কত কান্ড রেলগাড়িতে

কত কান্ড রেলগাড়িতে

যত কান্ড রেলগাড়িতেই!

অন্যে যে যা বলুক, রেলগাড়িতে ঘটা কান্ডকারখানার তুলনা নেই। এই জায়গাটিতে বহু কান্ডই ঘটে এবং ঘটে আসছে তার জন্মকাল থেকেই।

রেলগাড়ির জন্মকালের প্রথম অধ্যায়ে সেই দুই সাহেব ভূতের ঝগড়া (কে না জানে সেকাহিনি?) দিয়ে শুরু করে, কতরকম ঝগড়াই যে ঘটে আসছে তার ইয়ত্তা আছে? শুধু ‘ঘটে আসছে’ই বা বলি কেন? ঘটেই চলেছে।

ঝগড়া থেকেই কত কান্ডকারখানা।

জানলার ধারের সিটের দখল নিয়ে ঝগড়া থেকে হাতাহাতি, জানলা গলিয়ে অপর পক্ষের ব্যাগ-ব্যাগেজ, কোট, হ্যাট, ছাতা, নস্যির ডিবে, সিগারেটের কেস ছুড়ে ফেলে দেওয়াদিই,আগে যারা উঠেছে, আর পরে যারা উঠেছে এই দুদলে ‘রাজাপ্রজা’ সম্বন্ধ হয়ে গিয়ে, রাজার হাত প্রজাকে রুখতে, সবলে দরজা আটকানো ধাক্কা মারামারি, মালপত্তর লটবহরের গন্ধমাদন নিয়ে ধুন্ধুমার অথবা, ‘আপারবার্থ, থেকে লোয়ারবার্থে চিনেবাদামের খোসা, আখের ছিবড়ে, কেক, চকোলেট ঝালমুড়ি খাওয়া মোচড়ানো খালি ঠোঙা, ফেলা নিয়ে রসাতল তলাতল , এসব তো নিত্য ঘটনা। অপর যাত্রীরা বেশ বিনা টিকিটে কৌতুক নাটিকা দেখার মজা উপভোগ করতে করতে যাত্রার সুযোগ পায়।

আবার রেলগাড়িতে ভাবেরও অর্থাৎ ভাব হওয়ারও ছড়াছড়ি কান্ড, ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত।

রেলগাড়ির ঘণ্টা কয়েকের যাত্রাসঙ্গীর সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা, রেলগাড়িতে ছেলেমেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলা একদম অজানা অচেনার সঙ্গে টিফিনকৌটায় ভরে আনা খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, এদের জলের বোতলের জলে ওদের পিপাসা নিবারণ, ওদের বাড়তি কম্বলে এদের ঘাটতি পূরণ, এদের খোকার ঝুমঝুমির ওদের খোকার হাতে নাচানাচি, ওদের খুকুর পুতুল এদের খুকুর কাছাকাছি,এসবের চাষই কি কিছু কম নাকি?

রেলগাড়িতে অনেক প্রাপ্তিযোগেরও কান্ড।

আবার রেলগাড়িতে হারানোর কান্ড? সেও তো অগাধ অগুনতি! টাকাকড়ি ট্রাঙ্ক সুটকেস ব্যাগ বেডিং থেকে শুরু করে মায় ছেলেমেয়ে পর্যন্ত।

তা ছাড়া বদল?

বাক্স বদল, বাচ্চা বদল, ঘোমটা মোড়া কনে বদল, কত বদলের ইতিহাসই লেখা আছে রেলগাড়ির দেয়ালে অদৃশ্য লিপিতে।

এইসব নিয়ে যে কত গল্পকাহিনি লেখা হয়েছে, কত সিনেমা থিয়েটার দেখানো হয়েছে সেটা রীতিমতো একটা গবেষণার বিষয়, তোমার নিশ্চিন্ত ধারণা! যারা ‘ডক্টরেট’ করবার জন্যে একটু সহজ বিষয়বস্তু খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের আমি এদিকে দৃষ্টিপাত করতে বলছি।

সকলের উপর বিরাজ করছে রেলগাড়িতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, ঘুস, জুয়া, স্মাগলিং। রেলগাড়ি তো এসবের মহাক্ষেত্র।

আবার জন্ম, মৃত্যু? এও ঘটে যায় বই কী রেলগাড়িতে মাঝেমধ্যে।

রেলগাড়িকে একটা ‘মিনি পৃথিবীই’ বলা চলে।

এইসব ভেবেই জিতু তার বন্ধু গৌতমের একান্ত ঝুলো-ঝুলিতেও তাদের মালদার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে বাসে যেতে রাজি হল না, চাপল রেলে। বলল, দুর রেলগাড়িতেই যদি না চাপলাম, তবে আর বেড়াতে যাওয়া কী? রেলগাড়ির চাকারা সারাক্ষণ শুনিয়ে চলবে ‘কু-ঝিক-ঝিক, কু-ঝিক-ঝিক মামারবাড়ি! মামারবাড়ি! কু-ঝিক-ঝিক, কু-ঝিক-ঝিক তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি।’

গৌতম বলল, তোর মাথায় যত ধোঁয়াটে আইডিয়া।…একটা রাতের তো ব্যাপার!

তা হলেই বা! রাতের রেলগাড়িই তো যত মজার! যত রহস্যের!

গৌতমের দাদা শুনে বলল, তোর বন্ধু বুঝি কবিতা লেখা ধরেছে?

কই না তো? কেন? কে বলল?

বলেনি কেউই। ওর মামারবাড়ি আর তাড়াতাড়ির মিলটা?

ওটাই তো ধরিয়ে দিচ্ছে।

বা:! এখন আবার কেউ মিল দিয়ে কবিতা লেখে নাকি?

লেখে না বুঝি? তাহলে তোর বন্ধু নির্ঘাত এন্তার রহস্য রোমাঞ্চ আর গোয়েন্দা গল্প পড়ে।

বা:! বই পড়ার সঙ্গে রেলগাড়ি চড়ার কী?

ওইসব বই বেশি পড়লেই মাথার মধ্যে পোকারা বাসা বাঁধে, আর কটাং কটাং কামড়ায়। নইলে আজকালকার দিনে শখ করে কেউ রাতের রেলগাড়ি প্রেফার করে? যেখানে দিব্যি দিনে দিনে বাসে চেপে দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।

গৌতম বলল, বললাম তো অনেক করে। ওই এক শখ! কথাটা সত্যি। অনেক করেই বলেছিল গৌতম। কারণ ওর খুব ইচ্ছে ছিল বাসের তিনটে হলটিং স্টেশন, রানাঘাট, কেষ্টনগর আর বহরমপুর, তিন জায়গা থেকে বন্ধুকে ভালো সব খাওয়াবে দাওয়াবে। রানাঘাটের চাপড়ামন্ডা, কেষ্টনগরের সরপুরিয়া আর বহরমপুরের ছানাবড়া। এসব সেই দাদুটাদুর আমলের মতো (যা গৌতম শুধু শুনেছে—দেখেনি) অপূর্ব না থাকলেও,নাম তো আছে? দামও আছে।

তা সেথাকলেই বা কী?

জিতুর সেই এক ঝোঁক রেলগাড়ি।

শক্তপোক্ত লম্বা-চওড়া একটা নাম অবশ্য আছে জিতুর, সেটা হচ্ছে অজাতশত্রু। কিন্তু নামটা এমনই আখাম্বা, ভেঙে-চুরে কোনো টুকরোখানা দিয়েই ডাকাডাকির কাজে লাগানো যায় না। ‘অজাত’ও বলা চলে না। শত্রু অবশ্যই নয়।

‘অজা’ই বা কী এমন ভালো কথা? …এই সবের প্যাঁচে পড়েই বন্ধুরা জিতু বলে ডাকে! …বাড়িতে নাকি বলে খোকা?

তা সেযাই হোক—

অনেকদিন থেকে গৌতম চেষ্টা করছে জিতুকে একবার তাদের মালদার, মানে দেশের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্যে।

ছুটি হলেই বলে। কিন্তু জিতুদের বাড়িটা এমন না খুঁতখুতে বন্ধুর সঙ্গে যাবে, তাও বলবে যে ‘একা? ও তো তেমন সাব্যস্ত নয়।

শুনে জিতু রাগ করে, মার সঙ্গে ঝগড়া করে, কিন্তু অনুমতিটা আদায় করতে পারে না।’

কিন্তু এবারের ছুটির পরই তো স্কুলজীবন শেষ, এরপর কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে, কে জানে। তাই এবার অনুমতি মিলেছে।

গৌতমের দাদা-বউদি কলকাতায় তাই গৌতম আর তার দিদি কলকাতায় থেকে পড়ে। গৌতম স্কুলে, দিদি কলেজে।

মালদায় গৌতমের মা, বাবা, দাদু আর পিসিমা। ছুটি হলেই গৌতম ওখানে চলে যায়। কত ছেলেবেলা থেকেই তো একা যায় আসে। বাসেই যায়। তবে ট্রেনে কি আর যায়নি?

দাদা-বউদিরা যখন যায়, দাদার অফিস বন্ধর দিন রাত্রেই রওনা হয়। গৌতমের এ রাস্তা মুখস্থ।

জিতু বলল, চেষ্টা করে একটা আপারবার্থ পাবি না? উঁচুতে শুয়ে দোল খেতে খেতে বেশ মজা।

গৌতম হেসে উঠল, চেষ্টা করে আপার? আপারবার্থটাই তো সবাই অ্যাভয়েড করতে চায়।

আরে কেন?

বা:! লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ওঠা একটা হ্যাঙ্গাম না? বুড়ো-বুড়ি, ছোটো ছেলেমেয়ে এসবই তো বেশি রে। আপারবার্থ ইজিলি পাওয়া যাবে। কিন্তু ঘুমটা কীরকম? হাত পা ছুঁড়িস?

পড়ে ফড়ে যাবি না তো?

ধ্যাৎ? বাচ্চা না তো?

অতঃপর একটা শনিবারের সন্ধ্যায় দুই বন্ধুতে গৌড় এক্সপ্রেসে এসে বসল। পরদিন রবিবার, গৌতমের বাবার ছুটি, স্টেশনে আসার সুবিধে। স্টেশন থেকে বাড়িটা বেশ দূরে আছে নাকি।

কিছুক্ষণ নীচে গৌতমের সিটে বসে গল্প করার পর, জিতু হাইজ্যাম্প করে তার নিজস্ব জায়গায় উঠে পড়ল।

গৌতম হেসে বলল, যাও খোকাবাবু তোমার সাধের দোল দোল দুলুনি করে ঘুমোও গে।

বাড়িতে তো জিতুর নাম ‘খোকা’, মাঝে মাঝেই এরা বলে নেয় সেটা।

ওপরে উঠে শুয়ে পড়ার একটু পরেই জিতু হঠাৎ উঠে বসে বলল, গৌতম! তোদের বাড়িতে কুকুর আছে?

কুকুর?

গৌতম হেসে উঠল, তাহলেই হয়েছে। মা তা-হলে থাকত নাকি ও বাড়িতে? স্রেফ বাপের বাড়ি চলে যেত। মার দারুণ ভয় কুকুরে। যে বাড়িতে কুকুর আছে, মা সেবাড়িতে বেড়াতে যায় না। অথচ বাবার বেশ শখ আছে। কিন্তু কী করবে?

তারপর আবার একটু হেসে বলল, অথচ আমার বাবার দাদুর, অর্থাৎ দাদুর বাবার নাকি একটা পোষা নেকড়ে বাঘ ছিল!

নেকড়ে বাঘ!

তাইতো শুনি! জমিদারবাবুর খেয়ালে। জমিদার ছিলেন তো। খুব বাচ্চাবেলা থেকেই পুষেছিলেন অবশ্য। সেনাকি ওনার পুত্রতুল্য ছিল। চেন ফেনের বালাই ছিল না সারাবাড়ি ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াত। আর বাবার ঠাকুমা অর্থাৎ দাদুর মা, তাকে নিজে হাতে করে খেতে দিতেন। দাদু তো তাই হেসে হেসে আমার মাকে বলেন, বউমা সামান্য কুকুরেই তোমার এত ভয়, আর আমার মা নিজে হাতে করে নেকড়েছানাকে খাইয়ে দাইয়ে মানুষ করেছেন। মাও হেসে বলে ‘মানুষ’ করেছেন? …তো দাদু বলেন, আহা না হয় নেকড়েই করেছেন। নিজে হাতে নাইয়েছেন খাইয়েছেন তো।

জিতু বলল, ভাবা যায় না।

আমারও তাই মনে হয়, তবে শুনেছি শিশু থেকে পালন করলে বাঘ সিংহী সবাই পোষ মানে। …দাদুর বাবার সেনাকি তার পালক পিতামাতার কোলে বসত, গা চাটত! অথচ বিশালকায় হয়ে উঠেছিল।

জিতু বলে উঠল, তার মানে খইরির মতন?

যা বলেছিস। …তবে শুনি শেষটা বড়ো স্যাড ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল নাকি! দাদুর বাবার এক বন্ধু এসেছিলেন বেড়াতে, শিকারের শখ। দাদুর সঙ্গে পরদিন শিকারে যাবার কথা, হঠাৎ বাড়ির পিছনে বাগানের মধ্যে একটা বিশালকায় নেকড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে—ব্যস! চালিয়ে বসলেন গুলি। খতম।

অ্যাঁ।

হ্যাঁ! দাদুর বাবা নাকি পাগলের মতো হয়ে গিয়ে বন্ধুকে বলেছিলেন, শিগগির পালাও তুমি, নইলে হয়তো তোমায় গুলি করে বসব!… সেযাক! হঠাৎ কুকুরের কথা তুললি কেন?

কী জানি! হঠাৎ মনে হল, একটা বাঘের মতো কুকুর যেন আমাকে কামড়াতে আসছে। হো হো করে হেসে উঠল গৌতম।

বলল, দাদা ঠিকই বলেছে।

কী বলেছে দাদা?

সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল জিতু।

গৌতম বলল, এমন কিছু না! বলছে, এন্তার রহস্য রোমাঞ্চ আর গোয়েন্দা গল্প পড়লে, মাথার মধ্যে পোকারা বাসা বাঁধে!

যতসব বাজে কথা!

বলে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ল জিতু।

আর গাড়ির গতির ছন্দে আর চাকার শব্দ ছন্দে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। ভারি মজার গভীর একটা আমেজের ঘুম। এই আমেজটাই তো রাতের গাড়ির আকর্ষক!

কতক্ষণ এই মধুর সুখটি অনুভব করেছিল জিতু জানে না।…

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল জিতুর। উঠে বসল।

শুনতে পেল কে যেন কোথা থেকে ডাকছে, অজাতশত্রু! অজাতশত্রু!…

চমকে উঠে বসল জিতু। এ নামে তাকে কে ডাকছে? কে? কে? গৌতম তো নিশ্চয়ই নয়! …নীচের বার্থের দিকে তাকিয়ে দেখল, বার্থটা খালি, গৌতম নেই।

গাড়িটা কি চলছে? না: চলছে না তো।

ওঃ। বোঝা গেছে। মালদায় পৌঁছে গেছি আমরা! খুব ভোরেই তো গাড়ি স্টেশনে ইন করার কথা।… জানলার শাটার ফাটার সব টাইট করে বন্ধু, বোঝা যাচ্ছে না, ভোর হয়েছে কি না।

অন্য সমস্ত সিটগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল, আচ্ছা সবাই তো বেশ আরামসে শুয়ে আছে… ব্যাপারটা কী? তবে কি গৌতমের বাবা আগের কোনো স্টেশনে এসে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে নেবার জন্যে?…

গৌতম নেমে পড়েছে, আর ওর বাবা জিতুকে পোশাকি নামে ডাক দিচ্ছেন।… তা উনি তো বোধ হয় পোশাকি নামটাই শুধু জানেন।

তাই হবে! তাই ঠিক। কারণ গৌতম কবে যেন একবার বলেছিল, ‘আমাদের বাড়িটা এমন একটা জায়গায় জানিস, সামনে দিয়ে ট্রেন চলে যাবে অনেকটা দূরে গিয়ে থামবে।…

স্টেশন থেকে আবার পিছিয়ে চলে আসতে হয় আমাদের।’

এবারে বোধ হয় গৌতমের বাবা নিজেই আগে থেকে পিছিয়ে এসে, ওদের নিতে এসেছেন।

আবার শুনতে পেল জিতু, অজাতশত্রু অজাতশত্রু!……

কেমন একটা ভারী গম্ভীর-চাপা স্বর।

জিতু লাফিয়ে নেমে পড়ল।

তারপর ছুটে দরজার কাছে গেল।

দেখল দরজাটা খোলা!

তার মানে গৌতমটা নেমেই পড়েছে।

দেখতে পেল না অবশ্য, কারণ বাইরে অন্ধকার।….

আকাশের নক্ষত্ররাই যা সমবেত চেষ্টায় সামান্য একটু আলোকিত করে রেখেছে পৃথিবীকে!

জিতু নামামাত্রই চোখের সামনে দিয়ে রেলগাড়িটা ঘস ঘস করতে ছুট মারল।

জিতু দেখল সেএকা রেললাইনের ধারে একটা এবড়ো খেবড়ো মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু দূরে কী একজন একটা লন্ঠন হাতে নিয়ে চলেছে।….

কে আর গৌতমের বাবাই হবেন।

গৌতম নির্ঘাত আরও তাড়াতাড়ি হাঁটছে। গাড়িটা বোধ হয় একটু দূরে ভালো রাস্তার ওপর পার্ক করেছে।

যে যাচ্ছে সেকিন্তু ফিরে তাকাচ্ছে না। সোজা এগিয়ে চলেছে।

রাগে দুঃখে জিতুর প্রায় চোখে জল এসে গেল।

এই তোর বন্ধুত্ব। এতবার বলে বলে নেমন্তন্ন করে নিয়ে এসে এই ব্যাভার। আগেভাগে নেমে গিয়ে চটপট ছুটতে লেগেছিস? তোর বন্ধুকে ডেকে নিয়ে যাবার দায়িত্বটি বাবার ওপর চাপিয়ে দিয়ে!

গৌতমের এই আচরণে মর্মাহত জিতু ভাঙাগলায় ডেকে উঠল, গৌতম! এটা কী?

কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না।

তা ছাড়া জোর হাওয়া বইছে, গাছপালার থেকে শনশন শব্দ উঠছে।

আরও চেঁচিয়ে ডাকল, এ-ই গৌতম!

সামনের আলোটা একবার থামল, আবার চলতে শুরু করল। তার ফাঁকে একটি কথা শোনা গেল ‘চলে এসো’।

সেই গম্ভীরচাপা ভারী স্বর।

কিন্তু কথা, না আদেশ?

রাগে অপমানে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে জিতুর।

তবু ওই বিশ্বাসসঘাতক বন্ধুর অনুসরণ করেই ছুটতে হবে তাকে।

এখানে রাস্তা হারালে যে কী হবে ভাবার বাইরের ব্যাপার।

আচ্ছা! জিতুও এর শোধ নেবে।

ওদের ওখানে পৌঁছেই তক্ষুনি বাসে হোক, ট্রেনে হোক, লরি, টেম্পো, রিকশা ঠেলাগাড়ি যাতে হোক, যে করেই হোক, সোজা কলকাতায় ফিরে আসবে। ওদের বলে বলে, দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়ে তবে—

ফিরে আসার কথাটা ভাবার সঙ্গেই হৃৎকম্পন শুরু হয়ে গেল জিতুর। কলকাতায়? কলকাতায় ফিরে যাবার রেস্ত কোথায়?

জিতুর সুটকেস, ফুটকেস মায় বালিশের তলায় চাপা পার্সটা সবই তো সেই রেলগাড়ি চড়ে চলে গেল। জিতুর সম্বলের মধ্যে এখন একটা হাতকাটা গেঞ্জি, তার একটা ডোরা-কাটা ‘রাত পায়জামা। এদের দুজনেরই কারও পকেটের বালাই নেই। কাজেই হাতড়ে দেখার প্রশ্নও নেই।

তাহলে?

টাকার অভাবে জিতুকে এই যাচ্ছেতাই অপমানটা হজম করতে হবে।

উপায় নেই। রাগ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার তো কোনো মানে হয় না। নিরুপায় জিতুকে ওই বিশ্বাসঘাতক নিষ্ঠুর পার্টির আলোটাকে ফলো করে করেই এগোতে হবে।

আবার চেঁচিয়ে উঠল জিতু, এই পাজি গৌতম! দাঁড়া বলছি।

এখন জিতু নিজের গলাটা যেন শুনতে পেল। আর— আর—

হ্যাঁ, আর সেই চলন্ত আলোটা থেমে গেল। …আলোধারী ঘুরে দাঁড়াল এবং হাতের আলোটাকে উঁচু করে তুলে ধরল।

মুখটা দেখা গেল।

শুধু কি মুখটাই ? সারা শরীরটাই নয়? পায়ের কাছের সেই ড্যালা পাকানো ছায়াটা নয়?

একটু আগেই না সঙ্গে টাকাপয়সা নেই বলে হৃৎকম্প হচ্ছিল জিতুর? কিন্তু এখন?

হৃৎকম্পের ওপর আর কী আছে?

হৃদযন্ত্র থেমে যাওয়া?

বোধ হয় তাই।

হৃদযন্ত্রটা বোধ হয় প্রচন্ড একটা শব্দ করে ফেটে গিয়ে থেমে গেল!….

পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেল না জিতু, একটা গভীর গহ্বরে তলিয়ে গেল।

গৌতমের আবার ট্রেনে ঘুম আসে না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ঘুমের সাধনা করতে করতে, হঠাৎ মনে পড়ল আরে, রাতে শোবার আগের দাঁতমাজাটা তো হয়নি। জিতুর সঙ্গে গল্প করছিল, হঠাৎ শুয়ে পড়েছে।

ট্রেনের যাত্রীরা সকলেই শুয়েটুয়ে পড়েছে, কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। জিতুর দিকে তাকিয়ে দেখল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

গৌতম নি:শব্দে টুথপেস্ট আর ব্রাশ নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

গৌতমের আবার এই একটা ব্যাপারে বড়ো বেশি নিষ্ঠা। অনেকক্ষণ ধরে, অনেকটা মাজন খরচ করে, ব্রাশটাকে অনেকক্ষণ ধরে ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বেরিয়ে আসছে, মনে হল একটা চাপা-গোঙানি গলায় কে যেন কী বলে উঠল, আর সেইসঙ্গে একটা হুড়মুড়নো শব্দ।

কার কী পড়ল কে জানে।

এমন ডাঁই করে মালপত্তর রাখে।

ওই শব্দটার সঙ্গে সঙ্গেই একসঙ্গে কয়েকজনের গলা শোনা গেল। ‘হায় হায়’ মতো ব্যস্ততা।

তা হায় হায় তো করবেই, যাদের জিনিস পড়েছে তারা করবে না হায় হায়? কে জানে কাচের জিনিস টিনিসই ছিল কি না।

লম্বা করিডরটা লম্বা লম্বা পা ফেলে, পার হয়ে এসে নিজের জায়গায় এসে দাঁড়াল গৌতম, আর এসেই একদম স্ট্যাচু বনে গেল।

এর মানে? এটা কী দৃশ্য?

জিতু চাদর বালিশ সমেত জড়িয়ে পাকিয়ে মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে, আর তার কাছে হুমড়ি খেয়ে কয়েকজন কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়া এলোমেলো যাত্রী।

গৌতমকে দেখে একজন বলে উঠল ‘গিরগিয়া’।

অবাঙালি বৃদ্ধ মুখে বেশ উদবেগের ছাপ! ফাস্ট এড-এর বাক্স ছিল তাঁর কাছে, বার করলেন।

কিন্তু বাক্সটা কী দরকারে লাগল?

না:! আশ্চর্যভাবে রক্ষা পেয়ে গেছে জিতু! কোথাও এতটুকু চোট খায়নি। অথচ মাথাও ফাটতে পারত, পাও ভাঙতে পারত! এসব হয়নি। তার কারণ হয়তো জিতুর হালকা পটকা দেহটা আর চাদর বালিশ সমেত তালগোল পাকানো হয়ে পড়া।

ছেলেটার কিছুই হয়নি দেখে যে যার ভাঙা ঘুম জোড়া লাগতে নিজ নিজ ঠাঁই-এ শুয়ে পড়তে গেল। শুধু জিতুর আর নিজ ঠাঁই নয়। জিতু গৌতমের বার্থে আর গৌতম তার মাথার দিকে বসে।

শেষপর্যন্ত সেই পড়লি?

গৌতম ঠাট্টার হাসি হেসে বলল, স্রেফ বাচ্চার মতো!

জিতু বলল উঃ যা একখানা নিদারুণ স্বপ্ন দেখেছি, তুই হলে পড়ে স্রেফ জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যেতিস।

কী ভাগ্য যে, পড়ে হাত পা ভাঙিসনি, তাহলে আমার যা একখানা অবস্থা হত! শুতে শুতেই এমন গভীর ঘুম, স্বপ্ন! বাবা:!

শুতে শুতেই?

জিতু সন্দেহের গলায় বলল ক-টা বেজেছে?

গৌতম হাতটা তুলে নিরীক্ষণ করে বলল, এই তো এখনই সাড়ে বারোটা! তুই তো—

সাড়ে বারোটা! ইমপসিবল তোর ঘড়ি ডেড!

বললেই হল!

কানের কাছে হাত তুলে গৌতম বলল হার্ট বিট নর্ম্যাল।

আশ্চর্য! আমি তো ভোর হয়ে গেছে বলে নেমে গেছলাম—

নেমে গেছলি! তার মানে? কোথায় নেমে গেছলি?

জিতু উঠে বসল। মাথাটা দু-হাতে ধরে একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, দেখ, আমার কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সত্যি আর স্বপ্ন এ দুটো হ য ব র ল হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে নেমে পড়েছিল। নামিনি কি? কী জানি। হঠাৎ মনে হল কে যেন কোথা থেকে আমার ভালো নামটা ধরে ডাকছে।

ভারী, গম্ভীর গলা! আমি তো আশ্চর্য! অজাতশত্রু বলে আবার কে ডাকতে যাবে আমায়! তুই তো নিশ্চয় নয়?…

তা ছাড়া নামটা জানেই বা কে?…আবার ডাক। তারপরই মনে হল নিশ্চয় ভোর হয়ে গেছে। তোর সিটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, খালি—

আরে আমি তো একবারটির জন্য বাথরুমে গেছলাম। ঘুম আসছিল না হঠাৎ মনে পড়ল রাতের দাঁতমাজাটা সেরে শুইনি। তাই ব্রাশফাশ নিয়ে চলে গেলাম।

জিতু বলল, রাতদুপুরে উঠে দাঁত মাজতে। তোর সবই অদ্ভুত।

আর তোর সবই ঠিক, কেমন? শখ করে বাসের বদলে ট্রেন, লোয়ার বার্থের বদলে আপার , ঘুমের বদলে চাদর বালিশ জড়িয়ে সোজা নীচে নেমে আসা!

জিতু বলল, আমার কিন্তু এখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ব্যাপারটা আসলে স্বপ্ন! পর পর বলে যাই শোন। তুই সিটে নেই দেখে ভাবলাম তোর বাবা আমাদের নিতে এসেছেন, তুই আগেই নেমে পড়েছিস

বাবা! রাত্তিরেই নিতে এসেছে বাবা! হি হি হি।

আঃ! নো কমেন্ট! শুনে যা। মনে রাখিস এটা স্বপ্ন!

…দেখলাম কামরার দরজাটা হাট করে খোলা। গাড়িটা থামা। লাফিয়ে নেমে পড়লাম, আর তক্ষুনি ট্রেনটা ছেড়ে দিল। বিশ্রী একটা এবড়ো খেবড়ো জায়গা তাকিয়ে দেখি সামনে লম্বা কেউ একজন একটা লন্ঠন হাতে নিয়ে গটগট করে এগিয়ে চলেছে।

…ন্যাচারালি ভাবলাম তোর বাবা আলো নিয়ে এসেছেন নিতে।…তুই বোধ হয় আগেই ছুট মেরেছিস!…সত্যি বলতে খুব রাগ হল। মনে হল এরকম বিশ্বাঘাতক বন্ধুর সঙ্গে যাবার দরকার নেই।

গৌতম আর মন্তব্য করবে না, তাই শুধু হেসে উঠল।

জিতু বলতে লাগল, কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কী? সঙ্গে নেই টাকাপয়সা, কোথায় যে নেমেছি তাই জানি না। বাধ্য হয়েই আলোর পেছনে ছুটছি।…একবার হোঁচট খেলাম,খুব রেগে গিয়ে বলে উঠলাম, ‘এই পাজি গৌতম দাঁড়া বলছি।’ আর সঙ্গে সঙ্গে—ইস মনে করেও মাথা ঘুরে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গেই আলোধারী ঘুরে দাঁড়াল!…মুখের পাশে আলোটা তুলে ধরল।… ইয়া রাজাই চেহারা লম্বাচওড়া ফর্সা। আর বললে বিশ্বাস করবি না পায়ের কাছে একটা বিশাল জানোয়ার কুকুর না বাঘ কে জানে!….

গৌতম আবার নিষেধ ভুলে গিয়ে চমকে উঠে বলল, রাজাই চেহারা?….

দারুণ!

গৌতম একটু থেমে বলল, ঘুমের আগে বাবার দাদুর নেকড়ে পোষার গল্প শুনেছিস তাই এই ব্যাপার!

জিতু বলল, ব্যাপারটা এইখানেই শেষ হয়নি। সেই চেহারা আর সেই জানোয়ারটাকে দেখে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, মাথা ঘুরে গেল, তারপর একদম বোকার মতো তাঁর পিছু পিছু চলতে লাগলাম।…কতক্ষণ যে চললাম কে জানে দেখি মাঠ জঙ্গল ছেড়ে একটা বাড়ির কাছে চলে এসেছি।…

প্রকান্ড বাড়ি। অন্ধকার অন্ধকার জায়গায় যেন দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে।…একটা অদ্ভুত ব্যাপার বড়ো লোহার গেট-এর কাছে যাবার আগেই সামনে একটা লাল রং লাগানো খুপরি কাটা কাঠের গেট বসানো রয়েছে— এরকম ডবল গেট—

লাল রং লাগানো খুপরিকাটা কাঠের গেট?

চমকে উঠল গৌতম, এ তো আমাদের বাড়ির ব্যাপার। বড়ো গেট-এর ফাঁক দিয়ে কুকুর ঢুকে পড়তে পারে ভেবে, মার বলাবলিতে ওটা করানো হয়েছিল। ঠিক বলেছিস, লাল রং লাগানো?

হ্যাঁ তো! ওই রাজাই ভদ্রলোক আলোটা উঁচু করে তুললেন তো! গেটটা ঠেলে খুললেন।

তারপর লোহার গেটটা ঠেললেন। গেটের দু-পাশের দুটো পিলারের ওপর দুটো থাবা উঁচু করা সিংহের মূর্তি—

গৌতম প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, এ তো আমাদেরই বাড়ি। ..

তারপর আস্তে বলল, আচ্ছা আমি কি তোকে কোনোদিন এসব গল্প করেছি?

কোনোদিনও না। শুধু তোদের বাড়িটা খুব বড়ো, পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু সারানো হয়ে ওঠে না, এই বলেছিলি কাল টাক্সিতে।

গৌতম বলল, ঢুকে গেলি বাড়ির মধ্যে?

হ্যাঁ।

জিতু বলল, বললাম তো স্বপ্নের ঘোরে বোকার মতো চলেছি তাঁর সঙ্গে। গেটে ঢোকার পর একখানা বিশাল দরজা মন্দির টন্দিরের দরজার মতো পেতলের গুলি বসানো বসানো—

গৌতম জিতুর কাঁধটা প্রায় খামচে ধরে বলল এ বাড়ি আমাদেরই। …যাবার আগেই তুই—

জিতু বলল, আশ্চর্য! তারপর শোন—ঢুকে একটা বড়ো হল-এর মতো জায়গায় পড়লাম—

গৌতমও প্রায় স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বলে উঠল, আমাদের নীচের তলার দালান।

সেখান দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে। আমরা কিন্তু সিঁড়িতে না উঠে সিঁড়ির তলার দিকের একটা ছোটো দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

তার মানে বাগানে গেলি।

অদ্ভুত! খুবই অদ্ভুত লাগছে রে! বাগানে একটা শুকনো ফোয়ারা আছে?

আছে। আগে নাকি জল উঠত, আমি দেখিনি।

জিতু শুয়ে পড়েছিল, আবার উঠে বসল।

বলল, সেই ফোয়ারার পাশ দিয়ে কোনদিকে যেন চলে গিয়ে একটা ঢিবি মতো জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।

ঢিবিমতো?

গৌতম চেঁচিয়ে উঠল, তাতে একটা পাথরের স্ল্যাব লাগানো আছে?—লেখা আছে—‘বিক্রম’!

আছে। কিন্তু আমায় বলতে দে। … সেই রাজাই ভদ্রলোক গম্ভীরভারী গলায় বলে উঠলেন, অজাতশত্রু, জায়গাটা মনে পড়ছে? কী? বল? মনে পড়ছে না?

আমি খুব ভয় ভয় বললাম, না তো!

‘পড়বে, পড়বে, খুব ভালো করে ভেবে মনে পড়াও।’

আমি তো বুঝলি মরে যাওয়ার মতো। উনি বললেন, ‘এইখানে তুমি আমার বিক্রম বাহাদুরকে গুলি করেছিলে। …হ্যাঁ ঠিক এইখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তাকে।

অজাতশত্রু, আমার তখনকার মানসিক অবস্থার কথা ভাবতে পারছ? … তাই না আমি তোমায়’

বুঝলি গৌতম, আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম, বললাম, আমি এসবের কিছু জানি না।

উনি তেমনি গম্ভীরভারী গলায় বললেন, মনে পড়ছে না।

জন্মান্তরের পরে তো? কিন্তু তোমায় খুব ভালো করে ভেবে ভেবে স্মরণে আনতে হবে, আমার বিক্রম বাহাদুরকে তুমি সত্যিই ভুল করে মেরেছিলে, না ইচ্ছে করে? এই উত্তরটার জন্যে আমি এতকাল হাহাকার করে বেড়াচ্ছি। মুক্তি পাচ্ছি না।

লক্ষ করে চলেছি, আমার গুলি খেয়ে মারা যাবার পর তুমি—

অ্যাঁ! গুলি খেয়েই!

গৌতম প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কী বললি? আর একবার বল তো! গুলি খেয়ে—

জিতু কিন্তু তেমনি স্বপ্নাচ্ছন্নের মতোই বলে চলল, আমার গুলি খেয়ে মারা যাবার পর তুমি কোথায় জন্মাচ্ছ লক্ষ্য করে চলেছি। …তারপর দেখতে পেলাম।… সেই পুরোনো নাম নিয়েই তুমি আবার আমার বাড়িতে আসছ। …বলো অজাতশত্রু, ভুল করে, না ইচ্ছে করে?

জিতু এই জিতু ঘুমিয়ে পড়ছিস, নাকি?

জিতু চাঙ্গা হয়ে তাকাল। বলল, ধ্যেৎ!

তারপর বলল, আমার ওই কাতরতা দেখে মনে হল, বন্ধুকে গুলি করে মেরে কষ্ট পেয়ে বেড়ানো আত্মাকে শান্তি দিতে বলা ভালো, ‘ইচ্ছে করে’। বললাম তাই।

ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ! ‘ইচ্ছে করে’ বললে তবু তো ওই আত্মা শান্তি পাবে। সত্যিই তাই হল। আমার বলার পরই তাঁর হাত থেকে আলোটা পড়ে নিভে গেল। অন্ধকারের মধ্যে শুনতে পেলাম, ঠিক বলছ? অজাতশত্রু ঠিক বলছ?

হ্যাঁ!

কিন্তু কেন? কেন মারলে?

ও সব সময় তোমার কাছে থাকত। আমার ভয় করত।

ঠিক। অজাতশত্রু আমি বাঁচলাম। এই নাও তোমার সেই চাবিটা, যেটা এতদিন ধরে নিয়ে বেড়াচ্ছি। রাখতে দিয়েছিলে আমার কাছে।

তারপর?

গৌতমের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ।

তারপর আর কী? গভীর অন্ধকার। কোনো সাড়া নেই। ‘আপনি কে? আপনি কোথায়? বলে চেঁচালাম, সব, নিস্তব্ধ। ভয় পেয়ে ছুটে চলে আসতে গেলাম, সেই ফোয়ারাটার ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই। কতক্ষণ পরে যেন মনে হল, কে আমার মুখে জলের ঝাপটা মারছে। কতজন যেন কথা কইছে।

হঠাৎ দুজনেই চুপচাপ।

একটু পরেই গৌতম বলল, আচ্ছা, সেই ভদ্রলোক কীরকম দেখতে।

বললাম তো রাজার মতো চেহারা। ফর্সা লম্বা, অ্যারিস্টোক্র্যাট ভঙ্গি।

কী পরা ছিল?

ফর্সা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি। নাকের দুপাশে বেশ মোটাসোটা গোঁফ।

গৌতম নিশ্বাস ফেলে স্থির-প্রত্যয়ের গলায় বলল, আমার বাবার দাদু। প্রসন্ননারায়ণ।

আবার একটু পরে গৌতম বলল, স্বপ্ন এমন অদ্ভুত ডিটেলস হতে পারে? হতে পারে শোবার আগের ওই নেকড়ের গল্প, হতে পারে কোনোসময় আমি আমাদের বাড়ির কথা বলেছি, তবু এভাবে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়?

তা ছাড়া—ওই দ্বিতীয় ব্যাপারটা। উনি ওঁর বন্ধুকে গুলি করেছিলেন, একথা জীবনেও শুনিনি। আস্ত একটা কাহিনি, তুই স্বপ্ন দেখলি। আবার মনে করে বলতেও পারলি।

কিন্তু সবটাই কি স্বপ্ন?

স্বপ্নের কিছু কি ধরাছোঁয়া যায়?

অথচ ওরা একটা জিনিস ধরে বসে আছে দুই বন্ধুতে। চকচকে একটা চাবি। পেতলের রিংহীন একটা চাবি। সেকালের সমস্ত জিনিসপত্রের মতোই ভারী আর মজবুত।….

ভোরের আগে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার সময় জিতুর সেই দলাপাকানো চাদরটা ঝেড়ে পাট করতে গিয়ে টুং করে কী একটু শব্দ হল। কী পড়ল?। কী ছিল বিছানায়?

তাকিয়ে দেখে তুলে নিল গৌতম।

আর ইলেকট্রিকের শক খাওয়ার মতো বসে পড়ল।…

কিন্তু? সম্ভব অসম্ভব বলে তো একটা কথা আছে?

চাবি একটা সলিড জিনিস।

স্বপ্নের মধ্যে আসবে কী করে?

গৌতম বলতে চেষ্টা করল, হয়তো আগের কোনো প্যাসেঞ্জারের। পড়ে টড়ে গিয়েছিল, কিন্তু স্বরটা বিশেষ জোরালো শোনাল। তার নিজের মধ্যেই যে আতঙ্ক।

অতঃপর জিতুই জোরালো গলায় বলে উঠল, রেলগাড়িতে ‘অসম্ভব’ বলে কিছু নেই বুঝলি? এ জায়গাটিতে এমন অনেক কিছু ঘটতে পারে, ঘটেও, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। আমার কী মনে হয় জানিস? রেলগাড়ি শুধুই একটা গাড়ি মাত্র নয়, এর প্রাণ আছে, আত্মা আছে, অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আর ভীষণ একটা আকর্ষণ আছে। চোখের সামনে দিয়ে রাতদিনই তো কত গাড়ি যেতে দেখা হয়, বাস, ট্রাম, ট্যাক্সি, রিকশা, লরি, গোরুর গাড়ি, কই কোনোটাকেই কি ছুটে চলে দেখলে ‘মন কেমন’ করে ওঠে? ইচ্ছে হয় চেপে বসি? না:। … কিন্তু রেলগাড়ি? দেখলেই ইচ্ছে হয় চেপে বসি।

কাউকে স্টেশনে তুলে দিতে এলে তো কথাই নেই। আর যেই চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দেয়, মোশান নেয়, মনটা যাকে ‘হাহাকার’ নাকি বলে, তাই করে ওঠে না? ওঠে। সকলেরই ওঠে।

গাড়ি ঘটাং করে থেমে গেল।

স্টেশনে ইন করল।

স্টেশনে গৌতমের বাবা এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে।

জিতু, গৌতম আর গৌতমের বাবা প্রভাসবাবু গাড়িতে উঠে বসলে, গাড়ি ছেড়ে দিল। না, এখন আর নিজেদের গাড়ি নেই গৌতমদের। ছিল—দাদুর আমলে। তার তো অনেক পয়সাকড়ি ছিল।…আর তাঁর বাবার আমলে ছিল দু-খানা জুড়িগাড়ি।

সাদা ধবধবে দুটি ঘোড়া ছিল তাঁর নিজস্ব গাড়ি টানতে। ঘাড়ে সিংহের মতো কেশরের ঝালর। নিজে চালাতেন ঘোড়ার মুখের রাশ টেনে ধরে। সেই মূর্তির একটি ছবি আছে তাঁর, তাই গৌতমের দেখা।

এখন সেরামও নেই, সেঅযোধ্যাও নেই।

গৌতমের বাবা সেই গল্পই করতে করতে যাচ্ছিলেন।

প্রভাসবাবু। জিতু হঠাৎ বলে উঠল, দেশটার চেহারা একদম বদলে গেছে। চেনাই যায় না আর।

অ্যাঁ! কী বললে?

প্রভাসবাবুর নামও বংশধারা হিসেবে ‘নারায়ণ’ দিয়ে তবে তিনি ওইরকম জমিদার মার্কা নাম পছন্দ করেন না বলেই, নামের শেষটা ছেঁটে ফেলেছেন। আর ছেলের নামটা অমন লম্বা চওড়া রাখেনইনি। অবশ্য নামকরণের সময় পুরোহিতের কাছে বাদে!

অ্যাঁ! কী বললে?

প্রভাসবাবু একটু চমকে উঠলেন।

জিতু বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা আবছাগলায় বলল, বলছি দেশটার চেহারা একদম বদলে গেছে। কিছু চেনা যাচ্ছে না। শুধু ওই যা রাস্তার বাঁদিকে এই টানা লম্বা ‘গড়ের পাঁচিলটা’। প্রায় একরকমই রয়েছে। এদিকটা যা একটু ধ্বসে গেছে!

গৌতমের বাবা অবাকগলায় বললেন,কতদিন আগে এসেছিলে তুমি? এরকম ধ্বসে যাওয়া তো আমিই ছেলেবেলা থেকে দেখছি। তা ছাড়া শহরের চেহারাও তো অনেকদিনই এইরকম। অবশ্য নতুন দোকান টোকান হচ্ছে—

জিতু বলল, আমি সেবারে যখন লাস্ট এসেছিলাম, তখনকার কথাই বলছি। …তার আগেও তো আরও অনেকবারই এসেছি।

জিতুর চোখ জানলার বাইরে।

জিতুর গলার স্বর ঝাপসা

গৌতমের বাবা জিতুর চোখ এড়িয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু ইশারাসূচকভাবে নিজের মাথাটায় একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। …যার অর্থ—মাথার গোলমাল আছে নাকি?

গৌতমও হতাশভাবে ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভঙ্গিতে দুটো হাত উলটে জানাল ভগবান জানেন। আর মুখটা যেভাবে করুণ করল, বোঝা গেল এমন তো ছিল না।

খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল গৌতমের।

কী এক বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে সত্যিই মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল নাকি জিতুর? বাড়ি পৌঁছেই আগে ভালো করে চান টান করিয়ে নেওয়াতে হবে। তবে আপাতত চাঙ্গা করার জন্যে বেশ জোরগলায় বলে উঠল, এই জিতু! বাড়িতে পৌঁছোনোর খবর দিয়ে চিঠি দিবি? না টেলিগ্রাম করবি? তোদের বাড়ির সবাই যা ভাবনদার! ভেবেই অস্থির হবেন। টেলিগ্রাম করিস তো স্টেশন থেকেই করে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছে গেলে আজ আর সুবিধে হয়ে উঠবে না। অনেকটা দূর তো!

জিতু এই সহজ কথার অবসরেই সত্যিই আবার সহজ হয়ে গেল।

বলল, ওই অকারণ ভাবনাকরা’ রোগটাই তো হয়েছে যত নষ্টের মূল। …আমি বাবা বলে এসেছি, সাতদিন পরেই ফিরছি, ‘নিরাপদে পৌঁছিয়াছি’ বলে চিঠি ফিটি দেব না।

একেবারে ফিরে এলেই খবর পাবে।

গুড।

গৌতমের বাবা বলে উঠলেন, এরকম একটু সাহসী বিদ্রোহ থাকা তোমাদের বয়সের ছেলেদের ভালো। নিজেরও সাহস বাড়ে, মা-বাপেরও অযথা ভয় কমে।… গৌতমকে তো আমি ন-দশ বছর বয়েস থেকেই একা জার্নি করতে দিয়েছি।

অবশ্য—

একটু হাসলেন, দু-একবার টাকাকড়ি হারিয়েছে। একবার সুটকেসও হারিয়েছে, সেআর কী করা যায়? আমিও হারাতে পারতাম।

গৌতমের বাবাকে বেশ ভালো লাগছিল জিতুর।

আর গিয়ে পৌঁছে?

গৌতমের দাদু প্রফুল্লনারায়ণকে এত ভালো লেগে গেল, যে মনে হল যেন চিরকাল দেখেছে।

কিন্তু?

হ্যাঁ, ওই কিন্তুটাই বড়ো মুশকিলে ফেলল। জিতু স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে এই ঘর বাড়ি সিঁড়ি বাগান সবই সেগতকাল রেলগাড়িতে স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু দোতলাটা? ছাতাটা? সেও কেন এমন চেনা চেনা?… এসেই তো গৌতম তাকে সারা বাড়িটা দেখাল মোটামুটি।

খাওয়া দাওয়ার পর গৌতম বলল, চল দাদুর সঙ্গে একটু ভালো করে গল্প করিগে। তখন তো শুধু প্রণাম করেই ছুটি করা হয়েছে। দাদু খুব ‘গল্পে আছেন। আর ওঁর স্টকে অনেক গল্প।’

প্রফুল্লনারায়ণ খেয়ে উঠে মৌজ করে একটু তামাক খাচ্ছিলেন গড়গড়া নিয়ে। যেরকম দৃশ্য আজকাল সিনেমা ফিনেমার সাজা জমিদারদের ছাড়া কোথাও দেখা যায় না।

বস্তুত, জিতু কখনো কোনো সত্যি মানুষকে তার সামনে বসে গড়গড়া খেতে দেখেনি।

ওদের দেখেই প্রফুল্ল উৎসুক হয়ে,একটু সোজা হয়ে বসে বললেন, আরে এসো এসো গৌতমবাবু অ্যাণ্ড জি-জি জিতেন্দ্রবাবু। কি জিতেন্দ্র তো?

জিতেন্দ্র? না তো।

গৌতম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ওর নাম তো জিতেন্দ্র নয়—

তবে? ‘জিতু,’ ‘জিতু’ শুনলাম! স্কুলের বন্ধু তো?

ওর নামটা একটু শক্ত বলে, ডাকনামটাই স্কুলে প্রচার।

হাসল গৌতম, গোড়ায় গোড়ায় রেগে যেত। কী রে জিতু রেগে যেতিস না? বলতিস না, বাড়িতেও যে নাম স্কুলে সেই নাম ভালো লাগে না।

জিতু ঘরে ঢুকেই নিরীক্ষণ করে চারিদিক দেখছিল। এই ঘরটির চেহারা ঘরের মালিকের মতোই সাবেকি সাবেকি। গড়গড়া তো রয়েছেই, তারসঙ্গে মানানসই একদম সেকেলে চড়ো হাতাওয়ালা আরাম কেঁদারা। দেয়ালধারে রীতিমতো কারুকার্য করা কালোরঙের উঁচু পালঙ্ক। মেহগিনি কাঠের না আবলুশ কাঠের কে জানে।

দেয়ালে দেয়ালে অয়েল পেন্টিং।

জিতু ভাবছিল গৌতমদের অন্য ঘরগুলো তো একদম সাধারণ। নতুন সোফা টোফা ইনি পুরোনো চেহারাই পছন্দ করেন দেখছি।

বন্ধুর মুখে ‘কী রে বলতিস না?’ শুনে একটু হাসল। বলল, সেতো ক্লাস টু-তে।

প্রফুল্লনারায়ণ বললেন, ছেলেবেলায় ওইরকম হয়। এই আমার তো এতখানি লম্বা একটা নাম। কিন্তু ডাকা হত কী বলে, শুনবে! ‘ফুলু’। আর পাঠশালায় শুধু ছেলেরাই নয় গুরুমশাই পর্যন্ত ডাকতেন ‘ফুলুরি’। এই যে ফুলুরি, আয় তো। দেখি বেশি গরম, না খাওয়া চলবে।

হেসে উঠলেন।

হেসে উঠল ওরাও।

তারপর দাদু একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তা তোমার পোশাকি নামটি কী হে?

অজাতশত্রু।

অজাতশত্রু!!

দাদু হাতের নলটা নামিয়ে রেখে খাড়া হয়ে বসলেন। বললেন, বাঙালির ঘরে তো এধরনের নাম বড়ো একটা দেখা যায় না।

জিতু লজ্জা লজ্জা হাসি হেসে বলল, যা বলেছেন দাদু এই নামটা নিয়ে আমার কোনোদিন শান্তি নেই। যে শোনে সেই যেন তেমন পছন্দ করে না।

পছন্দ করে না?

দাদু বললেন, না না, অপছন্দের কী আছে? শব্দার্থটা তো উত্তম। যার কোনো শত্রু নেই। জন্মায়ইনি। সেই তো অজাতশত্রু।…. আসলে আমি ওটা বললাম কেন জানো? অনেকদিন আগে আমার ছেলেবেলায় ‘অজাতশত্রু’ নামের একজনকে জানতাম স্মৃতিটা মোটেই সুখের নয়, তাই আর কী। জিতু’ বেশ নাম। সর্বজিৎ, বিশ্বজিৎ, রণজিৎ হা-হা-হা, জিতের ছড়াছড়ি আছে আমাদের মধ্যে। জিতু! জিতু! এই ভালো। অজাতশত্রু বড্ড শক্ত।

ঠিক এই সময় জিতুর স্মৃতিতে সেই ভারী ভারী গম্ভীর গলায় ডাকটা একবার যেন আছড়ে পড়ল। ‘অজাতশত্রু’! বলে উঠল, স্মৃতিটা সুখের নয় কেন দাদু?

সেঅনেক কথা।

গৌতম বলে উঠল, জানো দাদু, এই জিতু না, কাল রাত্রে রেলগাড়িতে যা না অদ্ভুত একখানা স্বপ্ন দেখেছে। স্রেফ একটা গল্পের বইয়ের গল্প। যদিও মোটেই মজার নয়। আবার একরকম খুব মজাও।

হেসে ফেললেন প্রফুল্লনারায়ণ। বললেন এটা বুঝি আধুনিক বাংলা ভাষার নমুনা? অ্যাঁ! মোটেই মজার নয় আবার খুব একরকম মজার। ব্যাপারটা কী হে?

ব্যাপারটা হচ্ছে— এই জিতু। তুই বল না।

জিতু উঁচু দেয়ালে ঝোলানো একখানা পোট্রেটের দিকে তাকিয়ে দেখছিল হাঁ করে। যেকোনো ছবি টবি যেমন হয়, খুব চওড়া কানা উঁচু ফ্রেমের মধ্যে আঁটা একজন জমজমাটি চেহারার ব্যক্তির ছবি। মধ্যযুগীয় মার্কা সাজ এবং চেহারা। ছবির চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বলিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও সোনালি রং করা ফ্রেমের সোনালিটা অনেক মলিন হয়ে গেছে

জিতু প্রফুল্লনারায়ণের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভয় ভয় গলায় বলল কার ছবি?

দাদু গর্বিতভাবে বললেন, আমার বাবার, প্রদ্যোৎনারায়ণ সিংহরায়ের। একজন সাহেব আর্টিস্টের আঁকা।

সাহেব আর্টিস্ট!

হ্যাঁ, আগেকার কালের সব বড়ো বড়ো লোকের পোট্রেট তো সাহেব আর্টিস্টদের হাতেরই। সাহেব উত্তরবঙ্গে এসেছিল কোচবিহার রাজার ছবি আঁকতে, শিকারের সূত্রে কীভাবে আমার বাবার সঙ্গে আলাপ হয়ে যায়। সাহেব স্বেচ্ছায় এখানে চলে আসে ছবি আঁকতে। আমি তখন নেহাত নাবালক। শুনেছি ওরে সঙ্গে শিকারে গিয়েই বাবা একটা নেকড়ে ছানা নিয়ে এসে পোষেন। ‘মা নেকড়েটা’ মেরে ফেলে বাবার এবং সাহেবের দু-জনেরই কেমন অনুতাপ হয়। সাহেব বলেছিল, আমি তো এদেশে শুধু ঘুরেই বেড়াই, এরপর আর এক রাজবাড়িতে যাব তাঁর মায়ের ছবি আঁকতে, বরোদায়। যদি আমার নিজের দেশ হত, এই মাতৃহারা শাবককে পালন করতাম।

শুনে আমার বাবা বলেছিলেন, তা আমি তো ঘুরে বেড়াই না। আমার তো দেশ এটা। আমিই পালন করব। উঃ সেযে কী যত্ন, আর কী আদর। আর সেটাও এমন বাধ্য আর ইয়ে ছিল। নাম ছিল—

জিতু হঠাৎ বলে উঠল, ‘বিক্রম বাহাদুর’!

আরে!

চমকে উঠলেন প্রফুল্লনারায়ণ। গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন বন্ধুর কাছে সব গল্প করা হয়ে গেছে? নামটা মনে ছিল তোর?

আমার কিছুই মনে ছিল না। জানাও ছিল না বোধ হয়। এই তো বলল আমায়।

এ বলল? এ বলল মানে?

সেই তো—

গৌতম বলল, ‘মজা নয়! আবার মজারও’! এই হচ্ছে সেই ব্যাপার দাদু। কাল রাত্রে জিতু স্বপ্নে এ বাড়ির সব ইতিহাস জেনে ফেলেছে এই বাড়িটা দেখেও ফেলেছে। বাগানে গিয়াছে—আর সব থেকে বিচ্ছিরি ব্যাপার কে ওকে নাম ধরে ডাকছে বলে, রেলগাড়ির দরজা খুলে লাফিয়ে নামছি ভেবে স্বপ্নের ঘোরে, আপার বার্থ থেকে ঝাঁপিয়ে নীচে পড়েছে।

অ্যাঁ! নীচেয় পড়েছে? চোট লাগেনি?

লাগেনি। হালকা পটকা তো! আর চাদর ফাদর বালিশ ফালিশ জড়িয়ে পড়ায়—

কিন্তু ডাকল কে?

জিতু আবার সেই স্বপ্নাচ্ছন্ন গলায় বলে উঠল এই ইনি। ইনিই আমায় ডেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। …হাতে আলো ছিল। আঙুলে ঝকঝকে আংটি—সঙ্গে করে কত হেঁটে হেঁটে বিক্রম বাহাদুরের কবর দেখতে বাগানে নিয়ে গেলেন।

বললেন, বললেন—আচ্ছা গৌতম, কী বললেন, বল তো?

আমার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। ঠিক মনে পড়ছে না।

গৌতম বলল, তা ঝিম ঝিম করতেই পারে। অ্যাইস্যান পড়া পড়েছিলি! মাথাটা যে ফেটে চারখানা হয়ে যায়নি, এই আশ্চর্য্যি সেই তো বললি তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বল অজাতশত্রু বিক্রম বাহাদুরকে তুমি সত্যিই ভুল করে মেরেছিলে, না ইচ্ছে করে?’

আরামচেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠলেন প্রফুল্লনারায়ণ! চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, গৌতম! এ কে? এ কাকে নিয়ে এসেছিস? এ কোন অজাতশত্রু ?…মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বাবা বিকারের ঘোরে শুধু ওই কথাই বলেছেন, বলে অজাতশত্রু সত্যিই ভুল করে না ইচ্ছে করে? বল বল।

গৌতম ভয় ভয় ভাবে বলে স্বপ্নটা খুবই আশ্চয্যি দাদু! কিন্তু থাকগে এখন ওকথা! তোমার কাছে আমরা গল্প টল্প শুনতে এসেছিলাম—গৌড়ের কাহিনি।

দাদু আবার বসে পড়ে গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু দাদুভাই তোমাদের কাছ থেকে যে ওই স্বপ্নের কাহিনিটি শোনা আমার বিশেষ দরকার।

দুই বন্ধুর ভাঙাচোরা কথার সাহায্যে প্রফুল্লনারায়ণ ডিটেলস সমস্ত শুনে গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তাজ্জব! কিন্তু কই কোথায় চাবি?

গৌতম বলল, আনছি। আমার সেই জামাটার পকেটে আছে।

উঠে গেল।

প্রফুল্লনারায়ণ জিতুর দিকে তাকালেন।

ছেলেটা বারে বারে কপাল টিপছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে বোঝাই যাচ্ছে। করাই স্বাভাবিক।

গৌতম ফিরে এল।

আস্তে দাদুর চেয়ারের হাতার ওপর নামিয়ে রাখল ঝক-ঝকে পেতলের চাবিটি।

গৌতম।

চিৎকার করে উঠলেন দাদু, তুমি কি আমার সঙ্গে কোনো ধাপ্পাবাছির খেলা খেলে মজা দেখছ? তাই বন্ধুকে তোমাদের পারিবারিক গল্প শুনিয়ে রেখে—এ চাবি কোথায় পেলে তুমি? বলো কোথায় পেলে?

আঃ দাদু! এরকম করছেন কেন? বললাম তো ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ। স্বপ্নের মধ্যে এরকম! তবে মনে হয় আগের কোনো প্যাসেঞ্জারের পকেট থেকে পড়ে টড়ে গিয়েছিল।

আগের কোনো প্যাসেঞ্জারের—

প্রফুল্লনারায়ণ উত্তেজিতভাবে বলে ওঠেন, আর কোন প্যাসেঞ্জার এ চাবি পাবে? দেখতে পাচ্ছ, এর গায়ে কী অক্ষর খোদাই রয়েছে? পি, প্রদ্যোৎনারায়ণের পি। আচ্ছা দেখছি—

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন প্রফুল্লনারায়ণ, প্রদ্যোৎনারায়ণের, ছবির ঠিক নীচেই একটা সাদা পাথরের চৌকো চৌকি ছিল, (সে-কালের বড়োলোকদের বাড়িতে থাকত এরকম, পাথরের চৌকি, পেতলের চৌকি। সাধারণ বাড়িতে যেমন কাঠের জলচৌকি।)

তার ওপর উঠে দাঁড়ালেন, ওই ছবিটার পেছনে দিকে কোনখানে যেন হাতটা ঢুকিয়ে দিলেন, তারপরই চিৎকার করে উঠলেন, নেই!

নেমে এলেন।

বসে পড়ে, প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, জানি, থাকবে না। এ চাবির রহস্য আমি ছাড়া কেউ জানে না। …আমিও জানি না কিসের চাবি। …শুধু জানতাম ওই ছবির চওড়া ফ্রেমের পেছনে একটা গুপ্ত চেম্বার আছে, তার মধ্যে চাবিটা থাকে।….

এই লুকোনো জায়গা থেকে চাবিটা চলে গেল কী করে?

হঠাৎ এলিয়ে বসে পড়ে কাতর গলায় বললেন, গৌতম। আমি, কি তবে তোমায় সন্দেহ করতে বাধ্য হব?

আমাকে?

গৌতম দারুণ রেগে গেল। যাওয়ারই কথা। একে তো চিরস্নেহময় দাদুর মুখে এই বাক্য, তায় আবার বন্ধুর সামনে।

রাগের চোটে প্রায় চোখে জলই এসে গেল গৌতমের।

বলল, ইচ্ছে হয় করতে পারো, আমার কিছু যায় আসে না।

আঃ! রাগ করছ কেন? আমার একটা বাস্তব যুক্তিতে আসতে হবে তো?

যত ইচ্ছে এসো। চাবিচোর বলে পুলিশে ধরিয়ে দাও আমায়।

দাদু হতাশগলায় বললেন, আচ্ছা এখন একথা থাক। আমারও তোমার বন্ধুর মতো মাথা ঝিমঝিম করছে।

ঠিক আছে দাদু, আপনি একটু ঘুমোন।

জিতু বলল, আমরা ওঘরে গিয়ে ক্যারাম খেলিগে।

কিন্তু ক্যারাম বোর্ডটা পাওয়া গেলেও ঘুটিগুলো পাওয়া গেল না। আর সত্যি বলতে তেমন ইচ্ছেও করল না বসে বসে খেলতে।

গৌতমের সব সাধ গুবলেট।

খুব ইচ্ছে করত প্রাণের বন্ধু জিতুকে একবার তাদের বাড়িতে নিয়ে আসবে। দেখাবে সেকোথায় খেলা টেলা করেছে। কোন জঙ্গলে বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছে। সেআর তার দিদি।

এই চার-পাঁচ পুরুষের আমলের বিরাট বাড়িটার একটা দিক ভেঙে পড়ে একটু শ্রীহীন হয়ে গেলেও মোটামুটি আর সব দিক ঠিক আছে। বাড়িটার যে কত বারান্দা, কত প্যাসেজ, কত ছোটো ছোটো খুপরি ঘর, চোরকুঠারি, তার সবটা গৌতমের জানাও নেই। সবাই তো বন্ধু পড়ে থাকে।

দিদি সব জানে । গৌতম বলল, কোন দরজা দিয়ে কোনখানে বেরিয়ে পড়া যায় চট করে, আর কোন প্যাসেজের মধ্যে ঢুকে পড়লে বেরোবার পথ হারিয়ে যায় দিদি ঠিক বোঝে।

জিতু বলল, এত গোলমেলে প্ল্যানে বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল কেন?

আরে তৈরি যখন করা হয়েছিল, তখন তো আর গোলমেলে ছিল না। …পরে নাকি কেবলই এখানে সেখানে দরকার মাফিক ঘর-টর বাড়িয়ে এই অবস্থা। …সব থেকে পুরোনো দিকটা যেটাকে ঠাকুরদালান বলা হত, সেদিকটা তো ভেঙেই গেছে।

সারানো হয় না?

জিতুর প্রশ্নে লজ্জিত হয় গৌতম।

তবু হেসে উঠে বলে কে সারাবে বাবা? কার এত টাকা?

সেকালে জমিদারির টাকা-ফাকা ছিল, অনেক কিছুই হত। পুজোয় নাকি দারুণ ঘটা হত। …অনেক বড়ো ঠাকুর হত।

এখন বাড়ির মধ্যেকার ঠাকুরঘরেই ছোটোমাপের ঠাকুর এনে পুজো হয়। পুজোর সময় তো তোদের বাড়ি থেকে আসতে অ্যালাউ করবে না। তোরা বেড়াতে-ফেড়াতে যাস, তাই কখনো বলিনি।

তারপর হঠাৎ মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, এবার যদি বা একটু আসা হল, তা কী যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে গেল।

যাকগে চল একটু বাড়ির ‘গোলমেলে’ জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখাই তোকে।

হেসে ফেলে বলল, দেখিয়ো। জানিস দিদি ছেলেবেলায় আমার সঙ্গে ঝগড়া হলে বলত রোস তোকে ‘গোলকধাঁধায়’ ঢুকিয়ে দিচ্ছি তখন ভীষণ ভয় পেয়ে দিদির কাছে সারেণ্ডার করতাম।… ছেলেবেলায় একবার হয়েছিল ওই অবস্থা। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ঢুকে পড়েছি একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে, সেঘরে যত রাজ্যের ভাঙা জিনিসপত্র ভরা ছিল। ঢুকে যে কী হল। বেরিয়ে পড়ে যেদিক থেকেই চলে যেতে চেষ্টা করি ঘুরে ফিরে আবার সেই ছোট্ট ঘরটার সামনে।

এ বাবা! তারপর?

তারপর আর কী?

গৌতম হাসল ‘শিশুর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র’ প্রয়োগ। পরিত্রাহি চিৎকার। তাতেই কাজ হল। যে আমাদের বাড়ির বাসন-টাসন মাজত, সেকোথা থেকে শুনতে পেয়ে ছুটে এসে, ‘ওমা খোকাবাবু এখেনে কেন?’ বলে কোলে করে নিয়ে গেল।… দিদি তাই ঝগড়া হলে বলত, ‘গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দেব।’

সত্যিই, গৌতমদেব বাড়িটা বেশ গোলমাল লাগছে জিতুর। শুধু বাড়ির প্ল্যান বলেই নয়… দোতলায় দাদু যেদিকে থাকেন, মানে যেটাকে ওরা ঠাট্টা করে ‘কর্তা মহল’ বলে, সেদিকটা যেন একশো বছর আগের সাজসজ্জা নিয়ে অচল অনড় হয়ে বসে আছে। দেয়ালের রং থেকে ঘরের আসবাব থেকে দুটো ঘরের সামনের বারান্দা, আর এধারে টানা একখানা দালান থেকে সর্বত্র সেই পুরোনো কালের ছাপ। অর্থাৎ, সেকালে যেরকম ফার্নিচার, ছবি, আরশি পর্দা ইত্যাদিকে নিয়ে ‘খাঁটি বিলিতি জিনিস’ বলে গৌরব করত লোকে। সেরকম জিনিস আজকাল আর কোনো বাড়িতে দেখতে পাওয়া যায় নাকি? অথবা, দেখতে পেলেও কেউ গৌরব করে না নিশ্চয়। সবই যেন ভারী ভারী, নিরেট নিরেট।

প্রফুল্লনারায়ণ কিন্তু সেইসবের মধ্যে বেশ গৌরবের আমেজ নিয়ে প্রফুল্লচিত্তেই নিমজ্জিত।

এদিকে বর্তমানের ব্যবহারের দিকটা একদম হালকা। হালকা আধুনিক জিনিসপত্রে সাজানো। তবে খুব বেশি কিছু না। শুধু ডাইনিং টেবিলটা বিরাট আর সাদা পাথরের। এটা যে সেই বিলিতিয়ানার কালের সন্দেহ নেই।

ঘুরতে ঘুরতে গৌতম ওদের রান্নাঘরের দিকে চলে এসে বলল, এই দিকটা হচ্ছে একদম গেরস্থবাড়ি।

গৌতমের গলা পেয়ে ওর মা রান্নাঘর থেকেই বলে উঠলেন এই গৌতম, বন্ধুকে নিয়ে সারাদুপুর কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস? বিকেল হয়ে গেল চপ ভাজচি তোদের জন্যে আয়।

ভারি মিষ্টি চেহারা গৌতমের মার।

কথাবার্তাও।

গৌতম হেসে বলল, ওকে না আমি সেই গোলকধাঁধার দিকটা দেখাচ্ছিলাম।

এই সেরেছে। ওদিকে আবার কেন? যত রাজ্যের ব্যাং বিছের আস্তানা। সাতজন্মে কারুর পা পড়ে না।

জিতু হাসি হাসি মুখে বলল, কেন বলুন তো মাসিমা? অতসব ঘরটর এমনি পড়ে আছে, পরিষ্কার করিয়ে নিলে কত দরকারে লাগে।

হাসলেন গৌতমের মা।

বললেন এত আর দরকার কোথায় বাবা? কটাই বা লোক এখন বাড়িতে? এই তো আমার বড়োছেলে বউ কলকাতায়, গৌতমও সারাবছর ওদের কাছে। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি। থাকার মধ্যে এই আমি, তোমার মেসোমশাই, গৌতমের দাদু আর দাদুর একজন ভাগনি। মানে গৌতমের পিসিমা। সকালে যাঁকে দেখলে? ওঁর দুই মেয়ে, বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে।

পুজোর সময় সবাই জড়ো হলে তবু একটু জমজমাট হয়। অথচ শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছি এই বাড়িতেই আগে এত লোক ছিল যে বাড়িতে ধরত না।

গৌতম এসব শুনেছে। জিতু শুনে অবাক।

কোথায় গেলেন তাঁরা সবাই? মানে তাদের ছেলেমেয়েরাও তো থাকবে?

গৌতমের মা বললেন, কেউই ঠিক পরিবারের লোক নয়তো? আশ্রয় পেয়েছিলেন, থেকেছেন, পরে চলে-টলে গেছেন। … আমার দাদাশ্বশুরের মানে গৌতমের দাদুর বাবার—

জিতু বলে উঠল, প্রদ্যোৎনারায়ণের?

হ্যাঁ। হাসলেন গৌতমের মা, শুনেছি তাঁর সব কত বড়ো বড়ো লোক বন্ধু এসে এক মাস দু-মাস থাকতেন। তার মধ্যে সাহেব বন্ধুও থেকেছে কিছু। একজন সাহেব তো ওনার পোট্রেট আঁকার জন্যে নাকি সাত আট মাস ছিল। তাঁর জন্যে আলাদা বাবুর্চি বেয়ারা, আলাদা খানাপিনা।

খুব হেসে উঠলেন।

নাও এসো এখন আমার হাতের খানাপিনা খাও তো।

চায়ের জল চাপিয়েছি।

জিতু চপে কামড় দিতে দিতে হেসে বলল, আচ্ছা মাসিমা ওনার ইয়ে গিন্নি রাগ করতেন না? সেকালে তো শুনেছি সাহেব টাহেবকে ‘ম্লেচ্ছ’ বলত।

বলত। আবার বড়োলোকের বাড়িতে সাহেব নিয়ে খুব মেলামেশাও হত। গিন্নিটিও তো বেশ আপটু-ডেট ছিলেন।

পিয়ানো বাজাতেন সাহেবের সঙ্গে ইংরিজি কথা বলতেন, সর্বদা শৌখিন করে দামি শাড়ি পরে থাকতেন। আর শুনলে অবাক হবে, হেসে হেসে বললেন আধুনিকতার সাহস দেখাতে, কর্তার পোষা নেকড়েছানাকে, খাওয়াতেন শোওয়াতেন।

জিতু বলে উঠল, ওঃ। বিক্রম বাহাদুর? যাকে সেই ওঁর বন্ধু ‘অজাতশত্রু’ ভুলে গুলি করেছিলেন?

গৌতমের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, বন্ধুর কাছে সব গল্পই করা হয়ে গেছে? আমাদের বলবার জন্যে আর কিছু রাখিসনি? আর দুটো চপ দিচ্ছি কিন্তু। উঁহু। ‘না না’ করবে না।

মা চলে যেতে গৌতম বলল, আচ্ছা এই যে বাড়ির একতলার এইসব দিকগুলো দেখলি, এগুলো আগে দেখাটেখা বলে মনে হচ্ছে না তো?

জিতু আস্তে মাথা নাড়ল, কই না তো।

বাঁচলাম বাবা।… আসলে ওই স্বপ্নটা তোর মাথার মধ্যে ঢুকে বসে গিয়ে—

জিতু চাপটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, কিন্তু চাবিটা?

তা সত্যি! ওই চাবিটা?

দাদু যদি ওটাকে প্লেস না করতেন, স্বপ্নের চাবি আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতেন, তাহলে কোনো প্রবলেমই থাকত না।

…কিন্তু দাদু কিনা শুধু দাবিই করলে প্রমাণও দেখালেন, এবং গৌতমকে সোজাসুজি অপবাদও দিলেন।…

আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল গৌতমের।

গৌতমের বাবাকে দেখলে মনেও হবে না ইনিও জমিদার বাড়ির ছেলে। মানে ওই সাবেকি বিলিতিয়ানা আঁকড়ে বসে থাকা প্রফুল্লনারায়ণের নিজের ছেলে। প্রফুল্লনারায়ণ গড়গড়া খান বটে সেও একটা জমিদারি চাল। সন্ধ্যায় আবার মরফিয়া খেয়ে ঝিমোন। এমনিতেই তো বয়সের গুণে ঝিমোনো আছে।

আশি বিরাশি বয়েস।

গৌতমের বাবা ফিরলেন সন্ধে সন্ধে সময়। উনি এখানে কালেক্টরিতে না কোথায় কাজ করেন। ভালো শার্ট প্যান্ট পরা ছিমছাম চেহারা। আজ ছুটি ছিল কিন্তু কোথায় যেন কী ইনস্পেকশনে যেতে হয়েছিল।

তরতর করতে করতে সাইকেল চালিয়ে চলে এলেন, সেটাকে সিঁড়ির তলায় রেখে দিয়ে বললেন, তারপর গৌতমবাবু? বন্ধুকে কোথায় কোথায় বেড়িয়ে আনলে? আমি তো সেই পৌঁছে দিয়েই নেয়ে খেয়ে চলে গেলাম।

গৌতম বলল, আজ আর কোথাও যাইনি। শুধু আমাদের বাড়িটাই দেখিয়েছি।…

আরে দুর! এই ভাঙাচোরা বাড়ির আর কী এত দেখাবে?

জিতু বলে উঠল, আমার কিন্তু এ সবই খুব ইন্টারেস্টিং লাগছিল। গৌতমের গোলকধাঁধার জায়গা-টায়গা—

ও হো হো। সেইসব ছেলেবেলার ব্যাপার।

হেসে উঠলেন প্রভাসনারায়ণ।

হ্যাঁ। নারায়ণ-তো বটেই। এ বাড়ির সবাই নামকরণের সময় ‘নারায়ণ’ হতে বাধ্য। গৌতমও তো গৌতমনারায়ণ। তবে স্কুলে সেটা লেখায়নি।

প্রভাসনারায়ণ তারপর স্নান করবার জন্যে তোয়ালে সাবান নিতে নিতে বললেন, এই শোন তোর বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে টেড়িয়ে আনবার জন্যে একটা গাড়ি ঠিক করলাম দুদিনের জন্যে। তোর পিসিমাও বলছিলেন অনেকদিন কালীবাড়ি দেখা হয়নি। যেদিন ওইদিকে যাবি ওঁকে না হয় একটু নিয়ে যাস। আজ তাহলে শুধুই গল্প টল্প। কী বল?

জিতুর মনে হল, কী সুন্দর এদের সবাই। অথচ— হায়! ওই চাবিটা যদি না পাওয়া যেত। জিতু সব ঝঞ্ঝাট মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আহ্লাদ করে থাকতে পারত! …

ইস কেন যে সেই ভোরে তখন চাদরটা ঝাড়তে ‘টুং’ করে শব্দটা হল।

তা ওটা তো দিয়েই দেওয়া হয়ে গেছে দাদুকে, আর ওটাকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই।

স্বপ্ন স্বপ্নই। ওটা একটা অলৌকিকের খাতায় থাক।

‘বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।’

কিন্তু হতভাগ্য জিতু।

সেঝেড়ে ফেলতে চাইলেও, সেই ভদ্রলোকটি কী ছাড়লেন?

তিনি কি আবার ওই ছেলে দুটোকে পাকড়াও করে পেড়ে ফেললেন না?

সন্ধ্যার সময়।

প্রথমে অবশ্য সকলে মিলেই গল্প চলছিল। গৌতমের মা, বাবা, দাদু, পিসিমা।

এখানকার কলকাতার হালচালের বা বেহালের গল্পই হচ্ছিল।

বিদ্যুতের বেহাল, যানবাহনের বেহাল, হরদম ব্যাংক ডাকাতি ইত্যাদি। কিন্তু যেই প্রভাসবাবু বললেন, যাই কিছু কাজকর্ম রয়েছে সেরে ফেলিগে’— আর গৌতমের মা পিসিমা বললেন, আমরাও খাওায়-দাওয়ার জোগাড় করিগে—

বলে তিনজনেই হাওয়া হয়ে গেলেন, সেই দাদু নড়েচড়ে বসে বলে উঠলেন, দুই বন্ধু তো দেখছি ‘হরিহর একাত্মা’। দুজনে খুব গোয়েন্দা গল্প-টল্প পড়া হয় বোধ হয়?

গৌতম বলে উঠল, গল্প আর কীসের হয়? রূপকথার গল্প পড়ব নাকি?

হুঁ। তাই ভাবছি। তবে যদি রাগ না করো তো বলি দাদুভাই,এখানে আসার আগে দুই বন্ধুতে শলামরামর্শ করে, জোরালো একটা স্টান্ট দেবার জন্যে একখানা ‘গল্প’ বানিয়ে ফেলে চলে এসেছ। আর গৌতম তুমি ব্যাপারটাকে ‘রহস্য রোমাঞ্চ’ করে তুলতে গুপ্ত চেম্বার থেকে কোনো এক সময় চাবিটি হাতিয়ে রেখে, পারিবারিক একটা কাহিনি জুড়ে কোনো বন্ধুকে দিয়ে ‘স্বপ্ন’ দেখিয়েছিলে, তাহলে কি খুব ভুল হবে?

দাদুর ওই একটু চিবিয়ে চিবিয়ে, আবার একটু কেটে কেটে বলা এই কথাগুলি ধৈর্য ধরে সবটা শুনে গৌতম গম্ভীরভাবে বলল, খুব ভুল হবে।

খুব ভুল হবে?

হ্যাঁ! খুব ভুল হবে—

জিতুও বলে উঠল, কারণ স্বপ্নটাও দেখায়নি আমি নিজেই দেখেছি। এবং সেই রেলগাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া বাবদ মাথায় এখনও যথেষ্ট ব্যথা হয়ে আছে।…

ঠিক বলছ? কারেক্ট?

কারেক্ট!

চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রফুল্লনারায়ণ। আবার বসে পড়লেন। বললেন, আচ্ছা—ওই চাবি পাবার অ্যাটমোস্ফিয়ারটা ডিটেলস বলো দিকি!

জিতু হঠাৎ চুপ করে গেল।

একটুক্ষণ চোখ বুজে থাকল। তারপর আস্তে বলল, বলছি— বলছি। …দেখতে পাচ্ছি আজকের ওই গোলকধাঁধা ঘরটার পিছন দিকটার কোনখানে যেন একটা অন্ধকার লম্বা প্যাসেজ।—সেখান দিয়ে চলেছি কার সঙ্গে—

কার সঙ্গে?

প্রফুল্লনারায়ণের স্বর ব্যাকুল।

কিন্তু জিতু আচ্ছন্নের মতোই উত্তর দেয়, ওই যে। ছবিতে যিনি! …ফর্সা পাঞ্জাবি, ফর্সা কোঁচানো কোঁচা লুটানো ধুতি, গা থেকে অদ্ভুত একটা কড়া সেন্টের গন্ধ আসছে, হাতে মোমবাতি। …মুখে কথা নেই। যেতে দেখলাম পাশে বড়ো বড়ো থাম দেওয়া একটা মস্ত জায়গা। খিলেন খিলেন, অনেক থাম—ভাঙা ভাঙা।

ঠাকুর দালান।

প্রফুল্লনারায়ণ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, সেই পুরোনো ঠাকুর দালানটা। যেটা একবার ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছিল।

জানি না। তাই হবে হয়তো। সেইটা পাশে রেখে একটা জায়গায় থামলেন। সামনে একটা ছোটো দরজাঅলা ঘর—

ঠাকুরের ভোগ রান্নার ঘর। ওটা এখনও ঝুলে পড়েও দাঁড়িয়ে আছে।

প্রফুল্লরারায়ণকেও যেন আচ্ছন্নতায় পেয়েছে, উনিও যেন ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন মোমবাতির আলোয়।

অবশ্যই স্মৃতির মোমবাতি।

জিতু বলে চলে দরজাটায় একটা ছেকল লাগানো ছিল—

এখনও থাকে।

হবে… সেই ছেকলটা খুলে ফেলে দরজাটা খুলে ফেললেন।

বিশ্রী একটা ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া গেল।

পাবেই তো। চামচিকেয় ভরতি তো।

দাদু—

গৌতম বলে উঠল, দাদু ওকে তাড়াতাড়ি বলতে দাও—

আচ্ছা! আচ্ছা! বলে যাও তুমি।

পায়ের কাছে ভাঙা ইট পাটকেল, কষ্টে ডিঙিয়ে উনি একটা দেয়াল আলমারির সামনে দাঁড়ালেন। খুব বাজে মতো—

বুঝেঝি, পুজোর বাসন রাখার সেই আলমারিটা—

দাদু! আবার!

ওঃ। আচ্ছা।

কিন্তু প্রফুল্লনারায়ণের এই কথা বলে বলে বিঘ্ন ঘটানোয় জিতুর খুব অসুবিধে হচ্ছে?

কই?

জিতু তো বলেই চলেছে, আলমারিটায় একটা মরচে ধরা ছোট্ট তালা, জোরে টানতেই খুলে গেল। ভেতরে কিছু নেই। তাকগুলো মাঝখানে ভেঙে পড়ে গেছে। উনি সেই আলমারির পিছনে দেয়ালে কোথায় যেন একটু চাপ দিলেন। কী আশ্চর্য যে সেখানে আর একটা ঘর। নীচুতে নেমে যেতে হয়। পাতাল ঘর। সেই ঘরের মধ্যেও একটা আলমারি।

উনি পকেট থেকে একটা চাবি নিয়ে বাতিটা নামিয়ে রেখে আলমারির কলে লাগিয়ে ভারী ভারী গলায় বললেন, অজাতশত্রু। এইখানে, এরমধ্যে তোমার সব জিনিস তুলে রেখেছি।

…অনেক কিছুই তো নিয়ে এসেছিলে এখানে কিছুদিন থাকবে বলে। তোমার সেই গচ্ছিত জিনিসগুলো নিয়ে যাও। আমাকে মুক্তি দাও। বুঝলে অজাতশত্রু নিয়ে যাও তোমার সব কিছু, তোমার আংটি, তোমার ঘড়ি, তোমার—বডি— মানে বুঝতে পারছি না। বলছেন আর চাবিটা লাগাবার চেষ্টা করছেন। খুলছে না। বারে বারে লাগাচ্ছেন, খুলছে না।

হঠাৎ বাতিটাও নিভে গেল। আর কিছু দেখা গেল না। সব নিথর অন্ধকার।

অন্ধকারের মধ্যে শুনতে পেলাম, অজাতশত্রু, আমি যখন তোমায় গুলি করলাম, তোমার চোখ দুটো বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল, কী বলে উঠেছিলে তুমি? বলো। জবাব দাও।

জানিনা কার গলা, কে বলে উঠল বলেছিলাম প্রদ্যোৎ।

তুমি! তুমি আমায়—

—একটা নিশ্বাস পড়ল। …তারপর শুনলাম—

ঠিক আছে। অজাতশত্রু, এইসব কিছু তুমি নিয়ে যাও,

আমায় রেহাই দাও।

আবার চাবি খোলার চেষ্টার শব্দ। তারপর চিৎকার—ওই যা: চাবি! অজাতশত্রু চাবিটা?

তারপর? আমি চলে আসছি …পায়ে কী ঠেকল।

তারপর? তারপর? জানি না। আমি জানি না। অন্ধকারে একা থাকতে গা শিরশির করছিল, চলে আসছি পায়ে কী ঠেকল।

এই চাবিটা।

দাদু উঠে দাঁড়ালেন।

তাঁর হরিণের চামড়ার চটিটা পায়ে গলিয়ে বলে উঠলেন, গৌতম, ওই ড্রয়ারে মোমবাতি আছে, একটা বার কর। চল দেখে আসি।

গৌতম চেঁচিয়ে উঠল, কী? কী বলছ? মোমবাতি? দাদু। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? এখন তুমি—

এখনই তো বেস্ট টাইম। রাতের অন্ধকার। কেউ টের পাবে না—

আঃ দাদু। সবাই টের পাবে। এখন খাওয়ার টাইম। বাবা ডাকছেন।

কিন্তু—

কিন্তু টিন্তু কিছু না। কাল সকালে দেখো। আমি অন্তত আমার বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে সাপের কামড়ে মরতে রাজি নই।

গৌতম, তুই বুঝছিস না—

এই সময় দাদুর খিদমদগার বুড়ো চাকর সতীশ এসে দাঁড়াল ট্রেতে করে প্রফুল্লনারায়ণের রাতের খাবার নিয়ে।

ফর্সা। ঝাড়ন ঢাকা ট্রেটা ওঁর সামনের টেবিলে নামাল।

প্রফুল্লনারায়ণ বললেন, সতীশ, কাল ভোরবেলা দুটো মজুর ডাকবি।

রাত্রে কি এদের কেউ ঘুমিয়েছিল? কে জানে।

ভোরবেলা ভাঙা ইটের স্তূপের কাছে গোটা দুই তিন মজুর দেখে পিসিমা বললেন,—হ্যাঁরে প্রভাস ওখানে মজুর কী করছেরে সকালবেলা?

ওরাই জানে, আর বাবাই জানেন।

ডাকল কে?

কে আর? সতীশ। তবে সেও কারণটা জানে না।

কিন্তু কারণটা জানতে চাইবেই বা কে?

প্রফুল্লনারায়ণকে যেভাবে উত্তেজিত হয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে, তাতে কারুরই জিজ্ঞেস করবার সাহস হচ্ছে না।

অনেক স্তূপ সরাবার পর পাওয়া গেল পায়ের নীচে একটা সিমেন্ট বাঁধানো পথ। তার মানে এটাই সেই অন্ধকার সরু প্যাসেজ’। যার ছাদটা ভেঙে পড়ে গিয়ে সেই ঘরটায় যাওয়ার পথ বন্ধ করে রেখেছিল।

আশ্চর্য! দরজা ঝুলে পড়া ছাদে গাছ গজানো সেই ভোগ রান্না না কীসের যেন ঘরটা নড়বড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।

তা এইরকমই হয় অনেক সময়।

বড়ো বড়ো প্রাসাদ ধূলিসাৎ হয়ে যায়, আর হয়তো একপাশে দিব্যি অটুট হয়ে বসে থাকে আস্তাবল, সহিসের ঘর, আউট হাউস।

ভরদুপুরে যখন গৌতমের মা আর পিসিমা একটু দিবানিদ্রায় মগ্ন, সতীশ নাক ডাকাচ্ছে, প্রফুল্লনারায়ণ চটি পায়ে, ছড়ি হাতে একেবারে প্রস্তুত হয়ে এসে বললেন, চল।

তখনও মজুররা খাটছে, এরা জানলা থেকে দেখছিল। বাইরে কী রোদ। ঝাঁ ঝাঁ করছে।

দাদুকে দেখে গৌতম কাতরভাবে বলল, এই রোদে তুমি বেরোবে দাদু?

ওঃ রোদ।

প্রফুল্লনারায়ণ তীব্র গলায় বললেন, রাতে সাপে কামড়াবে, দিনে রোদ লাগবে, আর তোমরা আমার পরলোকগত বাবাকে ‘খুনি’ বানিয়ে রেখে দিয়ে মজা দেখবে, কেমন?

চিরকাল জানি বাবার বন্ধু ভুল করে বন্ধুর জানোয়ারটাকে মেরে ফেলে, দুঃখে লজ্জায় কাউকে না বলে পালিয়ে গেছল, আর তোমরা এখন মজা দেখতে চালাকি করে আমার বাবাকে খুনি বানিয়ে এক গল্প ফেঁদে— না না যেতেই হবে।

আজ্ঞে বেরিয়ে পড়ল দুজনে, দাদুর সঙ্গে সঙ্গে।

প্রফুল্লনারায়ণ মজুরগুলোকে ডাকলেন, হাতে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে বললেন, যা টিফিন করে আয়, অনেকক্ষণ খেটেছিস।

ওরা তো কৃতার্থ।

একজন বলে উঠল, এ কাজ হচ্ছে কেন বাবু? পুজোর দালান আবার উঠবে?

দেখি। এখন তো যা তোরা!

ওরা চলে গেল।

এরা তিনজনে পা টিপে সেই ছোট্ট ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

খাঁ খাঁ করছে আকাশ।

রাস্তায় জনমনিষ্যি নেই।

গৌতমের মনে হচ্ছে তারা যেন একটা কিছু চুরি করতে যাচ্ছে।

দরজাটা একটু ঠেলা মারতেই খুলে গেল। দেয়ালধারে আলমারিটাও দেখে বোঝা গেল উই ধরে চাপড়া হয়ে আছে।

ঘরের মাথা থেকে লম্বা লম্বা ঝুল। চামচিকে চামচিকে গন্ধ।

প্রফুল্লনারায়ণ চিরস্নেহের নাতি দিকে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলে উঠলেন, ওরমধ্যে যদি আলাদা কোনো চেম্বার না দেখি, যদি সব ফক্কিকার হয়, তাহলে তোমাদের থানায় চালান দেব বুঝলে?

ওরা তো কাঠ!

বলতে বলতেই হাতের ছড়িটা দিয়ে সেই পুজোর বাসনের আলমারিটার দরজায় ধাক্কা দিলেন, সত্যিই ঝরঝরিয়ে পড়ে গেল সেটা চাপড়া হয়ে।

আর তার মধ্যে?

চাপ দিতে হল না।

সেখানেও কাঠের দরজা উই খেয়ে খসে গেছে। …ঠেলা দিতেই অনেকখানি জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। ভরদুপুরের আলো, তবু আবছা অন্ধকার।

কিন্তু একেবারেই কি ফাঁকা হয়ে গেল?

কড়িকাঠ থেকে দোদুল্যমান ওটা কী? চিৎকার করে উঠল গৌতম, ওকী ওটা কী?

আস্ত একটা নরকঙ্কাল না?

গলায় দড়িবাঁধা অবস্থায় ঝুলে রয়েছে।

কিন্তু দড়ি না আর কিছু।

হ্যাঁ আর কিছু। কুকুর বাঁধার চেনের মতো। একটা লোহার চেন!

সেই দোদুল্যমান কঙ্কালের গায়ে ঠিক জামাকাপড়ের ধ্বংসাবশেষ আটকে রয়েছে বোধ হয় উইয়ের চাপড়া হয়েই।

…কিন্তু বুকের ওপর ওটা?

মোটা সোনার চেনে ঝোলানো একটা গোল ঘড়ি না?

সেকালে একে ‘ঘড়ি ফড়ির চেন বলত’।

তা সেতো বুকে।

আর হাতের আঙুল?

অন্ধকারে জ্বলজ্বলিয়ে জ্বলছে ওটা আংটির হিরে না?

কঙ্কালের বেঁকে যাওয়া আঙুলের গাঁটের কাছে আটকে আছে সেই খুব দামি হিরের আংটিটা।

ওই তো-ওই তো—

জিতু প্রায় পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে যায় ওই তো আমার সেই আংটি। …আমার বাবার দেওয়া—

লুটিয়ে পড়ল সেই ধুলো জঞ্জালের ওপর।

প্রফুল্লনারায়ণ দেয়ালটা ধরে কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, অজাতশত্রু তাহলে গলায় দড়ি দিয়েছিলেন!

না।

কে কে বলে উঠল ‘না’!

শুয়ে পড়ে থাকা অজাতশত্রু?

নাকি কোনো অদৃশ্য আত্মা!

প্রফুল্লনারায়ণ এদিক ওদিক তাকালেন।

কী আশ্চর্য! বলল কে? গৌতমই নাকি?

তবু জোর দিয়ে বললেন, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আত্মহত্যা—

না হত্যা করে গলায় চেন বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

দেখতে পাচ্ছ না?

প্রফুল্লনারায়ণ দেখলেন গৌতমই বলছে। কিন্তু গলাটা কি গৌতমের?

তারপর?

তারপর জিতু নামের ছেলেটা, বিকারের রোগীর মতো মাঝে মাঝেই চেঁচাচ্ছে, প্রদ্যোৎ তুমি? প্রদ্যোৎ, তুমি?

….প্রদ্যোৎ আমি তো ভুল করে—

আর কলকাতা থেকে চলে আসা মা, বাবা, দাদা, কাউকে চিনতে পারছে না।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিল সম্প্রতি কি মাথায় আঘাত টাঘাত পেয়েছে?

তারপর বলেছে, পেয়েছে? বুঝেছি। সেটাই কারণ। তাতেই এরকম। সারতে সময় নেবে।

এরপর ডাক্তারকে নিয়ে টানা মোটরে নিয়ে যাওয়া হবে জিতুকে। আর রেলগাড়ি নয়। সঙ্গে ডাক্তার থাকবেন, আর মা-বাবা।

তবে দাদু বলেছেন, ‘এফিডেবিট’ করে ওর নামটা আপনারা বদলে দেবেন। নামটা অনিষ্টকারী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *