এখন আমাদের কোন ভাষাতত্ত্ব চাই
১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম জোনস এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সভায় যে-বক্তৃতা দেন তাতে ইউরোপের কয়েকটি ভাষার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। এখান থেকেই তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রপাত। এবং ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বলা হয় যে, এখান থেকেই ভাষাবিজ্ঞাচর্চারও আধুনিক পর্বের সূচনা। এরপর এরই সূত্র ধরে গোটা উনিশ শতক জুড়ে প্রথমে তুলনামূলক ভাষাব্যাকরণ, তারপর ঐতিহাসিক ভাষাব্যাকরণের চর্চা চলতে থাকে। ব্যাকরণচর্চার এই দুটি ধারাই ছিল লিখিত সাহিত্যের ভাষা-বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল। ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাকরণকারেরা ক্রমে লক্ষ করলেন যে, ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস শুধু ভাষার লিখিত নিদর্শনের মধ্যেই সঞ্চিত থাকে না, ভাষার ইতিহাসের অনেক অদৃশ্য সূত্র ভাষার কথ্য রূপের মধ্যেও নিহিত থাকে। এরই সূত্র ধরে উনিশ শতকের শেষ দিকে দেখা দিল কথ্য উপভাষার সন্ধান ও বিশ্লেষণ। এইভাবে ভাষাবিজ্ঞানের ভাষার লিখিত রূপের এলাকা ছেড়ে ভাষার কথ্যরূপের দিকে পা বাড়াল। এরপর বিশ শতক ধরে মুখের ভাষা ও তার মান্যরূপ ধরে একে একে নানা শৃঙ্খলার ব্যাকরণচর্চা শুরু হল। বর্ণনামূলক, সংগঠনমূলক, শেষে সঞ্জননী-সংবর্তনী ভাষাবিজ্ঞান। এর সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি দেখা গেল ভাষাবিজ্ঞানের নানা পার্শ্বশাখা, যেমন: সমাজভাষাবিজ্ঞান, শৈলীবিজ্ঞান, মনোভাষাবিজ্ঞান, ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপরে ভাষাবিজ্ঞানের যেসব শাখা ও পার্শ্বশাখার উল্লেখ করা হল সেগুলির উদ্ভব ও অনুশীলন সমাজের বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ঘটেছে, তবে সব বিদ্যাশৃঙ্খলারই থাকে দুটো দিক : তাত্ত্বিক দিক ও ব্যাবহারিক দিক। তাত্ত্বিক দিকের ক্ষেত্রে প্রবক্তার বিশেষ দার্শনিক উপলব্ধি ও সেই উপলব্ধি রূপায়ণের প্রয়াস বিশেষভাবে কাজ করে। সেখানে সমাজের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের সঙ্গে তার তেমন যোগ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু বিদ্যাশৃঙ্খলার ব্যাবহারিক দিক থেকে সমাজের ব্যাবহারিক প্রয়োজনের বিষয়টাই সবচেয়ে জরুরি। প্রকৃতপক্ষে আঠারো শতকের শেষে এবং গোটা উনিশ শতক জুড়ে যে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণচর্চার বিস্তার ঘটেছে তার সঙ্গে জড়িত ছিল সমসাময়িক ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের ব্যাবহারিক স্বার্থ, বিশ শতকের সংগঠনমূলক ভাষাবিজ্ঞানের পেছনে ছিল বিশ্বযুদ্ধের সামরিক চাহিদা যাতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অচেনা জায়গায় সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সেনাদলকে স্থানীয় ভাষার সঙ্গে পরিচিত করানো যায়। আবার, অধুনালপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে যে নতুন করে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের অনুশীলন শুরু হয় তার পেছনেও ছিল পূর্ব-ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রসারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: এখন এই মুহূর্তে সামাজিক প্রয়োজনের দিক থেকে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে কোন ধরনের ভাষাবিজ্ঞানের অনুশীলন বিশেষভাবে জরুরি।
এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গেলে আগে দেখা দরকার পশ্চিমবঙ্গে এখন ভাষাবিজ্ঞানের অবস্থাটা কী? সাধারণভাবে ভাষাবিজ্ঞানচর্চার অবকাশ দুটি ক্ষেত্রে: এক. বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ধরে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন, দুই. প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানের কোনো শাখার গবেষণা। পশ্চিমবঙ্গে গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও গবেষণায় প্রধানত তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান নামান্তরে বহুকালিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এরপর রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সত্তরের দশক থেকে সংগঠনমূলক-বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের মতো এককালিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা যুক্ত হয়েছে। এখন তত্ত্বমূলক সঞ্জননী ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাও ভাষাবিজ্ঞানের সাধারণপত্রে স্থান পাচ্ছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে উপভাষা নিয়ে এককালিক গবেষণা ও বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সম্পর্কসন্ধানী তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা ক্রমশ পিছনে পড়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর সামাজিক পরিস্থিতির দিক থেকে এই অবস্থা কতটা কাম্য?
প্রথমত, ভারতবর্ষ একটি বহুভাষিক দেশ। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক ভাষানীতির ফলে সারাভারতে ইংরেজির একচ্ছত্র প্রসার ঘটেছে, কিন্তু বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, না সিলেবাসের মধ্য দিয়ে, না সমাজের ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার বদলে আরও অবনতি ঘটেছে। একদিকে রাষ্ট্রভাষার নামে জনসম্পর্কহীন এক কৃত্রিম হিন্দির আধিপত্য, অন্যদিকে প্রাদেশিক ভাষাগুলির অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রিকতা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। আমরা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জাতীয় সংহতির কথা বলি, কিন্তু ভারতে যে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষার মানুষের বসবাস তাদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা কোথায়? জাতীয় শিক্ষানীতি, ভাষানীতিতে তার প্রতিফলন কোথায়? এর জন্য দরকার জাতীয় শিক্ষানীতির অঙ্গ হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার নানাস্তরে ভারতীয় ভাষা নিয়ে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন ও গবেষণা। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন তাঁর প্রত্যক্ষ উৎসাহে স্নাতকোত্তর স্তরে মাতৃভাষার পঠন-পাঠন করতে হলে আর একটি ভারতীয় ভাষার অধ্যয়ন করতে হত। তাঁর তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যবস্থাও অন্তর্হিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ৬০ বছর কেটে গেল। এখনও কি বিষয়টি নিয়ে পুনর্ভাবনার সময় আসেনি? বিগত ৬০ বছরে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ও বাইরে ভাষাগবেষণার নানা কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেগুলিতে ভাষাভিত্তিক জাতীয় সংহতির প্রয়াস কোথায়? সব মিলিয়ে কি মনে হয় না যে এখন ফেলে আসা বহুকালিক ভাষাবিজ্ঞান বা তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের ব্যাপারে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠিত উদ্যোগ দরকার।
দ্বিতীয়ত, যেসব শক্তি বিশ্বের বাজার-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের চোখে ভারত একটি অনন্ত সম্ভাবনাময় শক্তিধর দেশ। হয়তো ভারতের জনসংখ্যার বিপুলতা, মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এই ভাবনার একটা বড়ো কারণ। এই কারণে ভারত এখন রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। এই গুরুত্ব আরও নিবিড় ও ব্যাপক করতে হলে দরকার এই এলাকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্তরে সম্পর্ক স্থাপন। এই কাজটা এক দিক থেকে খুব কঠিন নয়, এই কারণে যে অতীতে এইসব দেশে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম প্রসারের সূত্রে ভারতের সঙ্গে এইসব দেশের একটা সম্পর্কের প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্যে সেই পুরোনো ঐতিহ্যের পুনর্বাসন ঘটাতে পারলে তাতে লাভ ছাড়া লোকসান নেই। এক্ষেত্রেও দরকার প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা যা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অনুষঙ্গী গবেষণাকেন্দ্র থেকেই পাওয়া সম্ভব।
তৃতীয়ত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এখন একদিক থেকে দরকার তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের মতো বহুকালিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা, অন্যদিকে দরকার উপভাষাচর্চার মতো এককালিক ভাষাবিজ্ঞানের অনুশীলন। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা বাংলা হলেও এখানে দীর্ঘদিন ধরে অন্যভাষার মানুষেরাও বসবাস করেন। বিশেষ করে এখানে নানা নৃবংশের আদিবাসী মানুষ আছেন যারা বাংলাভাষী জনসমাজের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর তেমন নিবিড় ও ব্যাপক যোগ স্থাপিত হয়নি। এইসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঘরে মাতৃভাষা ব্যবহার করলেও বাইরে কাজের জগতে বাংলাভাষা ব্যবহার করেন। এতে বাংলাভাষী মানুষের একটু শ্লাঘাবোধ হলেও বিষয়টি তেমন বাঞ্ছনীয় নয়। এইসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা স্থাপন করতে হলে এবং তাঁদের পরিপূর্ণ আস্থা অর্জন করতে হলে ভাষা ও সংস্কৃতির স্তরে তাঁদের সঙ্গে আদান-প্রদানের সম্পর্ক তৈরি করাই বাঞ্ছনীয়। আর এক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান নানা দিক থেকে সাহায্য করবে।
আগেই বলেছি, পশ্চিমবঙ্গে এখন বহুকালিক ভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে উপভাষাবিজ্ঞানের মতো এককালিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাও সামাজিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গে [এমনকি বাংলাদেশেও] বাংলা কথ্য উপভাষা নিয়ে কোনো ব্যাপক কাজ হয়নি, যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন ও বিকীর্ণ। দ্বিতীয়ত, উপভাষাচর্চার মধ্যে ভাষার আঞ্চলিক শাখাই হচ্ছে উপভাষা—অর্থাৎ উপভাষা ভাষার চেয়ে ছোটো—এই ধরনের একটি ভ্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণা বলবৎ থাকায় উপভাষাচর্চার অনেক জায়গায় বৈজ্ঞানিকতার অভাব ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রেই গবেষকরা উপভাষার বৈশিষ্ট্য দেখাতে গিয়ে মান্য চলিত বাংলার সঙ্গে তুলনা করে তার বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। এটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত তা ভেবে দেখার দরকার আছে। কাজেই সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাপকভাবে উপভাষাচর্চা শুরু করতে হবে। এ কাজ ব্যাপকভাবে করতে হবে, তার কারণ তার ফলে বিভিন্ন উপভাষার মধ্যে তুলনা করা সম্ভব হবে এবং কথ্য উপভাষাগুলি যে বাংলা ভাষার বিচিত্র ঐশ্বর্যের প্রকাশ তা উপলব্ধি করে উপভাষা সম্পর্কে ভ্রান্ত ঔপনিবেশিক ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে ভাষাতাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতাবাদকেওপ্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ODBL [১৯২৬] প্রকাশের বেশ কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন [১৯০৪] যে, বাংলা উপভাষাগুলির তুলনা করতে পারলেই বাংলা ভাষার বিকাশের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হবে। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের অমূল্য গবেষণাকার্যের অসামান্যতা স্বীকার করেও বলতে হয় ওই গ্রন্থে ভাষাতাত্ত্বিক পুনর্গঠনকে যতটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষাগুলির তুলনার উপর তেমন নির্ভর করা হয়নি। সেটা তখন করাও তেমন সুবিধাজনক ছিল না, কারণ অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের কাজের সময় বাংলা উপভাষার ক্ষেত্রভিত্তিক বিস্তৃত পরিচয় তেমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। এখন উপভাষার চর্চা তেমন ব্যাপ্তিলাভ না করলেও যেটুকু কাজ হয়েছে তাতে বেশ বোঝা যায় উপভাষাগুলির আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের মধ্যেই বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের অনেক অনালোকিত সূত্র নিহিত আছে। এই কারণেই বাংলা ভাষার ইতিহাস নতুন করে লিখতে গেলে বাংলা কথ্য উপভাষাগুলি নিয়ে আরও কাজ হওয়া দরকার।
উপভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে এখন সমাজভাষাবিজ্ঞানের চর্চাও ব্যাপকভাবে করা দরকার। কারণ উপভাষাচর্চায় ভাষার ভৌগোলিক বিন্যাসের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু পুরোপুরি সামাজিক ছবিটা তাতে ধরা পড়ে না। যেমন, কলকাতার উত্তর-পূর্ব এলাকার সল্টলেক বা দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক এলাকায় ধনী বসতির পাশাপাশি গরিব জনবসতি আছে। এই দুই বাংলাভাষী বাসিন্দাদের বসবাস একই ভৌগোলিক এলাকায় হলেও তাদের ভাষাব্যবহারে তফাত আছে। এই তফাতের কারণ ভৌগোলিক নয়, আর্থ-সামজিক। ভাষার এই আর্থ-সামাজিক বৈচিত্র্য ধরা পড়ে সমাজভাষাবিজ্ঞানচর্চায়। সামাজিক উন্নয়ন আমাদের আনুষ্ঠানিক সংকল্প হলেও বর্তমানে সরকারের দিক থেকে এ ব্যাপারে একটা সচেতন ও সক্রিয় প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে যা আগে ছিল না। আমরা তো জানি উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের সব মানুষকে আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্ত দিক থেকে উন্নয়নের একটা মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করা। কিন্তু আমাদের সমাজ নানাভাবে শ্রেণিবিভক্ত, তাই নানা ধরনের প্রান্তিকায়নের লক্ষণ আমাদের সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান। সমাজের এই প্রান্তিক অংশকে সমাজের কেন্দ্রীয় মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য চাই মানসিক স্তরে যোগাযোগের উন্নয়ন যা একমাত্র সর্বজনীন শিক্ষার মাধ্যমেই করা সম্ভব। দেশে জাতীয় স্তরে সার্বিক সাক্ষরতার কাজ শেষ হয়েছে, সর্বশিক্ষা অভিযানের কাজ এখনও চলমান। কিন্তু এ কাজে অসুবিধা হচ্ছে ভাষার ক্ষেত্রে। সাক্ষরতা ও সর্বশিক্ষার জন্য যেসব বই ব্যবহার করা হয় তার ভাষা বাংলা হলেও পশ্চিমবঙ্গের প্রান্ত-এলাকার বাঙালিদের মধ্যে ওইসব বই ব্যবহারে অসুবিধা হচ্ছে। সেই অসুবিধা যত না ভৌগোলিক তার চেয়েও বেশি আর্থ-সামাজিক। এই অসুবিধা দূর করতে হলে দরকার সমাজভাষাবৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রসমীক্ষা যা আমাদের কাছে সমস্যার স্বরূপ শনাক্ত করে সমাধানের পথও বাতলে দেবে। অথচ এই জরুরি কাজে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু পিছিয়ে থাকলে তো চলবে না, এগোবার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তার জন্য চাই উপযুক্ত অ্যাকাডেমিক পৃষ্ঠপোষকতা যা পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এই জন্য দরকার স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরে ভাষাবিজ্ঞানের পাঠক্রমে সময়োপযোগী নানা পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাস। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বা হিন্দির মতো ভারতীয় সাহিত্য বিষয়ের স্নাতক (সাম্মানিক) ও স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রমে ভাষাবিজ্ঞানের উপর একটি সাধারণ পত্র পড়া ও পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। এখানে জোর দেওয়া উচিত সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ভাষাটির ইতিহাস, সামাজিক বিস্তার ও সমবর্গীয় অন্যান্য ভগিনীস্থানীয় ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক বিচারের ওপর। এক্ষেত্রে সঞ্জননী-সংবর্তনী ভাষাতত্ত্বের মতো তত্ত্বভূয়িষ্ঠ ব্যাকরণের পাঠ ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষ পত্রের জন্য তুলে রাখলে সাধারণ পত্রের সামাজিক তথা ব্যাবহারিক উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য, সিলেবাসের এই পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাসের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা পরিকল্পিত সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। না হলে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচ্ছিন্ন প্রয়াস সামাজিক স্তরে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।