২৩ কার্তিক।
কার্তিক মাস ফুরিয়ে এল। একটু একটু শীতের হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে; ভোরাত্রে গায়ে চাদর দিতে হয়।
উনি সেই যে চলে গিয়েছিলেন, আর সাড়াশব্দ নেই। নিশ্চয় রাগ করে আছেন। আমি না-হয় কেউ নয়, আমার ওপর রাগ করতে পারেন। কিন্তু মেয়ে তো নিজের, তার খোঁজ কি একবার নিতে নেই? আমি আর পারি না বাপু। ইচ্ছে করে পিউকে ফেরত দিয়ে আসি, বলি, এই নাও তোমার মেয়ে, আমাকে রেহাই দাও। মেয়েমানুষের সঙ্গে যখন সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছ তখন নিজের মেয়ে নিজে মানুষ কর। আমার কিসের দায়?
শুক্লাও যেন আজকাল কেমন একরকম হয়ে গেছে। বেচারীকে দোষ দেওয়া যায় না। একদিকে নিজের কাজ, অন্যদিকে জামাইবাবুর সংসার। সে রোজ সকালে গিয়ে বাড়ি তদারক করে আসে, জামাইবাবুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে। তার ওপর গিন্নী ঠাকরুনের ভাবনা। হাসপাতালে তাঁর মাঝে বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছিল, রক্তের চাপ বেড়ে গিয়ে আবার একটা আক্রমণ হব-হব হয়েছিল; কিন্তু সামলে গেছেন। কী দরকার ছিল সামলাবার তা জানি না।
শুক্লা হঠাৎ কিছু না বলে কয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, কী করে, কিছুই জানতে পারি না। জিগ্যেস করলে ভাসা-ভাসা উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে জামাইবাবুর বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি করে। প্রশ্ন করি, এত দেরি যে! সে বললে, শশী ঝিকে নিয়ে বড় মুশকিল হয়েছে। রোজ বাড়ি থেকে জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে। কি যে করি। আমি বলি বিয়ে করে ফে। সে জবাব দেয় না, হাসেও না; হতাশ চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এইভাবে দিন কাটছে। সংসারে এত জ্বালা তবু সংসারের জন্যে আমরা পাগল। দুর ছাই, কিছু ভাল লাগে না। আজ যোল দিন পরে ওঁর গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম—কে, প্রিয়দম্বা! কেমন আছ?
বুজে-যাওয়া গলায় কোনমতে বললুম, ভাল।
তোমার মেয়ে কেমন আছে?
আমার মেয়ে!
মানে—পিউ কেমন আছে?
ভাল।
বেশ বেশ। শুক্লা আছে? তাকে একবার ডেকে দাও।
শুক্লার হাতে ফোন দিয়ে আমি সরে বসলুম। কী ব্যাপার!…শুক্লা বেশী কথা বলছে না, হাঁ হাঁ দিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি—তোমার মেয়ে কেমন আছে মানে কী? ঠাট্টা? আমি পিউকে যেতে দিইনি তাই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ? তা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের কী দরকার? জোর করে মেয়েকে কেড়ে নিয়ে গেলেই পারেন। ওঁর গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, পকেটে পিস্তল আছে। তবে ভয়টা কিসের?…কিন্তু শুক্লার সঙ্গে এত মনের কথা কেন!
আচ্ছা আসি বলে শুক্লা ফোন রেখে দিল, আমার পাশে এসে বসল। আমি আগ্রহ দেখালুম না, তখন সে নিজেই বলল, শঙ্খনাথবাবু আজ বিকেলে আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন। পিউয়েরও নেমন্তন্ন।
চমকে উঠলুম,—হঠাৎ-কী মতলব?
সে বলল, মতলব আবার কী? উনি নেকড়ে বাঘও নয়, অজগর সাপও নয়; তা তো তুই জানিস। তোর জামাইবাবুকেও নেমন্তন্ন করেছেন।
কিন্তু হঠাৎ নেমন্তন্ন কেন?
তা কী জানি! আমরা একদিন ওঁকে খাইয়েছিলুম, হয়তো তারই জবাব দিচ্ছেন।
আমি যাব না।
শুক্লা ভুরু তুলে আমার পানে তাকাল,—যাবি না।
না। তোকে নেমন্তন্ন করেছেন তুই যা। আমি যখন ফোন ধরেছিলুম তখন আমাকে তো কিছু বলেননি। আমি যাব কেন?
তোর কি হিংসে হচ্ছে নাকি?
চোখ ফেটে জল এল। বললুম, তোকে হিংসে হচ্ছে না। কিন্তু ও কেন আমাকে কিছু বলল না? আমি যাব না।
এবার শুক্লা রেগে উঠল, কঠিন সুরে বলল, দেখ প্রিয়া, তুই বড় বাড়াবাড়ি করছিস। ভগবানের দান হাত পেতে না নিলে ভগবান হাত গুটিয়ে নেবেন। তখন সারাজন্ম ধরে কাঁদলেও আর পাবি না। মনে রাখিস।
আমি কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরলুম, বললুম, শুক্লা, আমার মাথার ঠিক নেই। তুই তো সব বুঝিস। আমি যাব। তুই যা বলবি তাই করব।
—আজ এইখানেই ডায়েরি লেখা শেষ করি। দুপুরবেলা পিউ ঘুমিয়েছে, আমি সেই ফাঁকে ডায়েরি লিখছি। কিন্তু মনটা ভারি ছটফট করছে।
বিকেলে পাঁচটার সময় আমরা বেরুব। কী জামা কাপড় পরব তাই ভাবছি। পিউকে গরম জামা পরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আজ আবার মেঘ করছে, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে।