৫
একটু পরে হ্যারি চোখ মেলে তাকাল। গোঙানির শব্দ বন্ধ হল। মারিয়া ঝুঁকে পড়ে বলল–হ্যারি এখন কেমন লাগছে?
হ্যারি অল্প হাসল। আস্তে বলল–ভালো লাগছে। মারিয়া ও অন্য বন্ধুরা এতক্ষণে হাসল।
শাঙ্কো বিছানায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল–ভাইসব–সারাদিন আমরা কিছু খাই নি। ক্ষুধায় আমাদের শরীর টলছে। রাতের খাবার আমরা এখুনি খাবো। ভাইকিং বন্ধুরা হৈ হৈ করে শাঙ্কোর কথা সমর্থন করল।
এবার শাঙ্কো লোহার দরজার কাছে এলো। দেখল এখন চারজন পাহারাদার পাহারা দিচ্ছে। সেই থুতনিতে দাড়িওয়ালা পাহারাদারটিও আছে। শাঙ্কো তাকেই বলল–ও ভাই–আমাদের খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। দাড়িওয়ালা পাহারাদারটি কথাটা কানেই তুলল না। শাঙ্কো আবার বলল। পাহারাদারটি কোনো কথাই বলল না।
ততক্ষণে কয়েকজন ভাইকিং উঠে এসে শাঙ্কোর পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল নজরদার পেড্রো। পেড্রো বন্ধুদের পেছনে লাগতে ওস্তাদ। পেড্রো দেখল ব্যাপারটা। ও প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল–এই ছাগলদাড়ি। চিৎকার শুনে পাহারাদার দু’জন, দাঁড়িয়ে পড়ল। আরো কয়েকজন ভাইকিং দরজার কাছে এলো।
দাড়িওয়ালা পাহারাদারটি তলোয়ার উঁচিয়ে ছুটে এলো। নাকিসুরে বলল–কেঁ? কেঁ বলেছে কথাটা? পেড্রো এগিয়ে এসে নাকিসুরে বলল–আমি–আমি বলেছি কথাটা।
পাহারাদারটি একবার সঙ্গীদের দিকে আর একবার পেড্রোর দিকে তাকাতে লাগল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।
এবার পেড্রো নাকিসুরে বলল–এই ব্যাটা ছাঁগলদাঁড়ি খেতে দে তাড়াতাড়ি।
এবার ভাইকিংরা কয়েকজন পেড্রোর সঙ্গে গলা মেলাল–এই ব্যাটা ছাগলদাঁড়ি– খেতে পেঁ তাড়াতাড়ি। আস্তে আস্তে সব ভাইকিংরা দরজায় এসে ভিড় করল। সমস্বরে বলতে লাগল–এই বাঁচা ছাগরদাঁড়ি-ঘেঁতে দে তাড়াতাড়ি।
এবারে দাড়িওয়ালা পাহারাদারটি বলল–দাঁড়াও–দেখাচ্ছি মজা। ও সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটল। ভাইকিংরাও চুপ করল।
কিছু পরে দেখা গেল সেনাপতি আসছে। সঙ্গে সেই পাহারাদার।
ওরা লোহার দরজার সামনে এলো।
সেনাপতি বলল–আমাদের প্রহরীকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছো কেন?
–খিদের জ্বালায়। শাঙ্কো বলল।
তার মানে? সেনাপতি বলল।
হুয়েনভা থেকে এই সেভিল্লায় হাত বাঁধা অবস্থায় আমাদের হটিয়ে আনা হয়েছে। আমরা তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত। এখানে খাবার জল পেয়েছি। কিন্তু এখনও খাবার পাই নি। আপনার প্রহরীকে এই কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমাদের কথা কানেও তুলল না। বিস্কো বলল।
সেনাপতি একটু ভাবল। তারপর বলল–তোমাদের রাতের খাবার এখনই দেওয়া হবে। কোনোরকম গোলমাল পাকালে চাবুক খেতে হবে। মনে থাকে যেন।
সেনাপতি দরজার কাছ থেকে সরে গেল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। দলপতি চলল তার পেছনে পেছনে। ভাইকিংরাও গিয়ে বিছানায় বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল।
দাড়িওয়ালা পাহারাদারের জায়গায় অন্য এক পাহারাদারকে দেখা গেল।
সেনাপতির হুকুমেই বোধহয় হ্যারিদের তাড়াতাড়ি খেতে দেওয়া হল। খাবার খেয়ে হ্যারিরা শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে লাগল।
ওদিকে ফ্রান্সিস আর বারাকা গাছের আড়াল থেকে হ্যারিদের দেখছিল। হ্যারিরা তখন বনের পাশের ঘাস-ঢাকা প্রান্তরে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছিল।
বারাকা বলল–এখন এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। তোমার বন্ধুদের এখন মুক্ত করা যাবে না। তাই বলছিলাম চলো আমরা সেভিল্লা নগরে চলে যাই। ওখানে কয়েদঘরের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করি। দলপতি নিশ্চয়ই ওদের কয়েদঘরে বন্দি করে রাখবে। ফ্রান্সিসও ভেবে দেখলো এখন কিছুতেই বন্ধুদের মারিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। বরং সেভিল্লা নগরে গিয়ে কয়েদঘরের কাছে অপেক্ষা করা ভালো। কয়েদঘরের পাহারাদারদের পাহারা দেওয়ার নিয়ম জানা যাবে হ্যারিদের কীভাবে মুক্ত করা যায় তাও ভেবে ঠিক করা যাবে। ফ্রান্সিস বলল–চল–আমরা আগেই চলে যাই।
ফ্রান্সিস আর বারাকা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চলল সেভিল্লা নগরের দিকে।
সেভিল্লা নগরে যখন এসে পৌঁছল তখন সন্ধে হয়েছে। সদর রাস্তায় কোথাও কোথাও মশাল জ্বলছে। বাড়িঘরদোরে মোমবাতির আলো।
বারাকা কয়েদঘরের কাছে ফ্রান্সিসকে নিয়ে এলো। কয়েদঘরের দরজায় দুটো মশাল জ্বলছে। দু’জন সশস্ত্র পাহারাদার খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে।
ফ্রান্সিস কয়েদঘরের সামনে মাঠটায় বসল। বারাকাও ওর পাশে বসল।
সময় বয়ে চলল। কিন্তু হ্যারিদের দেখা নেই।
বারাকা বলল–চলো তোমার বন্ধুদের আসার আগে আমরা কিছু খেয়ে আসি গে। ফ্রান্সিস হেসে মাথা নাড়ল। বলল–বন্ধুরা এখনও উপবাসী। আমি কী করে খাবো? ওরা আসুক–এখানে খাবার খা জলটল খা–তবেই আমি খেতে যাবো।
বারাকা একটু আশ্চর্যই হল। বলল–তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তুমিও উপোস করে থাকবে?
–হ্যাঁ–আমি এখন কিছু খাব না। তুমি খেয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল। বারাকা কী ভাবল। বলল–না তোমার বন্ধুরা না খাওয়া পর্যন্ত আমিও কিছু খাবো না।
দু’জনে মাঠটায় বসে রইল।
রাত বাড়তে লাগল। বন্ধুদের দেখা নেই।
একসময়ে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল-বারাকা এখানে বসে থেকে বন্ধুদের খোঁজ পাওয়া যাবে না। আমাদের সেই বনের কাছে যেতে হবে। ঐ বনের ধারেই বন্ধুরা বিশ্রাম করছিল।
–বেশ চলো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে হুয়েনভা থেকে হেঁটে এখানে এসেছি। আবার হাঁটবে? বারাকা বলল।
–উপায় নেই। বন্ধুরা কোথায় আছে কেমন আছে এটা না জানা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি বন্ধুদের জন্যে খুব ভাবো তাই না? বারাকা বলল।
বন্ধুরাও আমার জন্যে ভাবে। ফ্রান্সিস বলল। বারাকা উঠে দাঁড়াল। বলল– চলো তাহলে।
দু’জন সদর রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। বেশ রাত হয়েছে। রাস্তাঘাট নির্জন।
একসময় ফ্রান্সিস বলল-বারাকা–তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। তুমি এখানে খেয়ে নিতে পারো।
না। বারাকা মাথা নেড়ে বলল–তুমি তোমার বন্ধুরা যখন খাবে আমিও তখন খাবো।
নগর ছাড়িয়ে দু’জনে চলল সেই বনভূমির দিকে।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর দু’জন সেই বনভূমির কাছে এলো।
অন্ধকারে যতটা দেখল তাতে বুঝল বন্ধুরা এখানে নেই। তবে ওরা গেল কোথায়?
হঠাৎই গোঙানি শুনল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। গোঙানির শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল ফ্রান্সিস অন্ধকারে সেইদিকে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস দেখল অন্ধকারে কে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস কাছে গেল। এবার অন্ধকারে দেখে ও বুঝল লোকটি রাজা ফার্নান্দোর সৈন্য।
ফ্রান্সিস মাটিতে বসল। সৈন্যটিকে জিজ্ঞেস করল–কী ব্যাপার ভাই? তুমি আহত হয়েছ। এখানে কি লড়াই হয়েছে? সৈন্যটি জিজ্ঞেস করল–তুমি কে?
–আমি ভাইকিং। আমার বন্ধুদেরই তোমরা বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছিলে। তারা কোথায়? তাদের কী হয়েছে? তোমরা কি আমার নিরস্ত্র বন্ধুদের মেরে ফেলেছো? সৈন্যটি মাথা নেড়ে বলল-না। তোমার বন্ধুরাই দলপতিকে হত্যা করে আমাদের আহত করে গেছে। শুধু একজন সৈন্যই পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
–আমার বন্ধুরা কোথায়?
সৈন্যটি বলল–তা জানি না। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়েনি।
–ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–তাহলে তোমাদের মধ্যে যে সৈন্যটি পালাতে পেরেছিল সে নিশ্চয়ই সেনাপতিকে এই সংবাদ দেবে। সেনাপতিও সৈন্য নিয়ে আমাদের বন্ধুদের খুঁজতে আসবে।
–আর এসে কী হবে? সবাই পালিয়ে গেছে। সৈন্যটি বলল।
—-কোনদিকে পালালো?
কাঁধে তলোয়ারের ঘা লেগেছে। এই অবস্থায় আমি আমার কথাই ভাবছি কতক্ষণে ওষুধ পড়বে–আমি অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো। আর কারো কথা ভাবি নি। সৈন্যটি বলল।
ফ্রান্সিস বলল-বারাকা–বন্ধুরা নিশ্চয়ই হুয়েনভা বন্দরে আমাদের জাহাজে চলে গেছে। আমার ফেরার জন্যে ওরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে। চলো আমাদের হুয়েনভা বন্দরে যেতে হবে।
–বেশ–চলো। আবার সেই হেঁটে। আমি তো তবু কিছু খেয়েছি পেটপুরে, জলও খেয়েছি। তুমি তো নির্জলা উপোসী। পারবে হেঁটে যেতে। বারাকা বলল।
নিশ্চয়ই পারবো। পারতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
–তুমি বন্ধুদের খুব ভালোবাসো–তাই না? বারাকা বলল।
–হ্যাঁ–প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। ওরাও আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ফ্রান্সিস বলল।
এবার দু’জনে চলল হুয়েভা বন্দরের দিকে। যখন ওরা হুয়েভা বন্দরে পৌঁছল তখন ভোর হল। ফ্রান্সিসের চোখে রোদ পড়তে চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল। রোদ ছড়াল চারদিকে।
ফ্রান্সিস বেশছুটেই ওদের জাহাজের কাছে এলো। ও হাঁপাচ্ছে তখন। জাহাজ জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। তার মানে বন্ধুরা জাহাজে ফেরে নি। তবে কোথায় গেল ওরা?
জাহাজের মাস্তুলের আড়াল থেকে কে যেন মুখ বাড়াল। তাহলে একজন তো আছে। বন্ধুটি মাস্তুলের আড়াল থেকে আবার মুখ বের করল। আরে! এ তো ভেন।
ফ্রান্সিস বারাকাকে ডাকল–চলোজাহাজে উঠবো। দু’জনে পাতা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে জাহাজে উঠল।
ভেন মাস্তুলের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস ভেনকে জড়িয়ে ধরলো। বলল–ভেন–তোমার খোঁজ রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা পায় নি।
–আমি আটা ময়দার বস্তার পেছনে লুকিয়েছিলাম। আমাকে তাই ধরতে পারে নি। ভেন হেসে বলল। ওরা ডেক-এ বসল।
এবার ফ্রান্সিস ভেনকে সব ঘটনা বলল। শেষে বলল–এখনও বন্ধুদের কোনো খোঁজ পেলাম না। এবার সেই বনের ধারে যেতে হবে। বনেও ঢুকতে হবে। হয়তো হ্যারিরা বনে আশ্রয় নিয়েছে।
–ঠিক আছে। তাই যাও। তার আগে উপোস তুমি কিছু খেয়ে যাও। ভেন বলল।
–অসম্ভব। বন্ধুরা মারিয়া কেউ খায় নি এখনও। ফ্রান্সিস বলল।
–ফ্রান্সিস–আমি একজন চিকিৎসক। আমি বলছি–এই উপোসে থাকা আর এইসব দুশ্চিন্তা তোমার দেহের ক্ষতিই করবে। তুমি এতে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি অসুস্থ হলে আমরা দিশেহারা হয়ে যাবো। একটু থেমে ভেন বলল–ফ্রান্সিসকথা শোনো। তোমাকে সুস্থ থাকতেই হবে। খেতে এসো। আমার খাবার তৈরিই আছে। তোমরা খাবে এসো।
তিনজনেই খাবার ঘরে এলো। ভেন দু’জনকে কাঠের থালা গ্লাস দিল। খাবার দিল। জল দিল। ফ্রান্সিস পরপর তিন গ্লাস জল খেল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল–ভেন–এতক্ষণে আমি বুঝতে পারছি আমি কতখানি তৃষ্ণার্ত আর ক্ষুধার্ত। ভেন বলল–ফ্রান্সিস–আমরা সবাই তোমার নির্দেশেই চলি। সেই তোমাকে এখন সুস্থ সবল থাকতে হবে।নাও খেতে শুরু করো। মোটা রুটি আর মাংসের ঝোল। ফ্রান্সিস হাপুস হাপুস্ খেতে লাগল। বারাকাও সমান আগ্রহে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস বলল–তোমার খাবার আমাদের দিলে।
–তাতে কি? আমি বেঁধে নেব। ভেন বলল–তোমাকে এই বিপদের সময় সুস্থ থাকতে হবে সবল থাকতে হবে।
তিনজনে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। তারপর পাতা পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে তীরে উঠল।
এবার দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে চলল সেভিল্লার দিকে। একসময় বারাকা বলল তোমার বন্ধুরা কোথায় আছে বলে তোমার ধারণা।
–ঐ বনে। ওরা দলপতির সৈন্যদের লড়াইয়ে হারিয়ে ঐ বনেই আত্মগোপন করে আছে। এটা আমি আগে ভাবিনি। এখন ভাবছি। ফ্রান্সিস বলল।
–তোমার কী মনে হয়? তোমার বন্ধুরা ঐ বনে লুকিয়ে আছে এই সংবাদটা কি সেনাপতি পেয়েছে? বারাকা বলল।
নিশ্চয়ই পেয়েছে আর এতক্ষণে সেই বনভূমিতে তল্লাশি শুরু করেছে। বন্ধুরা ধরা পড়বেই। আমি ধরে নিয়েছিলাম ওরা লড়াইয়ে জিতেই জাহাজে ফিরে আসবে। কিন্তু ওরা তা করে নি। ফ্রান্সিস বলল।
–এটা তো বোকামির কাজ হল। বারাকা বলল।
ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল-বারাকা–আমরা পরস্পরকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসি। আমাকে না নিয়ে ওরা জাহাজে ফিরবেই না।
–তোমাদের মধ্যে এত বন্ধুপ্রীতি? বারাকা বলল। ফ্রান্সিস হাসল।
দু’জনে রাস্তার এমন একটা জায়গায় এলো যেখান থেকে ঐ বনটা দেখা যায়। সেখানে এসে দু’জনে দেখল বনের মাথায় ধোঁয়ার কুণ্ডুলি। তার মানে বনে আগুন লাগানো হয়েছে। ফ্রান্সিস অস্ফুটস্বরে বলল–কি মর্মান্তিক। তারপর দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বলল-বারাকা তাড়াতাড়ি এসো। বারাকা গতি বাড়াল। ও ভেবে আশ্চর্য হল–সেই কাল রাত থেকে ওরা হাঁটতে শুরু করেছে। এখনও হাঁটছে। অথচ ফ্রান্সিসের এখনও কোনো ক্লান্তি নেই কোনো কষ্ট নেই। সটান হেঁটে চলেছে। শুধু ওর জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে।
দু’জনে দূর থেকে দেখল সেই জ্বলন্ত বনটা ঘিরে রাজা ফার্নান্দোর সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু অশ্বারোহী সৈন্যও রয়েছে। সেনানায়ক ঘোড়ায় চড়ে বনের আগুনের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আশেপাশের গ্রাম থেকেও লোকজন আগুন দেখতে এসেছে। তারা গোল হয়ে সৈন্যদের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস আর বারাকা তাদের সঙ্গে মিশেদাঁড়িয়ে রইল।
আগুন উঁচুতে উঠল। কাঁচা গাছগাছালি লতাপাতা ঝোঁপ পুড়ছে। জোর চট চট শব্দ উঠেছে। শুকনো বন নয়। তাই আগুন খুব একটা তেজি আগুন নয়।
বিছুক্ষণ সময় গেল। ফ্রান্সিস এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আগুনের দিকে।
হঠাৎ বারাকা লক্ষ্য করল–ফ্রান্সিসের দু’চোখ জলে ভিজে উঠেছে। ফ্রান্সিস জামার হাতা দিয়ে দু’চোখ মুছল। অঞরুদ্ধস্বরে বলল–যদি আমার একজন বন্ধুও পুড়ে মরে তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি প্রথমে সেনাপতিকে আর পরে রাজা ফার্নান্দোকে আমি হত্যা করবো। তাতে যদি আমার জীবন যায়–পরোয়া নেই।
আস্তে আস্তে আগুনের তেজ কমে আসতে লাগল। গাঢ় ধোঁয়া উঠতে লাগল আকাশের দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আগুন নিভু নিভু হল। এখানে-ওখানে তখনও আগুন। ধোঁয়া উঠছে।
তখনই ফ্রান্সিসের চোখে পড়ল টিলাটা। টিলাটার গায়ে আগুনের কালচে দাগ। ফ্রান্সিস তখন পায়চারি করতে লাগল। আগুন আরও নিভে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এখনও ঐ ছাইচাপা আগুন পার হয়ে দেখতে যাওয়া যাবে না।
তখনই ফ্রান্সিস দেখল হ্যারি টিলাটার সামনে এসে দাঁড়াল। পেছনেশাঙ্কো মারিয়াকে ধরে ধরে একটা পাথরের চাঙ-এর ওপর বসাল। হ্যারি দু’হাত ওপরে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গী করল।
ফ্রান্সিস জীবিত মারিয়া হ্যারিদের দেখে চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। সেই ধ্বনি অবশ্য হ্যারিরা শুনতে পেল না।
ফ্রান্সিস বারাকাকে বলল–চলো–মাঠটায় বসি।
দু’জনে এসে মাঠটায় বসলো।
তখন সন্ধে হয়েছে। চারদিকে সৈন্যরা মশাল জ্বালল।
হ্যারিরা পোড়া বনের ছাইয়ের ওপর দিয়ে সাবধানে এলো। আত্মসমর্পণ করল।
সেনাপতির নির্দেশে হ্যারিদের দু’পাশে ঘিরে নিয়ে সবাই চলল সেভিল্লার দিকে।
অন্ধকারে পেছনে পেছনে ফ্রান্সিস আর বারাকাও চলল।
সেভিল্লা নগর পৌঁছল সবাই।
হ্যারিদের কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হল।
ফ্রান্সিসরা অন্ধকারে মাঠে বসে রইল।
রাত বাড়ল।
হ্যারিদের যখন খেতে দেওয়া হল তখন ফ্রান্সিস বলল-বারাকা এবার তোমাদের বাড়িতে নিয়ে চলো।
চলো। বারাকা বলল। দু’জনে রাস্তায় এলো। চলল পুবমুখো।
দু’জনে যখন বারাকার বাড়িতে পৌঁছল, অন্ধকারের মধ্যেও দেখে ফ্রান্সিস বুঝল বাড়িটা বেশ বড়ো। কাঠ আর পাথরে তৈরি। কাঠের দরজাটার সামনে এসে বারাকা দাঁড়াল। তারপর দরজায় আঙুল ঠকে শব্দ করল। একটু পরেই দরজা খুলে গেল। বড়ো জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির মুখেচোখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। বারাকাকে দেখে ও বলে উঠল, দাদা, বাবা ছাড়া পেল না?
না। বারাকা দরজা পার হয়ে বলল, ফ্রান্সিস, এসো।
ফ্রান্সিসকে নিয়ে বারাকা ভেতরের ঘরে এলো। দেখল এক শুভ্রশয্যায় একজন ভদ্রমহিলা বসে আছে। বারাকা বলল, মা, বাবাকে এই সেভিল্লায় আনা হয়েছে।
–তাহলে এই বাড়িটাও তল্লাশি করা হবে। মা বললেন।
–হ্যাঁ। এসব তল্লাশি খোঁজখবরের পর হয়তো রাজা ফার্নান্দো বাবাকে মুক্তি দেবেন। বারাকা বলল।
–হ্যাঁ, এখন শুধু অপেক্ষা করে থাকা। মা বললেন।
ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বারাকা বলল, মা, এর নাম ফ্রান্সিস। আমার বন্ধু। মা একটু শুকনো হাসি হেসে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন।ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল। মা বললে, আমার যা মনের অবস্থা, মানে, তোমার সঙ্গে কথা বল মানে–
ঠিক আছে, ফ্রান্সিস বলে উঠল, পরে কথা হবে।
দু’জনে বারাকার ঘরে এলো। বারাকা একটা আবলুশ কাঠের গদিওয়ালা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বসো। তখনই বারাকার বোন মোমবাতি হাতে ঘরে ঢুকল। একটা ছ’ কোণা টেবিলের ওপর রুপোর বাতিদানে মোমবাতিটা রেখে বলল, দাদা, বাবার মুক্তির ব্যবস্থা কী করবি?
–দেখি। বারাকা বলল। বারাকার বোন চলে গেল।
ফ্রান্সিস বলল, বারাকা, যা বুঝতে পারছি, তোমার বাবাকে আর আমার বন্ধুদের কাল সকালেই ফার্নান্দোর সামনে হাজির করানো হবে। ওদের কথা শোনার পরেই আমি রাজার সঙ্গে কথা বলতে চাই। সেটা কী করে হবে বুঝতে পারছি না।
বারাকা বলল, সে ব্যবস্থা করা যাবে। রাজদরবারের নাজির আমার খুবই পরিচিতি। একটা স্বর্ণমুদ্রা দিলেই সে রাজার সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবে।
–কিন্তু আমার কাছে তো স্বর্ণমুদ্রা নেই। ফ্রান্সিস বলল।
–সে আমি দেব’খন। বারাকা বলল।
–তাহলে এখুনি চলো। নাজিরকে কাল সকালে হয়তো পাবো না। ফ্রান্সিস বলল।
–চলো তাহলে। কিন্তু তার আগে কিছু খেয়ে নিই। সারাদিন তুমি না খেয়ে আছে। বলে বারাকা বোনকে ডেকে তাদের খাবার দিতে বলল।
খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস বলল, আচ্ছা, বারাকা, তোমার একটা পোশাক দাও তো। দেখি আমার গায়ে ঠিক লাগে কিনা।
–বেশ তো। বারাকা আলমারি খুলে ফ্রান্সিকে ঢোলাহাতা পোশাক দিল। ফ্রান্সিস নিজের পোশাকের ওপরেই পরল সেটা। মোটামুটি লেগে গেল।
দু’জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তার এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। সেসবের আলো রাস্তায় যতটা পড়েছে তাই দেখে চলল দুজনে।
নাজিরের বাড়িতে এলো ওরা।নাজিরের মূর চাকর দরজা খুলে ফ্রান্সিসদের বাইরের ঘরে বসাল।
একটু পরেই নাজির এলো। নাজিরের সাদা দাড়ি-গোঁফ। মাথায় পাতলা কাপড়ের টুপিমতো। তিনি গদি-আঁটা চেয়ারে বসতেই ফ্রান্সিস বলল, আমি যাতে রাজা ফার্নান্দোর সঙ্গে কথা বলতে পারি, আপনি দয়া করে সেই ব্যবস্থাটা করে দেবেন? নাজির রাজি হলো। বারাকার স্বর্ণমুদ্রাও নিল। ফ্রান্সিসের পোশাক দেখে বুঝল ফ্রান্সিস এখানকারই লোক।
পরদিন সকালে দলপতি কয়েদখানায় এলো। হ্যারিদের বলল, তোমরা কয়েকজন এসো। বারাকার বাবাকেও আসতে বলল।
হ্যারি, মারিয়া আর বিস্কো চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। বারাকার বাবাও চললেন। দু’পাশে দু’দল সৈন্যও চলল।
রাজদরবারে তখন অমাত্যরা বসেছেন। নাজির বিচারের ব্যাপারটা লিখবে বলে কাগজ কলম নিয়ে বসেছে। হ্যারিরা এসে দাঁড়াল।
একটু পরেই রাজা ফার্নান্দোদরবারে এলেন। নাজির প্রথমে বারাকার বাবাকে ডাকল। রাজা ফার্নান্দো বললেন, খলিফা ইবন আমীরের গোপন ধনভাণ্ডারের হদিস নিশ্চয়ই আপনাদের পরিবারের কোনো কিছুর মধ্যে আছে। আপনাদের সেভিল্লার বাড়ি তল্লাশি করতে হবে। আরো কিছু জায়গা দেখতে হবে। এখনও বন্দি থাকতে হবে।
এবার দলপতি হ্যারিদের নিয়ে এগিয়ে এলো। দলপতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে হ্যারিদের গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ প্রকাশ করল। হারির দিকে তাকিয়ে রাজা ফার্নান্দো বললেন, এই অভিযোগের উত্তরে তোমরা কী বলতে চাও বলল।
হ্যারি এগিলে এলো। মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল। বলল, মাননীয় রাজা, আমরা ক্যামেরিনাল বন্দর শহরে আমাদের জাহাজ থামিয়েছিলাম জল, খাদ্য সংগ্রহের জন্যে। শুনেছিলাম ঐ অঞ্চলের রাজা গার্সিয়া। এর বেশি আর কিছুই আমরা জানি না।
–ঠিক আছে, হুয়েনভা বন্দর শহরে লোক পাঠানোহবে। খোঁজ নেওয়া হবে আমার ভাই রাজা গার্সিয়া তোমাদের গুপ্তচরবৃত্তির জন্যে পাঠিয়েছিল কিনা। এখন কয়েদঘরে থাকতে হবে। রাজা বললেন।
এবার হ্যারি মৃদুস্বরে বলল, রাজকুমারী, আপনাকে রাজঅন্তঃপুরে রাখার কথা বলি?
মারিয়া মাথা নেড়ে বলল, না, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো।
হ্যারি বলল, দোহাই, আমার ব্যবস্থাটা মেনে নিন। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের বিপদের শেষ থাকবে না। অনুরোধ করছি, যা বলছি শুনুন।
রাজা ফার্নান্দো বললেন, তোমাদের আর কিছু বলার আছে?
হ্যারি মারিয়াকে দেখিয়ে বলল, ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। কয়েদঘরের কষ্টকর জীবন ইনি সহ্য করতে পারবেন না। বিনীত প্রার্থনা, রাজকুমারীকে অন্তঃপুরে রাখা হোক।
রাজা ফার্নান্দো দলপতির দিকে তাকালেন। বললেন, এই রাজকুমারীকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাও। পরিচারিকাদের বলো এঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিতে।
দলনেতা মারিয়ার কাছে এসে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
ঠিক তখনই নাজির ফ্রান্সিসকে নাম ধরে ডাকল। মারিয়া চমকে পেছন ফিরে তাকাল। হ্যারি, বিস্কোও তাকাল এদেশের পোশাক পরা ফ্রান্সিসের দিকে। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে তাদের দেশীয় ভাষায় বলল, আমাকে চেনো না, সবাই স্বাভাবিক থাকো। ভয় নেই।
রাজা ফার্নান্দো ফ্রান্সিসকে বললেন, বলো, তোমার কী বলার আছে।
ফ্রান্সিস একটু মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল, মহামান্য রাজা, আমি শুনেছি যে– একশো বছর আগে খলিফা ইবন আবি আমীর এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এক যুদ্ধে যাবার সময় বা তারও আগে তাঁর বিপুল ধনসম্পত্তি তিনি যে কোথায় লুকিয়ে রাখেন তা কাউকে বলে জাননি। তার গুপ্ত ধনভাণ্ডার নিশ্চয়ই তারপর কোনো কোনো রাজা খুঁজেছিলেন। কিন্তু কেউই তার হদিস পাননি।
–হ্যা, তুমি ঠিকই শুনেছো। রাজা বললেন।
–এখন মাননীয় রাজা আমাকে যদি কিছুদিন সময় দেন তাহলে সবরকম খোঁজখবর করে আমি ঐ গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধারের চেষ্টা করব। ফ্রান্সিস বলল।
তুমি কি জানো আমিও খোঁজখবর চালাচ্ছি? রাজা বললেন।
জানি মান্যবর রাজা। শুধু আমাকে একবার সুযোগ দিন, এই অনুরোধ।
–বেশ। রাজা ফার্নান্দো বললেন।
ফ্রান্সিস বলল, আর একটা অনুরোধ আমাদের স্বাধীন চলাফেরায় কেউ যেন বাধা না দেয়।
–বেশ, তোমাকে রাজপাঞ্জা দেওয়া হবে। রাজা বললেন।
দলপতি হ্যারিদের নিয়ে চলে গেল। ফ্রান্সিস বারাকার সঙ্গে প্রাসাদের বাইরে এলো। চলল তার বাড়ির দিকে। পথে কিছুটা যেতেই ফ্রান্সিস দেখল পেছনে ঘোড়ায় চড়ে দলনেতা আসছে। দলনেতা ফ্রান্সিসদের সামনে এসে ঘোড়া থামাল। কোমর থেকে গোলমতো একটা পিতলের চাকতি বের করে বারাকার হাতে দিল। বলল, রাজা তোমাদের এই রাজপাঞ্জা দিয়েছেন। দলনেতা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।