২৪ কার্তিক।
বুকের মধ্যে অনাহত মৃদঙ্গ বাজছে। কী করে লিখব?
যখন প্রথম ডায়েরি লিখতে আরম্ভ করেছিলুম তখন কে জানত আমার বর্ণহীন বৈচিত্র্যহীন জীবন এমন রঙে রসে ভরে উঠবে! মাত্র তিন মাস কেটেছে, এরই মধ্যে সব বদলে গেল। যেন বিশ্বাস হয় না।
আমার জীবনের দৃশ্যকাব্য বেশ তোড়জোড় করে আরম্ভ হয়েছিল, তারপর হঠাৎ যেন ঝপ করে শেষ হয়ে গেল। কিংবা এইটে হয়তো শেষ নয়, নাটকের প্রথম অঙ্কে যবনিকা পড়ল। এর পর আরও অনেক আছে; অনেক দুঃখ সুখ, কান্না হাসি–
আজ আমার শেষ ডায়েরি লেখা, আর লিখব না। যখন লিখতে আরম্ভ করেছিলুম তখন মনের আশ্রয় ছিল না; নিজের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। কিন্তু এখন আর আমার সময় নেই; একদিকে পিউ, অন্যদিকে একটি চাষা মনিষ্যি।…ভাবছি ডায়েরির এই পাতাগুলো যদি কোনও প্রবীণ লেখককে পাঠিয়ে দিই, কেমন হয়? তিনি হয়তো পড়বেন না, ফেলে দেবেন। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু যদি পড়েন! যদি পড়ে তাঁর ভাল লাগে–?
.
পাঁচটার সময় ট্যাক্সিতে চড়ে বেরুলুম। পিউকে পশমের জামা পশমের টুপি পরিয়ে নিয়েছি। যেরকম ভিজে ভিজে হাওয়া বইছে, বৃষ্টি নামল বলে।
শুক্লা বেশ সাজগোজ করেছে। পুজোর সময় যে মেহদী রঙের মাদ্রাজী সিল্কের শাড়িটা কিনেছিল সেইটে পরেছে। এই রঙের শাড়িতে ওকে খুব মানায়। আমার কিন্তু সাজগোজ করা হল না, পিউকে সাজাতে সাজাতেই দেরি হয়ে গেল। কী বা হবে সাজগোজ করে। একটা ফিকে নীল রঙের পুরনো জর্জেটের শাড়ি পরেছি। চুলগুলো এলোখোঁপা করে জড়িয়ে নিয়েছি। এই যথেষ্ট।
আমি সাজগোজ করিনি দেখে শুক্লা মুখ টিপে হেসেছে, কিছু বলেনি। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বললুম, শুক্লা, ওঁর সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে, সত্যি কিনা বল্। মিথ্যে বললে অনন্ত নরকে পচে মরবি।
সে বলল, মিথ্যে বলব কেন্ দুঃখে! হয়েছে দেখা।
কেন? তোর সঙ্গে ওঁর কী দরকার?
বলব না।
আমার হিংসে হচ্ছে কিন্তু।
তুই থাম্। সত্যি হিংসে হলে মুখ ফুটে বলতে পারতিস না।
কেন পারব না! ও নাহয় আমাকে চায় না, তাই বলে হিংসে হবে না!
শুক্লা জবাব দিল না, বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। সন্দেহ হল সে হাসছে।
ট্যাক্সি গিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। গাড়িবারান্দার সামনে উনি দাঁড়িয়ে আছেন, একপাশে কলাবতী অন্য পাশে শিউসেবক। শিউসেবক গাড়ির দরজা খুলে দিতেই কলাবতী পিউকে ছোঁ মেরে নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।
উনি বললেন, এস, অন্য অতিথিরা এখনও আসেননি।
আমার দিকে একবার তাকালেন; যেন একটু অপ্রস্তুত ভাব। তারপর আমাদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ওঁর চেহারা অনেকটা ভাল, সেই আগুনে ঝলসানো ভাব আর নেই।
ড্রয়িংরুমের ভেতরে এর আগে আসিনি; ছবির মত সাজানো। আমি আর শুক্লা একটা সোফায় বসলুম। শুক্লা বলল, অন্য অতিথিরা কারা? একজন তো ডক্টর দাস–?
উনি বললেন, দ্বিতীয় ব্যক্তি ডক্টর মন্মথ কর।
আমরা হকচকিয়ে তাকালুম। মন্মথ করকে আমাদের সঙ্গে নেমন্তন্ন করেছেন। এ কী কাণ্ড!
কিন্তু আর কোনও কথা হবার আগেই বাইরে জামাইবাবুর গাড়ির হর্ন শোনা গেল। উনি বাইরে গেলেন।
আমি আর শুক্লা মুখ-তাকাতাকি করলুম। দুজনের চোখে একই প্রশ্ন—মন্মথ করকে আবার কেন?
ওঁরা দুজনে কথা কইতে কইতে ঘরে এলেন। জামাইবাবুর ডাক্তারী পোশাক; আমাদের দেখে কৌতুক-ভরা হাসি হাসলেন, বললেন, আমি কিন্তু বেশীক্ষণ থাকব না, চা খেয়েই পালাব। হাসপাতালে কাজ আছে।
উনি বললেন, না ডাক্তারবাবু, আজ আপনাকে একটু থাকতে হবে। মন্মথ করকে ডেকেছি, আপনাদের সামনেই তার সঙ্গে বোঝাপড়া হবে।
জামাইবাবুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, তীক্ষ্ণ চোখে ওঁর পানে তাকিয়ে বললেন, মন্মথ কর! তার সঙ্গে কিসের বোঝাপড়া?
ওঁর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল,—আছে। পরশু মন্মথ কর এসেছিল। আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ওদের দুজনের নামে অকথ্য মিথ্যে কথা বলে গেছে। আপনাকেও বাদ দেয়নি। আমি তখন কিছু বলিনি, কেবল শুনে গেছি। আজ তাকে আসতে বলেছি, আপনাদের তিনজনের সামনে ভাল করে শিক্ষা দেব।
আমরা কাঠ হয়ে বসে রইলুম। জামাইবাবুর কপালে ভুকুটি দেখা দিয়েছিল, আস্তে আস্তে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি একটু হেসে বললেন, মন্মথ কর যে সত্যি কথা বলেনি আপনি জানলেন কী করে? আমাদের আপনি কতটুকুই বা জানেন?
তিনি মাথায় একটা ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, জানি। আমার অন্তরাত্মা জানে, আপনারা খাঁটি মানুষ। আমি মানুষ চিনি। জীবনে মাত্র একবার মোহের নেশায় মানুষ চিনতে ভুল করেছিলুম, গিলটিকে সোনা মনে করেছিলুম। সে ভুল আর দ্বিতীয়বার করব না।
জামাইবাবু ওঁর একটু আছে সরে গিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, শুক্লার সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ আপনি জানেন?
উনি উঁচু গলায় বললেন, জানি। শুক্লা নিজেই আমাকে সব বলেছে। আপনি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, ও আপনাকে বিয়ে করেনি। যেদিন ওর মুখে এই কথা শুনেছিলাম, ইচ্ছে হয়েছিল ওকে কাঁধে তুলে নাচি। ডাক্তারবাবু, আমি ভালবাসার কাঙাল, যখন সত্যিকার ভালবাসা। দেখতে পাই তখন আমার মাথা ঠিক থাকে না।
শুক্লার দিকে তাকিয়ে দেখলুম সে রুমালে ঠোঁট চেপে মুখ নিচু করে আছে। জামাইবাবু কিন্তু হেসে উঠলেন, বললেন, ভালই করেছেন ওকে কাঁধে তুলে নাচেননি, তাতে ওর গুমর আরও বেড়ে যেত, হয়তো কোনদিনই আমাকে বিয়ে করত না। যাহোক, মন্মথ কর আমাদের অনিষ্ট করার চেষ্টা করেছে, কিছুটা কৃতকার্য হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তাকে মারধোর করবেন নাকি?
উনি চোয়ালের হাড় শক্ত করে বললেন, সেটা নির্ভর করবে তার ব্যবহারের ওপর।
জামাইবাবু একটি নিশ্বাস ফেলে আমার পাশে এসে বসলেন, আমার কানে কানে বললেন, সখি, দেখছ কী, একেবারে আস্ত গুণ্ডা।
মনে মনে বললুম, তা কি আমি জানি না। কিন্তু এমন গুণ্ডা পৃথিবীতে কটা আছে!
এই সময় বাইরে একটা ছোট গাড়ি এসে দাঁড়াল। উনি বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। আমার বুক ঢিব ঢিব করতে লাগল।
জামাইবাবু বললেন, দেখ, মন্মথ করকে সিধে করা আমাদের কম্ম নয়। যেমন বুনো ওল তেমনই বাঘা তেঁতুল দরকার।
মন্মথ কর ওঁর সঙ্গে ঘরে ঢুকল, তারপর আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মুখ এক মুহূর্তে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল।
উনি বললেন, কী ডাক্তার, এদের চিনতে পার?
স্মার্ট ডাক্তার মন্মথ করের অবস্থা দেখে কষ্ট হয়; সে থতমত খেয়ে ঠোঁট চেটে বলল, আমি—দেখুন—আড়ালে আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই–
উনি আস্তিন গুটিয়ে হুঁঙ্কার ছাড়লেন, আড়ালে নয়, যা বলবে সকলের সামনে বল। কী বলবার আছে তোমার?
এক পা পেছিয়ে গিয়ে মন্মথ কর বলল, আমি—দেখুন—আমি তো নিজে কিছু দেখিনি, পাঁচজনের মুখে যা শুনেছি–। এসব যে মিথ্যে গুজব তা আমি কী করে জানব?
ওঁর ডান হাতটা মন্মথ করের কাঁধের ওপর পড়ল, আঙুলগুলো চিমটের মত তার শার্ক-স্কিনের কোট চেপে ধরল; বাঘের মত চাপা গর্জনে উনি বললেন, ডাক্তার, আজ তোমাকে ছেড়ে দিলাম। ফের যদি শুনতে পাই তুমি এদের কুৎসা করেছ, তোমার জিভ উপড়ে নেব। যাও। উনি তার কাঁধ ছেড়ে দিলেন, ডাক্তার টাউরি খেতে খেতে ঘর থেকে চলে গেল।
মন্মথ কর আমাকে কয়েকবার দুষ্ট মতলবে চায়ের নেমন্তন্ন করেছিল, উনি কি শুক্লার মুখে তাই জানতে পেরে জবাব দিলেন? শুক্লা ওঁকে আমাদের জীবনের অনেক গোপন কথা বলেছে; কেন বলেছে জানি না, নিশ্চয় কোনও উদ্দেশ্য আছে। শুক্লা তো বাইরের লোকের কাছে ঘরের কথা বলার মেয়ে নয়।
মন্মথ করের গাড়ি চলে গেল, আওয়াজ পেলুম। আমার একপাশে শুক্লা অন্য পাশে জামাইবাবু। গৃহস্বামী দোরের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। কারুর মুখে কথা নেই। ঘর অন্ধকার হয়ে আসছে।
উনি হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপলেন, ঘরটা দপ করে হেসে উঠল। হঠাৎ যেন রঙ্গমঞ্চে পটপরিবর্তন হল।
শিউসেবক ঘরে ঢুকল; আমার পিছনে এসে একটু ঝুঁকে খাটো গলায় বলল, মাজী, চা আনি?
আমি চমকে ঘাড় ফেরালুম; শিউসেবক আমার পানেই সসম্ভ্রমে চেয়ে আছে। কিন্তু চা আনবে কি না একথা শিউসেবক আমাকে জিগ্যেস করছে কেন? কেমন যেন বোকা হয়ে গিয়ে বললুম, আন।
শিউসেবক চলে গেল। আমি জামাইবাবুর দিকে তাকালুম; তিনি ভালমানুষটির মত চুপ করে বসে আছেন, কিন্তু তাঁর ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির আভাস লেগে আছে। শুক্লার দিকে চোখ ফেরালুম; পোড়ারমুখী দুষ্টুমিভরা চোখ আকাশপানে তুলে বসে আছে। বাড়ির কর্তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি চোখ ফিরিয়ে জানলার সামনের গিয়ে দাঁড়ালেন। এদের মনে কী আছে। বুঝতে পারছি না; বোধ হচ্ছে যেন সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে।
শিউসেবক এবং আর-একজন চাকর চা নিয়ে এল। চায়ের সঙ্গে ট্রে-ভরা দেশীবিলিতী খাবার; কচুরি সিঙাড়া কেক প্যাটি। চাকরেরা টেবিলের ওপর ট্রে সাজিয়ে রেখে চলে যাবার পর জামাইবাবু বললেন, আমাকে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। সখি, আমাকে চা ঢেলে দাও। এবং একটা কচুরি। বেশী কিছু খাব না।
আমি উঠে গিয়ে টি-পট থেকে চা ঢাললুম। গৃহস্বামী জানলার দিক থেকে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, হঠাৎ বললেন, সখী! সখী কে?
জামাইবাবু বললেন, প্রিয়ংবদাকে আমি সখী বলে ডাকি। আর শুক্লা বলে প্রিয়া।
উনি টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন, হাসিমুখে একবার আমার পানে চেয়ে বললেন, তাই নাকি! আমি ওকে প্রিয়দম্বা বলি, কিন্তু নামটা বোধহয় ওর পছন্দ নয়। একদিন আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। তাহলে আমি কি ওকে সখী বলে ডাকব? কিংবা প্রিয়া?
আমার কান গরম হয়ে উঠল। জামাইবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, নিজের মনের মত সবাই করুক নামকরণ, বাবা ডাকুন চন্দ্রকুমার খুড়া রামচরণ। প্রিয়দম্বা আমার তো খুব খারাপ লাগে না; মনে হয় যেন জগদম্বার মাসতুত বোন।
আমি দুজনকে চা দিলুম, তারপর নিজের আর শুক্লার চা নিয়ে শুক্লার পাশে গিয়ে বসলুম। চা খাওয়া চলতে লাগল। ওদিকে ওঁরা দুজনে কী সব গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু করেছেন। শুক্লা বলল, খিদে পেয়ে গেছে রে! তোর পায়নি?
উঠে গিয়ে একটা প্লেটে খাবার ভরে নিয়ে এলুম, দুজনে খেতে লাগলুম। কলাবতী পিউকে কোলে নিয়ে দোরগড়ায় এসে দাঁড়াল; তার মুখে একান থেকে ওকান পর্যন্ত হাসি। বলল, পিউরানী খেতে চাইছে।
পিউ কলাবতীর কোল থেকে পিছলে নেমে পড়ল, আমার কাছে ছুটে এসে প্লেটের দিকে ছোট্ট আঙুল দেখিয়ে বলল, উই খাব।
ওকে ভারী জিনিস খেতে দিই না, কিন্তু আজ আর না বলতে ইচ্ছে হল না। বললুম, কী খাবে তুলে নাও।
পিউ সন্তর্পণে একটি প্যাটি তুলে নিয়ে আমার পানে তাকাল,—খাই?
বললুম, খাও।
পিউ তখন প্যাটিতে ছোট্ট কামড় দিয়ে ঘাড়-হেলিয়ে বলল, ভাল।
কলাবতী এতক্ষণ দাঁত বার করে আমার পানে তাকিয়ে ছিল, পিউ তার কছে ফিরে গেল। দুজনে ঘর থেকে চলে গেল। দোরের কাছ থেকে কলাবতী ঘাড় ফিরিয়ে আর একবার দাঁত বার করল।
কী হয়েছে এদের? সবাই যেন আমার সম্বন্ধে একটা গুপ্ত কথা জানতে পেরেছে, কিন্তু বলছে না।
চা খাওয়া শেষ হল।
জামাইবাবু রুমালে মুখ মুছে বললেন, আমি তাহলে এবার—
উনি হাত তুলে বললেন, একটু বসুন ডাক্তারবাবু। আপনার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ দরকার আছে।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলুম, ওঁর মুখে সেই অপ্রস্তুত-ভাব ফিরে এসেছে। উঠে দাঁড়ালেন, গলা ঝাড়া দিলেন, যেন বক্তৃতা দেবার উদ্যোগ করছেন। তারপর ধরাধরা গলায় বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি ওর—মানে–প্রিয় প্রিয়ংবদার অভিভাবক। তাই আপনার কাছে—ইয়ে প্রস্তাব করছি, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। আপনি অনুমতি দিন।
আমার অবস্থা বলবার চেষ্টা করব না, চেষ্টা করলেও বলতে পারব না। যখন বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল তখন জামাইবাবু ওঁকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়াচ্ছেন; শুক্লা আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। সে কানে কানে বলল, চল, ওপর যাই। আমার হাত ধরে টানতে টানতে সে দোরের দিকে চলল।
জামাইবাবু ডেকে বললেন, ও কী, চললে কোথায় সখি! প্রস্তাবের উত্তর দিয়ে যাও।
শুক্লা বলল, ও উত্তর দেবে কেন? শঙ্খনাথবাবু তো ওর কাছে প্রস্তাব করেননি। তবে আমি বলতে পারি, সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করা হল। আয় প্রিয়া। তুমি যেন পালিও না, আমরা এখনই আসছি।
ওপরে পিউয়ের নার্সারিতে কেউ নেই, কিন্তু আলো জ্বলছে। শুক্লা আমার গলা জড়িয়ে বলল, প্রিয়া! আর হিংসে হচ্ছে না তো?
শুক্লার কাঁধে মাথা রেখে একটু কাঁদলুম। মনটা হাল্কা হলে জিগ্যেস করলুম, তুই আমার কথা ওঁকে কী বলেছিস।
শুক্লা নিরীহভাবে বলল, কিচ্ছু তো বলিনি?
শুক্লা। সত্যি বল নইলে এমন চিমটি কাটব—
না না, বেশী কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলুম, তুই মরে যাচ্ছিস। পুরুষমানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে কি ওরা কিছু দেখতে পায়!
এমন চিমটি কেটেছি শুক্লাকে, অনেকদিন কালশিটে থাকবে।
নীচে নেমে এসে শুক্লা জামাইবাবুকে বলল, চল, তুমি আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। পিউ আর প্রিয়া পরে যাবে, শঙ্খনাথবাবু ওদের পৌঁছে দেবেন।
ওরা হাসতে হাসতে চলে গেল। আমার একটা নিশ্বাস পড়ল। এত প্রীতি, এত মমতা, এত দরদ ওদের প্রাণে! ভগবান কবে যে ওদের মুক্তি দেবেন।
ওরা চলে যাবার পর উনি ঘরের বড় আলো নিভিয়ে দিয়ে ছোট আলো জ্বেলে দিলেন। গোলাপী প্রভায় ঘরটি স্বপ্নময় হয়ে উঠল।
আমি সোফার এক কোণে বসে ছিলুম, উনি আমার পাশে এসে বসলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, তোমাকে কী বলে ডাকব আগে ঠিক হোক। প্রিয়া চলবে না?
আমার নিশ্বাস ঘন ঘন বইতে আরম্ভ করেছিল, যথাসাধ্য দমন করে বললুম, না।
তবে—প্রিয়া? সখী?
আমি আস্তে আস্তে বললুম, আমার মা-বাবা আমাকে বাদল বলে ডাকতেন।
বাদল। বাদল। তিনি নামটা কয়েকবার আবৃত্তি করে বললেন, এই তো খাসা নাম। আমিও আজ থেকে তোমাকে বাদল বলে ডাকব।
আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। আমার সারা গায়ে যেন উইপোকা চলে বেড়াচ্ছে। খোঁপাটা হঠাৎ খুলে গিয়ে পিঠে এলিয়ে পড়ল।
উনি বললেন, ও কী, তুমি কাঁপছ কেন? ভয় করছে?
বললুম না।
তবে?
চুপ করে রইলুম।
উনি হঠাৎ আমার হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে গাঢ়স্বরে বললেন, প্রিয়দম্বা, তুমি আমাকে ভয় কোরো না। আমি বড় অসহায়। আমাকে তুমি নিজের হাতে তুলে নাও। সত্যি আমি চাষা মনিষ্যি, আমাকে তুমি সভ্য করে নাও, ভদ্র করে নাও। একটু স্নেহ একটু ভালবাসা—এর বেশী কিছু আমি চাই না। তাঁর গলা বুজে এল।
আমি কী উত্তর দেব? আমার কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। তারপর উনি হঠাৎ আরও ব্যগ্র স্বরে বলে উঠলেন, তুমি কোনওদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না?
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলুম না, ওঁর মুখখানা দুহাতে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বললুম, তুমি ওসব কথা ভুলে যাও। আমি তোমাকে ভুলিয়ে দেব–
কিছুক্ষণ ঘর নিস্তব্ধ হয়ে রইল।
দম্মা!
দোরের কাছ থেকে মিহি আওয়াজ পেয়ে দুজনেই মুখ তুললুম। পিউয়ের ছোট্ট চেহারাটি দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে; বোধহয় কলাবতী তাকে দোরের কাছে নামিয়ে দিয়ে সরে গেছে। সে এদিক-ওদিক চেয়ে আমার কাছে এল; একবার বাপের দিকে তাকাল, তারপর আমার কোলে মাথা রেখে বলল, ঘুম পাচ্ছে।
আমি পিউকে কোলে নিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। পিউ আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুবার উপক্রম করল।
উনি পাশে এসে দাঁড়ালেন, পিঠের ওপর দিয়ে আমাদের দুজনকে বাহু দিয়ে ঘিরে খুব আস্তে আস্তে বললেন, পিউ যেন কোনও দিন জানতে না পারে তুমি ওর মা নও।
না, পিউ জানতে পারবে না। পিউকে জানতে দেব না। কিন্তু–বুকের মধ্যে একবার মুচড়ে উঠল—পিউ কি আমার পেটে জন্মাতে পারত না? জন্মালে কী দোষ হত?
কিন্তু না, এই ভাল। পিউ আমার পেটে জন্মালে এত সুন্দর হত কি?…
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে–রিমঝিম রিমঝিম।