রাজাই গল্প
কালীগঞ্জের নাম শুনেছ তো? কালীগঞ্জ আর ওখানের প্রাচীন বিগ্রহ, গঞ্জের কালীর? না শুনে থাকো তো শোনো—
ওখানের লোকেরা বলে ওই মা কালীর বেদির নীচে নাকি একশো এক নরমুন্ড পোঁতা আছে। সেকালে যখন নরবলি-টলির চলন ছিল তখন ডাকাতরা যেসব বলি দিত, ওসব নাকি তাদের মাথা।
তবে কেউ কেউ আবার বলে, তা নয়, ওই মা কালীর বেদির তলায় ডাকাতদের লুঠ করে আনা সোনাদানা টাকা মোহর পোঁতা আছে। মহা ধুরন্ধর ডাকাতরা লুকিয়ে রাখবার এই কৌশলটি করেছিল।
কালীগঞ্জেরই কোনো আনাচে কানাচে নাকি একটা সুড়ঙ্গ-পথ আছে, যেটা এখন জঙ্গলে ঢাকা পড়ে হারিয়ে গেছে, কিন্তু তখন ছিল, সেই পথ দিয়ে তারা আসা যাওয়া করত, টাকা বার করত, টাকা জমা করত, নতুন নতুন লুটের মাল পুঁতে রাখত। সেই সুড়ঙ্গ ঘরের ওপরই কালী প্রতিষ্ঠা।
গঞ্জের সব লোকেরা এসে পুজো দিত, তাই পুলিশ বা চোরেদের ভয় খাইয়ে রাখার জন্যেই ওই একশো এক নরমুন্ডের গল্প।
আরও একটি কথা লোকের মুখে প্রচার হয়ে আসছে, কালীগঞ্জের জমিদার সিংহরায়েরা নাকি ওই ডাকাত সর্দারের বংশধর। ডাকাতি করেই জমিদারি।
সত্যি মিথ্যা ভগবান জানেন, তবে এক একটা দেশ গ্রাম পাড়া দিঘি পুকুর সম্পর্কে যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব নাম কিংবা গল্প তৈরি হয়ে ওঠে, সেগুলোকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কথাতেই আছে যা রটে তার কিছুটা সত্যি বটে।
কাজেই ধরে নেওয়া যাক, ওই মা কালীর নীচে একশো এক না হোক দু-পাঁচটা অন্তত নরমুন্ড গাড়া আছে, অথবা ঘড়া ঘড়া মোহর না হোক দু-এক ঘড়া সোনা দানা টাকা কড়ি পোঁতা আছে।
তা যাই থাকুক না কেন, ত্রিভুবনে এমন কে মহাপাপী দুঃসাহসী আছে যে ওই কালী মূর্তি তুলে সরিয়ে দেখতে যাবে কোনটা সত্যি। তা ছাড়া তো তোলবার জোও নেই, বেদির সঙ্গে দেবী পোঁতা। তুলতে হলে ভেঙে উপড়োতে হবে।
কিন্তু কালীগঞ্জে এমন কে পাগলই বা আছে যে ওই কর্ম করবে? (সুড়ঙ্গটা অবিশ্যি লুকিয়ে খুঁজেছে অনেকে, কিন্তু খুঁজে পায়নি।) না, তেমন পাগল টাগল কেউ নেই, তাই মা কালী এই দু-শো তিনশো বছর ধরে শক্ত হয়ে বসে আছেন, আর এতকাল ধরে যেখানে যত ভক্ত আছে ওঁর, ওনার কাছে অনবরত মানত মানসিক করছে।
নরবলি না হলেও পাঁঠা বলি পড়ে ঢের, কালীপুজোর রাতে মোষ বলিও পড়ে। শুধু ওই জমিদার বাড়ি থেকেই তো প্রতি অমাবস্যায় বলি পড়ে, পুজো পড়ে।
তবে সেই সেকালের মতো কি পড়ে? মানে এখনকার জমিদারদের পূর্বপুরুষ সদাশিব সিংহরায়ের আমলে যেমন পড়ত? সেই পুজোর বহর শুনলে তোমরা তো হাঁ হয়ে যাবে। হয়তো বা বিশ্বাসই করবে না, ভাববে আমি তোমাদের ছেলেমানুষ পেয়ে যা ইচ্ছে রং চড়াচ্ছি।
না বাবা, শোনাতে আর চাই না, যার যত কল্পনার দৌড় সেতত ভেবে নাও।
এখন তো আর সেই রামও নেই সেঅযোধ্যাও নেই। জমিদারও নেই, জমিদারিও নেই। নেহাতই মাঝারি হয়ে গেছেন ওঁরা।
তবে কিনা পুরোনো কালের কর্তাদের মতো অহংকারটি আছে ষোলো আনা।
ও, তোমরা তো আবার ষোলো আনা কথাটারও মানে জানো না। তোমাদের টাকা একশো পয়সায়। সেকালের টাকা ছিল ষোলো আনায়। তার মানে হিসেবপত্তর ক্রমশই ছোটো ছোটো টুকরোয় গিয়ে ঠেকেছে। ষোলো ছটাকে এক সের ছিল, এখন এক কিলো হিসেব করতে হাজারে গিয়ে পৌঁছোতে হয়।
যাক গে, যে যুগে যা।
কিন্তু এঁরা ওই কথাটি মানতে চান না। এখনকার জমিদার বীরেশ্বর সিংহরায় আর শিবেশ্বর সিংহরায়। হ্যাঁ, দু-জনেই হচ্ছেন এই কালীগঞ্জের জমিদার। দুই জ্ঞাতি। দুই ভাগীদার।
সম্পর্কে কাকা আর ভাইপো। কাকা বীরেশ্বর হচ্ছেন বড়োতরফ, আর ভাইপো শিবেশ্বর হচ্ছেন ছোটোতরফ। তার মানে একজনের বেশি ভাগ, একজনের কিছু কম ভাগ। কম বেশি কেন হয়েছিল তা অবশ্য জানি না, কালীগঞ্জের কেউই জানে না। বড়োতরফ আর ছোটোতরফ, এই সকলের জানা।
কাকা ভাইপো হলে কী হবে, দুজনে সমবয়সি আর দাপটেও দু-জনেই সমান। দু-জনেরই চালচলন, ধরন ধারণ ‘রাজারাজড়ার স্টাইলে’। এখনও ওনারা চাকরটাকরকে ডাকতে হলে ‘ওরে কে আছিস!’ বলে হাঁক পাড়েন, ওনারা রাস্তায় বেরোলে ওঁদের যারা প্রজাটজা, তারা তখন সেরাস্তা দিয়ে হাঁটলে কাছারিতে ধরিয়ে এনে জরিমানা করেন, আর গ্রামের লোকেরা রাজাবাবু না বলে শুধু ‘বাবু’ বললে রীতিমতো চটে যান।
অবিশ্যি কালীগঞ্জ বলেই এখনও এই সব চলছে। কলকাতায় চলে এলে দেখতে পেতেন, ‘রাজাবাবু’ বলতে কার দায় পড়েছে।
যাকগে কলকাতায় ওঁরা চলে আসেননি। সাত পুরুষ ধরে ওই কালীগঞ্জেই আছেন, ওখানেই বন-গাঁয়ে শেয়াল রাজা হয়ে সুখে বসবাস করছেন।
কাকা ভাইপো দু-জনেই মা সরস্বতীর অবাধ্য প্রজা, কোন ছোটোবেলায় লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়ে মনের সুখে রাজাগিরি করছেন। অর্থাৎ খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, পুরোনো পালঙ্কে ঘুমোচ্ছেন, চাকরকে দিয়ে একঘণ্টা ধরে তেল মাখছেন, ষোলো ঘড়া জলে চান করছেন, দাবা খেলছেন, মাছ ধরছেন, আর তাস খেলছেন, আর ওস্তাদ পুষে গান শুনছেন।
এই বিলাসিতাটি দু-জনেরই আছে।
মহা মহা সব ওস্তাদদের পায়ের ধুলো পড়েছে এই কালীগঞ্জে, সিংহরায়দের বৈঠকখানায়।
দু-তরফের দু-বাড়িতে।
বড়ো তরফের বাড়ি আমিনউদ্দিন খান, তো ছোটো তরফের বাড়ি সাদাৎ আলি। বড়োতরফের বাড়ি সারেং খান, তো ছোটোতরফের বাড়ি জামির মিয়া। কেউ তো হারতে রাজি নয়, দু-জনেরই দু-জনকে টেক্কা দিয়ে জিতে যাবার তাল, চিরকাল এই চলে আসছে।
সত্যি বলতে, এই দুই পক্ষ জমিদারের একমাত্র লক্ষ্যই যেন অপর পক্ষকে ডাউন করা। এই নিয়েই আমোদ, এই নিয়েই মত্ত।
তা সত্যি বলতে, শুধু এখনই নয়, এটা এ বংশে চিরকালই চলে আসছে।
এখন তো সিঁড়ি ভাঙার মতো দু-পক্ষ খুব দূরজ্ঞাতি হয়ে গেছে, সম্পর্কটা ওই কাকা ভাইপো এই যা। আগে, মানে তিন চার পুরুষ আগে, দুই তরফে নিজের ভাই টাইই ছিল, তবুও ওইটি ছিল। ওই টেক্কা দেওয়া দিইই।
বড়োতরফ যদি মেয়ের বিয়েতে গড়ের বাদ্যি আনাল তো, ছোটোতরফ মেয়ের বিয়েতে ইংরেজি বাজনা নিয়ে এসে বাঁচল। ছোটোতরফ যদি বাপের শ্রাদ্ধে পাঁচশো কাঙালিকে খাওয়াল তো, বড়োতরফ মায়ের শ্রাদ্ধে অন্য অন্য গ্রাম থেকে ধরে এনে হাজার কাঙালি ভোজন করাল।
বড়তরফ দুর্গাপুজোর সময় চুপি চুপি কুমোরকে নির্দেশ দিল আঠারো হাত উঁচু ঠাকুর বানাতে, সেই একান্ত লুকোনো কথা কেমন করে যেন জেনে ফেলে ছোটোতরফ চুপি চুপি স্রেফ বিশ হাত উঁচু প্রতিমা বানিয়ে বসল।
প্রতিপদে এইরকম ছেলেমানুষি। সাত পুরুষ ধরে চলছে এইরকম।
অথচ আশ্চর্য, ঝগড়া-ঝাঁটি নেই।
যদিও বীরেশ্বরও শিবেশ্বরকে নাম ধরে ডাকেন না, আর শিবেশ্বরও কাকা বলেন না, দু-জনেই দু-জনকে বলেন বড়োতরফ আর ছোটোতরফ। তবু বিয়েটিয়ে কাজকর্মে দু-বাড়িতে নেমন্তন্ন চালু আছে, পুজো-বাড়িতে যাওয়া-টাওয়া আছে, অসুখ-বিসুখ কী বিপদ-আপদ হলে প্রাণ দিয়ে দেখা আছে, আর এখনকার দুই তরফের মধ্যে তো অনেক কিছুই আছে।
সমবয়সি দুই কাকা ভাইপো। ছেলেবেলায় একসঙ্গে ফুটবল খেলেছেন, এখন একসঙ্গে দাবা খেলেন, তাস খেলেন।
ওই খেলতে খেলতে একবার যা কান্ড হল—
হ্যাঁ কী বলেছিলাম? একবার দাবা খেলতে বসে?
ওঃ বলছি, হল কী, হঠাৎ খেলাটা এমন ভাবে জমে উঠল, বোড়েরা আর নড়ে না। কেউ হারছে না কেউ জিতছে না, সময় কেটে যাচ্ছে। ইনি যদি একটা চাল দিতে আধঘণ্টা সময় নিচ্ছেন তো উনি চল্লিশ মিনিট। …দিন কাটল রাত কাটল, আবার দিন-রাত পড়ল কাটল, আবার সকাল হল। দু-জনের কারুরই হুঁশ নেই কোথা দিয়ে রাত কাটছে।
যারা দেখছে, তারা অবাক হয়ে যাচ্ছে। হাটুরেরা হাটে যাওয়ার সময় দেখে গেছে এঁরা খেলছেন, ফেরার সময়ও দেখছে। ডেলিপ্যাসেঞ্জার বাবুরা সকালে ইস্টিশনে যাওয়ার সময় দেখে গেছে, রাত্রে ইস্টিশনে ফিরেও দেখছে। খেলাটা যেন অনন্তকাল চলবে। দেখতে পাচ্ছে সবাই, কারণ খেলা চলছে একেবারে পাবলিক জায়গায়।
গঞ্জের কালীর নাটমন্দিরের মাঝখানে মার্বেল বাঁধানো বেদিতে বসে। সেকালে কর্তারা এটা বানিয়েছিলেন তাঁরা নিজেরা ওইবেদিতে দাঁড়িয়ে মা কালীর আরতি দেখবেন বলে। ওনারা তো আর সাধারণ প্রজা-টজার সঙ্গে একসঙ্গে মেঝেয় দাঁড়িয়ে দেখবেন না? তা ছাড়া—ওই সদাশিব সিংহরায় নাকি লম্বায় মাত্র সাড়ে চার ফুট ছিলেন। চওড়ায়ও তাই। কাজেই ওর চারচৌকো দেহটির জন্যে উঁচু জায়গা দরকার।
তা এখন ওই মার্বেল বাঁধানো লম্বা-চওড়া বেদিটি দুই তরফের কর্তার দাবা খেলার আসন। লোকচক্ষুকে ওঁরা কেয়ার করেন না। ওতে ওঁদের ব্যাঘাতও হয় না। যেই কেউ একটা ভালোমতো চাল দেন, তিনি হুংকার দিয়ে ওঠেন ‘জয় মা গঞ্জের কালী!’
ছেলেবেলায় বাবা ঠাকুরদাকে নানান ব্যাপারে এইরকম হুংকার দিতে দেখেছেন তাই এই অভ্যাস।
খেলতে খেলতে দিন কেটে রাত হয় প্রায়ই। কিন্তু সেদিন একেবারে একস্ট্রা-অর্ডিনারি। দিন গেল রাত গেল, আবার দিন যেতে বসেছে, ওঠার নাম নেই। দু-বাড়ি থেকেই চাকররা ডাকতে এসে চোরের মতো বসে আছে, কেউ আর ভয়ে ডাকতে পারছে না।
ওদিকে বাড়ি থেকে ওই চাকরদের খোঁজ করতে আবার অন্য চাকর এসেছে। তারপর আবার অন্য। ক্রমশ লাইন পড়ে গেছে দু-দিকে দুটো। চাকর ফুরিয়ে গেলে লাইন দিতে এসেছে গোয়ালা, মালি, দারোয়ান, সরকার।
সবাই আসছে আর ওনাদের মুখ দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে বসে পড়ছে।
ওনাদের মুখ কাঠের মতো শক্ত, চোখ জবাফুলের মতো লাল, মাথার চুল খাড়া, দাঁতে দাঁতে খিল, আর কপালে ভ্রূকুটি।
থেকে থেকে এক-একজন বাঘের মতো হুংকার দিয়ে উঠছেন, ‘জয় মা গঞ্জের কালী, মুখ রাখিস মা! এই দিলাম চাল।’
একজন যদি বাঘের মতো তো, অন্যজন সিংহের মতো।
মাঝে মাঝে আবার ওঁরা তেমনি হুংকারেই বলে উঠছেন, ‘চা…শরবত!’
ব্যস আর কিছু না।
তা আর কিছু বলবারই বা দরকার কী? চাকরদের কাছে তো ওসব জিনিস মজুদই আছে। কেটলি ভরতি চা বানিয়ে এসে কাঠ-কয়লার উনুনে বসিয়ে রেখে দিয়েছে। হুংকার শুনেই ছুটে গিয়ে সামনে ধরছে এক পেয়ালা গরম চা। আর নচেত এক গেলাস ঠাণ্ডা শরবত।
ঘোলের শরবত বানিয়ে ইস্টিশন থেকে বরফ আনিয়ে তার ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। পালাপালি করে দেওয়া হচ্ছে। একবার চা একবার শরবত।
তবে যে দিচ্ছে দু-পক্ষকেই দিচ্ছে। প্রথম দিন বড়োতরফের চাকর সাধন শুধু বীরেশ্বরের সামনেই ঠাণ্ডা শরবতের গেলাসটা ধরে দিয়েছিল। ব্যস আর যায় কোথায়। বড়োতরফ তাকে এই মারেন তো সেই মারেন। ‘বেটা ছোটোলোক’ বলে যাচ্ছেতাই বকুনি তো খেলই সাধন, তার ওপর আবার চাকরিটি যায় যায়। নেহাত হাতেপায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে সেযাত্রা টিকে গেল।
শিবেশ্বরের চাকরদের তো দেখে শুনেই আক্কেল গজিয়ে গেছে।
অতএব একটা হুংকার উঠলেই দুজনের হাতের কাছে দু-পাত্তর পানীয় এসে যাচ্ছে। অথচ ওদিকে বাড়িতে দু-বাড়ির গিন্নিরই মুখে ভাত জল নেই। রোগা হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁরা তো আর মুহুর্মুহু চা শরবত খাচ্ছেন না। অথচ কর্তারা না খেলেই বা কী করে ভাতটাত খান?
দু-বাড়ির মধ্যে রেষারেষিও আছে, আবার আত্মীয়তাও আছে। তাই বড়োতরফের গিন্নি চারুলতা ছোটোতরফের দিকের বারান্দায় এসে ডাক দেন, বউমা কী হবে বল তো?
ছোটোতরফের গিন্নি সুধাময়ী বলেন, তাইতো খুড়িমা ভেবে তো পাচ্ছিনে কী হবে।
লোক দুটো যে পাগল হয়ে যাবে।
আমার মনে হচ্ছে যাবে নয়, গেছে। আপনিই বলুন খুড়িমা, পাগল না হলে কেউ—
কাকা-ভাইপো দুটোই একযোগে পাগল হয়ে গেল?
তাই তো দেখছি।
তা আমরা বসে বসে মানুষ দুটোকে উন্মাদ হয়ে যেতেও দেখব?
দেখব কী, দেখছিই তো খুড়িমা!
থামো বউমা, তুমি বড়ো অপয়া কথা বল।
বেশ তো আপনি পয়া কথা বলুন?
কথা বাড়িও না বউমা, এখন উপায় চিন্তা করো।
তাই তো করছি। মা কালীর কাছে পুজো মানছি ওঁদের সুমতি হোক।
চারুলতা রেগে উঠে বলেন, শুধু তুমিই মানত করেছ? আমি করিনি?
সুধাময়ী বলল, আমি তো বলিনি খুড়িমা, আপনি করেননি।
তুমি কী মানত করেছ শুনি।
সুধাময়ী বলল, মানত করেছি তিনটে পাঁঠা একটা মোষ।
কর্তাদের দেখে দেখে ওদেরও ওই পাল্লা দেওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই চারুলতা বলে ওঠেন, আমি পাঁচটা পাঁঠা দুটো মোষ।
ছি ছি ও-কী কথা খুড়িমা? আপনি পাঁঠা? আপনি মোষ? বলুন ওইসব মানত করেছি?
তুমি থামো বউমা। আমি তোমার মতন অত ব্যাকরণ পড়িনি। দু-দুটো মানুষ, যার নাম বাড়ির কর্তা, তারা পাগল হতে বসেছে—
বসেছে নয় খুড়িমা, হয়েছে।
আঃ। বউমা, চারুলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, তুমি কি আমাকেও পাগল করবে? চলে এসো শিগগির পুকুরঘাটে, পরামর্শ হোক একটা।
পরামর্শ করতে পুকুরঘাট ছাড়া গতি নেই। বিনা নেমন্তন্নয় কেউ তো কারুর বাড়ি যাবে না। তা পুকুরঘাটে বসেই পরামর্শ হল।
আর সেযাত্রা দুটো মানুষ পাগল হতে হতে বেঁচে গেল।
কী করে? সে-কথা ‘মা গঞ্জের কালীই’ বলতে পারেন।
কারণ ওপর থেকেই তো দৈব-বাণী হল, ‘তোঁরা এঁবার খেঁলা ছেঁড়ে উঁঠবি? তোঁদের খেঁলা দেঁখতে দেঁখতে আঁমার যে মাঁথা ধরে গেঁল।’
দেবীর দৈববাণী, কিন্তু ভূতের মতো খোনা খোনা গলা। এটা যে কেন, তা কেউ বুঝতে পারল না।
বোধ হয় বেশি মাথা ধরার জন্যেই খোনা হয়ে গেছলেন মা কালী।
যাই হোক ঠাকুরের যখন মাথা ধরে গেছে তখন তো—আর খেলা চলে না।
বীরেশ্বর শিবেশ্বর দু-জনেই দাবা মুড়ে রেখে, সঙ্গে সঙ্গে প্রণিপাত করে প্রচন্ড হুংকারে বলে ওঠেন, মা অপরাধ মার্জনা করিস মা, মা অজ্ঞান ছেলেকে ক্ষমা করিস—বলে খানিক গড়াগড়ি খেয়ে সেযাত্রা ফিরলেন।
সবাই বলে বেড়াতে লাগল, আশ্চর্য এ যুগেও দৈববাণী হয়।
হবে না কেন? সব যুগেই সব হয়। বিশ্বাস থাকলেই হয়।
তা সেযাত্রা বেঁচে গেলে আর কী হবে?
এক একদিন তো এক এক যাত্রার পালা? বেশ জমকালোই পালা।
এদিকে ব্যাপার এই—বীরেশ্বর পাখি শিকারে ওস্তাদ, আর শিবেশ্বর মরা পাখি দেখলে ভয় পান। কিন্তু হলে কী হবে, হেরে যাওয়া তো চলবে না।
বীরেশ্বরের চাকর এসে চুপি চুপি খবর দিল, ছোটোরাজাবাবু, বড়োরাজাবাবু আজ বেতশরের বনে পাখি শিকার করতে যাচ্ছেন।
এরকম লুকোনো খবর ওরা দেয়। এই ওদের মজা।
শিবেশ্বর লাফিয়ে উঠলেন, কী? বেতশরের বনটা না দু-তরফের? বড়োতরফ একলা গিয়ে সব পাখি সাফ করে আসবে? ব্যস সঙ্গে সঙ্গে জুড়ি গাড়ি চেপে বড়োতরফের ফটকের সামনে।
গাড়িটা অবিশ্যি চালাতে হল না, কারণ দুটো বাড়িই তো পাশাপাশি।
কিন্তু তাতে কী?
পায়ে হেঁটে কেউ কারুর বাড়িতে আসবে নাকি? মান যাবে না?
গাড়ির মধ্যে থেকেই হাঁক পাড়েন শিবেশ্বর, বড়োতরফ! বেতশরের বন কার?
বড়োতরফ দোতলার বারান্দা থেকে ধীরকণ্ঠে বলে উঠলেন, যে শিকারে যায় তার।
ইস! তাই নাকি? আইনে একথা বলে?
বীরেশ্বর সেইভাবেই জবাব দিলেন। আইনকে আমি বুড়ো আঙুল দেখাই ছোটোতরফ। পাখি মারবার সাহস থাকে তো বন্দুক নিয়ে চলো।
ঠিক আছে তাই যাচ্ছি।
ছোটোতরফ হাঁক পাড়লেন, ওরে কে আছিস? আমার বন্দুকটা বার কর।
বীরেশ্বর হাঁক পাড়লেন, ওরে কে আছিস গাড়িতে একখানা কার্পেট আর দাবার ছকটা দে।
ব্যস চলল দু-খানা জুড়ি গাড়ি ঠুন-ঠুন করতে করতে বেতশর বনের উদ্দেশে। যেমন গাড়ি, তেমনি ঘোড়া।
বুড়ো কর্তাদের আমলের জিনিস। আগের মতো গাড়ির যত্ন কোথায়? ঘোড়ার খাদ্য কোথায়? তাহলে কী হবে? ওঁরা তো আর লোকেদের মতন গ্রামে নতুন আসা সাইকেল রিকশায় চড়বেন না? ওঁরা রাজা নয়?
বেতশরের বন খুব দূরের পথ নয়। বনের মধ্যে প্রবেশ করে বীরেশ্বর গাড়ির কোচম্যান বসির মিয়াকে হুকুম করলেন, কার্পেট লাগাও।
কার্পেট লাগাব! কোথায় লাগাব? এই ধুলোবনে?
বীরেশ্বর রেগে ধমক দিলেন, যা বলছি করো। গেলে আমার যাবে।
শিবেশ্বরের গাড়ির ঘোড়ারা আর একটু বেশি পক্ষীরাজ, তাই তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন। এসে দেখলেন আমবাগানের চমৎকার ঠাণ্ডাছায়ায় কার্পেট বিছানো, দাবার ছক পাতা।
শিবেশ্বর বললেন, এটা কী হল বড়োতরফ? আমরা না পাখি মারতে এসেছি?
বীরেশ্বর বললেন, পাখি মারা তো দূরের কথা, মরা পাখি দেখলেই তো তুই মূর্ছা যাস জানি না আমি?
আমি মূর্ছা গেলে তোমার কী হে বড়োতরফ?
বীরেশ্বর বললেন, আমার কী, সেকথা তোকে বোঝাতে আমার দায় পড়েছে ছোটোতরফ। তর্ক রেখে খেলতে বোস।
কিন্তু বড়োতরফ, বনের মধ্যে যদি খেলতে খেলতে রাত হয়ে যায়? জ্ঞান তো থাকবে না।
বড়োতরফ গম্ভীর গলায় বলেন, সেভাবনাটা কি তোর ভাববার জন্যে তুলে রেখেছি? বসিরকে বলেছি বিকেল পড়ে গেলেই ঘোড়া দুটোকে আমাদের গায়ের ওপর ছেড়ে দিতে।
ছোটোতরফ মুঠো পাকিয়ে বলেন, গায়ের ওপর ছেড়ে দিতে বলেছ? ঘোড়া? এ কী আরশোলা না ব্যাঙাচি যে গায়ের ওপর ছেড়ে দেবে?
মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিসনে ছোটোতরফ, ব্যাঙাচি আরশোলা হলে আমাদের হুঁশ ফিরবে?
তা বলে ঘোড়া?
তাতে কী? ঘোড়া ছাড়া কেউ আমাদের নেশা ভাঙাতে পারবে?
ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ঘোড়া যদি আমার গায়ের ওপর এসে পড়ে?
সেতো পড়বেই।
সেতো পড়বেই? এ কী ছেলের হাতে মোয়া? তাতে আমার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে না?
গেলে তো বয়েই গেল।
শিবেশ্বর বললেন, বড়োতরফ, কথাবার্তা ভালো হচ্ছে না।
ভালোর জন্যে তো কার্পেট পেতে রেখেছি, আরও ভালো চাস? ভালো অত সস্তা নয় ছোটোতরফ! নে বসে পড় বলছি!
খেলা চলছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সোনাঝরা গোধূলি বেলা; বসির মিয়া গাড়ি থেকে একটা ঘোড়া খুলে কাছাকাছি এনে হাঁটাচ্ছে।
খট খট খটাস খটাস।
আর কী করবে? সত্যি তো আর কর্তাদের গায়ের ওপর ঘোড়া ছেড়ে দিতে পারে না। কিন্তু এদিকে যে বনেরমধ্যে সন্ধে নামে নামে।
যা থাকে কপালে।
ছোটোতরফের সহিস আবদুল ঠাঁই করে ধাক্কা মেরে, দিল একটা ঘোড়াকে ছুটিয়ে, কারণ বসিরের সঙ্গে সারাদিন গালগল্পের মধ্যে সেওনাদের খেলার অজ্ঞানতা ভাঙাবার ওষুধ জেনে ফেলেছে।
তা এ ঘোড়াটা আবার বেতো। আর বেতো ঘোড়াদের নিয়মই হচ্ছে হঠাৎ ধাক্কা দিলে হড়বড়িয়ে ছোটে। তাই ছুটল।
পায়ের তলায় দাবার ছক পিষে দুই রাজার পিঠের ওপর খুর তুলে দিয়ে তছনছ করে বেরিয়ে গেল খানিকটা। আর যায় কোথায়?
বীরেশ্বর হাঁকলেন বসির! তোর দেশে যাবার ভাড়া কত?
বসির কেঁদে ফেলে বলে, কসুর হয়ে গেছে বড়ো রাজাবাবু। তবে আগে তো আমিই ঘোড়া ছেড়ে ছিলাম। কিন্তু আপনার ঘোড়া তো আর আবদুলের ঘোড়ার মতো অসভ্য নয়। ও ঠুক ঠুক করে আপনাদের জানান দিচ্ছিল।
জানান দিচ্ছিল! জানান দিলেই সব হল? বীরেশ্বর রেগে মেগে বলেন, আর এই ছোটোতরফ জিতে গেল?
বসির কোনো কথা না বলে দু-হাতে নিজের দুই কান ধরে মাটিতে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে নাকে খৎ দিতে লাগল।
হেসে উঠলেন দুই মহারাজা।
থাক থাক হয়েছে। চল বেটা বকশিশ নিবি।
বকুনি খেলেই ওরা বকশিশ পায়। এই নিয়ম।
এরপর দু-জন দু-গাড়িতে উঠলেন।
আর চলল প্রতিযোগিতার দৌড়। কে কাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে। আপ্রাণ চেষ্টাতেও আবদুল পিছিয়ে গেল।
বড়োতরফ গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে দুয়ো ছোটোতরফ দুয়ো—বলে হাসতে হাসতে দেউড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন গাড়িসমেত।
আর ছোটোতরফ গুম হয়ে বসে প্রতিজ্ঞা করলেন, এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। চাই প্রতিশোধ চাই।
প্রতিশোধের প্রধান উপায় হচ্ছে ঝট করে বড়োতরফের নাকের সামনে একটা ভালো ঘোড়া কিনে গাড়িতে জুড়ে ফেলে বড়োতরফের চোখের সামনে দিয়ে টগবগ করে বেড়িয়ে বেড়ানো।
কিন্তু কোথা সেই ঘোড়া?
আগে আগে, মানে কর্তাদের আমলে নাকি কালীগঞ্জের ওপারে চকের হাটে বছরে দুবার করে ঘোড়ার হাট বসত। চৈত্র মাসে আর কার্তিক মাসে, এখন ভোঁ ভোঁ। ওই চকের হাটের মাঠে এখন প্লাস্টিক তৈরির কল বসেছে।
তা ছাড়া মাত্র একটা ঘোড়া কিনেই বা লাভ কী? জুড়ি ঘোড়ারগাড়িতে একটা তাজা আর একটা বেতে ঘোড়া জুড়লেও তা চলবে না।
তাহলেই হয়তো বড়োতরফ ছড়া বেঁধে পাড়ার কুচো ছেলের দল লেলিয়ে দেবেন। তারা গেয়ে বেড়াবে…
‘আহা কী মানানের ঘোড়া! একটা তাজা টগবগে, একটা বেতো খোঁড়া।’
অথবা ওইরকমই একটা কিছু। হয়তো—‘সাবাস ঘোড়া সাবাস! একজন খায় দানাপানি একজন স্রেফ ঘাস।’
অথচ দুটো ঘোড়া কেনা? সেও তো সহজ নয়। শিবেশ্বরের মনে সুখ নেই। শিবেশ্বরের খিদে নেই ঘুম নেই।
শিবেশ্বরের এক দূর সম্পর্কের ভাগনে মাঝে মাঝে কালীগঞ্জ বেড়াতে আসে, দু-পাঁচ দিন থাকে রাজা-মামার ঘরের গোরুর দুধের ক্ষীর, পুকুরের রুই কাতলার মুড়ো, বাগানের আম, গাছের মর্তমান কলা— এই সব সেঁটে এবং কিছু বা ছাঁদা বেঁধে নিয়ে ডুব দেয়।
দেয় তো দেয় ছ-মাস আর দেখা নেই। আবার হঠাৎ একদিন এসে উদয় হয় সর্বাঙ্গে কলকাতার নতুন হাওয়া বয়ে নিয়ে।
শিবেশ্বরের এই মনমরা সময়ে হঠাৎ একদিন ভ্যাবলার আবির্ভাব।
ভ্যাবলার পরনে চককর-বককর-কাটা সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে নামাবলির ফ্রক কোট, মাথার চুল মেয়েদের মতো পিঠে ছড়ানো, দুই গালে দু-চাপড়া জুলপি, চোখে দু-খানা ঘুঁটের সাইজের গগলস, একহাতে ঘড়ি আর অন্যহাতে স্টিলের বালা।
শিবেশ্বর হাঁ হয়ে গিয়ে বললেন, এসব কী ভ্যাবলা?
ভ্যাবলা একটু কৃপার হাসি হেসে বলল, এটাই ক্যালকাটার নিউ মডেল মামা!
তোর সেই চোঙা প্যান্ট কোথায় গেল?
চোঙা প্যান্ট? আরে ছি ছি, সেতো লর্ড ক্লাইভের আমলের।
বলিস কী? এই তো সেবার—
সেবারে আর এবারে আশমান-জমিন ফারাক মামা, সেতো সাড়ে পাঁচমাস আগেকার ঘটনা।
সেই ছুঁচোলো জুতো।
আঃ হা হা! নাম কোরো না। এখন ওসব মেয়েরা পরে।
মেয়েরা পরে? সু-জুতো? হায় মা গঞ্জের কালী! তোরা ছেলেরা তবে কী পরিস?
ভ্যাবলা মৃদু হেসে বলে, জরির নাগরা, রঙিন চটি।
শিবেশ্বর নিশ্বাস ফেললেন। বললেন—ভ্যাবলা জল খা।
গুছিয়ে বসে জলযোগ সেরে ভ্যাবলা বলল, তোমায় কেন মন-মরা দেখছি মামা?
শিবেশ্বর বললেন, সেবললে তুই বুঝবি না।
ভ্যাবলা রেগে বলল, বাংলায় বললে বুঝব না কেন?
তা শিবেশ্বর বলবার আগেই বলে দিলেন সুধাময়ী। সেই পুরোনো কথা, বড়োতরফ গাড়ি এগিয়ে ‘দুয়ো’ দিয়েছেন। এখন একজোড়া তাজা ঘোড়া হলে—
ভ্যাবলা বলল, ঘোড়া রোগটা ছাড়ো মামা। ধাঁ করে একখানা মোটর গাড়ি কিনে ফেলো আর সাতবেলা বড়োতরফকে দুয়ো দিয়ে ভঁকভঁকিয়ে বেড়াও।
মোটর গাড়ি! ভঁকভঁকিয়ে।
ছোটোতরফের সব লোমকূপগুলোর কাঁটা ঠিকরে উঠল, মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল ধুতির কাছা খুলে পড়ল। ছোটোতরফ নিশ্বাসকে মাঝপথে রেখে বললেন, মোটর গাড়ি কিনব? আমি?
ভ্যাবলা কিন্তু দিব্যি অবহেলায় বলল, কেন কিনবে না? মোটর গাড়ি তো রাজা-রাজড়ারাই কেনে।
ছোটোতরফ এবার নিশ্বাসটা ফেলে বললেন, নামেই রাজা রে ভ্যাবলা, তবে-পুকুরে ঘটি ডোবে না।
আরে বাবা, তবু মরাহাতি লাখ টাকা।
না রে ভ্যাবলা! সব ঢনঢনে।
ভ্যাবলা একটু গুম হয়ে থেকে বলে, আর এই যে নিত্য দু-বেলা রাম-রাজত্বে খাওয়া-দাওয়া চলছে?
ওইটিই আছে।
আর এই রোজ পাটভাঙা গিলেকরা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো কাঁচির ধুতি?
ওইটুকুই আছে রে ভ্যাবলা!
কানে আতর? পা টেপার চাকর?
ওইটুকুতে আর নজর দিসনি ভ্যাবলা! ওইটুকুই আছে।
তবে মোটর গাড়িও থাকবে। ভ্যাবলা লাফিয়ে উঠে বলে, না হয় একটা সেকেণ্ডহ্যাণ্ডই কিনে নিয়ে আসি, টাকা দাও।
শিবেশ্বর ভুরু কুঁচকে বলেন, কী হ্যাণ্ড? শেকহ্যাণ্ড?
সেকেণ্ডহ্যাণ্ড গো সেকেণ্ডহ্যাণ্ড! মানে জানো না? না: তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। মানে একটু ব্যাভার করা।
ব্যাভার করা?
ছোটোতরফ ছিটকে ওঠেন। তার মানে— পুরোনো? তুই বলিস কী ভ্যাবলা, কালীগঞ্জের সিংহরায়দের বংশধর হয়ে আমি অন্যের ব্যাভার করা জিনিস কিনব? যা বললি আর বলিসনি।
ভ্যাবলা এবার বিপদ গোনল। কিন্তু ভ্যাবলা ঘাবড়াবার ছেলে নয়, তাই বলে উঠল, গাড়ি কিছু আর জুতো জামা নয় মামা যে, পুরোনোয় দোষ লাগাবে। রেলগাড়িতে চড়ো না তুমি? তাতে আগে অন্য লোক বসেনি?
ছোটোতরফ নরম হয়ে যান। যুক্তিটা মানেন। বলেন, বলছিস তাই?
বলছিই তো।
তবে তাই না হয়—
শিবেশ্বর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ উৎসাহের সঙ্গে বলে ওঠেন, তার চেয়ে তুই বরং একটা কাজ কর ভ্যাবলা। বাজার ঘুরে কোনোখান থেকে একখানা দোকানে পড়ে থাকা বস্তা-পচা সস্তা গাড়ি দেখগে—তবু তো লোকের পুরোনো নয়?
দোকানে পড়ে থাকা। বস্তা পচা সস্তা জিনিস।
ভ্যাবলা, একটুক্ষণ ওর মামার উৎসাহদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক আছে তাই হবে। তাহলে কিছু টাকা ফেলো। কলকাতা শহরে তো আর পায়ে হেঁটে দোকানে ঘোরা যায় না?
ওদিকে বড়োতরফের বৈঠকখানায় জোর বৈঠক।
জমকালো এক গুজব এসেছে, শুনেপর্যন্ত বড়োতরফ আলবোলার নল হাতে নিয়ে খেতে ভুলে গিয়ে বসে আছেন গুম হয়ে।
হ্যাঁ, এযুগেও গড়গড়া আলবোলা এসব বজায় রেখেছেন এঁরা। চাকর দু-একবার বলেছে, রাজাবাবু তামাক ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
রাজাবাবু বলেছেন, চোপরাও!
কিছুক্ষণ আগে সরকার মশাই অনেক বুঝিয়েছেন, গুজবে কান দেবেন না— কিন্তু কান না দিয়ে উপায় কী?
রাজাবাবুর খাসচাকর বঙ্কিম এসে খাসখবর দিয়েছে… ছোটোতরফ মোটর গাড়ি কিনছেন। মোটর গাড়ি! তার মানে বড়োতরফের ঘোড়ারাও মান মর্যাদা হারিয়ে কোন পিছনে পড়ে থাকবে!
গুম ভেঙে বলে উঠলেন বীরেশ্বর, বঙ্কিম গাড়ি যে কিনছে তা টাকা পাচ্ছে কোথায়?
বঙ্কিম মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে সেখবরটা এই সদরে বসে বলা চলবে না। গুপ্ত খবর। গুপ্ত খবর! তার মানে?
মানে আজ্ঞে বললাম তো আড়ালে নিবেদন করতে হবে।—বলে বঙ্কিম মুখের সামনে হাত আড়াল করে কথাটা নিবেদন করেই ফেলল।
আর শুনেই বড়োতরফ একেবারে ঠিকরে দাঁড়িয়ে উঠলেন, অ্যাঁ! এত দূর সাহস? বঙ্কিম, লেঠেলদের খবর দে—
বঙ্কিম মাথা চুলকে বলল, লেঠেল আর কই বাবু? সব তো ওই পেলাসটিকের কারখানায় কাজ করতে চলে গেছে। আর বুড়োগুলো মরে হেজে গেছে।
তা বলে আমি বেঁচে থেকে গঞ্জের কালীর এই অপমান চোখে দেখব?
বঙ্কিম বলল, চোখে আর দেখবেন কেমন করে? চোখের আড়ালেই তো কাজ হচ্ছে। ঠিক আছে, আমি নিজেই পাহারা দেব।… কইরে কে আছিস,দে তো আমার বন্দুকটা!
বঙ্কিমের হাতে আড়াল-করা কথাটা অবশ্য শুনতে কারও বাকি রইল না।… ছোটোতরফের সেই লক্কমার্কা ভাগনেটা নাকি মা কালীর সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করে ফেলে সেখান থেকে মোহরের ঘড়া সাফ করে আনছে।
ঘরে আরও যারা সব ছিল তারা বলে, বঙ্কিমের কথা শুনে ঝপ করে কিছু করে বসবেন না রাজাবাবু, দেখুন সত্যি-মিথ্যে। ছোটো রাজাবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন—
বঙ্কিম বলে ওঠে, আহা রে! জিজ্ঞেস করলেই উনি সত্যি কথা বলবেন?
যেই না বলা, বঙ্কিমের মাথায় ঠাস ঠাস ডজনখানেক চাঁটি পড়ে।
কী বললি পাজি! ছোটোমুখে বড়ো কথা! সিংহীরায়ের বংশ মিছে কথা বলবে? যা বেরিয়ে যা! উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজে হাতে নিজের গায়ে জলবিছুটি লাগাগে যা।
আজ্ঞে রাজাবাবু নিজের হাতে?
আলবাত নিজের হাতে। সদাশিব সিংহরায়ের হাতে পড়লে তোর ওই জিভখানা টুকরো টুকরো হয়ে কুকুরের পেটে যেত তা জানিস?
ওরে বাবা। বঙ্কিম বেঁা করে কাট মারল।
বড়োতরফ বললেন, ওরে কে আছিস, বন্দুক, থাক, গাড়িখানা বার করতে বল।
আস্তাবল থেকে গাড়ি বেরোল! বীরেশ্বর সিংহরায় কানে আতর দিয়ে আট আঙুলে আটটা আংটি পরে গাড়ির এ দরজা দিয়ে ঢুকে ও দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাঁক পাড়লেন, ছোটোতরফ!
শিবেশ্বর নিজের গেটের মধ্যে দাঁড়িয়ে জবাব দিলেন, কী আজ্ঞে বড়োতরফ?
তুই নাকি মোটর গাড়ি কিনছিস?
শিবেশ্বর জবাব দিলেন, কিনলে কিনছি। নিজের পয়সায় কিনছি, তোমার কীসের মাথাব্যথা?
নিজের পয়সায় কিনছিস না মা কালীর মোহর সরাচ্ছিস?
কী? কী বললে বড়োতরফ? তোমার মুখে এরকম চাষাভুসোর মতো কথা? মা কালীর মোহর সরাচ্ছি?
বীরেশ্বর একটু মুষড়ে গিয়ে বললেন, তবে যে বঙ্কিম বললে তোর ওই লক্কা-মার্কা ভাগনেটা, যেটাকে দেখলে মেয়ে না ছেলে বোঝা যায় না, সেটা নাকি মা কালীর সুড়ঙ্গ পথ আবিষ্কার করেছে—
বঙ্কিম তার নিজের মতন কথাই বলেছে।
হুম! তাহলে মোটর গাড়ি কেনার টাকা পাচ্ছিস কোথায়?
পাচ্ছি তোমার মতন কিপটে নই বলে, বুঝলে বড়োতরফ? শিবেশ্বর ভুরু নাচিয়ে ভ্যাবলার কথাটাই বলেন, মরাহাতি লাখ টাকা বুঝলে? বড়ো গোলার তাল!
আচ্ছা ঠিক হ্যায়।
বড়োতরফ গাড়ির ও দরজা দিয়ে নেমে পড়ে বৈঠকখানায় গিয়ে বসে ঘোষণা করলেন, আমার কোনো ভাগনে আছে কি না খোঁজ করো তোমরা। খুঁজে বার করে আনাও তাকে।
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সাতজন্মে তো কোনো বোনই দেখেনি কেউ, ভাগনে আসবে কোথা থেকে? কিন্তু সেকথা বলে কার সাধ্য?
বাড়ির মধ্যে যখন খেতে ঢুকেছেন, তখন চারুলতা বলেন, মোটর গাড়ি কিনবে তো মোটর গাড়ি কিনবে, ভাগনে কী হবে?
বলি, বড়োরানি, ছোটোতরফের ভাগনে গাড়ি কেনার ভার নিয়েছে না? সামান্য একটা ভাগনের ব্যাপারে ওর কাছে হেরে যাব আমি? আমি এমনই অধম যে আমার একটা ভাগনে জোগাড় হবে না?
হবে না বললে তো হবে না। হতেই হবে।
দিকে দিকে লোক ছুটল, বড়োতরফের একটা ভাগনে জোগাড় করতে।
ছুটল তো, কিন্তু ছুটলেই কী আর তদ্দন্ডেই পাওয়া যায়? এ তো আর বড়োবাজারের হরেক মালের দোকান নয় যে, গেলাম, টাকা ফেললাম, কিনে নিয়ে এসে ঘরে তুললাম। এ হচ্ছে জলজ্যান্ত একটা ভাগনে। ভ্যাবলার থেকে ছোটো হলেও চলবে না, বড়ো হলেও চলবে না। বুনো হলেও চলবে না, গাঁইয়া হলেও চলবে না, স্রেফ একেবারে ভ্যাবলার জুড়ি। বরং একটু বেশি ভালো।
এতরকম বায়নাক্কা, অথচ মূলেই শূন্যি। তিনকুলে একটা ভগনীই নেই, তা ভাগনে!
তবু খুঁজে হাললাক হয়ে যাচ্ছে সবাই, যদি হঠাৎ কোনখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। লোকেরা ট্রেন ভাড়া নিচ্ছে, বাস ভাড়া নিচ্ছে, তোফা কলকাতা বেড়িয়ে আসছে। আর এসে শ্রীরামকৃষ্ণঠাকুরের ছবির মতো দু-হাত ওলটাচ্ছে।
বড়োতরফ হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলেন, আশ্চয্যি। আকাশের চাঁদ চাইনি, সাপের মাথার মণি চাইনি, নন্দন কাননের ফুলও চাইনি, চেয়েছি কুল্লে একটা ভাগনে তা তোরা জোটাতে পারলি না?
ওরা মাথা হেঁট করে থাকে।
তা এত দুঃখ দেখে বোধ হয় ভগবানের প্রাণে দয়া হল, হঠাৎ একদিন আপনি আপনিই এক ভাগনে এসে হাজির। ঠিক যেমনটি চেয়েছেন তেমনটি। বড়োতরফের পিসতুতো মাসির খুড়তুতো বোনঝির ছেলে।
যাক তুতো-ফুতোর জটিল জাল ভেদ করতে যান না বড়োতরফ, ভাগনে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে চেঁচিয়ে ধমকে ওঠেন, এতদিন কোথায় ছিলি রে হতভাগা? আমি তোকে গোরুখোঁজা করে খুঁজছি।
ভাগনে চটপট বলে ওঠে গোরুখোঁজা করে খুঁজছেন বলেই পাননি,মানুষ খোঁজা করে খুঁজলে পেতেন।
বা: বা:। ঠিক যেন ছোটোতরফের ভাগনে ভ্যাবলা বসানো কথাবার্তা।
বড়োতরফ বলেন, তা ছিলি কোথায় তা বলবি তো?
ভাগনে বুক টান করে বলে, জলেও নয়, পাতালেও নয়, আকাশে অন্তরিক্ষেও নয়, এই মর্তলোকেই ছিলাম।
তা এতদিন আসিসনি কেন? মামা বলে একটু টান নেই?
ভাগনে আরও বুক টান করে বলে,আপনিও কখনো ডাকেননি। আপনারও ভাগনে বলে টান নেই।
শুনে না— বড়োতরফ আহ্লাদে বিগলিত হন। হাঁ এ ছেলে পারবে। পারবে ছোটোরাজাকে কথায় জব্দ করতে! আর ওই নামাবলি মার্কা জামা পরা ছেলেটাকেও।
বড়োতরফ তাই মাথা চুলকে বলেন, তা ভুল হয়ে গেছে বটে। রাজারাজড়াদের একটু ভুলভাল হয় বাপু। তা যাক এখন কাজের কথায় এসো। ছোটোতরফ গাড়ি কিনছে, আমারও একটা গাড়ি চাই।
ভাগনে মুখে আকাশের আলো মেখে বলে, এই ব্যাপার! এই জন্যে এই চিন্তা? টাকা সাপ্লাই করুন, কালই এনে হাজির করছি।
বড়োতরফ আহ্লাদে গলে গিয়ে ভাগনের গলা ধরে বলেন, ওরে আমার চাঁদুরে, চল চল তোর মামির কাছে। আগে তার কাছে সরের নাড়ু, ক্ষীর, কদমা, নারকেল তক্তি, আর খাসা মোয়া দিয়ে জলযোগ সারবি চল,তারপর কথা। কিন্তু খবরদার যে-সেলোকের মতো শুধু মামি বলবি না, বলবি রানি মামি।
ভাগনে বলে উঠল,শুনে বড়ো দুঃখ পেলাম রাজা মামা! এ আবার শেখাতে হয়? না হয় গরিবের ছেলে তবু রাজবাড়ির ভাগনে তো বটে। চালচলনের কিছুও জানব না।
আহা আহা, দুঃখ করিসনে বাপ। বললাম একটা কথার কথা। তোর ওই রানি মামিটি একটু উগ্রচন্ডী তো, চালচলনে খুঁত থাকলে ভাগনে বলে মানবেই না। হ্যাঁ রে, তা নাম কী তোর?
নাম? নাম স্বপন। স্বপন বসুচৌধুরী।
বেশ বেশ। এই তো চাই! এই নামেই তুই ছোটোতরফকে গোল দিয়ে চলে যাবি। আহা, ছোটতরফের ভাগনের নামের কী ছিরি! ভ্যাবলা! শুনে হাসি পায়। চল ভেতরে চল।
বাড়ির মধ্যে ঢুকেই হাঁক পাড়েন বড়োতরফ, বড়োরানি এই দেখো এসে। ভাগনের মতন ভাগনে। ছোটোতরফ কোথায় লাগে। আহা, ওর ভাগনের নামটি কী? না ভ্যাবলা! আর এর নাম? ইয়ে—মানে হ্যা, গোপন বোসচৌধুরী।
গোপন নয় রাজা মামা, স্বপন।
স্বপন। ও, তা যাই হোক, ও দুইই এক। বলি রানি, ভাগনে এল তেতে পুড়ে, খেতে দিচ্ছ না যে?
চারুলতা গম্ভীরভাবে বলেন, আগে থেকে খবর দিয়ে এলে বাড়ি ঢোকবার আগেই খাবার রেডি থাকত।
স্বপন উল্লাসে উথলে উঠে বলে, রেডি। ওরে ব্বাস! রানিমামির যে দেখছি ইংরিজি বিদ্যেও আছে। ভালো ভালো। তা খবর দেবার ফুরসত কোথা পেলাম। লোকমুখে শুনলাম, রাজামামা ভাগনে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, শুনে মনটায় বড়ো কষ্ট হল। কত আজেবাজে লোকের মুঠো মুঠো ভাগনে ছড়াছড়ি যাচ্ছে, আর রাজামামা ভাগনের কাঙাল? তক্ষুনি কাজকর্ম সব ছেড়ে চলে এলাম।
বীরেশ্বর সিংহরায়, গোঁফে চাড়া দিয়ে বলেন, দেখলে তো মহারানি, কী দরের ভাগনে আমার। অ-দরকারে টিকিটি দেখোনি, দরকারের সময় ঠিক এসে হাজির। তা এখন খেতে বোস, সঙ্গে সঙ্গে কথা হোক।
হোক।
তাই হয়।
জলখাবারের থালা সামনে টেনে নিয়ে স্বপন বলে, শুনলাম ছোটোতরফের ভাগনের রোজ মাছের মুড়ো না হলে চলে না।
বড়োতরফ সজোরে বলেন, তোরও চলবে না। ওরে কে আছিস, কানাইকে খবর দে, পুকুরে জাল ফেলুক।—এখন আসল কথায় আসি। আমি তো বাবা আজ কদিন ধরে কালীগঞ্জে মুখ দেখতে পারছি না। ছোটোর নাকি মোটর গাড়ি আসছে।
আসছে বুঝি?
স্বপন ক্ষীরের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বলে, বড়োরও আসবে। নইলে ভাগনে আসে কোন দরকারে?
ঠিক ঠিক!
বড়োতরফ গিন্নির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন, দেখেছ, কী বুদ্ধি ভাগনের!
অতঃপর পরামর্শ হয়।
এবং স্বপন অবহেলায় বলে, ওর আর কী, হাজার দশেক টাকা ছাড়ুন, গাড়ি এসে কালীগঞ্জে ঢুকে যাবে।
দশহাজার!
বড়োতরফ বলেন, এত টাকা লাগে নাকি রে স্বপন?
স্বপন হেসে উঠে বলে, বলেন, কী রাজা মামা! আরও অনেকই তো লাগবার কথা, নেহাত নাকি আমার বন্ধুর পিসেমশাইয়ের মোটর তৈরির কারখানা আছে তাই—
বীরেশ্বর সিংহরায় সিংহবিক্রমে বলেন, ঠিক আছে। তাই দেব। কালই বেরিয়ে পড়।
ওদিকে ততক্ষণে ছোটোতরফের ভাগনে গাড়ি এনে হাজির করে ফেলেছে।
অবিশ্যি গাড়িটা নিজে চলে আসতে পারেনি, একটা লরি ওকে টেনে এনেছে। তাই কোনো কথা বলার আগে লরি ভাড়াটা চেয়ে নিয়ে তাকে বিদায় করে ভ্যাবলা। তারপর ধীরেসুস্থে জলখাবার খেতে বসে।
সরের লাড়ু, পাকা কলা, গরম লুচি, বড়োমাছের দাগার ঝাল।
কিন্তু গাড়ি কেন পরের ঠ্যালায় এল? নিজের চাকা নেই ওর?
ভ্যাবলা মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলে, চাকা নেই মানে? চার চার খানা চাকা রয়েছে দেখতে পাচ্ছ না?
তাতো পাচ্ছি। কিন্তু চলছে না কেন রে ভ্যাবলা? গাড়ির ধর্মই তো চলা।
ধর্ম? ধর্ম জ্ঞানটা দেখছি তোমার বড্ড বেশি মামা! নিজেই বলেছিলে বস্তাপচা সস্তা মাল খুঁজে পেতে নিয়ে আসতে।
ছোটোতরফ মলিন মুখে বলেন, তা বলে চলবে না?
কেন চলবে? বসে খেয়ে ওর গাঁটে গাঁটে গেঁটেবাত ধরে গেছে না? সস্তার জন্যে কিছুটা তো ছাড়তেই হবে মামা। …ভ্যাবলা সরের নাড়ুতে কামড় দিতে দিতে বলে, গাড়িটার আর কী নেই বল? রং রয়েছে, গড়ন রয়েছে, জানলা, দরজা, চাকা, স্টিয়ারিং সব রয়েছে। প্রধান যেটা দরকার, হর্নও রয়েছে দিব্যি। অভাবের মধ্যে ভেতরের ইঞ্জিনটা নেই, তা তোমার এত চাইলে চলে না! আসুক না রানি মামি তার আড়াই মুনি শরীরটা নিয়ে, বসে দেখুক গাড়ি ফেঁসে যায় কি না। যাবে না। টসকাবে না। এ আমার গ্যারান্টি দেওয়া।
কিন্তু তাহলে?
তাহলে আবার কী? গাঁয়ের কি তোমাদের প্রজা-ফ্রজা কম আছে? ওই তো গাড়ি দেখতে পিলপিল করে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদেরই ক-টাকে লাগিয়ে দেবে, ঠেলে ঠেলে বড়োতরফের নাকের সামনে দিয়ে যাবে আর আসবে। আসবে আর যাবে, আসবে আর—(রানিমামি আর দুটো সরের নাড়ু ছাড়ে।) যাবে আর—।
দোহাই তোর ভ্যাবলা, চুপ কর। আমার মাথা কেমন করছে। শুধু ভাবছি বড়োতরফ কী বলবে এই গাড়ি দেখে।
সুধাময়ী আর চারটে সরের নাড়ু এনে ভাগনের পাতে দিয়ে বলে ওঠেন,কিছু বলবেন না। ওনারও ভাগনে জোগাড় হয়েছে। তার ওপরই গাড়ি কেনার ভার।
সিংহীরায়দের সংবাদদাতারা খবরের কাগজের থেকে কিছু কম চটপটে নয়,কাজেই ভ্যাবলার শেষ সরের নাড়ুটি শেষ হওয়ার আগেই বড়োতরফের বৈঠকখানায় ছোটোতরফের মোটর গাড়ির খবর পৌঁছে গেছে।
শুনে বড়োতরফের মুখে বিজলি আলো জ্বলে ওঠে, সত্যি সত্যি সেগাড়ি নিজের কলকবজায় চলে না? লরিতে টেনে এনেছে। তবে তো দেখতে যেতে হয়।…ওরে কে আছিস। বসিরকে বল জুড়িটা বার করতে।
জুড়ি বেরোল।
বড়োতরফ কাঁচির ধুতি পরলেন, মলমলের পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন, আর জরিপাড় চাদর কাঁধে ঝোলালেন, ঢুকিয়ে নিলেন আট আঙুলে আটটা আংটি। কানে আতরের তুলো, হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি, পায়ে বার্নিশ করা পাম্পসু, জুড়িগাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
তারপর বললেন, কালীতলা ঘুরিয়ে নিয়ে ও রাস্তা দিয়ে আসবি। যেন টের না পায় ওর মোটর গাড়ি দেখতে বেরিয়েছি।
বসির ওসব কায়দায় পাকা, বসির ঘোড়ার গায়ে ছপটি মারতে মারতে আর রোখকে রোখকে করতে করতে পাড়া তোলপাড় করে কালীতলায় গিয়ে পৌঁছোল।
বড়োতরফ বললেন, মন্দিরেই যখন এলাম মায়ের পুজো দেওয়া তো দরকার। বসির, গাড়ি থামা।
গাড়ি থামাল বসির।
বড়োতরফ মাটিতে দেড়বিঘত লোটানো কোঁচার আগা সামলে নেমে মন্দিরে চাতালে উঠে করজোড়ে বললেন, মা ডাকাতে কালী। মান মর্যাদা রাখিস মা। ছোটোর গাড়ি যেন চলে না। তারপর পকেটে হাত পুরে যতগুলো টাকা ছিল বার করে ঠাকুরের সামনে থালায় রেখে দিয়ে কোঁচা সামলে গাড়িতে উঠলেন।
বসির একগাল হেসে বলল, ছোটো রাজামশাইয়ের গাড়ি চলে না, কী তামাশা বড়ো রাজামশাই?
বড়োতরফ গাড়ির দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে গর্জন করে বললেন, কী বললি বসির! বেঁটে মুখে লম্বা কথা!
গর্জন শুনেই বসিরের প্রাণ উড়ে গেছে। বসির মাথা চুলকে বলে, আজ্ঞে ছোটো রাজামশাইয়ের গাড়িটা চলে না তাই বলছিলাম।
তামাশার কথা কী বলছিলি?
আজ্ঞে গাড়ির ধড় আছে, মুন্ডু আছে, চারখানা চাকা আছে অথচ চলে না, তাই বলছিলাম এ তো বড়ো তামাশা।
হুঁ। ভারি শয়তান তুমি! কথা দিয়ে কথা ঢাকছ। খবরদার, যদি সিংহীরায়েদের নিয়ে একটা কথা বলবি তো তোকে কাঠপিঁপড়ে দিয়ে খাওয়াব। আমি বলছি বলে তুমি বলবে? পায়ে মাথায় সমান?
বসির হাতজোড় করে বলে, কসুর মাপ করুন হুজুর কে বলেছে ছোটো হুজুরের গাড়ি চলে না? খুব চলে!
বসির। আবার বেঁটে মুখে লম্বা কথা? কে বলেছে মানে? আমি বলেছি না? তোর বুঝি আজ মরণের পাখা উঠেছে? তাই আমার ওপর কথা? বলে দিলি, খুব চলে?
বসির আর কোনো কথা না বলে হাতের ছপটি নামিয়ে রেখে দু-হাতে দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে।
বড়োতরফ প্রসন্ন মুখে বলেন, ওটা কী হল বসির?
আজ্ঞে হুজুর, বেসুরো কথার জন্যে কানমলা খাচ্ছি।
বেশ। ঠিক আছে। মনে থাকে যেন। সব সময় সুরে তালে কথা কইবি, বেসুরে বেতালে নয়। মনে থাকবে?
বসির জিভ কেটে বলে, বলেন, কী হজুর। মনে থাকবে না? এই তো, ছোটোহুজুরের গাড়ি চলে, চলে না। চলে না,চলে। চলে, চলে না। চলে না, চলে। চলে—
থাম থাম বলছি শয়তান! বড়োতরফ চেঁচিয়ে ওঠেন, মাথার খিল নাড়িয়ে দিল।! চল শিগগির।
বসির আবার ঘোড়ার গায়ে ছপটি মেরে টকাটক শব্দ তুলে পাড়া গমগমিয়ে বাড়ি ফেরার পথে যখন—যেন হঠাৎই এসে পড়েছে এইভাবে ওই মোটর গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ভ্যাবলা পরামর্শ দিচ্ছে গাড়ির গ্যারেজটা কোনখানে হওয়া উচিত।
বড়োতরফ জুড়িগাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে আর হাত বাড়িয়ে ছড়িটা উঁচিয়ে বললেন, কী রে ছোটোতরফ, এই গাড়ি?
ছোটোতরফ শিবেশ্বর বললেন, হুঁ।
বড়োতরফ হেসে ছড়ি নাড়তে নাড়তে বলেন, তা হাওয়া গাড়ির শুনছি নাকি চাকায় হাওয়া নেই?
ভ্যাবলা কটাক্ষে একবার ওই ছড়ি নাড়াটা দেখে নিয়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
ছোটোতরফ বললেন, হাওয়া নেই মানে? কে বলেছে নেই? আলবাত আছে। শুধু হাওয়া কেন, ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাত সব আছে।
ও! তাই বুঝি? ভালো ভালো! তা আমার সামনে একবার চালা? দেখি মোটরে কতটা অশ্বশক্তি।
শিবেশ্বর কিছু বলার আগেই ভ্যাবলা এগিয়ে এসে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ড্রাইভারের পেটের অসুখ, সেএখনও এসে পৌঁছোনি, চালাবে কে?
ছোটোতরফ হাঁ করে ভাবেন, উঃ! ছেলেটার কী বুদ্ধি। সেই যে ভূধর পন্ডিত পড়াতেন ছোটোবেলায়, প্রুত্যুৎপন্নপ্রতিত্ব! এ যে দেখছি তাই।
কিন্তু বড়োতরফ কি এত সহজে হারবেন? হেসে হেসে বলেন, তবে যে শুনছিলাম গাড়ি নাকি চাকায় চলে না। নাকি লরিতে টেনে এনেছে। লরি ভাড়া নাকি তিনশো টাকা। এ সব তাহলে সত্যি নয়?
ভ্যাবলা তেমনি টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, সবই সত্যি। তবে কিনা যে আপনার খবর সাপ্লায়ার সেএখনও কলকাতার হালের হালচালের খবর রাখে না দাদু-রাজা!
মানে মানে?
বড়োতরফ ছড়িটাকে বাড়িয়ে প্রায় ভ্যাবলার নাকের আগায় ঠেকান।
ভ্যাবলা কৌশলে নাক সামলে মাথা পিছু হটিয়ে বলে, নতুন গাড়িকে চাকায় চালিয়ে আনার ফ্যাশান আর এখন নেই ক্যালকাটায়।
বড়োতরফের হাতের ছড়িটা ঝুলে পড়ে!
গলার স্বরও। বলেন, তাই নাকি?
তবে? আনকোরা নতুনের কদর সব জিনিসেই। দেখুন না কেন, নতুন জুতো দোকান থেকে আনবার সময় বুকে এনে বিছানায় রাখি না? অথচ একদিন পরেই? পায়ের তলা থেকে সিঁড়ির তলা। গাড়িই বা প্রথম দিন খাটবে কেন? কাল দেখবেন কতটা অশ্বশক্তি।
বড়ো সিংহরায় একটু দমে গিয়ে হঠাৎ বসিরকে ধমকে বলে ওঠেন, এই হতভাগা, বাড়ি ফিরতে হবে না? রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে কী তামাশা দেখা হচ্ছে? ঘোড়া দুটোকে আস্তাবলে পোরার পর চাবুকটা আমার হাতে দিস দিকিনি।
বসির তাড়াতাড়ি বলে, আপনি আবার এই ধুলোমাখা চাবুকে হাত কেন দেবেন হুজুর? এই আমি নিজেই সাত ঘা চাবুক খাচ্ছি।
বসির চাবুকটা তুলে নিজের গায়ে একবার বুলিয়ে নিয়ে হাঁক পাড়ে, এই এক—
বসির, খবরদার! তার মানে হাতের সুখটা নিজেই করে নিবি? আমায় করতে দিবি না? রাখ চাবুক।
বাড়ি ফিরে ভয়ানক যন্ত্রণা, প্রায় যমযন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকে বড়োতরফ।
তাঁর ভাগনেকে তো বলে দেওয়া হয়নি, কলকাতার হালের হাল ফ্যাশনটা কী জেনে আসতে। বড়োতরফের জুড়ি গাড়ি চোখ ছাড়া হতে ছোটোতরফ বলেন, তোর তো খুব প্রত্যুৎপন্নপ্রতিত্ব ভ্যাবলা!
ভ্যাবলা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, আমার কী?
আহা প্রত্যুৎপন্নপ্রতিত্ব জানিস না বুঝি? জানবি কোথা থেকে? ভূধর পন্ডিতের কাছে তো পড়িসনি কখনো! পড়লে জানতিস শুদ্ধভাষা কাকে বলে। বলি—মানে বলতে পারবি—‘তপ্ত তৈলে বার্তাকুবৎ।’ …বানান করতে পারবি, ‘হুংকারিল কুম্বকর্ণ করঞ্জাক্ষ মেলি। …পারতে হয় না চাঁদু। …মুখস্থ কর দিকি— ভর্জিত মদগুর মৎস্য নাড়ে না মস্তক। তিন্তিড়ির শীর্ষশাকে ওঠে নাকো বক।’ ওসব তোদের এই ভেজাল খাওয়া দাঁতে হবে না ভ্যাবলা, সব ক-টা দাঁত পড়ে যাবে। আমাদের ছিল দুধ ঘির শরীর।
সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি রাজা মামা! যাক বড়ো রাজামশাইকে খুব দম খাইয়ে দিয়েছি কী বল?
ছোটোতরফ চিন্তিতভাবে বলেন, সেনা হয় আজ এই প্রতিত্বর কায়দায় খাওয়ালি, কিন্তু এরপর? খুব তো বড়োগলায় বলে দিলি, কাল দেখবেন। তা কাল গাড়ি চলবে তো?
ভ্যাবলা তার চকরাবকরা শার্টের ঝোলা কলারটা গলায় টেনে তুলে ববকরাচুলে একবার হাত বুলিয়ে আত্মস্থ গলায় বলে, কাল বড়ো রাজামশাই দেখতে আসবেই না।
তারমানে? কেন? কেন?
দেখো কাল।
ছোটোতরফ রেগে উঠে বলেন, সব্বাইকে যে তুই কাল দেখাচ্ছিস দেখছি।
ওই তো!
ভ্যাবলা বলে, এখন গ্যারেজটার কথা হয়ে যাক।
গ্যারেজের আবার অভাব?
শিবেশ্বর সিংহরায় বলেন, ঠাকুরদাদের আমলে গোরু ছিল শত খানেক, এখন ঠেকেছে দশটায়, শূন্য গোয়ালগুলো তো পড়েই আছে খাঁ খাঁ করা প্রাণ নিয়ে, ওতেই—
গোয়ালে? শূন্য গোয়ালে? হা হা হা! ভ্যাবলার হাসি আর থামে না।
বলো কী মামা, কলকাতায় এ কথা চাওর হলে, কলকাতার লোক এসে এই কালীগঞ্জে ভেঙে পড়বে সং দেখতে।
ছোটতরফ রেগে উঠে বলেন, তা চাউরই বা হতে যাবে কেন? করলে তুইই চাউর করবি। ভ্যাবলা বিজ্ঞহাসি হেসে বলে, ও তোমার ডেকে হেঁকে চাওর করতে হয় না মামা, বাতাসে খবর রটে। এই যে তুমি মোটর গাড়ি কিনলে, এ খবর কলকাতায় রাষ্ট্র হল কী করে? আমি তো খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিতে যাইনি?
শিবেশ্বরের মুখ আহ্লাদে জ্বলজ্বলিয়ে ওঠে, রাষ্ট্র হয়ে গেছে? সত্যি বলছিস?
ভ্যাবলা বুকটান করে বলে, ভ্যাবলা কখনো মিথ্যে ছাড়া সত্যি বলে না মামা!
শিবেবশ্বাস বিগলিত গলায় বলেন, তা ঠিক তা ঠিক। কিন্তু পরক্ষণেই হঠাৎ চমকে উঠে বলেন, কথাটা তুই কী বললি ভ্যাবলা? কী ছাড়া কী বলিস না।
ভ্যাবলা কখনো এক কথা দুবার বলে না মামা, যা বুঝেছ তাই ঠিক।
বলে ভ্যাবলা প্যান্টের পকেট থেকে চিরুনি বার করে খ্যাস খ্যাস করে চুল আঁচড়াতে লাগল।
শিবেশ্বর সেই দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যান, চিরুনি পকেটে নিয়ে বেড়াস তুই ভ্যাবলা? শুনে ভ্যাবলা যেন আকাশ থেকে পড়ে। বল কী রাজামামা, এ দৃশ্য দেখনি কখনো? শিবেশ্বর আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, কস্মিনকালেও না।
আশ্চর্য। কলকাতায় তো ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, পুরুষ সবারই পকেটে পকেটে চিরুনি। আহা কলকাতায় তো গেলে না কখনো! সেযাক, জমির তোমার অভাব নেই, মিস্ত্রি মজুর ডেকে কাজে লাগিয়ে দাও। লোকে দেখে যাতে বলতে পারে, হ্যাঁ গ্যারেজ বটে একখানা!
তবে? দিকে দিকে লোক বেরোল মিস্ত্রি মজুর ডেকে আনতে, ইট কাঠ সংগ্রহ করতে।
ওদিকে বড়োতরফের এদিক থেকে গিয়ে পর্যন্ত মনে সুখ নেই। এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল ছোটোতরফ। জানছেন তো সবই গাড়ি তো বটে, আবার গ্যারেজ। যেন চাঁদের ওপর চুড়ো। নৈবিদ্যির ওপর মন্ডা!
ভ্যাবলা বলেছে, কাল দেখবেন। এদিকে আজ যে এক দারুণ ভাবনায় বড়োতরফের খেয়ে হজম নেই,শুয়ে ঘুম নেই। কলকাতার লেটেস্টো ফ্যাশানটা যদি জেনে না আসে ভাগনেটা?… তা হলে তো দাঁড়িয়ে অপমান।
বড়োতরফের গিন্নি বলেন, তুমি সারাদিন অমন হাঁসফাঁস করছ কেন বলোতো? শরীর খারাপ নয়তো?
শরীর খারাপ শত্রুর হোক। বড়োতরফ পায়চারি করতে করতে বলেন, আমার এখন ভাবনা হচ্ছে হতভাগা বাউণ্ডুলে হয়তো গাড়ি কিনে সেটাকে চাকায় চালিয়েই নিয়ে আসবে।
ওমা! চারুলতা গালে হাত দেন, হতভাগা বাউণ্ডুলে আবার কে?
কেন? জানো না? তোমার আদরের ভাগনেটি।
রক্ষে মধুসূদন, সেআবার আমার আদরের হতে গেল কবে? তুমিই তাকে খুঁজে পেতে নিয়ে এলে—
বড়োতরফ রেগে উঠে বলেন, আর তোমার কাছে পশমের আসনে বসে আলুর দম, রাধবল্লভি, কাঁচাগোল্লা, ক্ষীরমোহন খেয়ে যায়নি?
তা খাবে না কেন? ভাগনে সম্পর্ক যত্ন না করলে হয়? কথায় বলে, ‘‘জন জামাই ভাগনা তিন হয় না আপনা।’’ তা তোমার ছটফটানিটা কীসের?
ছটফটানিটা কীসের? বলি সেব্যাটা যদি গাড়িটা কিনে চাকায় চালিয়ে নিয়ে আসে? যদি তার ড্রাইভারের আমাশা না হয়।
শুনে চারুলতা তো আর নেই।
আর তিনি কিছু রাজামশাই বলে সমীহও করেন না। বলে ওঠেন, কী আবোল তাবোল বকছ? গাড়ি চাকায় চালিয়ে আনবে না তো কি মাথায় করে নিয়ে আসবে?
বড়োতরফ গম্ভীরভাবে বলেন, দেখো যা জানো না তা নিয়ে তর্ক করতে এসো না। হালের কলকাতার লেটেস্টো ফ্যাশান জানো তুমি? নতুন গাড়ি কিনে চাকায় চালিয়ে আনা নিয়ম নয়। ছোটোতরফের গাড়িকে তার ভাগনে লরি দিয়ে টেনে আনিয়েছে—
বড়োতরফ গিন্নি মুচকি হেসে বলেন, তাই বুঝি? তা হলে তোমার ভাগনে গোরুর গাড়ি দিয়ে টানিয়ে আনবে।
বড়োতরফের মুখে হঠাৎ একটু আশার আলো জ্বলে ওঠে। ব্যগ্র হয়ে বলেন, তাই বলছ?
বলবই তো। ওর ভাগনের থেকে তোমার ভাগনে অনেক বেশি ওস্তাদ।
ওদিকে ভ্যাবলা দুপুরের গাড়িতে কলকাতা চলে গেছে।
ছোটোতরফ বলেছিলেন, আবার তোর কী কাজ সেখানে?
ভ্যাবলা একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলে, আছে কাজ। বাকিটা ভাঙে না।
ভাগনে ভাগনে মাসতুতো ভাই। ভ্যাবলা মনে মনে পরবর্তী নাটকের খসড়া ভাঁজে।
একদিন যায়, দুদিন যায়, ভ্যাবলার পাত্তা নেই। ওদিকে বড়োতরফের হাওয়াগাড়ির খবরও হাওয়ায়। বড়োতরফ মা কালীর কাছে গিয়ে পড়েন, মা গো, ছেলেটা হালের খবর না জেনে শুনে গাড়িটাকে চাকায় চালিয়ে আনতে আনতে নিজেই চাকার তলায় পড়ে যায়নি তো? হেই মা, আমার জন্যে ওর অ্যাকসিডেন্টো হল না তো?
মা অবশ্য কথা বলেন না। এত কাতর প্রশ্নেও না। বললে রক্ষে ছিল? যে প্রশ্ন করছে সেলাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটে পালিয়ে নিজেই হাত পা ভাঙত না?
তিনদিন পরে চারদিনের দিন ভ্যাবলা এল।
শিবেশ্বর তেড়ে এলেন, ‘অ্যাতো দিন তুই ছিলি কোথায়? এই আসি বলে গিয়ে এত দেরি! তোর না সেই পরদিন বড়ো হুজুরকে মোটর গাড়ির ঘোড়ার না গাধার কীসের শক্তি দেখাবার কথা ছিল?
ছিল। আছে।
ভ্যাবলা এবারে একটা নামাবলির লং পাঞ্জাবি করিয়ে পরে এসেছে, সেটাকে টান টান করে বলে আমি মামা ভদ্রলোক। আমার এক কথা। বলেছি কাল দেখাব তাই দেখাব।
ওদিকে বড়োতরফ যখন হালের কলকাতায় হালচাল ছেড়ে গাড়ির ব্যাপারেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন সাধন এসে হাঁপাতে হাঁপাতে খবর দিল, হুজুর, ভাগনে দাদাবাবু গাড়ি আনতেছে। কাছারি বাড়িতে খবর পাইঠেছে।
বড়োতরফ ছিটকে উঠে বলেন, কীভাবে আসছে? ড্রাইভারে চালিয়ে নিয়ে আসছে?
সাধন ভয়ে মাথা চুলকে বলে, আজ্ঞে সেকথাটি তো শুনলাম না। …কে যেন বলল— গাড়ির হাত পা শিরদাঁড়া পাঁজর সব আলাদা বাকসোয় প্যাক করে আসছে। সঙ্গে গাড়ির সার্জন সাহেব আসছে, এখেনে বসে ওগুলো জুড়ে জুড়ে গাড়িকে খাড়া করবে।
বড়োতরফ থতোমতো খেয়ে বলেন, তাই নাকি? এটাই বুঝি হালের ফ্যাশান?
সাধন বলে, তা তো জানি নে হুজুর! তা বলছিলাম কী, এক বোঝা হাড়জোড়া গাছের ডাল মজুত রাখব? দেখেছি তো পেত্যক্ষ ও একেবারে অব্যর্থ। সায়েব ডাকতার কোথায় লাগে।
বলছিস?
বলছি তো।
তবে রাখগে যা, তাই রাখগে যা।
ওদিকে ছোটোতরফ বলেন, ভ্যাবলা কী শুনছি? বড়োতরফের ভাগনে নাকি— যে ফ্যাশান কলকাতায় আসছে বছর চলবে, সেই ফ্যাশান আজ এনে হাজির করছে এই কালীগঞ্জে?
ভ্যাবলা গম্ভীরউদাস গলায় বলে, ওর মামা টাকা ছেড়েছে, তাই হয়েছে।
ছোটোতরফ বসে পড়েন।
কে যে হাতুড়ি মারল তাঁর মাথায়। আহত গলায় বলেন, এই কথা শোনালি তুই আমায় ভ্যাবলা? আমি বলেছিলাম টাকা দেব না?
বলোনি বটে। তবে বলেছিলে তো টাকার অনটন। তালপুকুরে ঘটি ডোবে না।
তা সেটা তো মিথ্যে নয় ভ্যাবলা!
ভ্যাবলা আরও গম্ভীর হয়। জামাটা আরও টান টান করে দাঁড়ায়। নামাবলির পাঞ্জাবির গায়ে ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ’ ছাপগুলো চোস্ত হয়ে ফুটে ওঠে।
ভ্যাবলা বলে, তোমাদের হচ্ছে মামা, ঘর থাকতে বাবুই ভিজে। লক্ষ্মী হয়ে ভিক্ষে মাগা…
তার মানে? তার মানে?
তার মানে? ভ্যাবলা দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে, মানেটা মা গঞ্জের কালীর কাছে।
বলব মামা সব বলব। আগে মন্ত্রণা-সভার কাজটা হোক। পার্টনারের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে হবে না?
একটু খুলে বল না বাবা!
তা মন্ত্রণার উপযুক্ত জায়গাটি বটে। চারিদিকে এত আগাছার জঙ্গল যে, নিবিড় অরণ্যই বলা যায়। যেন ঠাকুরমার রূপকথার গল্পের ‘অজগর বিজবন’।
মা কালীর মন্দিরের পেছন দিকে অনে-কখানি জায়গা জুড়ে এই অজগর জঙ্গল। লোকে চিরকাল বলে আসছে, ওখানে নাকি মায়ের ডাকিনী-যোগিনীর আড্ডা। তারা নাকি অমাবস্যার রাত্রে খলখলিয়ে হাসে। খোনা খোনা সুরে গান গায়, আর ধেইধেই নেত্য করে মা কালীর পুরোনো হয়ে যাওয়া বাতিল মুক্তমালাগুলো নিয়ে গলায় পরে সেজে হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি মেরে খেলা করে।
কে আর তবে সেখানে যাবে বল? যাওয়া ছেড়ে সেদিক দিয়েই হাঁটে না। ওই জঙ্গলটার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার পথে পার হয়ে ইস্টিশানে যেতে পাঁচ সাত মিনিট, তবু সবাই বড়োরাস্তা ঘুরে আধঘণ্টায় ইস্টিশানে পৌঁছোয়।
কাঠকুড়ুনিটা পর্যন্ত কাঠ কুড়োতে যায় না ওখানে। তাহলেই বোঝো… ওরা তো বাঘের জঙ্গলে সাপের গর্তে পর্যন্ত উঁকি মারে।
তা বলে ডাকিনী যোগিনী। বাবা!
ছোটোছেলেরা বল কুড়োতেও যায় না। মন্দিরের এধারে মাঠে বলটল খেলত ডাকাবুকো ছেলেরা।
কিন্তু ছিটকে যদি ওই জঙ্গলের দিকে চলে যায়? না বাবা আর সেবলের মায়া নয়।
তবে ওই যা—
কুমন্ত্রণা করতে হলে জায়গাটা আদর্শ।
চোরেরা আসে।
ওরমধ্যে ঢুকে পড়ে চৌকিদারের হাত এড়ায়, আর চোরাই মাল ভাগযোগ করে। এই পৃথিবীতে চোরেরাই সব থেকে নির্ভীক। ওদের ভূতের ভয় নেই, সাপখোপের ভয় নেই, ছাত থেকে পাঁচিল থেকে পড়ে হাড়গোড় ভাঙবার ভয় নেই, কাঁচা নর্দমায় নেমে গা-ঢাকা দিতে ভয় নেই, ধেড়ে ইঁদুরের ভয় নেই, আর রোগ-অসুখের ভয় তো নেই-ই।
তা ছাড়া ভয়ের সেরা ভয় পুলিশের ভয়? সেও তো নেই। থাকলে কি আর পৃথিবীতে এত চুরি হয়?
সেই ডাকিনীর বনের মধ্যে ভরদুপুরে দুটো ছেলে মন্ত্রণা করতে ঢুকেছে। শুধু মন্ত্রণা বলত মন্ত্রণা, কুমন্ত্রণা বলত কুমন্ত্রণা!
ভরদুপুর বটে, তবে জঙ্গলের একেবারে মধ্যিখানে প্রায় রাতের অন্ধকার। কাঁটাগাছ ঠেলে ঠেলে শুকনো লতাপাতা সরিয়ে ঢুকছে যে কী করে তা ওরাই জানে। আর বেরোবে যে কী করে তা ওদের ভগবানই জানেন।
ওদের সাজসজ্জা যে কেমন তা বোঝার জো নেই, গাছের পাতার ফাঁকফন্দি দিয়ে একটু আধটু যে আলোর ঝিলিক মারছে বাতাসে ডালপালা দোলার সময়, তাতেই শুধু বোঝা যাচ্ছে ওরা দুটো প্রায় একই বয়সের ছেলে।
কথা কইছে ফিসফিসিয়ে, তাই গলা বোঝা যাচ্ছে না। যদিও এখানে ফিসফিসানির দরকার ছিল না, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না।
ঢোকবার আগে অবশ্য সাহস করতে হয়েছে, অনেক সাহস।
একজন প্ররোচনা দিয়েছে তো অন্যজন ভয় খাচ্ছে।
কথাবার্তাগুলো এইরকম হয়েছে : –
বলছিস তো? কিন্তু ডাকিনী যোগিনী?
আহা তারা তো অমাবস্যের রাত্তিরে আসে।
আজ কী?
আজ তো পূর্ণিমে। পূর্ণিমের দুপুর।
আর যদি বাঘ বেরোয়?
বাঘ বেরোবার আগে দূর থেকে গন্ধ বেরোয়। বাঘ বাঘ গন্ধ। তখন গাছে চড়ে বসলেই হবে।
ও বাবা, আমি তো গাছে চড়তে পারি না।
প্রাণের দায়ে পেরে যাবি। প্রাণভয়ে লোকে যে কী পারে আর কী না পারে!
শেয়ালও তো আছে?
আঃ এ তো ভালো জ্বালা করল! এত কলকাত্তাই হওয়া ভালো নয় রে! তা বলতে গেলে কলকাতায়ও তো শেয়াল থাকে। খাস কলকাতা যোধপুর পার্ক, নিউ আলিপুর, দেখগে যা। অবিশ্যি দেখতে হলে সেখানে রাত্তিরে গিয়ে শুতে হবে। তা মাসিপিসি কাকা মামা কেউ কি আর নেই ওসব জায়গায়? শুয়ে দেখিস, রাত বারোটা বাজলেই কেমন হুক্কা-হুয়া রব ওঠে। তবে এখানে শেয়াল বিস্তর আছে।
তাহলে? আমার ভাই দারুণ ভয় করছে।
না:। তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। কুকুর শেয়াল হল জগতের সবচেয়ে হ্যানস্তার জিনিস, তাদেরও যদি ভয় করতে হয়—
আর আর— মানে মা কালী?
মা কালী? কী মা কালী?
মানে মা কালী যদি রাগ করেন?
এই দেখো। মা কালী কেন রাগ করতে যাবেন। বরং আমাদের মতন দুটো ছোটোছেলের সাহস দেখে খুশিই হবেন। মা কালী হচ্ছেন সাহসের দেবতা।
সাহসের দেবতা? কে বললে?
দুর বুদ্ধু। তুই আমার থেকে বয়সে বড়ো হলে কী হবে, নেহাত বাচ্চা! বলবে আবার কে? দেখতে পাস না, লোকে বিপদে পড়লে, ভয় পেলে বলে, হে মা কালী, রক্ষে করো। এই যে ডাকাতরা? ওদের অত সাহস কীসে? মা কালীর বরপুত্তুর বলেই তো?
তাহলে বলছিস যাব?
বলছি আবার কী? যাচ্ছি তো। এই দেখ চললাম। তবে সাবধান, কেউ যেন দেখতে না পায় যে আমরা ডাকিনীর বনে ঢুকছি।
ভরদুপুর, কেউ কোথাও নেই, রোদে মাথা ফাটছে, কে আর বেরিয়েছে পথে?
তবু ছাগল চরানো বুড়া নিমাইয়ের মার ঘোলা ঘোলা চোখের জ্যোতি মন্দ নয়। সেডাক দিয়ে বলে, ওদিকে যাচ্ছ কেন গো বাবাধনেরা?
ওরে বাবা! এই ডাকিনী নয় তো? একজন আর একজনের কবজি টিপে ধরে। এ কে রে?
আরে ও তো নিমাইয়ের মা। ছাগলের দুধ বেচে। তাই ছাগল চরাতে আসে। তুই বুঝি এর আগে কখনো কালীগঞ্জে আসিসনি?
না।
তুই এত ভীতু কেন? তুই না দর্জিপাড়ার ছেলে? তাহলে বল যে দর্জিপাড়ার কলঙ্ক?
দেখ দর্জিপাড়া তুলিসনি! মেজাজ ফেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। দর্জিপাড়ার ছেলেরা দু-হাতে বোমা নিয়ে লোফালুফি করতে পারে, তা বলে সাপ বাঘ শেয়াল ভোঁদড় ডাকিনী যোগিনী? না বাবা ওসবের মধ্যে নেই।
সবের মধ্যেই থাকতে হবে। নে চল।
বুড়ি আবার জিজ্ঞেস করে, ছেলেরা ওদিক পানে যাচ্ছ কোথায়?
ও একটা ওষুধ আনতে।
কী ওষুধ বাবা?
ও একটা গাছের শেকড়।
কী গাছের বাবা?
জ্বালাতন করিসনে বুড়ি, নাম বললে তুই বুঝবি? ভ্যারেণ্ডা গাছের নাম শুনেছিস?
না বাবা! তা কী অসুখে লাগে?
আঃ এ তো আচ্ছা ছিনেজোঁক! লাগে? আমাশায় লাগে।
অ্যাঁ! আমাশায় লাগে? ও বাবাধনেরা, আমায় এক চিলতে দিয়ে যেয়ো না বাবা! ভুগে ভুগে মরছি। কী করে খেতে হয়? চিবিয়ে না সেদ্ধ করে?
আঃ এ তো আচ্ছা নাছোড়। বেটে, বুঝলি বেটে।
আচ্ছা! বুড়ি বলে, তাহলে দিয়ে যেয়ো বাবা।
দেব কিন্তু কাউকে বলবি না বললে কাজ হবে না।
আচ্ছা বাবা বলব না।
হ্যাঁ মনে থাকে যেন।
মনে আর থাকবে না? যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কীসে সারল? বলবি যে, বলব না। বললে কাজ হবে না।
হ্যাঁ ঠিক।
বুড়ি ছাগল তাড়াতে তাড়াতে এগিয়ে যায়।
উঃ অনেক কষ্টে বুড়ির হাত ছাড়ানো গেছে। এবার চল।
তারপর এই আসা। কাঁটায় গা ছিঁড়ে।
দুজনের ফিসফিস কথা। একজন বলে। দেখতে পাচ্ছিস, এখানে একটা গর্ত। এই গর্তটাই হচ্ছে সুড়ঙ্গ। …এর মধ্যে সিঁড়ি আছে। নেমে গিয়ে সোজা গলিপথ একেবারে মা কালীর মন্দিরের নীচে অবধি।
তুই কী করে জানলি রে ভ্যাবলা?—ভ্যাবলার কাঁধটা খামচে ধরে স্বপন।
আমি? আমি কি আর একদিনে জেনেছি রে স্বপ্নন। দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে যে আসি, সেকি আর শুধুই মামির হাতে সরের নাড়ু খেতে? অভিযান চালিয়ে যাই। তবে কী জানিস? একেবারে একা ভয় করে। ধর যদি সুড়ঙ্গয় ঢুকে হোঁচটাই খেলাম, ধরে তোলবার একটা লোকও তো দরকার তা ছাড়া—
ভ্যাবলার গলা আরও আস্তে হয়ে যায়।
ভ্যাবলার আর স্বপনের মাথা প্রায় ঠোকাঠুকি।
ভ্যাবলা বলে, বড়োতরফের ওই বঙ্কিম বলে চাকরটা? ও আমায় একটু একটু সন্দেহ করে।
ওটাকেই ভয়।
কেন রে, সন্দেহ করে কেন?
কেন কে জানে। এক একজনের না কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি থাকে বুঝলি? তারা মানুষের মধ্যেকার ‘মানুষে’র গন্ধ পায়।
তাহলে তো ওকে খুব সাবধান?
সেআর বলতে!
আচ্ছা ভ্যাবলা, তুই যে আমায় বললি কারখানা টারখানা থেকে কিছু ভাঙা লোহালক্কড় নিয়ে প্যাকিং বাক্সে করে এনে বলব, ‘মামা এই হচ্ছে গাড়ি! পার্টস জুড়ে জুড়ে আস্ত কলেবরখানি হবে। করলাম তো তাই। কিন্তু পরিণামটা কী হবে?
কী হবে দেখতেই পাবি।
আরে বাবা বলই না।
পার্ট আর জুড়তে হবে না, তার আগেই গাড়ি জ্বলবে।
জ্বলবে? জ্বলবে মানে?
আরে সব কথার মানে আর বোঝাতে পারি না তোকে। সময়ে দেখবি।
কিন্তু এই সুড়ঙ্গর মুখটা যে ইটপাটকেল গাছপালায় বোঝাই।
তাই তো হবে। তা নয় তো কি তোর জন্যে কেউ রাস্তা পালিশ করে রেখে দেবে? পাছে কেউ দেখতে পায় বলে, এখানে এক পাহাড় ইট জমিয়ে রেখেছিল। মাঝে মধ্যে এসেছি, আর সরিয়েছি।
ভ্যাবলা! তোর কী সাহস!
এ পৃথিবীতে সাহস ছাড়া কিছু হয় না, বুঝলি?
আচ্ছা আমরা যদি ঢুকে পড়ে আর বেরোতে না পারি ভ্যাবলা?
সব সময় অলক্ষুণে শেয়াল ডাক ডাকিসনে স্বপন। বেরোতেই বা পারব না কেন? স্বপন বলে, ধর যদি ওর মধ্যে বন্ধ বাতাসে গ্যাস থাকে? ধর যদি সিঁড়িটার মাঝখানটা ভাঙা থাকে। ধর যদি ঢোকার পর এ মুখে ইট পাটকেল গড়িয়ে গিয়ে মুখ ঢেকে যায়। ধর যদি—
উঃ!
ভ্যাবলা বলে, তোর মতন অত ‘যদি’ ধরতে পারি না আমি। যাবি কিনা বল?
যাব তো।
স্বপন বলে, তবে কিনা ভাবছি—‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ শাস্ত্রের বচন। একটাই মাত্র প্রাণ তো? মরে গেলে তো আর বাঁচব না।
রিস্ক নিতে হবে।
ভ্যাবলা বীরত্বব্যঞ্জক গলায় বলে, রিস্ক নিতে হবে। তুই জ্বর-বিকারে মরতে পারিস না বিছানায় শুয়ে শুয়ে?
পারি।
নেমন্তন খেয়ে ফুড পয়জন হয়ে মারা যেতে পারিস না?
পারি।
বাড়িতে সিঁড়ি নামতে পা পিছলে পড়ে মাথা ফেটে মরতে পারিস না।
পারব না কেন? সবই পারি।
তবে?
ভ্যাবলা খুক খুক করে হাসে, তা হলে তুই জীবনে সিঁড়ি ওঠা-নামা করবি না? নেমন্তন্ন খাবি না? রাস্তায় বেরুবি না?
স্বপনের হঠাৎ বীরত্ব জেগে ওঠে। জোরগলায় বলে, ঠিক আছে। চল। কিন্তু—
ভ্যাবলা বলে, সেরেছে। আবার কিন্তু? কীসের কিন্তু?
মানে বলছি কী, আগে থেকেই ভাগটা ঠিক হয়ে গেলে ভালো হত না?
ওর আবার ঠিকঠাক কী? আমার বারো আনা, তোর চার আনা।
তার মানে? স্বপন রেগে ওঠে, কেন ? তোর বারো আনা আর আমার চার আনা কেন?
বা:। আমিই পথ দেখিয়ে নিয়ে এলাম না?
আর আমি যে প্রাণ হাতে করে সুড়ঙ্গে নামছি।
বেশ নামিসনি। আমি বঙ্কিমকে নেব। ওকে দু-আনা দিলেই হবে।
তুই বড্ড রাগি ভ্যাবলা। চল বাবা চল। তবে দশ-আনা ছ-আনা করে না হয়।
আচ্ছা ঠিক আছে। আবার বলে বসবি না তো, তোর দশ-আনা আমার ছ-আনা।
দেখ ভ্যাবলা, দর্জিপাড়ার ছেলেরা অত ছোটোলোক হয় না। তাদের যে কথা সেকাজ।
আচ্ছা। বল জয় মা গঞ্জের কালী।
জয় মা গঞ্জের কালী!
জয় বাবা ডাকাত সর্দার সিংহীরায়দের পূর্বপুরুষ!
অত কথা বলতে পারব না ভ্যাবলা! জয় বাবা ডাকাত সর্দার!
জয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর!
জয় হুঁ হুঁ মহেশ্বর।
হুঁ হুঁ মানে?
মানে তুই কী বললি ঠিক বুঝতে পারিনি।
বলেছি ব্রহ্মা বিষ্ণু। কালা নাকি?
ওঃ হোপলেস! জয় তেত্রিশ কোটি দেবতা কি জয়!
জয় তেত্রিশ কোটি কি জয়!
থাক স্বপন, তোকে আর বলতে হবে না। ভ্যাবলা বলে, জয় ডাকিনী-যোগিনী শেয়াল ভাম চামচিকে আরশোলা বাদুড় পেঁচা কি জয়!
এইসবের জয় দিচ্ছিস ভ্যাবলা?
দিচ্ছি। দিতে হবে। কে বলতে পারে ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে কে আছেন আর না আছেন।
তা বটে।
অবশেষে আর একবার দুজনে ‘মা ডাকাতে কালী কি জয়’ বলে আস্তে আস্তে সুড়ঙ্গের মুখে পা ফেলে।
ভ্যাবলা তুই আগে ঢুকছিস যে? আগেভাগে মোহর-টোহর সরাবার মতলব?
বেশ তবে তুই আগে যা।
না বাবা না। তুই বড়ো রাগি ভ্যাবলা!
আর তোর কথা শুনলে মরামানুষেরও রাগ হয়! যা তুই আগে।
না: তুই আগে।
তুই আগে।
তুই আগে।
তার থেকে ঠেসাঠেসি করে দুজনেই একসঙ্গে নামি আয়।
তাই নামে শেষপর্যন্ত।
আসলে ভয় ভয় আছে তো!
এক দুই তিন।
স্বপন, সিঁড়ি পাচ্ছিস?
পাচ্ছি। চার পাঁচ ছয়।
নেমে যায়। দুজনেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
সুড়ঙ্গের মধ্যে চামচিকের উপদ্রব আছে বই কী। ফরর করে মুখের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। মাথার ওপর চক্কর খেতে লাগল।
ভ্যাবলা বলল, একটা খুব ভুল হয়ে গেছে। তোরও মনে করা উচিত ছিল, তোরই ভয় বেশি। একটা টর্চ আনা উচিত ছিল।
সত্যি এটা কেন মনে হয়নি!
ক-টা সিঁড়ি নেমেছি রে আমরা ভ্যাবলা?
গুনিসনি?
না।
আমি গুনেছি। নটা।
আর ক-টা আছে মনে হয়?
বলতে পারছি না। একশো আটটাও হতে পারে।
অ্যাঁ। বলিস কী? তাহলে যে পাতালে চলে যাব।
হতে পারে বলেছি। হয়ে বসে আছে তা বলিনি। যাকগে শোন। আজ এইপর্যন্ত থাক। তুই এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা ইস্টিশানে পৌঁছে যা। কাল ফিরবি টর্চ নিয়ে।
হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাব? মামা ভাবনা করবে না?
করবে। বেশি করে চারটি ক্ষীরের মালপো খাবে। আমার তো হঠাৎ হাওয়া হয়েই যাওয়া পেশা। মামা কি তারজন্যে আহার নিদ্রা ছাড়ে? তা ছাড়া ওনারা যদি কাকা-ভাইপোতে হঠাৎ দাবা নিয়ে বসে তাহলে তুচ্ছ একটা ভাগনে কেন, এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সব হাওয়া হয়ে গেলেও টের পাবে না।
দাবা নিয়ে বসে? ওরা দুজন বিরুদ্ধ পার্টি না?
তাতে কী? বিরুদ্ধ পার্টি বলে দাবা খেলতে পারে না? সেও তো এক প্রকার যুদ্ধই। এ ওকে কাটছে, ও একে কাটছে। এসেছিস যখন অনেক দেখবি।
আচ্ছা তুই তো ছোটোতরফের ভাগনে, তবে বড়োতরফকেও মামা বলিস কেন? ওরা তো খুড়ো-ভাইপো।
তাতে কী! ভাগনে হচ্ছে ভাগনে। পৃথিবীর সবাই তার মামা। অত হিসেব করে চললে তো তোকেও এখন আমার কাকা কী মামা যাহোক একটা ডাকতে হয়! ছেড়ে দে ওসব। আমি জানি—ভাগনেয় ভাগনেয় মাসতুতো ভাই!
আস্তে আস্তে উঠে এসেছে তখন ওরা।
কাল টর্চ নিয়ে আসবে,আবার পরশু হবে অভিযান।
তখন ছোটোতরফ আর বড়োতরফ মাছ ধরতে বসেছিলেন ছিপ নিয়ে।
একজন পুকুরের এ পাড়ের ঘাটে, আর একজন পুকুরের ও পাড়ের ঘাটে। এর কারণ এ পাড়ের ঘাটের মালিক বড়োতরফ, ও পাড়ের হচ্ছেন ছোটোতরফ।
জলের মাঝখানটা তো লাইন দিয়ে ভাগ করা যায় না তাই ঘাট ভাগ।
দৃষ্টি ছিপে আর ফাতনায়, কিন্তু মন পড়ে আছে কে বেশি মাছ ধরে ফেলে।
মাছ অবিশ্যি, ধরা পড়েনি একটাও এখন। অথচ বেলা পড়ে এল।
বড়তরফ হেঁকে বললেন, আর কতক্ষণ পন্ডশ্রম করবি রে ছোটোতরফ?
কথা কয়ো না বড়োতরফ, মাছ পালাবে।
মাছেরা সবাই গভীর জলে। ভারি চালাক হয়ে গেছে। বড়োতরফ বলেন, আগে আগে কত বড়ো বড়ো মাছ ধরেছি, তোর মনে আছে?
ছোটোতরফ বড়শিতে নতুন চার আটকাতে আটকাতে বলেন, মনে আবার থাকবে না কেন? রঘু জেলে জালে মাছ তুলে কানকোয় লম্বা সুতো বেঁধে ওই গাছের গোড়ায় বেঁধে রাখত, আর তুমি সেই মাছ বড়শি বিঁধে খেলিয়ে তুলতে।
কী বললি? রঘু জেলে মাছ ধরে আমায় এগিয়ে দিত?
ছোটোতরফ তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, দিতই তো। রঘুও দিত বংশীও দিত। আর আমায় দিত ভবানী জেলে।
তার মানে তুইও ওই কর্ম করতিস?
তা করব না? আমার কাছেই তোমার শিক্ষা।
আবার গুরুলঘু জ্ঞান না করে কথা ছোটোতরফ?
ছোটতরফ হুইলে সুতো জড়াতে জড়াতে বলেন, যা সত্যি তাই বলছি। সবই আমার দেখাদেখি তোমার। পরপর দেখে যাও। আমার ভাগনে, তোমার ভাগনে। আমার গাড়ি, তোমার গাড়ি—
বড়োতরফ লাফিয়ে ওঠেন, ভালো কথা মনে করিয়ে দিলি ছোটোতরফ, ভাগনে দুটো কই? আজ যে গাড়ি চলার কথা?
ছোটোতরফ মনে মনে প্রমাদ গোনেন।
ওই কথা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যেই তিনি আজ মাছ ধরতে এসেছেন। জানেন তিনি বসলেই বড়োতরফেরও মাছ ধরা পেয়ে যাবে। হয়েছেও তাই।
বড়োতরফ নিজের বাড়ির দোতলায় দক্ষিণের বারান্দা থেকে দেখতে পেলেন শিবেশ্বর ঘাটে বসে ছিপ হাতে। হাতের গোড়ায় চারের পুঁটলি।
দেখামাত্রই চটপট নেমে এলেন। হাঁক পাড়লেন, বঙ্কিম, সাধন, বৈকুন্ঠ গঙ্গা। কোথায় আছিস তোরা? বেঁচে আছিস, না মরে গেছিস?
চারজন চার দিক থেকে ছুটে এল।
আজ্ঞে হুজুর। মরেই গেছি। তবে আপনার—হুকুম হলে জিয়োতেও পারি।
জীয়ো-ও। হুকুম হচ্ছে। বলি এই বড়োতরফের সংসারে একটু কান্ডজ্ঞান নেই? একটু পান্তোভাত নেই? পচা কুচো চিংড়ি নেই? পিঁপড়ের ডিম নেই?
আঁ— আজ্ঞে।
আঁ— আজ্ঞে? একধার থেকে চারটেকে জ্যান্ত পুঁততে ইচ্ছে করছে।
হুজুর, সেটা কী করে হবে? কে কার গোর খুঁড়বে? দু-জন করে করলে ভালো হয় না?
ভালো! ভালো আর রইল কী? বলি ছোটোতরফ যে পুকুরের সব মাছ ধরে ফেলল! আমার ছিপ কই?
আজ্ঞে এই তো।
চারদিক থেকে চারখানা ছিপ এনে হাজির করে।
বীরেশ্বর হাঁকলেন, মহারানি!
চারুলতা ওদিক থেকে বললেন, আমি ঠাকুরের সলতে পাকাচ্ছি।
তা শুধু সলতে পাকালেই হবে? আর ওদিকে ছোটোতরফ পুকুরের সব মাছ তুলে ফর্সা করবে?
ফর্সা অমনি করলেই হুলো?
হয়েছে, আর হল? এই আমি চললাম। আমায় কেউ ডিস্টার্ব করবে না।
ভাগনেটি কোথায়?
বড়োতরফ রেগে বললেন, সেকথা আমায় জিজ্ঞাসা করছ? ভাগনের খবর মামি জানবে না, আমি জানব?
ব্যস সেই নেমেছেন।
এখন পড়ন্ত বেলা, মাছের চিহ্নমাত্রও নেই। তবে এই শান্তি, ছোটোতরফেরও চিহ্ন নেই।
ছোটোতরফ বললেন, আমরা এখানে পড়ে, গাড়ি চলা দেখবে কি রাস্তার বাজে লোকেরা?
আমরা আজ এখানে পড়ে কেন?
কেন তা তুমিই জানো।
শুধু আমি জানি, তুই জানিস না?
অত কথায় কাজ কী বড়োতরফ? দেখি ভাগনে দুটো মামিদের কাছে বসে ক্ষীর মুড়কি সাঁটছে, না ইস্টিশানে গিয়ে কলকাতার টিকিট কাটছে?
গিয়ে দেখেন, দুটো কথাই মিলে যাচ্ছে। ছোটোতরফের ভাগনে ভ্যাবলা মামির কাছে বসে মর্তমান কলা, নতুন গুড়ের মুড়কি, মন্ডা, গরম গরম ক্ষীর দিয়ে মেখে সাঁটছে।
আর বড়োতরফের ভাগনে? গিয়ে দেখেন মহারানি ভাগনের জন্যে কড়াইশুঁটির কচুরি ভেজে বসে আছেন, ভাগনের পাত্তা নেই। কোথায় আর যাবে? কলকাতায় ছাড়া?
তাহলে মিস্ত্রি আনতে গেছে। বললেন, বড়োতরফ, আমায় কাল বলছিল যে বেটাকে এনেছে, সেটা নাকি বিলিতি মডেল গাড়ির পার্ট জুড়তে জানে, জাপানি গাড়ির জানে না।
তোমার গাড়ি জাপানি?
তবে না তো কী? জগতের সেরা জিনিস।
মহারানি বলেন, তবে যে চিরদিন শুনে এসেছি জাপানি মাল সস্তা মাল, টেকসই নয়? বিলিতি মালই ভালো।
বড়োতরফ অগ্রাহ্যের গলায় বলেন, সেকবে শুনেছ? বিলিতি আমলে তো? ওসব হচ্ছে অপপ্রচার।
কী প্রচার? বড়োগিন্নি বলেন।
আহা তুমি ও বুঝবে না। ওর মানে হচ্ছে মিথ্যে-নিন্দে। জাপানি জিনিসের মিথ্যে নিন্দে হত তখন। এখন ওসব মিথ্যের কারবার নেই। যা দেখবে সব সত্যি, যা শুনবে সব সত্যি, যা জানবে সব সত্যি।
ওমা তাই বুঝি? তাহলে সত্যযুগ এসে গেছে?
বড়োতরফ গিন্নি ভারি খুশি হন। ছোটোবেলায় ঠাকুমার মুখে শুনতাম কলিকাল শেষ হলেই আবার সত্যযুগ আসবে।
তা সত্যযুগ এলেও ভাগনে এল না। স্বপন যেন স্বপ্নেই মিলিয়ে গেল।
বড়োতরফ কড়াইশুঁটির কচুরি খেতে খেতে বললেন, কচুরিটা হয়েছিল ভালো। ছেলেটা খেল না।
ছোটোতরফের সেদুঃখ নেই, ছেলেটা বেশ ভালো করেই খেয়ে দেয়ে এসে বলে, রাজামামা, একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে।
ছোটোতরফের চাড়া দেওয়া গোঁফ ঝুলে পড়ল, চোখ কপালে উঠে গেল।
ওই ক্ষীর মুড়কি সেঁটে এসে তারপর তোর সর্বনাশের কথা মনে পড়ল?
খেয়ে দেয়ে জোর করে নিচ্ছিলাম রাজামামা! যাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে পিঠটা নেহাত গুঁড়ো না হয়ে যায়। যা ভুল করেছি—
এলোমেলো কথা বলছিস কেন ভ্যাবলা? আমি ভাগনে ঠেঙাবো। আমি কংস না কালনেমি, না শকুনি? ভাগনে ঠ্যাঙালে হাত কাঁপে তা জানিস?
ভ্যাবলা ভ্যাবলা মার্কা মুখ করে বলে, জানি না তো!
তা জানবে কেন? ঘাড়ে বাবরি রাখতে জানো, গালে জুলপি টানতে জানো, আর শাস্তরের কথা জানো না। দেখ এই পৃথিবীতে মন্দ জ্যাঠা খুড়ো ঢের ছিল, ঢের আছে, মন্দ মেসো পিসেরও অভাব নেই, এমন কী মন্দ বাপও হতে পারে, ধ্রুবর হয়েছিল, পেল্লাদের হয়েছিল, কিন্তু শাস্তরে তাদের নাম উঠেছে? ওঠেনি। কিন্ত ওই মামা তিনটির? চার যুগ ধরে ওই তিন মুখে চুন কালির কথা ভাব। তাবৎ মামাদের ওপর কড়া শাপ, ভাগনে ঠ্যাঙালে হাত কাঁপবে। মামা হওয়া কম জ্বালা নয় রে ভ্যাবলা।
ভ্যাবলা করুণ মুখে বলে, তাইতো দেখছি রাজা মামা। এই যে আমি তোমার সর্বনাশ করে বসে আছি, এতে তো তোমার মাথার রক্ত চড়ে গিয়ে আমায় পিটিয়ে ছাতু করে ফেলতে ইচ্ছে করবে? কিন্তু উপায় নেই। হাত কাঁপার ভয়।
ছোটোতরফ আট আঙুলে আটটা আংটি পরা হাত কপালে চেপে ধরে হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলেন, কিন্তু সর্বনাশটা কী তাই খুলে বল।
বলব মামা?
বলবি না তো কি দগ্ধে মারবি? বল, বলে ফেল।
পেট্রলের টিনটা উলটে গেছে মামা—।
ছোটোতরফ হা হা করে হেসে ওঠেন, এই? ওরজন্যে এত ভয় তোর? কলকাতায় লোক পাঠা, আর দু-টিন কিনে আনুক।
ভ্যাবলার মুখ কাঁচুমাচু।
ভ্যাবলার মাথা চুলকে চুলের কায়দা খারাপ করে ফেলে, ভয় তো তাতে নয় মামা! উলটেছে গ্যারেজের মধ্যে। এদিকে ওইখানেই আমার ইয়ে মানে লাইটারটি পড়ে—
ছোটোতরফ বলেন, কী পড়েছে?
লাইটার। মানে আর কী একটা যন্তর। আপনি আগুন জ্বলে ওঠে। সিগ্রেট খেতে দেশলাই লাগে না।
ছোটোতরফ অবাক হয়ে বলেন, আপনি আগুন জ্বলে ওঠে?
তাইতো। আঙুলে ছুঁতে যা দেরি। এখন ভয় হচ্ছে কখন ফস করে জ্বলে উঠে লঙ্কাকান্ড না বাধায়।
কিন্তু ভ্যাবলা, ও জিনিস তোর কাছে ছিল কেন? তুই খাস ওসব? বিড়ি সিগারেট?
আঃ ছি ছি রাজা মামা! তোমার ভাগনে হয়ে আমি? ও আমি অন্য লোকের দরকারের জন্যে রাখি। পরোপকারী মনটা তো। কিন্তু সেকথা থাক। এখন অগ্নিকান্ড তো ঠেকানো যাবে না মামা, গাড়ি জ্বলবে।
জ্বলবে? বলিস কী? কী সর্বনাশ!
তা সেইটাই তো গোড়ায় বলছিলাম মামা! গাড়ি গেল।
ছোটোতরফ চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, গাড়ি যায় যাক,কিন্তু মান? গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেটাও যে যাবে।
সেটা যাবে না।
ভ্যাবলা আত্মস্থহাসি হেসে, সেআমি ম্যানেজ করে নেব। …গ্যারেজে আমার ইয়েটা রয়েছে। মানে আর কী জুতোটা। ওটা নিয়ে আসি। যদি হঠাৎ জ্বলে ওঠে, ওটাও যাবে।
তা এমনি ভ্যাবলার ভাগ্য, জুতোটা আর আনা হল না।
ভ্যাবলা গ্যারেজে ঢুকতে গিয়েই ‘আগুন আগুন’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আর ছোটোতরফকে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে বাড়ির মধ্যে দোতলার বারান্দায়।
আগুন-আগুন! সাড়া কালীগঞ্জে আগুনের ধোঁয়া।
আগুন! আগুন! আগুন! কালীগঞ্জের আকাশ আগুনে লাল হয়ে উঠেছে।
কোথায় আগুন লাগল? কোনদিকে?
সিংহীরায়েদের রাজপ্রসাদের দিকে না?
সর্বনাশ! সর্বনাশ!
গ্রামের যে যেখানে ছিল, জল নিয়ে ছুটতে শুরু করে দেয়। ঘড়া, বালতি, কলসি, কুঁজো, হাঁড়ি, ডেকচি, গামলা, কাঁসি, কেটলি, সসপ্যান যা হাতের কাছে পাচ্ছে নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে, আর পুকুরে ডুবিয়ে নিয়ে ছুটছে। এমনকী ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত খাবার জলের গেলাস, ঘটি নিয়েই দৌড় দিচ্ছে। পুকুরের জল ফুরিয়ে আসার জোগাড়।
রাজবাড়িতে আগুন লেগেছে এ কী সোজা কথা!
অবশ্য ওই দৌড়োদৌড়ির সঙ্গে চেঁচামেচিও চলছে দারুণ। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছে না, কেউ কারও কথায় কানও দিচ্ছে না। সেই যে কবিতায় আছে, ‘আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান তারই তরে কাড়াকাড়ি—’
এ-ও প্রায় তাই।
আগে কেবা জল ঢালিবেক আহা তারই তরে কাড়াকাড়ি।
অথচ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোটোতরফ পটাপট হাততালি দিচ্ছেন, আর হা হা হা হা হাসছেন। আর তারসঙ্গে ভ্যাবলা কোমরে হাত ঠেকিয়ে পাক দিয়ে দিয়ে নাচছে।
লোকজনকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে ভ্যাবলা,নেভাস না, নেভাস না। রাজা মামার শখ। গাড়ি জ্বালা কেমন দেখতে তাই দেখছেন।
ওদিকে—
বড়োতরফ তখন সবে গড়গড়ার নলটি হাতে নিয়ে মৌজ করে অম্বুরি তামাকটি টানতে শুরু করেছেন। এমন সময় কানে এল এই গোলমাল।
হাঁক পাড়লেন, এই কে, কোথায় আছিস রে?
গোটা তিনেক চাকর একেবারে গরুড়পক্ষীমূর্তিতে এসে দাঁড়াল, ‘কোথায় আর যাব হুজুর, আপনার পাপোশের কাছে ছাড়া?’
বলি গোলমালটি কীসের?
আজ্ঞে ছোটোরাজার গ্যারেজে আগুন লেগেছে। গাড়ি জ্বলছে—
অ্যাঁ।
বড়োতরফের হাত থেকে গড়গড়ার নল খসে পড়ল, পা থেকে হরিণের চামড়ার চটি।
বড়োতরফ চোখ আর ঘুসি পাকিয়ে বললেন, ছোটোরাজার গাড়ি জ্বলছে? আর তোমরা এখানে বসে বসে মজা দেখছ? …জল ঢালতে যাসনি কেন? অ্যাঁ? ঘড়া ঘড়া জল নিয়ে ঢালতে যাসনি ক্যা— নো?
ওরা সবিনয় নিবেদন করল, আজ্ঞে রাজামশাই, মজা তো ছোটোরাজা নিজেও দেখছেন। মামাতে ভাগনেতে হাততালি দিয়ে দিয়ে নেচে নেচে গাড়ি জ্বলা দেখছেন।..যেমন না দেয়ালিতে তুবড়ি জ্বালা দেখেন আপনারা?
বড়োরাজা থমকে গেলেন। বললেন, তার মানে?
মানে টানে জানি না হুজুর, রাজা-রাজড়াদের খেয়ালখুশির মানে বোঝা কি আর আমাদের মতন হেলে চাষাদের কর্মো! তবে শুনছিলাম নাকি আমেরিকা না কোন মুল্লুক থেকে আজই টাটকা এই ফ্যাশানটা এসেছে কলকাতায়। সঙ্গে সঙ্গে ছোটোরাজার ভাগনে ভ্যাবলাবাবু ফ্যাশানটি লুফে নিয়ে দিয়েছেন আগুন লাগিয়ে—
সাধন! বাজে কথা বলছিস, না সত্যি কথা বলছিস?
আজ্ঞে আপনার সামনে বাজে কথা?
সাধন দু-হাতে কান মলে বলে, বিশ্বাস না হয় চলুন আপনার চিলেকোঠার ছাতে, দেখবেন ওনারা মামা-ভাগনে হাততালি দিচ্ছেন কি না।
বড়োতরফ বললেন, তাই তা! এই বুড়ো বয়সে চিলেকোঠার ছাতে? সেই কোনকালে ঘুড়ি ওড়াতে উঠেছি। যাক যেতে যখন হবেই, চল। আমেরিকানরা গাড়ি জ্বালায়?
আজ্ঞে তা আর বলতে। শুনছি সর্বস্ব জ্বালায় ওরা।
মরতে মরতে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে চিলেকোঠায় উঠে বড়োতরফ দেখলেন, ওদের কথা মিথ্যে নয়। সত্যিই ছোটোতরফ উল্লাসে চিৎকার করতে করতে হাততালি দিচ্ছেন, আর ভ্যাবলা ধুনুচি নৃত্যের ভঙ্গিতে একহাত মাথায় আর এক হাত কোমরে দিয়ে পাক খেয়ে খেয়ে নাচছে।
ওদিকে খানিক দূরে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে, আকাশ লালে লাল। আর মাঠে পথে, এখানে সেখানে রাশি রাশি লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে ছবির মতন, ঘড়া-বালতি হাঁড়ি কলসি কুঁজো গেলাস হাতে নিয়ে।
এখন আর গোলমাল নেই, সবাই যেন হাঁ হয়ে গেছে। যেন হাঁ করে দেওয়ালির বাজিই দেখছে।
শুধু ছোটোতরফের দরজায় দাঁড়িয়ে একটা লোক একটা পুরোনোকালের গ্রামোফোনের ঢাউস চোঙ মুখে দিয়ে চেঁচাচ্ছে— খবরদার কেউ আগুনে জল ঢালবে না। ছোটোহুজুর নতুন বিলিতি খেলা দেখছেন। …দেখছে—।
বড়োতরফ বসে পড়লেন, এই, তোরা যে বললি আমেরিকার খেলা?
আজ্ঞে হুজুর, বিলেত আমেরিকা, ও দুই তো একই, একেবারে পাশাপাশি। এই যেমন কালীগঞ্জ আর নবিগঞ্জ! যেন এক মায়ের দুই ছেলে, এক বেঁাটায় দুটি ফুল।
আমার গাড়িটা কোথায়? বজ্রনির্ঘোষে হাঁক দিলেন বড়োতরফ চিলেকোঠা থেকে নেমে এসে।
ওরা মাথা চুলকে বলল, আপনার তো গাড়ি নয় হুজুর, গাড়ির পার্ট!
হোক পার্ট! পার্টে আগুন লাগানো যায় না?
আজ্ঞে তা আবার যায় না? খুব যায়।—আপনার গিয়ে আগুন আর কীসে না লাগানো যায় হুজুর? উচিত মতন তেল থাকলেই হল।
বড়োতরফ আবার গড়গড়ায় নলটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, তেলটা কী? কেরোসিন?
আরে রাম রাম। বিলেত আমেরিকায় ওসব দীনদুঃখী তেলের ব্যাভার আছে নাকি?
পেটরোল হুজুর।
ওঃ। তা আমাদের নেই সেটা?
খুব আছে। গাড়ি চালাবেন বলে ভাগনে দাদাবাবু টিন টিন মজুত করে রেখেছে না?
তা কোথায় ভাগনে দাদাবাবু? হুমকি দিয়ে ওঠেন বড়োতরফ, ছোটোর ভাগনে কোমরে হাত দিয়ে বাউল নাচ নাচবে, আর আমার ভাগনে নো পাত্তা।
আজ্ঞে সকালে তো ছিলেন, দুপুর থেকে যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন—
তা যাবেন বই কী।
বড়োতরফ গড়গড়ার নল আছড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলেন, মামার প্রেস্টিজের বারোটা বাজাতে না পারলে আর ভাগনে কীসের? কেষ্টঠাকুরের আমল থেকেই চলছে এ কান্ড। ঠিক আছে, তোরাই জ্বালাগে যা—
হুজুর। ছোটোতরফের গ্যারেজটা বাড়ি থেকে দূরে, আগুন জ্বলা দেখতে মজা লাগছে, আমাদের ওই পার্টগুলো বাড়ির মধ্যে প্যাক করা বাকসোয়। আগুন লাগলে—
বাকসোগুলো নিয়ে বাইরে বার করো সাধন! তোমাদের বুদ্ধি জোগান দিতে দিতে আমার মগজ ফতুর হয়ে গেল। বাকসোগুলো ওই তুবড়ি পোড়ার মাঠে নিয়ে গিয়ে তেলগুলো ঢেলে দিয়ে দূর থেকে মশাল জ্বেলে দিয়ে পোঁ পোঁ করে চলে আয়। তারপর আমি আছি হাততালি দিতে, আর তোরা আছিস নাচতে।
আ ছি ছি, রাম রাম!
ওরা শিউরে ওঠে, আমরা? আমরা আপনার সামনে নাচব?
বড়োতরফ তাকিয়ায় ঘুসি ঠুকে বলেন, আলবাত নাচবি। আমি হুকুম করলে, আমার সামনে শুধু নাচ কেন, কালোয়াতি গানও গাইতে হবে তোদের।
কালোহাতি গান। ওরা হাত জোড় করে সমস্বরে বলে ওঠে, নাচব হুজুর নাচব। ওই কালোহাতি গানটি গাইতে হুকুম করবেন না আজ্ঞে।
অতঃপর একে একে সেই পার্টসের বাকসোগুলি বার করে ওই চাকর নফরের দল তুবড়ি পোড়ার মাঠে নিয়ে গিয়ে ফেলে।
যে পাটর্সগুলো স্বপন ভাঙা লোহার দোকান থেকে কিনে নিয়ে বাকসে প্যাক করে ফেলেছিল।
প্যাকিং কেসের মধ্যে কী আছে, আর কী না আছে, কে দেখছে?
পেট্রোলের টিনের মধ্যেই বা কী আছে কে জানে।
ওরা ঢালতে ঢালতে বলে, বঙ্কিম, কেরোছিন কেরোছিন গন্ধ কইছে না?
তাইতো রে সাধন! কেরোছিন এনে পেটরোলের দাম গেঁটিয়েছে মামার কাছে। ভ্যাবলা দাদাবাবুর থেকে অনেক বেশি ওস্তাদ আমাদের এই স্বপন দাদাবাবু।
তা তেল তো ঢালা হল, এখন মশালটা জ্বালায় কে?
এরা একে অপরকে প্ররোচনা দেয়, তুই যা না। এতে আর ভয়টা কী? লম্বা ঠ্যাঙার আগায় পলতে জ্বেলে…
ভয় নেই তো তুই যা না। একবার উনুনে আগুন দিতে গিয়ে আমার পিসির যা দুর্দশা হয়েছিল। ঘুঁটে সাজিয়ে তেল ঢেলে দেশলাই কাঠিটি জ্বেলেছে, আর দপ! ব্যস সঙ্গে সঙ্গে পিসির চুল ভুরু মুখ চোখ সব খতম। একেবারে পুড়ে বেগুন পোড়া।
তবু রক্ষে যে গোঁফ দাড়ি ছিল না—
থাম উজবুক। পিসির গোঁফ দাড়ি মানে?
আহা হা ছিল না ভাগ্যি, তাই বলছি। থাকলে কী দুর্ঘটনাই ঘটত?
মেলা কথা থামা। ওদিকে হুজুর বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন!
বঙ্কিমকেই শেষপর্যন্ত এই গুরুভার কাঁধে তুলে নিতে হয়, কারণ সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ।
বাইশ হাত একটা বাঁশ জোগাড় করে তার আগায় ন্যাকড়া জড়িয়ে মশাল বানিয়ে আগুন লাগাতে যায় যায়, এমন সময় বড়োতরফ বারান্দা থেকে ছোটোতরফদের মতোই একটি কুকুর আঁকা মরচে-পড়া চোঙায় মুখে দিয়ে পরিত্রাহি চেঁচান, খবরদার তোরা নয়, আসল লোক এসে গেছে। রাখ আগুন।
সেকালেও তো রেষারেষি ছিল। কর্তারা যখন গ্রামোফোন কিনেছেন দু-তরফেই কিনেছেন!
ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আসল লোক মানে বড়োতরফের ভাগনে।
স্বপন দু-হাতে মামার দু-চটির ধুলো নিয়ে মাথায় থাবড়ে বলে, মামা গো। তোমার কী চৌকস বুদ্ধি। সব রেডি করে রেখেছ—
তা তু—তু— তুমি কোথায় ছিলে শয়তান? ওদের গাড়ি আগে জ্বলে গেল, আর আমরা হাবার মতন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের আগুনে কালীগঞ্জের আকাশ লাল হলে, তবে না মানমর্যাদা বাড়ত?
স্বপন একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলে, রাজা মামা গো, একটু অনুধাবন করে দেখো দেরির কারণটা কী—
কী ধাবন করে দেখব?
অনুধাবন। মানে আর কী ভেবেচিন্তে। বলি, আগুন দিনের আকাশের শোভা, না রাতের আকাশের? দেওয়ালির বাজি রাতে রাতে জ্বালা হয়, না দিনে?
বড়োতরফ ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললেন, তাইতো তাইতো! বুদ্ধি আছে তোর। ওরে কে আছিস, তোদের রানিমাকে বল দাদাবাবুকে পরাত-সাইজ ছানার জিলিপি খাওয়াতে।
কালীগঞ্জের রাতের আকাশ লাল করে বড়োতরফের গাড়ি জ্বলতে থাকে। প্যাকিং বাকসের কাঠগুলো যোগ হেওয়ায় আগুনের বাহার উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে।
এখন আর গ্রামবাসীরা জলের বালতি হাতে ছুটে আসে না, হই চইও করে না, সিনেমা সার্কাস দেখার মতো দূর থেকে দেখে, আর বলে, ‘হ্যাঁ একখানা রাজাই খেলা দেখলাম বটে আজ। খেলার মতন খেলা। সারাজীবন মনে থাকবে।
ছোটোতরফের আগুন তখন নিভে এসেছে।
বড়োতরফের আগুন রাত বারোটা একটা দুটো পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। আশপাশে ঘরবাড়ি গাছপালা কিছুর বালাই নেই যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিপদ ঘটাবে। কাছে থাকার মধ্যে রাজার দিঘি। তা দিঘিতে কি আর আগুন লাগে?
ওদিকে ভ্যাবলা আর স্বপন সরে পড়েছে।
স্বপন নাচতে পারে না। ভারটা বঙ্কিম সাধন এরাই নিয়েছে তখন।
স্বপন রে, কী মার্ভেলাস একখানা প্লানই মাথা থেকে বার করেছিলি! ভ্যাবলা বলে, তুইও রক্ষে পেলি, আমিও রক্ষে পেলাম। নইলে ওই গাড়ির গলতি নিয়ে মামারা আমাদের জ্যান্ত গোর দিত।
স্বপন মিটিমিটি হাসে। এ কী আর ভ্যাবলার মাথা রে?
ওসব বলিসনে স্বপন চটাচটি হয়ে যাবে। এখন বল টর্চ এনেছিস কি না।
এনেছি বলে এনেছি। দু-দুটো এনেছি। তোর একটা,আমার একটা।
এ্যাঁ! সত্যি? স্বপন রে তোর পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে আমার।
নিতে পারিস। সম্পর্কে আমি গুরুজন। তা এখন ওসব ধুলো-ফুলোর ব্যাপার থাক। চল এগিয়ে পড়ি।
এখন? এই রাত্তিরে?
সুড়ঙ্গর আবার দিন রাত্তির কী রে? টর্চ আনা কেন তা হলে? আজই তো সুবিধে, বেশ চারিদিকে আগুনের হই চই, বনের টর্চ নিয়ে ঢুকলে কারুর নজরে পড়বে না।
তবে শুভস্য শীঘ্রম। টর্চ নিয়ে সেই জঙ্গলে চলে যায় ওরা। সুড়ঙ্গের পথ তো জানাই আছে।
এই স্বপন, কী হচ্ছে কী? ভ্যাবলা কাতর আর্তনাদ করে ওঠ, টর্চটা জ্বাল?
আর্তনাদ করা বাড়াবাড়ি হয়নি ভ্যাবলার। কারণ পায়ের নীচে ঠিক পরের ধাপে পদার্পণ করতে সিঁড়ি আছে, না অতল পাতাল , তা বোঝবার উপায় নেই।… গাঢ় অন্ধকার, ঘন অন্ধকার, নিবিড় অন্ধকার, নিকষ অন্ধকার, সূচিভেদ্য অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার অনেকরকম অন্ধকারের নাম শুনেছে ওরা, কিন্তু এই অন্ধকারটাকে যে কোনশ্রেণিতে ফেলা যায় তা ওদের জানা নেই।
এ যেন চাঁই চাঁই কালো পাথরের অন্ধকার। কয়লাখনির মধ্যে কি এরকম অন্ধকার থাকে? হিমালয় পাহাড়ের গুহার মধ্যে?
ভগবান জানেন কার মধ্যে কী থাকে, কোন অন্ধকারকে কোন নামে চিহ্নিত করা হয়, ভ্যাবলার চেঁচিয়ে ওঠাটা বাড়াবাড়ি হয়নি এই হচ্ছে কথা।
কিন্তু স্বপনের ব্যাপারটা কী? ওর হাতেই তো টর্চ। জ্বালছে না কেন? ওর কি তাহলে বেড়ালের মতো অন্ধকারে চোখ জ্বলে? তাই নি:শব্দে যাচ্ছে?
ভ্যাবলা আবার চেঁচিয়ে ওঠে, এই স্বপন , তোর মতলবটা কী? টর্চটা জ্বালছিস না কেন?
স্বপন দাঁতে দাঁত চেপে শীতে কাঁপার মতো বলল, ট-টর্চটা কেমন গড়বড় করছে রে ভ্যাবলা।
অ্যাঁ—অ্যাঁ!
ভ্যাবলার গলা দিয়ে যেন একটা করাত-কাটার শব্দ বেরিয়ে আসে, ন-নতুন টর্চ তোর গড়বড় করছে?
তাই তো দেখছি রে ভ্যাবলা। বোতামটা আটকে গেছে। নড়ছে চড়ছে না।
কই আমায় দে তো দেখি—
তুই কোথায়?
এই তো তিন সিঁড়িতে।
অ্যাঁ তুই এখনও তিন সিঁড়িতে? আমি যে পাঁচ সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে এসেছি রে ভ্যাবলা।
পাঁচ সিঁড়িতে।
তার মানে আর দুটো ধাপ অন্তত পা ফেলতে পারবে, অতল পাতালে পা পড়বে না। তবে পা ফেলল ভ্যাবলা, হাতটা নীচের দিকে বাড়িয়ে বলল, দে।
তোর হাত দেখতে পাচ্ছি নাকি?
হাতটা বাড়িয়ে টর্চটা নিয়ে এদিক ওদিক কর না, হাতে ঠেকবে।
কিছুক্ষণ চেষ্টার পর টর্চটা ভ্যাবলার হাতে ঠেকল, ভ্যাবলা অতিসাবধানে সেটিকে ধরে নিয়ে জ্বালতে চেষ্টা করল। ভেবেছিল ঠিক পেরে যাবে (অন্য কেউ কিছু নিয়ে না পারলে যেমন মনে হয় আর কী) কিন্তু পারল না।
অনেক চেষ্টার পর হতাশ হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কলকাতায় গিয়ে এই টর্চ নিয়ে এলি তুই?
স্বপন দুঃখের গলায় বলে, ভালোই তো আনলাম রে ভ্যাবলা, কপালগুণে বিগড়ে গেল। দেশলাই আছে তোর কাছে?
দেশলাই?
ভ্যাবলা দপ করে জ্বলে ওঠে, (অবশ্য সেজ্বলায় আলো ঠিকরোয় না।) আমার কাছে দেশলাই থাকবে মানে? আমি সিগারেট খাই?
আহা হা তাই কী বলছি? তুই বড্ড রেগে যাস ভ্যাবলা! ধূপকাঠি জ্বালবার জন্যেও তো থাকতে পারে?
তোরও তাহলে কান চুলকোবার জন্য থাকতে পারে।
বেশি তেরিয়া হসনে ভ্যাবলা, পা ফসকে পড়ে যেতে পারিস। পায়ের নীচে পাতাল আছে, না চাতাল আছে ভগবান জানে।
তেরিয়া হতে যাব কেন? ভ্যাবলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, কে জানে নিশ্চিত মৃত্যুর গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি কি না। তুই রাতদুপুরে টেনে আনলি এখানে, আর টর্চটা গড়বড়ালি—
ইচ্ছে করে গড়বড়িয়েছি? তোর মৃত্যুভয় আছে আর আমার নেই? নাকি তোর প্রাণটার প্রাণ, আমারটা কিছু নয়?
তেরিয়া হসনে স্বপন, ভ্যাবলাও বলে, পা পিছলে পড়ে যেতে পারিস।
ইস একটা যদি দেশলাইও থাকত সঙ্গে—বলল স্বপন।
ভ্যাবলা খুব বিজ্ঞের মতো বলল, নেই একরকম ভালোই হয়েছে স্বপন। সুড়ঙ্গটার মধ্যে কতকালের বন্ধ গ্যাস, জ্বলে গিয়ে বিচ্ছিরি কান্ডকারখানা হতে পারে।
দেশলাই জ্বাললে ফস করে গ্যাস জ্বলে!
স্বপন স্বীকার করল কথাটা। বলল, সেটা বলেছিস মিথ্যে নয়! কিন্তু আমরা কি এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালমন্দ করব?
ভ্যাবলা গম্ভীরভাবে বলে, তা কেন? তুই যেমন পা ঘষে ঘষে নেমে যাচ্ছিস যা। আমিও আস্তে আস্তে—
স্বপন চেঁচিয়ে ওঠে, ভ্যাবলা! এই তোর বন্ধুত্ব? মরতে হলে আমিই আগে মরব, কেমন?
ভ্যাবলা উদাস উদাস গলায় বলে, ওঃ তোর মনে এত পাঁচ! আমি কোথায় ভাবলাম, মোহরের ঘড়াটা পেলে তুইই আগে পাবি।
স্বপন যদিও এখন মরণ বাঁচনের মাঝখানে, তবু স্বপন হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, ওঃ তাই বুঝি? এত বন্ধু—।
কথা শেষ করা হয় না, ওই হাসির সঙ্গেই বিরাট একটা আওয়াজ ওঠে, হা হা হা!
ব্যস আর যায় কোথা? স্বপন বলে ওঠে, ভ্যা—বলা—
ভ্যাবলা বলে ওঠে, স্বপ—ন—
সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাবলা স্বপনের ঘাড়ের ওপর পড়ে যায়, এবং দুজনে জড়াতে জড়াতে গড়াতে গড়াতে আঁ আঁ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে পড়তে থাকে। সিঁড়ির মাথা থেকে একটা পিপে গড়িয়ে দিলে যেমন গড়াতে গড়াতে নামতে থাকে ঠিক তেমনি।
ওদিকে অবস্থা এই। গাড়ি পোড়ানোর আমোদ-আহ্লাদ মেটার পর বড়ো ছোটো দু-তরফেরই খেয়াল হল, ভাগনে দুটো নেই। আসল যারা নাটের গুরু।
খোঁজ খোঁজ। না: কোথাও নেই। রাতদুপুরে ট্রেন নেই যে কলকাতায় চলে যাবে। তবে গেল কোথায়?…. আর কিছু নয়, শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র।
সকালবেলা— বড়োতরফ বললেন, রহিম, গাড়ি বার কর।
রাজাবাবুর মোটর আসাপর্যন্ত রহিমের প্রাণে সুখ ছিল না। মোটর চললেই তো রহিম বেকার হয়ে যাবে। তুবড়ি পোড়ার মাঠে গাড়ির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়ে যাওয়ায় রহিম আহ্লাদে আটখানা, আনন্দে উৎফুল্ল। গাড়ির গা—শুনেছে কী ছুটে চলে গেছে।
সেই দশ আঙুলে দশটি আংটি, বুকের পকেটে ঘড়ি, ঘড়ির চেন, পায়ে পাম্পসু, লুটোনো কোঁচা, বড়োতরফ এবাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন, ছোটো, আমার ভাগনেটাকে কোথায় গুম করে রেখেছিস?
ছোটোতরফ তখন সেজেগুজে গোঁফে আতর লাগাচ্ছিলেন, আতরের শিশিটা হাতে নিয়েই জরির নাগরায় পা গলিয়ে এসে চড়া গলায় বললেন, এই কথাটা আমিই তোমায় বলতে যাচ্ছিলাম। বড়োতরফ।
তার মানে?
তার মানে, আমার ভাগনেটাকেও গুম করা হয়েছে।
তার মানে তুই আমায় সন্দেহ করছিস?
তার মানেটা তাই দাঁড়ায় বটে।
ভালো হবে না বলছি ছোটো—
আমিও তো তাই বলছি বড়োতরফ—
তার মানে আমি যা বলব, তুই তাই নকল করবি?
না তার মানেটা হচ্ছে, আমার বলবার কথাটা তুমি আগে ধরে নিয়ে ঝড়ের আগে এঁটো পাতের মতো ছুটছ।
কী? কী বললি?
বড়োতরফ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, গুরুজনকে এইসব কথা বলা? আচ্ছা! দেখাচ্ছি তোকে মজা।
ছোটোতরফ রাগেন না, মুচকি হেসে বলেন, তুমি আর আমায় কী মজা দেখাবে? আমি তোমার নামে পুলিশ কেস করব।
বড়োতরফের চোখ পাথরের মতো হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, পুলিশ কেস করবি? আমার নামে?
বড়োতরফের ভয় দেখে ছোটোতরফের খুব আমোদ লাগল। মহোৎসাহে বললেন, করবই তো। এই তো নালিশ ঠুকতে যাচ্ছি! দারোগাকে বলব, হুজুর, আবার সারের সার সারাৎসার বস্তু ভাগনেখানা চুরি হয়ে গেছে—
বড়োতরফ বরফ মেশানো লেবুর শরবতের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলেন, এত দুর্মতি হয়েছে তোর ছোটো? সত্যিই ছোটো হয়ে গেছিস? একেবারে রামছোটো। সিংহীরায়ের বংশধর হয়ে তুই গিয়ে গবরমেন্টের একটা চাকরকে ‘হুজুর’ বলবি? বলতে লজ্জা হল না তোর? ওই তোর হুজুর যখন রিটায়ার্ট হবে তখন তারসঙ্গে রাস্তার লোকের কী তফাত বল, কোন তফাত আছে?
ছোটোতরফ নিজের অপরাধের গুরুত্ব বুঝেও জোরগলায় বলেন, সিংহীরায়ে সিংহীরায়ে চিরদিনই তো মামলা।
সেআলাদা! সেহচ্ছে বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার মামলা মকদ্দমা নিয়েই কাজ-কারবার। আর এটা কী? ভাগনে চুরির মামলা! ছি ছি! প্রেস্টিজ নেই সিংহীরায়েদের?
ছোটোতরফ নরম হয়ে যান, বলছ?
বলছি।
তার মানে, বলতে চাইছ ভাগনেটাকে হারিয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে বসে থাকি?
ভাগনে তোর একার হারায়নি ছোটো, আমারও হারিয়েছে। খুঁজতে হলে দু-জনে মিলে খুঁজতে হবে।
তাই বলছ?
বলছি।
বড়োতরফ হিরের আংটি পরা আঙুল তুলে গোঁফে চাড়া দিয়ে বলেন, আমার সন্দ হচ্ছে, ছোঁড়া দুটো নিজেরাই গুম হয়েছে। আর একসঙ্গেই হয়েছে।
হুঁ:।
ছোটোতরফ বলে ওঠেন, কী বলো খুড়ো! তোমার এবার মাথার ঘিলু ফিলু সব স্রেফ বনস্পতি হয়ে গেছে। দুটোতে একত্রে গুম হবে মানে? দুটোতে তো আদায় কাঁচকলায়।
বড়োতরফ মৃদু হেসে বলে, ওই বাইরে আদায় কাঁচকলায় দেখায় ছোটো! আমার সন্দ, ভেতরে আঁতাত আছে। নির্ঘাত ওরা কোনো মতলব নিয়ে বেরিয়ে দু-জনে একই কলে পড়ে গেছে। এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ছোটোতরফ খপ করে একটা হাত বাড়িয়ে বড়োতরফের গোঁফের আগায় একটু আতর লাগিয়ে দিয়ে বলেন, আমারও তাই বিশ্বাস।
তবে পাইক-পেয়াদা ছুটুক।
ছুটুক।
ছোটোতরফ গিন্নি সুধাময়ী তাঁর খাসদাসী মোক্ষদাকে ডেকে বললেন, মোক্ষদা, আমার পালকিটাকে ঠিক করে বার করতে বলত!
পালকি! মোক্ষদা গালে হাত দিয়ে বলল, পালকি ঠিক করবে কী গো রানিমা? এ আবার কী দিবাস্বপ্ন!
সুধাময়ী রেগে বললেন, কেন? আমার পালকি ছিল না? বিয়ের সময় শ্বশুর আমাকে ওই স্পেশাল একখানা পালক উপহার দেননি?
মোক্ষদা বলে, তা অবিশ্যি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেতো ঢেঁকিঘরে পড়ে আছে আজ পাঁচ-দশ বছর ঝুলকালিতে ভরতি!
তা ঝুলকালি সাফ করতে পারো না তোমরা? আছ কী করতে? মাছের ল্যাজা দিয়ে ভাত খেতে, পাটি পেড়ে শুতে, আর গন্ধতেল গায়ে মাখতে?
মোক্ষদা বেজার মুখে বলে, তা রাজবাড়িতে এসে রানিমার খাসদাসী হয়ে কাজ করে যদি এটুকু সুখও মেলে, জীবনে ধিক! তবে হুকুম হলে সবই করতে পারি কিন্তু পালকি বেয়ারার কাজ তো করতে পারব না।
কেন সেটা করতে যাবি কেন? বেয়ারারা কি সবকটা একসঙ্গে মরেছে?
আহা হা বালাই ষাট! মরবে কেন? রাজামশাইয়ের সঙ্গে মিশে মিশে আপনারও বচন-বাক্যি খারাপ হয়ে গেছে। বেয়ারাদের তো কোনজন্মে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুধাময়ী আকাশ থেকে পড়েন, কেন? তাদের অপরাধ?
অপরাধ তো ঘোরতর!
মোক্ষদা বলে, আপনারাও তো দরকার হলেই জুড়িগাড়ি চড়েন, পালকি পড়ে থাকে ঢেঁকিশালে, ওই চার-চারটে জোয়ান বেয়ারা শুধু খায় দায় আর ঘুম মারে। রাজামশাইয়ের অসহ্য হল—
সুধাময়ী রেগে বলেন, অমনি অসহ্য হল? কেষ্টর জীব একটা ভালো আশ্রয়ে এসে দুটো খাচ্ছিল-দাচ্ছিল তা সহ্য হল না, কেমন? আমিও দেখাচ্ছি—
মোক্ষদা বলে, যা দেখাবেনে, তা তো এই যাবৎকাল দেখলাম গো রানিমা! কিন্তু এখন শুধোই হঠাৎ পালকির খোঁজ কেন?
সুধাময়ী গলা নামিয়ে বলেন, চুপি চুপি একবার ওবাড়ি যাব। রানিখুড়ির কাছে দরকার। গাড়ি চাইলেই তো এক্ষুনি জানাজানি।
মোক্ষদা আবার গালে হাত দেয়। ওমা এইটুকুর জন্যে আপনাদের গাড়ি পালকি?
তুই বুঝি এসব নতুন দেখছিস মোক্ষদা?
মোক্ষদা গম্ভীরভাবে বলে, তা দেখছি না, তবে একালে এসব হাসির কথা, তাই বলছি। এ বাড়ির রান্নাশালের পিছনের বাগানের দরজা খুললেই তো ওবাড়ির রান্নাশালের পিছনের বাগান। এই বাগানে মনের মতন কাঁচালংকা খুঁজতে তুমি নিত্যি যাচ্ছ—
সুধাময়ী বলেন, ও তুই বুঝবি না।
আর কোনো কথা হওয়ার আগেই বড়োতরফের রানিমার খাসদাসী বিধুমুখী এসে বলে, আপনি একবার উই বাগানের দরজায় দাঁড়ান গে—
ওমা, কেন?
বড়োরানিমা কথা বলবেন। দোরে দেঁইড়ে আছেন।
তার মানে তিনিও চৌকাঠ পার হয়ে এ বাড়ির মাটিতে পা দেবেন না। বিনা নেমন্তন্নে কেউ কারুর বাড়ি যাওয়ার নিয়ম নেই।
ছোটোতরফ গিন্নি ছুটে ছুটে যান, নিজের এলাকায় মাটিতে সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করে বলেন, কী বলছেন রানি খুড়িমা?
বড়ো রানিগিন্নি দাসীদের বলেন, তোরা সব সরে যা, গোপন কথা আছে।
ওরা চলে গেল।
বড়োতরফ গিন্নি বললেন, বলি হ্যাঁগা রানি বউমা, দুটো টাটকা ছেলে অমনি কর্পূর হয়ে উড়ে যাবে?
ছোটোতরফ গিন্নি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, সেই পরামর্শের জন্যেই তো আপনার কাছে যাচ্ছিলাম—
আসছিলে?
হ্যাঁ খুড়িমা! পালকির জন্যে যাওয়া হল না—
বড়োতরফ গিন্নি ধমক দিয়ে ওঠেন, বিপদের সময় অত ভাবলে চলে না। পালকি তো আমিও—সেযাক, বলছি ছেলেটা কি তোমায় কিছু বলে গেছে?
না তো!
আমাকেও না। তোমার কিছু আন্দাজ হয়?
না রানি খুড়িমা!
আমারও না।
তাহলে?
তাহলে আর কী? মা গঞ্জের কালীর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ি গে, মানত-টানত করি গে, যাতে ছেলে দুটো ঘরে ফেরে। ভাগনে বলে কথা। ছিল না তো ছিল না। ক-দিনের জন্যে এসে মায়া বাড়াল, এখন কিনা, দুম করে হারিয়ে গেল।
তাহলে কবে যাওয়া হবে খুড়িমা?
আগামীকালই। বড়োতরফ গিন্নি বলেন, কাল মঙ্গলবার আছে, মা জাগ্রত হন, কালই ভালো।
তবে এই বলে রাখছি রানি বউমা, আমার মানতের থেকে তোমার মানত যেন বেশি ওজনের না হয়।
সুধাময়ী নিশ্বাস ফেলে বলেন, বেশ!
তারপর বলেন, ভ্যাবলাটা সরের নাড়ু বলে বাঁচে না—ক-দিন ধরে সরের নাড়ু আর মুখে করতে পারছি না—
বড়োতরফ গিন্নি ধমকে বলেন, সেআর বেশি কথা কী রানি বউমা, স্বপনকুমার আমার পাকা রুই-এর মুড়িঘণ্ট ভালোবাসে বলে জেলেদের হুকুম করে দিয়েছি পাকা মাছ যেন জালেই না তোলে।
সত্যি। ছেলে দুটোকে কি ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেল?
তাই তো! ভেবে তো কূল পাওয়া যাচ্ছে না। ভূতে না হোক, পরিতেও নিয়ে যেতে পারে। নাকি বাঘেই খেল?
আর তা নয়তো কি সেদিন গাড়ির আগুনে পুড়ে মরে গেল, কেউ দেখল না। কিংবা আগুনের আঁচে গরম লেগে যাওয়ায় দিঘিতে গা ধুতে গিয়েছিল? সাঁতার জানে না বলে ডুবে মরে গেল?
না, তাহলে লাশ ভেসে উঠত। পুরো তিনটি দিন রাত্তির কেটে গেল।
তিন দিন তিন রাত্তির। দিকে দিকে লোক ছোটানো হয়েছে। তারা পথখরচা নিচ্ছে, হোটেল খরচা নিচ্ছে, পান সিগারেট বিড়ির খরচা নিচ্ছে, আর ঘুরে ফিরে এসে হাঁপিয়ে পড়ে বলছে, কোথাও পাওয়া গেল না হুজুর!
বিমর্ষ হয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকেন দু-জনেই।
হাতে ছিপ আছে, পুকুরে মাছ আছে, কাছে চার আছে, মনে সুখ নেই।
হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এল বঙ্কিম, হজুর আমায় সাত ঘা জুতো মারুন।
বড়োতরফ চড়াগলায় বলেন, কেন কী এমন মহৎ কর্মটি করলে তুমি যে, এতবড়ো প্রাইজ?
বঙ্কিম ঢোক গিলল। হুজুর, ছোটো রাজামশাইয়ের—
সামনে বলবি না মানে? এত আসপর্দার কথা কেন—
আজ্ঞে কথাটা ভ্যাবলা দাদাবাবুকে গিয়ে কিনা—
অ্যাঁ অ্যাঁ— ছোটোতরফ হাতের ছিপ জলে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠেন, ভ্যাবলা নেই?
আহা কী মুশকিল। বঙ্কিম হাতজোড় করে বলে, থাকবে না কেন? (মনে মনে বলে থাকবেই বা কেন? সুড়ঙ্গে নামলে মানুষ বাঁচে? আছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে আছে। লাশ আছে।
সুড়ঙ্গর মধ্যে!
শুনে বড়োতরফও হাতের ছিপ ছুড়ে জলে ফেলে দেন। চড়া গলায় বলেন, তার মানে?
মানে, আজ্ঞে সুড়ুঙ্গুর জঙ্গলে সেঁদিয়ে ছিল, সেদিন ওই ছাগলচরানি বুড়িটা নিজের চক্ষে দেখেছে। ও বলছে নির্ঘাত ওই সুড়ুঙ্গুর মধ্যেই—
বড়োতরফ জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, ছোটোতরফ। তোমার ভাগনের অনেক জ্বালাতন সহ্য করা হয়েছে, আর নয়। সুড়ঙ্গের মধ্যে? অ্যাঁ! মা কালীর মোহরে হাত দিতে যাওয়া! এত বড়ো দুঃসাহস। এই আমি বলে রাখছি, গুণ্ডা, লেঠেল, পাইক বরকন্দাজ সবগুলোকে এক ধার থেকে পাঠাব সুড়ঙ্গের মুখ আগলাতে, দেখি কেমন করে তোর এই চক্রাবক্রা জামা পরা লক্ষ্মী-ছাড়া ভাগনেটা সিংহীরায়েদের মুখ থেকে মোহরের ঘড়া নিয়ে যেতে পারে।
অ্যাঁ! ছোটোতরফ ছিটকে উঠলেন, একবোরে সেঁদিয়ে যেতে দেখল? বড়োতরফ! তোমার এই ন্যাকামার্কা ভিজে বেড়াল ভাগনেটা যে মা-কালীর মোহরের ঘড়া নিয়ে ভাগবে, এ হতে দেব না! আমি এই পাঠাচ্ছি পাইক পেয়াদা, লেঠেল, গুণ্ডা, সুড়ঙ্গর মুখ পাহারা দিতে! জয় মা গঞ্জের কালী! মুখ রাখিস মা।
বড়োতরফ হুংকার দিয়ে ওঠেন, মা গঞ্জের কালী— মান রাখিস মা!
ব্যস, রে রে করতে করতে এগিয়ে যায় দু-দলের সৈন্য সামন্ত।
পাইকদের পরনে ছোটো ছোটো খেঁটে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গলায় রুপোর চাকতি পদক লাল সুতোয় বেঁধে ঝোলানো।
হাতে ঢাল আর সড়কি।
লেঠেলদের পরনে লুঙ্গি, মাথায় ইয়া বড়ো পাগড়ি, গায়ে ফতুয়া, হাতে মাথা ছাড়ানো পাকা বাঁশের লাঠি।
বরকন্দাজের হাতে, বেঁটে লাঠি, পরনে লম্বা পায়জামা, গায়ে রঙিন কোর্তা, মাথায় ফেজটুপি। তবে সকলের কিন্তু কাঁধে একখানা করে গামছা আছেই!
আর গুণ্ডাদের? তাদের বিশেষ কোনো সাজ নেই। তারা দলে মিশে আছে বর্ণচোরা হয়ে।
কিন্তু দু-তরফেরই তো সাজসজ্জা একই, বোঝা যাবে কী করে কে কোন দলের? না বুঝে যদি নিজের দলের লোকের মাথায় লাঠি বসায়?
বড়োতরফ বললেন, ছোটো, এর প্রতিকার?
ছোটোতরফ বললেন, আমিও তো তাই ভাবছি—
ওদিকে যে তারা এগিয়ে যাচ্ছে!
রুখতে হবে।
হবে বললেই হবে? ওদের পিছন ছুটবে কে?
বুদ্ধি থাকলে ছুটতে হয় না। ছোটোতরফ গটগট করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন।
বুদ্ধির খোঁটায় ক্রুদ্ধ বড়োতরফ তেড়ে ছাদে উঠে গিয়ে সেই ভাঙা গ্রামোফোনের চোঙাটা মুখে দিয়ে চেঁচান, বড়োতরফের লোকজনেরা তোমরা সবাই যে যার গামছাখানা কোমরে বাঁধো। তোমাদের চিহ্ন… আমি বড়োহুজুর বলছি—
এ দিকে ছোটোতরফও ওই কর্মই করছেন তখন। চোঙায় মুখ দিয়ে বলছেন, তোমরা যে যার গামছাগুলো কোমরে বাঁধো, আমি ছোটোহুজুর বলছি— তোমাদের চিহ্ন কোমরে গামছা।
দু-জনেই দু-জনের চোং-ঘোষণা শুনেছেন, শুনে মাথায় হাত।
নেমে এসে আবার দিঘির ঘাট।
ছোটোতরফ বলেন, এটা কী হল বড়োতরফ?
বড়োতরফ হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, বড্ড যে বুদ্ধির বড়াই করছিলে—
সেযা হোক। কিন্তু এখন উপায়?
উপায় আর কোথায়? বড়োতরফ তাচ্ছিল্যের গলায় বলেন, আর কোনো উপায় নেই। যদুবংশ ধ্বংসের মতন মরবে নিজেরা মারামারি কাটাকাটি করে।
মরবে?
তা মরবেই তো। ও তোর— রাম মারলেও মরা, রাবণে মারলেও মরা, ও নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে মাথাটারই লোকসান। ছেড়ে দে।
বড়োতরফ আর দু-গাছা ছিপ আনতে বললেন, কাছারিবাড়ি থেকে। কাছারিবাড়ির জিনিস দুজনেরই সম্পত্তি। দুজনে দুটো ছিপ নিয়ে বসে পড়েন।
সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে দুটো ছেলে স্রেফ পিন্ডিখেজুরের মতো একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যেখানে গিয়ে ঘষটে পড়ল, সেখানটা হচ্ছে একটা চাতালের মতো। সিঁড়ি থেকে নেমে যেমন হয় আর কী। কিন্তু আশ্চয্যি— সেখানটায় কোথা থেকে যেন সামান্য আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে।…
কে জানে কোনদিকে কীভাবে ফোকর আছে।
তা থাকলেও, এই গভীররাত্রে বাইরেই বা আলো কোথায়?
চোখ খুলেই ওই আলোর আভাস দেখে ভাবতে লেগে গিয়েছিল ভ্যবালা আর স্বপন। প্রথমটা কিছুই পারেনি, এখন ভাবতে পারছে। শুধু বুঝতে পারছে না চোখটা খুলেছে তারা তিনদিন তিন রাত্তির পরে! এখন বাইরে রোদ্দুর গনগন করছে।
ভ্যাবলা বলল কাতর আর্তনাদ করে, উঃ হাড়গোড় আর কিছু আস্ত নেই রে!
এই ভ্যাবলা, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমরা যে গড়াতে গড়াতে পড়ে গেলাম, তারপর কী হল বল তো?
ভ্যাবলা কোমর ধরে হাঁটু টেনে বসবার চেষ্টা করে, বলে, তারপর আবার কী রে বাবা!
এই এক্ষুনিই তো পড়ে গেলাম বলের মতন।
ভ্যাবলা রে, মাথায় গোটা দু-তিন আলু গজিয়েছে, ঝিমঝিম করছে। স্বপন উঠবার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘তুই বলছিস বটে এই পড়লাম, আমার যেন মনে হচ্ছে একশো বছর।… গেল গেল হাঁটুটা গেল, ওরে ভ্যাবলা, কনুইটাও গেল। হাড়ে হাড়ে পাকা ফোড়ার ব্যথা রে বাবা— মনে হচ্ছে একশো বছর ধরে এইভাবে পড়ে আছি।’
ভ্যাবলা অনেক কষ্টে উঠে বসে বলে, মাথায় ধাক্কা লাগলে ওরকম মনে হয়। উঃ, তোর মাথায় গোল আলু আমার মাথাটা চেপটে চাটুর মতন হয়ে গেছে। এই দেখ। দেখছিস ঘাড়ের ওপরটা স্রেফ চিঁড়ে চ্যাপটা। দেখ হাত দিয়ে।
স্বপন অবশ্য দেখে না, কারণ বিশ্বাসই করে না। ঠুকে গেলে মাথা ফুলে যেতে দেখেছে, চেপটে যেতে তো দেখেনি কখনো। স্বপন শুধু একটি বড়োসড়ো নিশ্বাস ফেলে বলে, একেই বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু—
যা বলেছিল! এখন এখান থেকে উঠে বেরিয়ে আবার নর-লোকের মুখ দেখতে পারব, না এখানেই জীবন্ত সমাধি হবে, তা বুঝতে পারছি না।
হাড়ের ব্যথা না কমলে সিঁড়ি দিয়ে উঠব কী করে? ওরে বাবা গেলাম গেলাম। ভগবান রে, তোর মনে এতও ছিল।
ভ্যাবলা আস্তে আস্তে বলে, আচ্ছা স্বপন তুই এখানে আসার আগে রাত্তিরের খাওয়া খেয়েছিলি?
স্বপন তার মাথার তালুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, রোস মনে করি, কেমন যেন বেভুলো হয়ে যাচ্ছি। খেয়েছিলাম কিনা—খেয়েছিলাম কিনা—হ্যাঁ খেয়েছিলাম তো।
কী খেয়েছিলি?
বোধ হয়, বোধ হয়, হ্যাঁ নিশ্চয়, গরম গরম ঢাকাই পরোটা আর পোনা মাছের কালিয়া। ওদিকে তুবড়ি পোড়ার মাঠে আগুন জ্বলছে, এদিকে মামির কাছে বসে পেটের আগুন নিবৃত্তি করছি। কেন, তুই খাসনি?
খেয়েছিলাম রে স্বপন, খুব খেয়েছিলাম। গোবিন্দভোগ চালের ভাত, ভাজা মুগের ডাল, দু-তিন রকম মাছ, আর ভাজাভুজি। তা ছাড়া ঘন দুধের ক্ষীর। রাজবাড়ির ব্যাপার! কিছু না হলেও চর্বচোষ্য। কিন্তু হলে কী হবে, এখন খিদেয় পেটের মধ্যে যেন ইঞ্জিন চলছে।
স্বপন নিশ্বাস ফেলে বলে, আমারও তাই। কিন্তু আশ্চয্যি, এই ক-ঘণ্টার মধ্যেই পেটের অবস্থা এমন কেন বল তো?— যেন সাত-দিন সাত-রাত খাইনি।
গড রে ভগবান রে!
করুণ দীর্ঘ দুটি নিশ্বাস সেই সুড়ঙ্গ গহ্বরে ঘুরপাক খেতে লাগল।
এইভাবে পড়ে থেকে না খেয়ে খেয়ে তিল তিল করে মরতে হবে আমাদের। ভ্যাবলা বলল, আমার মনে হচ্ছে পায়ের হাড় ভেঙে গেছে।
স্বপন বিষণ্ণ গলায় বলল, আমরা যে হারিয়ে গেলাম, আমাদের কেউ খুঁজবে না?
দায় পড়েছে! মা নেই, বাপ নেই, থাকার মধ্যে ওই মামা, তা তাদের তো কম জ্বালাই পোড়াইনি?
সত্যি, মামার অনেক টাকা মেরে দিয়েছি। কাজটা ভালো করিনি!
গুহা গহ্বরে মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত মনে এখন বিবেক কামড় দিতে থাকে। থেকে থেকেই করুণ মন্তব্য করতে থাকে ওরা।
টাকাগুলো তো পোস্ট-অফিসে পড়েই রইল, আমি এখানে পড়ে পড়ে মরব।
আমি তো পোস্ট-অফিসেও রাখিনি, কলকাতায় পিসির বাড়ির ছাদের কার্নিশে একটা পায়রার বাসায় রেখে দিয়েছিলাম।
অ্যাঁ! পায়রার বাসায় টাকা রেখে এসেছিস তুই? পৃথিবীতে আর জায়গা পাসনি?
ভ্যাবলা মলিন গলায় বলে, ভেবেছিলাম গিয়েই নেব। যেখানে সেখানে রাখলে তো লোকে দেখে ফেলবে। আরও কিছু না জমলে তো জীবনের সাধ মিটবে না।
আমারও তাই! তাই সব সাধেরই সমাধি হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ কারও মুখে কথা নেই।
হঠাৎ ভ্যাবলা চেঁচিয়ে ওঠে, স্বপন, রে, পেটের মধ্যে ডাংগুলি খেলছে।
তোর শুধু ডাংগুলি? আমার তো ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, সব খেলাই খেলছে।
ওরে স্বপন, পেটের মধ্যে ছুঁচো ডাকছে—
আমার তো শুয়োর ডাকছে ভ্যাবলা!
ওরে স্বপন, ডাকাডাকির স্টেজ ছাড়িয়ে গিয়ে এখন আমার পেটের মধ্যে বাজনা বাজছে। খোল করতাল বাঁয়া-তবলা! —তোর?
আমার। আমার শুধু ইলেকট্রিক গিটার।
আয় স্বপন, আমরা একটু ভালো কথা কই। মানে, পেটের কথা তো ভুলতে হবে?
ভালো কথা মানে কী রে? সব তো ভুলে যাচ্ছি ভ্যাবলা।
আচ্ছা ধর, টাকা জমিয়ে তুই কী করবি ভেবেছিলি, মানে তোর জীবনের সাধটা কী ছিল?
সাধ? এখন আর বলে কোনো লাভ নেই, তবু খিদে ভুলতেই যখন বলা,বলি— এই পৃথিবীটাকে একবার দেখতে বড্ড বাসনা ছিল। ভূগোলেই শুধু পৃথিবীর খবর পড়েছি। কলকাতা আর এই কালীগঞ্জ ছাড়া আর কোনো দেশ দেখিনি, তাও ওই রাজা মামার দৌলতে। নিজেদের কী আছে বল?
ভ্যাবলা নিশ্বাস ফেলে বলে, তোর সঙ্গে তাই এত মনের মিলরে স্বপন! পৃথিবী ট্রিথিবী না হোক, এই ভারতবর্ষটাই সব দেখতে ইচ্ছে করে।… ফার্স্টক্লাস ট্রেনে গদিদার সিটে বসে চলেছি, এই চা-ওলা ডাকছি, এই খাবার-ওলা ডাকছি, উর্দিপরা বয় এসে ভাত-টাত দিয়ে যাচ্ছে…ভাবতে বসলে নেশা লেগে যায়।
স্বপন বলে,তোর নেশা লাগে? আমার ওসব ভাবতে বসলে খুন চেপে যায়।
আর ভাবাভাবি!
দুজনে সমস্বরে বলে, সব ভাবনার শেষ হয়ে গেছে। এখানেই—
থেমে গেল স্বপন।
চিৎকার করে বলে উঠল, ভ্যাবলা! ওটা কী?
কই? কই? কোনটা?
ওই যে খিলনের নীচেয়—স্বপন ভ্যাবলার কাঁধ খামচে ধরে।
স্বপন! ভ্যাবলা স্বপনের পেট খামচে ধরে, কালো ভূত হয়ে যাওয়া একটা পেতলের ঘড়া না?
পায়ের ব্যথা, কোমরের ব্যথা, ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা, মাথা ঝিমঝিমোনি, সব কিছুই মুহূর্তে হাওয়া, বেমালুম উধাও।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দুজনেই সেই খিলেনের নীচেয় নেমে যায়। চাতালটার ধারেই ওই একটা নীচু খিলেন, কেন কে জানে। তার ওইখানেই কোথায় যেন দেয়ালে ঘুলঘুলি আছে, যা দিয়ে আলো আসছে। জায়গাটা যে কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু পিতলের ঘড়াটি? এটা তো বোঝা যাচ্ছে?
সর্বাঙ্গে পাকা পোড়ার ব্যথাটা যে কোন মন্তরে উপে গেল।
দু-জনেই এখন লাফিয়ে গিয়ে কলসির কানা চেপে ধরেছে।
কী ভারী রে বাবা, নড়ায় কার সাধ্যি!
স্বপন! আমার যে নাচতে ইচ্ছে করছে।
আমার নাচতে, লাফাতে, ছুটতে ডিগবাজি খেতে, অনেকরকম ইচ্ছে করছে রে ভ্যাবলা! কিন্তু ওসব চলবে না। ভগবান মেরেছে।
তাহলে আয় দু-জনে গান গাই।
গান? কী গান গাইব?
যা প্রাণ চায়। এই তো আমি গাইছি—
ভ্যাবলা তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘প্রভু তোমার দয়ার নাহি শেষ’। পরের লাইনটা তুই বানা।
স্বপনও তার থেকে জোরে গেয়ে ওঠে, ‘হাত পা ভাঙুক মাথা ফাটুক, তবু বলি বেশ’।
ভ্যাবলা আবার বলে,
ও প্রভু গড়গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে হয়েছিলাম মড়া।
এখন তোমার দয়ায় পেয়ে গেলাম মোহর ভরতি ঘড়া।
তারপর দু-জনে তারস্বরে গাইতে থাকে—
তাই তো বলি প্রভু, তোমার দয়ার নাহি পার।
এখনই এই মৃত্যুগহ্বর হতে মোদের করো গো উদ্ধার।
এখন আর কারও পেটের মধ্যে ইঞ্জিন চলছে না, ইলেকট্রিট গিটার বাজছে না, ছুঁচো ডাকছে না, শুয়োর নাচছে না। ক্রমশ গান-গাইতে গাইতে ওরা সেই গুঁড়িয়ে যাওয়া হাঁটু কোমর নিয়েও চার-ফুট বাই চার-ফুট জায়গার মধ্যে নাচতেও পারছে।
অনেকক্ষণ নেচে গেয়ে ক্লান্ত হয়ে, ভ্যাবলা স্বপনকে, আর স্বপন ভ্যাবলাকে বলে, আয় ওটাকে যেনতেন করে টেনে নিয়ে ওপরে উঠি।
কিন্তু বেরোবার সময় কেউ যদি দেখতে পায়?
দুর, এই রাত্তিরে কে কোথায় দেখবে?
রাত্তির আর বোধ হয় নাই রে স্বপন! ওই আলোটা নইলে আসছে কেন?
আচ্ছা এইটাই কি মন্দিরের তলা? একেই বলে পাতালঘর?
তাই হবে।
কিন্তু ঘড়া যে নড়ছে না।
দু-জনে প্রাণপণে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে,তবু ঘড়া অটল।
ভ্যাবলা রে, কুলে এসে তরি ডুবল।
স্বপন রে, হাতে পেয়েও ফসলে গেল!
তা ঘড়া নড়ানো যদি সম্ভব না হয় তা হলে ঘড়ার মধ্যে থেকে মালকড়িগুলি বার করে নিলে কেমন হয়?
ভালোই হয়, মানে ভালোই হত, কিন্তু হবে না। ঘড়ার মুখে একটা লোহার ঢাকনি একেবারে সিল করা।
তার মানে ওই ঘড়াটাকেই হিঁচড়ে নাড়িয়ে টেনে ঘষটে নিয়ে যেতে হবে। আর কামানের দোকান থেকে রাংঝাল খুলিয়ে তবে দেখা যাবে ভেতরে কী আছে?
তার মানেই দেশসুদ্ধ লোক জেনে ফেলবে। তার মানেই— যে এল চষে, সেরইল বসে। যারা প্রাণ তুচ্ছ করে এই কান্ড করল, তাদের ভাগ্যে লবডঙ্কা, তাদের ভাগ্যে কচুপোড়া।
সবাই বলবে, উঁহু উঁহু, তোরা ছেলেমানুষ তোরা মোহর-টোহর নিয়ে কী করবি, এ সব হচ্ছে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্যে।
ভ্যাবলা হঠাৎ ডুকরে ওঠে, স্বপন, আমার কান্না পাচ্ছে।
স্বপন গম্ভীরভাবে বলে, আমারও পাচ্ছে, আমি চাপছি। …কিন্তু কোথা থেকে যেন কীসের একটা আওয়াজ আসছে মনে হচ্ছে? যেন সমুদ্দুরে গর্জনের মতন।
তাই তো! কান পাতল দু-জনে।
গর্জন এগিয়ে আসছে। চাপা জায়গায় যেন গুমগুম করছে…
ভ্যাবলা রে। ঘেরাও!
ইঁদুর টিঁদুররা যেমন গর্তের মধ্যে থেকে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে দেখে নেয় বাইরের অবস্থাটা কী, বেরোনো চলে, না সামনে শত্রু, স্বপনও তেমনি ব্যথা হাঁটু টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নাকের ডগাটুকু বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখেই দুদ্দাড়িয়ে নেমে এসে প্রায় আছড়ে পড়ে, সর্বনাশ হয়েছে রে ভ্যাবলা, ঘেরাও!
ঘেরাও!
হ্যাঁ! একেবারে অস্ত্রধারী শত্রুসৈন্য। আর কোনো উপায় নেই রে ভ্যাবলা! এই সুড়ঙ্গের মধ্যে জাঁতিকলে পড়া ইঁদুরের মতন মরতে হবে।
ভ্যাবলা বসে পড়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, শুধু মরতে হবে? মরতে হবে, পড়ে পড়ে পচতে হবে, পচে গলে গন্ধ বেরিয়ে অবশেষে কঙ্কাল হয়ে শুয়ে থাকতে হবে এখানে।
উঁহুহু, অমন করে বলিসনে ভ্যাবলা, শুনে বুক ফেটে যাচ্ছে।
ভ্যাবলা আরও গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, যা সত্যি তাই বলছি। বেরোতে গেলে টুকরো টুকরো হয়ে মরা, আর না বেরোলে পচে পচে মরা। এখন বেছে নাও কোনটা তুমি চাও।
এমনভাবে বলল ভ্যাবলা, যেন দু-হাতে দুটো রসগোল্লা ধরে বলছে, বলো কোনটা চাও।
স্বপন রুক্ষু গলায় বলে, এটা ঠাট্টার সময় নয় ভ্যাবলা।
ভ্যাবলা বলে, এর থেকে ঠাট্টার সময় আর কী আছে বল? মরতে হয় বীরের মতন হাসতে হাসতে মরাই ভালো।
স্বপন গম্ভীরভাবে বলে, মরার কথা না ভেবে এখন বাঁচার কথাটাই ভাবতে হবে।
ভাব। ভাবতে ভাবতে ওরা লাঠি সড়কি, খাঁড়া বল্লম নিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসবে। তারপর বাঁচিস ভালো করে।
ওদিকে সুড়ঙ্গর বাইরে তুমুল কলরোল। যেন দারুণ যুদ্ধ হচ্ছে।
স্বপন কিন্তু ওর কথায় কান না দিয়ে সিঁড়ির দেয়ালে টোকা মেরে দেখছে। লক্ষ করছে কোথা দিয়ে আলো আসছে।
ভ্যাবলা বলে ওঠে, দেখছিস কী?
দেখছি আর কোনো পথ আছে কি না।
আর পথ রাখতে ডাকাতদের দায় পড়েছে।
স্বপন দৃঢ়ভাবে বলে, উঁহু নির্ঘাত আছে। সুড়ঙ্গর নিয়মই হচ্ছে একদিক থেকে ঢুকে আর একদিকে বেরিয়ে যাওয়া। নইলে তো গুহা বলত, সুড়ঙ্গ বলত না।
তবে খোঁজ তুই, আমি এই শুলাম।
এই ভ্যাবলা খবরদার! ঘুমিয়ে পড়লে তোকে ডেকে তোলা আমার কর্ম নয়। শুনেছি, ঘুমোলে তোকে নিয়ে ডাংগুলি খেললেও নাকি ঘুম ভাঙে না তোর।
ভ্যাবলা গম্ভীরভাবে বলে, যে ঘুম জীবনেও ভাঙে না, সেই ঘুমেরই ব্যবস্থা হচ্ছে… শুনতে পাচ্ছিস?
সত্যিই ভয়ানক সেই শব্দটা বেড়েই চলেছে। যেন মরণ-বাঁচন যুদ্ধ চলছে সুড়ঙ্গের মুখে।
তবু ভ্যাবলা হাত পা ছেড়ে শুয়েই পড়ে।
আর স্বপন পাগলের মতো দেয়ালের সর্বত্র টোকা মেরে মেরে ঘুরতে থাকে।
ওদিকে কর্তারা আর পুকুরপাড় ছেড়ে নড়ছেন না। বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেই তো যে যার আলাদা। তখন কথা না কয়ে প্রাণ হাঁপাবে, পেট ফুলবে।
বসে থাকতে থাকতে দু-পক্ষের দুই ভগ্নদূত এসে হাজির।
কালু সর্দার, আর লখাই সর্দার।
ব্যাপার কী?
না দুই তরফের পাইক পেয়াদা সেপাই সান্ত্রিতে দারুণ লড়াই হয়ে গেছে, কেউ কাউকে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে দেয়নি, এখন দু-পক্ষই লড়াই স্থগিত রেখে সুড়ঙ্গের দরজা আগলাচ্ছে।
স্থগিত রেখেছে কেন?
আজ্ঞে দু-চারজনের মাথা ফেটেছে, কারুর নাক-কান উড়ে গেছে।
বড়োতরফ হুংকার দিয়ে বললেন, কোন দলের ক-জনের মাথা ফেটেছে?
ছোটোতরফের ভগ্নদূত নালিশের গলায় বলে ওঠে আজ্ঞে হুজুর আমাদের পাঁচজনের, আপনাদের কুল্লে চারজনের।
বটে!
বড়োতরফ দাঁড়িয়ে উঠে আরও জোরে নিজের দলের লোককে বললেন, ব্যাটা কালু, এতখানি অপমান মাথায় বয়ে এনে তুই ব্যাটা আমার কাছে নাকি কান্না কাঁদতে এসেছিস? ছোটোতরফের পাঁচ-জন আর আমার মাত্তর চার-জন? তার মানে ওর থেকে আমার গুনতিতে কম। চলবে না, এসব চলবে না।
কালু সর্দার থতোমতো খেয়ে বলে, হুজুর! কী বলছেন আজ্ঞে?
যা বলছি ঠিকই বলছি।
বড়োতরফ বলেন, আর কারুর মাথা পর্যন্ত হাত না পৌঁছোয়, তোর ওই হাতের বাঁশখানা নিজের মাথায় বসিয়েই গুনতি সমান করে ফেল হতভাগা ব্যাটা! গুনতির কমতি আমি সহ্য করব না। …ছোটোতরফ বলবে বড়োর লেঠেলরা ভীরু কাপুরুষ, মাথা বাঁচাতে পিছু হটেছে। কী রে ছোটো, বলবি না?
ছোটোতরফ ছিপের সুতো গুটিয়ে নেওয়ার জন্যে হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে অবলীলায় বলেন,
তা বলব বই কী! এখনই বলছি।
কালু দেখলি? …যা বেরো আমার সমুখ থেকে। নিজের না পারিস দলের আর যে কারুর মাথা ফাটিয়ে গুনতি সমান করে তবে আমার সামনে আসবি।
তার যাদের মাথা ফাটল, তাদের কী ব্যবস্থা?
বড়োতরফ ছোটোতরফ একসঙ্গে বলে ওঠেন, তাদের আবার নতুন কী ব্যবস্থা চাই? চিরকাল যা হয়ে আসছে তাই হবে। গোরুর গাড়ি করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে আনবি, যতদিন না সারে তাদের জন্যে ঘি-দুধ-মাছ-মাংস ইত্যাদি করে উত্তম খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবি, আর তাদের স্ত্রী-পুত্র পরিবারের ভরণ-পোষণ করাবি, খরচ-খরচা যা লাগে কাছারি থেকে পাস হবে। তোরা সর্দার, তোদের ওপরই ভার।
কথা শেষ হওয়ার পর বড়োতরফ আর একবার স্মরণ করিয়ে দেন, তবে হ্যাঁ, সদর হাসপাতালে যাবার সময় গুনতিটা ঠিক করে নেওয়া চাই।
কালু সর্দার গজগজ করতে করতে চলে যায়, কিন্তু ছোটোতরফের ভগ্নদূত লখাই সর্দার চলে যায় না। সেফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ছেলে দুটো তা হলে গর্তে পড়েই পচতে থাকবে?
অ্যাঁ! তাই তো! সেকথা তো মনে পড়েনি। আসলেই ভুল। তবে উপায়?
উপায় আর কী, তাদের টেনে বার করে আনান।
কিন্তু কার দলের লোক কাকে আনবে, ঢুকবেই বা কে আগে? দু-দলই তো সুড়ঙ্গর মুখ পাহারা দিচ্ছে।
ছোটোতরফ গম্ভীরভাবে বলেন, আমার বিবেচনায় আপাততত দলাদলিটা ত্যাগ হোক।
বড়োতরফ তড়পে উঠে বলেন, তোমার বিবেচনায়? আর আমার বিবেচনা নেই? এই লখাই, যা কালুর পেছনে ছুটে যা। বলগে যা লড়াই বন্ধ। দলাদলি খতম। ছেলেদুটোকে টেনে বার করে আন। তারপর দেখা যাবে।
লখাই সর্দার মুচকি হেসে বলে, তা হলে কেলোর মাথাটা বাঁচল? আর ফাটিয়ে ফেলতে হবে না?
বড়োতরফ হা হা হা করে হেসে ওঠেন, হতভাগার কথার বাহার দেখো! যেন নারকেল ফাটাচ্ছে—
আজ্ঞে হুজর আমাদের মাথাগুলো তো আপনাদের কাছে বেল-নারকেলের শামিল।
হুঁ, খুব কথা শিখেছিস দেখছি। কালু তোর স্যাঙাত বুঝি?
গরিব মাত্তরই গরিবের স্যাঙাত হুজুর। বলে লখাই খানিকটা এগিয়ে গিয়ে মুখের দু-পাশে হাত আড়াল করে চিৎকার করে, কালু—উ! বলে লড়াই খতম! দলাদলি বন্ধ।
ছেলে দুটো প্রাণে বেঁচে আছে তো ছোটো? বলেন বড়োতরফ।
ছোটো বিষণ্ণ মুখে বলেন, তাই ভাবছি সুড়ঙ্গের মধ্যে সাপ আছে কী ব্যাং আছে, নাকি বন্ধ গ্যাস আছে, কে জানে—!
আচ্ছা— ছোঁড়াদের এ দুর্মতি হল কেন বল দিকি?
মা কালীই জানেন।
যদি ওদের না তুলে ওদের লাশ তোলে রে ছোটো?
ও হো হো, করে কঁদে ওঠেন দুই তরফই।
তাহলে কী হবে ছোটো?
ছোটোতরফ কোঁচার খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, তা হলে দু-জনের নামে দুটো শহিদ-বেদি বানিয়ে দিয়ে শোকসভা করা হবে।
তাই বলছিস।
আর যদি মা-কালীর দয়ায় জ্যান্ত ফেরে?
ছোটোতরফ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, তাহলে উঠোনে দাঁড় করিয়ে উত্তম মধ্যম।
উত্তম-মধ্যম?
তবে না তো কী? তোমার ভাগনেকে তোমার রাজভোগ রসগোল্লা খাওয়াতে সাধ হয় খাইয়ো বড়ো! আমার ভাগনে বেঁচে ফিরলে স্রেফ জলবিছুটি খাবে।
বড়োতরফের মুখটি মলিন দেখায়।
ছোটো যেন তড়পানিতে জিতে যাচ্ছে। আস্তে বলেন, যদি মার খেয়ে মরে যায়?
মরবে না। বলেছি তো, ওরা যা ছেলে, পুকুরের এ পাড়ে পুঁতলে ওপারে গাছ গজাতে পারে।
তা হোক। জলবিছুটিটা এখন থাক।
থাক কেন? সিংহীরায়ের বংশধর যা বলে, তা করে ছাড়ে। একদিকে জলবিছুটি আর একদিকে ইট সুরকি চুন বালি মজুত রেখে বসে থাকব।
ইট সুরকি? সেটা আবার তোর কোন কম্মে লাগবে?
কেন, শহিদ-বেদি গাঁথতে হলে ওসব চাই না?
হুঁ, তাই চাই বটে। তবে মনে রাখিস ছোটো, তোর ভাগনের যদি চুন সুরকির বেদি হয়, তো আমার ভাগনের মার্বেল পাথরের।
ছোটোতরফ এই দুঃখের মধ্যে মুচকি হেসে বলেন, তাহলে জলবিছুটির বদলে?
বড়োতরফ গোঁফটা একটু মোচড়ান, কোঁচাটা একটু ঝাড়েন, তারপর বলেন, তাহলে ঘোড়ার চাবুক, এ তো পড়েই আছে। তবে— ছোঁড়ারা তাদের মামিদের হাতে গিয়ে পড়লে কী হয় বলা যায় না।
তা যা বলেছ। হয়তো জলবিছুটির বদলে ক্ষীরতক্তি চন্দরপুলি গোকুল পিঠে খেতে বসবে।
সেই তো ভাবনা! বড়োতরফ একটু পায়চারি করতে করতে হঠাৎ বলে ওঠেন, যত নষ্টের গোড়া হচ্ছিস তুই, আর তোর ওই চকরা-বকরা ভাগনেটি।
ছোটোতরফ চোখ গোল করে বলেন, তার মানে?
মানে বুঝছ না? বুদ্ধু তুমি? বলি—তোর ওই ভ্যাবলাই গাড়ির ফ্যাচাং তোলেনি?
তুলেছে তার কী?
সেই তোলা থেকেই যত উৎপাত আবার কী? আমার কি ত্রিজগতে কোনো ভাগনে ছিল? খুঁজে-পেতে ভাগনে বানিয়ে নিয়ে আসা। না আনলে তো আর আজ ভাগনের শোকে হাহাকার করে মরতে হত না আমায়?
ছোটোতরফ অগ্রাহ্যের গলায় বলেন, খুঁজে-পেতে ভাগনে আনতে আমি তোমায় মাথার দিব্যি দিইনি বড়োতরফ!
বটে? মাথার দিব্যি দিসনি? বলি তোর ভাগনে থাকবে, আমার থাকবে না, তোর গাড়ি হবে, আমার হবে না, এসব চলতে দেব আমি?
তবে আর কী করা? করো হাহাকার!
ছোটোতরফ ছিপ হুইল গুটিয়ে ফেলে হাঁক দেন, ওরে— কে আছিস ছিপ ঘরে তোল।
বড়োতরফ ওসব না গুটিয়েই হাঁক দেন, ওরে কে আছিস, এসব গুটিয়ে ঘরে তোল।
তারপর যখন দু-জনে বাড়ির দিকে আসছেন, আবার সামনে সেই দুই ভগ্নদূত। লখাই সর্দার, আর কালু সর্দার। কালুর মাথায় গামছা বাঁধা, গামছা লালে লাল।
বড়োতরফ গম্ভীরভাবে বলেন, কী রে কালু, আর কারুর মাথা পেলি না?
কালু ঘাড় চুলকে বলে, কোথায় আর মাথা খুঁজতে যাব হুজুর! এদিকে তো হুকুম হয়ে গেছে লড়াই খতম। দলাদলি শেষ। এদিকে আপনার হুকুম গুনতি ঠিক রাখা চাই।
বড়োতরফ ম্রিয়মাণভাবে বলেন, তাইবলে ওইভাবে নারকেল ফাটানো ফাটাবি কালু? নিজের মাথা বলেও একটু দুঃখ-দরদ করবি না? তোরা বড়ো নিষ্ঠুর কালু!
লখাই বোধ হয় বড়োতরফের এই দুঃখ দেখে স্থির থাকতে পারে না। বলে ওঠে, সব ধাপ্পাবাজি হুজুর। মাথায় গামছা বেঁধে, গোলা আলতার শিশি উপুড় করেছে।
অ্যাঁ তাই নাকি? হা হা হা! মেঘের ফাঁকে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়।
হা হা হা হাসতেই থাকেন বড়োতরফ, ব্যাটা আচ্ছা ঘোড়েল তো! হা হা হা!
দেখাদেখি ছোটোতরফও হাসতে থাকেন, হি হি হি ! হা হা হা!
হাসি শুনতে শুনতে লখাই আর কালুও হেসে ফেলে। হি হি হি!
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠেন, বড়োতরফ, অ্যাই চোপ! তোরা হাসছিস, মানে? বেয়াদব কোথাকার! কেন হাসলি?
আপনারা হাসলেন বলে হুজুর—
আমরা হাসব বলে তোরা হাসবি? খবরদার! আমাদের সামনে তোরা শুধু কাঁদবি, বুঝলি? এই নিয়ম।
লখাই আর কালু একসঙ্গে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে বলে, আজ্ঞে হুজুর, কাঁদতেই তো এসেছিলাম। কেমন গোলমাল হয়ে গেল।
কাঁদতেই এসেছিলি? কেন? কান্নার কারণটা কী?
দু-জনে সমবেত সংগীতের মতন সমবেত ভেউ ভেউ রবে বলে ওঠে, হুজুর সুড়ুঙ্গের মধ্যে ভোঁ ভোঁ, ভাগনে দাদাবাবুরা নোপাত্তা।
জীবনে যা না হয়েছে, তাই হয়। সিংহীরায়ের বংশধরেরা দেউড়ির সিঁড়িতে ধুলোর ওপর বসে পড়ে বলেন, নোপাত্তা?
সুড়ঙ্গের মধ্যে নেই ওরা?
আজ্ঞে না।
বলি ওদের লাশও নেই?
না হুজুর!
ওদের কঙ্কাল,মানে হাড়গোড়?
কিছু না হুজুর। একগাছি চুলও না।
ছোটোতরফ চিঁ চিঁ করে বলে ওঠেন, তবে যে কে বলেছিল ওরা ওর মধ্যে ঢুকেছিল সেদেখেছে—
বড়োতরফ আরও চিঁ চিঁ করে বলেন, তার মানে সেটা বানানো কথা—
লখাই সর্দার শক্ত গলায় বলে, না হুজুর বানানো নয় সত্যি কথা। আমরা নিজের স্বচক্ষে দেখেছি। স্বপন দাদাবাবু নাকের ডগা বাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে, আর ঢুকিয়ে নিচ্ছে।
থাম, মেলা বকবক করিসনে। তাহলে গেল কোথায়?
সেই তো সমিস্যে হুজুর!
অন্যদিকে আর পথ নেই?
আজ্ঞে না।
বলি জলজ্যান্ত দুটো ছেলে, সাড়ে-তিন হাত, সাড়ে-তিন হাত, সাত হাত মাল গেল কোথায়?
সেই তো চিন্তা হুজুর!
মাটির তলায় ফাটল টাটল নেই তো?
আজ্ঞে। না।
তাহলে হলটা কী?
আজ্ঞে হুজুর, সেই তো ভাবনা।
বড়োতরফ চেঁচিয়ে ওঠেন, কেবল তোমাদের সমিস্যে চিন্তা আর ভাবনা! হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া বোম্বেটে ভূত। বলি মাথা ফাটানোরা হাসপাতালে গেছে?
আজ্ঞে তদ্দন্ডে।
লড়াই থেমেছে?
আজ্ঞে কোনকালে।
দু-দলে মিলে করছে কী?
আজ্ঞে নন্দর দোকানে ঢুকে চা খাচ্ছে, মুড়ি তেলেভাজা খাচ্ছে, ছোলা সেদ্ধ খাচ্ছে। আর ইয়ে আপনার গিয়ে ধোঁয়া খাচ্ছে।
থাম গাধা, কার সামনে কী বলতে হয় জানে না। দু-দলে এখন ভাব?
আজ্ঞে গলায় গলায়।
এসব খাচ্ছে দাচ্ছে, পয়সা কোথায় পাচ্ছে?
কোথায় আর পাবে হুজুর, ধারে খাচ্ছে কাছারি থেকে শোধ হবে!
ঠিক আছে। পেট ভরে খেতে বলিস।
আজ্ঞে তাই বলছি গিয়ে।
আর তোরা?
আমাদের— আজ্ঞে আগেই সারা হয়ে গেছে।
উত্তম হয়েছে। যা বেরো আমাদের চোখের সামনে থেকে চক্ষুশূল দুটো!
ছোটোতরফ আবার হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ওঠেন, যাদের দেখলে চোখ জুড়োত, তারা হাওয়া হয়ে গেল।
বড়োতরফ বলেন, কাঁদিসনে ছোটোতরফ, আয় উঠে আয়। চল দাবায় বসিগে, মনটা অন্যমনস্ক হবে।
কোঁচা লুটোতে লুটোতে উঠে যান দু-জনে। হাঁক দিয়ে বলেন, কে আছিস রে! হরিসভা কেত্তন-মন্ডপে গালচে বিছিয়ে আমাদের দাবার ছক পেতে দিয়ে যা।
কে বারবাড়ির বৈঠকখানায় গিয়ে বসবে? তাহলেই তো মান কমে যাওয়ার ব্যাপার। তাই এই হরিসভার কীর্তন-মন্ডপে বসার ব্যবস্থা।
সেখানে গালচে পড়ল, গড়গড়া এল, তাকিয়া এল, পানের ডিবে, জর্দার কৌটো নামাল, দাবার ছক পাতা হল, দুই কর্তা বসলেন দু-দিকে।
বঙ্কিম, সাধন, বসির আর নিতাই রইল ধারেকাছে। কখন যে ‘কই রে কে আছিস’ বলে হেঁকে বসবেন ওনারা বলা তো যায় না। তবে চোখের সামনেও বসে থাকা চলবে না, আড়ালে থাকতে হবে।
গঞ্জের কালীর মন্দিরে আজ বিশেষ ভিড়। কারণ আজ একে মঙ্গলবার, তায় চতুর্দশী। চতুর্দশীতে মঙ্গলবার পড়া নাকি দারুণ ব্যাপার। মন্দির প্রাঙ্গণে লোকে লোকারণ্য। কারও হাতে জবার মালা, কারও হাতে ফুল বেলপাতা, কারও হাতে সরায় বা ডালায় চিনি সন্দেশ।
মন্দিরের পেছনে মায়ের দিঘি। সেখানে সদ্য চান করে উঠে এসে ভিজে কাপড়েই পুজো দিলে খুব বেশি পুণ্য হয় বলে অনেকেই আবার তাই করে ভিজে কাপড় সপসপিয়ে পুজো দিতে এসেছে। তাদের কাপড়ের জলে আর লোকেদের পায়ের ধুলোয় চাতালটা কাদায় কাদা। এর মাঝখান দিয়েই সুধাময়ী আর চারুলতা পুজোর থালা হাতে পা টিপে মন্দিরে ঢুকলেন। পরনে লাল টকটকে পাড়ের দুধে-গরদ, কপালে ইয়া বড়ো সিঁদুরের টিপ, রুপোর থালায় মন্ডা সন্দেশ আর গোলাপি চিনি।
ওঁদের দেখেই সকলে তটস্থ হয়ে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বলাবলি করে, রানিমারা এসেছেন, রানিমারা। বড়োরানিমা, ছোটোরানিমা! দেখ কী ফর্সা। যেন পদ্মফুল!
ওনারা এসব কথায় কানটান দিলেন না, মন্দিরে ঢুকে পড়ে ঠাকুরের সামনে বসে পড়লেন। সঙ্গের খাসদাসী দু-জন বসল দরজার বাইরে!
পুরুতঠাকুর পুজোটুজো দিয়ে দেওয়ার পর প্রসাদটা দাসীদের দিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওঁরা প্রার্থনা জানাতে শুরু করলেন, মাগো দয়াময়ী মা, ছেলে দুটোকে এনে দে মা! তুই যে চিরকালের জাগ্রত ঠাকুর, একবার বল মা, তারা কোথায় আছে? যতক্ষণ না বলে দিবি, এইখানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকব, বাড়ি ফিরব না, জলস্পর্শ করব না। বল মা, তারা প্রাণে বেঁচে আছে, না নেই?
বলেই চলেছেন।
কত লোক এল গেল, ওনারা আর উঠছেন না। মাঝে মাঝে চোখ বুঝছেন, মাঝে মাঝে চোখ খুলছেন। …ক্রমশ মন্দির খালি হয়ে গেল। পুরুতমশাই সরে এলেন মন্দিরের কপাট ভেজিয়ে দিয়ে।
হঠাৎ এ কী! সত্যি না ভুল?
শিউরে দুজেন দুজনকে চেপে ধরে ফেললেন।
রানি বউমা! ও কী?
রানি খুড়িমা! এ কী?
আঁকড়ে ধরলেন দু-জন দু-জনকে। ভয়ে কাঁপছেন ঠকঠক করে,চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে। সেচোখ ভয়ে বুজে ফেলছেন, আবার না তাকিয়েও থাকতে পারছেন না।
পারবেন কী করে? মা কালী, চিরকালের কালীগঞ্জের কালী, যতই জাগ্রত হোন, কেউ কখনো নড়তে দেখেছে তাঁকে? দুলতে দেখেছে? অথচ ওনারা দেখছেন। দেখতে পাচ্ছেন। ঠাকুর প্রথমে একটু কাঁপলেন, তারপর যেন নড়ে উঠলেন, তারপর দুলতে থাকলেন। দুললেন বিপুল বিক্রমে, তারপর মুন্ডমালা খাঁড়াটাঁড়া সমেত একেবারে একদিকে হেলে কাত হয়ে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে চড়-চড় চড়াৎ করে একটা শব্দ হল, কিন্তু কে শুনছে সেশব্দ? মা কালীকে কাত হতে দেখেই তো দুজনেই কুপোকাত।
মা যে কোন দিকে মাথা হেলালেন, কোন দিকে কাত হলেন, প্রাণে বেঁচে ‘আছে’র দিকে না ‘নেই’য়ের দিকে, তা দেখে বুঝতে পারলে তো?
এঁরা শুধু আঁ আঁ করতে করতে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ। যেন দুটো বিরাট বিরাট সাদা কুমড়ো কীসের ধাক্কা খেয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ঠাকুরকে ডাকাডাকির সময় লোকে বলে বটে, ‘হে ঠাকুর, দেখা দাও, হে ঠাকুর দেখা দাও’ বলে ‘হে ঠাকুর চোখ মেলে চাও’, কিন্তু সত্যি সত্যি যদি ঠাকুর সেসব করেন? তা হলে?
তাহলে আর কী? তা হলে ওই ‘আঁ আঁ’। ওই কুমড়ো গড়গড়ি। ওই পেটের মধ্যে হাত পা সেঁধিয়ে যাওয়া। ওই অজ্ঞান অচৈতন্য হওয়া।
ওনাদের যে কারা ধরে তুলল, কারা চোখে মুখে জল ছিটোল, সেওঁরা টেরও পেলেন না।
মা কালী আবার নিজ আসনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জিভ মেলে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।
বাইরে তো এত কান্ড! কিন্তু সুড়ঙ্গের মধ্যে কী হচ্ছে?
যে ছেলে দুটোর জন্যে এত বড়ো একখানি লড়াই, এদিকে চার-জনের ওদিকে পাঁচ-জনের মাথা ফাটল পাকা বেলের মতো, নাক কানও উড়ল কারুর কারুর, আবার দু-দলে গলাগলি মুড়ি ফুলুরিও খেতে বসল, ওদিকে খারাপ হয়ে যাওয়া মন ভালো করতে দুই রাজামশাই বসলেন, দাবা খেলায়, আর দুই রানিমা ‘মা মা’ করে প্রবল ডাকের চোটে মা কালীর আসন টলিয়ে দিয়ে নিজেরাই টলে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি হলেন, সেই ছেলে দুটোর অবস্থা কী?
…তাহলে আবার সেখানে গিয়ে দেখতে হয়।
হ্যাঁ, সেই ছেলে দুটো যখন দেখল সুড়ঙ্গের মুখে পাহারা, তখন তো ভ্যাবলা পড়ল শুয়ে, আর স্বপন দেয়ালে ঠোকা দিয়ে দিয়ে দেখতে লাগল কোনোখানটা ফাঁপা কি না।…
দেখছে তো দেখছেই আর ভ্যাবলা সুড়ঙ্গর ছাদের দিকে দুই চোখ মেলে চিত হয়ে শুয়ে আছে তো আছেই।
মিনিট কাটছে, ঘণ্টা কাটছে।
কাটছে, আরও কাটছে, একটা বেলাই কেটে যাচ্ছে।
হঠাৎ ভ্যাবলা চিৎকার করে ওঠে, স্বপন! ছাদে ওই আংটাটা কীসের রে?
আংটা!
হ্যাঁ, আংটা। ছাদটা কালো ভূত হয়ে গেছে বলে চট করে বোঝা যায় না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখি—
স্বপনও দেখতে পায় এবার।
সুড়ঙ্গর ছাতের একটা জায়গায় চৌকো টালির মতো একটা বড়ো পাথর, তার মাঝখানে একটা ইয়া মোটা লোহার আংটা ঝুলছে।
ভ্যাবলা রে, নির্ঘাত ওইখানেই আছে কিছু।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। ওটাকে টেনে খুলতে পারলে বোধ হয় বেরোবার পথ পাওয়া যাবে।
কিন্তু খোলাটা যাবে কেমন করে? সমস্যা সেখানেই!
এমনিতে যদিও মনে হচ্ছে সুড়ঙ্গর ছাদ মাথায় ঠেকু ঠেকু, কিন্তু হাত বাড়িয়ে দেখলে অনেকটা দূর। …বোকার মতো এদিক ওদিক তাকাল ওরা, একটা টুল কী চৌকির আশায়, তা সেটা তো আর পাওয়ার কথা নয়?
কোনো আঁকশি-টাকশি আছে দেয়ালের কোণে।
পাগল! আঁকশি ছেড়ে একটা খড়কে কাঠিও নেই কোথাও।
অথচ তাকাতে তাকাতে ক্রমশই বুঝতে পারছে, ওই আংটার মধ্যেই রহস্য। স্বপন, উপায়?
স্বপন মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, উপায় একটা আছে, মানে মাথায় খেলছে, কিন্তু তুই কি রাজি হবি?
কথাটা কী শুনি?
কথা আর কিছুই নয়, ভেবেচিন্তে দেখেছে স্বপন—একজন অপরজনের কাঁধে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালে আংটায় হাত পাবে।
ভ্যাবলা গম্ভীরভাবে বলে, আমার রাজি হওয়া মানে?
মানে—স্বপন দুঃখু দুঃখু গলায় বলে, তুই কি আমার কাঁধে উঠতে রাজি হবি? যতই হোক আমি সম্পর্কে তোর গুরুজন।
ভ্যাবলা দরাজ-গলায় বলে ওঠে, ঠিক আছে, তুমি আমার ঘাড়ে ওঠো। তাতে তো আর গুরু-লঘু দোষ ঘটবে না?
অগত্যা তাই। ভ্যাবলার দুই কাঁধে দু-পা দিয়ে দাঁড়িয়ে স্বপন সেই আংটাটাকে দু-হাতে ধরে মারে একটা হ্যাঁচকা টান।… আবার… আবার।
ভ্যাবলা বলে, স্বপন, গেলাম।
স্বপন বলে, আর একটু ধৈর্য ধর ভ্যাবলা, এরপর তোর ঘাড়ে তেল মালিশ করে দেব। হেঁইয়ো মারি হ্যাঁচকা টান। হেঁইয়ো মারি জোর জোয়ান।
চেষ্টার ফল ফলে।
টান মারতে মারতে হঠাৎ এক সময় চড়চড় চড়াৎ শব্দ করে চৌকো টালি পাথরটা বাকসোর ডালার মতো খুলে ঝুলে পড়ে। যে দিকটা আটকানো থাকে, সেদিকটা যে কী কৌশলে জোড়া আছে মা কালীই জানেন। আর জানত বোধ হয় সেই ডাকাতরা।
ওই চৌকো পাথরখানা খুলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর যে একটা জিনিস ঝুলে পড়ল তা দেখে ওরা নাচবে না লাফাবে, কাঁদবে না হাসবে, চেঁচাবে না গান গেয়ে উঠবে বুঝতে পারে না।
তাজ্জব বটে! একেই বলে ভগবান আছেন।
জিনিসটা— (অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি) শক্ত রেশমের দড়িতে তৈরি একটা দড়ির মই।
স্বপন ভ্যাবলার কাঁধ থেকে নেমে পড়ে বলে, মইটার নীচের দিকটা টান টান করে ধর ভ্যাবলা। তারপর—চটপট মই বেয়ে উঠে উঁকি মেরে দেখে বলে, যা দেখছি রে ভ্যাবলা, মনে হচ্ছে বোধ হয় মা কালীর বেদির একটা পাশ খুলে পড়েছে।…তার মানে উঠে বেরিয়ে পড়তে পারলেই একবারে মার মন্দিরের মধ্যে।
স্বপন রে। ক্রেডিট কার?
স্বপন উদার গলায় বলে, সবটাই তোর। তুই যদি চিত হয়ে শুয়ে পড়ে থেকে আংটা আবিষ্কার করতে না পারতিস, হত কাঁচকলা, না তো ঘোড়ার ডিম। …তা ছাড়া তুই আমার পা রাখতে কাঁধ দিয়েছিস।… তোরই সব। এখন তুই একবার উঠে দেখ।
স্বপন, ঘড়াটা নিয়ে কী করব আমরা?
স্বপন দৃঢ় গলায় বলে, স্রেফ মামাদের সামনে ধরে দেব। ওনাদের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি—
ভ্যাবলা উল্লাসের গলায় বলে, আমিও তাই ভাবছিলাম রে, তোর ভয়ে বলতে পারছিলাম না।
ভয়ের কী আছে—স্বপন গম্ভীর গলায় বলে, দুষ্টু বুদ্ধির বশে মামাদের বেশ ঠকিয়েছি। আমরা, তোর মামাকে তুই, আমার মামাকে আমি। হাতে হাতে তার ফল ফলছিল, স্রেফ জ্যান্ত কবর হয়ে যাচ্ছিল। নেহাত মা কালীর দয়ায়—জয় মা কালী।
ভ্যাবলাও ভক্তিভরে বলে ওঠে, জয় মা কালী। আচ্ছা স্বপন, মামারা তো একরকম রাজাই, গাড়ি-ফাড়ির বদলে ওনাদের একটা করে হাতি হলে কেমন হয়?
দি আইডি-য়া!
স্বপন চেঁচিয়ে ওঠে, ঠিক বলেছিস। …কিন্তু দেখ আগে ঘড়ায় আসলে কী আছে।
আমি বলছি নিশ্চয়ই মোহর। সোনা না হলে এত ভারী হয়?
আচ্ছা এখন বাকতাল্লা রেখে মইতে ওঠ তো—
ভ্যাবলা এই দড়ির মই বেয়ে ওঠে। তারপর বলে, ঠিক বলেছিস। ঠাকুরের বেদির ডান পাশে ফাঁকা হয়ে গেছে। ওখান থেকে মাথা বাড়িয়ে উঠে পড়লেই স্রেফ মা কালীর কোলে।
অতঃপর চটপট ওরা কর্তব্য নির্ধারণ করে ফেলে। দড়ির মইয়ের নীচে ঘড়াটাকে বেঁধে দু-জনে উঠে পড়বে, তারপর ওপর থেকে ‘হেঁইয়ো মারি জোয়ান।’
পারব তো ভ্যাবলা? স্বপন বলে।
দেখ।
তা ভগবান লোকটাকে দয়ালু বলতে হবে।
সেই বিরাট ভারী ঘড়াটাকে তো বাগিয়ে তুলল পটকা দুটো ছেলে। কার দয়ায় এত শক্তি পেল? তা ছাড়া সর্বাঙ্গে তো ব্যথা। হাড়ে হাড়ে গিঁঠে গিঁঠে!
সবই ভগবানের দয়া। ভগবানের আরও দয়া, মন্দিরে ভিড় নেই। মন্দিরের দরজা ভেজানো। ঘড়াটাকে টেনে তুলে দুম করে মাটিতে বসিয়ে ফিসফিস করে ভ্যাবলা বলল, চটপট সরে আয় স্বপন, টালিখানাকে আবার জুত করে বসিয়ে দিতে হবে, মা কালী কাত।
স্বপনও উঠে আসে, সেই ঝুলে পড়া পাথরখানাকে আবার টেনে তুলে বাকসোর ডালার মতো বসিয়ে দিতেই মা কালী আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
ওরা এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘড়াটাকে দেবীর মূর্তির পেছনে রেখে দড়িতে ঝোলানো ঠাকুর মশাইয়ের নামাবলিখানা নিয়ে তাতে চাপা দেয়। তারপর হাত মুখ ঝেড়ে এদিকে উঁকি মেরেই থ হয়ে যায়। কী ও?
মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে? শুধু গড়াগড়ি নয়, জড়াজড়ি। দুটো বিশাল সাদা কুমড়ো?
না, কুমেড়ো তো নয়।
কুমড়োদের কী গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয়? এদের যে আওয়াজ বেরোচ্ছে আঁ আঁ আঁ!
মন্দিরে সেবাইত, রানিমাদের মান সম্মানার্থে মন্দিরের কপাট দুটি ভেজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, ওনারা নিশ্চিত হয়ে ধ্যান প্রার্থনা করবেন বলে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি গুটি গুটি এগিয়ে এসে দেখেন, দরজার বাইরে রানিমাদের খাসদাসীরা মাটিতে আঁচল পেতে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে।…
সেবাইত আস্তে কপাট ঠেলে মুখ বাড়ান, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আঁ আঁ করে চেঁচিয়ে উঠেই পিছিয়ে এসে ছুট ছুট! দে ছুট।
হঠাৎ ওনাকে অমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে দেখে, পেছনে পেছনে সবাই ছুটতে থাকে। ছেলে বুড়ো, মেয়ে পুরুষ, বামুন, চাষি। সকলের মুখে একই কথা—ঠাকুরমশাই হলটা কী?…
এতদিনের নি:ঝুম কালীগঞ্জে হঠাৎ যে কত আলোড়ন উঠতে শুরু করেছে!
প্রথমে তো ভ্যাবলা আর তার গাড়ি। তারপর স্বপন আর তার পার্টস। তারপর সেই অগ্নি উৎসব। তারপর? তারপর তাদের সুড়ঙ্গ প্রাপ্তি।
তারপর জমজমাট্টি একখানা লড়াই। তাতে কালু সর্দারের দলের চারজনের মাথা ফাটা, আর লখাইয়ের দলের পাঁচজনের।…. তারপর লড়াই খতম করে দু-দলের গলাগলিও দেখল গ্রামের লোক।
কিন্তু তারপর? তারপর যা ঘটেছে সেএকেবারে তাজ্জব।
সেবাইত নিজের চক্ষে দেখেছেন, মা গঞ্জের কালী অল্প দুলছেন, আর বাবা ভোলানাথের দুই পার্শ্বচর নন্দী-ভৃঙ্গী, মাকে দুদিক থেকে ধরে টাল সামলে দিচ্ছে।
কিন্তু নন্দী-ভৃঙ্গীকে চিনলেন কীকরে সেবাইত মশাই? বা: তা আর চিনবেন না? চিরটাকাল মা কালী আর বাবা ভোলানাথকে নিয়েই তো পড়ে আছেন। ডাকিনী-যোগিনী, নন্দী-ভৃঙ্গী, সব ওঁর চেনা। তা ছাড়া নন্দী-ভৃঙ্গীই যদি না হবে, তো একটু পরেই আর দেখা গেল না কেন তাদের? গেল কোথায়?
অতএব কালীগঞ্জের বাড়িতে তখন আর কোনো কথা নেই, শুধু ওই নন্দীভৃঙ্গীর কথা, আর মা কালীর দুলুনি কথা।…
অথচ খোদ যাঁরা গ্রামের মাথা, তাঁদের মাথার মধ্যে এসব ঢোকানো যাচ্ছে না। তাঁরা সেই যে গতকাল দুপুর থেকে দাবায় বসেছেন, আজ দুপুর পার হয়ে সন্ধে হয়ে গেল, ওঁদের নাড়ানো তো দূরের কথা, কানে একটা কথাও ঢোকানো যায়নি। নন্দী-ভৃঙ্গী তো তুচ্ছ ব্যাপার, স্বয়ং বাবা মহাদেব এসে তান্ডব নাচলেও চটকা ভাঙবে না।
ডাকবে কে? কার একদা ঘাড়ে পাঁচটা মাথা আছে যে, ওঁদের খেলা ভঙ্গ করতে যাবে?
ওঁরা চাল চেলেই চলেছেন। রাজা মন্ত্রী নৌকো ঘোড়া বোড়ে নিয়ে।
এদিকে ওঁদের ভাগনেরাও কম চাল চালছে না।
ওরা ঘড়াটাকে মায়ের পেছন থেকে সরিয়ে এনে দুই রানিমার হাতে জিম্মা দিয়েছে, এখন ঘড়ার মুখের শিলমোহর খোলা হয়নি। অপেক্ষা করছে কখন দুই তরফের দাবা বোড়ে ওঠে।
কিন্তু উঠছে কই? দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল থেকে রাত, রাত থেকে দিন, কর্তাদের আর ওঠার নাম নেই।
যারা ডাকবে বলে এগিয়ে যাচ্ছে, তারা ভয়ে পিছিয়ে পিছিয়ে আসছে। কারণ কর্তারা এখন ইহলোকে নেই, ঊর্ধ্বলোকে। তিনদিন তিনরাত জল আর ডাক ছাড়া কিছু খাওয়া নেই। চুল রুক্ষ, চোখ লাল, মুখ শুকনো।
দুই ভাগনে দুই মামির কাছে বসে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় সেঁচে গল্প করতে বসে যখন শুনতে পায় তারা পাঁচদিন নিখোঁজ, তখন তো তাদের চোখ গোলআলু।
তার মানে আমরা তিন-চারদিন জ্ঞানগম্যি হারিয়ে মূর্ছা গিয়ে পড়ে থেকে ছিলাম! ওঃ! ভাবা যাচ্ছে না!
আবার মামিদেরও চোখ ঢাকাই খাজার মতো বিরাট, গোল, ভাগনেদের অভিযানের কাহিনি শুনে।
ছোটোতরফ গিন্নি তাঁর ভাগনে ভ্যাবলাকে বলেন, এসব তুই লেখ ভ্যাবলা, শুনেছি এখন নাকি অ্যাডভেঞ্চার বই সবচেয়ে বেশি কাটে।
আর বড়োতরফ গিন্নি বলে, এ সব কথা কারুর কাছে ফাঁস করিসনি স্বপন। আশ্চর্য কথা ব্যক্ত করতে নেই, পেটে রাখতে হয়, এটা শাস্তরের কথা।
কিন্তু সেসব তো পরের কথা, এখন কলসির মুখ খোলার কী হয়?
কর্তারা না দেখলে? অথচ কর্তারা দাবা ছেড়ে ওঠা তো দূরে থাক, দাবা থেকে মুখই তুলছেন, না।
তবু করতে তো হবে কিছু?
চাকরেরা আবার এসে দাঁড়াচ্ছে—গরুড় পক্ষীর মতো জোড়হাতে।
হুজুর!
হুজুররা নীরব।
হু—জু—র!
হুজুর, ভাগনে দাদাবাবুদের পাওয়া গেছে।
হুজুররা বোড়ের চাল দিতে দিতে বলেন, পাওয়া গেছে? তুলে রাখ।
হজুর, তুলে রাখার জিনিস নয়। ভাগনে দাদাবাবুরা। …যাঁদের জন্যে এত জ্বালা।
হুজর ঘোড়ার আড়াই-চাল দিয়ে বলে ওঠেন, আঃ এখন আবার জাল ফেলতে বলল কে? তা বড়োমাছ উঠল নাকি?
রাজামশাই—ই—ই!
আঃ, কানের কাছে এত মাছি ভনভন করছে কেন? কে আছিস উড়িয়ে দিয়ে যা।
হজুর—রাজা, মাছি নয়, আমরা। সুখবর আছে!
আরে বাবা, কে বলেছে এখন খাবার দিতে?
খাবার নয় বাবুমশাই, খবর। ভাগনে দাদাবাবুরা এসে গেছেন।
গেছেন তো যান। মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিসনি।
হুই-উ-জুউ-উর! নন্দী-ভৃঙ্গী ওনাদের উড়িয়ে নিয়ে গেছল, আবার ফেরত দিয়ে গেছে।
আঃ।
বড়োতরফ ধমকে ওঠেন, দেখছিস ছোটো, এই হতভাগাগুলোর মুখ্যুমি। … বলে কিনা ফেরত দিয়ে গেছে। এই বুদ্ধু ভুতুম, তোরাও ফের ফেরত দিয়ে দিগে যা। আচ্ছা করে কড়কে দিগে, সিংহীরায়েরা কখনো কারুর নেওয়া জিনিস ফেরত নেয় না।
ও হো হো ! বঙ্কিম আর নিতাই একসঙ্গে আর্তনাদ করে ওঠে, বাবু মহারাজ-গো, আপনাদের পায়ে পড়ি, একবার মুখ তুলে তাকিয়ে শোনেন।
এবার ছোটোতরফ ধমকে ওঠেন, তোরা আমাদের পায়ে পড়বি এতে আশ্চর্যের কী আছে রে? কেবল বাজে কথা। যা বেরো।
অতএব চাকররা বিদায় নেয়।
অবশেষে ওরাই দুই মূর্তিমান গুটিগুটি এসে একেবারে সপাটে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে প্রণিপাত! একেবারে দাবার ছকের গা ঘেঁষেই পড়ে।
এ কী, এটা কী! এতক্ষণে চমক ভাঙে হুজুরদের, টনক নড়ে।
তোরা? তোরা কোথা থেকে? কখন এলি? বলিনি ছোটোতরফ ওদের মধ্যে আঁতাত আছে।
মামা গো, অনেকক্ষণ—
অনেকক্ষণ আর এখনও পর্যন্ত—দুই রাজামশাই দাঁড়িয়ে উঠে, হুংকার ছাড়েন, ওরে আমার ঘোড়ার চাবুকটা! …ওরে আমার সেই জলবিছুটি—
ওসব কী হবে রাজামামা?
কী আবার হবে? তোমাদের খাওয়াতে হবে না? পাঁচদিন খাওনি তোমরা। হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া, বোম্বেটে, টিকটিকি, নেংটি ইঁদুর, আরশোলা—
কিন্তু আমাদের যে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে মামাহুজুর।
হয়ে গেছে।
দুই তরফ একসঙ্গে বসে পড়ে বলেন, হয়ে গেছে, কে খাওয়ালে?
আজ্ঞে আর কে? মামি! রানি মামি।
ওঃ! তাই তো, কী খাওয়া হল প্রভুদের?
এই আর কী, ইয়ে, রাজভবনে যত সুখাদ্য আছে।
হুঁ। সরের নাড়ু খেয়েছিস?
খেয়েছি বই কী। সবের আগে।
মাছের মুড়ো?
নিশ্চয়।
গোকুল পিঠে?
তা আর বলতে।
পোলাও, কালিয়া, কোর্মা কোপ্তা, দই পায়েস, মন্ডা রসবড়া?
সব সব।
ঠিক আছে। বলি ছিলি কোথায় এতদিন?
সেঅনেক কথা রাজামামা। এখন বিপদ হয়েছে ঘড়াটা নিয়ে।
ঘড়া! কীসের ঘড়া?
মামা গো! ডাকাতের ঘড়া সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিল—
অ্যাঁ!!! ডাকাতের ঘড়া সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে এনেছিস তোরা কী করে?
ওঃ সেআর কী বলব মামা, প্রাণে বেঁচেছি এই ঢের।
তাই নাকি? খুব কষ্ট পেয়েছিস?
মুখে বলা যায় না এত কষ্ট!
তা ঘড়া আনতে তোদের বলেছিল কে রে?
কে আর, নন্দী-ভৃঙ্গী!
নন্দী-ভৃঙ্গী!
হ্যাঁ, মামা তারাই তো উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে— সেযাক, এখন আপনারা ঘড়াটা নিয়ে উদ্ধার করুন আমাদের।
এ্যাই দেখো উজবুকের মতন কথা। তোরা ছেলেমানুষ কষ্ট-মষ্ট করে বয়ে এনেছিস, আমরা নেব মানে? দু-জনে ভাগ করে নিগে যা।
অ্যাঁ! যে যেখানে ছিল সবাই চমকে বলে ওঠে, অ্যাঁ।
রাজামশাইরা বকে ওঠেন, কেন? এক ঘড়া দু-জনে ভাগ করে নেওয়া যায় না? দু-জনের দু-ঘড়া চাই? হবে না? একালের ছেলে যে? আমাদের আমলে দুই বন্ধুতে একটা পেয়ারা আধখানা ভাগ করে খেয়েছি। কী রে ছোটো, খাইনি?
খাইনি আবার! ছোটো বলে ওঠেন, কত খেয়েছি। পেয়ারা, গাব, নোনা, আতা। বাড়িতে খেতে দিত না, বলত রাজপুত্তুররা ও সব খায় না, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে—
আর এরা কিনা এক ঘড়া মোহর দু-জনে ভাগ করে নিতে রাজি নয়। বলে কিনা বিপদ! একেই বলে ঘোরকলি। কে আছিস রে, নিয়ে আয় তো, আমিই ভাগ করে দিই—
ভ্যাবলা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, মামা, আমরা মোহর নিয়ে কী করব? বড়ো সাধ ছিল তোমাদের জন্যে একটা হাতি কেনা হবে—
স্বপনও বলে ওঠে, আমিও তো তাই—
দুই মামা একসঙ্গে ধমকে ওঠেন, খবরদার! আর ওসব দুর্মতি নয়। তোরা ছেলেমানুষ, কিছু পেয়েছিস, নিজেরা খেলনাপাতি কিনবি। …কই রে, কে আছিস! নিয়ে আয় তো সেই মোহরের ঘড়া। খুলে দেখি কত—
সাধন আসে ছুটতে ছুটতে, মহারাজ। ঘড়ার মুখ খোলা হয়েছে, বড়ো রানিমা খুলেছেন! ছোটোমা সাহায্য করেছেন।
বড়োতরফ হা-হা করে হেসে ওঠেন, খোলা হয়েছে? তা হবেই তো! মেয়েদের কৌতূহল! কতক্ষণ আর ধৈর্য ধরতে পারে! তা ওনাদেরই বলগে যা, দু-জনকে ভাগ—
হুজুর, ঘড়ায় মোহর নেই—
মোহর নেই? যাচ্চলে তা ছোটো। শুনলি? মোহর নেই! হা-হা-হা! তাহলে কী আছে? মড়ার খুলি।
আজ্ঞে না রাজামশায়, এক ঘড়া গহনা, কোন না মন দুই ওজন।
গহনা!
হ্যাঁ হুজুর! সোনার গহনা! কী ঝকমকানি। ইয়া মোটা মোটা চুড়ি, বালা, তাগা, গোটহার, বাউটি, তাবিজ, খাড়ু, টপচে, মটরমালা, বিছে, চন্দরহার—
ওরে বাবা! থাম! থাম! আর ফিরিস্তিতে কাজ নেই। মাথা ধরিয়ে দিল! মোহর নয়, কতকগুলো মেয়েলি জিনিস। ও আর কোন কম্মে লাগবে? মামিদের বলগে তুলে রাখতে, ভাগনে-বউরা এলে কাজে লাগবে। …চাঁদুরা আমাদের পাঁচদিন বেপাত্তা হয়ে, রোগা, চামচিকে আর কেলে কিস্টি হয়ে, নিয়ে এলেন কিনা এক ঘড়া গহনা। আরে দুর। এমন জমজমাটি খেলাটাই মাটি করে দিলে। আয় ছোটো, আর এক হাত হোক। ঘুঁটি সাজা।