রানি মায়াবতীর অন্তর্ধান রহস্য
বেলা আটটা দশ।
একটু আগে চায়ের দোকানের ছেলেটা দু-জনের মতো ব্রেকফাস্ট, চা টোস্ট আর ডবল ডিমের অমলেট এনে খাইয়ে গেছে। টেবিলের ওপর খালি কাপ-ডিশ দুটো পড়ে রয়েছে তার সাক্ষী হয়ে। পাশে নুন আর মরিচ গুঁড়োর সুন্দর শিশি দুটো। এ দুটো টি. সি.র কেনা। তা কেনাকাটার কাজটা টি. সি. ই করে। আর ছোটোখাটো জিনিসের ব্যাপারে সেবেশ একটু শৌখিন। চায়ের দোকানের ছেলেটা অবশ্য নুন মরিচ আনে, কিন্তু ওদের সেই ফুটো বুজে আসা শিশি থেকে ঝেড়ে ঝেড়ে বার করতে ধৈর্ম থাকে না। টি. সি.-র তো নয়ই। তাই নিজেদের স্টকে রেখেছে জিনিস দুটো!
তা ধৈর্যটা টি. সি. র সব বিষয়েই একটু কম। এই যেমন নীচে থেকে ছুড়ে দেওয়া রবার ব্যাণ্ড মোড়া খবরের কাগজের প্যাকেটটা বারান্দায় এসে পড়ার শব্দটি শোনামাত্রই টি. সি. সেটা দু-পা হেঁটে কুড়িয়ে নিয়ে যায় না, ঘর থেকেই একটা পাক মেরে বারান্দায় পা ফেলেই যেন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়।
এম. কে. বলে, অমন করে ছুটে যাস কেন রে টি. সি.? কেউ কি কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে?
টি. সি. তখন একটু হ্যাবলা হাসি হেসে বলে, তোর মতন আমি অমন ধৈর্য ধরতে পারি না বাবা!
আজও , নুন মরিচের শিশি দুটো তুলে রেখে খালি কাপ সরিয়ে টেবিলটা সাফ করবে বলে হাত লাগাতে যাচ্ছিল, ওই পাকানো কাগজটা এসে পড়ার ‘ঠক’ শব্দটা শুনতে পেয়েই এমন একখানা লাফ মারল যে, তার ধাক্কায় টেবিলটা নড়ে উঠে একটা কাপ ছিটকে মাটিতে গিয়ে পড়ল। কাপটা ভাঙল না, নেহাত অভঙ্গুর বলেই। নিজেরই হাত পায়ের ঠিক নেই বলে, টি. সি. নিজেই বুদ্ধি করে ‘আনব্রেকেবল’ কাপ-ডিশ কিনেছে।
ভাঙল না তবু পড়ল তো। টি. সি. সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে রোল করা কাগজ দুটো কুড়িয়ে এনে, ফস করে রবার ব্যাণ্ডটা টেনে খুলে ফেলে দিয়ে, ইংরেজি কাগজখানা এম. কে-র দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে বাংলাখানার ভাঁজ খুলে ফেলে প্রথম পাতায় চোখ না বুলিয়ে ভেতরের একটা পাতার ওপর চোখ রাখে।
সবই ঘটে গেল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই।
যে পাতাটায় চোখ ফেলল, সেটা হচ্ছে, ‘শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপণ’-এর কলাম। টি. সি.-র চোখে—‘বাড়ি জমি ফ্ল্যাট! ক্রয় বিক্রয় ভাড়া।’
‘দৈনিক লোকবার্তায়’ এই বিজ্ঞাপনগুলো বেশ বেশি থাকে।
টি. সি. আর এম. কে’র ঢাকুরিয়ায় এই ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট ফ্ল্যাটটি অন্য সব দিক দিয়ে খুবই ভালো। সুবিধেরও। অসুবিধে হচ্ছে, বড্ড ছোট্টো। মাত্র একখানি ঘর। আর ‘ড্রয়িং কাম ডাইনিং’ নামের যে অংশটুকু, সেএকটি ‘সোফা কাম বেড’-এর মাপেই প্রায়। সেখানে এদের সুটকেস, বাক্স, বাড়তি জুতোরা।
‘বসবার ঘর’ একটা বিশেষ দরকার। নিজেদের বসবার জন্যে নয়, অন্যদের বসাবার জন্যেই। আর সেই অন্য লোকেরা হচ্ছে একদম বাইরের লোক। তাদেরকে নিজেদের শোবার ঘরে বসাতে বেশ অস্বস্তি লাগে। শুধু তো শোবার ঘরই নয়, খাওয়া, বই পড়া, নিজস্ব ‘কাজ’ টাজ করা। সব কিছুই। কী আছে, আর কী নেই এ ঘরে?
কাজেই ক্লায়েন্ট এলে বসানোর অসুবিধে। বারান্দাটায় অবশ্য বসার জায়গা হিসেবে একটু ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়, কিন্তু যারা আসে, তারা ‘কোথাও থেকে কেউ কিছু শুনতে পাবে না’ আশ্বাস পেলেও, খুঁত খুঁত করে। দরজা ভেজালে ঘরে চুপিচুপি কথা বলতেই পছন্দ করে।
তাই এই ‘বাড়ি জমি ফ্ল্যাট’-এর কলম-এ দেখা।
সুবিধামতো একটা ফ্ল্যাট যদি ভাড়া পাওয়া যায়। এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে ফেলতে মন নেই এদের। বিশেষ করে টি. সি. র। সেবলে, অমন চিন্তা মনেও আনিসনি এম. কে.। এই ফ্ল্যাটখানা আমাদের পয়মন্ত। তা ছাড়া অন্য সবদিকেই সুবিধে। এমন হাতের কাছে চায়ের দোকান, ভাতের হোটেল আর কোথাও পাবি, তার গ্যারান্টি আছে?
এখন আর টি. সি. ‘গেরান্টি’ বলে না। এম. কে.-র তাড়া খেয়ে খেয়েই শোধরাচ্ছে। ইংরেজি বলার ভারি শখ টি. সি.-র। এম. কে. ভুলে টুলে ‘মক্কেল’ বলে ফেললে, টি. সি. তাকে আক্কেল দেয়, ‘মক্কেল মক্কেল’ করবি না বলছি। কেন ‘ক্লায়েন্ট’ বলতে কী হয়?
এই যে বাংলা ইংরেজি দুখানা কাগজ নেওয়া হয়, সেও ওই টি. সি.-র শখে কারণ ওর মতে ক্লায়েন্টরা এসে ঘরে একখানা ইংরেজি কাগজ না দেখলে প্রেস্টিজ থাকে না! তবে ইংরেজি কাগজখানাকে কিছু কিছু পড়ে ফেলতে হলেও, পুরো দিনটা লেগে যায়। আহা কবে যে এম. কে.-টার মতো গড়গড়িয়ে পড়ে ফেলতে পারবে। তবে পারবে ঠিকই। এ আত্মবিশ্বাস তার আছে। আপাতত সেহুমড়ে পড়েছে দৈনিক লোকবার্তার ওই ‘বাড়ি ও ফ্ল্যাট’-এর কলমে। কিন্তু আজকাল আর বাড়িটাড়ি ভাড়া দিতে কেউ তেমন উৎসাহী নয়। সব খবরই ‘ওনারশিপ’এর। …সেদিন তো একজন দালাল বলেই দিল, বাড়ি ভাড়া দেওয়া ,আর ব্রাহ্মণকে দান করে ফেলা একই কথা দাদা। জন্মের শেষে হাতছাড়া। ভাড়াটে মরে গেলেও বাড়ি ছাড়ে না, শুনে থমকে উঠেছিল, টি. সি. অ্যাঁ। ভূত হয়ে আগলে বসে থাকে নাকি?
দালাল অমায়িক হেসেছিল, ভূত বললে, ভূত, ভবিষ্যৎ বললে ভবিষ্যৎ। ছেলেপুলে নাতিপুতিকে রেখে দিয়ে যায় শেকড় গাড়িয়ে। তেমন কেউ না থাকলে ভাইপো ভাগনেকেও।
তার মানে, কেনার কথাই ভাবতে হবে।
কিন্তু সেতো আর চারটিখানি কথা নয়।
চোখ বুলোতে বুলোতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে টি. সি. মদনা! পেয়ে গেছি। বেশি আবেগের সময়, মদনা বলে ডেকে না ফেলে পারে না ট্যাঁপা।
কী পেয়েছিস?
ভাড়াটে ফ্ল্যাট একটা। ঠিক যেমনটি চাইছি আমরা। ‘বড়ো বড়ো দুইখানি!—
আচ্ছা শুনছি। তো, তোর লোকবার্তায় এ খবরটা বেরিয়েছে? দেখ তো।
কোন খবর? …‘দুইখানি ঘর ও দালান—সামনে বারান্দা’— হ্যাঁ কী বললি কোন খবর?
এই যে— ‘‘পাথরগুড়ির রাজপ্রাসাদ থেকে রানি মায়াবতী—’’
ও হ্যাঁ হ্যাঁ। পেয়ে গেছি—‘‘রহস্যময় অন্তর্ধান। পাথরগুড়ির প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ‘মণিমঞ্জিল’ হইতে, অকস্মাৎ বিরানব্বই বৎসরের বৃদ্ধা রানি মায়াবতী আশ্চর্যভাবে নিরুদ্দেশ। জীর্ণ প্রাসাদে তখনও লোকসংখ্যা শতাধিক। কেহই কিছু বলিতে পারিতেছে না। নিকট আত্মীয়ের মধ্যে তাঁহার পৌত্র রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণ, অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং এম. এল. এ.। …পিতামহীর এই অন্তর্ধানে তিনি দিশাহারা। অনুসন্ধান চলিতেছে।’’
কেসটা সত্যিই রহস্যের, তাই নয় রে ট্যাপা? অত বুড়ি অত লোকের মাঝখান থেকে নিরুদ্দেশ হল কী করে?
ট্যাঁপা বলে, শুনি যে, এখন আর কোথাও ‘রাজা রানি’ বলে কিছু নেই। তবু দেখি যেখানে সেখানে রাজাও আছে রানিও আছে। ওই পাথরগুড়িটা আবার কোথায়?
নর্থ বেঙ্গলে। ওখানে তো যত ‘গুড়ি’র ছড়াছড়ি। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি— এটা হচ্ছে পাথরগুড়ি।
তো হ্যাঁরে, বুড়িকে কেউ খুন করে গুম করে ফেলেনি তো? ‘রানি’ যখন, তখন কিছু না কিছু টাকাকড়ি সোনাটোনা হিরে মুক্তো থাকতেই পারে। তো লোভী আর পাজি লোকের তো অভাব নেই জগতে।
খুন করা, গুম করা কি সহজে সম্ভব! ভেবে দেখ গরিব গেরস্ত লোকের বাড়িতেও অত বুড়িদের কাছাকাছি একটা দাসী থাকে। আর এ হল গিয়ে যতই হোক ‘রানি’! দুটো একটা অন্তত আয়াও ছিল দিনেরাতে সর্বদা কাছে থাকতে।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, তাদের মধ্যেই কাউকে হাত করে বিষ দিয়ে হাপিস করে ফেলা যায়। তুইই তো বললি জগতে লোভী আর পাজি লোকের অভাব নেই।
সেতো নেইই। হাপিস করে ফেলাও কোনো প্রবলেম নয়। সামান্য কিছু টাকার লোভেও, ওই সব লোক তা করতে পারে! কিন্তু কথা হচ্ছে—লাশটা হাপিস করবে কী করে? তিনমহলা প্রাসাদ, অত লোকের মধ্যে থেকে একটা লাশ হাপিস করা সম্ভব? কেউ না কেউ দেখে ফেলবে না? সকলেই তো লোভী আর খারাপ নয় যে ষড়যন্ত্রে যোগ দেবে।
তাহলে বাড়ির মধ্যেই কোথাও পুঁতে ফেলতে পারে। পুরোনো রাজবাড়ি, বাগান তো থাকতেই পারে।
তোর মাথায় অবশ্য অনেক চিন্তা আসে টি. সি., কিন্তু ভাব— এম. কে. বলে, মানুষটি কে? ‘রানি মায়াবতী’! সেমানুষ কতক্ষণ বেওয়ারিশ পড়ে থাকবে, তাই অতসব সম্ভব। তা ছাড়া এখন রাজাটাজার মহিমা না থাকলেও, দেখলি তো নাতিও একটি বিশিষ্ট লোক। মফসসল অঞ্চলে একজন এম. এল. এ.-ও কেওকেটা। সেই লোক বুড়ি ঠাকুমাকে হারিয়ে দিশেহারা। তার মানে ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসে। সেকি আর ঠাকুমার জন্যে বেশি বেশি কেয়ার নেয়নি?
ট্যাঁপা হঠাৎ রেগে উঠে বলে, তা নিত তো নিত। তাতে আমাদের কী? এ কি আমাদের কেস? তাই তা নিয়ে আমাদের দামি মাথাদুটো ঘামাতে হবে? কোথায় কোন কাঠগুড়ি না হামাগুড়ির একটা বুড়ি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে,তাকে নিয়ে এত ডিসকাশান করে ফালতু সময় নষ্ট কী জন্যে? যেটা বেশি দরকারি যা নিয়ে তোকে বলতে যাচ্ছিলুম—
এম. কে. অবাক হয়, কোনটা?
চমৎকার! ভুলেই মেরে দিলি? বললুম না ঠিক আমরা যেমনটি চাইছি, তেমনটি। দেখ না ফ্ল্যাটভাড়া! …একতলায় বড়ো রাস্তার ধারে। দুইখানি বড়ো বড়ো ঘর, দালান রান্নাঘর স্নানের ঘরসহ! বিশদ সন্ধানের জন্য নীচের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।… সাক্ষাতের সময়—রবিবার বাদে সকাল আটটা হইতে সাড়ে দশটা। ঠিকানাটা দেখছিস? ভবানীপুরে হরিশ মুখার্জি রোড। আমাদের যেতে যেতেই—আর গিয়েই বা কী হবে! এতক্ষণে হয়তো ভাড়া হয়েই গেল। সব পাড়া আমাদের মতন নয়। অনেক পাড়ায় খুব ভোরবেলাই কাগজ এসে যায়। আর এ খবর তো মাছিদের কাছে গুড়ের কলসি ভেঙে যাওয়ার মতো।
কত ভাড়া, তা লিখেছে?
বিজ্ঞাপনে সেটি খুলে বলে নাকি?
এম. কে. একবার হাত উলটে ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে, কত বললি? সাড়ে দশটা না? হয়ে যাবে। একটা নয় অটো নিয়ে নেব। তবে মনে হচ্ছে খুব পুরোনো বাড়ি।
হাত গুনলি?
না, ওই যে বলেছে, ‘দালান’। রান্নাঘর ভাঁড়ার ঘর আজকাল আর ওসব কেউ বলে না। থাকেও না। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ঘর। নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে আজকাল কেউ বড়ো বড়ো ঘরও করে না। অবশ্য পুরোনো হলেই যে—কী হল? যাবি না? এখন আবার টেবিল সাফ করতে বসলি? এসে হবে।
ঘরটা এইভাবে রেখে যাওয়া হবে? জাস্ট দু-মিনিট। দেখ না-তুই তো আমায় কিছু করতে দিবি না। সব একা করবি।
তুই করতে বসলে দশ মিনিট,আমি করলে দু-মিনিট! এই তো হয়ে গেল। বলেই ট্যাঁপা আলনা থেকে প্যান্ট আর শার্টটা হাতে নেয়।
এম. কে. বলে সকালে যে কেন ওই লুঙ্গিটা পরিস।
কাজ করার সুবিধে হয় রে—তুই ততক্ষণ চুলে চিরুনি লাগা না, আমি এলাম বলে,—
বলেই যেই বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়েছে, ফ্ল্যাটের দরজায় জোর শব্দে বেল বেজে ওঠে।
হল তো! …ট্যাঁপা বলে, বেরোনোর বারোটা বাজিয়ে দিল। যাই রক্ষে ঘরটা ঠিক করে নেওয়া হয়েছে। এইজন্যেই আলাদা একটা ঘর—তুই দোর খুলে ওকে এক মিনিট আটকা—
বলে চলে যায় বাথরুমে সাজ বদলে নিতে।
ততক্ষণে আর একবার বেল।
এম. কে. এগিয়ে যায়। তবে ধীরেসুস্থে।
সম্পূর্ণ অচেনা, একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক। চেহারায় একটু উশকো খুশকো ভাব। মনে হচ্ছে রাতে ঘুম না হওয়া, সকালে স্নান না করা চেহারা।
এটাই কি ‘যুগলরত্ন’ অফিস?
অফিস বললে অফিস! চেম্বার বললে চেম্বার।
‘যুগলরত্ন’ মানে, দু-জন তো? আমি তাঁদের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
একটি রত্নের দেখা পেয়েই গেছেন—আর একটির দেখা— এই পেলেন। বলে পেছনে এসে দাঁড়ায় ট্যাঁপা। একদম ফ্রেশ হয়ে। একদম ঝকঝকে পোশাক, চুল পরিপাটি।
ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বলেন, আচ্ছা এঁরা ডিটেকটিভ তো?
তাই বলতে পারেন।
তাহলে? আপনারাই কি?
আমরাই।
ভদ্রলোক আরও ইতস্ততভাবে বলেন, আমি ভেবেছিলাম—
ট্যাঁপা ফস করে বলে ওঠে, বেশ জাঁদরেল গোছের ব্যাপার। কেমন? হতাশ হলেন?
এম. কে মনে মনে ঠোঁট কামড়ায়। তাড়াতাড়ি বলে, আসুন, ভেতরে আসুন।
ভেতর বলতে, অবশ্যই সেই একমেবাদ্বিতীয়ং ঘরটি।
এম. কে. দেখে অবাক হয়ে যায়, ইতিমধ্যেই ট্যাঁপা দুজনের—নেওয়ারের খাট দু-খানার ওপর দু-খানা নতুন কেনা সুন্দর বেডকভার পেতে ঘরের চেহারা ফিরিয়ে ফেলেছে।
ইস। ছেলেটার এত গুণ। শুধু বাইরের লোকের সামনে যদি একটু কম কথা বলত।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এদিকে ওদিক তাকিয়ে বলেন, একটু ভেতরদিকের কোনো ঘরে বসলে হত! আমার একটু গোপনীয় কথা ছিল। মানে একটু বিশেষ প্রাইভেসি চাইছিলাম।
ট্যাঁপা দরাজ গলায় বলে, এ বাড়িতে বাথরুম ছাড়া এর থেকে বেশি প্রাইভেসি পাবেন না। ভেতরে কোনো ঘরটর নেই।
এম. কে. কড়াচোখে তাকায়। কিন্তু যার দিকে তাকায় সেতখন—অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে দরজার কাছে পাপোশটা বাঁকামতো হয়ে রয়েছে।
ভদ্রলোক তবুও সভয়ে বলেন, কেউ এসে পড়বে না তো?
আমরা দু-জন ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। থাকে না।
মনা আবার সেইরকম তাকায়। তারপর তাড়াতাড়ি বলে, বলুন।
বসেন ভদ্রলোক। তারপর বলেন, দেখুন আমি খুব বিপদে পড়ে—
ট্যাঁপার হঠাৎ মনে পড়ে যায়—তার সংকল্প বাইরের লোকের সামনে বেশি কথা বলবে না। তাই চুপ করে যায়।
মদনাই বলে, বিপদে ছাড়া আর কে আমাদের কাছে আসে বলুন? তো আসছেন কোথা থেকে?
ইয়ে অনেকটা দূর থেকেই— নর্থ বেঙ্গল থেকে।
নর্থ বেঙ্গল শুনেই দুই বন্ধু উৎফুল্ল হয়ে নড়েচড়ে বসে। এইমাত্র না কাগজে এই নর্থ বেঙ্গলেরই একটা ঘটনা পড়া হল! ব্যাপার কী।
ভদ্রলোক গলার স্বর নামিয়ে বলেন, আমি ওখানের পাথরগুড়ির রাজবাড়ির পুরোনো আমলের ম্যানেজার। ওখানে অবশ্য আগেকার কালে ‘দেওয়ানজি’ বলা হয়। সেযাক। রাজত্ব বলে কিছু নেই, রাজা নামটি আছে। তো সেখানেই সম্প্রতি একটা ঘটনা ঘটায়—
এরপরও ট্যাঁপা মুখে তালাচাবি দিয়ে থাকবে? বলে উঠবে না, ‘রানি মায়াবতীর অন্তর্ধান’ তো?
ভদ্রলোক থমকে উঠে বলেন, কী করে জানলেন?
এম. কে. একটু হেসে বলে, চমকাবার কিছু নেই। জ্যোতিষের ব্যাপার নয়। যে সোর্স থেকে পৃথিবীর সব খবর জানা যায় সেইখান থেকেই। আজকের কাগজেই বেরিয়েছে—এই যে দেখুন না। বলে টেবিল থেকে কাগজখানা নিয়ে খুলে ধরে।
ভদ্রলোক হতাশ গলায় বলেন, অথচ আমি দপ্তরের কর্মচারীদের বিশেষ করে নিষেধ করেছিলাম, ঘটনাটা এখুনি হই হই করে পাবলিককে না জানাতে। আর এ কিনা রাজ্যসুদ্ধু ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া।
এম. কে. বলে, কিন্তু বারণ করার কী দরকার? বৃদ্ধা মহারানির হঠাৎ অন্তর্ধান, এ তো তোলপাড় করে খোঁজারই কথা।
ভদ্রলোক ম্লানভাবে বলেন, সাধারণভাবে সেটাই ঠিক। কিন্তু রাজারাজড়ার ঘরে অন্য ব্যাপার। মান সম্মানের প্রশ্ন।
ট্যাঁপা আবার সরব। হেসে উঠে বলে, এর আবার মান সম্মানের কী আছে? সুন্দরী রাজকন্যে তো হারিয়ে যায়নি। নব্বুই বছরের এক বুড়ি—
ভদ্রলোক বলেন, বিপদ তো সেখানেই। রহস্যও। শক্তপোক্ত কেউ হত, ভাবা যেত নিজেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু যে মানুষ চলাফেরা করতে পারেন না। তা সেই বিষয়েই একটু…
এম. কে. তখন বলে, কিন্তু তার আগে বলুন তো, ব্যাপারটা কী? আমরা এই দুই বন্ধু পাকেচক্রে গোয়েন্দা হয়ে বসেছি বটে, তবু এমন কিছু রাজ্যজানিত লোক নয়। পরিচয় তো নিজেরাই দিয়েছি, দেখলেন ‘যুগলরত্ন টিকটিকি’। তো সেই নর্থ বেঙ্গলে সামান্য দুটো টিকটিকির নাম পৌঁছোল কী করে? তাও আবার রাজবাড়িতে।
ভদ্রলোক একটু পিঠ সোজা করে বসেন। বলেন, তাহলে আসল ব্যাপারটা খুলে বলতে হয়। সেতো অনেক কথা।
কিন্তু অনেক কথা না বলে তো উপায়ও নেই। যদি অবশ্য আমরা আপনার কোনো কাজে লাগি। ডাক্তারের কাছে, উকিল ব্যারিস্টারের কাছে, আর ডিটেকটিভের কাছে, সব কিছুই খুলে বলতে হয়। কিছু চাপতে যাওয়া মানেই নিজেরই ক্ষতি করা। এটা অসম্ভবই বলা চলে, আপনার হঠাৎ আমাদের মতো অজানা অচেনা তুচ্ছ গোয়েন্দার কাছে আসা। কী সূত্রে এলেন এটা তো আগে শোনা দরকার। জানেন তো গোয়েন্দাদের প্রথম কাজই হচ্ছে সক্কলকে সন্দেহ করা। কিন্তু সব আগে আপনাকে একটু চা-টা না খাওয়াতে পারলে—তো…
ট্যাঁপার দিকে তাকায়। অর্থাৎ চায়ের দোকানটায় একটু জানান দে।
…বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু হাতছানি দিয়ে ডাকলেই—চায়ের দোকানের ছেলেটা চলে আসে। এরা যাকে আদর করে নাম দিয়েছে ‘দন্তমানিক’। এরকম এরা করেই থাকে মাঝে মাঝে। বাড়িতে তো চায়ের পাট নেই। অথচ অতিথি আসে।
কিন্তু বলামাত্রই ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, না না! আমি সারারাত ট্রেনে আসছি স্নান করা হয়নি বাসি কাপড় বদলানো হয়নি, আমার এখন একফোঁটা জল খাওয়াও চলবে না। বুঝতেই তো পারছেন সেকেলে মানুষ, এসব নিয়ম আবার মেনে চলা অভ্যাস।
তাহলে আর কী করা। কিন্তু আপনার নামটা তো এখনও জানা হয়নি।
আমার নাম! নাম রঘুনাথ ভট্টাচার্য! আসল বাড়ি কলকাতায়। কিন্তু আজ পঞ্চাশ বছর ওই নর্থ বেঙ্গলে। জীবন কেটে গেল ওই রাজবাড়িতেই।
ওখানে আপনার ফ্যামিলিও? মানে ছেলেমেয়ে—
ছেলেমেয়ে? না বাবা সেসব কিছু নেই। সংসার টংসার করবার সময়ই হয়ে ওঠেনি। …মা বাপ ছিল না, কাকা জ্যাঠারা তেমন— সেযাক বলতে গেলে প্রায় বালক বয়েসেই স্রেফ ভাগ্যান্বেষণেই কলকাতা থেকে ছিটকে চলে গিয়ে এখান সেখান ঘুরে ওই পাথরগুড়ি রাজবাড়ির দেউড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। সেই অবধি ঢুকেই আছি। তারপর কাজে কাজে কোথা দিয়ে যে জীবনটা পার করে এলাম। প্রথম দিকে রাজবাড়িতে খুব বোলবোলাও দেখেছি। মহারাজা, মানে এই রানি মায়াবতীর ছেলে রাজা হারীন্দ্রনারায়ণ ছিলেন দুর্দান্ত ধরনের। হাতি শিকার ছিল তাঁর একটা প্রিয় শখ। আরও কত কী শখই ছিল। আমাকে তাঁর বেশ পছন্দ ছিল, বছর আষ্টেকের বড়ো ছিলেন আমার থেকে। তবু সব ব্যাপারে আমাকে সহকারী করতেন। আবার সেরেস্তার ভারও আমায় দিয়ে বসেছিলেন। তা তিনি তো কবেই মারা গেছেন। খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে আসতে, ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে। তাঁর বিধবা স্ত্রী রানি পুষ্পলতাও অকালে চলে গেলেন। এখন যিনি রাজা, জীবেন্দ্রনারায়ণ তিনি হচ্ছেন রানি মায়াবতীর নাতি! অতিভালো ব্যক্তি। বছর চল্লিশ বয়েস। স্থানীয় লোকেদের খুব প্রিয় পাত্র। গেলবারের নির্বাচনে এম. এল. এ হয়েছেন—
ট্যাঁপা উশখুশ করে বলে ওঠে, কিন্তু আমাদের খবরটা জানলেন কোথা থেকে সেটা তো—
ওঃ। দেখছেন তো—কথায় কথায়—কিন্তু বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে এসে আপনাদের কাজের কোনো অসুবিধে ঘটাচ্ছি না তো?
রাজবাড়ির মানুষ। আদব কায়দাটি জানেন ভালো।
সেকিছু না, আপনি বলে যান।
দেখো বাবা—ইয়ে দেখুন—
এরা বলে ওঠে, থাক থাক আপনি আমাদের তুমি করেই বলুন। বয়স্ক মানুষ, আপনি বলছিলেন, অস্বস্তিই হচ্ছিল।
তাহলে তাই-ই বলি। কথা বলার সুবিধে। তাহলে বলি আসলে ডিটেকটিভের কাছে আসব এমন কোনো মতলব নিয়ে আমি কলকাতায় আসিনি। এসেছিলাম অন্য উদ্দেশ্যে।… এই যে তোমাদের বাড়ির সামনাসামনি এক জ্যোতিষী ঠাকুরের বাড়ি রয়েছে. দেখেছ তো নিশ্চয়। মহাযোগী মহাসাধক মহাজ্যোতিষী শ্রীভার্গবাচার্য—
ওরা হেসে ওঠে, সারাক্ষণই দেখছি। অতবড়ো সাইনবোর্ড।
তা তো দেখবেই। সামনাসামনিই তো—তো উনি এখন আর কোনো কাজ করেন না, তা শুনেছ?
ট্যাঁপা, মদনা দু-জনে চোখ চাওয়াচায়ি করে বলে, করেন না বুঝি?
না। বাড়ির লোক তো তাই বলল। অথচ ওঁর আশাতেই চলে এসেছি—আসলে উনি শুধু জ্যোতিষীই নন, একজন মহাসাধকও। উনি হচ্ছেন আমার এক সম্পর্কের ভাগনির গুরুদেব। যখনই কোনো কাজ পড়ে কলকাতায় আসতে হয় ওই ভাগনির বাড়িতেই উঠি। ‘মামা’ বলে খুব ভক্তি যত্ন করে। তো তার মুখেই এঁর বিষয় শুনেছি। ভাগনি তো ওঁকে দেবতার মতো মনে করে। তো রানিমার হঠাৎ নিরুদ্দেশে যখন ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সবাই সহসা এঁর কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল একবার গণনা করিয়ে দেখলে কী হয়। ভাগনি যেমন বলে, তাতে তো মনে হয়েছে সঠিক বলে দিতে পারবেন—এই নিরুদ্দেশের কারণ কী, এখন কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না। তা আমার অদৃষ্ট। বাড়িতে বলল, মস্ত একটা অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে উনি আর কাজ করেন না।
কিন্তু তার পরের ব্যাপারটা কী? …ট্যাঁপার অধৈর্য প্রশ্ন, আমাদের খবরটা জানলেন কোথায়।
সেই কথাই তো বলছি বাবা! ওঁর একটি ভাইপোই বোধ হয়— ওঁর কথায় বলল তো ‘জেঠু’। তো একটু যেন ইয়ারমার্কা ছেলে। তবে আমাকে খুব হতাশ হয়ে পড়তে দেখে বলল, ‘জ্যোতিষ দেখিয়ে না হয় হদিশ পেলেন—কেন গেছেন, কোথায় আছেন।’ জ্যোতিষ তো আর খুঁজে বার করে হাতে এনে দেবে না। তার থেকে গোয়েন্দা লাগান কাজ হবে। তো সেই ছোকরাই তোমাদের কথা বলল। ওদের বাড়ির একটা দারুণ চুরির কেস-এর নাকি ফয়সালা করে দিয়েছ তোমরা। খুব সূক্ষ্ম বুদ্ধি। খুব লক্ষ। তা ছাড়া খুব ভদ্র। তোমাদের লাগাতে পারলে—তা সেই ছোকরাই তোমাদের এই সাইনবোর্ডও দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল সিঁড়ি দিয়ে উঠে, কোনদিকের দরজা। তবে তোমরা যে এমন ছেলেমানুষ গোয়েন্দা, তা বলে দেয়নি।
এখন আমাদের দেখে তেমন আস্থা আসছে না? কেমন?
না। না। সেকী। এটা কী বলছ? শ্রীভার্গবের বাড়ির লোক সার্টিফিকেট দিল। তা ছাড়া তোমাদের দেখে এখন বেশ ভালো লাগছে। তা ছাড়াও এই যে আমাদের ওখান থেকে এত দূরে, ওখানের কারুর কাছেই ফাঁস হয়ে যাবে না, এটিই চাই আমি। জ্যোতিষীর কাছে আসাও জানাইনি কাউকে। বলে এসেছি হঠাৎ ভাগনির অসুখের খবর পেয়ে—দেখতে আসছি। ওখানে সবাই জানে, আমার আপন বলতে ওই ভাগনিটি।
তাহলে কেসটা আপনি আমাদের হাতে দিতে চান?
নিশ্চয়। নিশ্চয়! সেতো একশোবার! রানিমার এই ব্যাপারে যে আমি কী মনের অবস্থায় আছি। শুধু তো হারিয়ে যাওয়ার চিন্তা নয়, আরও এক মহাবিপদ এসে পড়েছে, ওনার নাতি এখনকার মহারাজা রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের।
ট্যাঁপার প্রতিজ্ঞা ভেস্তে যায়। বলে ওঠে, ঠাকুমা হারানোই তো যথেষ্ট বিপদ, আবার বাড়তি কী?
বাড়তি কী জানো?…রঘুনাথ অকারণ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলেন, রাজবাড়ির সকলে এমনকী বাইরেও সকলেই ফিসফাস করছে—এই অন্তর্ধানের ঘটনাটি নাকি জীবেন্দ্রনারায়ণেরই ঘটানো।
অ্যাঁ।
সেই তো। …এই সন্দেহে ক্রমেই ছড়াবে বই কমবে না, যতক্ষণ না রানিমার কোনো সন্ধান মিলছে।
এম. কে বলে, কিন্তু এ ধরনের সন্দেহের কারণ কী? এতে ওই এখনকার মহারাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের লাভ কী?
দেখো বাবা, পৃথিবীতে কুটিল লোকের অভাব নেই। আর কুটিলদের মগজই হচ্ছে সবচেয়ে উর্বর।… কাজেই তাদের ধারণায়, ‘রাজাবাবু’ নাকি ওঁর ঠাকুমার এতদিন বেঁচে থাকার দারুণ চটে যাচ্ছিলেন—
বেঁচে থাকায় চটে যাচ্ছিলেন?
তাদের মতে তাই। আসলে উনি নামে ‘রাজাবাবু ’ হলেও এখনও পর্যন্ত সর্বস্বের সর্বাধিকারিণী হিসেবে সমস্ত কিছুতেই তো রানিমার নাম। তাঁর মত না নিয়ে বা তাঁর সই না নিয়ে কোনো সম্পত্তি বেচাকেনা চলবে না। অর্থাৎ রাজাবাবু কর্তা হয়েও কর্তা নয়। এদিকে বয়েস বেড়ে যাচ্ছে. কবে আর স্বাধীন হবেন? তাই কোথাও পাচার করে দিয়ে খুন করিয়ে ফেলার মতলব। এই ওদের বক্তব্য।
ট্যাঁপা ব্যঙ্গের হাসি হাসে। বলে, লোকে এইরকম একটা বোকাটে গল্প বিশ্বাস করছে? জীবেন্দ্রনারায়ণ তো শুনলাম একজন শিক্ষিত লোক। পলিটিকস করেন, তাঁর বুদ্ধি নেই? তিনি এরকম একটা হাঁদামার্কা ঝুঁকি নেবেন?
এম. কে. মনে মনে বলে, ট্যাঁপা রে! তোর যুক্তিটুক্তিগুলো তো ভালো, কিন্তু বাইরের লোকের সামনে এরকম বাজে ভাষায় কথা যে কেন বলিস? … মুখে বলে, তা সত্যিই বুদ্ধিমান লোক এমন কোনো কাজ করে না।
রঘুনাথ ম্রিয়মাণভাবে বলেন, সেকথা কে বোঝে? আসলে মানুষ জাতটা বড়ো হিংসুটে, বুঝলে? ওই যে উনি যে একটু বিশেষ বিশিষ্ট হয়েছেন, তাতেই অনেকে হিংসেয় ফেটে যাচ্ছে। তাই এমন কোনো গল্পও বিশ্বাস করতে চাইছে। … আর রাজবাড়ির মধ্যে যারা আছে? তাদের মধ্যে নিকট আত্মীয় বলে তো বড়ো কেউ নেই। জীবেন্দ্রনারায়ণের কোনো ভাইবোন নেই, একমাত্র ছেলে। বাপ জ্যাঠাও নেই, ওর বাবা হারীন্দ্রনারায়ণও ছিলেন ছেলে হিসেবে একমাত্রই। দু-জন বোন আছেন, জীবেন্দ্রর পিসিরা, তারা দূরে দূরে থাকেন, নিজেরাই যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। জীবনে আসেন না। রানি মায়াবতী মেয়েদের এই ব্যবহারে দুঃখ করেন এবং অভিমানে মেয়েদের কোনো সম্পত্তির ভাগ দেবেন না বলে উইল করে রেখেছেন।
সম্পত্তি আর কত? এই তো বললেন রাজত্বই নেই।
তা বটে। তাহলেও কী জানো বাবা? কথায় বলে, ‘বড়োগোলার তলা’। নেই নেই করেও দু-দুটো চা বাগান আছে, নর্থ বেঙ্গলের মধ্যেই নানা জায়গায় গোটাকতক বাড়ি আছে, তীর্থস্থান হিসেবে বেনারসে মস্ত বাড়ি আছে। যেখানে আগে আগে খুব যাওয়া হত সপরিবারে। …তা ছাড়া কালিম্পঙে বাড়ি। মংপুতে কিছুটা সিঙ্কোনার চাষের জমি। …যখন এসব সম্পত্তি করা হয়েছিল সামান্যই দাম ছিল। শিলিগুড়িতে যে বাড়িটা আছে, যেখানে গিয়ে ওঠা হয় যার যখন দরকার হয়। সেবাড়িটাও কেনা হয়েছিল মাত্র ছাব্বিশ হাজার টাকায়। এখন নাকি আড়াই তিনলাখ দাম। সেযাক, এখন তো সব কিছুই একশো গুণ দামি হয়ে উঠছে। শুধু মানুষের দামই নেমে যাচ্ছে। তা ওই যা বললাম, রাজবাড়িতে আপনজন বলতে কেউ নেই। থাকবার মধ্যে মাইনে করা লোক, আর আশ্রিতরা। যাদের কাজ হচ্ছে, যার খাব, পরব, আশ্রয়ে থাকব, তারই নিন্দে করব। …তাই তলে তলে এইটে রটিয়ে বসেছে। আর লোকে বিশ্বাস করে বসছে। সাধারণ লোক অন্যের নামের নিন্দেটা খুব সহজে বিশ্বাস করে।
এম. কে. বলে তাহলে প্রবলেম হচ্ছে দুটো? এক হচ্ছে রানি মায়াবতীর অন্তর্ধান, আর অন্যটা হচ্ছে তার নাতির ওপরই সন্দেহ ঘনীভূত হওয়া। তাই না?
ঠিক তাই। জীবেন্দ্রনারায়ণ এতে এত বেশি মুষড়ে পড়েছেন, যে ভাবনা হচ্ছে অসুখে টসুখে না পড়েন। ওঁর আবার একটা রাজনৈতিক দিক আছে। এ ধরনের প্রচারে তাতেও সুনামে কালি পড়বে। বিরোধী পক্ষ আহ্লাদে নাচবে।
ট্যাঁপা মনে মনে ভাবে, মদনা বলে, আমি বেশি কথা কই। আর এই বুড়ো? ধরলে কথা থামায় কে? এবং মদনার দিকে তাকিয়ে বলে, কিন্তু এম. কে. এঁনার তো নাওয়া খাওয়া হয়নি। জল পর্যন্ত না। এখন থামা দিলে হয় না? বাকি পরামর্শ না হয় পরে—
রঘুনাথ যেন একটু বর্তেই যান। তাই বলেন, কিন্তু আবার কোন সময় তোমাদের সময় হবে?
ট্যাঁপা তাড়াতাড়ি মদনাকে একটা ইশারা করে নিয়ে বলে, আচ্ছা আমাদের খাতাটা দেখে বলছি। এম. কে দেখো তো!
মদনা এই ইশারা বোঝে। দেখানো তো দরকার তারা খুব বিজি।
সেটেবিলের ড্রয়ার টেনে একখানা ডায়েরি বুক বার করে উলট পালট বলে, আজই বিকেলের দিকে তো হতে পারে। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে—তো সেরাত আটটার সময়। চারটে থেকে আটটা ফ্রি! …কালই বরং একেবারে ব্যস্ত।
বিকেলে, তাই বলছ? …আচ্ছা—এখনই তাহলে ভাগনিকে গিয়ে জানাই, যাতে বেশি রান্নাটান্না করতে বসে দেরি করিয়ে না দেয়।
ট্যাঁপা হঠাৎ দয়ার অবতারের মতো বলে ওঠে, আপনি বয়স্ক মানুষ, রাতে ট্রেন জার্নির ধকলে টায়ার্ড, আবার খেয়ে উঠেই ছুটে আসবেন? আমরা তো বিকেলে বেড়াতে বেরোই, বলেন তো আমরাই চলে যেতে পারি!
তোমরা? অ্যাঁ? সুবিধে হবে?
অসুবিধের কী আছে? ঠিকানাটা দিয়ে যান।
রঘুনাথ কৃতার্থ গলায় বলেন, ঠাকুরমশাইয়ের ভাইপোটি ঠিকই বলেছিল। অতিভদ্র। তা যদি যেতে পারো বাবা, তাহলে তো বেঁচে যাই।
সেবাড়িতে আপনার মনের মতো প্রাইভেসি আছে?
তা আছে। …রঘুনাথ প্রসন্নভাবে বলেন, ভাগনি বিধবা মেয়ে, ছেলেপুলে নেই, শুধু একটা কাজের মেয়ে নিয়ে বাস। …তা মেয়েটাকে ছুতো করে সরিয়ে দিলেই হবে। …আর ভাগনি? সেতো আমার নিজের মেয়ের অধিক। … তাহলে বলছ আমি এখন উঠব?
নিশ্চয়! নিশ্চয়! আপনার এখন নাওয়া খাওয়ার দরকার।
কী বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব বাবা!
এম. কে. হেসে বলে, এখন আর ধন্যবাদের কী হয়েছে? যদি আপনার কোনো কাজে লাগি, তখন দেবেন। এই যে—এই কাগজটায়—
রঘুনাথ চলে যাওয়ার পর এরা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখে ভদ্রলোক বেরিয়ে যেন নিজেকে টানতে টানতে খানিক এগিয়েই মোড়ের মাথায় একটা রিকশায় চড়ে বসেন। সত্যিই খুব টায়ার্ড।
ঘরে ফিরে আসতেই ট্যাঁপা বলে ওঠে, মদনা! জগতে ট্যাঁপা হতভাগাই শুধু বেশি কথা বলে, কেমন? বুড়োর বকবকানির বহর দেখলি?
তা দেখলাম।
বলে মদনা একটু হাসে।
আরও বকত। বলতে গেলে তা জোর করেই ভাগালাম। দেখছি অবস্থা কাহিল। সারারাত ট্রেনে এসেছে, এতবেলা অবধি নাওয়া খাওয়া নেই।…
বকবকানিতে আমাদের কিন্তু কিছু লাভ হল। ওর মধ্যে থেকেই সেই রাজবাড়ির অনেকখানি ছবি দেখতে পাওয়া গেল। তবে অবশ্য কাজটা আমাদের দেবেই, এমন সঠিক নিশ্চয়তা নেই। ভদ্রলোক তো ডিটেকটিভের সন্ধানে আসেননি, এসেছিলেন গনতকারের সন্ধানে। তো ওনার সেই ভাগনি না ভাইঝিটি যদি আবার নতুন কোনো গনতকার সাপ্লাই করে বসেন তাহলেই তো হয়ে গেল।
তা যা বলেছিস রে মদনা। ইয়ে এম. কে।
থাক না। সাবেক নামটাই না হয় চলুক এখন। বাইরের কেউ তো নেই।
বলছিস? ভালো। তা একটা মজার ব্যাপার দেখলি মদনা? শ্রীভার্গবের সেই মস্তান মার্কা ভাইপোটা আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে লোকটাকে ঠেলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাজ্জব।
মানুষ জাতটাই তাজ্জব রে ট্যাঁপা। …নইলে ভাব—
আবার বেল বেজে উঠল।
এই দেখো। আবার নতুন কোনো ক্লায়েন্ট নয় তো? আজ দিনটা দেখছি পয়মন্ত—বলে ট্যাঁপা দরজা খুলতে এগোয়।
তোর যে দেখছি, ভারি অহংকার বেড়ে গেছে। এক্ষুনি আবার নতুন ক্লায়েন্ট আসবে? হয়তো ওই ভদ্রলোকই আবার কিছু বলতে—
তা ঠিক তা না হলেও এম. কে.-র আন্দাজটা খুব ভুলও নয়।
তিনি না হলেও তাঁর সংক্রান্ত ব্যাপার। এসেছে শ্রীভার্গবের বাড়ির ‘কাজের ছেলেটা’। … হাতে একটা বাঁশের হ্যাণ্ডেল দেওয়া আদ্যিকাল মার্কা কালো ছাতা!
একগাল হেসে ছেলেটা বলে, একটা বুড়োমতন ভদ্দরলোক এয়েছে না এখানে? এইটাও বাড়িতে ফেলে এয়েছিল।
সেভদ্দলোক তো এই মাত্তর চলে গেলে।
চলে গেছে? অ্যাঁ? এখন উপায়?
উপায় আর কী? যেমন হাতে নিয়ে দোলাচ্ছো, তেমনি—দোলাতে দোলাতে ফেরত নিয়ে যাও।
ওরে বাবারে! তাহলে আর রক্ষে আছে? এই ছাতাই দাদাবাবু আমার পিঠে ভাঙবে।
ভাঙলে ভাঙবে। আমাদের কী?
ছেলেটা বলল, হায় হায়! নিজের দোষেই গো—বুড়ো যখনই চলে এল, দাদাবাবু তখনই বলল, ‘যা যা দিয়ে আয়।’ তো আমি ‘যাই যাই’ করে হাতের কাজ সারতে সারতে ভাবলাম বকবকুন্তুড়ে বুড়ো ও বাড়ি থেকে কি আর সহজে উঠবে? কাজগুলো সেরেই যাই।
এম. কে. বলল, তা তোমার আন্দাজটা নেহাত ভুল নয়। তিনি এতক্ষণই বকবকাচ্ছিলেন। এই মাত্তর গেলেন। কী আর করবে।
হেই দাদাবাবুরা এটা আপনাদের ঘরে রেখে দাও। যদি আবার আসে তো দিয়ে দিয়ো। আসবেই তো!
মদন ট্যাঁপার দিকে তাকায়। ট্যাঁপা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, আবার আসবেই একথা কে বলেছে?
আজ্ঞে, আপনারা তো ‘টিকটিকি’। ‘টিকটিকি’ পুলিশের কাছে কি আর একবার এসে কাজ মিটে যায়?
আমরা পুলিশ নই।
তা নামে না হলেন, কাজে তো? এলোপাথিয়ো ডাক্তার, হোমেপাথিয়ো ডাক্তার। লোকে তারে গণ্য করে না বলে কি আর তাদের চিনির গুলিতে কাজ হয় না? খুব কাজ হয়। আমার তো সেবার অ্যায়সা পেট ব্যথা—ডাক ছেড়ে কাঁদছি—
ট্যাঁপা বলল, তুমিও তো কম বকবকাচ্ছ না! যাও বাবা তোমার ছাতা নিয়ে সরে পড়ো।
দাদাবাবু ছাল ছিঁড়ে নেবে।
নিলে নেবে। দোষ করলেই শাস্তি আছে।
আপনি তো বাবু খুব নিষ্ঠুর। …তো আপনারাই তো আমাদের বাড়িতে দাদুর ঠাকুরঘরে চুরির চোর ধরলে তখন তো এমন দেখি নাই।
তখন দেখোনি, এখন দেখো। ওই বিটকেল ছাতাটা আমাদের এখানে রাখব কোথায়? তোমাদের পেল্লায় বাড়ি। একশোটা ইঁদুর বেড়াল ছুঁচো ব্যাং আশ্রয় নিয়ে দিব্বি লুকিয়ে থাকতে পারে। ওটাও থাকবে।
তা যা বলেছেন। আছেও । তবে এটা নিয়ে বিপদ। দাদাবাবু দেখতে পেলে—
এম. কে. বলে তবে না হয় রেখেই যাও। এত যখন ভয়!
ট্যাঁপা চোখ পাকিয়ে বলে, কোথায় রেখে যাবে শুনি?
ও আর কোথায় রাখবে? আমিই খাটের তলায় টলায় কোথাও— ছেলেটা আবার একগাল হেসে ছাতাটা দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে যায়।
দরজাটা বন্ধ করে ফিরে আসতেই, ট্যাঁপা বলে, তোর দেখছি বড্ড মায়া। বুড়ো আর আসবে?
আরে আমরাই তো যাব আজ বিকেলে।
কী? ওই তেঠেঙে কেলেকুচ্ছিত ছাতাটাকে হাতে করে বাসে উঠতে হবে? আমি তাহলে যাব না। তুই একা যাস!
আরেব্বাস! তুই তো বেশ বাবু হয়ে উঠেছিস রে ট্যাঁপা।
ট্যাঁপা গম্ভীর হয়ে বলে বাবু নয়। সভ্য সুন্দর হবার চেষ্টা করছি।
কিন্তু ছাতাটাকে ঘরে নিয়ে এসে এম. কে. যে আরও কিছু তথ্য আবিষ্কার করে ফেলল। ছাতাটা একবার খুলে দেখতে গিয়েই তার মধ্যে থেকে টুপ করে পড়ল আর কী একটা কাজ! একটা ট্রেনের টিকিট। যেটাতে রঘুনাথ গতকাল শিলিগুড়ি থেকে হাওড়া এসেছে। সেকেণ্ড ক্লাস টিকিট! অনেকের এমন অভ্যাস থাকে ছাতা মুড়ে রাখার পর টুকটাক কিছু কাগজপত্র কী রুমালখানাও তার খাঁজে ফেলে রাখে।
এম. কে. বলল, টি. সি. একটা জিনিস দেখলি? রাজবাড়ির দেওয়ানজি, কিন্তু রেল গাড়িতে থার্ডক্লাসে। এখনকার ভাষায় অবশ্য ‘সেকেণ্ড’, তা যাই হোক। লোকটা মিতব্যয়ী। ছাতাটাও দেখছিস? দু-জায়গায় তালিমারা। কালো ছাতায় সাদা তালি! দেখে লোকে হাসবে তা খেয়াল নেই।
টি. সি. বলল, রঘুনাথবাবু বললেন তো পাথরগুড়ি। অথচ টিকিট তো দেখছি শিলিগুড়ি থেকে।
ওখানেও তো রাজাদের বাড়ি আছে বললেন। সদর জায়গা, হয়তো কিছু কেনাকাটা করে তবে বেরিয়েছে।
ও হো এই যে আর একটা কী… হাঁ ঠিক বলেছিস, শিলিগুড়ির কোনো একটা দোকানের ক্যাশমেমো। একজোড়া কেডস কেনা হয়েছে। পায়ে কী পরা ছিল রে?
দেখিনি বাইরে ছেড়ে রেখে ঘরে ঢুকেছিল।
তার মানে কলকাতায় আসতে একজোড়া জুতো কিনতে হয়েছে। আগেরটা নিশ্চয় ‘অচল অধম’ হয়ে গিয়েছিল। হি হি। রাজবাড়ি! নামের কী অহংকার।
এম. কে. বলল, যদিও গোয়েন্দাশাস্ত্রের নিয়মই হচ্ছে সব থেকে নিরীহ আর নি:সন্দেহ লোককেই আগে সন্দেহ করা। তবে মনে হচ্ছে লোকটা বোধ হয় সত্যিই নি:সন্দেহ।
ছাতা নিয়েই যাবি?
যাব না? বাসে নাই গেলাম। একটা না হয় অটো নেওয়া যাবে। ওই পচা এক ছাতার জন্য গ্যাঁটগচ্চা!
বুড়োর ওপর তুই চটে আছিস মনে হচ্ছে।
তা ঠিক নয়। তবে ভক্তি তো আসছে না। এরকম দীন দরিদ্দির লোক কী এমন কেস দেবে?
তবু আর একটা এক্সপিরিয়েন্স হবে। এই তো বললি, দিনটা পয়মন্ত। একটা তালিমারা ছাতার খোঁচা খেয়েই মেজাজ বিগড়ে মত বদলে গেল?
ট্যাঁপা হেসে ফেলে বলে, আচ্ছা বাবা আচ্ছা! ওই তালিমারকে গাড়ি চড়িয়ে তার মালিকের কাছে পৌঁছে দেব। তো ঠিকানা লেখা কাগজটা কই? দেখি সেকোথায়?
কিন্তু দেখামাত্রই ট্যাঁপার চোখ গোল গোল হয়ে আসে। মদনা!
কী রে?
এটা কী? ম্যাজিক? না দৈব?
কীরে বাবা!
ঠিকানা দেখছিস?
হ্যাঁ এই তো ষোলোর তিন—হরিশ—
বলি আগে কোথাও দেখেছিস এ ঠিকানা?
আগে? …হ্যাঁ রে! দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে যেন। কার বল তো?
এই যে, বলে ট্যাঁপা সেই খবরের কাগজখানা তুলে ধরে দেখায়। সেই ভাড়ার ফ্ল্যাটের বিশদ জানবার যোগাযোগের ঠিকানা।
তার মানে সকালে যেখানে যাচ্ছিলাম, যাওয়াটা পন্ড হয়ে গেল।
তবে? বলা হবে না ম্যাজিক? কিংবা দৈব।
তা ট্যাঁপা মদনার এতদিনের জীবনটাই তো ম্যাজিক। কিংবা দৈবের যোগাযোগ।
ছাতাটা ফেরত পেয়ে রঘুনাথ যেন হারানিধি পেলেন। ছাতাটি নাকি তার একটি বিশেষ স্মৃতিমন্ডিত।
বলে উঠলেন এর থেকেই আশা হচ্ছে, সূচনাটা শুভ। হয়তো হারানো রানিমাকে তোমরাই উদ্ধার করে দিতে পারবে।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, তাহলে আমরা সেখানে যাচ্ছি?
নিশ্চয়। যাবে তো অবশ্যই। তবে ঘটনাটি এমনভাবে ঘটাতে হবে যেন আমার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। আমি আলাদা যাব, তোমরা আলাদা যাবে।
সেটা কীরকম করে হবে? আপনার সঙ্গে যাওয়াই তো সুবিধে। আমরা হঠাৎ গিয়ে পড়লে কে আমাদের পাত্তা দেবে? হয়তো দেউড়িতে ঢুকতেই দেবে না।
সেটাই তো গোপন পরামর্শের।
অতঃপর সেই পরামর্শ।
রাজবাড়ির যারা স্বয়ং রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণকে সন্দেহ করছে, তারা নাকি জীবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি একান্ত স্নেহশীল এই রঘুনাথ ভট্টাচার্যকেও সন্দেহের চোখে দেখছে। তাদের ধারণা রঘুনাথের যোগসাজসেই জীবেন্দ্রর এই ‘ঠাকুমা অপহরণ’ কান্ড!…
এম. কে. বলে, কেন বলুন তো?
কেন আর? স্বর্গত রাজা হারীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে ও আমার পুত্রতুল্য স্নেহভাজন বলে। এখন আমি যদি ভাগনির অসুখ ছুতো করে হঠাৎ কলকাতায় চলে এসে, একজোড়া গোয়েন্দা নিয়ে গিয়ে হাজির হই, সন্দেহ আরও গভীর হবে না?
তা হতে পারে বটে।
হতে পারে নয়। হবে। কাজেই—
কাজেই ব্যবস্থা হয়। রঘুনাথ যেমন ফেরবার, আগামীকালই ফিরে যাবেন। ভাগনি ভালো আছে বলে। আর জোড়া গোয়েন্দা যাবে পরদিন ভ্রাম্যমাণ শখের গোয়েন্দা হিসেবে। যেন কাগজে খবরটা পড়ে কৌতূহলী হয়ে এসে পড়েছে। এবং খোঁজ নিতে চাইছে।
এই অবস্থায় রঘুনাথ তার প্রবল বিরোধিতা করবেন, ঢুকতে দিতে চাইবেন না। এমন কী এদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন, আর আপত্তি জানাবেন। তখন সন্দেহকারীদের সন্দেহ আরও জোরদার হবে রহস্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে দেওয়ানজি এমন করছেন। কাজেই তারাই গোয়েন্দাদের রাজপ্রাসাদে প্রবেশের পথ সুগম করে দেবে।
বা:। আপনার মাথাটিতেও তো কম আইডিয়া খেলে না দেওয়ানজি?
রঘুনাথ একটু হেসে বলেন, ওই মাথাটির জোরেই তিনপুরুষের প্রিয় হয়ে রয়েছি বাবা। বেশ চলছিল, হঠাৎই যে কোথা থেকে কী এক দুর্ঘটনা এসে হাজির হল।
তাহলে ওই কথাই রইল।
তো যাবার খরচাটা আজ এখনই দিয়ে রাখি?
এম. কে. এবার বলে, না না সেপরে হবে।
টি. সি. গম্ভীরভাবে বলে, বা: না দিতে পারলে উনি স্বস্তি পাবেন কেন?
এম. কে. হেসে বলে, এমনও তো হতে পারে ‘রাহা খরচটি’ নিয়েও আমরা গেলাম না। মানুষকে বিশ্বাস কী?
রঘুনাথ বলেন, তা ঠিক। মানুষকে বিশ্বাস নেই। আবার মানুষকেই বিশ্বাস করতে হয়। না করলে পৃথিবী চলে না! …সকলেই তো আর লোভী নয়। এই যে আমার ভাগনি—
রঘুনাথের এই ভাগনিটিই গোয়েন্দা যুগলকে চা জলখাবার খাইয়ে অতিথি আপ্যায়িত করেছেন। রোগা কালো আধাবয়সি বিধবা! ছেলেমেয়ে নেই—একাই থাকেন, মাত্র একটি ‘কাজের মেয়ে’ নিয়ে। তা তাঁর সম্পর্কেই কিছু জানবার জন্যে অনেকক্ষণ থেকে উশখুশ করছিল ট্যাঁপা! ‘যোগাযোগের ঠিকানাটি তো এটাই। তাই এখন ফস করে বলে বসে, আচ্ছা আজ সকালে কাগজে একটা একতলার ফ্ল্যাট ভাড়ার অ্যাডভারটাইসমেন্ট দেখলুম। ঠিকানাটা যেন—
সেই কথাই তো বলছি বাবা! এই শান্তি, শ্বশুরের বাড়ির দরুন এই অংশটি পেয়েছে। কিন্তু বলে, একা মানুষ এতটার দরকার কী? শুধু সিঁড়ি উঠতে মেজেনাইন ফ্লোরের ঘরখানাতেই থাকতে পারে। পাশের প্যাসেজে আলাদা বাথরুম টাথরুমও রয়েছে। বাড়িটা ভাড়া দিলে, ওর নিজের খরচটা ভালোভাবে চলে যাবে। এখন তো ভাড়া টাড়া বেশিই হয়েছে। তো ওর একটা হতভাগা দেওর নাকি ফট করে না জিজ্ঞেস না কিছু, পেপারে এক বিজ্ঞাপন দিয়ে বসেছে। মতলব মোটা টাকা সেলামি আদায় করবে। বোঝো ব্যাপার। শান্তি ওতে খুব নারাজ। তো দেওর বলে কিনা, ‘তোমার যদি এত ধর্মজ্ঞান, তুমি নিয়োনা, সেলামিটা আমিই নেব। বাড়িটা তো আমার বাবারই।’ সেই নিয়ে আজ কথান্তর। পাশের অংশটা তার। পাশাপাশি দরজা। খদ্দের এলে, সেপুরুষ মানুষ আগেই তো কথা কইতে বসবে! শান্তি বলে, ‘অন্যায় সুযোগ নিয়ে বাড়তি টাকা নেব? তা হয় না! দেওর অবশ্য আলাদা, তবু মানতে হয়।’ সেবলে কিনা, ‘এ বাড়ির জন্যে লোকে পনেরো কুড়ি হাজার সেলামি হাসতে হাসতে দেবে।’ ছাড়া হবে কেন?
অথচ সেলোক নানা বিজনেস করে কত কত টাকা রোজগার করে। আর এই শান্তির রোজগারের লোক নেই। স্বামীর অফিস থেকে পাওয়া সামান্য পেনশন থেকেই যা পায়। তবে বাজার আগুন তাই বাড়িটা ভাড়া দেবার কথা তুলেছিল—
ট্যাঁপা রেগে বলে, তো উনিই তো মালিক?
সেই তো কথা। তবে জগতে জোর যার মুলুক তার। নইলে—
ট্যাঁপা মনে মনে ভাবে, হল আরম্ভ। তাড়াতাড়ি বলে, আচ্ছা দেওয়ানজি ওই কথাই রইল। আপনি কাল রওনা দিচ্ছেন। আমরা পরশু। আপনি আর আমরা কেউ কাউকে চিনি না। জীবনে দেখিনি। তাইতো?
হ্যাঁ, আর আমি তোমাদের বিরোধী পার্টি! অ্যাঁ? মনে থাকবে তো? তখন কিন্তু ‘আপনি আজ্ঞে’।
সেই ষোলোর তিন হরিশ মুখার্জি রোড থেকে বেরিয়ে খানিকটা চলে এসে ট্যাঁপা বলে, এম. কে. কী বুঝলি?
এখনও বুঝে ফেলা শেষ করে ফেলিনি।
রাজবাড়িতে গিয়ে আমরাই গুম খুন হয়ে যাব না তো? গোয়েন্দাদের তো সবসময় সেরিস্ক নিয়ে কাজ করতে হয় রে। আচ্ছা! যদি ফিরে আসি, ওই শান্তিদেবীকে ‘মাসিমা’ ডাকতে শুরু করব?
এম. কে. হেসে ফেলে বলে, যা শুনলি তাতে তো ওঁকে ‘মাসিমা পিসিমা’ ডাকার দরকারই নেই। প্রবলেম সেই দেওর নাকি যেন? তাকে কী ডাকবি? কাকু? জেঠু? দাদু? মামু?
রাতে ট্রেনে চেপে সকালে শিলিগুড়ি স্টেশনে নেমে, ওয়েটিংরুমে স্নানটান সেরে ঝকঝকে হয়ে একটা পছন্দসই রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা।
শিলিগুড়িটাই এখন নর্থ বেঙ্গলের যত ব্যাবসা-বাণিজ্যর প্রাণকেন্দ্র। স্টেশনের ধারে কাছে বা দূরপাল্লার বাস-গুমটির কাছাকাছি অনেক হোটেল রেস্টুরেন্ট চায়ের দোকান। গমগমে জায়গা।
এম. কে. আমাদের নামের কার্ড দুটো সঙ্গে আছে? জিজ্ঞেস করল টি.সি.।
এম. কে. বলল, আছে।
আচ্ছা! রাজবাড়ির ব্যাপার তো? যদি জেরা করতে পুরো নামটা জানতে চায়?
সেতো তোর কী একটা মুখস্থ করা আছে না?
তা আছে।। মলয়কুমার দাস। আর তপনচন্দ্র পাল। সেটাই বলব?
দরকার পড়লে তাই বলবি!
আচ্ছা বুড়োকে তোর সত্যি ভালো লোক বলে মনে হয়েছে?
মনে হবার কথা আগে ভাগে বলতে নেই রে টি. সি.। নিজেকে সবরকম ধারণা মুক্ত করে রাখা উচিত।
পারিসও বাবা! আমার অত অঙ্ক আসে না!
তা না আসুক তোর বুদ্ধিটা আসে।
রেস্টুরেন্টের বয় ছোকরা ওদের কাছে এসে ‘কী লাগবে’ জিজ্ঞেস করার সময় কেমন যেন মিটিমিটি হাসে। তারপর খাবার আনতে যায়।
টি. সি. গলার স্বর নামিয়ে বলে, ছেলেটা ওভাবে হাসল কেন? বল তো?
কী জানি। অকারণ হাসা হয়তো ওর একটা রোগ।
না:। আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে। চল এখান থেকে পালাই।
পাগল নাকি? …আমরা কি আসামি? তাই পালাব? ভয়ের কী হল?
ও হাসল কেন?
ততক্ষণে ছেলেটা খাদ্যসামগ্রী সাজিয়ে ট্রে নিয়ে হাজির।
এম. কে. আড়চোখে একবার টি. সি.-কে দেখে নিয়ে বেশ চড়া গলায় ছেলেটাকে বলে, তুমি আমাদের দেখে তখন হাসলে কেন?
ছেলেটা একদম ছেলেমানুষ।
একটু ভয় পেয়ে বলে, কই না তো? হাসি নাই তো!
নিশ্চয় হেসেছ। আমরা দেখেছি। বলো কেন হেসেছ?
ছেলেটা দেখে আরও লোক ঢুকে আসছে। ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেলে দোষ হয়েছে স্যার। আপনাদের দেখে আমার টি. ভি.-তে দেখা লরেল হার্ডির ছবি মনে পড়ে গেল। তাই।
হেসে ফেলল, এম. কে.। তাকাল টি. সি.-র দিকে।
ততক্ষণে একটা দল ঢুকে পড়ে টেবিল দখল করছে।
এরা খেয়ে বিল মিটিয়ে চলে আসে। বাইরে বেরিয়ে এম. কে. বলে, দেখলি তো টি. সি.? অকারণে আতঙ্কিত হতে নেই।
তা জানলুম। তবে তোতে আমাতে জুটি খুব বেমানান। তুই তালগাছ, আর আমি বেগুন গাছ।
আরে ওটাই তো মজার। লোকের মনে থাকার মতো।
তুই কিন্তু আমায় অ্যাসিস্টেন্ট বলবি। দুটোই ‘গোয়েন্দা’, এটাও বেমানান। গোয়েন্দার একটা অ্যাসিসটেন্ট থাকবে, আর সেখুব বোকা হবে, আর বোকামি করবে এটাই নিয়ম।
ঠিক আছে বাবা, সেই নিয়মেই চলব, তবে কতটা পর্যন্ত বোকামি করা চলবে, সেটা ভেবে ঠিক করে রাখিস।
অনেক ধকল সয়ে এরা যখন রঘুনাথ ভট্টাচাযির ডিরেকশন মিলিয়ে রাজবাড়ির দরজায় এসে পৌঁছোল, তখন বিকেল পড়ে এসেছে। মস্ত রাজবাড়িটাকে যেন একটা ছায়া দৈত্যের মতো দেখতে লাগল। পুরোনো তো! বহুদিন রংটং পড়েনি তা বোঝা যাচ্ছে। তবু মরা হাতি লাখ টাকা। সামনে লন, লম্বা টানা মার্বেল পাথরের বেশ গোটাকতক সিঁড়ি দিয়ে উঠলে তবে বারান্দা। তার ওপর মোটা থাম! দরজাগুলো বেশ বিশাল বিশাল। গেট-এ দারোয়ান।
এম. কে. বেশ সপ্রতিভভাবে তার কাছে চলে এসে বলে রাজাবাহাদুর আছেন?
কাঁহা সেআয়া হ্যায়?
কলকাতাসে—
কৌন কাম?
এম. কে. নিজের নামের কার্ডটা বার করে বলে, রাজাবাহাদুরকো ভেজ দিজিয়ে।
লোকটা একটা হাঁক ছাড়ল। তার মানে গেট ছেড়ে নড়বে না।
কোনখান থেকে যেন একটা রোগা প্যাঁকাটি কোলকুঁজো আধবুড়ো লোক বেরিয়ে এল! ওদের দুজনকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, কী চাই! …গলার স্বরটা যেন খোনা খোনা। বোধ হয় নস্যি নেওয়ার ধাত।
কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে ওরা বলল, রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা হতে পারে?
লোকটা কার্ডের দিকে না তাকিয়েই একবার ওদের আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে বলে, একেবারে রাজা বাহাদুরের সঙ্গে? আশা তো কম নয়! ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার শখ! …কর্মপ্রার্থী তো? আমি ম্যানেজার, সব খবর আমার কাছে। এখানে কোনো চাকরি টাকরি খালি নেই।
ধবধবে জামা প্যান্ট পরা বলেই যে ম্যানেজারবাবু সমীহ করতে বসবেন, তার কোনো মানে নেই। ও আজকাল রিকশাওয়ালারাও পরে। তাই ম্যানেজারবাবুর এমন রাজাই চাল।
ট্যাঁপা এত সহ্য করবে? বলে উঠবে না, রাজবাড়ির যা জেল্লা দেখছি, তাতে তেমন আশা কেউ করবেও না। কলকাতা থেকে আমরা এই পাথরগুড়িতে চাকরির খোঁজে এসেছি? হ্যাৎ! রাজা বাহাদুরের সঙ্গে দেখা হলে, জিজ্ঞেস করা যেত—
লোকটা হঠাৎ কী ভেবে একটু থতোমতো খায়। ভাবে হয়তো, কী জানি রাজাবাবুর চেনা লোক নয় তো? তবু কথায় ডাঁট ছাড়ে না, বলে, চাকরির খোঁজে লোকে কলকাতা থেকে আফ্রিকার জঙ্গলে যায়। তো আসার হেতুটা বলবেন তো?
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে?
মদনা ট্যাঁপার জ্বালায় নিরুপায়ভাবে দাঁড়িয়েছিল। এখন শান্ত গলায় বলল. তোমার কার্ডটা দাও টি. সি.। হেতুটা বুঝতে পারবেন।
বার করে দেয় ট্যাঁপা।
লোকটা এখন দুটোই দেখে। দেখে অস্ফুটে বলে, ডিটেকটিভ!
…কে ডেকেছে? রাজাবাবু? না—
এখন মদন হাল ধরে। বলে, ডাকেনি কেউ। আমরা নিজেরাই এসেছি। আসলে গোয়েন্দাগিরিটা আমাদের পেশা নয়, শখের নেশা। অ্যামেচারও বলতে পারেন। কদিন আগে কাগজে একটা খবর দেখেছিলাম ‘পাথরগুড়ির রাজপ্রাসাদের মধ্য থেকে রানি মায়াবতীর অন্তর্ধান’ ব্যাপারটা কী জানতে পারা যায় কি না খেয়াল হল! চলে এলাম! তা রাজবাড়ির অভ্যর্থনার যা বহর দেখছি—আচ্ছা নমস্কার।
এখন শুঁটকো ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, আহা সেকী। যাবেন কী? কাগজে বেরিয়েছিল? জানতেও পারিনি। এইরকমই সব ব্যবস্থা। কোন কাগজে বেরিয়েছিল?
‘দৈনিক লোকবার্তা!’ রানির বয়স নব্বুই দেখেই একটু কৌতূহল হয়েছিল। আহা—
আহা-হা। যাচ্ছেন কেন? আসুন। ভেতরে আসুন। শুনি ভালো করে। বিজ্ঞাপন দিলাম! এক কপি পাঠাবি তো? তা পাঠায়নি। দেখলামও না।
এম. কে. বলে, দেখতে পারেন। আমাদের সঙ্গে আছে কপিটা।
এরপর শুঁটকো অভ্যর্থনা কাকে বলে, তা দেখিয়ে এদের ভেতরে নিয়ে এল। সেই টানা লম্বা সিঁড়ির একধার দিয়ে উঠে পাশের একটা ঘরে এনে বসিয়ে বলে, এইটে আমার অফিসঘর। রাজবাড়ির কাজকর্ম সবই আমার ঘাড়ে, আরও একজন আছেন বটে আমার ঘাড়ের ওপর, তবে তিনি কেবল রাজাবাবুর দেখভাল করেন।
এরা বুঝে ফেলে ইনি, দেওয়ানজি রঘুনাথবাবুর সেই বিরুদ্ধ পার্টির একজন। নেতাও হতে পারেন।
অফিসঘর বলতে গৌরবের কিছু নেই। একশো বছর বয়েসের ছাপমারা চেয়ার টেবিল আলমারি!
ঘরে এসে বসে কাগজটা উলটে পালটে দেখে শুঁটকো বলে, এইটুকু খবরের জন্যে অতগুলো টাকা নিল—
খবর ছাপতে আবার টাকা নেয় নাকি? ট্যাঁপা বলে ওঠে।
শুঁটকো বলে, কী জানি! আমার কর্মচারীটি তো আমায় বোঝাল, এরকম খবর ছাপতে টাকা নেয়। তা আপনারা তো বললেন, শখের গোয়েন্দা! টাকা ফাকা নেন না?
এম. কে. আর টি. সি. অলক্ষ্যে একবার চোখাচোখি করে। রঘুনাথ তো আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন, খরচ যা লাগবে দেবেন, সমস্ত রকম সুবিধে করে দেবেন, এবং সাফল্য লাভ করতে পারলে—মোটা দক্ষিণা। তাই ঘাড় নেড়ে বলে, না:।
বা:। বেশ তো। তার মানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো?
তা বলতে পারেন। তবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চলে এলে ওই বনের মালিকের কাছ থেকে খাওয়া শোওয়াটা নিতে হয়।
তার মানে? বনের মালিক মানে?
মানে, অনুসন্ধান চালাতে যে কদিন লাগবে, সেকদিন সেবাড়িতে থাকতে , খেতে দিতে হবে। আলাদা আর একটা স্নানের ঘর ছেড়ে দিতে হবে, এইটুকু আমাদের চাহিদা।
শুঁটকো বলে, আহা। বিলক্ষণ। সেতো নিশ্চয়। আর এখন যতই পড়তি দশা হোক, তবু রাজবাড়ি। এখানে দু-জন অতিথির খাওয়া থাকা কোনো সমস্যাই নয়। একতলা দোতলায় দেদার ঘর পড়ে আছে চাবিবন্ধ। তিনতলাতেই যা—কড়াকড়ি। তো দোতলা একতলা দুই আরামের। দোতলায় যেমন ঘরের পাশে চওড়া বারান্দা, একতলায় তেমনি ঘরের পাশে বাগান। দুয়েতেই হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। আহা রানিমাকে যদি খুঁজে বার করতে পারেন!
লোকটার এমন ভাব যেন কনে দেখার ঘটকালি করছে।
এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছু কিছু আলোও জ্বলে উঠেছে, তবে ঘরে ঘরে আনাচে কানাচে নয়। আলো ঝলমলানো চেহারাও নয় রাজবাড়ির। উঠোনে নেমে দাঁড়ালে, সেই ছায়া দৈত্যের মতোই লাগছে।
এম. কে. বলে, একতলাই তো ভালো? কী বল টি. সি.? মনে মনে ভাবে পলায়ন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়ে পড়লে, সহজে পিটটান দেওয়া যাবে!
টি. সি.-ও বলে আমিও তাই ভাবছি। বারান্দার থেকে বাগানই আমার পছন্দ।
তাহলে আমরা থেকে যাচ্ছি? কেমন? ঘরটা দেখিয়ে দিন।
এখন ‘ম্যানেজারবাবু’ চুপসে গিয়ে বলেন, সেতো এখনই দেখিয়ে দিতে পারি। আমার এই অফিস ঘরের দুখানা ঘরের পাশেই তো—আগেকার ‘মাস্টারবাবু’র ঘর। পাশেই বাথরুম। খালি পড়ে আছে কোনো ঝামেলা নেই। তবে শুধু আমি বললেই তো হবে না! ..মুখটা প্যাঁচার মতো করে বলে, এখানে যে আবার দাদার ওপর দাদা আছেন। তাঁর পারমিশান ব্যতীত—কিছুই হয় না।
এরা অতি ইনোসেন্টের মতো বলে, তাই নাকি? তিনি আবার কে?
ওই তো—গালভরা নাম ‘দেওয়ানজি’। রাজাবাবুর প্রাণের লোক। …তো তিনি না আসা পর্যন্ত—ততক্ষণ আপনাদের চা-টা দিক। ওরে—
এম. কে. বলে, না: থাক! থাকাটাই যখন লিখিত নয় তখন কেন আর? তা তিনি কখন আসবেন?
এখুনি এসে যাবেন। সদরে গেছেন ডাক্তারের কাছে কর্তার রিপোর্ট দেখাতে। …আপনাদের চুপিচুপি বলে রাখি, লোক সুবিধের নয়! আমাদের তো ঘোরতর সন্দেহ—ওই এসে গেছেন। গাড়ির শব্দ হল। …আপনারা একটু ইয়ে করবেন, বুঝলেন? রানিমা নিখোঁজ হওয়া পর্যন্ত আমরা যে কী মনোকষ্টে আছি। …উনি হয়তো ডিটেকটিভ শুনেই আপত্তি করে বসবেন। কারণ ভেতরের কথা ফাঁস হবার ভয় আছে। রাজাবাবুটিও তো—শুনুন আমার নাম হচ্ছে রামজীবন রথ। মনে রাখবেন। আমি যা কিছু বলেছি , ওকে বলে ফেলবেন না।
বলতে বলতে থেমে যায়।
বাইরের বারান্দায় একটি গমগমে গলার স্বর বেজে ওঠে, ‘তার মানে? জানা নেই শোনা নেই উটকো দুটো ছোকরা ঢুকে ছোটো ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কীসের এত আড্ডা মারছে?…কী বললি? অ্যাঁ? ডিটেকটিভ? গোয়েন্দা? …কে তাদের এ বাড়িতে মাথা গলাতে দিয়েছে? কই দেখি, কেমন সেই ডিটেকটিভ! কীরকম চেহারা! কীসের সাহসে—
গলা বেশ জোরালো। যাতে সারাতল্লাটেই শুনতে পাওয়া যায়।
না: অসহ্য!
বলে, এম. কে. ও টি. সি. যুগলরত্ন উঠে দাঁড়ায়। বলে , আমরাও দেখি কেমন তিনি—
রামজীবন রথ মিয়োনো গলায় বলেন, দেখছেন তো তম্বি! সহজে এত মেজাজ দেখান না। ‘গোয়েন্দা’ শুনেই মাথা ঘুরে গেছে!
ওরাও ঘরের দরজার কাছে চলে আসে! আর ‘দাদার দাদা’ও এগিয়ে আসেন।
রিহার্সাল দেওয়া অভিনয়।
রঘুনাথ কড়া গলায় বলেন, কোথা থেকে আসা হয়েছে? কী দরকার?
টি. সি. বলে ওঠে, সেটা আর বাড়তি জিজ্ঞেস করছেন কেন? সবই তো জেনে গিয়ে এতক্ষণ তড়পাচ্ছিলেন।
এম. কে. পাশ থেকে তাকে একটা কড়া চিমটি কেটে, এগিয়ে এসে বলে, দেখুন, কিছু মনে করবেন না। আমার এই অ্যাসিস্টেন্টটি একটু রগচটা। আর একটু বোকা। ওর কথা ধরবেন না। আমাদের বিবরণ তো জেনেই গেছেন। তো এই ম্যানেজারবাবু আশ্বাস দিলেন, ভালো ঘর। আলাদা স্নানের ঘর। রাজবাড়ির খাওয়া দাওয়া। আশা করছিলাম কেসটা পেয়ে যাব! গোয়েন্দাগিরির শখটা হয়তো বৃথা না। তো বুঝতে পারিনি, অনধিকার প্রবেশ করে বসেছি। তো মাপ করবেন এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছি বললেই হল? যাবেন কোথায়? রাত হয়ে গেছে।
সেচিন্তায় আপনার দরকার কী? যাহোক একটা হোটেল মোটেল খুঁজে নেওয়া যাবে!
হোটেল। এখানে অমন যেখানে সেখানে ভদ্রলোকের ছেলেদের থাকবার মতো হোটেল নেই।… তা ছাড়া রাজবাড়ি থেকে কোনো অভুক্ত অতিথিকে যেতে দেওয়া হয় না। খাওয়া দাওয়া করুন, রাতটা এখানে থাকুন। সকাল হলে, যা হয় করবেন।
টি. সি. চিমটির জ্বালা ভুলে গেছে। কাজেই জোর মাথা নেড়ে বলে, অসম্ভব! আমরা ভিখিরি নই যে বললেই—রাজার বাড়ি একপাত খেতে বসতে যাব! …কেসটা পাবার ভরসা হচ্ছিল, তাই থাকা খাওয়ার প্রশ্ন। দাতব্য থাকব নাকি? এম. কে. চলো!
রামজীবন মিনমিন করে বলে, একটু চা পর্যন্ত খাওয়া হল না—
দেওয়ানজি গম্ভীরগলায় বলেন, তো এতক্ষণ সেটুকু করানো হয়নি কেন? অথচ বসে বসে গালমন্দ করে এঁদের আশ্বাস দিয়ে আকাশে তুলে বসেছেন। এখন কী ফ্যাসাদের অবস্থা হল আমাদের ভাবুন? একেই তো রাজবাড়ির জ্যান্ত লক্ষ্মী প্রাসাদ ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন তার ঠিক নেই। আবার প্রাসাদের চিরদিনের দেবী লক্ষ্মীও কী বিমুখ হয়ে বসবেন? কবে এই রাজবাড়ি থেকে বহিরাগত অতিথিকে ‘অভুক্ত’ ছাড়া হয়েছে? রাতের মুখে বাড়ির বার করে দেওয়া হয়েছে? অ্যাঁ? এঁরা এভাবে চলে গেলে মালক্ষ্মী কুপিত হবেন না?
রামজীবন রথ আরও মিনমিনে গলায় বলে, তা আপনি তো বলছেন, খাওয়া দাওয়া করে রাতটা থেকে, সকালে—
কিন্তু ট্যাঁপা? তার গলা তো আর মিনমিনে হতে পারে না? এমনিতেই তো গলা চড়া, তাকে আরও চড়িয়ে বলে, উনি বললেই তাই হবে? ‘কেস’ হাতে না পেলে আমরা শুধু একরাত খেয়ে আর থেকে বর্তে যাব? আমাদের একটা প্রেস্টিজ নেই? এই আমরা জলস্পর্শ না করে সেলাম ঠুকে বিদায় নিচ্ছি। তাতে আপনাদের রাজবাড়ির মালক্ষ্মী থাকুন আর ছেড়ে যান।
দেওয়ানজি যেন শিউরে ওঠেন। বলেন ,দুর্গা! দুর্গা! আপনি তো দেখছি সাংঘাতিক ছেলে। যা মুখে আসে বলে বসেন। ঠিক আছে, অমনি একরাত খাওয়া থাকা যখন সম্ভব নয় আপনাদের পক্ষে , তখন নিন কেস। রাজবাড়ির চিরদিনের নিয়ম তো লঙ্ঘন করা যায় না।
রামজীবনবাবু এঁদের ঘরটর দেখিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। আর মনে রাখবেন, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায় যেন রাজবাড়ির প্রেস্টিজের হানি না হয়।
হ্যাঁ, তা আপনারা কী যেন নাম বললেন? ওঃ কার্ডেই লেখা আছে দেখছি। তো গ্যারান্টি দিতে পারবেন, রানিমার ‘অন্তর্ধান রহস্য’ উদঘাটন করতে পারবেন?
এখন টি. সি.-র আগেই এম. কে. স্থিরগলায় বলে ওঠে, কোনো শক্ত রোগীকে হাতে নেবার সময়, কোনো ডাক্তার গ্যারান্টি দিতে পারেন, ‘নিশ্চিত সারিয়ে তুলব?’ নাকি তেমন গ্যারান্টি দিতে রাজি হন? এই কথাটার উত্তর পেলে ভালো হয়।
দেওয়ানজি এখন লজ্জিত ভাব দেখিয়ে বলেন, না না, ঠিক তা বলছি না। মানে ওনার এই অন্তর্ধানের ব্যাপারে মন, মাথা খুবই খারাপ হয়ে আছে, তারওপর আবার রাজাবাবুর অসুখ! তাই ব্যস্ততার বশে,—কিছু মনে করবেন না।
ট্যাঁপা এখন অমায়িক হয়। বলে, ঠিক আছে, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে, কিছু মনে করলাম না। … তবে এ গ্যারান্টি দিচ্ছি, যথাসাধ্য চেষ্টা করব। নিজেদের শখের নেশাতেই তো এসেছি। আশা করছি, আপনাদের কাছে সবরকম—ইয়ে।
ওকে থেমে যেতে দেখেই এম. কে. তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সাহায্য সহযোগিতা পাব, এই আর কী!
দেওয়ানজি বলে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেতো নিশ্চয়। কেসটা যখন হাতে দেওয়াই হচ্ছে। তা এই রামজীবনবাবুই আপনাদের সবরকম সাহায্য সহায়তা করবেন। কী বলেন, রামজীবনবাবু?
চলে গেলেন। …রামজীবন চুপিচুপি বলে ওঠেন কীরকম ডাঁট দেখলেন তো!
এরা যখন এদের জন্যে নির্দিষ্ট সেই মাস্টারবাবুর ঘরটিতে ঢুকে এসে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় এসে বসে তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। যদিও দেয়ালে যে একটা হলদেটে হয়ে যাওয়া বেশ বড়ো ঘড়ি ঝুলছে , সেটা কোনো একদিন বা রাত্রে বারোটা বেজে গিয়ে বন্ধ হয়ে বসে আছে, কতকাল কে জানে?
ট্যাঁপা তাকিয়ে দেখে একটু হেসে বলে, রাজবাড়িরও বারোটা বেজে গেছে, কি বলিস এম. কে?
হুঁ।
তোর ঘড়িতে এখন কত? আমার তো দশটা চল্লিশ।
আমারও তাই। দুজনের একই ঘড়ি। তো কীরকম বুঝছিস?
সব প্রথম তো বুঝলুম, তালিমারা ভাঙা ছাতার মালিক দেওয়ানজিমশাই একটি পাকা অভিনেতা। স্টেজে নামলে, নাম করতেন। তারপর দেখলুম, মরা হাতি লাখ টাকা। কী খাওয়া দাওয়ার বহর। এই কম সময়ের মধ্যে এত সব আয়োজন—
আরে ওসব আয়োজন এদের নিজেদেরই জন্যে হয়ে থাকে।
রোজ এই মাছ মাংস লুচি ক্ষীর, দশরকম তরকারি—আর পাঁচরকম মিষ্টি?
সবাইয়ের জন্যে না হোক, বিশেষ, জনেদের জন্যে তো নিশ্চয়?
তোফা কাটবে ক-দিন তাহলে? কী বল? দুবেলা হোটেলে খেয়ে খেয়ে খাওয়ার ঘেন্না ধরে আসছিল।
বা:। চমৎকার। তুই এখন ওই চিন্তায় মশগুল?
ট্যাঁপা দমে গিয়ে বলে রোস বাবা, একটু থিতিয়ে নিতে দে। তারপর কাজের একটা প্ল্যান বানিয়ে ফেলতে হবে।
প্ল্যান ট্যানগুলো কিন্তু তোরই খোলে টি. সি।
ছাড় বাজে কথা! সব সময় মনে রাখবি, আমি তোর অ্যাসিস্টেন্ট মাত্র! তবে মনে যা হচ্ছে তা বলি—ওই রথটি হচ্ছেন একটি ঘুঘু! ওই দেওয়ানজিটি ওঁর দু-চক্ষের বিষ, পরম শত্রু বলে মনে করেন। অথচ ওঁর তাঁবে থাকতে হয়। কাজেই ওঁকে উচ্ছেদ করার একটি গভীর বাসনা রয়েছে।
হুঁ। স্টাডিটা ঠিকই করেছিস মনে হচ্ছে। তবে যে ছোকরা আমাদের ওই ঘরটর সাফ করে বিছানা পেতে মশারি পর্যন্ত টাঙিয়ে দিয়ে গেল, সেছোকরা কি বোবা কালা? কোনো অনুভূতি দেখলুম না!
হতে পারে। রাজবাড়িতে টাড়িতে অমন দু-একটা বোবা কালা চাকর টাকর থাকাটা বোধ হয় দরকার। তবে সাজা বোবা কালাও হতে পারে। লোকটা ওই রামজীবনের খিদমদগার বলে মনে হল।
এম. কে. বলে, একধার থেকে বাড়ির সবাইকে স্টাডি করে যেতে হবে।
তা সেটাই তো আসল কাজ। তো খেতে বসে কথায় কথায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেল, কী বলিস? ওই বুড়ো রাঁধুনিটা রান্না ঘরের ফরমাশ খাটিয়ে ছেলেটার সঙ্গে অনেক কথা বলছিল।
এম. কে. বলে, গল্পের ধরনের মধ্যে আমাদের সম্পর্কেই তো জেরা বেশি। কোনটা তোর ‘তথ্য’ বলে মনে হল।
এই যে, বাড়িটা তিনতলা হলেও, পুরো তিনতলাটায় রানিমা ছাড়া আর কেউ থাকত না। তাঁর নিজস্ব আয়া নার্স ছাড়া! রাজাবাবুর এই চল্লিশ বছর বয়েসে, একটা মাত্রই ছেলে, আট-ন-বছর বয়েস। তাও বাড়ি ছাড়া, দার্জিলিঙে পড়ে। বোর্ডিঙে থাকে! এজন্যে রানি মায়াবতী খুব দুঃখিত ছিলেন। আর—রানি নাকি ওই বুড়ো রাঁধুনিটার হাতে ছাড়া আর কারও হাতে খেতেন না। আর রোজ রাত্রে নাকি শুধু একটু ক্ষীর আর কয়েকটা করে আঙুর খেতেন। আঙুরের সময় না হলেও ওনার জন্যে যে করেই হোক—
তা এ তথ্যটি থেকে কী বুঝলি?
বুঝলুম খুব শৌখিন ছিলেন, আর মহারানি মহারানি ভাবটাও ছিল বেশ। তা ছাড়া—কে? দরজায় কেউ টোকা দিল মনে হল।
কান খাড়া করল দু-জনেই।
হ্যাঁ। কেউ দুটো আঙুলের মৃদু টোকা দিয়েছে।
ঘরটার দরজার দুপাশে দুটো জানলা আছে বটে, এবং বাড়ির এই পেছন দিকটাতেও সামনের মতো থাম আর বারান্দাও আছে তবে থাকলেও জানলা খুলে দরজার সামনের লোককে দেখা যাবে না। কারণ জানলার বৃহৎ বৃহৎ পাল্লাগুলো বাইরের দিকেই। খুললেই আড়াল। তবু এম. কে. ইশারায় টি. সি.-কে দরজা খুলতে বারণ করে, জানলার সামনে এসে খড়খড়ি তুলে জিজ্ঞেস করে, কে?
নি:শব্দে সেই বোবাকালা চাকরটি এসে সামনে দাঁড়ায়। একটা লম্বা টর্চ দেখিয়ে ইশারায় জানায়, দিতে এসেছে।
এরা হাত নেড়ে জানায়, দরকার নেই! তাদের কাছে নিজেদের আছে!
একটু খড়খড়ি খুলতেই টের পায়, সত্যই হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। এই বারন্দার নীচেতেই বাগান।… কিন্তু প্রথম রাতটা এরা সাহস করে জানলা খুলে শোয়ার চেষ্টা করেনি। টি. সি. বলেছিল সেকেলে ছাদের শুধু মোটামোটা লোহার গরাদ দেওয়া জানলা। আর দুটো গরাদের মধ্যে এতটা ফাঁক যে বেড়াল কুকুর ঢুকে আসতে পারে। তাই ঘরের মধ্যে যে একটা ঘাড়নাড়া টেবিলফ্যান বসিয়ে গেছে, সেটাতেই সন্তুষ্ট থেকেছে।
জানলার কাছ থেকে সরে এসে ট্যাঁপা বলে, এই অতিথি সৎকারটি কার বলে মনে হল তোর? বড়োবাবুর? না ছোটোবাবুর?
খুব সম্ভব ছোটোবাবুর। বোবাকালাটা তো ওরই লোক!
বেশি আদরের ঠ্যালা।
বলেই টি. সি. একটা হাই তুলে বলে, থাকগে বাবা, আজ তো শুয়ে পড়া যাক। যা ভাববার কাল সকালে ভাবা যাবে।
এম. কে.-ও তাতে অরাজি নয়।
কাল রাতে সেই ট্রেনে চড়া থেকে, পায়ের ওপরেই তো আছে।
ঘরের আলো নিভিয়ে টর্চ জ্বেলে, পোশাক ছেড়ে গেঞ্জি আর রাত পায়জামা পরে নিয়ে যে যার খাটের ওপর বসল একবার। দুটোই খাট নয়, একটা চৌকি। তা হোক বিছানাটা ভালোই দিয়েছে। তবে কেমন যেন ভ্যাপসা মতো গন্ধ। তুলে রাখা বিছানা, চালি থেকে নামিয়ে পেতে দিয়ে গিয়েছে বোধ হয়।
ঘরটা একটু স্যাঁতসেঁতে না রে?
হতেই পারে। পুরোনো বাড়ি, তায় একতলা। সিলিংটা কি উঁচু দেখেছিস? সেকালের প্যাটার্নই হচ্ছে অপচয় করা। দেয়ালগুলো কী দারুণ চওড়া। দুটো ঘরের মালমশলা একটা ঘরে।
অতঃপর শুয়ে পড়ে দু-জনেই দু-দেয়ালে বসানো দুটো খাটে।
..ট্যাঁপার একটা শখ, রাতে শোয়ার সময় দু-একটা ধূপ জ্বেলে শোওয়া। সুটকেসেই ছিল, অন্ধকারে হাতড়ে বার করে জ্বেলে দেয় দুটো। আর তার সুগন্ধে বিছানার ভ্যাপসা গন্ধটা আর মালুম হয় না। আস্তে ঘুম এসে যায়।
তো সবেমাত্র একটু তন্দ্রা এসেছে, হঠাৎ যেন মনে হল বাইরে থেকে কেউ মাথার কাছের জানলার খড়খড়িটা একটু ওঠানামা করছে। খুট! খুট!
ফট করে বালিশের তলা থেকে টর্চটা বার কেরে এম. কে. বলে উঠল ,কে?
ক্ষীণ একটু স্বর, ‘আমি!’
‘আমি’ মানে কী? কার আমি?
একটুক্ষণ চুপ!
তারপর আবার খুট!
এবার টি. সি.-র চড়া গলার প্রশ্ন কে?
আমি! ম্যানেজারবাবু!
টি. সি. উঠে এল। জানলার কপাটটা খুলতে চেষ্টা করল, মরচেধরা ছিটকিনি আটকে আছে, সহজে উঠছে না। খড়খড়ির ফাঁক থেকেই জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার।
না, ইয়ে ব্যাপার কিছু না। জলটল কিছু লাগবে?
সেই কথা জিজ্ঞেস করতে আপনি? কী আশ্চর্য! আপনার সামনেই তো এক কুঁজো জল রেখে গেল আপনার সেই বোবা কালা।
না, মানে যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে।
টি.সি. একলাফে উঠে এসে বলে, আমরা কি মশাই মরুভূমি বুকে নিয়ে আপনাদের রাজবাড়িতে এসে ঢুকেছি? যান নিশ্চিন্দি হয়ে ঘুমোন গে! …বলে খড়খড়িটা নামিয়ে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ে।
কী ব্যাপার বলত এম. কে.?
ব্যাপার আর কী, বেশি আপনজন হতে চায়। আসলে ওর বিশেষ প্রতিপত্তি আছে বলে মনে হয় না। আর অন্য সবাই ছোটো ম্যানজারবাবু বলছে বটে, তবে পুরোনো কালের বুড়ো রাঁধুনি ঠাকুরটা বলছিল, ‘সরকার মশাই’।
ওকেই বলছিল? আমি ভাবলুম আর কাউকে। আরও বেশ ক-জনকে দেখলুম তো! কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল!
ঘুম কাঁচা থেকে গভীরে এসে যায়। দুজনের মাথাতেই নানা স্বপ্ন ঘোরাঘুরি করছে। …কাল প্রথম কাজ হবে সেই রানি মায়াবতীর ঘরটি বা মহলটি দেখা। আর তাঁর ছবি দেখা। রাজারাজড়ার ব্যাপার বড়ো করে অয়েল পেন্টিংও করা থাকতে পারে। কী জানি কেমন দেখতে ছিলেন? …না, এখনই ‘ছিলেন’ বলা ঠিক নয়, ‘আছেন’।
কী হল? ঘরে কি ইঁদুর ছুঁচো আছে? আবার যেন খুটখুট শব্দ হচ্ছে।
এখন আর ‘কে?’ না বলে নীরবে শুধু টর্চটা জ্বেলে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। আর পড়বি তো পড় টি. সি.-র চোখেই পড়ে। সেই মাথার কাছের জানলার খড়খড়িটা একটু উঠছে পড়ছে।
ব্যস! আর কথা টথা নয়, উঠে গিয়ে হ্যাঁচ করে ছিটকিনিটায় টান।
সেই তখন খানিকটা উঠেই ছিল, এখনকার হ্যাঁচকা টানে সবটা উঠে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গেই টি. সি. জানলার কপাটে একটা জোর ধাক্কা মারে। …ফলে যা হওয়ার তাই হয়। ..যেহেতু কপাট বাইরে দিকে খোলে, তাই সেই সাত ফুট উঁচু ভারী কপাটখানা সজোরে ধাক্কা মারে জানলার ধারে দাঁড়ানো লোকটাকে।
আঁক করে একটা চিৎকার।
কপাল ধরে দাঁড়িয়ে ছোটো ম্যানেজারবাবু।
এর মানে? আপনি এত রাত্তিরে?
না, মানে দেখতে এসেছিলাম অজানা অচেনা নতুন জায়গায় আপনাদের ঘুম হচ্ছে কিনা!
বা:। চমৎকার। নিজের ঘুম নষ্ট করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেখতে এসেছিলেন, ঘুম হচ্ছে কি না। রাজবাড়ির অতিথি আদর বুঝি এইরকম? তাহলে তো মশাই টেকা ভার হবে! আচ্ছা ধন্যবাদ। যান জানলা খোলাই থাকল। যত পারুন দেখুন।
ছোটো ম্যানেজারবাবু তখনও কপালে হাত বুলোচ্ছেন বোকার মতো দাঁড়িয়ে। পরনে একটা ফতুয়া, আর হাঁটুতে উঠিয়ে পরা একখানা ধুতি।
এম. কে. উঠে এসে বলে, কপালে বেশি লেগেছে নাকি?
না না, ও কিছু না।
বলেন তো ডেটল লাগিয়ে দিই, আছে আমাদের সঙ্গে।
না না। লাগবে না। ঘুমোন আপনারা।
‘ঘুমোন’ বলেই জানলার আরও ধারে সরে এসে বলেন, শ্রীরামজীবন রথ, দরজাটা একটু খোলার অসুবিধে হবে? দু-একটা কথা ছিল।
এম. কে.-কে পাশ করে টি. সি. বলে, হ্যাঁ। অসুবিধে হবে। এটা কথার সময় নয়। আপনি মশাই রাতে ঘুমোন না? যান যান ঘুমোনগে যান।
আবার টর্চ নেভায়।
জানলাটা খুলেই রেখেছে রাগ করে। কাজেই আর কথাটথা নয়।
কী জানি দেয়াল ঘেঁষে আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ কান খাড়া করে আছে কি না।
ভোরের ঘুমটা ভালোই হয়েছিল। জানলাটা খোলা থাকার জন্যে হু হু করে স্নিগ্ধ হাওয়া আসছিল। কিন্তু ঘরের দরজা খুলে বেরোতেই সব স্নিগ্ধতা দূরীভূত। সামনেই ছোটো ম্যানেজারবাবু।
মানুষ যে এত বেহায়া হয়, তা কে জানত?
এম. কে. টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। ট্যাঁপা কড়াগলায় বলে, আপনি কি সারারাত এখানেই আমাদের পাহারা দিচ্ছিলেন?
পাহারা? ছি ছি। এটা কী বলছেন? আপনারা যাতে কোনো অসুবিধে না পান, তাই—
আমরা কিন্তু আপনার তদারকিতেই অসুবিধে বোধ করছি।
রামজীবন রথ কাঁচুমাচু মুখে বলেন, কিছু মনে করবেন না। আমার স্বভাবটাই একটু বেশি ব্যস্ত হওয়া। …ইয়ে—কাছে সরে এসে ফিসফিস স্বরে, বলছিলাম কী, রাতের কথা কাউকে বলবেন না।
রাতের কথা মানে?
এই যে আমি আপনাদের একটু খোঁজ টোঁজ নিতে এসেছিলাম। মানে আপনারা হয়তো একটু ডিস্টার্ব হয়েছিলেন—
‘হয়তো’ নয়। রীতিমতোই হয়েছিলাম। তা সেআমরা রাজবাড়ির অতিথি সৎকারের নিয়মকানুন জানি না বলেই—আপনি তো ভালো ভেবেই এসেছিলেন।
তা ঠিক। তা ঠিক। না মানে সবাই তো আপনাদের মতো সরল নয়। ওই যে দেওয়ানজি! উনি তো একখানি চিজ। হয়তো ওই নিয়েই—আরে! উনি নেমেছেন মনে হচ্ছে। এক্ষুনি! …সাতটার আগে তো কোনোদিন…আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
‘যাচ্ছি’ বললে কী হবে, ততক্ষণে তো এসেই গেছেন তিনি। এখানে রঘুনাথের অন্য চেহারা। ধীর স্থির, আত্মস্থ।
এই যে আপনারা উঠেছেন? অন্যটি?
মুখ ধুতে গেছে।
রামজীবনবাবু আপনিও তো দেখছি—যাক কী যেন নাম আপনার? মনে থাকে না। অ্যাসিস্টেন্ট সাহেবই বলি, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
ট্যাঁপা দেখে মদন অনুপস্থিত। এই সুযোগ। বলে ওঠে, কই আর? ঘরে বোধ হয় কিছু ইঁদুর ছুঁচো আছে। মারাত্মক খুটখাট করেছে!
রঘুনাথ বলেন, তাই নাকি! হতেই পারে। পুরোনো বাড়ি। নীচের তলা। তাহলে তো ঘর বদলানো দরকার। ..আচ্ছা দেখছি। …আসুন রেডি হয়ে। চা দেবে। …এ কী রামজীবনবাবু? আপনার কপালে অতটা কালসিটে কীসের? একটু ফুলেও রয়েছে মনে হচ্ছে। পড়েটড়ে গেছলেন নাকি?
না। না। কই? কখন? না তো?
বলে সরে পড়েন ছোটো ম্যানেজারবাবু।
দেওয়ানজি খুব গলা নামিয়ে বলেন, এই লোকটিকে একটু চিনে রাখবেন।
ট্যাঁপা তেমনিভাবে বলে, অলরেডি অনেকটাই চেনা হয়ে গেছে।
এরপরই ঘটনা ঘটতে থাকে দ্রুতবেগে!
চা খাওয়ার পর এম. কে. আর টি. সি. দেওয়ানজিকে বলল, আমরা একবার বাইরে বেরিয়ে রাজবাড়ির চারদিকটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।
ঠিক আছে। তবে চারপাশটা ঘুরে দেখা সহজ নয়। কয়েক একর জমি নিয়ে প্রাসাদ আর প্রাসাদ সংলগ্ন বাগান। এক সময় সবটাই মজবুত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল, এখন সেপাঁচিল প্রায় লুপ্ত।
আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই?
না রাজবাড়ির আশেপাশে তেমন কোনো বাসবাড়ি নেই। তবে রাজাদের দেওয়া জমিতেই একটি সরকারি বিদ্যুৎ অফিস, আর ‘জায়েন্ট টিউবওয়েল’ তৈরি হওয়ায় কিছু লোক বাস করছে। তা ছাড়া—একটু এপাশে রানি বিদ্যুৎলতা অর্থাৎ বর্তমান রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের বিদুষী স্ত্রী একটি ‘বালওয়ারি স্কুল’ আর একটি ‘নারী শিক্ষা মন্দির’ স্থাপন করেছেন। তবে রাজবাড়ির অন্দর থেকে কিছুই দেখা যায় না। প্রাসাদের সংলগ্ন গাছপালায় সব ঢাকা! সবটা কি আর এক সকালে দেখা যাবে?
দেখি।
টি. সি. বলল, কাল সন্ধেমতো সময় এসে কিছুই বোঝা যায়নি। দেখ ফটকের ওপর বাড়ির নাম লেখা পাথর বসানো রয়েছে।
হলদেটে হয়ে যাওয়া শ্বেতপাথরের ফলকের ওপর একটু একটু খেঁদো হয়ে যাওয়া কালো অক্ষরে লেখা ‘মণিমঞ্জিল’। নামটা বেশ। বলে টি. সি. গেট ছাড়িয়ে একটু এগিয়েই বলে দেখ কত আম গাছ! আর রাশি রাশি কচি আম ফলে রয়েছে।
তা থাকতেই পারে এখন মার্চ মাসের শেষ, কাঁচা আমের সময়! কী মনে হচ্ছে রে? সঙ্গে একটা ছুরি আর একটু নুন থাকলে বেশ হত?
ধ্যাৎ। ও সব ছেলেমানুষি আর নেই। দেখ বাউণ্ডারি ওয়ালটার মাঝখানেই সব প্রায় ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কতখানি জায়গা জুড়ে রে?
হ্যাঁ হাঁটছে তো হাঁটছে। সামনের দিকটা শেষ হল তো একটা পাশের দিক।
আচ্ছা মানুষ এতখানি জায়গা দখল করে বাড়ি বানায় কেন রে?
সব মানুষ নয়, রাজা রাজড়ারা। সাধারণ মানুষদের তো সকলের ঘর বাড়িই নেই। বাবা:!। এ যে আর ফুরোয় না। ডানদিকের পাঁচিল শেষ হল তো পিছনের পাঁচিল।…অনেকখানিকটা এসে থমকে দাঁড়ায় দুজনেই। টি. সি. দেখ এখানে পাঁচিলটা যেন নতুন ভাঙা। আর ঠিক যেন ভেঙে পড়েনি, ইচ্ছে করে বেশ খানিকটা ভেঙে ফেলে সাফ করা হয়েছে। ইট পাটকেল একদিকে ঠ্যালা!
তাইতো! ব্যাপার কী বল তো? সত্যিই তো এই ভাঙাটা যেন একটা চওড়া গেট-এর মতো! আর সামনে পিছনে আগাছার গাছটাছও সাফ করে ফেলা হয়েছে।
ব্যাপারটা তো বেশ রহস্য রহস্য মনে হচ্ছে।… নাকি রাজবাড়ির নিজস্ব কাজেই এরকম করা হয়। হয়তো চালের বস্তা ভাঁড়ারের মালপত্তর নিয়ে গোরুর গাড়ি ঠ্যালা গাড়িটাড়ি আসে পিছন দিক দিয়ে।
রান্নাবাড়িটা কি এই পিছন দিকেই?
কে জানে? কাল রাত্তিরে অত দিক নির্ণয় করা যায়নি!
মদনা!
ট্যাঁপার উচ্ছ্বসিত স্বর।
অ্যাই! ও কী?
আহা এখানে কে শুনছে? একটা জিনিস দেখেছিস?
ট্যাঁপা নীচু হয়ে কুড়িয়ে নেয়, তিন চারটে পোড়া সিগারেটের টুকরো!… মোটামুটি টাটকাই। অন্তত তার ওপর বৃষ্টি পড়েনি এখনও!
তার মানে কেউ এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে।
‘কেউ’ বা কেউরা।…
তার মানে রান্নাবাড়ির মালপত্রের ঠ্যালাগাড়ি নয়। তাহলে বিড়ির টুকরো থাকত। …বাবুটাবুর ব্যাপার…
আর নিরীক্ষণ করতে করতে, এম. কে.-ই এবার চাপাগলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ট্যাঁপা! দেখছিস?
দেখে। দুজনেই দেখে। একটা খালি সিগারেটের বাক্স। ‘ফাইভ ফিফটি ফাইভ’ ব্র্যাণ্ড! মহামূল্য রত্নের মতো কুড়িয়ে তুলে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে সাবধানে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে ট্যাঁপা।
ঘাড় উঁচু করে সামনেটা দেখে। দোতলায় সারি সারি বড়ো বড়ো বন্ধ জানলা। খড়খড়ি দেওয়া। তিনতলায় অন্য দৃশ্য। ছাতের কার্নিশ আর পাঁচিল। বেশ যেন কারুকার্য করা মতো।
রানি মায়াবতীর মহল তিনতলাতেই না? …কাল কে যেন বলছিল! …ও ওই বুড়ো রাঁধুনি ঠাকুরটাই বোধ হয়। বলছিল, রানিমা আর কারও হাতে খেতেন না। তাই তাকেই সব সময় তিনতলায় উঠতে হত!
আচ্ছা, আরকারও হাতে খেতেন নাকি বিচার আচার শুচিবাইয়ের জন্যে? ওর তো দেখলুম খুব মোটা একগোছা পইতে।
তাও হতে পারে। আবার অন্য সকলের ওপর অবিশ্বাসও হতে পারে। ..ওই পিছনটা ওরা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল। মনে হচ্ছে এখান দিয়ে কিছু ঘটানো হয়েছে। অথচ রাজাবড়ির কারও চোখে পড়েনি। ঘাসের মধ্যে চোখ রেখে ট্যাঁপা আরও কিছু সংগ্রহ করে দু-হাত ঘষে মুচে পকেটে পুরল। গোটাকয়েক মুখপোড়া দেশলাই কাঠি।
বাড়ির এপাশটাতেও এল। যদিও আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না। তা ছাড়া এদিকটা হাঁটায় অসুবিধেও হচ্ছিল। সবটাই যেন কাঁটার ঝোপ। …যে যেভাবে গজিয়েছে।
ফিরে এসে আবার মেন গেট-এ আসা মাত্রই সেই কালকের দারোয়ানটা সেলাম জানায়। সকালে এ ছিল কোথায়? কই দেখা যায়নি তো? গেট-এর থামের কাছে একটা কমবয়সি ছেলেকে বসে থাকতে দেখেছিল মনে হচ্ছে।
নমস্তে দারোয়ানজি! সুবা মে দেখা নেই কিঁউ?
নমস্তে বাবুজি। সোকাল মে, তো স্নান আন, আউর পূজাপাঠ হ্যায়। ইসি ওয়াস্তে ভাতিজাকে সুবা মে খাড়া রাখা থা!
এম. কে. হেসে চাপা গলায় বলে, বোধ হয় ভোরসকালে ডাকাত পড়ার ভয় নেই ভেবে।
এরা ঢুকেই সেই মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে হিসেব করতে চেষ্টা করে, ঠিক সেইসময় একটি অচেনা ভৃত্য কাছে এসে বিনীত গলায় বলে, আপনাদের ব্যবস্থা হয়েছে দোতলায়। চলুন আপনাদের জিনিসপত্র দেখিয়ে দিন উঠিয়ে নিয়ে যাই। কোন ঘরে ছিলেন কাল রাত্তিরে?
কী জানি ঠিক বুঝতে পারছি না! শুনেছিলাম, মাস্টারবাবুর ঘরে।
ওঃ বুঝেছি। …পিছনে! আমি দোতলায় কাজ করি।
চলে আসে চটপট। এরাও সঙ্গে।
জিনিসের মধ্যে তো দুজনের দুটো সুটকেস আর দুটো টর্চ। সকালে দু-খানা তোয়ালে কেচেছিল, জানলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল, নিয়ে নেয়।
টি. সি. একটু হেসে বলে, এখানের সেই বোবা কালাটি কোথায় গেল?
বোবা কালা? বোবা কালা তো কেউ নাই বাবু!
বা: কালকে যে আমাদের ঘর সাফ করে দিল। বিছানা ঠিক করে দিল। ছোটো ম্যানজারবাবুর সঙ্গে সঙ্গে—
ছেলেটাও হেসে ফেলে বলে, ওঃ। নবীন। বোবা কালা নয় বাবু, ও বেজায় তোতলা, তাই ভদ্দরলোকেদের সামনে কথা কয় না!
ইনি তোতলা নয়। কাজেই ভদ্দরলোকেদের সঙ্গে কথা বলেন। এবং মনে হল সুযোগ পেলে বেশ বেশিই কথা বলবেন। সুটকেস দুটো এরা নিজেরাই নিতে চাইছিল। সেএকেবারে ‘হাঁ হাঁ’ করে উঠল। …মনিব সেদৃশ্য দেখলে তার নাকি গর্দান যাবে।
তবে আর কী করা। তোমার গর্দানটা যায়, এ আমরা চাই না। নাম কী?
আজ্ঞে পঞ্চু!
দোতলায় যে ঘরখানায় ওদের ঘর বলে এনে দাঁড় করায় পঞ্চু, দেখে মনে হল যেন সর্গে এসে পৌঁছে গেছে। …বিরাট ঘর। সাদাকালো মার্বেল পাথরের মেঝে। বিশাল বিশাল জানলা, খোলা। হাওয়ার বন্যা বইছে। সামনে পেছনে চওড়া বারান্দা। ঘরের মধ্যে—দু-দেয়ালের ধারে দু-খানা পুরোনো রং ওঠা হলেও, দুটো বাহারি কাজ করা পালঙ্ক। ফ্রেশ সুজনি ঢাকা। দুদিকেই মাথার কাছে এক একটা টুলের ওপর জলের কুঁজো বসানো। দেয়ালে দেয়াল জোড়া আলমারি। এ ধারে আলনা ড্রেসিং টেবিল। খাটের ধারে দুটো বেতের মোড়া। খাটের সামনে পায়ের কাছে, এক টুকরো করে রংজ্বলা কার্পেট পাতা! দেয়ালে দেয়ালে বড়ো বড়ো ছবি টাঙানো।
অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই। শুধু সবই বয়সের ভারে বিবর্ণ।
টি. সি. চুপিচুপি বলে, ঠিক যেন সিনেমায় দেখা সেকেলে বড়োলোকের বাড়ির মতো! না রে?
হুঁ।
বাবু। আপনাদের এখন শরবত লাগবে?
না না!
ডাব?
আরে না বাবা! আমাদের এখন আর কিছু লাগবে না। তুমি তোমার নিজের কাজে যাও।
এখন তো আমার আপনাদের দেখাশুনোই কাজ।
সর্বনাশ। সর্বক্ষণ আমাদের দেখাশুনো করলেই গেছি আর কী। না না ভাত খাবার আগে আর কিছু লাগবে না।
আপনারা ক-টায় ভাত খান? টাইমটা জেনে রাখি।
সেরেছে। সবাই যখন খাবে তখনই—
সবাই কি একসঙ্গে খায়? বেলা বারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত খাওয়া চলে। এ বাড়িতে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উনুন জ্বলন্ত, হাঁড়ি ফুটন্ত।
এত লোক কে হে?
কেউ নয় আবার সবাই। আসলে বাড়িতে যানারা কাজ করেন তানাদের সকলের ‘ফেমিলি’ থাকে তো। তা ছাড়া বুড়ো রানিমার সব কোনকালের পুষ্যিরা ডালপালা গজিয়ে শেকড় গেড়ে বসে আছে। এখন তাদের চোখেও দেখতেন না। দেখলেও চিনতে পারতেন কি না সন্দ। …তবে বাড়িতে ভি. আই. পি কেউ এলে, রাজাবাবু দেওয়ানজি আর উকিলবাবুর সঙ্গে দুপুরে লাঞ্চে বসেন। তো আপনাদেরও তো ভি. আই. পি বলেই মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে নাকি?
তাই মন নিচ্ছে। …তবে হ্যাঁ, সব থেকে ভি. আই. পি তো ছিলেন তিনি। ..কোথায় যে হারিয়ে গেলেন!
রানি মায়াবতীর কথা বলছ?
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, সেই তো! তেনার ভাত খাওয়ার টাইম ছিল ঘড়ি ধরা বেলা এগারোটা। এক মিনিট এদিক ওদিক হবার জো ছিল না। আর ভাত তো খাবে দু-চামচ চালের। কিন্তু বেঞ্জন চাই বিশরকম। খাক না খাক পাতে ধরে দিতে হবে! যাকগে বাবু ওনার কথা বেশি কইতে বারণ।
কিন্তু আমরা তো ওনাকেই খুঁজে বার করবার চেষ্টায় এসেছি। আমাদের তো সব কথা শোনা দরকার।
সেকর্তাদের কাছে শুনবেন। আমি তা হলে যাই! মাসির আজ জ্বর, তার হয়ে কিছু কাজ করে দিইগে। মাসি হচ্ছে রান্নাবাড়ির বাটনা বাটুনি। দিন ভোর বাটনা বাটছে, ডাল বাটছে, পোস্তো বাটছে বিরাম নাই!
তা যাও তার সাহায্য করতে। আচ্ছা দেয়ালে এসব ছবি কাদের বল তো?
কার আর, পুব্বোপুরুষদের। দেখছেন না মাথায় পাগড়ি, কানে গহনা। …এখন আর অমন নাই।
তা এখানে রানি মায়াবতীর ছবি নেই?
ছেলেটা যেন এদের বোকামিতে হেসে উঠে বলে, শোনো কথা। এখেনে সদর ঘরে রানিমাদের ছবি থাকতে আছে? সেসবগুলি তিনতলায়, বুড়ো রানিমার মহলে। খাতা খাতা এলবামও নাকি আছে। তো আমাদের তো আর তিনতলায় ওঠার পারমিশান নাই।
তোমরা তিনতলায় ওঠো না?
খেপেছেন? সেওঠে, বাছাগোছা লোকেরা। আর রাতে তো শুধু আয়া দিদিমণি আর নার্স দিদিমণিরা ছাড়া কেউ না। …সিঁড়ির ‘কোলাপসিবলে’ তালাচাবি আঁটা। ….যাই বাবা অ্যাতো কতা কইছি শুনলে—ছোটো মেনেজারবাবু আস্ত রাখবে না।
বলে ছেলেটা পালায়।
এম. কে. কী বুঝলি?
তুই কী বুঝলি?
আমি? আমি যা বুঝি সেতো খাতায় না লিখে বলতে পারি না। জানিস তো? চিরকালের স্বভাব।
তা লেখ তুই!
লিখব। আর একটু দেখে। তবে বুড়োরানিকে নিয়ে এত কড়াকড়ি কেন?
হয়তো তাঁর নিজেরই ভয় বাতিক। বুড়ো হলে অমন হয়।
আলোচনা রেখে ওরা ঘরের বাইরে এল।
বাড়ির এই অংশটা, সামনের দিকে! যার নীচের তলায় সারি সারি সব ঘর, কাছারি ঘর, দপ্তর ঘর, দলিল ঘর, জাবদা খাতার ঘর ইত্যাদি। বাইরের বারান্দাটি খোলা। কিন্তু ভেতরের বারান্দাটা বড়ো বড়ো জালের জানলা দিয়ে ঘেরা। জানলাগুলো খুললে অবশ্য বেশ খোলামেলা। এখন খোলাই রয়েছে।
টি. সি. একটু দাঁড়িয়ে থেকে, বলে ওঠে, দ্যাখ এম. কে.! বাড়িটা যেন ঠিক চৌবাচ্চার মতো! শুধু চারধারের পাড়গুলো খুব উঁচু আর মাঝখানের খোঁদলটা বিরাট এই যা।
এম. কে. হেসে ওঠে।
আর ঠিক এইসময় দেওয়ানজি এসে দাঁড়ান।
এই যে সকালে খুব বেড়িয়ে এলেন?
ওই আর কী! বাড়িটার চারপাশে ঘোরা হল।
হাসছিলেন যে?
এই যে। আমার অ্যাসিস্টেন্ট মশাই বলছিলেন বাড়িটার ছাঁদ ঠিক চৌবাচ্চার মতো। শুধু পরিধিটাই যা বিশাল।
দেওয়ানজি একবার নীচের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, অদ্ভুত দৃষ্টি তো? চকমেলানো বাড়ি এইরকমই হয় জানতাম। মাঝখানে চৌকো উঠোন, আর চারধারে দালান বারান্দার ওপর ঘরের সারি। কিন্তু কোনোদিন চৌবাচ্চা প্যাটার্ন তা মনে হয়নি। সত্যি তো। দেখলে তাই—
ওর কথা ছাড়ুন। ওর ওইরকম এক একটা ভাবনা। তো এত ঘর, সবই তো দরজা বন্ধ। খালি পড়ে থাকে?
তা ঠিক নয়। চৌবাচ্চার চারপাড়ের এক একদিকে দশখানা করে ঘর। তা—
টি. সি. বলে ওঠে, তার মানে এক একতলায় চল্লিশখানা করে? তিন তলায়—
তিনতলাটা বাদ। ওর আলাদা প্যাটার্ন। একতলা দোতলায় ওই আশিখানাই। কিন্তু একতলাটা সবই ভরতি। সামনের দিকে অফিসবাড়ি। পিছন দিকে রান্নাবাড়ি। অর্থাৎ খাওয়া দাওয়া স্টোর ইত্যাদি। আর দুধারে সব আশ্রিত আর কর্মচারীদের ফ্যামিলি। আর এই দোতলাটা অবশ্য দক্ষিণে রাজাবাবুর আর মহারানির মহল। পুরো দশখানা ঘরই লেগে যায় ওদের। এদিকটা অতিথি মহল। মহারাজার পরিচিতবন্ধুবান্ধব আসেন মাঝে মাঝে। রানির বাপের বাড়ি দিনাজপুর থেকেও অনেকে আসেন টাসেন। তবে বাকি দুটো দিক অবশ্য পুরোনো আসবাবপত্র, বাতিল জিনিস টিনিস ইত্যাদিতে বোঝাই হয়ে পড়ে থাকে। বাড়িও তো পড়ে যাবার দাখিল।
কিন্তু তিনতলাটা কী প্যাটার্ন বলবেন?
সেঅনেক কথা। পুরোনো কালে তিনতলায় কোনো ঘর ছিল না। শুধু মাঠের মতো প্রশস্ত ছাদ। …রানি মায়াবতী বউ হয়ে এসে আবদার ধরেন, ছাদে বেড়াতে ইচ্ছে করে, তাঁর, কিন্তু ওরকম খাঁ খাঁ করা মাঠ ময়দান ছাদে বেড়াতে ভয় করে। ওখানে নতুন করে তাঁর মহল তৈরি করা হোক। যাতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে বেড়ানো যায়। তা সেইভাবেই মহল হল। তবে এমন সোজাসুজি নয়, কেমন যেন গোলোকধাঁধাঁ প্যাটার্নের। … কোন ঘর থেকে বেরিয়ে কোন ঘরে পড়লাম বোঝা যায় না। সব ঘরের চারদিকেই টুকরো টুকরো বারান্দা। তো ওঁরও খান আষ্টেক ঘর নিয়ে মহল। নিজে নাকি এঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মিস্ত্রিদের।
খুব শৌখিন ছিলেন, তাই না?
শৌখিন তো দারুণ। আবার খুঁতখুঁতেও।
টি.সি বলে ওঠে আর ভীতুও তো!
ভীতু? কই কে বলল?
এম. কে. তাড়াতাড়ি বলে, ওই যে বউ হয়ে এসে মস্ত ছাদ দেখে ভয় পেয়েছিলেন।
না। সেকিছু না। …তখন তো বয়েস মাত্র বারো তেরো। ওই মহলেরই-বয়েস হল বাহাত্তর বছর। …তবে হ্যাঁ। সম্প্রতি কিছুদিন থেকে—ঠিক ভয় নয়, একটা যেন সন্দেহ বাতিক হয়েছিল। কেউ যেন তাঁর অনিষ্ট করবে, এইরকম ভাব।
টি. সি. হেসে ফেলে বলে, এত বয়েসেও অনিষ্টের ভয়?
ভয় কি আর বয়েস মানে বাবা?
তা ওঁর ছবিটবি দেখতে পাব তো।
নিশ্চয়। …ওঁর মহলে তো নিয়েই যেতে হবে! তবে মনে হয় দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর গেলেই ভালো হয়। অনেকটা সময় হাতে পাওয়া যাবে।
এম. কে. একটু ইতস্তত করে বলে, আচ্ছা রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা হবে না?
হ্যাঁ সেটা উনি নিজেই বলেছেন। সন্ধ্যার পর একবার আপনাদের ওঁর কাছে নিয়ে যাব।…তবে একটা বলে রাখি বাবা, হুটহাট নীচের তলায় নামবেন না, বা এদিক সেদিক ঘুরবেন না। …দুবেলা খাওয়ার সময় ওই পঞ্চুই আপনাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আর চা তো ঘরেই দিয়ে যাবে।
কেন বলুন তো? আমাদের নিয়ে এত ভাবনা কীসের?
কী বলছেন? আপনারা তো অন্তর্ধান রহস্য ফাঁস করবার চেষ্টায় এসেছেন? তা সেটা ফাঁস হয়ে গেলে যে বিপদে পড়বে, সেআপনাদের বিপদে ফেলে ঘায়েল করবার চেষ্টা করবে না! কে বলতে পারে আসামি আমাদের চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কি না।
আচ্ছা রানিমহল দেখে নিয়ে, আমরা কিছুজনকে আলাদাভাবে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?
সেতো নিশ্চয়ই পারেন। সেতো করতেই হবে। বিশেষভাবে আয়া বিন্দুবাসিনী, বামুন ঠাকুর মিশিরজি, নার্স মিসেস ভঞ্চু! এরা সর্বদা রানিমার কাছে আসা যাওয়া করত। নার্স আর আয়া তো এই তিনতলাতেই থাকত। তবে যেদিন বা যে রাত্রে ঘটনাটা ঘটে, সেদিন ওই মিসেস ভঞ্চু ছিলেন না। মেয়ের অসুখ বলে একদিনের জন্যে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন এসে তো অবাক।
এম. কে. বলে, আচ্ছা ঠিক কখন কীভাবে জানতে পারলেন আপনারা, রানিমা নেই।
সেইখানেই তো গোলমেলে ব্যাপার।
দুজনের কথায় মিলছে না। মিশিরজি বলছে, নিত্যদিনের মতো বিন্দু রানিমার রাতের খাবার ক্ষীরটা নিয়ে যাবার জন্যে তাঁর নিজস্ব বাসন ঢাকা দেওয়া রুপোর বাটি আর ঢাকা দেওয়া রুপোর গেলাসটা নামিয়ে এনে মিশিরজিকে বলে, ‘‘গতকাল ক্ষীর পাতলা হয়েছিল, রানিমার পছন্দ হয়নি। আজ যেন ঘন হয়। চটপট নিয়ে যেয়ো ঠাকুর। রানিমাকে চেয়ারে বোস করিয়ে রেখে এয়েছি। আমি চললুম। আজ নার্স দিদিমণি নাই, উনি একা রয়েছে।’’ … বলে চলে যায়। মিশিরজি না কি তখন ক্ষীরটা আর একটু জ্বাল দিয়ে বাটিতে ভরে, ঢাকা বার করে দুহাতে বাটি গেলাস নিয়ে যেমন যায় তেমনি গিয়ে দেখে, ঘরে রানিমাও নেই, বিন্দুও নেই। … ভাবল যেমন ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়, তাই গেছে। তাই ভেবে পাথরের টেবিলটার ওপর সেদুটো নামিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল কিন্তু টেবিলটা বসানো, তার কাছে বেতের সেই চেয়ারটা কই? বিছানা থেকে সাবধানে নামিয়ে, যেটার ওপর রানিমাকে বসিয়ে দেওয়া হয় খাবার সময়। … তো একটু দাঁড়ানোর পরই বাইরে ছাদের দিক থেকে যেন পাগল হয়ে বিন্দু ঘরে এসে বলে ওঠে, মিশিরজি। নীচে থেকে এসে রানিমাকে দেখতে পাচ্ছি না। সব ঘর বারান্দা ছাদ খুঁজে এলাম কোথাও নেই।
মিশিরজি বকা দিয়ে বলেছিল, উনি কী নিজে চলাফেরা করতে পারেন? তাই ছাতে খুঁজতে গেছ? …তারপর আবার নিজেও তা করেছিল। গোলোক ধাঁধার মতো ঘরদালান, বার বার খুঁজে মরেছে , কোথাও কোনো চিহ্ন নেই।
…অথচ বিন্দু বলছে, সেনাকি রানিমাকে খাইয়ে শুইয়ে, রুপোর বাটি গেলাসটা ছাদের ঘর থেকে ধুয়ে এনে দেখে রানিমা বিছানায় নেই। তখন ভয় পেয়ে নীচে এসে চুপিচুপি মিশিরছিকে খবর দেয়। …তখন মিশিরজি গিয়ে খোঁজাখুজি করে এসে, আমায় খবর দেয়।
এম. কে. আস্তে বলে, আপনার কার কথাটা ঠিক বলে মনে হয়?
দেখুন, বোঝা শক্ত। ওরা দু-জনেই ব্যাপারটা ভৌতিক ভেবে এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল, চোখ নাক সব কপালে উঠে গিয়েছিল। তাই উলটো পালটাও বলে ফেলছিল। …আসলে মিসেস ভঞ্চু না থাকাতেই—এই কান্ড ঘটতে পেরেছে।
বাড়ি সুদ্ধু সকলেরই কি মনে হয়েছে, ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে?
দেওয়ানজি একটু হেসে বলেন, সত্যি বলতে ব্যাপারটা এতই আকস্মিক যে, প্রথমটা হতভম্ব হয়ে সবাই তাই ভেবে বসেছিল। তারপর তো অনেকরকম কথার চাষ হচ্ছে তলেতলে! সেইজন্যেই গণনা করাতে জ্যোতিষীর কাছে ছুটেছিলাম।
এতক্ষণ যা কথা, এম. কে-ই বলছিল, টি. সি. যেহেতু অ্যাসিস্টেন্ট, তাই চুপচাপ ছিল। এখন বলে উঠল, তখন কত রাত?
ওই তো। রানিমাকে তো খাবার দেওয়া হত ঘড়ির কাঁটায় আটটায়। তো এইসব জানাজানি হতে নটা-দশটা বেজে গেছল।
রাজাবাবু আর তাঁর রানি তখন কোথায় ছিলেন?
আর বলবেন না। রানিও তো তার দু-দিন আগে মালদায় বাপের বাড়ি গিয়ে রয়েছিলেন ভাইপোর উপনয়ন উপলক্ষে। দু-দিন পর ফিরলেন।
যাচ্চলে—তিনিও সেরাত্রে অনুপস্থিত? আর রাজাবাবু?
উনি নিজের ঘরে বইটই নিয়ে বসেছিলেন, যেমন থাকেন। বাপ ঠাকুদার মতো অন্য কোনো নেশাটেশা তো নেই। নেশার মধ্যে বই পড়া।
তা উনি শ্বশুরবাড়ির ঘটায় নেমন্তন্নে যাননি?
উনি? না: রাজারাজড়াদের ওসব নিয়ম নেই। বেশি খরচ করে লৌকিকতা করলেই হল।
কী করলে?
লৌকিকতা! মানে—
ও বুঝেছি, প্রেজেনটেশন। … তো যাইহোক ঠাকুমা হারানোর রাতে তিনি ছিলেন। …এবং রানি ছিলেন না।
পাকেচক্রে সেটাই ঘটেছিল।
ক-দিন হয়ে গেল?
দেওয়ানজি হতাশ গলায় বলেন, এই তো আজ সাতদিন হয়ে গেল। কী জানি কোথায় আছেন, আদৌ আছেন কী নেই।…ভৌতিক ব্যাপার ছাড়া সাধারণ লোকেরা তো আর কিছু ভেবে বার করতে পারছে না। তবে—কুটিল লোকেরা—তো সেতো আপনাদের আগেই বলেছি। ট্যাঁপা হঠাৎ খুব রাগের গলায় বলে ওঠে, অথচ আসল লোক, রানিমার আদরের নাতি সাহেবটি তো তেমন হই চই করে খোঁজার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। নেতিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।
কী করবেন! আকস্মিক এই অদ্ভুত দুর্ঘটনায় নার্ভাস ব্রেক ডাউন। একটু হার্ট অ্যাটাক মতোও হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া হই চইটাই তো চাইছেন না।
না চাইলেও হবে না বলে মনে করেন? রাজ্যের লোকেরা যদি ঠিকভাবে জেনে যায়, বুড়ো রানিমা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেছেন, আর তাঁর নাতি রাজা পুলিশে একটা খবর পর্যন্ত দেননি, রাজ্যের লোকেরা খেপে উঠবে না? রাজার বিরোধী পক্ষরা তাতে উৎসাহ দেবে না? তখন কী হবে?
দেওয়ানজি মলিনভাবে বলেন, সেই তো! তবে তলে তলে চেষ্টা চালানো হচ্ছে না, তা নয়। ওই যে মিসেস ভঞ্চু, ওঁর সম্পর্কে একটু সন্দেহ বোধ করে খোঁজ করা হচ্ছে ওঁর বাড়ি কোথায়, মায়ের অসুখ না, কী যেন বলে ছুটি নিয়েছিল, সেটা সত্যি কি না।
উনি কাজটা কী করতেন?
উনি? রানিমা দিনে যে ছ-আটবার ওষুধ খান, সেগুলি নিয়মমতো খাওয়াতেন, রোজ অকারণেই টেম্পারেচার নিতেন। প্রেসার চেক করতেন যখন তখন, তা ছাড়া নানারকমতেল-মশলা মাখিয়ে রানিমাকে স্নান করাতেন।
ট্যাঁপা হঠাৎ হেসে ওঠে, তেল-মশলা দিয়ে রান্নাই তো হয় জানি, স্নানও হয়।
দেওয়ানজিও হাসেন একটু,তা হয়। ওটা রাজপরিবারের নিয়ম বা বাতিকই বলা যায়। …তবে এই বর্তমান রাজা রানির ওসব পাট নেই বলে রানিমা যথেষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। …বিশেষ করে এই রানি বিদ্যুৎলতাকে তো তাঁর ওই বাইরের কাজকর্মের ব্যাপারে দুচক্ষে দেখতে পারতেন না. …পারিবারিক নিয়মে প্রতিদিন সকালে যখন রানিমাকে প্রণাম করতে যেতেন, উনি নাকি মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতেন। ওই যে খোকারাজাকে দার্জিলিঙে পড়তে পাঠানো হয়েছে, তাতেও নাতি নাতবউয়ের ওপর মহা খাপপা। …আসলে বেশ একটু মেজাজি তো। ওই তো বলেছিলাম, নিজের মেয়েরাও মায়ের কাছে বিশেষ আসতে পারে না বলে, তাদের ওপর এত খাপপা, যে সাফ বলে রেখেছেন, বিষয়সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করবেন। রাজাই মেজাজ।
তা একটু আছে বটে।
এম. কে বলে ওঠে, আচ্ছা, এখন মাত্র বেলা সাড়ে এগারোটা, এখনও তো দুপুরের খাওয়ার দেরি ,এই সময় রানিমহলটি একবার দেখে নিলে কেমন হয়? আপনার অসুবিধে হবে কি?
না, আমার আর বিশেষ কী? তাই চলুন!
চৌবাচ্চার একপাড় থেকে আর এক পাড়ে চলে যান। …সিঁড়ির সামনে পৌঁছোন। তারপর বলে ওঠেন, দাঁড়ান পঞ্চুকে একবার ডাকি, কোলাপসিবলটা ঠেলে দেবে!
তেতলায় ওঠার সিঁড়ির সামনেটায় বিরাট কোলাপসিবল গেট।
ট্যাঁপা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কী আবার দরকার ডাকাডাকির? আমি ঠেলে দিচ্ছি। তা তালাচাবি লাগানো তো!
দেওয়ানজি তার পইতেয় বাঁধা একটা মস্ত লোহার চাবি টেনে বার করে তালাটা খুলে ফেলেন। বলেন, আমাকে তো রোজ সকালে একবার করে রানিমার কাছে আসতে হত সেরেস্তার কাগজপত্র দেখাবার জন্যে, তাই একটা ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে থাকে! জানি না আর কখনো—
এরা অবাক হয়ে বলে, উনি থাকতেও সব সময় তালাচাবি লাগানো থাকত?
তা থাকত! সেটাও ওঁর বাতিক। তবে বিশেষ বিশেষ লোকের কাছে একটা করে ডুপ্লিকেট আছে। যেমন রাজাবাবু, মিশিরজি, বিন্দু, আর এই যে আমার কাছে।
আচ্ছা কারণটা কী?
কী জানি! ওঁর ধারণা ‘ভালমতো সুরক্ষিত আছেন’ জানতে পারলে, মনে স্বস্তি থাকে!
অথচ সেই সুরক্ষিত দুর্গ থেকে ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেল। হি হি! বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো! হি হি—
এম. কে. যাকে বলে রক্তচক্ষে তাকায়, কিন্তু টি. সি.-র সেদিকে তাকাতে বয়েই গেছে।
দেওয়ানজি অবশ্য তেমন কিছু মনে করেন না।
তিনতলায় উঠে এরা সত্যিই অবাক হয়ে যায়। এখানে মোটেই তেমন পুরোনো পুরোনো ছবি নেই। মেঝেয় মার্বেল পাথরের বদলে মোজাইক টাইলস, জানলায় জানলায় বাহারি গ্রিল। …আর গড়ন যাকে বলে সত্যিই গোলোক ধাঁধা।
দেওয়ানজি বলেন, সত্তর বাহাত্তর বছর আগে, তো সব কিছুতে বিলিতি বাহার, সাহেব ইঞ্জিনিয়ার ডাকিয়ে, নিজে প্ল্যান বাতলে কর্তারাজাকে দিয়ে এসব করিয়েছিলেন রানি মায়াবতী। কর্তারাজারও যত বন্ধু ছিল, সব সাহেব সুবো। তাদের সঙ্গে শিকারে যেতেন, বাড়িতে ‘বল ডান্স’ বসাতেন, সেনাকি এক রমরমার দিন ছিল। আমি অবশ্য তখন আসিনি। জন্মাইনিই। …শোনা কথা।
তা এরাও শুনে যায়, এই যে, এ ঘরে কর্তারাজা সেরেস্তার কাজকর্ম দেখতেন। এ ঘরে সাজপোশাক করতেন। এটা পারিবারিক ড্রইংরুম। আপনজনদের নিয়ে বসতেন টসতেন।
ঘরে ঘরে বড়ো বড়ো দেয়াল জোড়া আরশি, দেয়ালে দেয়ালে বিরাট বিরাট অয়েল পেন্টিং, ফোটোও। চেয়ার টেবিল সোফা সবই বড়ো বড়ো।
কিন্তু সারি সারি ঘর নয়। প্রত্যেকটা যেন প্রত্যেকের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন …একটু ছোট্ট বারান্দা, একটুখানি করিডোর, একটি হয়তো—কাশ্মীরি কাঠের শৌখিন তিনকোণা পর্দার আড়াল।
তবে সবেই ষাট সত্তর বছরের ছাপ আঁকা।
কিন্তু রানিমার বেডরুমটা কোনটা? যেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেলেন।
সেটা এই এদিকে।
দুটো সিঁড়ি উঠে, এবং একটুখানি প্যাসেজ পার হয়ে দুটো সিঁড়ি নেমে রানিমার ঘর।
কী অদ্ভুত খেয়াল।
ওই তো!…
এ ঘরে ঢুকতেই সামনের দেয়ালে চোখে পড়ল, সোনালি ফ্রেমে আটকানো মুকুট পরা এক রানির ছবি।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, রানি মেরির ছবি না?
দেওয়ানজি হাসেন,না রানি মায়াবতীর। কম বয়েসে নাকি কলকাতার হ্যামিল্টনের দোকান থেকে রানি মেরির মুকুটের ডিজাইনে মুকুট আর গলার গহনা গড়িয়ে ‘রানি মেরি সেজে কোনো সাহেব ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে ছিলেন।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, বা:। তার বেলায় দোষ হয় না? আর এখনকার রানি গরিব ছেলেদের জন্যে স্কুল করতে বাইরে বেরোলে—যত দোষ?
দেওয়ানজি এখনও হাসেন, সেকালে রাজারাজড়াদের আভিজাত্যের মাপকাঠিই ছিল আলাদা। সাহেব মেম নিয়ে মাতামাতিতে তাঁদের আব্রু নষ্ট হত না। হত নিজের রাজ্যের দেশীয় লোকেদের বা প্রজাদের সামনে যেমন তেমন করে বেরোলে। …সেযাকগে। এসব আমি দেখিনি। কর্তারাজাকেও দেখিনি। ওঁর ছেলের আমলেই—
আচ্ছা দেওয়ালে আর যেসব ছবি?
ওই যে রং বোঝা যাচ্ছে না অয়েল পেন্টিংটা? ওটা মায়াবতীর শাশুড়ির। আর এধারে ওনার পুত্রবধূ রানি, বর্তমান রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের মা, রানি পুষ্পমালার। দু-পাশে ওই দুজন ওনার দুই মেয়ে।
তার মানে এটি প্রমীলারাজ্য? বলে হাসে এম. কে।
তারপর দুজনেই বলে ওঠে, কিন্তু এঘরটা এত ফাঁকা কেন? শোবার খাট আর ছোটো ছোটো দুটো টেবিল ছাড়া কোনো ফার্নিচারই নেই দেখছি। এত বিশাল ঘর। এরকম শূন্য। দেখে গা ছমছম করছে।
শোবার ঘরে জবড়জং পছন্দ করতেন না উনি। সব কিছুই ওঁর দেওয়ালের মধ্যে ভরা।
বলে দেওয়ানজি দেখান, এই যে প্রতিটি জানলা দরজার মাঝখানগুলির দেওয়ালে পালিশ করা কাঠ মারা দেখছেন? এসব হচ্ছে দেওয়াল আলমারি।
তাই নাকি? আমরা তো ভেবেছিলাম এই ফ্যাশান। রঙিন দেওয়াল না হয়ে পালিশ দেওয়াল।
না: সব আলমারি। বাইরে থেকে বোঝবার উপায় নেই। ছোট্ট একটু গা চাবি আছে।…পাল্লা খুললেই সরে গিয়ে দেওয়ালের খাঁজে ঢুকে যায়। …এমনকী ওঁর ড্রেসিং আয়না পর্যন্ত এই দেওয়ালে। এর চাবি নেই। শুধু একটা বোতাম। বলে টিপে সরিয়ে দেন দেয়ানজি।
আর দেখা যায় খাঁজের মধ্যে যেন ছোট্ট একটু ঘরের দেয়ালে সাঁটা ড্রেসিং আয়না। তার সামনে তাকে নানাবিধ শিশি—কৌটো।
দেওয়ানজি আবার কোথায় যেন হাত দিয়ে ফট ফট দুটো তিনটে সুইচ টিপে দেন, আয়নার দুপাশে আর মাথার ওপর জোরালো বালব জ্বলে ওঠে।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, বাবা:! কত কায়দা!
বলেই মনে মনে নিজের কানটা মুলে নেয়।
মদন আর ওর দিকে তাকায় না। খুব মন দিয়ে ঘরের অন্য সব জিনিস দেখে। …কিছুই জিনিস নেই। শুধু খাট আর তার পাশে একটা ছোটো টেবিল। তাতে ওষুধপত্র, এটা ওটা।
দেওয়ানজি অবশ্য তাঁর গোয়েন্দার অ্যাসিস্টেন্টের মন্তব্যে কিছু মনে করেন না। স্মৃতির আবেগে বলে চলেন, সবই বিলিতি কায়দা! সায়েব মিস্ত্রিদের কারবার। ….তো ওইসব ব্যবহার করা তো কবেই বন্ধ। ওঠাউঠিই নেই দশ বিশ বছর। আমায় ছেলের মতো ভালোবাসেন, তাই একদিন বলেছিলেন, ‘খুলে দেখো তো রঘুনাথ,আলোগুলো এখনও জ্বলে কি না।’ বাকি আলমারিদের কখনো খোলা দেখিনি। শুনেছি কর্তারাজার মানে রানি মায়াবতীর স্বামীর সব জিনিসপত্র তুলে রাখা আছে। তাঁর শিকারের সরঞ্জাম, দরবারি পোশাক টোশাক তা ছাড়া বিলিতি কেতার সাজের সুট বুট ছড়ি টুপি, সেতো অসংখ্য!
সবই দেওয়ালের মধ্যে। ঘরটা তাই এত ফাঁকা দেখাচ্ছে। বাবা, ঘর নয়তো মাঠ।
এম. কে. শান্তগলায় বলে , টি. সি. তুমি একটু থামবে?
দেওয়ানজি বলেন, না না, উনি তো ঠিকই বলেছেন। এই এতবড়ো ঘরে বৃহৎ একটা পালঙ্কে পাখির মতো রোগা একটা মানুষ। পাখির মতোই হালকা হয়ে গেছলেন ইদানীং। আহারও পাখির। তবু নিয়মটি ঠিক থাকা চাই। দু-বেলা পালঙ্ক থেকে নামিয়ে ওঁর স্পেশাল একখানা চাকা দেওয়া চেয়ারে বসিয়ে ঠেলে ঠেলে পাশের খাবার ঘরে নিয়ে যেতে হত!…সেই চেয়ারেই সকালবেলা একবার করে ছাদের ফুলবাগানে বেরিয়ে আনত!
এম. কে. বলে ওঠে,কই সেই চেয়ারটা? দেখি।
দেওয়ানজি একবার পাশের ঘরে ঘোরাঘুরি করে এসে বলেন, কই দেখছি না। বোধ হয় ছাতেই আছে। চলুন না বাগানটাও দেখিয়ে আনি আপনাদের। চমৎকার বাগান।
চলে আসে তিনজনে। …বিশাল তিনদিকের ছাত জুড়ে মানেই তিনদশে তিরিশখানা ঘরের মাথায় সত্যিই চমৎকার বাগান। কত রকমের যে টব। ছোটো বড়ো নানা ডিজাইনের। আর দেশি বিদেশি নানা ফুলের সমারোহ। সতেজ সুন্দর। …তবে চেয়ারটা সেখানে নেই।
আচ্ছা এত সুন্দর বাগান কে করেছে? কে দেখে শোনে?
কে আর? পুরোনো মালির ছেলে আর নাতি। এখানে অনেকেরই পুরুষানুক্রমে কাজ। কীসে কী সার লাগে সব জানে।
ট্যাঁপা আবার বলে ওঠে, তাহলে ওদের কাছেও ডুপ্লিকেট চাবি থাকে।
চাবি? ডুপ্লিকেট? …ও হো হো। না না ওরা রানির মহল দিয়ে আসা যাওয়া করে না। ওদের আলাদা ব্যবস্থা। এই রানি মহলের ঠিক নীচেই যে ঘর বারান্দা, তার এক জায়গায় চওড়া কার্নিশে একটা লম্বা লোহার মই আটকানো থাকে, মালিরা তাই দিয়েই ওঠানামা করে। তবে ছাদে তো জলের ব্যবস্থা রয়েছে, মস্ত ট্যাংকে কল লাগানো।
কার্নিশে মই লাগিয়ে ওঠানামা? পড়ে যাবার ভয় নেই?
আরে বাবা। তাকে কার্নিশ বললে, কার্নিশ, বারান্দা বললে বারান্দা।
হাত দুই চওড়া। আধুনিক কালে কংক্রিট দিয়ে বানানো। সবই ওই রানিমার মাথা থেকে বার করা। দারুণ মাথা! …অথচ সেই মানুষই এখন—
একটা নিশ্বাস ফেলেন।
কিন্তু চেয়ারটা?
কী জানি, বিন্দু কোথাও সরিয়ে রেখেছে হয়তো। দেখে মন খারাপ লেগেছে হয়তো।
তুচ্ছ চেয়ারটা নিয়ে ভাববার কী আছে, ভেবে পান না দেওয়ানজি।
এম. কে. বলে, আচ্ছা এইসব আলমারিগুলোর ভেতরটা দেখবার পারমিশান পাওয়া যাবে? মানে, জাস্ট একটু কৌতূহল। রাজামশাইয়ের দরবারি পোশাক কেমন ছিল। শিকারের সাজসরঞ্জাম কেমন দেখতে…।
দেওয়ানজি বলেন, পারমিশান না পাওয়ার কী আছে? দেখবেন বই তো আপনারা নিয়ে যাবেন না। রাজাবাবুকে একটু বললেই হবে। তবে ওদের চাবিটাবি কোথায় আমার জানা নেই। …কিন্তু এখন নেমে যাওয়া যাক। বেলা হয়ে গেছে। আবার ওবেলা হবে। চলুন।
নেমে আসে তিনজনেই। আবার কোলাপসিবল ঠ্যালা হয়, তালা লাগানো হয়।
এম. কে. আর টি. সি. বলে কই দেখি সেই কার্নিশটা কোনদিকে? কোনখানে মই লাগিয়ে মালি উঠে গাছের যত্ন সেবা করে।
দেওয়ানজি মনে মনে হাসেন , নেহাতই ছেলেমানুষ। অযথা কৌতূহলেই অস্থির। ওই ব্যবস্থা সবাই জানে। কে কবে দেখতে যায় ‘কী’ করে।
গেল সেদিকে। বাড়ির পেছন দিক সেটা। সারি সারি বন্ধ ঘর। তার পেছনের বারান্দা। কিন্তু ঝুঁকে পড়ে দেখতে পায় না, সেই মই। কীভাবে ওঠে। জল না নিয়ে যেতে হোক, মাটি সার এসব তো নিয়ে যেতে হয়।
দেওয়ানজি বললেন, দেখতে পাবেন না, দেয়ালের গায়ে ‘হুকে’ সাঁটা থাকে। ও আর দেখে কী হবে? যাঁর শখের বাগান, তিনিই এখন কোথায় তার ঠিক নেই, আর বাগান।
বেহারি বুড়ো ভদ্রলোক বড়োই কাতর হয়েছেন।
নীচের তলায় নেমে এসে খাওয়া দাওয়ার সময় দেওয়ানজি একটি বয়স্কা মেয়েকে ডেকে বলে ওঠেন, বিন্দু রানিমার চেয়ারগাড়িটা কোথায়?
বিন্দু বাইরের বাবুদের দেখে লজ্জায় জড়সড়ো হয়ে ঘোমটা টেনে আস্তে বলে, ওইখানে তো আছে।
দেখলেন তো। বললাম? আচ্ছা আবার যখন যাওয়া হবে দেখাব। এমন কিছু আহামরি নয়। সাধারণ বাহারি ধরনের একখানা বেতের চেয়ারের পায়ায় চারটে ছোটো ছোটো চাকা লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে।
রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না?
বলেছেন সন্ধ্যার পর।
তাহলে, আমরা এখন একটা কিছু করি।
বলুন কী করতে চান?
আচ্ছা—ওই আপনাদের পঞ্চু বলছিল, একটা নাকি ‘অ্যালবাম খাতা’ আছে, তাতে রানিমার অনেক ছবি আছে।
শুনে দেওয়ানজি স্বস্তি পান। যাক বাবা, এখন আবার ‘ছাদ দেখা বাগান দেখা’ করতে বসবে না। তাহলে বসে বসে ছবিই দেখুক।
এরা যে কিছু করে উঠতে পারবে, এমন আশা রাখছেন না। ভাগনি বলেছে, কোনো ভালো জ্যোতিষীর সন্ধানে থাকবে, খবর পেলে চিঠি লিখে জানাবে। হাওড়ায় না কোথায় যেন ‘জানবাড়ি’ বলে কী আছে, সেখানে নাকি, হারানো টারানো ব্যাপারে সব বলে দিতে পারে। …তবে এদের যখন ডেকে-ডুকে আনা হয়েছে, মান সম্মানটা তো দিতেই হবে।
তাই এখন এরা কিছু হুটপাট করতে চাইছে না দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বলেন, দপ্তরখানা থেকে আনিয়ে দিচ্ছি। পূর্বকাল থেকে যত সব ফটো অ্যালবাম আছে রাজাদের, সাহেব সুবোর সঙ্গে ছবি, শিকারের ছবিটবি, দরবারের ছবি, সবই রক্ষিত আছে। তবে রানিমার ইদানীং-এর ছবি নেই। বয়স হয়ে যাবার পর, চেহারা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আর ছবি তোলাতে দিতেন না।
এম. কে. বলে, বেশিকিছু দরকার নেই, ওই রানি মেরি মার্কা ছবিটি ছাড়া ঘরে তো আর কিছু দেখলাম না। এমনি অন্য যদি কোনো ছবি থাকে।
দেওয়ানজি নীচে নেমে যান, খানিকক্ষণ পরে পঞ্চুকে দিয়ে মোটা মোটা খানতিনেক অ্যালবাম পাঠিয়ে দেন।
পঞ্চু একগাল হেসে বলে, এই ন্যান। বসে বসে ছবি দেখুন। দেওয়ানজি শুধোল বৈকেলে কটার সময় চা খান আপনারা?
কী মুশকিল। আমরা কি বরযাত্রী এসেছি? তাই এত—আদর আপ্যায়ন। তোমরা সবাই যখন খাবে, তখনই খাব।
আমাদের কথা বাদ দ্যান। তো যতই হোক কুটুম ঘরের ছেলে তো বটে।
আমরা কুটুম ঘরের ছেলে?
কেন, তা নও? ছোটো মেনেজারবাবু তো তাই বলল। দেশ বেড়াচ্ছ, রাজবাড়ি দেখতে এয়েছ। তো এসে দেখছ এই বিপদ। তবু যত্নআত্তি তো করতে হবে। …তালে বলে দিইগে, চায়ের জন্যে আপনাদের কোনো নিয়ম নাই। যখন পাবে তখন খাবে। …আর হ্যাঁ দেওয়ানজি বলে দিল, এই লাল মলাট খাতা খানায় শুধুমাত্তর, বুড়ো রানিমার, আর ওনার ছেলের বই, এই রাজাবাবুর যিনি মা ছিল সেই রানিমায়ের ফটোক ছবি আছে। গাদাগাদা। আর এই কালো খাতা দুটোয় যত সব গুরুপ ফটোক। …।
চলে যেতে যেতে আবার ফিরে আসে, চুপিচুপি বলে, আর হ্যাঁ, বলে দিল, আপনারা দুপুরবেলা ঘরে খিল ছিটকিনি লাগিয়ে শোও বসো।
দুপুরবেলা খিল ছিটকিনি লাগিয়ে? আশ্চর্য! কেন বল তো?
পঞ্চু দুহাত উলটে বলে, বুড়োর খেয়াল। তো বলছিল, কেউ এসে পাছে আপনাদের রিক্ত করে। …জানলাগুলান তো খোলা আছে, হাওয়ায় আটকাবে না। আর ফ্যানও তো রয়েছে। একটু ঘাড় নড়বড়ে বটে। ভয় লাগে বুঝি মাথায় এসে পড়বে। তো পড়ে না।
বলে হি হি করতে করতে চলে যায়।
এম. কে! কী করব? দরজা লাগাব?
বলেছে যখন লাগা।
আমারও এটাই পছন্দ। ফস করে যখন তোর নাম ধরে ডেকে বসব, আর কেউ শুনতে পারে। এ বেশ ভালো হল।
অ্যালবামে সাঁটা বেশিরভাগ ছবিই হলদেটে হয়ে গেছে। তবে বোঝা যাচ্ছে, রানি মায়াবতী একখানা সুন্দরী ছিলেন বটে। নানা বয়েসের নানা ভঙ্গির ছবি। আপাদমস্তক গহনায় মোড়া, আবার হালকা সাজ, কত যে ছবি। শৌখিন ছিলেন বটে মহিলা।
রাজা হারীন্দ্রনাথের রানি শান্তিলতার তেমন সৌন্দর্যও নেই, তেমন মহারানি মহারানি ভাবও নেই।
দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভালোমানুষ ছিলেন, নারে এম. কে.?
তাই মনে হচ্ছে। তা ছাড়া দাপটওলা মহারানি মার্কা—শাশুড়ির ভয়েই হয়তো—
অল্প বয়সে তো বিধবাও হয়েছেন শুনলাম। বেচারি । এই রাজা তখন নাকি নেহাত ছোটো তাই না?
এম. কে. তখন নিবিষ্ট হয়ে দেখেই চলেছে।
একসময় বলে, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস টি. সি.?
কী বল?
তুই বল।
টি. সি. বলে, বলল তো এনার কোনোও ভাইবোন হয়নি। একমাত্তর ছেলে। কিন্তু রানি মায়াবতীর দু-একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটু ছোটো বড়ো দুটো ছেলে। একরকম পোশাক পরা। ঠিক পিঠোপিঠি ভাইয়ের মতো। আবার ওই রানি শান্তিলতার দু-চারটে ছবিতেও তাই। এরমধ্যে তো আবার শুধুই ছেলে দুটোর ছবি। ধারে পাশে একগাদা খেলনা পত্তর।
গুড।
এম. কে. ওর পিঠটা ঠুকে দিয়ে বলে, আমিও ঠিক ওটাই লক্ষ করেছি। …ইস টি. সি..-রে। তোর এত মাথা। তবু কেন যে এত কথা।
টি. সি. এখন বরাবরের মতো নিজের দোষ স্বীকার না করে বলে ওঠে, গোলামার্কা লোকেদের সঙ্গে একটু বেশি কথা কইলে সুফল পাওয়া যায়রে। তাদের মধ্যেকার বেশি কথাগুলো হড়বড়িয়ে বেরিয়ে আসে।
বলছিস?
আমার তো তাই ধারণা।
তবে চালিয়ে যা।
বলে হেসে ওঠে।
তারপর বলাবলি করে দু-জনে, হয়তো ছিল দুটোই ছেলে। একটা হয়তো অল্প বয়সে মারা গেছে। মনের দুঃখে তাই আর সেকথা উল্লেখ করে না।
তাই হবে। সবকটা ছবিতেই দেখ একরকম পোশাক।
কালো মলাটের অ্যালবাম থেকেও তেমন ছবি দু-চারখানা দেখা যায়। নেহাত ছোটোও নয়। বছর দশ বারো মতো বয়েস হবে। ..ছেটো ছেলেটা যেন বেশি সুন্দর দেখতে।
এত বড়ো হয়েছিল? তবু কিছু বলল না। আশ্চর্য। রাজাকে একমাত্তর ছেলে বলে বানাচ্ছে।
কারণ কী বল তো?
ওই তো বললাম। দুঃখ উথলে ওটার ভয়।
না: ওই বয়েসের পরে আর দু-জনকে দেখা যাচ্ছে না। একাই রাজপুত্র বড়ো হচ্ছেন। …মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওই দুটো ছেলের মধ্যে বড়োটাই।
আরে বাবা! রাজা তো দেখছি বেশ বিদ্বান রে। এম. কে? গ্র্যাজুয়েট হওয়া টুপি মাথায় ছবিও রয়েছে। রাজপুত্তুরা তো, তেমন হয় না শুনি।
যা বলেছিস টি. সি.। আগের জনেরা কী ছিলেন কে জানে। শিকার করা ঘোড়ায় চড়া সাহেব সুবো নিয়ে মাতা, ওই সবই তো শুনলাম।
না:। টি. সি. তুই যতই হ্যাবলা ভ্যাবলা ভান করিস, তোর ব্রেন আছে।
টি. সি. গম্ভীরভাবে বলে, বেঁটে গোল্লা রসগোল্লা মার্কা চেহারাদের মগজে বুদ্ধি থাকে, একথা কেউ মানবে?
তবু লম্বা বেঁটে দুজনেই, সারাদুপুর ধরে ওই ছবিগুলোই দেখতে থাকে। …গ্রূপ ফটোয় কে কার বোঝা যায় না। তবে মনে হয় কোনো বিয়ে টিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে অনেকে একত্র হলে, সেকালে যেমন তেঠেঙে টুল ফিট করে তাতে ক্যামেরা বসিয়ে ফটোগ্রাফাররা মাথায় কালো কাপড় ঢেকে যেসব ছবি তুলত, এ হচ্ছে তাই। এখনকার মতো উঠতে বসতে এত বেশি ফটো তোলা রাজা মহারাজাদের ঘরেও ছিল না।
তবে তন্ন তন্ন করে দেখা গেল, ওই দুটো ছেলের মধ্যে ছোটোটাকে বছর দশ-বারো মতো পরে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে মারাই গেছে, কী বলিস?
তাই হবে।
বিকেল চারটের আগেই এরা দরজা খুলে রেখেছিল।
বারান্দার একধারে বাথরুম, সেখানে আলনা আরশি, ফর্সা তোয়ালে সাবান টাবান সবই মজুত। মানে অবস্থা পড়তি হলেও, অভ্যাসরীতি আতিথ্যের কমতি হয় না। হয়তো আরশিতে ছাতা ধরা, আলনাটা নড়বড়ে, তোয়ালেটা তেমন দামি নয়, সাবান টাবান তেমন নামি নয়, তা ছাড়া সবই ঠিক আছে।
ঠিক চারটের সময় পঞ্চুবাহিত হয়ে চা আসে। তারসঙ্গে বিস্কুট ও বেশ গোটাকতক মিষ্টি।
এরা বলে, মিষ্টিগুলো নিয়ে যাও বাবা। ওসব এখন চলবে না।
পঞ্চু আকুতির গলায় বলে, খাও না। এখানের মিষ্টি ভালো।
তা হোক। চায়ের সঙ্গে মিষ্টি টিষ্টি খাই না আমরা।
ফেরত নিয়ে যাব?
পঞ্চুর করুণ গলা।
ট্যাঁপা হেসে বলে, বয়ে নিয়ে যেতে কষ্ট হয়, পেটে ভরে নিয়ে চলে যেতে পারো।
ধ্যাৎ।
বলে কান থেকে কান হাসে পঞ্চু।
এম. কে. আস্তে বলে, ওরা অবশ্য ভাববে আমরাই মেরে দিয়েছি।
ট্যাঁপা বলে, ভাবলেই বা কী? মেরে দিতেই তো পাঠিয়েছে। তা ছাড়া ফেরত দিলেই যে শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে কে জানে। তারপর বলে, এই একটা সন্দেশ আমরা নিলুম, দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিচ্ছি। বাকিগুলো তুমি ফুরিয়ে ফেলে খালি প্লেট দুটো নিয়ে যাও মানিক, তাহলে আর কেউ আমাদের বকবে না।
পঞ্চু আবারও বলে য্যা:। এবং আর একবার বলতেই হঠাৎ—এদের দিকে পেছন ফিরে গবগব করে গোটাসাতেক মিষ্টি মুখে চালান করে প্লেট দুটো নিয়ে ঘাড় গুঁজে পালায়।
তার ভাব দেখে এরা হেসেই অস্থির।
একটু পরে আবার আসে পঞ্চু খালি পেয়ালা নিতে। আস্তে আস্তে বলে, কেউ যেন টের না পায় কুটুমবাবু।
পাগল। কী করে পাবে? আমাদের বকুনি খাবার ভয় নেই?
শুনে বেশ আশ্বস্ত হয় পঞ্চু। এবং ‘আপনারা খুব ভালো’ বলে একটি সার্টিফিকেট ঝেড়ে হৃষ্টচিত্তে নীচে নেমে যায় পঞ্চু।
খানিকপরে দেওয়ানজি আসেন।
চা টা দিয়েছে? ঠিক আছে। … তো একটা কথা জানাই, আজ আর সন্ধ্যায় রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা হবে না।
হবে না।
না। মানে, বলছেন আজ শরীরটা একটু বেশি খারাপ লাগছে। বরং কাল সকাল নটা সাড়ে নটার সময়—
ঠিক আছে। ..তাহলে , সন্ধ্যাটা আমাদের আর একটা কাজ করতে দিন।
দেওয়ানজি ভীতভাবে বলেন, সন্ধ্যায় আবার কী কাজ? দুপুরে তো ছবি টবি দেখলেন।
সেআর এমন কী! …আমরা তো এখানে সত্যি বরযাত্রী আসিনি যে, যত পারব খাব, আর গড়াব। সন্ধ্যার দিকে যদি কয়েকজনকে কিছু জিজ্ঞেস করি?
দেওয়ানজি স্তিমিতভাবে বলেন, কাকে কাকে বলুন?
এই অন্তত ওই বামুন ঠাকুর মিশিরজিকে, আয়া বিন্দুকে, নার্স মিসেস ভঞ্চুকে—
মিসেস ভঞ্চুকে তো এখন পাওয়া যাবে না। এখানে কাজটা বন্ধ হওয়ায়, এখন ‘রাজ-হাসপাতালে’ ডিউটি দিচ্ছে। …আর মিশিরজির তো রাত দশটার আগে নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। তবে বিন্দুকে পেতে পারেন।
আচ্ছা তাই সই। মিশিরজিকে না হয় রাত দশটার পরেই পাকড়াও করা যাবে। আচ্ছা ছোটো ম্যানেজারবাবু তো এখানেই থাকেন?
কী? ওই রামজীবনটাকে জেরা করবেন? ওর পেট থেকে সত্যি কথা আদায় করতে পারবেন? সত্যিকথা বলা ওর কুষ্ঠিতে নেই।
না, ঠিক ওঁকে নয়। ওঁর স্ত্রীকে যদি—
ওর স্ত্রী? সেকী আর রাজি হবে? ভয় খাবে…
বলবেন, ভয়ের কিছু নেই। আমরা পুলিশের লোক নই, কিছুই নই, এমনি, শখের গোয়েন্দা—
ভয় আপনাদের নয়, পুলিশকেও নয়। ভালো মেয়ে। সত্যিবাদী। কিন্তু ভয় ওর নিজের স্বামীকেই। জানতে পারলে হয়তো ঠেঙিয়ে দেবে।
অ্যাঁ। কী বলছেন?
ঠিকই বলছি। ও ওইরকমই লোক। এক নম্বরের পাজি।
তাহলে তো কাজ কিছুই এগোচ্ছে না।
কী আর করা। বিন্দুকেই পাঠিয়ে দিই। আর দেখি যদি মিশিরজি কে—
চলে যাচ্ছিলেন, আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলেন, দেখলেন আমাদের রানিমার ছবি? কী চেহারাই ছিল।
যা বলেছেন। যাকে বলে রানির মতো রানি ! কত ছবি, কতরকম। বরং এখনকার রাজাবাবুর মার মানে রানি মায়াবতীর বউমার তত না।
না, উনি একটু বেশি লাজুক ছিলেন। তা ছাড়া অল্প বয়েসে বিধবা হওয়ায়—
দুঃসাহসী ট্যাঁপা ফস করে বলে ওঠে, আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন, এখনকার রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণ ওঁর মা-বাবার একমাত্র সন্তান, কিন্তু বেশকিছু ছবিতে তো দুই ভাইয়ের মতো ছবি দেখলুম।
দুই ভাই।
একটু থমকাল দেওয়ানজি।
হ্যাঁ এই তো—
বলেই দুটো পাতা খুলে দেখায় তাড়াতাড়ি । একটিতে রানি মায়াবতী দু-পাশে দুটি সাজাগোজা বালক নিয়ে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বসে আছেন। আর একটাতে রানি শান্তিলতার দুপাশেও ওই দুটি। একরকম সাজসজ্জা।
দেওয়ানজি তাচ্ছিল্যের গলায় বলেন, এ ছবি দুটোও ছিল বুঝি ওরমধ্যে?
শুধু এই দুটি কেন? আরও বেশ কয়েকটি ছবিই তো রয়েছে। দুই ভাইয়ের মতো।
না না, ভাইটাই কিছু নয়। কেউ নয়। বলতে বসলে অনেক ইতিহাস. মহাভারত।
‘কেউ নয়, কিছু নয়’ অথচ অনেক ইতিহাস! মহাভারত!
দুই বন্ধু মুখ চাওয়াচায়ি করে। আর দুঃসাহসী ট্যাঁপা ফট করে বলে বসে, একটু শর্টকাট করে বলা যাবে না?
শুনে কোনো লাভ নেই। তোমাদের কেস-এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অনেককালের একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। ওই জঞ্জালগুলো যে অ্যালবামে ভরছিল তা কে জানত।
এম. কে. আস্তে বলে, বলতে বাধা থাকলে, কিছু করার নেই। তবে কীসের সঙ্গে যে কীসের সম্পর্ক থাকে বলা শক্ত।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, কোনো দুর্ঘটনায় মারাটারা যাওয়ার ব্যাপার বুঝি?
মারা? মারা গেলে তো ভালো হত। আপদ ঘুচত। …বলে দেওয়ানজি বেশ উত্তেজিতভাবে বলেন, শুনতে চাও বলছি। তবে তোমাদের কোনো কাজে লাগবার নয়। বলে— যথাসাধ্য সংক্ষেপে যা বলেন, তা সত্যিই মহাভারত! …ঘটনা এই—
এই রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের কোনো ভাইবোন না থাকায়, রানি মায়াবতী ‘‘ওর কোনো খেলুড়ি নেই। আহা বেচারি একা’ বলে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে, নাতির একটা খেলুড়ি জুটিয়ে বসেন। রাজকুমারের থেকে বছর দেড়েকের মতো ছোটো। রানি মায়াবতীর বাপের বাড়ির দিকের এক নেহাত গরিব আত্মীয়ের একপাল ছেলেমেয়ের মধ্যে থেকে একটাকে চেয়ে নেন, ‘‘আমায় দে, আমার কাছে রাজ আদরে থাকবে’’ বলে। তা ছাড়া তার বাপকে ভাঙা বাড়ি সারাতে বেশ কিছু টাকাও দিয়েছিলেন। ছেলেটা দেখতে চাঁদের মতো ফুটফুটে বলেই, মায়াদয়াটা বেশি উথলে ছিল বোধ হয়। …তা কথা রেখেছিলেন, নিজের নাতির সঙ্গে সমান করে রাজ-আদরেই রেখেছিলেন। একরকম খাওয়াদাওয়া একরকম জামা পোশাক, বিছানা, খেলনা। …কে বলবে নিজের নাতি নয়। …কিন্তু হলে কী হবে? হাড় দুঃখী ঘরের ছেলে, এত পেয়ে হয়ে উঠল বেয়াড়া। …লেখাপড়ার দিক দিয়ে যেতে চায় না, দাসদাসীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, আর যার ‘খেলুড়ি’ করে আনা, তাকে রীতিমতো হিংসে করে। দাদার যাতে অসুবিধে হয়, দাদার যাতে জ্বালাতন হয়, সেটাই যেন তার আমোদ। …কাজেই রাজকুমার তাকে এড়িয়ে যেতে চাইতেন। অথচ রানি মায়াবতী তাকে চোখের মণি করে বসে আছেন। সত্যি নাতির তো বাপ না থাকলেও একটা মা আছে সেটা নিজের নয়। কিন্তু এই পাতানো নাতিটি তো সবটা নিজের। তা ছাড়া বাপের বাড়ির দিকের। সেএকটা আলাদা টান।
…দিনে দিনে ছেলেটা যত দূর নয় তত দূর মেজাজি হয়ে ওঠে, যা ইচ্ছে তাই করে। …রানি মায়াবতী তাকে আগলে বেড়ান। …কিন্তু একদিন করে বসল একটা কান্ড! কী জন্যে যেন একজন দাসীর ওপর রেগে গিয়ে তার কোলের কচি ছেলেটাকে ছুড়ে মারল একটা ভারী ফুলদানি! …ফলে যা হবার তাই হল। …দশ বছরের একটা ছেলে হয়ে পড়ল খুনের আসামি।
…পুলিশ কেস হলেই তো সর্বনাশ! স্বামী নেই, ছেলে নেই, ভরসার মধ্যে এই দেওয়ানজি! …জীবেন্দ্রর বাবা হারীন্দ্রনারায়ণের একান্ত প্রিয়পাত্র। রানি মায়াবতীর ছেলের মতো! তো এই দেওয়ানজির সাহায্যেই রানি মায়াবতী খুনি আসামিটাকে রাতারাতি তার মা বাপের কাছে গ্রামের বাড়িতে পাচার করে দিলেন। এবং তার মা-বাপকে জানিয়ে দিলেন ছেলে যেন জীবনে এ মুখো না হয়। এলেই পুলিশ কেসে পড়তে পারে।
ওদিকে সেই দাসীকে তার সমগ্র ফ্যামিলিসুদ্ধু অনেক টাকা দিয়ে তার দেশে চালান করে দেওয়া হয়েছিল, জমিজমা কিনে চাষবাস করে খাবে বলে। ..তো সেআজ হয়ে গেল প্রায় তিরিশ বছর। জীবনের আর এই রাজবাড়িতে তার নাম কেউ মুখে আনেনি। …যদিও রানি মায়াবতী শখের আর আদরের বাড়াবাড়িতে ছেলেটার শিবকুমার নামটাকে পালটে নাম দিয়েছিলেন শিবেন্দ্রনারায়ণ।
কাহিনিটি বলে নিয়ে দেওয়ানজি বিরক্তির সঙ্গে বলেন ওই ছবিটবিগুলোকেও যে কেন তখন নষ্ট করে ফেলা হয়নি কে জানে। ওগুলো দপ্তরে তোলার আগে, ওই বদ ছেলেটার ছবিগুলো বার করে দিতে হবে। …রানি মায়াবতী একটু বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলেন। শেষে পরে অবশ্য বলেছিলেন, ‘‘লক্ষ্মীছাড়াটার মা-বাপের কাছে কথা দিয়েছিলাম নিজের নাতির মতো আদরে রাখব, তাই রেখেছিলাম। তা আমড়া গাছে কি ল্যাংড়া ফলে?’’
কিন্তু—
দেওয়ানজি একটু দুঃখের হাসি হেসে বলেন, এখন নাতির বউয়ের ওপর রাগে ল্যাংড়াকেও আমড়া লাগছিল। …নাতির সঙ্গে প্রায়ই বচসা হচ্ছিল। আসলে ওঁদের প্রায় শতবর্ষ আগের দৃষ্টিভঙ্গি, আর এদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর রানি বিদ্যুৎলতাও তো নিজের ধরন বদলাতে রাজি হচ্ছেন না। আমি তো ইশারায় ইঙ্গিতে বলেওছি কত সময়, রানিমা আর কতদিন? উনি বিদায় নিলে না হয় এইসব বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে ইস্কুল করবেন। তো সেকথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কে বলতে পারে আরও বিশ বছর পৃথিবীতে টিকে থাকবেন কি না। এইসব সংঘর্ষের সময় রানিমার অন্তর্ধান। বড়োই ভাবিয়ে তুলেছে।
উনি চলে যেতে, ট্যাঁপা বলে, এম. কে. রাজা সম্পর্কে তোর কী মনে হচ্ছে বল তো? আমাদের যেন এড়িয়ে চলতে চাইছেন। আজই আবার শরীর বিশেষ খারাপ হল?
সেই তো ভাবছি।
ভেতরে গোলমাল আছে বাবা!
সেতো আছেই। না হলে এমন একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটে?
…জেরা করবারও তো লোক মিলছে না। দেখি যদি বিন্দুবাসিনী আসেন। আজ সন্ধেটা মাঠে মারা যাচ্ছে।
নেহাত মাঠে মারা গেল না। বিন্দুবাসিনীর কাছে অনেক তথ্য!
প্রথমটা তো সেভয়েই অস্থির। এরা গলায় মধু ঢেলে বলল, মাসি ভয় খাচ্ছ কেন? আমরা তো আর পুলিশের লোক নই। তোমাদেরই ঘরের ছেলের মতো দুটো ছেলে। শখের গোয়েন্দাগিরি। তো তোমার ঠাকুর দেবতার নাম টাম করে বল তো, যা জিজ্ঞেস করব তার ঠিক ঠিক জবাব দেবে? ভয় খেয়ে কিছু চাপবে না? দেখো—আমরা তো রানিমার খোঁজ তল্লাশ করব বলে জাহির করেছি, তো তোমাদের সাহায্য টাহায্য না পেলে কী করে হবে মাসি?
একে ‘মাসি’ ডাক তায় এমন মিষ্টি কথা। এতেও গলে যাবে না বিন্দু? গলে গিয়েই গলগলিয়ে কথা বেরিয়ে আসে।
আচ্ছা মাসি বল তো, নাতি ঠাকুমার সম্পর্ক কেমন ছিল?
সেআর কী বলব বাবা, আগে তো দেখেছি দুজনাই দুজনার প্রাণতুল্য। কিন্তু ইদানীং ওই বউ বউ করে অশান্তি। বউ কেন ছোটোলোকদের ছেলেপুলে নিয়ে মাখামাখি করে? বউ-এর পরামর্শে ছেলেকে কেন বাড়ি ছাড়া করে বোডিং ইস্কুলে দিয়ে রেখেছিস? এইসব।
…তা বলে নাতির কিছু ভালোবাসার অভাব নাই। রাতদিন খবর নিচ্ছে, ‘মহারানি কেমন আছেন? মহারানি ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না।’ …সদাই সজাগ।
‘মহারানি’ বলেন বুঝি?
হ্যাঁ ঠাকুমাকে ওই আদরের ডাক। তো এমন হুঁশ, এই ক-দিন আগে একদিন রাতে হঠাৎ বুড়ির—ইয়ে রানিমায়ের কাশির শব্দে ঘুম ভেঙেই টের পেলুম, রানিমার ঘরে ছিগারেটের গন্ধ। সর্বনাশ। এ তো রাজাবাবুর গন্ধ। …আমি পাশের ঘর থেকে কাশির শব্দ টের পাইনি, আর উনি দুতলা থেকে উঠে এসেছে। ভয়ে বুক ধড়ফড়। লজ্জায় মাথা কাটা। তাড়াতাড়ি উঁকি মেরে দেখি কী যেন একটা ওষুদ খাইয়ে দিল। ভয়ে কাঠ হয়ে চক্ষু বুজে বসে আছি এই বুঝি বকা দেয়, এত ঘুম কেন? তা কিছু করল না। চোখ খুলে উঁকি মেরে দেখি ঘরে নাই। তো তখনও ঘরে ছিগারেটের গন্ধ ভাসছে।
খুব সিগারেট খান বুঝি রাজাবাবু?
খায় বোধ হয়। তবে রানিমার ঘরে বসে কখনো খেতে দেখি নাই। সেই রাতে বোধ হয় খেয়েছিল।
তা তুমি পাশের ঘরে কেন? রানিমার ঘরে নয় কেন?
সেকথা আর বোলো না বাবারা। আমার নাকি নাক ডাকে, তাতে ওনার ঘুম হয় না। আচ্ছা বল তো বাবা, আমার নাক ডাকল, আমি জানলুম না, ওনার ঘুম ভাঙল? তো কী আর বলব?
তা একা তুমিই বা কেন? নার্স দেখে না রাত্রে কাশি হল কী কিছু হল?
নার্স দিদি? ও বাবা উনি তো এক রাজরানি। রাত জাগা ওনার পোষায় না। শুধু ওষুদ খাওয়ানো আর জ্বরকাঠি মুখে ঢুকিয়ে জ্বর দেখা ছাড়া কিছুই করেন না উনি।
বা: তেমন লোককে রাখা কেন? বদলালেই তো হয়।
ও বাবা। উনি হল গিয়ে ছোটো মেনেজারবাবুর কোনো এক বন্ধুর পরিবার। ওনাকে কে ছাড়াবে?
ছোটো ম্যানেজারবাবুর বুঝি খুব রাগি?
রাগি? রাগি তো বটেই, আবার সিয়েনের ধাড়ি। প্রেকাশ করে ফেলো না বাবা, একথা বলেছি। তাহলে উনি আমার গর্দান নেবে।
না না। কোনোকিছু প্রকাশ হবে না। এবার বল তো মাসি, সেই হারিয়ে যাবার দিনটিতে ঠিক কী হয়েছিল। তোমার কথার সঙ্গে তোমাদের ওই মিশিরজির কথা তো মিলছে না।
বিন্দুবাসিনী ভয়ের মুখ করে গলার স্বর নামিয়ে বলে, সত্যিকথা কই বাবা, মিশিরছি যেটা বলেছে, সেটাই ঠিক। আমার না ভয়ে ভয়ে মাথা গুলিয়ে গেছল। ..আস্ত মানুষটাকে চেয়ারে বোস করিয়ে রেখে শুধু নীচের তলায় নেমে বাটি গেলাসটা দিয়ে এসেছি, এসে দেখি মানুষটা হাওয়া। আর যে মানুষ নিজে কিছু করতে পারে না…
ট্যাঁপা বলে ওঠে, তো সেই চেয়ারটা কোথায়? দেখলুম না তো।
বিন্দুবাসিনী হঠাৎ ডুকরে উঠে বলে, চেয়ারখানাও তো তদবধি হাওয়া।
তাই!
তাই তো। আর একটা কথা— বলতে আমার গা কাঁপছে বাবা, নীচতলায় থেকে এসে তো দেখলুম, চেয়ার সুদ্ধু মানুষটা উবে গেছে। কিন্তু ঘরের হাওয়ায় রাজাবাবুর ছিগ্রেটের গন্ধ ছড়াচ্ছে। সর্বদা তো খায় না, তবে গায়ে যেন গন্ধটা লেগে থাকে।
আবার বলে, তা বিড়িও তো তাই। ছোটো মেনেজারবাবু চলে ফেরে বাতাসে বিড়ি বিড়ি গন্ধ ঘোরে। এবার যাই?
আচ্ছা যাও। মিশিরজিকে বোলো, কাজ সারা হলে যেন—
এম. কে. তোর একবার গায়ে কাঁটা দিল না?
কখন বল?
ওই যে যখন বলল এসে দেখে চেয়ারশুদ্ধু রানিমা হাওয়া, আর ঘরের হাওয়ায় রাজাবাবুর গায়ের গন্ধ।
ঠিক তাই।
এখন কীভাবে এগোনো হবে বল?
দেখি। সবে তো একজনের মুখ খোলাতে পারা গেছে।
আর একজন এল বটে মুখ খুলতে, তবে তার সাফ সাফ জবাব। ‘মিশিরঠাকুর’ দু-বার দু-কথা বলবে না বাবু! যা বলেছে তাই বলবে। বিন্দু মিশিরকে বাটি গিলাস দিয়ে চলে গেল। আর মিশির রানিমার জল আর ক্ষীর নিয়ে গিয়ে দেখল কী রানিমা নাই। ব্যস আর কোনো কথা জানে না মিশির।
কিন্তু এটা তো জানে, রানিমা, কেমন লোক? রাজাবাবু কেমন লোক।
বাবু। মিশির হচ্ছে নোকর! পনচাস সাল ষাট সাল মিশির এ বাড়ির ভাত খাচ্ছে।
আচ্ছা বেশ। তাহলে ওকথা থাক। কিন্তু বলো তো তুমি কি কখনও দেখেছ কাউকে ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেছে?
মিশিরজি গম্ভীরভাবে বলে, মিশির ভূত ভি দেখেনি ভগোয়ান ভি দেখেনি, দেখেছে শুধু মানুষ। তো মানুষ ভি সোব পারে।
ব্যস। আর কোনো কথা নয়। আরও অনেক রোটি বানাতে বাকি আছে মিশিরের।
এম. কে! লোকটা কি ওস্তাদ রে?
তাই দেখলাম। তবে একটা ‘মানুষ’ বটে।
তোর খাতা কী বলে টি. সি.?
এখনও কিছু বলছে না! আসল চাঁইকে দেখা হোক আগে।
পরদিন সকালে এরা দেওয়ানজিকে জিজ্ঞেস করল, রাজাবাবুর শরীর কেমন?
ভালো কিছু নয়। তবে আজ বেলা সাড়ে নটার সময় আপনাদের ডেকেছেন।
ধন্যবাদ!
শুনুন, বলছি কী রাজাবাবু খুবই মনমরা হয়ে রয়েছেন,—
সেটাই তো স্বাভাবিক —
তাই বলছি যে, মানে বেশিকিছু জেরা টেরা করবেন না তো?
ট্যাঁপা মদনাকে এবং মদনা ট্যাঁপাকে অলক্ষ্যে এক একটা সূক্ষ্ম চিমটি কাটে।
তার মানেটা হতে পারে, দেখ, কী স্নেহ! একেবারে বাৎসল্যবৎ!
এম. কে বলে, দেখুন, আমরা তুচ্ছ প্রাণী, রাজা বাদশাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ টুযোগ নেই, ওঁদের পক্ষে কোনটা বেশি হয়ে পড়বে, তা ঠিক জানি না। তবে কেসটা যখন হাতে দিয়েছেন, তখন তার স্বার্থে যেটা দরকার সেটা তো করতেই হবে।
দেওয়ানজি মলিনভাবে বলেন, তা তো বটেই।
সেই চাবির বিষয়টা আপনি একটু বলেবেন।
কোন চাবি?
সেই যে রানিমার ঘরের বড়ো বড়ো দেয়াল আলমারির।
ওঃ। হ্যাঁ। আচ্ছা বলব। তবে এই কেস-এর সঙ্গে ওর আর কী যোগ? আপনারা রেডি থাকবেন। ঠিক সাড়ে নটার সময়।
উনি কি শুয়েই থাকেন?
তা ঠিক নয়। বসেন। তবে বেশিক্ষণ বসে থাকলেই টায়ার্ড বোধ করেন।
অর্থাৎ জানান দেওয়া, বেশিক্ষণ জ্বালাতন করবেন না ওঁকে।
দেওয়ানজি চলে যেতেই টি. সি, বলে ওঠে, লোকটার কী অন্ধ স্নেহ। এদিকে নিজেই গোয়েন্দা ডেকে আনলি, অথচ ‘খোকাবাবুকে’ জেরা করে জ্বালাতন করার ভয়ে—
আমার মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের নিজের মনের মধ্যেও বোধ হয় এখন সন্দেহ ঢুকে বসেছে। অবস্থা এখন সেই যে কী বলে, সাপের ছুঁচো গেলা, তাই হয়েছে।
এম. কে. আমরা কি সাকসেস হব?
‘নিশ্চয় হব’ এই মনোভাব নিয়েই কাজে হাত দিতে হয় টি. সি.।
একটু পরে পঞ্চু এসে ডাক দেয়, চলেন রাজাবাবুর কাছে।
সেটা কোথায়?
কোথায় আবার! এই দোতলাতেই। চৌবাচ্চার আর একটা পাড়। দক্ষিণপাড়ের দশখানা ঘর নিয়ে রাজাবাবুর মহল।
এইখানে আসতে এত তোড়জোড়, এত অ্যাপয়েন্টমেন্ট! একেই বলে রাজ কায়দা!
দরজায় দরজায় ভারী ভারী পর্দা ঝোলানো। পঞ্চু একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়, দরজায় ঝোলানো একটা ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, পর্দা সরিয়ে এদের ঠেলে দেয়।
…মস্ত ঘর মস্ত মস্ত সোফা সেট চেয়ার টেবিল। মাঝখানের বড়ো একটা টেবিলের ধারে রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন যিনি যদিও সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরা, তবু বুঝতে দেরি হয় না ইনিই রাজাবাবু।
সমস্ত পরিবেশের দিকে একবার চোখ ফেলে যুগল রত্ন টিকটিকি, আর সঙ্গে সঙ্গে দুজনের গায়েও কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাজাবাবুর টেবিলে, কিছু কাগজপত্র, একটা পাথরের পেপার ওয়েট আর তার পাশে একটা সিগারেটের বাক্স। …‘ফাইভ ফিফটি ফাইভ’ ব্র্যাণ্ড।
টি. সি. ঠিক করেছে, এখানে ও কিছুতেই কথা বলবে না। বলেও রেখেছে এম. কে.-কে। প্রথম কথাটা তাই সেই বলে, আপনার অসুস্থতার সময় বিরক্ত করতে আসার জন্যে দুঃখিত।
না না ঠিক আছে। কাজটা তো আমাদের, আমারই।
বেশি সময় নেব না। আচ্ছা বলুন তো, বাড়িতে হঠাৎ এরকম একটা ঘটনা ঘটল, অথচ পুলিশে কোনো খবর দিলেন না?
দেখুন , পুলিশে খবর দিলেই হই চই। পারিবারিক সম্ভ্রমের কথা ভেবেই—
কিন্তু তাতেই কি লোক জানাজানি আটকাল? সেযাক, এখন ধরুন, রানি মায়াবতীর সন্ধান মিলল, অপহরণকারীকে শনাক্ত করা হল, তাকে অ্যারেস্ট করবে কে? প্রাইভেট ডিটেকটিভের তো সেক্ষমতা নেই।
বলছেন , পুলিশে জানাব?
আমরা কী বলব? আপনার বিবেচনার ওপর আমাদের কী কথা। তবে, কিছু মনে করবেন না, এই নিষ্ক্রিয়তায় লোকের মনে নানা সন্দেহ আসতে পারে কিনা?
রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা এবং শান্তভাবের সামনে এসে ট্যাঁপার তো ভয়ই করছিল। মুখের ওপর কথাটা বলল, এম. কে.?
কিন্তু রাজাবাবু তাতে অপমানে উত্তেজিত হলেন না, শুধু একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললেন, জানি। এসেওছে। আমিই আমার পিতামহী রানি মায়াবতীকে কিডন্যাপ করিয়েছি এই তো?
এসেছে, তা জানতাম না। তবে হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। একদম নিশ্চিদ্র ঘর থেকে আস্ত একটা মানুষ পাঁচ মিনিটের মধ্যে উবে গেলেন, এর ব্যাখ্যা খুঁজতে সত্যিই তো আর ভূতের কাছে যাওয়া যায় না? সেযাক, আপনার কারও ওপর সন্দেহ হয়?
রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণ আস্তে মাথা নাড়েন।
ঘটনার কিছু আগে আপনি কি রানিমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
না। ওটা আমার যাবার সময় নয়।
রানিমার ছাদের বাগানের মালিদের আপনি বিশ্বাস করেন?
মালিদের? আপনারা মালিদের কথাও ভাবছেন?
আমাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধেই ভাবতে হয়।
তাহলে বলতেই হয় ওদের আমি ভগবানের থেকেও বিশ্বাস করি। আমার এখানের প্রতিটি কর্মচারীই বিশ্বাসী।
কথাটা শুনে খুব ভালো লাগল। আচ্ছা আপনাকে আর বেশিক্ষণ কষ্ট দেব না।
কাছাকাছি আর একটা চেয়ারে নিথর পাথর হয়ে বসে রয়েছেন দেওয়ানজি, তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে এম. কে. দেওয়ানজি আমাদের সেই অকারণ কৌতূহলের আবদারটি জানিয়েছিলেন রাজাবাবুকে?
আবদার?
কী সেটা?
আর কিছু নয়, সেই চাবি। দেওয়ানজি গলার স্বর নামিয়ে কিছু একটা বলেন। শুনে রাজাবাবু একটু হেসে ফেলেন, আপত্তির কিছু নেই। তবে আপনাদের কি মনে হচ্ছে, রানিমা বাচ্চাদের মতো লুকোচুরি খেলতে ওদের কারও মধ্যে ঢুকে আছেন?
‘অসম্ভব’ সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে না দেওয়াই আমাদের নিয়ম। দেওয়ানজি, আপনি জানেন না চাবি কোথায় থাকে?
দেওয়ানজি মাথা নাড়েন।
‘চাবি-ঘরের’ মধ্যে নেই?
চাবি-ঘর?
হ্যাঁ চাবি-ঘর। দেখেননি কোনোদিন? আশ্চর্য তো। ওই তো কোনদিকের যেন একটা দেয়ালে ছোট্ট একটা কুলুঙ্গির মধ্যে মহারানির যে একখানা ঠাকুর বসানো আছে, তার নীচের একটা ডালা তুললেই চাবি-ঘর। ছেলেবেলায় আমরা চুপিচুপি টাকা লুকোনো খেলতাম—
ট্যাঁপা ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফস করে বলে ওঠে, আম-‘রা’ মানে?
রাজাবাবু একটু থতোমতো খেয়ে বলেন ইয়ে বাড়িতে আরও যে-সব ছোটো ছেলেরা থাকত, তারাই আর কী!
ও!
আচ্ছা আপনাকে আর বিরক্ত করব না। নমস্কার।
আচ্ছা—বলে বিরতির রেখা টানতে-রাজাবাবু সিগারেটের প্যাকেটের বাক্সর দিকে হাত বাড়াল, আর ট্যাঁপার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের পাপে পাপী হয়। বলে ওঠে এন্তার সিগারেট খান বুঝি?
রাজাবাবু, এই আচমকা প্রশ্নে চমকে উঠে বলেন, কেন?
না! সবাই বলে কিনা বেশি সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়!
জীবেন্দ্রনারায়ণ সকৌতুকে বলেন, এই বালক দুটিকে কোথায় পেলেন দেওয়ানজি?
এম. কে. টি. সি.-র দিকে ভস্ম করে ফেলার দৃষ্টিতে তাকায় ।
ঘরে ফিরে এম. কে. হতাশভাবে বলে, ইচ্ছে করে বোকা সেজে হেয় হোস কেন টি.সি.?
টি. সি. অবিচলিত গলায় বলে, অন্যকে বোকা বানাতে।
কী? কথাটা কী হল?
কী আর? একপক্ষকে ‘নীরেট’ বলে মনে করলে, অপর পক্ষ দিব্যি নিশ্চিন্দি থাকে।
ট্যাঁপা! ট্যাঁপারে!
এম. কে. ট্যাঁপার দিকে হাত বাড়ায়।
কিছুক্ষণ পরে পঞ্চু আসে বলে, ছোটো মেনেজারবাবু আপনাদের ডাকতেছে।
এম. কে. আর টি. সি. পরস্পরের দিকে তাকায়।
টি. সি. তখন তার ডায়েরি খাতায় আজকের অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখছে। বলে, তুই যা, ততক্ষণ আমি একটু পরে যাচ্ছি।
কী এত লিখছিস হিজিবিজি? বলে এম. কে. ওর কলমটা কেড়ে নিয়েই ফেরত দিয়ে বলে, আচ্ছা লেখ। আসিস পরে।
কিন্তু একটু পরে নীচে নেমে গিয়ে টি. সি. কি দেখতে পেল এম. কে.- কে?
ছোটো ম্যানেজারবাবু বললেন, আপনার তিনি তো আমার কথায় কান না দিয়েই বললেন, মাপ করবেন পরে আসছি, একটু বাথরুমে যাচ্ছি বলে ওই বাগানধারে নেমে গেলেন। আর এলেন না।
আর এলেন না? বলছেন কী?
এলে কি আমি তাঁকে খেয়ে ফেলেছি মশাই? আপনি আচ্ছা তো? প্রায় খেঁকিয়ে ওঠেন।
টি. সি. বলে, তা ডেকেছিলেন কেন?
কেন আর? রাজাবাবুর সঙ্গে কী কথাবার্তা হল, কেমন দেখলেন তাঁকে, এইসব একটু জানতে। বলুন না একটু শুনি।
কিন্তু টি. সি.-র এখন ওই আবদার রাখার অবস্থা?
টি. সি.-কে খুঁজতে হবে না তার পার্টনার তাকে না বলে, হঠাৎ এমন হাওয়া হয়ে গেল!
সারাবাড়িতে সব্বাইকে জিজ্ঞেস করে বেড়ায় টি. সি. কোথাও কারও সঙ্গে কোনো কথা কয়েছে কি না তার পার্টনারটি।
না: এখানে, নীচের মহলে, কেউ তাকে সকাল থেকে দেখেইনি। দারোয়ান?
না: ।
আবার ফিরে এল সেই ছোটো ম্যানেজারবাবুর দেখিয়ে দেওয়া বাগানের দিকে। সঙ্গে পঞ্চু। কোথাও নেই। শুধু দেখতে পায় সেই বোবা কালাটা বাগানের ঘাস ছিঁড়ছে। …কিন্তু পঞ্চু বলেছে, ও বোবা কালা নয়, শুধু তোতলা।
তাই তাকে জেরা।
এই অন্য বাবুটা কোনদিকে গেছে দেখেছিস?
আ-আ-আমি কী জা-জানি।
জানতেটা বলেছে কে তোকে? দেখেছিস কি না?
সেতখন দাঁড়িয়ে উঠে চোখমুখের কী একটা ইশারা করল পঞ্চুর দিকে।
পঞ্চু নীচু গলায় বলে, বলছে, আপনাদের সঙ্গে বেশি কথা কইলে ছোটো মেনেজারবাবু তাকে আস্ত রাখবে না।
তা টি. সি. তো আর একটা নির্দোষ বেচারির শাস্তির কারণ হতে পারে না?
টি. সি. দেওয়ানজিকে খবরটা জানিয়ে বলে, আমি একটু বেরিয়ে দেখি।
দেওয়ানজি হাঁ হাঁ করে ওঠেন। কী জানি হঠাৎ কোথায় কী বিপদে পড়ে গেছে হয়তো, আপনিও আবার? আমি লোকজন দিয়ে সন্ধান করাচ্ছি।
তবে আর কী করবে টি. সি. পাগলের মতো ছটফট করা ছাড়া?
এদিকে রান্নামহলে নিশ্চিত ঘোষণা হয়ে যায়। এও সেই ভূত ছাড়া আর কিছু নয়। তার মানে, এবার রাজবাড়ির সবাইকেই একে এক ভূতে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ভয়ানক একটা প্রকোপ পড়েছে রাজবাড়ির ওপর।
দিনদুপুরে ভয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে থাকে রান্নাবাড়ির দিকের লোকেরা। মিশিরজি বলে আর সেভূতুড়ে বাড়িতে থাকবে না দেশে চলে যাবে।
দেশে? দেশে আবার তোমার কে আছে?
কেউ না থাক ভূতও তো নেই।
দেওয়ানজি কাকে কোথায় পাঠিয়েছিলেন কিংবা আদৌ কাউকেই পাঠিয়ে ছিলেন কি না কে জানে। তবে বেলা গড়িয়ে গেলে ঘোষণা করলেন, ‘পাওয়া গেল না’।
টি. সি. রাগ দেখিয়ে বলল, চমৎকার। আমি নিজে যাচ্ছি। বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।
গেল তো গেল। আর এল না। বিকেলে নয় সন্ধ্যায় নয়, রাত্তিরে নয় পরদিন নয়। তারপর দিন সকালেও নয়।
এতেও যদি মিশিরজি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না চায় তো কীসে যাবে? সেতো স্পষ্টই দেখল, এ ছেলেটাকেও যেন দানোয় ছোঁ মেরে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
রামজীবন রথ অবশ্য খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললেন, ও দেওয়ানজি আসলে ভয় খেয়ে ন্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে। খুব ভড়কেছিল তো রানিমাকে খুঁজে বার করে দেব বলে।
শুনে রাজাবাবুও বলেন, তাই সম্ভব। দেখলাম তো নেহাতই দুটো ফাজিল মার্কা ছোকরা মাত্র।
দেওয়ানজি বললেন, কিন্তু ওদের জিনিসপত্র তো পড়ে!
রামজীবন রথ সেই হাসি হেসে বলেন, জিনিস বলতে তো সেই সুটকেস দুটো? খুলে দেখুন গে, হয়তো দেখবেন ফাঁক। লোক দেখিয়ে ফেলে গেছে।
দেওয়ানজির সামনে এত কথা বলার সাহসটা তার এল কী করে? তবে দেওয়ানজির যেন ছেলে দুটো নিখোঁজ হওয়ায় তেমন উদবেগ নেই।
তারপর? সত্যিই কি ছেলে দুটো হাওয়া হয়ে গেল? আর ফিরে এল না এই পাথরগুড়ি রাজবাড়িতে?
তাই কী হয়?
এল বই কী। এল—পরদিন বেলা এগারোটা বারোটা নাগাদ মিশিরজি যখন তার গামছা নিয়ে পুঁটলি বাঁধছে দেশে চলে যাবার তালে। রানিমা উপে যাওয়া পর্যন্তই তো তার এ বাড়ি থেকে ছুটে পালিয়ে যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। …এটা একটা নতুন সংযোজন।
কিন্তু গামছা বাঁধাই সার। যাওয়া হল কই? ভূতে দানোয় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছেলে দুটো যদি এসে পড়ে বলে, ‘‘ও মিশিরজি, তোমার রান্নাঘরে কোথায় কী আছে চটপট বার করো। পেটের মধ্যে ইঞ্জিন চলছে। ডন বৈঠক মারছে, বাঘ আঁচড়াচ্ছে!’’
তাহলে? কিন্তু তারপর?
তারপর এক চিচিং ফাঁক কান্ড! নাটকের মতো বললেই হয়। বেশ কিছু খেয়ে নিয়েই টিকটিকি যুগল বলে চাবি চাই। চাবি।
কীসের চাবি?
বা: রানিমার ঘরের সেই দেওয়াল আলমারিগুলোর চাবি। চাবি-ঘর না কোথায় যেন আছে। ওরা বলেছিল, দেখেছি বটে, রানিমার বিছানার মাথার কাছে একটা ছোট্ট কুলুঙ্গিতে শিবঠাকুর নাকি গড়াগড়ি খাচ্ছেন। সেখানেই নাকি চাবি-ঘর।
দেওয়ানজি বলেছেন, কী আশ্চর্য। আমি এতকাল ধরে রোজ এ ঘরে আসছি, দেখিনি।
রাজাবাবুও ছেলে দুটোর আত্মস্থ ভাব দেখে, নার্ভাস ব্রেকডাউন ভুলে, উঠে এসেছেন তিনতলায় রানিমহলে। তিনি বললেন, হ্যাঁ, মনে পড়ছে , ওর মধ্যেই ঠাকুরের নীচের একটা আংটা লাগানো ডালা আছে, একটু চাপ দিলেই খুলে যায়।
কিন্তু অত খাটতে হল না। দেখা গেল রুপোর রিঙে লাগানো একগোছা চাবি, সেই শিব ঠাকুরের নীচেই লেপটে পড়ে আছে। তার মানে সম্প্রতি তাতে হাত পড়েছে। এবং খুব ব্যস্ততার হাত।
চার চারটে বিশাল বিশাল দেওয়াল আলমারি।
এক নম্বরেরটা খুলতেই চোখ ঝলসে গেল। ভেতরটা ঠিক যেন একখানা ছোট্ট ঘর। সেই ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো যতসব শিকারের সরঞ্জাম। বন্দুকের বাক্স, তলওয়ার, ভোজালি, কুকরি, এমনকী তির ধনুকও। এ নাকি স্থানীয় দেহাতিদের অস্ত্র। তিরের মুখে বিষ মাখিয়ে রাখে।
দ্বিতীয় নম্বরেরটা খুলেও চোখ ট্যারা হবার জোগাড়। বিশাল ওয়ার্ডরোবের মতো ওই জায়গাটার মধ্যে হ্যাঙারে ঝোলানো, দরবারের পোশাক এখনও ঝকমকে জরি মখমল শল্মার কাজ করা সব পোশাক। কোমরবন্ধটায় সত্যি মুক্তা পাথর বসানো কারুকার্য!
কিন্তু এখন আর বেশি তারিফ করে দেখার সময় কোথা?
না চার নম্বরেরটা পর্যন্ত আর যেতে হল না, তিন নম্বরেরটা খুলতেই সকলেই প্রায় ‘আঁক’ করে উঠল। তা এ অভিযানে এঁদের সঙ্গে বিন্দুবাসিনীকেও আনা হয়েছিল, সেসর্বদা এ ঘরে থাকত বলে।
সেতো প্রায় ডুকরেই উঠল।
কিন্তু কী ছিল তিন নম্বরের মধ্যে?
আসলে কিছুই ছিল না। একটি জিনিস বাদে। খোলা মাত্রই মনে হল, যেন একটা ফাঁকা লিফটের ঘর। শুধু তার মাঝখানে বসানো রয়েছে, রানি মায়াবতীর সেই ঐতিহাসিক চাকা দেওয়া বেতের চেয়ারটি।
বিন্দু ডুকরে ওঠে, এই তো সেই চ্যায়ার গো! এখান থেকেই তাহলে উপে গেছে রানিমা।
কিন্তু শুধু চেয়ারখানা পেলে আর কী হবে? তার মালিক কোথায়?
এম. কে. বলে, সেই তো কথা! মনে হচ্ছে এই পথ দিয়েই তাঁকে পাচার করা হয়েছে।
কিন্তু পথটা কোথায়? দমবন্ধ একটা ছোট্ট ঘর তো শুধু!
এম. কে. বলে, পথ কোথায় সেটা আমি এখনও জানি না। দেখি।
বলে ঢুকে পড়ে সেই লিফটের ঘরের মতো ঘরটার মধ্যে! চেয়ারটা এদিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে। আর আলমারির পেছন দেয়ালটায় কী যেন নিরীক্ষণ করে দেখেই, একটা হ্যাণ্ডেল ধরে চাপ দিয়ে দেয়ালটাকে সরসরিয়ে সরিয়ে দেয়. সেটা গিয়ে সেঁটে যায় বাড়ির বাইরের দেয়ালে। দেখা যাচ্ছে পেছন দেয়ালটা একটা লোহার শিট-এর।
দৃশ্যটা দেখেই থমকে শিউরে উঠতে হয়। বিশাল একটা হাঁ হাঁ করা ফাঁকা জায়গা। যেখান থেকে একটু পা ফসকে পড়ে গেলেই সরাসরি তিনতলা থেকে নীচে, বাড়ির পেছনের জঙ্গুলে বাগানে।
রাজাবাবু আর দেওয়ানজি দুজনেই শিউরে আর্তনাদ করে ওঠেন, ওঃ। এখান থেকেই তাহলে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে?
টি. সি. আর কতক্ষণ চুপ করে থাকবে? বলে ওঠে, আহা কী ব্রেন! ফেলে দেওয়া হয়েছে! তাহলে এতদিন ‘গলিত শবদেহের’ গন্ধে পাগল হয়ে যেতে হত না? … রানিমাকে মেরে ফেলে কার কী লাভ?
…জ্যান্ত নিয়ে গিয়ে নিজেদের খপ্পরে ফেলতে পারলে তবেই না।
রাজাবাবু হতাশভাবে বলেন, ‘মুক্তি পণের’ দাবির কথা বলছ?
এম. কে. একটু হেসে বলে, কতকটা তাই। তবে মনে হচ্ছে দাবিটা স্বয়ং রানিমার কাছ থেকেই।
এখানে একটা দরজা ছিল, আমিও কোনোদিন জানতাম না।
…কিন্তু কেন ছিল বলুন তো দেওয়ানজি?
কী জানি। রানিমার তো অনেক অদ্ভুত শখ ছিল। হয়তো এও তার একটা। …সেকালে রাজা রাজড়াদের বাড়ির মধ্যে নাকি, বিপদ আপদের সময় প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে সুড়ঙ্গপথ থাকত।
এও হয়তো সেইরকম।
পালানো কোথায়? এতো শূন্যে ঝাঁপ দেবার!
এম. কে. বলে, তাই কি? ছাদে বাগান বানাতে মালি ওঠবার ওই হালকা লোহার মইটা কি মালির জন্যেই বানানো হয়েছিল?
অ্যাঁ! তাই তো। দেওয়ানজি ‘হাঁ’ হন। ওটা তো বরাবরই আছে।
কোথায় যেন পড়েছিল, এখন কাজে লাগানো হয়েছিল।
রাজাবাবু বলেন, কিন্তু আমার তিন-চার পুরুষের বাড়ি, আমি জানলাম না, আপনারা এতসব জানলেন কী করে?
এম. কে. বলে, নিরীক্ষণ শক্তিটাকে একটু বাড়িয়ে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে ঘাড় উঁচু করে রানিমহলের এই দেয়ালটার দিকে ভালো করে তাকাতেই রহস্যটা ধরা পড়েছিল।
আপনারা সেই পেছনে গিয়েছিলেন নাকি কাঁটাঝোপের মধ্যে?
যাব না? কাঁটাঝোপ কেন, দরকার হলে আগুনেও ঝাঁপ দিতে হয়। …দেখতে পেয়েছিলাম, সারাবাড়ির পুরোনো দেয়ালে যেমন শ্যাওলার ছোপ পড়েছে, খাঁজে খাঁজে গাছ গজিয়েছে, খানিকটা চৌকো জায়গায় যেন, ঠিক তেমনটি নয়। আসলে ইঁটের দেয়ালে পড়া শ্যাওলা, আর লোহার পাতের গায়েপড়া শ্যাওলায় তো তফাত থাকে। … সেইটা দেখেই সন্দেহ হয়। …তারপর দেখা গেল ভাঙা ইটপাটকেল সরিয়ে কাঁটাঝোপ কেটে খানিকটা পথ সাফ করা হয়েছে, যেন গাড়ি ঢোকাবার মতো করে। …তখনই সন্দেহ হল, এইখান দিয়েই পাচার করা হয়েছে রানিমাকে। … মাথায় খেলে গেল সেই প্রথমদিন দেখা রানিমার ঘরের দেয়ালের বড়ো বড়ো দেয়াল আলমারির দৃশ্য। …জায়গাটা যেন নীচে ওরই কাছাকাছি, তখনই একফাঁকে দোতলার বারান্দার পিছনের কার্নিশে ঝোলানো মালির সেই মইটা দেখে নেওয়া গেল। হ্যাঁ ঠিক তাই। মইয়ের পায়ায় তাই মাটি কাদা আর ঘাসের কুচি লেপটে রয়েছে। রাজবাড়ির শান বাঁধানো ভিতর উঠোন থেকেই মই লাগানো হয়, মাটি ঘাসের কুচি আসবে কোথা থেকে?
কিন্তু ওই সরু সিঁড়ি দিয়ে একটা মানুষকে নামানো সম্ভব?
কেন নয়? বলেছেন তো পাখির মতো হালকা আর ছোট্ট হয়ে গিয়েছিলেন। পাটকরা চাদরের মতো কাঁধে ফেলে নিয়ে নেমে আসতে কতক্ষণ?
তা হতচকিত রাজাবাবুও জেরায় কম যান না।
কিন্তু তিনি চেঁচালেন না?
কী করে চেঁচাবেন? ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঝিমোনো একশো বছরের বড়ো মানুষ চেঁচাতে পারে?
ঘুমের ওষুধ? সেটা আবার কে কখন খাওয়াল? এই বিন্দুবাসিনী তো বলেছে, মহারানির খাবার আনাবার জন্যে তাঁর রুপোর বাটি গেলাসটা নীচে নামিয়ে দিয়ে আসার সময়টুকুরু মধ্যেই ঘটে গেছে ঘটনা।
তার আগে বিন্দুমাসিই, খাইয়ে গেছল।
অ্যাঁ। বিন্দু! অসম্ভব।
অসম্ভব কীসে? মাসি সেদিন রানিমার খাবার আগে তুমি ওঁকে একটা ওষুধ খাওয়াওনি?
বিন্দু সাদা হয়ে যাওয়া মুখে বলে, ওষুধ? আমি? ওষুধ তো নার্সদিদি খাওয়াত!
হ্যাঁ তা খাওয়াত। কিন্তু সেদিন? নার্সদিদি ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ায় তুমি খাওয়াইনি?
বিন্দু আড়ষ্ট হয়ে বলে, হ্যাঁ! দিদি আমারে বলে গেছল, খাবার দেবার একটুক আগে এই হজমের বড়িটা খাইয়ে দিয়ো।
কী বড়ি? দেখো তো চিনতে পারো কিনা?
বলে এম. কে একটা ট্যাবলেটের খালি মোড়ক পকেট থেকে বার করে বাড়িয়ে ধরে, এইটা তো?
সকলেরই পরিচিত জিনিস। একটা ‘কাম্পোজ’-এর মোড়ক।
বিন্দু আস্তে মাথা কাত করে, হ্যাঁ এইটেই। তো এ কাগজ আপনি এতদিন পরে কোথায় পেলেন?
এম. কে. একটু হাসে, হ্যাঁ এতদিন পরে ঠিকই। তবে এর মধ্যে কি ওই ঘরটা তেমন ভাবে সাফ করা হয়েছিল?
বিন্দু স্বীকার করে, তেমনভাবে কিছুই হয়নি। ভয়ে ও ঘরে আর উঁকি মারেনি বিন্দু।
এম. কে বলে, সেই প্রথমদিনই ও ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা এটাকে দেখতে পাই আমরা। আর দেখেই ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে থাকি। …তা ছাড়া সেদিন ছাদের বাগান দেখতে গিয়ে একটা টবের আড়ালে এই চিরকুটটা দেখতে পাই। দেওয়ানজি দেখুন তো-এ হাতের লেখা কার? চিনতে পারেন কি না!
দেওয়ানজি বুকপকেট থেকে চশমা বার করে পড়েন, ‘দশ মিনিটের মধ্যেই কাজ সাফাই করে ফেলতে হবে।’ পড়ে আস্তে বলেন, ‘মনে হচ্ছে, নার্স মিসেস ভঞ্চুর। মাঝে মাঝে ওষুধপত্রের বিল-এর সঙ্গে টাকা চেয়ে পাঠাতেন। এই হাতের লেখাই।
হ্যাঁ তাঁরই। আর তিনিই হচ্ছেন ষড়যন্ত্রের এক প্রধান নায়িকা।
…আসলে তিনি নার্সও নয়, মিসেস ভঞ্চুও নয়। সবটাই ছদ্ম ব্যাপার।
নার্স নয়!!
না। ষড়যন্ত্রের নাটের গুরু ছোটো ম্যানেজারবাবু তাঁকে নার্স পরিচয়ে রাজবাড়িতে এনে ঢুকিয়েছিলেন, সর্বদা মূল আসামির সঙ্গে খবর সাপ্লাই দিয়ে যোগাযোগ রাখতে।
ছোটো ম্যানেজার—মানে রামজীবনবাবু?
হ্যাঁ। রামজীবন রথ। তাঁর রথের চাকাটি বেশ গড়গড়িয়েই চালিয়ে চলেছিলেন তিনি। তবে বেশি চালাকি করতে গিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বসে নিজের জালেই নিজে আটকা পড়ে গেলেন। …ভেবেছিলেন, দেওয়ানজি যখন খবরটা লোক জানাজানি করতে বারণ করছেন তখন হয়তো ওঁর এতে স্বার্থ আছে। তাই লোক জানাজানি করে বসলেন। আর সেইসূত্রেই এই ‘বালক’ দুটোর আবির্ভাব।
রাজাবাবু ঈষৎ লজ্জিতভাবে বলেন, আমার কথা আমি উইথড্র করে নিচ্ছি। কিন্তু আসলে রানি মায়াবতী এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কে ‘কী’ উদ্দেশ্যে নিয়ে গেছে জানতে না পারা পর্যন্ত—
আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, ‘আছেন’! ছদ্মনামি মিসেস ভঞ্চুর শহরতলির বাসায়, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, তবে বেঁচে আছেন। আর—তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর আগেই বলেছি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে। তবে সেটা তাঁর কাছ থেকেই।
কিন্তু আসল আসামিটা কে?
কেন, আপনাদের রাজবাড়ির পারিবারিক অ্যালবামে সযত্নে সমাদরে যাঁর দশ বিশখানি ছবি রাখা আছে। স্বয়ং রানি মায়াবতীর কোলের কাছে, স্বর্গীয়া রাজমাতার পাশে এই রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে। এক বেশভূষায় সাজিয়ে। ছেলেবেলায় রাজবাড়িতে প্রতিপালিত সেই ‘মাথাভাঙার’ সরকার বাড়ির ছেলে, শিবপদ সরকার, ওরফে ‘শিবেন্দ্রনারায়ণ সিংহরায়’।
রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণ স্তম্ভিত হয়ে বলেন, সেএখনও বেঁচে আছে? মানে তাকে কোথায়—
বেঁচে নেই? দারুণভাবে বেঁচে আছেন। জলপাইগুড়ির একটা ছোটো চা বাগানের তিনি অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার। …তবে নিজেকে ‘পাথরগুড়ির রাজবাড়ির ছেলে শিবেন্দ্রনারায়ণ সিংহরায়’ বলে পরিচয় দেন। সাজসজ্জা চালচলন সবই রাজকীয়। হরদম সিগারেট খান, এবং সেসিগারেট আপনার ব্র্যাণ্ডের। …মনে হয় সাপ্লায়ার ওই ‘রথ’ মশাই।
ওর সঙ্গে—মানে ইয়ে—
মাপ করবেন রাজাবাবু। ওঁর সঙ্গেই তো কারবার। ওঁকে হাত করেই তো শিবেন্দ্রনারায়ণ এতদূর এগোতে পেরেছেন। এরকম নিঘিন্নে চরিত্রের লোককে যে আপনারা কী করে এতকাল পুষে এসেছেন। ওর নিজের রানিমহলে প্রবেশের পারমিশান নেই বলে, এনে হাজির করেছিলেন ওই নার্স মিসেস ভঞ্চুকে। আসলে যিনি মিসেস শিবপদ সরকার।
অ্যাঁ। এসব কী বলে চলেছ হে? গোয়েন্দা গল্প বানিয়ে চলেছ যে।
ট্যাঁপা আর চুপ থাকে? বলে উঠবে না, ঠিক আছে। বানানো গল্প তো? তাহলে আমাদের বিদায় দিন।
‘না না সেকী?’ বলে রাজাবাবু তাড়াতাড়ি নম্রতা দেখিয়ে তার গোঁসা ভাঙান।
এম. কে. বলে, তো আসলে একটা গল্পেরই মতো। একদা রাজবাড়িতে প্রতিপালিত ওই শিবপদ সরকার দশ বারো বছর বয়সে একটা মারাত্মক কান্ড করে বসে যে রাজবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়, সেটা আমার দেওয়ানজির কাছ থেকেই শোনা। তারপর খবর নিয়ে জানলাম নিজের বাড়ি থেকেও উনি অনেককালই বিতাড়িত। অতঃপর নিজে নিজেই ‘মনের মতো’ একটি বিয়ে করে, দুজনে নানাভাবে, আর নানা নামে জালিয়াতি কারবার করে বেড়ান। এই নর্থ বেঙ্গলে ওর অনেক কীর্তি আছে। আছে কলকাতাতেও।
সম্প্রতি আবার মাথায় এসেছে এখানে খেল দেখাবার। আসলে ছেলেবেলায় রানিমার আদরের গোপাল হয়ে এখানে থাকার ফলে রাজবাড়ির অন্ধিসন্ধি সব জানা তো। হঠাৎই রথ মশাইয়ের সঙ্গে শুভ যোগাযোগে অ্যাকশানে নেমে পড়েছেন। …ওঁর উকিলের কাছে প্রতিপন্ন করেছেন উনি রানি মায়াবতীর ‘দত্তক পুত্র’। একসময় রানিমার ওপর অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে আসায় রানিমা কৃতার্থ। তো এখন তিনি আপন পৌত্র রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি বিশেষ বিরূপ হওয়ায়, ওই দত্তক পুত্রটিকেই সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে ইচ্ছুক। তাই রানিমা কোনোমতে নার্স টার্সের সাহায্যে দত্তকপুত্রের বাড়িতে পালিয়ে এসে রয়েছেন। উইল সমাধা করে ফিরবেন।
রাজাবাবু নিশ্বাস ফেলে বলেন, এ যে সমুদ্র চুরির তুল্য।
দেওয়ানজি নিশ্বাস ফেলে বলেন, এ যে মিস্টার ব্লেকের গল্পের অধিক।
বেচারি দেওয়ানজির সেই কোন অতীতে পুরোনো লাইব্রেরির স্টক থেকে পড়া—গোয়েন্দা গল্পের দৌড় মিস্টার ব্লেক পর্যন্তই।
কিন্তু এই সন্ধান জোগাড় করে ফেলার বিরাট পর্ব সমাধার কাহিনিটা কী?
এম. কে. বলে, সেতো বলতে গেলে মহাভারত। তবে ছোটো ছোটো ব্যাপার থেকেই সূত্র আবিষ্কার হয়। …যেমন এই সামান্য কাম্পোজের খোসাটা, বা মিসের ভঞ্চুর হাতের একলাইন লেখাটা।
…তবে আবার বড়োও কিছু লাগে। হাতাতে হয়। যেমন ছোটো ম্যানেজারবাবুর হিসেবের খাতা বা রোজনামচার খাতাটা।
অ্যাঁ সেসব আপনি?
কী করব বলুন? উপায় কী? গোয়েন্দাকে একরকম ‘চোরের রাজা’ও বলা চলে। …উনি নিশ্চিন্ত আছেন, ওঁর নিজের অফিসঘরের ড্রয়ারের মধ্যে চাবিবন্ধ করা আছে। …কিন্তু সাতকালের পুরোনো ড্রয়ারের নীচের তক্তাখানা যদি—আলগা হয়ে ঝুলতে দেখা যায়। লোভ সামলানো যায়? বলুন, বিশেষ করে উনিই যখন নাটের গুরু। …তো তা থেকে খানিকটাই লাভবান হওয়া গেছে।
কিন্তু মিসেস ভঞ্চুর শহরতলির বাড়িটা আবিষ্কার করলেন কী করে?
সেটা অনেকটা ভাগ্যের দান। আসলে উনি নার্স পরিচয়ে রাজ-হাসপাতালের সঙ্গে তো একটা যোগাযোগ রাখতেন, কাজেই আসা যাওয়ার কান্ডারি সাইকেল রিকশারা। তাদেরই একজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে, ‘ফর্সা নার্স দিদির’ বাড়িতে নিয়ে যেতে বললাম, ভীষণ দরকার বলে।
ফর্সা জানলেন কী করে? দেখেননি তো?
সেটা বিন্দু মাসির কথার ফাঁক থেকে। ‘রং তো ফর্সা তবু সর্বদা পাউডার মাখা’ এইরকম একটা কিছু বলেছিল। আসলে—গোয়েন্দাদের কাজই হচ্ছে, যখন যা দেখবে শুনবে মনে গেঁথে নেবে, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ভেবে।
কিন্তু শুধু সন্দান পেলেই তো হবে না। সেই খর্পর থেকে তাঁকে উদ্ধার করে আনার কী পথ?
ট্যাঁপা বলে ওঠে, সেতো বলেই দিয়েছি আগে। প্রাইভেট গোয়েন্দারা যতই ক্যাপাসিটি দেখাক আর আসামির সন্ধান করে ফেলুক তাকে অ্যারেস্ট করবার ক্ষমতা তাদের নেই। তারজন্যে পুলিশিব্যবস্থা ছাড়া গতি নেই। তবে আপনি রাজা মানুষ। একজন এম.এল.এ. আপনার কি আর কোনো প্রবলেম হবে?
কিন্তু এই তিনদিনের মধ্যে এত খবর তোমরা জোগাড় করলে কী করে বাবা? বলেছিলে—‘ক-দিনের জন্যে আমরা একটু হারিয়ে যাচ্ছি’…
দেওয়ানজির এই বিগলিত প্রশ্নে এরা বলে, চেষ্টা তো ছিলই, তবে ভাগ্যও ভালো ছিল। …সন্ধান নিতে গিয়ে বুঝলাম পাড়ার লোক ওই মিসেস ভঞ্চু ওরফে মিসেস সরকারের ওপর মহা খাপপা। মাঝে মাঝে চা বাগান থেকে চলে আসা ওঁর স্বামী ওই ‘রাজবাড়ির ছেলেটির’ মান অহংকার দেখে ভীষণ বিরক্ত। পাড়ার লোকের কথা শুনে মনে হল ওদের ধারণা এই কর্তা গিন্নি দুজনে কিছু সমাজবিরোধী কাজটাজের সঙ্গে যুক্ত। অনেক নিন্দে টিন্দে করল। তবে একজন যেই ফস করে বলে ফেলল, ‘এই তো ক-দিন যেন দেখছি, কোথা থেকে মেমবুড়ির মতো একটা হাড় বুড়িকে নিয়ে এসে বাড়িতে রেখেছে। বলে দেশ থেকে অসুস্থ দিদিমাকে নিয়ে এসেছে চিকিৎসা করাতে। আমাদের তো বিশ্বাস হয় না। মনে হয় অন্য ব্যাপার। কেবলই তো শুনতে পাওয়া যায় বুড়ি চিল চেঁচানি চেঁচিয়ে বকাবকি করছে।
এই শুনেই না স্থির নিশ্চিত হওয়া গেল, ওই ‘মেমবুড়ি’ আর কেউ নয়, রানিমা। তবে এইবেলা ধরতে যান, বেশি চেঁচাতে গিয়ে প্রাণপাখিটি না খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে পালায়।
হ্যাঁ। ট্যাঁপা এরকম ঘোরানো ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসে।
তা তক্ষুনি গিয়ে পড়েও দেখা গেল পাখি খাঁচা থেকে উড়ে পালিয়েছেই। …তবে রানি মায়াবতীর দেহখাঁচার মধ্যে থাকা প্রাণ পাখিটি নয়, দুটি আসামি পাখি তাদের বাসা থেকে।
পুলিশ টুলিশ নিয়ে গিয়ে দেখা গেল বাড়ির দরজায় তালা দেওয়া।
ভেতরে কে যেন চিঁ চিঁ করে চেঁচিয়ে চলেছে।
তা চিঁ চিঁই তো হবে। আর কি চিল চেঁচানোর ক্ষমতা থাকে?
দরজা ভাঙিয়ে দেখা গেল বেচারি বুড়ি চেঁচিয়ে চলেছেন, শিবে, অ শিবে! গেলি কোথায়?
তবে বিছানাপত্র ভালো। ফর্সা ধবধবে লেসের সেমিজ পরে শুয়ে আছেন, ইদানীং যেমন থাকতেন। শাড়ি পরতে পারতেন না।
দেখা গেল রানি মায়াবতীর ব্যবহারের জামাটামা জিনিসপত্র ওষুধ টষুধ, সব রয়েছে। খুব সম্ভব— মিসেস ভঞ্চু ছুটিতে দুদিন বাড়ি যাচ্ছি বলে যে ব্যাগটি নিয়ে গিয়েছিলেন—
তারমধ্যে রানিমার জিনিসপত্তরই ভরে নিয়ে গিয়েছিল। তাই নির্ঘাত! কষ্টে তো রাখবে না। কাজ উদ্ধার করার দরকার তো?
কিন্তু পেরেছিল তা? রানি মায়াবতীকে দিয়ে একটা সই করাতে পেরেছিল এই পনেরো ষোলো দিনে?
না:!
রানিমহলে নিজের চিরকালের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে রানি মায়াবতীর চিঁ চিঁ গলাও একটু চড়ে। আমায় কিনা হুমকি দেয়, ‘সই না করলে গলা টিপে মেরে ফেলবে।’ আমি বলি ফেল। তাই ফেল বুড়ি মেরে খুনের দায়ে পড়। তবে মনে ভাবিসনি রানি মায়াবতীকে হজম করতে পারবি। …একদা দুধকলা দিয়ে কী কালসাপই পুষেছিলাম!
…তো হাত ফসকে পালিয়ে গেল? ওকে আর ওই নার্স সেজে ছলনা করা বউটা? তার নাক কান কেটে ঝামা ঘষলেও গায়ের জ্বালা যাবে না আমার। …ভাত রেঁধে এনে আমায় বলে কিনা, ‘ভালো চান তো খান বলছি’—এত আসপদ্দা। বলি, ভালোটা চাইছে কে? জন্ম জীবনে আমি মিশিরজির হাতে ছাড়া খেলাম না—আর—
শুনে মিশিরজি মনে মনে নাক কান মলে, ভাগ্যিস ভূতের ভয়ে দেশে চলে যায়নি।
‘পালের গোদা’ এবং ষড়যন্ত্রের নায়িকা’, হাত ফসকে পালিয়ে গেলেও, নাটের গুরুটি ধরা পড়লেন। কারণ পুলিশ নিয়ে রানিমাকে উদ্ধার করতে যাওয়ার খবরটি তিনিই তৎপর হয়ে সাপ্লাই করেছন, সেটি ধরা পড়ল।
তারপর আর কী? পুলিশি জেরার দাপটে সব কবুল করতে বাধ্য হলেন রামজীবন রথ। …ওই ‘শিবেন্দ্রনারায়ণ সিংহ রায়’ তাকে মোটা ঘুস কবলে ছিলেন সহায়তা করতে। তা তিনি করেছিলেন। কিন্তু— শেষপর্যন্ত লাভের অঙ্কে শূন্য। বদলে হাজতবাস। বিশ্বাসঘাতকের ভাগ্যে যা হয়।
রাজা জীবেন্দ্রনারায়ণ গভীরগলায় বলেন, আপনাদের বয়েস দেখে কৌতুক করে ‘বালক’ বলে ফেলেছিলাম, এজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী! আপনারা আমার যা উপকার করলেন, তার উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই। আপনাদের আরও অনেক উন্নতি হোক। …আর মহারানিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ টাকায় মাপা যায় না। তবু সেআনন্দ জানিয়ে এই যৎসামান্য একটু পারিশ্রমিক। বলে একখানি কুড়ি হাজার টাকার চেক ধরে দেন এদের সামনে।
এরা অবশ্য বলে উঠল, রানিমাকে যে পাওয়া গেল, এতেই আমাদের সব পরিশ্রম সার্থক। এটা আমাদের এখন জীবনের প্রয়োজনের তাগিদে পেশা হয়ে দাঁড়ালেও আসলে নেশাই। …তবে রাজবাড়ির আদর যত্মের কথা জীবনে ভুলব না।
ঘরে এসে ট্যাঁপা চেকটা হাতে নিয়ে চাপাগলায় বলল, মদনারে—আমরা বেঁচে আছি তো?
মদনা বলল, দস্তুরমতো!
যাবার আগে কর্তব্যবোধে ওরা রানি মায়াবতীকে একটু প্রণাম করতে এল। মায়াবতী একবার ওদের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠলেন, ওমা। এ যে দেখি, একটা তালগাছ,একটা বেগুন গাছ। তো শুনলাম নাকি তোমরাই সব করেছ। তো আমার হাতের এই দু-খানা আংটি নাও তোমাদের নিজের নিজের বউকে পরিয়ো।
বলে পাথর বসানো-দুটি ভারী সোনার আংটি এগিয়ে ধরেন।
ট্যাঁপা বলে ওঠে, মাথা নাই তার মাথা ব্যথা। ও আপনি তুলে রাখুন রানিমা!
রানিমা দেশলাইয়ের কাঠির মতো ফস করে জ্বলে উঠে বলেন, রানি মায়াবতী একবার যে হাত উপুড় করে, আর সেহাত চিত করে না বাছা!
বউ যখন নেই নিজেরাই পরো। যে আঙুলে ঢোকে।
গাড়িতে তুলে দিতে এসে রঘুনাথ বলেন, তোমাদের যে কী বলে আশীর্বাদ করব বাবা! গরিব ব্রাহ্মণ কিছু দেবার তো ক্ষমতা নেই। আশীর্বাদই সম্বল।
ট্যাঁপা দুষ্টু হাসি হেসে বলে ওঠে, তা খুব যদি কিছু দিতে ইচ্ছে করে, তাহলে—আপনার ওই ভাগনিকে বলে, সেই ফ্ল্যাটটা পাইয়ে দিতে পারেন।
রঘুনাথ উত্তর দেবার আগে ট্রেন ছেড়ে দেয়। অভয় মুদ্রার ভঙ্গিতে কী যেন বলতে থাকেন তিনি বোঝা যায় না।
গাড়ি ছুট মারে।
ট্যাঁপা একটুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘মন কেমন’ একটা বালাই! কী বলিস এম. কে.?
জানলার বাইরে তখন চোখ মদনার।