৬
খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, আমি সময় নষ্ট করতে পারবো না। এখনই কারডোভা চলো। আজকে থেকেই কাজে নামবো।
-বেশ, চলো। বারাকা বলল।
–কারডোভা কি খুববেশি দূরে। ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
–তা একটু দূরে বৈকি। তবে আমাদের আস্তাবল থেকে দুটো ঘোড়া নেব।
–তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। ফ্রান্সিস বলল।
বারাকা চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসে বলল, ঘোড়া তৈরি। চলো।
বারাকাদের বাড়ির বাইরে দু’জনে এলো। দেখল একজন সহিস দুটো ঘোড়া নিয়ে এসেছে।
দু’জনে ঘোড়ায় উঠল। বারাকা আর ফ্রান্সিস চলল কারডোভার দিকে।
বিকেল নাগাদ দু’জনে কারডোভা পৌঁছল। কারডোভা একসময় রাজধানী ছিল। কাজেই রাস্তার দু’পাশে অনেক বাড়িঘর। যথেষ্ট লোকবসতি এখানে। রাস্তায় বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, আমারশহরটা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি খলিফা ইবন আমীরের তৈরি নতুন রাজপ্রাসাদে, তারপর পুরনো রাজপ্রাসাদে নিয়ে চলো।
বারাকা প্রথমে নতুন রাজপ্রাসাদে এলো। ঘোড়া থেকে নামল দু’জনে। একটা প্রান্তরের মধ্যে পাথরের প্রাচীর ঘেরা প্রাসাদটি। প্রাচীরটার অনেক জায়গাতেই ভাঙন ধরেছে।
দু’জনে প্রধান ফটকে এলো। প্রহরীরা ওদের আটকাল। বারাকা রাজপাঞ্জা দেখাল। প্রহরীরা সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকল দুজনে। কিছুটা পাথর-বাঁধানো চত্বর পেরিয়ে প্রাসাদ। ওটা পার হতে হতে বারাকা বলল, এখানে আলতোয়াইফ থাকেন। তার সঙ্গে ই দেখা করতে হবে।
প্রাসাদে প্রবেশের দরজার কাছে দ্বারীরা পাহারায় রয়েছে। তাদের রাজপাঞ্জা দেখিয়ে বারাকা বলল, আলতোয়াইফের সঙ্গে দেখা করবো। তাকে খবর দাও।
একজন দ্বাররক্ষী প্রাসাদে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, আসুন আপনারা। সদর দরজার পরেই একটা পাথরের ঘর। ঘরের মাঝখানে শ্বেতপাথরের গোল টেবিল। আবলুশ কাঠের গদি-আঁটা চেয়ার টেবিল ঘিরে। ফ্রান্সিসরা বসল।
একটু পরেই ঢোলাহাতা দামি কাপড়ের জোব্বা পরা আলতোয়াইফ ঢুকলেন। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়াল। নিজে বসে ফ্রান্সিসদের বসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিসরা বসল।
বারাকা বলল, ফ্রান্সিস, তোমার যা বলার বলল।
ফ্রান্সিস বলল, মাননীয় মহাশয়, খলিফা ইবন আবি আমীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর বিপুল ধনভাণ্ডারের কোনো হদিস কাউকে দিয়ে যাননি। আমরা সেই গোপন ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছি। এই প্রাসাদেইখলিফা মৃত্যুর পূর্বে ছিলেন। কাজেই এই প্রাসাদের কোথাও খলিফা কোনো চিহ্ন বা নকশা রেখে গেছেন কিনা সেটাই আমরা খুঁজে দেখতে এসেছি। এজন্যে আপনার সাহায্য চাই।
–অন্দরমহল বাদে আপনারা সারা প্রাসাদই খুঁজে দেখতে পারেন। তবে শুনেছি খলিফার ধনসম্পদ অনেকেই খুঁজেছে। কেউ হদিস করতে পারেনি। আলতোয়াইফ বললেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। অন্দরের দিকে চলে গেলেন।
ফ্রান্সিস আর বারাকা এবার প্রাসাদের ঘরগুলো দেখতে লাগল। কোনো ঘরে অস্ত্রশস্ত্র রাখা, কোনো ঘরে বেশ কয়েকটা লোহার সিন্দুক রাখা। প্রায় একশো বছর আগে তৈরি প্রাসাদের বেশ কয়েকটা ঘর এখন ভাঙা পাথরের স্তূপ। সেখানে ফ্রান্সিস পাথরের স্কুপের পাথর তুলে সরাতে লাগল। বারাকাও হাত লাগাল। পাথরের স্তূপ সরিয়ে ওরা দেখল গোপন জায়গা বলে কিছু নেই।
আর একবার সব দেখেশুনে দু’জন বাইরের ঘরে এসে বসল। ফ্রান্সিস বলল, বুঝেছো বারাকা, এই প্রাসাদে গোপনীয় জায়গা বলতে কিছু পাওয়া গেল না। লোহার সিন্দুক যে ক’টা আছে সবই খোলা হয়েছে। কাঠের আলমারিগুলোও দেখা হয়েছে। এবার পুরনো প্রাসাদে চলো।
ঘোড়ায় চড়ে দু’জনে পুরনো প্রাসাদে এলো। এখন নামেই প্রাসাদ। কয়েকটা পাথরের ঘাম শুধু দাঁড়িয়ে আছে। আর সব জায়গাতেই পাথরের স্তূপ।
ঘোড়া থেকে নেমে এলো দু’জন। ফ্রান্সিস পাথরের পাটা ছড়ানো জায়গায় এদিক ওদিক লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে দেখতে লাগল। বোঝা গেল ধ্বংসের হাত থেকে কোনো ঘর বাঁচেনি। স্তূপের আকারে পাথরের পাটা ছড়িয়ে থাকায় বোঝাও যাচ্ছে না কোথায় কোথায় ঘর ছিল। সেসব ঘর দেখতে গেলে আগে সব পাথরের পাটার স্কুপ সরাতে হবে। তার জন্য লোক চাই অন্তত পঞ্চাশজন। তবেই পাথরের স্তূপ সরানো সম্ভব।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়েছে তখন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না। দু’জনে ঘোড়ায় উঠল। ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, এবার রাতের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করো।
বারাকা জানাল, আমার জানাশুনো একটা সরাইখানা আছে বাজার এলাকায়। সেখানে চলো।
ফ্রান্সিস বলল, তার আগে আলতোয়াইফের সঙ্গে দেখা করে আসি চলো।
ওরা নতুন প্রাসাদে এলো। ভেতরে দ্বাররক্ষীদের একজনকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে ফ্রান্সিসরা বাইরের ঘরে বসল। একটু পরে আলতোয়াইফ এলেন।ফ্রান্সিস বলল, মাননীয় মহাশয়, আপনার কাছে একটু সাহায্য চাই।
-বলো কি সাহায্য চাও।
–এখানে কী বন্দিশালা আছে? ফ্রান্সিস বলল
–হ্যাঁ, একটা ছোটো কয়েদঘর আছে। সেখানে এখন কয়েকজন বন্দি আছে।
আজ রাতেই আপনি সেভিল্লায় দূত পাঠান। রাজা ফার্নান্দোকে অনুরোধ করুন কাল সকালে যেন সেভিল্লার বন্দিশালা থেকে জনা পঞ্চাশেক বন্দি এখানে পাঠিয়ে দেন।
–কেন বলো তো?
–এখানে পুরনো প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ সরাতে হবে। ধ্বংসস্তূপ সরাতে পারলে মেঝেগুলো দেখে মোটামুটি আন্দাজ করা যাবে কোথায় কোথায় ঘর ছিল। এটা জানা খুবই দরকার।
–বেশ, লোক পাঠাচ্ছি। আলতোয়াইফ বললেন।
ঘোড়া চালিয়ে দু’জনে বারাকার জানাশুনো সরাইখানায় এলো। রাতে খেয়েদেয়ে দু’জনে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের মাথায় অনেক চিন্তা। ও ইচ্ছে করেই সেভিল্লা থেকে বন্দি বন্ধুদের এখানে আনার ব্যবস্থা করল। এখন চিন্তা গুপ্ত ধনসম্পদ ঐ ভাঙা প্রাসাদে এ যাওয়া যাবে কিনা।
পরের দিন একটু বেলাতেই ফ্রান্সিসের ঘুম ভাঙল। দেখল বারাকার ঘুম তখনও ভাঙেনি। ফ্রান্সিস ধাক্কা দিয়ে ওকে তুলল। সরাইখানায় সকালের খাবার খেয়েও ওরা ঘোড়ায় উঠল। চল নতুন রাজপ্রাসাদের দিকে।
ফ্রান্সিস দূর থেকেই দেখল প্রাসাদের সামনের প্রান্তরে কিছু লোক বসে-দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু এগিয়ে এসে পোশাক দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল হ্যারিদের আনা হয়েছে। ফ্রান্সিস বারাকাকে বলল, এই বন্দিদের মধ্যে তোমার বাবা আছেন?
না। বারাকা বলল।
ফ্রান্সিস বুঝল হঠাৎহ্যারিদের সামনে হাজির হলে ওরা চমকে উঠবে। হৈ হৈকরবে। সেটা এই মুহূর্তে বিপদ ডেকে আনতে পারে। ও তাই বারাকাকে বলল, বারাকা, তুমি ঐ বন্দিদের সমানে যাও। বলবে, এদেশীয় একজন লোক নাম ফ্রান্সিস; তোমাদের কিছু কাজের কথা বলবে। তোমরা চুপ করে শুনবে।
বারাকা হ্যারিদের সামনে এসে ফ্রান্সিসদের শেখানো কথাগুলো বলল।ফ্রান্সিস ঘোড়ায় চড়ে হ্যরিদের সামনে আসার সময় বেশ জোরে ওদের দেশীয় ভাষায় বলল, মনে রাখবে তোমরা কেউ আমাকে চেনো না।
হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল, সবাই চুপ। কোনো কথা নয়।
ফ্রান্সিস এবার বলতে লাগল, এখান থেকে কিছুদূরে কারোভা। ওখানে একটা পুরনো রাজপ্রাসাদ আছে। এখন পাথরের স্তূপ। সেই পাথরের স্তূপ সরিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এই তোমাদের কাজ। সকালের খাবার খেয়ে আমরা করডোভা যাবো।
সকালের খাবারের ব্যবস্থা দেখছিল দলপতি। ফ্রান্সিস বারাকাকে বলল, যে কটা বেলচা জোগাড় করতে পারো, নিয়ে এসো। সকালের খাবার খেয়ে সবাই তৈরি হলো।
সকলের সামনে চলল ঘোড়ায় চড়ে দলপতি। বন্দিদের দু’পাশে প্রায় জনা দশেক অশ্বারহী সৈন্য। হঠাৎ ফ্রান্সিস হ্যারির সামনে এসে ঘোড়া থামাল। নিজে দ্রুত নেমে এসে হ্যারিকে তুলে দিল ঘোড়ার পিঠে। ফ্রান্সিস চুপ করে থাকতে বলেছে তাই হ্যারিও কোনো কথা বলল না। আস্তে আস্তে ঘোড়া চালল। ফ্রান্সিস সবার পেছনে হাঁটতে লাগল।
একটু বেলায় সবাই ভাঙা প্রাসাদের সামনে এলো। ফ্রান্সিস দলপতিকে বলল,সকলের হাতের বাঁধন খুলে দিন। নইলে পাথর সরাবে কী করে! দলপতি একজন সৈন্যকে বলল সব বন্দির হাতের বাঁধন খুলে দিতে।
ফ্রান্সিস চারদিকে নজর বোলাতে বোলাতে দেখল ভাঙা স্তূপের পরে বেশ বড়ো একটা গর্ত মতো। বোঝা গেল এখানে একটা জলাশয় ছিল। এখন শুকনো। ঐ জায়গাটা দেখিয়ে ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলল, পাথরের আস্ত বা ভাঙা পাটাগুলো এই গর্তটায় ফেল। সবাই কাজ শুরু করো। ততক্ষণে বারাকা পাঁচটা বেলচা নিয়ে এসেছে।
সব বন্দিরা কাজে নামল। পাঁচজনকে বেলচা দেওয়া হলো। ওরা ভাঙা পাথরের টুকরো একটা জায়গায় জড়ো করতে লাগল। বাকিরা হাত লাগাল পাথরের পাটা সরাতে। ফ্রান্সিস আর বারাকাও কাজে নামল। চলল পাথর ঠোকাঠুকিরশব্দ। এলাকার কৌতূহলী লোকজন এসে ঘিরে দাঁড়াল। চারদিকে অশ্বারোহী সৈন্যরা নজর রাখতে লাগল যাতে কোনো বন্দি পালাতে না পারে।
সূর্য মাথার ওপরে। চড়া রোদের মধ্যে বন্দিরা কাজ করতে লাগল। এবার ফ্রান্সিস দলপতির কাছে এসে বলল, এদের দুপুরের খাবার তো দিতে হয়।
দলপতি বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি। একটু পরেই খাবার নিয়ে এখানকার কয়েদঘরের প্রহরীরা আসবে।
যাক! নিশ্চিত হলাম। ফ্রান্সিস বলল।
দলপতি এবার একটু হেসে বলল, রাজা ফার্নান্দো হুকুম দিয়েছেন গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে তোমাকে যেন সবসময় সাহায্য করা হয়।
ভালো, তবে এতে দায়িত্বটা বেড়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল।
একটু পরেই কয়েকজন প্রহরী খাবার নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসের নির্দেশে বন্দিরা সবাই পাশের প্রান্তরে খেতে বসে গেল। ফ্রান্সিস, বারাকা, দলনেতা, সৈন্যরাও খেতে বসল। লম্বাটে পাতায় গোল করে কাটা রুটি, আনাজের ঝোল, পাখির মাংস খেতে দেওয়া হলো।
খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো পাথর সরানো কাজ।
বিকেল হলো। ফ্রান্সিস সব ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ভাঙা দেয়ালের অংশ, পাথরের চৌকোলো মেঝে দেখে বুঝল ঘরগুলো কোথায় ছিল। ফ্রান্সিসের উদ্দেশ্য ছিল– রাজকোষাগার খুঁজে বের করা। দেখল অর্ধেকেরও বেশি জায়গা থেকে পাথর সরানো হয়েছে। কালকের মধ্যেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন ঘরগুলোর মধ্যে দেখে আন্দাজ করা যাবে কোথায় কোথায় ঘর ছিল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, আজকের মতো এখানেই কাজ শেষ। সবাই বসে জিরিয়ে নাও।
সন্ধের আগেই সবাই ফিরে চলল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে ঘোড়ায় চড়িয়ে দিল। নিজে আর সব বন্দির সঙ্গে হেঁটে চলল।
দলপতি সব বন্দিকে নিয়ে চলল ওখানকার কয়েদঘরটার দিকে।ফ্রান্সিস আর বারাকা সরাইখানায় ফিরে এলো।
পরদিন আবার পাথর সরানোর কাজ চলল। দুপুরে খাবার খেতে বন্দিরা কাজ থামাল। তারপর আবার শুরু হলো কাজ–পাথর ঠোকাঠুকির শব্দ।
বিকেলের আগেই পাথরের স্তূপ সরানো শেষ হলো। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, এবার সবাই বিশ্রাম করো। বন্দিরা যে যেখানে পারল বসে পড়ল। বিশ্রাম করতে লাগল।
ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখতে লাগল। প্রথমে দেখল বড়ো ঘরটা। বোঝা গেল এটা ছিল রাজদরবার। অন্য ঘরগুলোও দেখল। কোনোটা মন্ত্রণাকক্ষ, কোনোটা অস্ত্রশস্ত্র রাখার ঘর, অন্তঃপুরের ঘর কোনগুলো তাও বুঝে নিল। দু’কোণায় দুটো ঘরের কোনটা মহাফেজখানা কোনটা রাজকোষাগার সেটা বুঝতে পারল না।
আলো কমে এসেছে। ফ্রান্সিস উঠে এলো। এখন ভালো করে দেখা যাবে না।
বন্দিদের নিয়ে সবাই চলল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে ঘোড়ায় উঠিয়ে নিজে হেঁটে চলল পাশে পাশে। হ্যারি মৃদুস্বরে ওদের দেশের ভাষায় বলল, ফ্রান্সিস, তুমি যা খুঁজছে তার কিছু হদিস পেয়েছো?
ফ্রান্সিসও গলা নামিয়ে বলল, বলতে পারো সাফল্যের দোরগোড়ায়।
এখানকার কয়েদঘরটা এত ছোটো যে আমরা ভালো করে ঘুমুতে পারছি না।
আজকের রাতটা কোনোরকমে কষ্ট করে থাকো। কালকে সব ঠিক হয়ে যাবে। ফ্রান্সিস বলল। সেইদিন রাতেই হ্যারিদের সেভিল্লা নিয়ে যাওয়া হল। কয়েদঘরে রাখা হল।
পরের দিন সকালেই ফ্রান্সিস আর বারাকা ঘোড়া ছুটিয়ে ভাঙা প্রাসাদে এলো।
ফ্রান্সিস পাথরে ভর রেখে নীচে নেমে এলো। দুকোণার ঘর দুটোর মেঝে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল কোণা ঘরটা ছিল রাজকোষাগার। হিসেব করতে গিয়ে দেখল পুবকোণার ঘরটাই প্রধান প্রবেশপথ থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে। তাহলে এটাই ছিল রাজকোষাগার।
ফ্রান্সিস ভাঙা ঘরের পাথরের মেঝেয় পায়চারি করতে লাগল। ভাবতে লাগল এই ঘরের একশো বছর আগেই বন আবি আমীর তার অর্থসম্পদ রাখতেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি সেসব কোথায় রেখে যান তা কাউকে জানিয়ে যেতে পারেননি। নাকি ইচ্ছে করে জানাননি।
ফ্রান্সিস পায়চারি করছে। হঠাৎ মনে হলো একটা পাথরের পাটা কেমন নড়ে উঠল। ফ্রান্সিস এবার আস্তে হাঁটতে লাগল। নড়ে-ওঠা পাটার ওপর দাঁড়াল। পায়ের চাপ এদিক-ওদিক করল। বুঝল পাটাটা নড়ছে। হিসেব করে দেখল–ঠিক মেঝের মাঝখানের পাটাটা নড়ছে। পাশের পাটাটায় পায়ের চাপ দিল। ওটাও নড়ছে। তবে পাশেরটার চেয়ে কম। ফ্রান্সিস বারাকাকে ডেকে বলল, দ্যাখো তো এই দুটো পাটা নড়ছে কিনা। বারাকা এসে দাঁড়াল ঐ দুটো পাটার ওপর। পা চাপল। তারপর বলল, সত্যি দুটো নড়ছে। একটা বেশি, অন্যটা কম।
ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, এই দুটো পাটাই কুড়ুল চালিয়ে তুলতে হবে। তুমি ক’টা কুড়ুল পাও নিয়ে এসো। কয়েকজন শক্তসমর্থ লোকও নিয়ে এসো। বলবে এখানে একটা কাজ করতে হবে। বদলে মজুরি পাবে।
বারাকা খাদ থেকে উঠে চলে গেল।
বারাকা ফিরে এলো। সঙ্গে কুড়ুল হাতে পাঁচটি যুবককেও নিয়ে এসেছে। ফ্রান্সিস ঐ যুবকদের পাথরের পাটাটা তুলতে বলল। দু-তিনজন মিলে পাটা দুটো নাড়িয়ে নাড়িয়ে তোলবার চেষ্টা করল। পারল না। ফ্রান্সিস বলল, কুড়ুলের ঘা মেরে পাটা দুটো ভাঙো। তারপর টুকরোগুলো সরিয়ে ফেল। পাঁচজনে পরপর কুড়ুলের ঘা মারল। পাথরের পাটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল। ওরা টুকরোগুলো সরালো। ফ্রান্সিস হাঁটু গেড়ে বসে দেখল লোহার পাত মতো। যুবকদের বলল, অন্য পাটাটাও ভাঙো। যুবকদের আরো দুটো পাটা কুড়ুল মেরে ভাঙাল। ভাঙা পাথরগুলো তুলে সারিয়ে রাখল। এবার ফ্রান্সিস লোহার জিনিসটা পুরো দেখতে পেল। বুঝল এটা একটা লোহার সিন্দুক।যুবকদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সিন্দুকটা তুলে আনো। ওরা আরো কয়েকটা পাটা ভেঙে গর্তটা বড়ো করল। তারপর সবাই হাত লাগিয়ে সিন্দুকটা আস্তে আস্তে তুলে এনে মেঝেয় রাখল।
ফ্রান্সিস ঝুঁকে পড়ে সিন্দুকটা দেখতে লাগল। সিন্দুকটা সাধারণ সিন্দুকের মতোই। রঙটা কালো। সিন্দুকটার সামনে-পেছনে দেখতে একই রকম। দু’পাশেই দুটো হাতল আছে। ফ্রান্সিস বুঝল সাধারণ সিন্দুকের মতো দেখতে হলেও এই সিন্দুকটা নির্দেশমতো তৈরি হয়েছে। সিন্দুকটার সামনে বা পেছনে কোথাও চাবির ফুটো নেই। ফ্রান্সিস বেশ আশ্চর্য হলো। বুঝল এই সিন্দুকে মূল্যবান কিছু নিশ্চয়ই আছে। তাই এই ব্যবস্থা।
ফ্রান্সিস যুবকদের দু’ভাগে ভাগ করল। নিজে আর বারাকাও হাত লাগাল। দু’দলে ভাগ হয়ে ফ্রান্সিসরা দুদিকের হাতল ধরে প্রচণ্ড জোরে টানল। সিন্দুকের ডালা খুলল না। এরকম কয়েকবারই টানা হলো। কিন্তু সিন্দুকের ডালা খুলল না।
ফ্রান্সিস মেজেয় বসে পড়ল। সিন্দুকটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল বিশেষভাবে তৈরি সিন্দুকটা যাতে খোলা না যায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই কীভাবে সিন্দুকটা খুলবে সেটা আগে বুঝতে হবে।
তখন বেশ বেলা হয়েছে। বারাকা বলল, ফ্রান্সিস, এবার খেতে চললো।
ফ্রান্সিস চিন্তিতস্বরে বলল, আমি খাবো না তুমি আর ঐ যুবকরা খেয়ে এসো।
–তুমিও এসো। উপবাসে থাকলে তোমার কষ্ট হবে। বারাকা বলল।
–আমার অভ্যেস আছে। তোমরা যাও।
বারাকারা খেতে চলে গেল।
ফ্রান্সিস সিন্দুকটার পাশে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ লক্ষ্য করল একদিকের ডালার ধারে ওপর থেকে নীচে একটা লোহার পাত বসানো। ভালো করে দেখে বুঝল পাতটা পরে বসানো হয়েছে। সিন্দুকের অন্যদিকে এরকম পাত বসানো নেই। ফ্রান্সিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই লোহার পাতটা দেখতে লাগল। বুঝল ছেনি-হাতুড়ি হলে লোহার লম্বা পাতটা খুলে ফেলা যাবে।
বারাকা আর যুবকরা ফিরে এলো। ফ্রান্সিস যুবকদের বলা, ছেনি-হাতুড়ি আনতে পারবে কেউ?
একটি যুবক বলল, আমি আনতে পারবো।
ফ্রান্সিস বলল, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। এতক্ষণে ফ্রান্সিস খাদের ওপরের দিকে তাকাল। দেখল খাদ ঘিরে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। ওরা দেখছে ফ্রান্সিস কী করছে।
যুবকটি ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে এলে ফ্রান্সিস লোহার পাতের খাঁজে ছেনি বসিয়ে হাতুড়ি চালাল। আশ্চর্য! একটা ঘা পড়তেই লোহার লম্বাটে পাতটা নড়ে গেল। এতক্ষণে ফ্রান্সিস হাসল। বারাকার দিকে তাকিয়ে বলল, বারাকা, আমার অনুমান সত্যি হতে চলেছে। লোহার লম্বা পাতটা উঠে এলেই সিন্দুকের রহস্যটা বোঝা যাবে।
ফ্রান্সিস আবার হাতুড়ি চালাল। লোহার লম্বা পাতটা আরো খুলল। পরপর দু’তিনটে হাতুড়ির ঘায়ে লোহার পাতটা উঠে এলো। দেখা গেল একটা রুপোর চাবি সিন্দুকের গায়ে আটকানো। তার নীচেই একটা চাবির ফুটো। ফ্রান্সিস চাবিটা খুলে নিল। তারপর, ফুটোয় চাবিটা ঢোকাল। ডান দিকে চাপ দিয়ে ঘোরাতেই কট করে একটা শব্দ হলো। সিন্দুকের ডালা খুলে গেল। ডালাটা আটকাবার আগেই চারটে স্বর্ণমুদ্রা পাথরের মেঝেয় পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ডালাটা সজোরে চেপে বন্ধ করল। যাতে আর কিছু দামি জিনিস বেরিয়ে না আসে। চাবি ঘুরিয়ে ডালা বন্ধ করে সে চারটে সোনার চাকতি কোমরে গুঁজল। খাদের ওপরে তাকিয়ে দেখল অনেক লোক জমে গেছে। দু-তিনজন। লোক ফ্রান্সিসের কাছে এলো। একজন বলল, সিন্দুক থেকে সোনার চাকতি পড়ল দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর সঙ্গীরাও বলে উঠল, হা, হ্যাঁ, আমরাও দেখেছি।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, ভাই, ওগুলো স্বর্ণমুদ্রা। আমার কোমরের ফেট্টি থেকে কী করে খুলে পড়ে গেছে। তোমরা সেই স্বর্ণমুদ্রাই দেখেছো। ওরা ঠিক বিশ্বাস করল না। তবে এই সোনার চাকতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। চারপাশের কিছু লোক এগিয়ে এলো। জটলা চলল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে ডাকল, বারাকা, কাছে এসো। বারাকা কাছে এলো। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল, তুমি ঘোড়ায় চড়ে এক্ষুণি আলতোয়াইফের কাছে যাও। বলবে, আমরা আমীরের গুপ্তধন আবিষ্কার করেছি। উনি যত শীঘ্র সম্ভব একদল সৈন্য নিয়ে যেন এখানে আসেন। যাও–জলদি।
ফ্রান্সিস সিন্দুকটার পাশে মেঝের বসে পড়ল। চাবিটা সিন্দুকের নীচে ঠেলে দিল। যে ভয়টা ফ্রান্সিস করছিল, এখন ঘটনা সেদিকেই মোড় নিল। সিন্দুকটা থেকে সোনার চাকতি বেরিয়েছে–খবরটা দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। চার পাঁচজনের একটি দল খাদে নেমে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। একজন বলল, আমরা দেখছি তুমি চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলেছিলে।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, ভুল দেখেছিলে, চাবিটা লাগেইনি।
অন্যজন বলল, আমরা দেখেছি সিন্দুক থেকে সোনার চাকতি গড়িয়ে পড়েছে।
ফ্রান্সিস আবার হেসে বলল, ভুল দেখেছো। আমার কোমরের ফেট্টি থেকে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা পড়ে গিয়েছিল।
আর একজন বলল, তুমি চাবি দিয়ে সিন্দুক খুলেছিলে?
না, সেই চাবিতে সিন্দুক খোলেনি। ফ্রান্সিস বলল।
আর একজন চড়া গলায় বলল, ঠিক আছে, তুমি চাবিটা দাও, আমরা দেখবো সেই চাবিতে সিন্দুক খোলে কিনা।
ফ্রান্সিস এরকম কিছু আগেই আন্দাজ করেছিল। হেসে বলল, সেই চাবি তো আমার কাছে নেই। এখানকার আলতোয়াফের কাছে লোক মারফৎ পাঠিয়ে দিয়েছি।
চড়া মেজাজের লোকটি বলল, না। তুমি মিথ্যে কথা বলছে। চাবিটা তোমার কাছেই আছে।
ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে হেসে বলল, ঠিক আছে, আমাকে তল্লাশি করো। চড়া মেজাজের লোকটি এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিসের পোশাক, কোমর সব দেখল। চাবি পাওয়া গেল না। ফ্রান্সিস আগেই ভেবেছিল জড়ো হওয়া লোকগুলো যদি চাবি পেয়ে সিন্দুক খোলে, সব ধনভাণ্ডার অল্পক্ষণের মধ্যেই লুঠ হয়ে যাবে। নিরস্ত্র ফ্রান্সিস কিছুই করতে পারবে না।
ফ্রান্সিস বারবার রাস্তার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু আলতোয়াইফ আসছেন না। এবার দলে দলে লোকজন খাদে নেমে আসতে লাগল। সিন্দুকটার গায়ে হাত দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস কাউকে বাধা দিল না। বাধা দিলে ওদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে, নিশ্চয়ই সিন্দুকের দামি কিছু আছে।
ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। হঠাৎ দেখল ধুলো উড়ছে। অশ্বারোহী সৈন্যদল আসছে। সামনে আলতোয়াইফ আর বারাকা।
সবাই খাদের কাছে এসে থামল। আলতোয়াইফ খাদে নেমে ফ্রান্সিসের কাছে এলেন। সিন্দুকটা দেখিয়ে বললেন, এটাতে কি গুপ্তধন আছে?
ফ্রান্সিস বলল, ঠিক বলতে পারবো না। সিন্দুকটা আপনার প্রাসাদে গিয়ে খুলতে হবে। তখন দেখা যাবে এই সিন্দুকেই গুপ্তধন রাখা হয়েছিল কিনা।
–আমার মনে হয় এই সিন্দুকের মধ্যে কিছু পুরনো দলিল-দস্তাবেজ আছে। আলতোয়াইফ বললেন।
–তাও হতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।
আলতোয়াইফ সৈন্যদের দলনেতাকে ডাকলেন। সে কাছে এলে বললেন, একটা ঘোড়ায়টানা গাড়ি জোগাড় করো। এই সিন্দুকটা গাড়িতে তুলে আমার প্রাসাদে নিয়ে এসো। সিন্দুকটা মহাফেজখানায় রাখবে।
আলতোয়াইফ এসে ঘোড়ায় উঠলেন। ফ্রান্সিসরাও এসে ঘোড়ায় উঠল। কিছু সৈন্য দলনেতার কাছে রইল, সিন্দুক গাড়িতে তুলে নিয়ে আসবে বলে।
সবাই চলল নতুন প্রাসাদের দিকে।
সন্ধের আগেই সিন্দুকটা এনে মহাফেজখানায় রাখা হলো। ফ্রান্সিস আর বারাকা প্রাসাদের বাইরের ঘরটায় বসেছিল। সিন্দুক রাখার পর ফ্রান্সিস বারাকাকে বলল, আলতোয়াইফকে বলো আমি তার সামনেই সিন্দুকটা খুলব। বারাকা একজন দ্বাররক্ষী মারফৎ এই আর্জি জানাল আতলোয়াইফকে। দ্বাররক্ষী কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, উনি তোমাদের মহাফেজখানায় যেতে বলেছেন।
ফ্রান্সিস আর বারাকা মহাফেজখানায় চলল। ফ্রান্সিস চাবিটা সিন্দুকের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। একসময় সকলের অলক্ষ্যে চাবিটা তুলে নিয়ে কোমরে গুঁজে রেখেছিল।
ওরা মহাফেজখানায় এলো। মশালের আলোয় দেখল আলতোয়াইফ দাঁড়িয়ে আছেন। ফান্সিসদের দেখে বললেন, সিন্দুক খোলার জন্যে এত তাড়াহুড়ো করছো কেন?
ফ্রান্সিস এবার কোমরের ফেট্টি থেকে চারটে সোনার চাকতি খুলে আলতোয়াইফের দিকে এগিয়ে ধরল। আলতোয়াইফ বেশ চমকে উঠলেন। ফ্রান্সিসসের মুখের দিকে তাকালেন।
ফ্রান্সিস বলল, এই সোনার চাকতিগুলো ঐ সিন্দুক থেকেই গড়িয়ে পড়েছিল।
আলতোয়াইফ সোনার চাকতি ক’টা হাতে নিলেন। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন।
ফ্রান্সিস বলল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সিন্দুকেই গোপনে রাখা হয়েছিল ইবন আবি আমীরের ধনভাণ্ডার।
আলতোয়াইফ সায় দিয়ে বললেন, আমার এখন তাই মনে হচ্ছে। এবার সিন্দুকটা খোল তো।
ফ্রান্সিসে সিন্দুকের সামনে এলো।
সিন্দুকের ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরাল। কিছু সোনার চাকতি নীচে ডালার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। এবার ফ্রান্সিস এক হ্যাঁচকা টানে ডালাটা খুলে ফেলল। মুঠো মুঠো সোনার চাকতি মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল।
মশালের আলোয় ঝকঝক করতে লাগল সোনার চাকতিগুলো। সিন্দুকের নীচের তাকটায় চেপে ভরা ছিল চাকতিগুলো। এবার ওপরের তাকেও দেখা গেল হীরে, মণিমুক্তোর কত অলংকার। মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল মণি-মাণিক্যগুলো। তিনজনেই হাঁ করে তাকিয়ে রইল সেই দিকে।
কিছু পরে আলতোয়াইফ বললেন, সিন্দুক বন্ধ করো। ফ্রান্সিস আর বারাকা মেঝে থেকে সোনার চাকতিগুলো তুলে সিন্দুকে চেপে চেপে ভরল। তারপর ফ্রান্সিস সিন্দুকের ডালা বন্ধ করে রুপোর চাবিটা আলতোয়াইফকে দিল। বলল, মাননীয় মহাশয়, কাজের সুবিধের জন্য আমি এই দেশের পোশাক পরে আছি। আসলে জাতিতে আমি ভাইকিং। আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের নিয়ে ক্যামেরিনাল বন্দর শহর হয়ে হুয়েনভা বন্দরে জাহাজ চালিয়ে এসেছিলাম। সেখানে আমাদের বন্দি করা হয়। রাজা ফার্নান্দো সন্দেহ করেছিলেন আমরা তার ভাই ক্যামেরিনালের রাজা গার্সিয়ার গুপ্তচর। আমার বন্ধুদের সেভিল্লা নগরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল, রাজা ফার্নান্দোর অনুমতি নিয়ে আমি ইবন আমীরের গুপ্তধন উদ্ধার করেছি। এবার আমার স্ত্রী আর বন্ধুদের মুক্তির ব্যবস্থা আপনি করুন।
বারাকা বলল, এইইবন আমীরের গুপ্তধনের হদিস আমার বাবা জানেন, এই সন্দেহে আমার বাবাকেও সেভিল্লায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। আপনি তারও মুক্তির ব্যবস্থা করুন।
আলতোয়াইফ বললেন, কাল ভোরে এই সিন্দুকের গুপ্ত ধনভাণ্ডার নিয়ে আমি সেভিল্লায় যাবো। রাজা ফার্নান্দোকে দেব ধনসম্পদ আর তোমাদের কথা বলবো।
পরের দিন ভোরে আলতোয়াইফের সঙ্গে ফ্রান্সিস আর বারাকা ঘোড়ায় চড়ে চলল। ঘোড়ায় টানা গাড়িতে সিন্দুকটাও নিয়ে চলল।
তখনও রাজদরবার শুরু হয়নি। আলতোয়াইফের নির্দেশে সিন্দুকটা রাজদরবারের মাঝখানে রাখা হলো।
রাজা ফার্নান্দো রাজদরবারে এলেন। সিংহাসনে বসে আলতোয়াইফকে তার সামনে আসার অনুমতি দিলেন। আলতোয়াইফ সামনে এগিয়ে গিয়ে রাজাকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজা ফার্নান্দো বললেন, আপনার পাঠানো দূত মারফৎ কাল রাতেই আমি জানতে পেরেছি ইবন আবি আমীরের গুপ্ত ধনভাণ্ডার আবিষ্কার করা হয়েছে।
আলতোয়াইফ পেছন ফিরে ফ্রান্সিসকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করলেন। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে দাঁড়াল। আলতোয়াইফ ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বললেন, এই যুবকটিই নিজের উ. বুদ্ধিকৌশলে গুপ্তধন আবিষ্কার করেছে।
রাজা ফ্রান্সিসকে বললেন, বলো এর পুরস্কার হিসেবে তুমি কী চাও এই গুপ্ত সম্পদের কিছু অংশ যদি তুমি চাও অবশ্যই তা পাবে।
ফ্রান্সিস বলল, মহামান্য রাজা, আমি অর্থসম্পদ চাই না। আমি চাই আমার স্ত্রী ও বন্ধুদের মুক্তি দেওয়া হোক। বারাকার বাবাকেও মুক্তি দেওয়া হোক।
রাজা ফার্নান্দো সেনাপতিকে ডাকলেন। কিছু আদেশও দিলেন। সেনাপতি ফ্রান্সিসের কাছে এসে বলল, আমার সঙ্গে এসো।
তখন আলতোয়াইফ সিন্দুকটা খুলছেন। রাজদরবারের সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সিন্দুকটার দিকে।
সেনাপতি বন্দিশালার সামনে এল।ফ্রান্সিসকে বলল, তোমার বন্ধুদের বলো বেরিয়ে আসতে। সেনাপতির ইঙ্গিতে প্রহরীরা বন্দিশালার লোহার দরজা টং টং শব্দে খুলে দিল।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব, তোমরা মুক্ত। বাইরে এসো।
ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে বাইরে এলো। প্রহরীরা ওদের হাতের বাঁধন কেটে দিতে লাগল। ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো।
দেখা গেল রাজপ্রাসাদের দিক থেকে একজন পরিচারিকা মারিয়াকে নিয়ে আসছে। মারিয়ার আর তর সইছিল না। মারিয়া হাসতে হাসতে প্রান্তরটা ছুটে পার হয়ে ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। তখনও হাঁপাচ্ছে, মারিয়াকে সুস্থ দেখে ফ্রান্সিস খুশি হলো।
মারিয়া আসতেই আবার ভাইকিংদের ধ্বনি উঠল–ও-হো-হো। ফ্রান্সিস বলল—এবার হুয়েনভা চলো—আমাদের জাহাজে।