বীর্যশুল্কা

বীর্যশুল্কা
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজকুমারী সুমিত্রার আর কিছুতেই বর পছন্দ হয় না। দেশ-দেশান্তর থেকে রাজারা লিপি পাঠান–রাজকন্যার পাণিপ্রার্থনা জানিয়ে কিন্তু লিপি গ্রাহ্য হয় না। রাজদূত নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।

সুন্দরকান্তি রাজপুত্রেরা আসেন রাজকন্যার প্রাসাদের সুমুখে ঘোড়ায় চড়ে ঘোরাঘুরি করেন। তাঁদের কোমরে রত্নখচিত অসি ঝলমল করে, কিরীটের হীরা সূর্যকিরণে ঝকমক করে। কিন্তু কুমারী সুমিত্রার মন টলে না। তিনি সখীদের ডেকে বাতায়ন থেকে আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘সখি, দ্যাখ দ্যাখ, কতগুলো মোমের পুতুল ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! সূর্যের তাপে গলে যাচ্ছে না কেন এই আশ্চর্য!’ এই বলে কোকিলকণ্ঠে হেসে ওঠেন। রাজপুত্রেরা তাঁর হাসি, কথা শুনতে পান তাঁদের মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।

আর্যাবর্তময়—দক্ষিণে অবন্তীরাজ্য থেকে পূর্বে কাশী-কোশল পর্যন্ত রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে, তক্ষশীলার শক রাজকুমারী যেমন অপরূপ সুন্দরী তেমনি গর্বিতা। তাঁর রূপ-লাবণ্য দেখে যাঁরা তাঁকে বিয়ে করতে আসেন, তাঁর দর্পের কাছে পরাভূত হয়ে তাঁরা ফিরে যান, আর্যাবর্তের কোনও রাজা বা রাজপুত্রকে তাঁর মনে ধরে না।

সুমিত্রার বাবা রুদ্রপ্রতাপ তক্ষশীলার রাজা–রুদ্রের মতই তাঁর প্রতাপ। তিনি শক-বংশীয়। শক বংশের অনেক ক্ষত্ৰপ তখন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে রাজত্ব করছিলেন বহুকাল আর্যাবর্তে থাকার ফলে তাঁরা অনেকটা আর্যভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু শক-রক্তের প্রভাব সম্পূর্ণ মুছে যায়নি শক নারীরা তখনও তরোয়াল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে ভালবাসত, অশ্বচালনায় পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতা রাজকুমারী সুমিত্রা ছিলেন সেই জাতের মেয়ে যেমন রূপসী তেমনি তেজস্বিনী।

রাজা রুদ্রপ্রতাপ যখন দেখলেন কোনও বরই মেয়ের পছন্দ হয় না তখন তিনি মেয়েকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোর আঠারো বছর বয়স হল তুই কি বিয়ে করবি না? স্বয়ংবর-সভা ডাকব?

সুমিত্রা মাথা নেড়ে বললেন, টনা, স্বয়ংবর-সভায় তো কেবল রাজা আর রাজপুত্রেরা আসবে। তাদের আমি দেখেছি—তারা সব ননীর পুতুল। তাদের কারুর গলায় আমি মালা দিতে পারব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বীর্যশুল্কায় যে আমাকে কিনে নিতে পারবে, তাকেই আমি বিয়ে করব—তা সে শূদ্রই হোক, আর চণ্ডালই হোক।’

শুনে রুদ্রপ্রতাপ খুশি হলেন সেকালে শূদ্রকে কেউ এত ঘৃণা করত না,—অনেক শূদ্র রাজা বাহুবলে সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। রুদ্রপ্রতাপ হেসে বললেন, ‘আমিও তাই চাই। কিন্তু তা হবে কী করে?’

কুমারী বললেন, ‘আমার প্রতিজ্ঞা এই-যে পুরুষ তিনটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন, আমি তাঁকেই বরমাল্য দেব। আপনি রাজ্যে এই কথা ঘোষণা করে দিন।’

‘বেশ! কী কী বিষয়ে পরীক্ষা হবে?’

‘বাহুবল, হৃদয়বল আর বুদ্ধিবলের পরীক্ষা হবে। আমি নিজে পরীক্ষা করব।’

রাজা মেয়ের পিঠে হাত রেখে আদর করে বললেন, ‘সুমিত্রা, তুই শক-দুহিতার উপযুক্ত কথা বলেছিস। আজই আমি দেশ-বিদেশে ঢেঁড়া দিয়ে দিচ্ছি।’

রাজ্যে-রাজ্যে আবার ঘোষণা হয়ে গেল। আবার অনেক রাজা, রাজপুত্র, সেনাপতি, অমাত্য এলেন কিন্তু সকলকেই ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে হল। কেউ বাহুবলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন কিন্তু বুদ্ধিবলে উত্তীর্ণ হতে পারলেন না আবার কেউ বা বুদ্ধিবলে উত্তীর্ণ হলেন কিন্তু হৃদয়বলে অর্থাৎ সাহসিকতায় বিফল হলেন। সকলেই অধোবদনে ফিরে গেলেন, রাজকুমারীকে লাভ করতে পারলেন না।

এমনিভাবে কিছুদিন কেটে গেল একদিন সকালবেলায় মন্ত্রগুহের দ্বিতলে রাজা রুদ্রপ্রতাপের সভা বসেছে। চারিদিকে পাত্রমিত্র, সেনাপতি, শ্ৰেষ্ঠী, সামন্ত রয়েছেন, রাজা স্বয়ং সিংহাসনে আসীন রাজার ডানপাশে মর্মর-পদ্মাসনে কুমারী সুমিত্রা সভা যেন তাঁর রূপের ছটায় আলোকিত হয়ে গেছে। তাঁর গর্বিত গ্রীবাভঙ্গী আর তীক্ষ্ণ কটাক্ষে সভার বড় বড় বীরের পৌরুষও যেন সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

সভার তোরণের কাছে প্রতীহার-ভূমিতে হঠাৎ একটা গোলমাল শুনতে পেয়ে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কিসের গণ্ডগোল?মকরকেতু, দেখ তো!’

মকরকেতু রাজ্যের একজন সেনানী। তিনি যুবাপুরুষ বিশাল তাঁর দেহ, তাঁর চেহারা দেখেই শত্রু ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। তিনি সভাদ্বারে গিয়ে দেখলেন, একজন দীনবেশ যুবক জোর করে সভায় প্রবেশ করতে চায় কিন্তু চার-পাঁচজন প্রতীহারী তাকে আটকে রাখবার চেষ্টা করছে। যুবক নিরস্ত্র, কিন্তু এমন ভয়ঙ্করভাবে সে হস্তপদ সঞ্চালন করছে যে, বর্মাবৃত শূলধারী প্রতীহারীরা তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। কিন্তু পাঁচজনের সঙ্গে একজনের যুদ্ধ কতক্ষণ সম্ভব? অবশেষে দ্বাররক্ষীরা তাকে মাটিতে ফেলে তার হাত বেঁধে ফেললে।

মকরকেতু রাজাকে এসে খবর দিলেন, শুনে রাজা হুকুম করলেন, কী চায় লোকটা? তাকে এখানে নিয়ে এস।’

তখন দু’জন প্রতীহারী লোকটিকে নিয়ে রাজার সুমুখে হাজির হল। রাজা তার চেহারা আর বেশভূষা দেখে আশ্বর্যান্বিত হয়ে গেলেন তার মাথায় উষ্ণীষ নেই, হাতে অস্ত্র নেই, পরিধানে নিখুঁত বস্ত্রও নেই—রক্ষীদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে। সর্বাঙ্গে ধূলা। কিন্তু তবু, ছিন্ন আর ধূলির আভরণের ভিতর দিয়েও অপরূপ সুঠাম দেহ-প্রভা প্রকাশ পাচ্ছে। দেহ রোগাও নয়, মোটাও নয়। পেশীগুলি প্রতি অঙ্গসঞ্চালনে সাপের মত খেলে বেড়াচ্ছে। মাথার কোঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছে গায়ের রং নূতন কচি ঘাসের মত শ্যাম। মুখে একটা খামখেয়ালি বেপরোয়া ভাবা।

রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? তোমার দেশ কোথায়?

বন্দী একবার রাজার দিকে চাইলে, একবার রাজকন্যার দিকে চাইলে তারপর বললে, ‘আমি এ রাজ্যে আগন্তুক। আমার দেশ বঙ্গ।’

রাজা বললেন, ‘বঙ্গদেশের নাম শুনেছি বটে, আর্যাবর্তের পূর্ব সীমান্তে সেই রাজ্য। শুনেছি সে দেশের লোকেরা পাখির ভাষায় কথা বলে।’

বন্দী গম্ভীরভাবে বললে, ‘মহারাজ ঠিক ধরেছেন। বঙ্গদেশের লোক কোকিলের ভাষায় কথা বলল। এত মধুর ভাষা পৃথিবীতে আর নেই।’

রাজা উত্তর শুনে ভারি আশ্চর্যান্বিত হলেন, একটু খুশিও হলেন। প্রতীহারীদের বললেন, বাঁধন খুলে দাও।’

বন্ধন-মুক্ত হয়ে যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন এই ছিন্নবেশ বিদেশী যুবার চেহারা দেখে কুমারী সুমিত্রার তীব্রোজ্জ্বল চোখদুটি ক্ষণকালের জন্য নত হয়ে পড়ল। তিনি উত্তরীয়টি ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন।

রাজা বললেন, ‘বিদেশী, তুমি বহুদূর থেকে এসেছ তোমার বস্ত্র ছিন্ন দেখছি। তুমি কি অর্থ চাও?

বিদেশী হাসল বললে, না মহারাজ, আমি অর্থ চাই না—অর্থের আমার প্রয়োজন নেই। আমি অন্য এক মহার্ঘ রত্নের সন্ধানে এ রাজ্যে এসেছি।’

বিস্মিত রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী? পরিচয় কী?’

বিদেশী বললে, ‘আমার নাম চণ্ড। আমি তালীবনশ্যাম সমুদ্র মেখলা বঙ্গভূমির একজন অজ্ঞ সন্তান—এইটুকুই আমার পরিচয় বলে ধরে নিতে পারেন।’

রাজা বললেন, ‘ভাল। এখন, জোর করে আমার সভায় ঢুকতে চেয়েছিলে কেন? তার কারণ বল।’

চণ্ড বললে, ‘মহারাজ, আপনার রাজ্যে প্রবেশ করে শুনলাম যে কুমারী সুমিত্রা বীর্যশুল্কা হতে চান। তাই আমি নিজের বীর্যের পরীক্ষা দিয়ে তাঁকে লাভ করতে এসেছি। ‘ বলে, পূর্ণদৃষ্টিতে সুমিত্রার দিকে তাকাল।

শুনে কুমারীর মুখ লাল হয়ে উঠল। মন তাঁর ক্ষণকালের জন্য বিদেশীর প্রতি কোমল হয়েছিল, আবার কঠিন হয়ে উঠল। একজন সামান্য লোক তাঁকে লাভ করবার দুরাশা রাখে! সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল যে, ভারতবর্ষের সকল রাজ্য থেকেই রাজা বা রাজপুত্র তাঁর পাণিপ্রার্থী হয়ে এসেছে—শুধু বঙ্গদেশ থেকে কেউ আসেনি। বঙ্গদেশের রাজপুত্রেরা কি এতই দর্পিত যে, নিজেরা না এসে একজন ভিক্ষুককে তাঁর পাণিপ্রার্থী করে পাঠিয়েছে? অপমানে তাঁর দু’চোখ জ্বলে উঠল।

সভাসদরাও চণ্ডের এই অদ্ভুত স্পর্ধা দেখে মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সকলের সমবেত অট্টহাস্যে সভা ভরে গেল।

রাজা রুদ্রপ্রতাপ কিন্তু হাসলেন না। তিনি আর চোখে মকরকেতুকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘এটাকে সভার বাইরে নিক্ষেপ করা’

মকরকেতু সবচেয়ে বেশি জোরে হাসছিলেন, হাসির ধাক্কায় তাঁর বিরাট দেহ দুলে দুলে উঠছিল। তিনি হাসতে হাসতেই চণ্ডকে সভার বাইরে নিক্ষেপ করতে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তার গায়ে হাত দিতে-না-দিতেই এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। চণ্ড দুই হাতে মরকেতুর কোমর ধরে তাকে মাথার ঊর্ধ্বে তুলে অবলীলাক্রমে গবাক্ষের পথে নিচে ফেলে দিয়ে রাজার সুমুখে ফিরে এসে বললে, ‘মহারাজ, আপনার আজ্ঞা পালিত হয়েছে।’

সভা নির্বাক রুদ্রপ্রতাপের মুখে কথা নেই। চণ্ড এমনভাবে এসে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সে বিশেষ কিছুই করেনি, এরকম সে রোজই করে থাকে।

সকলে ভাবছে—এ কী আশ্চর্য ব্যাপার! মকরকেতুকে যে ব্যক্তি একটা তুলোর বস্তার মত তুলে ফেলে দিতে পারে, তার গায়ে কী অসীম শক্তি! সভাসুদ্ধ লোক বিস্ফারিত চোখে চণ্ডের মুখের পানে চেয়ে রইলা।

এতক্ষণে সুমিত্রা কথা কইলেন নিস্তব্ধ সভাগৃহে তাঁর কণ্ঠস্বর বীণার মত বেজে উঠল। ঈষৎ জভঙ্গী করে তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘বিদেশী, তোমার দেশে কি রাজা নেই?

চণ্ড বললে, ‘রাজা আছেন বৈকি রাজকুমারী তাঁর প্রতাপে প্রাগজ্যোতিষ থেকে কোশল পর্যন্ত কম্পমান।’

সুমিত্রা বললেন, বটে! তবে কি তিনি প্রবীণ?

চণ্ড বললে, ‘হ্যাঁ, তিনি প্রবীণ।’

সুমিত্রা প্রশ্ন করলেন, তাঁর কি পুত্র নেই?’

চণ্ড মৃদু হাসল, ‘আছে। শুনেছি যুবরাজ ভট্টারক পরম রসিক। তবে তিনি পিতার মত বীর কি বলতে পারি না।’

সুমিত্রার কণ্ঠের চাপা শ্লেষ এতক্ষণে স্ফুরিত হয়ে উঠল তিনি তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘তাই বুঝি তোমাদের রসিক যুবরাজ একজন মল্লকে তাঁর প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন?’

চণ্ড মাথা নেড়ে বললে, ‘না, আমি স্বেচ্ছায় এসেছি। তাছাড়া আমি মল্ল নই। আমার দেশের সকলেই আমার চেয়ে বেশি বলবান, তাই আমি লজ্জায় দেশ ছেড়ে চলে এসেছি।’ এই বলে কপট লজ্জায় মাথা নিচু করলে।

কুমারী সুমিত্রা অধর দংশন করলেন। এই লোকটার সঙ্গে কথাতেও পারবার জো নেই। যে ব্যক্তি এইমাত্র মহাকায় মকরকেতুকে জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দিয়েছে, তার মুখে একথা পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। কুমারী অল্পকাল চিন্তা করে বললেন, ‘ভাল! তুমি মল্ল হও বা না হও, ভার উত্তোলন করতে পার বটে। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, তিনটি পরীক্ষায় যে উত্তীর্ণ হতে পারবে, তাকেই আমি বরমাল্য দেব, তা সে পামরই হোক আর চণ্ডালই হোক। কিন্তু ভার উত্তোলন করাই বাহুবলের প্রমাণ নয়, উষ্ট্রও ভার বহন করতে পারো তুমি বাহুবলের আর কী প্রমাণ দিতে পার?

চণ্ড বললে, “মানুষের যা সাধ্য আমিও তাই পারি।’

‘পার? বেশ, আমার এই মুঠির মধ্যে একটি মুক্তা আছে…মুঠি খুলে মুক্তাটি নিতে পার?’ এই বলে সুমিত্রা মৃণালের মত ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন।

অনেক রাজপুত্ৰই রাজদুহিতার মুঠি খুলতে না পেরে লজ্জায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। চণ্ড তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ক্ষুব্ধস্বরে বললে,—‘রাজকুমারী, এ পুরুষের উপযুক্ত পরীক্ষা নয়, আমাকে অকারণ লজ্জা দিচ্ছেন কেন?’ এই বলে সে বাঁ-হাতের দুটি আঙুল দিয়ে রাজকুমারীর মুঠির দু’দিক চেপে ধরলো রাজকুমারী একবার শিউরে উঠলেন, তারপর তাঁর মুঠি আস্তে আস্তে খুলে গেল।

মুক্তাটি হাত থেকে তুলে নিয়ে চণ্ড বললে, ‘আজ থেকে এই মুক্তাটি আমার কর্ণের ভূষণ হল।’ রাজকুমারীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল তিনি কিছুক্ষণ বিহুল চক্ষে নিজের পানে চেয়ে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অবরুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘প্রথম পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। বাকি দুই পরীক্ষা আজ অপরাহ্নে হবে।’ এই বলে তিনি দ্রুতপদে সভা ছেড়ে চলে গেলেন।

নিজের শয়নঘরে গিয়ে রাজকুমারী বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলেন এমন লাঞ্ছনা তিনি জীবনে ভোগ করেননি। কোথাকার এক পরিচয়হীন অখ্যাত লোক এসে অবহেলাভরে বাঁ-হাতে তাঁর মুঠি খুলে দিলে! কী কঠিন তার আঙুল! যেন লোহা দিয়ে তৈরি! সেই আঙুল রাজকুমারীর মুঠি স্পর্শ করামাত্র যেন অবশ হাত আপনি খুলে গেল। কেন এমন হল? ও কি ইন্দ্রজাল জানে?

চোখ মুছে সুমিত্রা পালঙ্কে উঠে বসলেন। তাঁর লুষ্ঠিত অভিমান আহত সর্পের মত আবার ধীরে ধীরে মাথা তুলতে লাগল। তিনি গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন কী করে আজ বাকি দুই পরীক্ষায় চণ্ডকে পরাস্ত করবেন!

* * * *

বেলা তৃতীয় প্রহরের তূর্য-দামামা বাজবামাত্র রাজা আর রাজ্যের বড় বড় প্রবীণ অমাত্যেরা রাজ-উদ্যানে সমবেত হলেন। রাজকুমারী বেণী দুলিয়ে ফুলের মালা গলায় দিয়ে নিজের প্রাসাদ থেকে নেমে এলেন চণ্ডও উপস্থিত হল। এখন আর তার ধূলি-ধূসর বেশ নেই, পরিধানে পট্টবস্ত্র,

বুকে লোহার বর্ম, হাতে ধনুঃশরা ডান কানে সেই মুক্তাটি বেলফুলের কুঁড়ির মত দুলছে।

রাজ-উদ্যানটি প্রকাণ্ড, চারিদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তাতে বড় বড় ফল-ফুলের গাছে, আম্র জম্বু বকুল পিয়াল কদম্ব শোভা পাচ্ছে। মাঝে মাঝে সরোবরা মাঝে মাঝে বুক পর্যন্ত উঁচু স্বচ্ছ স্ফটিকের দেওয়াল বাগানের পুষ্পিত অংশকে ঘিরে রেখেছে। চারিদিকে পোষা হরিণ, শশক, ময়ুর চরে বেড়াচ্ছে।

একটি পাথরের বড় বেদীর উপর রাজা আর অমাত্যেরা আসন গ্রহণ করলেন সুমিত্রা দু’জন সখীর সঙ্গে অদূরে আর একটি বেদীতে বসলেন। চণ্ড দাঁড়িয়ে রইল।

কুমারী একবার আয়ত উজ্জ্বল চোখ তুলে চণ্ডের দিকে চাইলেন তারপর গ্রীবা হেলিয়ে একজন সখীকে ইঙ্গিত করলেন। সখীর হাতে একটা সোনার কলস ছিল, সে গিয়ে সেই কলসটি স্ফটিকের দেয়ালের পিছনে রেখে এল।

কুমারী তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিদেশী, তুমি তীর ছুঁড়তে জান?’

মুখ টিপে হেসে চণ্ড বললে, ‘ছেলেবেলায় শিখেছিলাম—অল্পস্বল্প জানি।’

‘ভাল। এবারে তোমার বুদ্ধিবলের পরীক্ষা হবে। স্ফটিক-কুড্যের ওপারে ঐ ঘট দেখতে পাচ্ছ? তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেইখান থেকে তীর দিয়ে ঐ ঘট বিদ্ধ করতে হবে। যদি পার বুঝব তুমি কৌশলী বটে!

রাজা এবং পারিষদেরা সকলেই অবাক হয়ে রইলেন। এ কী অদ্ভুত পরীক্ষা! এদিক থেকে ঘট বিদ্ধ করা কি সম্ভব কখনও? মাঝে পাঁচ আঙুল পুরু স্ফটিকের দেয়াল রয়েছে সে দেয়াল ভেদ করে তীর ছোঁড়া মানুষের সাধ্য নয়।

চণ্ড বললে, ‘এ কি মানুষের কাজ? এ-রকম লক্ষ্যভেদ যে দেবতাদেরও অসাধ্য?’

সুমিত্রা বিদ্রুপ-স্বরে বললেন, ‘তবে কি তুমি চেষ্টার আগেই পরাভব স্বীকার করছ?’

চণ্ড বললে, ‘না না, তা আমি বলছি না। আমি বলছি যে, আপনি মানুষের অসাধ্য কাজ দিয়ে আমাকে দেব-পদবী দান করছেন।’

রাজকুমারী তীক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তবে কি তুমি পারবে বলে মনে হয়?’

চণ্ড হেসে বললে, ‘পারা না-পারা দৈবের অধীন। তবে এ পরীক্ষা বঙ্গীয় ধনুর্ধরের উপযুক্ত বটে।’

চণ্ড সযত্নে ধনুকে গুণ পরালো ঈষৎ টঙ্কার দিয়ে দেখলে গুণ ঠিক হয়েছে কি না। তারপর আকাশের দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে ধনুকে শর-সংযোগ করলে।

গাছের পাতা নড়ছে না, বাতাস স্থির। দর্শকেরাও চিত্রার্পিতের মত বসে দেখছেন। চণ্ড ধীরে ধীরে ধনুক ঊর্ধ্বে তুললে। একবার সুবর্ণ ঘটের দিকে চেয়ে দেখলে তারপর জ্যা-মুক্ত তীর আকাশের দিকে ছুটে চলল।

তীর আতসবাজির মত সোজা আকাশে উঠে, পাক খেয়ে নক্ষত্ৰবেগে নিচের দিকে মুখ করে নেমে আসতে লাগল। ঠং করে একটা শব্দ হল। সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখলেন, তীরটি সোনার কলসের গায়ে বিঁধে আছে।

রাজকুমারী এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে বসে দেখছিলেন, তাঁর বুক থেকে একটি কম্পিত দীর্ঘশ্বাস বার হয়ে গেল। বুক দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগল—আশঙ্কায় কি আনন্দে বুঝতে পারলেন না। চণ্ডের কপালেও ঘাম দেখা দিয়েছিল। সে ঘাম মুছে জিজ্ঞাসা করলে, ‘রাজকন্যা, আদেশ পালন করতে পেরেছি কি?’

রাজকন্যার গলা কেঁপে গেলা। তিনি বললেন, ‘পেরেছ।‘ একটু থেমে বললেন, ‘এবারে শেষ পরীক্ষা।’

চণ্ড যেন একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বললে, ‘এরই মধ্যে শেষ পরীক্ষা! আমার ইচ্ছা হচ্ছে সারা জীবন ধরে আপনার কাছে পরীক্ষা দিই।’

সুমিত্রার বুক আবার দুরুদুরু করে উঠল, কিন্তু তিনি নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘শেষ পরীক্ষা এই—আমি এই বনের মধ্যে দৌড়ে যাব। দশ গুনতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ পরে তুমি আমার পশ্চাদ্ধাবন করবো তোমার হাতে একটা তীর আর ধনুক থাকবে তুমি যদি আমাকে স্পর্শ করতে পার, তাহলে তোমার জিত, আর আমি যদি ফিরে এসে এই বেদী স্পর্শ করতে পারি, তাহলে তোমার হার। আমার গতি রোধ করবার জন্য তুমি অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পার। কিন্তু যদি আমার অঙ্গ থেকে একবিন্দুরক্ত বার হয়, তাহলে তদ্দণ্ডেই তোমার প্রাণ যাবে।’

চণ্ড বললে, ‘মানবী-মৃগয়া আমার জীবনে এই প্রথমা ভাল, তাই হোক।’

* * * *

হরিণীর মত ক্ষিপ্র চঞ্চল পদে কুমারী সুমিত্রা বনের গাছপালার মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। দশ। গণা শেষ হলে চণ্ড তীরধনুক হাতে শিকারীর মত তাঁকে অনুসরণ করলে।

চণ্ডও খুব দ্রুত দৌড়তে পারে কিন্তু রাজকুমারীর সঙ্গে পাল্লায় সে পেছিয়ে পড়তে লাগল। ক্রমে উদ্যানের গাছপালা যতই ঘন হতে আরম্ভ করল, ছায়াও তত গভীর হতে লাগল। তার ভিতর দিয়ে পলায়মান সুমিত্রার শুভ্র অঞ্চল আর উড্ডীন বেণী দেখা যেতে লাগল। কিন্তু ক্রমে আর তাও দেখা যায় না। চণ্ড বুঝলে, সুমিত্রার সঙ্গে দৌড়ে সে পারবে না। হাজার হোক, তিনি নারী—তাঁর শরীর লঘু। এদিকে চণ্ডের গায়ে লৌহ-বর্ম, এ অবস্থায় কেবল পশ্চাদ্ধাবন করে কুমারীকে ধরা অসম্ভব।

চণ্ড তখন যে-পথে রাজকুমারীর ফেরবার সম্ভাবনা সেই দিকে যেতে লাগল। ছায়ায় অস্পষ্ট বন, ফুলের গন্ধে বাতাস যেন ভারী হয়ে আছে। অগণ্য গাছের শ্রেণীতে বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যায় না। সংশয়ভরা মন নিয়ে খানিকদূর যাবার পর হঠাৎ চণ্ড দেখলে, সুমিত্রা তার দিকেই ছুটে আসছেন। কিন্তু কাছাকাছি এসে সুমিত্রাও চণ্ডকে দেখতে পেলেন। উচ্চ হাস্য করে তিনি আবার বিপরীত দিকে ছুটলেন কিন্তু চণ্ড তখন তাঁর খুব কাছে এসে পড়েছে, তার দৃষ্টি ছাড়িয়ে পালানো আর সম্ভব নয়।

তবু চণ্ড পেছিয়ে পড়তে লাগল। দশ হাতের ব্যবধান পনেরো হাতে দাঁড়াল। সুমিত্রার পা যেন মাটিতে পড়ছে না—তিনি যেন পাখির মত শূন্যে উড়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে চাইছেন, আর কলকণ্ঠে হেসে আবার দৌড়চ্ছেন। ক্রমশ ব্যবধান যখন আরও বেড়ে গেল, তখন চণ্ড মনে মনে স্থির করে নিলে—আর রাজকুমারীকে চোখের আড়াল করা চলবে না। সে দৌড়তে দৌড়তে ধনুকে শর-যোজনা করলো তারপর শুভ মুহূর্তের জন্য সতর্ক হয়ে রইল।

এবার একটা মোটা গাছের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুমিত্রা নিমেষের জন্যে থেমে পিছু ফিরে চাইলেন। এই সুযোগের জন্যই চণ্ড অপেক্ষা করছিল পলকের মধ্যে তার তীর ছুটল। সুমিত্রা যখন আবার পা বাড়ালেন তখন দেখলেন, তাঁর চলার শক্তি নেই। চণ্ডের তীর তাঁর বেণী ভেদ করে গাছের গুড়িতে বিঁধে গেছে।

চণ্ড ছুটে এসে তীর উপড়ে রাজকুমারীর বেণী মুক্ত করে দিল। হাসতে হাসতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে—তাঁর চোখে জল।

চণ্ডের মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল, সে ক্ষণকাল চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললে, ‘দেবী, আমি এখনও আপনার অঙ্গ স্পর্শ করিনি। যদি আপনি আমার মত লোকের গলায় মালা দিতে না চান—আমি শেষ পরীক্ষায় হেরে যেতে রাজী আছি। আপনি যান—বেদী স্পর্শ করুন গিয়ে।’

সুমিত্রা নতজানু হয়ে সেইখানে বসে পড়লেন, বাষ্পরুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘প্রথম দর্শনেই আমার মন বুঝেছিল যে তুমি আমার স্বামী। শুধু অহঙ্কার আমাকে অন্ধ করে রেখেছিল আর্যপুত্র, বীর্যশুল্কে তুমি আমাকে জয় করেছ, তবু স্বেচ্ছায় আমি তোমার পায়ে আত্মসমর্পণ করছি।’

চণ্ডের মুখ হাসিতে ভরে গেল। সুমিত্রাকে ধরে তুলে সে বললে, ‘সুমিত্রা!’

সুমিত্রা গলা থেকে মালা খুলে তার গলায় পরিয়ে দিলেন তারপর আবার নতজানু হয়ে বরকে প্রণাম করলেন।

চণ্ড হেসে বললে, ‘সুমিত্রা, তুমি রাজকন্যা দরিদ্রের পর্ণকুটীরে তোমার কষ্ট হবে না?’

সুমিত্রা চোখ নিচু করে বললেন, ‘তোমার মত স্বামী যার, পর্ণকুটীরে থেকেও সে রাজরাজেশ্বরী। আর্যপুত্র, আমাকে তোমার তালীবনশ্যাম বঙ্গদেশে নিয়ে চল।’

চণ্ড বললে, ‘সুমিত্রা, তোমার সঙ্গে আমি প্রতারণা করেছি। বলেছিলাম মনে আছে— বঙ্গদেশের রাজকুমার রসিক? আমি তোমাদের সঙ্গে একটু রসিকতা করেছি। আমার সত্যিকার নাম—চন্দ্র। আমার একটি ছোট্ট বোন আছে, সে চন্দ্র উচ্চারণ করতে পারে না, চণ্ড বলে, তাই—’

বিস্ময়-উৎফুল্ল চোখে চেয়ে সুমিত্রা বললেন, ‘তুমিই তবে বঙ্গের রাজপুত্র?’

‘হ্যাঁ কিন্তু রাজপুত্র বলে তোমার মালা ফিরিয়ে নিয়ো না যেন।’

সুমিত্রা মুগ্ধ নেত্রে কিছুক্ষণ চণ্ডের মুখের পানে চেয়ে থেকে মৃদুস্বরে বললেন, ‘রাজপুত্র যে এমন হয়, তা জানতাম না!’

তারপর দুজনে হাত-ধরাধরি করে, যেখানে রুদ্রপ্রতাপ স-পারিষদ বেদীতে ছিলেন, সেইদিকে চললেন।

3 Comments
Collapse Comments
প্রভাষ চন্দ্র মণ্ডল June 19, 2021 at 12:59 pm

চমৎকার কাহিনি। পড়ে খুবই ভালো লাগলো। বীর্যশুল্কা শব্দের অর্থ খুজতে গিয়ে কাহিনিটি পেয়ে গেলাম। বড় ভালো লাগলো।

Krishna Chandra Das July 19, 2021 at 2:35 pm

ধন্যবাদ শ্রী সবিতেন্দ্রনাথ রায় কে, তাঁর সূত্র ধরেই এই চমৎকার গল্প পড়ার সুযোগ পেলাম।

কমল পাল January 4, 2022 at 1:40 am

স্বয়ংবর সভা এবং বীর্যশুল্কা প্রথার মধ্যে মূল পার্থক্য আরো একটু বিশদে আলোচনা করলে সমৃদ্ধ হতাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *