একটি কাল্পনিক কথোপথন (উপলক্ষ্য : ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী)
[কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকে ৫নং প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন। বঙ্কিমচন্দ্র শেষ জীবনে এখানে একটি বাড়ি করেছিলেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই এপ্রিল এই বাড়িতেই তাঁর দেহাবসান হয়। তবে দেহের অবসান হলেও সে-দেহ ছিল তাঁর স্থূল দেহ। মৃত্যুর পর তিনি সূক্ষ্ম দেহে এখনও ঐ বাড়িতে বাস করেন। সমকালে প্রকাশিত নানা বাংলা ও ইংরেজি বই ও পত্রপত্রিকা পড়েন; এবং সমকালের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন। এ ছাড়া পছন্দসই লোকজন পেলে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। তখন তিনি সাময়িকভাবে পরিচিত মূর্তিতেই দেখা দেন।
ঘটনার দিন অপরাহ্ণে বঙ্কিমচন্দ্র সেদিনকার সংবাদপত্র পাঠ করছেন। এমনসময় তাঁর সূক্ষ্মদেহী পরিচারক মুরলী এসে তাঁকে জানাল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম. এ. ক্লাসের ছয়জন ছাত্রছাত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর বাড়িতে এসে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। তিনি তাদের লাইব্রেরীঘরে বসাতে বলে নিজে শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে এলেন। তাদের অভ্যর্থনা করে সোৎসাহে বললেন—:]
বঙ্কিমচন্দ্র।। আরে আরে এসো, বোসো। তোমরা আমার সতীর্থ। (আগন্তুক ছেলেমেয়েদের চোখে সপ্রশ্ন বিস্ময় লক্ষ করে) ও, তোমরা ভাবছ তোমরা আমার সতীর্থ হলে কী করে? আরে বাপু, আমাদের বিদ্যাতীর্থ তো একটাই—কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরের ছাত্র, আর তোমরা তার অনেক পরের হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তো ছাত্রছাত্রী। তাই তোমরা আমার সতীর্থ।—তা বলো, তোমরা কী জন্য আমার কাছে এসেছ? তার আগে এক এক করে নিজেদের নামগুলো বলো।
(ছাত্রছাত্রীরা এক এক করে নিজেদের নাম বলল। নামগুলি হল : তন্নিষ্ঠ চট্টোপাধ্যায়, আজিজুল হক, জটেশ্বর বর্মণ, মন্দোদরী সেনগুপ্ত, তসলিমা নাসরিন ও দেবশ্রী মাহাতো।)
বেশ, বেশ এবার তোমাদের শুভাগমনের কারণ কী বলো।
ছাত্রছাত্রীরা (প্রায় সমস্বরে)।। এটা ইংরেজি ২০১১ সাল। এ-বছর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে আমরা একটা সেমিনার করছি। সম্ভব হলে আপনাকে নিয়ে যেতাম। কারণ শুনেছি আপনি তাঁর সাহিত্যকর্মের একজন বড়ো সমঝদার। কিন্তু আপনাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে আমরা আপনার কাছে এসেছি তাঁর সম্পর্কে কিছু বিষয় জানতে।
বঙ্কিমচন্দ্র।। আমি তাঁর বড়ো সমঝদার কিনা জানি না, তবে হ্যাঁ, আমি তাঁর কাছে ঋণী। আমার প্রথম দিনকার বেশ কয়েকটি কবিতা তিনি ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ছেপেছিলেন। আমার সাহ্যিতচর্চার হাতেখড়ি তাঁরই আনুকূল্যে। তাঁর কবিতাসংকলন প্রকাশ করতে গিয়ে আমি ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনচরিতও কবিত্ব’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধটি ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা-সংগ্রহ’ গ্রন্থের ভূমিকা হিসাবে যুক্ত হয়। প্রবন্ধটি সেই সময়ের ‘নবজীবন’ পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছিল। এ ছাড়া, আমার দীনবন্ধু মিত্রের উপর লেখা প্রবন্ধটিতেও ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে কিছু কথা আছে। সেসব তোমরা পড়েছ কি?
মন্দোদরী ও আজিজুল।। ওগুলো আমরা পড়েছি বলেই আপনার কাছে এসেছি আরও কিছু পরিষ্কারভাবে জানার জন্য।
দেবশ্রী ও জটেশ্বর।। (সঙ্গের ব্যাগ দেখিয়ে) তা ছাড়া, আপনার রচনাবলীর দুটি খন্ডই আমাদের সঙ্গে আছে। দরকার হলে পড়ে শোনাতে পারব।
বঙ্কিমচন্দ্র।। বেশ, বলো কী জানতে চাও?
তসলিমা।। (বই খুলে) এই যে আপনি লিখেছেন , ‘মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি—ঈশ্বর গুপ্ত বাংলার কবি।’
এ কথার অর্থ কী? মধুসূদন, হেমচন্দ্র প্রভৃতি যাঁদের নাম করেছেন তাঁরাও কি বাঙ্গালার কবি নন?
বঙ্কিমচন্দ্র।। ঐ যে বললাম, একটু তফাত আছে। মধুসূদন-আদি কবিদের কাব্যরস উচ্চস্তরের, সুশিক্ষিত না হলে তার পরিপূর্ণ আস্বাদন সম্ভব নয়, কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের রচনা শিক্ষা-নিরপেক্ষভাবে সমস্ত বাঙালির উপভোগ্য।
তন্নিষ্ঠ।। অর্থাৎ ঈশ্বর গুপ্ত হচ্ছেন ম্যাংগো পিপলের কবি।
বঙ্কিমচন্দ্র।। ম্যাংগো পিপল? সেআবার কী? কথাটা বুঝলাম না।
তসলিমা।। তন্নিষ্ঠ খুব দুষ্টু ছেলে। সব কিছুতেই ওর ইয়ার্কি। সংবাদপত্রের দৌলতে বাংলা ভাষায আম-জনতা বলে একটা কথা এখন খুব চালু হয়েছে—ও তার ইংরেজি করেছে, mango people। এটাও ওর একটা ইয়ার্কি। আপনার সঙ্গে ও ইয়ার্কি করছে, কিছু মনে করবেন না।
বঙ্কিমচন্দ্র।। না, না, মনে করব কেন? ইয়ার্কি তো খারাপ নয়, তাতে রঙ্গব্যঙ্গ আছে, কিন্তু বিদ্বেষ নেই। এমন বিদ্বেষহীন ইয়ার্কি তো ঈশ্বর গুপ্তেরও বৈশিষ্ট্য। তোমাদের সহপাঠী একটা সুন্দর শব্দ তৈরি করেছে: ম্যাংগো পিপল। ইয়ার্কি হলেও দারুণ সুন্দর ইয়ার্কি। তোমাদের বন্ধুটি তো ঈশ্বর গুপ্তকে ভালো বুঝবে মনে হচ্ছে, কারণ দুজনেই সমানধর্মা।
তসলিমা ও মন্দোদরী।। কিন্তু যাই বলুন, তিনি বাংলার কবি হলেও বাংলার মেয়েদের তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তাদের নিয়ে তাঁর কেবলি রঙ্গব্যঙ্গ। কেন, বাংলার মেয়েদের কোনো সদগুণ বা সৌন্দর্য কি তাঁর চোখে পড়েনি? জীবনে তিনি কখনও কি কোনো মেয়ের ভালোবাসা পাননি?
বঙ্কিমচন্দ্র।। কী করে পাবেন? পুরুষের জীবনে মেয়েদের ভালোবাসার দুটি প্রধান উৎস—শৈশবে মা ও যৌবনে স্ত্রী। কিন্তু এদিক দিয়ে তিনি হতভাগ্য। তিনি মাকে হারিয়েছেন মাত্র দশ বছর বয়সে। তারপর বাড়িতে বিমাতার আবির্ভাব। বিমাতাকে ঘিরে তাঁর উপর পারিবারিক অনাদর ও অত্যাচার। এরপর যখন তাঁর বয়স বছর পনেরো, তখন কাঁচড়াপাড়ার এক ধনবানের পরমা সুন্দরী কন্যাকে ঘিরে তাঁর মনে romance জমা হতে থাকে। ঐ মেয়েকেই জীবনসঙ্গিনী করার ইচ্ছে তাঁর। কিন্তু পিতার হস্তক্ষেপে তাঁর এই ইচ্ছায় বাধা পড়ল। পিতার নির্দের্শে গুপ্তিপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবীকে নিতান্ত অনিচ্ছায় বিবাহ করতে তিনি বাধ্য হন। এই দুর্গামণি ছিলেন দেখতে কুৎসিত, হাবা-বোবার মতো—ঈশ্বরচন্দ্রের মতো বাকপটু, রঙ্গপ্রিয় ও প্রতিভাধর কবির জীবনসঙ্গিনী হওয়ার মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে ভালোবাসা তো দূরের কথা, দৈনন্দিন সাধারণ কথাবার্তাও হত না। অবস্থা দেখে তাঁর আত্মীয়-মিত্রগণ তাঁকে আর একটি বিবাহ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি বলেন, সংসারধর্মে আমার কাজ নেই। কারণ তাহলে দুই সতিনের ঝগড়ার মধ্যে পড়ে জীবন দুর্বিষহ হবে, তাই আর বিবাহ না করাই ভাল।
জটেশ্বর।। কিন্তু দুর্গামণি হাবা-বোবা হলেও এবং তাঁর অনুপযুক্ত হলেও ঈশ্বরচন্দ্র কি তাঁর প্রতি স্বামীর কর্তব্য পালন করতেন?
বঙ্কিমচন্দ্র।। ঈশ্বরচন্দ্র স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ না করুন, চিরকাল তাঁকে ঘরে রেখে ভরণ-পোষণ করেছেন এবং মৃত্যুকালে তাঁর ভরণ-পোষণের জন্য দুর্গামণির নামে কিছু কাগজও রেখেছিলেন।
দেবশ্রী।। এ সবই করেছেন অনিচ্ছাভরে, সামাজিক চাপে। তাই না? আর এই জন্যই কি মেয়েদের উপর তাঁর এত রাগ? এই জন্যই কি স্ত্রীলোক তাঁর কাছে কেবল ব্যঙ্গের পাত্র?
বঙ্কিমচন্দ্র।। একদিক থেকে তোমার কথাটা ঠিক। পুরুষের যে শিক্ষাটুকু স্ত্রীলোকের কাছে পেতে হয় তা তাঁর হয়নি। হৃদয়বৃত্তির যে উন্নতি স্ত্রীলোকের সংসর্গে হয়, স্ত্রীলোকের প্রতি স্নেহ-ভক্তি থাকলে হয় তাও তাঁর হয়নি। এইজন্যই স্ত্রীলোক তাঁর কাছে কেবল ব্যঙ্গের পাত্র। তিনি তাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে হাসেন, মুখ ভেঙান, গাল পাড়েন। তারা যে পৃথিবীর পাপের আকর তা অশ্লীলভাবে উচ্চস্বরে জানান।
মন্দোদরী।। এই অশ্লীলতার জন্যই কি তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন?
বঙ্কিমচন্দ্র।। মোটেই না। তিনি তাঁর কবিত্বের জন্যই জনপ্রিয়, অশ্লীলতার জন্য নয়। মনে রাখবে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু অশ্লীলতার নয়, শুধু ভঙ্গিটা এখনকার বিচারে অশ্লীল। আচ্ছা বলো তো, অশ্লীলতা জিনিসটা আদপে কী?
তন্নিষ্ঠ।। এই খিস্তি খেউড়—স্ল্যা এইসব আর কী?
বঙ্কিমচন্দ্র।। শোনো, শুধু ইন্দ্রিয়ের উত্তেজনা উদ্দীপিত করার জন্য যা লেখা হয় সেটাই আসল অশ্লীল রচনা। কিন্তু যে লেখার ভঙ্গিটা শুধু উত্তেজক কিন্তু বিষয়বস্তু নয় সেলেখা অশ্লীল নয়। এই ভঙ্গিসর্বস্ব অশ্লীলতা সেকালের বাঙালিদের প্রায় স্বভাবসিদ্ধ ছিল। এটা আমি অনেক দেখেছি। অশীতিপর বৃদ্ধ, ধর্মাত্মা, আজন্ম সংযতেন্দ্রিয়, সভ্য, সুশীল, সজ্জন এমন লোকও কুকাজ দেখে রেগে গেলেই এমন ‘বদজোবান’ আরম্ভ করতেন। তখনকার রাগ প্রকাশের ভাষাই ছিল অশ্লীল। ফলে সেসময়ে ধর্মাত্মা ও অধর্মাত্মা উভয়কেই অশ্লীলতায় পটু দেখতাম। শুধু প্রভেদ এই যে, যিনি শুধু রাগের বশে অশ্লীল, তিনি ধর্মাত্মা।
তন্নিষ্ঠ।। বা: বা: চমৎকার। এখনকার সুশীল সমাজের তো তাহলে পোয়াবারো। মনের সুখে খিস্তিখেউড় করবেন, স্ল্যাং ঝাড়বেন। কেউ নিন্দে করলে তাঁরা বলবেন আমরা রাগের বশে এসব কথা বলেছি, কিন্তু আমরা ধর্মাত্মা। কারণ স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, যিনি রাগের বশে অশ্লীল, তিনি ধর্মাত্মা।
বঙ্কিমচন্দ্র।। না, এটা আমার কথার একটা অংশ মাত্র। বাকি অংশটা তো বলার আগেই তুমি বলতে শুরু করলে। বাকি কথাটা আগে বলতে দাও। বইটা দাও তো। জায়গাটা পড়ে বাকি অংশটা তোমাদের শোনাই। (বই খুলে) ‘‘যিনি ইন্দ্রিয়ান্তরের বশে অশ্লীল, তিনি পাপাত্মা। সৌভাগ্যক্রমে সেরূপ সামাজিক অবস্থা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে। ঈশ্বর গুপ্ত ধর্মাত্মা, কিন্তু সেকেলে বাঙালি। তাই ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা অশ্লীল। সংসারের উপর, সমাজের উপর ঈশ্বর গুপ্তের রাগের অনেক কারণ ছিল।’’ কাজেই সেকালের ঈশ্বর গুপ্ত প্রসঙ্গে যে কথা ঐ প্রবন্ধে বলেছি, তা একালে প্রযোজ্য নয়। এখনকার দিনে সাহিত্যে রাগ প্রকাশের জন্য এখনকার সামাজিক ও সাহিত্যিক রীতিনীতিই মানতে হবে।
মন্দোদরী, দেবশ্রী ও তসলিমা।। বেশ, ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতার বিষয়টা বেশ ভালো করে বুঝলাম। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমাদের যে মূল অভিযোগ তার উত্তর এখনও পাইনি। বাঙালি মেয়েদের কোনো রূপই কি তাঁকে আকর্ষণ করেনি?
বঙ্কিমচন্দ্র।। কেন করবে না? স্ত্রীলোকের রূপ আছে—তা তোমার মতো ঈশ্বর গুপ্তও জানতেন। তবে বাঙালি স্ত্রীলোকের সেরূপকে তিনি idealise করেননি। সে-রূপ বাস্তবে যা তাই দেখিয়েছেন। বই থেকে একটু পড়ে শোনাই—‘‘তোমরা সুন্দরীগণকে পুষ্পোদ্যানে বা বাতায়নে বসাইয়া প্রতিমা সাজাইয়া পূজা কর, তিনি তাহাদের রান্নাঘরে, উনুন-গোড়ায় বসাইয়া, শাশুড়ি ননদের গঞ্জনায় ফেলিয়া, সত্যের সংসারে একরকম খাঁটি কাব্যরস বাহির করেন—
বধূর মধুর খনি, মুখশতদল।
সলিলে ভাসিয়া যায়, চক্ষু ছল ছল।’’
চমৎকার! তাই না?
তসলিমা ও মান্দোদরী।। মন্দ নয়, তবে তাঁর সমকালে যতগুলি নারীকেন্দ্রিক প্রগতিশীল অন্দোলন হয়েছে, সবগুলিকেই তিনি বিদ্রুপ করেছেন। প্রথমে ধরুন নারীশিক্ষার কথা। উনিশ শতকে বেথুন সাহেব মেয়েদের স্কুল খুললেন, মেয়েরা সেখানে ভরতি হতে লাগল। আর ঈশ্বর গুপ্ত নারীশিক্ষার এই উদ্যোগকে ব্যঙ্গ করে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ছড়া কাটলেন—
আগে ছুঁড়িগুলো ছিল ভাল
ব্রতধর্ম করত সবে।
এখন এ বি শিখে বিবি সেজে
বিলাতি বোল কবেই কবে।
বঙ্কিমচন্দ্র (একটু হেসে)।। আরে বাপু। এ ব্যঙ্গ নয়, রঙ্গ—রং তামাশা। কারণ এতে স্ত্রী শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো বিদ্বেষ বা বিরূপতা প্রকাশ পায়নি। আসলে তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তনে উৎসাহীই ছিলেন। প্রমাণ চাই? তা হলে শোনো। একসময় ঈশ্বর গুপ্তের উপর আমার প্রবন্ধটা একটু বাড়াবার কথা ভেবেছিলাম, বিশেষত তাঁর শিক্ষাচিন্তার বিষয়ে কিছু নতুন তথ্য দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। এ সব তো আমার বাল্যকালের কথা। তাই সেসময়কার পুরনো বইপত্র, সংবাদপত্র কিছুদিন ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম। তবে ব্যস্ততার জন্য শেষ পর্যন্ত লেখাটা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তথ্যগুলো মোটামুটি সবই মনে আছে। এই স্মৃতি থেকেই তোমাদের বলছি, স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে তিনি রঙ্গরস করলেও তিনি তার বিস্তারে উৎসুক ছিলেন। বেথুন সাহেব তাঁর স্কুল চালু করার দিন পনেরো পর এক সন্ধ্যায় স্কুল চত্বরে ছাত্রীদের অভিভাবক ও স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী ব্যক্তিদের নিয়ে একটা সভা করেন। তখনকার প্রায় সব কাগজেই এই সভার খবর ছাপা হয়েছিল। The Calcutta Star পত্রিকায় তার বিস্তৃত বিবরণ বেরিয়েছিল। তাতে দেখা যায় ঐ সভায় স্ত্রীশিক্ষার শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ঈশ্বর গুপ্তও হাজির ছিলেন। তা ছাড়া, বেথুন সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকরে’ কবিতাও প্রকাশ করেন। তবে শুধু স্ত্রীশিক্ষা নয়, ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারেও তিনি উৎসাহী ছিলেন। তিনি নিজের চেষ্টায় কিছুটা ইংরেজি শিখেছিলেন, তাতে বুঝেছিলেন ইংরেজি না শিখলে কূপমন্ডূক হয়ে থাকতে হবে। তাই তিনি ঘুরে ঘুরে স্থানীয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। এসব খবর তাঁর কাগজে নিয়মিত ছাপা হত। তা ছাড়া অনেক স্কুল কমিটির তিনি মেম্বারও হয়েছিলেন। শুধু ইংরেজি বিদ্যালয় নয়, ইংরেজ সরকার যখন উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সচেষ্ট হয়, তিনি তখন সেই চেষ্টাকেও অভিনন্দন জানিয়ে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।
তসলিমা, মন্দোদরী ও দেবশ্রী।। হুঁ, বুঝলাম। কিন্তু বিধবাবিবাহের মতো প্রগতিশীল আন্দোলনকে তো তিনি মোটেই সমর্থন করেননি।
বঙ্কিমচন্দ্র।। তোমাদের কথাটার প্রতিবাদ করব না, কারণ কথাটা অনেক পরিমাণে সত্য। বিধবাবিবাহ নিয়ে তিনি কাগজে অনেক ছড়া লিখেছিলেন। কিন্তু এখানেও তাঁর সামাজিক কল্যাণকামনা কাজ করেছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘ছুঁড়ির কল্যাণে যেন বুড়ি নাহি তবে।’ তাঁর আশঙ্কা ছিল যে বিধবাবিবাহ আইনের দৌলতে অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে বয়স্কা বৃদ্ধারাও পুনর্বিবাহের সুযোগ পাবে। ফলে একটা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে যা তিনি চাননি। সত্যিকথা বলতে কী, বিধবাবিবাহ আইন চালু হলেও সমাজের সমস্ত স্তরে তা গৃহীত হয়নি। তা ছাড়া, অনেক বিবাহিত পুরুষ নূতনত্বের লোভে, বরপণের টানে এবং ভালো সরকারি চাকুরির আকর্ষণে তরুণী বিধবাদের বিয়ে করত। সেসব বিয়ে কতটা সুখের হত তার হিসেব কে রেখেছে? প্রথম বিধবাবিবাহকারী শ্রীশচন্দ্র বিদ্যরত্নের কথাই ধরো না কেন? প্রথম পক্ষের স্ত্রী দুটি শিশু সন্তান রেখে অকালে মারা গেলে বিপত্নীক শ্রীশচন্দ্র প্রথমে সরকারি জজপন্ডিতি ও পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরির টানে পারিবারিক আপত্তি সত্ত্বেও বিধবা তরুণী কালীমতীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সেবিয়ে সুখের হয়নি। কালীমতী নি:সন্তান অবস্থায় মারা গেলে পারিবারিক সুযোগসুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য শ্রীশচন্দ্র প্রায়শ্চিত্ত করে সমাজে ফিরেছিলেন। অথচ এই বিধবাবিবাহকারীদের চাহিদা মেটাবার জন্য বিদ্যাসাগর মশাই প্রচুর দান করতেন, শেষপর্যন্ত তিনি শোচনীয়ভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ঈশ্বর গুপ্ত দূরদর্শী ও ভূয়োদর্শী ছিলেন, তাই এই সব দুরবস্থা তিনি আগেথেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। বিধবাবিবাহে এই কারণেই তাঁর আপত্তি। বিষয়টা তাঁর সময়কালের প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে।
আজিজুল।। আপনার ব্যাখ্যায় বিষয়টা বেশ পরিষ্কার হল। কিন্তু আর একটা প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি মারছে।
বঙ্কিমচন্দ্র।। অসংকোচে বলে ফ্যালো। দ্বিধার কিছু নেই।
আজিজুল।। প্রশ্নটা হচ্ছে এখনকার দিনে ঈশ্বর গুপ্তের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। তাঁর জীবনকালের পর দেশে নানা দিক থেকে নানা পরিবর্তন হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের পর দেশে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন, ইংরেজি শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার। উনিশ শতকের পর বিশ শতকে তো আরও অনেক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক নোবেল পুরস্কার পেলেন। বিজ্ঞানে আচার্য জগদীশচন্দ্র, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ও আরও অনেকে অসামান্য অগ্রগতি করেছেন। এরমধ্যে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত বিপ্লব ও দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা—ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর—তারপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ—স্বাধীনতা ও দেশভাগ—স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা— বিশ শতকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাজনৈতিক শক্তির একমেরুকরণ—আরও কত কী?
জটেশ্বর ও দেবশ্রী।। আজিজুল, তুই বিশ শতকেই থামলি কেন? এখন তো নতুন শতাব্দী—একুশ শতক। নতুন শতক, নতুন অধ্যায়। প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতিতে মানুষ এখন নিজের মত্যসীমা চূর্ণ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিরও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তনশীলতার প্রেক্ষাপটে আমাদের এখনকার জীবনে দুশো বছর আগেকার ঈশ্বরগুপ্ত কতটা প্রাসঙ্গিক? তাঁর প্রতি যে আমাদের এখনকার এই শ্রদ্ধা নিবেদন, এ কি শুধু পূর্বপুরুষের প্রতি দায়সারা শ্রদ্ধা নিবেদন?
তন্নিষ্ঠ।। মানে, যাকে বলে শ্রাদ্ধ। এই জন্যই কি শ্রাদ্ধশতবার্ষিকী কথাটা এখন চালু হয়েছে?
তসলিমা।। তন্নিষ্ঠ, ফের ইয়ার্কি হচ্ছে? একটু মন দিয়ে শোন না কথাগুলো।
বঙ্কিমচন্দ্র।। প্রশ্নটা বেশ ভালো তুলেছ। তবে আমার প্রবন্ধে এর খানিকটা উত্তর আগেভাগেই দিয়ে রেখেছি। ঐ প্রবন্ধের শেষ দিকে আমি লিখেছি, ‘‘যাঁহারা বিশেষ প্রতিভাশালী তাঁহারা প্রায় আপন সময়ের অগ্রবর্তী। ঈশ্বর গুপ্ত আপন সময়ের অগ্রবর্তী ছিলেন।’’
জটেশ্বরী ও মন্দোদরী।। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলুন।
বঙ্কিমচন্দ্র।। প্রযুক্তির বিস্ফোরণ, রাজনীতি, অর্থনীতির বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের ফলে ঈশ্বরগুপ্তের সময় থেকে তোমাদের সময়ের বিরাট ব্যবধান। এখনকার জীবনযাপন সম্পূর্ণ আধুনিক। এই অত্যাধুনিক জীবনে ঈশ্বরগুপ্ত কতটা কাজে লাগবেন? ভেবে দেখলে দেখা যাবে, তোমাদের এখনকার সময়ের যেসব সমস্যা তার সমাধানের কিছু ইঙ্গিত ঈশ্বরগুপ্তের রচনায় আছে। তোমাদের এখনকার জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রযুক্তির অসাধারণ অগ্রগতি। কিন্তু তার সুফল কারা পাচ্ছে? পাচ্ছে কেবল অল্প কিছু ধনী লোক। বাদবাকি হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তের তাতে কোনো উন্নতি নেই। হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত হচ্ছে সেই শ্রেণির মানুষ যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তোমাদের বন্ধুর ভাষায় যারা ম্যাংগো পিপল, তারা যে তিমিরে সেই তিমিরেই।
ছাত্রছাত্রীরা (প্রায় সমস্বরে)।। তাতে ঈশ্বরগুপ্ত কী করবেন?
বঙ্কিমচন্দ্র।। দাঁড়াও। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। দেশের এখনকার আর এক সমস্যা যাকে এখন বলা হচ্ছে ‘বিশ্বায়ন’। এই বিশ্বপুঁজি আমাদের দেশে ক্রমে ক্রমে পা বাড়িয়ে আমাদের দেশজ চাষবাস, দেশীয় কুটীরশিল্প ও কারুশিল্প এবং ঐতিহ্যগত খাদ্যাভ্যাস ও বেশভূষা, সামাজিক রীতিনীতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। বিশ্বের পুঁজিপতিরা দেখছেন, যদি কোনোভাবে সারা পৃথিবীর মানুষকে নিজ নিজ ঐতিহ্য ভুলিয়ে একই খাদ্যে ও বেশভূষায় এবং একইরকম বিনোদন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করানো যায়, তাহলে উৎপাদনের বৈচিত্র্যজনিত খরচ যেমন কমে, তেমনি পৃথিবী জুড়ে খাদ্য, পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতির বাজারটাও প্রায় একচেটিয়াভাবে দখল করা সহজ হয়। এইখানেই ঈশ্বরগুপ্ত এ কালের সমাজকে সাহায্য করতে পারবেন।
আজিজুল, মন্দোদরী ও জটেশ্বর।। সেটা কীভাবে? ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা পড়ে তো কিছু হবে না। এরজন্য দরকার সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন।
বঙ্কিমচন্দ্র।। সেআন্দোলন তো রাজনৈতিক নেতারা করবেন। কিন্তু দেশের ম্যাংগো পিপল তাতে কতটা সাড়া দেবেন, যদি না এই সংকটের বার্তা তাদের মতো করে তাদের কানে পৌঁছয়? এরজন্য দরকার অকপট দেশপ্রেম ও দেশের সংকটের কথা দেশের একেবারে নীচের তলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের জাগিয়ে তোলা এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করা। এ কাজটা পন্ডিতি প্রবন্ধ লিখে হবে না। লিখতে হবে ঈশ্বর গুপ্তের মতো ঝাঁঝালো ব্যঙ্গ কবিতা। গড়তে হবে কবির লড়াইয়ের দল। এইখানেই ঈশ্বর গুপ্ত আজকের জীবনে এখনও প্রাসঙ্গিক।
আজিজুল।। বুঝলাম। এইজন্যেই আজকের দিনে গণসংগীত এত জনপ্রিয়, পথনাটকও ভালোই দর্শক টানে। আর কবির লড়াই তো এখনও চলে, বিশেষ করে ভোটের মরসুমে। তবে এসব মাধ্যমকে ঈশ্বর গুপ্তের ধাঁচে আরও ধারালো, আরও মজাদার ও আরও সংগঠিত করতে হবে।
বঙ্কিমচন্দ্র।। তাহলে দ্যাখো, তোমাদের সময়ে সেকেলে ঈশ্বর গুপ্ত এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক। এখানে আর একটা কথা বলা দরকার। সেটা হল তোমাদের সময়কার আর একটি সমস্যার কথা। সেটা হল: তথ্যকথিত বিশ্বায়নের চাপে বাঙালি এখন নিজের ঐতিহ্য, নিজের জাতিসত্তা, নিজের মাতৃভাষার চর্চা ভুলে যেতে বসেছে। ফলে পৃথিবী জুড়ে এখন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী আক্রমণে বাঙালির জাতিসত্তা আজ বিপন্ন, কিন্তু আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির একটা বড়ো অংশ সেকথাটা বুঝেও বুঝছে না। বাঙালি জাতির এটাই এখনকার সবচেয়ে বড়ো বিপদ। এই বিপদেও ঈশ্বর গুপ্ত এখনকার বাঙালিকে সাহায্য করতে পারবেন।
ছাত্রছাত্রীরা (সমস্বরে)।। কীভাবে?
বঙ্কিমচন্দ্র।। ঈশ্বর গুপ্তের ধাঁচে সহজ ভাষার সরস কবিতায় দেশপ্রেম ও নিজেদের ঐতিহ্য-গৌরবের কথা প্রচার করে। আসলে দেশবাৎসল্য ও ঐতিহ্যপ্রীতি একই সুতোয় বাঁধা। আমাদের দেশে ঈশ্বরগুপ্ত এই দুয়েরই পথিকৃৎ। এ সম্পর্কে আমার প্রবন্ধেও আমি লিখেছি : (বই খুলে) ‘মহাত্মা রামমোহন রায়ের কথা ছাড়িয়া দিয়া রামগোপাল ঘোষ ও হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাঙ্গালা দেশে দেশবাৎসল্যের প্রথম নেতা বলা যাইতে পারে। ঈশ্বর গুপ্তের দেশবাৎসল্য তাঁহাদিগেরও কিঞ্চিৎ পূর্বগামী। ঈশ্বর গুপ্তের দেশবাৎসল্য তাঁহাদের মতো ফলপ্রদ না হইয়াও তাঁহাদের অপেক্ষাও তীব্র ও বিশুদ্ধ।’
জটেশ্বরী, তসলিমা ও দেবশ্রী।। হ্যাঁ হ্যাঁ। এটা পড়েছি, এরপর আপনি ঈশ্বর গুপ্তের রচনা থেকে কয়েক ছত্র উদ্ধার করেছেন :
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।।
আজিজুল ও মন্দোদরী।। তা ছাড়া মাতৃভাষাপ্রীতির কথা ঈশ্বর গুপ্তই তো প্রথম জোরালো ভাবে প্রচার করেন :
মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা
তুমি তার সেবা করো।
যাইহোক, তাঁর ঐতিহ্যপ্রীতি সম্পর্কে আপনার কাছে আরও কিছু শুনতে চাই।
বঙ্কিমচন্দ্র।। ঈশ্বর গুপ্ত তো বাঙালি ঐতিহ্যেরই ধারক ও বাহক। ঐতিহ্যপ্রীতির প্রেরণায় তিনি বিস্মৃত সব কবিওয়ালা ও তাঁদের রচিত কবিতা ও গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এসব পড়ে বাঙালি তার দেশজ ঐতিহ্যের যুগসঞ্চিত শক্ত মাটিতে পা রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। আর তাঁর কবিতার অনেক অংশ জুড়ে রয়েছে বাঙালির নানা ঐতিহ্যের গুণকীর্তন। আমার প্রবন্ধেও একটু অন্যভাবে এ কথাটা লিখেছি। একটু পড়ে শোনাই: ‘ঈশ্বরগুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধুঁয়ায়, নাটুরে মাঝির ধজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খাবার, পাঁঠার অস্থিস্থিত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুর রস ছাড়া কাব্যরস পান, তপসে মাছে মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেন, পাঁটার বোকাগন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান। তিনি বলেন ‘তোমাদের এ দেশ, এ সমাজ বড় রঙ্গভরা।’ তোমরাও এখন ঈশ্বর গুপ্তকে আদর্শ করে সংগঠিত ভাবে দেশবাসীকে, বিশেষত দেশবাসীর আত্মবিস্মৃত অংশকে এই ঐতিহ্যের কথা জানাও, ঐতিহ্যকে ভালোবাসতে শেখাও।
তন্নিষ্ঠ।। কিন্তু শুধু ঐতিহ্যের মধ্যে ডুবে থাকলেই হবে? আন্তর্জাতিক হতে হবে না?
বঙ্কিমচন্দ্র।। নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক হতে হবে। তবে নিজের জাতিসত্তার মর্যাদাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, সম্পূর্ণ রক্ষা করেই। তোমাদের চেনাজানা দুজনের কথা বলি। এঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। রবীন্দ্রনাথকে আমি তাঁর যুবক বয়স পর্যন্ত দেখেছি। কিন্তু তার পরের কথা আমি বই পড়ে জেনেছি। আর সত্যেন্দ্রনাথকে আমি চোখে দেখিনি। তবে তাঁর কীর্তিকথা আমি পত্র-পত্রিকা পড়ে জেনেছি। তাতে দেখেছি, দু-জনেই আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু এঁদের কেউই আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেন নি। রবীন্দ্রনাথ তো আজীবন মাতৃভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। আর সত্যেন্দ্রনাথ মাতৃভাষাতেই বিজ্ঞানচর্চার জন্য উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মাসিক বাংলা বিজ্ঞান-পত্রিকা ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’-এ প্রতিমাসে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয়। এরকম আরও উদাহরণ তোমরা নিজেরাই দিতে পারবে।
ছাত্রছাত্রীরা (উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে)।। অনেকক্ষণ আপনার সময় নিয়েছি, এবার বিদায় নেবার পালা। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আপনি আমাদের প্রণাম নেবেন।
বঙ্কিমচন্দ্র।। চলে যাবে? তা, তোমাদের সঙ্গে আমারও সময়টা বেশ ভাল কাটল। একটা নতুন কথাও শিখলাম—ম্যাংগো পিপল। (একটু থেমে) বৎস তন্নিষ্ঠ, তোমাকে বলছি, তোমার বন্ধুরা পছন্দ না করলেও আমি বলছি, ইয়ার্কিটা চালিয়ে যাও। তবে শুধু ইয়ার্কিতে ফুরিয়ে গেলে চলবে না। তন্নিষ্ঠ হয়ে মাতৃভাষায় লেখালিখি শুরু করো। একজন অভিজ্ঞ সম্পাদক হিসাবে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, মন দিয়ে লেখালিখি করলে তুমি একদিন বাংলা ভাষার একজন সেরা রসসাহিত্যিক হয়ে উঠবে—আর বাকিদেরও বলছি, তোমরাও লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষায় লেখালিখিটাও চালিয়ে যাও, তোমরা বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী যখন। আমি তো তোমাদের আশীর্বাদ করছিই। কবি ঈশ্বর গুপ্তও স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ করবেন যদি তোমরা তাঁর দেশপ্রেমের বাণী অনুসরণ করে দেশের মানুষের জন্য, বিশেষত ঐ ম্যাংগো পিপলের জন্য দল বেঁধে কিছু কর।—আচ্ছা, বলা রইল, দরকার পড়লে আবার আসবে। অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু।