রামমোহন রায়ের বাংলা ব্যাকরণ : তখন ও এখন

রামমোহন রায়ের বাংলা ব্যাকরণ : তখন ও এখন

রামমোহন রায় দুটি ভাষায় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লিখেছিলেন। প্রথমটি ইংরেজি ভাষায়, দ্বিতীয়টি বাংলা ভাষায়। ইংরেজি বইটির নাম Bengalee Grammar in the English Language। এটি কলকাতার Unitarian Press থেকে মুদ্রিত হয়ে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। আখ্যাপত্র অনুসারে বাংলা বইটির নাম ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (বইয়ের ভিতরে প্রথম অধ্যায়ের শীর্ষে অবশ্য ‘গৌড়ীয় ভাষা ব্যাকরণ’ কথাটি লিখিত আছে)। বইটি Calcutta School Book Society-র উদ্যোগে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে (১৮৭২) মন্তব্য করেছেন, ‘‘বাঙ্গালাখানি ঐ ইংরাজিরই অনুবাদ’’ (৩য় সং, ১৩১৭ সন, পৃ. ২১১)। রামমোহনের জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, ‘‘তাহা (বাঙ্গালা ব্যাকরণ) একপ্রকার উপরোক্ত ইংরেজি ব্যাকরণের অনুবাদ বলিলেও বলা যায়’’ (মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৪০২)। মন্তব্য-দুটি কিছু পরিমাণে সত্য, কারণ ব্যাকরণের বাংলা সংস্করণে তিনি ইংরেজি সংস্করণের বিষয়বস্তুর অতিরিক্ত কোনো নতুন বিষয়ের অবতারণা করেননি বা ব্যাপক কোনো পরিবর্তনও করেননি। বিষয়বস্তু, অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ-বিভাগ দুই বইতেই একইরকম। তবু সূক্ষ্ম বিচারে বাংলা সংস্করণটিকে পূর্বগামী ইংরেজি সংস্করণের অবিকল বঙ্গানুবাদ বলা চলে না। কারণ দুটি সংস্করণ দুই ভিন্ন লক্ষ্য দলের জন্য রচিত। ইংরেজি সংস্করণটি রচিত হয়েছে ইংরেজিভাষী বয়স্ক বিদেশিদের জন্য, আর বাংলা সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল অল্পবয়সি বাঙালি স্কুল-পড়ুয়াদের জন্য। তাই বাংলা সংস্করণে কিছু কিছু পরিবর্তন অনিবার্য ছিল। সেজন্য বাংলা সংস্করণ ইংরেজি সংস্করণের তুলনায় কোথাও ঈষৎ সংক্ষেপিত, কোথাও বিস্তারিত, কোথাও বা সামান্য পরিবর্তিত। কোথাও আবার তাঁর ‘ইংলণ্ড গমন সময়ের নৈকট্য হওয়াতে ব্যস্ততা ও সময়ের অল্পতা প্রযুক্ত’ প্রয়োজন সত্ত্বেও অপরিবর্তিত। দুই সংস্করণের এইসব সূক্ষ্ম পার্থক্য যথাস্থানে আলোচিত হবে।

ইংরেজি সংস্করণ :

এই সংস্করণের ভূমিকায় রামমোহন ইংরেজিতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, অনেক ইংরেজিভাষী বিদেশি মানুষকে জনসেবা (‘Philanthropy’), প্রশাসন ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বাংলায় এসে বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। তাঁরা যাতে সহজেই বাঙালিদের মাতৃভাষায় তাদের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে পারেন, তাই তাঁদের জন্য তিনি ইংরেজি ভাষায় বাংলা ভাষার ব্যাকরণখানি লিখেছেন। বস্তুত তাঁর আগে অবশ্য ইংরেজিতে হ্যালহেড (১৭৭৮), উইলিয়াম কেরি (১৮০১/১৮০৫/১৮১৫/১৮১৮) এবং হটনের (১৮২৩) বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু হ্যালহেডের ব্যাকরণ তখন দুষ্প্রাপ্য, অবশ্য সহজপ্রাপ্য হলেও তখন তাতে কাজ চলত না। কারণ হ্যালহেড, কেরি, হটনের ব্যাকরণ বাংলা ভাষার নিজস্ব উপাদানের বিচার-বিশ্লেষণের দিক থেকে সম্পূর্ণ ছিল না। তাঁরা তাঁদের ব্যাকরণে সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককেই তুলে ধরেছেন। কিন্তু বিদেশি আগন্তুকদের কম সময়ের মধ্যে বাংলা শেখানোর জন্য ব্যাকরণে বাংলার নিজস্ব লৌকিক উপাদানগুলির উপর জোর দেওয়াই ছিল খুব জরুরি। রামমোহন তাই তাঁর পূর্বসূরিদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ না করে তার ব্যাকরণে বাংলা ভাষার লৌকিক উপাদানের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। অন্য আর একটি দিক থেকেও তাঁর প্রয়াস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর পূর্বসূরিরা তাঁদের বইতে ব্যাকরণের বিশেষ্য, বিশেষণ, কারক ইত্যাদি প্রকরণের কোনো সংজ্ঞা না দিয়ে শুধু তাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে গিয়েছেন। এটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে সুবিধাজনক নয়। বহুভাষাবিদ রামমোহন বুঝেছিলেন যে-কোনো প্রকরণের দৃষ্টান্ত দেওয়ার আগে যদি প্রকরণগুলির তাত্ত্বিক সংজ্ঞা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ভাষার পরিচয় গ্রহণে শিক্ষার্থীদের এই অসুবিধা দূর হবে। এজন্য তিনি প্রথমে প্রতিটি প্রকরণের উদাহরণ দেওয়ার আগে অল্পবিস্তর তাদের তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যায় তিনি কোথাও সংস্কৃত ব্যাকরণের বহু পরিচিত সংজ্ঞা ও পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, কোথাও আবার বাংলা ভাষার নিজস্ব প্রকৃতি বোঝানোর জন্য নতুন সংজ্ঞা ও পরিভাষা নির্মাণ করেছেন। তখনকার বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে অন্য ব্যাকরণগুলির তুলনায় রামমোহনের বইয়ের স্বাতন্ত্র্য সংজ্ঞা ও পরিভাষার এই অভিনবত্বে।

প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে রয়েছে ভাষার উৎপত্তি নিয়ে কিছু আলোচনা। এই আলোচনা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও সেকালের অন্যান্য ব্যাকরণের তুলনায় অভিনব ও বিজ্ঞানসম্মত। অন্যান্য ব্যাকরণের গোড়ায় থাকত বর্ণ ও উচ্চারণ-প্রক্রিয়ার আলোচনা, কিন্তু রামমোহন তাঁর ব্যাকরণে ভাষার উৎপত্তি বিশ্লেষণে আরও পেছন থেকে শুরু করেছেন। তাই অন্য ব্যাকরণের শুরু বর্ণ ও উচ্চারণ-প্রক্রিয়া দিয়ে, কিন্তু রামমোহনের ব্যাকরণ শুরু হয়েছে ধ্বনি ও ধ্বনির বিভিন্ন রূপান্তর দিয়ে। এটা আধুনিক বিচারেও ভাষাবিজ্ঞানসম্মত, যা তখনকার অন্যান্য বৈয়াকরণের কাছে ছিল অকল্পনীয়। ধ্বনির বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন যে, ভাষায় মানুষের মনের ভাব প্রকাশ পায়, ‘Oral Sound’ বা ‘বক্ত্র ধ্বনি’-র মাধ্যমে।এই বক্ত্র ধ্বনি দুরকম: ১. ‘natural and bear the same signification amongst all nations; as the sounds of crying and laughing’ ২. ‘of conventional adoption’। এই শেষোক্ত ধ্বনিই দেশে দেশে বিশিষ্টতা অর্জন করে এবং শেষ পর্যন্ত দেশবিদেশের ভাষারূপে পরিচিত হয়। এইসব প্রথাবদ্ধ ধ্বনি যেসব চিহ্ন দিয়ে লিখে বোঝানো হয় সেগুলিকে তিনি বলেছেন Character বা অক্ষর। তাঁর মতে ব্যাকরণের সংজ্ঞা :‘grammar ব্যাকরণ explains the principles on which conventional sounds or marks are composed and arranged to express thoughts’। তাঁর এই সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় ব্যাকরণকে তিনি কোনো ঔচিত্যমূলক (Prescriptive) শাস্ত্র বলে মনে করেননি, ব্যাকরণ তাঁর কাছে ভাষা-বিশেষের ব্যাখ্যামূলক (explanatory) বা বর্ণনামূলক (descriptive) শাস্ত্র। প্রথম পরিচ্ছেদে এই ধ্বনি, ধ্বনির বিবিধ রূপান্তর, ধ্বনির সঙ্গে ভাষা ও অক্ষরের সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে আলোচনা করেছেন তা খুব বিশদ না হলেও তা থেকেই ভাষা সম্পর্কে তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়, যা তখনকার অন্যান্য ব্যাকরণকারদের কাছে ছিল অকল্পনীয়।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বাংলা বর্ণমালার বিবরণ, উচ্চারণশুদ্ধি ও লিপিশুদ্ধি নিয়ে আলোচনা আছে। বর্ণমালার বিবরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে তিনি স্বর ১৬ + ব্যঞ্জন ৩৪টি নির্দেশ করলেও ণ, য, ব, ষ, ঋ, ঋ, ৯, ৯৯ অং এবং অঃ- কে শুধু সংস্কৃত থেকে গৃহীত শব্দের ক্ষেত্রেই ব্যবহার্য বলে নির্দেশ করেছেন। এখানেও তাঁর আধুনিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

উচ্চারণ-প্রকরণে সন্ধির উল্লেখ আছে, তবে তা অন্যান্য ব্যাকরণের মতো বিস্তৃত নয়। কারণ তাঁর মতে, সন্ধিপ্রক্রিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণের বিষয় এবং বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। বাংলায় যেসব সন্ধিবদ্ধ শব্দ আছে, সেগুলি সন্ধিবদ্ধ অবস্থাতেই সংস্কৃত থেকে বাংলায় গৃহীত, এজন্য ‘the rules…to explain the changes remarked to take place in vowels and consonants’ তাঁর আলোচনায় বর্জিত হয়েছে এবং সন্ধি প্রকরণ নিয়ে আগ্রহী পাঠককে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ সন্ধি প্রকরণের বিস্তৃত আলোচনা তখনকার অন্যান্য ব্যাকরণে ছিল অবশ্য করণীয়। কেরি তো তাঁর ব্যাকরণের বিভিন্ন সংস্করণে সন্ধির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব দিয়েছেন। এইখানেই সমকালীন বৈয়াকরণদের থেকে তিনি ব্যতিক্রমী, অভিনব ও (একালের বিচারে) আধুনিক।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে Etymology (পদবিধান), case, number, gender প্রসঙ্গে আলোচনা আছে। ‘পদবিধান’ প্রসঙ্গে সমস্ত শব্দকে নিম্নোক্তরূপে শ্রেণিবিভাগ করেছেন:

পদবিভাগেও রামমোহনের স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। কারণ সমসাময়িক কেরি তাঁর ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে পদকে সুবন্ত, তিঙন্ত ও নিপাত—এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন। কিন্তু রামমোহন বিশেষ্য ছাড়া অন্য সমস্ত পদ বিশেষণের শ্রেণিভুক্ত করেছেন। সম্ভবত এক্ষেত্রে তিনি তৎকালীন ইংরেজি ব্যাকরণের আদর্শ অনুসরণ করেছিলেন। বিদেশি পদ্ধতিতে পদ বিভাগ করতে গিয়ে তিনি যেসব বাংলা পরিভাষা নির্মাণ করেছেন তার সবগুলিই পরবর্তী কালের বাংলা ব্যাকরণে গৃহীত হয়নি, তবে পরিভাষা ও সংজ্ঞা রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাঁর ভাষাদৃষ্টিতে স্বচ্ছতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষ্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘A substantive is the name of a subject of which we have a notion: either through our external senses, as Ram, man; or by our internal powers of mind, as hope, fear, submission.’ (বক্রাক্ষর বর্তমান লেখকের)। বিশেষ্যের এমন স্বচ্ছ সংজ্ঞা তখনকার আর কোনো ব্যাকরণে পাওয়া যায় না।

রামমোহনের অভিনবত্বের নিদর্শন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় Case-এর আলোচনায়। অন্য ব্যাকরণকারদের আলোচনা মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুগামী, কিন্তু রামমোহন গতানুগতিক প্রথার অনুগমন না করে Case শব্দটিকে বিদেশি অর্থে গ্রহণ করে বিদেশি প্রয়োগ-তাৎপর্য অনুসারে তার বাংলা নাম দিয়েছেন ‘পরিণমন’ এবং বিদেশি রীতি অনুযায়ী সম্বন্ধকেও Case বা পরিণমনের শ্রেণিভুক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য : ‘‘ইংরেজি Case শব্দটি এসেছে লাতিন Casus থেকে (শব্দটি গ্রিক ptosis-এর লাতিন অনুবাদ)। Casus-এর মূল অর্থ ধরে রামমোহন Case-এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন পরিণমন।’’ এক্ষেত্রে রামমোহন সংস্কৃত বৈয়াকরণদের পরিবর্তে প্রাচীন গ্রিক বৈয়াকরণদের মতই অনুসরণ করেছেন। এই মতে, কর্তৃকারকে নাম পদটির যেন ‘খাড়া, উন্নত বা দন্ডায়মান অবস্থান’ (Casus rectus-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘খাড়া পতন’), এর পাশে অন্যান্য Case বা কারকগুলি হচ্ছে oblique অর্থাৎ তির্যক বা পতনের নিদর্শন। এই ব্যাখ্যা ধরেই রামমোহন ইংরেজি বইতে Case-এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘পরিণমন’। আর বাংলা বইতে ‘পরিণাম’ (ব্যাকরণকার রামমোহন : তত্ত্বকৌমুদী, মাঘোৎসব সংখ্যা, ১৩৭৩, পৃ. ২২)।

রামমোহন Case-এর শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়েও অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। অন্যরা সংস্কৃতের অনুসরণে কারকের সংখ্যা নির্দেশ করেছেন ৬টি। কিন্তু রামমোহনের মতে ‘in Bengali, cases may be reduced to four, the nominative, accusative, locative and genitive ’। Nominative-এর প্রতিশব্দ করেছেন ‘অভিহিত পদ’। এ ছাড়া instrumental করণ, dative সম্প্রদান, ablative অপাদান, সম্বোধন vocative (ইংরেজি মতে Case) তাঁর আলোচনায় বর্জিত হয়েছে। ‘করণ’ বর্জনের কারণ ‘instrumental nouns are generally indicated by prepositions but seldom by their termination’, সম্প্রদান বর্জনের কারণও প্রায় একই রকম : ‘it is unavoidably used in Sanskrit, both from the peculiarity of its termination in that language and from the variety of its application’, কিন্তু বাংলায় কর্ম থেকে এর রূপগত পার্থক্য না থাকায় সম্প্রদান বাংলায় বর্জনীয়। নিজস্ব রূপবৈশিষ্ট্যের অভাবে অপাদান ablative-ও অপ্রয়োজনীয়। আর সম্বোধনের ক্ষেত্রে ‘nominative form’-ই ব্যবহৃত হয়, নিজস্ব রূপস্বাতন্ত্র্যের অভাবে সম্বোধনও রামমোহনের বিচারে কারক-তালিকায় গ্রহণীয় নয়। তবে বিভক্তির ক্ষেত্রে তিনি কোথাও কোথাও ঔপভাষিক রূপভেদ উল্লেখ করেছেন, যেমন, Accusative বা কর্মকারকের সাধারণ বিভক্তি ‘কে’ কিন্তু ‘sometimes in poetry and most frequently in the language of the native of the eastern part of Bengal রে or এরে is used instead of কে।’ বচনের ক্ষেত্রে কর্মপদের বহুবচনের উদাহরণে ‘বালকদিগগে’ পদ নিষ্পন্ন করেছেন। এই প্রয়োগ লেখ্য শিষ্ট বাংলায় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় হুগলি-বর্ধমান জেলা সন্নিহিত এলাকার কথ্য উপভাষায়। রামমোহন নিজে এই এলাকার মানুষ এবং কর্মউপলক্ষ্যে তিনি কিছুদিন পূর্ববঙ্গের ঢাকায় বাস করেছিলেন। এজন্য বিভক্তি ব্যবহারে বাংলার পূর্ববঙ্গীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় কথ্য উপভাষার এই স্বাতন্ত্র্য তাঁর কাছে সহজেই ধরা পড়েছে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদে Case-এর, বিশেষত অভিহিত পদের রূপভেদ সম্পর্কে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে Contempt বা তুচ্ছতা বোঝাতে কতৃকারকে বিশেষ্যপদের কী কী রূপান্তর ঘটে, তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন এবং এ প্রসঙ্গে বলেছেন :

This contemptuos manner, in which superiors speak of and address men of inferior birth and menial employment, is one of the degrading consequences of aristocracy in this country. As it is strongly hoped that in a few years under the blessings of the British rule, one man will know his duty to another, these expressions will then be scarcely used; and I will, therefore, not proceed any further on this subject.

ভাষার ব্যবহারে তাঁর এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে, রামমোহন ভাষাকে কেবল কিছু বৈয়াকরণ নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ স্থবির অবয়ব বলে মনে করতেন না, তাকে তিনি সমাজ-জীবনের সচল প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন এবং ভাষার এই সজীব ও সচল রূপের সঙ্গে ব্যাকরণের সংযোগ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। এইজন্য লিঙ্গ প্রকরণে সংস্কৃত স্ত্রী প্রত্যয়ের ব্যবহার দেখাননি, কেবল মানুষ ও ইতর প্রাণীভেদে কতকগুলি বাংলা প্রত্যয়ের উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে বাংলা স্ত্রী প্রত্যয় ছাড়াও কতকগুলি তদ্ভব প্রত্যয়ের উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন, ‘দেশবাচক’ (‘gentile’) শব্দগঠনে-আই, -ইয়া, ঈ, উয়া, ইয়ে < ইয়া, ও < উআ প্রভৃতি। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে আছে ‘স্বভাববাচক’ (‘abstract’) শব্দ গঠনের আলোচনা। এখানে তদ্ভব প্রত্যয় ‘মি’ ও ‘আমি’ উল্লিখিত। আলোচনায় সংস্কৃত প্রত্যয়ের উল্লেখ থাকলেও তার পরিমাণ খুব কম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদের সমাস পর্যায়ের আলোচনায় অন্যেরা সংস্কৃত ব্যাকরণের সংজ্ঞা, শ্রেণিবিভাগ ও নামকরণ গ্রহণ করলেও রামমোহন সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তিনি সমাসের শ্রেণিবিভাজনে সমস্যমান পদের অর্থ ছাড়াও ‘সমস্ত’ পদের রূপের উপর লক্ষ রেখেছেন। এক্ষেত্রে সংস্কৃতের সমাস-নাম তিনি গ্রহণ করেননি। মূলত গঠনগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করে সমাসকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করেছেন: ১. পূর্ব পদ বিশেষ্য + কৃদন্ত পদ, ‘a noun in the nominative form’ + উত্তরপদ ‘a passive participle’, যথা : হাতভাঙা। ২. বিশেষ্য+বিশেষ্য, পূর্বপদে ‘the nominative form is substituted for the genitive or locative case’ + উত্তরপদ ‘through in the nominative form, may end in either এ, ও, or আ’, যথা : তালপুকুরে, কানতুলসে; ৩. বিশেষণ+বিশেষ্য, ‘সমস্ত’ পদ ‘though in the nominative form, ends in ও or এ’, যথা: মিষ্টমুখো, কটাচুলে; ৪. Compounded of two words, generally signifying mutual or vehement action, having the final vowel changed into ই’, অর্থাৎ একটি আধুনিক ব্যাকরণের ব্যতিহার বহুব্রীহি, যথা : মারামারি, হাতাহাতি, অন্যটি এখনকার ব্যাকরণের শব্দদ্বৈত, যথা : হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি। শব্দদ্বৈতের আলোচনা তাঁর সময়কার, এমনকি তার অনেক পরেকার বাংলা ব্যাকরণেও বহুদিন স্থান পায়নি। সেদিক থেকে রামমোহনের ভাষাবীক্ষণ অনেক বেশি সজাগ, তীক্ষ্ণ ও সময়ের অগ্রবর্তী।

চতুর্থ অধ্যায়ে pronoun বা ‘প্রতিসংজ্ঞা’-র আলোচনা খুব সংগঠিত না হলেও এতে বাংলার প্রায় সব শ্রেণির সর্বনামেরই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। সর্বনামের ক্ষেত্রে তাঁর ‘পুরুষ’ (person)-এর আলোচনা বিস্তৃত না হলেও তার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। বাংলা সর্বনামের লেখ্য রূপ ও কথ্য রূপের মধ্যে যে কিছুটা পার্থক্য আছে, তা তিনি লক্ষ করেছেন এবং পাদটীকায় এই পার্থক্যের উদাহরণ দিয়েছেন, যথা : ইহাকে > একে, উহাকে > ওকে। পঞ্চম অধ্যায়ে বিশেষণের আলোচনায় বাংলায় বহু ব্যবহৃত কিছু সংস্কৃত প্রত্যয়ের (মতুপ, অতিশায়ন-বাচক তর, তম ইত্যাদি) উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোনো বিশদ তালিকা না দিয়ে আগ্রহী পাঠককে Dr. Wilson-এর Sungskrit Dictionary পাঠের পরামর্শ দিয়েছেন।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে Verb-এর আলোচনা। তিনি Verb-এর প্রতিশব্দ করেছেন ‘আখ্যাতিক পদ’। তার শ্রেণিবিভাগ তাঁর মতে নিম্নরূপ :

Verb-এর mode (mood)-এর প্রতিশব্দ করেছেন ‘প্রকার’। Verb-এর পরিস্থিতি অনুসারে ‘প্রকার’ তিন রকম: ১. ‘Indicative অবধারণ’, ২. ‘Subjunctive সংযোজন’ এবং ৩. Imperative নিযোজন’। এই প্রতিশব্দগুলি সমকালীন কেরির প্রতিশব্দগুলির (যথাক্রমে ‘স্বার্থ’, ‘আশংসার্থ’ ও ‘অনুমত্যর্থ’, তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছ। অর্থ অনুসারে ক্রিয়ার কাল তিনটি, গঠন অনুসারে ক্রিয়ার কালরূপ : Simple ও Compound। ক্রিয়ারূপের সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণের জন্য তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিবর্তে ইংরেজি ব্যাকরণের Infinitive, Gerund, Participle-এইসব নীতি অনুসরণ করেছেন। ক্রিয়ার আলোচনায় তাঁর আর-একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি ক্রিয়ারূপের গঠন দেখাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গীয় ও পূর্ববঙ্গীয় কথ্যভাষার রূপভেদ সহ পদ্য ভাষারও রূপভেদ উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া, তুচ্ছতাবোধক মধ্যম পুরুষের ক্রিয়ারূপ যে পৃথক সেকথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন ভদ্রলোকদের পক্ষে এইসব ক্রিয়ারূপ শেখার দরকার নেই :

The perversion of the second personal pronoun and of its corresponding verbs is, generally, made by proud and unreflecting masters, in addressing their servents, it is, therefore, not requisite that a gentleman, in studying Bengalee, should pay much attention to the above forms.

ভাষাশিক্ষণে রামমোহনের এই উদার মানবতাবোধ আজকের দিনে আমাদের বিস্মিত করে।

সপ্তম অধ্যায়ে participle (‘ক্রিয়াপেক্ষ ক্রিয়াত্মক বিশেষণে’)-এর ব্যবহার সম্পর্কে পৃথক আলোচনা, অষ্টম অধ্যায়ে adverb ‘বিশেষণীয় বিশেষণ’-এর এবং নবম অধ্যায়ে Preposition (‘সম্বন্ধীয় বিশেষণ’)-এর আলোচনা আছে। দশম অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় Conjunctions (‘সমুচ্চয়ার্থ বিশেষণ’)। একাদশ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ‘Interjection’ (‘অন্তর্ভাব বিশেষণ’)। দ্বাদশ অধ্যায়ে অন্বয় প্রকরণ। এই অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র :

A complete sentence must contain, at least one noun and one verbal attribute expressed or understood.

বাক্যে ব্যবহৃত শব্দাবলির পারস্পরিক অন্বয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন :

A sentence generally commences with a noun or pronoun in the nominative case, unless that has an adjective prefixed to it, and always ends with a verb.

এখানে উল্লেখযোগ্য যে নিজের গদ্য রচনায় তিনি সর্বত্র ক্রিয়াপদ দিয়ে বাক্য শেষ করেছেন। অন্বয়ের আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে বাংলা ইডিয়ম (বা ‘বাক্যপ্রবন্ধ’)-এর কথাও এসেছে। আলোচনা খুব বিস্তারিত না হলেও এক্ষেত্রে বাংলায় হিন্দুস্থানি ভাষার মাধ্যমে আগত পারসি ভাষার প্রভাবের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এখানেও সমকালীনদের তুলনায় তাঁর নিজস্বতা ও অভিনবত্ব লক্ষণীয়।

শেষ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে Prosody (‘ছন্দঃ’)। এই আলোচনা খুব বিস্তারিত না হলেও এখানে রামমোহন বাংলা ছন্দের দুর্বলতা নিরূপণে সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। স্বরের উত্থান-পতনের অভাবই যে সেকালের বাংলা কবিতা বা কাব্যসংগীতের প্রধান দুর্বলতা সেকথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন :

the natives of Bengal have neither music nor a language well-adapted for poetry

পাদটীকায় তিনি উল্লেখ করেছেন এই দুর্বলতার জন্যই তখনকার বাংলা কাব্যসংগীত হিন্দুস্থানি সংগীতজ্ঞ বাঙালিদের তেমন আকর্ষণ করেনি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই দুর্বলতা সত্ত্বেও রামমোহন নিজে ব্রহ্মসংগীত রচনার সময় এই দুর্বল ছন্দই ব্যবহার করেছেন। এছাড়া রামমোহন বাংলা কবিতা ও বাংলা কাব্যসংগীত সম্পর্কে যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার সম্ভাব্য কারণ অনুমান করে বলেছেন:

the folk-music of Bengal was a terra incognita to learned Bengalis of the time, and the possibilities of the Bengali language in verse music were still a possibility’ (The English Works of Raja Rammohun Roy, Social and Educational Centenary Edition, Notes, p. 29)

যাই হোক, রামমোহন বাংলা ছন্দ পদ্ধতির মধ্যে শুধু পয়ার, ত্রিপদী ও তোটক ছন্দের আলোচনা করেছেন। ত্রিপদী ও তোটকের আলোচনা বহিরঙ্গমূলক, তবে পয়ারের বিশ্লেষণে কিছুটা সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয় আছে।

বাংলা সংস্করণ :

রামমোহনের ব্যাকরণখানির বাংলা সংস্করণের মূল্যায়ন করতে গেলে এই বইয়ের পশ্চাদবর্তী কতকগুলি পরিস্থিতিগত পূর্বশর্তের কথা মনে রাখতে হবে। এইসব শর্ত কেউ আরোপ করেনি, কিছু পরিস্থিতি অদৃশ্যভাবে বইটির রচনা ও প্রকাশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রথমত, ইংরেজি বইটির লক্ষ্য দলে ছিলেন বাংলা শিক্ষার্থী বয়স্ক বিদেশিগণ, অন্যদিকে বাংলা বইটির লক্ষ্য দল ছিল অল্পবয়স্ক বাঙালি ছাত্রকুল। এজন্য বাংলা বইটির বিন্যাস ও গ্রন্থনায় ইংরেজি বই থেকে কিছু পার্থক্য রাখা অনিবার্য ছিল। দ্বিতীয়ত, রামমোহন বাংলা বইয়ের রচনাবিন্যাসের প্রয়োজনীয় পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন থেকেই কাজ শুরু করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর এই সচেতনতা সক্রিয় ছিল না, কারণ হিসাবে বাংলা বইয়ের ‘ভূমিকা’য় লেখা হয়েছে :

গৌড়ীয় ভাষার ব্যাকরণ না থাকাতে ইহার কথনে ও লিখনে সম্যক রূপে রীতিজ্ঞান হয় না, এবং বালকদিগ্যের আপন ভাষা-ব্যাকরণ না জানাতে অন্য ভাষা ব্যাকরণ শিক্ষাকালে অত্যন্ত কষ্ট হয়, আর আপন ভাষা ব্যাকরণ যাহার বোধ অল্প পরিশ্রমে সম্ভবে তাহা জানিলে অন্য ২ ভাষা ব্যাকরণ জ্ঞান অনায়াসে হইতে পারে। একারণ স্কুল বুক সোসাইটির অভিপ্রায়ে শ্রীযুত রাজা রামমোহন রায় ঐ গৌড়ীয় ভাষা ব্যাকরণ তদ্ভাষায় করিতে প্রবৃত্ত হয়েন। পরন্তু তাঁহার ইংলন্ড গমন সময়ের নৈকট্য হওয়াতে ব্যস্ততা ও সময়ের অল্পতা প্রযুক্ত কেবল পান্ডুলিপি মাত্র প্রস্তুত করিয়াছিলেন, পুনর্দৃষ্টিরও সাবকাশ হয় নাই, পরে যাত্রাকালীন ইহার শুদ্ধাশুদ্ধ ও বিবেচনার ভার স্কুল বুক সোসাইটির অধ্যক্ষের প্রতি অর্পণ করিয়াছিলেন, তেঁই যত্নপূর্ব্বক তাহা সম্পন্ন করিলেন ইতি।

রামমোহন ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর ইংল্যাণ্ড যাত্রা করেন, এবং বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৩৩ সালের এপ্রিল মাসে। সুতরাং বইটি তাঁর অগোচরেই ছাপা হয় দীর্ঘদিন ধরে এবং বইটির ‘শুদ্ধাশুদ্ধ ও বিবেচনার ভার’ যাঁকে দেওয়া হয়েছিল তিনি কতটা ‘যত্নপূর্বক’ সেকাজ সম্পন্ন করেছিলেন সেবিষয়ে সন্দেহ জাগে। তিনি হয়তো রামমোহনের প্রতি শ্রদ্ধাবশত এবং/অথবা বিষয় সম্পর্কে অনধিকারবশত পান্ডুলিপির ভেতরে রামমোহনের কাজের উপর হস্তক্ষেপ করেননি, বাইরে থেকে শুধু ছাপার কাজটিই চালিয়ে গিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতির জন্যই বাংলা সংস্করণের ভাষা ও বিষয়বিন্যাসে আগাগোড়া সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়নি। ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এর সঙ্গে ইংরেজি সংস্করণের সমান্তরাল তুলনা করলে দেখা যায় যে গোড়ার দিকে তিনি উভয় বই রচনার প্রয়োজনগত পটভূমিকা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কিন্তু শেষের দিকে কিছুটা শৈথিল্য দেখা যায়। এজন্য বাংলা বইয়ের প্রথম দিকে লক্ষ্যোপযোগী ভাষা ও বিন্যাস, কিন্তু শেষ দিকে অনেকটাই যান্ত্রিক ভাষান্তর। আমাদের মনে হয় শেষ দিকে পান্ডুলিপির কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য তিনি যেসব নীতি অবলম্বন করেছিলেন তার অন্যতম হচ্ছে, ইংরেজি সংস্করণের যেসব অংশ অবিকল গ্রহণ করলে মূল বিষয়বস্তুর কোনো ক্ষতি হয় না সেসব অংশের অবিকল বঙ্গানুবাদ করেছেন এবং যেসব অংশ কেবল ইংরেজির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বাংলা সংস্করণে সেগুলি বাদ দিয়েছেন। যেমন, ইংরেজি ব্যাকরণের chapter IX-এর ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদটিতে Preposition-এর ব্যাপারে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার প্রয়োগগত পার্থক্যের কথা লিখেছেন, বাংলা বইতে সেটি বর্জিত। দুই বইয়ের প্রথম দিককার কিছু অংশের পারস্পরিক তুলনা করলে গোড়ার দিককার তারতম্য সহজেই ধরা পড়ে। যেমন, chapter I-এর Section I-এর সঙ্গে ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এর প্রথম অধ্যায়ের ১ প্রকরণের প্রথম অনুচ্ছেদটির তুলনা করলেই বাংলা বই রচনার প্রথম দিকে রামমোহনের সযত্ন অভিনিবেশের পরিচয় পাওয়া যাবে:

ইংরেজি ব্যাকরণের প্রথম অনুচ্ছেদ :

Man exresses his thoughts principally by means of oral sounds বক্ত্র ধ্বনি। Of these some are natural and bear the same signification amongst all nations; as the sounds of crying and laughing. Others are of conventional adoption, and of these last the inhabitants of various countries have each their own peculiar sounds for the expressions of their ideas. Those conventional sounds form what is called language ভাষা, and are frequently expressed by conventional marks called characters, অক্ষর।

গৌড়ীয় ব্যাকরণ’-এর সংশ্লিষ্ট অংশ :

সকল প্রাণীর ম ধ্যে মনুষ্যের এক বিশেষ স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম হয়, যে অনেকে পরস্পর সাপেক্ষ হইয়া একত্রে বাস করেন। পরস্পর সাপেক্ষ হইয়া এক নগরে অথবা এক গৃহে বাস করিতে হইলে সুতরাং পরস্পরের অভিপ্রায়কে জানিবার আবশ্যক হয়। মনুষ্যের অভিপ্রায় নানাবিধ হইয়াছে, এবং কন্ঠ তালু ওষ্ঠ ইত্যাদির অভিঘাতে নানাপ্রকার শব্দ জন্মিতে পারে; এ নিমিত্তে এক ২ অভিপ্রেত বস্তুর বোধ জন্মাইবার নিমিত্তে এক ২ বিশেষ শব্দকে দেশভেদে নিরূপিত করিয়াছেন। যেমন ভিন্ন ২ বৃক্ষ সকলের বোধের নিমিত্তে আঁম্র, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি ভিন্ন ২ ধ্বনিকে গৌড়দেশে নিরূপণ করেন, সেইরূপ ভিন্ন ২ ব্যক্তি সকলের উদ্বোধের নিমিত্তে রামচন্দ্র, রামহরি, রামকমল ইত্যাদি নাম স্থির করিতেছেন; সেই ২ ধ্বনিকে শব্দ ও পদ কহেন, এবং সেই ২ ধ্বনি হইতে যাহা বোধগম্য হয় তাহাকে অর্থ ও পদার্থ কহিয়া থাকেন। /দূরস্থিত ব্যক্তির নিকটে শব্দ যাইতে পারে না, এ কারণ লিপিতে অক্ষরের সৃষ্টি করিলেন, যাহার সংকেত জ্ঞান হইলে কি নিকটস্থ কি দূরস্থ ব্যক্তিরা অক্ষর দর্শন দ্বারা বিশেষ ২ শব্দের উপলব্ধি করিতে পারেন, ও শব্দজ্ঞান দ্বারা সেই ২ শব্দের বিশেষ ২ অর্থ জ্ঞান হয়। /ঐ শব্দ ও ঐ অক্ষর নানাদেশে সংকেতের প্রভেদে নানা প্রকার হয়। সুতরাং তাহাকে সেই ২ দেশীয় ভাষা ও সেই ২ দেশীয় অক্ষর কহা যায়।

ইংরেজি ও বাংলা উদ্ধৃতাংশের মূল বক্তব্য এক, কিন্তু বক্তব্যের উপস্থাপন-ভঙ্গি এক নয়। ইংরেজি ব্যাকরণ বিদেশি বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত, তাই সেখানে তিনি সরাসরি ধ্বনি ও অক্ষরের তাত্ত্বিক প্রসঙ্গে প্রবেশে করেছেন; কিন্তু বাংলা বইটি অল্পবয়স্ক বাঙালি ছাত্রদের জন্য রচিত, এজন্য তাদের বোধশক্তি ও মানসিক সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে ধ্বনি ও অক্ষরের তত্ত্বটি বিস্তৃত উদাহরণ ও বিশদ আলোচনার মাধ্যমে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। শুধু ধ্বনি ও অক্ষরের ব্যাপারেই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদাহরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুই বইতে পার্থক্য রেখেছেন। ইংরেজি বইতে বিশেষ্য পদের Proper Noun-এর উদাহরণ হিসাবে ভারতীয় নামের সঙ্গে ইউরোপীয় নাম John, Richard ব্যবহার করেছেন, কিন্তু বাংলা বইতে এক্ষেত্রে ‘রামচন্দ্র, রামভদ্র ইত্যাদি’ ব্যবহার করেছেন। কারণ অল্পবয়স্ক বাঙালি ছাত্রদের কাছে ইউরোপীয় নাম অবান্তর ও অস্বস্তিকর। এছাড়া, ইংরেজি বইয়ে বিদেশিদের বাংলা কথ্য ভাষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি উপভাষার উদাহরণও দিয়েছেন, কিন্তু বাংলা বইয়ের লক্ষ্য বাঙালি ছাত্রদের শুধু শিষ্ট মান্য ভাষা শেখানো, তাই বাংলা বইতে কথ্য ভাষার উদাহরণগুলি বর্জিত হয়েছে।

অনুরূপভাবে ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের শেষ দিকের একই অংশের পারস্পরিক তুলনা করলে দেখা যাবে, এই অংশে তিনি যান্ত্রিকভাবে বঙ্গানুবাদ করেছেন। যেমন :

ইংরেজি বইয়ের Chapter IX-এর একটি অংশ :

The foregoing prepositions are indeclinable. While such words as নীচে beneath: মধ্যে among or in; জন্যে for; উপরে upon; ভিতরে within; উচ্চে above, though they are found in the locative from, may, in common with some others be enumerated among Prepositions by English Grammarians; … But they are also used in the nominative form as adjectives joined with substantives; as নীচভূমি low ground; উচ্চস্থান high place… .

বাংলা বইয়ের নবম পরিচ্ছেদের সংশ্লিষ্ট অংশ :

পূর্বোক্ত সম্বন্ধীয় বিশেষণ সকল অব্যয় হয়, কিন্তু নীচে, মধ্যে, জন্যে, উপরে, ভিতরে, উচ্চে ইত্যাদি কতক শব্দ যদিও অধিকরণ পদের ন্যায় দৃষ্ট হইতেছে, তথাপি ইংরেজি বৈয়াকরণদের মতে এ সকলও সম্বন্ধীয় বিশেষণের মধ্যে গণিত হয়;….কিন্তু এ সকল শব্দও অভিহিত পদের ন্যায় ব্যবহারে আইসে, তৎকালে গুণাত্মক বিশেষণ শব্দের ন্যায় বিশেষ্য শব্দের সহিত প্রয়োগ হয়, যথা নীচ ভূমি, উচ্চ স্থান ইত্যাদি….।

যাইহোক, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ে আংশিক আনুগত্য ও আংশিক স্বাতন্ত্র্য থাকলেও একটা বিষয়ে বাংলা বইটির বিশিষ্টতা চোখে পড়ে, সেটি হল পরিভাষা রচনায় ইংরেজি বইয়ের তুলনায় বাংলা বইয়ের আপেক্ষিক পরিপূর্ণতা। ইংরেজি বইতে তিনি প্রায় প্রতিক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার প্রচলিত ব্যাকরণে ব্যবহৃত শব্দগুলির বাংলা পরিভাষা প্রণয়ন করেছেন, যেগুলি বাদ ছিল সেগুলি বাংলা বইতে স্থান পেয়েছে। পরিভাষার ব্যাপারে তিনি কোথাও ইংরেজি পরিভাষার আক্ষরিক বঙ্গানুবাদ করেছেন, কোথাও সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে পরিভাষা সংগ্রহ করেছেন, কোথাও আবার বাংলার জন্য সংস্কৃত-নিরপেক্ষ নতুন পরিভাষা রচনা করেছেন। যেমন, বাংলা বইতে ‘পুরুষ’-এর শ্রেণিবিভাগে সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা ব্যবহার না করে ইংরেজি পরিভাষার আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন : (1st Person) প্রথম পুরুষ, (2nd Person) দ্বিতীয় পুরুষ ও (3rd Person) তৃতীয় পুরুষ। সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে গৃহীত পরিভাষার উদাহরণ—Infinitive mood (সংস্কৃতের) চতুম প্রত্যয়, past participle অতীত কর্তা বা বক্তা, second gerund—দ্বিতীয় নামধাতু, third gerund তৃতীয় নামধাতু, tense ল-কার, passive voice—কর্মণি বাচ্য, causal verb ণিজন্ত ইত্যাদি; আবার case-এর পরিভাষা ইংরেজি বইতে ‘পরিণমন’, বাংলা বইতে ‘পরিণাম’ ইত্যাদি।

রামমোহনের ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ প্রকাশিত হবার পর বইটি কয়েক বছর শিক্ষাজগতে সমাদৃত হয়েছিল, কিন্তু এক দশকের মধ্যেই এই বইয়ের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এর কারণ ব্রিটিশ সরকারের পরিবর্তিত সরকারি ভাষানীতি। এর আগে সরকারি ভাষা ছিল নবাবি আমলের পারসি ভাষা, কিন্তু ১৮৩৮ সালে ইংরেজ সরকার ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করল এবং সেই সঙ্গে আরও ঘোষণা করল যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার চলতে পারে, তবে সেভাষা হবে আরবি-পারসি-বর্জিত সংস্কৃত-ঘনিষ্ঠ বাংলা ভাষা। বলাবাহুল্য এই ভাষানীতির পেছনে সরকারের সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতিই সক্রিয় ছিল। এর ফলে অচিরেই একাধিক বাংলা সাধুভাষার ব্যাকরণ প্রকাশিত হল (‘সাধু ভাষার ব্যাকরণসার-সংগ্রহ’—ভগবচ্চন্দ্র বিশারদ, ১৮৪০ এবং ‘বঙ্গভাষা ব্যাকরণ’—ব্রজকিশোর গুপ্ত, ১৮৪০), সেই সঙ্গে কয়েকটি বাংলা অভিধানও (‘বঙ্গ পারসিক অভিধান’—জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, ১৮৩৮; ‘পারস্য ভাষানুকল্পাভিধান’—বিপ্র শ্রীমান মহেশকৃত’, ১৮৩৯; Polyglot Munshi or Vocabulary— মুনশি দেবীপ্রসাদ রায়, ১৮৪১ ইত্যাদি) প্রকাশিত হল, যেগুলির লক্ষ্য ছিল বাংলায় প্রচলিত আরবি-পারসি শব্দের পরিবর্তে সেই জায়গায় ব্যবহার্য তৎসম শব্দের তালিকা প্রণয়ন। পক্ষান্তরে রামমোহন স্থানে স্থানে সংস্কৃত পরিভাষা গ্রহণ করলেও ব্যাকরণে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতেতর লৌকিক উপাদানের পরিচয় দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তাই তাঁর ব্যাকরণ অচিরেই সাধু ভাষার অনুগামী পাঠ্য তালিকার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ল। যাঁরা (হিন্দু স্কুল, তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা ইত্যাদি) বইটি তালিকায় রেখেছেন তাঁদের প্রয়োজনে স্থানে স্থানে রামমোহনের পরিভাষার বদলে সংস্কৃত পরিভাষা ব্যবহার করে বইটির সংক্ষেপিত ও পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশিত হল। ফলে ওই সব সংস্করণে রামমোহনের মূল রচনার অনেক অংশ বাদ গেল, যেমন, ছন্দপ্রকরণ একেবারেই বর্জিত হল। এরপর শিক্ষাজগতে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরা মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের অনুসরণে বাংলা ব্যাকরণ লিখতে লাগলেন, ফলে রামমোহনের ব্যাকরণ শিক্ষাজগতে একেবারে পরিত্যক্ত হল।

উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ নব্যপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় রামমোহনের বৌদ্ধিক পুনর্বাসন হল। কিন্তু তাও খুব প্রত্যক্ষভাবে ও সংগঠিতভাবে নয়।

রামমোহনের বাংলা ব্যাকরণ ও এইসময় :

রামমোহনের ইংরেজিতে লেখা বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশের পর আরও অনেক দেশি ও বিদেশি পন্ডিত বিদেশিদের জন্য ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই রামমোহনের ব্যাকরণের অভ্যন্তরীণ শিথিলতার কথা বলেছেন, তাই তাঁরা রামমোহনকে আর অনুসরণ করেননি। আর এখনকার সময়ে তো বিদেশি ভাষা শেখার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ নতুন নতুন পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে, সেদিক থেকেও রামমোহনের ইংরেজি বইটি এখন শুধু আমাদের ঐতিহ্যের সম্পদ, কিন্তু নিত্যব্যবহার্য নয়।

তাঁর বাংলা বইটিও অনেকদিন আগে পাঠ্যতালিকা থেকে নির্বাসিত হয়েছে, তবে বিভিন্ন সময়ে তাঁর চিন্তা পরবর্তীকালের ব্যাকরণচিন্তাকে প্রথামুক্ত করতে সাহায্য করেছে, বিভিন্ন সময়ে স্কুলের সিলেবাসেও তার পরোক্ষ হলেও নিশ্চিত প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন, এখনকার সিলেবাসে কারকের ক্ষেত্রে সম্প্রদান কারক বর্জন, এটাতো বহু আগে রামমোহন তাঁর ব্যাকরণে সম্প্রদান অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করেছেন, এখনকার সিলেবাস-কর্তারা এই সংস্কারকর্মে রামমোহনের নাম উচ্চারণ না করলেও এই বর্জনে রামমোহনের যুক্তিই তাঁরা ব্যবহার করেন। স্কুলের এখনকার সিলেবাসে ‘কারক’ শব্দটি বর্জিত না হলেও মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্রে এখন আর কারক নির্দেশ করতে না বলে পদের অন্বয়গত পরিচয় নির্দেশের কথা বলা হচ্ছে। এতে পদ পরিচয়ে ‘সম্বন্ধ’ ও ‘সম্বোধন’-ও অন্তুর্ভুক্ত হচ্ছে। রামমোহন সম্বোধনকে ‘পরিণাম’ শ্রেণিভুক্ত না করলেও ‘সম্বন্ধ’-কে তার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

রামমোহনের সময়কালে এবং তারপরও অদ্যাবধি বাংলা ব্যাকরণ শুরু হয় বর্ণ ও তার শ্রেণিবিভাগ দিয়ে, কিন্তু রামমোহন আরও পিছিয়ে গিয়ে ব্যাকরণ শুরু করেছেন ধ্বনির প্রসঙ্গ দিয়ে, এবং বাংলার বর্ণমালায় রক্ষিত কিন্তু উচ্চারণে বর্জিত কয়েকটি বর্ণের উল্লেখ করেছেন (যথা : ণ, ষ, অন্তঃস্থ ব ইত্যাদি)। এই বিশ্লেষণ তখনকার দিনে অকল্পনীয়। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণের সর্বশেষ সিলেবাস অনুসারে ধ্বনির পরিচয় দিয়ে ব্যাকরণ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপর বর্ণ ও তার প্রসঙ্গ। এটা কি কাকতালীয়, না এর পেছনে রামমোহনের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা কাজ করেছে সিলেবাসকর্তাদের মাথায়?

সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি অনুসরণে বহুদিন ধরে বাংলা ব্যাকরণের গোড়ায় থাকে সন্ধি প্রসঙ্গ। বিশ শতকের গোড়ায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৮ম ভাগ, ১ম সংখ্যা, ১৩০৮) এটি অযৌক্তিক ও পরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তারও অনেক আগে রামমোহন তাঁর ইংরেজি ও বাংলা দুই বইতেই সন্ধিকে বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ঘোষণা করে সন্ধি-প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও তার বিশদ আলোচনা করেননি। এখনকার ৬ষ্ঠ-৭ম-৮ম শ্রেণির সিলেবাসে সন্ধির আলোচনা থাকলেও শুধু যেসব তৎসম সন্ধিবদ্ধ শব্দ বাংলায় বহু প্রচলিত শুধু সেগুলিরই সন্ধিসূত্র ও উদাহরণ উল্লেখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দশম শ্রেণির সিলেবাসে সন্ধির পাঠ সম্পর্কে বলা হয়েছে শুধু সন্ধিবদ্ধ তৎসম শব্দের বানানশুদ্ধি শেখার জন্যই সন্ধি পঠনীয়, আগের মতো ভাষা-নিরপেক্ষভাবে সন্ধির নিয়ম শেখার জন্য নয়।

রামমোহন বাংলা বইতে ‘অব্যয়’ শব্দটি ব্যবহার করলেও সংস্কৃত ব্যাকরণের অর্থে ব্যবহার না করে ইংরেজি ‘participle’ অর্থে ব্যবহার করেছেন এবং প্রচলিত অব্যয়কে ‘সমুচ্চয়ার্থ বিশেষণ’ ও ‘অন্তর্ভাব বিশেষণ’ রূপে বর্ণনা করেছেন। সাম্প্রতিককালের বাংলা ব্যাকরণে ‘অব্যয়’ শব্দটির প্রয়োগ থাকলেও ওই পরিভাষার প্রযোজ্যতা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের পঞ্চম শ্রেণির (অধুনালুপ্ত) ‘কিশলয়’ বইতে এক্ষেত্রে ‘যোজক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ঢাকা বাংলা একাডেমী-প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (ডিসেম্বর, ২০১১) বইতেও এই ‘যোজক’ পরিভাষাটি গৃহীত হয়েছে। ‘অব্যয়’ এবং ‘অব্যয়ীভাব সমাস’ পরিভাষা দুটি যে সাম্প্রতিককালে প্রশ্নাধীন হয়েছে, এতে রামমোহনেরই প্রশ্নমনস্কতার অগোচর অনুবর্তিতা আছে—একথা বললে আশা করি তা দোষাবহ হবে না।

সংস্কৃত ‘পুরুষ’ (person) পরিভাষাটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ব্যাকরণে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সিলেবাসে ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ পরিভাষাটি গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ non-academic কারণে স্কুল শিক্ষার সঙ্গে জড়িত নন অথচ অন্যভাবে প্রভাবশালী এমন কিছু ব্যক্তি এতে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করে তোলেন। ফলে পর্ষদ সিলেবাসে পুনরায় ‘পুরুষ’ শব্দটি ফিরিয়ে আনে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে রামমোহন person-এর আলোচনায় ‘পুরুষ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করলেও ‘পুরুষ’-এর সংস্কৃত শ্রেণিবিভাগ মানেননি, ইংরেজির অনুসরণে তিনি 1st person প্রথম পুরুষ, 2nd person দ্বিতীয় পুরুষ ও 3rd person তৃতীয় পুরুষ ব্যবহার করেছেন। সংস্কৃত পরিভাষা বাংলার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর বলেই রামমোহন এই পরিবর্তন করেছিলেন। একই কারণে রামমোহনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ১৮৪০ সালে ভগবচ্চন্দ্র বিশারদ সংস্কৃতব্যবসায়ী হয়েও নিজের বাংলা ব্যাকরণে ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘ব্যক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। তদনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ : প্রথম ব্যক্তি, দ্বিতীয় ব্যক্তি ও তৃতীয় ব্যক্তি। এই পরিবর্তনের ধারা বর্তমান কালেও গৃহীত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ-পরিচালিত রাজ্যব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালায় নমুনা সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা ‘পুরুষ’-এর বদলে একদা প্রবর্তিত ও পরে বর্জিত ‘পক্ষ’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। তাঁদের মতে এই পরিবর্তন ছাত্রছাত্রীদের বিভ্রান্তি দূর করতে সাহায্য করে এবং প্রসঙ্গটি অনায়াসে তাদের বোধগম্য হয়। যাই হোক, ভারতের ত্রিপুরায় এবং ঢাকা বাংলা অ্যাকাদেমি পূবোক্ত ব্যাকরণে ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ পরিভাষাটিই গৃহীত হয়েছে। রামমোহন এখানেও স্মরণীয় পূর্বপুরুষ।

পরিশেষে, রামমোহনের ব্যাকরণের আর একটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। রামমোহন ইংরেজি বইতে বাংলা ভাষার পরিচয় দিতে গিয়ে তার শিষ্ট রূপের সঙ্গে স্থানে স্থানে বাংলার আঞ্চলিক (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গীয়) কথ্য ভাষা ও পদ্য ভাষার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন। উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার একটা সার্বিক পরিচয় সংক্ষেপে বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা। দীর্ঘদিন পর এখনকার মাধ্যমিক শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণের সিলেবাসেও এই উদ্দেশ্যের অনুরণন লক্ষ করা যায়। এখনকার স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণে শিষ্ট সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্যই প্রধানত আলোচিত হলেও সংক্ষেপে বাংলা ভাষার বিবিধ রূপ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য গোড়ার দিকে ভাষা ও উপভাষার সম্পর্ক এবং ভাষার ঔপভাষিক ও রীতিগত রূপান্তর (পদ্য > গদ্য) নিয়ে পাঠ তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং পরীক্ষাতেও তদনুরূপ প্রশ্ন করা হচ্ছে। এখানে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলা দরকার। এখনকার দিনে ভাষাবিজ্ঞান -এর বৈচিত্র্যমুখী অগ্রগতির ফলে উপভাষা-বিজ্ঞান (Dialectology) ও সমাজ-ভাষা-বিজ্ঞান (Sociolinguistics)-এর অনেক অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু রামমোহনের সময়ে বাংলা তথা ভারতে তো নয়ই, ইউরোপেও এই দুটি বিদ্যার চর্চা শুরু হয়নি। অথচ রামমোহনের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা বাংলা ভাষার এই দুটি বিদ্যারই অঙ্কুরোদগম লক্ষ করি। তাঁর মহাপ্রয়াণের ১৮০ বছর পূর্তির প্রাককালে তাঁর এই অবিস্মরণীয় কীর্তির কথা স্মরণ করে তাঁকে প্রণাম জানাই।১০

__________________________________________________

তথ্যসূত্র :

১. The English Works of Rammohun Roy (Social and Educational), Centenary Editions, Sadharan Brahmo Samaj, Calcutta 1934.

২. রামমোহন গ্রন্থাবলী—সম্পাদক: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস, কলকাতা, ১৯৪৫।

৩. মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত—নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৮৮১।

৪. রাজা রামমোহন রায়ের ইংরেজিতে লিখিত বাংলা ব্যাকরণ—রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এম. এ., ভারতবর্ষ, শ্রাবণ, ১৩৩৯।

৫. ব্যাকরণকার রামমোহন—সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, তত্ত্বকৌমুদী মাঘোৎসব সংখ্যা, ১৩৭৩।

৬. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ—নির্মল দাশ, প্রথম সং, কলকাতা, জুলাই, ১৯৮৭।

৭. ভাষা পরিচ্ছেদ—নির্মল দাশ, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৫।

৮. বাংলা অভিধানের ক্রমবিকাশ—ড. সরস্বতী মিশ্র, কলকাতা, জুলাই ২০০০।

৯. লোকভাষা থেকে ভাষালোক—নির্মল দাশ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১১।

১০. বিতর্ক : বাংলা ব্যাকরণ—সম্পাদক : ড. সরস্বতী মিশ্র, ২য় সং, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *