বাংলা উপভাষা ও রবীন্দ্রনাথ
উপভাষাচর্চার শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে জার্মানিতে। জার্মান ভাষাতাত্ত্বিকেরা এই শতকের প্রথম দিকে তুলনামূলক ব্যাকরণচর্চা করে পরে শুরু করলেন ঐতিহাসিক ব্যাকরণচর্চা। এই সময়ে ইউরোপের চিন্তাজগতে ডারউইনের বিবর্তন বাদের খুব প্রভাব। এই প্রভাব ভাষাতত্ত্বচর্চার এলাকাতেও দেখা দিল। জৈব বিবর্তনের সূত্র অনুসরণ করে ভাষাতাত্ত্বিকেরা এক একটি ভাষা ধরে তার বিবর্তন বা ইতিহাস সন্ধান করতে লাগলেন। তাঁদের গবেষণার মূল অবলম্বন ছিল সংশ্লিষ্ট ভাষার লিখিত প্রাচীন সাহিত্য। কিন্তু ভাষার বিবর্তনের পর্যায় নির্ধারণ করতে গিয়ে তাঁরা অনেক সময় লক্ষ করলেন ভাষার বিবর্তনের সব ধাপ লিখিত সাহিত্যের ভাষারূপের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। ডারউইনের বিবর্তনবাদের ‘মিসিং লিংক’-এর ধারণা অনুসরণ করে তাঁরা ভাষার বিবর্তনেও এমন কিছু ‘মিসিং লিংক’ বা হারিয়ে-যাওয়া যোগসূত্রের সন্ধান পেলেন যা লিখিত ভাষায় দুর্লভ, কিন্তু লিখিত সাহিত্যের বাইরে প্রচলিত কথ্য ভাষায় যার অস্তিত্ব সংরক্ষিত। এইভাবে ভাষার কথ্য রূপ বা আঞ্চলিক উপভাষা ভাষাতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। শুরু হল উপভাষা সমীক্ষা বা dialect studies, তৈরি হতে লাগল একাধিক উপভাষা সমিতি বা dialect society। উপভাষাচর্চা এইভাবে সারা জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ল, ক্রমে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এর বিস্তার ঘটল। সেই সূত্রে পৃথিবীর অন্য যেসব দেশে ইউরোপীয় উপনিবেশ ছিল সেইসব দেশেও উপভাষাচর্চা শুরু হল। এই সূত্রে ব্রিটিশ ভারতেও উপভাষাচর্চার ঢেউ এসে লাগল।
প্রথম দিকে ভারতের ঔপনিবেশিক রাজশক্তির প্রতিনিধিরাই উপভাষাচর্চায় অল্পবিস্তর মন দিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে সরকারি উদ্যোগে জনগণনার প্রতিবেদন ও জেলা গেজেটিয়ার প্রকাশিত হতে থাকে, সেখানে কোথাও কোথাও অঞ্চলবিশেষের কথ্য ভাষার নমুনাও প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে উনিশ শতকের শেষ দিকে আর একটি ঘটনায় ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও আঞ্চলিক উপভাষার পরিচয় সংগ্রহের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনায় International Congress of the Orientalists-এর যে সপ্তম অধিবেশন হয় সেখানে Johann Georg Buhler ভারতীয় ভাষাগুলির সমীক্ষার প্রস্তাব করে এ বিষয়ে ভারত সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ম্যাক্সমুলার, কাউয়েল, হর্নলে, মনিয়ের উইলিয়মস প্রমুখ বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ্যাবিদ পন্ডিতেরা প্রস্তাবটি সমর্থন করেন এবং জর্জ এব্রাহাম গ্রিয়ার্সন এই সম্মেলনে উপস্থিত থেকে প্রস্তাবিত এই সমীক্ষার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার প্রস্তাবটি অনুমোদন করে সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৯৮ সালে গ্রিয়ার্সন সমীক্ষার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে সারা ভারতে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যসংগ্রাহক (informant)-দের সাহায্যে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা চালান। তারপর পঁচিশ বছর ধরে তিনি সমীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে The Linguistic Survey of India নামে কয়েক খন্ডে প্রকাশ করেন। গ্রিয়ার্সন ব্যক্তিগতভাবে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাই বিশাল সর্বভারতীয় সমীক্ষার মধ্যেও বাংলা ভাষার নানা কথ্য রূপভেদের আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত Survey-র পঞ্চম খন্ডের প্রথম ভাগে বাংলা উপভাষাগুলির প্রসঙ্গ বিস্তৃতভাবে উত্থাপিত হয়েছে। সমীক্ষার সূচনায় গ্রিয়ার্সন বাংলা ভাষার ব্যাকরণের একটা কাঠামো ছক কেটে দেখিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘This dialect is not explained in the usual grammars, and at present can only be learned by actual contact with the speakers’ (p.17)। লিখিত ভাষার বদলে লোকমুখে প্রচলিত কথ্যভাষার উপর একান্তভাবে নির্ভর করায় গ্রিয়ার্সনের এই উপভাষা-সমীক্ষায় প্রত্যক্ষতার স্পর্শ পাওয়া যায়।
তবে গ্রিয়ার্সনের সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলেও একেবারে ত্রুটিমুক্ত ছিল না। প্রথমত, গ্রিয়ার্সনের আলোচনায় বাংলা উপভাষাগুলির বৈজ্ঞানিক বর্গীকরণের অভাব। কোন কোন উপভাষা কী কী কারণে একটি বিশেষ বর্গের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এবং অন্য উপভাষাগুলি কী কারণে ও কীভাবে অন্যান্য বর্গে বিন্যস্ত হতে পারে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাবে সমীক্ষাগুলি একটু অগোছালো হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীকালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিকেরা এই বর্গীকরণের কাজটি অনেকখানি সুবিন্যস্ত করেছেন। দ্বিতীয়ত, গ্রিয়ার্সন যদিও সমীক্ষার ব্যাপারে ‘actual contact with the speakers’-এর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, তবু অনেক ক্ষেত্রেই এই ‘actual contact’ ঘটেছে স্থানীয় তথ্যসংগ্রাহক বা informant-দের মাধ্যমে। এই informant-দের তেমন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছিল না, ফলে তাদের সরবরাহ করা অনেক তথ্য সমীক্ষার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে সত্য নির্ণয়েও বিচ্যুতি ঘটেছে। যেমন, উত্তরবঙ্গের কথ্য বাংলাকে তিনি দুটি ভাগে ভাগ করেছেন (১) রাজবংশী বা রংপুরী : গোয়ালপাড়া, রংপুর, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার কথ্য বাংলা; (২) ‘Northern Bengali’: দিনাজপুর, পুর্নিয়া ও মালদহের কথ্য বাংলা। এখানে পরিষ্কার নয় রাজবংশী/রংপুরীকে ‘Northern Bengali’—এই ব্যাপক অভিধার মধ্যে ধরার অসুবিধা কোথায়। আবার কয়েকটি জেলার কথ্য ভাষাকে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী বা একটি বিশেষ জেলার নামে চিহ্নিত করার যুক্তি কী তাও অপরিষ্কার। কারণ, উত্তরবঙ্গ বা আসামের ওইসব এলাকায় বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষজন ছাড়া অন্যরাও ওই বাংলায় কথা বলেন। সুতরাং বিশেষ জনগোষ্ঠী বিশেষ জেলার নামে ওই বাংলার নামকরণ করার যুক্তি কী তা-ও পরিষ্কার নয়। এছাড়া, গ্রিয়ার্সন ‘রাজবংশী’ উপভাষা সম্পর্কে বলেছেন ‘It has one sub-dialect, called Bahe, spoken in the Darjeeling-Tarai’ (p.18)। এখানে ‘রাজবংশী’ উপভাষার বিভাষাটির এলাকা আলাদাভাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় মনে হয় তিনি ‘বাহে’ নামক কোনো বাচকগোষ্ঠীর নামে বিভাষার নামকরণ করেছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্লিখিত এলাকাতে তো বটেই, উত্তরবঙ্গের বাইরে থেকে আসা মানুষজন অনেক সময় উপহাসছলে উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী পুরোনো বাসিন্দাদের ওই নামে অভিহিত করত। গ্রিয়ার্সনের তথ্যদাতা (informant) ‘বাবু প্রসন্নচন্দ্র দত্ত’ এই ধরনেরই বহিরাগত মানুষ। ফলে স্থানীয় মানুষজনের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতা গ্রিয়ার্সনের বিশ্লেষণে সংক্রামিত হয়েছে। এই সংক্রমণ আপাতত নিরীহ হলেও উত্তরবঙ্গের জনজীবনে তা বিভিন্ন সময়ে অমূলক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং শেষ পর্যন্ত বিশ শতকের শেষ দশকে তার ফলে একাধিক রাজনৈতিক নরহত্যাও ঘটেছে। এর পেছনে যে সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সক্রিয় সেই শক্তি উত্তবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করার জন্য গ্রিয়ার্সনের ভুলগুলিকেই মূলধন করেছে।১ এটাই হল গ্রিয়ার্সনের উপভাষা-সমীক্ষার ক্ষতিকর দিকের একটা উদাহরণ।
তবে গ্রিয়ার্সনের সমীক্ষাকে কাজে লাগিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা শুধু একালে অর্থাৎ আমাদের সমসাময়িক কালেই ঘটেনি। গ্রিয়ার্সনের সমীক্ষাপত্র প্রকাশের (১৯০৩) প্রায় সমকালেই ব্রিটিশ রাজশক্তি এই অপচেষ্টা করেছিল। ওই সময় অবিভক্ত বাংলার সমস্ত এলাকা জুড়ে ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল। ব্রিটিশ প্রশাসন গ্রিয়ার্সনের সমীক্ষাপত্রে চোখ রেখে বুঝল বাঙালিরা ইংরেজকে তাড়াবার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করলেও তাদের মাতৃভাষার মধ্যে অনেক ভৌগোলিক ব্যবধান আছে। এই ব্যবধান সত্ত্বেও তাদের ভাবপ্রকাশের মধ্যে কোনো বাধা পড়ে না, তার কারণ তাদের শিক্ষা ও সাহিত্যের ভাষা একটি সর্বজনমান্য লেখ্য ভাষা, যার নাম সাধুভাষা। এই মান্য লেখ্য ভাষার জন্যই তাদের কথ্য ভাষায় অনেক পার্থক্য থাকলেও তাদের লিখিত ভাববিনিময়ে কোনো ঐক্যের অভাব হয় না। এই ঐক্যের অভাব ঘটবে যদি ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে ভাষার ঐক্যবদ্ধ মান্যরূপকে কোনোভাবে বিসর্জন দেওয়া যায়। এইজন্য ইংরেজ সরকার ঠিক করল শিক্ষার নিম্নতম স্তরে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠ্যবই মান্য ভাষায় লেখা হবে না, লেখা হবে বাংলার বিভিন্ন এলাকার কথ্য উপভাষায়। পাঠ্য বইয়ের ভাষা সংস্কারের অজুহাত হিসাবে বলা হল, সাধুভাষায় লেখা পাঠ্যবইয়ের ভাষারীতিতে গুরুগম্ভীর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব খুব বেশি, সেজন্য তা পল্লিবাসী কৃষকসন্তানদের কাছে দুর্বোধ্য। চারজন ইংরেজ রাজপুরুষ ও রাজভক্ত বাঙালি আই সি এস কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তকে নিয়ে গঠিত একটি কমিটি সুপারিশ করল যে, পাঠ্য বই সহজবোধ্য করার জন্য প্রথমে পাঠ্য বইয়ের একটি আদর্শ ইংরেজি সংস্করণ তৈরি করে পরে বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় এবং বাংলার উত্তর-পূর্ব-মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলের চারটি কথ্য উপভাষায় সেগুলির তর্জমা করতে হবে। এই সংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শিক্ষিত মহলে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হল। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ ‘The Bengalee’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে একে ‘Partition Movement in Another Form’ বলে চিহ্নিত করা হল। বাংলাভাষী সমাজে অনৈক্যসৃষ্টিকারী এই সুপারিশের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের একাধিক সভায় বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা হয় এবং ২১ ফাল্গুন, ১৩১১ বঙ্গাব্দে (5 March, 1904) গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যে পরিষদের দশম মাসিক অধিবেশনে স্থির হয় ‘‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে কোন প্রকাশ্য স্থলে সাধারণকে আহ্বান করিয়া এতৎসম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠের জন্য আহ্বান করা হইবে।’’
ঔপনিবেশিক রাজশক্তি যে প্রশাসনের সংকীর্ণ স্বার্থে ভাষাকেও কাজে লাগাতে পারে সেসম্পর্কে কয়েক বছর আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ সচেতন ছিলেন। ১৩০৫ সালে শ্রাবণ সংখ্যার [August 1898] ‘ভারতী’ পত্রিকার ‘ভাষাবিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যক্রমে ভেদনীতি ইংরেজের রাজকৌশল। সেই নীতি অবলম্বন করিয়া তাঁহারা আমাদের ভাষার ব্যবধানকে পূর্বাপেক্ষা স্থায়ী ও দৃঢ় করিবার চেষ্টায় আছেন।’’ তবে এই প্রবন্ধে আসাম ও উড়িষ্যার ভাষাকে বাংলার উপভাষা বলে চিহ্নিত করে অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তিনি কিছুটা বিচার-বিভ্রান্তির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর এই বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। তাই এর কয়েক বছর পর প্রাথমিক শিক্ষায় কথ্য উপভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার জন্য তিনি যখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আমন্ত্রণ পান, তখন তিনি সাগ্রহে সম্মতি জানিয়ে পরিষদের সহ-সম্পাদক ব্যোমকেশ মুস্তাফীকে লিখেছিলেন (6 March, 1904) : ‘‘মিনার্ভার চেয়ে কার্জনে বেশি জায়গা আছে। আমার প্রবন্ধটির নাম ‘‘সফলতার সদুপায়’’। …ভিড় সামলাইবার সুব্যবস্থা করিয়ো।’’ চিঠির ভাষাতে বোঝা যায় উপভাষা নিয়ে ঔপনিবেশিক রাজশক্তির ষড়যন্ত্রকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি কতটা উৎসুক হয়েছিলেন। সভা ১১ মার্চ, ১৯০৪ তারিখে কার্জন পার্কের বদলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সভাপতিত্বে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে (এখন স্কটিশ চার্চ কলেজ) অনুষ্ঠিত হয়।২ সভায় উপভাষার প্রশ্নে রাজশক্তির চক্রান্তের স্বরূপ উদঘাটন করে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘‘চারিজন ইংরেজ ও তাঁহাদের অনুগত একজন বাঙালী বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রণালীর ভিত্তিপত্তনে ভাষাবিচ্ছেদ ঘটানোটাকে ‘matter of great importance’ গুরুতর প্রয়োজনীয় ব্যাপার বলিয়া মনে করেন। …কমিটি বলিতেছেন, ‘ইহাতে চাষীদের উপকার হইবে’।’’ যুক্তি দিয়ে কমিটির এই বক্তব্যের অসারতা ও অসাধুতা দেখিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘‘ইংরেজদের দেশেও চাষা যথেষ্ট আছে এবং সেখানে যে ভাষায় পাঠ্যগ্রন্থ লেখা হয়, তাহা সকল চাষার মধ্যে প্রচলিত নহে। …ল্যাঙ্কাশিয়রের উপভাষায় ল্যাঙ্কাশিয়রের চাষীদের বিশেষ উপকারের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন হইতেছে না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ইংলন্ডে চাষীদের শিক্ষা সুগম করা যদিও নিশ্চয়ই matter of great importance, তথাপি ইংলণ্ডের সর্বত্র ইংরেজি ভাষার ঐক্য রক্ষা করা matter of great importance, ….জনসাধারণের শিক্ষার উপসর্গ লইয়াই হৌক বা যে উপলক্ষ্যেই হৌক, দেশের উপভাষার অনৈক্যকে প্রণালীবদ্ধভাবে ক্রমশ পাকা করিয়া তুলিলে তাহাতে যে দেশের সাধারণ মঙ্গলের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, তাহা নিশ্চয়ই আমাদের পাশ্চাত্য কতৃপক্ষেরা, এমনকী, তাঁহাদের বিশ্বস্ত বাঙালী সদস্য, আমাদের চেয়ে বরঞ্চ ভালোই বোঝেন।’’
জনমতের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক কমিটির সুপারিশ কার্যকর করেনি। তবে এই উপলক্ষ্যে রবীবন্দ্রনাথ আরও যেসব প্রবন্ধ লেখেন তাতে সমাজে উপভাষার অবস্থান ও প্রচলন সম্পর্কে তাঁর ধারণার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায়, তিনি আঞ্চলিক উপভাষার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনে একটি সর্বজনমান্য উপভাষার প্রচলনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন। ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধ রচনার পর ‘ভান্ডার’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (April, 1905) প্রকাশিত ‘প্রাইমারী শিক্ষা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন : ‘‘যে চাষা তাহার ছেলেকে প্রাইমারী স্কুলে পাঠায় তাহার একটিমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, তাহার ছেলে যেন নিতান্ত চাষা না থাকিয়া কিঞ্চিৎ পরিমাণে ভদ্র সামাজঘেঁষা হইবার যোগ্য হইতে পারে। চিঠিটা পত্রটা লিখিতে পারে পড়িতেও পারে, গ্রামের মোড়লি করিবার যোগ্য হয়, ভদ্রলোকের মুখে শুনিতে পায় যে, ‘‘তাই তো রে, তোর ছেলেটা তো বলিতে কহিতে বেশ।’’ অর্থাৎ সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য আঞ্চলিক উপভাষার সঙ্গে মান্য উপভাষার শিক্ষাও দরকার। আঞ্চলিক উপভাষার সঙ্গে মান্য উপভাষার ব্যবহারকে তিনি আঞ্চলিক উপভাষার ওপর মান্য উপভাষার ‘জোরজবরদস্তি’ বা hegemony বলতে চাননি। তিনি একে হিতকর সামাজিক ‘বাধ্যতা’, ‘স্বভাবের নিয়ম’ বা ‘ভাষার লোকাচার’ বলে অভিহিত করেছেন এবং উদাহরণ দিয়ে বলেছেন ‘নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার কাব্যে চট্টগ্রামের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার না করিয়া নবদ্বীপের প্রাদেশিক প্রয়োগ ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার বিপরীত করিবার স্বাধীনতা তাঁহার ছিল; কিন্তু নিশ্চয় কাব্যের ক্ষতি আশঙ্কা করিয়া সেই স্বাধীনতাসুখ ভোগ করিতে ইচ্ছা করেন নাই।’ (দ্রষ্টব্য ‘শব্দতত্ত্ব’ : বিবিধ)।
তবে বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজনের দিক থেকে আঞ্চলিক উপভাষার চেয়ে বিশেষ আঞ্চলিক উপভাষা-নির্ভর মান্য উপভাষার আপেক্ষিক গুরুত্বের কথা ঘোষণা করলেও রবীন্দ্রনাথ ভাষার বিকাশে ও ভাষাসংক্রান্ত অধ্যয়নে আঞ্চলিক উপভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করেননি, বরং এর প্রয়োজনীয়তার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। উপভাষা নিয়ে যখন তিনি চিন্তাভাবনা করছেন তখন দেশে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনের কোনো কোনো অংশে যোগ দিলেও কোনো কোনা অংশে যুক্ত হননি। তার কারণ তাঁর মনে হয়েছিল বাইরের আন্দোলনের দ্বারা দেশে ও লোকের মনে স্থায়ী দেশপ্রেম জাগানো সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন দেশের আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া। কারণ ‘দেশের বাস্তবিক জ্ঞান এবং দেশের বাস্তবিক কাজের উপরে যখন দেশহিতৈষা প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই তাহা মাটিতে বদ্ধমূল গাছের মতো ফল দিতে থাকে।’ এই ধারণা কার্যকর করার জন্য রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ৬ চৈত্র, ১৩১১ সালের [19 March, 1904] এক বিশেষ অধিবেশনে ‘নিমন্ত্রিত’ রূপে উপস্থিত থেকে প্রস্তাব দেন : ‘পরিষদের একাদশ বৎসর অতীত হইতে চলিল। এখন কিছু কিছু কাজ হাতে কলমে করা আবশ্যক। ইতিহাস, নৃতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে পরিষদ স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান আরম্ভ করুন। এখন পরীক্ষা দিয়া ছাত্রেরা অবসর পাইবে। এই অবসরে তাহারা স্ব স্ব গ্রামে ওই সকল বিষয়ের তথ্যসংগ্রহ করুক। পরিষৎ তাহাদিগকে এ বিষয়ে উপদেশ দিয়া কার্য করিবার নিমিত্ত পরিচালন করুন। এখন শহরে বি. এ. ও এম. এ. পরীক্ষার্থীরা উপস্থিত আছে, পরিষৎ একদিন তাহাদিগকে আমন্ত্রণ করুন এবং এ বিষয়ে তাহাদিগকে বলুন’ (রবিজীবনী ৫ম খন্ড, পৃ ২২১)। সভায় এই প্রস্তাব গৃহীত হবার পর ১৭ চৈত্র ১৩১১[30 March, 1904] রবীন্দ্রনাথ ক্লাসিক থিয়েটারে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে ‘সহস্রাধিক’ ছাত্রের উপস্থিতিতে তাঁর ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার নমুনাসংগ্রহ ও তুলনামূলক আলোচনার উপর গুরুত্ব দেন। এর কারণ বাংলার উপভাষাগুলিকে তিনি দু-দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। প্রথমত উপভাষাগুলি ভাষাবিকাশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপকরণ ধরে রেখেছে : ‘আমরা ভাষাতত্ত্ব মুখস্থ করিয়া পরীক্ষায় উচ্চস্থান অধিকার করি; কিন্তু আমাদের নিজের মাতৃভাষা কালে-কালে প্রদেশে-প্রদেশে কেমন করিয়া যে নানা রূপান্তরের মধ্যে নিজের ইতিহাস নিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে তাহা তেমন করিয়া দেখি না বলিয়াই ভাষারহস্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠে না।’ দ্বিতীয়ত উপভাষাগুলির তুলনামূলক পর্যালোচনা থেকেই বাংলা ব্যাকরণের প্রকৃত কাঠামো নির্মাণ সম্ভব—‘বাংলা ভাষার একখানি ব্যাকরণ রচনা সাহিত্য পরিষদের একটি প্রধান কাজ। কিন্তু কাজটি সহজ নহে। এই ব্যাকরণের উপকরণ সংগ্রহ একটি দুরূহ ব্যাপার। বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলি উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ। আমাদের ছাত্রগণ সমবেতভাবে কাজ করিতে থাকিলে এই বিচিত্র উপভাষার উপকরণগুলি সংগ্রহ করা কঠিন হইবে না।’
রবীন্দ্রনাথের এই ভাষণের পর তখনকার ছাত্রসমাজে খুব উৎসাহ দেখা দেয়। আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকসাহিত্য, উপভাষা ইত্যাদির উপকরণ সংগ্রহের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে। তবে কালের নিয়মে ধীরে ধীরে কাজের গতি মন্দীভূত হয়ে আসে। বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও দেশভাগের ফলে এইসব কাজের পূর্বানুবৃত্তিতে বাধা পড়ে। বিশেষ করে দেশভাগের পর বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভাষাবিজ্ঞানের চর্চায় তুলনামূলক-ঐতিহাসিক বিদ্যাশৃঙ্খলার পরিবর্তে অন্য শৃঙ্খলার অনুশীলন প্রাধান্য পাওয়ায় ক্ষেত্রভিত্তিক উপভাষা সমীক্ষার কাজও তেমন এগোতে পারেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপভাষা নিয়ে গবেষণার কাজে কিছুটা অগ্রগতি হলেও সংগৃহীত উপকরণগুলির সংরক্ষণ, প্রকাশনা ও সংগঠিত অনুবর্তনের অভাবে এইসব কাজের প্রতিফলন সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। মোট কথা, বিশ শতকের গোড়ায় উপভাষা নিয়ে ছাত্রদের কাছে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তব্য রেখেছিলেন একুশ শতকের গোড়াতেও তার অনেকটাই অসম্পন্ন।৩ অথচ তার প্রয়োজন অদ্যাবধি বর্তমান। তাই ছাত্রছাত্রীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের কথায় সাড়া দেবার পুনরাহ্বান জানিয়ে প্রবন্ধটির ইতি টানা গেল।
__________________________________________________
তথ্যসূত্র :
১। উত্তরবঙ্গের ভাষাপ্রসঙ্গ—নির্মল দাশ।
২। রবিজীবনী (৪র্থ ও ৫ম খন্ড)—প্রশান্তকুমার পাল।
৩। রবীন্দ্ররচনাবলী (৩য় ও ১২শ খন্ড)—বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।