কনক দীপ
অসহ্য গুমোটটা ঝড়ের পূর্বসংকেত। সমস্ত দুপুরের অসহ্য গুমোটের পর ঝড় উঠল বিকেলের দিকে। দুরন্ত দুর্দাম ঝড়—যেন উন্মত্ত গরুড়ের ক্রুদ্ধ পাখার ঝাপটানি। তোলপাড় করে তুলতে চায় সমস্ত পৃথিবীটাকে।
চকিত হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলেন মিত্তির সাহেব, সঙ্গে সঙ্গে চাকর এসে ঝটপট বন্ধ করে দিল জানলা দরজাগুলো। শিক্ষিত ভৃত্য, জানে ঝড়ের ধুলো ঘরে ঢুকলে তার চাকরিতে টান পড়তে পারে।
কিন্তু মিত্তির সাহেবের আজ কী হল কে জানে, জানলাগুলো বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিরক্তিসূচক একটা ‘আঃ’ শব্দ উচ্চারণ করে নিজে উঠে গিয়ে দু-হাতে ধাক্কা মেরে বারান্দার দরজাটা খুলে ফেলে বেরিয়ে এলেন।
মার্বেল পাথরে বাঁধানো চওড়া বারান্দা, কেন কে জানে চাকর-বাকরগুলো বলে ‘গাড়ি-বারান্দা’। সেখানে প্রচন্ড শব্দের দাপাদাপি। সেখানে ধুলোর উন্মাদ লাফালাফি। অসংখ্য মুঠোয় কে যেন ধুলোপড়া ছুড়ে ছুড়ে পাগলা করে দিতে চায় মিত্তির সাহেবকে।
প্রথমটা বোধকরি ঝড়ের ঝাপটে অজ্ঞাতসারেই একবার পিছিয়ে এসেছিলেন মিত্তির সাহেব, তারপর দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন।
ঝড় মানেই তো ধুলোর ছুটোছুটি।
রাস্তার মাঝখানে মাঝখানে ধূমকুন্ডলীর মতো পাক দিয়ে উঠছে ধুলোর কুন্ডলী, যে কুন্ডলী বাতাসের তাড়নায় বেঁা বেঁা করে ছুটছে চলন্ত রেলগাড়ির মতো। ধুলোর শোভাযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে ছেঁড়া কাগজ, শুকনো শালপাতা।
চাকরটা ঘরের মধ্যে থেকে সবিনয়ে জানাল একবার—‘‘বাবু ভারি ঝড় উঠেছে।’’
এটা বাহুল্য বিজ্ঞপ্তি বটে, তবে কথাটার প্রকৃত অর্থ বোধ করি ‘‘বাবু, খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা দেখবার উপযুক্ত সময় এটা নয়।’’
মিত্তির সাহেব শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। চাকরটা খানিকক্ষণ হাবার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে বাঁচাতে সরে পড়ল।
বাইরের বাতাস এসে তোলপাড় করতে লাগল—রেশমি পর্দা, শাটিনের বেডকভার, ভেলভেটিং কার্পেট। জঞ্জালে ভরিয়ে তুলতে লাগল আয়না পালিশ আসবাবপত্র, শৌখিন টেবল-ল্যাম্প, শ্বেত-পাথরের ফুলদানি, পিতলের বুদ্ধমূর্তি।
শন শন করে কী একটা পাতা ঠিকরে এসে গায়ে লাগল।
কী এ?
পাতা না? কী পাতা?
আম পাতা!
মুঠোয় চেপে ধরে পরীক্ষা করতে গেলেন মিত্তির সাহেব, গুঁড়িয়ে গেল হাতের মধ্যে। হয়তো অজানা বাজে গাছের পাতা, হয়তো বা সত্যিই আমপাতা। কিন্তু শুকনো খড়খড়ে বুড়োপাতা।
কাঁচাপাতা ওড়ে না এখানে? সেই কবেকার কোন ভুলে যাওয়া দিনে যেমন উড়ত অসংখ্য কাঁচাপাতা? ছপাছপ ঝপাঝপ করে গায়ে এসে পড়া সেই পাতাগুলোকে ঝাড়তে ঝাড়তে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে ফেলে যারা দেখছে তাজাপাতার সঙ্গে তাজা মটমটে কাঁচা আমগুলো কোথায় কোথায় পড়ছে, ওরা কারা?
ওই ঝড়ে লুটোপুটি খাওয়া প্রকৃতির মতোই দুর্বার দুরন্ত ওই প্রাণীগুলো? ওরা যে বাগানে লুটোপুটি করছে, কেবলমাত্র কি ওই কাঁচা আমগুলোর আশায়? না লুটোপুটিটাই সুখ?
কিন্তু কোথায় সেই আমবাগান? কবেকার ছবি ওটা?
মিত্তির সাহেবের সঙ্গে ও ছবির কোনো যোগসূত্র আছে?
ঝড়ের বেগ ক্রমশ বাড়ছে, বাড়ছে বুক-কেমন করা শব্দ। কোথাকার একটা ছোট্ট দোকানের শেডটা বুঝি খুলে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল রাস্তার ওপর। ভয়ংকর সেই শব্দে কানে তালা দিয়ে উঠল।
এত ধুলোয় আর চোখ বন্ধ না করে উপায় নেই। কিন্তু বন্ধ চোখের সন্ধানী দৃষ্টি, বিস্মৃতির অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে বেড়াতে চাইছে কেন আজ? কী সেখুঁজছে? পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে অবস্থিত সেই আমবাগানটিকে? যেখানে গাছপালা ফলপাতার মতোই প্রবল বর্ষণে নির্ভয়ে ভিজছে কাঁচা আমলুব্ধ প্রাণীগুূলো?
ওরা কী মনুষ্য-শাবক? না ওই দুরন্ত প্রকৃতিরই এক টুকরো অংশ? কিন্তু কোথায় ছিল ওরা? কোথায় কবে করত এই দুরন্ত মাতামাতি?
দেশটার নাম থাক, শুধু ছবিটাই আঁকা হোক।
সাঁেদা সাঁেদা গ্রাম নয়, চড়া কড়া শহর নয়, মাঝারি মফসসল টাউন। যেখানে গ্রাম-শহর দুয়েরই আস্বাদ মেলে। যেখানে সমাজজীবনে ধীরতা স্থিরতা আছে, ঘরে সংসারে আব্রু-সভ্যতা আছে, পুরুষের জীবনে কর্মব্যস্ততা আছে, মেয়েদের জীবনে গতি আছে। তবু আমবাগানে ঝড় ওঠে।
আচ্ছা, চিরকালই কি ঝড়ের আগে পৃথিবীর মাটি থেকে এমনি উত্তাপ ওঠে? এমনিতরো দম আটকানি গুমোট দেখা দেয়? যেমন এই একটু আগে দেখা যাচ্ছিল?
বোধ হয় যায়।
নইলে সেদিন কানু নামক সেই অতবড়ো ছেলেটাকে যখন তার মা-পিসি দু-জনে মিলে গালমন্দ করে ঘরে আটকে রেখে পাখা ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছিল, তখন ছেলেটার এমনি দম আটকানো গরমের অনুভূতি লাগছিল কেন? কেন ইচ্ছে করছিল দাঁড়িয়ে উঠে মাথার চড় দিয়ে ঘরের ছাদটাকে খুলে ফেলে দিতে? কেন ইচ্ছে করছিল দু-হাত দিয়ে ঠেলে দেয়ালগুলো সরিয়ে দিতে?
অবশেষে ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখল আকাশ অন্ধকার!
দিন-দুপুরেই ঘরের মধ্যে সন্ধ্যার ছলনা!
রাসমণির হাত থেকে পাখাটা কখন পড়ে গেছে, গলদঘর্ম রাসমণির নাক ডাকছে স্বচ্ছন্দ তালে। তার পাশে তার ভাই-বউ কমলাও রোগা দেহটাকে একটা ভিজে দড়ির মতো এলিয়ে দিয়ে হাঁ-করে ঘুমোচ্ছে। নিশ্বাসের ওঠাপড়ায় তার পাঁজরের খোঁচাখোঁচা হাড়গুলোরও ওঠাপড়া কাপড়ের আচ্ছাদন থেকেও বোঝা যাচ্ছে।
ওদের মাঝখান থেকে ওঠে সরে পড়া এমন কিছু শক্ত কাজ নয়।
আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়েই কোঁচার কাপড়টা খুলে মাথার ওপর ‘পাল তুলে’ দিয়ে পাঁই পাঁই করে ছুটতে থাকে ছেলেটা। ছুটতে ছুটতে একটা পুরোনো একতলা বাড়ির কাছ বরাবর এসেই কী ভেবে বাড়ির সদরে না ঢুকে পাশ দিয়ে এগিয়ে ‘ওঁচলাগাদা’ ডিঙিয়ে ভেতর দালানের জানলায় গিয়ে ডাক দেয়, ‘‘ফুলি, এই ফুলি!’’
বলাবাহুল্য স্বর উচ্চগ্রামে নয়, তবু ঠিক জায়গায় পৌঁছোতে দেরি হয় না। দালানের জানলার একটা কপাট খুলে গেল, এবং একটি ভীতসন্ত্রস্ত মুখ যেন আলোর মতো ফুটে উঠল!
দু-জনেরই কন্ঠস্বর খাদে।
‘‘কে কানুদা?’’
‘‘হ্যাঁ, বেরিয়ে আয় চুপি চুপি।’’
‘‘কানুদা!’’
‘‘কী হল! চোখ গুলিগুলি করছিস যে!’’
‘‘আবার তুমি আজ বেরিয়েছ কানুদা? দেখছ না আকাশের অবস্থা? বাড়ি যাও শিগগির।’’
কানু মুখ ভেঙচে বলে ওঠে—‘‘আহা! কী কথাই বললেন! ‘বাড়ি যাও শিগগির!’ গাছে আজ আর একটাও আম থাকবে ভেবেছিস? বেরিয়ে আয় চটপট।’’
জানলাটা ভেজিয়ে দিয়ে নি:শব্দে বেরিয়ে আসে ফুলি।
আকাশের ঈশান কোণ জুড়ে অন্ধকারের কী বিরাট সমারোহ! মেঘের মাথায় মাথায় রূপালি জরিফিতের ঝলকানি! আমবাগানের চেহারাটা কল্পনা করে ফুলির ছোট্ট বুকটায় দুরন্ত লোভ স্পন্দিত হয়ে ওঠে সন্দেহ নেই, তবু ফুলি ভারিক্কি চালে বলে ওঠে, ‘‘আচ্ছা বেহায়া তো তুমি কানুদা! তোমার পিঠের দাগ যে এখনও মিলোয়নি। জ্যাঠামশাইয়ের খড়মজোড়া হারিয়ে গেছে বুঝি?’’
এত অপমান অবশ্য নীরবে সহ্য করা কানুর পক্ষে সম্ভব নয়, সেফুলির গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, ‘‘হয়েছে, হয়েছে, খুব পাকামো হয়েছে! যাবি না তো যাবি না, বয়ে গেল! কে তোর জন্যে মরছে!’’
ঝড় ওঠে আকাশে, ঢেউ ওঠে গঙ্গায়।
এক গালের চড় খাওয়া লাল ছড়িয়ে পড়ে সারামুখে।
বালিকার চোখে তরুণীর তীব্রতা!
‘‘যাব নাই তো—! আমি কি তোমার মতো গুরুজনের অবাধ্য?’’
‘‘গুরুজন!’’
‘পাল তোলার’ জন্যে খোলা কোঁচাটা এতক্ষণ কাঁধে জড়ো করা পড়েছিল, সেটাকে টেনে নিয়ে জোরেজোরে কোমরে জড়াতে জড়াতে কানু ফের মুখ ভেঙচে বলে, ‘‘গুরুজনের বাধ্য হয়ে তো সগগের সিঁড়ি হবে! গুরুজনের নাম করিসনে আমার কাছে। ছোটোদের মারতে বকতেই ওরা জন্মেছে।’’
কানুর এহেন মন্তব্যে ফুলি হেসে ফেলে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখ-ধাঁধানো একটা আগুনের ফিতে আকাশের গায়ে যেন সাপের মতো ফুঁসে দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রলয়ংকর একটা শব্দ!
এ শব্দ চেনে না এমন কে আছে?
তবে মনে হল বড্ড কাছাকাছিই কোথাও পড়েছে বাজটা।
বজ্র আর বিদ্যুৎ!
মুহূর্তের জন্য দুজনেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরপরই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নামল।
বৃষ্টি দেখেই কানু চেঁচিয়ে ওঠে—‘‘এই সেরেছে! বিষ্টি এসে গেল! ফুলি আয় না! না হয় বাড়িতে একটু মারবে।’’ বলেই ফুলির কাঁচের চুড়ি পরা গোলগাল একখানা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে।
তথাপি ফুলি আত্মরক্ষা করে ‘‘না ভাই না!’’
‘‘যাবি না তাহলে?’’
‘‘রাগ করিসনে কানুদা—’’ ফুলির মুখের রেখায় রেখায় ভয়ের স্বাক্ষর। গুরুজনের অবাধ্য হওয়ার ভয়, কাল-বৈশাখীর মেঘপ্রমত্ত আকাশের ভয়, আর নাম-না-জানা একটা দুর্বার আকর্ষণের ভয়!
‘‘বেশ যাসনে! ভীতু ব্যাং কোথাকার! ব্যাং ব্যাং কুয়োর ব্যাং!’’
উন্মত্তবেগে ছুটে যায় কানু আমবাগানের দিকে। ফুলি বৃষ্টি থেকে সরে এসে জানলার দিকে দাঁড়ায়। হয়তো এই নিদারুণ অপমানে ওই বৃষ্টির মতোই বড়ো বড়ো কয়েকটি ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে তার চোখের কোল বেয়ে।
ছেলেবেলায় ভীরুতার অপবাদ সব থেকে মর্মান্তিক। আরও মর্মান্তিক, সেভীরুতা যদি নিরুপায়তা থেকে সৃষ্ট হয়।
শহরে ছেলেমেয়েদের চিত্ত-জগৎটা যেন শূন্যোদ্যান! ওর মূল বনেদে না আছে গভীর আনন্দের মাটি, আর না আছে নিবিড় রসানুভূতির শিকড়।
শহুরে ছেলেমেয়েদের বাল্য-কৈশোর যেন মেটে রঙের কালিতে লেখা একটা দিনলিপির খাতামাত্র।
রুলটানা খাতায় একটানা লেখা!
পরবর্তীকালে সেখাতা কোনোদিন উলটে দেখতে গেলে কোথাও চোখ আটকে যাবে না। শহুরে ছেলেমেয়েদের ‘ছেলেবেলা’ বহু বিচিত্র অনেকগুলি ছবির সমষ্টি নয়, ঝাপসা ঝাপসা অনেকগুলো ঘটনার সমষ্টিমাত্র।
নিজের ছেলে ‘টুটুল’, ‘টোকনে’র জন্য করুণা অনুভব করেন মিত্তির সাহেব। যে ছেলেমেয়েরা শেষরাত্রে উঠে পরের বাগানের ফুল চুরির আর রোদে খাঁ খাঁ দুপুরে পরের পুকুরের মাছ চুরির রোমাঞ্চ জানল না, তাদের জন্যে করুণা হবে না?
যারা কালবোশেখীর ঝড়ে আম কুড়োয়নি, যারা খালি পায়ে এক হাঁটু ধুলো মেখে তিন ক্রোশ মাঠ ভেঙে ‘মেলার বাজারে’ যাত্রা দেখতে যায়নি, যারা সেই মেলার বাজারের বাদাম-তেলেভাজা-পাঁপর আর সাতদিনের বাসি ঝালমুড়ি খেয়ে যাত্রার আসরের এক কোণে পড়ে ঘুমিয়ে জ্বর-জ্বর-গা আর লাল-লাল চোখ নিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরে বাপ-কাকার কাছে পিটুনি খায়নি, যারা গাছে চড়েনি, জলে ঝাঁপাই ঝোড়েনি, পাখির বাসা থেকে ছানা পেড়ে আনেনি, তাদের স্মৃতির ভান্ডারে আছে কী?
কিছু না। শুধু একমুঠো শূন্যতা!
যাত্রা!
যাত্রার কথা মনে পড়তেই—মনে পড়ে যায় কী যেন এক বিখ্যাত অপেরা পার্টির কী যেন ‘পালা’র ভীমসেনকে। ‘পালা’র নাম মনে নেই, ভীমসেনকে মনে আছে।
ইয়া গোঁফের জোড়া, ইয়া ভুরুর জোড়া, ইয়া ভুঁড়িদার সেই ভীমসেনকে ভোলার কথাও নয়। ভোলবার কথা নয় সাংঘাতিক সেই দৃশ্যটাও।
মিত্তির সাহেবের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস।
বীরবিক্রমে নাচতে নাচতে কোমরবন্ধ খুলে পড়েছিল ভীমসেনের। খসে পড়েছিল ভেলভেটের প্যান্ট। হতভাগ্য ভীম বিপদের পূর্বমুহূর্তেও টের পায়নি। যখন পেল তখন ধুপ করে বসে পড়ল বটে, কিন্তু তখন সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
দর্শকমহলে সেকী হাসির ধুম!
আধঘণ্টা ধরে চলতে লাগল সেই হাসির দমক। পালা আর জমলই না তারপর।
সেই হাসির রেশ নিয়ে বাড়ি ফিরে, সেকী বেধড়ক প্রহার জুটেছিল বেচারা কানু বলে ছেলেটার ভাগ্যে! মেরেছিল কে? না সেই কাকাটি, যিনি নিজে তখুনি যাত্রার আসর থেকে ফিরেছেন।
সাধে কি আর কানু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে ‘গুরুজনগুলো’ শুধু ছোটোদের মারতে বকতেই জন্মেছে!
কানুর দেখা সেই দেশটার অতীতের পাতাটা একবার খুলে দেখলে কেমন হয়? কী যেন নাম? ‘রায়গঞ্জ’? ‘পাট নগর’? ‘সদর হাট’? হবে যাহোক একটা। সেনামে আর আজ কার কী দরকার?
না কড়া পিচঢালা শহর, না ভিজেভিজে সাঁেদা মাটির গ্রাম। আধা-শহর-আধা-গ্রাম মফসসল টাউন। পুরুষরা বেলা দশটার মধ্যে ভাত খেয়ে ফর্সা ধুতিকামিজ পরে কোর্টে-কাছারিতে, স্কুলে, ইউনিয়ন বোর্ডে, কী মিউনিসিপ্যাল অফিসে ছোটে, মেয়েরা তারপর ক্ষার কাচে, বড়ি দেয়, পাড়া বেড়ায়, বেলা তিনটেয় ভাত খেয়ে গড়াগড়ি পাড়ে।
তবে ব্যতিক্রম কি আর নেই?
ব্যতিক্রম কানুদের বাড়ি, ব্যতিক্রম ফুলিদের বাড়ি। কানুর বাপ-কাকার গুড়ের ব্যাবসা, তাদের নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। আর ফুলির দাদু হাইস্কুলের সেকেণ্ড মাস্টার হলেও, এবং তাঁর নাওয়া খাওয়ার সময়ের ঠিক থাকলেও ওদের সংসারের কিছু ঠিকঠাক নেই।
মাস্টারমশাইয়ের গৃহিণী নেই, মারা গেছেন অনেক দিন। একটা বিধবা মেয়ে ছিল, সেটিও গেছে। তারই মেয়ে ফুলি। তাকে সদ্যোজাত শিশু থেকে মানুষ করেছেন মাস্টার শিবনাথ চাটুয্যে।
কিন্তু তাহলে ফুলিদের সংসার পরিচালনা করে কে?
সেও একটি ব্যতিক্রম।
দু-চারটি করে গরিব ছাত্র পোষা শিবনাথ মাস্টারের বাতিক। জীবনে সাধ ছিল ভারতবর্ষের সনাতন ভাবধারার আদর্শে একটি ‘বিদ্যার্থী আশ্রম’ স্থাপন কবেন। আশ্রমের নৈতিক শিক্ষা, আর আধুনিক উচ্চশিক্ষা, এই দুই শিক্ষার সমন্বয়ে বলিষ্ঠ করে তুলবেন সেই ‘বিদ্যার্থী’ বালকদের চরিত্র, স্বাস্থ্য, স্বভাব। বিনা দক্ষিণায় তাদের তৈরি করে তোলবার বিনিময়ে থাকবে একটি মাত্র শর্ত— তারা যেন প্রত্যেকে এই অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন দেশের অন্তত পাঁচটি লোকেরও নিরক্ষরতা দূর করতে যত্নবান হয়।
দীপশিখা থেকে দীপশিখা, জ্ঞানদীপ থেকে জ্ঞানদীপ!
শিবনাথ মাস্টার বলেন ‘‘প্রত্যেকের মধ্যেই প্রদীপ আছে, আছে তেল সলতে, শুধু একটু জ্বালিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। দেওয়ালির আলোর মতো একের থেকে হাজার প্রাণের আলো উঠবে জ্বলে। সেই আলোর আগুনে ভস্মীভূত হবে, দেশের অজ্ঞানতা, নীচতা, সংকীর্ণতা। ভস্মীভূত হবে লোভ আর পাপ, ঈর্ষা আর স্বার্থ।’’
আদর্শবাদী ভাবুক মাস্টার এমন অনেক কথাই বলতেন, কিন্তু জীবনে তিনি তাঁর ইচ্ছার অনুরূপ আশ্রম গড়ে তুলতে পারেননি। মফসসল স্কুলের সেকেণ্ড মাস্টার, সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায়?
জীবনের আরম্ভ থেকেই শিবনাথ শিক্ষাব্রতী। কত ছেলেকে মানুষ করে চলেছেন। স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে মধ্যে সবাইকে বলেছেন নিজের এই আদর্শের কথা। বলেছেন ‘‘তোরা মানুষ হবি, কৃতী হবি, অবশ্যই অনেকে ধনী হবি। তখন মনে রাখবি তো আমার কথা? জানিস তো দশের তিল একের তাল! যারা যারা কৃতী হবি, ধনী হবি, আমার আশ্রমের জন্যে কিছু কিছু যদি দিস, তাতেই আমার স্বপ্ন সফল হবে।’’
সব ছেলে বলেছিল ‘‘নিশ্চয় দেব স্যার, নিশ্চয় দেব।’’
কিন্তু আজপর্যন্ত আর সেস্বপ্ন সফল হয়নি শিবনাথ মাস্টারের। তাঁর সেই প্রথম জীবন থেকে যাদের মানুষ করে এলেন, তারা ‘মানুষ’ আর হল কই? তারা অনেকেই আজ সত্যই কৃতী, ধনী, বিখ্যাত। কিন্তু ছেলেবেলার সেপ্রতিশ্রুতি আজ আর কারও মনে নেই। আর যদিও বা স্মৃতির রোমন্থনে কোনোদিন মনে পড়ে যায়, হয়তো হাস্যকর ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না সেপ্রতিশ্রুতিকে।
তাই নিজের সাধ্যাতীত সাধ্যে কয়েকটি দুঃস্থ ছেলেকে বাড়িতে জায়গা দিয়ে রাখেন মাস্টার, বিনা মাইনের স্কুলে পড়তে দেন। স্কুলের গন্ডি পার হলেই তাদের ছেড়ে দিতে হয় বাধ্য হয়ে।
একদল যায় আর একদল আসে।
তারাই মাস্টারমশাইয়ের গৃহিণীহীন গৃহে ভাত রাঁধে, জল তোলে, বাটনা বাটে, কুটনো কোটে।
ভাগ্যের কাছে সব রকমেই পরাজয় মাস্টারের। সাধ ছিল এই ছেলেদের মায়ের মতো হয়ে সেবা যত্ন করবেন তাদের ‘গুরুমা’। কিন্তু তিনিও রইলেন না। বিধবা মেয়েটা পর্যন্ত, যে মেয়ে বাপের আদর্শে জীবনকে গড়তে চেয়েছিল, যে এই সব দুঃখী ছেলেদের মায়ের মতো হতে পারত, সেও গেল।
শুধু মরুভূমিতে ওয়েশিস আছে ফুলি।
তা প্রথম দিকে ফুলিও প্রায় মানুষ হয়েছে, ওই ছেলেদেরই হাতে। এখন অবিশ্যি ফুলি বারো তেরো বছরের হয়ে উঠেছে। আর হয়ে উঠেচে রীতিমতো একটি গিন্নি।
আগের দলেরা ফুলিকে মানুষ করে গেছে, বর্তমানের দলকে ফুলিই মানুষ করছে।
রাসমণি চেঁচাচ্ছিল।
চেঁচাচ্ছিল কানুর উদ্দেশ্যে!
‘‘হাড়হাবাতে হতচ্ছাড়া ছেলে এখনও এল না গো! এত বড়ো ঝড় জল হয়ে গেল, ভয় ডর নেই প্রাণে? আচ্ছা একবার তো ফিরতে হবে বাড়িতে, তখন কী করি দেখাচ্ছি। তাকে যদি জ্যান্ত ধরে ‘চন্ডীতলা’য় দিয়ে না আসি তো আমি—’’ অকথ্য একটি দিব্যি গালে রাসমণি।
বলাবাহুল্য ‘চন্ডীতলা’ হচ্ছে এ অঞ্চলের শ্মশান।
কানুর মা কমলা শুনতে পেয়ে বিরক্তস্বরে বলে, ‘‘ভর সন্ধ্যাবেলা ওসব কি ছাই-ভস্ম গাল পাড়ছ ঠাকুরঝি?’’
প্রতিবাদ শুনেই ঠাকুরঝি রাসমণি আক্রমণের টার্গেট বদলায়। মুখ বিকৃত করে বলে, ‘‘এই যে এলেন রাঙের রাধা! ছেলে শাসন করতে জানেন না, জানেন খালি আদর দিতে, আর গেলাতে। আমি মা হলে অমন ছেলেকে জ্যান্ত গোর দিতাম।’’
‘‘কী বললে?’’ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে কমলা।
‘‘ঠিক কথাই বলেছি।’’ রাসমণিও সমান তীক্ষ্ণস্বরে উত্তর দেয়।
‘‘তা-বলবে বই কী—’’ বলে কমলা আঁচলটা হঠাৎ কোমরে জড়াতে থাকে।
কমলা কথা কম কয়, কিন্তু দৈবাৎ যখন মুখ খোলে তখন তার কথার ধারটা রাসমণির প্রাণে ছুরির মতোই কাজ করে।
কোঁচড়ে আমের বস্তা নিয়ে খিড়কির দরজায় উঁকি মারছিল কানু। ভেবেছিল চুপি চুপি ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে দাওয়ায় আমগুলো ঢেলে দিয়ে দোতলায় পালাবে। কিন্তু উঁকি মেরে দেখল উঠোনের অবস্থা ভয়াবহ।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে বড়ো বড়ো এক একটা গাছ বসানো উঠোনটা যেন জমাট অন্ধকারের পাহাড় একটা, তার মাঝখানে তুলসীমঞ্চের কুলুঙ্গিতে মাটির প্রদীপের ক্ষীণ শিখাটা কেঁপে কেঁপে একটা আলো আঁধারের সৃষ্টি করছে।
এ যেন আলো নয়,, আলোর দৈন্যের চরম প্রকাশ। আবার দালানে বসানো হ্যারিকেন লন্ঠনটাও তদ্রূপ। রাসমণির কড়া হুকুমে ‘চোখের কাজে’র দরকার ছাড়া, সর্বত্র সব সময় বাড়ির হ্যারিকেন লন্ঠনের শিখাগুলো ক্ষীণ করে রেখে দেওয়া হয়।
প্রায় নিস্প্রদীপের মহড়া!
ঝগড়া কোঁদলটা চোখের কাজ নয়, কাজেই দালানের ওপর বসানো হ্যারিকেনটাও আলোর চাইতে অন্ধকার সৃষ্টি করছে বেশি।
আর এই অন্ধকারের মধ্যে প্রেতিনীর মতো দুটো মানুষ চেঁচাচ্ছে।
মুখটা একটু বাড়িয়েই কানু আবার টেনে নিল, শুনতে পেল কমলা বলছে, ‘‘তুমি মা হলে ছেলেকে জ্যান্ত গোর দিতে তা আমিও জানি ঠাকুরঝি! পিসি হয়েই যখন এই! তা তুমি যার মা হবে এমন দুর্ভাগাকে গড়তে ভগবানেরও বোধ হয় প্রাণ কেঁদেছে, তাই গড়েনি।’’
বন্ধ্যা রাসমণি এই কটাক্ষে ধেই ধেই করে নেচে ওঠে, ‘‘কী বললি? কী বললি নতুনবউ? এতবড়ো আসপদ্দা তোর? কেনোর মতোন ছেলে আমার হলে জ্যান্ত গোর দেওয়া কেন, জ্যান্ত দাঁড় করিয়ে করাত দিয়ে চিরতাম। বুঝলি? গাল দেব না! একশোবার দেব, হাজার বার দেব। কেউ এসে খবর দিয়ে যায়, কেনো বাজ পড়ে মরেছে, তো আমি এখুনি শ-পাঁচ আনার হরির লুঠ দেব।’’
এমনিই মুখ রাসমণির।
আবার ওই কানুরই দু-দিন অসুখ করলে রাসমণি তিনমাইল রাস্তা হেঁটে চন্ডীতলায় ‘হত্যে’ দিতে যায়, চন্ডীতলার ‘পাগলাবাবার’ কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ে। বংশাবলির ধারানুক্রমিক অশিক্ষা আর কুশিক্ষাই তাকে এমনি রূঢ় আর অমার্জিত করে রেখেছে।
কিন্তু সেসব কথা বোঝবার ক্ষমতা বালকের থাকে না।
মা-পিসির ব্যবহারে কানু তিক্ত উত্যক্ত। তার ওপর আছেন বদমেজাজি দুর্দান্ত বাপ, আর ধূর্ত ফিচেল এক কাকা। কানুকে শাসন করাই যেন কানুর কাকার জীবনের পরম আনন্দ, চরম সার্থকতা।
কে বলবে কেন? হয়তো এরজন্যে কেবলমাত্র তার প্রকৃতিই দায়ী।
রাসমণির আস্ফালনে কমলা আবার বলে ওঠে, ‘‘যাকে বলো ‘মর মর’, সেপায় দেবীর বর। তোমার গালাগালে আমার ছেলের কিছু হবে না, বুঝলে ঠাকুরঝি? শুধু তোমার মুখেই পোকা পড়বে।’’
আমের ভারে কোঁচার কাপড় ফাঁসছে টের পাচ্ছে কানু। এখনও এইবেলা এগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে বাড়ির মধ্যে এনে ফেলতে না পারলে নির্ঘাত ছিঁড়ে ছড়িয়ে সব বরবাদ যাবে। আনাচে কানাচে নোংরা জায়গায় পড়লে তো আর রাসমণি নেবে না। আর রাসমণিই যদি না নিল, কাঁচা আমগুলো নিয়ে হবে কী?
বাড়ির ভয়াবহ শাসন, আর প্রকৃতির ভয়াবহ আক্রমণ, এই দুটো স্বীকার করে নিয়ে, এককথায় প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে, এই আমের ভরা ভারী করবার নেশা কেন এদের?
অবাধ্য দুঃশাসন ছেলেগুলো নিজেরাই কি জানে কেন? আম কুড়োনো শুধুই কি ফুর্তির উদ্দন্ড প্রকাশের সুযোগ? ঠিক তাও নয়। বোধ করি ওদের দশাও রাসমণির মতোই। যেন ‘মর’ বলে গাল দিয়ে তারই কল্যাণ কামনায় দেবদুয়ারে হত্যা দিতে যাওয়া।
গুরুজনদের দেখলে ওদের গা জ্বালা করে, তবু মনের তলায় তলায় লুকোনো থাকে তাদের কাছ থেকে এতটুকু সপ্রশংসদৃষ্টি পাওয়ার লোভ।
রাসমণি যখন লুব্ধ আর উজ্জ্বল চোখ মেলে বলবে—‘‘ওমা! কত আম এনেছিস কানু!’’ তখনই তো এত কষ্টের পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল। কানু অবিশ্যি অবহেলাভরে উত্তর দিয়ে যাবে—‘‘আরও কত—ছিল, নিলাম না! কী হবে নিয়ে’’—তবু সেই উদাসীনতার অন্তরালে কন্ঠস্বরের পুলকটুকু গোপন থাকবে না।
ফুলচুরি, মাছচুরি, আম ডাকাতির ভেতরের ইতিহাস এই। ওই প্রশংসা দৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। শিশুরা সহজেই তাদের ওপরওয়ালাদের লোভ আর নীতিহীনতাকে ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু ক-জন অভিভাবক এসব বোঝে? নিজেদেরকে তৈরি করতে জানে না, তৈরি করতে যায় সন্তানকে। উচিতক্ষেত্রে শাসন হয় না, অথচ অসংগত শাসনে শাসনে কচি মনের এই অবোধ কোমলত্বটুকু ক্রমশ নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ফলে বস্তুহীন ভোঁতা ছেলেমেয়েগুলো হয়ে ওঠে ভীতু, মিথ্যাবাদী, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আর বস্তুসম্পন্ন তীক্ষ্ণ ছেলেমেয়েগুলো হয় বেপরোয়া, বিদ্রোহী, অবাধ্য।
কী আশ্চর্য!
এরা চেঁচাতে চেঁচাতে একবার নড়ছেও না তো! বরং কমলা যেন আরও গলা বাড়িয়ে আছে, আরও শক্ত কিছু বলবে বলে। আর রাসমণি দু-হাত তুলে ঝাঁপাই ঝুড়ছে, ‘‘কী বললি? আমার মুখে পোকা পড়বে? আসুক আজ দাদা, দেখাচ্ছি তোর মজা।’’
কমলা দাশু মিত্তিরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, তাই সাহস বেশি। সেঅগ্রাহ্যভরে বলে, ‘‘তোমার দাদা তো আমার সব করবে!’’
আড়াল থেকে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে কানু। দুর দুর, এদের জন্যে আবার কষ্ট করে আম আনা! রাস্তার ধারে ফেলে দিয়ে এলেই আপদ চুকে যেত। এই কুঁদুলি দুটোর হাতে দেওয়ার চাইতে গোরুকে খাওয়ানো ভালো ছিল। মা কানুর যতই পৃষ্ঠপোষক হোক, মাকেও দু-চক্ষে দেখতে পারে না কানু। মা-পিসি দু-জনকেই মনের একই স্তরে রাখে। ঝগড়া আর ঝগড়া! থাকতে ইচ্ছে করে না বাড়িতে। আবার এও দেখা যাবে এই ঝগড়ার ফাঁকে ফাঁকেই দু-জনে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে, এক ঘণ্টা ধরে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে বসে দিব্যি চচ্চড়ির ডাঁটা চিবিয়ে চিবিয়ে ভাত খাচ্ছে এক কাঁড়ি করে। আর কোথাও কোনোখানে যাওয়ার দরকার হলে, মেলায় কী ঠাকুরবাড়িতে, যাত্রাগান কী পাঁচালিতে, সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কমলা রাসমণির পায়ে পায়ে ঘুরছে।
এ এক অদ্ভুত আশ্চর্য!
কানু ঠিক জানে, যে আম নিয়ে এত কান্ড, ঠিক সেইগুলোই, পিসি যেই দেখবে হুমড়ে পড়বে তার ওপর। আর তখনই ছাড়াতে বসবে বঁটি নিয়ে। আর এও জানে, মা দিব্যি প্রসন্নমুখে লংকা মেথি গুঁড়োতে গুঁড়োতে জিজ্ঞেস করবে—‘‘সবগুলোই ‘তেল আম’ হবে, না গোটাকতক ‘গুড় আম’ করবে ঠাকুরঝি?’’
রাসমণি বলবে ‘‘গুড় আমসিও করব দু-খানা। ‘কেনো’ ভালোবাসে মিষ্টি আচার।’’
অথচ এও নিশ্চিত, সেই গুড় আমসি ছোঁওয়ার অধিকারও থাকবে না কানুর। নেহাত চুরিচামারি করে যেটুকু যা জোটে। তাও সেচুরি ধরতে পারলে আর রক্ষে নেই। ‘আচার’ নাকি অনাচার হয়ে গেলেই পচে যায়! আর কানু হাত দিলেই নাকি অনাচার!
বোঝো!
অথচ বলা চাই ‘‘কানু ভালোবাসে তাই করা’’।
দুর দুর! বড়োদের মতো মিথ্যেবাদী যদি পৃথিবীতে আর কেউ থাকে। কানু তার এই পনেরো বছরের জীবনে শুধু এই দেখে এল। বড়োরা শুধু যা খুশি করবার আর যা খুশি বলবার কর্তা! আর কোনো গুণ নেই ওদের শরীরে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকত মেজাজ যারপর নাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল কানুর। দুরছাই, ফুলিটা যদি আচার তৈরি করতে পারত, তো সব আমগুলো ওকেই দিয়ে আসত কানু। তারপর ছুটির দিনে এক খাবলা করে নিয়ে দু-জনে ওদের চিলেকোঠার ছাদে উঠে তারিয়ে তারিয়ে—আহা!
কিন্তু না:। ফুলিটা কোনো কর্মের নয়। অতবড়ো ধিঙ্গি মেয়ে হল, এখনও আমের আচার করতে শিখল না। আবার পাকামাটিও আছে। ও আম কুড়োতে যায়নি বলে খুব রাগ হলেও দয়াধর্ম করে চারটি দিতে গিয়েছিল কানু, তা নিতেই চায় না। বলে, ‘‘আমাদের অত কাঁচা আম কী হবে? আমাদের নন্দদা যা আমের টক রাঁধে, হি—হি—হি, একদিন খেলে জন্মের শোধ আমের টক খাওয়ার বাসনা ঘুচে যায়।’’
সব বাজে কথা, আসলে না নেবার ফন্দি।
কেন নুন লংকা দিয়ে এমনি খাওয়া যায় না? সেই কথাই বলে অনেক ‘ইয়ে’ করে গোটাকতক গছিয়ে দিয়ে এসেছে মাত্র। বড়ো তাড়াতাড়ি গিন্নি হয়ে যাচ্ছে ফুলিটা! মনে হয় যেন কানুর চোখের আড়ালে কোন অদৃশ্য পথ ধরে ছুট ছুট করে কোথায় দৌড় মারছে ফুলি, ক্রমশই কানুর নাগালের বাইরে চলে যাবে। মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়।
কমলা রাসমণির কোঁদলে ছেদ পড়ল। অধৈর্য কানু এবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
বিনা বাক্যব্যয়ে—কোঁচড় থেকে গুরুভার দ্রব্যগুলো ঢেলে দাওয়ায় নামিয়ে দিয়ে কোঁচার ছেঁড়াটা ঢাকতে ঢাকতে ঘরে ঢুকে গেল।
ঝগড়া থামিয়ে চিৎকার করে ওঠে রাসমণি, ‘‘এই যে গুণের গোপাল এলেন! তোমার দিব্যি দিচ্ছি নতুনবউ, যদি ছেলেকে এখন সোহাগ করে মুড়কির মোয়া খেতে দেবে! ও ছেলেকে তিনবেলা উপোস দিয়ে রেখে দিলে তবে জব্দ!……ওমা! কী সর্বনাশ! এত আম? এত আম কুড়িয়েছে মুখপোড়া!’’ রাসমণির কন্ঠে পুলক গোপন থাকে না—‘‘এ যে কাছারির বাগানের আম মনে হচ্ছে! আহা কী রূপ আমের! শিগগির একটা ঝুড়ি এনে ঘরে তুলে ফেলো নতুনবউ, দাদা দেখলে আর রক্ষে রাখবে না।’’
ঘর থেকে উঁকি মেরে দেখে কানু।
ছেলেকে মুড়কির মোয়া খাওয়ানোর বাসনা তো কই দেখা যায় না কমলার! বরং ঠাকুরঝির নির্দেশ পালন করতেই তৎপর হয়ে ওঠে। চটপট একটা ঝুড়ি এনে তুলতে থাকে, আর অনবরত তাজা মটমটে আমগুলো বেছে বেছে আলাদা করে রাখতে থাকে।
কাঁচা আমে ভারি লোভ কমলার, কিন্তু অম্বলের রুগি বলে ওসব খাওয়ার অনুমতি নেই তার। তবু কমলা কুপথ্য করে লুকিয়ে চুরিয়ে। কানু তার সাক্ষী, মাঝে মাঝে কানুই কুপথ্যের সংগ্রহকারক। কানুকে অবশ্য কমলা নিজের দলের বলেই মনে করে, তাই ওর কাছে লুকোয় না। কিন্তু কমলা জানে না মায়ের এই ক্ষুদ্র আচরণ ছেলেকে তার কী পরিমাণ ক্ষিপ্ত করে তোলে। কানু মায়ের আদেশ হয়তো পালন করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাকে ঘৃণা করতে শেখে। যে ছেলেকে সেনিজের দলের ভেবে পরম নিশ্চিন্ত, সেছেলে যে ভেতরে ভেতরে ক্রমশই দলছাড়া গোত্রছাড়া হয়ে চলেছে ও বোঝবার বুদ্ধি কমলার নেই।
কিন্তু কেন খেপে যাবে না কানু?
একদিন কানু পেট খারাপের ওপর পেটের জ্বালায় লুকিয়ে বাগানে পাতা জ্বেলে হাঁসের ডিম সেদ্ধ করে খেয়েছিল বলে কী লাঞ্ছনাটাই হয়েছিল তার! বাবা বলেছিলেন—‘‘ওর জন্যে যদি কেউ ডাক্তার খরচ করতে বলে তো, দাশুমিত্তির তাকেই ধরে ঠ্যাঙাবে’’। পিসি বলেছিল—‘‘এতখানি বয়সে এত-এত বদমাইশ ছেলে দেখেছি, কেনোর মতো এতবড়ো ফিচেল বদমাইশ ছেলে দেখিনি। বাগানে গিয়ে নিজে রেঁধে খাওয়া! কী বুকের পাটা!’’ কাকা বলেছিল মিচকে মিচকে হেসে—‘‘হেঁসেলের ভারটা এবার থেকে আমাদের কানুবাবুর হাতেই তুলে দেওয়া হোক না? রান্নাবান্না যখন সবই শিখে ফেলেছে! আর এর পর ওই রাঁধুনিগিরি কী চাকরগিরি করেই তো খেতে হবে! তা ছাড়া ওর হবে কী!’’
আর মা, ওই হাড়জিরজিরে অম্বলের রুগি কমলা, যে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, আর তাজা মটমটে আমগুলো কোঁচড়ে পুরছে, সেচেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল ‘‘এ্যাঁ! আমার গর্ভে এমন ‘লুভিষ্টে’ ছেলে জন্মেছে! দেখে যে আমার বিষ খেতে ইচ্ছে করছে গো!’’
কোন মুখেই যে কথা কয় বড়োরা!
ছোটোদের ওরা ভাবে কী? অবোধ, অজ্ঞান, হাবা-গোবা? অথচ বড়োদের কাজে আর কথায় অসংগতির নির্লজ্জতাটা যে ছোটোদের চোখেই আগে ধরা পড়ে, এ বোধ ওদের নিজেদেরই নেই।
কানু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, জন্মেও আর আম কুড়োবে না। নয়তো— যদি কুড়োয়, সেগুলো মুনশি পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে আসবে।
রাতে খবরটা কেউ টের পায়নি।
ভোরেও নয়।
চনচনে বেলায় কে যেন গঞ্জের হাটে যাওয়ার জন্যে শর্টকাট করতে চন্ডীতলার পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সেই এসে খবরটা রাষ্ট্র করল। গঞ্জের হাটে সওদা করতে যাওয়া তার মাথায় উঠেছে, সেএখন প্রত্যক্ষদর্শীর অপার গৌরব নিয়ে টাউনের মধ্যমণি হয়ে বেড়াচ্ছে।
প্রথমটা ফিসফিস, তারপর চাপা আন্দোলন, শেষ অবধি আর সামলানো গেল না। আগুনের হলকার মতো সারাশহরে ছড়িয়ে পড়ল খবরটা।
কালকের ঝড়ে চন্ডীতলার পাগলাবাবা বাজ পড়ে মারা গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একই রিপোর্ট একশোবার পেশ করতে করতে ক্রমশ কাহিল হয়ে পড়ছিল। তবু বলতে হচ্ছে তাকে। ভয়ানক, বীভৎস, শোচনীয়, মর্মান্তিক, এই সব শুনতেই তো মানুষের সবচেয়ে আনন্দ! শোনবার জন্যে হাঁ করে থাকে একেবারে।
‘‘অমুকের ছেলেটি ভালো করে পাশ করেছে’’—এ শুনতে আর কী এত আমোদ? ‘‘অমুকের ছেলেটি যে মারা গেল—’’ এ শুনলে কানখাড়া করে ছুটে আসবে সবাই। এই স্বভাব মানুষের!
পাগলাবাবা সকলেরই পুজ্য ছিলেন। কিন্তু পাগলাবাবার এই শোচনীয় অপঘাত মৃত্যুর খুঁটি-নাটি বিবরণীটি ফেনিয়ে ফেনিয়ে শোনবার জন্যে সকলেই উদগ্রীব।
লোকটা বলছিল—‘‘টের পেত না কেউ, অমনি পোড়াকাঠ হয়ে পড়ে থাকতেন। বজ্রাঘাতের মড়া শেয়াল শকুনেও ছুঁত না। বিধাতার নির্দেশ, আমার কেমন মনে হল এতটা এসেছি তো আর একটু ঘুরে একটা পেন্নাম ঠুকে যাই।……উঃ গিয়ে সেকী দৃশ্য! এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!’’
দৃশ্য এই, চন্ডীতলায় মড়াপোড়ানো ঘাটের ঠিক ডানদিকে যেখানে পাগলাবাবার আস্তানা ছিল, সেইখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন তিনি, কাঠের মতো শক্ত আর পোড়া কয়লার মতো দেহটা নিয়ে!
রাত-বিরেতে ঝড়বৃষ্টিতে শ্মশানযাত্রীদের বসবার জন্যে যে ঘরটা বানানো আছে শ্মশানের ধারে, পাগলাবাবাও তো ঝড়েজলে সেখানটার উঠে যেতেন, কালকের সেই প্রবল ঝড় বিদ্যুতের সময় বাইরে ছিলেন কেন, এই এক রহস্য!
পাগলবাবার মনও কি এই ঝড়ের মাতনে পাগলা হয়ে উঠেছিল কাঁচা আম কুড়োতে? তাই বেরিয়ে পড়েছিলেন ‘মা চন্ডী’র ফল বাগানের উদ্দেশ্যে?
ফিসফিসানি চাউর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই বজ্রাহত! পাগলবাবার এ কী পরিণতি।
দেশসুদ্ধ লোকের ভয়ভক্তির পাত্র ছিলেন যিনি, ছিলেন ভূত-ভবিষ্যৎ বক্তা, যিনি নাকি—আগুনের উপর দিয়ে হাঁটতে পারতেন অবলীলায়, শূন্যপথে উড়ে যেতে পারতেন, পারতেন মরাকে বাঁচাতে, জ্যান্তকে মন্ত্র পড়ে ভস্ম করতে, শ্মশান থেকে মরামানুষের খুলি খুলে নিয়ে গিয়ে যিনি ঝুলিতে জমাতেন মদ খেতে, সেই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাগলাবাবার এই পরিণাম!
এত লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ গুণে দিয়েছিলেন পাগলাবাবা, শুধু নিজের ভবিষ্যৎটাই গুণতে ভুলে গিয়েছিলেন?
‘‘ব্রহ্মশাপ?’’
‘‘ব্রহ্মশাপ না থাকলে বজ্রাঘাত হয় না!’’ ‘‘নিশ্চয় পূর্বজন্মের কোনো মহাপাপে—! ‘‘আমাদের একটা মস্ত ভরসা গেল! ছেলেপুলের রোগ অসুখ হলেই ছুটে গিয়েছি। আহা যতদিন ছিলেন দেশে একটা বিপদ আপদ হয়নি।’’…
কথাটা অবশ্য খুব ঠিক নয়, সাত আট বছর ধরে এখানে রয়েছেন পাগলাবাবা, বিপদ সম্পদ যা হওয়ার ঠিকই হয়ে চলেছে, কিন্তু বেশি আবেগের সময় এমন কথা বলেই থাকে লোকে, আর সেসময় কেউ প্রতিবাদও করে না।
চন্ডী-ভক্তেরা আবার মা চন্ডীকে দুষছেন। ‘‘মা চন্ডী! একী করলি?
তুই তো জাগ্রত মা, তবে সন্তানকে রক্ষে করতে পারলিনে?’’
স্কুল খোলা থাকলে আজ স্কুলের নাম-ডাকা খাতায় নামের পাশে সব ছেলেরই ঢেরা পড়ত নিশ্চিত, গ্রীষ্মের ছুটি আছে তাই কামাইয়ের দায়ে রক্ষা! কিন্তু অনেকগুলো ছেলেই আজ স্কুলের মাঠে গিয়ে জমা হয়েছে। শলা ষড়যন্ত্র করতে জায়গাটা ভালো। ছুটির সময় দিব্যি নির্জন নির্জন!
বাড়িতে জানলে কেউ অনুমতি দেবে না নি:সন্দেহে, তাই চুপি চুপি বেরিয়ে পড়বার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বলাবাহুল্য নির্বাচিত গম্যস্থলটা হচ্ছে চন্ডীতলা। সকাল থেকে শোনা তো হল ঢের, কিন্তু সেই অদ্ভুত অপূর্ব দৃশ্যটা তো দেখা চাই! কে জানে জীবনে আর কখনো বাজে-পোড়া মড়া দেখবার সৌভাগ্য হবে কি না। সকাল থেকে কাতারে কাতারে লোকও যাচ্ছে সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে। স্কুলের এই উৎসাহী ছেলে ক-টাই বা বঞ্চিত থাকবে কেন?
কিন্তু মাঠে এসে অনেকেরই সাহস হয়ে যাচ্ছে, কারণ হিসেব হচ্ছে এই বিকেলবেলা বেরোলে যত ছুটেছুটেই যাওয়া আসা হোক, সন্ধ্যার আগে ফেরার সম্ভাবনা নেই। বরং হয়ে যাওয়াটাই সম্ভব।
অনেকগুলি উৎসাহীই খসল।
তারা ম্লানমুখে বলল, ‘‘দেরি হয়ে গেলেই বাড়িতে টের পাবে। আর তাহলেই তো ভাগ্যে যা ঘটবে—’’
কানু এদের দলের সর্দার, সেবিরক্তভাবে বলে, ‘‘ভাগ্যে নতুন আবার কী ঘটবে শুনি? খানিক পিটনচন্ডী, এই তো? মেরে তো আর ফেলবে না? আর ফেললেই বা দুঃখু কী? মরে গেলে তো ফুরিয়ে গেল, ওদের হাত এড়িয়ে সগগে চলে যাব, ভালোই হবে।’’
এহেন আশ্বাসবাণীতেও কিন্তু বিশেষ আগ্রহ কেউ দেখায় না। তাদের মুখ দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় আপাতত স্বর্গসুখের বাসনা তাদের প্রাণে তেমন জোরালো নয়।
শেষপর্যন্ত সংকল্পে স্থির থাকল জনা চারেক। কানু তো আছেই, সেতো বলেছে কেউ না গেলেও সেযাবে, কারণ তার নাকি সেখানে যাওয়া অবশ্য অবশ্য দরকার। তা ছাড়া টিকে রইল রমেশ, সত্যশরণ আর নীরেন।
সত্যশরণ আবার ওরই মধ্যে একটু বোকা-বোকা, সেহঠাৎ ফট করে বলে বসে, ‘‘যাবার জন্যে তোড়জোড় তো দেখছি কানুরই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু পাগলাবাবার জন্যে কানুর কিছু দুঃখু দেখছি না।’’
রমেশ জানে কানু বদরাগি, কীসে কী হয় বলা যায় কী, সেতাড়াতাড়ি বলে, ‘‘না, দুঃখু দেখছিস না! কী যে বলিস! বলে পৃথিবীসুদ্ধু লোকের দুঃখু হল—’’
কানু কিন্তু একেবারে উলটো গেয়ে চমকে দিল বেচারা রমেশকে। মুচকে হেসে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘‘পৃথিবীসুদ্ধু লোকের দুঃখু হলেও আমার হয়নি। সতে ঠিকই বলেছে।’’
রমেশ নীরেন আহত বিস্ময়ে বলে, ‘‘তোর দুঃখু হয়নি?’’
‘‘না:! কেন এতে আবার দুঃখু কষ্ট কীসের?’’
‘‘তবে যাচ্ছিস যে?’’
বোকার মতো বলে ওরা।
কানু আর একটু মুচকি হাসি হেসে বলে, ‘‘যাচ্ছি তোদের শোকে সান্ত্বনা দিতে।’’
সত্যি বলতে, কানুকে সকলেই একটু ভয়ভয় করে, কাজেই আর বেশি কথা তোলে না। কী জানি বাবা, কী ওর খেয়াল! পাগলাবাবার এমন দুঃখাবহ মৃত্যুতেও দুঃখকষ্টের কারণ যে খুঁজে পায় না, সেআবার তাদের শোকে কী সান্ত্বনা দেবে, সেও তো বুদ্ধির অগম্য।
খানিকটা গিয়ে রমেশও বলে বসে, ‘‘যাচ্ছি তো— কিন্তু ভাবছি—’’
‘‘কী ভাবছিস?’’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে কানু।
‘‘ভাবছি শ্মশানটশান জায়গায় সন্ধে হয়ে যাবে—’’
‘‘তবে আর কী, ভূতে খেয়ে ফেলবে তোকে! যা বেরো, যেতে হবে না,
মার কোলে শুয়ে দুধ খেগে যা।’’
‘‘আহা তা নয়! মানে—’’
‘‘মানেফানে রেখে দে! তোর মানের ধার কে ধারে? ফুলিটারও আজকাল এইরকম পাকামি হয়েছে, ডাকতে গেলাম, এল না। বলে, ওমা! এই অবেলায় তোমরা শ্মশানে যাচ্ছ— তোমাদের কি ভয়ডর নেই?’ দেখতে পারি না এই সব পাকামি।’’
ফুলি!
‘‘ফুলিকে ডাকতে গিয়েছিলি?’’ সত্যশরণ অবাক হয়ে বলে ওঠে, ‘‘ফুলি যাবে আমাদের সঙ্গে চন্ডীতলায়?’’
‘‘কেন? যাবে না কেন?’’ কানু ভুরু কুঁচকে বলে, ‘‘ফুলির পা নেই?
তোর চেয়ে ফুলি বেশি হাঁটতে পারে, বুঝলি?’’
সত্যশরণ গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘হাঁটার কথা হচ্ছে না। মেয়েমানুষ আবার আমাদের সঙ্গে অত দূরে যাবে কী?’’
‘‘মেয়েমানুষ তা কী?’’— দস্তুরমতো ঝেঁকে ওঠে কানু— ‘‘মেয়েমানুষ মানুষ নয়? ওই রকম করেই তো শেষ অবধি মেয়েমানুষগুলো পেতনি হয়ে ওঠে। যেমন হচ্ছে ফুলিটাও।’’ জোরে জোরে পা চালায় কানু।
‘‘কানুটা কী রাগি বাবা!’’
রমেশ তার সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে মন্তব্য করে। আর বোকা ইয়ার সত্যশরণ বলে বসে ‘‘হুঁ’’, তারওপর আবার ফুলির কথা!’’
কানু চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ল, সন্দেহভাবে বলল, ‘‘ফুলির কথা তা কী?’’
‘‘কিছু না এমনি।’’
ভয় পেয়ে নিরীহ ভাব দেখায় সত্যশরণ। কিন্তু কানুর কাছে রেহাই নেই। সেক্রুদ্ধভাবে বলে, ‘‘এমনি মানে? বল ও কথা বললি কেন?
সত্যশরণ ব্যাপারটাকে গুরু থেকে লঘুতে আনবার প্রয়াসে ফিক করে হেসে ফেলে বলে, ‘‘আহা যেন বোঝেন না কিছু!’’
পড়ন্ত রোদে তাড়াতাড়ি হাঁটার এমনিতেই মুখ লাল হয়ে উঠেছিল কানুর, এর ওপর প্রচন্ড রাগে গনগনে আগুনের মতো দেখায়। কে জানে ফুলির উল্লেখে ওর অত রাগ কেন! হঠাৎ সেঘুরে দাঁড়িয়ে সত্যশরণের গালে ঠাশ করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে, ‘‘ফের বলবি ও কথা? বল শিগগির।’’
চড় খেয়ে চড়ে উঠবে না, এত নিরীহ তা বলে সত্যশরণ নয়। সেএক ঝটকায় সরে গিয়ে বলে, ‘‘বলবই তো! একশোরবার বলব, হাজারবার বলব। সবাইকে বলে দেব, দেখিস তখন মজা!’’
কানু তেড়ে এসে প্রায় বাঘের মতন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, ‘‘বলে দিবি মানে? কী বলে দিবি? বল কী বলে দিবি?’’
‘‘কিছু না কিছু না—’’ চিৎকার করে ওঠে সত্যশরণ, ‘‘ওরে বাবারে ঘাড় কামড়ে ধরেছে—’’
রমেশ আর নীরেন কোনোপ্রকারে ছাড়িয়ে নেয় দু-জনকে, কিন্তু এইটুকুর মধ্যেই খন্ডপ্রলয় হয়ে গেছে। দেখা গেল সত্যশরণের শার্টের এক টুকরো কানুর দাঁতে উঠে এসেছে, আর সত্যশরণের সেই কামড়ের জায়গায় রক্ত ফুটে উঠেছে।
‘‘ছি ছি কী করলি বল দেখি’’—রমেশ আপোশের চেষ্টা করে— ‘‘শুধু শুধু আরও বেলা চলে গেল। নে এখন চল!’’
কিন্তু সত্যশরণ তখন ফিরে দাঁড়িয়েছে। বোকারা যখন রাগে তখন গোঁয়ার হয়ে ওঠে। ও বুনো ঘোড়ার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘‘যাব? ওই কেনো রাসকেলের সঙ্গে ফের যাব আমি? দাঁড়া না— এখুনি গিয়ে ওর কীর্তি দেখাচ্ছি ওর বাবাকে।’’
নাগালের বাইরে গিয়ে ভেংচি কেটে সত্যশরণ শাসিয়ে যায়, ‘‘কপালে তোর আজ কী দুর্গতি জোটে দেখিস!’’
হ্যাঁ, কপালে সেদিন অনেক দুর্গতিই জুটেছিল। কিল, চড়, লাথি, গাঁট্টা, খেতে না দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখা প্রভৃতি ছেলে শাসনপদ্ধতির কোনো বিধিই বাকি রাখেননি বদমেজাজি দাশু মিত্তির। পরের ছেলের ঘাড়ের রক্তবিন্দুটি দেখে তাঁর দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দু জ্বলে উঠেছিল।
তবু এসবে আজ আর কাবু করতে পারেনি কানুকে। সব কিছু অনুভূতি ছাপিয়ে চন্ডীতলার শ্মশান আর পাগলাবাবার সেই বীভৎস মূর্তিটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে।
সারাদিনে দর্শক এসেছিল দেদার, কিন্তু সেই হুমড়ে পড়ে থাকা দেহটাকে তুলে ঘুরিয়ে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেউ করেনি। শুধু হা হুতাশ করেছে, আর উদ্দেশে একটা করে প্রণাম ঠুকে গেছে।
সেই প্রায়-উলঙ্গ বাজে-পোড়া দেহখানা সমস্ত দিনের রৌদ্রে কী কদর্য কালোই হয়ে উঠেছিল! মাছি উড়ছিল চারপাশে, আর খানিকটা দূরে গড়াগড়ি যাচ্ছিল সাধুর সম্বল লোহার চিমটে আর কাঠের কমন্ডলুটা। কিন্তু আরও একটি জিনিস যে সাধুর ওই ধুনির ভস্মের মধ্যে লুকোনো আছে সেকথা আর কে জানে, কানু ছাড়া?
কানু জানে! আর জানে বলেই তো এখানে আসার নিতান্ত প্রয়োজন ছিল ওর। জানে বলেই তো পাগলাবাবার শোচনীয় মৃত্যুর খবরেও ওর প্রাণে হাহাকার জাগেনি। কিন্তু কী হয়ে গেল! সমস্ত রাত শুধু সেই কথাই ভেবেছে কানু, না ঘুমিয়ে।
ওরা যখন পৌঁছেছিল, তখন বেলা পড়ে এসেছে, কৌতূহলী দর্শকের ভিড়ও কমে এসেছে, তবুও ছিল পনেরো-কুড়ি জন।
তাদের ঠেলেঠুলে, আর তাদের ‘হাঁ হাঁ’ করা প্রতিবাদ সত্ত্বেও সাধুর দেহটাকে ঘুরিয়ে শুইয়ে দিয়েছিল কানু।
যারা উপস্থিত ছিল তারা প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিল, ‘‘এ কী! এ কী! কী সর্বনেশে ছেলেরে বাবা! এই ভর সন্ধেবেলা বাজেপোড়া তান্ত্রিকের শবদেহ ছুঁল!’’
‘‘কে ও? দাশু মিত্তিরের ছেলে না?!’’
‘‘হুঁ! সাংঘাতিক ছেলে!’’
ছোঁয়ার দোষ বাঁচাতে সরে দাঁড়িয়েছিল সবাই, কিন্তু কানুর ওসবে দৃকপাত ছিল না। ও তখন আগ্রহব্যাকুল চিত্তে ধুনির ছাই হাতড়াছাচ্ছিল। বেশি হাতড়াতে অবিশ্যি হয়নি, ছাই তো আর ছাই ছিল না, কালকের বৃষ্টিতে কাদা হয়ে গিয়েছিল। সেই কাদার মধ্যে থেকে কালো চকচকে একটি শিলাখন্ড বার করে ফেলেছিল কানু, তিনবার নিজের কপালে ঠেকিয়ে আস্তে-আস্তে একবার ঠেকিয়েছিল পাগলাবাবার বুকে। উপস্থিত দর্শকরা অবাক হয়ে দেখছিল ছেলেটার কান্ডকারখানা। দেখল পাথরটা ঠেকিয়ে ছেলেটা —যাকে বলে বিস্ফারিত নেত্র—সেইভাবে তাকিয়ে রইল পাগলাবাবার অসাড় পাথরের মতো দেহটার দিকে। যেন অদ্ভুত কিছু, অলৌকিক কিছু আশা করছে পাগলাবাবার কাছে, কেমন যেন একটা নিশ্চিত আশার ছাপ তার মুখে!
তারপর ব্যাকুল হয়ে উঠল ছেলেটা, পাগলের মতো বারবার সেই পাথর-খন্ডটুকু ঠেকাতে লাগল নিজের কপালে আর পাগলাবাবার বুকে, বারবার কী এক প্রতীক্ষায় চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে থাকল। ক্রমেই যেন ভীষণ হয়ে উঠল তার মুখটা, ফুলে উঠল কপালের শিরা, আর অবশেষে পাথরটা দূর করে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হনহন করে চলে গেল ভিড়ের দিকে পেছন করে।
যারা চেনে না, তারা বলাবলি করতে লাগল—‘‘ছোঁড়াটা খ্যাপা নাকি?’’ যারা চেনে, বলল—‘‘উঁ হু’, ছেলেটা নিশ্চয় কোনোরকম তুকতাক শিখেছে, তাই তান্ত্রিকের শবদেহ নিয়ে কিছু ক্রিয়া করে গেল।’’
কিন্তু পাথরটার সন্ধান ও পেল কোথায়?
কে জানে, হয়তো বা পাগলাবাবার কাছে আসা যাওয়ার ছুতোয় লক্ষ করে রেখেছিল!
‘সিদ্ধশিলা’ বোধ হয়!
কিন্তু নিয়ে গেল না তো!
তাও তো বটে!
আচ্ছা অতটুকু ছেলে, ও আবার শিখবে কী?
কী জানি বাবা! তবু যাবার সময় কীভাবে চলে গেল দেখলে না? কারও মুখের দিকে না তাকিয়ে! কিছু তুকতাক না হলে—
তা সত্যি! তুকতাকের ব্যাপারেই এমনটা হওয়া সম্ভব।
তবে হয়তো বা পাগলাবাবাই কিছু শিখিয়েছিলেন। প্রায়ই আসত বটে ছোঁড়া এখানে।
হ্যাঁ, প্রায়ই আসত বটে কানু এখানে।
অলৌকিক রহস্যের প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ছিল তার। ছিল নিশ্চিত একটা বিশ্বাস।
ক্লাস পরীক্ষার আগে আর পরে, কিংবা কোনোকিছু ভুলভ্রান্তি করে ফেললে, আসবেই আসবে কানু। ফুলিও এসেছে আগে আগে ওর সঙ্গে।
পাগলাবাবার পদ্ধতি ছিল ছেলেপুলে দেখলেই প্রথমটা চিমটে নিয়ে তেড়ে আসা, সেদৃশ্য দেখলেই ভয়ে খানিকটা পালিয়ে আসত ফুলি। কিন্তু কানুর এসব পদ্ধতি মুখস্থ। সেগম্ভীরভাবে পকেট থেকে একটা আনি কী চারটে পয়সা বার করে প্রণামির ভঙ্গিতে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে নমস্কার করত দুটি হাত জোড় করে।
কটমট করে তাকিয়ে প্রণামি তুলে নিয়ে পাগলাবাবা যেন নিতান্ত কৃপাভরে বলতেন ‘বৈঠ’। তখন আবার ফুলিও গুটি গুটি এসে কানুর পেছনে বসত।
ধুনির আড়াল থেকে শিলাখন্ডটুকু বার করে পাগলাবাবা আস্ফালনের ভঙ্গিতে বলতেন—‘‘হামার এই পাত্থল দেখতা হ্যায়? নাম আছে ‘মনত্র শিলা!’ ‘মনত্র শিলা!’ সমঝা? এই শিলা পরশন করিয়ে হামি সব লোগকে মারতে পারি, ফির জিয়াতে পারি।’’
‘‘সব লোককে? পৃথিবীর সব লোককে?’’ স্তম্ভিত হয়ে প্রশ্ন করত কানু।
সাধু অবলীলাক্রমে উত্তর দিতেন—‘‘সব—সব! বিলকুল।’’
‘‘আর, পাথর ঠেকিয়ে একজামিনে পাশ করিয়ে দিতে পারো না?’’
‘‘একজামিন!’’
সাধু সন্দেহযুক্ত দৃষ্টিতে তাকাতেন। যেন সেটা আবার কী বস্তু!
কানুর হিন্দি ভাষার ভান্ডার জোরালো নয়, সেবলত—‘‘জানতা নেই? পরীক্ষা জানতা নেই?’’
‘‘পরীকষা! আস্কুলমে?
‘‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! পারোনা পাশ করিয়ে দিতে?’’
‘জহুর! লেকিন পইসা দিতে হোবে।’’
শ্মশানচারী সাধুর পয়সার প্রয়োজন কী, এ কূট প্রশ্ন কানুর মাথায় কোনোদিন আসেনি। সেকতকটা প্রস্তুত হয়েই আসত। আর পকেটে হাত ঢোকাবামাত্রই পাগলাবাবার মুখের রেখায় প্রসন্নতার ছাপ পড়ত।
একদিন—
সেদিন ফুলি ছিল সঙ্গে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে ফস করে বলে বসেছিল কানু—‘‘আমি যদি মরে যাই, ওই পাথর দিয়ে বাঁচাতে পারবে?’’
‘‘ক্যা?’’
বলাবাহুল্য সবটা ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া কানুর পক্ষে সম্ভব ছিল না, সেনিজের বুকে হাত দিয়ে, চোখ উলটে এবং জিভ বার করে ইশারায় ‘মৃত্যু’ কথাটাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর পুনর্জীবনের ভঙ্গিও করেছিল। সাধু বড়ো গলায় বলেছিল—‘‘জরুর!’’
বুকের ভিতর উদবেল হয়ে উঠেছিল কানুর, আনন্দে চোখে জল এসেছিল।
অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে সম্পূর্ণ পদ্ধতিটা শিখেও নিয়েছিল।
ফেরার পথে ফুলিকে চুপি চুপি উপদেশ দিয়ে রেখেছিল কানু, তেমন দুর্দিন এলে ফুলির কর্তব্যটা কী।
কিছু না। গোটাকতক বেশি করে পয়সা নিয়ে গিয়ে পাগলাবাবার কাছ থেকে ‘মন্ত্রশিলাটা’ একবার নিয়ে এসে তিনবার নিজের কপালে ছুঁইয়ে একবার মরা কানুর বুকে ঠেকানো!
ব্যস!
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকাবে কানু। চোখ নড়বে, বুক নড়বে, সারাদেহটা নাড়িয়ে ধড়মড় করে উঠে বসবে তখন কানু।
সেই আশাস্পন্দিত বুক নিয়েই তো আজ চন্ডীতলায় আসা কানুর। যখনই শুনেছিল, তখনই আসত। কিন্তু দুরন্ত একটি লোভ ছিল—এই ভয়ংকর অলৌকিক কান্ডটা, যেটা কানুর দ্বারা সংঘটিত হবে, সেটা সহপাঠীরা দেখুক। তাই তাদের জড়ো করতে গড়িয়ে গিয়েছিল বেলা।
কিন্তু তাদের সামনেই এই অপদস্থ!
পাথরটা ঠেকিয়ে দৃষ্টি ঠিকরে অপেক্ষা করেছে কানু, সেই পোড়া কয়লার মতো দেহটা কীভাবে নড়ে ওঠে!
না, দেহটা নড়ে ওঠেনি।
নড়ে উঠেছিল শুধু একটি কিশোরচিত্তের বিশ্বাসের ভিত!
পূর্ণিমায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো হয় মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে। চিরাচরিত প্রথায়। গৃহিণীহীন গৃহেও সেপ্রথাটা রেখেছেন মাস্টারমশাই। বিধবা মেয়েটা অর্থাৎ ফুলির মা মারা যাওয়ার পর থেকে পাড়ার অভিভাবিকা হিসেবে রাসমণিই ‘উয্যুগের’ ভার নিয়েছিল, এ যাবৎ সেই প্রথাই বলবৎ।
ব্রতের ‘কথা’ শুনতে পাড়ার সকলেই প্রায় আসে। প্রসাদ পায়। এক-টুকরো শালপাতায় সামান্য পরিমাণ কাঁচাশিন্নি, দু-খানা বাতাসা, এক টুকরো আখের গুড়ের পাটালি, আর টুকরো কয়েক শশা কলা। এই প্রসাদ। তথাপি তাতে নিষ্ঠা ও ভক্তির অভাব কারও ছিল না। সত্যনারায়ণের ‘কথা’ হচ্ছে জেনেও শুনতে যাবে না, বাড়ি বসে থাকবে, প্রসাদের পরিমাণ তুচ্ছ বলে অবহেলা করবে, এমন কথা অন্তত মফসসলের লোকেরা তখনও ভাবতে শেখেনি।
তা ছাড়া মাস্টারমশাই ছিলেন দেশসুদ্ধ সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র।
কানুর বরাবরই এদিনে বিরাট উৎসাহ।
দূর-দূরান্তরের পথ ভেঙে ফুল সংগ্রহ করে আনে সেঝুড়ি বোঝাই করে, ফুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মালা গাঁথে চৌকি ঘিরতে। আর সত্যনারায়ণে যতটা ভক্তি থাক না থাক, তাঁর প্রসাদে অটুট ভক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে।
কিন্তু এবারে সেনিয়মের বৈলক্ষণ্য দেখা গেল। কানু ফুল আনল না, ব্রতমাহাত্ম্য শুনল না এবং প্রসাদ খেল না। এ বাড়িতে এসেছে বটে, বোধ হয় না এসে পারেনি বলেই এসেছে, কিন্তু বাড়ির মধ্যে তার দর্শন পাওয়া যায়নি। বাইরের দাওয়ায় গম্ভীরমুখে বসে একখানা বই ওলটাচ্ছে।
সকালবেলা থেকেই ভাবান্তর ধরা পড়েছে ফুলির কাছে।
‘‘আমি ফুলটুল আনতে পারব না’’—শুনে স্তম্ভিত ফুলি প্রথমটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি, তারপর কানুর অনমনীয় মনোভাব দেখে অভিমানে ভারভার হয়েছিল। আলপনা দিয়েছে, মালি-বউ প্রদত্ত সামান্য ফুলে মালাও গেঁথেছে, রাসমণির নির্দেশে করেছে সবই, কিন্তু কেমন যেন মনমরাভাবে। তবু ‘কথা’ আরম্ভের সময় চঞ্চল হয়ে উঠেছিল বেচারা। কানুদার দুর্মতিটা যাতে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, সত্যনারায়ণের কাছে তারই প্রার্থনা জানিয়ে ডাকতে গিয়েছিল, ‘‘কানুদা এবার ‘কথা’ আরম্ভ হবে চলো।’’
‘‘আমি যাব না।’’
নিশ্চিত সুরে উত্তর দিয়েছিল কানু।
‘‘যাবে না?’’—ব্যাকুল প্রশ্ন করে ফুলি—‘‘কথা শুনতে যাবে না?’’
‘না:! শুনে কী হবে? ও সব সত্যনারায়ণ ফারায়ণ সব বাজে।’’
ফুলি শিহরিত কলেবরে বলে উঠেছিল—‘‘পাগলের মতো কী বলছ কানুদা?’’
‘‘পাগল আবার কী! ঠিকই বলছি। যারা ওই সব মানে তারাই পাগল। ঠাকুর টাকুর সব মিথ্যে বুঝলি, সব মিথ্যে। ব্রতকথাগুলো স্রেফ বানানো। ও সত্যনারায়ণ, মা চন্ডী, কারুরই কিছু খ্যামতা নেই। শুধু শুধু ঠাকুর হ্যান করল ত্যান করল, মরা বাঁচাল, ডোবা জাহাজ ভাসাল, এই সব বানানো কথা শুনে লাভ? শিন্নিতে আমি পা ঠেকাতে পারি, বুঝলি? বিশ্বাস না হয় আন! তোর সামনে ঠেকাচ্ছি।’’
কাঁপন্ত বুকে সরে পড়েছিল ফুলি, আর কথা বলতে সাহস পায়নি। চোখ ফেটে জল এসেছিল তার। আর কিছু নয়, পাগলা হয়ে গেছে কানু। আর পাগলাবাবার মড়া ছোঁয়ার ফল সেটা! হ্যাঁ—নিশ্চয় তাই।
নীরনে আর রমেশ বেশ ডালপালা সহযোগেই তো সেদিনকার অভিযানের গল্প করে গিয়েছিল—এ বাড়িতে এসে। মাস্টারমশাইয়ের পালিত ছাত্রগুলি তো ওদেরই সহপাঠী।
হ্যাঁ—ঠিক! সেদিন থেকেই কানুর ভাবান্তর লক্ষ করেছে ফুলি।
কানুর চোখ লাল, দৃষ্টি রুক্ষ, সমস্ত প্রিয় খেলাধুলোর প্রতিই যেন ঔদাসীন্য।
তারপর আজ এই সর্বনেশে কথা!
সন্দেহের অবকাশ নেই, ভূতাশ্রিত হয়েছে কানু।
বাড়িতে নানা লোকের ভিড়।
বারে বারেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ মুছতে লাগল ফুলি, কাউকে কিছু বলতে পারল না।
কিন্তু প্রসাদ বিতরণকালে কানুর অনুপস্থিতি রাসমণির চোখ এড়াল না। সেহাঁক দিল, ‘‘কানু কোথায় রে ফুলি?’’
‘‘ওই যে—ইয়ে বাইরের দাওয়ায়।’’
‘‘পেসাদ না নিয়ে একখুনি আবার তাড়াতাড়ি বাইরে যাওয়া কেন।’’ রাসমণি সন্দেহের সুরে বলে, ‘‘কথা শোনার সময় ছিল তো?’’
ফুলি ঢোক গিলে বলে, ‘‘দেখতে পাইনি।’’
কথাটা মিথ্যে নয়, দেখতে তো সত্যিই পায়নি। বারে বারেই তো ভিড়ের পেছন দিকে চোখ ফেলেছে, যদি পরে অনুতপ্ত হয়ে এসে বসে থাকে, কিন্তু না, দেখতে পায়নি সেই পরিচিত মুখটি।
রাসমণি ভুরু কুঁচকে বলে, ‘‘উঁহু, আমি তো কই দেখিনি তাকে! গুণ বাড়ছে বুঝি! ঠাকুরদেবতাকে অগ্রাহ্যি করতে শিখছে? নির্গুণ কিংশুকের তবু ওই গুণটুকু ছিল—দেব-দ্বিজে ভক্তি, তাও যাচ্ছে! …কেনো, কেনো, এই কেনো লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, মরণ-বাড় বেড়েছে তোমার কেমন?’’
পাঁচজনের ভাগ একজনের পাতায় গুছিয়ে মূল-নৈবিদ্যের বড়ো মন্ডটি তাতে যোগ করে ভাইপোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল রাসমণি।
কিন্তু লক্ষ্মীছাড়া ছেলের এতবড়ো দুঃসাহস হবে, একথা ভাবতেই পারেনি রাসমণি। ব্রতকথা শুনুক না শুনুক, মুখের ওপর স্পষ্ট বললে, ‘‘পেসাদ খাব না!’’ রাসমণি কি নিজের মাথা দেয়ালে ঠুকবে, না এই ভ্রংশবুদ্ধি ছেলেটার মাথাতেই হাতের থালাটা ছুড়ে মারবে?
না, সেসব অবিশ্যি করেনি রাসমণি পাঁচজনের মাঝখানে। শুধু দাঁত কিড়মিড় করেই যতটা ঝাল মেটাতে পারে মিটিয়েছে। কিন্তু এই ভয়ানক ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে পারেনি। বাইরের লোকজন চলে গেলে, উপবাসী মাস্টারমশাইকে জল খাইয়ে পেড়েছে কথাটা।
কাঁদোকাঁদো হয়ে বলেছে, ‘‘চাটুয্যে কাকা, আপনি থাকতে ছেলেটা একেবারে ‘বয়ে’ যাবে?’’
শিবনাথ চাটুয্যে এই আকস্মিক নালিশে চমকে উঠে বলেন, ‘‘কার কথা বলছ রাসু?’’
‘‘কার আর? আমি আর কার কথা বলব? আমার বাপের কুলের ধ্বজা ওই কেনোর কথা বলছি। ছেলেটা যে একেবারে উচ্ছন্ন যাচ্ছে!’’
মাস্টারমশাই ঈষৎ অবাক হয়ে বলেন, ‘‘কানুর কতা বলছ? আমাদের কানুর? কেন, কানুত খুব খাসা ছেলে, বুদ্ধিমান ছেলে। ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট বয়।’’
রাসমণি আক্ষেপ করে বলে, ‘‘কেলাসে ফাস্টো হয়ে আর আমার পরকালে কী সাক্ষী দেবে? এদিকে যে সব্বনেশে বুদ্ধি হয়েছে।’’
যেন রাসমণির পরকালে সাক্ষ্য দেওয়াই কানুর পরম কর্তব্য।
মাস্টারমশাই অবাক হয়ে বলেন, ‘‘কেন বলো তো রাসু? হঠাৎ কী করল সে?’’
‘‘হঠাৎ কী চাটুয্যে কাকা, অনবরতই তো যা খুশি করছে! অবাধ্যর একশেষ গুরুলঘু জ্ঞান নেই, বাপ-কাকার মুখের ওপর চোপা! একদন্ড বাড়িতে টিকি দেখবার জো নেই। এই গ্রীষ্মের দুপুরে পথে বেরোলে গায়ে ফোসকা পড়ে, আর ওই ছেলে পাড়াগাঁয়ের চাষা-ভুসোর ছেলের মতন টো টো করে বেড়াচ্ছে—কোথায় কুমোরপাড়ার পুতুল গড়া দেখতে, কোথায় জেলেপাড়ায় জাল বোনা দেখতে, বারণ করলেই বলে —বেশ করব, খুব করব, আবার যাব—’
এই দীর্ঘ ফিরিস্তির মাঝখানে রাসমণি বোধকরি একবার দম নেওয়ার জন্যেই থামে।
সেই অবসরে শিবনাথ মৃদু হেসে বলেন, ‘‘ছেলে মানুষের বুদ্ধি, সেরে যাবে এরপর।’’
‘‘তাইতো ভাবতাম চাটুয্যে কাকা, কিন্তু আজকে যে বড়ো ভয় ধরিয়ে দিয়েছে! ওর কথা শুনে ‘থ’ হয়ে গেছি একেবারে! বলে কিনা ‘ঠাকুরটাকুর সব মিথ্যে, পেসাদ খাব না, শিন্নিতে পা ঠেকাব’—দুর্গা! দুর্গা! অপরাধ নিয়ো না সত্যপীর!’’
মাস্টারমশাই এতক্ষণ রাসমণির নালিশে বিশেষ কর্ণপাত করেননি, নালিশের শেষ অংশে সচকিত হয়ে ওঠেন। গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘তাই নাকি?’’
‘‘তবে আর বলছি কী!’’
‘‘কিন্তু হঠাৎ এরকম হল কেন বলো তো?’’
‘‘পাকামি বাড়ছে আর কী! হয়তো কোথাও বদসঙ্গে মিশছে—’’
‘‘না না তা হতেই পারে না—’’ মাস্টারমশাই নিশ্চিত বিশ্বাসের সুরে বলেন ‘‘ও কথা নয়! আচ্ছা তুমি একবার তাকে ডেকে দাও তো আমার কাছে।’’
‘‘সেকি আর এখনও এখানে আছে? আমার কাছে গালমন্দ খেয়ে ঠিকরে বেরিয়ে গেল।’’
‘‘আহা হা গালমন্দ কেন, গালমন্দ কেন?’’ শিবনাথ দুঃখিতভাবে বলেন ‘‘ছেলেপুলেকে গালমন্দ করা ভারি খারাপ অভ্যাস রাসু!’’
‘‘কী যে বলেন চাটুয্যে কাকা—’’ অবোধ বালকের অজ্ঞতায় বিজ্ঞরা যেমন হাসে, তেমনি হাসি হেসে রাসমণি বলে, ‘‘শাসন না করলে কখনো ছেলে মানুষ করা যায়? কথায় বলে ‘গালাগালিতে ভূত ছাড়ে’!’’
‘‘ছাড়েনা রাসু, বেড়েই যায়। অহেতুক গালমন্দে দুর্বুদ্ধির ভূত আর ঘাড়ে চেপে বসে।’’
‘‘চাটুয্যে কাকার এক কথা!’’ রাসমণি অপ্রত্যয়ের সুরে বলে, ‘‘আদি-অন্তকাল ওই করেই ছেলে শাসন করে আসছে লোকে। শুধু গালমন্দেই শায়েস্তা হয় নাকি? প্রহারই হচ্ছে আসল ওষুধ! শুনতে পাই আমার ঠাকুরদা এমন ছেলে ঠেঙাতেন, যে ছেলের মুখ দিয়ে রক্ত উঠে যেত!’’
শিবনাথ ক্লিষ্টস্বরে বলেন, ‘‘থাক রাসু, ওসব কথা থাক। তুমি বরং কাল সকালে একবার কানুকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। আমার মনে নিচ্ছে তোমাদের কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।’’
কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে কি না, সেসন্ধান কে নেয়? প্রত্যেকেই জানে আমি নির্ভুল!
তাই নিজের হিসেবে কানুকে শাসন করে কানুর কাকা নানু মিত্তির। ছেলেকে মাটিতে ফেলে তার ওপর কিলচড় বৃষ্টি করতে করতে বলে, ‘‘বল আর বলবি ও কথা? বল ফের মুখে আনবি?’’
আর কানু দম বন্ধ হয়ে আসা গলায় বলে চলে, ‘‘হ্যাঁ বলব, বেশ করব, হাজার বার বলব। ঠাকুরটাকুর কিছু নেই। মা চন্ডীর গায়ে ইট ছুড়তে পারি আমি।’’
‘‘কী বললি? কী বললি? জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে কুকুরকে খাওয়াব, তা জানিস! আর তোকে খুন করে ফাঁসি যাব আমি।’’ হাত ছেড়ে এবার পায়ের সাহায্য নেয় নানু মিত্তির!
কানু এই আক্রমণ থেকে ঝেড়ে ওঠবার ব্যর্থচেষ্টায় লুটোতে থাকে, আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘‘যাও, যাও,. তাই যাও! তুমি ফাঁসি যাবে জানলে আমি মরেও হরির লুট দেব।
অনুকরণপ্রিয় মানুষ? জন্মাবধি যা শুনে আসছে তাই শিখেছে।
নানু মিত্তির খেপে উঠেছে। কমলার সাধ্য নেই এ কোপ থেকে ছেলেকে রক্ষা করে। সেচোখ বুজে শুয়ে পড়েছে রান্নাঘরে।
রাসমণিও নিজের হাতে জ্বালা আগুনের বহরে এখন নিজেই কাঁপছে। তবু সাহস করে বলে, ‘‘ছেড়ে দে! ছেড়ে দে! শেষে সত্যিই হাতে দড়ি পড়বে!’’
‘‘পড়ুক!’’ বাঘের মতো গর্জন করতে থাকে হাড়জিরজিরে নানু মিত্তির। নিজেরা আশৈশব অমানুষিক শাসনে মানুষ, সেই শাসনের ভয়ে গুরুজনদের ভয় করত যমের মতো। কানুর এই নির্ভীকতা ওর রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! ‘‘পড়ুক হাতে দড়ি, আজ হয় ওকে মাপ চাওয়াব, নয় খুন করে ফেলব, এই নানু মিত্তিরের শেষ কথা।’’
‘‘মাপ চাইব? মাপ চাইব?’’ মার খেয়ে খেয়ে গলা বুজে এসেছে কানুর। হাত পা অবসন্ন হয়ে আসছে, তবু বিদ্রোহের কন্ঠে ঘোষণা করছে, ‘‘মাপ চাইব? মরে গেলেও না! আবার বলব, খালি খালি বলব, মা চন্ডী একটা পাথরের ঢিপি! ঠাকুরটাকুর কিচ্ছু নেই। পুজো করে করে তোমরা ভারি ভালো হয়েছ যে! যে ঠাকুরের তোমাদের মতন ভক্ত, আমি সেঠাকুরের গায়ে থুতু দিই।’’
আশৈশবের পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ যেন আজ এই একটা পথে মুক্তি পেতে চায়। তাই খ্যাপার মতোই আচরণ করতে থাকে কানু।
মেরে মেরে নানু মিত্তিরের হাত পা ব্যথা হয়ে উঠেছে, তার ওপর আর এত বড়ো অপরাধের উপযুক্ত মোহাড়া নেওয়া চলে না। তাই সেও বুনোমোষের মতো এদিক ওদিক তাকাতে থাকে—মারবার উপযুক্ত একটা কাঠ-কুটোর আশায়। অবশ্য বিনা বাক্যব্যয়ে নয়, চেঁচাতে চেঁচাতেই। যদিও হাঁপাচ্ছে সেও কম নয়।
‘‘দিদি, বলে দাও তোমাদের নতুনবউকে, আজ যেন তিনি পুত্রশোকের জন্যে প্রস্তুত থাকেন! কেনোকে চন্ডীতলায় রেখে এসে তবে আমি জলগ্রহণ—’’ এতোবড়ো একটা মহান প্রতিজ্ঞার মাঝখানেই ঝট করে প্রতিজ্ঞাটা গিলে ফেলে বীর নানু মিত্তির! রাসমণিও স্তব্ধ!
বেড়ার দরজা ঠেলে সামনেই এসে দাঁড়িয়েছেন শিবনাথ মাস্টার।
পেছনে প্রায়-রোরুদ্যমানা ফুলি।
ভূতগ্রস্ত কানুকে আর একবার ভালো করে নিরীক্ষণ করবার জন্যে বাড়ির কাজকর্মের শেষে একটু আগে এ বাড়িতে আসছিল ফুলি, আর হাতে করে এনেছিল একটু প্রসাদি নির্মাল্য! ভেবেছিল লুকিয়ে অন্তত ওর মাথায় একটু ঠেকিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু উঠোনের দরজার কাছ এসে দাঁড়িয়েই নিজে ভূতাহতের মতো ছুটে পালিয়েছিল। ছুটতে ছুটতে গিয়ে কেঁদে পড়ে বলেছে—‘ও দাদু! শিগগির চলো, কানুদাকে ওরা মেরে ফেলছে।’’
‘‘মেরে ফেলছে!’’
‘‘হ্যাঁ দাদু, নানু মামা মেরে মেরে একেবারে শেষ করে ফেলছে কানুদাকে।’’
মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন শিবনাথ। দ্বিধা করেননি।
‘‘এটা কী হচ্ছে নলিনী?’’
শান্তভাবে প্রশ্ন করেন মাস্টার। নানু মিত্তিরের পোশাকি নাম নলিনী। সেও একসময় শিবনাথ মাস্টারের ছাত্র ছিল, কাজেই এহেন সঙ্গিন মুহূর্তে মাস্টারমশাইয়ের আবির্ভাব ঈষৎ কুন্ঠিত না হয়ে পারে না। নিজের দোষ ঢাকার সুরে নানু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘‘ছেলেটা একেবারে বদ হয়ে গেছে বুঝলেন মাস্টারমশাই!’’
‘‘অকারণে বদ হয়ে যায়নি নলিনী, বদ করে তুলেছ তোমরা।’’
‘‘আমরা! বদ করে তুলেছি আমরা? ওকে একটু সভ্যভব্য বাধ্য করবার জন্যে—বুঝলেন—চেষ্টার কোনো কসুর রাখিনি।’’
‘‘চেষ্টা—!’’ শিবনাথ মাস্টার গম্ভীরহাস্যে বলেন, ‘‘তোমাদের চেষ্টার পদ্ধতি তো এই? পদ্ধতিটা ভুল, বুঝলে নলিনী!’’
এত সহজে নিজের পদ্ধতির ভুল মেনে নেবে, নানু মিত্তির অবশ্য এত কাঁচাছেলে নয়। তাই আরও উত্তেজিত স্বরে বলে, ‘‘কী বলব, আপনি তো জানেন না ছেলেটি কী চিজ! ক্লাসে ভালো নম্বর পায়, তাতেই মনে করেন খুব ভালো ছেলে—’’
শিবনাথ মাস্টার বাধা দিয়ে বলেন, ‘‘থাক নলিনী, আমি কী মনে করি না করি, সেটা আর তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই না। ক্লাসে ভালো নম্বর তো মনে হচ্ছে যেন তুমিও পেতে! তাই না? সেযাক। একটি অনুরোধ তোমাকে আর তোমার দাদাকে করব—’’
কী অনুরোধ করতেন শিবনাথ কে জানে, কিন্তু কথার মাঝখানে হঠাৎ কমলা এসে দাঁড়াল। এর আগে কোনোদিন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কথা কয়নি সে, দরকারও হয়নি। আজ আর না করে পারল না। পুত্রশোক পাওয়ার আগেই পুত্রের ত্রাণকর্তার মতো যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারবে কেন সে? মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মৃদুকাতর বচনে কমলা, ‘‘কাকাবাবু, ছেলেটার ভার আপনি নিন। নইলে হতভাগাটা কোনদিন মার খেয়েই মরে যাবে!’’
এহেন পরিস্থিতিতে রাসমণি আর স্থির থাকতে পারে না, বিরক্তস্বরে বলে ‘‘নতুনবউ, আমাদের কথার মাঝখানে তুমি কেন? যাও ঘরে যাও।’’
‘‘থামো রাসু’’, মাস্টারমশাই গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘কথাটা তোমাদের নয়, ওঁরই। কারণ উনি কানুর মা।……কিন্তু বউমা, আমি কীভাবে ওর—’’
‘‘আপনি ওকে নিয়ে যান কাকাবাবু, নিয়ে যান!’’ কমলা আর্তনাদের মতো বলে ওঠে, ‘‘আপনার বাড়িতে তো অনেক অনাথ ছেলে প্রতিপালিত হয়, তাই মনে করেই ওকে একটু ঠাঁই দিন। আর সহ্য হচ্ছে না আমার।’’
কমলা যে হঠাৎ এরকম কান্ড করে বসবে, কানু বা রাসমণি কেউ ধারণাই করতে পারেনি, তাই তারা যেন একটু থতোমতো খেয়ে গেছে। কানু তখনও ওঠবার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি বলেই চোখবুজে পড়ে আছে। ফুলি তো পাথর!
শিবনাথ মাস্টার অবশ্য কমলার কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করেন না, তবু এই কাতরতা ওঁর হৃদয় স্পর্শ করে। আপাতত হিসেবে কানুর কাছে এগিয়ে গিয়ে হেঁট হয়ে ওর একটা হাত ধরে তুলে বলেন, ‘‘কানু ওঠো। চলো আমার সঙ্গে। আজ থেকে তোমায় ভালো হতে হবে। বুঝলে তো? সত্যিকার ভালো!’’
কিন্তু সত্যিকার ভালো হওয়ার সুযোগ ক-জনার জীবনে আসে? পরিবেশ পরিস্থিতি অবিরতই মানুষকে ভাঙছে চুরছে, ধ্বংস করছে, নতুন চেহারায় গড়ছে। মুছে যায় সংকল্পের প্রতিশ্রুতি-লিপি, নষ্ট হয়ে যায় দীর্ঘ সাধনার সুফলটুকু। পরিবেশ পরিস্থিতির দাসত্ব করে করে কুৎসিত বিকৃত চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষ।
কানুর জীবনেও ভালো হওয়ার সুযোগ আসেনি।
মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ক-দিন যেন ছিল কানু? পাঁচদিন? তাই হবে বোধ হয়। তারপর তো দাশু মিত্তির পুলিশের দারোগাকে এনে ছেলে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। না যাবে কেন? সেই রাত্রেই যখন বাড়ি এসে সব ঘটনা শুনে ছেলেকে ডাকতে গিয়েছিল, কানু যে কিছুতেই আসতে চায়নি। বাপের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেনি।
আর শিবনাথ মাস্টার বলেছিলেন, ‘‘থাক না দাশরথী, টানা-হেঁচড়া করছ কেন? এখানে না হয় থাকলই দু-দিন? ছেলেমানুষ, রাগ-অভিমান হয়েছে, দু-দিন পরে কমে গেলে আপনিই যাবে। তোমার বাড়ি আমার বাড়ি আলাদা তো নয়!’’
অতএব দাশু মিত্তিরকে চলে আসতে হয়েছিল। কিন্তু নানু মিত্তির আর রাসমণি এত অপমান নীরবে মেনে নিতে পারেনি। কমলাকে তো তারা যা নয় তাই গালমন্দ করেই ছিল, তার ওপর দাদাকে টিটকিরি দিয়ে বলেছিল, ‘‘পরের বাড়ি থেকে নিজের ছেলেকে উদ্ধার করে আনবার ক্ষমতা যার না থাকে, তার বনবাস করাই ভালো। বুঝেছি, শিবনাথ মাস্টারের অনাথ আশ্রমে ছেলেটাকে ভরতি করে দেওয়ায় তোমারও সায় আছে। নি-খরচায় ছেলে মানুষ হয়ে যাক, এই ইচ্ছে। তা নইলে নতুন বউয়ের সাধ্য কী যে আমাদের মুখের ওপর এত বড়ো কথা বলে? আমরা হলে এক্ষুনি থানা-পুলিশ করে ছেলে বের করে আনতাম।’’
তারপরেও থানা-পুলিশ করবে না, দাশুমিত্তির এত ঠাণ্ডা-রক্ত মানুষ নয়।
পাঁচটি দিন!
কী সুন্দর সেই দিনগুলি!
পৃথিবীর যে শান্তি আছে, জীবনে আনন্দ আছে, এ বিশ্বাস যেন ফিরে এসেছিল। ভোরে ঘুম ভেঙেছে—রাসমণি আর কমলার ঝগড়ার শব্দে নয়, ভেঙেছে মাস্টারমশাইয়ের গম্ভীর উদাত্ত কন্ঠের গীতা-পাঠের ধ্বনিতে। মানে বোঝবার সাধ্য কিছু নেই। কিন্তু ধ্বনিটা যেন প্রাণের মধ্যে ধ্বনিত হয়ে ওঠে!
হ্যাঁ, এমন পরিবেশে ভালো হওয়ার বাসনাই প্রাণে জাগে। সেই পাখি-ডাকা ভোরে, সেই ছায়া-ঢাকা উঠোনের এক কোণে এসে পড়া না-ওঠা সূর্যের অরুণ আভার দিকে চোখ মেলে মনে হয়েছিল কানুর, ভালো হবে। সত্যিকার ভালো!
কিন্তু সত্যিকার ভালো হতে হলে যে কী হতে হয়, কী করতে হয়, সেকথা কে কবে বলেছে কানুকে? কানুর অভিভাবকরাই বা কবে শিখেছে সেকথা?
শিবনাথ মাস্টার চেয়েছিলেন বলতে, কিন্তু তিনি আর তার সময় পেলেন কই?
মারের ব্যথা মিটে বিছানা থেকে উঠতেই তো পাঁচদিন লেগেছিল কানুর। তারপরই দাশু মিত্তিরের হামলা!
তবু জীবনে সেই পাঁচটি দিন বড়ো উজ্জ্বল, বড়ো মিষ্টি!
ওরই মধ্যে একদিন কানুকে নিজের মহিমা দেখাতে মোচারঘণ্টা রেঁধেছিল নন্দ। বাড়ির কলাগাছের মোচা। হি, হি, হি, সেকথা মনে করতে গেলে এই দু-যুগ পরেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
হি-হি-হি!
হেসে পিঁড়ির ওপর গড়িয়ে পড়েছে ফুলি। ‘‘ও নন্দদা, এ কী রেঁধেছ গো? মোচারঘণ্ট, না সোজাসুজি একেবরে কলাগাছেরই ঘণ্ট? ও কানুদা, দেখো দেখো একবার খেয়ে দেখো! জীবনে আর ভুলতে পারবে না। সত্যি বাপু, আমাদের নন্দদার রান্না বটে একখানা! জন্মের মতন খাবার বাসনা ঘুচিয়ে দেওয়া রান্না! নন্দদা, তোমার সেই বিখ্যাত আমের চাটনিটা একবার খাইয়ে দিয়ো না কানুদাকে!’’
ঝরনার মতো হাসি!
মেদিনীপুরের ছেলে নন্দ। তার কথায় টান, মেজাজে রাগ। হাতমুখ নেড়ে সেউত্তর দিয়েছে, ‘‘ওঃ ভারি আমার পাকা রাঁধুনি এলেন! বলি মন্দটা কী হয়েছে? মন্দটা কী হয়েছে? ঘণ্ট আবার কেমন হয়?’’
ফুলির হাসি আরও উদ্দাম হয়ে ওঠে, ‘‘ওমা কী আশ্চয্যি কথা নন্দদা মোচারঘণ্ট যে ‘নিম-বেগুনে’র মতো হয়, তাও জানো না? এ যে মোটে উচ্ছের ঝালের মতো হয়েছে গো! আর একটু তেতো হবে, তবে না মোচার ঘণ্ট? কী বলো কানুদা? তাই না?’’
নন্দর ভাতের মাপটা একটু বেশি।
সেএকটু একটু ঘণ্ট মেখে এক এক থাবা ভাত মুখে পুরতে পুরতে ভরা মুখে বলে, ‘‘এই তো আমি খাচ্ছি, কী হচ্ছে কী?’’
‘‘আহা হবে আবার কী? তোমার বুঝি আশা ছিল নন্দদা, তোমার মোচারঘণ্ট খেয়ে আমাদের সবাইয়ের কপালের ওপর দুটো করে শিঙ গজাবে?’’
ছেলেমানুষের ছেলেমানুষি ঠাট্টা!
কিন্তু এই হাসির আলোয় কী অদ্ভুত লাবণ্য ফুটে উঠেছিল ফুলির মুখে! কানু অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেবেছিল—ফুলিটা এত হাসতে পারে কী করে? এত প্রফুল্লতা, এত প্রসন্নতা কোথায় পায় ও?
আর বেচারা নন্দ রাগ ভুলে হাঁ করে তাকিয়েই ছিল সেই মুখের দিকে।
মার খেয়ে রক্ত ফুটে উঠেছিল পিঠে, লাল লাল ছড়া ছড়া দাগ। নারকেল তেল গরম করে পেছন পেছন ছুটছে ফুলি, ব্যথা সারিয়ে দেবে।
কানুও দিতে দেবে না, ফুলিও ছাড়বে না।
শেষ অবধি ফুলিরই জিত!
‘‘ইস আহা-হা!’’ ফুলির মুখে করুণার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা দুষ্টু-হাসি ফুটে ওঠে। ‘‘আহাহা দেখে দুঃখু হচ্ছে! তবু—যাই বলো কানুদা, ভাগ্যিস নানুমামা এই কান্ডটি করেছিলেন!’’
ভাগ্যিস!
কানু চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘‘ভাগ্যিস মানে? আমার এই দুর্গতিতে খুব তাহলে ফুর্তি হয়েছে তোর?’’
‘‘আহা তা নয়, মানে—বুঝতে পারছ না? এই রাম বেধড়ক প্রহারটি না দিলে তো আর তোমার আমাদের বাড়িতে এসে থাকা হত না?’’
‘‘ওঃ! এই কথা!’’ মুখের রেখা মসৃণ হয়ে গেছে কানুর, ‘‘তা যা বলেছিস—’’ বলে দু-জনেই হাসতে শুরু করেছে হো-হো করে।
‘‘নতুন মামিমা যদি এখানে এসে থাকেন, তাহলেই সব শান্তি হয়ে যায়, না কানুদা?’’
‘‘নতুন মামিমা? ওঃ মা?’’ কানুর ভুরু ফের কুঁচকে ওঠে, ‘‘কেন? কীসের জন্যে?’’
‘‘আহা যতই হোক, মার জন্যে তো তোমার মন কেমন করছে—’’
‘‘কক্ষনো না! পৃথিবীতে কারুর জন্যেই আমার মন কেমন করে না।’’ কানু সগর্বে ঘোষণা করে।
পৃথিবীতে কারুর জন্যেই না!
ফুলির মুখটা যেন মলিন হয়ে আসে। তবু গিন্নির ভঙ্গিতে বলে, ‘‘ও তোমার রাগের কথা কানুদা, মায়ের তুল্য জিনিস কি আর জগতে আছে? এই যে আমার দেখো না, মা নেই বলেই না—’’
‘‘মা নেই বলেই বেশ আছিস, ভালো আছিস খুশিতে আছিস! আমারও না থাকলে বাঁচতাম! মা-পিসি, বাবা-কাকা কেউ যদি না থাকত তাহলেই ভালো ছিল আমার। আমায় কেউ ভালোবাসে না। আমিও কাউকে ভালোবাসি না।’’
কথাটা বলে দালানের এদিক থেকে ওদিক অবধি জোরে জোরে পায়চারি করে কানু।
ফুলির বুকটা ধক ধক করে ওঠে।
মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়। এসব কী ভয়ানক ভয়ানক কথা বলছে কানুদা! যে কথা মনে আনাও পাপ, মনে আনার কথা কেউ ভাবতে পারে না, সেকথা কানুদা এত সহজে মুখে আনছে! কেন এমন ভয়ংকর মনোভাব ওর?
এত ভালো লাগে কানুদাকে, কিন্তু এক এক সময় কেন এত ভীতিকর ও? ওর মনের নাগাল পাওয়ার কোনো উপায় নেই যেন।
দাশু মামা, নানু মামা, রাসু মাসি, নতুন মামি, সকলকেই তো দেখেছে ফুলি, কিন্তু ওরা এত কি খারাপ? কই বোঝা যায় না তো! নানু মামাটা বড্ডো মোক্ষম মারে সেকথা সত্যি, তবু ওরা সব্বাই মরে গেলে ভালো হত এমন কথা কখনো ভাবা যায়? আর কানুদা ওদের নিজেদের ছেলে হয়ে…..আশ্চর্য! কমলার জন্যেই বেশি দুঃখ হয় ফুলির। আহা বেচারা রোগা রোগা মানুষটা! রাসু পিসির জ্বালাতেই ঝগড়াটে হয়ে গেছে। নইলে কী আর যতই হোক কানুর নিজের মা!
কানুর এই অধঃপতনে ভারি দুঃখ বোধ করে ফুলি। এতে ও নিজেও তো কষ্ট পায়! না-না, ওর এই অকারণ অশান্তি দূর করা দরকার।
‘‘তুমি ওইরকম বলছ কানুদা’’ ফুলি কোমল সুরে বলে, ‘‘কিন্তু নতুন মামিই তো তোমাকে রক্ষা করলেন? তোমায় যদি ভালো না বাসবেন; তাহলে কেন অমন করে—’’
‘‘সেকি আমার জন্যে ভেবেছিস?’’ কানু উদ্ধত গলায় বলে, ‘‘সেশুধু নিজের পুত্রশোকের ভয়ে। বুঝলি? আমার জন্যে কষ্ট হলে অনেক আগেই আটকাতে পারত! জানি জানি, চিনে নিয়েছি আমি সবাইকে।’’
এই রুক্ষ উদ্ধত মূর্তির সামনে আর কথা জোগায়নি ফুলির, ও শুধু ঠাকুরের কাছে কাতর প্রার্থনা জানিয়েছে—ঠাকুর, কানুদাকে সুমতি দাও।
খানিক পরেই আবার কানুর অন্য ভাব।
মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতেই ওর থাকাটা নিশ্চিত ভেবে মহোৎসাহে উঠোনে মাচা বাঁধতে বসে ঝুমকোলতার গাছ লাগাবে বলে। অবশ্য ফরমাশ খাটতে খাটতে ফুলি নাজেহাল হয়ে যায়।
‘‘দড়ি আন, পেরেক আন, ইট সরিয়ে দে, কঞ্চিটা ধরে থাক শক্ত করে—’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
উৎসাহের জোয়ার আসে ফুলির প্রাণেও।
দেখাদেখি নন্দ এসে হাত লাগায়। দীনেশ, গোবিন্দ আর রামমোহন বলে আরও যে ছেলে তিনটি রয়েছে, তারাও কাজে লেগে যায়।
মাচা বাঁধা যেন এক উৎসবে পরিণত হয়।
আর বাঁধা শেষ হয়ে সবে যখন লতাকুঞ্জের পরিকল্পনা চলছে, ঠিক সেই সময় দাশু মিত্তির ঢুকলেন দারোগাকে নিয়ে।
স্থিরগম্ভীর মূর্তি, শিবনাথ মাস্টার বলেছিলেন ‘‘এতর দরকার ছিল না দাশরথী, ও আপনিই যেত। মিথ্যে কতকগুলো হাঙ্গামা পোহালে।’’
দাশু মিত্তির সেকথার উত্তর দেয়নি, শুধু তীব্র চিৎকারে বাড়ি মাথায় করে ছেলেকে ডাক দিয়েছিল ‘‘বেরিয়ে আয়, বেরিয়ে আয় বলছি, পাজি বদমাশ শয়তান!’’
বেরিয়ে এসেছিল কানু ঘর থেকে।
বুনো ঘোড়ার মতো ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে বলেছিল—‘‘আমি যাব না।’’
‘‘যাবি না? যাবি না? বজ্জাত ছেলে! …দারোগাবাবু, দেখছেন কুশিক্ষার ফল? দেখে যাচ্ছেন তো আপনি? এ বাড়ির মালিকের নামে আমি নালিশ করব আমার ছেলে খারাপ করার জন্যে।’’
বলা বাহুল্য দারোগাবাবু বেশ কিছু ‘সেলামি’ নিয়েই তবে এসেছিলেন, কাজেই তিনি দাশু মিত্তিরের পক্ষে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘হুঁ।’’
‘‘আমি এখানেই থাকব কিছুতেই যাব না। কেটে ফেললেও না,’’ বলেছিল কানু।
কিন্তু থাকা হয়নি।
শেষপর্যন্ত মাস্টারমশাই নিজেই বলেছিলেন, ‘‘কানু, তোমাকে আমি আদেশ করছি তোমার বাবার সঙ্গে যাও।’’
চিরদিনের অবিচলিত ধীরস্থির শিবনাথ চাটুয্যের চোখদুটো জ্বালা করে কি জল ‘আসি আসি’ হয়েছিল সেদিন? কে জানে!
কানু অত তাকিয়ে দেখেনি। দেখবার মতো অবস্থাও ছিল না তার। সেঅভিমানাহত কন্ঠে শুধু বলেছিল, ‘‘তাড়িয়ে দিচ্ছেন?’’
শিবনাথ বলেছিলেন, ‘‘ধরে নাও তাই।’’
আর দ্বিরুক্তি করেনি কানু। বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গিয়েছিল, বোধকরি সমস্ত পৃথিবীর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে।
মাস্টারমশাই যে পুলিশের ভয়েই কানুকে বাড়িতে থাকতে দিলেন না, এ সম্বন্ধে আর সন্দেহ রইল না কানুর। ‘‘ভালো হওয়ার’’ যে পবিত্র সংকল্পটুকু একটুখানি নরম করে আনছিল তাকে, সেটুকু আর রইল না। সারাপৃথিবীর প্রতি আক্রোশ এল।
কিন্তু কেন কানুর এই দুরন্ত মানসিক যন্ত্রণা? কানুর অভিভাবকরা অত্যাচারী বলে?
সেকথা বললে মিত্তির বাড়ির প্রতি অবিচার করা হবে। মফসসলে তখনও যে হাওয়া বইত সেহাওয়া ঠিক আধুনিক জগতের নয়। ছোটোদের ‘মানুষ’ বলে গণ্য করবার রেওয়াজ তখন সেখানে পৌঁছোয়নি। ছোটোদের পক্ষে বড়োদের ইচ্ছার দাস হওয়াই একমাত্র কর্তব্য, আর খাওয়া পরা ও স্কুলের মাইনে একই হচ্ছে তাদের ঊর্ধ্বতম পাওনা, এমনি একটা মনোভাব নিয়েই প্রায় সবাই চলত। কাজেই শুধু দাশু মিত্তিরদের অপরাধী করা চলে না।
ছেলে মানুষ করা মানেই ছেলে শাসন করা!
আর শাসন পদ্ধতিটাও কমবেশি সকলেরই এক। রমেশ, নীরেন, সত্যশরণ, এরা ওরা তারা, সকলেই এই রকম শাসনযন্ত্রের তলায় পীড়িত। কিন্তু তারা কেউ কানুর মতো উদ্ধত নয়, বিদ্রোহী নয়। তারা চোখরাঙানিতে ‘কেঁচো’ মূর্তি ধরে, কাজেই অভিভাবকদের পরিশ্রম কম।
চড়টা চাপড়টা?
একবারের বেশি দু-বার নায়। ‘‘আর কক্ষনো করব না’’ এ বুলি তাদের মুখস্থ যে!
কানু জীবনে উচ্চারণ করেনি ও কথা।
কাজেই কানু অভিভাবকদের পরিশ্রমের অন্ত নেই। কানুকেও যদি একবার মেরে দু-বার মারতে না হত, তা হলে দাশু মিত্তিরও হয়তো নীরেনের বাপের মতন চটি পেটানোর পরই চারটে পয়সা হাতে দিয়ে বলত, ‘‘যা ঘুড়ি কিনগে যা।’’
নীরেনের যেদিন ঘুড়ি লাট্টুর পয়সার অভাব হয়, ও সেদিন ইচ্ছা করে বাপের অপ্রীতিকর কোনো কাজ করে বসে, একথা নিজে মুখেই গল্প করেছে পরম আনন্দে। ওর দিকেও অবশ্য যুক্তি আছে, ‘‘মার তো গায়ে লেগে থাকবে না, লাট্টু থেকেই যাবে।’’
কিন্তু কানুর কাছে তো বালকমনের এই সহজ হিসেব নেই। কানু ছোটোদের প্রতি বড়োদের এই সহজাত অধিকারকে অবিচার বলে গণ্য করে, আর সেই অবিচারের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণা।
বড়োদের প্রাণের স্নেহ মমতা করুণাকে ঘৃণা করে সে, দস্তুরমতো ঘৃণা করে। একমাত্র ফুলির কাছেই মাঝে মাঝে সেতার হৃদয় উদঘাটন করেছে, আর সেই উদঘাটনের মুহূর্তে বলেছে কানু যে—‘‘হ্যাঁ, বরং পিটনচন্ডী সহ্য হয় তো আদর সহ্য হয় না। মা যখন আদর করতে আসে, মাকে আমার মারতে ইচ্ছে করে।’’
কানুকে কেউ বোঝে না বলেই হয়তো কানুও কাউকে বুঝতে শেখেনি। হয়তো কানুকে যদি ওরা বুঝতে পারত, তাহলে কানুর আত্মা এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠত না।
‘‘দাশু মিত্তিরের ছেলের ব্যাপারটা শুনেছ তোমরা? তোমাদের ওই বন্ধু কানুর?’’ বলেছিলেন রমেশের বাবা, ছেলেদের ডেকে। ‘‘ও রকম বদছেলের সঙ্গে তোমরা মেশো এ আমি চাই না বুঝলে? বংশের মুখ হেঁট করা ছেলে! বুকের পাটা কী! দারোগার মুখের সামনে বলে ‘বাপের সঙ্গে যাবনা’! ছি ছি!’’
সত্যশরণের বাড়িতে তো সকলেই জেনে ফেলেছিল ‘কানু একটা ডাকাত’। পাগলা বাবার মরার দিন থেকে কানুর সঙ্গে তার কথা বন্ধ। তবু তার ওপরও আদেশ জারি হয়ে যায় কানুকে ‘বয়কট’ করে চলতে।
নীরেন, প্রবোধ, আশু, কেষ্ট—পাড়ার আরও সব ছেলেদের বাড়ি থেকেও তাদের প্রতি অভিভাবকদের এমনি কড়া নির্দেশ জারি হয়ে গেল।
কানুর সঙ্গে কেউ মিশবে না, কানু খারাপ ছেলে। যে ছেলের জন্যে থানাপুলিশ করতে হয় তার মতন খারাপ ছেলে ভূভারতে আছে নাকি?
অবশ্য বাড়িতে বাড়িতে অন্য আলোচনাও চলেছিল। মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্রয়েই যে এত দুঃসাহস বেড়ে গেছে ছেলেটার এটা ঠিক। তুমি বাপু মাস্টার আছ, আছ। পাড়ার লোক আছ, আছ। তাই বলে পরের সংসারে নাক গলাতে যাবার তোমার দরকার কী? কে কার ছেলেকে কীভাবে শাসন করছে তা দেখবার তোমার কী কাজ? আপনার ছাগল ল্যজে কাটবার স্বাধীনতা সকলেরই আছে।
মাস্টারমশাইয়ের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধাশীল হলেও দাশু মিত্তিরের ছেলের ব্যাপারে অনেকেই যেন বিরূপ হয়ে উঠল। কারণ ইতিমধ্যে তার ধিঙ্গি নাতনিটার প্রতি অনেকে বিরূপ ছিল। অতবড়ো মেয়ে ইচ্ছেমতো হিহি করে হাসে, খেলে, পাড়া বেড়ায়—একী? কানুরই বা সারাদিন ও বাড়িতে যাবার কী দরকার? আবার বাড়ি থেকে চলে গিয়ে থাকতে গেল ওদের বাড়ি?
না না, এত খারাপ ছেলের সঙ্গে নিজের ছেলেদের মিশতে দিতে কেউ রাজি নয়।
গ্রীষ্মের ছুটির পর কানু স্কুলে এসে দেখল সে‘একঘরে’। সহপাঠীরা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচাচ্ছে—‘‘বয়কট বয়কট! কানু বয়কট!’’
বয়কট!
কথাটার মধ্যে কী দুরন্ত জ্বালা!
কানুর মনে হতে লাগল ওরা যেন খানিকটা তরল আগুন নিয়ে কানুর গায়ে লেপে দিচ্ছে।
তবু কাউকে কিছু বলল না সে।
মাস্টারমশাইদের কাছে গিয়ে নালিশ জানাবে এমন পাত্র কানু নয়। একলা একলাই মনের আগুনে পুড়তে লাগল বেচারা।
আর কারও চোখে পড়েনি, চোখে পড়েছিল শিবনাথ মাস্টারের। সেই গোলমালের দিনের পর থেকে কানুকে তিনি বড়ো একটা দেখতে পাননি, স্কুলে দেখলেও কথাবার্তা হয়নি। ডেকে কথা বলতে তাঁর নিজেরই কেমন লজ্জা করছিল। আজ বললেন। টিফিনের সময় কানু পিছনের মাঠে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল, মাস্টারমশাই এসে বললেন, ‘‘তুমি এখানে একা যে কানু?’’
কানু মুখ তুলে একবার তাকাল।
হাতে একটা ঘাস ছিল সেটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, ‘‘এমনি।’’
‘‘ওরা বুঝি তোমার সঙ্গে খেলা করছে না?’’ গম্ভীরহাস্যে বললেন শিবনাথ।
বলা বাহুল্য কানু নীরব।
‘‘ঝগড়া হয়েছে?’’
কানু লাল লাল ভিজে ভিজে চোখ দুটো তুলে তীব্রস্বরে বলল, ‘‘না।’’
আচ্ছা আমি ওদের ডেকে বকে দিচ্ছি।’’
‘‘না না, কক্ষনো না—’’ কানু আরও তীব্রকন্ঠে বলে ওঠে, ‘‘আমার জন্যে কাউকে কিছু করতে হবে না। সবাইকে চিনে নিয়েছি আমি।’’ জোরে জোরে ঘাসটাকে আরও টুকরো করতে লাগল কানু।
শিবনাথ আবার হাসলেন।
‘‘চিনে নিয়েছ, সেতো ভালোই। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিলে-মিশে থাকতে হবে তো?
‘‘কেন হবে? থাকব না আমি। দরকার নেই আমার কারও সঙ্গে মিলে-মিশে থাকবার। আমি পাজি, আমি খারাপ, আমি ছাই, আমি জন্তু, আমি জানোয়ার, আমি মরে যাব।’’ বলে হঠাৎ পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল কানু স্কুল-কম্পাউণ্ডের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে।
শিবনাথ মাস্টার কেমন যেন স্তম্ভিতের মতো তাকিয়ে থাকলেন, বাধা দিতে পারলেন না।
শিবনাথ মাস্টারকেও কেউ বাধা দিয়ে আটকাতে পারেনি। সেইদিনই তিনি স্কুল-কমিটির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, তিনি স্কুলের কাজ থেকে মুক্তি চান।
দরখাস্ত দেখে স্কুল কতৃপক্ষ তো নিজেদের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারেননি। শিবনাথ মাস্টার ছাড়বেন ‘বঙ্গভারতী হাইস্কুল’!
বঙ্গভারতী হাই স্কুলের প্রত্যেকটি বেঞ্চ, টেবিলও যে শিবনাথ মাস্টারের সন্তানতুল্য প্রিয়। মরবার দিন পর্যন্ত উনি স্কুলে আসবেন এই ছিল সকলের ধারণা।
এ স্কুলের গোড়াপত্তন থেকে শিবনাথ আছেন। কত মাস্টার এল গেল, স্কুল কমিটির কত রদবদল হল, শিবনাথ ঠিক আছেন টিকে।
আর আজ হঠাৎ কারও সঙ্গে কোনো মতান্তর হয়নি, কোথাও কোনো গোলমাল হয়নি, শান্তস্থির পরিবেশের মাঝখান থেকে শিবনাথ হঠাৎ চাকরির দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাইছেন, এর মানে কী?
কর্তারা ‘হাঁ হাঁ’ করে ছুটে এলেন, কত প্রশ্ন, কত অনুনয় বিনয়! শিবনাথ আপন প্রতিজ্ঞায় অটল। তাঁর শুধু একটি কথা—‘‘আর পারছি না।’’
‘‘পারছেন না? শরীর খারাপ? বেশ তো ছুটি নিন?’’
না, শরীরে কিছু হয়নি শিবনাথের।
শরীরে কিছু হয়নি অথচ ‘পারছি না’—এ কেমন কথা?
ওই কথা।
ছুটি চাই! ছুটি চাই!
শিবনাথ মাস্টারের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ছুটির জন্য।
অনেক অনুনয়ের পর অবশেষে সেক্রেটারি মশাই রেগেই উঠলেন। বললেন, ‘‘বিনা কারণে হঠাৎ এভাবে কাজ ছাড়া সন্দেহজনক। এতে স্কুলের বদনাম হতে পারে, অনেকে হয়তো মনে করতে পারে আমি আপনাকে ছাড়তে বাধ্য করেছি। আপনাকে স্কুল ছাড়ার কারণ দর্শাতে হবে। লিখুন তাহলে— ‘শারীরিক অসুস্থতার জন্য—’’
শিবনাথ বাধা দিয়ে বললেন, ‘‘বললাম তো শরীর খুব সুস্থ আছে আমার—’’
‘‘তা হলে? একটা কিছু বলবেন তো—’’ প্রায় বকে ওঠেন সেক্রেটারি।
‘‘আচ্ছা! বলছি।’’
শিবনাথ টেবিল থেকে একখানা কাগজ টেনে নিয়ে লিখলেন—‘শিক্ষকতা আমার জীবনের ব্রত ছিল, ‘বঙ্গভারতী হাই স্কুলে’ দীর্ঘকাল সেকাজ করিয়াছি, কিন্তু এখন বিবেচনা করিতেছি যে, শিক্ষকতা করিবার অধিকার আমার ছিল না। দীর্ঘকাল যাবৎ একটি প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনে বসিয়া ‘শিক্ষকতা’রূপ খেলা করিয়া আসার জন্য আমি লজ্জিত। সেকারণ আমি আজ—’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবাক হয়ে সকলে ভাবল, বয়েস হয়ে মাথাটা বিগড়ে গেল নাকি শিবনাথ মাস্টারের? কেউ কোনো কারণ বুঝতে পারল না।
আর—একটু একটু কারণ যারা বুঝতে পারছিল, তারা ভয়ে চুপচাপ রইল। কারণ তারাই হয়তো ‘কারণ’। শিবনাথ মাস্টারের ছাত্রবৃন্দ।
কানু দৌড় মারবার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লাসে এলেন মাস্টারমশাই। অভিমানাহত কানুর যন্ত্রণা তিনি নিজের ভেতরে অনুভব করছিলেন। ক্লাসে এসে ছাত্রদের ডেকে প্রথম বললেন, ‘‘শোনো, তোমরা তোমাদের একজন সহপাঠীর দুঃখের কারণ হয়েছ, এটা ভারি লজ্জার কথা। কানুর সঙ্গে তোমরা কথা বলছ না, খেলছ না—এতে সেঅত্যন্ত কষ্ট পেয়েছে।’’
ক্লাসসুদ্ধ ছেলেই অবশ্য নীরব।
তবে দু-চারজন উশখুশ করছিল উত্তর দেওয়ার জন্য। মাস্টারমশাই আর একবার সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করে স্নেহ-কোমল কন্ঠে বললেন, ‘‘সেতোমাদের বন্ধু। তোমাদের উচিত হয় না তার মনে কষ্ট দেওয়া। তোমরা ছাত্র, সব থেকে পবিত্র আর মহৎ এই জীবন! পরস্পর পরস্পরকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে যদি না দেখতে পারো তোমরা, তার চাইতে নিন্দনীয় আর কিছুই নেই। জীবনের পরম শ্রেষ্ঠ কাল—বাল্যকাল, পরম শ্রেষ্ঠ জীবন ছাত্রজীবন, এসময় তোমরা নিজেদেরকে মানুষ করে তোলবার সাধনায় ডুবে থাকবে। হিংসা-দ্বেষ, রেষারেষি, নীচতা, এসব কেন? কানু বেচারা আজ পালিয়েছে, কাল থেকে তোমরা ওর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলবে।’’
হঠাৎ একটা বেঞ্চের তলা থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘‘না না না।’’ সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসসুদ্ধ ছেলে হই চই করে উঠল—‘‘না না না।’’
কোন ফাঁকে সত্যশরণ বেঞ্চ থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে বেঞ্চের তলায় বসেছিল, আর ঝুলন্ত পা গুলোতে চিমটি কাটছিল। এখন যেন বাজনার ধুয়ো ধরল—‘‘না না না।’’
মাস্টারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কেন, তার দোষটা কী?’’
‘‘একশো হাজার দোষ! সেপাজি, ভীষণ পাজি!’’
শিবনাথ মাস্টারের ক্লাসে এরকম গোলমাল বোধকরি এই প্রথম।
মাস্টারমশাই বিরক্তভাবে বললেন ‘‘সভ্য ভাষায় কথা বলতে শেখো। তার দোষটা কী না বলে তাকে খারাপ বলছ কেন?’’
‘‘দোষ-টোষ জানি না স্যার—’’ ছেলেদের গলায় যেন বেপরোয়ার সুর— ‘‘বাড়িতে বারণ করে দিয়েছে ওর সঙ্গে মিশতে।’’
শিবনাথ মাস্টার দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘‘সকলে মিলে একজনের বিরুদ্ধে লাগা হচ্ছে নিষ্ঠুরতার চরম, এতে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। বাড়িতে বোলো আমি বলেছি কথা বলতে।’’
‘‘হবে না স্যার! বাড়িতে মেরে ফেলবে। আপনার কথা শুনতে গিয়ে মরতে পারিনা তো স্যার! কেনোর সঙ্গে আমরা কেউ কথা বলব না।’’
শান্তশিষ্ট দেখতে ছেলেগুলোর ভেতরের বর্বরতা বেরিয়ে পড়েছে।
শিবনাথ মাস্টারেরও হঠাৎ কেমন রোখ চেপে গেছে। তাঁর কপালের শির ফুলে ওঠে, চোখ জ্বালা করতে থাকে, প্রায় ধমকের সুরে বলেন তিনি, ‘‘আমার আদেশ হচ্ছে তোমরা তোমাদের একজন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বন্ধ রাখবে না। কথা বলবে।’’
‘‘বলব না। বলব না।’’
‘‘তোমরা যদি এরকম অসভ্যতা করো, আমি আর তোমাদের পড়াব না।’’
মাস্টারমশাই বুঝি মোক্ষম চাল দেন।
কিন্তু ছেলেগুলো আজ যেন দুঃসাহসের বর পেয়েছে, তাই বলে ওঠে—‘‘না পড়াবেন, না পড়াবেন, তাই বলে কি নিজের বাপ-মার অবাধ্য হব? তাই বুঝি চাইছেন? বেশ তো আপনার শিক্ষা স্যার!’’
শিবনাথ মাস্টারের সামনে যেন হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠেছে, যেন সেআগুনে তাঁর সর্বস্ব পুড়তে বসেছে, অথচ তাঁর হাত-পা বাঁধা। হাত-পা বাঁধার মতো নিরুপায় দৃষ্টিতে তিনি এই কোলাহলপরায়ণ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন। প্রথম শ্রেণির ছাত্র, নেহাত অবোধ শিশু কেউ নয়, চৌদ্দ পনেরো ষোলোর মতো বয়েস। ক্লাসে ফেল করা সতেরো আঠারোর গাধাও আছে দু-একটা।
কারও গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে, কারও গলার স্বর মোটা হয়ে গেছে, এদের এই দুর্বিনয়কে ছেলেমানুষি বলে ওড়ানো চলে না।
হঠাৎ নিজের অভ্যেসের বিপরীত স্বরে ধমক দিয়ে উঠলেন শিবনাথ মাস্টার, ‘‘বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে।’’
গোটাকতক ছেলে বাদে, সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সমস্ত ছেলে হই হই করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মাস্টারমশাই যেন দিশেহারা হয়ে গেছেন, বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কোথায় কী ঘটল! তাঁর শিক্ষকজীবনে ছাত্রদের এরকম অসৌজন্য এই প্রথম।
কিন্তু কেন? সকলে একসঙ্গে এ রকম কেন?
বোধকরি বর্বরতার একটা নেশা আছে। একজনের মধ্যে তার প্রকাশ দেখলেই অপরজনের সেই ইচ্ছে জেগে ওঠে। আর এই বর্বরতার শিক্ষা পেয়েছে তারা তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকেই।
শিবনাথ একবার ভাবলেন, যে ক-টা ছেলে বসে আছে যথানিয়মে তাদেরই পড়িয়ে যাবেন, পারলেন না। হাত পা কাঁপছে, গলার স্বর বসে গেছে। হাতের ইশারায় ওদের চলে যেতে বললেন। ওরা চলে গেল। উনি বসে রইলেন একটুখানি। তারপর মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন ক্লাস থেকে।
মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকা, দুটো হাত পেছনের দিকে জড়ো করা, যাচ্ছেন সরু প্যাসেজটা দিয়ে, হঠাৎ কী একটা বন্দুকের গুলি এসে বুকে বিঁধল?
না, সত্যকার বন্দুকের গুলি নয়, কিন্তু তার চাইতেও বুঝি ভয়ানক! কথার গুলি!
কাঠের পার্টিশনের ওপিঠে একটা হি-হি-হি-হি-হাসির সঙ্গে কথার আওয়াজ! ‘‘শিবু মাস্টারকে আজ একেবারে হাড়গোড়ভাঙা ‘দ’ বানানো হয়েছে। হি হি হি!’’ ‘‘আচ্ছা কেনোটার ওপর শিবুর এত দরদ কেন বলত?’’
‘‘জানিস না? হি-হি-হি-হি হো-হো-হো-হো—খ্যাক খ্যাক খ্যাক! কেনোই যে শিবুর নাতজামাই!’’
না, তবুও অজ্ঞান হয়ে যাননি শিবনাথ, শুধু বোধকরি অসাড় হয়ে গিয়েছিলেন।
সেই অসাড় অবস্থাতেই অফিসঘরে এলেন, দরখাস্ত লিখলেন, নি:শব্দে বেরিয়ে গেলেন বঙ্গভারতী হাই স্কুলের গেট পার হয়ে।
পরের দিন কমিটির দলবল নিয়ে স্বয়ং সেক্রেটারি গিয়ে হানা দিয়েছিলেন মাস্টারের কাছে, কিন্তু তার ফলাফল তো আগেই বলেছি।
‘‘আমি অসুস্থ নই’’ বলে যতই বিবৃতি দিন শিবনাথ, ক-দিন পরেই বিছানা নিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রথম আর সেই শেষ।
কিন্তু বেচারা ফুলি আর ক-টা ছোটোছেলে কীভাবে এত বড়ো বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, সেখবর কে রাখে?
দেশসুদ্ধ লোক তখন দাশু মিত্তিরের ছেলের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার মুখরোচক খবরটা নিয়ে মশগুল।
শুধু যুদ্ধে যেদিন হার মানল ফুলি, সেদিন সবাই সচকিত হয়ে ছুটে এল। কোমরে গামছা বাঁধল, ঘি কাঠ জোগাড় করল, শিবনাথ মাস্টারের দেহভস্ম চন্ডীতলার শ্মশানে রেখে ফিরে আসার সময়ে সমস্বরে বলতে লাগল—‘‘একটা ইন্দ্রপাত হয়ে গেল!’’ ‘‘হ্যাঁ যথার্থ ব্রাহ্মণ ছিলেন বটে একজন!’’ ‘‘অমন স্বাস্থ্য ছিল, এত তাড়াতাড়ি যাবেন, কেউ ভাবেনি কখনো।’’
কানু এ সবের কিছুই জানতে পারল না।
সেতখন দিনের পর দিন—না স্নান, না খাওয়া, এক কাপড়জামায় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দাশু মিত্তির যে নিরুদ্দেশ ছেলের উদ্দেশে কাগজে কাগজে আবেদনপত্র ছাপিয়েছেন তার মা মৃত্যুশয্যায় বলে, আর পাঁচশো টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে, সেসব কিছুই টের পায়নি কানু।
রাস্তার ছেলেদের মতোই অনেকদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল কানু।
কী খেয়েছে?
ঈশ্বর জানেন!
কী পরেছে?
সেই এক কাপড় জামা।
রাস্তার কলে ভিজেছে, বৃষ্টির জলে ভিজিয়েছে, গায়েই শুকিয়েছে।
কোথায় শুয়েছে?
হয়তো ফুটপাথে, হয়তো কারও বাড়ির দাওয়ায়, হয়তো কারও ঝুল বারান্দার নীচে।
আর শুধু মনে মনে সংকল্প করেছে ওর এই যন্ত্রণার শোধ পৃথিবীকে কীভাবে দেবে।
অবশেষে একদিন জীবনের মোড় একটু ঘুরল। আশ্রয় পেল কানু।
কানুর প্রায় সমবয়সি একটা ছেলে, হয়তো বা মাত্র দু-এক বছরের বড়ো, মোটর চালিয়ে ছুটে আসছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে, ব্রেক কসতে কসতেও কানুর গায়ে লাগল একটু ধাক্কার মতো, রাস্তায় পড়ে গেল কানু।
রাস্তাটা একটু নির্জনমতো, তাই সঙ্গে সঙ্গে দশ-বিশজন লোক এসে গাড়ির চালককে ঘিরে ধরেনি, কানুই ঝেড়েঝুড়ে উঠল। উঠে চোখ রাঙিয়ে রুখে দাঁড়াল।
কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে, কাউকে গাড়িচাপা দিলে যে চালকের শাস্তি হয়, সেটা তার জানা হয়ে গেছে। তার ওপর যখন দেখল চালক একটি কিশোর মাত্র, সর্বাঙ্গে যেন আগুন ধরে গেল তার।
ওই ছেলেটা, কানুর মতো বয়েস যার, কানুর চাইতে অনেক বিশ্রী আর কালো, সেএরকম ঝকঝকে পোশাক, তকতকে জুতো পরে হাওয়া-গাড়ি চালিয়ে হাওয়ার মতো ভেসে যাবে, আর কানু হতভাগা তার গাড়ির তলায় পড়ে মরবে?
মরেনি, মরতোই তো এখুনি!
হাত-পা, মুখ ছড়ে কেটে তো গেছেই।
ছেলেটা বুঝি বলেছিল, ‘‘লাগেনি তো?’’
কানু রুক্ষ গলায় চেঁচিয়েছিল, ‘‘লাগেনি তার কী, লাগতে পারত। মরিনি, মরতে পারতাম। লাগেনি বলে তোমার দোষ কেটে যায়নি। বড়োলোক হলেই যে রাস্তার লোকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে হবে তার কোনো মানে নেই! চলো তুমি আমার সঙ্গে থানায়।’’
দেখতে দেখতে রাস্তায় ভিড় জমে ওঠে।
ভীতত্রস্ত কিশোরটি প্রমাদ গণে।
সেবেচারি বাবার অজানিতে গাড়িটিকে বার করে নিয়ে এসে একটু শখ মিটোচ্ছিল, এরকম হবে কে জানে। অবিশ্যি ছেলে সেভীতু নয়, তবে অবস্থাটা বেকায়দা যে!
সেভিড়ের কান বাঁচিয়ে কানুকে বলতে থাকে, ‘‘মাপ করো ভাই, কিছু মনে করো না ভাই। থানায় নিয়ে গেলে গাড়িটা ঠিক কেড়ে নেবে। আমার তো আর লাইসেন্স নেই।’’
চালাক কানু কথাটা বুঝে নেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আরও রোখালো গলায় বলে,
‘‘কী তোমার লাইসেন্স নেই? তাহলে তো—’’
‘‘আস্তে ভাই আস্তে, দোহাই তোমার। তুমি বরং আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলো, তুমি যা চাইবে তাই দেব।’’
অন্য সময় হলে ছেলেটা যে কানুকে ‘ভাই’ বলার কথা ভাবতে পারত না, তাতে আর সন্দেহ কী। কিন্তু বলেছি তো বেকায়দা! বেকায়দায় পড়লে বাঘও হরিণকে ‘ভাই’ বলে।
‘‘বেশ’’। বলে কানু গম্ভীরচালে গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি এসে থামল বিরাট একটা বাড়ির গেটের সামনে।
হ্যাঁ, সেই বিরাট বাড়িটার মধ্যেই আশ্রয় পেয়েছিল কানু। কেমন করে পেয়েছিল সেএখন মনে করা শক্ত। হয়তো নিরাশ্রয়রা শুধু নিজের দরকারে থেকে যায় বলেই আশ্রয় পেয়ে যায়, আর যাদের অনেক জায়গা, তারা চক্ষুলজ্জায় বলতে পারে না ‘তুমি যাও।’
কানু রয়ে গেল।
অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও কানুর পরিচয় ওরা আদায় করতে পারেনি, তবু ওরা এটুকু বুঝেছিল, ছেলেটা ভদ্রঘরের ছেলে। স্কুলে প্রথমশ্রেণি অবধি পড়েছিল, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে।
এ এক আজব বাড়ি।
কানু অবাক হয়ে দেখে এ যেন তার এতদিনের জানা পৃথিবীর উলটো-পিঠ।
এখানে বড়োরা ছোটোদের সমীহ করে কথা বলে পাছে তারা রাগ করে, ছোটোরা ইচ্ছে করে বড়োদের অগ্রাহ্য করে।
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
বাড়িতে ছেলেমেয়েই বা কতগুলো!
দুই কর্তার মিলিয়ে অন্তত আট দশটা ছেলেমেয়ে। এরা যে কখন বাড়ি থাকে কখন থাকে না, কখন লেখাপড়া করে, কথন খায়দায় কিছুই হিসেব করে উঠতে পারে না কানু।
যে ছেলেটা কানুকে গাড়িচাপা দিয়েছিল এবং সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ ওকে ডেকে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, তার নাম তপন। বড়োকর্তার ছোটোছেলে সে। ম্যাট্রিক পাশ করে সবে কলেজে ঢুকেছে। কানুর মতো একটা স্কুলেপড়া গাঁইয়া ছেলেকে সেমনিষ্যির মধ্যেই গণ্য করত না, যদি না সেদিন গাড়িচাপার ব্যাপারটা ঘটত। দায়ে পড়ে তাকে সেদিন কানুকে বন্ধুর পর্যায়ে তুলতে হয়েছিল। কিন্তু কেন কে জানে এই দুটি অসম অবস্থার ছেলের মধ্যে সত্যিকার একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রথমটায় একপক্ষের ভয়ে, শেষে বোধ করি উভয়পক্ষের ভক্তিতে।
তপন প্রথমে ওকে বাড়ি এনেই চট করে নিজের পড়ারঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘‘তোমাকে যখন বন্ধু বলেছি, তখন নিশ্চয়ই তুমি আমার নামে কারুর কাছে কিছু লাগিয়ে দেবে না, কী বলো?
কানু একবার ওর মুখের দিকে কেমন রুক্ষ রুক্ষ দৃষ্টিতে তাকায়, তারপর গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘বন্ধু না বললেও লাগাতাম না। আমি আমার শত্রুর নামেও কখনো লাগাতে যাই না।
তপন ঠিক এ ধরনের উত্তর আশা করেনি, একটু থতোমতো খেয়েই ঈষৎ বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, ‘‘তুমি তো তাহলে খুব মহৎ দেখছি।’’
কানু বসেছিল একটা চেয়ারে, দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘‘তুমি কি আমাকে ঠাট্টা করবার জন্যেই বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলে?’’
আর একবার থতোমতো খেল তপন। দেখল একে নেহাত হেলাফেলা করা চলে না। এর মধ্যে যেন একটা নতুন কিছু আছে। কী সে? আগুন নাকি?
আগুনের প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরকালের। নিজের থেকে যদি কাউকে কোনো বিষয়ে শ্রেষ্ঠ মনে হয়, তার সঙ্গেই মেশবার ইচ্ছে করে ছেলেদের। ইচ্ছে করে তাকে সন্তুষ্ট রাখতে। তপনের হঠাৎ মনে হল এই রাস্তার ছেলেটা কোথায় যেন ওর থেকে শ্রেষ্ঠ। এবারে তাই নরম সুরে একটু হেসে বলল, ‘‘তুমি আচ্ছা রাগি তো দেখছি। ঠাট্টাতেও রাগ? শোনো এসো, রাস্তায় পড়ে গিয়ে তোমার গায়ে ধুলো-কাদা লেগে গেছে, একটু গা ধুয়ে নেবে চলো। না হলে বাড়ি গিয়ে বকুনি খাবে।’’
বাড়ি!
কানুর ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকাহাসি ফুটে উঠল—বাড়ি! বলল, ‘‘আমার বাড়ি নেই।’’
‘‘বাড়ি নেই?’’ তখন একটু অবাক হয়েই কী ভেবে বলে, ‘‘ও! তুমি বোর্ডিঙে থাকো বুঝি?’’
‘‘না।’’
‘‘বোর্ডিঙে নয়? তাহলে—মানে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বুঝি?’’
‘‘না। আত্মীয় টাত্মীয় কেউ নেই আমার।’’
তপন অবাক হয়ে বলে, ‘‘তাহলে? মানে থাকো কোথায় তুমি?’’
‘‘রাস্তায়!’’
তপন এবার বুঝে নিল ছেলেটা নিশ্চয় বাজে কথা বলছে। সত্যি তো আর রাস্তায় থাকতে পারে না মানুষ! অবিশ্যি থাকে নাকি আর, তাও থাকে, কিন্তু তপনরা তাদের ‘মানুষ’ ভাবে না। আর কানুকে ঠিক সেদলে ফেলতেও পারছে না।
হয়তো খুব খারাপ বাড়িতে থাকে। কিংবা কিংবা—ওঃ নিশ্চয় তাই।
তপন ব্যগ্রভাবে বলে, ‘‘তুমি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসোনি তো ভাই?
কানু বিরক্তভাবে বলে, ‘‘আমি কী করেছি, না করেছি—তা জেনে তোমার কিছু লাভ আছে?’’
তপনের যেন উত্তরোত্তর চমক লাগে। এইটাই মজা, যারা শুধু মান্য সম্ভ্রম পেয়ে আসছে, তারা যদি হঠাৎ এরকম অগ্রাহ্য, অবহেলা পায়, তাহলে নতুন ধরনের একটা চমকের আকর্ষণ অনুভব করে। তাই রাগের বদলে বড়োলোকের আদুরে ছেলে তপন, যে ছেলে মিনতি করা কাকে বলে জন্মে জানে না, সেমিনতির মতো করে বলে, ‘‘লাভ-লোকসান আবার কী ভাই, তোমাকে বন্ধু বলে মনে করছি তাই—’’
এবারে একটু নরম হল কানু, গম্ভীরভবে বলল, ‘‘আমাকে বারবার বন্ধু বলছ কেন? তুমি এত বড়োলোকের ছেলে, আর আমি একটা রাস্তার লোক।’’
তপন ওর হাত ধরে ফেলে বলে, ‘‘বা: আর তুমি রাস্তার লোক থাকবে কেন? এখন থেকে এখানেই থাকবে।’’
‘‘এখানে থাকব?’’
হো-হো করে হেসে উঠেছিল কানু, বলেছিল, ‘‘এখানেই থাকব? কী সম্পর্কে? কোন দাবিতে?’’
তপন বলেছিল, ‘‘বলেইছি তো, আমার বন্ধু হলে তুমি, এই দাবিতে।’’
সেই দাবিতেই না হোক, তবুও থেকে গেল কানু। হয়তো বা থেকে যেতে হল বলেই থেকে গেল। রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে লেখাপড়া হওয়ার যেকোনো উপায় নেই, এটা বুঝেছিল কানু, আর এটা স্থির সংকল্প করেছিল লেখাপড়া তাকে শিখতেই হবে, মানুষ হতেই হবে। অতএব তপনের সাহায্য একটু নেওয়াই ভালো। তা ছাড়া এখানে কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখে না বলেই থাকা সহজ হল।
তবে কানুর চোখে এ এক মজার বাড়ি!
ছেলেরা বেড়িয়ে ফিরতে রাত করলে কেউ বকে না, লেখাপড়া করছে কি না কেউ দেখে না। তারা কখন খায়, কখন শোয়, বামুন, চাকর ছাড়া কেউ জানতে পারে না। অথচ তারা যখন যা ইচ্ছে করছে, তখনই পেয়ে যাচ্ছে। শুধু বলতে যা দেরি।
তপনের কাকার ছেলে স্বপন।
তার কথা ভাবলে এখনও আশ্চর্য লাগে। ওইটুকু ছেলে ম্যাট্রিক দেবে এবার, কিন্তু মুঠো মুঠো টাকা খরচ করে। বন্ধুও তার অসংখ্য। পাড়ার ফুটবল ক্লাবের ফুটবল ছিঁড়ে গেছে, স্বপন দেবে। দলকে দল বন্ধু কুলপি বরফ খেলো, স্বপন দাম দেবে। পাঁচজনকে জুটিয়ে সার্কাস দেখতে যাবে স্বপন একলা সবাইকার টিকিট কিনে দিয়ে। বোটানিকসে বেড়াতে গেল সবাই স্বপনের ঘাড় ভেঙে। কোনো ব্যাপারে তপন যেখানে এক টাকা চাঁদা দেয়, স্বপন দেয় চার টাকা।
তা বলে স্বপন বোকা নয় মোটেই।
আসল কথা সেযে বড়োলোকের ছেলে, সেটা ভালো করে জানিয়ে দিতে চায় বন্ধুবান্ধবকে। কথাবার্তাও তার তেমনি চালিয়াতের মতো।
একদিন কানু বলেছিল, ‘‘তুমি যে এত টাকা খরচ করো, পাও কোথায়?’’
স্বপন মুচকি হেসে বলে, ‘‘পাই কোথায় মানে? কেন আমার বাবা কি বেকার?’’
‘‘আহা তা নয়, মানে তোমার বাবা এত বাজে খরচ করতে টাকা দেন?’’
‘‘বাবা!’’
স্বপন আর একটু রহস্যের হাসি হেসে বলে, ‘‘বাবা কি আর সেধে সেধে দেয়? মার ভয়ে দেয়।’’
‘‘তার মানে?’’ কানু অবাক হয়ে বলে, ‘‘তোমার বাবা তোমার মাকে ভয় করেন?’’
‘‘আহা রে! ন্যাকা চৈতন!’’ পাকাটে হাসি হেসে স্বপন বলে, ‘‘বোঝো না কিছু? বাবা মাকে যমের মতন ভয় করে বুঝলি? আর এদিকে মা আমাকে যমের মতন ভয় করে।’’
‘‘ধেৎ, তুই ঠাট্টা করছিস!’’ কানু অবিশ্বাসের হাসি হাসে।
‘‘ঠাট্টা মানে? দেখিস লক্ষ করে। আমি যক্ষুনি যা চাইব, না দেবার সাধ্যি আছে নাকি মার? বাবা দিতে আপত্তি করলে রাগারাগি করে। নয়তো লুকিয়ে পকেট থেকে সরায়।
কানু গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘ছি: এটা কিন্তু তোর মার খুব অন্যায়।’’
‘‘আহা! কী আমার ন্যায়বাগীশ এলেন রে! সরাবে না তো কী? বাবারই বা কী এমন পুণ্যির টাকা? সেও তো স্রেফ চুরির ব্যাপার।’’
কানুও অবশ্য নিজের বাবাকে কখনও ভক্তি করত না, কিন্তু স্বপনের কথায় সেও চমকে ওঠে। আরক্তমুখে বলে, ‘‘তার মানে?’’
‘‘মানে?’’ মিটিমিটি হাসে স্বপন, ‘‘বাবা একটি পয়লা নম্বরের ঘুসখোর, বুঝেছিস?’’
‘‘ঘুসখোর!’’
‘‘তবে আবার কী! বাবা ঘুস খায়, কাকা রেস খেলে, নইলে আমাদের এত টাকা কীসের?’’
কানু অবাক হয়ে তাকায়।
ঘুস খায়, রেস খেলে! কানু তো জানে সেসব খুব খারাপ কাজ। এত ভালো ভালো দেখতে স্বপনের বাবা, কাকা, তারা এইরকম! ও অবাক হয়ে গিয়ে একটা বোকার মতো কথা বলে বসে। বলে, ‘‘ওঁরা তো শুনেছি খুব বিদ্বান?’’
‘‘বিদ্বান তা কী? বিদ্যে দিয়ে তো ছাই হয়। বিদ্যে থেকে অনেক বেশি টাকা হয় না রে! বেশি টাকা রোজগার করতে চাস তো বাঁকা পথ ধরতে হবে। এই হচ্ছে স্পষ্ট কথা।’’
কানুর মনে আগুন আছে, বিদ্রোহের আগুন, কিন্তু তার পরিচ্ছন্ন গ্রাম্য মনের কাছে এ ধরনের কথা বড়ো ভয়ংকর নতুন! ও আচ্ছন্নের মতো বলে, ‘‘কিন্তু ব্যাবসা করলেও তো অনেক টাকা হয়।’’
স্বপন হেসে উঠে বলে, ‘‘তুই একটা গাঁইয়া ভূত! ব্যাবসা করে অনেক টাকা কি আর যুধিষ্ঠিরমার্কাদের হয়? যারা জোচ্চুরি করতে পারে, জিনিসে ভেজাল দিতে পারে, লোকের গলায় ছুরি দিতে পারে, তাদেরই হয়, বুঝলে হে!’’
‘‘স্বপন!’’ কানু ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘‘এ কথা সত্যি? ওতে পাপ হয় না?’’
‘‘পাপ! বাবা:! তুই যেন একেবারে ভূত ‘দেখার মতো ভয় খেয়ে গেলি। সাধে কী আর বলছি গাঁইয়া ভূত! পাপ-পুণ্যি বলে জগতে কিছু নেই বুঝলি, টাকাই হচ্ছে সব।’’
গাঁইয়া ভূত! গাঁইয়া ভূত!
বড়ো অপমানকর কথাটা!
কথাটা নিয়ে অনবরত তোলাপাড়া করতে থাকে কানু, আর শেষসিদ্ধান্তে পৌঁছোয় স্বপনের কথাই ঠিক। টাকাই সব!
কানুকে টাকা রোজগার করতে হবে।
এ বাড়িতে অনেক ছোটো ছেলেমেয়ে।
মাধু, হাসি, বেলা, বাপি, মন্টু, নীলু। কেন কে জানে এরা ভারি ভক্ত হয়ে উঠল কানুর। অষ্টপ্রহর ওদের মুখে খালি ‘কানুদা’ ’কানুদা’। নিজেদের দাদা দিদিদের কাছে আমল পায় না বলেই ওদের এই আকর্ষণ! তা ছাড়া কানুর এমন কতকগুলি গুণ আছে, যা তাদের নিজেদের দাদাদের কাছে পাওয়া অসম্ভব।
কানু রঙিন কাগজ জুড়ে জুড়ে ফানুস তৈরি করতে পারে, কানু রংমশাল আর উড়ন তুবড়ির মশলা বলে দিতে পারে, কানু সামান্য একটু তুলো, পিজবোর্ড আর সুতো দিয়ে অসামান্য রকমের সব মুখোশ তৈরি করতে পারে, কানু ‘হরবোলা’ ডাকতে পারে, সর্বোপরি কানু ‘কবির লড়াইয়ে’র গান গাইতে পারে।
ছোটোদের চোখে কানুদা একটি মস্ত লোক। স্বপনের বোন—‘না ছোটো না বড়ো’ সুধা, যেন এসব ব্যাপার নেহাত কৃপার চক্ষে দেখে। অথচ আড্ডায় আসাটি চাই তার। মনে হয় যেন কানুকে রাগাবার জন্যেই ওর আসা।
হয়তো বাচ্চাগুলো কানুকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গিয়ে হাজির হল, সুধা সেখানেও হাজির। ছোট্টরা যখন কানুর গুণপনায় মোহিত, সুধা তখন ঠোঁট উলটে বলবে, ‘‘আহা ভারি তো! কে না পারে?’’
কানুর স্বভাবে এরকম সহ্য করা শক্ত, সেচটে উঠে বলে, ‘‘কে না পারে বললেই হল? নিজে তো পারার মধ্যে পারো শুধু মাথায় বাহার করে ফিতে বাঁধতে! কই হরবোলা ডাক ডাকো দিকি?’’
সুধা দুষ্টু-হাসি হেসে বলে, ‘‘দায় পড়েছে আমার গাধার ডাক, শেয়ালের ডাক ডাকতে। ও যাকে মানায়, সেই ডাকবে।’’
‘‘কী! কী বললে!’’ বিচলিত কানু ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, ‘‘তোমার ভারি সাহস দেখছি! জানো ফুলি এরকম কথা বললে, তাকে—’’
হঠাৎ থেমে যায় কানু।
বোধ হয় বোঝে এ তুলনা অর্থহীন। কোথায় সুধা আর কোথায় ফুলি! কিন্তু করবেই বা কী, সুধাকে দেখলেই সবসময় যে তার খালি খালি ফুলির কথা মনে পড়ে যায়,দু-জনের যেন কোথায় কোনোখানে বিশেষ একটা মিল আছে। কিন্তু কী সেই মিল? কানু জানে না, বোঝেও না।
কানু চুপ করতেই কিন্তু সুধা কথা বলে ওঠে, ‘‘কী হল? কথা বলতে বলতে থামলে যে? ফুলি কে?’’
‘‘কেউ নয়!’’
‘‘কেউ নয়!’’
গম্ভীরভাবে বলে কানু।
‘‘কেউ নয় মানে?’’ সুধা ব্যগ্রভাবে বলে, ‘‘তোমার বোন বুঝি?’’
‘‘না।’’
‘‘তবে কে বলোই না শুনি।’’
‘‘বললাম তো কেউ নয়! তোমার ভারি কৌতূহল তো! ফুলি কখনো কোনো কথা—’’
আবার সেই ফুলির কথাই এসে পড়ে, আবারও চুপ করে যায় কানু। চুপ করা ছাড়া উপায় কী। ফুলির সূত্রে যদি কানুর পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়, যদি এরা খবর দিয়ে বসে কানুর বাপকে! তাই না ফুলি সম্বন্ধে এত সাবধানতা! অথচ ফুলি ছাড়া আর কারও কথাই যে ছাই মনে আসে না।
‘‘আবার ফুলি?’’
সুধা গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘ও বুঝেছি, ফুলি তোমার বন্ধু। বলো ঠিক বলেছি কি না!’’
কানুও গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘তা অবশ্য বলেছ। কিন্তু আর কিছু জিগ্যেস করতে পারবে না।’’
‘‘কেন? কেন? তোমার হুকুম নাকি?’’ হঠাৎ সুধা এক কান্ড করে বসে।
কাগজের শিকলি তৈরি করার জন্যে গোছাভরতি রঙিন কাগজ কেটে রেখেছিল কানু, সুধা সেগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে ছড়িয়ে উড়িয়ে দুম দুম করে চলে যায়।
ছোটো ছেলেমেয়েগুলো ‘আঁ আঁ’ করে ওঠে, সুধার প্রতি দাঁত কিড়মিড় করে ছড়ানো কাগজগুলো কুড়োবার চেষ্টা করে, কিন্তু কানু যেন গুম হয়ে যায়। রাগ করতেও ভুলে যায় যেন। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘‘দুর আর খেলব না। ভালো লাগছে না।’’
ছেলেমেয়েগুলো বোধ করি হতাশ হয়ে ছোড়দির মুন্ডপাত করতে থাকে। তারা লক্ষ করেছে ছোড়দিই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। সবসময়ই ওটা খেলা ভন্ডুল করার তালে আছে। কী গোলকধাম খেলার সময়, কী ক্যারম খেলার সময়, কী বা হরবোলা আর কবির লড়াই, ভূতের গল্প আর শ্মশানকালী পুজোর গল্পের সময়। জমজমাটি মজলিশের মাঝখানে ছোড়দি ঠিক আসবে, আর আলটু-বালটু কথা বলে কেমন একরকম ঢং করে কানুদাকে রাগিয়ে দিয়ে চলে যাবে, ব্যস! সেদিনের মতো খতম!
সাধে কি আর ছোড়দিকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না ওরা!
দেখতে অবশ্য কানুও পারে না, দেখলেই মনে মনে বলে—‘‘এই যে জ্বালাতনের অবতার এলেন!’’ কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না।
তপন গিয়ে বাপের কানে তুলেছিল কথাটা। শুনে বড়োকর্তা মনে মনে চটলেন। এ আবার কী আবদার! রাস্তা থেকে একটা ঘর-পালান ছেলেকে এনে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এই তো যথেষ্ট, আবার কিনা তার পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে! এমন কথা কে কবে শুনেছে?
কিন্তু ছেলেকে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেন না, জানেন একটু কিছু বললেই ছেলে ফোঁস করে উঠবে। তাই ঠাট্টার মতো হেসে বললেন, ‘‘কী বললে? তোমার ওই বন্ধুর ম্যাট্রিক দেবার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে? খ্যাপা না পাগল! স্কুল সার্টিফিকেট না থাকলে একজামিন দিতে দেয়?’’
তপন মুচকে হেসে বলে, ‘‘চেষ্টা করলে কী না হয়? আপনি গার্জেন হয়ে দরখাস্ত করতে পারেন—ও কোনো স্কুলেই কখনো পড়েনি, এ যাবৎ বাড়িতেই পড়েছে—’’
তপনের বাবা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘‘তারপর যখন গাড্ডু খাবে? ও যে ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে, সেকথা বলছে কে? ও নিজেই তো? ছেড়ে দাও ও সব কথা।’’
তপন গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘ছেড়ে দেব কেন? ওর যা বিদ্যে, আমাকে পড়াতে পারে।’’
‘‘তাই নাকি? এত বিদ্যের পরিচয়টা দিল কখন?’’
‘‘এত কথা আপনাকে বোঝানো আমার সাধ্য নয়। মোটকথা টেস্টে অ্যালাউ হয় কি না দেখলেই তো বোঝা যাবে।’’
‘‘তা পরিচয়টা কী দেব? তোমার উনি তো আবার নামধাম কিছু বলেন না।’’
‘‘সেআপনি বানিয়ে কিছু বলে দেবেন। ভাগনেটাগনে যা হয় কিছু বলতে পারেন।’’
এবার কথা বলেন তপনের মা। তিনি বিরক্তভাবে বলেন, ‘‘তা কে না কে, একটা রাস্তার ছোঁড়া, তার জন্যে উনি এত মিথ্যে কথা বলতে যাবেন কেন রে? এ যে একেবারে দিনকে রাত করা!’’
‘‘দিনকে রাত’’!
তপন মৃদু হেসে বলে, ‘‘সেতো আপনারা হরদমই করছেন! তবে যদি বলেন অন্যের উপকার করতে কেন করবেন, সেআলাদা কথা! নিজের দরকারে একটা কেন একশোটা মিথ্যে কথাও বলা যায়, তাই না?’’
গট গট করে চলে যায় তপন, আর স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন তার মা-বাপ। বিশেষ করে বাবা। কখন কী অন্যায় আচরণটা করছেন তিনি? কিছু তো মনে পড়ে না। হ্যাঁ, তাঁর মেজোভাই, ছোটোভাই একটু নীতিজ্ঞানহীন বটে, কিন্তু তিনি তো ওকালতি করেই যা কিছু করছেন। কত সুখে রেখেছেন ছেলেমেয়েদের, তবু ছেলেরা তাঁকে অগ্রাহ্য, অপমান করতে পারলেই আহ্লাদ পায়।
কেন? কেন?
‘কেন’ এ প্রশ্ন আজ মিত্তির সাহেবও মনে মনে করেন। দেখছেন তো চারিদিকে তাকিয়ে। দেখছেন আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যেন ফণাধরা সাফ! ফোঁস করেই আছে। মা-বাপের অধিকার নেই একটা ন্যায়অন্যায় কথা বুঝিয়ে বলবার! গুরজনকে মান্যভক্তি করার কথাটা এ যুগে হাস্যকর, বয়সে বড়োদের মুখের ওপর কথা বলে তাঁদের ঠাণ্ডা করে দিতে পারলেই যেন এ যুগের ছেলেদের বাহাদুরি!
এরা তর্ক করে না, রাগারাগি করে না, করে অবজ্ঞা আর অগ্রাহ্য!
এই তো সেদিন মিত্তির সাহেবের চোখের সামনেই তাঁর এক বন্ধুর ছেলেকে দেখলেন। কী একটা কথা নিয়ে ছেলেকে বকাবকি করছিলেন বন্ধু, ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর দিচ্ছে না দেখে মিত্তির সাহেব ভাবছিলেন ছেলেটা খুব নম্র তো, আধুনিক ছেলেদের মতো উদ্ধত নয়। হায় ভগবান! আর বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, যেই বাপ থেমেছে, ছেলে একটু মুচকে হেসে বলল কী না, ‘‘আপনার আর কিছু বলবার আছে? থাকে তো তাড়াতাড়ি বলে নিন, আমার একটু কাজ আছে।’’
বাপ আর বাপের বন্ধু দু-জনেই হতবাক!
আর সেদিনকে পাড়ার শ্যামলবাবুর মেয়েটা কী করল! পাঁচ-জনের সামনে বাপ তো লজ্জায় লাল! বাড়িতে না বলেকয়ে স্কুলের দলের সঙ্গে বোটানিক্যাল গার্ডেন বেড়াতে যাওয়া হয়েছে মেয়ের, এরা তো ভেবে অস্থির। এখানে খোঁজ নেয়, ওখানে খোঁজ নেয়, স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে তখন, স্কুলের দারোয়ান ঠিক খবর বলতে পারে না। বাড়িতে কী অবস্থা ভাবো!
সন্ধ্যার পর যখন মেয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি এলেন, কার ইচ্ছে করে মেয়েকে তখন আদর করতে? বাপ কাকা বকবে না যাচ্ছেতাই করে? অবিশ্যি বকেছে তারা খুবই। বাড়ির দরজাতেই বকেছে, বলেছে—‘‘যা ইস্কুলেই থাকগে যা বাড়ি ঢুকতে পাবি না।’’ ব্যস মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে গট গট করে উলটোমুখো চলতে শুরু করল!
ভয় নেই ডর নেই! শ্যামলবাবুই তখন ছুটলেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসতে।
শেষপরে বলে কিনা, ‘‘খেতে পরতে দিচ্ছ, সেতোমরা দিতে বাধ্য, লেখাপড়া শেখাচ্ছ, সেতোমাদের কর্তব্য, তাই বলে এত শাসন কীসের? এত শাসন সহ্য করব না, এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার যুগ, প্রত্যেকটি মানুষই মানুষ। তারা গোরু-ঘোড়া বাক্স-বিছানার মতো কারও সম্পত্তি নয়।’’
একটা স্কুলেপড়া মেয়ের মুখে এই কথা!
আজকালকার বাপ মা তাই ভয়ে আর কিছু বলে না। ভয় মানে তো আর ছেলেমেয়েকে নয়, ভয় আত্মসম্মানকে। ভয় অপমানিত হওয়ার ভয়।
সবাই বলছে এ ঔদ্ধত্য এ যুগের কুশিক্ষার ফল, ভুল শিক্ষাপদ্ধতির ফল।
কিন্তু—
মিত্তির সাহেব ভাবেন, এ ফল কি আজই হঠাৎ ফলতে শুরু করেছে? অনেক অনেক আগে থেকেই এর সূচনা দেখা গিয়েছিল।
দেখা গিয়েছিল মফসসলে কানুর মতো ছেলেদের মধ্যে, দেখা গিয়েছিল শহরে তপন স্বপন সুধাদের মতো ছেলেমেয়েদের মধ্যে। বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়েছে অনেকদিন থেকেই।
হয় তো এও একরকম প্রতিক্রিয়া!
একসময় এ দেশের মানুষকে সবকিছুই নির্বিচারে মেনে আসতে হত— দেবতা থেকে শুরু করে পাথরের নুড়িটাকে পর্যন্ত, রাজা থেকে রাজপেয়াদাকে! মানতে হত মঘা, অশ্লেষা, হাঁচি ; টিকটিকি, মানতে হত শাপমণ্যি, তুকতাক, মাদুলি কবচ, মানতে হত গুরুজন পরিজন পাড়াপড়শি, গো-ব্রাহ্মণ, গুরু-পুরুত সব কিছুই।
মানতে মানতে, আর ‘না মানলেই সর্বনাশ হবে’ এই ভয়ের বোঝা বইতে বইতে মুখ থুবড়ে যাচ্ছিল তার, হঠাৎ দেশের নাড়িতে জাগল চাঞ্চল্য, দেশবাসীর রক্তে জাগল বিদ্রোহ।
বিদ্রোহী মানুষ একদিন ভাবতে শুরু করল ‘কেন এই মানা? আচ্ছা এইবার না মেনেই দেখি। জয় করব ভয়কে।’’
সেই তার অগ্রাহ্যের শুরু! অবাধ্যতার শুরু!
সেই সংকল্পের ক্ষণে তাদের গুরুর নির্দেশ এল এক নতুন ভয় ভাঙানো মন্ত্র নিয়ে, সেমন্ত্র ‘অহিংসা’। তিনি বললেন, ‘‘হিংসা কোরো না, কিন্তু ভয়ও কোরো না। তুমি পরাধীন তোমার ভয়ের কাছে, সেখানে স্বাধীন হতে হবে তোমাকে—’’
নতুন কথা, নতুন মন্ত্র!
ভয় জয় করার নেশা ধরল লোকের, তুচ্ছ করল রাজভয়, আর শাসনভয়, তুচ্ছ করল সর্বনাশের ভয়। তুচ্ছ করল মৃত্যুভয়।
তারপর—
তারপর আস্তে আস্তে কোন দিক থেকে কী যে হয়ে গেল! চাওয়ার রূপ গেল বদলে, মন্ত্রের মূর্তি গেল মিথ্যে হয়ে, শুধু নেশাটা রইল প্রচন্ড তাড়নায়।
তুচ্ছ করবার নেশা!
সেই নেশায় দেশ প্রথমেই তুচ্ছ করে বসল তার ‘অহিংস’ মন্ত্রকে, তুচ্ছ করে বসল তার গুরুকে। তুচ্ছ করতে শিখল তার সভ্যতার ঐতিহ্যকে। দু-যুগ ব্যাপী অহিংসার শিক্ষাকে ধ্বংস করে সুদে-আসলে পুষিয়ে নিল দেশে রক্তের বন্যা বইয়ে। এই রক্তের বন্যা আর দুর্নীতির বন্যার মাঝখানে যারা জন্মাল, প্রথম চোখ মেলে দেখল যুদ্ধোন্মত্ত পৃথিবীকে। তারা কোথায় পাবে সভ্যতার শিক্ষা, নম্রতার শিক্ষা, বাধ্যতার শিক্ষা?
এরা জানছে অবাধ্যতাই সভ্যতা, অনমনীয়তাই ফ্যাশান। তাই আজকের ছেলেমেয়ে শুধু ওপরওয়ালাদেরই অপমান করছে না, অপমান করছে নিজেদের আত্মাকেও।
নীতিহীন, লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন অদ্ভুত একটা জাত সৃষ্টি হয়েছে আজকে!
যোগসাধনার ‘অষ্টসিদ্ধি’ তত্ত্ব বিসর্জন দিয়ে একটিমাত্র সিদ্ধির সাধনায় উন্মাদ হয়ে বেড়াচ্ছে সেজাত, তার নাম স্বার্থসিদ্ধি!
না, আজকের যুগ শুধু আজকেই সৃষ্টি হয়নি, যুগান্তর আগে এর সূচনা! আগে ওপরওয়ালা থেকে অবিচারের চাপ নীচেরতলাকে পিষ্ট করত, এখন নীচেরতলা থেকে অসহিষ্ণুতার ঠেলা ওপরতলাকে ক্লিষ্ট করছে!
অনন্তকালের বহমান সমুদ্রে অসংখ্য ঢেউ উঠছে পড়ছে মিলিয়ে যাচ্ছে, কে তার হিসেব রাখে? হিসেব রাখে শুধু সেই ঢেউটার, যে ঢেউ জাহাজ ডোবায়, তীর ভাসায়!
অনেক দিনরাত্রির সমষ্টি নিয়ে একটা জীবন। অসংখ্য ঘটনা দিয়ে সেজীবন ভরাট। সব ঘটনা কার মনে থাকে? মনে থাকে সব কথা? শুধু ঝাপসা ঝাপসা স্মৃতির নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে ভেসে ওঠে এক একটা বিশেষ দিনের স্মৃতি, এক একটা বিশেষ ঘটনার ঢেউ।
হয়তো সেবিশেষটা অন্যের চোখে তুচ্ছ, কিন্তু বিশেষ একজনের কাছে বিশেষ কোনো একটি মুহূর্ত অক্ষয় হয়ে থাকে বই কি!
কানুর কাছেও অক্ষয় হয়ে আছে ছোটো একটা মেয়ের ছোটো একটু নির্বোধ ছেলেমানুষি, আর তার সঙ্গে নিজের নির্বোধ হৃদয়হীনতা।
খানচারেক দশটাকার নোট!
লুকিয়ে মুঠোয় চেপে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সুধা। কানু বুঝি ওর তখনকার ভীত হৃৎপিন্ডের ধুক ধুক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল।
‘‘এতে চারটে নোট আছে কানুদা!’’
অবাক হয়ে গিয়েছিল কানু। বলেছিল, ‘‘আছে তার কী?’’
‘‘এতে তোমার একজামিনের ফি দেওয়া হবে না?’’
হয়তো হত।
টাকার দাম সিকি হয়ে যায়নি তখনও। কিন্তু হত তাতে কী। কানু চোখ গোল করে বলে উঠেছিল, ‘‘ওতে আমি একজামিনের ফি দেব?’’
‘‘দেবে না কেন? নাও না।’’
‘‘নেব মানে?’’ কানুর বিস্ময় এবার বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে। ‘‘তোমার টাকা আমি নেব কেন?’’
‘‘নিলেই বা! নিলে তুমি ক্ষয়ে যাবে নাকি? নাও না। তোমার তো দরকার।’’
হৃদয়হীন কানু তখন অদ্ভুত একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিল, ‘‘ওঃ! ভিক্ষে দিতে চাইছ? বা: বেশ!’’
সুধা আহতভাবে বলেছিল, ‘‘ভিক্ষে আবার কী! এমনি বুঝি কেউ কাউকে দেয় না?’’
‘‘আপনার লোককে দিতে পারে, রাস্তার ছেলেকে দিতে যাবে কেন?’’
সুধার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল, যেমন লাল হয়ে উঠত ফুলির মুখটা কানুর হাতের বেদম চড় খেয়ে। তবু সেবলেছিল, ‘‘বেশ, এমনি না নাও, ধারই নাও। বড়ো হয়ে রোজগার করে শোধ দিয়ো।’’
‘‘কানু আরও তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলেছিল, ‘‘আহা মরে যাই! পরে বড়ো হয়ে রোজ যেন ওঁর সঙ্গে দেখা হবে আমার! চিরকাল তোমাদের বাড়ি পড়ে থাকব আমি?’’
সুধা ফুলি নয়, ফুলির মতন ভালোমানুষ নয়। তার রাগ আছে, অভিমান আছে, মুখে প্রখর ভাষা আছে। তবু সেকষ্টে আত্মসংবরণ করে বলেছিল, ‘‘চিরকাল তুমি পরের বাড়িতে পড়ে থাকবে, সেই কথাই কি বলছি আমি? তা বলে কখনো কখনো দেখা হবে না?’’
‘‘মোটেই না।’’ নিষ্ঠুরতাতেই আনন্দ কানুর, তাই সগর্বে বলেছিল, ‘‘চলে যখন যাব জন্মের শোধ দিয়ে যাব।’’
সুধা এরপরও ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে, বলেছে, ‘‘বেশ, তাই—তাই। কিন্তু কানুদা, উন্নতি করতে না পারলে তো কিছুই হবে না। উন্নতি করতে হলে লেখাপড়া শেখা দরকার। আর শিখতে হলে টাকা চাই। রাস্তায় কেউ তোমার জন্যে টাকা নিয়ে বসে নেই!’’
বসে যে নেই, সেকথা কি আর কানুই জানে না? রাস্তার অভিজ্ঞতা তার যথেষ্ট হয়ে গেছে। তবু অহংকারী কানু কখনো ভবিষ্যৎ ভাবতে শেখেনি। তাই কড়া সুরে বলেছিল, ‘‘বসে আছে কী নেই সেআমি বুঝব।’’
আশ্চর্য! সুধা এরপরও রেগে ঠিকরে না উঠে সহসা ভারি নরম হয়ে গিয়েছিল। নরম হয়ে ব্যগ্রভাবে বলেছিল, ‘‘মিথ্যে অহংকারে সব নষ্ট কোরো না কানুদা, তোমার পায়ে পড়ি। ভালো করে পাশ করে এদের একবার দেখিয়ে দাও, যে-সেছেলে নও তুমি। তারপর তো টিউশনি করেও কলেজে পড়তে পারবে।’’
পাশ!
কলেজ!
লোভে সমস্ত মনটা দুলে উঠেছিল কানুর। ‘ভগবান বলে কিছু নেই’ জেনেও ভুলে ভুলে সেকাল সারারাত ধরে ভেবেছে—ভগবান যদি কিছু টাকা তাকে হঠাৎ পাইয়ে দেন। সেই টাকাই আজ এসে গেছে হাতের মুঠোয়। কিন্তু সেটাকা নিতে পারবে না। অহংকার আর উচিত-অনুচিত বোধ নিতে দেবে না তাকে। তাই রূঢ়স্বরে বলে উঠেছিল, ‘‘আমার জন্যে তোমার এত মাথা-ব্যথা কেন? নিজের চরকায় তেল দাওগে না।’’
এ অপমানে সুধার চোখে হঠাৎ জল এসে গিয়েছিল, সেই জলভরা চোখে ছুটে পালিয়েছিল সেএই কথা বলতে বলতে, ‘‘ঠিক আছে। আর বলব না। এই জন্যেই বলে কলিকালে কারুর ভালো করতে নেই—’’
কান্নাফান্না মোটে সহ্য করতে পারে না কানু। তাই তখন কেমন ভ্যাবা-চ্যাকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। আর বার বার ভেবেছিল ‘টাকাটা না হয় না নিতাম, এত কড়া কথা না বললেই হত।’
সেদিনের কথা ভাবতে গেলে এখনও যেন মনটা কেমন করে ওঠে।
সুধার টাকা কানু নেয়নি, কিন্তু সুধাদের বাড়ি থেকেই টাকাটা জোগাড় করেছিল। ছি ছি! সেকথা মনে পড়ে গেলে এখনও যেন লজ্জায় মাথাকাটা যায় কানুর। তবু এও ঠিক, সঙ্গদোষই কানুকে সেই ছোটো কাজে প্রবৃত্ত করেছিল। অথচ সেসঙ্গ ছোটোলোকের নয়, বড়োলোকের ছেলেদেরই। এদেরই। স্বপন আর তাদের ভাইদের এবং বন্ধুদের। মনে আছে একদিন বাড়ি থেকে খানিক দূরে একটা গলির মোড়ে স্বপন আর তার দুটো বন্ধুর কান্ড দেখে যেন নিশ্বাস আটকে গিয়েছিল কানুর। চোখের তারা শক্ত করে কাঠ হয়ে গিয়ে বলে উঠেছিল সে, ‘‘স্বপন, তোমরা সিগারেট খাও?’’ আর কানুর সেই চমকানি দেখে অন্য ছেলে দুটো একেবারে হি হি করে হেসে উঠে ওর গায়ের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বলেছিল—‘‘বটে নাকি? অ্যাঁ তাইতো! স্বর্গের দেবদূতটি কোথা থেকে এল হে! ও স্বপন, এই চিজটিই বুঝি তোর দাদার আমদানি সেইটি?’’
বোঝা গেল স্বপন কানুর নামে বেশ কিছু গল্প করেছে বন্ধুদের কাছে। বিস্ময়ে দুঃখে ধিক্কারে আর এই ঠাট্টায় কানু হঠাৎ এক মিনিট কীরকম যেন হয়ে গিয়েছিল, সেই অবসরে স্বপন ওর মুখে একটা সিগারেট গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলেছিল, ‘‘আহা রে! চাষা কী জানে মদের স্বাদ! খেয়ে দেখ না একবার, বুঝবি কী মজা।’’
কানু ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়ে এসে একবারে সোজা বাড়ির মধ্যে ঢুকে বসে বসে বেশ কিছুক্ষণ হাঁপিয়েছিল।
তারপর?
হ্যাঁ, তারপরের কথাও মনে আছে বই কী। একটু পরেই কী কাজে যেন স্বপনের মা এসেছিলেন সেঘরে। এসেই থমকে গেলেন কানুকে চৌকির ওপর বসে হাঁপাতে দেখে। বললেন, ‘‘কী হল কানু? অমন করে হাঁপাচ্ছ যে?’’
ঠিক সেইমুহূর্তে না হলে হয়তো কানু নিজেকে সামলে নিত, হয়তো বলত না, কিন্তু তখন কানুর নিজের ওপর কন্ট্রোল ছিল না। তাই তেমনি হাঁপাতে হাঁপাতেই চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘জানেন মেজ কাকিমা, স্বপন সিগারেট খায়।’’
শুনে স্বপনের মা—হ্যাঁ, জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে সেও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা—শুনে স্বপনের মা চমকে ওঠেননি, শিউরে ওঠেননি, উলটে রেগে আগুন হয়ে উঠেছিলেন কানুরই ওপর। জ্বলন্ত চোখে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘‘এসব আজগুবি খবর কে আমদানি করছে তোমার কাছে?’’
তবু তখনও ঠিক অবস্থাটা বুঝতে পারেনি কানু, তাই তেমনি উত্তেজিত হয়ে বলেছে, ‘‘আমি নিজের চোখে দেখলাম।’’
‘‘তোমার নিজেরই বোধ হয় গাঁজার মাত্রাটা আজ বেশি হয়ে গেছে—’’ বলে মেজোকাকি আঁচল দিয়ে সামনের টেবিলটা অকারণে জোরে জোরে ঝাড়তে থাকেন।
কানুর আর জ্ঞান থাকে না, সেতীব্রস্বরে বলে ওঠে, ‘‘ওঃ নিজের ছেলের দোষ বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি জ্যাঠামশাইকে বলে দেব!’’
এবার মেজোকাকি নিজমূর্তি ধরেন। তীক্ষ্ণ কটুকন্ঠে বলেন, ‘‘তুমি বলে দেবার কে শুনি? তুমি বলে দেবার কে? আমার ছেলে যদি উচ্ছন্নে যায়, তোমার কি রাইট আছে কথা বলবার? ও যদি সিগারেট খেয়ে থাকে, ওর বাপের পয়সায় খেয়েছে, তোমার তো খেতে যায়নি। ওর ইচ্ছে হলে ও মদ খাবে বুঝলে!’’
গট গট করে চলে গিয়েছিলেন মেজোকাকি।
আর কানু আরও বেশি হাঁপাতে শুরু করেছিল।
ওর কিশোর মনের ওপর কে যেন একটা বিশ মন পাথর চাপিয়ে দিয়ে গেছে, তার ভার বইতে পারছে না সে।
একটু পরেই তপন এল শিস দিতে দিতে। একটা চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলে উঠল, ‘‘সবাই নাচে স্ফূর্তি করে সবাই গাহে গান, একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান?’’
কানু আড়ষ্ট কঠিন।
তপন কিন্তু ওকে সত্যিই ভারি ভালোবেসে ফেলেছে। তাই বুঝতে পারে এটা কানুর স্বাভাবিক মন খারাপ নয়। চেয়ারটা সুদ্ধ ঘড়ঘড় করে টানতে টানতে সরে এসে বলে ‘‘কী হয়েছে রে? কেউ কিছু বলেছে?’’
কানু নীরব।
তপন উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘‘কনেবউ বনে গেলি যে? হল কী?’’
কানু এবার দাঁড়িয়ে ওঠে বলে, ‘‘আমি আর এখানে থাকব না, একখুনি চলে যাব।’’
তপন একটু থতোমতো খেয়ে বলে, ‘‘কেন কেন, কী হল তাই বল না।’’
কানু এবার গড়গড় করে বলে যায় ওর আজকের সমস্ত অভিজ্ঞতার কাহিনি। ধিক্কারে আর রাগে ওর কান লাল হয়ে ওঠে, বার বার গলা বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু—কিন্তু আশ্চর্য, তপন নির্বিকার। কানুর কথা শেষ হলে ও একটুখানি হেসে বলে, ‘‘আচ্ছা কানু, তুই অন্যদিকে তো বেশ বুদ্ধিমান, তবে এদিকে এত বোকা কেন বল তো?’’
‘বোকা!’’
‘‘তা ছাড়া আর কী! অন্য লোক খারাপ হলে তোর অত রাগ চড়ে ওঠে কেন? তোর কী ক্ষতি তাতে?’’
‘‘আমার কী ক্ষতি?’’ কানু মূঢ়ের মতো বলে, ‘‘ও ওইটুকু ছেলে সিগারেট খাবে, ওর মা তাতে প্রশ্রয় দেবেন, এই সব সহ্য করব?’’
‘কেন করবি না? পৃথিবীতে কত বদমাইশ লোক আছে, রাতদিন কত খারাপ খারাপ কাজ হচ্ছে, তুই সব সামলাতে পারবি?’’
‘‘তা কে বলছে? তা বলে চোখের ওপর—’’
তপন মুচকি হেসে বলে, ‘‘তোর চোখটা এখনও সম্পূর্ণ খোলেনি কিনা তাইতেই যা দেখিস তাতেই এত চমকে চমকে উঠিস! সম্পূর্ণ খুলে গেলে দেখবি চোখের ওপর আরও কত খেলা চলছে। দুনিয়াখানাই এই রে ব্রাদার! স্বপন সিগারেট খেয়েছে দেখে তুই একেবারে কাঁটা হয়ে গেছিস দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। আমিও তো কত খেয়েছি—’’
‘‘তুমিও—’’
‘‘হ্যাঁ! অনেকবার! খেতে ভালো লাগে না, কাশি আসে বলে খাই না আর। সিগারেট! হুঁ:।’’
তপন মুচকে মুচকে হাসতে থাকে, তারপর বলে, ‘‘একদিন তো মদও খেয়েছিলাম!’’
‘‘মদ!’’ এইটুকুই শুধু উচ্চারণ করতে পারে কানু।
হ্যাঁ। হয়েছে কী? খাবার জিনিসই তো? খেয়ে দেখলাম একদিন। বিচ্ছিরি খেতে, তেতো!’’
কানু রুদ্ধস্বরে বলে, ‘‘কোথায় পেলে?’’
‘‘পেলাম? পেলাম—ছোটকার ঘর থেকে চুপি চুপি চুরি করে—’’
‘‘তোমার ছোটোকাকা মদ খান?’’
তপন এবার হো-হো করে হেসে ওঠে। হেসে কানুর মুখের কাছে হাত দুটো দুলিয়ে সুর করে বলে—
‘‘আমি কোনোরূপে স্বর্গ হতে টসকে,
পড়েছি এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে—’’
ওহে ব্রাদার, এ মাটির পৃথিবী তোমার জন্যে নয়। ছোটকা মদ খায় জানিস না তুই?’’
কানু ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।
তপন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, ‘‘ছোটকা তো তবু ফ্যাশান করে একটু আধটু খায় রে, মেজকা তো পাঁড়মাতাল। দেখিস না সন্ধের পর আর ঘর থেকে বেরোয় না। মেজোকাকি বেরোতে দেয় না ; লোক জানাজানির ভয়ে। হুঁ:। লোকে যেন আর জানে না!’’
কানু এবার গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘বুঝেছি! বুঝেছি কেন মেজোকাকি ছেলের দোষ চাপা দিলেন।’’
‘‘বুঝেছিস তো? বাঁচলাম। রোস তোকে আমি ক্রমশ বখিয়ে তুলব। একটু বখা না হলে বুদ্ধি পাকা হয় না বুঝলি? মদ খাওয়ার জন্যে কিছু না, ওতে আমি তত দোষ ধরি না, খাবার জিনিস খাকগে। ওর চেয়ে আরও কত নীচু কাজ করছে ওরা। জাল জোচ্চুরি ঘুস খাওয়া, সেঅনেক ব্যাপার! ছেলেরা সিগারেট খেলে বকবে আর কোন মুখে?
কানুও চিরদিন উদ্ধত, চিরদিনই বাপ কাকাকে অশ্রদ্ধা আর ঘৃণা করে এসেছে, তবু বুঝি এদের মতো এমন নয়। তাই চুপ করে চেয়ে থাকে। তপন এবার আবার বসে পড়ে পা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘‘আমি সব বুঝতে পারি জানে বলেই তো আমাকে সবাই ভয় করে, কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না, বুঝলি?’’
কানু ধীরে ধীরে বলে, ‘‘জ্যাঠামশাইও ওইরকম?’’
‘‘বাবা? না: বাবা অবিশ্যি ওদের মতো নয়। কিন্তু তাতে কী? আমি ইচ্ছে করেই কাউকে কেয়ার করি না। জানিস না তুই, বড়োদের স্বভাবই হচ্ছে একটু মান্য করলেই একেবারে পেয়ে বসা! ওরা চায় সন্তান হবে একেবারে ভক্ত হনুমান! কেনরে বাপু? নিজেরা তাহলে রামচন্দ্রের মতো ভালো হও? তা নয়—নিজেরা যা তা হব, ছেলেরা অবতার হবে! মাস্টারগুলোও তাই! নিজেরা একের নম্বর—’’
কানু হঠাৎ তীব্রস্বরে বলে ওঠে, ‘‘সব মাস্টার কক্ষনো সেরকম নয়।’’
তপন একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘‘ও, তোর কপালে বুঝি একটা ভালো মাস্টার জুটেছিল? তা কী জানি! তুই তো কখনো নিজের কথা বলিস না।’’
কানু সহসা বিচলিত হয়ে ওঠা মনকে ঝেড়ে ফেলে গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘আমার কোনো কথা নেই। কিন্তু একটা কথা ভাবছি—’’
‘‘কী কথা?’’
‘‘তোমরা যে এইসব করো—মানে বায়োস্কোপ দেখা, ফুটবল ম্যাচ দেখা, ইয়ে—সিগারেট ফিগারেট খাওয়া, এ সব পয়সা কোথায় পাও? তোমরা তো আর রোজগার করো না?’’
তপন হেসে উঠে বলে, ‘‘না: তোকে আর মানুষ করা যাবে না। কোথায় আবার পাব? বাবার পকেট থেকে না বলে চেয়ে নিই। অবিশ্যি ‘হাত খরচ’ বলে মার কাছ থেকে মাসে দশটা করে টাকা পাই, কিন্তু তাতে আর কদিন চলে? মেজোকাকির ছেলেটার তো দু-দিনও হয় না। বন্ধুবান্ধবদের জন্যেই কত খরচা ওর!’’
কানুর চোখ জ্বালা করতে থাকে, ও ধীরে ধীরে বলে, ‘‘টের পায় না তোমাদের বাবা কাকা?’’
‘‘টের? আমার বাবা পায় না। সত্যিই পায় না। পকেটেই সব সময় গাদা গাদা টাকা! উকিলের কাঁচা পয়সা তো? তবে স্বপনের ব্যাপার আলাদা। ওদিকে মেজোকাকি আর মেজকা দুজনেই সজাগ আছে। কাজেই স্বপন ওদের আলমারির একটা ডুপ্লিকেট চাবি করিয়ে রেখেছে। সুবিধে পেলেই আলমারি খুলে সরায়।’’
হ্যাঁ জ্ঞানদৃষ্টি খুলছে বই কী, এখুনি খুলতে শুরু করেছে কানুর। বুঝতে পারছে, সুধা ছেলেমানুষ কোথায় পেল চার চারখানা দশটাকার নোট। নিশ্চয়ই সেই ডুপ্লিকেট চাবিটা হস্তগত করেছিল। এটা ঠিক, সমবয়সি ভাইবোনদের মধ্যে কখনোই কেউ কাউকে লুকিয়ে কিছু করতে পারে না। সুধাকেও লুকোতে পারেনি স্বপন। ……বুঝতে পেরেও কিন্তু কেন কে জানে সুধাকে ঘৃণা করতে পারে না কানু, চেষ্টা করেও না।
না, সেবাড়ি থেকে সেদিন যাওয়া হয়নি কানুর। তপনের তত্ত্বজ্ঞানের স্পর্শে ক্রমশ সামলে উঠেছিল সে। তারপর স্বপনের সঙ্গেও ফের মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। স্বপন ওকে পিঠ চাপড়ে বলেছিল, ‘‘তুই যদি এত ইনোসেন্ট না হতিস তো কত চালাকি শিখিয়ে দিতে পারতাম। আসল কথা কী জানিস, ভালো হওয়ার কোনো মানেই হয় না। কী হবে ভালো হয়ে, পৃথিবীর কেউই যখন ভালো নয়?’’
কানু কাঁপা কাঁপা বুকে শোনে। হ্যাঁ, এ অভিমত তো কানুর নিজেরই ছিল। সেই তো বলেছে ফুলিকে ‘ভালো হয়ে কী হবে?’ কিন্তু কানুর মনোজগতে ‘খারাপ হওয়া’ মানে ছিল শুধু বড়োদের অবাধ্য হওয়া, এদের মতো এমন ভয়ংকর ঘটনাবহুল নয়।
তবু আশ্চর্য এরা এতর মধ্যেও লেখাপড়াটা দিব্যি চালিয়ে যায়। সেকথাও বলে এরা ‘‘যাই করি আর তাই করি, যতক্ষণ ঠিকমতো পাশ করে যাব, কেউ কিছুই বলতে পারবে না বুঝলি? মা-বাবাও চায় বাইরের লোকের চোখে ছেলের ‘গুণ’ ধরা না পড়লেই হল। ভেতরে যত পাজিই হই না, পড়া-লেখায় ভালো হলেই সব্বাই বলবে—‘‘আহা হিরের টুকরো ছেলে!’’
আর একবার লেখাপড়া সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে কানু। যে জিনিসটা ছিল তার স্বর্গীয় স্বপ্ন, সেটা ক্রমশ নতুন মূর্তিতে দেখা দেয়। ডিগ্রি চাই। গোটা তিন চার ডিগ্রি নিয়ে নিতে পারলে সমস্ত পৃথিবীকে বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে যা খুশি করা যায়। কারণ লোকের চোখে সেযে তখন ‘হিরের টুকরো!’
তপনের অনুরোধে তার এক মাস্টারমশাইয়ের চেষ্টায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায় কানুর। নন কলেজিয়েট বলে চালিয়ে দেবেন তিনি। এখন দরকার ফি জমা দেওয়ার টাকার।
ভারি আপশোস হতে থাকে এখন কানুর, সেদিন সুধার টাকাটা ফেরত দিয়েছে বলে। স্বপন আর স্বপনের বন্ধুদের হাসি তামাশা, দুঃসাহসিক পরামর্শ আর প্রত্যেক বিষয়ে ওকে ‘ইনোসেন্ট’ বলে ব্যঙ্গ, সবকিছু ক্রমেই কিশোর একটি মনকে ঠেলে নিয়ে যায় পাকামি আর ঠকামির দিকে। আজকাল এদের সঙ্গেই তার ভাব বেশি। সঙ্গদোষে আসে লোভ, আসে অসততা।
‘টাকা চাই’ ‘টাকা চাই’ সমস্ত দিন মনের মধ্যে এই বাজনার ঝনঝনা। তারই ওপর এক একটা কথার তরঙ্গ এসে আছড়ায়।
স্বপনের বন্ধু দিবাকর।
সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যখন তখন বলে—‘‘পাপ-পুণ্যি’ ‘ধর্ম-অধর্ম’ ওসব হচ্ছে পুরুত ব্যাটাদের তৈরি করা বাক্যি। আসলে সব বুজরুকি! আমি বাবা সার বুঝি নিজের সুখ সুবিধে। ‘দরকার’ ইজ দরকার। যে করে হোক সেটা জোগাড় করতে হবে ব্যস। পাঁজি-পুথি, শাস্তর, আইন, ওসব ভীতুদের জন্যে।’’
দিবাকর কম করে বোধ হয় পাঁচ বছরের বড়ো স্বপনের চাইতে, তবু গলায় গলায় বন্ধুত্ব দু-জনের। তপন ঠিক এদের মতো নয়, এদের তপন ঘৃণা করে। কানু যতদিন থেকে এদের দলে ভিড়েছে ততদিন থেকে কানুকে অবজ্ঞা আর ঘৃণা করতে শুরু করেছে তপন। আর তাতেই বুঝি একদিন মরিয়া হয়ে ওঠে কানু।
হ্যাঁ, সেদিনটা যেন ছবির মতো চোখে ভাসে। কানুর অদৃষ্টে মেজোকাকির বাপের বাড়িতে কার যেন বিয়ে লেগেছে সেদিন, ওরা সপরিবারে নেমন্তন্ন গেল সেজেগুজে। টাকার ব্যাপার থেকে সুধা আর সামনে আসে না কানুর। কানু দূর থেকে দেখল চলে গেল সবাই। খালি পড়ে রইল ওদের ঘরের দিকটা। মেজোবাবুর ছোকরা চাকরটা সুদ্ধু গেছে নেমন্তন্নে, কাজেই এর চাইতে সুবর্ণ সুযোগ আর কি মিলবে?
স্বপনের ড্রয়ারের চাবিটা হস্তগত করেছে কানু, আর ড্রয়ার হাতড়ে আবিষ্কার করেছে সেই ভয়ংকর জিনিসটা। সেই মেজোকাকির আলমারির ডুপ্লিকেট চাবি! স্বপনের তৈরি করানো!
সন্ধেবেলা সবাই আপন আপন ব্যাপারে ব্যস্ত, কে দেখতে যাচ্ছে তিনতলায় মেজোকাকির অন্ধকার ঘরটায় কে ঢুকল আর কে বেরিয়ে এল!
তবু সেদিন মনে হয়েছিল বই কী, পৃথিবীর সমস্ত চোখ শুধু কানুর দিকেই তাকিয়ে আছে। আর কানুর বুকের মধ্যে যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে, তার দুম দুম ঢিপ ঢিপ আওয়াজ সেই বাড়ির সর্বত্র, বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তায়, রাস্তা ছাড়িয়ে আরও অনেক—অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই শুনতে পাচ্ছে।
না, কানু সেরাতে খায়নি।
খেতে বসলে বামুনঠাকুর যদি শুনতে পায় সেশব্দ! যদি খপ করে ওর জামার কলারটা চেপে ধরে বলে ওঠে, ‘‘কী কানুদা’বাবু, তোমার বুকের মধ্যে ও কীসের শব্দ?’’
রাত্রে অন্ধকারে নিজের সরু ছোট্ট বিছানাটায় জেগে পড়ে থেকে থেকে মনগড়া অনেক যুক্তি দিয়ে দিয়ে মনকে শক্ত করে তুলল কানু।
কী এমন অপরাধ করেছে সে?
সামান্য খান ছয়েক দশটাকার নোট মেজোকাকাদের কাছে কী বা মূল্যবান? কত সময় পকেটেই যাঁর গোছা করে একশো টাকার নোট থাকে।! তা ছাড়া কতগুলো টাকা তো সুধা তাকে দিতেই এসেছিল। ধরো যদি তখনই নিত কানু? তাহলেই তো আর কানুর দোষ হত না? বেশ না হয় তাই নিয়েছে, ধরো তখন যেন বলেছিল সুধাকে ‘এখন রাখো পরে নেব।’ এমন তো হয়ও। সেই হিসেবে পরেই নিয়েছে, সুধা বাড়ি ছিল না বলে না হয় নিজে বার করে নিয়েছে। আর—আর অন্ধকারে বুঝতে না পেরে চার-খানার জায়গায়ছ-খানা নিয়ে ফেলেছে। শুধু তো এইটুকু! মনকে প্রবোধ দিতে দিতে হাতুড়ির আওয়াজটা ক্রমশ বিলীন হয়ে গেল, কিন্তু সারারাতের মধ্যে ঘুম হল না একফোঁটাও। আর বিছানার তলায় যেখানে সেই জিনিসটা গুঁজে রেখে তারওপর চেপে শুয়ে থেকেছিল সেখানটায়, পিঠের সেই মাঝখানটায়, অনবরত পোড়ার জ্বালার মতো জ্বলতে থাকল হু হু করে।
কিন্তু তবু—
তবু অপরাধ স্বীকার করে ফেরত দেওয়ার কথা ভাবা যায় না। কানুকে লেখাপড়া শিখতেই হবে। মানুষ হওয়ার জন্যে নয়, ডিগ্রি নেওয়ার জন্যে।
দিবাকর বলেছে ‘‘দু-চারটে ডিগ্রি নিয়ে নিতে পারলে পৃথিবীতে বুক ফুলিয়ে যা খুশি করা যায়।’’
সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফিয়ের টাকাটা জমা দিয়ে এল কানু। আর জমার পঁয়ত্রিশ টাকা বাদে বাকি পঁচিশটা টাকা ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা পুরোনো ধুলোপড়া অয়েল-পেন্টিং-এর ফ্রেমের পেছনের খাঁজে লুকিয়ে রেখে সবে যখন ধুলোহাতটা মুচ্ছে, তখন তপন হঠাৎ তাকে ডাকল, ‘‘এই কানু শোন।’’
অনেকদিন তপন এভাবে ডাকেনি তাকে।
স্বপনের দলে ভিড়ে যাওয়া অবধি ব্যঙ্গহাসি হেসে ‘এই যে কানুবাবু’ বলে সম্বোধন করত।
কানুর বুকটা হিম হয়ে গেল।
নিশ্চয়!
নিশ্চয় তার কীর্তি ধরা পড়ে গেছে! তাই তপন…..কিন্তু তপনের মুখে তো ব্যঙ্গ নেই ধিক্কারও নেই, বরং কিছু খুশি খুশি ভাব।
হ্যাঁ, সেদিনকে বুকটা আরও হিম হয়ে গিয়েছিল কানুর, তপনের কথা শুনে। বরফ পাহাড়ের মতো হিম!
তপন ওকে একান্তে ডেকে বলেছিল, ‘‘এই শোন, বাবাকে বলেটলে তোর একজামিনের টাকাটা আদায় করেছি, এই দেখ।’’
হাতের মুঠো খুলে দেখিয়েছিল তপন ছ-খানা নোট। কানুর চোখের সামনে থেকে চারিদিক ঝাপসা হয়ে সরে গিয়েছিল। আশ্চর্য! আশ্চর্য! পৃথিবীর সমস্ত টাকাগুলোর কি একই চেহারা! নাকি কোনো মন্ত্রবলে কিছুক্ষণ আগে যে নোটগুলো থেকে কানু কিছুটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কেরানির কাছে জমা দিয়ে এল, আর কিছুটা অনেক কৌশলে লুকিয়ে রাখল, সেইগুলোই উড়ে তপনের হাতে এসে পড়েছে?
এ কি ভোজবাজি?
তাদের সেই ছোট্ট শহরে মাঝে মাঝে মেলার বাজারে যে বাজিকরটা আসত, সেতো করত ঠিক এমনি কৌশল! নিজের হাতের থেকে উড়িয়ে দিয়ে অন্যের পকেট থেকে বার করত সেই জিনিসটা! লোকের ঘড়ি, আংটি, টাকা, রুমাল! তপন কি বাজি শিখে এসে খেলা দেখাচ্ছে কানুকে?
তপন বলে চলেছে, ‘‘যাই হোক তাই হোক, বাবার শরীরে বিবেচনা যে একেবারে নেই তা নয় বুঝলি? তবে বিবেচনাটা বড্ড ভেতরের দিকে থাকে। চোখ রাঙিয়ে সেবিবেচনা টেনে বার করতে হয়। আমার মা-টির কুমন্ত্রণাতেই এইরকম হয়েছে আর কী! সব সময় খালি ফ্যাচ ফ্যাচ করবে ‘‘একে টাকা দেবে কেন, ওকে টাকা দেবে কেন, অত দেবে কেন, তত দেবে কেন?’’ শুনতে শুনতে মানুষের বুদ্ধি বিবেচনা ঘোলা হয়ে যায়ই। আমিও তাই তাক বুঝে মার আড়ালে বললাম। বললাম—‘‘আমার চাইতে কানুর পড়ার দরকার অনেক বেশি। আমি পাশ না করলেও খেতে পাব, ও পাবে না। ক-দিন পরেই তো আমার ইন্টারমিডিয়েটের ‘ফি’টা দিতে হত আপনাকে, সেটাই না হয় দিয়ে দিন। আমি না হয়—আপনার আবার টাকা জোগাড় হলে পরের বছর পরীক্ষা দেব।’’ শুনে—মুচকে হাসে তপন, ‘‘বাবা বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা এনে আমার হাতে দিয়ে বেচারি বেচারি মুখে বলল ‘‘এত কথা বলবার কোনো দরকার ছিল না।’’ যাই বলিস ভাই, পিসিমা যে বলেন ‘ভগবান আছেন’—কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়, ভগবান বলে কেউ একটা আছেই। নইলে—’’
কানুর মনশ্চেতনার ওপর দিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছিল তপনের কথাগুলো, ও তখনও সেই ওদের দেশের বাজিকরের কৌশলের কথা ভাবছিল, হঠাৎ তপনের শেষের কথাটা কানে গিয়ে ধাক্কা মারল। ‘ভগবান আছেন’!
‘‘ভগবান বলে কেউ একটা আছেই।’’
সহসা চোখ দুটো ঠিকরে উঠল কানুর, কানের মধ্যে যেন লক্ষ করতালির শব্দ! সারাশরীর ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে।
‘‘না! না! ভগবান নেই! কক্ষনো ভগবান নেই!’’ চিৎকার করে উঠল কানু।
তপন অবাক হয়ে বলে, ‘‘কী বলছিস পাগলের মতো?’’
ওঃ কথাটা পাগলের মতো বলা হয়ে গেছে বুঝি! তাইতো!
কিন্তু পাগল না হয়ে আর উপায় কোথায় কানুর? ভগবানের দুর্ব্যবহারেই পাগল হয়ে উঠেছে সে। ভগবান, মানে সত্যিকারের দয়ালু কোনো ভগবান যদি থাকত, তাহলে কি সেগতকাল সন্ধেবেলা এই টাকাটা দিতে পারত না কানুকে? যখনও কানু স্বপনের ড্রয়ারে হাত দেয়নি, সেই তখন? তাহলে কি কানু চিরকালের মতো ভগবানের ভক্ত হয়ে যেত না?
ভগবান! ভগবান!
হ্যাঁ আছে ভগবান।
কেবলমাত্র কানুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্যে কোথাও কোনোখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
তপন ওর দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে ওঠে, ‘‘তোর কী হয়েছে বল দেখি? ওদের সঙ্গে মিশে নেশাফেশা করেছিস নাকি?’’
রক্তচড়া মাথায় কানু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রথমে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘‘হ্যাঁ করেছি নেশা, কী করবি তুই যদি করে থাকি? নিয়ে যা তোর টাকা। ভগবানের দেওয়া টাকায় আমার দরকার নেই, শয়তান আমায় দিয়েছে টাকা। শয়তান ভালো, শয়তানই ভালো—।’’ তারপরই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
তারপর জল, বাতাস, ডাক্তার!
বিপদে পড়ে খরচ করতে বাধ্য হয়েছে ওরা।
তবে বাড়ির সকলেই সেদিন ধরে নিয়েছিল কানু কিছু নেশাই করেছে। অনভ্যাসের ব্যাপার তো, তাই এমন অবস্থা! নিন্দে আর টিটকিরিতে তপনের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। তাই পরদিন সকালেই কানুর ঘুম ভাঙতেই তপন এসে গম্ভীরভাবে তদ্দন্ডে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। তীক্ষ্ণভাবে বলেছিল, ‘‘জীবনে কখনও এমনভাবে মাথা হেঁট হয়নি আমার। যাক যথেষ্ট শিক্ষা হল! একটা কথা বলি শোন, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না বুঝলি? নেশা করা বড়োলোকেরই সাজে। মেজকা ছোটকার মদ খাওয়ার গল্প শুনে ভেবেছিলি তুইও ওদের মতো, তাই না? হুঁ:! যা, জীবনে আর তোর মুখ দেখতে চাই না।’’
স্বপন ওর কাছে হেসে লুটিয়ে পড়ল, ‘‘কী বাবা ইনোসেন্ট বয়! শেষরক্ষে করতে পারলে না? যাক খুব লীলা-খেলাটা দেখালি বটে কানু!’’
জনে জনে সবাই এসে ধিক্কার দিয়ে গিয়েছে, আর বিনা প্রতিবাদে কাঠের মতো বসে থেকেছে কানু! শুধু যখন—
হ্যাঁ, শুধু যখন সুধা এক ফাঁকে এসে চুপি চুপি বলল, ‘‘সবাই মিলে যে যা বলে বলুক কানুদা, আমি কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করব না যে তুমি—’’, তখন লাল লাল চোখ তুলে কানু প্রতিবাদ করে উঠল, ‘‘কেন, তুমিই বা বিশ্বাস করবে না কেন?’’
‘‘করব না আমার খুশি। আমি জানি তোমার কোথাও কোনোখানে খুব কষ্ট আছে, তাই তুমি এমন সৃষ্টিছাড়া রাগি। তোমাকে কেউ বুঝতে পারে না তাই—’’
কথাটা শুনে কানুর মনটা হঠাৎ অদ্ভুতভাবে তোলপাড় করে উঠল। ঠিক, ঠিক এই কথাই না ফুলি বলেছিল একদিন! মেয়েগুলো কি তাহলে সবাই একরকম? বড়োদের থেকে, পুরুষমানুষদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান?
হয়তো কানু নরমভাবে কিছু একটা উত্তর দিত, কিন্তু ওর কপালদোষে ঠিক সেই সময় রণরঙ্গিণী মূর্তিতে ঘরে ঢুকলেন মেজোকাকি।
মেয়ের একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে ভেতরের দরজার কাছে ঠেলে দিয়ে তীব্রকন্ঠে বলে উঠলেন, ‘‘তুই এখানে কী করছিস লক্ষ্মীছাড়ি? যা বাড়ির ভেতরে যা।’’ তারপর কানুর কাছে এসে দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘‘বলি, সুশীল সুবোধ ছেলে, তাড়ি খাওয়ার পয়সাটি জোটালে কোথা থেকে?’’
কানু লাল টকটকে চোখ দুটো তুলে একবার তাকাল মাত্র।
মেজোকাকি আবার বললেন, ‘‘মিছিমিছি স্বপনের নামে লাগিয়ে ভাঙিয়ে লোকের কাছে নিজে সাধু সাজতে যাওয়া হয়েছিল কেমন? ধর্মের কল বাতাসে নড়ছে তো? বল টাকা কোথায় পেয়েছিস?’’
কানু আবার মুখ তুলে পরিষ্কার গলায় উচ্চারণ করল ‘‘আপনার আলমারি থেকে।’’
আপনার আলমারি থেকে!
শুনে প্রথমটা চমকে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মেজোকাকি।
যদিও সেই সন্দেহের বশেই জেরা করতে এসেছিলেন তিনি, কিন্তু কানুর এরকম স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে তিনি যেন থতোমতো খেয়ে গেলেন। আর ওদিকে তখনও দরজার পিঠে দাঁড়িয়ে থাকা সুধা শিউরে থরথর করে কেঁপে উঠল!
উঃ কানু কী ছেলে! কী ছেলে!
যারা আত্মহত্যা করে হাতে করে বিষ খেয়ে, গলায় দড়ি লাগিয়ে, অথবা নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে, নয়তো নিজের বুকে ছুরি মেরে, কানু তাদেরই দলের?
স্তম্ভিত ভাব কাটিয়ে মেজোকাকি তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘কী? আমার সঙ্গেঠাট্টা?’’
‘‘ঠাট্টা নয়। সত্যিই আপনার আলমারি থেকে টাকা আমি নিয়েছি!’’
হঠাৎ তিরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মেজোকাকি, দরজাটাকে টেনে বাইরে থেকে শিকল লাগিয়ে দিয়ে।
অর্থাৎ কানুকে বন্দি করে গেলেন তিনি। ভাবলেন ভয়েডড়ে বলে ফেলেছে, এইবার নিশ্চয় পালাবে! অতএব—
ঠিকই বলেছে সুধা, ঠিকই বলত ফুলি, ‘‘তোমাকে কেউ বুঝতে পারে না কানুদা!’’ সত্যি কে বুঝবে কানুর মনের গতি কোন রাস্তা লক্ষ্য করে ছুটছে!
ক্ষণপরেই ঘরের বাইরে রীতিমতো এক শোরগোল উঠল।
অনেকের কথা, অনেকের গলার প্রশ্ন, অনেক মন্তব্য, অনেক ছি-ছিক্কার।
সব কিছু ছাপিয়ে মেজোকাকির গলা শোনা যাচ্ছে, ‘‘আজ বলে নয়, ওই হতচ্ছাড়া শয়তান অনেকদিন থেকেই আমার আলমারি থেকে টাকা সরাচ্ছে। প্রায়ই দেখি টাকা কম। তবু কিছু বলি না। ভাবি তপনের আদরের বন্ধু, কিছু বলতে গেলে আবার অপমানী হতে হবে, দরকার নেই। জানতাম একদিন হাটে হাঁড়ি ভাঙবেই। রাম! রাম! একেই বলে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা!’’
মেজোকাকি চেঁচিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ার পর হঠাৎ কানুর ঘরের দরজাটা খুলে গেল, আর বাড়ির ঝি লালুর মা খ্যারখেরিয়ে উঠল, ‘‘ওগো বাছা চলো! বড়োবাবুর ঘরে তলব হয়েছে। তোমার কীর্তি-কান্ডর বিচের হবে।’’
‘‘আমি যাব না।’’
‘‘যাবে না! ই-স! না গেলে দরোয়ান দে’ মারতে মারতে নে যাবে না? একেই বলে দুর্মতি! হুঁ:! দিব্যি খাচ্ছিলে দাচ্ছিলে রাজার হালে ছিলে, সইলোনি। কুগগেরোয় ধরল! ন্যাও চলো চলো।’’
‘‘চলো।’’
কানু স্থির অচঞ্চলভাবে ওর পেছন পেছন উঠে যায় দোতলায় বড়োকর্তার ঘরে।
বড়োকর্তা আলবোলার নল মুখ থেকে সরিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন ‘‘বোসো!’’
কানুর মুখে হঠাৎ একটু বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, সেই হাসির মধ্যেই বলল, ‘‘বসব কেন দাঁড়িয়ে থাকাই তো উচিত আমার।’’
বড়োকর্তা অলসভাব ত্যাগ করে উঠে বসে তীক্ষ্ণভাবে বললেন, ‘‘কেন?’’
‘‘অভিযুক্ত আসামিরা কি বসবার অধিকার পায়?’’
‘‘হুঁ! বেশ বড়ো বড়ো কথা জানো দেখছি। তা অভিযোগটা কি তুমি অস্বীকার করো?’’
কানু সোজা সটান দাঁড়িয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘‘কোন অভিযোগটার কথা বলছেন?’’
‘‘কোন অভিযোগ মানে?’’
‘‘আপনি তো আমাকে বিচার করবার জন্যে ডেকেছেন শুনলাম, আমার নামে কী কী অভিযোগ উঠেছে শোনেননি?’’
বড়োকর্তা এমন কথাবার্তার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। ভেবেছিলেন ছেলেমানুষ দুর্মতির বশে, কুসঙ্গে পড়ে করে ফেলেছে কিছু অন্যায়, ডেকে ধমকে দেবেন, ভবিষ্যতে যাতে আর এমন না করে শাসিয়ে রাখবেন। ব্যস! তাতে কাজও হবে, আবার বড়োকর্তার ক্ষমা করার মহত্ত্ব দেখে সবাই অবাকও হবে। টাকাটা যদিও মেজোকর্তার ঘরের, কিন্তু বড়োকর্তাই তো বাড়ির প্রধান!
কিন্তু একী?
এ যে ফণাধরা কেউটে!
বড়োকর্তা অতএব গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘হ্যাঁ শুনেছি বই-কী, অস্বীকার করতে পারো তুমি মদ খেয়েছ?’’
‘‘পারি’’ বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায় কানু, ‘‘নিশ্চয় অস্বীকার করব।’’
‘‘মানুষ কত কারণে বিচলিত হতে পারে। হঠাৎ মাতলামি বলে ধরে নিতে হবে কেন? কেন মানুষের সম্বন্ধে মানুষের এমন হীন ধারণা বলতে পারেন?’’
বড়োকর্তা মিনিটখানেক ভুরু কুঁচকে থেকে বললেন, ‘‘হুঁ! তা হঠাৎ এত বিচলিত হবার কারণ?’’
হয়তো সেই মুহূর্তেই যদি কারণটা খুলে বলতে পারত কানু, যদি বলে ফেলতে পারত নিজের জীবনের ইতিহাস, ভগবান সম্বন্ধে তার বিরূপ মনোভাবের মূল কাহিনিটা, তাহলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা পেয়ে যেত! হয়তো ‘আহা বেচারি’ বলে সহানুভূতিও করত কেউ কেউ! কিন্তু তা হল না। কানুর বুদ্ধির গোড়ায় শনি তাকে তা করতে দিল না।
তার বদলে তাকে বলাল, ‘‘সেকথা জেনে আপনার কোনো লাভ হবে না। আমার কথা যদি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় করুন, ইচ্ছে না হয়, যা ভাবছেন তাই ভাবুন।’’
বড়োকর্তা একবার ব্যঙ্গ মেশানো কঠোরদৃষ্টিতে তপনের দিকে তাকালেন, ভাবটা যেন, ‘বা: কী সুন্দর বস্তুটিকেই পুষেছ।’
তারপর তেমনি ব্যঙ্গহাসি হেসে বললেন, ‘‘বেশ, না হয় বিশ্বাসই করলাম তোমার কথা, কিন্তু আরও একটা অভিযোগ তো তোমার নামে রয়েছে হে!’’
‘‘চুরির তো? হ্যাঁ চুরি আমি করেছি।’’
‘‘বা: বা: বা:!’’ বড়োকর্তা বলে ওঠেন, ‘‘এ যে একেবারে ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির দেখছি! তা বাপু চুরি করে তো কেউ কখনো বলে বেড়ায় না, তোমার হঠাৎ এ শৌখিনতা কেন?’’
‘‘আমি ওইরকমই।’’ সতেজ জবাব দেয় কানু।
বড়োকর্তা এবার গম্ভীরভাবে বলেন, ‘‘নিজেই যখন স্বীকার করছ তখন জেরার খাটুনিটা আমার কমে গেল। কিন্তু কথা হচ্ছে নিলে কীভাবে?’’
‘‘আলাদা চাবি দিয়ে খুলে।’’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মেজোকাকি ফিসফিসিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন। হ্যাঁ, বউদের ভাসুরদের সামনে অমনি ফিসফিসিয়ে কথা বলার প্রথা ছিল তখন। চেঁচিয়ে উঠে বলেন মেজোকাকি, ‘‘উঃ কী শয়তান! কী শয়তান! এতখানি বয়সে এমন পাকা বদমাইশ ছেলে কখনো দেখিনি!’’
‘‘দেখেননি, দেখুন।’’
তপন আর চুপ করে থাকতে পারে না, ক্রুদ্ধভাবে বলে ওঠে, ‘‘কানু চলে যা তুই।’’
বড়োকর্তা ধমকে ওঠেন, ‘‘না চলে যাওয়া হবে না! জানতে চাই, আলাদা চাবি পেয়েছিল কোথায়?’’
কানু এবার চারিদিকে তাকায়।
আশেপাশে বাড়ির সবাই বসে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ মজা দেখতে এসেছে সকলেই। চোখ পড়ল স্বপনের মুখের দিকে। ছাইয়ের মতো পাঙাস হয়ে উঠেছে তার মুখ। নিশ্চয় ভাবছে এখুনি কানু কী বলে বসে! চাবির কথা যখন বলছে, তখন নিশ্চয়ই স্বপনের ড্রয়ার থেকেই নিয়েছে। স্বপন নিজে অস্বীকার করলেই বা উপায় কী! সুধাটা আজকাল যা গোঁয়ার হয়েছে, ঠিক ফস করে সত্যি কথা বলে দেবে! হঠাৎ ওকে আজকাল যেন ‘সত্যিকথা’য় পেয়ে বসেছে।
কী বলে কানু!
কী বলে বসে!
অবাক! অবাক! কানু বলছে, ‘‘আলাদা চাবি আমি তৈরি করিয়েছিলাম।’’
‘‘তাই নাকি! ওঃ! একেবারে পাকা চোর! সেইজন্যেই রাস্তায় রাস্তায় বেড়াচ্ছিলে, বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। আমাদেরই অন্যায় হয়েছিল কিছু না জেনেশুনে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া! যাক যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে!……তপন তোমার বন্ধুকে পুলিশের হাতে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’’
পুলিশ!
সবাই একেবারে আচমকা চমকে উঠল। পুলিশ! এতটা কেউ আশা করেনি। ভেবেছিল দু-চারটে গালাগাল মন্দ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে বড়োজোর! যে চাবুকের মতো ছেলে, হাতেপায়ে পড়ে মাপ তো আর চাইবে না, অতএব এ বাড়ির হাঁড়ির ভাত তার এবার বন্ধ হল!
কিন্তু পুলিশ!
বড়োকর্তা কিন্তু সেদিন অনমনীয় ছিলেন। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘‘তোমাদের মতো ছেলেকে সমাজে চরতে দেওয়া পাপ, অন্যায়! আমি যদি শুধু তোমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি, সেটা হবে আমার কর্তব্যকর্মে অবহেলার অপরাধ। পুলিশের হাতে সমর্পণ করে তবে আমার ছুটি।’’
বড়োকর্তার এ আক্রোশ যেন কানুর ওপরে নয়, আক্রোশ নিজের ছেলের ওপরে! যেন অনেকদিনের অনেক অপদস্থ হওয়ার শোধ আজ মিটিয়ে নিতে চান তিনি।
তপনের বন্ধু পুলিশে যাওয়ার যোগ্য!
যে বন্ধুকে সেরাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যার শিক্ষার জন্যে এই ঘণ্টা কয়েক আগেও বাপের কাছ থেকে টাকা এনেছে, বাপকে মর্মান্তিক কথার বাণে বিঁধে।
তপনের পক্ষে এর চাইতে লজ্জার আর কী হতে পারে?
হ্যাঁ, চিরদিনের উদ্ধত ছেলের মাথাটা সেদিন হেঁট হয়ে গিয়েছিল। তা নইলে তপনের মতো ছেলে কোনো প্রতিবাদ না করে মাথা হেঁট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়?
ছোটোকর্তা মুখ টিপে হেসে বলেন, ‘‘কিন্তু হঠাৎ তোমার এত টাকার দরকার হল কেন বলো তো বাপু?’’
‘‘ভগবান জানেন!’’ তপনের মা ঠোঁট উলটে বলেন, ‘‘এদিকে তপন তো ওর একজামিনের কী জমা দেবার টাকার জন্যে তোমার দাদাকে যা নয় তাই বলে আদায় করল!’’
আবার ভগবান!
সবই যদি জানেন ভগবান, তা হলে কানুর মনের জ্বালাটার কথা কেন জানতে পারেন না তিনি? কেন শুধু শুধু কানুর এত কষ্ট?
হঠাৎ জীবনে কখনো যা না হয়েছে তাই হল কানুর।
কানুর অজান্তে কানুকে আটকাবার চেষ্টা করতে সময় না দিয়ে হঠাৎ ঝর ঝর করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল তার দুই চোখ দিয়ে।
আর—‘‘দিন দিন আমায় পুলিশে দিন, আমার জেল হোক আমার ফাঁসি হোক, তাই চাই আমি—’’ এই কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল কানু।
তা কানু চেয়েছিল বলেই হয়তো সেদিন জেল হয়নি কানুর। আসলে শেষপর্যন্ত আর ওকে পুলিশে দেওয়ার মতো উৎসাহ খুঁজে পাননি বড়োকর্তা। এমনকী কানুকে থেকে যেতেও অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘সব সময় বড়োদের মুখের ওপর চোটপাট করতে নেই হে, ওর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। ওটা একটা জোলো ফ্যাশান! যাকগে যা হয়ে গেছে গেছে, এখন মন দিয়ে লেখাপড়া করো, জীবনে উন্নতি করার চেষ্টা করো। তা যদি পারো সেটাই বাহাদুরি।’’
কিন্তু তবু থাকতে পারেনি কানু।
মেজোকর্তা বলেছিলেন, ‘‘তাহলে এরপর থেকে আমার ঘরের দরজায় একটা দারোয়ান বসাবার খরচ বাড়াতে হবে দেখছি।’’
মেজোকাকি বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলেমেয়েদের অগত্যা তাদের মামার বাড়িতে রেখে মানুষ করতে হবে। চোরের সঙ্গে এক বাড়িতে ছেলে রাখতে পারব না বাবা!’’
ছোটোকাকা বলেছিলেন, ‘‘থাকে তো চাকরদের ঘরে থাকুক এবার থেকে। যেমন ওর প্রবৃত্তি!’’
আর তপন শান্তগম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘‘দয়া করে তুমি আর আমার সঙ্গে কথা কইতে এসো না কানু! না, তুমি শুধু অপরের বাক্স থেকে কয়েকটা টাকা নিয়েছ বলেই তোমাকে ঘৃণা করছি না আমি, আমি তোমায় ঘৃণা করছি তোমার বোকামির জন্যে। যে সংসারে থেকে তুমি নিজেকে মানুষ করে তুলতে পারতে, সেখান থেকে তুমি কুকুরের মতো বিতাড়িত হচ্ছ কেবলমাত্র বুদ্ধির দোষে। মদ না খেয়ে যারা মাতলামি করে বসে কেলেঙ্কারী ঘটায়, তাদের আমি ঘৃণা করি।’’
এরপর কি আর কেবলমাত্র বড়োকর্তার অনুরোধটুকু সম্বল করে সেবাড়িতে টিকে থাকা যায়?
বেত খাওয়া কুকুরের মতোই ছটফটিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছিল কানু একই বস্ত্রে। আর ঈশ্বর জানেন কার শিক্ষায় তখন বাড়ির খুব বাচ্চা ছেলেগুলো ওপরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে দিয়ে আওড়াচ্ছিল—
‘‘চোর হয়ে বাড়ি যায়—
ব্যাং পুড়িয়ে ভাত খায়।
সেব্যাংটা পচল—
পান্তাভাতে মজল।’’
ওদের কাছে দাঁড়িয়ে বাড়ির ছোঁড়া চাকরটা হাসছিল দাঁত বার করে।
তখন প্রায় ছুটেই পালাতে থাকে কানু ওই হাততালির এলাকা থেকে। আর অনেকটা যাওয়ার পর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় বামুনঠাকুরের ডাকে।
কানুর ছোটো টিনের সুটকেসটা হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে সে।
হ্যাঁ, এ বাড়িতে এসে একটি সুটকেস জুটেছিল কানুর। জুটেছিল ভদ্রসমাজে চলে ফিরে বেড়াবার মতো কিছু কাপড়জামা। আর সঞ্চিত হয়েছিল কয়েকখানি পড়ার বই—তার প্রাইভেট পরীক্ষা দেওয়ার ভেলাস্বরূপ!
‘‘এটা ফেলেই চলে যাচ্ছ যে দাদাবাবু, এত রাগ!’’
কানু একবার ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে আবার চলতে শুরু করে হন হন করে।
ঠাকুর কিন্তু নাছোড়।
‘‘নিয়ে যাও দাদাবাবু, নইলে সুধা দিদিমণি আমায় বকবে। দিদিমণিই বললে, ‘কানুদা রাগ করে চলে যাচ্ছে ঠাকুর, কাপড়চোপড় সব ফেলে রেখে, ছুট্টে দিয়ে এসো’।’’
‘‘আমি নেব না।’’
বলে ফের চলতে শুরু করে কানু।
ঠাকুরও কিন্তু ফের দৌড়োয়। বলে, ‘‘না নিয়ে আর কী হবে, সঙ্গে তো দ্বিতীয় বস্তরখানা পর্যন্ত নেই, এরপর পরবে কী?’’
‘‘সেখোঁজে তোমার দরকার কী?’’
‘‘আমার আবার কী দরকার দাদাবাবু! গরিবের ছেলে পেটের দায়ে খাটতে এসেছি, যে যা হুকুম করবে পালতে হবে। সুধা দিদিমণিটিকে তো চেনো? হুকুম না পাললে রক্ষে রাখবে? তোমার বই খাতা রয়েছে এতে—’’
কানুর মনটা কি একবারের জন্যে লোভে দুলে ওঠেনি? মনে হয়নি হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয় সুটকেসটা? অন্তত বইগুলোর জন্যেও? যে পরীক্ষার জন্যে এত কান্ড, সেই পরীক্ষাই তো দেওয়া হবে না বইগুলোর অভাবে।
তবু—
তবু পারেনি কানু হাতটা বাড়াতে।
বাধা! অদ্ভুত একটা বাধা!
সেবাধা কানুর নিজের মনেরই পাথরের টুকরো দিয়ে দিয়ে তৈরি পাহাড়!
সেপাহাড় ঠেলে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা আজ আর নিজেরই নেই কানুর।
নীল, খয়েরি, আর কালো ডোরা টানাটানা কয়েকটা শার্ট আর খানকয়েক মোটাসোটা ধুতি! সুটকেসটায় আজও তেমনি সাজানো আছে, আছে সুধার ঘরের খাটের তলায়। শুধু বইগুলো—
কিন্তু সেতো অনেক দিন পরের কথা।
তখন কানু শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবে। লোভের জগৎ থেকে, নিষ্ঠুরতার জগৎ থেকে, আবার সহানুভূতিভরা ভালোবাসার জগৎ থেকেও।
এতবড়ো পৃথিবীতে কানুর কোনো আশ্রয় নেই।
কানু যেন একটা অভিশপ্ত জীব!
আবার পথ!
আবার খোলা রাজরাস্তা! সেরাস্তায় শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়ানো—ক্ষিধেয়, তেষ্টায়, রোদে ঝলসে!
রাস্তার কলের জলে আর কতটুকু শান্তি মেলে? খালি পেটে রোদে ঘুরে ঘুরে শুধু জল খেলেই বা ক-দিন শরীর টেকে?
অবশেষে একদিন হাসপাতালে যেতে হয়েছিল কানুকে, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে।
পথে পড়ে ছিল অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে, কর্পোরেশনের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
সেখানে, যখন জ্ঞান হল সেএক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা! সেবার, যত্নের, অথচ নিষ্ঠুরতার!
কত মমতাশূন্য হয়ে, কত নিপুণভাবে সেবা করা যায়, হাসপাতাল যেন তার দৃষ্টান্তস্থল।
ঘড়ি ধরে ঔষধ, ঘড়ি ধরে খাদ্য, নিয়মিত পদ্ধতিতে জ্বর দেখা, গা মাথা মোছানো—কলের মতো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বলো দিকি ‘যন্ত্রণায় আমার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, একটু টিপে দেবে গো?’ দেবে না। উলটে ধমকের চোটে মাথার যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে।
সেই বিরাট ‘হল’, সেই অনেকের ব্যবহারে মলিন বিবর্ণ বিছানা, সেই পাশাপাশি অনেক অনেক রোগী, আর তাদের রোগ যন্ত্রণার কাতরোক্তি…….এখনও যেন অনুভবে আসে কানুর।
অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলে তো আসেই। তাই না এখন হাসপাতালের উন্নতির জন্যে—কিন্তু সেকথা এখন থাক। চৈতন্য আর অচৈতন্যের মাঝামাঝি একটা ঝাপসা ঝাপসা জায়গা, তার মাঝখানে শুধু একটা অসহায় অনুভূতি—ক্লান্ত কাতর ভারাক্রান্ত!
সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে যা এই এক বছরের মধ্যে করেনি কানু তাই করতে থাকে, যেন নিজেকে ছেড়ে দিয়ে।
স্মৃতির রোমন্থন! মনকে ছেড়ে দিয়ে শুধু ভাবা!
তপনদের বাড়িতে থাকতে যখনই বাড়ির কথা, পুরোনো জীবনের কথা মনে পড়ে গেছে, তখনই জোর করে সেচিন্তার গলা টিপে ধরেছে কানু। না না, কিছুতেই মনে আসতে দেবে না সে, ওর সেই ফেলে আসা জীবনকে!
ওর কেউ নেই, কেউ ছিল না!
এই শেষকথা!
কিন্তু হাসপাতালের ঘরে বুঝি দুর্বলতার সংক্রামকতা আছে। শারীরিক দুর্বলতার নয়, মানসিক। তাই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে কানু। এখানে এই চৈতন্য আর অচৈতন্যের আলো-আঁধারিতে দেহটাকে ফেলে রেখে কানুর আত্মা অনেকটা ব্যবধান ঘুচিয়ে চলে যায় সেই ছোট্ট মফসসলি টাউনটায়।
না চড়া কড়া শহর, না ভিজে মাটির সাঁেদা গন্ধবহা গ্রাম।
গ্রাম আর শহরের মধ্যবর্তী সেই ধুলো-ওড়া পাকা রাস্তায়, আর গোরুচরা খোলা মাঠে, ছোটোবড়ো দোতলা বাড়ির ধারে ধারে, আর বন-বাদাড়ের ঘনগভীর ছায়ায় ছায়ায় খালিগায়ে মালকোঁচা মেরে শুধু একখানা কাপড় পরে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ায় কানুর আত্মা।
সেআত্মা ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে কোঁচার পুঁটলিতে বয়ে এনে বাড়ির উঠোনে ঢেলে দেয়, শরতের ভোরে ধামায় করে শিউলি ফুল কুড়িয়ে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির দাওয়ায় এনে ধরে দেয়—একখানি উৎফুল্ল মুখ, একজোড়া সপ্রশংস দৃষ্টি আর এক টুকরো উল্লসিত হাসির সামনে।
সেআত্মা অধীর আগ্রহে ‘পাগলাবাবার’ আশ্রমের উদ্দেশে হেঁটে হেঁটে পায়ে, আর বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে ‘চু কিত কিত’ খেলতে গায়ে ব্যথা ধরায়।
সেআত্মা স্কুলে মাস্টারের প্রশ্নে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে চটপট নির্ভুল জবাব দেয়। আবার বছরের শেষে প্রমোশনের দিন প্রথম পুরস্কারগুলি লাভ করেও নির্বিকারভাবে ‘অফিস রুমে’ ফেলে রেখে দিয়ে খেলতে চলে যায় অনেকক্ষণের জন্যে।
কবে যেন একদিন নিজে হাতে তৈরি ছিপ ফেলে মাছ ধরেছিল না কানু? ধরেনি, ধরতে গিয়েছিল ‘পাড়ুই’দের ভাঙাভিটের পেছনের ডোবায়।
মশার কামড়ে গা ফুলে ওঠে, পায়ের কাছে ব্যাং লাফায়, তবু একটা মাছ অন্তত ধরবেই পণ করে বসেছিল পড়ন্ত বিকেল অবধি। সেখানে কেমন করে যেন ফুলি এসে হাজির।
ফুলি এসে হেসেই কুটিকুটি।
‘‘এ কী কানুদা, এই পচা ডোবায় মাছ ধরতে এসেছ তুমি? হি হি হি! এখানে কে ‘পোনা’ ছেড়ে মাছের চাষ করছে? এখানে তো শুধু বাগদিপাড়ার লোকেরা এসে বাসন মাজে।’’
ফুলির সামনে ব্যর্থতার এই শোচনীয় প্রকাশে রাগে আগুন হয়ে উঠেছিল কানু, আর মটমট করে ছিপটা ভেঙে জলে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘‘লক্ষ্মীছাড়ার মতো হি হি করে হাসছিস যে? মাছ ধরিনি নাকি? অনেক ধরেছি। ধরে ধরে আবার পুকুরে ছেড়ে দিয়েছি। কী হবে অসময়ে বাড়িতে মাছ নিয়ে গিয়ে? পিসি তো চেঁচাবে রাক্ষুসির মতো!’’
ফুলি দুষ্টুহাসি হেসে বলেছিল, ‘‘তা’ নয় আমাদের উঠোনে ফেলে দিয়ে যেতে? আমি তো আর চেঁচাতাম না?’’
‘‘তোকে দেব? কেন? তোকে আহ্লাদ করে মাছ ধরে খাওয়াতে যাবার কী দায় পড়েছে রে আমার? সেও তো জলে ফেলে দেওয়াই। তার চেয়ে জলের জীব জলে ছেড়ে দিলাম চুকে গেল।’’ বলে হন হন করে চলে গিয়েছিল কানু—ফুলি এমন সময় এখানে কেন, এ প্রশ্ন না করেই।
এখন সেই ডোবার ধারে ঘুরে বেড়ায় কানুর দেহচ্যুত আত্মা বেদনা-কাতর মুখে। চুপি চুপি ফুলিকে জিজ্ঞেস করতে চায়, ‘‘এমন সময় তুই এখানে কেনরে? আমায় খুঁজতে বুঝি?’’
পিসির কথাই কি মনে পড়ে না?
তাও পড়ে বই কী।
রাসমণির তো ভাইপোর ওপর ভালোবাসার অভাব ছিল না, শুধু সেই ভালোবাসার পদ্ধতিটা কানুর অপছন্দকর ছিল। তবু এখন মনে পড়ে মন কেমন করে।
আর মা?
সেই বেচারি বেচারি রোগদড়ি মানুষটা! তার ওপর কি কম দুর্ব্যবহার করেছে কানু? কিন্তু—
হঠাৎ দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে—হাসপাতালের বিছানায় শোওয়া ছেলেটার দু-চোখের কোণ বেয়ে।
শুধু যদি—বাবা আর কাকা অত শয়তান না হত!
কানুর ভাগ্যে হাসপাতালও সইল না।
ভালো করে সেরে ওঠবার আগেই তাড়িয়ে দেওয়া হল তাকে।
অপরাধ?
অপরাধ, কানু একটা নার্সের মুখের ওপর বার্লির গেলাস ছুড়ে মেরেছে। কিন্তু কেন মেরেছে? নার্সের কী অপরাধ? সেকথা কেউ জানতে যায়নি। নার্স-ই রসাতল করে বেড়িয়েছে দোতলা থেকে একতলা, এ ডাক্তারের কাছ থেকে ও ডাক্তারের কাছে।
কানু যে একশোবার করে সবাইকে ডেকে ডেকে বলেছে—ডাক্তার থেকে জমাদার পর্যন্ত—তার জলের কলসিটা ভেঙে গেছে, কাল থেকে জল খেতে পায়নি সে, সেকথায় কি কান দিয়েছে কেউ? তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল, তখন কিনা বার্লি! তবু তো রাগ চেপে ফের আবেদন জানিয়েছিল কানু। নার্স কান দেয়নি, উলটে ধমক দিয়েছে। কান দিত যদি পয়সা থাকত কানুর কাছে—যদি একটা কোনো আত্মীয়ও দেখতে আসত কানুকে!
কানু যেন রাস্তার ভিখিরি!
কিন্তু ওদেরই বা দোষ কী? ভিখিরির মতোই তো রাস্তা থেকে ওকে কুড়িয়ে এনেছিল ওরা।
এখন—এই বয়সের অভিজ্ঞতায়, পৃথিবীকে দেখে দেখে শক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে কানু—ওরা যা করেছিল সেটাই স্বাভাবিক। পথের জঞ্জালকে আবার মানুষ বলে গণ্য করে কে?
কিন্তু তখন বোঝবার ক্ষমতা ছিল না।
তাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বার্লির গেলাসটাই—
তবু যে ওকে কোনো শাস্তি না দিয়ে ওরা এমনি ছেড়ে দিয়েছিল, এই তো যথেষ্ট!
তপনের বাবাও তো শাস্তি দেননি শেষপর্যন্ত।
না, বরং দোষ করে শাস্তি পায়নি কানু, শাস্তি পেল অকারণে। শুধু ছেঁড়া ময়লা কাপড়জামা পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল বলে, শুধু পাহারাওয়ালার প্রশ্নের ঠিকমতো জবাব দেয়নি বলে, কানুকে হাজত যেতে হল!
সেখানে?
সেএক অলৌকিক কাহিনির মতো।
অপর একজন হাজতবাসী, কী যেন নাম তার? হ্যাঁ দিবাকর সিংহী। দিব্যি ফিটফাট বাবুর মতো চেহারা, চোখে সোনার চশমা। বলল, ‘হাতে সোনার ঘড়ি ছিল, পাহারাওলারা কেড়ে নিয়েছে।’
হ্যাঁ, সেবলল এক অদ্ভুত কাহিনি!
সেনাকি নোট জাল করে।
ইচ্ছেমতো নোট ছেপে ছেপে হাজার হাজার টাকা করে সে। হাজার হাজার টাকা! কানুর চোখ জ্বলে ওঠে।
কেন কে জানে কানুকে তার ভারি পছন্দ হয়ে গেল। অবিশ্যি সেধরে নিয়েছিল কানু পকেটমার। তাই বেশ বন্ধুর ভঙ্গিতে বলল ‘‘ওসব ছিঁচকেমি করে কোনো লাভ নেই হে! মারি তো গণ্ডার, লুঠি তো ভান্ডার, এই হচ্ছে পুরুষের কথা। আমার ব্যাবসা দেখো, কারুর বাক্স ভাঙি না, কারুর পকেট মারি না, মোটকথা কারুর কোনো ক্ষতিই হয় না, অথচ আমার হাজার হাজার টাকা হয়। এই দুনিয়াটা শুধু টাকারই বশ হে! টাকা থাকলে বিনা খাটুনিতে লাট সাহেবের হালে থাকো—’’
‘‘আর এই যে ধরা পড়লেন—’’ কানু বলে।
‘‘সেদৈবাৎ। তাও আমার অ্যাসিস্টেন্ট ব্যাটার বোকামিতে! কতকাল ধরে এ ব্যাবসা চালাচ্ছি, কিছু হয়নি, আর ও ব্যাটা হঠাৎ বোকামি করে—সেযাক। ভাগ্যে ওঠাপড়া আছেই। তা বলে ভেবো না আমার ব্যাবসা আমি ছাড়ব! কিন্তু একটা চালাক-চতুর ছেলে জোগাড় করতে পারলে ভালো হয়। তোমাকে দেখে আমার বেশ মনে ধরেছে! লেখাপড়া কিছু জানো?’’
উত্তর প্রত্যুত্তরের মধ্যে কানুর বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় সংগ্রহ করে দিবাকর সিংহী বলেছিল, ‘‘তোমাকে গড়েপিটে নেব আমি! এইরকম ছেলেই আমার দরকার, মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো! কিন্তু লেখাপড়া কিছু শিখতে হবে বাবু! লেখাপড়া না শিখলে কি আরজাল-চোচ্চুরি চালানো যায়? আমার সঙ্গে চলো। দু-একটা পাশ করে ফেলো—’’
কানু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলেছিল, ‘‘আমার সঙ্গে মানে? আপনি কবে জেল থেকে ছাড়া পাবেন তার ঠিক কি?’’
কানু জানে সেনিজে নির্দোষী, বিচারে ছাড়া পাবেই। কিন্তু ওই লোকটা?
‘‘জেল থেকে?’’ হো হো করে হেসে উঠেছিল দিবাকর সিংহী। ‘‘জেলে যাচ্ছে কে? মোটা টাকা জামিন দিয়ে দিব্যি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব। তারপর বড়ো বড়ো উকিল ব্যারিস্টার লাগিয়ে মামলা চালাব, ঘুস দেব, ব্যস! সোনার চাঁদ হয়ে সমাজের চুড়োয় বসে থাকব! টাকা থাকলে কেউ ফাঁসাতে পারে না হে!’’
অবিশ্যি এ জোর তার শেষ অবধি খাটেনি, কিন্তু সেঅনেক—অনেক পরের কথা! এখন মুগ্ধ হয়ে শোনে কানু এই বীরপুরুষের মন্তব্য।
‘‘কী বলো রাজি আছ? বলছ তো গত বছরেই পরীক্ষা দিতে, দেওয়া হয়নি। বেশ দিয়ে ফেলো এ বছর। তারপর ভালো কলেজে ভরতি করে দিই। কেমিস্ট্রি পড়ো, যাতে আমার ব্যাবসার সুবিধে। তারপর দেখো না, তুমি একটি ছোটো রাজা, আমি একটি বড়ো রাজা। মনে করো হাজার হাজার টাকা ঘরে বসে তৈরি করছ তুমি!’’
শয়তানের মধুর ছলনা!
আনন্দে আগ্রহে বুক কেঁপে উঠল কানুর। বড়োলোক হওয়ার এর চাইতে সুন্দর উপায় আর কী আছে?
‘‘তাহলে রাজি তো? তোমার নাম যাইহোক, তোমাকে আমি ‘মানিক’ বলে ডাকব বুঝলে? ‘কুড়োনো মানিক’!’’
দিবাকর সিংহী বললেন, ‘‘দেখলি তো মানকে, কেমন গট গট করে বেরিয়ে এলাম ওদের নাকের সামনে দিয়ে? বলিনি তোকে ‘জেলে যাচ্ছে কে’? বেশির মধ্যে তোকে সুদ্ধু ছাড়িয়ে আনলাম।’’
ঘণ্টাকয়েকের আলাপেই ‘তুমি’ ছেড়ে ‘তুই’ ধরেছিলেন সিংহী মশাই।
কানু লাল লাল মুখে বলল, ‘‘আমি তো ছাড়া পেতামই। আমি তো কিছু করিনি, আমাকে তো ভুল করে ধরেছিল।’’
‘‘হা হা হা!’’
অট্টহাস্য হেসে উঠলেন সিংহী। ‘‘ওই আনন্দেই থাক। ওরে বাপু তোর হয়ে যদি লড়বার কেউ না থাকে তাহলে দোষীই হস আর নির্দোষীই হস ফল একই। ধরেছে যখন দিতই জেলে পুরে। আসল কথা পৃথিবীটা হচ্ছে বলবানের জন্যে। দুর্বলেরা পড়ে মার খাবে, বলবানেরা ড্যাঙডেঙিয়ে বেড়াবে, এর নামই আইন।’’
আশ্চর্য!
কানুর মন থেকে ন্যায় আর নীতিবোধ ধুয়ে মুছে ফর্সা করে দেওয়ার জন্যেই কি সমস্ত পৃথিবী ষড়যন্ত্র করে বসে আছে? যেন কোথাও কোনোখানে অবশিষ্ট না থাকে কিশোর মনের সৌকুমার্য, না থাকে চিরদিনের সংস্কারগত পাপ-পুণ্য, সভ্য-অসভ্য বোধ!
দিবাকরের ভেতরের ব্যাবসা যাই হোক, বাইরের ব্যাবসা হচ্ছে ফোটোগ্রাফের। বড়ো রাস্তার ওপর দিব্যি একখানা স্টুডিয়ো খুলে বসে আছেন ভদ্রলোক। যথেষ্ট পসার, দলে দলে লোক আসে ফোটো তোলাতে। যে একবার আসে, সেবার বার আসে। কারণ বেজায় খোলামেলা দিলদরিয়া লোক এই ‘সিংহ স্টুডিয়ো’র সিংহী মশাই!
কানু পরে ভেবেছে—অমন একটা লোক যদি জীবনের চলার পথে অমন একটা ভুল নীতি বেছে না নিতেন! কিন্তু তখন ভাবেনি তাঁর নীতিটা ভুল। পরম পুলকে সিংহী মশাইয়ের অসাধারণ বুদ্ধির তারিফই করেছিল। ভেবেছিল—সত্যি বড়োলোক হওয়ার এই সহজ উপায়টা সবাই ধরে না কেন? যত ইচ্ছে নোট তৈরি করো, যত ইচ্ছে খরচ করো, ব্যস চুকে গেল! কোথাও কারুর কোনো লোকসান করা হচ্ছে না।
ওর থেকে বেশি ভাববার মতো বুদ্ধি আর তখন ছিল না কানুর।
তবু সিংহীমশাইয়ের নীতি ঠিকই হোক আর ভুলই হোক—কানুর কাছে তিনি নমস্য। চিরদিনের জন্য নমস্য।
তাঁর দয়াতেই তো আজ কানু জীবনের পথে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছে! তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে, নিরুপায়তার কোন অতল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে হত কানুকে কে জানে!
স্টুডিয়োতে সহকারী, বাইরের জগতে ভাগনে।
হ্যাঁ, স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে দিব্যি স্বচ্ছন্দে পরিচয় করিয়ে দিলেন সিংহীমশাই—‘‘এই নিয়ে এলাম আমার ভাগনেটিকে। গ্রামের স্কুলে ফার্স্টক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল, তারপর নানা অসুবিধায়—’’
হেডমাস্টার গম্ভীরভাবে বলতে যাচ্ছিলেন বছরের মাঝখানে ছাত্র ভরতি করা সম্ভব হবে না, সিট নেই। কিন্তু সিংহীমশাইয়ের প্রবল ব্যক্তিত্বের এবং জোরালো কথার দাপটে তাঁর গাম্ভীর্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
‘‘সিট নেই তো হয়েছে কী মশাই? একস্ট্রা চেয়ার দিয়ে দেবেন একখানা। দেখেননি থিয়েটার বাড়িতে বেশি ভিড় হলে কোথা থেকে না কোথা থেকে চেয়ার এনে যেখানে সেকানে বসিয়ে দেয়?’’
হেডমাস্টারমশাই হেসে ফেলে বললেন ‘‘সিট মানে কি শুধু চেয়ার?’’
‘‘তবে আবার কী?’’—দিবাকর দাবড়ানি দেন ‘‘চিরকালই তো তাই জেনে আসছি। স্কুলে না থাকে তো বলুন বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেব একখানা। আর না হয়তো কিনেই নেবেন একটা। ‘‘এই যে’’—পকেট থেকে দুখানা একশো টাকার নোট বার করে টেবিলে রাখলেন দিবাকর। তারপর মধুর হেসে বললেন ‘‘ওই হচ্ছে একস্ট্রা চেয়ারের দাম। আর কী কী লাগবে বলুন চটপট। গত আট মাসের—মানে জানুয়ারি থেকে এই আগস্ট অবধি মাইনে, স্পোর্টস ফি, পাখাভাড়া, পুওর ফাণ্ডস, সরস্বতী পুজোর চাঁদা, বেয়ারার বকশিশ, এসব তো জানাই আছে, আর যদি কিছু লাগে বলে ফেলুন, বলে ফেলুন।’’
হাঁ করে তাকিয়ে দেখে কানু আর একগোছা দশটাকার নোট টেবিলে ফেলে দেন সিংহী নেহাত অবহেলাভরে।
ওর নিজের তৈরি জিনিস!
কী মহিমা! কী মহিমা! বিগলিত হওয়ার যেটুকু বাকি ছিল কানুর তা সম্পূর্ণ হয়। আর আশ্চর্য হয়ে দেখে হেডমাস্টারমশাই আর দ্বিতীয় কথাটি না বলে কলিংবেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে কেরানিবাবুকে ডাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভরতি করলেন কানুকে।
আরও দু-একটা কথা হয়, হেডমাস্টারমশাই দু-চারটে প্রশ্ন করেন কানুকে, এবং সন্তুষ্টও হন।
সতৃষ্ণনয়নে স্কুলবাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে ফিরে এসে সিংহী-মশাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে ওঠে কানু!
‘‘দেখলি তো!’’
আর একবার খুশিতে ফেটে পড়েন দিবাকর সিংহী। ‘‘বলিনি তোকে, জগতে বন্ধ দরজা খোলবার চাবি হচ্ছে টাকা!’’
কানু বিহ্বলভাবে বলে, ‘‘কিন্তু একটা চেয়ারের জন্যে অত টাকা দিলেন কেন? দশ বারো টাকাতেই তো একটা চেয়ার—’’
‘‘দুর হাঁদা!’’ কানুর পিঠটা চাপড়ে দিয়ে হেসে ওঠেন দিবাকর সিংহী, ‘‘সত্যি কি আর চেয়ারের দাম! ওর নাম হচ্ছে ঘুস! না দিলে কিছুতেই ভরতি করতে চাইত না, নানান বায়নাক্কা করত, পুরোনো স্কুলের সার্টিফিকেট চাইত, কত কী! এ একেবারে সব ভুলে গেল! কিন্তু তোর কথা তো কিছু বললি না আমাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলি কেন, ছিলি কোথায় এত দিন, বলবি বলেছিলি যে?’’
বলবে বলেছিল, বলেও ছিল কানু।
একমাত্র দিবাকর সিংহীর কাছেই বলেছিল কিছু কিছু মনের কথা। দু-জনের বয়সের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান থাকলেও, সুন্দর একটি বন্ধুত্বের সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল।
জীবনের নীতি গ্রহণের ভুল, যেন খেলতে বসে ‘চাল’ ভুল! নইলে দিবাকরের মতো দরাজপ্রাণ লোক জীবনে কমই দেখেছে কানু।
অতঃপর ঘুরে গেল কানুর জীবনের মোড়। ভালো খাওয়া দাওয়া, ভালো জুতো জামা কাপড়, গাড়ি করে স্কুলে যাওয়া আসা, সেএক স্বপ্নময় অবস্থা!
ঠিক বড়োলোকের ভাগনের উপযুক্তই চাল।
এত দাক্ষিণ্য! অথচ নিতে কুন্ঠা আসে না। কানুর মতো ছেলেরও না।
দিবাকরের এই দেওয়ার মধ্যে তো দয়ার ছাপ নেই, আছে শুধু সহৃদয় বন্ধুর ভালোবাসা। তাই সহজেই নেওয়া যায়।
প্রথম বিভাগেই পাশ করল কানু।
দিবাকর পিঠ ঠুকে দিয়ে বললেন, ‘‘এই তো চাই। এখন ভাব বসে বসে, কোন কলেজে ভরতি হতে চাস?’’
কলেজ!
সেই অজানা রহস্যময় রূপকথার পুরী! সেখানে প্রবেশাধিকার পেয়েছে কানু! কিন্তু কলকাতা শহরটা কি এতবড়ো? তাই দৈবাতের জন্যেও কখনো দেখা হয়ে যায় না পুরোনো পরিচিতদের সঙ্গে? অথচ এই শহরটাতেই বাস করছে তপন, স্বপন, তাদের বন্ধুরা। তারাও তো পড়ছে কলেজে। আর—বাস করছে সুধা আর তার বাপ কাকারা। কোনোদিন কখনো কি তাদের কাজ পড়তে নেই শহরের এ অঞ্চলে?
কিন্তু কাজ পড়ে কী হবে?
কানুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া এই তো? তাতে কানুর লাভ?
তা লাভ আছে বই কী!
যারা কানুকে পথের ভিখিরির মতো তাড়িয়ে দিয়েছে বললেই হয়, তাদের কাছেই যদি কানুর এই গৌরবময় অবস্থা প্রকাশিত না হল—
ভাবতে ভাবতে এক সময় চিন্তার গতি বদলায়। …কোথায় গৌরব? এও তো ভিখিরির অবস্থাই। এ অবস্থা—একজনের দয়ার দান বই তো নয়! দিবাকর যদি আজই তার ওপর বিমুখ হয়? কবে আসবে কানুর জীবনে সেই সত্যকার গৌরবের দিন, যখন কানু নিজের পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে?
সেদিন কোন পথ ধরে আসবে?
উচ্চশিক্ষার সাফল্যের পথ ধরে! না জালনোট তৈরির সাফল্যের পথে?
বুঝতে পারে না কানু। তবু দিবাকরের সহকারীর কাজে আত্মনিয়োগ করতে লাগল। দুপুরে কলেজ, সকাল সন্ধ্যায় পড়া, আর রাত্রে স্টুডিয়োর ‘ডার্করুমে’ বসে ফোটো ‘ডেভেলাপ’ করার সঙ্গে সঙ্গে নানা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কাগজ তৈরির কাজ চলে। তারপর সেকাগজ নোটরূপে ছাপা হয় আরও গভীরতম গোপন একটি ঘরে।
সেখানে আরও দু-জন সহকারী আছে দিবাকরের। একজন হচ্ছে বোবা নেপালি যুবা, অপরজন হাঁটুর নীচে পা-হারানো একটা বর্মি প্রৌঢ়! ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে ওর দুটোপা-ই কাটা পড়েছে।
ঈশ্বর জানেন দিবাকর সিংহী এদের কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে। বর্মিটা গুপ্তঘর থেকে আদৌ বেরোয় না, বোবা নেপালিটা দৈবাৎ বেরোয়। দিবাকরের ওদের সঙ্গে খুব দোস্তিভাব। যদিও কথাবার্তা চলে সবটাই ইংরেজিতে।
দিবাকর এক-আধবার এ ঘরে আনে কানুকে, আর হেসে হেসে বলে, ‘‘দেখ, দেখে শিখে নে। তুই বেইমানের কাজ করবি না, অথবা বোকার মতো বেফাঁস কথা বলে ফাঁসিয়ে দিবি না এ বিশ্বাস রাখি। তুইই আমার ভবিষ্যতের ভরসা।’’
কানু একদিন বলে ফেলেছিল, ‘‘কিন্তু অনেক তো টাকা করেছেন। আর কেন? বেশির কী দরকার?’’
শুনে সেকী হাসি দিবাকরের! হাসি থামলে বলে, ‘‘ওরে এখনও অবোধ শিশু আছিস, তাই ওকথা বলছিস। টাকা কখনো বেশি হয়? ও জিনিসটা যত বাড়ে, ওর প্রয়োজনও তত বাড়ে, বড়ো হলে বুঝবি।’’
অথচ দিবাকরের স্ত্রী পুত্র নেই। লোকটা অবিবাহিত। আশ্চর্য! দু-হাতে টাকা ছড়াতেই যেন ওর চরম আনন্দ!
তা কানুও দু-হাতে টাকা ছড়াতে পারে। কলেজে বন্ধুবান্ধবদের খাওয়ানোতেই হোক, দলবেঁধে সিনেমা থিয়েটার দেখতেই হোক, অথবা কলেজের কোনো চাঁদার ব্যাপারেই হোক, কানুর ভূমিকা একেবারে প্রধানের। কানু নিশ্চয়ই সকলের খরচ একলা দেবে।
বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে, ‘‘যাই বলিস ভাই, দিব্যি একখানা মামা বাগিয়েছিস! আবার শুনি নাকি নিজের মামা নয়! লাকি ম্যান!’’
আবার কেউ কেউ বা বলে, ‘‘তোর মামার তো মাত্র একখানা ফটো তোলার দোকান, এত পয়সা আসে কোথা থেকে বলত?’’
কানু গম্ভীরভাবে বলে, ‘‘একদিন যাবি?’’
‘‘যাব! কোথায় যাব!’’
‘‘কেন মামার কাছে! নিজে মুখে জিজ্ঞেস করে আসবি—আচ্ছা এত টাকা পান কোথায়?’’
ওরা সামলে গিয়ে বলে, ‘‘ধ্যেৎ!’’
কানু বড়োলোক।
কানু গম্ভীর।
তাই কানুর বন্ধুর সংখ্যা কম। তবুও জুটেছিলো বই কী অনেক বন্ধু। জীবনের সেই তো সবচেয়ে আনন্দের কাল—সেই ছাত্রকাল!
কুনো কানুকে বন্ধুরাই মাঝে মাঝে জোর করে টেনে নিয়ে যেত বেড়াতে—দলবেঁধে কোনো ছুটির দিনে বোটানিকসে কী ডায়মণ্ডহারবারে, বেলুড়ে কী দক্ষিণেশ্বরে।
বেলুড়ের মন্দিরে তখনও মিস্ত্রির কাজ চলছে, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে এত বাজার বসেনি।
হঠাৎ এক শীতের দুপুরে!
সেই এক অদ্ভুত বোকামির ইতিহাস খোদাই করা আছে কানুর জীবনের পাতায়।
বোটানিকসে পিকনিক ছিল। ছাত্রদের আর অধ্যাপকদের মিলিত উল্লাসের আয়োজন। ওরই মধ্যে একটু দলছাড়া হয়ে কানু ঘুরছিল এদিক ওদিক, এ গাছতলায় ও গাছতলায়।
হঠাৎ দুই চোখ ঠিকরে উঠল কানুর।
ওদিকে কে ওরা? গাছতলায় উনুন জ্বেলে মহোৎসাহে রান্না চাপিয়ে হই হই করে গল্প করছে? ওর মধ্যে স্বপন আর তার বন্ধু রয়েছে না?’’
হঠাৎ একজনের সঙ্গে চোখোচোখি হয়ে গেল কানুর। না, স্বপন নয়, তার এক বন্ধুর। আর সঙ্গে সঙ্গে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগল কানু, কেন কে বলবে?
কানুকে যেন ভূতে তাড়া করেছে!
একেবারে বাগানের গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে তবে শান্তি! কানু যে একটা দলের সঙ্গে এসেছিল, খাওয়াদাওয়ার সময় যে সবাই কানুকে খুঁজবে, এরকম না বলে চলে আসার জন্যে যে অধ্যাপকদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে, এসব কথা তখন মনের কোণেও ঠাঁই পায় না কানুর, ওর তখন শুধু চিন্তা ‘পালাতে হবে’।
এখন মাঝে মাঝে ভাবতে গেলে নিজেই নিজের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজে পায় না কানু। যাদের সঙ্গে দৈবাৎ কোথাও একবার দেখা হয়ে যায় না কেন ভেবে আক্ষেপের অন্ত ছিল না, তাদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেন এই ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়?
বাড়িতে এসে দামি কাশ্মীরি শালখানা গা থেকে খুলে অবহেলায় চেয়ারের পিঠে ফেলে রেখে, মটমটে সার্জের শার্টটা পরেই বিছানায় শুয়ে পড়ে কানু। যেন অনেক বিপদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে নিরাপদ আস্তানায় আশ্রয় পেল!
দিবাকর সিংহী নিজে দোতলায় থাকেন, কানুর ঘর তিনতলায়। তিনতলায় ছোটো ছোটো দু-খানা ঘর, দু-খানাই কানুর। একটা ঘর পড়বার জন্যে সাজানো টেবিল, চেয়ার, বুককেস, সেলফ দিয়ে, আর একটা সাজানো শোবার ঘরের হিসেবে। জমিদারবাড়ির ছেলের মতোই হাল কানুর।
সেদিন দিবাকর সিংহী কি কিছু সন্দেহ করেছিলেন কানুকে? তা নইলে কানু এসে শুয়ে পড়ার পরই কানুর ঘরে তাঁর আবির্ভাব ঘটল কেন?
দিবাকর ঘরে ঢুকতেই অবশ্য কানু উঠে বসেছিল তাড়াতাড়ি। দিবাকর বলেন, ‘‘থাক থাক ব্যস্ত হবার কিছু নেই। শুনেছিলাম তোমাদের আজ পিকনিক আছে, হঠাৎ চলে এলে যে?’’
‘‘শরীর খারাপ লাগল।’’
হেঁটমুন্ডে বলে কানু।
দিবাকর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘শরীর খারাপ? তোমার সিঁড়িতে ওঠা দেখে মনে হল যেন পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে পালিয়ে এলে!’’
কানু নীরব।
‘‘দেখ মানিক, আমার কাছে কিছু লুকোতে চেষ্টা করিসনি, আমার কাছে হাজার দোষের মাপ আছে, মিথ্যে কথার মাপ নেই।
হ্যাঁ, জালিয়াত দিবাকর সিংহী এইরকমই।
কানু হঠাৎ সমস্ত কুন্ঠা ঝেড়ে ফেলে বলে, ‘‘আগে যেখানে ছিলাম, বাগানে তাদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই—’’
‘‘দেখা হয়ে গেল তা কী?’’ দিবাকর উদারভাবে বলে, ‘‘তুই তো আর সেখান থেকে চুরি করে পালিয়ে আসিসনি?’’
বুকটা ধড়াস করে ওঠে, চোখের সামনে অন্ধকারের গায়ে শুধু কয়েকটা হলুদ রঙের ফুল!
আবার সামলে নেয় কানু। মুখ তুলে স্পষ্টস্বরে বলে, ‘‘তাইতো এসেছিলাম।’’
‘‘তার মানে? চুরি করে পালিয়ে এসেছিলি?’’
‘‘হ্যাঁ!’’
আর কাউকে হলে বলত কি না কানু কে জানে, কিন্তু দিবাকর সিংহীর ব্যক্তিত্বের প্রতাপই আলাদা। সব কথা না বলে উপায় থাকে না।
সব কথা শুনে কিন্তু দিবাকর হেসে উঠেছিলেন, সেই ওঁর ঘর ফাটানো হাসি। ‘‘দুর দুর! নিলি তো সিন্দুক ফর্সা করে নে, তা নয় ছুঁচো মেরে হাতে গন্ধ! ধ্যেৎ! আবার চুরির টাকা তাদের ঘরেই লুকিয়ে রেখে এলি? এই তুই চালাক ছেলে?’’
কানু অবশ্য নীরব।
একটু পরে দিবাকর বলেন, ‘‘আমার টাকা চুরি করলেও আমার কিছু এসে যাবে না, তবু বলে রাখি হে, না বলে চেয়ে নেওয়ার চাইতে বলে চেয়ে নেওয়াই ভালো।’’
উঠে গিয়েছিলেন দিবাকর।
আর কাঠ হয়ে বসেছিল কানু।
হয়তো কানুর দুর্মতি তাকে আবার ঘর ছাড়া করত, কারণ সেদিন অনেকবার মনে হয়েছিল কানুর ‘পালাই পালাই’। আর যাতে না মুখ দেখাতে হয় ওঁকে। কিন্তু আসন্ন টেস্ট পরীক্ষার বাঁধনই বেঁধে রেখেছিল ওকে।
সিংহীমশাই অবশ্য আর তোলেননি সেকথা, তবে কানুর ওপর কাজ চাপাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। হয়তো দায়িত্বের বন্ধনে বাঁধতে চাইছিলেন তাকে। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এ ছেলে একটা শিকলিকাটা ময়না, একে আটকে রাখা শক্ত।
সন্ধ্যায় স্টুডিয়োর কাজে অনেক সাহায্য করতে হয় কানুকে। এক-আধ সময় ফোটো তোলাও।
হঠাৎ একদিন আবার এক বিপত্তি।
না:! কলকাতা শহরটা এমন কিছু বড়ো নয়।
ইয়া মোটা একটি ভদ্রলোক সকালে এসেছিলেন স্টুডিয়োতে। বললেন, ‘‘আমার একটি ভাগনির ফটো তুলে দিতে হবে মশাই, যাতে কালো রং বেশ ফর্সা দেখায়।’’
দিবাকর হেসে ফেলে বলেন, ‘‘কেন বিয়ের জন্যে ফটো চাই বুঝি?’’
‘‘ঠিক ধরেছেন মশাই! ফটো পাঠাতে হবে এলাহাবাদে, ‘সম্বন্ধ’ চলছে। বেশ আলো-টালো ফেলে—বুঝলেন তো?’’
‘‘ঠিক আছে, আনবেন ওবেলা। ছটা থেকে আটটার মধ্যে।’’
‘‘আপনি থাকবেন তো?’’
‘‘আমি না থাকি, আমার এই অ্যাসিস্টেন্ট থাকবে।’’
‘‘এই সেরেছে! ও ছেলেমানুষ—মানে উনি ছেলেমানুষ, পারবেন?’’
‘‘খুব পারবে। একটু আধুনিক-টাধুনিকভাবে সাজিয়ে আনবেন মেয়েটিকে।’’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। আর কানু বার বার ভাবতে লাগল কোথায় যেন দেখেছে কানু এঁকে।
পরে বুঝেছিল এঁকে দেখেনি, দেখেছিল এঁর বোনকে। কারণ যে ভাগনিকে নিয়ে ফোটো তোলাতে এলেন ভদ্রলোক, সেআর কেউ নয়—সেসুধা!
দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল নাকি কানু? ভাগ্যের এ কী পরিহাস? এ বোটানিক্যাল গার্ডেন নয় যে ছিটকে পালাবে। অতএব?
অতএব না চেনার ভান!
সুধাও কি প্রথমটা পাথর হয়ে যায়নি? গিয়েছিল বই কী।
সেকী করে বিশ্বাস করবে এই দামি গরম সুট পরা লম্বা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চেহারার তরুণটি তাদের বাড়িতে পড়ে থাকা ছেঁড়াশার্ট পরা কানু? তবু চিনতে সেঠিকই পেরেছিল। অস্ফুটে উচ্চারণও করেছিল ‘কানুদা’।
কিন্তু কানুর যে তখন না চেনার ভানের পালা। তাই গলার স্বর ভারী করে বলেছিল, ‘‘আমায় কিছু বলছেন?’’
‘‘আপনি—আপনি—মানে আপনার নাম কী?’’
‘‘আমার নাম—’’
হঠাৎ ধমকে উঠলেন সুধার মামা,—‘‘ছবি তোলাতে এসেছিস ছবি তোলা, ওঁর নামে তোর কী দরকার রে?’’
‘‘না, না, তাতে কী?’’ অমায়িক হাসি হাসে কানু, ‘‘আমার নাম অজিত মুখোপাধ্যায়।’’
হ্যাঁ, ওই নামটাই তখন মুখে এসে গিয়েছিল।
কিন্তু সুধা কি তাতে ভুলেছিল? মনে হয় না। তা হলে বার বার অমন তাকাচ্ছিল কেন? আর পরে ফোটোর মুখটাই বা অত বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল কেন?
তারপর ওরা চলে যাওয়ার পর—আরও অনেকদিন পর পর্যন্ত যখন তখন এই কথাটা মনে পড়েছে কানুর, আর মনটা সেই সুধার ছবির মুখের মতোই বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। কী দরকার ছিল ও রকম নিষ্ঠুরতার?
জীবন বসে থাকে না।
আজকের নিতান্ত দুঃখ পরবর্তীকালে শুধু একটা অস্পষ্ট স্মৃতির ছাপ। জীবনে আসে নিত্য নতুন মুখ, নিত্য নতুন ভিড়। সেভিড়ে হারিয়ে যায় পুরোনো মুখ, পুরোনো কথা। কিন্তু সব কি যায়?
কেন তবে কানুর মাঝে মাঝে কেবলই ইচ্ছে হয়, একবারের জন্য শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে বিশেষ একখানা টিকিট কিনে উঠে পড়ে ট্রেনে? না, কারও সঙ্গে দেখা করবে না কানু, শুধু বেড়াবে, শুধু একটা বাজে কোনো লোককে ধরে দেশের খবরাখবরগুলো জেনে নেবে। আর কিছু নয়।
হাতে টাকা থাকে সর্বদাই, প্রচুর থাকে। দিবাকর সিংহীর তো ঢালা হুকুম—‘‘দরকার হলেই সরকার মশাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিবি।’’ কাজেই ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। কিন্তু—
কিন্তু যেন সাহস কুলোয় না কিছুতে।
কেন এই ভয়?
কীসের এই কুন্ঠা?
অহরহ ভাবতে থাকে কানু, সেতো আর কাউকে ধরা দিতে বা চেনা দিতে যাচ্ছে না, শুধু একবার জানতে যাওয়া। কেমন আছে তারা? সেই তার সহপাঠীরা, তার মা, পিসি, মাস্টারমশাই, ফুলি? আচ্ছা ওরা কি এখনও স্কুলে পড়ে? কেন তা পড়বে? আশ্চর্য তো! ওদের দিনগুলো কি এগোচ্ছে না? হয়তো—হয়তো ফুলির বিয়েই হয়ে গেছে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে আছে, দেখাই হবে না।
এসব কথা মনে করতে করতে সহসা একদিন মন উদ্দাম চঞ্চল হয়ে ওঠে, কিছুতেই বুঝি আর বেঁধে রাখা যাবে না নিজেকে।
যেতেই হবে! যেতেই হবে!
মনের মধ্যে অবিরত এই শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে। অবশেষে দিবাকরকে বলেই বসে, ‘‘আমি দু-দিনের জন্যে একটু বাইরে যাব’’।
‘‘বাইরে যাবি? কোথায় যাবি?’’
না, দিবাকরের সামনে মিথ্যে কথা বলা যাবে না। কিছুতেই না। অনেকবার ভেবেছিল বানিয়ে বলবে ‘বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাব’, পারল না। চুপ করে রইল।
দিবাকর সন্দেহ সন্দেহভাবে বললেন, ‘‘কই বললি না?’’
‘‘কোথায় যাব জানি না।’’
‘‘কোথায় যাবি জানিস না! জিজ্ঞেস করি আমি কালা, না তুই পাগল?’’
‘‘বোধ হয় আমিই পাগল’’ মাথা নীচু করে বলে কানু।
‘‘তাই দেখছি। কিন্তু বলতে তো হবেই বাপু, জানো আমার কাছে সাতখুনের মাপ আছে, মাপ নেই লুকোচুরির।’’
‘‘আমি—আমি—ভাবছি দেশে যাব।’’
‘‘দেশে?’’
‘‘হ্যাঁ’’—মুখটা আরও নীচু করে বলে কানু, ‘‘যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম।’’
‘‘যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলি সেইখানে যাবি তুই? সেইখানে যাবি? কেন? কেন?’’ হঠাৎ ভারি বিচলিত দেখায় দিবাকরকে, ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলেন, ‘‘বনের পাখি শিকলি কেটে ফের বনে চলে যাবি বুঝি? কিন্তু আমি যে বড়ো আশা করেছিলাম রে—বড়ো আশা করেছিলাম।’’
বিচলিত কানুও হয়েছে বই কী!
দিবাকর সিংহীর এ চেহারা অপরিচিত। কানু একটু কাতরভাবে বলে ‘‘আমি শুধু একবার দেখতে যাব। রাতের অন্ধকারে ঘুরে বেড়িয়ে চলে আসব।’’
‘‘সেকি অনেক দূর?’’
‘‘না না, এই তো মাত্র ঘণ্টা কয়েকের রাস্তা।’’
‘‘আচ্ছা যা। যদি তোর বাপ-মা তোকে আটকায়, থেকে যাবি তো?’’
‘‘আমি তো তাদের সঙ্গে দেখাই করব না।’’
দিবাকর আবার পায়চারি করতে থাকেন, তারপর হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে বলেন, ‘‘আমি বড়ো স্বার্থপর না?’’
‘‘না না, কেন?’’
‘‘কেন তা কি বুঝতে পারছিস না? ভয় হচ্ছে পাছে তোকে হারাই, তাই —আচ্ছা যা যা, শুধু যদি সেখানে থেকেই যাস একটু জানাস বাবা!’’
হঠাৎ চোখটা ছলছলে দেখায় দিবাকরের।
আশ্চর্য!
এরকম হবে তা তো ভাবেনি কানু।
ভাবল দুরছাই দরকার নেই যেয়ে।……আবার ইচ্ছে তীব্রতর হয়ে ওঠে। যেতেই হবে।
কানু তো আর সত্যি থেকে যাবে না!
শেয়ালদা!
শেয়ালদা!
উঃ কী সেই তীব্র আনন্দের যন্ত্রণা! টিকিট চাইতে গলা কাঁপছে, টিকিট কিনতে হাত কাঁপছে! অদ্ভুত সেই অনুভূতি!
তারপর জীবনে কত কতবার রেলগাড়ি চড়ল কানু, কত টিকিট কাটল, কতবার ট্রেনের হুইসিল শুনল, কিন্তু সেদিনকার হুইসিলের মতো তীক্ষ্ণতীব্র ধ্বনি কি আর কখনো শুনেছে? রেলগাড়ি চড়তে, টিকিট কিনতে, আর ট্রেন আসার আগে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে অনুভব করেছে সেদিনের মতো উত্তেজনা?
কিন্তু তারপর?
তারপর ফিরে আসার সময় কানুর মনের কাছে সমস্ত পৃথিবীটা কী একটা জমাট সিসের পিন্ডের মতো নিথর হয়ে যায়নি? সেইসঙ্গে কানুর হৃৎপিন্ডটাও?
কানু কি ভাবতে পেরেছিল মাত্র এই ক-টা বছরের অবসরে সারাজগৎটাই ভয়ংকরতার নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠবে?
কী ভয়ংকর! কী কুৎসিত!
কানুর সহপাঠীরা কেউ আর দেশে নেই, সবাই বাইরে ছিটকে পড়েছে, কেউ পড়ার জন্যে, কেউ চাকরির চেষ্টায়। কানুর মা মারা গেছে, আর কানুর বাবা আবার একটা বিয়ে করেছে। কানুর পিসি রাসমণি নতুন ভাজের সংসারে থাকতে না পেরে চলে গেছে কাশী, আর—আর মাস্টারমশাই মারা গেছেন সেই ক—বে! তাঁর নাতনি ফুলি নিরুপায় হয়ে চলে গেছে তার পিসির বাড়ি—সেকোথায় কোন দেশে সেকথা বেচারাম বলতে পারে না।
বেচারাম গ্রামের ধোপা।
তাকেই ধরেছিল কানু ভরদুপুরে পুকুরপাড়ে। জানত বেচারামই দেশসুদ্ধ লোকের খবর রাখে। সকলেই—হয় ওর, নয় ওর ভাই কেনারামের, খদ্দের।
কিন্তু আশ্চর্য! এরা তো বদলায়নি।
এতটুকু—এক তিলও না।
ওর সেই নীল রং গোলবার কানাভাঙা গামলাটা পর্যন্ত আজও তেমনি অবিকল আছে। তবে কেন পৃথিবীটা এত বদলাল?
বেচারাম আক্ষেপ ক’রে বলে, ‘‘সেই এলেই দাদাবাবু, যদি আর কিছুদিন আগে আসতে, তালে তোমার মা-টা একবার চোক্ষের দেখা দেখতো পেত! আহা, ‘ছেলে ছেলে’ করেই মা ঠাকরুনের প্রাণটা বেইরে গেল।’’
কানু হঠাৎ চোখে এসে যাওয়া জলকে প্রচন্ড চেষ্টায় শুকিয়ে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘‘মিথ্যে কথা, কেউ কি আমায় খুঁজেছিল?’’
‘‘আ কপাল! শোন কথা! জলজিয়ন্ত একটা ছেলে নিখোঁজ হয়ে গেল, খুঁজবেনি? কত খুঁজেছে!’’
‘‘ছাই খুঁজেছে! বলে সহসা উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে চলতে থাকে নিজের বাড়ির রাস্তার উলটোদিকে।
বেচারাম হতভম্ব হয়ে ডাক দেয়, ‘‘এই রোদ্দুরে হনহন করে আবার কোথায় চললে? বাড়ি গিয়ে চান আহার করে ওবেলা বেড়াতে বেইরো—’’
কিন্তু বেচারামের কথার শেষটুকু আর বোধ করি কানুর কানে পৌঁছোয় না।
কেনারাম ঘুরে কাপড় আছড়াচ্ছিল, এদের কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে এখানে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘‘কী রে বেচা?’’
‘‘আর কও কেন দাদা! মিত্তিরঠাকুরদের সেই খ্যাপা ছেলেটা ফিরে এসেছে গো—’’
‘‘তাই নাকি? হায় হায়! এতকালে? তা তোকে কী বলছিল!’’
‘‘কিছু না, এই সব খোঁজ তল্লাশ নিচ্ছিল, হঠাৎ কী যে হল, রেগে কাঁই হয়ে হনহনিয়ে চলে গেল।’’
‘‘মাথাটা বোধ হয় একেবারেই বিগড়েছে!’’
বলে কেনারাম নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে মন দেয়।
বেচারামও একটু তাকিয়ে থেকে শব্দ তোলে—ধাঁই ধপাধপ, ধাঁই ধপাধপ।
পরদিনই যখন কানু ফিরে আসে, সিংহীমশাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন, কিন্তু ওর মুখ দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস করেন না। ফিরে এসেছে এই ঢের।
ছেলেটাকে যে বড্ডই ভালোবেসে ফেলেছেন সিংহীমশাই। ভালো অবশ্য তিনি তাঁর বোবা আর পা-কাটা সহকারীদেরও বাসেন, কিন্তু সেটা অনেকটা স্বার্থের বশে। কানুর কথা আলাদা। কানুকে অকারণেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু কানু কি সেভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে?
না:! কানুর বিদ্রোহী-আত্মা শুধু নিজের আগুনে নিজে জ্বলে জ্বলে খাক হতে জানে, শুধু অশান্ত উত্তেজনায় শূন্যে মাথা কুটে মরতে জানে।
তবু কানু পড়াশোনায় অদ্ভুত ভালো।
ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র। তবে একরোখা আর অহংকারী বলে অধ্যাপকদের তেমন স্নেহের পাত্র নয়। কী করে যে কানু এত মানসিক অস্থিরতার মধ্যেও পড়ালেখাটা এমন নিখুঁতভাবে চালিয়ে এসেছিল, এখন ভাবলে তার নিজেরই বিস্ময় জাগে। কিন্তু?
কিন্তু কানুর ভাগ্যাকাশে যে চিরদিনই শনি!
বি, এ, পরীক্ষার ঠিক আগেই সেশনি চালল আর এক মোক্ষম চাল!
সেই এক ভয়ংকর দিন!
কানুকে ডাকিয়ে পাঠিয়ে সিংহীমশাই ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন, কানু আসতেই কেমন একরকম হেসে বললেন, ‘‘লীলা-খেলাটা সাঙ্গ হলরে মানিক!’’
কানু অবাক হয়ে তাকাল।
‘‘আবার পুলিশে সন্ধান করে গেছে! এবার আর ফসকে বেরিয়ে আসা যাবে না মনে হচ্ছে, এখনকার পুলিশ সুপার লোকটা বড়ো কড়া! গোয়েন্দা লাগিয়ে যেখানকার যত জাল-জালিয়াতি কারবারের আড্ডা তচনচ করছে! এবার আর সরে পড়া ছাড়া গতি নেই।’’
আবার কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠেন দিবাকর সিংহী। কিন্তু সেকি হাসি? না কান্না? হঠাৎ শিউরে স্তব্ধ হয়ে যায় কানু।
দিবাকরের হাতে একটা রিভলভার।
‘‘আপনি কী করতে চান?’’
চেঁচিয়ে ওঠে কানু।
সিংহীমশাই হেসে ওঠেন। ‘‘কী আর? জালিয়াতের যা শেষ পরিণাম তাই!’’
‘‘আপনি কি সুইসাইড করতে যাচ্ছেন?’’ কানু ছুটে গিয়ে রিভলভারটা কেড়ে নিতে যায়, কিন্তু দিবাকর সেটা সুকৌশলে অপর হাতে নিয়ে বলেন, ‘‘কী আর করা যায়? এ বয়সে আর জেল খাটা পোষাবে না।’’
‘‘কেন, এখনও তো আপনার অনেক টাকা আছে’’—কানু হাঁপায়, ‘‘আরও অনেক তৈরি করবেন, দিয়ে দিন না ওদের?’’
‘‘সেআর হবে না।’’ দিবাকর তেমনি হাস্যমুখে বলেন, ‘‘সেচেষ্টা কি করিনি ভেবেছিস? করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম পৃথিবীতে খাঁটি লোকও আছে রে! আর হয়তো—’’ অন্যমনাভাবে বলেন দিবাকর,—‘‘হয়তো সেইজন্যেই পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে। যাক এবারের মতো পৃথিবী থেকে বিদায়! ভেবেছিলাম তোকে দেদার টাকা দিয়ে আগেই এখান থেকে সরিয়ে দেব, তুই অন্যত্র গিয়ে জীবন গড়তে পারবি। কিন্তু থাক। তুই এমনিই চলে যা, শুধু হাতে! অন্যায়ের অর্থ মূলধন করে জীবন শুরু করে কাজ নেই! এ পর্যন্ত তোকে ঢের কুশিক্ষা দিয়েছি, সেসব ভুলে যাস। মনে রাখিস সৎপথই সত্য পথ! ভাবছিস, হঠাৎ ভূতের মুখে রাম রাম নাম কেন? তাই না? মরণের দরজার কাছে এসে আজ দৃষ্টিটা খুলে গেল রে!’’
‘‘কে আপনাকে মরতে দিচ্ছে?’’ কানু হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়—, ‘‘তা হলে তার আগে আমাকে গুলি করুন।’’
‘‘খ্যাপামি করিসনে মানকে—’’ চেঁচিয়ে ওঠেন দিবাকর,—‘‘গুরং সিং আর বাথিনও তোর মতন জ্বালাতন করেছিল, ধমক দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছি।’’
‘‘বাথিন? তার যে দুটো পা কাটা!’’
‘‘তাতে কী? লোক দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিলাম। কলঙ্কিত টাকাগুলোর কিছু সদবয় হল!’’
‘‘ওদের বিদেয় করতে পেরেছেন, আমায় পারবেন না!’’
‘‘পাগলের মতো কথা বলিসনে মানকে, যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার করতে আসতে পারে, তখন তুইও জালে পড়ে যাবি। তুই এইবেলা আমাদের কারখানা ঘরের চোরা দরজাটা খুলে বেরিয়ে যা।’’
‘‘না।’’
‘‘না? ফের না? না গেলে তোকে গুলি করে ফেলব মানকে!’’
‘‘তাই তো চাই! তাই করুন!’’
হঠাৎ বিছানার ওপর বসে পড়েন দিবাকর। বসে পড়ে ক্লান্ত গলায় বলেন, ‘‘তোকে আমি খুবই বেইমান ভাবতাম জানিস মানকে! ভাবতাম ছোঁড়াকে এত ভালোবাসি, ছোঁড়া তার এক ছটাকও প্রতিদান দিতে জানে না। পৃথিবী থেকে যাবার আগে অনেক ভুলই ভাঙছে রে!’’
হঠাৎ নীচে একটা উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল। দিবাকরও উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। ‘‘ওই বোধ হয় পুলিশ এসে গেছে। দারোয়ান ব্যাটা বোধ হয় আটকাতে চেষ্টা করছে। ব্যাটা বোকা! তুই যা বলছি মানিক, যা শিগগির!’’
‘‘না!’’
‘‘ফের না? তার মানে আমায় জেল না খাটিয়ে ছাড়বি না?’’
‘‘তা’ কেন? আপনিও চলুন না, সেই চোরা দরজাটা দিয়ে।’’
‘‘আমি?’’ হঠাৎ মুখটা কেমন উজ্জ্বল দেখায় দিবাকরের। ‘‘ঠিক বলেছিস, তবে এক কাজ কর, সিঁড়ির দরজাটা চট করে বন্ধ করে দিয়ে আয়। ওরা দরজা ভাঙতে ভাঙতে, আমরা বাথরুমের জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাতে পারব।’’
যতই হোক তবু কানু ছেলেমানুষ কী করে বুঝবে কানু, যে মুহূর্তে সেসিঁড়ির দরজার দিকে ছুটে যাবে, সেই মুহূর্তে ভয়ংকর নিদারুণ সেই শব্দটা বিদীর্ণ করে দেবে সমস্ত পৃথিবীর স্তব্ধতা!
আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পাওয়া যাবে আর একটা শব্দ।
ভারী জিনিস পড়ে যাওয়ার।
না, যারা পুলিশি পরোয়ানা নিয়ে সেদিন দিবাকর সিংহীর বাড়ি চড়াও হয়েছিল, তারা কোনো অপরাধীকেই ধরতে পারেনি। প্রধান অপরাধী চিরতরে ফসকে পালিয়ে গিয়েছিল মানুষের গড়া আইনের হাত থেকে, আর দুজন আগেই পৌঁছে গিয়েছিল নিরাপদ জায়গায়। আর শেষ অপরাধী সেই ভয়ংকর মুহূর্তে অনভ্যস্ত হাতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল বাথরুমের সিঁড়ি দিয়ে।
কে সেই দুঃসাহসের প্রেরণা জুগিয়েছিল কানুকে? কে বুদ্ধি দিয়েছিল আত্মহত্যার অস্ত্রটা কুড়িয়ে নিয়ে আত্মরক্ষা করতে? কে জানে!
বোধ করি পরিস্থিতিই প্রধান প্রেরণাদায়ক।
তারপর?
তারপর—
জীবনের সেএক উদ্ভ্রান্ত উন্মাদনাময় অধ্যায়!
অনেক ভাবলেও এখন কানু নিজেই কি আর বলতে পারবে কেমন করে সেখোলা দিনের আলোয় কলকাতার রাস্তায় রিভলভার নিয়ে দৌড়েছিল, কেমন করে অজানতে বেপরোয়া ছুটতে ছুটতে শহরের খুব কাছাকাছি অথচ বনবাদাড় পুকুরে ভরা একটা অজানা জায়গায় গিয়ে পড়েছিল, আর কেমন করে এখান থেকে ওখান, আর ওখান থেকে এখান লুকোচুরি করতে করতে শেষ অবধি একটা বিপ্লবীদের দলে গিয়ে ভিড়েছিল? না, কিছু বলতে পারবে না কানু। প্রবল জ্বরের সময় প্রলাপের ঘোরে যেসব কথা বলে মানুষ, সেসব কথা কি পরে মনে থাকে?
মাথার মধ্যে তখন কী আর কিছু ছিল জ্বলন্ত আগুন ছাড়া? শুধু আগুন। তার উত্তাপে জ্বলে যাচ্ছে জ্ঞান, চৈতন্য, বুদ্ধি! জ্বলে যাচ্ছে জীবনের অন্য সব চিন্তা! সেইসময় সেই বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের হাতে ধরা পড়ল কানু।
পরে অনেকদিন অনেক হাহাকারের মুহূর্তে—দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে মরে যাওয়ার মতো ইচ্ছের মুহূর্তে—মনে হয়েছে কানুর, ওদের দলের হাতে না পড়ে যদি পুলিশের হাতেই ধরা পড়ত কানু! তাহলে—তাহলে তো কানুর জীবনের বনেদটা গড়া হত না একটা রক্তাক্ত ভয়ংকরতা দিয়ে!
জেল হত, হত!
দিবাকর সিংহীর অন্নের ঋণ আর অযাচিত স্নেহের ঋণ শোধ হত তাঁর বদলে জেল খেটে! কিন্তু এমন তো হত না? সেকথা ভাবতে গেলেই সব কিছু গুলিয়ে যায়, শুধু একটা দম আটকানো অনুভূতি, শুধু সামনে ভেসে ওঠে একটা জমাট কালচে গাঢ় রক্তধারা!
তবু সেই দম আটকানো অনুভূতির মাঝখানেও অনেকগুলো মুখ ফুটে ওঠে ঝকঝকে জ্বলজ্বলে। ওরা—ওই মুখের অধিকারীরা ভুল করে সর্বনাশের পথ ধরেছিল সত্যি, কিন্তু কানুকে তো তারা সত্যিই ভালোবেসেছিল! ভালোবেসেছিল বলেই তো টেনে নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের হাতে কাটা সর্বনাশের রাস্তায়।
প্রথমটা বোধকরি কানুর হাতের রিভলভারটার লোভের আকর্ষণেই ওরা ধীরে ধীরে কানুর সঙ্গে ভাব করেছে, বন্ধুত্ব করেছে, করেছে দলভুক্ত। তারপর ভালোবেসেছে কানুর অনমনীয়তা, দৃঢ়তা, নির্ভেজাল খাঁটিত্ব, আর দুরন্ত বিদ্রোহ জ্বালাভরা প্রাণটা দেখে। এই তো চাই! এই তো দরকার!
এক এক সময় সব মুখগুলো এক সঙ্গে ভিড় করে আসে…….‘প্রভাতকিরণ’ ‘নিকুঞ্জ’ ‘বলাইদা’ ‘বড়দা’ ‘রোখা বরিশাল’ ‘হাঁদা যশোর’ আর ‘নীরজাদি!’ নীরজাদির রঙে আগুন, চোখে আগুন, কথায় আগুন! ‘বড়দা’ বাদে দলের সবাই তাঁর কথায় উঠত বসত। শুধু বড়দা হেসে বলতেন যখন তখন, ‘‘সব আগুন যদি দলের মধ্যেই খরচ করে ফেলো নীরজা, সাহেবদের ল্যাজে লাগাবার জন্যে আর রাখবে কী? সাগরপার থেকে আসা ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েই তো ফের সাগর পার করে ছাড়তে হবে?’’
ভাঙা দুটো গাদা বন্দুক, আর গোটা তিন চার রিভলবার এই ছিল ওদের অস্ত্রশক্তি! তবে বাক্যশক্তিতেই সব ঘাটতি পূর্ণ হয়ে যেত। বিদেশি শাসনের অবসানের জন্যে মরণ পণ করেছিল ওরা! আর বক্তৃতার ঝাঁজে ফুটে উঠত সেই মরণপণকারী রক্ত!
এর আগে কানু কোনোদিন ‘দেশ’ নিয়ে ভাবেনি। ভেবে দেখেনি সেদেশ কার লৌহশৃঙ্খলে বন্দিনি। নিজের জীবনের অকারণ যন্ত্রণা নিয়েই কেটেছে বাল্য-কৈশোর, তারুণ্যের সঙ্গে সঙ্গে পেল দিবাকরের অগাধ দাক্ষিণ্য। যে কলেজে ভরতি হল, সেটি হচ্ছে বড়োলোকের ‘বাবু’ ছেলেদের কলেজ। সেখানে কেউ দেশোদ্ধারের স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর যদিও বা কেউ ঘামিয়ে থাকে, সেঅন্যত্র, অন্য দলে। কানু তার সন্ধান রাখেনি। কানুর জীবনের একমাত্র চিন্তা ছিল নিজেকে দাঁড় করিয়ে তোলা! দেশের কথা ভাববার অবকাশ তার কবে জুটেছে?
এখানে এক নতুন চেতনা!
পরাধীনতা যে এত গ্লানিকর, পরশাসন যে এত ধিক্কারজনক, সেকথা কানু প্রথম টের পেল এই ‘বিপ্লবী মুক্তি সমিতি’তে যোগ দিয়ে।
কিন্তু ওদের কাজ ধ্বংসাত্মক!
ওরা মুক্তি চেয়েছে, কিন্তু আপন শক্তির ওজন করেনি। বিবেচনা করেনি ওদের পথটা ঠিক কী ভুল। মহাত্মাজির ‘অহিংস মন্ত্র’ ওদের কাছে হাস্যকর, ওদের স্লোগান, ‘‘রক্তের বদলে রক্ত চাই!’’
ওদের কাছে আত্ম বিক্রয় করল কানু!
ওরা বলে ‘‘ধ্বংস করো, সব ধ্বংস করো। বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল ভাঙো, তার শৃঙ্খলার যন্ত্রগুলিও ভাঙো! মারো পুলিশ, মারো লাট-বেলাট, ভাঙো তার ঘরবাড়ি অফিস আদালত, উপড়ে ফেলো তার শিল্পকেন্দ্রগুলি, জ্বালাও, পোড়াও, উৎখাত করো!’’
কী সেই ধ্বংসের নেশা!
সেদিনের অনেকগুলো ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক কাজের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত থেকে গেছে কানু! কানু নয়, কানুর ভ্রান্ত আত্মা। ব্যাংক লুট করাকে ওরা ভাবে ‘দেশের কাজ’! ‘দেশের কাজ’ মোটর ডাকাতি, পুলিশ খুন, সরকারি মজুতখানার চাল ডালের গুদামে আগুন লাগানো, রেললাইনের ওপর বোমা ফেলে রেখে ট্রেন উলটে দেওয়া! এই ‘দেশের কাজ’ করার উন্মাদ আনন্দে কানু ভুলে যায় তার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান।
দিনেরবেলা কোনো পোড়ো ভাঙাবাড়িতে লুকিয়ে থাকা, কাঁচা পোড়া আধসিদ্ধ যাহোক কিছু খাওয়া আর ষড়যন্ত্র ভাঁজা এবং রাত হলেই দুষ্কর্মের চেষ্টায় বেরিয়ে পড়া, এই ওদের জীবনের ছক!
চোরের মতো, পশুর মতো!
কিন্তু পশুরাও কি এত নৃশংস হতে পারে? অকারণ এত হিংস্র?
একটা অখ্যাত গ্রামের এই দৈন্যদশাগ্রস্ত হাসপাতালের ঘরে, অচৈতন্য ফুলির খাটের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এই কথাই ভেবেছে কানু।
শেষরাত্রে লাইনে বোমা রেখে ট্রেন উলটে দেওয়ার পর, ‘দেশের কাজে’ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায় সেই নারকীয় নাটকের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ‘প্রভাতকিরণ’ ‘নিকুঞ্জ’ ‘হাঁদা যশোর’ আর কানু! সেযত টাকাকড়ি গহনা সংগ্রহ করতে পারবে, নীরজাদি তার ওপর তত খুশি হবেন। অতএব—
অতএব সেই মৃত্যুস্তূপের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো দরকার।
হঠাৎ কি মেঘ ডেকেছিল? না সেশব্দ কানুর বুকের? হঠাৎ কি বিদ্যুৎ চমকেছিল? না সেদীপ্তি কানুর দৃষ্টির তীব্রতার?
প্রথমটায় কি কানু বিশ্বাস করেছিল যা দেখছে সেটা সত্যি? কানুর চোখের ভ্রম নয়, শয়তানের নিষ্ঠুর পরিহাস নয়, একেবারে খাঁটি সত্যি?
না প্রথমটায় বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তারপর?
লাইনের খানিকটা দূরে একটুখানি সোনার চকচকানি! বার বার চোখ রগড়ে রগড়ে আর বার বার দেশলাই কাঠি জ্বেলে জ্বেলে দেখে অবিশ্বাসটাই যেন শিউরে উঠে স্তব্ধ হয়ে বিশ্বাসকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল।
সেই সোনার চকমকানিটুকু একগাছি সোনার বালার। সেবালাপরা হাতখানি বিছিন্ন হয়ে পড়েছিল গজখানেক দূরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা একটি মেয়ের দেহ থেকে। আর? আর সেমেয়ে ফুলি!
দশ বছর পরে দেখা।
কিন্তু হাজার বছর পরে দেখা হলেও কি ফুলিকে চিনতে ভুল করত কানু?
হাসপাতালের ঘরে রোগীর খাটের সামনে বসে তাকিয়ে দেখছিল কানু। দেখছিল কপালে ব্যাণ্ডেজ থাকা সত্ত্বেও ভুরুর কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া একটা জমাট গাঢ় কালচে রক্তের ধারা।
না, তখুনি মারা যায়নি ফুলি, জ্ঞান হয়েছিল তার। উপযুক্ত চিকিৎসা হলে হয়তো বা সামলে যেত। হয়তো ‘ফুলি’ নামক সেই একটা অদ্ভুত উজ্জ্বল আনন্দ আবার পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াত। হয়তো তারপর থেকে পৃথিবীটা অন্যরকম দেখতে হয়ে যেত। কিন্তু তা হল না। সেই এক অখ্যাত গ্রামেই অবহেলিত হাসপাতালের ধুলোভরা ঘরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ফুলি। করল শুধু উপযুক্ত একটু চিকিৎসার অভাবে।
ক্ষতের মুখে রেল-লাইনের ধুলো-কাঁকর ঢুকে সমস্ত রক্ত বিষাক্ত হয়ে গিয়ে জ্বর দেখা দিয়েছিল। প্রবল জ্বর। সঙ্গে সঙ্গে বিকার। দেড়দিন ধরে ফুলি বিকারের ঝোঁকে কাঁদল, চেঁচাল, অজস্র অর্থহীন কথা বলল, তেড়ে তেড়ে উঠে বসতে চাইল, তারপর আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেল।
নিরুপায় দর্শকের ভূমিকা নিয়ে বসে বসে দেখল একটা আধা পাশকরা বোকা ডাক্তার, আর তার তেমনি কম্পাউণ্ডার।
আর কানু?
কানুর সেদিনের অবস্থা কানু এখন কি আর স্পষ্ট করে মনে আনতে পারে? ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। ‘কানু’ বলে সেই ছেলেটা পাগলের মতোই কান্ড করেছিল। চেঁচিয়েছে, ছুটোছুটি করেছে, দেয়ালে মাথা ঠুকেছে, নিজের হাতে নিজের চুল ছিঁড়েছে, আর সেই হতভম্ব কম্পাউণ্ডারটার পায়ে পড়েছে সদর থেকে একটা ইনজেকশনের ওষুধ এনে দেওয়ার জন্যে। যত টাকা লাগে লাগুক, সারাজীবন ধরে ধরে শোধ করবে কানু। কিন্তু এসব কোনো কিছুই কাজে লাগেনি।
কী করে লাগবে?
রেললাইন উপড়ে ফেলে এ গ্রামের সঙ্গে বাইরের জগতের যোগাযোগ নষ্ট করে রেখেছে তো কানুরাই। গোরুরগাড়ি করে কি আর মৃত্যুদূতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়? সেযে ঝড়ের বেগে আসে।
লোকটা গোরুরগাড়ি চড়ে গিয়েছিল চেষ্টা করতে, কিন্তু ফিরে আসার আগেই ফুলি মারা গিয়েছিল।
ডাক্তারের মতোই স্তব্ধস্তিমিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বসে বসে দেখেছিল কানু সেই মৃত্যুকে।
অবশ্য নিজে ফুলি বাঁচতে চায়নি। আগে যে দুদিন চৈতন্য ছিল, তার মধ্যে বলেছিল, ‘‘বেঁচে কী হবে কানুদা! দেখছ তো ডানহাতটাই কাটা গেছে। কাজের হাত! কাজের হাতটাই যদি গেল তো পৃথিবীর অন্নধ্বংস করে লাভ কী?’’
লাভ!
কানু ব্যাকুলভাবে বলেছিল, ‘‘লাভ তোর নয় ফুলি, আমার! আমার পাপের অন্তত এক টুকরোও প্রায়শ্চিত্ত হবে।’’
শুনে হেসেছিল ফুলি।
হেসে বলেছিল, ‘‘বুঝেছি! ভাবছ বাঁচিয়ে তুলে সারাজীবন আমাকে বসিয়ে খাওয়াবে তুমি! কিন্তু একটা নুলো মেয়েকে সারাজীবন বসিয়ে খাইয়ে কি আর প্রায়শ্চিত্ত হবে কানুদা? প্রায়শ্চিত্তের আরও অন্য পথ আছে।’’
বলেছিল, ‘‘হ্যাঁ, পাপ তোমরা করেছ কানুদা, মহাপাপ! ভগবান জানেন কে তোমায় কুমতি দিয়ে এই পাপের পথে টেনে এনেছে। এ পথ ছাড়ো কানুদা! দেশকে ধ্বংস করার বুদ্ধি ছেড়ে, তাকে গড়বার ব্রত নাও। যদি প্রায়শ্চিত্ত চাও তো বাকি জীবনটা সেই ব্রত নিয়েই থাকো। গ্রামে গ্রামে স্কুল খোলো, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করো, গরিব দুঃখী চাষিদের বোঝাও কেমন করে বাঁচতে হয়।’’
এত কথা কোথায় শিখেছিল ফুলি?
সেই সামান্য লেখাপড়া জানা ফুলি!
সেকথাও জেনেছিল কানু, ফুলিই বলেছিল। মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর ফুলি নিতান্ত নি:সহায় হয়ে চলে এসেছিল কলকাতায় দূর সম্পর্কের এক পিসির বাড়িতে। সেইখানেই তার শিক্ষা। পিসেমশাই ছিলেন মহাত্মাজির চেলা, গোঁড়া অহিংস। নিজের হাতে চরকা কেটে নিজের কাপড় জামার প্রয়োজন মেটাতেন তিনি। পিসিমা পারতেন না বলে বেজায় দুঃখ বোধ করতেন।
ফুলি গিয়ে তাঁর শিষ্য হল।
চরকা কেটে নিজের শাড়ি ফুলিও তৈরি করেছে, তৈরি করে দিয়েছে পিসিমাকে, পিসিমার ছেলেমেয়েদেরকে।
ভারি ভালবাসতেন পিসেমশাই ফুলিকে।
নিজে পরিশ্রম করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, তারপর সঙ্গে করে করে নিয়ে গেছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে। গ্রামে গ্রামে, হাটে, মাঠে, ঘাটে। দুঃস্থ দরিদ্রের সেবা করাই ছিল পিসেমশাইয়ের জীবনের লক্ষ্য।
দু-বছর হল মারা গেছেন পিসেমশাই, কিন্তু ফুলি তার শিক্ষাভ্রষ্ট হয়নি। এই তো এখানেও যে এসেছিল, সেতো এই দুটো গ্রাম ছাড়িয়ে দূরের গ্রামে মড়ক লেগেছে বলে কলেরার ইনজেকশন দিতে। গাড়িতে তার আরও সঙ্গী ছিল। ছিল তার পিসতুতো ছোটোভাই। সেই কথা বলতে গিয়ে উথলে কেঁদে উঠেছিল ফুলি, আর সেই আবেগে কপালের ক্ষতের মুখ থেকে রক্ত ছুটে ব্যাণ্ডেজের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল।
চিৎকার করে উঠেছিল কানু। ছুটে এসেছিল ডাক্তার, এরকম দুর্বল রোগীকে কথা বলানোর জন্যে কানুকে তিরস্কার করেছিল।
তবুও কথা বলেছিল ফুলি—পরে ডাক্তার চলে গেলে। বলেছিল, ‘‘বুঝতে পারছ তো কানুদা, আপনার লোক শুধু শুধু এরকম বেঘোরে মারা পড়লে প্রাণে কীরকম লাগে? নিজের দিয়েও তো বুঝতে পারছ? এখনও না পারো আমি মরে গেলে নিশ্চয় পারবে—’’
‘‘কক্ষনো তোকে মরতে দেব না।’’ বলে উঠেছিল বোকা অবুঝ সেই ছেলেটা। কিন্তু তার চাইতে বয়সে ছোটো হয়েও কী ধীরস্থির সেই মেয়েটা! চিরকালই ধীরস্থির বুদ্ধিমতী। এই ভয়ংকর অপঘাত মৃত্যুর কবলে পড়েও সেতার স্থিরতা হারায়নি। স্থিরভাবে একটু হেসে বলেছিল, ‘‘মরতে দেব না বললেই কি আটকাতে পারবে কানুদা? ঘরে আগুন লাগালে ঘর পুড়বেই। যাক আমার মরার জন্যে বলছি না, বলছি আরও পাঁচজনের কথা ভেবে। এই গাড়ি উলটে কত লোক মারা গেল, কতলোক কানা, খোঁড়া, বোবা, কালা হয়ে গেল, ভাবো দিকি? কিন্তু সকলেরই তো আপনার লোক আছে? তাদের কষ্টের কথা কখনো ভেবেছ তোমরা?’’
শিউরে স্তব্ধ হয়ে গেল কানু।
সত্যিই বটে। তেমন করে তো কই কোনোদিন ভাবেনি! বিদেশি সরকারের সম্পত্তি নষ্ট করছি, তার আর্থিক ক্ষতি করছি, আর ‘দেশের কাজে’ টাকা তুলছি, এই আনন্দটুকু ছিল। তার বাইরে আর কোনো চিন্তা করেনি।
ফুলি যেন ওর মন বুঝেই বলল, ‘‘কোম্পানি তোমাদের অনেক ক্ষতি করেছে, তাই তোমরা কোম্পানির ক্ষতি করতে চেয়েছ, কেমন? কিন্তু বল তো কানুদা, এতে আর কোম্পানির কতটুকু ক্ষতি হবে? না হয় কিছু টাকার লোকসান। অথচ ভেবে দেখো কী ক্ষতি তাদের হয়ে গেল—যাদের মা গেল, বাপ গেল, স্বামী গেল, স্ত্রী গেল, গেল ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, বন্ধু, আত্মীয়! পৃথিবীর সমস্ত টাকা এনে তাদের কাছে ঢেলে দিলেও কি তাদের সেক্ষতিপূরণ হবে?’’
বলতে বলতে কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল ফুলি, তেড়ে বিছানায় উঠে বসল। আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘‘প্রতিজ্ঞা করো কানুদা, আমার সামনে প্রতিজ্ঞা করো আর কখনো এমন কাজ করবে না! বলো দেশের ভালো করতে গিয়ে তার সর্বনাশ ডেকে আনবে না? বলো বলো—’’
বলতে বলতে গড়িয়ে শুয়ে পড়ল ফুলি, শুয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ল।
কানু যখন চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘‘প্রতিজ্ঞা করছি ফুলি, আর কখনো এমন কাজ করব না, আর কখনো এই ভুল পথে চলব না’’, তখন তার এক বর্ণও ফুলির কানে গেল না।
কিন্তু স্বর্গ থেকে কি দেখতে পায় না মানুষ?
ঘর আবছা আবছা অন্ধকার হয়ে এসেছে। চাকর এস ঘরে ঢুকল।
একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘বাবু ‘সদরহাট’ না কোথা থেকে যেন ‘দুজন বাবু এসেছে।’’
নতুন চাকর, এদের জানাশোনা কাউকেই বিশেষ চেনে না।
সদরহাট!
মিত্তির সাহেব অতীত স্মৃতির অথই সমুদ্র থেকে ভেসে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘‘সদরহাট থেকে? নাম বলেছে কিছু?’’
‘‘আজ্ঞে না। শুধু বলল ‘শিবনাথ সিঁতি ইস্কুল’ না কোথা থেকে যেন আসছে।’’
‘শিবনাথ সিঁতি ইস্কুল’!
মনে মনে একটু হাসলেন মিত্তির সাহেব। এ ব্যাটার এইরকমই উচ্চারণের বাহার! বললেন, ‘‘বুঝেছি। দেখ বলগে যা—বাবুর আজ শরীরটা তেমন ভালো নেই, আজ আপনারা বিশ্রাম করুন, খাওয়া দাওয়া করুন, কাল সকালে কথাবার্তা যা হবার হবে।’’
‘‘আচ্ছা আজ্ঞে।’’
‘শিবনাথ স্মৃতি বিদ্যাশ্রম’!
শিবনাথ মাস্টারের কল্পনার রূপে গড়া। মানুষ যায়, বেঁচে থাকে তার কল্পনা, পরিকল্পনা, তার তপস্যা আর সাধনা।
বেঁচে থাকে, যদি তার সাধনার যথার্থ উত্তরাধিকারী কোথাও থাকে।
‘‘আর দাঁড়া শোন—’’ চাকরটাকে আর একবার থামালেন মিত্তির সাহেব, ‘‘তোদের মাকে বলে দিস বাবু দু-জন এখানে খাবে।’’
‘‘সেআর বলতে হবে না বাবু, দেখুন গে এতক্ষণে বোধ হয় চা জলখাবার চলে গেছে।’’ বলে বেজার মুখে চলে যায় চাকরটা।
মিত্তির সাহেব আর একবার হাসেন।
আবার একটু ক্ষুণ্ণও হন। হতভাগা এমন আচমকা এসে ডাকল।
এতক্ষণ যেন অপরের লেখা একখানা উপন্যাস পড়ছিলেন মিত্তির সাহেব। এই আচমকা বাধায় সেকাহিনির খেই হারিয়ে গেল। জমাট সুরটা আর জমবে না।
এখন খন্ড খন্ড করে কিছু মনে পড়তে পারে, স্পষ্ট মনে পড়বে না, কাহিনির নায়ক ‘কানু’ বলে সেই ছেলেটা কেমন করে বিপ্লবীদলের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে শুরু করল নতুন জীবনের সাধনা।
তারপর দেশের ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেল, গেল কত দুর্দিন, দুঃসময়। যুদ্ধ এল, মহামারি এল, বন্যা এল, এল রক্তক্ষয়ের নেশা। দেশ ভাগ হল, ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি মারল, ভুল পথ আর সত্যপথ একাকার হয়ে দিশেহারা করে তুলল জাতিকে। তবু কানু তার সেই একদিনের প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হল না। সেদিন থেকে ভাঙার কাজ ছেড়ে গড়ার কাজকে নিয়েছে জীবনের ব্রত করে। আগে নিজের ভাঙাচোরা জীবনটাকে গড়েছে, তারপর জীবনের লক্ষ্য আর আদর্শকে।
তিলে তিলে ধীরে ধীরে কত প্রতিষ্ঠানই গড়ে তুলল কানু। ছেলেদের স্কুল, মেয়েস্কুল, হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম, আরও কত কী?
আর তার জীবিকা?
সেও তো গড়ার কাজ।
রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার মিত্তির সাহেবের কত নাম ডাক, কত প্রশংসা!
এখন তো দেশ স্বাধীন হয়েছে।
দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কী বিরাট বিরাট কল্পনা, কী বিপুল অর্থব্যয়, কত কারখানা, কত বাঁধ, কত বিদ্যুৎ শক্তির কেন্দ্র, কত বন কেটে নগর তৈরি! এর বহুবিধ কাজের সঙ্গেই যুক্ত আছেন মিত্তির সাহেব। কর্মের তপস্যার পথে এগিয়ে চলেছেন জীবনের পরিণতিতে।
আচ্ছা, সেই দাশু মিত্তির আর নানু মিত্তির?
তারা কোথায় গেল?
তারা?
দাশু মিত্তির রোগে ভুগে ভুগে বয়েস না হতেই বুড়ো হয়ে গিয়ে চলে গিয়েছিল কাশীতে রাসমণির কাছে। তা রাসমণিও তো সেবার মারা গেল, যেবার কাশীতে খুব ‘বেরিবেরি’ হল। দাশু মিত্তির এ দোর ও দোর ঘুরে ঘুরে না খেয়ে কঙ্কালসার হয়ে অবশেষে চলে এসেছিল কলকাতায়, এসেছিল নাকি ছেলের সন্ধানে। তা কোথায় বা ছেলে আর কোথায় বা তার সন্ধান! পরে নানু মিত্তিরের মুখেই শোনা—এই রাস্তার আনাচে কানাচেই নাকি কতদিন ঘুরে বেরিয়েছে দাশু মিত্তির কিন্তু কেউ কাউকে চেনেনি।
শেষপর্যন্ত অবশ্য মারা গিয়েছিল দেশের ভিটের সদরহাটে ফিরে গিয়ে।
আর নানু মিত্তির?
সেতো এখন রাজার হালে বাস করছে কানু মিত্তিরের বাড়িতেই। দুধের সরটি, মাছের মুড়োটি, দইটি, সন্দেশটি, মিঠেপান, অম্বুরি তামাক, এসব না হলে চলে না তাঁর! বাড়িতে যে কেউ বেড়াতে আসে, তার কাছেই গল্প করেন নানু মিত্তির,—‘‘এসব ছাড়তে পারিনে বাপু, চিরকেলে অভ্যাস! আর ছাড়বই বা কেন? কানু আমার রাজাছেলে, সোনার চাঁদ ছেলে, বুড়োকাকাকে কি আর অযত্ন করতে পারে?’’ অবশ্য কানুর ছেলেদের কাছে জমজমাটি গল্প ফাঁদেন তিনি, ‘‘তোদের বাপ যে আজ এমন মান্যগণ্য, এমন একটা মানুষের মতো মানুষ হয়েছে, সেকি অমনি অমনি? হয় না বাপু অমনি হয় না! গোড়ার জীবনে সুশিক্ষা চাই! সেই সুশিক্ষাটি কে দিয়েছিল ওকে? এই আমি! বুঝলে ভায়ারা এই নানু মিত্তির! ছেলে শিক্ষা দেওয়া কাকে বলে সেকথা এই নানু মিত্তির ভালোরকম জানে। আর তোরা? তোরা মানুষ হচ্ছিস যেন এক একটি আদরের দুলাল, এক একটি রাজপুত্তুর! হুঃ! এতে কি আর মানুষ হবি? কচু হবি। এক একটি গোবরগণেশ হবি।’’
ছেলেরা রাগ করে না, হাসে।
হাসে আর বলে, ‘‘বাবাকে তো আপনি রাজাই বলেন ছোটোদাদু, তবে আমরা রাজপুত্তুর হব না কেন?’’
নানু মিত্তির বলেন, ‘‘তর্ক কোরো না বাবু, তর্ক কোরো না! তর্ক আমার সয় না’’ বলেই রাগের মাথায় যা তাঁর সয় তাই করে ফেলেন। টপাটপ গোটা চারেক কড়াপাকের সন্দেশ খেয়ে ফেলেন। ঘরে সর্বদা মজুত থাকে কি না। রাখতেই হয় মজুত, নইলে নাকি ওঁর পিত্তি পড়ে।
ঘরে আলো জ্বালা হয়নি।
বারান্দার আলোয় দরজার কাছে দুটো ছোটো ছোটো ছায়া পড়ল।
‘‘কে? কে ওখানে?’’ জিজ্ঞাসা করেন মিত্তির সাহেব।
‘‘আমরা বাবা!’’ আস্তে আস্তে এগিয়ে এল ছায়া দুটি। ছোটোছেলে আর মেয়ে। একটি মাত্রই মেয়ে।
‘‘তোমাদের এখুনি বেড়িয়ে ফেরা হয়ে গেল?’’
‘‘বেড়িয়ে? না তো! আমরা তো আজ খেলতে যাইনি।’’
‘‘খেলতে যাওনি? কেন?’’
‘‘বা: আজ কী ঝড় হল!’’
‘‘ওঃ তাও বটে! ঝড় হলে তোমরা আর বাড়ি থেকে বেরোও না, তাই না?’’
মেয়েটা হেসে উঠল, ‘‘আহা ঝড় হলে বুঝি বেরোনো যায়?’’
‘‘যায় না! তা বটে! আমাদের ছেলেবেলায় কিন্তু যেত। ঝড়ের মুখে বেরিয়ে পড়াই তো মজা!’’
‘‘বারে বেশ তো! মা তাহলে আমাদের আস্ত রাখবে বুঝি?…’’
‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ তাও তো সত্যি, তোমার মা যে আবার শহরের মেয়ে।’’
ছোটো ছেলেটা আরও এগিয়ে আসে, ‘‘একদিন আমরা ঝড় হলে রাস্তায় বেরোব বাবা!’’
‘‘রাস্তায়?’’ মিত্তির সাহেব হেসে ওঠেন, ‘‘শুধু ঝড়ে রাস্তায় বেরিয়ে কী করবি? আম কুড়োবার জনেই তো যাওয়া! এখানে আম কোথা?’’
‘‘তাহলে আমরা একদিন ঝড় হলে তোমার সেই দেশের বাড়িতে যাব বাবা!’’—ছেলেটা বলে বাবার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে।
মিত্তির সাহেব সস্নেহে তার মাথার একটা হাত রেখে বলেন, ‘‘শুধু আমার দেশ নয় বাবা, তোমাদেরও দেশ! যাব যাব নিয়ে যাব। দেশের বাড়িটা আগে তৈরি হোক।’’
ছেলেমেয়েরা একটু দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ‘‘তোমার কি মাথা ধরেছে বাবা?’’
‘‘কই না তো! কেন?’’
‘‘তবে যে অন্ধকারে রয়েছ?’’
‘‘ওঃ তাই? না মাথা ধরেনি, এমনি। তোমাদের ভালো লাগছে না বুঝি? আচ্ছা যাও এবার তোমাদের ঘরে যাও, খেলা করোগে।’’
‘‘খেলা! ওরে বাবা!’’ মেয়েটা ভয়ের ভান করে, ‘‘সন্ধেবেলা খেললে মা তো একেবারে বলে রসাতল! এখন শুধু পড়া আর পড়া।’’
মিত্তির সাহেব মৃদু হেসে বললে, ‘‘তোদের মা তোদের খুব বকে, না রে?’’
মেয়েটা গিন্নির মতো ভারিক্কি চালে বলে, ‘‘আহা তা বকলেই বা? মা হয়েছেন একটু বকবেন না? আমাদের তো মা ভালোবাসেন খু—বই, শুধু একটু রাগি বলেই তাই—’’
মেয়েটা চলে যেতেই হঠাৎ কেমন অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন মিত্তির সাহেব। কী অদ্ভুত সুন্দর কথাটা বলে গেল অতটুকু মেয়েটা! কই এরকম কথা তো তিনি কোনোদিন ভাবেননি ছেলেবেলায়!
যখন সেই রোগা দড়ির মতো মানুষটা অন্য কারও সঙ্গে ঝগড়া করে তিত-বিরক্ত হয়ে নিজের ছেলেকে বকুনি লাগাত, তখন তো কই সেছেলেটার একবারের জন্যেও মনে হত না ‘আহা তা বকলেই বা, মা হয়েছেন, একটু বকবেন না?’’ কোনোদিনই মনে হয়নি হয়তো তার মা তাকে ভালোবাসে, শুধু নিজেই সেউৎপীড়িত লাঞ্ছিত বলেই সমস্ত ঝালটা ঝাড়ে ছেলের ওপর। আর সেই মানুষটা? সেই পিসি? সেও কি তাহলে ভালোবাসত তার ভাইপোটাকে? ওরকম গালমন্দ করত একটু রাগি বলেই?
হায়! হায়! একথা তো একদিনের জন্যেও কখনো মনে হয়নি সেই ছেলেটার! যে ছেলেটা তার সারা ছেলেবেলাটা উৎকট এক দুরন্ত যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছে তাকে কেউ ভালোবাসে না ভেবে!
ছেলেটা কি তবে ভয়ংকর একটা নির্বোধ ছিল? তার নিজের নির্বুদ্ধিতাই আজীবন তাকে স্বস্তি দেয়নি, শান্তি দেয়নি?
আর এই মেয়েটা ছোট্ট এই মেয়েটা—এমন স্বচ্ছ বুদ্ধি পেল কোথায়? কেমন করে বুঝল মা-বাপ যদি তিরস্কার করে, তাতে তাদের ভালোবাসায় সন্দেহ করতে নেই!
না, আশ্চর্যেরই বা কী আছে?
মেয়েরা তো এমনিই স্থিরশান্ত বুদ্ধি হয়। ‘ফুলি’ বলে সেই ছোট্ট মেয়েটাও তো ঠিক এই কথাই বলত! সোনার প্রদীপের মতো উজ্জ্বল তার সেই মুখটা মনে পড়ল, যে মুখটা উঁচু করে বলত, ‘‘কী যে বলো কানুদা, ‘মা’ বলে কথা! মা ভালোবাসেন না—এও কি হয়?’’
সেই সোনার প্রদীপের স্থির শিখাই মিত্তির সাহেবের বিপর্যস্ত জীবনকে পথ দেখিয়েছে।
‘‘এ কী? এখন ঘর এমন অন্ধকার যে?……হরিসাধন! সন্ধেবেলা ঘরের আলোটা একটু জ্বেলে দিতে পারিসনি?’’ চাকরের উদ্দেশে একটা ধমক দিয়ে সুইচটা টিপেই মিসেস মিত্তির একটু থতোমতো খেয়ে গেলেন, ‘‘আরে তুমি শুয়ে আছ অন্ধকারে? কেন? শরীর ভালো নেই?’’
মিত্তির সাহেব ক্লান্ত গলায় বলেন, ‘‘শরীর ভালোই আছে, আলোটা কেমন ভালো লাগছে না সুধা, নেভানোই থাক।’’
মিসেস মিত্তির, দেখা যাচ্ছে—যাঁর নাম সুধা, তিনি আলোটা নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারেই একটা শোফায় বসে পড়ে বলেন, ‘‘তুমি এখনও বাড়ি আছ তা কি জানি? স্কুলের সেই ভদ্রলোক দুটি তো থাকতে চাইল না কিছুতে, বলল—কোথায় তাদের আত্মীয়ের বাড়ি আছে সেখানে থাকবে, কাল সকালে আসবে আবার।’’
‘‘আচ্ছা!’’
‘‘আর শোন, তুলসীপুর থেকে সেই বুড়ো ডাক্তারটি একটা চিঠি দিয়েছেন—’’
‘‘চিঠি?’’
‘‘হ্যাঁ, পোস্টকার্ডের চিঠি, পড়েই ফেলেছি। নতুন কিছু নয়, তুলসীপুর হাসপাতালের যে বিল্ডিংটা তুমি করে দিয়েছ তার নামটা তো এখনও সম্পূর্ণ সাব্যস্ত হয়নি, তাই উদবোধন করতে পারছেন না। সঠিক একটা নাম যদি—’’
‘‘আচ্ছা আজই জানাব।’’
‘‘ঠিক করেছ নাকি?’’
‘‘এইমাত্র করলাম।’’
‘‘কী?’’ সুধা একটু দুষ্টুহাসি হেসে বলে, ‘‘ফুলেশ্বরী দাতব্য চিকিৎসালয়?’’
‘‘না!’’ মিত্তির সাহেব স্থিরস্বরে বলেন, ‘‘কমলা সেবাভবন!’’
কমলা সেবাভবন!
অবাক হয়ে যায় সুধা, বলে, ‘‘কমলা সেবাভবন?’’ সুধা জানে না ‘কমলা’ কার নাম।
মিত্তির সাহেব জোর দিয়ে বলেন, ‘‘হ্যাঁ! হ্যাঁ, ওই নামই থাকবে। আজই লিখে দেব।’’
সুধা জানে না, কিন্তু মিত্তির সাহেব তো ভুলে যাননি সেই রোগা দড়ির মতো মানুষটার ওই নামই ছিল।