঠে যেতেও যেন ক্ষমতায় কুলোলো না। সেই কার্পেটের উপর মাথা রেখেই আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লুম। সে রাত্রে আর ঘুম ভাঙেনি।

দেশে ফিরে এসে শুনলুম, সে-রাত্রে আমার কপাল ফেটে রক্ত পড়ে কার্পেট ভিজে গিয়েছিলো, ঐ অজ্ঞান অবস্থায় দু-দিন ছিলুম সারাক্ষণ এত দুর্বল ছিলুম যে, ডাক্তাররা আশঙ্কা করছিলেন যে-কোন সময়ে আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমার জ্ঞান হারানোর জন্যও নাকি ভয়ানক শারীরিক দুর্বলতা আংশিকরূপে দায়ী। তাছাড়া মানসিক উত্তেজনা ও স্নায়বিক দৌর্বল্য মিলে আমার শরীরকে নাকি এমনভাবে ভেঙে দিয়ে গিয়েছিলো যে, আর একটু হ’লেই একেবারে হাড়গোড়সুদ্ধ চুরমার হয়ে যেতুমা

ধীরে ধীরে সেরে উঠলুম। মনটা যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো, তখন সেই অপরিচিতাকে জানবার জন্য সহস্র চেষ্টা করতে গেলুম, কিন্তু সমস্ত ছল, সমস্ত কৌশলই ব্যর্থ হ’লো। কিছুতেই কোনো দিশে করতে পারলুম না। আজ পর্যন্ত পারিনি

তারপর—স্টিমারটা বিকট স্বরে শিঙা বাজিয়ে উঠলো। আমার আর বলা হলো না।

গোয়ালন্দ এসে পড়েছে। অতি সংকীর্ণ জলপথের মধ্য দিয়ে আমাদের স্টিমারখানা খুব সাবধানে আপনাকে বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে চলছে। একটা বিশাল ফ্ল্যাট সামনে এসে পড়েছে, ঝনঝন কড় কড় ক’রে নোঙর নেমে যাচ্ছে, ভসভস ক’রে রাশি রাশি বাষ্প বেরুচ্ছে—এতখানি পথ নিরাপদে অতিক্রম করে এসে স্টিমারটা যেন তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলেছে—সঙ্গে-সঙ্গে একটু একটু দুলছে, আমাদেরও দোলাচ্ছে। ঘটঘট ক’রে সিঁড়ি ফেলা হচ্ছে, খালাসিরা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, কুলিরা দুঃসাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অনিশ্চিত সিঁড়ি ডিঙিয়ে দুড়দুড় করে উপরে উঠে ‘ফাস্টো কেলাসে’র মাল নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করচে, থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা ব্যাগ হাতে করে প্রতীক্ষা করছে—আমাদেরও নাবতে হবে তো! এখানে অসংখ্য স্টিমার ফ্ল্যাটের ব্যুহ ভেদ করে চাঁদের আলো ঢুকতে পারছে না। গ্যাসের আলোয় নদীর কালো জল আগুনের মতো জ্বলছে—ডাঙায় রেলগাড়ির সিংহনাদ শোনা যাচ্ছে—উঃ কী ভীষণ গণ্ডগোল হচ্ছে চারদিকে থেকে!

এতক্ষণে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলুম। দুটো কুলি ডেকে ওদের মাথায় জিনিসপত্তরগুলো চাপিয়ে দিয়ে ওদের আগে পাঠিয়ে দিলুমা তারপর নীলিমার একটু কাছে সরে এসে বললুম, ‘গাড়ি ছাড়বার আর পনেরো মিনিট বাকি। এ-গাড়িতে চাপলে কাল ভোর নাগাদ পৌঁছবো। কাল বুধবার। রবিবার তারিখ ফেলা হয়েছে। মাসের তিনটে দিন হাতে থাকো তুমি আজ ছাড়বার সময় যে-কথা বলেছিলে, এখনো কি সেই কথা বলছো?

নীলিমার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, কিন্তু কী বললে, শুনতে পেলুম না। ঠিক সেই মুহূর্তেই স্টিমারের বাঁশিটা অসম্ভব জোরে চীকার ক’রে উঠলো নীলিমার মুখের ওপর স্টিমারের চোঙাটার ছায়া পড়েছিলো।

আমি নীলিমার হাত ধরে সেই অন্ধকারের তলা থেকে সরিয়ে নিয়ে এলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *