২০ শ্রাবণ।
কাল ডায়েরি লেখা শেষ হল না।
শুক্লার সঙ্গে ওই কথা নিয়ে তোলাপাড়া করতে করতে বেলা বেড়ে গেল, তখন একেবারে নাওয়া-খাওয়া সেরে শুতে গেলুম। শুক্লার আজ দুপুরে কাজ, সে বেরিয়ে গেল। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম, কাল যে ফোন করেছিল সে যদি মন্মথ কর হয় তবে তার মতলব কী? ব্ল্যাকমেল?…
ঘুমিয়ে উঠে ডায়েরি লিখতে বসেছিলুম, লেখা শেষ হবার আগেই দেখি আটটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলুম। ঠিক নটার সময় গাড়ি এল।
গিয়ে দেখি, পিউয়ের ঘরে শঙ্খনাথবাবু আছেন, দোরের পাশে কলাবতী হাঁটু উঁচু করে বসে আছে; পিউ বিছানায় বসে পুতুল-নিলে খেলা করছে। আমাকে দেখে শঙ্খনাথবাবু বললেন, দেখ একবার কাণ্ড। পিউ এখনও ঘুমোয়নি।
জিগ্যেস করলুম, খেয়েছে?
কলাবতী দাঁত বার করে ঘাড় নাড়ল। আমি তখন পিউয়ের কাছে গিয়ে একটু ধমকের স্বরে বললুম, পিউ, তুমি এখনও ঘুমোওনি?
পিউ আমার পানে মুখ তুলে মিষ্টিমিষ্টি দুই-দুষ্ট হাসি হাসল, কচি দাঁতগুলি ঝিকমিক করে উঠল। তার এই হাসি দেখে বুঝলুম তার মনের ওপর থেকে রোগের ছায়া সরে গেছে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে।
তারপর সে পুতুল ফেলে আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল।
কোলে তুলে নিলুম। সে আমার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল। …মেয়েটাকে কোলে নিলে বুক জুড়িয়ে যায়।
তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করবার পর বিছানায় শুইয়ে দিলাম। সে তখনও জেগে আছে, কিন্তু চোখ দুটো ঘুমে ভরে উঠেছে। পাখির মত মৃদু কূজন করে বলল, ঘুমুই?
ঘুমোও বলে আমি তার গায়ে হাত রাখলুম।
আশ্চর্য, এক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমি বিছানার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শঙ্খনাথবাবুর দিকে চাইলুম; তিনি ফিসফিস করে বললেন, পিউ তোমার জন্যেই জেগে ছিল।
এই সময় দোরের কাছে এক অপরূপ মূর্তির আবির্ভাব হল। পিউয়ের মা যে আজ বাড়িতেই আছে তা জানতুম না। দেখলুম আটপৌরে ঘরোয়া পোশাকেও তাকে কম মানায়নি। সাদাসিধে ঢিলেঢালা সিল্কের শাড়ি ব্লাউজ, তার ওপর একটি জাপানী কিমোনো, পায়ে লাল মখমলের স্লিপার, চুলগুলি একটু শিথিল। গায়ে গয়না নেই, কেবল গলার কণ্ঠিতে কাঁইবিচির মত একটি চুনি ধকধক করছে।
এত রূপ। শুক্লার মুখে গান শুনেছি–ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়। এ যেন তাই। কিন্তু গুণ কি একটিও নেই?
শঙ্খনাথবাবুর পানে আড়চোখে তাকালাম। তিনিও সলিলার পানে চেয়ে আছেন; তাঁর চোখে আকর্ষণ-বিকর্ষণের একটা দ্বন্দ্ব চলছে। তৃষ্ণা আর বিতৃষ্ণা একসঙ্গে। কী অদ্ভুত এঁদের সম্পর্ক।
আমার কাজ আছে–নীচে যাচ্ছি—এই বলে শঙ্খনাথবাবু চলে গেলেন। সলিলা তাঁর পানে একবার তাকালও না।
আজ সে বেড়াতে বেরোয়নি কেন কে জানে। হয়তো নেচে নেচে হাঁপিয়ে পড়েছে, একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।
শঙ্খনাথবাবু বেরিয়ে যাবার পর সলিলা পিউয়ের খাটের পাশে এসে দাঁড়াল, হাসিহাসি মুখে পিউয়ের পানে একবার তাকিয়ে বলল, পিউ ঘুমিয়েছে?
বললুম, হ্যাঁ, এই ঘুমোল।
সলিলা আমার পানে প্রশংসা-ভরা চোখে চাইল, একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, কী সুন্দর আপনার জীবন! শিশুর সেবা! তার কথাগুলি মুখে মিলিয়ে গেল।
শুধু শিশু নয়, দরকার হলে বৃদ্ধবৃদ্ধাদেরও সেবা করে থাকি—একথা আর বললুম না। এবং আমার কর্মজীবনে সুন্দর যদি কিছু থাকে তা সম্পূর্ণ আকস্মিক, একথা বলেও কোনও লাভ নেই। বললুম, সুন্দর কি না জানি না, কিন্তু আমার ভাল লাগে।
সলিলার চোখের প্রশংসা আরও গাঢ় হল, সে বলল, আপনাকে হিংসে হয়। মনে মনে আশ্চর্য হলুম। সলিলা আমাকে হিংসে করে! কিন্তু আসল কথাটা কী? আমার মত সামান্য নার্সের কাছে লক্ষপতির স্ত্রী সলিলা কী চায়? হয়তো কিছুই চায় না, কথা কইবার একজন লোক চায়। কিংবা অপরিচিতের কাছে, নিজেকে ভাল মেয়ে প্রতিপন্ন করবার ইচ্ছে মেয়েদের স্বাভাবিক ধর্ম, হয়তো সলিলা সেই চেষ্টাই করছে।
সে বলল, আচ্ছা, আপনার সত্যিকার নামটি কী বলুন তো? শঙ্খ-ডার্লিং কী একটা অদ্ভুত কথা বলে–
বললুম, প্রিয়দম্বা। আমার সত্যিকার নাম প্রিয়ংবদা।
সে খিলখিল করে হেসে উঠল—প্রিয়ংবদাকে প্রিয়দম্বা বলে! পুওর শঙ্খ, হাউ ফানি হি ইজ।
মনে মনে ভাবলুম, ফানি বইকি, ভীষণ ফানি। কিন্তু তার চেয়েও ফানি, তুমি স্বামীকে শঙ্খ-ডার্লিং বল।
জিগ্যেস করলুম, মাফ করবেন, আপনি কি বিলেতে মানুষ হয়েছেন?
সলিলা মুখখানি করুণ করে বলল, বিলেত যাওয়া আর হল কই। এত যাবার ইচ্ছে, কিন্তু শঙ্খর মত নেই! হ্যাজব্যান্ড আর ফানি, ডোন্ট ইউ থিঙ্ক?
হেসে বললুম, জানি না। আমার বিয়ে হয়নি।
এই সময় কলাবতীর ওপর চোখ পড়ল। সে দোরের পাশে হাঁটু তুলে বসে সলিলার পানে তাকিয়ে আছে। একটা দাসীর চোখে গৃহস্বামিনীর প্রতি এতখানি ঘৃণা আর অবজ্ঞা আমি আগে দেখিনি, দেখলে চমকে উঠতে হয়।
সলিলার কিন্তু সেদিকে নজর ছিল না, সে বলল, বিয়ে হয়নি। হাউ লাকি ইউ আর। আসুন না আমার ঘরে, খানিক বসে গল্প করা যাক।
বললুম, কিন্তু পিউ—
কলাবতী ততক্ষণ পিউকে দেখবে।
পিউ ঘুমুচ্ছে, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে হাসি-গল্প করলে সে জেগে উঠতে পারে। বললুম, চলুন।
কলাবতীকে ডেকে বললুম, তুমি পিউয়ের কাছে একটু থাক, আমি আসছি।
আসুন বলে সলিলা এগিয়ে চলল, আমি পিছু পিছু গেলুম। দেখাই যাক না ওর মনে আরও কী আছে।
সলিলা আমাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। বারান্দার শেষ প্রান্তে ঘরটি, মৃদু নৈশ-দীপ জ্বলছে। ঘুম-নগরের রাজকুমারী যে-ঘরে শুয়ে ঘুমুতেন, এ যেন সেই ঘর। সলিলা সুইচ টিপে কয়েকটা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে দিল, ঘরটি ঝলমল করে উঠল।
চৌকশ ঘর, লম্বায় চওড়ায় বোধ হয় বিশ ফুট। ঝকঝকে নতুন আসবাব দিয়ে সাজান। প্রত্যেক দেয়ালে বড় বড় আয়না, তা ছাড়া একটি অপূর্ব ড্রেসিং-টেবিল। ঘরের মাঝখানে খাট। কিন্তু জোড়া-খাট নয়, একজনের শোবার মত খাট। বিছানায় পুরু সিল্কের বেড়কভার পাতা।
ঘরের দুপাশে দুটি পদা-ঢাকা দোর। ঘর দুটিতে কী আছে দেখতে পেলুম না; একটি বোধহয় বাথরুম, অন্যটি হয়তো শঙ্খনাথবাবুর শোবার ঘর।
ড্রেসিং-টেবিলের কাছে কয়েকটি গদিমোড়া উঁচু তাকিয়ার মত আসন রয়েছে; সলিলা একটিতে আমাকে বসতে বলল, আর একটিতে নিজে বসে ড্রেসিং-টেবিলের আয়নায় নিজের মুখ একবার দেখে নিল; হাসিমুখে বলল, এটা আমার শোবার ঘর।
তা না বললেও চলত। তবু এটা শঙ্খনাথবাবুরও শোবার ঘর কি না তাই জানবার জন্যে মন উসখুস করছে। কিন্তু জিগ্যেস করা তো যায় না।
বললুম, সুন্দর আপনার ঘরটি।
সে তৃপ্তি-ভরা চোখে একবার ঘরের চারিদিকে তাকাল, বলল, মনের মত করে সাজাতে কী কম খরচ হয়েছে! দশটি হাজার টাকা।
তা হবে। আমি কেমন করে জানব! বললুম, টাকা থাকলে ভাল বাড়ি করা যায়, সাধ মিটিয়ে বাড়ি সাজান যায়।
কথাটা সলিলার বোধহয় খুব মনঃপূত হল না, সে একটু বিমনা হয়ে বলল, তা হয়তো যায়। কিন্তু সব সাধ কী টাকায় মেটে?
খুবই উচ্চাঙ্গের কথা। কিন্তু সলিলার কোন্ সাধটা মেটেনি জানবার জন্যে ভুরু তুলে তার পানে চাইলুম। সে বলল, টাকায় কি স্বাধীনতার সাধ মেটে? ধরুন না কেন আপনি। আপনার স্বাধীনতা আছে, যখন যা ইচ্ছে করতে পারেন। সবাই কি তা পারে?
ও, ব্যথা তবে ওইখানে। স্বাধীনতার অভাব। স্বামীর টাকায় বড়মানুষি করব, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় চলব! যখন যা ইচ্ছে করতে পারাটাই স্বাধীনতা। বললুম, আমার স্বাধীনতা আছে বটে কিন্তু যখন যা ইচ্ছে করতে পারি না। তার জন্যে টাকা চাই। ভগবান বোধহয় সকলের সব সাধ মেটাতে ভালবাসেন না।
আমার দিকে একটা বাঁকা কটাক্ষ হেনে সে আয়নার দিকে চোখ ফেরাল, তাচ্ছিল্যভরে বলল, যাকগে ওসব কথা, মন খারাপ করে লাভ কি? আমার চুলগুলো কি বিশ্রী হয়ে আছে।
সে উঠে গিয়ে ড্রেসিং-টেবিলের আয়নার মুখোমুখি বসল, চুলগুলোকে আরও একটু আলগা করে দিয়ে হাল্কাভাবে বুরুশ চালাতে লাগল। চুল খুব লম্বা নয়, কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা; কিন্তু রেশমের মত নরম আর উজ্জ্বল।
আমি বসে বসে তার চুলের প্রসাধন দেখতে লাগলুম। ড্রেসিং-টেবিলের ওপর নানা জাতের নানা রঙের শিশি-বোতল কৌটো সাজান; তেল সেন্ট ক্রীম পাউডার, আরও কত কী। যা কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু একটি জিনিস সেখানে নেই; পিউ কিংবা শঙ্খনাথবাবুর ফটোগ্রাফ নেই। ঘরে কোথাও স্বামী বা মেয়ের ছবি নেই; ঘরে স্বামীর বা মেয়ের ছবি রাখেনি সলিলা। কী জানি, যারা সর্বদা চোখের সামনে রয়েছে তাদের ছবি দরকার নেই বলেই বোধহয় রাখেনি। শুনেছি ড্রেসিং-টেবিলে প্রিয়জনের ছবি রাখা বিলাতী রীতি।
আর-একটি জিনিস নেই। সিঁদুরকৌটো। আগেও লক্ষ্য করেছিলুম সলিলা সিঁথিতে সিঁদুর পরে। টেবিলে গালে মাখাবার রুজ আছে, ঠোঁটে লাগাবার সোনা বাঁধানো লিপস্টিক আছে; কিন্তু সিঁদুরকৌটো নেই। ওদের প্রগতিশীল সমাজে সিদুর পরা বোধহয় ঘোর কুসংস্কার।
চুল বুরুশ করা শেষ হলে সলিলা টেবিল থেকে একটি সেন্টের শিশি তুলে নিয়ে তার কাচের ছিপি খুলে গন্ধ শুকলো, তারপর আয়নার ভিতর দিয়ে আমার পানে চেয়ে বলল, দেখি আপনার রুমাল!
ভাগ্যে হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে একটা পাট-না-ভাঙা রুমাল ছিল, বার করে দিলুম। সলিলা সেটাতে এসেন্সের ছিটে দিয়ে বলল, এবার শুকে দেখুন। কেমন গন্ধ?
সত্যি কী গন্ধ! অতি মৃদু গন্ধ, কিন্তু নেশা লেগে যায়; মনে হয় বসন্তের সমস্ত ফুল ওই শিশির মধ্যে তাদের মধু ঢেলে দিয়েছে। বললুম, অপূর্ব গন্ধ।
সলিলা হেসে আমার দিকে ফিরল, শিশিটি দুই আঙুলে তুলে ধরে বলল, কত দাম জানেন? এই শিশিটির দাম আড়াই শো টাকা।
হবেও বা। কিন্তু দাম শুনে গন্ধের মাধুর্য যেন কমে গেল। সলিলা মৃদু হেসে বলল, আমার একটি বন্ধু উপহার দিয়েছে।
বন্ধু! নিশ্চয় পুরুষ বন্ধু। মেয়ে বন্ধু এত দামী জিনিস উপহার দেবে না; অন্তত ওদের সমাজের মেয়ে দেবে না। আমি হেসে ঘাড় নাড়লুম। শঙ্খনাথবাবুর মনের ভাব কতকটা যেন বুঝতে পারছি।
সলিলা হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আপনি তো স্বাধীন, আপনার নিশ্চয় অনেক বন্ধু আছে?
স্বাধীনতার সঙ্গে বন্ধুর নিশ্চয় গাঢ় সম্পর্ক আছে। আমি সাবধানে প্রশ্ন করলুম, কোন্ বন্ধুর কথা বলছেন? পুরুষ বন্ধু? না মেয়ে বন্ধু? আমার একটি বান্ধবী আছে। তার নাম শুক্লা–
না, না, পুরুষ বন্ধু। মানে ইয়ং মেন—
আমি দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললুম, ওরকম বন্ধু আমার একটিও নেই।
অবাক হয়ে সলিলা বলল, একটিও না?
একটিও না। তবে একজন পরম বন্ধু আছেন, তাঁর বয়স কিন্তু চল্লিশের ওপর। তিনি কোনদিন আমাকে চায়ের নেমন্তন্ন পর্যন্ত করেননি, সিনেমা দেখতেও নিয়ে যাননি।
সলিলা চুক্ষ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল, বোধহয় বিশ্বাস করল না। কিন্তু—শুনেছি-নার্সদের সঙ্গে ইয়ং ডক্টরদের ভাব-সাব থাকে আপনি তো দেখতে শুনতে ভালই কথাটা ঠিক রুচিসম্মত হল না ভেবেই সে বোধহয় থেমে গেল।
একজন ইয়ং ডক্টর ভাব-সাব করবার চেষ্টা করেছিলেন, এখনও করছেন; কিন্তু সুবিধে করতে পারছেন না। আচ্ছা, এবার পিউয়ের কাছেই যাই। আপনার বোধহয় ঘুমুবার সময় হল। বলে আমি উঠে দাঁড়ালুম।
সলিলাও উঠল। বলল, না না, তার এখনও ঢের দেরি। আসুন, আমার ড্রেসিংরুম দেখবেন না?
নিরুপায় হয়ে বললুম, চলুন দেখি।
সলিলার স্বাধীনতার সাধ মেটেনি বলেই বোধহয় আমাকে তার ঐশ্বর্য দেখিয়ে বড়মানুষির সাধ মেটাতে চায়। যার সারা অঙ্গে এত রূপ তার মন এত খেলো কেন? সেখানে কি এতটুকু লাবণ্য থাকতে নেই?
পর্দা সরিয়ে সলিলা আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটি শোবার ঘরের চেয়ে হোট। দেয়ালের গায়ে সারি সারি ওয়াড্রোব, সবগুলির কপাটে আয়না লাগান। একটা দেয়ালে লম্বা তাকের ওপর প্রায় তিরিশ জোড়া জুতো। কত রঙের কত ঢঙের জুতো; লাল সাদা নীল সোনালী; কোনওটা হাই-হিল, কোনওটা হিললেস, কোনওটা নাচের পাম্প। জুতোর বাহার দেখেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
তারপর সলিলা একে একে ওয়াড্রোবগুলি খুলে খুলে আমাকে দেখাতে লাগল। কোনওটিতে শাড়ি ব্লাউজ, কোনওটিতে শালোয়ার পায়জামা ওড়না; অন্তর্বাস বহির্বাস, কাঁচুলি ব্রাসেয়ার, আরও কত কী। বলে শেষ করা যায় না।
মুগ্ধ হয়ে দেখছি, তবু মনটা ছটফট করছে। পরের ঐশ্বর্য দেখে আমার কী লাভ? এসব জামাকাপড় পোশাক পরিচ্ছদ আমি তো কোনওদিন কিনতে পারব না। এসব জিনিস আমার কাছে আকাশের চাঁদের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য।
আয়নার ওপর ছায়া পড়ল। শঙ্খনাথবাবু দোরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। সলিলাও তাঁকে দেখতে পেয়েছিল, চট করে ওয়াড্রোবের কপাট বন্ধ করে বলল, চলুন চলুন, দেখা হয়েছে। কী-ইবা দেখবার আছে, সামান্য দু-চারটে কাপড় বলতে বলতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শঙ্খনাথবাবু বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে তার পিছন পিছন বেরুলেন। আমি তাঁর পিছনে বেরুলুম। একটা দাম্পত্য দুর্যোগ ঘনিয়ে উঠেছে। আমি আর দাঁড়ালুম না, সোজা গিয়ে পিউয়ের পাশে বসলুম। কলাবতী মেঝেয় বসে ঢুলছিল, তাকে বললুম, তুমি এবার যাও। সে চলে গেল।
কান খাড়া করে শুনছি। শোবার ঘর থেকে মিহি আর মোটা গলার ড়ুয়েট আসছে, কিন্তু কথাগুলো ধরা যাচ্ছে না। শঙ্খনাথবাবু চটলেন কেন, সলিলাই বা তাঁকে দেখে ড্রেসিংরুম থেকে অমনভাবে পালাল কেন? শঙ্খনাথবাবু কি পছন্দ করেন না যে সলিলা তার কাপড়-চোপড় অন্যকে দেখায়? কেন পছন্দ করেন না?
পনেরো মিনিট পরে শঙ্খনাথবাবু এলেন। পিউয়ের খাটের পাশে বসে গম্ভীরমুখে আমার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে বললেন, প্রিয়দম্বা, তুমি কিছু মনে কোর না, নিজের জাঁক দেখানো সলিলার অভ্যেস।
তাঁর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলুম। চাষা-মনিষ্যির মনে জাঁক দেখানো সম্বন্ধে সংকোচ আছে তাহলে। বললুম, সব মেয়েই জাঁক দেখাতে ভালবাসে, নিজের গয়না কাপড় দেখাতে ভালবাসে। এতে মনে করার কী আছে?
তিনি বললেন, তুমি দেখাতে ভালবাস?
আমার থাকলে ভালবাসতুম।
হুঁ–বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন; আর কোনও কথা বললেন না, পিউয়ের পানে একবার চেয়ে থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমার নিশি-জাগরণ আরম্ভ হল। আজও বই আনতে ভুলে গেছি। বসে বসে ভাবছি…এ ভাবে আর কতদিন চলবে? সুস্থ মেয়েকে রাত জেগে পাহারা দেওয়া কি নার্সের কাজ?…সলিলা…মেয়ের কথা ভাবে না, স্বামীর কথা ভাবে না…এত পেয়েও তবু তৃষ্ণার শেষ নেই। সে নির্বোধ নয়, বুদ্ধি। আছে; কিন্তু তার বুদ্ধিকে চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে অন্ধ ভোগতৃষ্ণা…এর শেষ কোথায়? চিরদিন তো রূপযৌবন থাকবে না, তখন ও কী করবে?…আর শঙ্খনাথবাবু? গরিবের ছেলে, নিজের চেষ্টায় বড়মানুষ হয়েছেন; কিন্তু মন মধ্যবিত্ত রয়ে গেছে। সাদাসিধে আটপৌরে মন, এখনও বড়মানুষির আঁচ মনে লাগেনি। কিন্তু লাগতে কতক্ষণ!
পিউ একটু উসখুস করল। তাকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিলুম, সে আবার শান্ত হয়ে ঘুমুতে লাগল।
একটা-দুটো-তিনটে। রাত শেষ হয়ে আসছে। আজ কেন জানি না একটু ক্লান্তি বোধ হচ্ছে। আমি রাতের পর রাত জেগে সেবা করেছি, কখনও ক্লান্তি আসেনি। আজ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। দেহের ক্লান্তি কি মনের ক্লান্তি বুঝতে পারছি না। কিন্তু যাকে সারাজীবন এই কাজ করতে হবে, তার ক্লান্তি এলে চলবে কেন? ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
সাড়ে তিনটের সময় দোরের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখি শঙ্খনাথবাবু দুপেয়ালা চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছেন; মুখে একটু হাসি। উঠে গিয়ে তাঁর হাত থেকে চা নিলুম। বললুম, আপনি রোজ রোজ এত রাত্রে আমার জন্যে চা তৈরি করে আনেন কেন? আমার দরকার হলে আমি নিজেই তো চা তৈরি করে নিতে পারি।
তিনি বললেন, শুধু কি তোমার জন্যে তৈরি করেছি। শেষ রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুমুতে পারি না, তখন চা খেতে ইচ্ছে করে। নিজেই চা তৈরি করে খাই। তুমি জেগে থাক তাই তোমার জন্যেও করি।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললুম, ধন্যবাদ। আপনি–
তিনি তর্জনী তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন। আমি খানিক তাঁর হাসি-হাসি মুখের পানের চেয়ে বললুম, কী হল?
তিনি বললেন, আমাকে আপনি বলছ যে।তুমি বলবার কথা। কী চুক্তি হয়েছিল?
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লুম। কিন্তু সত্যিই তো আর ভদ্রলোককে তুমি বলা যায় না, মুখ দিয়ে বেরুবে কেন? রাগের মুখে কী বলেছিলুম, উনি সেটি মনে গেঁথে রেখেছেন।
ওকথা এড়িয়ে বললুম, শঙ্খনাথবাবু, একটা কথা বলি?
তিনি সন্দিগ্ধভাবে আমার পানে তাকিয়ে বললেন, কী কথা?
একটু ইতস্তত করে বললুম, এবার আমাকে ছুটি দিন। পিউ তো এখন সেরে গেছে—
কথা ছিল যতদিন না ভাল ঝি পাই কতদিন তুমি থাকবে।
তা সত্যি কিন্তু কতদিনে আপনি ভাল ঝি পাবেন তার ঠিক কী? আমি অন্য কাজও তো আছে আমার।
যদি আরও বেশী টাকা চাও—
না না, টাকার কথা নয়। টাকা আপনি যথেষ্ট দিচ্ছেন, কিন্তু–
বুঝেছি, সলিলার ব্যবহারে তুমি রাগ করেছ। কিন্তু পিউ তো কোনও দোষ করেনি।
আমার চোখে জল এসে পড়ল। কোনওমতে সামলে নিয়ে বললুম, কেউ কোনও দোষ করেনি। কিন্তু আমাকে আর এখানে দরকার নেই, কাল থেকে আর আমি আসব না।
এবার তাঁর সুর কড়া হয়ে উঠল–বেশ, আসতে না চাও এসো না। আমি কারুর ওপর জোর করতে চাই না। তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি বলেই থাকতে বলেছিলাম। এই বলে হঠাৎ চলে গেলেন।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। শঙ্খনাথবাবু এতটা অবুঝ হবেন ভাবিনি। তাঁকে অসন্তুষ্ট করে চলে যাবার ইচ্ছে আমার ছিল না, ভালয় ভালয় যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু উপায় কী? বাঁধন তো ছিঁড়তে হবে।
সকালে পিউ জেগে ওঠবার আগেই চলে এলুম। ইচ্ছে হল পিউয়ের ঘুমন্ত গালে একটা চুমু খাই। কিন্তু কাজ নেই মায়া বাড়িয়ে।
শঙ্খনাথবাবু গম্ভীরমুখে টাকা চুকিয়ে দিলেন, কথা কইলেন না। মোটর বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
পিউয়ের কথা মনে পড়ছে আর বুকের মধ্যে টনটন করে উঠছে। আর হয়তো কোনওদিন ওকে দেখতে পাব না। কিন্তু এই ভাল।
বাসায় পৌঁছে দেখলুম শুক্লা কাজে বেরুচ্ছে। বলে গেল, এ-বেলা রান্না হল না, হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খাস। আমার ফিরতে সন্ধ্যে হবে।
কিন্তু হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খেতে ইচ্ছে হল না। বাড়িতে ডিম ছিল, তাই দুটো সেদ্ধ করে খেলুম। তারপর শুয়ে পড়লুম।
ঘুম ভাঙল পৌনে দুটোর সময়। উঠে রান্না চড়াম। বেশী কিছু নয়, ভাত ডাল আর একটা নিরামিষ তরকারি। শুক্লা ফিরলে দুজনে মিলে খাব। যদি দরকার হয় হোটেল থেকে মাংস আনিয়ে নিলেই হবে।
রান্না শেষ করে ডায়েরি লিখতে বসেছি। আজ রাত্রে জামাইবাবু আসবেন কি না কে জানে। মনটা ওই ব্যাপার নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে রয়েছে। যদি আসেন রাত্রি দশটার আগে আসবেন না। তখন ওঁর জন্যে ভাল করে রান্না করব। আজ রাত্তিরে আমার তো কোথাও যাবার নেই।