৭ ভাদ্র।
কাল ডায়েরি লেখা শেষ করলুম বিকেল পাঁচটা সময়। সওয়া পাঁচটার সময় টেলিফোন এল।
শঙ্খনাথবাবু ফোন করছেন; গলার আওয়াজ একটু যেন অন্য রকম। বললেন, প্রিয়দম্বা, তুমি একবার আসবে?
উকষ্ঠিত হয়ে বললুম, কী হয়েছে। পিউ কেমন আছে?
তিনি বললেন, পিউ ভালই আছে। আমার নিজের একটু শরীর খারাপ হয়েছে।
শরীর খারাপ। কী রকম শরীর খারাপ?
সামান্য জ্বর হয়েছে। আর গায়ে ব্যথা। একটু দুর্বল বোধ করছি।
বোধহয় ইনফ্লুয়েঞ্জা। ডাক্তার কী বললেন?
ডাক্তার ডাকিনি? সামান্য জ্বরে ডাক্তার কী করবে? তুমি একবার আসবে? আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
শুক্লা বাড়ি নেই। তাকে একছত্র চিঠি লিখে তৈরি হয়ে নিলুম। ব্যাগে সব জিনিস আছে কি না দেখে নিলুম। হয়তো রাত্তিরে থাকতে হবে। শঙ্খনাথবাবু বললেন বটে সামান্য জ্বর, কিন্তু বলা যায় না। এক ধরনের মানুষ আছে যারা নিজের অসুখকে অসুখ বলেই মনে করে না।
পৌনে ছটার সময় গাড়ি এল। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লুম। আকাশ অন্ধকার, কিন্তু রাস্তায় এখনও আলো জ্বলেনি।
শঙ্খনাথবাবুর বাড়িতে আলো জ্বলেনি। শিউসেবক গাড়ি বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, সেলাম করে বলল, আসুন মাজী। বাবু নীচেই আছেন। শিউসেবক আজ আমাকে প্রথম মাজী বলল।
বাড়িতে ঢুকেই সামনে লবি; লবির বাঁ পাশে ড্রয়িংরুম, ডান পাশ দিয়ে ওপরের সিঁড়ি উঠে গেছে। আর লবির মুখোমুখি একটা ঘর। ঘরটা অন্ধকার ছিল। শিউসেবক আমাকে সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল। মাঝারি গোছের ঘর; একটা টেবিল, টেবিলের ওপর টেলিফোন; গোটা দুই চেয়ার, আর একটা খাট। খাটের ওপর শঙ্খনাথবাবু দোরের দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন।
শঙ্খনাথবাবুর চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, তার ওপর মুখে দুতিন দিনের দাড়ি। একটু হেসে হাত বাড়ালেন,—এস প্রিয়দম্বা।
বললুম, এ কী, আপনি এখানে শুয়ে আছেন যে।
তাঁর মুখ একটু ম্লান হল। বললেন, এটা অফিস-ঘর। বাড়িতে যখন কাজকর্ম করি, এখানেই বসি।
বললুম, তা বেশ তো, কিন্তু অসুস্থ শরীরে এখানে শোবার কী দরকার?
তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, যদি ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়, তাই নীচে থাকবার ব্যবস্থা করেছি। শেষে ছোঁয়াচ লেগে বাড়িসুদ্ধ পড়বে।
টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে চেয়ার টেনে তাঁর খাটের পাশে বসলুম। বললুম, দেখি আপনার নাড়ী।
তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন।
তারপর–তারপর—
কিন্তু নিজের কথা পরে বলব; আগে ওঁর কথাটা শেষ করে নিই।
নাড়ী দুর্বল এবং চঞ্চল। গা বেশ গরম। টেম্পারেচার নিলুম; একশ এক পয়েন্ট চার।
কবে থেকে জ্বর হয়েছে?
পরশু রাত্তির থেকে।
ওষুধ-বিষুধ কিছু খেয়েছেন?
কয়েকটা অ্যাস্পিরিনের বড়ি খেয়েছি।
আর পথ্য?
সাবুর জল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবলুম, তারপর মুখ তুলে বললুম, আপনার ফোন ব্যবহার করতে পারি?
কাকে ফোন করবে?
ডাক্তারকে।
ডাক্তার ডাকার দরকার?
দরকার।
বেশ, ডাক। ডক্টর করের ফোন নম্বর—
ডক্টর করকে ডাকব না। আমার একজন জানা ডাক্তার আছেন, তাঁকে ডাকব।
যা ভাল বোঝ কর।
জামাইবাবুকে ডাকলুম। তিনি ভাগ্যক্রমে নিজের ডিস্পেন্সারিতে ছিলেন, সব শুনে বললেন, ইনফ্লুয়েঞ্জাই তো মনে হচ্ছে।
বললুম, আপনি একবার আসবেন?
তিনি বললেন, আমি স্ত্রী-রোগের ডাক্তার, আমাকে কেন?
আপনি আসুন।
আচ্ছা যাব। কিন্তু একটু দেরি হবে, একটা কল সেরে যাব। সাতটা বাজবে।
তাই সই।
ফোন ছেড়ে দিলুম। কব্জির ঘড়িতে ছটা বেজেছে।
শিউসেবককে ডেকে বললুম, এক পট্ কড়া কফি তৈরি করে নিয়ে এস। আর গোটা কয়েক টোস্ট। টোস্টে মাখন লাগিও না।
জী, বলে শিউসেবক চলে যাচ্ছিল তাকে ডেকে জিগ্যেস করলুম, পিউ কোথায়?
শিউসেবক বলল, পিউ-দিদি ওপরেই আছে। কলাবতী তাকে খেলা দিচ্ছে। এখানে আনতে বলব?
না না, এখানে আনতে হবে না। তুমি যাও, কফি আর টোস্ট তৈরি করে আন।
শিউসেবক চলে গেল। শঙ্খনাথবাবু কাতরভাবে বললেন, কিন্তু আমার যে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না প্রিয়দম্বা।
ইচ্ছে করুক আর না করুক, খেতে তো হবে।
তিনি মুখ বিকৃত করে শুয়ে রইলেন।
আমি অন্য কথা পাড়লুম, সেদিন আপনি যে চমৎকার স্টোভ উপহার দিয়েছিলেন তার জন্যে শুক্লা ধন্যবাদ জানিয়েছে।
তিনি বললেন, সেদিন তোমরা যা খাইয়েছিলে অমন তৃপ্তি করে অনেকদিন খাইনি।
বললুম, আবার যাবেন বলেছিলেন, গেলেন না তো।
তিনি বালিশের ওপর কনুই রেখে উঁচু হয়ে বললেন, যাব কোত্থেকে? ওই ব্যাটা লটুপ সিং বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে।
লিট্পট্ সিং কে?
তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল,–লটপটকে জান না? কর্নেল হড়বড় সিংয়ের ব্যাটা লেফটেনেন্ট লট্পট্ সিং। আমার বউয়ের প্রাণের বন্ধু।
শম্ভুনাথবাবুর অভ্যেস লোকের নাম উল্টোপাল্টা করা। বোধহয় লোকটার নাম লজপৎ সিং, উনি তাকে টুপ সিং করেছেন।
বললুম, যাতায়াত শুরু করেছে তো কী হয়েছে। বাড়িতে অতিথি আসবে না?
তিনি বললেন, অতিথি আসুক। ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করুক, চা খাক, তারপর চলে যাক।–আমি সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরি না, সেদিন একটা দরকারে চারটের সময় ফিরে এসে দেখি, লটপট সিং আমার বউয়ের শোবার ঘরে আয়নার সামনে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ভেবে দেখ দিকি।
আপনার স্ত্রী সেখানে ছিলেন?
সলিলা পাশের ঘরে সাজ-পোশাক পরছিল। মানে দুজনে মিলে বেরুবে।
তারপর?
তারপর লটপট সিংকে বললুম,—নিকালো হিঁয়াসে। ফের যদি আমার বাড়িতে মাথা গলিয়েছ ঠেঙিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেব। বেটা নেড়ি কুত্তার মত পালাল।
আর আপনার স্ত্রী?
সলিলার বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দিয়েছি।
তারপর?
তারপর আর কী? ঘরে বন্ধ করে রাখতে তো পারি না, তাই নিজেই বাড়ি আগলে পড়ে আছি। প্যান্প্যান্ নাকে-কাঁদুনি শুনছি। আমি সভ্যসমাজের চাল-চলন বুঝি না, তাই মিছিমিছি সন্দেহ করি। নিজের স্ত্রীকে যারা সন্দেহ করে তারা মানুষ নয়, যারা ঘরে আটকে রাখে তারা পশুর অধম–বুঝলে?
তিনি ক্লান্তভাবে আবার শুয়ে পড়লেন। আমি বললুম, আপনার শরীর দুর্বল হয়েছে, বেশী কথা কইবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। এ অবস্থায় বেশী উত্তেজনা ভাল নয়।
তিনি চোখ বুজে রইলেন।
বাইরে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। টিপটিপ বৃষ্টি চলেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল—এইজন্যে অসময়ে বৃষ্টি নেমেছে। আমার মাথা খাবার জন্যে! কিন্তু—এ আমার কী হল? এ কী হল? কেন মরতে ওঁর নাড়ী দেখতে গিয়েছিলুম।
উনি বললেন, আর একবার নাড়ী দেখ তো প্রিয়ম্বা। যেন আরও দুর্বল মনে হচ্ছে।
ভয় পেয়ে ওঁর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলুম। না, ভয়ের কিছু নেই, তবে নাড়ী আরও দুর্বল হয়েছে। কী করি এখন! জামাইবাবুর আসতে দেরি আছে। শিউসেবক কফি নিয়ে এল না এখনও। আমার মাথাটা যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে হচ্ছে ডাক ছেড়ে কাঁদি।
মনটাকে হিঁচড়ে টেনে খাড়া করলুম। না, এখন ওসব নয়; কাঁদবার অনেক সময় আছে।
আমি ওষুধ দিচ্ছি, বলে উঠে টেবিলের পাশে গেলুম। আমার ব্যাগে স্পিরিট অব অ্যামোনিয়া আছে, তাই ফোঁটা কয়েক খাইয়ে দিই—
শিশি বার করেছি এমন সময় এক কাণ্ড! সে কী কাণ্ড!
দেখি উনি হঠাৎ বিছানার ওপর উঠে বসেছেন, জ্বলজ্বল চোখে দোরের বাইরে তাকিয়ে আছেন। তারপর এক হুঙ্কার ছাড়লেন, সলিলা! কোথায় যাচ্ছ তুমি?
গলা বাড়িয়ে দেখলুম, সলিলা লবির কিনারায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার পরনে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। বোধহয় পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ভেবেছিল শঙ্খনাথবাবু দেখতে পাবেন না। আমি যদি তাঁর সামনে চেয়ারে বসে থাকতুম তাহলে বোধহয় দেখতে পেতেন না।
সলিলার শরীরের মোড় বাইরের দিকে, মুখখানা আমাদের দিকে। এইভাবে সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ফিরে এসে দেরের সামনে দাঁড়াল। তার মুখখানা ফ্যাকাসে, চোখের মিশমিশে কালো মণি দুটো আরও কালো দেখাচ্ছে।
শঙ্খনাথবাবু আবার বললেন, যাচ্ছ কোথায় তুমি?
সলিলার চোখ দুটো একবার আমার দিকে ফিরল। মুখখানা শক্ত হয়ে উঠল। এত নরম সুকুমার মুখ এত কঠিন হয়ে উঠতে পারে ভাবা যায় না। কিন্তু সে নিচু গলাতেই বলল, আমার বাবা এসেছেন, গ্র্যান্ড হোটেলে আছেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
বাবা এসেছেন। মিথ্যে কথা। যাও, ওপরে যাও-বাড়ি থেকে তুমি বেরুতে পাবে না। এই বলে শঙ্খনাথবাবু সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখালেন।
সলিলার চোখের দৃষ্টি যেন বিষিয়ে উঠল, সে বলল, আমি যাব।
না, তুমি যাবে না। আমার হুকুম, তুমি বাড়ি থাকবে।
তোমার হুকুম আমি মানি না। আমি যাচ্ছি। কেউ আমাকে আটকাতে পারে না।
শঙ্খনাথবাবু ধড়মড় করে খাট থেকে নামবার উপক্রম করলেন। আমি এতক্ষণ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলম, এখন ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেললাম। তারপর যা বলেছি যা করেছি সব পাগলের কাণ্ড।
তিনি খাট থেকে নামতে নামতে চিৎকার করে উঠলেন, কী, এত বড় আম্পর্ধা–
আমি দুই হাত তাঁর বুকের ওপর রেখে তাঁকে আটকে রাখবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু আটকে রাখা কি যায়। তিনি যেন উন্মত্ত, এখনই আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন। আমি তখন সমস্ত শরীর দিয়ে চেপে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিলুম, হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম, না, তুমি উঠতে পাবে না। দুর্বল শরীরে তোমার হার্ট ফেল করে যাবে। যার ইচ্ছে যাক, যেখানে ইচ্ছে যাক। তোমাকে আমি উঠতে দেব না।
লিখতে লিখতে ভাবছি, সত্যিই কি এই কথাগুলো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল? না আমার অন্তর্যামী আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন? আমি তো ভেবে-চিন্তে কিছু বলিনি, প্রচণ্ড ব্যগ্রতার তাগিদে কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
যাহোক, আস্তে আস্তে তিনি শান্ত হলেন; কিন্তু চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে রইল। আমি কে, তাও বোধহয় অনুভব করলেন না। আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলুম সলিলা চলে গেছে। মোটরের আওয়াজ শুনিনি; বোধহয় হেঁটে বাড়ির ফটক পার হয়েছে, তারপর রাস্তায় ট্যাক্সি ধরেছে।
ইনি নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছেন, যেন গায়ের জোর সব ফুরিয়ে গেছে। ওষুধ খাইয়ে দিলুম, স্পিরিট অ্যামন অ্যারোম্যাট বিশ ফোঁটা। তারপরে কফি আর টোস্ট নিয়ে শিউসেবক এল। এদিকে যে এত ব্যাপার হয়ে গেছে, তার মুখ দেখে মনে হল সে কিছু জানে না।
শিউসেবক টেবিলের ওপর ট্রে রাখল। আমি খাটের ধারে গিয়ে আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলুম, কফি ঢেলে দেব?
তিনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। এতক্ষণে যেন আমাকে দেখতে পেলেন, বালিশ থেকে মাথা তুলে বললেন, প্রিয়দম্বা, গ্র্যান্ড হোটেলে ফোন কর তো। ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নাও প্রাণগোপাল সেন হোটেলে উঠেছে কি না!
প্রাণগোপাল সেন কে?
পি. জি. সেন, আই. সি. এস–সলিলার বাপ।
আমি বড় মুশকিলে পড়ে গেলুম। সলিলা যদি মিছে কথা বলে থাকে, তার বাপ যদি না এসে থাকেন, তাহলে ইনি জানতে পারলে আবার লাফালাফি শুরু করে দেবেন। কী করি! খানিক ইতস্তত করে বললাম, আগে কফি টোস্ট খেয়ে নিন, তারপর ফোন করব।
আপত্তি করলেন না। আমি বিছানার ওপর ট্রে রেখে কফি ঢেলে দিলুম, উনি বসে বসে খেতে লাগলেন। এক টুকরো শুকনো টোস্টও খেলেন। কতকটা সামলেছেন মনে হচ্ছে।
খাওয়া শেষ হয়েছে কি না-হয়েছে অমনি বললেন, এবার ফোন কর।
নাছোড়বান্দা মানুষ। কিন্তু ফোন করতে হল না, এই সময় জামাইবাবুর মোটর এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। জামাইবাবু যখন আমাদের বাসায় যান তখন মোটরে যান না, কিন্তু তাঁর একটি মোটর আছে। বেশী বড় গাড়ি নয়, কালো রঙের ছোট একটি গাড়ি। এই গাড়িতে চড়ে তিনি রুগী দেখতে যান।
আমি লবিতে বেরিয়ে গিয়ে তাঁকে ঘরে নিয়ে এলুম। তাঁর পরনে কোট প্যান্ট টাই, পকেট থেকে স্টেথস্কোপ উঁচু হয়ে আছে। মন্মথ করের মত অমন ফিটফাট নয়, কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ চেহারা মিলিয়ে একটি অনায়াস আভিজাত্য আছে। অনেকদিন তাঁকে এ বেশে দেখিনি।
শঙ্খনাথবাবু খাটে বসে ছিলেন, কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে নতুন ডাক্তারের পানে চেয়ে রইলেন, তারপর তাঁর মুখের সংশয় পরিষ্কার হয়ে গেল। একটু অনুযোগের সুরে বললেন, দেখুন না ডাক্তারবাবু, আমার কিছুই হয়নি, মিছিমছি প্রিয়দম্বা আপনাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে আনল।
জামাইবাবু হাসলেন, কিছু হয়েছে কিনা আমি দেখলেই বুঝতে পারব। আপনি শুয়ে পড়ুন।
শঙ্খনাথবাবু শুলেন। ডাক্তার তাঁর নাড়ী দেখতে দেখতে সহজভাবে কথা বলতে লাগলেন, আপনার মেয়ে নাকি প্রিয়ংবদার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে।
শঙ্খনাথবাবু বললেন, মেয়ে ন্যাওটা হলে কী হবে, প্রিয়দম্বা তাকে একটুও ভালবাসে না।
এমন না হলে পুরুষমানুষের বুদ্ধি। আমি পিউকে ভালবাসি না! জামাইবাবুকে বললুম, আপনি পরীক্ষা করুন, আমি চট করে পিউকে দেখে আসি।
ডাক্তার রুগীকে বললেন, আপনি এবার গায়ের জামা খুলুন।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখলুম, পিউয়ের ঘরে কলাবতী মেঝের ওপর বসে আছে, আর পিউ তার কোলে শুয়ে কলা খাচ্ছে। বেশ শান্ত নিশ্চিন্ত ভাব, বাড়ির গিন্নী যে কতার সঙ্গে ঝগড়া করে পালিয়েছে, তা কেউ জানে বলেও মনে হল না।
আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পিউ চোখ টেরিয়ে আমাকে দেখল, তারপর হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে দাঁড়াল।
আমি বললুম, পিউ!
দম্মা! বলে পিউ ছুটে এসে আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরল। ভোলেনি আমাকে। চোখে জল এল, কোলে তুলে নিয়ে আদর করলুম, চুমু খেলুম; চুপিচুপি তার কানে কানে বললুম, পিউ, তুমি আমার এই সর্বনাশ করলে?
পিউ বলল, উঁ?
বললুম, কিছু না। কলা খেয়েছ, এবার ঘুমিয়ে পড়।
সে আমার কাঁধে মাথা রাখল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলুম, কলাবতীকে বললুম, তুমি থাকবে তো?
সে বলল, জী, রাত্রে পিউরানীর কাছে শুই।
বেশ। আমি আবার দেখে যাব। বলে আমি নীচে নেমে গেলুম।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে, জামাইবাবু চেয়ারে বসে প্রেক্রিপশন লিখছেন, আমাকে দেখে মুখ তুললেন,—আশঙ্কার কিছু নেই, কিন্তু পাক্কা দুদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। নড়াচড়া বারণ! এই ওষুধটা আনিয়ে নাও-তিন ঘণ্টা অন্তর খাওয়াতে হবে। আজ রাত্রে এক দাগ দিলেই চলবে, বাকী ওষুধ কাল খাবেন।
প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে জিগ্যেস করলুম, কী খেতে দিতে হবে? কাল সাবুর জল খেয়েছিলেন, আজ আমি এসে কফি আর টোস্ট খাইয়েছি।
ডাক্তার বললেন, ঠিক করেছ। চা কফি কোকো টোস্ট দিতে পার। কাল জ্বর নেমে যাবে, তখন মুরগির সুপ, হাফ বয়েল্ড ডিম দেওয়া চলবে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, রুগীর দিকে হেসে তাকালেন, দুটো দিন একটু কষ্ট করুন, তারপর চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।–আচ্ছা চলি।
শঙ্খনাথবাবু বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনার ফী—
ডাক্তার বললেন, আপনি তো আমাকে ডাকেননি, আপনার কাছ থেকে ফী নেব কেন? প্রিয়ংবদা ডেকেছে, ওর কাছ থেকে নেব।
ডাক্তার ঘর থেকে বেরুলেন, আমি সঙ্গে গেলুম। জিগ্যেস করলুম, রাত্তিরে কি আমার থাকা দরকার?
বললেন, আমি তো কোনও দরকার দেখি না।
তখন আমি সলিলার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বললুম। শুনে তিনি বললেন, তাই নাকি! তাহলে তো তোমাকে থাকতে হয়। মহিলাটি যদি দুপুর রাত্রে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধবিগ্রহ আরম্ভ হয়ে যায়, তখন রোগীকে সামলাবে কে?
বেশ, আমি থাকব।
আচ্ছা। আমি শুক্লাকে খবর দেব যে আজ রাত্তিরে তুমি ফিরবে না।
একটু হেসে তিনি গাড়িতে উঠলেন, গাড়ি চলে গেল। শিউসেবক লবিতেই ছিল, তাকে প্রেস্ক্রিপশন দিয়ে বললুম, ওষুধটা ডিস্পেন্সারি থেকে আনিয়ে নাও। সে চলে গেল।
আমি ঘরে ফিরে গেলুম। সঙ্গে সঙ্গে রোগীর হুকুম হল, এবার গ্র্যান্ড হোটেলে ফোন কর।
আর এড়ানো যায় না। ডাইরেক্টরিতে নম্বর খুঁজে ফোন করলুম। ম্যানেজারকে পাওয়া গেল না, তার বদলে যে লোকটা ছিল সে স্পষ্টভাবে বলতে পারল না প্রাণগোপাল সেন নামে কেউ হোটেলে আছেন কি না। ভালই হল, শঙ্খনাথবাবুকে তাই বললুম। তিনি মুখ অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পরে বললেন, ডাক্তারবাবুটি বেশ লোক, চ্যাংড়া ডাক্তার নয়। নাম কী?
নিরঞ্জন দাস।
তোমার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে দেখলাম।
হ্যাঁ, আমি ওঁর ছাত্রী, ওঁর কাছে পড়েছি।
আর কিছু বললেন না, চোখ বুজে শুয়ে রইলেন।
খানিকক্ষণ চুপচাপ কেটে যাবার পর তিনি চোখ খুলে আমার দিকে ঘাড় ফেরালেন, রাত্তিরে থাকবে?
থাকব।
তুমি তো খেয়ে আসনি।
না।
তিনি তখন ডাকলেন, শিউসেবক।
শিউসেবক বোধহয় অন্য কোনও চাকরকে ওষুধ আনতে পাঠিয়ে নিজে লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল, সে ঘরে এসে বলল, জী?
ইনি আজ এখানে খাবেন। ওঁর খাবার এই ঘরে নিয়ে এস।
আমি বললুম, এই আটটা বেজেছে। এখন নয়, নটার পর। সেই সঙ্গে এঁর জন্যে দুধ দিয়ে কোকো তৈরি করে আনবে।
জী। শিউসেবক চলে গেল। সে পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে কিন্তু মালিকের সামনে হিন্দীতে কথা বলে। কলাবতী একেবারেই বাংলা বলতে পারে না, চেষ্টাও করে না।
সাড়ে আটটার সময় ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ এল। এক দাগ খাইয়ে দিলুম।
তারপর আস্তে আস্তে সময় কাটতে লাগল। রুগী কখনও চুপচাপ শুয়ে আছেন, কখনও এপাশ ওপাশ করছেন। শরীরে যদি বা স্বস্তি থাকে, মনে স্বস্তি নেই। মনটা শরশয্যায় শুয়ে আছে।
সওয়া নটার সময় শিউসেবক খাবারের প্রকাণ্ড ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল, টেবিলের ওপর ট্রে রেখে বলল, মাজী, খাবার এনেছি।
ন্যাপকিন দিয়ে ট্রে ঢাকা, কী খাবার এনেছে দেখতে পেলুম না। জিগ্যেস করলুম, বাবুর মিল্ক-কোকো এনেছ?
জী, এনেছি।
উঠে গিয়ে ট্রে থেকে ন্যাপকিন তুললুম। বাদশাহী ব্যাপার। পোলাও চাপাটি মাছের ফ্রাই মাংসের কালিয়া চিংড়িমাছের মালাইকারি চাটনি রাবড়ি সন্দেশ। এক পাশে একটা বড় পেয়ালায় গরম মিল্ক-কোকো।
পেয়ালা নিয়ে খাটের কাছে গেলুম,—উঠে বসুন, খাবার এনেছি।
উঠে বসে পেয়ালা হাতে নিলেন, বললেন, তুমি খেতে বসো।
ঘরের লাগাও বাথরুম, সেখানে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের মুখখানা আয়নায় দেখলুম। প্রিয়ংবদা ভৌমিক, তোমার জীবন ওলট-পালট হয়ে গেছে, কিন্তু মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না।
ফিরে এসে খেতে বসলুম। উনি বসে বসে আমার খাওয়া দেখতে লাগলেন। এক সময় জিগ্যেস করলেন, কেমন বেঁধেছে?
বললুম, কাঁকড়ার ঝাল বাটি-চচ্চড়ির চেয়ে ভাল।
একটু হাসলেন, মুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল। বেশ বোঝা যায় উনি মানুষকে খাওয়াতে ভালবাসেন, মানুষকে তৃপ্তি করে খেতে দেখলে নিজে তৃপ্তি পান।
খুব তৃপ্তি করেই খেলুম। উনি বসে বসে দেখলেন। শিউসেবক পাশে দাঁড়িয়ে খাওয়া তদারক করল; তারপর খাওয়া শেষ হলে বাসন তুলে নিয়ে চলে গেল।
হাতমুখ ধুয়ে খাটের ধারে চেয়ারে এসে বসলুম, এবার আপনি শুয়ে পড়ুন। দশটা বেজে গেছে, ঘুমুবার চেষ্টা করুন।
আমি ঘুমুব, তুমি একা জেগে থাকবে?
আমি চেয়ারে বসে বসে ঘুমুতে পারি। নিন আর কথা নয়, শুয়ে পড়ুন।
আর কথা হল না, উনি শুলেন। চোখের ওপর একটা বাহু রেখে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।–
এইবার নিজের কথা লিখি। কিন্তু কী ছাই লিখব? মরণের কি ধরন আছে। কেউ তিল তিল করে পুড়ে মরে, কেউ আতশবাজির মত এক লহমায় পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরই নাম ভালবাসা!
ভালবাসার কথা গল্প উপন্যাসে পড়েছি, শুক্লার মুখে কিছু কিছু শুনেছি। সে একবার বলেছিল–ভালবাসার কতখানি চোখের নেশা কতখানি মনের মিল, কতটা স্বার্থপরতা কতটা আত্মদান বুঝতে পারি না, হয়তো সবটাই জৈববৃত্তি। কিন্তু প্রেম যে হঠাৎ এসে এক মুহূর্তে জীবনকে তোলপাড় করে দিতে পারে একথা সে বলেনি। তবে কি সকলের প্রেম একরকম নয়?
প্রথম দর্শনেই প্রেম হয় শুনেছি। শকুন্তলার হয়েছিল, রোমিও-জুলিয়েটের হয়েছিল; আজকালও নিশ্চয় হয়। কিন্তু আমার হল না কেন? ওই যে মানুষটি একমুখ দাড়ি নিয়ে শুয়ে রয়েছেন ওঁকে তো আজ নতুন দেখছি না, বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি; তবে এতদিন কিছু মনে হয়নি কেন? বরং ওঁর কথাবার্তা আচার ব্যবহার খারাপই লেগেছিল। তারপর অবশ্য গা-সওয়া হয়েছিল, লোকটি যে অন্তরে খাঁটি তাও বুঝতে পেরেছিলুম। কিন্তু তাই বলে এরকম হবে এ যে কল্পনার অতীত! পুরুষের স্পর্শে কি ম্যাজিক আছে? এই জন্যেই কি আমাদের দেশে প্রবাদ আছে ঘি আর আগুন!
কিন্তু তাই বা কেন? আমার পঁচিশ বছর বয়স হয়েছে; কচি খুকি নই, প্রথম-প্রণয়-ভীতা নবীনা কিশোরী নই। কাজের সুত্রে অনেক পুরুষের সঙ্গে হাত ঠেকাঠেকি হয়েছে; জামাইবাবুর সঙ্গে কতবার খেলার ছলে পাঞ্জা লড়েছি, কখনও কিছু মনে হয়নি। তবে আজ আমার এ কী হল! এ কি কারুর হয়? এ কি সম্ভব?
নাড়ী দেখবার জন্যে ওঁর কব্জি আমার হাতে নিয়েছিলাম। মনে হল আমার চুল থেকে নখ পর্যন্ত একটা শিহরণ বয়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল; বুকের মধ্যে ঝড়ের বেগে মৃদঙ্গ বেজে উঠল। তারপর যন্ত্রের মত কী করেছি আবছা মনে আছে। হঠাৎ যখন সচেতন হলুম তখন দেখি, ওঁকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছি আর পাগলের মত বলছি—না, তুমি উঠতে পাবে না…তোমাকে উঠতে দেব না।
এ আমার কী সর্বনাশ হল! শুক্লা বলেছিল—পুরুষদের মধ্যে নেকড়ে বাঘ আছে, অজগর সাপ আছে। শঙ্খনাথবাবু কি তাই? আমাকে মোহাচ্ছন্ন করেছেন? কিন্তু তাই বা কী করে হবে? কোনওদিন ওঁর চোখে লোভ দেখিনি। সরল সহজ মানুষ। তবে কি আমারই দোষ? আমার মন দুর্বল? কিন্তু কী দেখে আমার মন ওঁর দিকে আকৃষ্ট হল! উনি বিবাহিত, স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে। ছি ছি, আমার মন এত অবুঝ? ঘেন্নাপিত্তি নেই?
এই ভালবাসা! এই প্রেম! যোক প্রেম, কিন্তু নিকষিত হেম নয়। প্রেমের এত গুণগান শুনেছি, সব মিথ্যে। চণ্ডীদাস জানতেন প্রেম ভাল নয়, তাতে খাদই বেশী। আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। সারা জন্ম ধরে কাঁদাবে।…
বারোটা বাজল। উনি চোখের ওপর হাত রেখে ঘুমুচ্ছেন, টেবিলের ওপর ঘোমটা-ঢাকা ল্যাম্প জ্বলছে। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আমি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে গেলুম।
লবিতে আলো জ্বলছে না, ঘরের আলো দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে অন্ধকারকে একটু স্বচ্ছ করেছে। দেখলুম, লবির এক পাশে দেয়াল ঘেঁষে শিউসেবক একটা কম্বল পেতে শুয়ে আছে। বোধহয় জেগেই ছিল, আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল; আমার কাছে এসে খাটো গলায় বলল, মাজী, কিছু দরকার আছে কি?
বললুম, শিউসেবক, তুমি এখানে শুয়েছ ভালই করেছ। এখন কিছু দরকার নেই, যদি দরকার হয় তোমাকে ডাকব।
বহুৎ আচ্ছা মাজী।
শিউসেবক প্রভুভক্ত চাকর। ওকে কেউ এখানে থাকতে বলেনি, নিজে থেকেই আছে। লক্ষ্য করেছি শিউসেবক আর কলাবতী দুজনেই মালিকের অন্ধ ভক্ত। কিন্তু মালিকের স্ত্রীকে বোধহয় একটুও শ্রদ্ধা করে না।
লবির কিনারায় গিয়ে বাইরের অন্ধকারে হাত বাড়ালুম, হাতে বৃষ্টির ছিটে লাগল। এখনও টিপিটিপি চলেছে।
ঘরে ফিরে গেলুম।
চেয়ারে বসেছি, উনি চোখের ওপর থেকে হাত নামিয়ে বললেন, সলিলা ফিরেছে?
না।
আবার চোখের ওপর হাত রেখে শুলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, মেয়েমানুষের দাবাই কী জান? চাবুক। সকালে একবার, রাত্তিরে একবার। তবে তারা শায়েস্তা থাকে।
বললুম, চাবুক লাগালেই পারেন। কে মানা করেছে?
কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললেন, ওইটে যে পারি না। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে যদি পারতাম তাহলে কি আমার এ দশা হত।
তবে আর ভেবে কী হবে! ঘুমিয়ে পড়ুন, রাত এখনও অনেক বাকী। আমিও যে মেয়েমানুষ সেকথা আর বললুম না। অবশ্য তিনি একটি বিশেষ মেয়েমানুষকে লক্ষ্য করে কথাটা বলেছিলেন। এবং একথাও আমার বুঝতে বাকী থাকেনি, সলিলা যতই মন্দ হোক তাকে তিনি ভালবাসেন। সলিলা তাঁকে ভালবাসে না, সে অতি নীচ প্রকৃতির মেয়ে; তবু তাকেই তিনি ভালবাসেন, আর কাউকে নয়।
কিন্তু আমার বুকের মধ্যে অনাহত মৃদধ্বনি বেজে চলেছে। কী চুলোর ছাই পেয়ে মৃদঙ্গ বাজছে? কী পেলুম, কী দিলুম?
ঘড়ির কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে। ইনি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছেন, আবার জেগে উঠেই প্রশ্নভরা চোখে চাইছেন; আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছি—না, সলিলা আসেনি।
রাত্রি আড়াইটের সময় একবার চুপি চুপি ওপরে গেলুম। পিউয়ের ঘরে দাউ দাউ করে দুটো বালব জ্বলছে; কলাবতী পিউয়ের বিছানায় শুয়ে তাকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ। দাঁড়িয়ে পিউকে দেখলুম; ইচ্ছে হল কলাবতীকে সরিয়ে আমি পিউকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমুই। কিন্তু–
আজ একবার পাগলামি করেছি, বার বার পাগলামি ভাল নয়। তাছাড়া নীচে রোগী আছেন।
একটা বা নিভিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে গেলুম। রোগী চোখ চেয়ে আছেন। তাঁর চোখের নিঃশব্দ প্রশ্নের উত্তরে বললাম, না, আসেনি। আমি পিউকে দেখতে গিয়েছিলুম।
তিনি আবার চোখের ওপর বাহু রাখলেন।
রাত কেটে গেল, সকাল হল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে; কাঁচা রোদ্র ভিজে আকাশের গায়ে সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে।
রোগীর টেম্পারেচার নিলুম; জ্বর কমেছে, সাড়ে নিরানব্বই। তাঁকে কফি টোস্ট খাওয়ালুম, নিজেও এক পেয়ালা চা খেলুম। শিউসেবককে বললুম, আধ ঘণ্টা পরে এক দাগ ওষুধ খাওয়াবে, তারপর তিন ঘণ্টা অন্তর ওষুধ খাইয়ে যাবে। ব্যাগ তুলে নিয়ে রোগীকে বললুম, আমি এবার চললুম। আর একটু বেলা হলে দাড়িটা কামাবেন।
দরজা পার হয়েছি, পিছন থেকে ডাক এল, শুনে যাও।
ফিরে গিয়ে সামনে দাঁড়ালুম। চোখের ওপর চোখ রেখে বললেন, একবার তুমি বলবার পর আবার আপনি কেন?
আমি উত্তর দিলুম না, ফিরে গিয়ে গাড়িতে উঠলুম। অত রাগারাগির মধ্যেও লক্ষ্য করেছেন। বাসায় ফিরে গিয়ে শুনতে পেলুম শুক্লা নিজের শোবার ঘরে গান গাইছে—অঙ্গনে আওব যব রসিয়া।
দোরের কাছ থেকে উঁকি মেরে দেখি, সে স্নান করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। বললুম, ও গান নয় শুক্লা, সেই গানটা গাকে বলে পিরীতি ভাল।
সে চিরুনি হাতে কাছে এসে দাঁড়াল, আমার মুখের পানে খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, কী হয়েছে রে?
বললুম, যা হবার তাই হয়েছে। তুই যেমন মরেছিলি, আমিও তেমনি মরেছি। তোর তবু একটা সুরাহা ছিল, জামাইবাবু তোকে ভালবাসতেন। আমার কিছুই নেই।
চোখ থেকে হঠাৎ জল বেরিয়ে এল।
শুক্লা আমাকে জড়িয়ে নিল, তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, যা, আগে স্নান করে ঠাণ্ডা হ, তারপর শুনব।
যেতে যেতে বললুম, আর ঠাণ্ডা! এজন্মে আর ঠাণ্ডা হব না।
পরে শুক্লাকে সব বললুম। আর সাবধান করে দিলুম, জামাইবাবুকে কিছু বলবি না।
সে বলল, তাঁকে কিছু বলতে হবে না। তিনি ডাক্তর, রোগীর মুখ দেখে রোগ ধরতে পারেন। কিন্তু এ আমাদের কী হল ভাই! দুজনের কপালের লেখাজোখা কি একই রকম?
বিকেলবেলা ফোন করলুম, আমি প্রিয়ংবদা। এবেলা শরীর কেমন?
তিনি বললেন, ভালই মনে হচ্ছে। জ্বর বোধহয় নেই। তবে একটু দুর্বলতা আছে।
ডাক্তারের হুকুম মনে আছে তো? দুদিন নড়াচড়া বারণ।
মনে আছে।
বাড়ির খবর কী?
বাড়ির খবর–মানে সলিলার খবর? সে ফেরেনি। যাকগে, যা ইচ্ছে করুক, আমার কী? কথাগুলো ভারি বৈরাগ্যপুর্ণ শোনাল।
পিউ ভাল আছে?
আছে। কাল রাত জেগে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে তো?
কষ্ট! মনে মনে ভাবলুম, আমার কষ্ট তুমি কী বুঝবে? মুখে বললুম, রাত জাগতে আমার কষ্ট হয় না।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, কাল তুমি খুব বাঁচিয়ে দিয়েছ। রাগ হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। চাষা মনিষ্যি তো।
বললুম, আপনি চাষা মনিষ্যি নয়। কিন্তু একটা কথা জিগ্যেস করি, লেখাপড়া শেখেননি কেন?
ধমক দিয়ে বললেন, আবার আপনি!
দু-তিনবার ঢোক গিললুম, তারপর বললুম, আচ্ছা বল, লেখাপড়া শেখনি কেন?
সহজভাবে বললেন, শিখব কখন? বাবা সামান্য চাকরি করতেন; আমার যখন তেরো বছর বয়স তখন তিনি মারা গেলেন। সংসার ঘাড়ে পড়ল। তারপর মা মারা গেলেন, তারপর হোটবোনটাও মরে গেল। ব্যস, সংসারে আমি একা; আর লেখাপড়ার দরকার কী? রোজগারের ধান্দায় লেগে গেলাম।
ইচ্ছে হল জিগ্যেস করি, এমন বউ যোগাড় করলেন কোত্থেকে? কিন্তু সংকোচ হল, প্রশ্ন করতে পারলুম না। বললুম, আচ্ছা কাল আবার ফোন করব।
আচ্ছা।
ফোন রেখে দিলুম। শরীরের সমস্ত স্নায়ুশিরা যেন টান হয়ে আছে। আবার এবেলা স্নান করব। তারপর খেয়ে ঘুমুব, যত পারি ঘুমুব। যতক্ষণ ঘুমুব অন্তত ততক্ষণ মনটা শান্ত থাকবে।
স্নান করে এসে শোবার ঘরে দোর বন্ধ করলুম। আলো জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালুম। আয়নায় আমার দেহের প্রতিবিম্ব পড়েছে। মুখ ফিরিয়ে নেবার মত নয়। কিন্তু কতদিন থাকবে এ যৌবন? মেয়েদের যৌবন কতদিন থাকে? সকালবেলার ফোটা ফুল সন্ধ্যেবেলায় শুকিয়ে যায়।
রাত্রি নটার সময় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। ভেবেছিলুম ঘুমিয়ে পড়ব, কিন্তু কোথায় ঘুম! এগারোটা পর্যন্ত এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লুম। চোখে মুখে জল দিয়ে আলো জ্বেলে ডায়েরি লিখতে বসেছি।
রাত্রি এখন আড়াইটে। বেশ আছি আমি; দিনে ঘুম নেই, রাত্রে ঘুম নেই। একেবারে তপস্বিনী হয়ে গেছি।