উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষা
সংস্কৃত নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাট্যকারে রা সংলাপ রচনার ব্যাপারে জাতিভেদপ্রথা স্বীকার করেছেন। এই জাতিভেদ অবশ্য কিছুটা পাত্র-পাত্রীর লিঙ্গগত, কিছুটা তাদের সামাজিক পরিচয়গত। এ সম্পর্কে সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রীরা যে বিধান দিয়েছেন সংক্ষেপে তার মর্মার্থ হচ্ছে১: পুরুষ চরিত্র যদি অভিজাত হন তবে তিনি সংস্কৃতে কথা বলবেন, আর যদি অনভিজাত হয় তবে নাটকে তাকে যে অঞ্চলের লোক বলে দেখানো হবে সেই অঞ্চলের প্রাকৃতে তার সংলাপ রচিত হবে। এ ছাড়া স্ত্রী-চরিত্রগুলি কয়েকটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্র ছাড়া প্রায় সব সময়েই প্রাকৃতে কথা বলে, তবে চরিত্রের সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে প্রাকৃতেরও ইতরবিশেষ ঘটতে পারে। সংলাপ রচনায় নাট্যকারদের এই ভেদনীতি হয়তো কিছুটা ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এবং এই ভেদসূত্র পুরোপুরি লিঙ্গগত না হয়ে অনেকটাই সেকালের সামাজিক পরিস্থিতির অনুগামী। তবু লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, এর মধ্যে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের অনুশীলনে যেসব পন্ডিত নৃতত্ত্ব ও সমাজবিদ্যাকে বিশেষভাবে আশ্রয় করেছেন, তাঁরা ভাষাবিশেষের উপভাষাবিচারে শুধু বৈচিত্র্যই স্বীকার করেননি, ভাষা-সম্প্রদায়ের নরনারী-ভেদে উপভাষার লৈঙ্গিক পার্থক্যও নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ মূলত একই ভাষার বক্তা হলেও পুরুষের ভাষা ও নারীর ভাষার মধ্যে নানাদিক থেকে কতকগুলি প্রভেদ তাঁরা লক্ষ্য করেছেন। এই প্রভেদের কারণ কিছুটা শারীরিক ও মানসিক, কিছুটা স্ত্রীপুরুষের সামাজিক বৈষম্যগত। যে সমাজ যত প্রগতিশীল এবং যে সমাজে নরনারীর সাম্য যত বেশি স্বীকৃত হয়েছে, সেসমাজে এই প্রভেদ তত বেশি দুর্লক্ষ্য। নারীর ভাষা সম্পর্কে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক Otto Jespersen তাঁর Language : Its Nature, Development and Origin গ্রন্থের ‘The Woman’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে সমাজবিদ্যার নানা তথ্যের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীর নানা সভ্য সমাজের চেয়ে আফ্রিকা ও আমেরিকার আদিম ও অনুন্নত স্তরের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে উপভাষার এই লৈঙ্গিক পার্থক্য অনেক বেশি পরিস্ফুট। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের ব্যবহৃত শব্দভান্ডারের প্রকৃতি ও পরিমাণের দিকে নজর রাখলে উপভাষার এই পার্থক্য ধরা পড়ে। মেয়েরা তাদের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার জন্য কিছুটা রক্ষণশীল, তাই তাদের শব্দভাণ্ডারও অনেকখানি রক্ষণশীল, অর্থাৎ মেয়েদের কথায় এমন অনেক শব্দ ও ইডিয়ম পাওয়া যায় যা সেই সময়কার পুরুষের ভাষায় দুষ্প্রাপ্য ও অপ্রচলিত। সিসেরো-র একটি প্রচলিত উক্তির মধ্যে Jespersen মেয়েলি ভাষার এই রক্ষণশীলতার ইঙ্গিত পেয়েছেন।২ আবার মেয়েদের ভাষা রক্ষণশীল বলেই পুরুষেরা যে পরিমাণে নতুন কথা নিত্য ব্যবহার করে, মেয়েরা নতুন কথা তত আয়ত্ত করে না। তাই মেয়েদের শব্দভান্ডার পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কৃশ। আবার শারীরিক-মানসিক উৎকর্ষের জন্যই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক প্রগতির আহ্বানে পুরুষেরাই প্রথম সাড়া দেয়, সেজন্য কিছু কিছু আদিম আচার ও সংস্কার নারীর মনোজীবনের আশ্রয়েই দীর্ঘস্থায়ী হয়। মেয়েদের এই আপেক্ষিক আদিমতার জন্য প্রায় সব দেশের মেয়েদের বাগব্যবহারে কতকগুলি সাধারণ বাচনিক নিষিদ্ধতা (verbal taboo) প্রতিপালিত হয়, যেমন, স্বামী বা গুরুজনের প্রকৃত নামোচ্চারণের পরিবর্তে তার সর্বনাম, প্রতিশব্দ বা রূপকার্থজ্ঞাপক শব্দ ব্যবহার, অমঙ্গলসূচক শব্দোচ্চারণে ভীতিবোধ ও প্রতিশব্দ-সন্ধান। শুধু অনুন্নত সমাজেই নয়, সভ্য সমাজেও হীনম্মন্যতাবোধ, লজ্জাশীলতা ও শারীরিক-মানসিক কোমলতা হেতু মেয়েরা কিছু কিছু শব্দের সরাসরি ব্যবহারে সংকোচ বোধ করেন। শব্দভান্ডারের এই দারিদ্র্য, লজ্জাতুরতা ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার জন্য মেয়েদের কথায় শ্বাসাঘাত ও স্বরাঘাত প্রাধান্য লাভ করে। এই স্বরাঘাত ও শ্বাসাঘাতের সাহায্যে মেয়েরা কথার অন্তর্নিহিত আবেগ বা ভাবকে একটা নির্দিষ্ট দিকে চালিত করার চেষ্টা করে। এই একই কারণে মেয়েদের ভাষায় তীব্রতাসূচক ও অনুভবদ্যোতক অব্যয় ও বাক্যাংশের আধিক্য। ভাবের তুলনায় শব্দ কম ও শ্বাসাঘাত-স্বরাঘাত বেশি বলে সাধারণ কথোপকথনে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের বাক্যই পরিমাণে বেশি অসমাপ্ত থাকে, সুতরাং অসম্পন্ন বাগব্যবহার (aposiopesis) নারীর ভাষার আর-একটি আপেক্ষিক বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া মেয়েরা ভাবপ্রকাশ করতে গিয়ে তীব্রতাসূচক ঝোঁক দেওয়া শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের পক্ষপাতী বলে তারা একাধিক বাক্যাংশ-নির্ভর দীর্ঘ মিশ্র বাক্য ব্যবহারে তেমন অভ্যস্ত নয়, কিন্তু পুরুষেরা শব্দভান্ডারের আপেক্ষিক সমৃদ্ধির জন্যই হোক অথবা ভাবপ্রকাশের ব্যাপারে কিছুটা চিন্তা বা বুদ্ধিনির্ভর হওয়ার জন্যই হোক একাধিক বাক্যাংশ-নির্মিত একটি জটিল বাক্য (hypotaxis) ব্যবহারে অসুবিধা বোধ করে না। মেয়েদের দীর্ঘবাক্য সেদিক থেকে আসলে সংযোজক অব্যয় দিয়ে জোড়া-দেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যের সংকলনবিশেষ (parataxis)।৩ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে উভয় ভাষার মধ্যে সাধারণ স্তরে আরো অনেক তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রভেদ ধরা পড়বে, তাদের কোনোটি চূড়ান্ত, কোনোটি বা দেশকালপাত্রভেদে আপেক্ষিক। সেই বিস্তৃত সাধারণ পর্যবেক্ষণের অবকাশ এখানে নেই।
বাংলা ভাষার উপভাষা নিয়ে এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হয়েছে তার প্রায় সবটাই ভূগোলভিত্তিক। ভূগোল ছাড়াও লিঙ্গের ভিত্তিতে বাংলা ভাষার যে পুনর্বিশ্লেষণ করা চলে সেসম্পর্কে সুধীসমাজের দৃষ্টি তেমন জাগরূক নয়। উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে উইলিয়ম কেরী তাঁর ‘কথোপকথন’ গ্রন্থে বাংলা মেয়েলি ভাষার কিছু নমুনা সংকলন করেছিলেন, কিন্তু এই সংকলন ভিন্নতর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ায় এর অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন ভাষাতাত্ত্বিক ইঙ্গিতগুলি পরবর্তী ভাষাগবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া, উনিশ শতকের বাংলা নাটকগুলিতে বিশেষত সামাজিক প্রহসনগুলির নারীচরিত্রের সংলাপে আঞ্চলিকতা ও মেয়েলি ভাষণভঙ্গি অনেকখানি রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে নাট্যকারদের মূল লক্ষ্য ছিল বাস্তব বাতাবরণসৃষ্টি ও মেয়েলি সংলাপের অ-সাধারণত্বের সাহায্যে প্রহসনের কৌতুকরস বৃদ্ধি। তা ছাড়া সংস্কৃত নাটকে সংলাপ রচনার চরিত্রসাপেক্ষ ভেদসূত্রের দ্বারাও আদিপর্বের বাঙালি নাট্যকারেরা অনেকখানি প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষভাবে নাটকের প্রয়োজনে রচিত হওয়ায় এইসব মেয়েলি সংলাপে বাস্তবতার স্থূল স্পর্শ থাকলেও ভাষাতাত্ত্বিক সূক্ষ্মদর্শিতা ও যাথাযথ্যবোধের পরিচয় তেমন পাওয়া যায় না। তা ছাড়া নাটক সৃষ্টিধর্মী রচনা, ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তার কর্তব্য নয়। ১৮৭২ সালে সারদাচরণ মিত্র বাংলা ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক একটি প্রবন্ধে বাংলা মেয়েলি ভাষার রূপস্বাতন্ত্র্যের কথা উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রসঙ্গটি তিনি বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষণ করেন নি।৪ এরপর বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম বাংলার লোক-সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে ‘গৃহচারিণী অকৃতবেশা অসংস্কৃতা’ মেয়েলি ভাষার মাধুর্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তবে তাঁর আলোচনা মূলত মেয়েলি ছড়ার রসগত সৌন্দর্য নিয়ে, ছড়ার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে নয়। বাংলা তথা নব্যভারতীয় আর্যভাষার লিঙ্গগত রূপান্তর সম্পর্কে গবেষকদের দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেই আকৃষ্ট হয়েছে। জর্জ এব্রাহ্যাম গ্রিয়ারসন তাঁর ‘লিংগুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের উপাদান সংগ্রহের সময় পুরুষের ভাষা ও নারীর ভাষার সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন, তবে তাঁর ‘সার্ভে’র উদ্দেশ্য ঠিক ভাষা-বিশেষের লিঙ্গগত বৈচিত্র্যবিচার নয় বলেই তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক সমীক্ষায় বিষয়টি অগ্রাধিকার বা স্বতন্ত্র মনোযোগ পায়নি। পৃথকভাবে শুধু লিঙ্গের ভিত্তিতেই যাঁরা ভাষার রূপবিচার করেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর সুকুমার সেন মহাশয়ের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of the Department of Letters (Vol. XXVIII)-এ প্রকাশিত ‘Women’s Dialect in Indo-Aryan’ ও বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় (১৯২৭) প্রকাশিত ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ-দুটি এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য।৫ ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ প্রবন্ধে ড. সেন জানিয়েছেন, ‘‘বাঙলা বলতে কেবল মধ্য ও পূর্ব পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ হাওড়া-হুগলী-বর্ধমান-চব্বিশ পরগনার মুখের ভাষা বুঝোবে।’’ বাংলা সাহিত্যে এই মধ্য-ও পূর্ব-পশ্চিমবঙ্গের উপভাষাই অল্পবিস্তর পরিবর্তিতভাবে শিষ্ট ভাষা হিসাবে গৃহীত হয়েছে, তা ছাড়া আদিপর্বের বাংলা নাটকে মেয়েলি সংলাপ-বিশিষ্ট যেসব নারী চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গীয়। সুতরাং ড. সেনের আলোচনা একদিক থেকে সাহিত্যে গৃহীত ভাষারূপেরই লিঙ্গগত বিশ্লেষণ।
উত্তরবঙ্গের উপভাষা সাহিত্যিক কৌলীন্য না পেলেও বাংলা ভাষার ইতিহাসে এই উপভাষার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপভাষাকে ‘কামরূপী’ নামে চিহ্নিত করে ক্ষান্ত থাকেন; কিন্তু এই সাধারণীকৃত নামকরণে এই অঞ্চলের ভাষাগুলি সম্পর্কে সূক্ষ্মতর ভাষাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের পরিচয় অনেকখানি অস্পষ্ট থাকে। এই অঞ্চলের ভাষা-সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে যেমন বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী আছে তেমনি পার্বত্য সীমান্ত জুড়ে ভোটচীনীয় ভাষাসম্প্রদায়ও আছে। এই সীমান্তবাসী ভাষাসম্প্রদায় কোথাও কোথাও বাংলা ও ভোটচীনীয় ভাষা দুইটিকে পারস্পরিক বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে। ভোটচীনীয় ভাষাসম্প্রদায় বাংলাকে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করায় অনেক ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের উপভাষায় প্রতিবেশী ভাষার নানা প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়েছে। এই অঞ্চলের বাংলা উপভাষার পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করতে গেলে এই প্রভাবসূত্রগুলি অতি সন্তর্পণে সন্ধান করা দরকার। এ ছাড়া, এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে যাঁরা শুধু বাংলাভাষা ব্যবহার করেন তাঁদের মুখের ভাষাও ঐতিহাসিক কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষার মধ্যস্তরের লক্ষণ নির্দেশের ব্যাপারে ভাষাবিজ্ঞানীরা মুখ্যত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথি ও বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ও পদাবলীর পুথির উপর নির্ভর করেন, কিন্তু এইসব পুথির প্রাচীনত্ব ও প্রামাণিকতা নিয়ে অনেকক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ থাকায় পুথির ভাষাবৈশিষ্ট্যের প্রাচীনতা নিয়েও সন্দেহ জাগা অস্বাভাবিক নয়। এদিক থেকে উত্তরবঙ্গের মুখের ভাষা বাংলা ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত সহায়ক বলে মনে হবে। কেননা, পুরোনো বাংলার যেসব লক্ষণ তাঁরা নির্দেশ করে থাকেন ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার অনেকগুলিই এ অঞ্চলের ভাষায় টিকে রয়েছে, যেমন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন তথা আদি-মধ্য বাংলায় আদ্যস্বরে শ্বাসাঘাত পড়ায় আদ্য অ > আ (অসুখ > আসুখ, অনল > আনল, অনুপম > আনুপম ইত্যাদি)। উত্তরবঙ্গের ভাষারও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আদ্য অ > (প্রায়শ) আ (অবস্থা > আবস্থা, কথা > কাথা, অতি > আতি, গলা > গালা, হতে > হাতে, ঘড়া > ঘারা ইত্যাদি), এর উল্টোটাও অবশ্য দেখা যায়, অর্থাৎ চলিত বাংলায় যেখানে আদি স্বর দীর্ঘ এখানে তা হ্রস্ব, যথা—মাসী > মোসী, পাখী > পখি, গাছ > গছ ইত্যাদি। এ ছাড়া সাধারণভাবে ভাষাবিজ্ঞানের বিচারে বাংলার বিভিন্ন উপভাষাগুলির মধ্যে ‘বঙ্গালী’ উপভাষা অনেকটা রক্ষণশীল অর্থাৎ ভাষাতাত্ত্বিক প্রাচীনতার লক্ষণ এই উপভাষায় অনেক বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত। এদিকে থেকে বঙ্গালীর সঙ্গে এ অঞ্চলের উপভাষার অনেক মিল আছে, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের উপভাষায় বঙ্গালীর চেয়েও প্রাচীনতর অবস্থার নিদর্শন অনেক বেশি পরিমাণে নিহিত আছে। যেমন, অপিনিহিতি বঙ্গালীর একটি সর্বব্যাপী বৈশিষ্ট্য, কিন্তু উত্তরবঙ্গের উপভাষায় অপিনিহিতির ব্যবহার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, সেই জায়গায় শব্দের অপিনিহিত রূপের অব্যবহিত প্রাচীনতর রূপটিই ব্যবহৃত হয়, উদাহরণ—
বঙ্গালী কামরূপী
আইজ আজি
কাইল কালি
রাইত আতি
রাইখ্যা আখিয়া
কইর্যা করিয়া
জাউল্যা জালুয়্যা, ইত্যাদি
অনেক ক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলার মতো ইল-ইব-প্রত্যয়ান্ত ক্রিয়াপদের বিশেষণ হিসেবে ব্যবহারের নজির এই উপভাষায় লক্ষ্য করা যায়, যেমন, দেখিলা মানসি = দেখা মানুষ, আসিবা দিন = আগামী দিন ইত্যাদি। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের উপভাষায় নঞর্থক বাক্যগঠনে মধ্যবাংলার বাক্যরীতির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। মধ্য বাংলায় নঞর্থক শব্দটি সমাপিকা ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে, উত্তরবঙ্গেও তাই ঘটে। এমনকি প্রাচীন সাহিত্যে স্থান পেয়েছে এমন কিছু কিছু প্রবাদ-প্রবচন ও কবিপ্রসিদ্ধি এ অঞ্চলের মুখের ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি বিখ্যাত শ্লোক ‘বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী/মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী।।’এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় উত্তরবঙ্গের নারীর মুখের প্রবাদোক্তিতে : বন পোড়া যায় সোগগায় দেখে/মন পোড়া যায় কাঁহয় না জানে। সূক্ষ্ম ও বিস্তৃততর বিশ্লেষণে উত্তরবঙ্গের উপভাষার আপেক্ষিক রক্ষণশীলতার আরও নির্দশন পাওয়া যেতে পারে। এই রক্ষণশীলতার কারণ উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মধ্যে অনেক পরিমাণে নিহিত আছে। রাজনীতি-সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতিচর্চার দিক থেকে যেসব অনুকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রগতির সম্মুখীন হয়েছে উত্তরবঙ্গের ভাগ্যে তা জোটেনি বলেই অন্যান্য অনেক ব্যাপারের মতোই ভাষার ব্যাপারেও এ অঞ্চলে মধ্যযুগ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। কিন্তু মধ্যযুগ কোথায় কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে তার বিশদ আলোচনা এখানে অবান্তর। নারীর ভাষার আলোচনায় উপভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্যের আলোচনাও অবান্তর মনে হতে পারে, কিন্তু এই আলোচনা এই কারণেই অপরিহার্য যে, বাংলা উপভাষাগুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের উপভাষার ভূমিকাটি বোঝা গেলে তার পটভূমিকায় এ অঞ্চলের নারীর ভাষার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যটি অনায়াসে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। নারীর ভাষা স্বভাবতই রক্ষণশীল, অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের উপভাষাও প্রকৃতিগতভাবে অনেকখানি রক্ষণশীল, সুতরাং এ অঞ্চলের নারীর ভাষা প্রায় দ্বিগুণভাবে রক্ষণশীল। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নারীর ভাষার রক্ষণশীলতার মাত্রা নির্ধারণের জন্যই এই প্রসঙ্গের অবতারণা।
এ অঞ্চলের নারীর ভাষার রক্ষণশীলতা শুধু উত্তরবঙ্গীয় উপভাষার সাধারণ প্রকৃতির কাছ থেকেই আনুকূল্য পায়নি, এ অঞ্চলের বৃহত্তর নারীসমাজের রক্ষণশীল পরিস্থিতিও এ ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। কিছুদিন আগে ডা: চারুচন্দ্র সান্যাল মহাশয় The Rajbanshis of North Bengal (Asiatic Society of Bengal, Calcutta, 1965) নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যায় এ অঞ্চলের রাজবংশী সমাজে নারীর বহুবিবাহ প্রচলিত থাকলেও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মেয়েদের মতোই এখানকার মেয়েরাও আসলে পুরুষ-নির্ধারিত সামাজিক নিয়মকানুনেরই একান্ত বশবর্তী।৬ বিধবা অবস্থাতে তো বটেই এমনকি সধবা অবস্থাতেও নারীর পুনর্বিবাহে এ সমাজের অনুমোদন আছে, কিন্তু এই বৈবাহিক অবস্থান্তর নারীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করে না। এ অঞ্চলে কন্যার বিবাহে কন্যার অভিভাবক বরপক্ষের কাছ থেকে কন্যাশুল্ক লাভ করে থাকেন, তাই এক নারীর পৌনঃপুনিক বিবাহের ব্যবস্থা করে সমাজ নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মর্যাদা দেয় না, নারীকে অর্থলাভের সমাজ-অনুমোদিত মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে। নারীর এই বিচিত্র বিবাহপদ্ধতি ও এইসব বিবাহের মাধ্যমে নারী সম্পর্কে পুরুষের যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় তাতে আপেক্ষিকভাবে পুরুষেরই প্রাধান্য ও সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়। উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষা আলোচনা করতে গেলে নারীর সামাজিক ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। নারী মূলত সামাজিক শোষণের লক্ষ্যস্থল বলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলে স্ত্রী-শিক্ষার কোনো প্রাচীন দেশজ ঐতিহ্য দেখা যায় না। গৃহস্থালির কাজকর্মই তাদের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয়। প্রশস্ত শিক্ষার অভাবে সংসারের নানা ব্যাপারে, বিবাহে, দাম্পত্যজীবনযাত্রায় ও সন্তানধারণ-প্রসব-পালনের ক্ষেত্রে মেয়েদের নানা আদিম প্রথা ও সংস্কার পোষণে অভ্যস্ত হতে দেখা যায়। সামাজিক স্তরে পুরুষের এই আপেক্ষিক সুবিধা ভোগের ফলে এই অঞ্চলের শিক্ষিত পুরুষ ও অশিক্ষিত পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য, অশিক্ষিত পুরুষ ও অশিক্ষিতা নারীর মধ্যে পার্থক্য তার তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং এদিক থেকেও এ অঞ্চলের নর ও নারীর ভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।
মেয়েদের ভাষার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষাতেও তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতাদ্যোতক স্বরাঘাত লক্ষ্য করা যায়। পুরুষের বাগব্যবহারের লয় সেতুলনায় বিলম্বিত। প্রকৃতপক্ষে ধ্বনিপ্রকৃতির দিক থেকে পুরুষ ও নারীর ভাষার মধ্যে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নেই। বিষমীভবন (জননী > জলনী, সিনান > সিলান), বিস্ফারণ (গান > গাহার, তোর > তোহোর), স্বরভক্তি (লক্ষ্মী > লখমী, গ্রাম > গারাম, বৃষ্টি > বিরিষ্টি), আদ্য ব্যঞ্জনের মহাপ্রাণতা (বেশ > ভেশ, জন > ঝন, বাসা > ভাসা), আদ্যস্বরে শ্বাসাঘাত হেতু পদমধ্যস্থ ধ্বনির বিবিধ পরিবর্তন : (১) পরবর্তী ঘোষবৎ > অঘোষ (জীব > জীপ, খুব > খুপ, ভোগ > ভোক), (২) আদ্য অ > আ (অবস্থা > আবস্থা, অসুখ > আসুখ, অলক > আলক), (৩) মধ্যস্বরলোপ, ফলে দ্বিমাত্রিকতা (কোটকী), আদ্য র লোপ, আদ্য ল > ন (লাউ > নাউ, লাগে > নাগে, লাংগল > নাংগল)—ধ্বনিব্যবহারের এই বৈশিষ্ট্যগুলি পুরুষ ও নারীর ভাষায় মোটামুটি একই রকম। পার্থক্যটা মূলত শব্দভান্ডারের দিক থেকে এবং কিছু পরিমাণে রূপতত্ত্ব তথা পদসাধনের দিক থেকে। তৎসম শব্দ তথা সংস্কৃত ভাষার জ্ঞান অত্যন্ত পরোক্ষ ও সংকীর্ণ হওয়ায় অনুকার ও দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহারের দিকে এই অঞ্চলের মেয়েদের একটা সাধারণ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এইসব শব্দের অন্তনির্হিত ধ্বনিব্যঞ্জনা বা ধ্বনিচিত্রের মাধ্যমে এ অঞ্চলের নিরক্ষর মেয়েরা কোনো বিমূর্ত ভাব বা ভাবের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। যেমন, বেশবাস সম্পর্কে অমনোযোগী ব্যক্তি—ভুলংভাসাং; খুব মোটা স্ত্রীলোক—ঢেমসী; মোটা পুরুষ—চেন্দেলা, ধেদেমা; রোগা পুরুষ—সিটিঙ্গা, খিটমিটা, সিটিংবিটিং; অন্যমনস্ক ব্যক্তি—ঘং সুং; বোকা লোক—ভ্যাদাং দ্যাং, ভোচোক-চোক; অগোছালো (জিনিস)—ভকর (ভাকর) ভাউল; শূন্যতা দ্যোতনায়—ডং ডং (তুলনায় : পশ্চিমবঙ্গীয় ‘খাঁ খাঁ’); অলস ব্যক্তি—স্যালস্যালা; বাচাল বা অনবরত কথা বলে যে—ভোকভোকিয়া, চ্যাদাং ব্যাদাং, অস্থির অসহিষ্ণুব্যক্তি—হোদোকদোকী; রোগা বালক—কেনকেনিয়া; পরদ্রব্যকারতর বালক—টেপেসটুপুস; খুব পাকা (ফল)—নল নল, টস টস ইত্যাদি। এই ধরনের ধ্বনিনির্ভর শব্দ মেয়েদেরই সৃষ্টি, তবে শব্দগুলির ভাবপ্রকাশক অমোঘতার জন্য পুরুষেরাও কখনো কখনো এগুলির সাহায্য নেয়।
পূর্বেই দেখা গেছে যে, ঝোঁক দিয়ে কথা বলা অভ্যাস বলে মেয়েরা সাধারণত দীর্ঘ বাক্যের চেয়ে হ্রস্ব বাক্য বেশি ব্যবহার করে এবং বাক্যের অন্তর্গত সংশ্লেষযোগ্য একাধিক পদকে সমাসের মতো একটি পদে ঘনীভূত করে নেয়। এদিক থেকে উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষায় বহুব্রীহি, তৎপুরুষ, দ্বন্দ্ব ও শব্দদ্বৈতের ব্যবহার খুব বেশি। বহুব্রীহি—মুটুককেশী। [যে মেয়ের চুল কোঁকড়ানো], চিরলদাতী [সূক্ষ্ম ও অসমান দন্তবিশিষ্ট মেয়ে]। হাসগালাণ্ডী [হাঁসের গলার মতো গলা যে মেয়ের], খরমপাই [খড়মপেয়ে], হাতিপাই [হাতির পায়ের মত বিসদৃশ পা যে-মেয়ের], হটকোটিয়া [(হটা = ডেঁয়ে পিঁপড়ে)] ডেঁয়ে পিঁপড়ের মত উচ্চনিতম্বিনী], কালীচুলী [(কালী-প্রতিমার মত?) লম্বা চুল যে-মেয়ের], উপরকাপড়ী [সদ্য-যৌবনা মেয়ে (যে-মেয়ে এখন আর কাপড় দিয়ে শুধু নিম্নাঙ্গ ঢাকে না, উপর বা ঊর্ধ্বাঙ্গের বুক ঢেকে কাপড় পরে)], দোকাপুড়ী [বয়ঃসন্ধিতে উপনীত মেয়ে (এই বয়সে মেয়েরা শাড়ি পরা ধরলেও বাল্যের পোশাক একেবারে পরিত্যাগ করে না, হয়ত বাড়িতে ফ্রক ও বাইরে শাড়ি—এই দুরকম কাপড় বা পোশাক ব্যবহার করে)], হেটকাপুড়ী [খুব অল্পবয়সি মেয়ে, যার দেহে এখনও যৌবনের লক্ষণ দেখা যায়নি। অর্থাৎ যে মেয়ে এখনো শুধু দেহের হেট ( < অধিস্তাৎ) বা নিম্নভাগ কাপড় দিয়ে ঢাকে], ঢ্যাপরচোখু। [বড় বড় চোখ যার], তিনকোনিয়ার [ত্রিভুজ], মাউরিয়া [মাতৃহীন], মাইয়ামরা-মাগমরা-মোগীমরা [বিপত্নীক], জোঁয়াই-ভাতারী [(জামাইকে যে পতিত্বে বরণ করেছে) এটি গালাগলিতে ব্যবহৃত হয়], হাগুরুয়া-নিগরুয়া [গোরু নেই যার (গোরু এ অঞ্চলের কৃষিজীবী সমাজে অন্যতম প্রধান সম্পদ বলে গণ্য, সেজন্য ব্যক্তিবিশেষের গোরু থাকা না-থাকার উপর তার সামাজিক মর্যাদা অনেকটা নির্ভর করে)], ইত্যাদি। তৎপুরুষ/কর্মধারয় : সেজামুতুরি [শয্যায় মূত্রত্যাগে অভ্যস্ত (শিশু বা বালক)], গাবুর-আড়ি [তরুণী বিধবা], ডেক্কুর-আড়ি [গর্ভিণী অবস্থায় বিধবা], চেটুলআড়ি-চিতলআড়ি-ফুলআড়ি [বালবিধবা], ভাতারীমাই-ভাতাত্তীমাই [সধবা মেয়ে], বিহাতীবেটী-বিয়াস্তীমাই [বিবাহিতা মেয়ে], গাবুরবেটী [বিবাহযোগ্যা মেয়ে (তুলনীয় : সোমত্ত মেয়ে)] পাতগাবুর [কিশোরবয়স্ক], সাংগেনাভাতার [উপপতি], সাংগনিমাইয়া [উপপত্নী], জেঠপইত [(< জ্যেষ্ঠা-পতি) বয়োজ্যেষ্ঠ ননদের স্বামী], শালপোইত [ছোট ননদের স্বামী], নাংগাহী [(নাং = উপপতি) অসতী স্ত্রীলোক], সরগোচালী-বাহোমারী [পাড়াবেড়ানী স্ত্রীলোক], মর্দাহী [মর্দ অর্থাৎ পুরুষের মত চালচলন যে স্ত্রীলোকের], ছোয়াভুরকা [ছেলেভুলানো (ছড়া)] ইত্যাদি। দ্বন্দ্ব ও দ্বিরুক্ত পদসমুচ্চয়—ত্যালসুপারি, পানগুয়া, ছামগাইন [ধানকুটবার উদখল], কাপড়লতা, পুছাগোংসা, বাই-বাই [এক গুঁয়ে], ন্যাম-ন্যাম [বড় বড়], নেসভেস [বন্ধুত্ব, ভাবসাব], খেস-নেস [যন্ত্রণা], হবর-জবর [বাহুল্য বা আতিশয্য বোঝাতে] ইত্যাদি।
এদিককার নারীর ভাষার অপর বৈশিষ্ট্য কতকগুলি বিশেষ উপসর্গ ও প্রত্যয়ের প্রতি পক্ষপাত। উপসর্গ (নঞর্থক): নি—নিকামা (নিষ্কর্মা), নিছালটিয়া (নির্লোম), নিজাঞ্জাল (নির্ঝঞ্ঝাট), নিপুতুরা-রী (অপুত্রক), নিপানিয়া (অনাবৃষ্টি), নিলাজ, নিধনী, নিগুরুয়া, হা—হাগরুয়া, হাখোরাক, হাখোরাগিয়া (অভুক্ত); অ, আ—অফুলা (ফুলহীন), আদেখিলা (অদেখা), আড্ডিম (ডিম্বহীন)। (স্বার্থিক) অ, আ—অকুমারী, আকুয়ারী (কুমারী কন্যা), আছিদ্দোর (ধূর্ত)। বংশগত অধস্তনতা-দ্যোতনায় পা (<প্র), গু—পা-নাতি, পা-নাতিনী, গু-নাতি। প্রত্যয়ের মধ্যে : তদ্ধিত আর, আরী-আল, ইয়া-ই-ইয়াল, উয়া-উয়ার, তী-লী, যথা, বাঁশিয়ার (বাঁশিওয়ালা), ফান্দিয়ার (যে ফাঁদ পেতে মাছ বা অন্য জন্তু ধরে), ভুজারী (ভুজাবিক্রেতা), বাঁশিয়াল-গীতাল-মইশাল (বাঁশিওয়ালা-গীতিকার বা গায়ক-মহিষপালক), জাঙ্গালিয়া (বনচর), গাউনিয়ার (গায়ক), কামাইয়াল (শ্রমিক), ধানুয়া (ধান্যবিক্রেতা), পানুয়ার (পানবিক্রেতা), গাছুয়ার (গাছে চড়তে অভ্যস্ত), আগতী-পছিমতী-ছোয়াতী-বিহাতী-বিয়াতী, ভাতাত্তী—ভাতারতী, নিকাতী (নিকাহ করা বউ), পেটেলী (গর্ভিণী), ফেদেলী (বাচাল স্ত্রীলোক), দোন্দোলী (<দ্বন্দ্ব, কলহপ্রবণ স্ত্রীলোক), ইত্যাদি। কৃৎপ্রত্যয়—আ—মুড়িবেচা (মুড়ি বেচ + আ), ঘাসবেচা। তী—শুকাতী (শুকনো), বুকাতী (চুয়া—পরিত্যক্ত কূপ); লা—দেখিলা (মানসি = পরিচিত লোক); উইয়্যা—দেউয়্যা (দানকর্তা), খাউইয়্যা (ভোজনকারী) ইত্যাদি। এ অঞ্চলের মেয়েদের কতকগুলি বহুব্যবহৃত মনোভাবদ্যোতক অব্যয় ও বাক্যাংশ : (ভয়-যন্ত্রণা-মনঃকষ্টব্যঞ্জক) ওরে বাপ, মইলুম বাবা, মরুনু মাও, আগা বাবা, ওহো ভগবান, হা ভালে তো (হা আমার কপাল); (করুণা-দ্যোতক) এঃ বাপরে বাপ, (বিস্ময়দ্যোতক) আউ আউ, (ঘৃণা বা জুগুপ্সা দ্যোতক) ছিকো ছিকো ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলের মেয়েদেরও কিছু বাচনিক নিষিদ্ধতা (Verbal taboo) আছে। রাত্রে হলুদকে এঁরা নং (< রং) বলেন, দইকে বলেন চুন। আতুঁড় ঘরে আগত স্ত্রী অপদেবতা—প্যাত্তানী (<প্রেতনী), পুরুষ অপদেবতা—দুয়ারী ঠাকুর। আহারের জন্য বয়স্ক পুরুষকে আহ্বান করতে ছলে এঁরা সরাসরি খেতে আসবার কথা বলেন না, বলেন ‘আইস’। এঁদের সংস্কার, সরাসরি ভাত খেতে আসার কথা বললে সকলেই তা বুঝতে পারে এবং প্রেতাত্মারাও হয়ত সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোজনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, এজন্য মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায় ঘরনীর কন্ঠে শুধু ‘আইস’ শুনেই গৃহস্বামী ভোজনের জন্য তৎপর হন। স্বামী বা গুরুজনের নাম এঁরাও মুখে আনেন না। শুধু তাই নয়, ঐ নামের সাদৃশ্য বা সম্মোচ্চার-সম্পন্ন শব্দ পর্যন্ত এঁরা উচ্চারণ করেন না। এক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে একটি ব্যক্তিগত নাম দেওয়া হয়, অথবা প্রকৃত নামের পরিবর্তে নামের প্রতিশব্দ-স্থানীয় কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়। যেমন: স্বামীর নাম যদি কালুয়া বা কালাচাঁদ হয় তবে স্ত্রী তার নামকরণে মইলা বা মইলা চাঁদ ব্যবহার করবে, মইলা অর্থে কালো। গুরুজনের বিকল্প নাম হিসেবে অনেক সময় তেল স্থলে ‘চিকন’, বাটি স্থলে ‘মালাই’, ভাত-স্থলে ‘গরম’, পান্তাভাত স্থলে ‘ভিজা’, বিড়াল স্থলে ‘নাকাড়’ শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়। স্বামীর ক্ষেত্রে সম্বোধনে ‘এই’ ‘গে’ ‘হে’ ব্যবহৃত হয়, ভাসুর অসম্বোধিত, বিশেষ প্রয়োজনে ‘দাদা’। ভাসুরের স্ত্রী সম্বোধনে ‘বাই’ ‘দিদি’, বড় ননদ (সম্বন্ধ—নোনোদী)—দিদি, বাই; বড় ননদের স্বামী (সম্বন্ধ—জেঠ পোইত)—দাদা; শ্বশুর (সম্বন্ধ—সোসুর)—বাহা, বাপু, ঠাকুর (সম্বোধন); শাশুড়ী (সম্বন্ধ—শাশুড়ি)—মা, আই; পিতামহ—ঠাকুরবাবা, মাতামহ—আজু, মাতামহী—আবো।
নারীর ভাষার একটি বিশিষ্ট আশ্রয় শিশুদের ডাকনামগুলি। শৈশবে শিশুরা মেয়েমহলে অর্থাৎ মা-মাসি-দিদিমা-ঠাকুরমার কাছেই বেশি সময় কাটায়; তাই তাদের নামকরণে বিশেষত আটপৌরে ডাকনামগুলিতে মেয়েদেরই কতৃত্ব লক্ষ্য করা যায়। বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পর বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তৎসম শব্দ দিয়ে বালকের নতুন পোশাকি নামকরণ করা হয় বটে, কিন্তু বাড়িতে বা ঘরোয়া পরিবেশে সেই আটপৌরে শৈশবকালীন নামগুলিই ব্যবহৃত হয়। এইসব আটপৌরে নামকরণে মেয়েদের বিচিত্র প্রবণতা, দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কার ও পর্যবেক্ষণশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বাগর্থবিজ্ঞান বা Semantics-এর দিক থেকে নামকরণ তাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরবঙ্গের শিক্ষিত পুরুষ ও নারীর পোশাকি নামের ক্ষেত্রে তৎসম শব্দ প্রচলিত থাকলেও ডাকনামগুলি নিতান্তই দেশজ, তদভব কিংবা ক্বচিৎ অর্ধতৎসম। এই অঞ্চলের মানুষ মুখ্যত কৃষিনির্ভর, তা সত্ত্বেও আধুনিক কলকারখানার যুগে পুরুষের এই কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক সংস্কার যদি কিছু পরিমাণে শিথিল হয়েও থাকে তবু নারী তার রক্ষণশীল স্বভাবের জন্য এই সংস্কার বহুলাংশেই ত্যাগ করতে পারেনি। এই কারণে পুত্র কন্যার নামকরণে কৃষির প্রসঙ্গ নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। কৃষির সঙ্গে ঋতুচক্র, জলবায়ু, ইতর জীবজন্তু ইত্যাদি নানা নৈসর্গিক উপাদান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেজন্য নামকরণে জাতক-জাতিকার জন্মকাল, জন্মবার, জন্মকালীন প্রাকৃতিক পরিস্থিতি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, সন্তানের আকৃতি-প্রকৃতির স্মৃতি রক্ষিত হয়েছে। যেমন, জন্মকাল অনুসারে : দোমাসু [দোমাসী = সংক্রান্তি; সংক্রান্তিতে জাত], পোহাতু (পুং)-পোহাতি (স্ত্রী) [প্রভাতে জাত] দুখুরু-আতিয়া [যথাক্রমে দুপুর (>দুখুর) ও রাত্রে জাত], আন্ধারু-জোনাকু [যথাক্রমে কৃষ্ণ ও শুক্ল পক্ষে জাত], পুনিয়া-আমাশু [যথাক্রমে পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় জাত]; জন্মবার অনুসারে নাম: রবিবার—দেবারু (পুং)-দেবারী (স্ত্রী), সোমবার—সোমারু (পুং)-সোমারী (স্ত্রী), মঙ্গলবার—মোংলা, মংলু (পুং)-মংলী (স্ত্রী), বুধবার—বুধারু, বুধু (পুং)-বুধারী (স্ত্রী), বৃহস্পতিবার—বিশাদু, বিশারু (পুং)-বিশাদী (স্ত্রী), শুক্রবার—শুকুরু (পুং)-শুকুরী (স্ত্রী), শনিবার—শনু (পুং)-শনিয়া (স্ত্রী); জন্মমাস অনুসারে নাম : বৈশাখ—বইশাগু (পুং), জ্যৈষ্ঠ—জেঠিয়া (পুং)-জেটিয়া (স্ত্রী), আষাঢ়—আষারু, শ্রাবণ—শাউনা-শানু, ভাদ্র—ভাদরু (পুং)-ভাদো (স্ত্রী), অগ্রহায়ণ—অঘু-অগনা, পৌষ—পুশু, মাঘ—মাঘু, মাঘো-মাঘেশ্বরী (স্ত্রী), ফাল্গুন—ফাগু (পুং)-ফাগুনী (স্ত্রী), চৈত্র—চৈতা, চৈতু-চৈতেশ্বরী (স্ত্রী)। জন্মকালীন প্রাকৃতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী নাম : ঝড়ু (পুং) [ঝড়ের সময় জন্ম], বানাতু (পুং) [বান বা বন্যার সময় জাত], আকালু (পুং) [আকাল বা দুর্ভিক্ষের সময় জাত], ভুঁইচালু (পুং) [ভুঁইচাল বা ভূমিকম্পের সময় জন্ম]; শিশুর চেহারা-আচরণ ও স্বভাব অনুযায়ী নামকরণ: ঢ্যাপা (পুং)-ঢ্যাপো (স্ত্রী) [হাঁটা চলার সময় যে ধুপধাপ করে আছাড় খায় ও কাঁদে], ধদা (পুং) [নাদুসনুদুস শরীরবিশিষ্ট], সুটকু (পুং)-সুটকী (স্ত্রী) [লিকলিকে রোগা চেহারা], চিমঠু (পুং)-চিমঠি (স্ত্রী) [ঝগড়াটে, হিংসুটে ও খুঁতখুঁতে], গসাই (পুং) [শান্তশিষ্ট], নিসারু (পুং) [(নি-সাড়া) ডাকলে সাড়া শব্দ দেয় না], পেটপেটিয়া (পুং) [শুধু বিড় বিড় করে বকে], ঘুনপেটারী (পুং) [পেটে পেটে দুষ্টু বুদ্ধি যার], ধ্যারধেরিয়া (পুং) [ছিঁচকাঁদুনে, অতি অল্পেই পেটের গোলমালে ভোগে], বাটু, বাংরু (পুং)-বাংরী (স্ত্রী) [বেঁটে], ঢ্যাঙ্গা (পুং)-ঢ্যাঙ্গা (স্ত্রী) [লম্বা], আদরী, আদুরী (স্ত্রী) [আদর বা সোহাগপ্রিয়], গালো (স্ত্রী) [বয়সে ছোটো হলেও প্রতিকথায় যে মেয়ে জবাব দেয়], কেটমী (স্ত্রী) [স্বভাবে ও চেহারায় আধপাগলী ভাব যার], ধরপারু (পুং) [চঞ্চল], কান্দুরা (পুং)-কান্দুরী (স্ত্রী) [রোদনপ্রবণ], ধোউলু, গোরাচান (পুং) [ফর্সা], ইত্যাদি; পশুপাখি-কীটপতঙ্গ-জলচর জীবের নামে নামকরণ : কাউয়া (কাক), খনজোন (খঞ্জনী), পোখি (পাখি), চিলা (চিল, কোচবিহারের এক প্রাচীন রাজপুত্রের ডাকনাম চিলা রায়), ময়না, ব্যাং, চিক্যা (ছুঁচো), সলেয়া (ইঁদুর), চ্যারা (কেঁচো), জোনাকী, ফোরিং গা (ফড়িং), খোলিশা (খলসে মাছ), চেংটিয়া, ছ্যাকা (মাছ), পশুনাথ-পুশু (সিংহ), কাছুয়া (কচ্ছপ), ইত্যাদি। শিশুর আকৃতি-প্রকৃতির কোনো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতর প্রাণীর আকার ও আচরণের আংশিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেই খানিকটা কৌতুকামিশ্রিত বাৎসল্যবোধের প্রেরণাতে নামকর্ত্রী ইতর প্রাণীর নামে শিশু সন্তানের নামকরণ করে থাকেন।
বাংলাদেশের মেয়েলি ভাষার আর একটি বৈশিষ্ট্য কথায় কথায় প্রবাদ-প্রবচন ও ইডিয়মের প্রচুর ব্যবহার। এগুলি অবশ্য পুরুষের ভাষাতেও আছে, কিন্তু নারীর ভাষাতেই এগুলির বাহুল্য এবং এই বাহুল্য থেকে মনে হয় অধিকাংশ ইডিয়ম ও প্রবাদের আদি উৎস নারীর রসনা। ক্রমে এগুলির অমোঘতা অনুভব করে পুরুষেরাও অজ্ঞতসারে এগুলি গ্রহণ করেছেন। তবে আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কথায় কথায় প্রবাদ-প্রবচনের এই বহুল ব্যবহার নারীর ভাষাতেও অপ্রচলিত হয়ে আসছে। এর কারণ সম্ভবত বাগব্যবহারে প্রবাদ-প্রবচনগুলি যে প্রয়োজন সিদ্ধ করে সেপ্রয়োজন এখন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভাষায় প্রবাদের ব্যবহার অনেকটাই আলংকারিক, প্রবাদের প্রয়োগের সঙ্গে প্রতিবস্তূপমা কিংবা দৃষ্টান্ত অলংকারের অনেকটা তুলনা চলতে পারে। তবে কাব্যে ব্যবহৃত অলংকারের সঙ্গে প্রবাদের আলংকারিকতার কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। কাব্যের অলংকার বাক্যে বা বাক্যের অর্থে কিছু বাড়তি সৌন্দর্য যোজনা করে, কিন্তু প্রবাদ অনেকটা মূল বক্তব্যের পরিপূরক বা অনুপূরক হিসাবে কাজ করে। শব্দভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতা, প্রকাশক্ষমতার দৌর্বল্য ইত্যাদি কারণে মেয়েদের বাগব্যবহারে যে অপুষ্টি ও অপূর্ণতা থেকে যায়, এইসব পরিপূরক বা অনুপূরক প্রবাদ প্রবচনের মাধ্যমে মেয়েরা সেই অপূর্ণতা পূরণ করার চেষ্টা করেন। তাঁদের নিজেদের বাক্য একটি বিশেষোক্তি মাত্র, আর ব্যঞ্জনার দিক থেকে প্রবাদ হচ্ছে সামান্যোক্তি। এই সামান্যোক্তির মধ্যে আশ্রয় তথা সমর্থন লাভ করতে পারলে নিজের বক্তব্যের অভ্রান্ততা সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন। আধুনিক কালের শিক্ষাদীক্ষা মেয়েদের প্রকাশক্ষমতাকে নানাভাবে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছে, তাই কথায় কথায় তাঁদের আর প্রবাদের আশ্রয় নিতে হয় না। ইডিয়মের ব্যবহার সম্পর্কেও সেই একই কথা খাটে। তবে ইডিয়ম প্রবাদের মত মূল বাক্যের অনুপূরক আর-একটি স্বতন্ত্র বাক্য নয়, মূল বাক্যেরই একটি গঠনগত উপাদান। কোথাও সেটি একপদবিশিষ্ট ক্রিয়ামূল। কিন্তু অর্থের দিক থেকে বাক্যের সাধারণ পদের সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। ইডিয়মে যেসব বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয় সেগুলির সার্থকতা ব্যচ্যার্থে নয়, ব্যঙ্গ্যার্থে। যে শব্দ সচরাচর একটি বিশেষ অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই শব্দ দিয়ে অন্য অর্থ প্রকাশ করলে ভাষার বৈচিত্র্য বাড়ে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাষার শব্দভান্ডারের দীনতাও আভাসিত হয়। মেয়েদের শব্দভান্ডার সাধারণভাবেই কম সমৃদ্ধ, তাই শব্দের তির্যক ব্যবহার তথা ইডিয়মের উপর মেয়েদেরই ভরসা সবচেয়ে বেশি। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ ও সংক্রামক প্রভাব এখনও ভালোমত পড়েনি, তাই এ অঞ্চলের অনুকার ও দ্বিরুক্ত পদগুলি এ অঞ্চলে প্রায় ইডিয়ম হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। ধাতুর মধ্যে বিশিষ্টার্থক ধাতু হিসাবে এ অঞ্চলে ‘খা’ (খোয়া < খাওয়া) ধাতুর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতুর মতই এর ব্যবহার প্রায় সর্বাত্মক, বিশেষ্য কিংবা ভাববচনের (verbal noun) সহযোগে এই ধাতুটি বিভিন্ন অর্থবোধক ক্রিয়ামূল হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, আগ খোয়া = রাগ করা, হাতাশ বা আটাশ খোয়া = সন্ত্রস্ত হওয়া, ঠ্যালা খোয়া = শাস্তি পাওয়া, যাওয়া খোয়া = যেতে বাধ্য হওয়া (মোর জাওয়া খায়), মনত খোয়া = মনে লাগা, কইন্যা বেচি খোয়া = মেয়ের বিয়ে দেওয়া, দিন বা কাল-বাচক শব্দের সঙ্গে ‘খোয়া’ কোথাও কালের ব্যাপ্তি অর্থে, কোথাও কালের অতিবাহন অর্থে ব্যবহৃত হয় (এই কাম একমাস খাবে = এই কাজে একমাস লাগবে, আর কিছুদিন খাক = আর কিছুদিন যাক), পছন (পছন্দ) খোয়া = কারো পছন্দের আস্পদ হওয়া (মুই কার পছন খাম = কে আমাকে পছন্দ করবে?), ইত্যাদি। অন্যান্য বিশিষ্টার্থক ক্রিয়া-বাক্যাংশ : ভাতার ধরা (পতিত্বে বরণ করা), [কোনো পুরুষের] ভাত খোয়া (স্বামী রূপে স্বীকার করা), [ভাত] পারোস ( < পরি-বিশ) করা = ভাত বেড়ে দেওয়া, টিকা ঘচলানা বা গোয়া ঘসা (বৃথা সময় কাটানো), নাক ডেনডেরা দেওয়া (ভৎর্সনা করা, অপমান করা), কানের পোকা ঝাড়া (সমুচিত দন্ডবিধান করা), বান্নি দিয়া মুখ ঝারা (ঝেঁটিয়ে বিষ ঝাড়া), বুক্কত চড়ি জল্পেশ দেখা (জল্পেশ বা জল্পেশ্বর জলপাইগুড়ি জেলার একটি প্রাচীন শৈব পীঠস্থান, কিন্তু শব্দটির বিচ্ছিন্ন বাচ্যার্থ এখানে অভিপ্রেত নয়, উদ্দিষ্ট সামগ্রিক অর্থ—উচিত শিক্ষা দেওয়া), কাজিয়া করা (ঝগড়া করা), ক্যাচাল করা (গোলমাল করা), আংশাং করা (আপত্তি-জনিত দ্বিধা প্রকাশ করা), হাত ধরা পাঁও ধরা (খাতির করা), দিন গাওয়ানো (দিন কাটানো), ধারত ঠ্যাকা (ঋণগ্রস্ত হওয়া), ভাল পাওয়া (ভালো বাসা, অক সগগায় ভাল পায় = ওকে সকলে ভালো বাসে বা পছন্দ করে), বারা বানা (ধান কোটা), ধান সিজানো (ধান সিদ্ধ করা), ধান বা পাট মারা (উক্ত ফসল কাটা), ঢুরকি মারা (উঁকি মেরে দেখা), কইন্যা ব্যাচা (মেয়ের বিয়ে দেওয়া, কন্যাপক্ষে), কইন্যা জুরা (কনের বিয়ে দেওয়া, বরপক্ষে) ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও কতকগুলি শব্দ বা বাক্যাংশ আছে যেগুলির প্রয়োগ ইডিয়মতুল্য, অর্থাৎ যেগুলির প্রকৃতিগত কোনো অর্থ নেই, শুধু প্রথানুসারে অর্থবদ্ধ, অথবা প্রকৃতিগত অর্থ থাকলেও ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত, কিংবা অনেক অর্থের মধ্যে একটি বিশেষ অর্থে সীমাবদ্ধ, যেমন, নাং (উপপতি), সাঙ্গানী, ঢেমনী (উপপত্নী), ডাউসা (চরিত্রহীন), ধাগিরি, নাংগাহী (চরিত্রহীনা, অসতী), মর্দাহী (পুরুষের মত স্বভাববিশিষ্ট স্ত্রীলোক), মইল্যা (মৃতবৎসা নারী), আটকুরা-আটকুরী (নিংসন্তান পুং ও স্ত্রী), বাঁজি (বন্ধ্যা), টুলসুংপারা, সরগোচালী, বাহোমারী, (পাড়াবেড়ানী, ‘কুনঠে গেইল সেবাহোমারী তোর ছোয়া কান্দেসে’), ঢক (রকম-সকম), হাউস (ইচ্ছা বা আশা), হাতাশ, আটাশ (ত্রাস), মুককাটু (মুখরা), দিনকাটু (অলস), নুটুরি (কাজকর্মে ঢিলে প্রকৃতির), হাউরিয়া (লোভী), বাউদিয়া (যাযাবর, ছন্নছাড়া), কাইদারি, কাইজুরি, নিয়াইচুঙ্গি (কলহপ্রবণ), বইলতাহী (গালাগালির শব্দ, যে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করে), চুলচুলি (যার পেটে কথা থাকে না), ভুলটুঙ্গী (অসতর্ক স্ত্রীলোক), কোটকা, কোটকী (কৃপণ, পুং ও স্ত্রী) হুলকা-হুলকী (মিতব্যয়ী পুং ও স্ত্রী), কুটুনী-কুটনী (< কুট্টনী, এর কথা তাকে লাগায় যে স্ত্রীলোক), ছিদ্দোর, আছিদ্দোর (< ছিত্বর, ধূর্তলোক), ঘরভুন্দরা (ঘরকুনো), মুকভুন্দরা (মুখচোরা), কেলাইদাতী, কোদালকাটী (ঝগড়াটে স্ত্রীলোক), ভাতারছারী-ভাতারধরী (মূলত গালাগালির শব্দ; যে মেয়ে পুনঃ পুনঃ স্বামী পরিবর্তন করে), নিরিখিনী (কনে দেখা), আন্ধন (পাকস্পর্শ), ঢাকন-ভাত (বৌ-ভাত), আওকারী, কুততুরী (বিবাহযোগ্যা মেয়ে), আওপারী (বাগদত্তা; রাব < আও = শব্দ, কথা; কথা পাড়া হয়েছে যে মেয়ের জন্য), নোদারী (নববধূ), বৈরাতী (বিবাহ-অনুষ্ঠানের এয়োস্ত্রী); আরহাতী (হলুদকোটায় আমন্ত্রিত স্ত্রীলোক), ভাকুরের ছুয়া (আদরের দুলাল), বুক্কের পাটা (বুকের পাটা), চুনের খুঁটি (খুঁটি = পাত্র, প্রকৃতঅর্থ ‘বইলতাহী’র অনুরূপ), ত্যালের তাড়ি (তাড়ি = মাটির ভাঁড়, প্রকৃত অর্থ নষ্ট স্ত্রীলোক), হোকোশের ডালি (= শকুনের বাসা, মাথার চুলের দুর্গতি বোঝাতে, তুলনীয় ‘বাবুয়ের বাসা’), খোকরা ভাত (বাসি ভাত), ছাচি ত্যাল; মিঠা ত্যাল (সরষের তেল), নরম ভাতার (গোবেচারা স্বামী), দীঘল বা ঘন পাও (মন্থর গতি), বকন্দা ছোয়া (মোটা ছেলে), বিয়াদারী বেটী, গাবুর বেটী (বিবাহযোগ্যা মেয়ে), বিয়াস্তী মাইয়া, বিহাতী বেটী (বিবাহিতা মেয়ে), ইত্যাদি।
প্রবাদবাক্যগুলির শব্দগত বিশ্লেষণ করে লাভ নেই, কেননা এগুলির আবেদন গোটা বাক্যসংস্থান নিয়ে। বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদের স্বতন্ত্র বাচ্যার্থ অবশ্য আছে, কিন্তু সেই বাচ্যার্থ এখানে অভিপ্রেত নয়, সমস্ত পদের পারস্পরিক অন্বয় মিলিয়ে গোটা বাক্য থেকে যে সামগ্রিক অর্থপরিণাম দেখা যায় সেইটিই প্রবাদের উপজীব্য। প্রবাদ যেহেতু অনেকাংশেই লৌকিক অভিজ্ঞতার সারাৎসার সেজন্য আকারে প্রবাদ খুব একটা বড় হয় না। যে-প্রবাদ যত সংক্ষিপ্ত সেপ্রবাদ তত লোকপ্রিয়। যেসব প্রবাদ একাধিক বাক্য বা খন্ডবাক্যের সমবায়ে গঠিত হয় সেগুলি স্মৃতির সুবিধার্থে সাধারণত ছন্দে গাঁথা থাকে। এই ছন্দ অবশ্যই গ্রাম্য লৌকিক ছন্দ, পর্বের ত্রুটিহীন মাত্রাসাম্যের চেয়ে চরণের অন্ত্যানুপ্রাসের দিকেই তার ঝোঁক বেশি। প্রবাদ আকারে খুব বড় হতে পারে না বলে তাকে নানা দিক থেকে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে হয়; এই প্রত্যক্ষতা আসে প্রধানত শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে। এই কারণে প্রবাদের বিশেষণগুলি খুব ঝাঁঝালো কিংবা জোরালো হয়, ক্রিয়াপদে নামধাতু ও ধ্বন্যাত্মক ধাতুর লক্ষণীয় প্রাধান্য দেখা যায় এবং ক্রিয়াবিশেষণগুলি অনেক ক্ষেত্রে ধ্বন্যাত্মক ও অনুকারধর্মী হয়ে থাকে। এই প্রত্যক্ষতার দাবিতেই প্রবাদের বাচ্যার্থ অনেক সময়েই কিছুটা স্থূল বা অশালীন হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষার একটা বড় পরিচয় নিহিত আছে এ অঞ্চলের মেয়েলি প্রবাদবাক্যগুলিতে। বিশ্লেষণের বিশেষ প্রয়োজন নেই, চলিত বাংলায় প্রবাদগুলির রূপান্তর করে দিলে ‘সহৃদয়’ পাঠক সহজেই এঁদের রসবোধ, কৌতুক-প্রবণতা, পরিহাসপটুতা, সামাজিক নিরীক্ষণভঙ্গি এবং সর্বোপরি এঁদের বাচনভঙ্গির একটা সংহত পরিচয় পাবেন।
প্রথমে কিছু সংক্ষিপ্ত প্রবাদবাক্য :
১. হদ্দ্যাক বহু ঘড়া—দিদ্দিরায় বাহিরে।
হদ্দ্যাক (হ + দ্যাখ) = ঐ দ্যাখ, ঘড়া = ঘোড়া, দিদ্দিরায় = ঘোড়ার মত মাটিতে শব্দ তুলে চলছে। যে- সব বৌয়ের ঘরের কাজে মন বসে না, সুযোগ পেলেই ঘরের বাইরে এসে ছুটে দাঁড়াতে চায় তাদের লক্ষ্য করে বাড়ির শাশুড়ী, ননদ বা বর্ষীয়সী মহিলারা এটি প্রয়োগ করেন।
২. লাটাই গুণে ফেটি, মাও গুণে বেটী। লাটাই = চরকা বা তকলি, ফেটি = সুতোর গাছি।
চরকার গুণে সুতো ভালো হয়, আর মায়ের গুণে মেয়ে ভালো হয়।
৩. হাড়িক না দেখাই বাড়ি, গুণ্ডীক না দেখাই খাঁড়ি। হাড়ি = হাড়ি সম্প্রদায় (এখানে বিত্তহীন ব্যক্তি), গুণ্ডী = ধীবর, খাঁড়ি = নদীর মৎস্যস্থল নালা। না দেখাই = দেখাতে নেই (দেখাই < দেখাইএ, মূলত কর্মবাচ্যে প্রযুক্ত, তবে এখানে কতৃবাচ্যের সঙ্গে একীভূত)। বিত্তহীনকে বিত্তবানের বাড়ি দেখাতে নেই, ধীবরকে দেখাতে নেই মৎস্যবহুল জলাশয়।
৪. গোয়া না হয় যদ্দুর ঠ্যাং ম্যালে তদ্দুর। অক্ষম ব্যক্তির সাধ্যাতীত কিছু করার চেষ্টা।
৫. সুকটি না ছাড়ে গং (গন), হলদী না ছাড়ে অং। শুটকী মাছের গন্ধ ছাড়ে না, হলুদের রং ছাড়ে না।
৬. ভাং ভাজিবার খোলা নাই আখা ছয় বুড়ি।
ভাং = ভাং পাতা (মাদক দ্রব্য), খোলা = মাটির পাত্র, আখা = উনুন, বুড়ি = সংখ্যাবিশেষ।
৭. ঘরে নাই ভিজা ভাং কাড়া বাজায় ঠাং ঠাং। কাড়া = কড়া ৬-৭ সংখ্যক প্রবাদের অর্থ অন্তঃসারশূন্য বাহ্যাড়ম্বর।
৮. ওদোলের বোদোল, শুকটা দিলে শিদোল। যেমন কর্ম তেমনি ফল
৯. কিরপিনের দুনা ব্যয় পনথা ভাতত নবনের খয়। পনথা ভাত = পানতা ভাত
কৃপণের দ্বিগুণ ব্যয়, ভাতের খরচ বাঁচাতে গিয়ে পানতা ভাতে লবণের ব্যয় বাড়ে।
১০. কিষৎ কি কাম করিল জোঁয়াই-ভাতারী হইল। জোঁয়াই-ভাতারী = যে স্ত্রীলোক জামাইকে স্বামী করেছে।
চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতার ক্ষেত্রে তিরস্কার হিসাবে ব্যবহৃত।
১১. গাঁও নষ্ট করে কানা পখোর নষ্ট করে পানা। কানা = অন্ধ, পখোর = পুকুর, পানা = কচুরিপানা, শেওলা।
গাঁয়ে কানা থাকলে গাঁয়ের বদনাম, পুকুরে পানা থাকলে পুকুরের ক্ষতি।
১২. ভাগ্যে বাড়ী, ভাগ্যে দাড়ী, ভাগ্যে মিলে নারী। সদবংশে সবারই জন্ম হয় না, সব পুরুষেরই দাড়ি হয় না, এবং সতী সাধ্বী স্ত্রীলাভ—তাও ভাগ্যের ব্যাপার।
১৩. ইয়্যার ঠেসসা উয়ার ঠেসসি, তাতকে যাছে কামের কিসসি তুলনীয় : ভাগের মা গঙ্গা পায় না।
১৪. কলাই মোদ্দে মুসুরী সাগাই মোদ্দে শাশুরী। ডালের মধ্যে মসুরী ও আত্মীয়ের মধ্যে শাশুড়ীই শ্রেষ্ঠ।
১৫. ঘড়া চিনা যায় ময়দানত, কুটুম চিনা যায় নিদানত। ঘড়া = ঘোড়া, নিদানত = দুঃসময়ে।
১৬. হাল নাই তে বাহে বড়, মাউক নাই তে মারে বড়
হাল না থাকলে হালের বড়াই, বউ না থাকলে পত্নীশাসনের বড়াই।
অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ প্রবাদ :
১৭. অকৎ সকৎ ঘকৎ—এই তিনটা দিবা পারিলে মোগি থাকে ঠিকৎ।। অকৎ = খাওয়া, সকৎ = শখের জিনিস, ঘকৎ = প্রেম-ভালোবাসা, মোগি = বউ, ঠিকৎ = ঠিক, তুষ্ট।
১৮. বেছুয়ার ভাতার মরদ, মরদের ভাতার কড়ি। কুঠি যাবে তমার দড়ি আর বিড়ি।।
বেছুয়া = নারী, কড়ি = টাকাপয়সা, কুঠি = কোথায়, দড়ি আর বিড়ি = (ইডিয়ম) সাংসারিক সংস্থান।
নারীর ভরসা পুরুষ, পুরুষের ভরসা টাকাপয়সা, টাকাপয়সা থাকলে সংসারে টানাটানি থাকে না।
১৯. মাউগের অধীন, ছোয়ার নেতর। তায় নি বসিবা পারে সভার ভিতর।।
নেতর (স্নেহ > নেহ + তর) = ছেলে মেয়েকে যে প্রশ্রয় দেয়। নি বসিবা পারে = বসতে পারে না।
স্ত্রীর কথায় যার ওঠাবসা এবং ছেলেমেয়েকে যে প্রশ্রয় দেয়, দশজনের সভায় সেঅপাঙক্তেয়।
২০. পরের ধানে বঝাই হয় না নিজের গলা। আর পরের ছুয়ায় বঝাই হয় না নিজের কলা।।
বঝাই = বোঝাই, গলা = (ধানের) গোলা, ছুয়ায় = ছেলে দিয়ে, কলা = কোল।
২১. আটে দশে লাঙ্গলত খিল। দুইহে চাইরহে মাউগক কিল।।
খিল = লাঙ্গলে ব্যবহৃত বাঁশের পেরেক। দুইহে চাইরহে = দুই চার দিন পরপর।
আট দশ দিন পর পর লাঙ্গলে খিল দিতে হয়, আর দু চার দিন পর পর বউকে শাসন করতে হয়।
২২. এগিনা নষ্ট করে ছিমছাম পানি। ঘর নষ্ট করে কান-ভানজানি।।
এগিনা = আঙ্গিনা, ছিমছাম = গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ঘর = সংসার, কানভানজানি = কানভাঙ্গানি।
২৩. অকম্মা ভাতার সেজার দোসর। সেজাত করে খোসর খোসর।।
অকম্মা = অকর্মণ্য, অলস; সেজার দোসর = শয্যার সঙ্গী, শয়নপ্রিয়; খোসর খোসর করে = এপাশ ওপাশ করে। স্বামীর অকর্মণ্যতা সম্পর্কে ক্ষুব্ধ স্ত্রীর উক্তি।
২৪. চোপোর দিন গেল অ্যালোরে ম্যালোরে জোনাকে শুকাছে ধান।
আনগে বেটী ছাম গাইন-লা তোর বাপে কুটুক ধান।।
চোপোর = চৌপহর অর্থাৎ সমস্ত দিনমান, অ্যালোরে ম্যালোরে = (ক্রিয়া বিশেষণ) বৃথা, জোনাকে = জ্যোৎস্নায়, ছাম গাইন = ধান কুটবার উদখল। তুলনীয় :
‘দিন গেল আলে ডালে, ধান শুকাবে জোনার আলে’
[প্রবাদ-সংগ্রহ ৪১১৩, বাংলা প্রবাদ—ডঃ সুশীলকুমার দে]
২৫. খরতর নারী ঝর ঝর ঝারি চোর নফর পর পর ঘর। তাক হাতি দূরত সর।।
খরতর = মুখরা, ঝর ঝর ঝারি = ছিদ্রবহুল জলপাত্র, পর পর = পড়ো পড়ো, তাকহাতি = তার থেকে।
২৬. দেখিলার বান্দিক আনি আদেখিলার গীততানিকও না আনি।
দই কিনি তার মাঝোত খাল, কইনা আনি যার মাওটা ভাল।।
দেখিলা = দেখা, জানাশোনা, আদেখিলা = অপরিচিত, গীততানিক = (< গৃহস্থানী), কুলবধূকে; কইনা = কনে, মাও = মা। জানাশোনা ঘর থেকে দাসীও আনা যায়, কিন্তু অজানা পরিবারের মেয়েকে ঘরে ঠাঁই দেওয়া যায় না।
দই কিনতে তার মাঝখানটা দেখতে হয়, আর কনে আনতে দেখতে হয় তার মায়ের স্বভাব কেমন।
২৭. আশমানের হচে গতিক খারাপ দুহে চারে হচে দুন।
সংসারের গতিক দেখিলে মাথাত ধরে ধুন।।
আশমান = আকাশ, হচে = হচ্ছে, গতিক = অবস্থা, দুয়ে-চারে = দুচার দিন পর পর, দুন = ঝড়, মাথাত = মাথায়, ধরে ধুন = মাথা ঘুরে যায়। সাংসারিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা লক্ষ্য করে কৃষক-পত্নীর খেদোক্তি। মর্মার্থ: বিপদ কখনো একলা আসে না।
২৮. বিশ বচ্ছরে গুণবিদ্যা চল্লিশে হচে ধন। পঞ্চাশ-ষাইট বচ্ছর হইলে
আগুরিবা হবে বাড়ির কন।। গুণবিদ্যা = আভিচারিক বিদ্যা, এখানে যাবতীয় বিদ্যা, আগুবিরা = আগলাতে, কন = কোণ। বিশ বছর পর্যন্ত বিদ্যা অর্জন করতে হয়, চল্লিশ বছর পর্যন্ত অর্থ, এর পর পঞ্চাশ-ষাটের কোঠায় পৌঁছলে মানুষের স্বাধীনতা থাকে না, সব ব্যাপারেই পরনির্ভর হয়ে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতে হয়।
২৯. সৎমাওর কি কোহি গুণ। কানচায় খুলির বথুয়া শাক তাত না দেয় নুন।।
কানচায় খুলির বথুয়া শাক = জঞ্জালের মধ্যে অযত্নে জাত বেথুয়ার শাক।
সৎমার গুণ আর কি বলব? আস্তাঁকুড়ে যে শাক গজায় তাই সিদ্ধ করে খেতে দেয়, তাতেও আবার নুন দেয় না। বিমাতার হৃদয়হীনতা প্রসঙ্গে একটি সামান্যোক্তি।
৩০. মাউক বড় সনা রে ভাই, মাউস বড় সনা। মাউগক কিছু না দিবা পারিলে
মাউক হই যাবে বেনা।।
মাউক বড় ধন রে ভাই, মাউক বড় ধন। মাউগের কথা না ধরিলে আউলাই যাবে মন।।
মাউক = স্ত্রী, সনা = সোনা, না দিবা পারিলে = দিতে না পারলে, হই যাবে বেনা = বীণা হয়ে যাবে, অর্থাৎ বীণার মত সব সময় ঘ্যান ঘ্যান করবে, আউলাই যাবে মন = মন ভেঙে যাবে, বেজার হবে। স্ত্রৈণ ব্যক্তির প্রতি মেয়েদের বক্রোক্তি।
এইসব প্রবাদ-প্রবচন ছাড়াও বিভিন্ন ধাঁধা, ছড়া ও গানে উত্তরবঙ্গের মেয়েদের রসনার রস তথা বাক-সৌন্দর্য সঞ্চিত আছে। এই বিচিত্র বাকসিদ্ধি মেয়েদেরই প্রায় একচেটিয়া, কোথাও কোথাও তা অবশ্য পুরষের উক্তিতে সংক্রামিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষার এই রসগত সৌন্দর্য বিশদ বিশ্লেষণ ও পৃথক মনোযোগের অপেক্ষা রাখে।
__________________________________________________
প্রাসঙ্গিক টীকা
১. পুরুষাণামনীচানাং সংস্কৃতং স্যাং কৃতাত্মনাম।
শৌরসেনী প্রযোক্তব্যা তাদৃশীনাঞ্চ যোষিতাম।।
আসামেব তু গাথাসু মহারাষ্ট্রীং প্রযোজয়েৎ।
অত্রোক্তা মাগধী ভাষা রাজান্তঃপুরচারিণাম।।…
সংস্কৃতং প্রযোক্তব্যং লিঙ্গিনীষূত্তমাসু চ।
দেবীমন্ত্রিসুতাবেশ্যাস্বপি কৈশ্চিত্তথোদিতম।।
যদ্দেশ্যং নীচপাত্রন্তু তদ্দেশ্যং তস্য ভাষিতম।
কার্যতশ্চোত্তমাদীনাং কার্যো ভাষাবির্পযয়ঃ।।
যোষিৎ সখীবালবেশ্যাকিতবাপ্সরসাং তথা।
বৈদগ্ধ্যার্থং প্রদাতব্যং সংস্কৃতং চান্তরান্তরা।।
—সাহিত্যদর্পণ, ২য় ভাগ ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ
২. ‘‘…Cicero in an often-quoted passage says that when he hears his mother-in-law Laelia, it is to him as if he heard Plautus or Naevius, for it is more natural for women to keep the old language uncorrupted, as they do not hear many people’s way of speaking and thus retain what they have first learnt (De oratore, III 45)’’.?62—Language : Its Nature, Development and Origin, chapter XIII, 12th impression, p. 242.
৩. ‘‘In learned terminology we may say that men say that men are fond of hypotaxis and women of parataxis’’ Language : Its Nature, Development and Origin p. 251.
৪. ‘On the Philology of the Bengali Language’ : Saroda Charan Mitra. The Mookerjee’s Magazine, November, 1872 (New Series, Part I), p. 274-284.
৫. এই দুটি রচনা মিলিয়ে ডক্টর সেন একটি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন : Women’s Dialect in Bengali, জিজ্ঞাসা, কলকাতা।
৬. এই নিবন্ধে উত্তরবঙ্গে অভিবাসিত উত্তরবঙ্গীয় বাবু-বাংলাভাষী মেয়েদের ধরা হয় নি; যাঁরা কয়েক শতাব্দী ধরে উত্তরবঙ্গে বাস করে আসছেন, সেই কামরূপীভাষী বাঙালি মেয়েরাই এই নিবন্ধের মাধ্যমে সমীক্ষিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে রাজবংশী ও পলিয়া সম্প্রদায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই এঁদের সামাজিক কাঠামোই এই নিবন্ধের পটভূমি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তবে এই নিবন্ধে যেসব শব্দ, শব্দগুচ্ছ, বাক্যাংশ ও প্রবাদ উদাহৃত হয়েছে, তার অনেকাংশই রাজবংশী-পলিয়া ছাড়াও উত্তরবঙ্গের কামরূপীভাষী অন্য সম্প্রদায়ের মেয়েরাও ব্যবহার করেন। এটা হয়ত প্রতিবেশগত সংক্রমণের ফল।
আকরপঞ্জি
এই নিবন্ধ অংশত ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং অংশত ক্ষেত্রসমীক্ষার উপর নির্ভর করে রচিত ; তথাপি কতকগুলি বই এই নিবন্ধরচনায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছে:
১. The Rajbanshis of North Bengal—Dr. Charuchandra Sanyal, Asiatic Society of Bengal, Calcutta, 1965.
২. Language : Its Nature, Development and Origin—Otto Jespersen, 12th Impression, London.
৩. বিচিত্র সাহিত্য (২য় খন্ড)—সুকুমার সেন, কলকাতা, ১৯৫৬।
৪. রাজবংশী অভিধান—কলীন্দ্রনাথ বর্মন, শিলিগুড়ি, ১৩৭৭।