রিমঝিম – ২

১৮ই শ্রাবণ।

কাল রাত্তিরে সে কী কাণ্ড!

অফিস-ঘরে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিলুম, নিজের টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললুম, কাকে চাই?

হেঁড়ে গলায় উত্তর এল, প্রিয়দম্বা  ভৌমিককে চাই।

রাগে গা জ্বলে গেল। কি রকম অসভ্য। আমার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে জানে না। বললুম, প্রিয়দম্বা নয়, প্রিয়ংবদা। আমিই মিস্ ভৌমিক। কী চাই বলুন?

হেঁড়ে গলা বলল, আমার বাচ্চা মেয়ের ভয়ানক অসুখ, তাকে রাত জেগে দেখাশোনা করবার কেউ নেই। আপনাকে আসতে হবে।

রাত দুপুরে ডাক আসা আমাদের পক্ষে কিছু নতুন নয়। কিন্তু আজ মনটা কেমন বেঁকে বসল। তবু এক কথায় যাব না বলা চলে না। বললুম, আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন?

আমি শঙ্খনাথ ঘোষ। ১১৭ বেলেঘাটা নিউ অ্যাভিনিউ থেকে বলছি।

রাত্তিরে কাজ করলে আমার ফী পঞ্চাশ টাকা।

দেব পঞ্চাশ টাকা।

কিন্তু এই বৃষ্টিতে যাব কী করে? এত রাত্রে ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না।

আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসুন।

গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য লোক। আমি যেতে পারব কি না, বাড়িতে আছি কি না,–জেনেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন আর এড়াবার উপায় নেই। টেলিফোন রেখে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে গেলাম।

শোবার ঘরে নার্সের ইউনিফর্ম পরতে পরতে ভীষণ রাগ হতে লাগল। বড়মানুষ নিয়েই আমাদের কাজ; যারা গরিব তারা তো আর রোগীর সেবার জন্য নার্স ডাকতে পারে না, নিজেরাই যতটুকু পারে সেবা-শুশ্রুষা করে। কিন্তু এই বড়মানুষগুলো যেন কী রকম, ওদের চালচলন ভাবভঙ্গি সব আলদা; দুচক্ষে দেখতে পারি না। যাঁরা বনেদী বড়মানুষ তাঁরা ভদ্র ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু মুরুব্বীয়ানায় অনুগ্রহের ভাব; টাকাকড়ি সম্বন্ধে ভারি চালাক, এঁদের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করা কঠিন কাজ। আর যাঁরা ভুঁইফোঁড় বড়মানুষ তাঁরা দুহাতে টাকা ছড়াতে ভালবাসেন, কিন্তু ব্যবহার একেবারে চাষার মত। মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানেন না; ভাবেন টাকা দিলেই যথেষ্ট, ভদ্রতার দরকার নেই। এই শঙ্খনাথ ঘোষটি বোধ হয় ভুঁইফোঁড় বড়মানুষ। প্রিয়দম্বা। কী কথার ছিরি! লেখাপড়া শিখেছেন বোধ হয় পাঠশালা পর্যন্ত। অথচ টাকা আছে।

ভোঁ ভোঁ। রাস্তায় দোরের সামনে মোটরহনের আওয়াজ শুনে বুঝলুম মোটর এসেছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। সদর-দরজায় তালা লাগিয়ে বেরুতে হল, বাসায় কেউ থাকবে না। শুক্লার কাছে আলাদা চাবি আছে, সে যদি আমার আগে ফেরে কোনও অসুবিধে হবে না।

নীচে নেমে দেখলুম প্রকাণ্ড জাহাজের মত একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিল, আমি টুক করে গাড়িতে উঠে পড়লুম; তবু মাথা মুখ বৃষ্টিতে ভিজে গেল। বাবা, কী বৃষ্টি! আমার জন্মদিন বেশ জানা দিচ্ছে।

গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে ড্রাইভার জিগ্যেস করল, আপনি মিস্ ভৌমিক?

হ্যাঁ।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। ঝাপসা নির্জন রাস্তা দিয়ে কোথায় চলেছি বোঝা যায় না। যেন স্বপ্নের মধ্যে কোন্ এক রহস্যময় অভিযানে চলেছি, জেগে উঠে দেখব ডায়েরি লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।

পাঁচ মিনিট পরে গাড়ি লোহার ফটক পার হয়ে ছাদ-ঢাকা গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল। একজন ফিটফাট উর্দিপরা চাকর বেরিয়ে এল, গাড়ির দোর খুলে বলল, আসুন মিস্।

আমি নামলুম। চাকরটা ড্রাইভারকে ফিসফিস করে কী বলল, তারপর তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বলল, আমার সঙ্গে আসুন, দোতলায় যেতে হবে। ড্রাইভার মোটর ঘুরিয়ে আবার বেরিয়ে গেল।

আমি চাকরের সঙ্গে যেতে যেতে নীচের তলার কয়েকটা ঘর দেখতে পেলুম; সব ঘরেই উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। একটা ঘর ড্রয়িংরুমের মত সাজানো। কিন্তু কোথাও লোজন নেই। বাড়িটা চমৎকার, ঝকঝকে নতুন। মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে ভাবলুম, ভুইফোঁড় বড়মানুষই বটে; বোধ হয় যুদ্ধের বাজারে ধান-চালের ব্যবসা করে লাখপতি।

ওপরতলাটা আলোয় আলো, যেন বিয়ে বাড়ি। কিন্তু মানুষ নেই। চাকর আমাকে নিয়ে একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। প্রকাণ্ড ঘর, নার্সারির মত সাজানো; শিশুর ছোট্ট খাট, দোলনা; নানা রকম ছোট-বড় খেলনা ঘরের চারিধারে ছড়ানো রয়েছে। দুটো বড় বা জ্বলছে। একটা ঘাগরা-পরা ঝি-জাতীয় স্ত্রীলোক দোরের পাশে উবু হয়ে বসে আছে। আর, একজন পুরুষ একটি শিশুকে বুকে নিয়ে পায়চারি করছেন।

চাকর দরজার কাছ থেকে নিচু গলায় বলল, বাবু, নার্স এসেছেন।

ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন। ঘন ভুরুর নীচে থেকে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ কিছুক্ষণ আমার পানে চেয়ে রইল। তারপর চোখ দুটো আমার মুখ থেকে নেমে দোরের পাশে ঝিয়ের ওপর পড়ল। কলাবতী। ঝি তখনই উঠে গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াল—খুকিকে শুইয়ে দাও। দেখো, ওর ঘুম না ভেঙে যায়।

ঝি অতি সন্তর্পণে শিশুকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল; শিশু একটু উসখুস করল, কিন্তু জাগল না। তখন ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ। তামাটে ফরসা রঙ, দোহারা গড়ন, কিন্তু ভুড়ি নেই; মুখখানা যেন পেটাই-করা লোহা দিয়ে তৈরি। একটু রুক্ষ রুক্ষ ভাব। মেয়েকে নিশ্চয় খুব ভালবাসেন, নিজেই তাকে বুকে করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু ওঁর স্ত্রী কোথায়? তবে কি বিপত্নীক?

লোকটির প্রতি মনে একটু সহানুভূতি জাগতে শুরু করেছিল, কথা শুনে সাহনুভূতি উবে গেল। যেন বেশ আশ্চর্য হয়েছেন এমনিভাবে বললেন, তুমি নার্স? প্রিয়দম্বা ভৌমিক?

আপরিচিত মহিলাকে আপনি বলতে হয় তাও তিনি জানেন না। তার ওপর প্রিয়দম্বা! দাঁতে দাঁত চেপে বললুম, প্রিয়দম্বা নয়—প্রিয়ংবদা।

তিনি বললেন, ও একই কথা। তুমি নার্স। রোগীর সেবা করতে জান?

ডিপ্লোমা দেখবেন?

দরকার নেই। ডাক্তার যখন রেকমেণ্ড করেছে তখন জান নিশ্চয়। আমার ধারণা ছিল নার্সদের বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশ হয়।—সে যাক, আমার মেয়ের বড় অসুখ, রাত্তিরে তার দেখাশোনা করবার লোক নেই। যতদিন দরকার তোমাকেই রাত্তিরে থাকতে হবে।

প্রশ্ন করলুম, রোগটা কী?

মেনিঞ্জাইটিস্।

কোন ডাক্তার দেখছেন?

দেখেছে অনেক ডাক্তারই। চার্জে আছে আমার ফ্যামিলি ডাক্তার। সে আজ রাত্রি দশটা পর্যন্ত এখানে ছিল। এস, তাকে ফোন করতে হবে। সে তোমাকে ইনস্ট্রাকশন দেবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি পাশের ঘরে গেলেন, আমি সঙ্গে গেলুম। এ ঘরে টেলিফোন আছে, তিনি টেলিফোন তুলে ডায়েল করলেন, বললেন, হ্যালো ডাক্তার, নার্স এসেছে, তাকে কী বলতে চান বলুন। এই বলে টেলিফোন আমার হাতে দিলেন।

ডাক্তারের কথা শুনলুম। রোগ এখন পড়তির দিকে; ভয়ের অবস্থা কেটে গেছে। তবে নজর রাখতে হবে। কী কী করতে হবে আমাকে জানালেন, তারপর স্নিগ্ধস্বরে বললেন, কাল সকালে দেখা হবে। গুড নাইট নার্স।

গুড নাইট ডক্টর।

ডাক্তারের নাম জানতে পারলুম না, টেলিফোনে গলা শুনেও চেনা গেল না। বোধ হয় জামাইবাবুর কোনও বন্ধু; নইলে আমাকে রেকমেণ্ড করবেন কেন!

পাশের ঘরে ফিরে গিয়ে রোগীর চার্জ নিলুম। রাত্রি তখন ঠিক বারোটা। শঙ্খনাথবাবুকে বললুম, আপনার আর এখানে থাকবার দরকার নেই। তবে বাচ্চার মা যদি মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতে চান তো দেখে যেতে পারেন। বাচ্চার মা সম্বন্ধে মনে একটু কৌতূহল হয়েছিল।

শঙ্খনাথবাবুর মুখের চেহারা বদলে গেল, গলার আওয়াজ কর্কশ হয়ে উঠল। তাঁর গলা স্বভাবতই মোটা, তার সঙ্গে রাগ মিশে গলার আওয়াজ বাঘের চাপা গর্জনের মত শোনাল। তিনি বললেন, ওর মা! সে তো নাচতে গিয়েছে।

আমি ভুরু তুলে চেয়ে রইলুম। তিনি বললেন, নাচ জান না? একজন পুরুষকে জাপটে ধরে ধেই-ধেই নাচ। আজ বিলিতী হোটেলে পার্টি আছে, আমার বউ না-গিয়ে থাকতে পারে? মেয়ের অসুখ, তাতে কী? নাচবার এত বড় সুযোগ কি ছাড়া যায়?

আমি লজ্জিত হয়ে পড়লুম। ঘরের কেচ্ছা যে শঙ্খনাথবাবু একজন অপরিচিতার কাছে এত সহজে প্রকাশ করবেন তা আশা করিনি। খুব রাগ হয়েছে বলেই বোধ হয় মনের কথা চেপে রাখতে পারেননি। কুণ্ঠিত হয়ে বললুম, তিনি নিশ্চয় এখনি ফিরবেন।

বলে গিয়েছিল দশটার মধ্যে ফিরবে, বারোটা বেজে গেছে। দুত্তোর! বলে তিনি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

আমার মনে আবার সহানুভূতি এল। স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে মনের মিল নেই; এ যেনডক্টর দাসের দাম্পত্য জীবনের উল্টো পিঠ। জিগ্যেস করলুম, আপনি বুঝি পার্টিতে যান না?

শঙ্খনাথবাবু চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন; আমি পার্টিতে যাব! কী বলছ তুমি প্রিয়দম্বা? আমি মুখখু অসভ্য, নাচতে জানি না, ব্রিজ খেলতে জানি না, ছুরিকাঁটা ধরে ডিনার খেতে জানি না—আমি পার্টিতে যাব! তোক হাসবে না। আমার স্ত্রী সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? তাছাড়া মেয়েটাকে দেখবার একটা লোক চাই তো। আজ তিন রাত্তির ঘুমুইনি। তিনি ক্লান্তভাবে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন।

কেন জানি না আমার রাগ হল। বললুম, আগে নার্সের ব্যবস্থা করেননি কেন? তাহলে তো তিন রাত্তির জেগে থাকতে হত না!

তিনি দুই হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে চালিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, প্রিয়দম্বা, আমি গরিবের ছেলে, গরিবি চালে মানুষ হয়েছি। বাড়িতে কারুর অসুখ হলে মা-খুড়ি বাপ-খুড়োরাই সেবা করে। এখন আমার টাকা হয়েছে, কিন্তু নার্স রেখে তার ঘাড়ে সেবার ভার তুলে দেওয়া যায় একথা মনেই আসেনি। আজ ডাক্তার বলল তাই খেয়াল হল।

লোকটি মুখখু এবং অসভ্য সন্দেহ নেই, কিন্তু স্পষ্টবক্তা। নিজের সম্বন্ধেও স্পষ্ট কথা বলতে  সংকোচ নেই। আমি বললুম, আপনি বিশ্রাম করুন গিয়ে। কোনও চিন্তা নেই, আমি এখানে রইলুম।

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, অনিশ্চিতভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, আমি আর কোথায় যাব, এই ঘরেই শুয়ে থাকি।–কলাবতী!

পশ্চিমা ঝি-টা আবার গিয়ে দোরের কাছে বসে ছিল, উঠে এসে কাছে দাঁড়াল। থ্যাবড়া-থ্যাবড়া মুখ, নাকে নোলকের আংটি; বয়স আন্দাজ তিরিশ। শঙ্খনাথবাবু তাকে বললেন, তুমিও তিন রাত্তির জেগে আছ, যাও ঘুমোও গিয়ে। আর শিউসেবককে বলে দিও মাকিনী না ফেরা পর্যন্ত যেন জেগে থাকে।

জি–কলাবতী চলে গেল।

এই সময় বিছানায় বাচ্চা একটু উসখুস করল। আমি গিয়ে চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসলুম; তার গায়ে হাত দিয়ে দেখলুম, জ্বর আছে; কিন্তু বেশী নয়। আমি গায়ে হাত রাখতেই সে আবার শান্ত হয়ে ঘুমুতে লাগল।

তার মুখের পানে চেয়ে রইলুম। বয়স বছর দেড়েকের বেশী নয়; মুখখানি যেন গোলাপফুল ফুটে আছে। এত অসুখেও চোখ ফেরানো যায় না। শঙ্খনাথবাবু আমার সঙ্গে খাটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আমি তাঁর পানে চোখ তুলে চাইতে দেখলুম তিনি সপ্রশ্ন চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমি ঘাড় নেড়ে জানালুম-ঠিক আছে।

তিনি গিয়ে দূরের একটা জানলা খুললেন, আবার তখনই বন্ধ করে দিলেন। বাইরে বৃষ্টি চলেছে, বিরাম নেই বিশ্রাম নেই।

জানলার কাছে একটা গদিমোড়া ডিভান ছিল, শঙ্খনাথবাবু তাতে বসলেন, আমাকে লক্ষ্য করে চাপা গলায় বললেন, পাশের ঘরে চায়ের সরঞ্জাম আছে, যদি রাত্তিরে খেতে চাও

আমি নিঃশব্দে হাত তুলে তাঁকে আশ্বাস দিলুম দরকার হলে খাব। তিনি তখন ডিভানের উপর লম্বা হয়ে শুলেন।

আধ ঘণ্টা শিশুর মুখের দিকে চেয়ে বসে আছি…মেনিঞ্জাইটিস। কঠিন রোগ, কিন্তু এখন রোগ বশে এসেছে; শিশু সেরে উঠবে। শুধু নজর রাখা দরকার, এতটুকু ত্রুটি না হয়। …এই শিশুর মা কী রকম মা? আধুনিকা অনেক দেখেছি, আমিও তো আধুনিকা। কিন্তু নিজের রুগ্ন সন্তানকে বাড়িতে ফেলে নেচে বেড়াতে কাউকে দেখিনি। হয়তো এটা আধুনিকতার দোষ নয়, ব্যক্তিগত চরিত্রের দোষ। কিন্তু মেয়ের মায়ের দোষ যতই থাক, নিশ্চয় অপূর্ব সুন্দরী। মেয়ে এত রূপ বাপের কাছ থেকে পায়নি। বাপের চেহারা তো গুণ্ডার মত।

ঘাড় ফিরিয়ে শঙ্খনাথবাবুর দিকে চাইলুম। তিনি কনুইয়ে ভর দিয়ে করতলে মাথা রেখে কাত হয়ে শুয়ে আছেন, দৃষ্টি আমার ওপর। কিন্তু দৃষ্টিতে আপত্তিকর কিছু নেই, কেবল নির্বাক কৌতূহল। আমার মত জীব তিনি জীবনে দেখেননি, তাই নিষ্পলক চেয়ে আছেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হবার পরও তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন না, একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন।

মুখের পানে একদৃষ্টে কেউ চেয়ে থাকলে অস্বস্তি হয় না? আমি উঠে গিয়ে ডিভানের কাছে দাঁড়ালাম; তিনি উঠে বসলেন। বললুম, আমি যখন চার্জ নিয়েছি তখন আপনার জেগে থাকার মানে হয় না। আপনি ঘুমুবার চেষ্টা করুন না।

তিনি বললেন, ঘুমুবার চেষ্টা! আমাকে চেষ্টা করতে হয় না, চোখ বুজে শুলেই ঘুমুতে পারি। আজ ইচ্ছে করে জেগে আছি। পিউ এখন কেমন আছে?

পিউ! খুকির নাম বুঝি পিউ?

হ্যাঁ। কেমন আছে?

ভালই আছে বলে আমি আবার গিয়ে বসলুম।

পিউ! পাপিয়ার ডাক। ছোট্ট একটি পাখির মিষ্টি একটু কাকলি। এই মেয়েটি পাখি নয়, পাখির কুজন। যে নাম রেখেছে তার রসবোধ আছে। শঙ্খনাথবাবু নিশ্চয়।

পিউ একটু উসখুস করল। তাকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিলুম। সে আবার শান্ত হয়ে ঘুমুতে লাগল।

একটা বেজে গেছে। বৃষ্টির ঝরঝর ঝঝম্ শব্দ যেন একটু মন্দা হয়ে আসছে। মনে হল নীচে গাড়ি বারান্দায় একটা মোটর এসে থামল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, শঙ্খনাথবাবু উঠে বসেছেন। তাঁর চোখে গনগনে আগুন, চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পরে ওপরের বারান্দায় মেয়েলি জুতোর খুটখুট শব্দ শুনতে পেলুম, আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমার ঘাড় আপনিই সেই দিকে ঘুরে গেল, দোরের পানে চেয়ে রইলুম।

দোরের সামনে এসে দাঁড়াল একটি মূর্তি। আরব্য উপন্যাসের হুরী-পরীদের দেখিনি, কিন্তু তারা এত সুন্দর কখনই ছিল না। মনে হল মেঘে-ঢাকা আকাশ থেকে এক ঝলক বিদ্যুৎ দরজার ফ্রেমের মাঝখানে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিপছিপে লম্বা ধরনের গড়ন, দুধে-আলতা রঙ; মুখখানি কুঁদে কাটা। পরনে খুব ফিকে নীল রঙের সিল্কের শাড়ি, তার চেয়ে একটু গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ; সবার ওপরে একরাশ হীরে আর পান্নার গয়না শিশিরবিন্দুর মত ঝলমল করছে। কিন্তু ওর রূপের বর্ণনা আর লিখতে পারি না; নিজেরই হিংসে হয়।

দরজার সামনে এসে প্রথমেই তার চোখ পড়েছিল আমার ওপর। সে আমাকে একনজর ভাল করে দেখে নিল। তার নরম রাঙা ঠোঁটে একটু মিষ্টি হাসি খেলে গেল।

হাসিটি কিন্তু স্থায়ী হল না। শঙ্খনাথবাবু পাগলা হাতির মত তার সামনে ছুটে এলেন, চাপা গর্জনে বললেন, দশটা বেজেছে?

একটি আঙুল ঠোঁটের ওপর রেখে পরী বলল, চুপ। পিউ জেগে উঠবে।

শঙ্খনাথবাবু ভেংচি কাটার স্বরে বললেন, পিউ জেগে উঠবে! এতক্ষণ পিউয়ের কথা মনে ছিল না?

পরীর মুখখানি ব্যথায় ভরে উঠল, সে করুণ সুরে বলল, মনে ছিল না। সারাক্ষণ কেবল পিউয়ের কথাই ভেবেছি। কিন্তু আসব কী করে? যা বিষ্টি, সাপের মুখ ছিঁড়ে যায়।

শঙ্খনাথবাবু বললেন, যখন বেরিয়েছিলে তখন বিষ্টি কিছু কম ছিল না। বেরুলে কেন? একটা দিন না-নাচলে কি চলত না?

পরী চকিত আড়চোখে আমার পানে তাকাল। বাইরের লোকের সামনে দাম্পত্য কলহ বাঞ্ছনীয় নয়। সে স্বামীর কথার উত্তর না দিয়ে ঘরের মধ্যে এগিয়ে এল। পিউয়ের খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। মেয়ের পানে একবার তাকাল কি তাকাল না, আমার পানে চেয়ে নরম হেসে বলল, আপনি বুঝি নার্স? বাঁচলুম। পিউয়ের জন্যে আর ভাবনা নেই।

শঙ্খনাথবাবু স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলেন, তিনি গলার মধ্যে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করলেন। বোধ হয় বলতে যাচ্ছিলেন—পিউয়ের জন্যে ভেবে ভেবে তোমার তো ঘুম হচ্ছে না। কিন্তু তিনি কোনও কথা বলবার আগেই পরী আবার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাঁকে থামিয়ে দিল। ফিসফিস করে বলল, চুপ! তোমার গলার আওয়াজে পিউ চমকে উঠবে।

আমি কব্জির ঘড়ি দেখে বললুম, আপনারা বিশ্রাম করুন গিয়ে। আমাকে এবার ইঞ্জেকশন দিতে হবে।

ইঞ্জেকশন! পরী ত্রস্ত হয়ে উঠল,—চল আমরা যাই। এই বলে সে আর দাঁড়াল না, দোরের দিকে পা বাড়াল।

শঙ্খনাথবাবু একটু ইতস্তত করলেন, বললেন, আমি থাকব?

না, দরকার নেই, বলে আমি ব্যাগ তুলে নিলুম। ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলুম, আগে আগে পরী এবং পিছন পিছন দৈত্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ইঞ্জেকশন তৈরি করতে করতে পরীর কথাই মনের মধ্যে ঘুর ঘুর করতে লাগল। হয়তো আমুদে আহ্লাদে মেয়ে; নিজের সংসারে আমোদ-আহ্লাদের সুযোগ কম, তাই বাইরের দিকে মন পড়ে থাকে। মেয়েকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার নামে প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল। হয়তো শরীরের কষ্ট দেখতে পারে না। অনেক লোক আছে যারা রক্ত দেখলে ভির্মি যায়। আমি নিজেই বা কী ছিলুম? প্রথম যেদিন হাসপাতালে মড়া দেখি সেদিন হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম। এখন অবশ্য সবই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। পরী তো আর নার্স নয়, সে এসব দেখতে পারে না। কিন্তু কথাবাতা চালচলন খুব মিষ্টি। আর কী রূপ! শঙ্খনাথবাবুকে ভাগ্যবান বলতে হবে। এমন বউ সকলের ভাগ্যে জোটে না।

ইঞ্জেকশন দিলুম। পিউ একটু নড়েচড়ে কাঁদবার উপক্রম করল, সুন্দর মুখখানি কুঁচকে উঠল; কিন্তু সে কাঁদল না। চোখ মেলে কিছুক্ষণ আমার মুখের পানে চেয়ে রইল, তারপর ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

আজ রাত্রে আমার কোনও কাজ নেই। শুধু পিউয়ের পানে চেয়ে বসে থাকা।

বৃষ্টি বোধ হয় থেমে গেছে; বাইরে আর সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড বাড়ির মধ্যে থেকে দুটি গলার আওয়াজ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। একটি স্বর মোটা এবং অস্পষ্ট, অন্য স্বর মিহি এবং স্পষ্ট। বোধ হয় শোবার ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা হচ্ছে—

…তুমি বুঝতে পারছ না কেন, ইচ্ছে করলেই কি পার্টি ছেড়ে চলে আসা যায়? আমি তো চলেই আসছিলুম, কিন্তু সবাই পথ আগলে দাঁড়াল, বলল, এত বিষ্টিতে যেতে দেব না। গাড়িও ছিল না তারপর কিছুক্ষণ মোটা গলার আফসানি…তারপর আবার মিহি গলা—সমাজে থাকতে গেলে সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়, সকলের সঙ্গে মিশতে হয়…বোরকা মুড়ি দিয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকার দিন কি আর আছে? লোকে হাসবে যে। তুমি মেলামেশা করতে ভালবাস না, তাই। আমাকেই করতে হয়। লৌকিকতা না রাখলে চলবে কেন?…

এইভাবে প্রায় আধ ঘণ্টা কথাকাটাকাটি চলল, তারপর আস্তে আস্তে সব ঝিমিয়ে পড়ল। বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, আমি বসে বসে ভাবছি…দাম্পত্য কলহ…বাবা বলতেন বারম্ভে লঘুক্রিয়া…ওরা ঝগড়াঝাঁটি করে এক বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে…ওদের মধ্যে ভাল কে? মন্দ কে? হয়তো মানুষ হিসেবে দুজনেই ভাল, কিন্তু বিপরীত ধাতের মানুষ। স্বামী উগ্র রুক্ষ অশিক্ষিত, স্ত্রী আধুনিকা প্রগতিশীলা। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এরা মানুষ হয়েছে; কেউ কারুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। এমনি ভাবে ঝগড়া করে আর এক বিছানায় শুয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে…

আমি নার্স, জেগে জেগে ঘুমিয়ে নিতে পারি। রোগীর বিছানার পাশে চোখ চেয়ে বসে আছি। রোগী ঘুমুচ্ছে, আমার কোনও কাজ নেই। সোজা বসে আছি চোখ মেলে, কিন্তু মনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে; জেগেও নেই, আবার ঘুমুচ্ছিও না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। যারা রাত জেগে সেবা করে তাদের মন এইভাবে বিশ্রাম করে নেয়।

খসখস শব্দে দোরের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলুম শঙ্খনাথবাবু দুহাতে দুপেয়ালা চা নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। ঘড়ি দেখলুম, তিনটে বেজে গেছে।

আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, এক পেয়ালা চা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

চায়ের পেয়ালা নিলুম। তিনি মেয়ের দিকে একবার চোখ বেঁকিয়ে ভ্রূ তুলে আমার পানে চাইলেন। আমি ঘাড় নেড়ে জানালুম—ভাল আছে।

তিনি তখন একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নিজের পেয়ালায় চুমুক দিলেন। আমিও উঠে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালুম। পেয়ালা ঠোঁটে ঠেকাতেই মনটা খুশি হয়ে উঠল। শেষ রাত্রে অপ্রত্যাশিত গরম চা বড় মিষ্টি লাগে।

নিচু গলায় বললুম, আপনি চা তৈরি করলেন?

তিনি বললেন, হ্যাঁ। আর কে করবে? আমার গিন্নী? তিনি ঘুমুচ্ছেন, বেলা দশটার আগে বিছানা ছাড়বেন না।

গিন্নীর প্রসঙ্গ বাড়তে দেওয়া উচিত নয়, তাই প্রশ্ন করলুম, আপনি ঘুমুলেন না কেন?

তাঁর মুখখানা বিরাগে ভরে উঠল,—ঘুমুতে ইচ্ছে হল না। আর কতটুকুই বা রাত্রি আছে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভোর হয়ে যাবে।

চা খাওয়া শেষ হলে শঙ্খনাথবাবু পেয়ালা দুটো পাশের ঘরে রাখতে গেলেন, আমি আবার পিউয়ের বিছানার পাশে গিয়ে বসলুম। শঙ্খনাথবাবু ফিরে এসে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আমি বসে বসে অনুভব করলুম, তাঁর চোখ থেকে থেকে আমার দিকে ফিরছে। আমার সম্বন্ধে তাঁর বিস্ময় আর কৌতূহল এখনও কাটেনি।

তারপর ক্রমে ফরসা হল, জানলার কাচের ভিতর দিয়ে দিনের আলো দেখা গেল। বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু মেঘ কাটেনি।

বাড়ি জেগে উঠল। প্রথমে ঘরে এল কলাবতী, তারপর শিউসেবক। কলাবতী পিউয়ের খাটের পাশে মেঝের ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসল, তারপর পিউয়ের পানে হাত বাড়াল। আমি অবাক হয়ে বললুম, এ কী?

কলাবতী হেসে বলল, বাচ্চা দুধ খাবে।

বললুম, দুধ! কোথায় দুধ?

কলাবতী নিজের বুকের ওপর হাত রেখে বলল, এইখানে।

আমি হাঁ করে চেয়ে রইলুম। কলাবতী আমার মুখের ভাব দেখে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল।

শঙ্খনাথবাবু কলাবতীর পিছনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, কী হয়েছে?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, ঝি বলছে পিউ নাকি–

উনি বললেন, কলাবতীর দুধ খায়? হ্যাঁ, জন্মে পর্যন্ত পিউ কলাবতীর দুধ খায়। ওর মা তো ওকে দুধ দেয়নি। ফিগার খারাপ হয়ে যাবে যে!

আমার মুখ-চোখ গরম হয়ে উঠল, কোন্ দিকে তাকাব ভেবে পেলুম না। শেষে বললুম, ডাক্তারের আপত্তি নেই?

না। আপত্তি হবে কিসের জন্যে?

না না, তা বলছি না, কিন্তু–

ইতিমধ্যে কলাবতী পিউকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করে দিয়েছে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলুম। কী যে এদের মতিগতি কিছুই বুঝি না। এরকম ব্যাপারে আমার অভ্যাস নেই। কিন্তু ডাক্তার যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন আর বলবার কী আছে?

শিউসেবক খাটো গলায় বলল, নার্স সাহেব, পাশের ঘরে চা দেওয়া হয়েছে, আপনি মুখ ধোবেন কি?

সাদা টাইল বাঁধানো ঝকঝকে বাথরুমে গেলুম, তারপর ডাইনিং রুমে গিয়ে চা খেতে বসলুম। প্রকাণ্ড ঘর, মাঝখানে লম্বা টেবিল, তার এক পাশে খাবার দেওয়া হয়েছে। শুধু চা নয়, টোস্ট, ডিম, এক গেলাস গরম দুধ। শঙ্খনাথবাবু টেবিলের পাশে বসেছেন, তাঁর সামনে কেবল এক গেলাস দুধ।

আমি খেতে আরম্ভ করলুম, বললুম, নার্সকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ানোর কিন্তু নিয়ম নেই। শঙ্খনাথবাবু বললেন, নিয়মকানুন আমি জানি না। বলেছি তো আমি চাষা মনিষ্যি, যা মনে আসে তাই করি।

আমি খেতে লাগলুম, তিনি মাঝে মাঝে দুধের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে আমার খাওয়া দেখতে লাগলেন।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি কথা বলে চললেন। ছাড়া ছাড়া কথা। তা থেকে তাঁর পারিবারিক পরিস্থিতির কিছু খবর পেলুম। কলাবতী হচ্ছে শিউসেবকের বউ। ওরা চার-পাঁচ বছর ওঁর বাড়িতে চাকরি করছে। ওরা পশ্চিমা পাহাড়ী জাতের লোক, বোধ হয় গাঢ়োয়ালী; শঙ্খনাথবাবুর অত্যন্ত অনুগত, ওঁর জন্যে প্রাণ দিতে পারে। …শঙ্খনাথবাবুর স্ত্রীর নাম সলিলা; রিটায়ার করা সিভিলিয়ানের মেয়ে। বছর তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। কী দেখে সলিলা শঙ্খনাথবাবুকে বিয়ে করেছিল জানি না; বোধ হয় টাকা দেখে।…পিউ তাঁদের একমাত্র সন্তান। জন্মাবধি ঝিয়ের কোলেই মানুষ। কলাবতীরও একটি বছর দেড়েকের ছেলে আছে।

.

বেলা আটটার সময় ডাক্তার এলেন।

ডাক্তারকে দেখে চমকে উঠলুম : মন্মথ কর। তেমনই ধারালো মুখ, তেমনই ফিটফাট চেহারা। পরনে শার্ক-স্কিনের সুট। দেখে মনে হয় প্রাটিস বেশ ভালই চলছে। মুচকি হেসে বললেন, আমাকে চিনতে পেরেছেন দেখছি।

তাঁকে প্রথম দেখে চমকে উঠেছিলাম বটে, কিন্তু নেকড়ে বাঘ আর অজগর সাপের ভয় আমার কেটে গেছে। বললুম, হ্যাঁ, কাল টেলিফোনে গলা শুনে চিনতে পারিনি। আপনি ভাল আছেন?

হেসে বললেন, চলছে একরকম! আপনি তো আলাদা বাসা নিয়ে প্র্যাকটিস করছেন, টেলিফোন ডিরেক্টরিতে দেখলাম। সঙ্গে আর কে থাকেন?

বললুম, শুক্লা। আমার বন্ধু শুক্লা। আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকি।

তিনি ভাবতে ভাবতে বললেন, শুক্লা—তিনিও কি নার্স?

হ্যাঁ। তাকে আপনার মনে নেই। দেখলে হয়তো চিনতে পারবেন। আসুন, আপনার পেশেন্টের কাছে নিয়ে যাই। পেশেন্ট ভাল আছে।

ডাক্তারকে পিউয়ের ঘরে নিয়ে গেলুম; শঙ্খনাথবাবুও সঙ্গে এলেন। কলাবতী পিউকে আবার শুইয়ে দিয়ে খাটের পাশে মেঝেয় বসে আছে। পিউ জেগে উঠেছে, চুপটি করে শুয়ে পিটপিট করে চাইছে।

ডাক্তার পিউকে পরীক্ষা করলেন, তার রিফ্লেক্স দেখলেন। আমি ডাক্তার দেখে দেখে পেকে গেছি, কোন্ ডাক্তার কী ভাবে রোগী পরীক্ষা করেন তা থেকে বোঝা যায় তিনি কী রকম ডাক্তার। দেখলুম বয়সে তরুণ হলেও ইনি বিচক্ষণ ডাক্তার। এঁর পরীক্ষা করার ভঙ্গিতে বেশ একটা সতর্ক আত্মপ্রত্যয় আছে, অথচ আড়ম্বর নেই।

পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার বললেন, বাঃ! খুকি তো সেরে গেছে। আর দু-চার দিন ভালভাবে নার্স করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

শঙ্খনাথবাবু বললেন, আর ইঞ্জেকশন দিতে হবে না?

ডাক্তার বললেন, না, ওরাল ওষুধেই চলবে।

তিনি ওষুধ পথ্য এবং পরিচর্যা সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন; যাবার সময় আমার পানে একটু মুচকি হেসে গেলেন।

আমি শঙ্খনাথবাবুকে বললুম, আমিও এবার যাই।

উনি বললেন, আচ্ছা। দিনের বেলাটা আমি সামলে নেব। তুমি কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি এসো প্রিয়দম্বা। আমি ঠিক নটার সময় গাড়ি পাঠাব।

আমাকে কি আর দরকার হবে?

হবে। তিনি পকেট থেকে পাঁচখানা দশ টাকার নোেট বার করে আমার হাতে দিলেন।

আচ্ছা, আসব।

নীচে গাড়িবারান্দায় মোটর দাঁড়িয়ে ছিল; আমি নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠলুম। শিউসেবক গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেলাম করল। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল।

যেতে যেতে দেখলুম আকাশ এখনও পরিষ্কার হয়নি; পাতলা ধোঁয়া-ধোঁয়া মেঘের মধ্যে দিয়ে পাসে রোদ দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল আজ সকালে পিউয়ের মাকে একবারও দেখিনি। তিনি বোধ হয় এখনও ঘুমুচ্ছেন। মাঝরাত্তির পর্যন্ত নাচলে সকালবেলা ঘুম ভাঙবে কী করে? মানুষের শরীর তো! অথচ শঙ্খনাথবাবু না-ঘুমিয়ে দিব্যি রাত কাটিয়ে দিলেন। লোহার শরীর বোধ হয়।

বাসায় এসে দেখলুম শুক্লা আগেই ফিরেছে, নিজের ঘরে দোর বন্ধ করে ঘুমুচ্ছে। ঝি বোধ হয় ডাকাডাকি করে চলে গেছে। আমি নিজের ঘরে গিয়ে নার্সের কাপড়চোপড় ছাড়লুম, তারপর স্নান করে শুয়ে পড়লুম।

ঘুম ভাঙল বেলা তখন দুটো। শুক্লা বিছানার পাশে বসে কাঁধ ধরে নাড়া দিচ্ছে, আমি চোখ মেলতেই জিগ্যেস করল, কোথায় গিয়েছিলি কাল রাত্রে?

বিছানায় উঠে বসে শুক্লাকে সব বললুম। শুনে শুক্লা শঙ্খনাথবাবুর পারিবারিক পরিস্থিতির সম্বন্ধে কিছু বলল না, ডাক্তার সম্বন্ধে বলল, নেকড়ে বাঘ এখনও তোর আশা ছাড়েনি। সাবধানে থাকিস।

বললুম, দূর! সে বয়স আর নেই।

শুক্লা বলল, কিছু বলা যায় না। পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই।–নে ওঠ। রান্না করেছি খাবি চল।

শুক্লার জীবন যে-পথেই চলুক, মনটা তার গোঁড়া।

দুজনে খেতে বসলুম। আজ রাত্রে শুক্লার কাজ নেই, সে বাড়িতেই থাকবে। বোধ হয় ডক্টর দাস আসবেন, শুক্লার মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে।

খাওয়া সেরে ডায়েরি লিখতে বসেছি। রাত্রি নটায় গাড়ি আসবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *