রূপোর চাবি – ৩

ঘোড়ায় বসা দলপতিকে শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, আপনি আমাদের বন্ধুকে মারলেন কেন? ও তো ধরা পড়তই। তবে কেন ওকে মেরে ফেললেন?

দলপতি বলল, এইরকম মৃত্যু দেখে আর কেউ পালাতে যাবে না।

শাঙ্কো আর অন্য বন্ধুরা মৃত বন্ধুটির কাছে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তার মুখের দিকে চেয়ে কেঁদে ফেলল। অন্য বন্ধুদের চোখেও জল এলো। ততক্ষণে হ্যারি ছুটে এসেছে। মৃত বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যারি কেঁদে ফেলল। জলে-ভেজা চোখে দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের নিরস্ত্র বন্ধুটিকে এভাবে হত্যা করলেন কেন? ও তো আপনাদের কাউকে আক্রমণ করেনি।

দলপতি বলল, ওসব বলে লাভ নেই। কাউকে পালাতে দেখলেই মেরে ফেলবো। চলো সব, দলে ঢোকো।

–না, বন্ধুটি শেষকৃত্য না করে আমরা যাবো না। হ্যারি বলল।

দলপতি খোলা তলোয়ার শূন্যে ঘুরিয়ে বলল, সবাই দলে যাও। আজ সন্ধের আগেই আমাদের সেভিল্লে পৌঁছেতে হবে।

হ্যারি চেঁচিয়ে বলল, না, আমাদের মৃত বন্ধুকে ফেলে আমরা যাবো না।

সব ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো।

 দলপতি ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, আমি যা বলবো তাই মানতে হবে। নইলে সবকটাকে মেরে ফেলবো।

শাঙ্কো, বিস্কো ছুটে দলনেতার সামনে এলো। শাঙ্কো চিৎকার করে বলল, মারুন আমাদের।

সব ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো।

দলপতি বেশ ঘাড়বে গেল। বুঝল, এরা এত ক্রুদ্ধ হয়েছে যে মরবে জেনেও খালি হাতে তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে ইতস্তত করবে না। তারা মাত্র চারজন। কেউই রেহাই পাবে না।

রূপোর চাবি দলপতি ডান হাত ওঠাল। ভাইকিংদের চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ হলো। দলনেতা বলল, তোমরা কী চাও?

হ্যারি বলল, আমরা আমাদের মৃত বন্ধুর শেষকৃত্য করে তবে যাবো।

তার মানে বন্ধুকে কবর দিয়ে যাবে, এই তো? দলপতি বলল।

–হ্যাঁ। তার আগে আমরা এখান থেকে নড়বো না। হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে, কোথায় কবর দেবে দেখো। দলনেতা বলল।

ভাইকিং বন্ধুরা এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল এমন জায়গা যেখানে মাটি না খুঁড়েও পাথর চেপে সাজিয়ে কবর দেওয়া যায়। ভাইকিংরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল।

দলনেতা চিৎকার করে বলে উঠল, কেউ পালাবার চেষ্টা করলে বন্ধুর দশা হবে।

একজন ভাইকিংহ্যারিকে ডেকে বলল, হ্যারি, এই জায়গাটা দেখো তো।হ্যারি সেদিকে গেল। দেখল জায়গাটা ছোটো গুহার মতো। হ্যারি ভেবে দেখল এখানে কবর দেওয়া যেতে পারে। সে শাঙ্কোদের বলল সে কথা।শাঙ্কোরা পাঁচ-ছ’জন মিলে গেল বন্ধুর মৃতদেহের কাছে। দেহটা কাঁধে করে নিয়ে এসে আস্তে আস্তে গুহার কিছুটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। হাতে হাতে পাথরের বড়ো বড়ো টুকরো এনে মৃতদেহের ওপর চাপিয়ে দিল। বন্ধুর কবরের দিকে তাকিয়ে অনেকেই কেঁদে ফেলল। এই বিদেশে এক অপরিচিত পরিবেশে ওরা এক বন্ধুকে হারাল। তখনই হ্যারি শুনল ফ্রান্সিসের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর, হ্যারি, তোমরা কোনো কিছুর প্রতিবাদ করো না। হ্যারি বুঝল ঐ ঝুঁকে পড়া পাথরের চাঙড়ের ওপাশ থেকেই কথাটা ভেসে এলো। হ্যারি চিৎকার করে ওদের দেশীয় ভাষায় বলল, ভাইসব, ফ্রান্সিস। আমাদের কাছাকাছিই আছে। কোনো ভয় নেই। ভাইকিং বন্ধুরা ধ্বনি তুলল, ও-হো-হো। দলপতি হ্যারির কথা কিছুই বুঝল না। ওরা কেন ধ্বনি তুলল তাও বুঝল না।

ফ্রান্সিস আবার চাপাস্বরে বলল–বন্ধুর মৃত্যুতে আমি শোকাহত। কেঁদেছি। এখন তোমাদের উত্তেজিত হওয়া চলবে না। এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে চিন্তা করে বুদ্ধি দিয়ে সব ভাবতে হবে। তারপর পালাতে হবে।

ওদিকে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে হ্যারিরা যখন রাজা ফার্নান্দোর দলপতি ও তিনজন সৈন্যের পাহারায় সেভিল্লোর দিকে যাত্রা শুরু করল, তখন থেকেই কিছুটা দূরত্ব রেখে ফ্রান্সিসও ওদের পেছনে পেছনে আসতে লাগল।

রাস্তায় সেভিল্লো থেকে আসা লোকজন ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে আসছে দেখা গেল। এদিক থেকেও লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া যাচ্ছে।

রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা আসার পর ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল একটি লোক হ্যারিদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে হেঁটে চলেছে। লোকটি কখনো হ্যারিদের দলের কাছে যাচ্ছে। না বা ওদের পার হয়েও যাচ্ছে না। ফ্রন্সিস বুঝল লোকটি ওর মতোই এই বন্দি দলকে অনুসরণ করছে। লোকটির পরনে চাষির পোশাক। গায়ে ঢোলাহাতা জামা। ফ্রান্সিস বুঝল ঐ লোকটির কোনো বন্ধু বা আত্মীয় এই বন্দিদের মধ্যে রয়েছে। একবার ভাবল লোকটির সঙ্গে পরিচিত হবে। জানবে সে এই বন্দিদের পেছনে পেছনে যাচ্ছে কেন। পরক্ষণেই ফ্রান্সিস ভাবল আরো কিছুদূর যাই। দেখি ও আমার মতোই বন্দিদের অনুসরণ করছে কিনা।

রূপোর চাবি বন্দির দল চলেছে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে ফ্রান্সিসও চলেছে।

হ্যারিরা থেমে যে গ্রাম থেকে জল খেল, ফ্রান্সিসও সেখানে জল খেল। ও কিছুটা জলে মাথা ভেজাল, হাতমুখ ধুল। কাঁধে গলায় যখন জল ছিটিয়ে দিচ্ছে তখনই দেখল সেই সাদা ঢোলাহাতা জামাপরা লোকটা ইঁদারার ধারে এলো। ফ্রান্সিস এবার ভালো করে লোকটাকে দেখল। লোকটা বয়েসে ফ্রান্সিসের চেয়ে ছোটো। ফ্রান্সিস জল তোলার পাত্রটা লোকটির হাতে দিয়ে বলল, যা গরম, কিছুতেই তেষ্টা মিটছে না। লোকটি বলল, ঠিকই বলেছেন। চড়া রোদ, ধুলোবালির ঝাপটা, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। তৃষ্ণার্ত লোকটা আগে জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটাক। লোকটা প্রথমে পাত্রের জল সমস্তটাই মাথায়-ঘাড়ে ঢালল। আবার জল তুলল। কপাল মুখ ধুয়ে ঢক ঢক করে জল খেল। আবার জল তুলে খেল। সবটা জল খেতে পারল না। জামার বোতাম খুলে গলায় বুকে জলটা ছিটিয়ে দিল।

ফ্রান্সিস এবার বলল, তুমিও কি সেভিল্লা যাচ্ছো?

–হ্যাঁ। লোকটি বলল। তারপর ফ্রান্সিসকে আর ওর পোশাক দেখে বলল, মনে হচ্ছে তুমি বিদেশি।

–হ্যাঁ। বলল ফ্রান্সিস।

–তোমাদের দেশ কোথায়? লোকটি জিজ্ঞাসা করল।

–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।

-বলো কি! তোমাদের জাহাজ চালানোর দক্ষতার কথা, বীরত্বের নানা কাহিনী আমরা শুনেছি।

ফ্রান্সিস বলল, চলো রাস্তায় নামি। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে।

বেশ, চলো। লোকটি বলল।

দু’জনে রাস্তায় এলো। ফ্রান্সিস দেখল হ্যারিরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল, ভাই, একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও। কথাটা বলে ফ্রান্সিস জোরে হাঁটতে লাগল। লোকটিও ফ্রান্সিসের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে লাগল।

একটু পরেই দু’জনে বন্দির দলের কাছাকাছি এলো।ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটিও দাঁড়িয়ে পড়ল। দু’জনেই বেশ হাঁপাচ্ছে তখন।

আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে লোকটি বলল, দেশ ছেড়ে এই স্পেনে এসেছো কেন?

–নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে তাই। ফ্রান্সিস বলল।

–সেভিল্লা যাচ্ছো কেন?

–দেখো, ঐ বন্দি দলে আমার ভাইকিং বন্ধুরা রয়েছে। ওদের বিচারের জন্যে সেভিল্লায় রাজা ফার্নান্দোর দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি যাচ্ছি যদি কোনো উপায়ে বন্ধুদের মুক্ত করা যায় তার জন্যে।

আমার ব্যাপারটাও তাই। লোকটি বলল, তুমি বন্ধুদের উদ্ধার করতে যাচ্ছো, আমি শুধু আমার বাবাকে মুক্ত করতে যাচ্ছি।

আগে তোমার নামটা বলো, তারপর সমস্ত ঘটনাটা বলো তো। ফ্রান্সিস বলল। লোকটি বলল, আমার নাম বারাকা। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে গেলে এই দক্ষিণ স্পেনের কিছুটা ইতিহাস তোমায় বলতে হয়। একটু থেমে বারাকা বলতে লাগল, প্রায় একশো বছর আগে এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন খলিফা ইবন আবি আমীর। তার রাজত্বে রাজধানী ছিল কারডোভা। সেভিল্লা থেকে বেশ কিছুটা দূরে। খলিফা ইবন আবি আমীর কারডোভা থেকে কিছুদূরে নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। বারাকা থামল। তারপর বলতে লাগল, খলিফা বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন। আমাদের একজন পূর্বপুরুষ তার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। উত্তর স্পেনের এক রাজা কারডোভা আক্রমণ করেছিলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে খলিফা নিহত হন। তখন জয়ী রাজা খলিফার ধনভাণ্ডারের খোঁজ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে রাজা আর তার অমাত্যরা পুরোনো প্রাসাদ, নতুন প্রাসাদের কোষাগার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাননি। বারাকা থামল।

-তারপর? ফ্রান্সিস বলল।

–আমাদের পূর্বপুরুষ বিপদ আঁচ করে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন। খলিফা আমীরের ধনসম্পদের খোঁজও পেল না কেউ। বারাকা থামল।

–আচ্ছা, মৃত্যুর পূর্বে খলিফা কি কাউকে বলে গিয়েছিলেন তার ধনসম্পদ তিনি কোথায়, কার জন্যে রেখে যাচ্ছেন? ফ্রান্সিস বলল।

–না, খলিফা আমীর কাউকে কিছু বলে যাননি।

–কোনো চিহ্ন, কোনো-নকশা, কোনো চিঠি? ফ্রান্সিস জিগ্যেস করল।

–না, এসব কিছুই কেউ পায়নি। বারাকা বলল।

 ফ্রান্সিস দ্রুত চিন্তা করতে লাগল-খলিফা আমীর কোথায় গোপনে রেখে যেতে পারেন তার ধনসম্পদ? আচ্ছা, এওতো হতে পারে–ফ্রান্সিস ভাবল, ধনসম্পদ যেখানে থাকার কথা সেখানেই রেখে গেছেন অর্থাৎ রোজকোষাগারে। কিন্তু কোন্ রাজপ্রাসাদের কোষাগারে? নতুন যে প্রাসাদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন, না পুরনো রাজপ্রাসাদ? ফ্রান্সিস ভেবে দেখল এটা একটা অনুমান মাত্র। সঠিক বুঝতে গেলে পুরনো নতুন দুটো রাজপ্রাসাদই খুঁটিয়ে দেখতে হবে।

দু’জনে হাঁটতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল, তোমার বাবাকে বন্দি করা হয়েছে কেন?

আমাদের পূর্বপুরুষ আমীরের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। রাজা ফার্নান্দোর কেমন বিশ্বাস হয়েছে ইবন আবি আমীর নিশ্চয়ই আমাদের পূর্বপুরুষকে কোনো সঙ্কেত-নকশা বা সূত্র দিয়ে গেছেন তার গুপ্তধনের।

সত্যি কি তোমাদের পুরুষানুক্রমে সংগৃহীত জিনিসের মধ্যে তেমন কিছু আছে? ফ্রান্সিস বলল।

 কিচ্ছু না। রাজা ফার্নান্দোর এই দলপতি আমাদের হুয়েনভার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কিছুই পায়নি। এবার সেভিল্লায় আমাদের বাড়ি তল্লাশি হবে। জানি না কিছু না পেলে বাবাকে মুক্তি দেবে কিনা। বারাকা বলল।

ফ্রান্সিস বলল, বুঝলে বারাকা, সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে চিন্তা করতে হবে। কিছু– কিছু জায়গা দেখতে হবে। তবেই আমি বলতে পারবো খলিফা ইবন আবি আমীরের গুপ্ত ধনভাণ্ডারের হদিস পাওয়া যাবে কিনা।

বিকেল হলো। রোদের তেজ কমল। দলপতি হ্যারিদের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিল, তোমরা বাঁ দিকের ঐ জঙ্গলটার কাছে বসে বিশ্রাম নাও। আমি একটু গ্রামটা ঘুরে আসি। হুকুমমতো হ্যারিরা রাস্তা থেকে নেমে চলল জঙ্গলটার দিকে। জঙ্গলের গাছের ছায়ায় বসল হ্যারিরা। কেউ কেউ ঘাসের জমিতে শুয়ে পড়ল। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায়-পথশ্রমে ক্লান্ত হ্যারিরা বিশ্রাম করতে লাগল।

কয়েকটা কাঠ আর পাথর দিয়ে তৈরি বাড়ি। ওটাই একটা গ্রাম। দলপতি ঐ বাড়িগুলোর কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামল। প্রথম যে বাড়িটা পড়ল তার দরজায় আঙুল দিয়ে টোকা দিল। দরজা খুলে গেল। দেখা গেল একজন বুড়ি দাঁড়িয়ে। বুড়ি ফোকলা মুখে হাসল। বলল, কী চাইছেন?

দলনেতা বলল, রান্না করা কিছু খাবার আছে?

রান্না করা খাবার তো দুপুরেই খাওয়া হয়ে গেছে। বুড়ি বলল।

–পিঠে-টিঠে এমন কিছু নেই? দলনেতা জিগ্যেস করল।

-হ্যাঁ, আছে। আজকে আমার নাতির জন্মদিন। তাই বেশ কিছুপিঠে তৈরি করেছি। গাঁয়ের লোকজনকে নেমন্তন্ন করেছি। বুড়ি বলল।

–পিঠে কোথায়? নিয়ে এসো। দলপতি বলল।

 বুড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকল। একটু পরে একটা কাঠের পাত্রে পিঠে নিয়ে এলো। দলনেতা আট-দশটা পিঠে ওখানে দাঁড়িয়েই খেয়ে নিল। তারপর জামার হাতার ভেতর থেকে একটা রুমাল বের করে বেশ কিছু পিঠে রুমালে বেঁধে নিল। বাড়িটার বাইরে এসে ঘোড়ায় উঠে সে আবার জঙ্গলটার কাছে ফিরে এলো। এসে অন্য সৈন্যদের হাতে পিঠে-বাঁধা রুমালটা দিল। দলপতি নিজে ও সৈন্যরা পিঠে খেতে লাগল।

হ্যারিরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল ওদের পিঠে খাওয়া। পিঠে খাওয়া শেষ করে দলপতি হাত ঝাড়ল। হ্যারি আশা করেছিল হয়তো এক-আধটা পিঠে ওদের দেবে। হ্যারি নিজের জন্যে চায় না। ক্ষুধার্ত মারিয়ার কষ্টের কথাই ভাবছিল।

ফ্রান্সিস আর বারাকা দূর থেকে দলপতি আর সৈন্যদের পিঠে খাওয়া দেখল। বারাকা বলল, চলো ঐ বাড়িটায়। কিছু খাবার নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, আমার বন্ধুরা এখনও উপবাসী। আমি কিছু খাবো না। তুমি খেয়ে এসো।

বারাকা তখন ক্ষুধায় অস্থির। ও ছুটল সেই বাড়িটার দিকে, যে বাড়িটায় দলপতি ঢুকেছিল। ফ্রান্সিস রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে বারাকা রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এলো। হেসে বলল, এক বুড়ি তার নাতির জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্যে পিঠে তৈরি করে রেখেছিল। দলপতি অনেক পিঠে খেয়েছে, নিয়েও এসেছে। বাকি পিঠেগুলো আমিই সাবাড় করে এলাম।

তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। পিঠে খেয়ে পরিতৃপ্ত দলপতি ও সৈন্যরা ঘোড়ায় উঠল। দলপতি গলা চড়িয়ে বলল–এবার চলো সবাই। শাঙ্কোরা সকলেই বনের কাছে ঘাসের ওপর শুয়ে বসেছিল।

শাঙ্কো দলপতিকে বলল–আমরা অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। এখনও খাওয়া জোটে নি। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যাবো।

–না-না–দলপতি মাথা নেড়ে বলল–আমাদের তাড়াতাড়ি সেভিল্লানগরে পৌঁছতে হবে।

–তাহলে আপনারা আগে সেভিল্লানগরে চলে যান। আমরা পরে যাচ্ছি। বিস্কো বলল।

ইয়ার্কি হচ্ছে না? দলপতি বলল–এক্ষুণি তলোয়ারের এক ঘায়ে মাথা উড়িয়ে দিতে পারি।

–তা পারেন। আমাদের বন্ধুকেও মেরেছেন–এজন্যে আপনার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বেশ তারিয়ে তারিয়ে পিঠে খেলেন। শাঙ্কো বলল।

ভালো করেছি–দলপতি বলল। তারপর বলল ঠিক আছে আর আধঘণ্টা সময় দিচ্ছি। তারপর আর দেরি করা চলবে না। সেভিল্লানগরে যেতে হবে।

—-বেশ–তাই হবে। শাঙ্কো বলল।

 আসলে শাঙ্কো চাইছিল আরো অন্ধকার নামুক।

 চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো।

এবার শাঙ্কো হ্যারির কাছে এলো। ফিসফিস্ করে বলল–আমার গলার কাছে। জামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আমার ছোরাটা বের করো। শাঙ্কো বলল–ছোরা ঘষে ঘষে আমার হাতে বাঁধা দড়িটা কাটো।

হ্যারি ছোরাটা কোনোরকমে ধরে শাঙ্কোর হাত বাঁধা দড়িটা ঘষে ঘষে কাটতে লাগল। একটু পরেই দড়ি কেটে গেল। শাঙ্কো এবার ছোরাটা হাতে নিল। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সবাইর হাতের দড়ি কাটল।

তখনই দলপতি চেঁচিয়ে বলে উঠল–অনেক বিভ্রাম হয়েছে–এবার ওঠো চলো।

অন্ধকারের মধ্যে শাঙ্কো বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল দলপতির ঘোড়াটার কাছে। দলপতি কিছু বোঝার আগেই শাঙ্কো ছোরার এক পোঁচে ঘোড়ার জিন-এর চামড়ার ফিতেটা কেটে ফেলল। জিন খুলে মাটিতে পড়ে গেল। দলপতিও মাটিতে ছিটকে পড়ল। শাঙ্কো এক লাফে দলপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর দ্রুত ছোরাটা দলপতির বুকে বসিয়ে দিল। দলপতির গলা থেকে শব্দ হল–আঁক। দলপতি বারকয়েক মাথা এপাশ-ওপাশ করে স্থির হয়ে গেল। দলপতি মারা গেল। ছোরাটা খুলে নিয়ে ছোরাটা ডানহাতে উঁচু করে ধরে শাঙ্কে চিৎকার করে উঠল–বন্ধুহত্যার প্রতিশোধ নিলাম। ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো।

শাঙ্কো অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করে বলল–বিস্কো–ফ্লেজার–বাকি সৈন্যদের আহত করো। পালাতে দিও না। দলপতির হাত থেকে ছিটকে পড়া তলোয়ারটা বিস্কো তুলে নিল। ছুটল একজন সৈন্যের দিকে। সৈন্যটি তলোয়ার চালাবার আগেই বিস্কো সৈন্যটির উরুতে তলোয়ারের ঘা বসাল। সৈন্যটি লাফিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে গেল। আহত উরু ধরে ও গোঙাতে লাগল।

ওদিকে সাত-আটজন ভাইকিং একটা সৈন্যকে ঘিরে ফেলল। সৈন্যটি ঘোড়ার দু’পা উঁচু করাতে লাগল। ভাইকিংরা সরে সরে যেতে লাগল। এবার বিস্কো তলোয়ার হাতে ছুটে এসে ঘোড়াটার কোমরে তলোয়ারের কোপ বসাল। ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠল। সৈন্যটি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল।

অন্য সৈন্যটি অবস্থা বেগতিক দেখে জোরে ঘোড়া ছোটাল। কয়েকজন ভাইকিংও ছুটল ঘোড়াটার পেছনে পেছনে। কিন্তু ঘোড়ার দ্রুত গতির সঙ্গে ভাইকিংরা পারবে কেন? অল্পক্ষণের মধ্যেই সৈন্যটি ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল।

অন্ধকারে হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব–আমরা এখনও বিপদমুক্ত নই। যে সৈন্যটি পালিয়ে গেল সে নিশ্চয়ই সেভিল্লায় গিয়ে সংবাদ দেবে। আরও সৈন্য আমাদের আক্রমণ করতে আসবে। এখন আমরা কী করবো সেটা ভেবে ঠিক করতে হবে।

শাঙ্কো বলল–এখন আমরা তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত। বেশি দূর যেতে পারবো না। এই বনের মধ্যেই আমরা আত্মগোপন করে থাকবো।

কিন্তু ঐ সৈন্যটি সেভিল্লা গেল। ওদের সেনাপতি সৈন্যদের নিশ্চয়ই এখানে নিয়ে আসবে। এবার ওরা চারদিকে আমাদের খুঁজে বেড়াবে। এই জঙ্গলেও ওরা নিশ্চয়ই তল্লাশি চালাবে। আমরা আবার ধরা পড়বো। হ্যারি বলল।

–কিন্তু এখন এই বনে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। তারপর ভাগ্যে যা আছে হবে। শাঙ্কো বলল।

হ্যারি বলল–আমরা সারাদিন কিছু খাইনি। তিনটে ঘোড়া আমরা পেয়েছি। ঘোড়ায় চড়ে সেভিল্লা থেকেই হোক বা অন্য গ্রাম-ট্রাম থেকেই তোক কিছু খাবার আর জলের ব্যবস্থা তো করতে হয়।

-ঠিক আছে। আমি বিস্কো আর পেড্রো যাবো খাবার আর জলের খোঁজে। তোমরা বনের মধ্যে ঢুকে পড়ো। শাঙ্কো বলল।

হ্যারিরা বনের মধ্যে ঢুকে গেল। অন্ধকারে গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে চলল। বন খুব ঘন না। ছাড়া ছাড়া ওক গাছ চেস্টনাট গাছ। লতাপাতা। বড়ো বড়ো ফার্ন গাছ। একটা ফাঁকে জায়গা পেয়ে হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–তোমরা এখানেই বসো। শাঙ্কোদের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। সবাই ঘাসে ঢাকা মাটিতে বসল। কয়েকজন শুয়ে পড়ল।

হ্যারিও বসল। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। হ্যারি হাত পা ছেড়ে শুয়ে পড়ল। এটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

তখনই হঠাৎ দেখল উত্তরদিকে কিছু গাছগাছালির পরেই একটা টিলামতো। হ্যারি উঠে পড়ল।ডাকল–ফ্লেজার। ফ্লেজার এগিয়ে এলো।হ্যারিবলল–দ্যাখো তোওটা কী? ফ্লেজারও অন্ধকারের মধ্যে উঁচু টিলামতো দেখল। বলল–মনে হচ্ছে টিলা। খুব বড়ো নয়।

–চলো তো–দেখে আসি। হ্যারি বলল।

 –টিলা দেখে কী হবে। ফ্লেজার বলল।

ভুলে যেও না আমরা বন্দিদশা থেকে পালিয়েছি। এখনও আমাদের জীবন নিরাপদ নয়। প্রয়োজনে লুকিয়ে আশ্রয় নিতে পারি এমন জায়গা ওটা কিনা দেখতে হবে। চলো। হ্যারি বলল।

হ্যারি আর ফ্লেজার চলল টিলাটার দিকে। কাছে এসে অন্ধকারেও দেখল টিলাটা কালো ছায়ার মতো। ফ্লেজার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিলাটা দেখতে লাগল। হ্যারি টিলাটা চারদিক থেকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। পশ্চিম দিকে দেখল টিলাটার মধ্যে একটা ছোটোমুখ গুহার মতো। হ্যারি গুহামুখে এসে দাঁড়াল। দেখল ছোটো গুহামুখ দিয়ে একজন মানুষ হামা দিয়ে ঢুকতে পারে। কিন্তু কতদূর ঢুকে যেতে পারবে তা বোঝা যাচ্ছে না। হ্যারি বলল–ফ্লেজার-গুহার ভেতরে একটু যেতে পারবে?

–এটা না পারার কী আছে। ফ্লেজার বলল। তারপর এগিয়ে গেল গুহাটার দিকে। হামা দিয়ে গুহাটার ভেতরে ঢুকল। তখনই ঝটপট শব্দ তুলে একপাল চামচিকে গুহাটা থেকে বেরিয়ে এসে এদিক-ওদিক পালাতে লাগল। প্রথমে ফ্লেজার চমকে উঠল। পরক্ষণে একটু পিছিয়ে এসে গুহা মুখটা খোলা রাখল। চামচিকেগুলোরও বেরিয়ে আসতে অসুবিধে হল না।

এবার ফ্লেজার হামা দিয়ে ঢুকল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হামা দিয়ে চলল। হঠাৎ ওর মনে হল এখন গুহাটা বড়ো লাগছে। ফ্লেজার উঠে দাঁড়াল। বুঝল গুহার মুখটাই ছোটো। ভেতরটা অনেক বড়ো।

নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ফ্লেজার পাথুরে দেয়ালে হাত বুলোতে বুলোতে এগিয়ে চলল। হঠাৎ সামনে মনে হল নিরেট পাথর। ফ্লেজার হাত বাড়িয়ে দেখল এবড়ো খেবড়ো পাথরের দেয়াল যেন। ফ্লেজার বুঝল গুহাটা এখানেই শেষ।

ফ্লেজার ফিরে চলল। হামা দিয়ে গুহামুখ থেকে বের হল। তখন ও বেশ হাঁপাচ্ছে। হ্যারি এগিয়ে এলো। বলল–কী দেখলে?

–কিছুই না–একটা লম্বা বড়ো গুহা। মুখটা ছোটো হলে কি হবে ভেতরটা বেশ বড়ো। অনায়াসে হেঁটে এগোনো যায়। কিছুদূর গিয়ে গুহাপথ শেষ। সামনে নিরেট পাথুরে দেয়াল। ফ্লেজার বলল।

 দু’জনে বন্ধুদের কাছে ফিরে এসে বসল। বন্ধুরা জানতে চাইল হ্যারিরা কোথায় গিয়েছিল। হ্যারি টিলার কথা গুহার কথা বলল।

ওদিকে শাঙ্কো বিস্কো আর পেড্রো বড়ো রাস্তা ধরে ঘোড়ায় চড়ে চলল। কতকটা আন্দাজেই সেভিল্লানগরের দিকে চলল।

পাশে তিনটে গ্রাম পেল। বাড়িঘর ঘোর অন্ধকার। এসব গ্রামে একসঙ্গে অত খাবারদাবার পাওয়া যাবে না।

একসময় সেভিল্লানগরে এসে ওরা পৌঁছাল। নগরের নির্জন পথে পথে কোথাও কোথাও মশাল জ্বলছে। বাড়িঘরদোরে আলোর চিহ্নও নেই। সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। শাঙ্কো একটা সরাইখানা খুঁজছিল। ওদের কপাল ভালো। একটা সরাইখানা পেল। সরাইখানার মধ্যে মোমবাতির আলো জ্বলছে।

ওরা সরাইখানার বন্ধ দরজার সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামল। কাঠের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিল। দরজা খুলে গেল। মোমবাতির আলোয় দেখা গেল পাকা ও দাড়িগোঁফওয়ালা এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে দাঁড়াল। শাঙ্কো এগিয়ে গেল। বলল দেখুন–আমরা খুব দূর থেকে আসছি। আমাদের বন্ধুরা সেভিল্লার বাইরে অপেক্ষা করছে। আমরা ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পরিশ্রান্ত। আমাদের জন্যে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন?

–নিশ্চয়ই পিরবো। আপনারা ভেতরে আসুন। প্রৌঢ় বলল। শাঙ্কোরা সরাইখানার মধ্যে ঢুকল। দেখল কয়েকজন লোক একতাল ময়দা ঠাসছে। রুটি হবে। এবার প্রৌঢ় বলল–আপনারা সংখ্যায় ক’জন?

ছাব্বিশ জন। বিস্কো বলল।

–ঠিক আছে। এই ময়দা দিয়ে কালকে সকালের জন্যে রুটি তৈরি হবে। এখন আমরা দোকানের সেই খাবার করবো না। আপনাদের জন্যে রুটি করে দেব। লোকটি বলল।

–রুটির সঙ্গে মাংস করে দিতে পারেন? বিস্কো বলল।

-মাংস রাঁধতে দেরি হবে। আপনারা ক্ষুধার্ত। বেশি দেরি করা চলবে না। আলু আর আনাজপত্র দিয়ে একটা খাবার করে দিচ্ছি। এটা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

–ঠিক আছে। শাঙ্কো বলল। তারপর তিনজনে টানা কাঠের বেঞ্চে বসল।

প্রথমে রাঁধুনিরা রুটি তৈরি করল। একটা বুনো লতা দিয়ে তৈরি বেশ বড়ো ঝুড়িতে রুটি রাখল। এবার আলু আনাজপত্র দিয়ে তরকারিমতো করল। শাঙ্কো এগিয়ে এলো। বলল তরকারির ঝোলটা কমাও। ঘোড়ার পিঠে করে নিয়ে যেতে হবে। চলুকে না পড়ে।

রাঁধুনিরা কিছুক্ষণ তরকারিটা ফুটিয়ে ঝোল কমিয়ে আনল।

এবার শাঙ্কো প্রৌঢ় দোকানির কাছে এলো। কোমরের ফেট্টি থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে প্রৌঢ় দোকানদারকে দিল। বলল–এবার আমাদের এক পীপে জল দিন। প্রৌঢ় রাঁধুনিকে বলল–এক পীপে জলের ব্যবস্থা কবো। একজন রাঁধুনি চলে গেল।

শাঙ্কো প্রৌঢ়কে বলল–ঐ রুটির ঝুড়ি তরকারি রাখার কাঠের পাত্র আর জলের পীপে–সব আমরা নিয়ে যাবো। ফেরৎ দিতে পারবো কিনা–বলতে পারছি না। তবে স্বর্ণমুদ্রা দিলাম। এতেই আপনার সবকিছুর দাম উঠে যাবে। প্রৌঢ় খুশির হাসি হাসল।

এবার রাঁধুনি জলভরা পীপে নিয়ে এলো। শাঙ্কোরা দোকানের বাইরে এলো।

ওরা একটা ঘোড়ার পিঠে রুটির ঝুড়িটা রাখল। বিস্কো ঘোড়াটার পিঠে উঠে রুটির ঝুড়িটা ধরল। পেড্রো নিল জলের পীপেটা। ঘোড়ার পিঠে উঠে পীপেটা বাঁ হাতে চেপে ধরে ডানহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে রইল। শাঙ্কো অন্য ঘোড়াটায় উঠল। রাঁধুনিকে ডাকল। রাঁধুনিদের একজন এলো। শাঙ্কো বলল-তরকারির কাঠের পাত্রটা তুলি দিতে। রাঁধুনি পাত্রটা শাঙ্কোর হাতে তুলে দিল।

তিনজনে খাবার আর জল নিয়ে অন্ধকারে সদর রাস্তা দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে চলল।

কিছুক্ষণ চলার পর পেড্রো বলল–এভাবে চললে তো পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

–উপায় নেই। এর চেয়ে জোরে ঘোড়া ছোটালে সব ধাক্কা খেয়ে খেয়ে মাটিতে পড়ে যাবে। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক আছে আস্তে আস্তেই চলা যাক। বিস্কো বলল।

ওরা ঘোড়ার গতি বাড়াল না। ঘোড়া চলল টুক টুক করে।

সেভিল্লা নগর শেষ হল। তখনই আকাশে চাঁদ দেখা গেল। জোছনা অনুজ্জ্বল। সামনেই টানা রাস্তা চলে গেছে। সবকিছুই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ওরা রাস্তা ধরে ঘোড়া চালাল। কিন্তু গতি বাড়াল ।

একটু দেরিই হল। শাঙ্কোরা সেই জঙ্গলের কাছে পৌঁছাল। ঘোড়া থেকে নামল। খাবার আর জলের পীপে নিয়ে ওরা বনে ডুল। খুব ঘন বন নয়। এখানে ওখানে অস্পষ্ট জোছনা পড়েছে।

হঠাৎ শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল–নিঃশব্দে এগোলে বন্ধুরা আমাদের শত্রু ভাবতে পারে। কাজেই হ্যারির নাম ধরে ডেকে ডেকে এগোতে হবে।

তিনজন আবার চলল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে ডাকল–হ্যারি–হ্যারি। বিস্কোও ডাকল–হ্যারি। ডাকতে ডাকতে একটু পরেই হ্যারির ডাক শুনল-শাঙ্কো–তোমরা এদিকে এসো।

হ্যারির ডাক শুনে অন্ধকারে দিক আন্দাজ করে শাঙ্কোরা হ্যারিদের কাছে এলো। শাঙ্কো বলল–আগে সবাইকে জল খেতে দাও। জলের পীপেটা মাটিতে নামিয়ে কাঠের গ্লাসগুলো বিস্কো নিল। পীপের ছিপি খুলে গ্লাস গ্লাস জল সবাইকে দিতে লাগল। তৃষ্ণার্ত ভাইকিং বন্ধুরা জল খেয়ে যেন নতুন জীবন পেল। শাঙ্কো চেঁচিয়ে বলল–সবাই শুকনো পাতা নিয়ে এসো। পাতাগুলো একত্র করে থালার মতো বানাও। তারপর রুটি তরকারি নিয়ে খাও। সবাই জঙ্গলের এদিক-ওদিক গিয়ে শুকনো বড়োপাতা কুড়িয়ে আনল। লাইন দিয়ে বসল। হ্যারি বলল–শাঙ্কো তোমরাও খেতে বসো। আমি আর ফ্লেজার। তোমাদের খেতে দিচ্ছি। তোমরা এখন ক্লান্ত।

হ্যারি আর ফ্লেজার সবাইকে রুটি তরকারি দিতে লাগল। মারিয়া কিন্তু খেতে বসল না ক্ষুধার্ত ভাইকিং বন্ধুরা খেতে লাগল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলের খাওয়া হয়ে গেল। রুটি তরকারি জল খেয়ে ভাইকিং বন্ধুরা তৃপ্ত হল। গায়ে নতুন শক্তি পেল যেন। এবার মারিয়া এগিয়ে এলো। বলল হ্যারি খেতে বসো। হ্যারি আর ফ্লেজার খেতে বসল। মারিয়া ওদের খাবার এগিয়ে দিল। দু’জন খেতে লাগল। দু’জনের খাওয়া হতে মারিয়া খেতে বসল।

খাবার ও জল খেয়ে পরিতৃপ্ত ভাইকিংরা ঘাসে ঢাকা মাটিতে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু হ্যারি জেগে রইল। ওর মন বলতে লাগল এখনও বিপদ কাটেনি। একজন সৈন্য পালিয়েছে। ও সেভিল্লা গিয়ে নিশ্চয়ই সেনাপতিকে সব কথা বলবে। সেনাপতি অনেক সৈন্য নিয়ে এই বনের ধারে চলে আসবে। দেখবে– দলপতি মারা গেছে আর দু’জন সৈন্য আহত হয়ে পড়ে আছে। সেনাপতি সবই বুঝবে। বনে ঢুকে ওদের তল্লাস করবে। ওদের পেলে সেনাপতি কোনো কথা শুনবে না। সঙ্গে সঙ্গে বন্দি করবে।

এসব ভাবতে ভাবতে হ্যারির একটু তন্দ্রা এসেছিল। তখনই বনের দক্ষিণ দিকে অনেক ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ পেল। জেগে থাকা হ্যারি চমকে উঠল। ডাকল–শাঙ্কো– বিস্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় দেখল সবাই ঘুমিয়ে আছে।

শাঙ্কো বলল–আক্রমণ হবেই। ঘুম ভেঙে শাঙ্কো বিস্কো হ্যারির কাছে এলো। শাঙ্কো বলল–হ্যারি–আমি দক্ষিণদিকে যাচ্ছি। বনের আড়াল থেকে দেখে আসি– ঘোড়ায় চড়ে কারা আসছে।

-যাও–তবে খুব সাবধানে। হ্যারি বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *