বাঙালির বর্ণশিক্ষা

বাঙালির বর্ণশিক্ষা

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে একটি পঙক্তি পাওয়া যায়, ‘‘আলিএঁ কালিএঁ বাট রুন্ধেলা।’’ এর বাচ্যার্থ আলি (=স্বরবর্ণমালা) ও কালি (=ব্যঞ্জনবর্ণমালা) পথ অবরোধ করল। এই বাচ্যার্থের অবশ্যই গূঢ় তাত্ত্বিক অর্থ আছে, কিন্তু আপাতত সেই গূঢ় অর্থের সন্ধান না করে শুধু বাচ্যার্থের দিকেই মনোনিবেশ করলে তার মধ্যে প্রায় হাজার বছর আগেকার বাঙালির বর্ণবিন্যাস সম্পর্কে একটি ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ তখনকার বাঙালি (শুধু বাঙালি বলি কেন, পূর্বভারতের শিক্ষিত সমাজ বললে ঠিক হয়) বর্ণ, বর্ণমালা, বর্ণমালার স্বরব্যঞ্জন-ভেদ-বর্ণশিক্ষার এইসব প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল। তবে ধর্মগুরুদের হাতে পড়ে বর্ণ বা বর্ণবিন্যাস তখন আধ্যাত্মিক তাৎপর্য লাভ করেছে। বর্ণ বা বর্ণমালার এই আধ্যাত্মিকীকরণ শুধু বৌদ্ধরাই করেননি, পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মগুরু রূপগোস্বামী ও জীবগোস্বামী তাঁদের ‘হরিনামমৃত ব্যাকরণে’ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণকে যথাক্রমে কৃষ্ণ ও রাধার প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহার করে বৈষ্ণব পড়ুয়াদের বর্ণপরিচয়কে একাধারে বর্ণশিক্ষা ও ধর্মচর্চার মাধ্যম করে তুলেছেন। অন্যদিকে বলরাম পঞ্চানন নামে জনৈক শৈব ধর্মশিক্ষক তাঁর ‘প্রবোধ প্রকাশ’ ব্যাকরণে স্বরবর্ণকে শিব ও ব্যঞ্জনবর্ণকে শক্তি হিসাবে বর্ণনা করে শৈব পড়ুয়াদের বর্ণশিক্ষাকে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে একসূত্রে বেঁধেছেন। এই প্রবণতারই সম্প্রসারিত রূপ দেখা যায় মধ্যযুগের আখ্যানকাব্যের কবিদের ‘চৌতিশা’ স্তব রচনার মধ্যে যেখানে চৌত্রিশ ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন জাগে, ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করতে গিয়ে ভক্ত কবিরা শুধু ব্যঞ্জনবর্ণকেই ব্যবহার করলেন কেন? স্বরবর্ণ কেন বাদ রইল? তবে কি মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের কোনো অংশে লিপিতত্ত্বের দিক থেকে স্বরবর্ণের চেয়ে ব্যঞ্জনবর্ণের আপেক্ষিক গুরুত্ব ছিল, যার ফলে হয়তো সমাজের ওই অংশে বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রেও আগে ব্যঞ্জনবর্ণ, তারপর স্বরবর্ণ-শিক্ষা? প্রকৃতপক্ষে লিপিতত্ত্বের বিচারে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণগুলি অক্ষরাত্মক (syllabic) , অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে একটি স্বরধ্বনি নিহিত থেকে এক একটি অক্ষর তৈরি করে; অন্যদিকে স্বরবর্ণগুলি অংশত ধ্বন্যাত্মক, কারণ সাধারণত একমাত্র শব্দের আদিতে ব্যবহৃত না হলে স্বরবর্ণের কোনো স্বতন্ত্র প্রয়োগ বা প্রকাশ দেখা যায় না। শব্দের আদি স্থান ছাড়া অন্য সর্বত্র স্বরধ্বনি ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে নিহিত থেকে তার ধ্বনিময় সত্তার পরিচয় দেয়। বর্ণমালায় ব্যঞ্জনবর্ণগুলি স্বপ্রকাশ ও বৈচিত্র্যময়, কিন্তু স্বরবর্ণের প্রকাশ সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত। হয়তো এজন্যই অতীতে বর্ণশিক্ষার কোনো কোনো ধারায় ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বরবর্ণ শিক্ষাকে গৌণ স্থান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মধ্যযুগে বাঙালির বর্ণশিক্ষার কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না, তাই এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তবে পরবর্তীকালে বর্ণশিক্ষার জন্য যেসব প্রাইমারি বেরিয়েছে, তাতে দেখা যায় বর্ণশিক্ষার ব্যাপারে স্বর-ব্যঞ্জনের আপেক্ষিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে একটা স্পষ্ট তফাত ছিল। অর্থাৎ কোনো বইতে আগে স্বরবর্ণের শিক্ষা, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণের শিক্ষা, আবার কোনোটিতে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইংরেজিতে যাঁরা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন তাঁদের আলোচনায় বর্ণশিক্ষার এই দ্বিমুখী প্রবণতা প্রতিফলিত হয়েছে। হ্যালহেড (১৭৭৮) তাঁর আলোচনায় প্রথমে স্বরবর্ণ, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণকে স্থান দিয়েছেন, অন্যদিকে কেরি (১৮০১) তাঁর আলোচনায় আগে ব্যঞ্জনবর্ণ, তারপর স্বরবর্ণের পরিচয় দিয়েছেন। হয়তো তাঁরা যে বাঙালি শিক্ষকদের কাছে বাংলা বর্ণমালার পাঠ নিয়েছিলেন সেই শিক্ষকরা বর্ণশিক্ষার এই দ্বিমুখী প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বর্ণশিক্ষার জন্য যেসব প্রাইমার বা বর্ণশিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে তাদের কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বইতে, যেমন ‘শ্রীক্ষেত্রমোহন দত্তদ্বারা সংগৃহীত’ ‘শিশুসেবধি/বর্ণমালা’ প্রথম ভাগ (নবম মুদ্রণ ১৮৫৪), শিশুসেবধি/বর্ণমালা/১ সংখ্যা/দ্বিতীয় খন্ড (১৭৭৭ শকাব্দ=১৮৫৫ খ্রি:), বর্ণমালা/প্রথম ভাগ (১৮৫৩)-এ প্রথমে ব্যঞ্জন বর্ণমালার পরিচয়, তারপর স্বরবর্ণ পরিচয়। অন্যদিকে রাধাকান্ত দেবের ‘বাঙ্গালা শিক্ষা গ্রন্থে’ (১৮২১) ‘‘প্রথম স্বর-ব্যঞ্জন প্রভৃতি বর্ণমালা পরে যুক্তাক্ষর ও দ্ব্যক্ষরযুক্ত ও ত্র্যক্ষরযুক্ত ও চতুরক্ষরযুক্ত ও যথাস্থানে বর্ণোচ্চারণ ও হ্রস্ব ও দীর্ঘ ও প্লুত ও ইহার উদাহরণ ও স্বরযুক্ত দ্ব্যক্ষরাদি শব্দ পড়িবার পাঠ’’; রামমোহনের ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণে’ (১৮৩৩)-ও প্রথমে স্বরবর্ণ ও তারপর ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয়। এর সঙ্গে আবার ‘লিপিধারা’ (১৮১৬)-র মতো বর্ণশিক্ষার বইও প্রচলিত ছিল যেখানে ‘‘ব, র, ক, ধ, ঋ এইরূপ অক্ষরের আকৃতি অনুসারে স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের অক্ষরগুলি এক এক স্থানে প্রদত্ত হইয়াছে।’’ অর্থাৎ বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি মডেল চালু ছিল: (ক) প্রথমে ব্যঞ্জনবর্ণ-শিক্ষা, তারপর স্বরবর্ণ শিক্ষা, (খ) প্রথমে স্বরবর্ণ শিক্ষা, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণ শিক্ষা এবং (গ) স্বর-ব্যঞ্জন নির্বিশেষে সম-আকৃতিবিশিষ্ট অক্ষরের শিক্ষা। বলাবাহুল্য উনিশ শতকের প্রথমার্থে বর্ণশিক্ষার এই মডেল-বৈচিত্র্য থেকে বোঝা যায় বাংলা বর্ণশিক্ষার তখনো কোনো মান্য (Standard) আদর্শ গড়ে ওঠেনি। বাংলা বর্ণশিক্ষার এই মান্য আদর্শ গড়ে তুলেছিলেন সংস্কৃত কলেজের দুই সহপাঠী। একজন মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), অন্যজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)।

মদনমোহন তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’ প্রথম ভাগে (১৮৪৯) প্রথমে (অং, অঃ সহ) ১৬টি স্বরবর্ণের পরিচয় দিয়ে তারপর ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয় দিয়েছেন। এই বই তখনকার সরকারি শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী বেথুন সাহেবের আনুকূল্যে বর্ণশিক্ষার আদর্শ বই হিসাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বর্ণশিক্ষায় প্রথমে স্বরবর্ণ, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণ পরিচয়ের পদ্ধতিই বাংলা বর্ণশিক্ষার একমাত্র গ্রহণযোগ্য মডেল হিসাবে মান্যতা লাভ করল। এর ছয় বছর পর বিদ্যাসাগর তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থের প্রথম ভাগে (১৮৫৫) মদনমোহন-মডেলের কিছু ভাষাবিজ্ঞানসম্মত সংস্কার করে বইয়ের বিজ্ঞাপন অংশে জানালেন :

বহুকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋ-কার ও দীর্ঘ ৯-কারের প্রয়োগ নাই। এই নিমিত্ত ওই দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত ওই দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণ স্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদমধ্যে অথবা পদান্তে থাকিলে ড়, ঢ়, য় হয়। সুতরাং উহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ত্রই পরস্পর ভেদ আছে তখন তাহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই শ্রেয়ঃকল্প। এই নিমিত্ত উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়। সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ এজন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।

বিদ্যাসাগরের এই সংস্কারের ফলে বাংলা স্বরবর্ণের সংখ্যা দাঁড়াল ১২ :

অ আ ই ঈ

উ ঊ ঋ ৯

এ ঐ ও ঔ

অন্যদিকে ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৯ :

বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার যে সংস্কার করলেন তাতে বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি সমাজ তাঁর কাছ থেকে একটা শিক্ষা বা guideline পেল যার মূল কথা হল বাংলা বর্ণশিক্ষা হোক বাংলা ভাষার প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে। এর জন্য প্রয়োজনমতো বর্ণশিক্ষা বা বর্ণমালার প্রথাগত ছক ভেঙে ফেলে সেখানে পুরোনো কিছু বর্ণকে বর্জন বা স্থানান্তরিত করে নতুন বর্ণ যোগ করার স্বাধীনতাও নিতে হবে। বাঙালির বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের এই প্রথাভাঙার শিক্ষা বাঙালি সমাজে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তাই কালক্রমে বাংলা বর্ণশিক্ষার বইতে পুরোনো অপ্রয়োজনীয় বর্ণ (যেমন : স্বরবর্ণের ক্ষেত্রে ৯, ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রে অন্তঃস্থ ব) পরিত্যক্ত হয়েছে, আবার প্রয়োজনীয় নতুন বর্ণ যোগ করা হয়েছে (যেমন : স্বরবর্ণের ক্ষেত্রে অ্যা, ব্যঞ্জনবর্ণের ক্ষেত্রে ৎ)। বাঙালির বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালির এই ক্রমবর্ধমান সংস্কারমুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতা বিদ্যাসাগরের আদর্শেই অনুপ্রাণিত।

দুই

এ পর্যন্ত গেল একক স্বর ও একক ব্যঞ্জনবর্ণের কথা। এখন দেখা যাক স্বরবর্ণের কার-চিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জন ও যুক্ত ব্যঞ্জনের বিষয়টি। পুরানো বাংলা পুঁথিতে স্বরবর্ণের কার-চিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জনের নানা রূপভেদ (allograph) দেখা যায়। ছাপাখানা শুরু হওয়ার সময় পুঁথির হরফের ছাঁদই সেখানে মোটামুটি গৃহীত হয়েছিল, তবু রূপভেদগুলির সংখ্যা কমিয়ে ফেলার চেষ্টাও দুর্লক্ষ্য নয়। সবচেয়ে বেশি রূপভেদ ছিল উ-কারযুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে, যেমন ক+উ=ঙ্গ, গ+উ=গু, জ+উ=হ্ন, ত+উ=ত্ত, দ+উ=দ, দ্ব, ন+উ=৯, র+উ=রু, শ+উ=শু, স+উ=সু, হ+উ=হু। ঊ-কার ও ঋ-কারের ক্ষেত্রে খুব সীমাবদ্ধ রূপভেদ ছিল, যেমন ক ঊ কূ, র ঊ রূ, ক ঋ কৃ, হ ঋ হৃ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের ছাপা বইপত্রে এই রূপভেদের বৈচিত্র্য দেখা যেত, তবে এই সময়ের কোনো কোনো বর্ণশিক্ষার বইতে ‘সাঙ্কেতিক অক্ষর’ এই শিরোনামে বাঁদিকের কলামে কার-চিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জনের ‘প্রকৃত’ রূপ এবং ডানদিকের কলামে কার-চিহ্নযুক্ত ব্যঞ্জনের ‘সাঙ্কেতিক’ অর্থাৎ প্রচলিত রূপ দেখিয়ে দেওয়া হত। যেমন : হিন্দু কালেজান্তর্গত বাঙ্গালা পাঠশালার নির্বাহক শ্রীক্ষেত্রমোহন দত্ত দ্বারা সংগৃহীত শিশুসেবধি/বর্ণমালা/প্রথমভাগ (ইষ্টার্ণ হোপ যন্ত্রালয়ে নবমবার মুদ্রাঙ্কিত ১৮৫৪)। একই সময়ে (১৭৭৭ শকাব্দ=১৮৫৫ খ্রি:) ‘কলিকাতা জ্ঞানাঙ্কুর যন্ত্রে মুদ্রাঙ্কিত’ শিশুসেবধি/বর্ণমালা/১ সংখ্যা/দ্বিতীয় খন্ড-এও এই ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। এই সময়ে মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯) এবং বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগে (১৮৫৫) এই ব্যবস্থা প্রত্যাহৃত হয় এবং কারযুক্ত ব্যঞ্জনের ‘সাঙ্কেতিক’ রূপটিকেই একমাত্র মান্য (Standard) রূপ হিসাবে দেখানো হয়। এরপর থেকে কারযুক্ত ব্যঞ্জনের মান্যরূপগুলিই বর্ণশিক্ষার বই এবং সাধারণ বইপত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে। সুদীর্ঘকাল (প্রায় দেড়শো বছর) এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বাংলা বানানবিধিতে স্বচ্ছতর বর্ণবিন্যাসের নীতি গ্রহণ ও প্রচার করার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষাপর্ষদ, মাধ্যমিক শিক্ষাপর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় সংসদ এবং জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় সংস্থা এই নীতি গ্রহণ করে পাঠ্য পুস্তকে স্বচ্ছতর বর্ণবিন্যাসের নির্দেশ দেয় এবং এই সূত্রে ছাপাখানার জগতেও নতুন Software প্রচলিত হওয়ায় বাঙালির বর্ণশিক্ষার জগতে নতুন মোড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখন কিছুদিন নতুন বর্ণবিন্যাসের পাশাপাশি পুরোনো রীতি সমান্তরালভাবে চলতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত নতুন রীতিই সর্বত্রগামী হবে বলে আশা করা যায়।

যুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে প্রাক-‘শিশুশিক্ষা’ পর্বের প্রাইমারগুলিতে যুক্ত ব্যঞ্জন গঠনের ব্যাপারে ফলা-ব্যবহারের যথেচ্ছাচার দেখা যায় অর্থাৎ এই যুক্ত ব্যঞ্জন দিয়ে কোনো শব্দ গঠিত না হলেও তা শেখাবার ব্যবস্থা চালু ছিল। যেমন : ক্ষেত্রমোহন দত্তের শিশুসেবধি/বর্ণমালা/প্রথম ভাগে (নবম মুদ্রণ ১৮৫৪) র-ফলা দিয়ে যুক্ত ব্যঞ্জন গঠনের শিক্ষা, ভাষাশিক্ষায় যার অনেকটাই অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় :

যুক্ত ব্যঞ্জনশিক্ষার এই অপ্রয়োজনীয় অত্যাচার বন্ধ করলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’ দ্বিতীয় ভাগে (১৮৫০)। এই বইয়ের ‘মুখবন্ধে’ তিনি জানালেন :

যে সকল সংযুক্ত বর্ণ বাঙ্গালা ভাষায় একেবারে অপ্রচলিত এবং সংস্কৃত ভাষাতেও বিরলপ্রচার তৎসমুদায় শিশুগণের অনাবশ্যক অভ্যাস পরিশ্রম পরিহরার্থে পরিত্যক্ত হইয়াছে। যেমন, ঙ্য, ছ্য, ঞ্য, চ্র, ঝ্র, ঙব , ঞব, খণ , ঝণ , ঘণ , ছণ ইত্যাদি।

বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগে (১৮৫৫) মদনমোহনের এই নীতিই অনুসরণ করেছেন। ফলে কালক্রমে বর্ণশিক্ষায় অনাবশ্যক যুক্ত ব্যঞ্জন গঠনের শিক্ষা পরিত্যক্ত হল এবং যুক্ত ব্যঞ্জন শব্দে ব্যবহৃত দুই অক্ষরের ও তিন অক্ষরের যুক্ত ব্যঞ্জনের পাঠ দেওয়া হল। যতদিন রেফ-এ দ্বিত্ব-নীতি প্রচলিত ছিল ততদিন ‘ঊর্দ্ধ’ শব্দটির উদাহরণ দিয়ে চারটি ব্যঞ্জনের (র দ ধ ব) সংযোগ শেখানো হত। তবে রেফ-এ দ্বিত্ব ব্যবহারের নীতি আবশ্যিক না থাকায় কোথাও রেফ-যুক্ত ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব ঘটত, কোথাও দ্বিত্ব ঘটত না। যেমন, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগ (অষ্টম মুদ্রণ ১৮৫৮)-এ রেফ-এর পাঠে কোথাও দ্বিত্ব রক্ষিত, কোথাও দ্বিত্ব বর্জিত। যেমন ২য় পাঠের শেষে রেফ সংযোগে গঠিত যুক্ত ব্যঞ্জনের উদাহরণে দ্বিত্ব বর্জিত—

র ক র্ক, তর্ক, কর্কশ, শর্করা।…..

র ভ র্ভ, গর্ভ, নির্ভয়, নির্ভর, দুর্ভাগ্য, দুর্ভাবনা।

অন্যদিকে ৪র্থ পাঠের শেষে ২১নং পৃষ্ঠায় প্রদত্ত উদাহরণে দ্বিত্ব রক্ষিত—

র ত ত র্ত্ত, আর্ত্ত, মুহূর্ত্ত, বর্ত্তমান, কর্ত্তা , বার্ত্তা, মূর্ত্তি ।

র ত থ র্ত্থ, প্রার্ত্থনা, অভ্যত্থর্না, প্রার্ত্থনীয়, প্রার্ত্থিত।

রেফ যোগে যুক্ত ব্যঞ্জন গঠনের এই দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই তখনকার বর্ণশিক্ষার্থীদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করত। কিন্তু বিদ্যাসাগর নিজেই এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে সমাধানের পথ বের করেন। তাঁর দ্বিতীয় ভাগের ৬২ তম সংস্করণে (১৯৩৩ সংবৎ=১৮৭৬ খ্রি:) দেখা যায় রেফ যোগে যুক্ত ব্যঞ্জন গঠনের দু-রকম দৃষ্টান্ত বর্জন করে তিনি রেফ-এ দ্বিত্ব বর্জনের নীতির ভিত্তিতে একটিমাত্র পাঠ তৈরি করেছেন। তবে বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণশিক্ষায় শেষ পর্যন্ত রেফ-এ দ্বিত্ববর্জনের নীতি গ্রহণ করলেও শিক্ষিত বাঙালি সমাজের রক্ষণশীল মহলে দ্বিত্বরক্ষার রীতি দীর্ঘদিন অনুসৃত হয়েছে, এমনকী ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-বিধিতে রেফ-এ দ্বিত্ববর্জনের নীতি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হলেও এই রক্ষণশীলতার পুরোপুরি মূলোচ্ছেদ হয়নি। তবে গত শতকের শেষ দিকে এই অবস্থার সদর্থক পরিবর্তন ঘটেছে।

বিশ শতকের শেষ দিকে শুধু রেফ যোগে ব্যঞ্জন গঠনের ক্ষেত্রেই সদর্থক পরিবর্তন ঘটেনি, সামগ্রিক ভাবে বাংলা বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু অভিনব প্রবর্তনা ও লক্ষ করা যায়। এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সংস্কারমুখী তৎপরতা প্রধানত দায়ী। বাংলা আকাদেমি বাংলা বানানের সংস্কার ও সমতাবিধানের জন্য যেসব নীতি প্রবর্তন করে তার অন্যতম অংশ হচ্ছে বানানের বর্ণবিন্যাসে স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ। এই স্বচ্ছতার নীতি যেমন কারবিশিষ্ট ব্যঞ্জনে, তেমনি দুই বা তিন ব্যঞ্জন দিয়ে গঠিত যুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রেও গৃহীত হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন কারবিশিষ্ট ব্যঞ্জন অন্যদিকে তেমনি দ্ব্যক্ষর ও ত্র্যক্ষর যুক্ত ব্যঞ্জনের পুরোনো ছাঁদের পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন :

পুরোনো ছাঁদ নতুন ছাঁদ

ক্ত ক্ত

স্থ স্থ

ঙ্গ ঙ্গ

ঞ্চ ঞ্চ

ক্র ক্র

হ্ম হ্ম

ষ্ণ ষ্ণ ইত্যাদি।

তবে বর্ণশিক্ষার একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে এইসব নতুন ছাঁদ বাংলা আকাদেমির নিজস্ব উদ্ভাবন নয়। আসলে আগেই বলা হয়েছে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কোনো কোনো প্রাইমারে (যেমন : ক্ষেত্রমোহন দত্ত সংগৃহীত শিশুসেবধি/বর্ণমালা/প্রথম ভাগ/ নবম মুদ্রণ ১৮৫৪) ‘সাঙ্কেতিক অক্ষর’ এই শিরোনামে বাঁদিকের কলামে কারবিশিষ্ট ব্যঞ্জন এবং দ্ব্যক্ষর ত্র্যক্ষর ব্যঞ্জনের ‘প্রকৃত’ রূপ এবং ডানদিকের কলামে তাদের ‘সাঙ্কেতিক’ অর্থাৎ প্রচলিত রূপ দেওয়া থাকত। বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত হরফের স্বচ্ছতর ছাঁদগুলির অধিকাংশই ওই পুরোনো প্রাইমারগুলিতে উল্লিখিত কারবিশিষ্ট ব্যঞ্জন ও দ্ব্যক্ষর ত্র্যক্ষর যুক্ত ব্যঞ্জনের ‘প্রকৃত’ রূপ। সুতরাং এখনকার পাঠকদের মধ্যে যাঁরা বাংলা আকাদেমির বর্ণসংস্কার প্রচেষ্টায় আতঙ্ক বোধ করেন, তাঁরা এবার বুঝতে পারবেন বাংলা আকাদেমি বাংলা বর্ণবিন্যাস বা বর্ণশিক্ষার পুরোনো ঐতিহ্যকে ভেঙে না ফেলে ঐতিহ্যের উপাদান দিয়েই তার পুনর্নবীকরণ করেছে। বলা বাহুল্য এ চেষ্টা চূড়ান্ত নয়, অন্তর্বর্তী। বর্ণবিন্যাসের এই অন্তর্বর্তী স্বচ্ছতাবিধানে বাংলা বর্ণশিক্ষাও এখন অনায়াসসাধ্য হয়েছে, সাক্ষরতা ও সর্বশিক্ষা আন্দোলনের পটভূমিকায় যা বয়স্ক বা অল্পবয়সি বর্ণশিক্ষার্থীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ শতকের শেষদিকে বাঙালির বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে আর একটি নতুন প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হল বিদেশি শব্দ বাংলা হরফে লেখার প্রয়োজনে শব্দের যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির জন্য নতুন নতুন যুক্ত ব্যঞ্জন গঠন। আগে যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনিযুক্ত বিদেশি শব্দ বাংলা হরফে লিখতে হলে প্রচলিত বাংলা যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহার করা হত এবং সেক্ষেত্রে বাংলা বানানের প্রথাসিদ্ধ ণত্ব-ষত্ব বিধি অনুসরণ করা হত। যেমন :

Cornwallis=কর্ণওয়ালিস (তৎসম ‘কর্ণ’-র সাদৃশ্যে ণত্ব বিধি) Corner=কর্ণার (’’)

Steamer=স্টীমার (তৎসম ‘ইষ্ট’-র সাদৃশ্যে ষত্ব বিধি) Street=(তৎসম ‘উষ্ট্র’-র সাদৃশ্যে ষত্ব বিধি) ইত্যাদি।

কিন্তু বিদেশি শব্দের বাংলা বর্ণীকরণে ণত্ব-ষত্ব বিধির কোনো বৈজ্ঞানিক উপযোগিতা না থাকায় এখন নতুন যুক্তবর্ণ তৈরি হয়েছে : rn=র্ন (র+ন); st=স্ট (স+ট)। আগে তৎসম ‘লুন্ঠন’ শব্দ ও বিদেশি ‘লন্ঠন’ শব্দ একই যুক্ত বর্ণ ‘ন্ঠ’ (ণ+ঠ) দিয়ে লেখা হত। এখন বিদেশি যুক্ত ধ্বনির জন্য নতুন যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ ণ্ঠ (ন+ঠ), ন্ট (ন+ট) (লণ্ঠন, পন্টিং) তৈরি হয়েছে। তেমনি ডাণ্ডা, ঝাণ্ডা, লণ্ডন-এর জন্য নতুন যুক্ত ব্যঞ্জন ণ্ড (ন+ড), পুরনো ন্ড (ণ+ড) নয়।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জ্ঞাপন-প্রযুক্তি (information technology)-র অভাবিত সম্প্রসারণের ফলে এখন এমন সব বিদেশি শব্দ বাঙালির কাছে পৌঁছচ্ছে যাদের কোনো কোনো যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি লিখে দেখাবার মতো যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে নেই। যেমন : Vladimir-এর VI, Spray-এর spr, Splinter-এর spl.—এদের জন্য বাংলার প্রচলিত যুক্ত বর্ণমালায় কোনো যুক্ত ব্যঞ্জন নেই। অথচ বাংলা সংবাদ মাধ্যমের কাছে তা খুব জরুরি, তাই VI-এর জন্য কোনো কাগজে পাই ভ্ল বর্ণ কোনো কাগজে পাই ভ্ল বর্ণ—এর মধ্যে কোনটা গ্রহণযোগ্য তার একটা নির্ণায়ক শিক্ষা দরকার। Spr ও Spl-এর জন্য এখন তৈরি হয়েছে নতুন যুক্ত ব্যঞ্জন—যথাক্রমে স্প্র ও প্লে । বলাবাহুল্য এটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা, কিন্তু একে স্থায়িত্ব দিতে গেলে বাংলা বর্ণশিক্ষা বা প্রাইমারের নতুন বইগুলিতে এইসব বিরল যুক্ত ব্যঞ্জনের শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। না হলে একালের বাঙালির বর্ণশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উপযুক্ত বর্ণশিক্ষা না হলে বাংলায় ইংরেজি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ কেমন অসঙ্গত হয়ে ওঠে তার ভালো উদাহরণ bulb-কে বাংলায় বাল্ব লেখা। এটা অসংগত ও অনুপযোগী এই কারণে যে বাংলায় ল্ব-এর উচ্চারণ ল্ল, সেখানে ব ধ্বনির জায়গা নেই। এখানে বর্ণশিক্ষার্থীকে সঠিক প্রতিবর্ণীকরণ যে ‘বালব’ তা শেখাতে হবে। তেমনি album কখনই ‘অ্যাল্বাম’ নয়, ‘অ্যালবাম’, Alva=কখনই ‘আল্বা’ নয়, আলভা বা আলবা।

তিন

এ পর্যন্ত গেল বর্ণশিক্ষায় বর্ণসংস্থান ও বর্ণগঠনের কথা। এবার দেখা যাক বর্ণশিক্ষার পদ্ধতি বা কৌশল আগে কেমন ছিল, এখনই বা কেমন? আগেই বলা হয়েছে প্রাক-আধুনিক যুগের বাঙালির বর্ণশিক্ষা সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাই ওই পর্বের বর্ণশিক্ষার পদ্ধতি নিয়েও খুব স্পষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তবে ইতিহাসের আনুষঙ্গিক তথ্য থেকে জানা যায় বাংলা শেখাবার জন্য যেসব পাঠশালা তখন চালু ছিল সেগুলির দায়িত্বে থাকতেন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরা। এই জন্য অনুমান করা যায় পাঠশালার বাংলা বর্ণশিক্ষাতেও টোলের পঠন-পাঠন রীতিই অনুসৃত হত। টোলের পঠনপাঠন-প্রক্রিয়ায় বলা হত ‘আবৃত্তি: সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী’ অর্থাৎ পড়ে শাস্ত্র বুঝে নেওয়ার চেয়ে শাস্ত্র আউড়ে যাওয়াই শাস্ত্রপাঠের শ্রেষ্ঠ উপায়। এ থেকে বোঝা যায়, পড়ে বোঝার চেয়ে মুখস্থ বিদ্যার চর্চাই টোলের পঠন-পাঠনরীতির বৈশিষ্ট্য। বাংলা পাঠশালাগুলি টোলের পন্ডিতেরাই চালাতেন বলে সেখানকার বর্ণশিক্ষাতেও মুখস্থবিদ্যার উপর জোর দেওয়া হত—এমন অনুমান অসংগত নয়। বর্ণসংস্থান ও বর্ণযোজনার রহস্য বুঝে নেওয়ার বদলে অসংযুক্ত ও সংযুক্ত বর্ণের শব্দতালিকা মুখস্থ করা এবং প্রয়োজনমতো এই তালিকা আউড়ে যাবার অ-বোধ সামর্থ্যই সম্ভবত ভালো পড়ুয়ার লক্ষণ বলে বিবেচিত হত। প্রাক-‘শিশুশিক্ষা’ পর্বের যেসব প্রাইমার পাওয়া যায় তাদের পাঠবিন্যাস থেকেই আমাদের এই অনুমান সত্য বলে মনে হয়। বস্তুত মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’র আগে পর্যন্ত বর্ণশিক্ষায় মধ্যযুগীয় রীতি-পদ্ধতিই অনুসৃত হত। অসংযুক্ত ও সংযুক্ত শব্দের বিস্তৃত তালিকা, ণত্ব-ষত্ব বিধি, জকার ভেদ, যকার ভেদ, ণকার ভেদ, শকার ভেদ, ষকার ভেদ, সকার ভেদ ও বিভিন্ন ঊহ্যক্রিয় বাক্য ও উক্তক্রিয় বাক্যই ছিল বর্ণশিক্ষার পাঠ্য বিষয়। এই পাঠে বোধের চেয়ে আবৃত্তি অর্থাৎ স্মৃতি থেকে আউড়ে যাওয়াই ছিল তখনকার বর্ণশিক্ষার শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।

মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’য় বাংলা বর্ণশিক্ষা নতুন পদ্ধতি আশ্রয় করল। মদনমোহন দেখলেন বর্ণশিক্ষার পাঠ যখন স্মৃতিনির্ভর তখন যান্ত্রিকভাবে স্মৃতিচর্চার বদলে তিনি পাঠের মধ্যে আনলেন স্মৃতি-সহায়ক (mnemonic) ছন্দের দোলা যেমন :

(প্রথম ভাগে)

কালো কাক ভালো নাক

কাটা কান ফাটা শান

পাকা পান টাকা দান

বার মাস তার দাস

(দ্বিতীয় ভাগে)

ক্য কটু বাক্য নাহি কবে। খ্য কুকাজে অখ্যাতি হবে।

গ্য আরোগ্য সুখের মূল। চ্য কুবাচ্য কথার শূল।

রবীন্দ্রনাথ যে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’-কে ‘আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা’ বলে অভিহিত করেছেন সেই গৌরব আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পড়া বই ‘শিশুশিক্ষা’ প্রথম ভাগের প্রাপ্য। কারণ ‘শিশুশিক্ষা’র বর্ণশিক্ষায় মদনমোহন যে স্মৃতিসহায়ক অন্ত্যমিলের ব্যবস্থা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে তা ভুলতে পারেননি। বিদ্যাসাগর অবশ্য ‘শিশুশিক্ষা’-র ছান্দসিক আবেদনের বদলে তাঁর ‘বর্ণপরিচয়ে’ ড্রিলিং পদ্ধতি অবলম্বন করে একই পর্যায়ের বিভিন্ন শব্দের পুনঃপুন অভ্যাস করিয়ে বর্ণশিক্ষা তথা বানান-শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন।

যেমন, দ্বিতীয় ভাগে (অষ্টম সংস্করণ)

‘সংযুক্ত বর্ণ।

য ফলা।

য্য

ক য খ্য ঐক্য, বাক্য, অনৈক্য, মাণিক্য, একবাক্য।

খ য খ্য মুখ্য, আলেখ্য, অসংখ্য, সংখ্যা, বিখ্যাত, অখ্যাতি, উপাখ্যান, আখ্যায়িকা।

গ য গ্য ভাগ্য, যোগ্য, আরোগ্য, যোগ্যতা, বৈরাগ্য, সৌভাগ্য।

চ য চ্য বাচ্য, বিবেচ্য, অচ্যুত, পদচ্যুত।’’

মদনমোহনের পাঠের সঙ্গে তুলনা করলেই তাঁর পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য বোঝা যাবে। এই পদ্ধতিতেই তিনি গদ্য রচনার উপর নির্ভর করেছেন, যার কোনো কোনোটিতে কাহিনির আভাস আছে। বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে এও এক নতুন প্রবণতা যা ‘শিশুশিক্ষা’র ছন্দনির্ভর মডেলের পাশে সেকালে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

মদনমোহন ও বিদ্যাসাগরের পরে পরেই তাঁদেরই বিশেষ পরিচিত রেভারেন্ড বোমওয়েচ (১৮২০-১৯০৫) নামে এক জার্মান পাদরি ‘শিশুর প্রথম পাঠনা পুস্তক’ নামে বর্ণশিক্ষার একটি বই প্রকাশ করেন (১৮৬২)। মদনমোহন ও বিদ্যাসাগরের তুলনায় এই বইতে বাংলা বর্ণশিক্ষার আর একটি নতুন মডেল দেখা গেল। এই বইয়ের ‘প্রদর্শিকা’ অংশে তিনি বর্ণশিক্ষার প্রচলিত পদ্ধতির ত্রুটি বিশ্লেষণ করে শিশুদের বোধ ও বুদ্ধির কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্প মডেল উপস্থিত করেছেন। এই মডেল অনুসারে :

বর্ণমালাটিও প্রথমে শিশুদের হাতে দিতে হয় না। অতি সরল ও স্বাভাবিক রূপে কর্মটি আরম্ভ করিতে হয়। একটি কাল তক্তায় অথবা দেওয়ালে (বাড়ত দুই-একটি ছেলের জন্যে শ্লেট হইলেও হয়) একটি ‘‘আ’’ লিখিতে হয়। ‘‘আ’’টি চিনাইয়া দিলে পর তাহার দক্ষিণ পার্শ্বে একটি ‘‘ম’’ লিখিয়া বলিতে হয় যে, ‘‘আ’’ এর পর একটি ‘‘ম’’ লিখিলে ‘‘আম’’ হয়। আর শিশুদিগকে তাহা উচ্চারণ করাইতে হয়। পরে ‘‘আ’’টির নীচে অন্য একটি ‘‘আ’’ লিখিতে হয়, শিশুরা তাহা উচ্চারণ করিলে পর তাহার দক্ষিণে (অর্থাৎ ‘‘ম’’-এর নীচে) একটি ‘‘ন’’ লিখিতে হয়। লিখিয়া বলিতে হয় যে, ‘‘আ’’ এর পর ‘‘ন’’ থাকিলে ‘‘আন’’ হয়। শিশুরা তাহা উচ্চারণ করিবে।

এই পদ্ধতিকে কাজে লাগাবার জন্য বোমওয়েচ তাঁর বইতে বর্ণশিক্ষার যে পাঠ দিয়েছিলেন তার নমুনা নিম্নরূপ:

১ পাঠ।

আ ।

ম ন

মা না

আমা আনা

মান নাম

আমান আনাম

মানা নামা

মামা নানা

মামান নানাম

মামাম নামান

আম আমা আনা না মা নাম

নামা মানা মান মানান মামা (পৃ: ১)

বোমওয়েচের এই মডেলে অভিনবত্ব থাকলেও সমকালীন শিশুশিক্ষায় তা তেমন স্বীকৃতি পায়নি। এই মডেলে বর্ণশিক্ষার প্রচলিত রীতির বিপরীত অবস্থানই হয়তো এর প্রধান কারণ।

এর পর বর্ণশিক্ষার বিশেষ উল্লেখযোগ্য বই যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশী’ প্রথম ভাগ (১৮৯৭) এবং দ্বিতীয় ভাগ (১৯০৫)। প্রথম ভাগে অসংযুক্ত বর্ণশিক্ষার পাঠ, দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত বর্ণশিক্ষার পাঠ। কিন্তু এখানে বিদ্যাসাগরের ড্রিলিং পদ্ধতি বর্জন করে অসংযুক্ত ও সংযুক্ত বর্ণের ছবি ও ছড়া যোগ করা হল। জীবনঘনিষ্ঠ ছবি ও মজাদার ছড়ার সাহচর্যে বর্ণশিক্ষা শিশুদের কাছে হয়ে উঠল আকর্ষণ ও কৌতূহলের বিষয়। এই বইতে বাঙালি বর্ণশিক্ষার আর এক রসময় মডেলের সন্ধান পেল।

এরপর রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ণশিক্ষার নতুন বই পাওয়া গেল—‘সহজপাঠ’ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ (১৯৩০)। এর প্রথম ভাগে আছে বর্ণসংক্রান্ত মজাদার ছড়া। তার সঙ্গে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। দুই ভাগের পাঠেই আছে কবিতা ও গদ্যে লেখা চমকপ্রদ কাহিনি যা শিশুর কল্পনাশক্তি ও কৌতূহলবোধকে উদ্দীপিত করে। এক কথায় শিশুমনের সঙ্গী হয়ে ওঠাই মডেল হিসাবে সহজপাঠের অভিনবত্ব।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলা শিক্ষার জন্য ‘কিশলয়’ গ্রন্থমালা ব্যবহার করা হয়। ‘কিশলয়ে’-র প্রথম দুটি ভাগ যথাক্রমে অসংযুক্ত ও সংযুক্ত বর্ণশিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এই বইতে বর্ণশিক্ষার জন্য প্রচলিত মডেলের বদলে নতুন মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম ভাগে প্রথমেই বর্ণমালার পাঠ না শিখিয়ে পরিচিত শব্দ দিয়ে তৈরি সচিত্র ছড়া পড়ানো হয় এবং সেই ছড়া থেকে একটি বা দুটি বর্ণ বেছে নিয়ে তা লিখতে এবং তা দিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করতে শেখানো হয়। দ্বিতীয় ভাগে সচিত্র গদ্য কাহিনির পাঠই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাঠ থেকে ওই পাঠে ব্যবহৃত সংযুক্ত বর্ণ দিয়ে পাঠ-বহির্ভূত শব্দ শেখানো হয়। যেমন :

দ্বিতীয় ভাগের পঞ্চম পাঠ

‘‘নেমন্তন্ন’’

নন্দকে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম—‘‘সক্কালবেলা উঠে কোথায় যাচ্ছিস রে?’’

নন্দ বলল—‘‘কোন্নগর যাচ্ছি। অন্নদা দিদির বাড়ি। দিদির ছেলের মুখেভাত। মাসি আর মেসোমশায় আসবে অনন্তপুর থেকে।….আমার ছোটো ভাই….চিত্তকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।’’

পাঠের পর নতুন সংযুক্ত বর্ণগুলি (ক্ক, ন্ন, ত্ত) চিনিয়ে দিয়ে ন-ফলা যুক্ত আরও কয়েকটি শব্দের উচ্চারণ শেখানো হয়েছে: গ্ন-ভগ্ন/অগ্নি। ঘ্ন-বিঘ্ন/ত্ন-যত্ন/রত্ন। ম্ন-নিম্ন। পাঠের সমসাময়িক সামাজিক চিত্র ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে থাকায় পাঠগুলি বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী হয়ে উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে বর্ণশিক্ষার ক্ষেত্রে আর একটি প্রেরণাদায়ী ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। এই ঘটনা হল সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন। এই আন্দোলনে বয়স্ক নিরক্ষরদের সাক্ষর করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, যার প্রথমেই আছে বর্ণশিক্ষার পাঠ। কিন্তু বর্ণশিক্ষার এই নতুন লক্ষ্য-দলের জন্য শিশুশিক্ষায় ব্যবহৃত কোনো মডেলের বই-ই উপযোগী নয়। কারণ লক্ষ্য-দলের বয়স ও কর্মব্যস্ততা। অল্পসময়ে তাদের বর্ণশিক্ষা দেবার জন্য বয়স্ক শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ সত্যেন মৈত্র তৈরি করলেন ‘সাক্ষরতার প্রথম পাঠ’ ও আনুষঙ্গিক পাঠমালা। এ এক নতুন মডেল যার সঙ্গে বোমওয়েচের পূর্বকথিত মডেলের কিছুটা মিল আছে। কিন্তু বোমওয়েচের মডেলের সঙ্গে সত্যেন মৈত্র মডেলের তফাত হচ্ছে সত্যেন মৈত্র-মডেল শব্দনির্ভর নয়, জীবনমুখী বাক্যনির্ভর। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতা কর্মসূচিতে সত্যেন মৈত্র-মডেল এত ফলপ্রসূ।

সবশেষে বাঙালির বর্ণশিক্ষার আধুনিকীকরণের কথা। এ যাবৎ বাংলা বর্ণশিক্ষায় দৃষ্টিনন্দন ছবি ও মনোগ্রাহী কবিতা ও কাহিনি যোগ করে বর্ণশিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়েছে যে তার সাহায্যে বর্ণশিক্ষায় প্রাণায়ন (animation) ও বহুমাধ্যম (multimedia) পদ্ধতির প্রয়োগ করলে বর্ণশিক্ষা পদ্ধতি একদিকে যেমন আরও আধুনিক হয়ে উঠবে, অন্যদিকে তেমনি তা বহুগুণ ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগী শিক্ষাব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রবন্ধের ঝাঁপি বন্ধ করি।

__________________________________________________

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ—নির্মল দাশ। কলকাতা, ১৯৮৭।

২. বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ—আশিস খাস্তগীর সম্পাদিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৬।

৩. শিশুশিক্ষার সেকাল-একাল—অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মারক গ্রন্থ। কলকাতা, ২০০৮।

৪. বাংলা বানানবিধি—পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।

৫. বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য, প্রথম খন্ড—কেদারনাথ মজুমদার, কলকাতা, ১৯১৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *