দূরের বাঁশি
এ স্টেশনে সব ট্রেন থামে না।
ছোট্ট স্টেশন, ছোটো প্ল্যাটফর্ম, ওয়েটিং রুম মানে একটা করোগেটের শেড-এর নীচে সিমেন্টে গাঁথা টানা বেঞ্চের মতো বেদি। তবে সেখানে বসা শক্ত। আগের যাত্রীরা এত নোংরা করে রেখেছে দিনে দিনে মাসে মাসে, বছরে বছরে, সেআর কহতব্য নয়।
খাবার খেয়ে যাওয়া এঁটো শালপাতা, রসগোল্লার রস এবং ভাঙা ভাঁড়, চিনেবাদামের খোলার গাদা, পানের পিক এবং ছোটো বাচ্চাদের ‘ছোটো বড়ো’ দু-রকমের ব্যাপারের চিহ্ন ইত্যাদি নিয়ে বেশ একখানা ‘নরক কুন্ড’ ‘নরক কুন্ড’ ভাব। …রেলের জমাদারদের অবশ্য ডিউটি আছে প্রতিদিন ওই ওয়েটিং রুমটাকে সাফ করা, কিন্তু পৃথিবীতে সবাই যদি নিজের নিজের ডিউটি পালন করত, তাহলে তো স্বর্গই হয়ে যেত এ পৃথিবীটা।
বদু অবশ্য এত কথা জানে না। সেশুধু তাদের রেল কোয়ার্টার্সের বাড়ির একফালি বারান্দা থেকে পৃথিবীটাকে দেখে। সেই পৃথিবীটা হচ্ছে নীচের ওই স্টেশন, তার প্ল্যাটফর্ম দু-খানা কাঠের খুঁটিতে ঢিলে হয়ে ঝুলে থাকা ফলকটায় বাংলা হিন্দি দু-ভাষায় লেখা ‘জীবনপুর’- যার ‘ব’টা রোদে জলে কেমন করে যেন মুছে গেছে, হঠাৎ মনে হয় ‘জী… ন পুর’। ওই খুঁটিটার কাছে, স্টেশনের তারের বেড়ার গায়ে লতিয়ে থাকা ফুলে ছাওয়া ‘কাগজ ফুল’ গাছ। সেগাছের হালকা হালকা পাতার মতো ফুলগুলো যখন ফুটে থাকে কী সুন্দর দেখায়! কিন্তু একটা ঝড়ের ঝাপটা এলেই গাছ নির্মূল হয়ে সব ফুল ধুলোয় গড়াগড়ি খায়, বাতাসে উড়ে বেড়ায়। কোণে কোণে জমা হয়ে হয়ে পড়ে থাকে, হঠাৎ মনে হয় যেন পিঁয়াজের খোসা।
মাঝে মাঝে ঝড়ে উড়ে ওই শুকনো ফুলের পাপড়িগুলো বারান্দায় এসেও পড়ে, আর বদুর মা রেগে বলে, ‘এই আবার হল জঞ্জাল! কী জ্বালা, কী জ্বালা!’
বদু অবাক হয়ে ভাবে, ফুলও জঞ্জাল হয়ে যায়!
বদু তখন অন্য আর কেটা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে। দেখতে দেখতে যেন অবাক হয়ে যায়। এই পৃথিবীটা কিন্তু আসলে আকাশ। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বদু অবাক হয়ে ভাবে, একই আকাশের কতরকম রূপ রে বাবা! ভোরে দুপুরে বিকেলে সন্ধেয় রাত্রে। আর মেঘের ব্যাপারে তো কথাই নেই। পড়ন্ত বিকেলে, যখন আকাশের দিকে তাকানো যায়, তখন বদু ওই মেঘগুলোকে হাঁ করে দেখে। মিনিটে মিনিটে কী বদল-ই বদলায় ওরা। এই দেখো যেন বড়ো বড়ো পাহাড়ের শ্রেণি, তখুনি দেখো যেন হাতি, ঘোড়া, উট, কখনো মানুষের মুখ, কখনো দশমুন্ডু রাবণরাজা, কখনো ঘরবাড়ি, মন্দির, গাছ, নৌকো।
কোনো কোনোদিন মনে হয় ওই মজার গড়নের ছবিগুলোকে চটপট শেলেটে এঁকে নেবে, কিন্তু সেআর হয় না. দুটো টান দিতে না দিতেই সেছবি তক্ষুনি বদলে আছে। প্রতিক্ষণ কে এসব আঁকে, কে মোছে, কে ফের আবার অন্য ছবি আঁকে? ভাবাই যায় না।
এই হাঁ করে আকাশ দেখার জন্যে মা বকে, বাবা হাসে, বাড়ির চাকরটা পর্যন্ত ব্যঙ্গ করে। কিন্তু বদুর তাতে কিছু এসে যায় না! বদু জানে বড়োরা চিরদিনই ছোটোদের নিয়ে হাসাহাসি করে, আর একটু এদিক ওদিক হলেই বকুনি লাগায়। কেন যে ওনাদের এমন দুর্মতি! বদু কতদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ‘ভগবান, তুমি ওঁদের বুদ্ধি ভালো করে দাও।’
কিন্তু ভগবান যে, সেপ্রার্থনা শুনতে পান তা মনে হয় না। আকাশটা অনেক দূর বলেই কি তাঁর কানে পৌঁছোয় না?
যদি পৌঁছোত, নির্ঘাত এসবের একটা বিহিত করতেন তিনি।
তা নয়, উলটোই ঘটে!
মা দেখতে পেলেই বলে ওঠে, ‘আবার আকাশপানে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস?। না:! এ ছেলেকে নিয়ে কী করব গো?’
বদু ভেবে পায় না, ওতে মার এত অস্বস্তি কেন? আকাশটা কী খারাপ জায়গা? তাই তাকালে দোষ?
আসলে ছোটোরা যা করবে, তাতেই ওঁদের অস্বস্তি। বদু ঝড়ের দিনে একবার একটু খালি গা করে, অমনি মা-বাবা তেড়ে আসবেন। ‘খালি গা কেন? খালি গা কেন?’— বলে। আর এইটুকু অসাবধানে থেকে কী কী অসুখ করতে পারে, আর কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেই অসুখের জের, তাই আওড়ান। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে বদুর।
গায়ে ঝোড়ো হাওয়া লাগলেই তো সর্দি-কাশি অনিবার্য, তার থেকে জ্বর হওয়ায়ও বিচিত্র নয়; আর জ্বর হলেই যে স্কুল কামাই, এ কথাটা কেই বা না জানে? এবং স্কুল কামাই হলেই যে পড়ায় পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, আর পড়ায় পিছোলেই পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ, এ তো আর কাউকে বলে দিতে হয় না। ফেল হতেই বা কতক্ষণ?
তবে? ওই ঝোড়ো হাওয়াটি থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছোতে হয় বোকা ছেলেদের।
বদু ভেবে পায় না ওঁরা কি কখনো ছোটো ছিলেন না? ওঁদের ইচ্ছে করত না যখন ঝড় ওঠে, গাছপালার দাপাদাপি শুরু হয়ে যায়, তখন খালি গায়ে সেই ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে নিজেও ‘গাছপালা’ হয়ে যেতে!
বদু তো তাই করে।
বদু ‘গাছপালা’ হয়ে গিয়ে মাথা দোলায়, হাত পা নাড়ে, ডিগবাজি খায়, আর মুখে শব্দ করে শোঁশোঁ, গোঁ গোঁ, গুম গুম।
মার হিসেবে, এই খেলাটা নাকি পাগুলে খেলা। আশ্চর্য। মানুষেরা মানুষ হয়ে জন্মেছে বলেই তাকে সব সময় মানুষ হয়ে থাকতে হবে— এর কোনো মানে আছে?
এক একবার গাছপালা হতে নেই? হতে নেই রেলগাড়ি? নৌকো? রিকশা? গোরু? কুকুর? বেড়াল? হাতি? ইচ্ছে করলেই তো মনে মনে হয়ে যাওয়া যায় এগুলো। কিন্তু হবার জো নেই। মা টের পেলেই অমনি বকুনি জুড়ে দেবে। ‘আবার ওই বিচ্ছিরি পাগুলে খেলা? মানুষের ঘরের ছেলের বেড়াল ডাক, কুকুর ডাক, রেলের বাঁশির ডাক, আর ঘরদোর বিছানা মাদুর তছনচ করা। এ ছেলেকে নিয়ে কী করব গো!’
এই কথাটা মার মুদ্রা দোষ।
বদু যদি বলতে যায়, সেএখন রিকশা গাড়ি হয়েছে। মা বলে, ‘এ ছেলেকে নিয়ে কী করব গো। চল তবে তোকে রিকশা স্ট্যাণ্ডে রেখে আসি।’
বদুর ভাগ্যি শুধু একটা খেলা মা ঠিক বুঝতে পারে না। আর সেই খেলাটাই বদুর সব চেয়ে প্রিয়।
রেলের বাঁশি শুনলেই উতলা বদু চটপট ট্রেন ধরতে ছোটে। বদুর গায়ে তখন ভালো জামা চড়ে আর হাতে ঝোলে সুটকেস, বেডিং, জলের ফ্লাস্ক।
সুটকেসটা বদুর বইয়ের বাক্স, জলের ফ্লাস্ক মানে ওয়াটার বটলটাও তাই, শুধু বেডিংটা বদুকে গুছিয়ে বেঁধে নিতে হয়। তবে অসুবিধে কিছু নেই। একটা বালশিকে তোয়ালেয় মুড়ে, নিজের স্কুল ড্রেসের বেল্টটাকে তাতে পেঁচিয়ে নিয়ে, ঘাড়ে মাথায় আর হাতে ঝুলিয়ে লাফিয়ে ট্রেনে চেপে পড়া, ব্যস!
তারপর বদুর চোখের সামনে দিয়ে কত কী জিনিস সরে সরে চলে যেতে থাকে। গাছপালা, পুকুর, মাঠ, মানুষ, গোরু, ধানখেত, ঘন আমবাগান।
দেখতে বাধা কি? চোখ বুজে থাকলে কী না-দেখা যায়?
তারপর স্টেশনে স্টেশনে গাড়ি থামে, তা ভেণ্ডারকে ডেকে চা কেনে বদু, কেনে লাড্ডু মেঠাই পেয়ারা।
তারপর আবার ভাতওয়ালাদের ডাকে, অর্ডার দেয়। ট্রে নিয়ে খেতে বসে যায়। তাতে পয়সা লাগছে না কিছু। কারণ রেলগাড়িটা মায়ের ঘরের জোড়া খাটটা।
এই জীবনপুরে সব গাড়ি থামে না বটে, কিন্তু বাঁশিটা বাজে। হয়তো ঠিক আগের স্টেশনটায় বাজে, নয়তো পরের স্টেশনটায়। শুনতে পেলেই ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে আসে বদু। রেলিঙে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। জানে এক্ষুনি ওই সামনে উঁচুতে লাইনের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি চলে যাবে খসখস করতে করতে।
সময়গুলো মুখস্থ হয়ে গেছে বদুর।
আর সকাল-সন্ধে দু-বার যখন গাড়ি এই জীবনপুরেই থেমে পড়ে দেড় দু-মিনিটের জন্যে, তখন?
তখন যেন বদু দিশেহারা।
বদুর মন-প্রাণ-আত্মা-চৈতন্য সব কিছুই ওই ‘কু—উ—উ’ ধ্বনির মধ্যে মিশে যায়, আহ্লাদে চোখে জল আসে বদুর। আর তখনই হঠাৎ মনে হয় তার— সেযেন এখানের কেউ নয়, অনেক অনেক দূরে অন্য কোনোখানে তার সত্যিকার নিজের বাড়ি আছে, আসল বাড়ি। যদিও সেই বাড়ি আর সেই মা বাবা ভাইবোনের চেহারাগুলো যথেষ্ট মনে করতে পারে না, ভাবতে গেলে ছায়া ছায়া লাগে। তবু ভয়ানক একটা টান অনুভব করে বদু সেই অজানা অচেনা নিজের বাড়ির জন্যে।
তা বলে এই মা-বাবাকে কি ভালোবাসে না বদু? খুবই ভালোবাসে। দিদি বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে বলে বদুর তো কান্না পেয়ে যায় কত সময়। তবু বদুর ওই ‘কু খসখস’ শুনলেই মনটা হারিয়ে যায়। অন্য বাড়ি আর অন্য মা-বাবার জন্যে মন কেমন করে।
বদু শত শত মাইল দূরে চলে যায়!
সেখানে যে কী আছে আর কী না আছে। সবুজ বন, উঁচু পাহাড়, গভীর সমুদ্র, ঝিরঝিরে নদী, ধু-ধু মরুভূমি।
বদু সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
বদুর সেটাই নিজের বাড়ি নিজের দেশ।
কোনো কোনোদিন বদু কাগজ পেনসিল নিয়ে এঁকে দেখতে চেষ্টা করে কেমন হতে পারে বদুর সেই আবছা স্মৃতির বাড়িটা। হয়তো মস্তবড়ো একটা তিনতলা বাড়ি এঁকে বসে, রাজপ্রাসাদের মতো মোটা মোটা থাম বসানো, তার জানলা দরজায় কারুকার্য, দরজায় ইয়া গোঁফ লাগানো দারোয়ান, তার কাছে দাঁড়িয়ে বদুর মতো জামাপ্যান্ট পরা একটা ছেলে।
তক্ষুনি মুছে ফেলে।
এ মা, এ বাড়িটা যে তার একটা গল্পের বইয়ের ছবির মতো। হুবহু!
আবার আঁকতে বসে।
মেটে কুঁড়ে বাড়ি, মাথায় খড় ছাওয়া, পেছনের আকাশে চাঁদ। এদিকে ওদিকে গাছপালা, আঁকতে আঁকতেই হাত থেমে যায়— দুর! ঠিক এইরকম একটা বাড়ির ছবি তো ছোটো মাসির ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে। ছোটোমাসি ছুঁচের কাজ করে করে বানিয়েছে।… আবার কোনো বাড়ির ছবিটা ঠিক তাদের এই রেল কোয়ার্টার্সের মতোই দেখতে হয়ে যায়। এসব কী করে বদুর আগের জন্মের ব্যাপার হবে? অথচ যা কখনো দেখেনি, তেমনি ছবি আঁকবে কী করে?
না দেখা জিনিস কি আঁকা যায়?
অথচ একটা না দেখা জগৎ বদুকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। বদু তাই যেন এই জীবনপুর রেলকলোনিতে থেকেও নেই।
বদু খাচ্ছে, কী যেন ভাবছে। বদু লেখাপড়া করতে করতে কখন যেন আকাশে চোখ তুলে আকাশ ছাড়িয়ে কোথায় যেন চলে গেছে—বদুর হাতের থেকে পেনসিল পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর খাতা বই বাতাসে ফরফরিয়ে উড়ছে।
সাধে আর বদুর মা বলে, ‘এ ছেলেকে নিয়ে আমি কী করি গো।’
রেল কোয়ার্টার্সের বাড়িগুলো সব একরকম দেখতে। গায়ে গায়ে লাগা, সারি সারি। ওই একই রকমের বাড়িগুলোকে বদুর মনে হয় যেন দেশলাই বাক্সের প্যাকেট।
বদুর একথা শুনে নাণ্টু হাসে, বলে, ‘তার চেয়ে এও বলতে পারিস— জুতোর দোকানের র্যাকে সাজানো জুতোর বাক্স!’
নাণ্টু আরও বলে, ‘আমার কিন্তু তোর কথা শুনে এও মনে হচ্ছে, ইটের পাঁজার ইট যেন। সত্যি। সব বাড়িই একরকম কেমন যেন বিচ্ছিরি লাগে। মামার বাড়ির ওখানে সব বাড়ি একরকম নয়। কত বাড়ি কত রকমমের— ছোটো বড়ো মেজো সেজো। কত সুন্দর সুন্দর। আলাদ আলাদা রং, আলাদা আলাদা ডিজাইন।’
নাণ্টুর মামার বাড়ি কলকাতায়— বালিগঞ্জেরর দিকে। সেখানে তো এরকম না। নাণ্টুরা স্কুলের ছুটি হলেই মামার বাড়ি চলে যায়। বদু এ ব্যাপারে বড়ো দুঃখী। বদুর মামার বাড়ি এত দূরে যে যাওয়াই হয় না।
বদুর একটি মাত্র মামা। তিনি থাকেন ত্রিবাঙ্কুর। বদুদের রেলগাড়ির ভাড়া লাগে না, বাবা ‘পাস’ পান।
হলে কী হবে? পাসই আছে। ছুটির বড়োই অভাব। বদুর বাবা রাজশংকরবাবু হেসে হেসে বলেন— ‘এ যেন আমার সেই কথামালার গল্পের শৃগাল ও সারসের ভোজ খাওয়ার গল্পের মতো। থালায় ঝোল ঢেলে সারসকে নেমন্তন্ন। রেলের পাস দেবে, ছুটি দেবে না।’
বদুর খুব দুঃখ হয় বাবার দুঃখে।
বদুর মা কিন্তু রেগে বলেন, ‘আরে দুঃখু করতে হবে না। শুনিস কেন ওঁর কথা? এত লোক ছুটি পায়, আর উনিই ছুটি পান না! আসলে নিজেরই কাজ কাজ বাতিক। আর বাক্স বিছানা বেঁধে কোথায়ও যাবার নামে আতঙ্ক।’
বদু অবাক হয়ে যায়।
মানুষের যাতে সবচেয়ে আনন্দ হওয়া উচিত তাতেই বাবার আতঙ্ক। কী অদ্ভুত!
বাবা যদি এরকম উলটো পালটা না হতেন, তাহলে বদুকে আর মিছিমিছি বাক্স বিছানা বেঁধে রেলগাড়ি চড়া খেলা খেলেই সাধ মেটাতে হত না। সত্যি সত্যিই বাক্স-টাক্স নিয়ে চড়ে বসত ওই রেলগাড়ির কামরার মধ্যে। যেগুলো রোজ চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় কু—উ খস খস শব্দ করে লাইন কাঁপিয়ে, মাটি কাঁপিয়ে আর বদুর প্রাণ কাঁপিয়ে!
রেল কোয়ার্টার্সের বাড়িগুলো যেমন পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি, তেমনি মানুষজনও অনেক। বদুর বয়সি ছেলেমেয়ের অভাব নেই, বলতে গেলে কিলবিল করছে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বও আছে। যদিও—ভাবও যত ঝগড়াও তত।
তবু তারা একসঙ্গে খেলাধুলো করে, দল বেঁধে নদীর ধারে বেড়াতে যায়, সরস্বতী পুজোর সময় নিজেদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর ব্যবস্থা করে। আর অঞ্জলি হয়ে গেলে মনের সুখে টক কুল খেয়ে কুলের বীজগুলো ছুড়ে ছুড়ে রেললাইন পার করে ফেলে দেয়।
বদু কিন্তু এ দলে নেই।
বদুর একমাত্র বন্ধু নাণ্টু। বন্ধুদের বাড়ি থেকে দু-খানা বাড়ির পরে। বদুদের তেরো নম্বরের বাড়ি, নাণ্টুদের ষোলো।
যদিও নাণ্টুই বদুর একমাত্র বন্ধু, তবু নাণ্টু কিন্তু মোটেই বদুর স্বভাবের নয়। দু-জনে দু-রকম। কিন্তু কেমন করে যেন হয়েও গেছে বন্ধুত্ব। হয়েছে অবশ্য নাণ্টুরই গুণে, নাণ্টুই ছুটে ছুটে আসে। নাণ্টুই গল্পের বই পেলে বদুকে দিয়ে যায়। ছুটিতে পড়ার বই নিয়ে এসে বদুর সঙ্গে পড়ে। আর বছর মা যা দেন অম্লান বদনে খেয়ে নেয়। এবং আরও একটি কাজও করে নাণ্টু। বদুর মায়ের সঙ্গে দেদার গল্প করে। কত যে গল্প আছে ওর।
বদুর মা এতে খুশিও হন, দুঃখিতও হন। দুঃখ করে বলেন, ‘এই তো বাপু ছেলে। কেমন সহজ স্বাভাবিক। আর আমার ছেলেটি? যেন আকাশচোখো।’
তা বললে আর কী হবে, যার যা স্বভাব।
এই যে বদুর বাবার কুনো স্বভাব। রেল-অফিসে কাজ করছেন এতকাল, রেলগাড়ি চড়তে ইচ্ছে করে না। রেলচড়া ওই বদলির সময়। জীবনপুরে আসার আগে বদুর বাবা ছিলেন ‘নন্দিনী’ বলে একটা জায়গায়, জায়গাটার যে ওরকম নাম কেন কে জানে।
‘নন্দিনী’-র জন্যে এখনও মন কেমন করে বদুর। কী সুন্দর বাগান করেছিল বদুর মা সেবাড়িটায়। কত ফুল ফুটত। সেটা ছিল একতলা। এ বাড়িতে মাটি নেই। দোতলায় মাটি থাকবে কোথা থেকে?
তা ছাড়া বদুর মার আর ইচ্ছেও নেই। বলেন, না, আর ফুল ফলের গাছের শখ নেই। আবার কখন বদলি করে দেবে, চলে যেতে হবে সব ফেলে।
কথাটা বদু মানে, তার মনও কেমন করে। কিন্তু বদুর বাবার এই বদলি হওয়াটাই ভালো লাগে। বেশ নতুন দেশে যাওয়া, নতুন ঘরবাড়ি, আকাশ বাতাশ। হ্যাঁ, অন্য দেশের আকাশটাও নতুন লাগে বই কী।
নাণ্টুও বলে, ‘কলকাতার আকাশটা অন্যরকম, জানিস! যেন ছায়া, ছায়া, ভারী ভারী।’
বদু কখনো কলকাতা দেখেনি, বদুর বাবা শেষ যেবার কলকাতা গিয়েছিলেন, তখনও বদু জন্মায়নি। …বদু কেবলই সবাইয়ের মুখে কলকাতার গল্প শোনে। আর ভাবে জীবনে কি কোনোদিন বদু সেখানে যেতে পারবে? পেল না তো কখনো সারাজীবনে?
বদুর ‘সারাজীবন’ মানে যে মাত্র সাতটা আটটা বছর, সেখেয়াল হয় না বদুর।
বদু ভাবে তার আর কখনো কোথাও যাওয়া হবে না। অথচ নাণ্টু? প্রত্যেকবারের মতো এবারও ওদের মা গরমের ছুটি পড়তেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে গেল জীবনপুর থেকে। এবারে আর কলকাতায় মামার বাড়িতে নয়, মাসির বাড়ি জলপাইগুড়িতে। একেবারে অজানা দেশ।
উঃ, কী লাকি নাণ্টুটা! বদুর যেন নাণ্টুর সৌভাগ্যে নিশ্বাস পড়ে। যদিও নাণ্টু নিজেও ফেলে গেছে দেখা করে যাবার সময়।
আসলে আগে নাণ্টু বদুর মার কাছে বলেছিল, ‘বদুও আমাদের সঙ্গে চলুক না মাসিমা!’
বদুর মা অবশ্য এ কথাটাকে তেমন করে ধর্তব্য করেননি। যতই হোক পরের সঙ্গে আবার তার মাসির বাড়ি। তাই কাটিয়ে দিতে বলেছিলেন, ‘পাগল! ওই ছেলে যাবে তোমার মাসির বাড়ি? বলে নিজের বাড়িতেই খেতে নাইতে ভুলে যায়। তা ছাড়া যা লাজুক।’
বদু অবশ্য বলতে চেষ্টা করেছিল, ‘আহা নাণ্টু তো থাকবে।’
কিন্তু কথাটা দাঁড়াল না।
দাঁড়ায়ও না এসব কথা। বদুর বাবা শুনে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘ও নাণ্টু, এবার যে আমিই ঠিক করছি একটু কোথাও বেরোব।’
বদু খুব রেগে বলে উঠেছিল, ‘তোমার ছুটি আছে?’
বদুর বাবা হেসে হেসে বললেন, ‘ছুটির দরখাস্ত করব ভাবছি।’
নাণ্টু বলেছিল, ‘তাহলে তো ভালোই। ‘কোথায় যাবেন মেসোমশাই?’
মেসোমশাই কিছু বলার আগেই বদু বলে বসেছিল, কোথায় জানিস? জীবনপুর রেল কলোনির তেরো নম্বর কোয়ার্টার্সে।’
শুনে রাজশংকর হা হা করে হেসে উঠে বললেন, ‘দেখেছ নাণ্টু, তোমার বন্ধু কী সাংঘাতিক!’
নাণ্টু বলল, ‘এই ধ্যেৎ, বাবাকে ওইরকম বলতে আছে? দেখবি হয়তো তোরা অনেক সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যাবি।’
বদু অবশ্য এতে আশ্বাস পেল না।
নাণ্টু চলে যেতে বদুর মা বললেন, ‘হঠাৎ বলে বসলে আমরাও বেড়াতে যাবার ঠিক করছি। কবে ঠিকটা হল? ’
বদুর বাবা রাজশংকর মৃদু মৃদু হেসে বললেন, ‘আহা বুঝছ না কেন,নাণ্টুটা অত আহ্লাদ করে বলতে এল বদুও ওদের সঙ্গে চলুক, মুখের ওপর তো বলা যায় না তোর মাসির বাড়ি ও আবার কী যাবে বাপু, চেনা নেই, জানা নেই। তাই আর কী, বলে দিলাম কথাটা?’
বদুর তখন রাগে দুঃখে চোখে জল এসে গেছে। কিছু বলতে পারছে না। তবে বদুর মা বললেন, ‘যা হোক কিছু একটা বলে দেওয়াই বুঝি ভালো! নাণ্টুরা ফিরে এসে বলবে কী?’
‘আহা। সেকথা আবার ওর দু-মাস পরে মনে থাকবে নাকি? ছোটোছেলে!’
বদুর মা রেগে বলেন, ‘ছোটো ছেলেদের তুমি যা ভাব তা নয়, বুঝলে? খুব মনে থাকে ওদের। কিছু ভোলে না। ওদের ওরকম যা হোক কিছু বলে ভোলানোর চেষ্টা করতে নেই। বলেছ যখন তখন চলো এবার কোথাও। ছুটি নাও।’
রাজশংকর কিন্তু একথাও হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘ওরে বাবা, এখন কোম্পানির যা দারুণ কাজ। এখন কি ছুটি নিলে চলে?
বদু শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘আরে এই যে নাণ্টুর বাবা ছুটি নিলেন, কুট্টির মামা ছুটি নিয়ে দেশে যাচ্ছেন বাগানের আম খেতে।’
রাজশংকর বলে ওঠেন, ‘আরে বাবা, ‘আরে বাবা, ওইজন্যেই তো হয়েছে আরও জ্বালা। অফিসসুদ্ধ সবাই ছেলেমেয়ের স্কুলের ছুটি হলেই নিজেরাও ছুটির দরখাস্ত করে বসে। তারসঙ্গে যদি আমিও নাচি অফিসটা তাহলে চালাবে কে?’
ব্যস, এরপর আর কী বলবার আছে?
সত্যি, অফিসটা তো চলা দরকার। অফিস না চললে, রেলগাড়িই বা চলবে কী করে? নাণ্টু যাওয়ার দিন দেখা করতে এসে বলল, ‘কোথায় যাওয়া ঠিক হল রে তোদের?’
বদুর ভীষণ দুঃখ আর লজ্জা হচ্ছিল, তাই মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি না।’
কাজেই নাণ্টু নিশ্বাস ফেলে চলে গেল।
বদু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
এখন কোনো গাড়ি যাচ্ছে না।
খাঁ খাঁ করছে চারদিক। —রেললাইন দুটো মাটিতে শুয়ে আছে যেন একজোড়া মোটা সাপের মতো।—
দু-ঘণ্টা পরে গাড়ি আসবে, জীবনপুরে এক মিনিটের জন্যে থামবে, সেইসময় নাণ্টুরা হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে গিয়ে উঠবে।
বদুর আর এখন রেলগাড়ি চড়া খেলাটাও খেলতে ইচ্ছে করল না। দাঁড়িয়েই রইল চুপচাপ।
ওমা। হঠাৎ দেখে তাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা গাড়ি থামল।— কে এল রে বাবা! ঝুঁকে দেখল, একটা রোগা খটখটে বুড়ি, মাথার চুল বেটাছেলেদের মতো ছাঁটা। পরনে পাড় ছাড়া একটা কাপড়, আর গায়ে একটা চাদর জড়ানো।
এ বুড়ি আবার কে রে বাবা। বদু তো জীবনেও দেখেনি। বাড়ি ভুল করে বদুদের বাড়িতে নামল না তো। বাড়ি ভুলের মতো কোনো লক্ষণই দেখল না বদু। শুনতে পেল, বেশ একটা বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন হল, ‘দেখো তো রিকশাওলা, এটাই তেরো নম্বর বাড়ি কি না?’
রিকশাওলা কী বলল বদু শুনতে পেল না, বুড়ি নিজে হিঁচড়ে রিকশা থেকে একটা পুঁটলি নামিয়ে দিয়ে, রিকশাওয়ালাকে হুকুম করল, ‘এই প্যাঁটরাটা নিয়ে ভেতরে চল। দোতলায় উঠে যাবি।’
তারপরই বদু শুনতে পেল সেই বাজখাঁই গলা থেকে হাঁক উঠছে, ‘রেজো, কোথায় রে? বলি বাড়ি এমন নি:সাড় কেন?’
বদুর বাবাকে ‘রেজো’ বলে ডাকতে পারে এমন কে আছে জগতে? বদুর জানা নেই। বদুর তো দাদুও নেই ঠাকুমাও নেই।
বদু বারান্দা থেকে সরে এসে এদিকে উঁকি মারল।
কে এই বুড়ি!
বুড়ি যে কে তা অবশ্য তক্ষুনি জানা হয়ে গেল। বাবা তড়বড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলে উঠলেন, ‘আরে এ কী ব্যাপার। …পিসিমা। তুমি হঠাৎ? চিঠিপত্র-টত্র তো আসেনি।’
পিসিমা।
ওঃ, বাবার একজন পিসিমা কোথায় যেন আছেন জানত বদু। বাবা সেখানে মাসে মাসে মানিঅর্ডার করেন, আর মাঝে মাঝে চিঠি দেন।
কিন্তু ওই পিসিমার তো কোনো চিঠি আসে না কখনো। তা এখন আর ‘কে এই বুড়ি’ ভাবাটা ঠিক নয়, বদু মনে মনে লজ্জা পায়।
পিসিমা বলে ওঠেন, ‘চিঠি-পত্তর! ‘চিঠি আমি নিজে লিকতে জানি, তাই লিকে খবর দেব? নিজের লোকের বাড়ি আবার খবর দেওয়া কি র্যা রেজো! ইচ্ছে হল চলে এলাম! …বউমা, এই পুঁটুলিটা ভাঁড়ারে তোলো দিকিন। আর প্যাঁটরাটা ঘরে রাখাও! …চানের জায়গাটা কোথা দেখিয়ে দিবি চ রেজো। …ওমা ইটি তোর ছেলে বুঝি তো এতবড়োটি হয়েছে? ভালো ভালো। আমি সেই মুখে ভাতের সময় দেখেছি। …কিরে, বোকার মতন হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস, যে? পায়ে ধুলো থাকতে থাকতে পায়ের ধুলো নে। …কক্ষনো দেখিসনি তো চিনবি কী? তোর নাম তো বদু? ও নাম আমার রাখা, বুঝলি? তুই যখন তোর মা-র পেটে, তখন বদ্যিনাথ গিয়েছিলাম তো, তাই বলেছিলাম ছেলে হলে নাম রাখবি বদ্যিনাথ। ওই তার থেকেই বদু। এই যে আমার নাম হয়ে ছেলো নগেন্দ্র নন্দিনী। আর সবাই ডাকত কী বলে?—নগি।’
বুড়ির কথা শুনে খুব হাসি পেয়ে গেল বদুর, কিন্তু ভাবনা হল, এই বাড়িতেই থাকবেন নাকি উনি? কী জানি বাবা! কীরকম যেন দেখতে। বকের মতো লম্বা লম্বা পা, কী রোগা খটখটি!
আহা বদু তো এখন জানছে না, এই চুলছাঁটা থান পরা খটখটি বুড়িই বদুর জন্যে স্বর্গীয় একটি আশীর্বাদ নিয়ে আসবেন।
হ্যাঁ, স্বর্গীয়ই।
স্নান-টান সেরে নগেন্দ্রনন্দিনী একটা বড়ো পাথরের গেলাসের এক গেলাস চা, একটা প্রকান্ড পাথরের বাটিতে একবাটি বেলের শরবত, একখানা কাটা তরমুজ আর লিচু এই নিয়ে ‘ব্রেকফাস্ট’ করতে বসে বলে উঠলেন, ‘বলি রেজো, চিরটাকাল রেলের আপিসে চাকরি করলি, তা এ আক্কেল হল না, বুড়ি পিসিটাকে একবার পাস দিয়ে তীর্থধর্ম করাই!
আমার বাবা, মানে তোর ঠাকুরদা রেলে চাকরি করেছেন। চিরকাল দেশসুদ্ধ বুড়িকে তীর্থ করিয়েছেন। মাসি পিসি খুড়ি জেঠি হোক আর না হোক। পাতানো সম্পর্কতেই। আর তুই এমন ছেলে যে নিজের পিসিকে—’
বদু দেখে বাবা যেন ভারী অপ্রতিভ হয়ে যান। তাড়াতাড়ি বলেন, ‘এই তো ছুটি নেবার কথাই তো হচ্ছে।’
নগেন্দ্রনন্দিনী বেলের শরবত-টা খেয়ে নিয়েই চায়ের গেলাসটায় চুমুক দিয়ে বলেন, ‘শুনে বাঁচলাম। খুব ইচ্ছে একবার জগন্নাথ দর্শন করে আসি। এই মাসখানেক পরেই রথ, একেবারে রথ দেখে—’
আশ্চর্য!
সত্যিই ছুটি নিলেন বদুর বাবা। আর সত্যিই সেভয়ানক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল! বদুরা রেলগাড়িতে চড়ে বসল। তারপর পুরীতে এসে নামল।
পুরী স্টেশনে নেমে চারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় বদু। তাদের জীবনপুরের সঙ্গে কী আকাশ-পাতাল তফাত! দেখে আহ্লাদও হচ্ছে দুঃখও হচ্ছে। দুঃখ হচ্ছে এই ভেবে জীবনপুর, যেটা নাকি একেবারেই বদুদের নিজস্ব, সেটা কত তুচ্ছ, কী দীনহীন। আর আহ্লাদে হচ্ছে জীবনপুরের বাইরে যে সুন্দর পৃথিবী রয়েছে—বদু তার একটুখানি দেখবার সুযোগ পাচ্ছে বলে।
বদুর বাবা মালপত্তর গোছ করে এক জায়গায় রাখিয়ে রিকশো দর করছিলেন, গোটাতিনেক রিকশো তো লাগবেই। বদু, বদুর মা-বাবা আর বাবার পিসি এই চারজনের জন্যে দুটো, আর মালপত্রে জন্যে একটা।…
বাবা রিকশোওয়ালার সঙ্গে দরাদারি করছেন দেখে রাগ হয়ে যায় বদুর। এতে শুধু দেরি করা বই তো নয়। স্টেশনটা দেখতে ভালো লাগছে বলেই যে সেখানে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে তা তো নয়।
তা বদুর মনের কথাটি বদুর বাবার পিসিমা, নগেন্দ্রনন্দিনী, যার ডাকনাম নাকি নগি, তিনিই বলেন। খরখরিয়ে বলে ওঠেন, ‘তীত্থি স্থানের মাটিতে পা দিয়েই গরিবের সঙ্গে পয়সা পয়সা করে খ্যাঁচখ্যাঁচ করছিস ক্যান রে রেজো? শ্রীক্ষেত্তর হল গিয়ে দান-ধ্যান করবার দেশ, জগন্নাথ গরিব-দুঃখীর বেশে ঘোরেন, তা জানিস?’
বদুর বাবা মালগুলো গুনে তোলাতে তোলাতে বলেন, ‘জানতাম না, এখন জানলাম। ও বাপ রিকশোওলা প্রভু জগড়নাথ, অপরাধ নিয়ো না, এখন দয়া করে এগোও। তুমি যা চাইছ তাই পাবে।’
এরপর সব গুছিয়ে বসা হয়। বদুর বাবা অবশ্য শুধ মালপত্র তুলে একটা রিকশোকে ছেড়ে দেন না, নিজে তাতে চেপে বসেন, আঁটসাঁট করে বাঁধা বেডিংটার ওপর। সেটা পিছুপিছু চলে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে।
ইত্যবসরে বাবার পিসি খনখনে গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘অ রেজো, এখন আমরা যাচ্ছি কোথা?’
‘রেজো’ও চেঁচিয়ে বলেন, ‘কোথায় আবার? হোটেলে। যেখানে আগে থেকে ঘর বুক করা আছে।’
‘এ মা মা!’ নগেন্দ্রনন্দিনী ঘেন্নার গলায় বলেন, ‘তুই কি একেবারে মেলেচ্ছ হয়ে গেচিস রেজো? শ্রীক্ষেত্তরে এসে জগন্নাথ দর্শন নেই, সমুদ্দুর দর্শন নেই, চললি কিনা হোটেলে? জগন্নাথকে জাকি দর্শন করতে হয় তাও জানিসনে? নাকি ঝাঁকি দর্শন মানেটাও জানিস না?
এখন বদুর মাকেও চেঁচাতে হয়। কারণ চলন্ত রিকশো থেকে কে কার কথা সহজে শুনতে পাচ্ছে? বদুর মা বলে, ‘জানব না কেন পিসিমা, তবে কিনা মন্দির বলে কথা। স্নান-টান না সেরে—’
‘রাকো বউমা— তোমার স্নান। বলে ধুলোপায়ে জগন্নাথ দর্শন হল চিরকেলে শাস্তর বাক্য। এই রিকশোওয়ালা, বাবুর কথা নেহি শুনেগা। হামকো কথা শুনো। আগে মন্দিরমে চলো।’
নগেন্দ্রনন্দিনীর চেঁচামেচিতে রিকশোওয়ালারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, বিছানার বান্ডিলের ওপর থেকে বদুর বাবা বলে ওঠেন, ‘ও পিসিমা, এটা হিন্দি কথার দেশ নয়। যা বলবে বাংলায় বলো, এরা খুব বুঝবে।’
পিসিমা রেগে উঠে বলেন, ‘ওঃ, বুঝবে। বুঝবে তো নিজের বুদ্ধিতে আগে জগন্নাথ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে না কেন শুনি? কোন যাত্রীটা এসেই আগে হোটেলে ওঠে?’
বদুর বাবা কাতর হয়ে বলেন, ‘এই সব মোট-মাটার নিয়ে আমি মন্দিরে যাব?’
বাবার পিসিমা এখন সেদিকটা অবলোকন করে কী ভেবে বলেন, ‘বেশ তবে তোরা তোদের হোটেলে-মোটেলে যা, আমি একাই ধুলোপায়ে ঠাকুর দেখে আসি।’
বদুর বাবা বলেন, ‘এই সেরেছে। একা? তাও কখনো হয়?’
নগেন্দ্রনন্দিনী একগাল হেসে বলেন, ‘কেন? তোর পিসি হারিয়ে যাবে? সেভয় করিসনে রেজো, তোর পিসি পথ হারাবার মেয়ে নয়।’
বাবা গলা নামিয়ে বলেন, ‘আহা তা নয়, মানে পান্ডা-টান্ডা কে কীরকম কে জানে—।’
‘থাম রেজো। পান্ডা দেখাতে আসিসনে তোর পিসিকে। পান্ডা তো পান্ডা, গুণ্ডাকেই বড়ো ভয় করি আমি। আমি এই এগোচ্ছি।’
বদু আর বদুর মা একটা রিকশোয়, বাবা জিনিসের রিকশোয় আর নগেন্দ্রনন্দিনী একা একটায়। কাজেই তিনি মন্দিরের পথ ধরার তাল করেন। বদুর মনটা ঘুরে যায়। ইস। পিসঠাকুমা দিব্যি আগে-ভাগে সব দেখে নেবে, মন্দির, ঠাকুর। আর বদু বাবা-মার সঙ্গে সেই কোথায় যেন হোটেলে গিয়ে ঢুকবে?
বদু মাকে ঠেলে বলে ওঠে— ‘আমি ঠাকুমার সঙ্গে যাব।’
‘আঃ, এই আবার এক ঝামেলা!’ মা বলে, ‘মিছিমিছি ফ্যাচাং তুলিস না বদু। উনি বুড়ো মানুষ যাচ্ছেন যান—।’
‘না আমি যাব।’
বলেই বদু রিকশো থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে নগেন্দ্রনন্দিনীর দিকে অগ্রসর হয়।
নগেন্দ্রনন্দিনী আহ্লাদে আটখানা গলায় বলেন— ‘ও আমার সোনার বদু। তুমি যাবে আমার সঙ্গে, তা চলো দাদু চলো।… দেখছ বউমা? দেখছিস রেজো? এই বয়েসেই বাছার ধর্ম-কর্ময় কী মতি, ভবিষ্যতে এ ছেলেই বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।’
যাক ভবিষ্যতে কী হবে, কী করবে কে জানে। আপাতত তো বদু বাবার পিসির সঙ্গে এক রিকশোয় উঠে বসে।
বাবা যে বেশ অস্বস্তিতে পড়েন, বদু তা বুঝতে পারে। মা তো চেঁচিয়েই ওঠেন, ‘বদু রোদ লাগবে, বদু সময়ে নাওয়া খাওয়া না হলে অসুখ করবে।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা?
বদু হি হি করে হেসে বলে, ‘ঠাকুমা,‘কেমন মজা হল। আমরা বেশ আগে জগন্নাথ দর্পণ করে নেব।’
নগেন্দ্রনন্দিনী সন্দেহ সন্দেহ গলায় বলেন, ‘জগন্নাথ কী করে নেব?’
‘বা: বললে না তখন আগে জগন্নাথ দর্পণ করতে হয়।’
‘ওমা শোনো ছেলের কথা।’
খটখটি বুড়ি খনখনে গলায় হেসে ওঠেন, ‘দর্পণ কি রে? বল দর্শন? ইস্কুলে পড়িস, দর্শন কথার মানে জানিস না? দেখা রে বাবা দেখা!’
বদু মুখ ভারী করে বলে, ‘জানব না কেন? খুব জানি। তোমার ফোগলা দাঁত দিয়ে উলটো কথা বেরোলে আমি কী করব?’
ফোগলা দাঁত শুনে বুড়ির ফোগলা মুখে আর কী হাসি। বলেন, ‘তুই ঠিক তোর বাবার মতন হয়েছিস। ছোটোবেলায় তোরই মতন তেড়ে তেড়ে কথা বলত তোর বাবা। বলত, নিজে প্যায়রা খেলে দোষ হয় না, ছোলা ভাজা খেলে দোষ হয় না, আমার বেলাতেই পেট কামড়াবে।’
এবার বদুর হাসির পালা, ‘এ মা এই বুড়ি তুমি। দাঁত নেই কিছু না, আবার ছোলা ভাজা পেয়ারা খাওয়া।’
নগেন্দ্রনন্দিনী বলেন, ‘ও ছেলে, চিরকাল আমি এইরকম ছিলাম, কেমন? এমন দাঁত ছিল আমার, লোহা চিবিয়ে খেতে পারতাম, তা জানিস?’
বলতে বলতেই নগেন্দ্রনন্দিনী হঠাৎ দুই হাত জোড় করে কপালে তুলে বলে ওঠেন, ‘জয়বাবা জগন্নাথ।’
মন্দিরের কাছে এসে গেছেন, তাই।
বদুও দেখাদেখি তাই করে।
কিন্তু…মন্দিরে ঢোকার পথে এ সব কী রে বাবা! বদুর তো মাথা ঘুরে যায়।
কী চেঁচামেচি! কী নোংরা!
এত ভিখিরি! পৃথিবীতে এত ভিখিরি আছে? এত ভয়ানক ভয়ানক! কানা, খোঁড়া,নুলো নাক-কান হীন। ওরে বাবা। কই বদুদের জীবনপুরে তো এমন বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ভিখিরি নেই।
একজন মাত্র অন্ধ ভিখিরি আছে।
যখন স্টেশনে অনেক লোক আসে,তখন রেললাইনের ধার দিয়ে একটা ছোট্ট ছেলের হাত ধরে আসে, গান গেয়ে ভিক্ষে চায়।
আর এমনি বাড়িতে দু-একটা ভিখিরি আসে, ফুটো ফুটো কলাই-করা বাটি হাতে নিয়ে দরজায় এসে বসে ডাক পড়ে। মাতাজি, থোড়া কুছ খানা মিলেগা। রোটি ওটি!
ওরা জীবনপুরের লোক নয়,কোথা থেকে যেন এসেছে। মা বলে, বানের জলে ওদের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। তারাও বাপু এমন বিচ্ছিরি করে চেঁচায় না।
বদু আস্তে বলে, ‘ও ঠাকুমা, ওদের ভিক্ষে দিয়ে দাও না। পয়সা নেই তোমার কাছে?’ ঠাকুমা একটি অলৌকিক হাসি হেসে বলেন, ‘দেব রে দেব। দেবার জন্যে এই অ্যাতো খুচরো পয়সা এনেছি। তবে আগে দিলে রক্ষে আছে? আমায় কি আর তাহলে রাখবে? দাও দাও করে পাগল করবে। এখন চল ঠাকুর দেখি। ফেরার সময় দিতে দিতে পালাব।’
তা ঠাকুর তো আর সহজ দ্রষ্টব্য নয়?
পান্ডা-টান্ডার শরণ না নিলে হবেই না। সেইসব যা করবার করে ঠাকুর দেখে মন্দির থেকে বেড়িয়ে নগেন্দ্রনন্দিনী মুঠো করে পয়সা নিয়ে দু-ধারে ছুড়তে ছুড়তে বেঁা বেঁা করে পালিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়ানো রিকশোটায় উঠে পড়ে হাঁপাতে থাকেন।
বদুও তাই, শুধু পয়সা ছড়ানো বাদে।
একটু চলতে চলতে বদু বলে, ‘আমি আর এখানে আসছি না বাবা।’
ঠাকুমা শিউরে উঠে বলেন, ‘নারায়ণ নারায়ণ! ও কথা মুখে আনতে আছে?’
বদু জোরের সঙ্গে বলে, ‘কেন আনব না? এত ভিখিরি দেখতে তোমার বুঝি খুব ভালো লাগে? কষ্ট হয় না?’
নগেন্দ্রনন্দিনী নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘হয় বই কী ভাই, হয়। ভগবানকে গাল পাড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু করা যাবে কি! যার যা ভাগ্য।’
বদু জোরের সঙ্গে বলে, ‘আমি যখন বড়ো হব, আমার সব টাকা ভিখিরিদের দিয়ে দেব।’
‘দিস ভাই দিস। তার বাড়া আর পুণ্যি নেই। তবে বলি তোরা বড়ো হয়ে যদি দেশের এমন অবস্থা ব্যবস্থা করতে পারিস, দেশ ভিখিরিশূন্য হয়, তবেই বলি কাজ।… নে এখন চল সমুদ্দুর ধার হয়ে তোদের সেই হোটেলে চল।’
বলেই নগেন্দ্রনন্দিনী হাতখানেক জিভ বার করে বলেন, ‘এই মরেছে। সেহোটেলটা আবার কোনদিকে। তোর বাবাকে তো ছেড়ে দিলাম, এখন রিকশোওলাকে চেনায় কে।’
হঠাৎ ভয়ানক একটা ভয়ে বদুর সারাশরীর আথাল পাতাল করে ওঠে। তাই তো, এখন কী হবে? বদুরা কি সত্যিই হারিয়ে যাবে? হায় হায়, কেন বদু চলে গেল? তবু বদুর মনের মধ্যে একটা আশার আলো খেলে গেল। হেটেলটার নাম নাকি ‘সাগরতীরে’! এটা বদুর মা বাবার কথার মধ্যে শুনেছে, তাই বলে ওঠে, ‘এই রিকশোওলা, তুমি ‘সাগরতীরে’ হোটেল জানো?’
রিকশোওয়ালা নিশ্চিন্ত গলায় বলে, ‘জানিব না কাঁই? ‘সাগরতীর’ নিকট তো মোরঅ রিকশো স্ট্যাণ্ডো।… আরঅ যে দুটো রিকশো ও তো মোরঅ ভাইর।’
বাবার পিসি মহারানির গলায় বলেন, ‘তোদের তো বিশ্বসুদ্ধ ভাই। দেশের লোক হলেই ভাই। কাকাকেও বলিস ভাই, মামাকেও বলিস ভাই। নে চল এখন সমুদ্দুরের ধারে।’
একটুক্ষণের পথ যেতে কতক্ষণই বা! সমুদ্রের উত্তাল কলকল্লোল তো সেই স্টেশনে পা দিয়ে অবধি শুনছে বদু। তবু হঠাৎ চমকে ওঠে। চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য। এই সমুদ্র। এ তো সেকতবার দেখেছে।
হ্যাঁ দেখেছে।
নিশ্চয় দেখেছে।
অনেক অনেকবার।
ঠাকুমা বলেন, হাতজোড় করে নমস্কার কর দাদু। সমুদ্দুরও নারায়ণ।’
বদু আস্তে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করে। আর আরও একবার মনে হয়, এইভাবে নমস্কারও করেছে কতবার।
এইবার কি তবে বদু তার সেই হারিয়ে যাওয়া অন্য জন্মটা খুঁজে পাবে? যেখানে বদুর অনেককিছু আছে?
নমস্কার করেও বদু হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে নগেন্দ্রনন্দিনী তাড়া দেন, নে এবার চল তোর বাপের সেই হোটেলে মোটেলে। শ্রীক্ষেত্তর এসেছি, পান্ডার বাসায় থাকব, মহাপ্পেসাদ খাব, এই তো জানি, শাস্তরেও তাই আছে। তা নয়, তোর সাহেব বাপ গেল হোটেলে ঘর ভাড়া করতে। হোটেলে আবার জাতজন্ম থাকে নাকি! তা মরুক গে, দেশে ফেরার দিনি, একেবারে রেলগাড়িতে চড়বার মুখে, জগন্নাথ দর্শন করে যাওয়া-জাত ফিরিয়ে নিয়ে তবে যেতে হবে। …ওমা ইকি গো! এ ছেলে যে ইট পাথরের মতন দাঁড়িয়ে আছে গো। নড়ে না নড়ে না। বলি বাসায় ফিরবি, না সমুদ্দুরের ধারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থালেই পেট ভরবে?’
বদু আস্তে বলে, ‘আচ্ছা পিসঠাকুমা, আমি তো কখনো এখানে আসিনি, তবে সমুদ্র দেখে কেন এমন চেনা চেনা লাগছে? মনে হচ্ছে কত কতবার দেখেছি।’
নগেন্দ্রনন্দিনী একমুখ হাসি হেসে বলেন, ‘ও মা, তোরও তাই হচ্ছে? অমন হয়, বুঝলি? আমারও হয়েছিল একবার। প্রেথম যেবার তারকেশ্বরে যাই, দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। মনে হল যেন কত কতবার এই মন্দিরে এসেছি, কতবার এইরকম মাটির ঘটে গঙ্গাজল নিয়ে বাবার মাথায় ঢেলেছি—’
বদু বলে ওঠে, ‘তোমার বাবার সঙ্গে গিয়েছিলে বুঝি?’
‘না তো! কেন, বাবার সঙ্গে কেন?’
‘বা:, তুমি যে বললে, বাবার মাথায় মাটির ঘটির জল ঢাললে।’
নগেন্দ্রনন্দিনী তো শুনে হেসে গড়াগড়ি। বালির গাদায় শুয়ে পড়েনি এই ঢের।… বাবার মাথায় নাকি নিজের বাবার মাথায়? যিনি সকলের বাবা, তারকনাথ, তাঁর মাথায়। তা একজন সাধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, এরকম কেন মনে হল?’ তা সাধু বললেন, ‘বেটি, এ হচ্ছে পূর্বজন্মের স্মৃতি। আগে কতবার জন্মেছিস, কতবার কত জায়গায় ঘুরেছিস! এখানেও এসেছিস। …তারকনাথ কৃপা করে তোকে আগের জন্মের স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়ে মন খুশ করে দিলেন।’
মন খুশ!
বদুর মনে হয়, কই তার তো মনটা খুশি লাগছে না, তার যেন কেমন মন হু-হু করা ভাব আসছে। যেন খুব বেশি করে ভাবলে, হঠাৎ সেই আগের জন্মের স্মৃতি ফিরে আসবে তার। মনে পড়ে যাবে এর আগে কোথায় ছিল বদু। … সেখানে কে তার মা-বাবা ছিল। কিন্তু সেই ‘খুব বেশি’টা ভেবে উঠতে পাচ্ছে না। অথচ সমুদ্রের ওই গর্জন, ওই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া ঢেউ, এ বদুর একেবারে ভীষণ চেনা লাগছে।
কিন্তু বসে বসে ভাবলে তো চলবে না, রিকশোওয়ালা এমন কিছু আর মহাপ্রভু নয় যে, সেও চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখবে। তাড়া লাগায় সে। এবার এই দেরির জন্যে পাঁচটাকা বেশি নেবে বলে শাসায়।
তবে নগেন্দ্রনন্দিনীকে শাসানো যে সোজা নয়,সেটি তো সেজানত না, নগেন্দ্রনন্দিনী রাগে টং হয়ে বললেন, ‘বটে? আচ্ছা।’
বদুর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে রিকশোয় উঠে বসে, কোমরের আঁচল থেকে একখানা দশ টাকার নোট বার করে,মহারানির ভঙ্গিতে রিকশোওয়ালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, ‘পাঁচটাকা কেন, পুরোপুরি দশটাকাই নে। নিয়ে চল থানায় চল।’
শুনে রিকশোওলা তো নেই।
‘থানায় যাইমু কাঁই?’
‘যাইমু কাঁই! যাবে কেন বুঝছ না চাঁদ? দারোগাকে শুধোব, জগন্নাথের রাজ্যে রিকশোওলাদের মানুষের গলা কাটবার ‘পারমশিন’ দেওয়া হয়েছে কি না। নে ধর বলছি।’
রিকশোওয়ালা অবশ্যি নেয় না, আপনমনে গজ গজ করতে করতে এগিয়ে যায় ‘সাগরতীরে’ হোটেলের দিকে ।
ওদিকে বদুর মা বাবা তখন অস্থির হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। একি রে বাবা, এত দেরি কেন?… কী করছে এতক্ষণ দুটো মানুষ, একটা বুড়ো আর একটা বাচ্চা? রাস্তাটাস্তাও চেনা নেই, কোথায় যেতে কোথায় গেল। ‘সাগরতীরে’র ঠিকানা তো বলে আসা হয়নি রিকশোওয়ালাকে। পুরীতে নামতে না নামতেই এ কী বিপত্তি!
ভাবনা হতে হতে তর্ক।
বদুর বাবার মতে সব দোষ বদুর মার, কারণ তাঁর রিকশোতেই ছেলে ছিল। তিনি ছাড়লেন কেন? আর বদুর মার মতে— সব দোষ বদুর বাবার,কেন তিনি হাঁকডাক করে বারণ করতে পারেননি?… আর ওই পিসিমা। ওঁর পৃষ্ঠবলেই তো—
তর্ক যখন প্রায় ঝগড়ার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে, হাঁটুতে শুরু করেছেন ওঁরা রাস্তায়, তখন বদু ভাবতে ভাবতে, নগেন্দ্রনন্দিনী বকতে বকতে, আর রিকশোওয়ালা গজ গজ করতে করতে এসে উপস্থিত।
প্রথম নম্বর তো খুব একচোট বকাবকি, তারপর খাওয়ার জন্যে তাড়া। হোটেলের ব্যাপার তো, বেশি বেলা হলে চা জলখাবারের পাট উঠে যাবে। …খেতে বসে, টোস্টে কামড় দিতে দিতে বদু বলে, ‘জানো মা, আমি না আগে আরও অনেকবার এখানে এসেছি।’
বাবা হেসে উঠে বলেন, ‘কোথায়? এই হোটেলে?’
বদু গম্ভীরভাবে বলে, ‘না। এই পুরীতে।’
বদুর মার রাগ এসে যায়, হঠাৎ হঠাৎ কেনই যে বদু এরকম উলটো-পালটা কথা বলে। তাই বদুর মা খুব কড়া গলায় বলেন, ‘মিছিমিছি বাজে কথা বলছিস কেন? আমরা এলাম না তুই এলি, একি মামার বাড়ির আবদার নাকি? একা একা এসেছিলি।’
বদুর বাবা কিন্তু হেসে উঠে বলেন, ‘আহা বুঝতে পাচ্ছ না, স্বপ্নে এসেছে। তা বদু, স্বপ্নেই যদি খেলি তো রাজভোগ না খেয়ে মুড়ি খেতে গেলি কেন? বিলেত আমেরিকা না গিয়ে হাতের কাছে পুরীতে এলি কেন?’
নগেন্দ্রনন্দিনী বারান্দার একধারে বসে মালা জপ করছিলেন, একবার মালাটা কপালে ছুঁইয়ে বলে ওঠেন, ‘স্বপ্নে নয়, বউমা, আগের জন্মে।’
কী জ্বালা!
আগের জন্মে আবার কী?
বদুর মা রাগ-রাগ গলায় বলেন, ‘এ আবার কী কথা পিসিমা? আগের জন্মের কথা মনে থাকে মানুষের?’
পিসিমা হাস্যবদনে বলেন, ‘থাকে না ঠিকই। থাকলে রক্ষেও থাকত না। মানুষের সমাজে তুলকালাম কান্ড বেধে যেত।… তবে কখনো কদাচ কারু কারু এরকম মনে পড়ে যায়। হঠাৎ কোনো নতুন জায়গায় এলে, কী কোনো ঠাকুর মন্দির দেখলে, মনে হয় যেন কত কতবার দেখেছি।’
বদুর মা দুঃখের গলায় বলেন, ‘একেই ওইরকম উদ্ভট ছেলে, তার ওপর আবার আপনি ওইসব বললে তো আর রক্ষে নেই।’
বদুর বাবা প্রমাদ গোনেন, পিসিমা না রেগে যান। কিন্তু পিসিমা রাগেন না, বরং হা হা করে হেসে উঠে বলেন, ‘তোর বউটা এমন রাগি কেন রে রেজো?’
‘আজ আর সমুদ্দুর টমুদ্দুরে যাওয়া নয়।’ বদুর মা বললে, ‘আজ অনেক বেলা হয়ে গেছে। কাল হবে। আজ বরং বিকেলের দিকে যা সব দেখবার টেখবার, দেখতে বেরোতে হবে।
নগেন্দ্রনন্দিনী রাজনন্দিনীর মতো বলে উঠলেন, ‘তোরা যা খুশি করিস কর, আমি এই চললাম।’
বদুর তো ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়।
একা ওই সমুদ্রে!
বদু বলে ওঠে, ‘ও পিসঠাকুমা, তুমি একা যেয়ো না, ডুবে যাবে।’
পিসঠাকুমা বলেন, ‘কী বললি? ডুবে যাব? ডুবলে, এদিকে ডুবে ওদিকে ভেসে উঠব।’ বলে গটগট করে বেরিয়ে যান।
বদু তো ভয়ে কাঁটা হয়ে সেই বারান্দায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওই তো ওদিক থেকে নামল পিসঠাকুমা, আর তো দেখাও যাচ্ছে না।
হঠাৎ চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে বদু।
মা-বাবা দু-জনেই অবাক হয়ে ছুটে আসেন, ‘কী হল?’
‘ঠাকুমা নিশ্চয় ডুবে গেছেন।’
সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজার কাছ থেকে ঠাকুমার গলা শোনা যায়, ‘হ্যাঁ রে, তোর ঠাকুমা ডুবে মরে গিয়ে আবার পেতনি হয়ে ফিরে এল।’
বদু নিশ্বাস ফেলে বাঁচে।
ঠাকুমা নিশ্চিতভাবে বলেন, ‘সমুদ্দুর কিছু নেয় না রে, তুমি যা দেবে, ছুড়ে খেলে দেবে। একটা পয়সা ফেলে দাও, দেখবে ঠিক ফেরত এসে গেছে।’
বিকেলবেলা বেড়াতে যাওয়ার কথা।
তার আগেই ভাগ্যক্রমে একদল বন্ধু জুটে গেল বদুদের। মানে জনে জনে— সকলের।
এই হোটেলেই দিন তিন চার আগে আর একটি পার্টি এসে রয়েছে। এমন মজা, তাদের দলে বদুর পিসঠাকুমার মতো একটি বুড়ি আছেন, বদুর বাবার বয়েসের মতো এক ভদ্রলোক আছেন, বদুর মার মতো এক মহিলা আছেন, আর প্রায় বদুর মতো বয়েসের—হয়তো একটু বড়ো একটা ছেলে আছে। আর বেশিরভাগের মধ্যে ছেলেটার এক মামা আছেন। বেজায় মজার মানুষ, তাঁকে সব বয়সেরই বলা চলে।
মানে সব্বাইয়ের সঙ্গেই তিনি সমানভাবে মিশে গেলেন ঘন্টা দুইয়ের মধ্যেই।
সকলে মিলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ঠিক হয়ে গেল। …খানকয়েক রিকশো নেওয়া হল।… মালা জপা দুই বুড়ি একটায়, দুই ভদ্রলোক একটায়, একটায় দুই মহিলা, আর সব শেষটায় সেই মামা আর দুটি বালক বদু আর সুমন্ত।
দুটিকে দুই হাতে চেপে ধরে প্রায় বগলদাবা করে মামা বসলেন জাঁকিয়ে।
বদুর আর সুমন্তর ভাব হয়ে গেছে এক মিনিটেই।
হোটেলে খাবার ঘরে আলাপ। কে কোথা থেকে এসেছেন, কবে এসেছেন,ক-দিন থাকবেন, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাওয়া ঠিক করেছেন— এইসব কথা হচ্ছে কর্তাতে কর্তাতে, গিন্নিতে গিন্নিতে। হঠাৎ মামা বলে উঠলেন, ‘এই ছেলে দুটো, তোরা মুখে তালাচাবি এঁটে বসে আছিস কেন রে? কথা ক, কথা ক।’
বদুর তো আর মামা নয়। তাই বদু মুখে সেই তালাচাবি এঁটেই থাকে, তবে সুমন্ত বলে উঠে, ‘কী কথা কইব, বা:, ও কী আমার চেনা?’
মামা এক হুমকি দিয়ে বলে ওঠেন, ‘চেনা কি আপনি আপনি হয় নাকি? চেনা করলেই চেনা।’
ততক্ষণে ওরা খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। মামা বললেন, ‘দাঁড়া দু-জনে, স্ট্রেট দাঁড়া। বল, চেনা চেনা চেনা—’
দু-জনেই হেসে ফেলে বলে, ‘ধ্যাৎ!’
‘ধ্যাৎ-ট্যাৎ নয়, বলে যাও। দেখি ওই ‘চেনার’ সঙ্গে ক কটা ‘মিল’ করতে পারো। যে যত চালাতে পারো চালাও। যে আর মিল জোগাতে পারবে না, সেহেরে যাবে, তাকে আগে এগিয়ে এসে বলতে হবে—ভাব ভাব ভাব। তারপরেই অপর জন বলবে ভাব ভাব ভাব। ব্যস।’
তবু দু-জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফিক ফিক করে হাসতে থাকে।
মামা আবার বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা তোমাদের যদি এমন মেয়েলি লজ্জা থাকে, গোড়াটা আমিই ধরছি— চেনা চেনা চেনা। সুমন্ত—’
সুমন্তর তার মামার ধরন-ধারণ জানা আছে। তাই সেবসে ওঠে, ‘কেনা কেনা কেনা—’
‘বদু তুমি—’
বদু আর হারতে রাজি নয়, তাই সেও বলে ওঠে, ‘দেনা দেনা দেনা—’
‘গুড! সুমন্ত—’
‘সেনা সেনা সেনা—’
বদুকে আর বলতে হয় না, নিজেই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘হেনা হেনা হেনা—’
সুমন্ত চোখ কুঁচকে বলে, ‘হেনা আবার কী! ও কথার মানে নেই।’
মামা বলেন, ‘মানে নেই মানে? হেনা হচ্ছে— এরকম ফুল। তা হলে সুমন্ত তুমি আর বলবে না?’
সুমন্ত বলে, ‘আর কথা থাকলে তো?’
বদু বলে ওঠে, ‘কেন থাকবে না? এই তো— নে না, নে না, নে না—’
সুমন্ত আবার বলে, ‘নে না মানে?’
‘বা:, নে না মানে জানো না? এই যে আমার পকেটে দারচিনি রয়েছে, আমি বললাম, ‘একটু নে না—’
‘বা:। বা:।’
মামা হা হা শব্দে হেসে ওঠেন, মিলও হল ভাবও হল। একবার যখন তুই বলা হয়ে গেছে ,তখন আর তুমি চলবে না। বল, ‘তুই, ছুঁই।’
মামার কথায় ভারি মজা পায় বদু, জোরে জোরে বলে ‘তুই ছুঁই।’
‘গুড গুড। কিন্তু শুধু বললে তো হবে না, ছুঁতে হবে।’
মামা দুহাতের তলা থেকে দুটো মাথাকে টেনে এনে মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে বলেন, ‘এইবার দুজনে একসঙ্গে বল, ‘ভাব ভাব ভাব।’
হি হি করে হেসে উঠল বদু, সঙ্গে সঙ্গে সুমন্তও। কাজেই বলল আর না বলল, ভাব হয়ে গেল। দু-জনে কেবল কেবল ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। ততক্ষণে সামনের রিকশো তিনটে থেমেছে, আরোহীরা নামছেন। বদুরা তো রিকশো না থামতেই তড়াক তড়াক করে লাফিয়ে নেমে পড়েছে। মামাও নামেন প্রায় লাফিয়েই।
প্রথমে নামা হল ‘সিদ্ধ বকুল’-এর কাছে।
নগেন্দ্রনন্দিনী গলা তুলে বললেন, ‘অ রেজো, ছেলেটা কই?’
বদু চেঁচিয়ে বলে, ‘আছি আছি?’
‘আছিস তো চোখে তো দেখছি না একবারও। বলি এদিকে আয় না—’
সকলে তখন রিকশো থেকে নেমে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল, বদু গট গট করে এগিয়ে যায় ঠাকুমার দিকে, বলে, ‘কী বলছ?’
‘কী আবার বলব? এই যেখানে এলি তার কথা পান্ডাঠাকুর বুঝিয়ে দেবেন, শোন মন দিয়ে।’
বদু অবহেলায় গড়গড়িয়ে বলে, ‘ও তো আমার শোনাই হয়ে গেছে। মামা বলে দিয়েছেন। যবন হরিদাস হচ্ছেন মহাপ্রভুর পরম ভক্ত, সব সময় হরিনাম করতেন, তাই সবাই ওঁর নাম দিয়েছিল ‘হরিদাস’ আর জাতিতে মুসলমান ছিলেন বলে যবন।
ভদ্রলোক হরিনাম টরিনাম নিয়ে সুখেই ছিলেন, কিন্তু হল না। এই দেশের কাজিটা ছিল ভীষণ দুষ্টু। সেবলল,একজন মুসলমান কেন ‘আল্লার’ নাম না করে হরিনাম করবে? মার লাগাও ওকে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল মার— ফটাফট বেত পেটা। শুধু কি একদিন? রোজ রোজ। বাইশটা বাজার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁকে বেত্রাঘাত করল কাজির লোকেরা, আর বলতে লাগল, ‘বল হরিনাম ছাড়বি?’
উনি বললেন, ‘উঁহু। বরং প্রাণ ছাড়ব তবু হরিনাম ছাড়ব না। শেষপর্যন্ত নবদ্বীপ ছেড়ে চলেই আসতে হল। আর এই বকুলগাছটার তলায় বসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে ‘সিদ্ধ-বকুল’ বলা হয় একে। দেখো না গাছটার শেকড় টেকড় সব শুকিয়ে গেছে, গা-টা ফোঁপরা, অথচ ডাল-পালা সবুজ।’
নগেন্দ্রনন্দিনী বলেন, ‘ও বাবা, এ ছেলে যে তুবড়ি ছোটাল।’
বদুর মা ছেলের এই জ্ঞানলাভে এত খুশি হয়ে যায় যে সুমন্তর মামাকে ‘দাদা’ বলতে শুরু করে দেয়।
নাম বটকৃষ্ণ, তাই বটুদা।
‘সিদ্ধবকুল’ থেকে ওরা গেল যবন হরিদাসের সাধনভূমিতে।
বদুর নতুন পাওয়া বন্ধুর মেজোমামা জানেন না এমন কথা নেই। সব কিছুরই ইতিহাস ওঁর কন্ঠস্থ। ‘যবন হরিদাস’ নামের ইতিহাস শুনিয়ে দেন তিনি বদুদের।
শুনে বদুর দুঃখের শেষ থাকে না।
না হয় তিনি মুসলমান ঘরে জন্মেই ছিলেন, তাঁর যদি হরিনাম করতে ইচ্ছে হয়, করবেন না? তাই বলে তাঁকে এত শাস্তি দেবে? বাইশটা বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাকি তাঁকে ‘বেত্রাঘাত’ করা হয়েছিল লোককে দেখিয়ে দেখিয়ে। শাসনকর্তা চাঁদ কাজিও ছিলেন মুসলমান, তাই এত শাস্তি।
কিন্তু তবু কী হরিদাসের হরিনাম ছাড়াতে পারল কাজি? পারল না। হরিদাসের নিজস্ব কী নাম ছিল তা ভুলেই গেল লোকে, নাম হয়ে গেল যবন হরিদাস। ইনি ছিলেন মহাপ্রভুর সব থেকে বড়ো ভক্ত ক-জনের মধ্যে একজন।
আবার এ প্রশ্নও করে বসে বদু, ‘আচ্ছা মেজোমামা, ‘হরিনাম’ করতে এতই বা কী সুখ, যে অত অত মার খেয়েও ওই নাম করতে ইচ্ছে করে?’
মেজোমামা হাসেন।
বলেন, ‘বড়ো হলে যখন অনেক পড়বি অনেক জানবি, তখন জানতে পারবি, পৃথিবীতে মানুষ ধর্মের বিভেদ আর ধর্ম আঁকড়ে থাকার জন্য যত মরে আর যত মার খায়, তত আর কিছুর জন্যে নয়।’
ওখান থেকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রম আর কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে যাওয়ার কথা, মাঝখানে বদুর মা বলেন, ‘এরমধ্যে ছোটোদের কিছু খাইয়ে নিলে হত না?’
শুনে বদুর বাবাও বেশ খুশি হলেন, কারণ খেলে কি আর শুধু ছোটোরা খাবে?… কিন্তুু বদুর বাবার পিসিমা তো শুনে এই মারেন কী সেই মারেন।
‘কী আশ্চর্য বউমা, তোমাদের কি ছেলে আদর মানেই খাওয়ানো? এসেছে ঠাকুর দেবতা দেখতে তাই দেখুক , তা না কেন খেতে বসুক। দন্ডে দন্ডে খাওয়া।’
শুনে তো বদুর মা লজ্জায় লাল।
কিন্তু মেজোমামা শুনেই হই হই করে ওঠেন, ‘সেকি পিসিমা, খাওয়া ছাড়া কোনো কিছু জমে নাকি? পেট চুঁই-চুঁই করলে, ‘পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যও বাজে মনে হবে।… আমার তো গাড়ি চড়লেই পেটের মধ্যে ছুঁচোয় ডনবৈঠক করে। বার করুন, বার করুন, আপনার ঝুলিঝোলায় কী মালপত্র আছে।’
তখন আর বাবার পিসিমার কী বলার আছে? বাইরের লোককে তো আর ‘না’ বলতে পারবেন না।
তখন বদুর মার ঝুলি-ঝোলা থেকে বেরোল গজা, ছোলার শিঙাড়া, আলুর দম, আর নকুলদানা।
বলাই বাহুল্য বদুর বাবাও বাদ গেলেন না।
খাওয়া পর্ব সেরে ,ওরা গেল জগন্নাথের মাসির বাড়ি দেখতে। ‘জগন্নাথের মাসি’ শুনে তো বদু আর বদুর বন্ধু হেসেই খুন। ঠাকুর দেবতাদেরও আবার মামা-মাসি-পিসি-কাকা থাকে?
ঠাকুরের আবার বেশি স্নান করলে জ্বর হয়? আর জ্বরের পর মুখে অরুচি হয়েছে বলে মাসির বাড়ি গিয়ে অরুচি সারাতে ইচ্ছে করে?
বদুর বন্ধু বলে ওঠে, ‘এসব মানুষের বানানো। ঠাকুরের কক্ষনো ওসব থাকে না—’
তার মেজোমামা শান্তভাবে বলেন, ‘ও কথা যদি বল, তাহলে তো ঠাকুরও মানুষের বানানো। এমনিই তো নিমগাছের কাঠ দিয়ে ওই মূর্তিটা বানিয়েছে, তা ছাড়া বলতে পারো ‘জগন্নাথ’কেও বানিয়েছে। ঠাকুর তো কোনো স্বর্গ থেকে নেমে এসে বলেননি, ‘ওর আমি জগতের নাথ, এই আমার চেহারা।’ …সবই বানানো! বানানোর মধ্যে দিয়েই মানুষের কল্পনা শক্তির বিকাশ। কল্পনা না থাকলে, বানাতে না শিখলে, মানুষ কি ‘মানুষ’ হত? বেবুন শিম্পাজি ওরাং ওটাংই থেকে যেত।’
মেজোমামার কথাগুলো শুনতে এত ভালো লাগে বদুর! ভাগ্যিস ওঁদের সঙ্গে দেখা হল, আলাপ হল।
আজ সবাই ক্লান্ত তাই বলা হল, আজ আর বেড়িয়ে কাজ নেই, আবার কাল হবে। আর পরশু যাওয়া হবে ভুবনেশ্বরে।
বদুর বাবা অবশ্য বলেছিলেন, ‘পুরী এসেছ, পুরীই দেখো ভালো করে। কত দেখবার আছে, এক মাসেও দেখে ফুরোবার নয়। আবার হই চই করে এখানে সেখানে কেন? ও আবার অন্য সময় হবে।’
কিন্তু বদুর বাবার কথা কোনো সময়ই টেকে না।
বাবার পিসিমা খনখনে গলায় বলে দেন, ‘খোকার মতন কথা বলিসনি, রেজো! এদিকে তুই রোজ রোজ আসছিস? তাই ও আবার অন্য সময় হবে? ভুবনেশ্বর একটা মহাতীর্থ না? হাতের কাছ থেকে না দেখে চলে যাব? তোর ইচ্ছে না হয়—হোটেল বসে থাক, আমরা সবাই মিলে দিব্যি চলে যাব।’
বাবা যাবেন না শুনে বদুর মন খারাপ হয়ে যায়, ও রেগে রেগে ঠাকুমাকে বলে, ‘তুমি বাবাকে ও কথা বললে কেন? বাবা যদি রাগ করে সত্যি হোটেলে বসে থাকে?’
ঠাকুমা একটু চালাক হাসি হেসে বলেন, ‘বকিস কেন? বাবা আবার তোদের ছেড়ে থাকতে পারে? দেখিস না, ঠিক যাবে গুটি গুটি এই আমি লিখে দিচ্ছি।
লিখে না দিলেও বদুর বুকের ভার নামে।
সারাদিন বেড়িয়ে রাত্রে বারান্দায় গল্পের আসর বসে। বক্তা অবশ্যই মেজোমামা, শ্রোতা বদুরা। …কত কত দেশ ঘুরেছেন মেজোমামা, কত জায়গা দেখেছেন। বদু অবাক হয়ে শোনে, মেজোমামার ছেলেবেলায় কেবলই মনে হত—তাঁর বুঝি অন্য কোথাও একটা বাড়ি আছে, সেটাই নিজের বাড়ি। তাই সেই বাড়ি খুঁজে বার করবার জন্যেই অত ছটফটানি, অত আকুলতা।
শেষকালে অবশ্য মেজোমামা বলেন, আসলে কী জানিস? এই পৃথিবীতে তো মানুষ বার বার আসে? মানে বার বার জন্মায় আর মরে, মরে আর জন্মায়। যার ভেতরে খুব গম্ভীর সূক্ষ্ণ একটা অনুভূতি থাকে, তার আত্মার মধ্যে ওই পৃথিবীকে দেখা আর জানার ছাপ থেকে যায়, তাই সেযা কিছু বিশেষ জিনিস দেখে, তাই তার মনে হয়, এ তো আমার দেখা। এ তো আমার জানা।’
বদু অবাক হয়ে ভাবে ‘আত্মা’ মানে কী? ‘গভীর আর সূক্ষ্ণ অনুভূতি’ বলতে কী বোঝায়? বদুদের রেল কোয়ার্টার্সের আশপাশে যারা আছে, থাকে,তারা এসব কথা বলে না। হয়তো জানেও না।
অথচ বদু এসব কথা শুনে মোহিত হচ্ছে।
বদু নিত্যদিনের নেহাত আটপৌরে এই জানা জগৎটার বাইরে আরও কিছু জানতে চায়। আহা ‘মেজোমামা’ যদি বদুর নিজের মামা হতেন।
পরদিন সকাল থেকে আবার সাজ সাজ রব।
যা যা দেখতে বাকি রয়েছে এখনও, সেগুলো দেখে নিতে হবে। না দেখলেই তা পরে লোকলজ্জা। সব দেখেও যদি ছোটোখাটো দু-একটা কিছু বাকি রেখে যায়, পরে অন্যদের কাছে গল্প করার সময় হয়তো শুনতে হবে, এ হে হে। ওইটাই দেখিসনি? ওটাই তো আসল।
কাজে কাজেই আবার খানচারেক রিকশো ভাড়া করে সদলবলে বেরিয়ে পড়ে বাকি সব দেখতে।
বদুর বাবা বলেন, ‘আর কী বা বাকি আছে?’
বাবার পিসিমা চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘বলিস কী রেজো? বাকি নেই? ‘সোনার গৌরাঙ্গ’ দেখা হয়েছে? ‘চক্রতীর্থ’? …‘জগন্নাথের বাগান’? মহাপ্রভুর কাঁথা না দেখে পুরী দেখা হয়ে যাবে? সাড়ে চারশো বছরের কাঁথা, ভক্তদের যত্নে অবিকল যেমনটি ছিল তেমনটি আছে, তা জানিস? এ কি সোজা কথা? উইয়ে খায়নি, পোকায় কাটেনি।’
বদুর বাবা বলেন, ‘এই যে বলছিলে, পুরীতে কখনো আসোনি তুমি। এত সব তবে জানলে কী করে?’
পিসিমা অগ্রাহ্যের গলায় বলেন, ‘তুইও তো কখনো বিলেত যাসনি, জানলি কী করে সেখানে মহারানি ভিক্টোরিয়া ছিলেন, তাঁর বংশধররা এখনও রাজত্ব করছেন।’
মেজোমামা হেসে বলেন, ‘পিসিমার নাম দেওয়া যায় ‘অকাট্য’। সত্যি, এমন করে সকলের সব কথা কেটে দিয়ে নিজের কথাকে অকাট্য করে তোলা আর দেখিনি।’
তখন পিসিমা হাসেন আর বলেন, ‘আমি তো ভুবনেশ্বরেও যাইনি, তা বলে কি জানি না সেখানে ভুবনেশ্বরের মন্দির বাদে দেখবার জিনিস আরও কী কী আছে? গিয়ে দেখবে— উদয়গিরি, খন্ডগিরি, ধবলগিরি, দুধকুন্ডু, মুক্তেশ্বরের মন্দির। পথে পড়বে সাক্ষীগোপাল। শ্রীক্ষেত্তর এসে সাক্ষীগোপাল না দেখলে শ্রীক্ষেত্তর দর্শনের ফল হয় না। পরকালে গিয়ে যখন যমরাজের আদালতে জেরা করবে,উনি সাক্ষী দেবেন, হ্যাঁ গিয়েছিল।’
শুনে বদু আনন্দিত হতে থাকে। … কখন সকাল হবে। কখন যাওয়া হবে।
কিন্তু পরের পরিদিন -কি ভুবনেশ্বরে যাওয়া হয়েছিল বদুর? কিংবা আর সকলের? কী করে হবে?
বদু যদি হঠাৎ সমুদ্রতীরে ঝড়ের ঝাপটায় হারিয়ে যায়? আর তারপর যদি সন্ধে হয়ে যায়?
বদু যদি আর তার মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে না পারে? তাহলে বাসের টিকিট কেনা আছে বলেই কি বদুর মা-বাবা, ঠাকুমা, বদুর বন্ধু আর তাদের সব লোকই আর মেজোমামা ভুবনেশ্বর দেখতে চলে যাবেন।
সেদিন বিকেলে ওরা সবাই সমুদ্রতীরে বসেছিল। বদু আর তার বন্ধু বালির গাদায় পা ঢুকিয়ে ভিজে বালি চেপে পায়ের গড়নের বালির ঘর তৈরি করছিল—আস্তে পা-টাকে বালি থেকে বার করে নিয়ে। বদুর মা রঙিন ঝিনুক খুঁজে খুঁজে কুড়িয়ে জড়ো করছিলেন, আর মেজোমামা আর বাবা বালির ওপর বসে গল্প করছিলেন, ঠাকুমা আর ঠাকুমার বান্ধবী নুলিয়াদের ডেকে ডেকে ‘নাভিশঙ্ঘ’ কিনছিলেন, হঠাৎ বেমক্কা বেয়াড়া একটা ঝড় উঠল।…
এখানে ঝড় মানেই তো চোখেমুখে বালির ঝাপটা। আর তারসঙ্গে তীব্র তীক্ষ্ণ একটা গোঁ গোঁ-হু হু শব্দ।
সমুদ্রে শব্দ উঠছে, শব্দ বইছে বাতাসের দুরন্ত বেগে। ওই শব্দ ছাপিয়ে কি আর মা-বাবার কাতর শব্দ শোনা যাবে?
‘বদু-বদু—উ—উ বদু—উ—উ’ এই আর্তনাদে ডাকটা ঝড়ের শব্দের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। তবু বদুর একবার যেন মনে হয়েছিল মা ডাকছেন ‘বদু’ বলে।
কিন্তু কোনদিক থেকে?
বদুর কি দিক বিদিক জ্ঞান আছে কিছু ? বদু মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াতে পারছে নাকি, তাই ইচ্ছেমতো ছুটবে? ঝড়ই বদুকে কোনদিকে যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যেন আছড়ে ফেলল।…
বদুও তো ‘মা—আ’ ‘বাবা অ’ বলে কত চেঁচিয়েছিল,কার কানে পৌঁছোল?
হয়তো নিজের লোকের কাছছাড়া হয়ে অনেক দূরেও গিয়ে পড়েনি বদু কিন্তু রাতের অন্ধকারে, ঝড়ের বালি খাওয়া চোখ নিয়ে কে তাকে খুঁজে পাবে? …নিজেদেরকে খুঁজে পেতেই তো কতক্ষণ গেছে। …ঝড়ের বেগ কিছু কমলে আবার ডাকাডাকি শুরু হল। মুখের দুপাশে হাত আড়াল দিয়ে জোরে, বদু বাদে একে এক সকলকেই পাওয়া গেল।
বদুকে পাওয়া গেল না। বদুর মা তো এমনিতেই অজ্ঞান মতো হয়ে গিয়েছিলেন। যখন দেখল বদুকে পাওয়া যাবে না, তখন পুরো অজ্ঞান হয়ে বালির ওপর শুয়ে পড়ল।
বদুর বাবা তো পাগলের মতো একবার এদিক ছুটছেন, আর একবার ওদিকে ছুটছেন। বাবার পিসিমা কেবল কপালে করাঘাত করছেন আর চেঁচাচ্ছেন, হে জগন্নাথ, এ কী করলে। ছেলে ফিরিয়ে দাও। হে ঠাকুর,আমি কি এই করতে তোমার কাছে টেনে আনলাম এদের? …ছেলে ফেরত না দিলে আমি সমুদ্দুরে ঝাঁপ দেব—।
বদুর বন্ধুর মা-বাবা চোখ বুজেই তাদের ছেলেটাকে কোলে করে হোটেলে নিয়ে গেলেন। শুধু মেজোমামাই কোনোমতে চোখে রুমাল ঘষে ঘষে যাহোক করে তাকিয়ে নুলিয়াদের ধরে ঘটনাটা বোঝাতে চেষ্টা করলেন। আর বোঝাতে লাগলেন, যদি ছেলে খুঁজে এনে দিতে পারে, তাহলে যা বকশিশ চাইবে পাবে।
বদুর যখন জ্ঞান হল, বদুর মনে হল ওর চারিদিকে শুধু জল আর জল। শুয়েও আছে জলের ওপর, মাথার ওপরও জল। প্রথমটা এই অদ্ভুত অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারল না বদু। এত জলের মধ্যে এল কী করে সে!
বদু মা বলে ডাকতে চেষ্টা করল, কোনো স্বর বেরোল না। ভয়ংকর ভয় করল বদুর। ভয়ে বদু আবার চোখ বুজল, আর সেই চোখ বুজে থাকার মধ্যে বদু যেন টের পেল সেজলের নীচে শুয়ে আছে আর ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে আরও নীচে।
তার মানে বদু সমুদ্রে ডুবে গেছে।
ডুবে গিয়ে ক্রমেই নীচে নেমে যাচ্ছে। বদু আবার চেঁচিয়ে উঠতে চেষ্টা করল, আমি তবে মরে যাইনি কেন? সমুদ্রে ডুবে গেলে কি মানুষ বাঁচে?
কিন্তু বদু বুঝতে পারল তার চারিদিকে জল বলেই এমন হচ্ছে। তখন বদু আবার আশ্চর্য হয়ে ভাবল, কিন্তু আমি মরে যাচ্ছি না কেন? আমি জল খেয়ে ফেলছি না কেন অনেক? জলে ডুবে গেলে তো জল খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে মরে যায়।…
বদুর প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
চারিদিকে জল বয়ে যাচ্ছে নি:শব্দে, স্থির গভীরভাবে। ভয়ে দুঃখে রাগে বদুর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল, বদু বেচারা জলে ডুবে গেল আর কেউ তাকে তুলল না? মা, বাবা, ঠাকুমা, আর ওদের সেই মেজোমামা, সবাই তো ছিল।
আচ্ছা আমি কখন ডুবে গেলাম?
বদু চোখ বুজেই মনে করতে চেষ্টা করল আস্তে আস্তে, সেই বেড়াতে আসা— আর বালির ঝড়ের কথা মনে পড়ে গেল।—সেই সময়, সেই ঝড়ের সময় ডুবে গেছে বদু, সমুদ্রের ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু জলের তলায় এরকম একটা জায়গা থাকে? যেখানে তলিয়ে গেলে মানুষ মরে যায় না? বেশ ভাসতে ভাসতে এগোতে পারে? অথবা শুয়ে শুয়ে ভাসতে পারে? ভাবতে ভাবতে বদুর একটু কৌতূহল হল। কান্না পাওয়াটা গেল। বদু আস্তে আসতে চোখ খুলল। তখন বদু বুঝতে পারল, সমুদ্রের তলায় আর একটা রাজ্য আছে। বদু ডুবে গিয়ে তলিয়ে সেই রাজ্যে চলে এসেছে। আর এও বুঝতে পারল, বদুর চারিদিকে জল ঢেউ তুললেও বদুর ডুবে মরে যাওয়ার বা জল খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে মরে যাওয়ার কোনো ভয় নেই, বদু যেন একটা কাচের ঘরের মধ্যে রয়েছে, বাইরে জলের স্রোত বয়ে যেতে দেখছে।
কিন্তু সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে বদুরা যে বিরাট ঢেউ দেখত, সেরকম নয়। এ শুধু প্রবল একটা স্রোত যে— বয়ে চলেছে।
আচ্ছা বদুকে এই কাচের ঘরের মধ্যে ভরে দিল কে? নাকি একেই ‘স্ফটিক দ্বীপ’ বলে? মা একদিন গল্প বলেছিল, সমুদ্রের তলায় একটা বিরাট রাজ্য আছে। সেখানে রাজা আছে, রানি আছে। রাজকন্যা, রাজপুত্র আছে। সেপাই আছে। আর রাজ্যের মধ্যে ভাগে ভাগে নানান দ্বীপ। স্ফটিক দ্বীপ, প্রবাল দ্বীপ, মুক্তা দ্বীপ, ঝিনুক দ্বীপ।
এখন বদুর মনে হল, তা সমুদ্রে ডুবে গিয়ে বদুর একরকম লাভই হয়েছে। এই সমস্ত দেখতে পাবে বদু। কিন্তু তাই কি? বদুকে হয়তো এই রাজ্যের লোকেরা দেখতে পেয়ে মেরে ফেলবে। হায়! মাও যদি বদুর সঙ্গে ডুবে যেত। তাহলে কারও সাধ্য ছিল না বদুকে মেরে ফেলতে। মা সঙ্গে থাকলে বেশ সব বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিত। আর তারপর সব দেখাটেকা হয়ে গেলে বদুকে আবার টেনে তুলে নিয়ে সমুদ্রের উপর চলে যেত।
কিন্তু মা কি সাঁতার জানে?
ভাবতে ভাবতে বদুর মাথা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ফের ঘুমিয়ে পড়ে বদু।
কতক্ষণ, কী কতদিন ঘুমিয়ে থেকেছিল বদু কে জানে। আবার যখন ঘুম ভাঙল, দেখল গভীর অন্ধকারের মধ্যে ছায়া-ছায়া একটা আলো, আর সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে বদুর পাশের জলে কাচের দেয়ালের বাইরে ইয়া মোটা মোটা সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেমন তাদের মামার বাড়িতে কাচের বাক্সর মধ্যে লাল মাছ ঘুরে বেড়ায়।
বদু ভয়ে কেঁপে ওঠে, হঠাৎ যদি বদুর এই কাচের বাক্সটা ভেঙে যায়। বদু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে না, ওরা বদুর দিকে তাকাচ্ছে, না আপনমনে জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, না গোল হয়ে হয়ে খেলা করছে।—কিন্তু তারপর ওকী? ওরে বাবা। কী বিরাট বিরাট কাঁকড়া। প্রকান্ড প্রকান্ড দাঁড়া। এরা নিশ্চয় বদুকে ওই দাঁড়ার মধ্যে চেপে মেরে ফেলবে।
ভয় ভয়। ভয় করতে করতে কেন কে জানে হঠাৎ বদুর ভয় চলে যায়।
থাক যাগ গে, বদু তো মরেই গেছে আর কী বদু এই সমুদ্রের তলা থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে? তা যখন নয়, তখন আর বদুর সাপেই বা ভয় কী, কাঁকড়াতেই বা ভয় কী! বদু তখন শুধু শুয়ে শুয়ে ভাবছে, বদুকে হারিয়ে মা কী করছে! কী করছেন বাবা আর ঠাকুমা!
ওঁরা কি এখনও সেই আগের মতো খাচ্ছেন দাচ্ছেন বেড়াচ্ছেন ঘুমোচ্ছেন? আর মাঝে মাঝে শুধু বলছেন——বদুটা হারিয়ে গেল!
একথা ভাবলেও তো কান্না পেয়ে যায়। বদু নেই অথচ ওঁরা ঠিক আগের মতোই—
হঠাৎ বদুর পেটের মধ্যে যেন একটা পাক দিয়ে উঠল। আর তখনই টের পেল বদু, ওর খুব খিদে পেয়ে গেছে।
খাওয়া দাওয়ার কথা ভাবতে গিয়েই কি?
বদুর এখন জীবনপুরের সেই বাড়ির রান্নাঘরের সামনেটার কথা মনে পড়ে গেল। বদু টেবিলের ধারে একটা উঁচুমতো চেয়ারে বসেছে। আর মা গরম রুটি আলুভাজা আর গুড় দিয়ে একটা থালা সাজিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘নিজে নিজে খা বদু, লক্ষ্ণীছেলে।। আমার এখন অনেক কাজ পড়ে। তোকে খাওয়াতে বসলে তো আর রক্ষে নেই।’
রাত্রে বদুর নিজে নিজে খেতে ইচ্ছে করে না। খেলেই তো হাতটা ধুতে হবে। তার থেকে অনেক ভালো মা খাইয়ে দেবেন আর বদু মনের আনন্দে শেলেট নিয়ে ছবি আঁকবে।
কিন্তু এখন যদি বদু গরম রুটি আলুভাজা আর গুড় পায় তাহলে এক মিনিটে খেয়ে নিতে পারে। আহা বদুকে যদি কেউ এখন—
হঠাৎ বদু শুনতে পেল, কে যেন কোথা থেকে খুব টিনটিনে গলায় বলে উঠল, কী গো বদুবাবু, এখন তাহলে তোমার রুটি খেতেও আপত্তি নেই? বেশ বেশ। শুধু-শুধুই তাহলে মাকে জ্বালাতন করতে?
বদু চমকে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে একটা মস্ত মাপের লালমাছ তার কাচের ঘরের বাইরে থেকে উঁকি মারছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, লাল মাছটার মুখটা ঠিক একটা ছোট্ট সুন্দর মেয়ের মতো। মাথাভরতি চুল, ঠিক মানুষদের ঘরের মেয়ের মতো মিষ্টি হাসি, শুধু গলা থেকে নীচপর্যন্ত স্রেফ একটা লাল মাছ। ঠিক যেন মেয়েটা লাল রেশমি ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তা কেন? ফ্রকের নীচেটা কি মাছের ল্যাজার মতো হয়? তার নীচে পা থাকে না?
এ কী তবে কোনো পরি? না পরিমাছ?
বদু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে সেই মাছপরি বা পরিমাছ হেসে উঠে বলল, ‘কী? খুব অবাক হয়ে গেছ বুঝি? তা যেতেই পারো। কখনো তো দেখোনি আমাদের? এইবার অ—নে—ক কিছু দেখতে পাবে যখন আমাদের রাজ্যে চলে এসেছ, তখন সবই দেখতে পাবে।’
বদু কষ্টে বলে, ‘আমি বুঝি নিজে ইচ্ছে করে চলে এসেছি? সমুদ্দুরের ঢেউ আর বালির ঝড়েতে আমায় নিয়ে এসেছে।’
‘আহা তা তুমি যে ভাবেই আসো, এসেছ তো?’
বদু রাগ-রাগগলায় বলে, ‘তুমি কে?’
‘আমি? আমি তো রুইতন। আমার বাবা হচ্ছেন মাছেদের মধ্যে সেরা মাছ। সব মাছের থেকে দাম বেশি। মানে আমি হচ্ছি রাজকন্যা।’
বদু আরও রেগে বলে, ‘ইঃ ভারি রাজকন্যা। আমি তোমায় ভেজে খেয়ে নিতে পারি তা জানো?’
‘আহা, খাও না দেখি।’
মাছপরি এক ঝাকায় ঘুরে নাচের মতো পাক খায় আর তার ল্যাজের তাড়ায় জলে মস্ত ঘূর্ণি ওঠে।
বদু অবাক হয়ে তাকায়।
মাছপরি আবার দুষ্টু হেসে বলে, ‘কই খাও ভেজে।’
বদু কড়া গলায় বলে, ‘এখন কী করে খাব? জেলেরা জাল ফেলে তোমায় তুলে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করে দেবে, তখন বাবা কিনে নিয়ে বাড়িতে আনবেন, মা বঁটিতে কেটেকুটে—’
মাছপরি চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ওঃ, তোমরা মানুষেরা কী নিষ্ঠুর! আমরা তোমাদের কিছু ক্ষতি করি না, বলো, করি কিছু? কিচ্ছু না, জলের তলায় ঘুরে বেড়াই, গান গাই, সাঁতার কাটি, আর তোমরা আমাদের জালে ফেলে মেরে ধরে কেটেকুটে ভেজে খেয়ে ফেলো। ছি:।’
শুনে বদুর হঠাৎ ভারি লজ্জা হতে থাকে। বদুর মুখ নীচু হয়ে যায়।
মাছপরি তখন নরম গলায় বলে, ‘তা তোমার আর কী দোষ বলো? তুমি যা দেখছ তাই শিখছ। চিরকাল মানুষ এইসব কান্ড করে আসছে, জান? আকাশের পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায়, তাকে তোমরা ধরে খাও। বন্যজন্তুরা বনে ঘুরে বেড়ায়, তাদের তোমরা মেরে ফেলে মাংস খাও।’
বদু আরও লজ্জা পায়।
আস্তে বলে, ‘আমি, আমি আর মাংস খাব না।’
মাছপরি হেসে উঠে বলে, ‘আহা, তুমি না খেলেই যেন সব হল। আর সবাই খাবে না? তোমাদের পৃথিবীসুদ্ধু লোক? থাক গে যাক— এখন তোমার তো খিদে পেয়েছে, কী খাবে?’
বদু বলে, ‘কে বললে আমার খিদে পেয়েছে?’
‘আমিই বলছি।’
বদু ফট করে বলে ওঠে, ‘রুটি আলুভাজা আর গুড় দিতে পারো?’
মাছ রাজকন্যার কথার সঙ্গে সঙ্গেই বদু অবাক হয়ে দেখল, সেযেন ওই মেয়েটার পিছু পিছু সরসর করে এগিয়ে চলেছে কোনদিকে। আরও নীচের গভীরে না সোজাসুজি—কে জানে।
বদুর চারধারে তেমনি জলের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে প্রকান্ড জলসাপ, বিদঘুটে মাছ, ধাড়ি ধাড়ি কাঁকড়া, বিরাট দাঁড়াওয়ালা চিংড়ি মাছ। এই মাছগুলোকে দেখলে খাবার কথা ভাবাই যায় না, বরং মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে ওরাই মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে।
তবে বদুর এখন ভয়টা একটু কমে গেছে। বদু বুঝতে পেরেছে, বদু শক্ত আর স্বচ্ছ একটা বাক্সমতো কোনো জায়গার মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে থেকে বাইরেটা দেখতে পেলেও, ওরা কামড় দিতে আসতে পারবে না। তা ছাড়া বাঁচা মরা সমান, এটা ভেবে ফেললে আর ভয়-টয় থাকে না।
তবু বদুর বুকের মধ্যে কি জলের ঢেউয়ের মতো একটা কান্নার ঢেউ উথলে উথলে উঠছে না? বদুকে এখানে সাপে কি রাক্ষুসে কাঁকড়ায় শেষ করে ফেলবে। বদুর মা-বাবা কি বন্ধু-টন্ধু জানতেও পারবে না। এর থেকে দুঃখের আর কী আছে!
যাক যা হবার হবে।
এখন দেখা যাক বদুকে মেয়েটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে হঠাৎ সব যেন কালো অন্ধকার হয়ে গেল। কেমন যেন একটা হালকা জ্যোৎস্নার মতো আলোয় সমুদ্রের তলার দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছিল। সেটা একদম ঢেকে গেল।
হঠাৎ বদু যেন তার মার গলার শব্দ শুনতে পেল। সেই শব্দটা যেন কেঁদে খেঁদে বলে উঠল, ‘রুটি আলুভাজা! ওগো আমি কী করব গো।’
বদু এই গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুলতে গেল, পারল না। চোখ দুটো যেন কে আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে। ভগবান জানেন বদুকে নিয়ে কে কী করছে।—কিন্তু মা কেন কেঁদে কেঁদে কথা বলল? বদু রুটি আলুভাজা খেতে চাইছে, একথা মা শুনলই বা কোথা থেকে?
না:, বদু আর ভাবতে পারছে না, বদুর মাথা ঝিমঝিম করছে।
কে জানে, কতক্ষণ পরে বদু সেই অন্ধকার জায়গাটা থেকে আলোয় এল। ঝাপসা হালকা শেষরাত্রির মতো আলো। বদু দেখল সেএকটা মস্ত ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার সামনে পেছনে চারপাশে লোক গিসগিস করছে, কথাও কইছে, কিন্তু কোন ভাষায় কথা বলছে, তা বুঝতে পারল না।—বদু তাকাতে তাকাতে অবাক হয়ে দেখল, লোকগুলোর মুখটুখগুলো দাড়িগোঁফঅলা, কিন্তু গলার নীচ থেকে সেই একই কান্ড! সেই টুকটুকে রাজকন্যার মতো স্রেফ মাছ।
প্রথমটায় বদু হঠাৎ মনে করেছিল, ওরা বুঝি সব গলাবন্ধ লম্বা ঝুল কালো কোট পরেছে। এখন বুঝল, ওদের দেহটা মাছই, শুধু মেছো গড়নের মুখের বদলে হাড়কুচ্ছিৎ মানুষের মুখ।
আশ্চয্যি। ওই মানুষমুখো মাছগুলোকে কিন্তু কী মাছ তা চেনাও যাচ্ছে। অবশ্য বদু যতটা চেনে। বদু তাকিয়ে ভাবল, ওইটা রুইমুখো, ওইটা ভেটকিমুখো ওইটা মাগুরমুখো, ওইটা ইলিশমুখো।
ওরা সকলেই যেন দারুণ উত্তেজিত, আর সকলেই যেন বদুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী বলছে। ওরা কি তাহলে সবাই মিলে বদুকে খেয়ে ফেলবে?
এখন তো আর বদু স্ফটিকের বাক্সের মধ্যে নেই। মস্ত হাঁ করে এগিয়ে এলেই হল। বদুর বুক ফেটে কান্না এল।
সেই আহ্লাদী মেয়েটাই বা কোথায় গেল? যে বদুকে এইখানে নিয়ে এল? বদু দিশেহারা হয়ে চারিদিক তাকাতে তাকাতে দেখতে পেল আসছে সে। আরে কীসের পিঠে চড়ে আসছে? দেখে বদু হাঁ।
আসছে বিরাট একটা কোমরের পিঠেয় চড়ে। বদু এখন আর একবার মনঃস্থির করে ফেলে, মরতে তাকে হবেই, তবে আর ভয় করে লাভ কী।
কিন্তু অঘটন আজও ঘটে।
মরতে তো হলই না বদুকে, বরং বদুও ওই মেয়েটার মতো কুমিরের পিঠে চেপে আরও গভীর সমুদ্রে নেমে গেল। মেয়েটা বদুর কাছে এসে কুমিরকে যেন কী ইশারা করল, কুমিরটা ল্যাজের ঝাপটায় বদুকে পিঠে তুলে নিল।
তবে বদুর তখন আর জ্ঞান রইল না। কুমিরের ল্যাজের ঝাপটা খেয়ে কত বাঘা বাঘা লোকই বলে জ্ঞান তো বটেই প্রাণও হারায়, আর এ তো ছোট্ট বদু।
ভাগ্যিস বদু প্রাণ হারায়নি, তাই বদুর আবার জ্ঞান হল। আর তখন বদু অবাক হয়ে দেখল, সেবিরাট একটা প্রাসাদের একটা ঘরের মধ্যে ফর্সা ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে।
বদুর খাটের ধারে এক জোড়া সিংহাসনে দুই রাজারানি বসে। মাথায় হিরের মুকুট ঝকমক করছে, গায়ে সোনার পোশাক ঝলমল করছে, গলায় মুক্তোর মালার গোছা, পোশাকের গায়ে নানা রঙের ঝিনুকের কারুকার্য।
বদু তাকিয়ে দেখল।
বদুর মনে হল, এদের যেন আগে কোথায় দেখেছে। বদু ভাবতে চেষ্টা করে, কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করে আসে। তবু একটু একটু মনে পড়ে, কোথায় যেন চেয়ারে বসে বসে দেখছে এদের বদু। পাশের চেয়ারে বোধ হয় মা, এ দিকের চেয়ারে বাবা না কে। হয়তো বাবাই। এই অগাধ সমুদ্রের নীচে চেয়ার পেতে বসে মা-বাবা আর বদু এদের দেখেছে কী করে কে জানে। তবে কি? তবে কি বদু তার আগের জন্মের মা-বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিল। যে আগের জন্মের কথা ভাবে বদু।
তাই হবে। আগের জন্মেই।
ঠিক এইরকম মাছের রাজারানিকে সিংহাসনে বসে থাকতে দেখেছে বদু, আর মাথার কাছে মাছ-পরিরা চামর দোলাচ্ছে।
এরা বোধ হয় বাংলা কথা জানে না, শুধু ওই রাজকন্যেটা জানে।
কোথা থেকে কে যেন বলে উঠল, এ বলছে রুটি আলুভাজা আর গুড় খাবে।
বদু ওকে দেখতে পেল না।
আবার শুনতে পেল, সেতো এখন নেই বাবু, এখন এই জলটা খাও।
শুনে বদুর রাগে মাথা জ্বলে গেল। এই জলের তলায় পড়ে আছে বলে বদু শুধু জলই খাবে? তা ছাড়া কে যে কোথা থেকে বলছে কথাগুলো! গলাটা যেন চেনা চেনা। এ গলা কি সেই রাজকন্যের? তবে সামনে আসছে কেন আর? আচ্ছা ও তো কিছু সোনার জামা মুক্তোর মালা হিরের মুকুট পরেনি? তবু বদু তাকে রাজকন্যে বলেই চিনতে পারল কী করে? দুর ছাই, কোথায় যে গেল!
বদু বলে উঠল,‘আমি জল খাব না।’
তখন হঠাৎ মাছের রাজার সিংহাসনটা নড়ে উঠল। আর তার ঠোঁটটাও। সিংহাসনটাকে ঠেলে দাঁড়িয়ে উঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘তবে কী খাবে? আমাদের?’
বদু বলল, ‘বা: রে, আমি কি তাই বলেছি?’
মৎস্যরাজ ঘাড় নেড়ে নেড়ে বললেন, ‘তুমি তা বলনি। কিন্তু তোমরা—মানুষরা তো তাই বল। …তোমাদের মতো এমন লোভী, পেটুক ও হিংস্র জাত পৃথিবীতে আর আছে নাকি? বনের বাঘেদের থেকেও তোমরা অধম।…বাঘরা তো শুধু মানুষ কী জন্তুটন্তু খায়, আর তোমরা জন্তু জানোয়ার থেকে শুরু করে আকাশের পাখি, জলের মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সাপ, ব্যাং, গাছপালা, ফুল, পাতা কী না খাও?…মাটির নীচে যা জন্মায়, তাও খুঁড়ে খুঁড়ে খাও! জন্তুদের খাবার জন্যেও কিছু রাখতে চাও না।… শুধু কী এই? যেসব জন্তুদের তোমরা খেতে পারো না, হয় তাদের পোষার ছল করে চাকর বানিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিয়ে নাও, নয় তো তাদের হাড়, চামড়া, দাঁত নখ, নাড়ি, পিত্তি নিয়ে কাজে লাগাও নিষ্ঠুরভাবে তাদের মেরে মেরে। হাতি খাও না, তার দাঁত ভেঙে নাও। কুমির তোমারা খাও না অথচ কুমিরা মেরে তার ছাল ছাড়িয়ে শখের জিনিস বানাও। বাঘ খাও না, তার ছাল নিয়ে আসন বানাও। নখ দিয়ে গয়না বানাও। ঘোড়া গাধা এদের নিয়ে কি না কর? … আর আমাদের মাছদের নিয়ে কীভাবে খাও ভাবো! কুচো কুচো বাচ্চাদের পর্যন্ত চচ্চড়ি বানিয়ে, চাটনি রেঁধে—ছি: ছি:! ডিমগুলোকে পর্যন্ত—ছ্যা: ছ্যা:।’
শুনতে শুনতে বদু ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলে ওঠে, ‘তা আমায় বকছ কেন? আমি ওসব করি? আমি তো মাছ খেতেই চাই না। বড়োরা তো ও সব—’
মাছের রাজার মুখটা ঘৃণায় বেঁকেই যায় প্রায়।
সেই বাঁকা মুখে বলে সে, ‘তুমিও একদিন বড়ো হবে, আর ওইসব করবে। মনে করবে পৃথিবীটা একা তোমার জন্যেই। আকাশ, পাতাল, মাটি, জল, নদী, পাহাড়, সমুদ্র সবের মালিক তুমি। তুমি সব নেবে, সব খাবে, সব দখল করবে, ছিঁড়বে কাটবে যা ইচ্ছে বানাবে। …কী করে যে তোমাদের মাথায় এত আসে তাই ভাবি। …কিছু না পারো তো পৃথিবীর যা কিছু আছে সব নিয়ে ছেঁচে কুটে ওষুধ বানাবে, এসেন্স বানাবে, তেল বানাবে। …কত লক্ষ লক্ষ জিনিসই যে তোমাদের দরকারে লাগে। কই, আর কোনো জীবজন্তু তো তোমাদের মতন লোভী নয়? এমন পেটুক নয়?’
বদুর এত কথা শুনতে শুনতে রাগ এসে গেল। তখন চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বেশ তো, আমাকেও তোমরা কেটেকুটে ভেজে খেয়ে ফেল না। আমি তো মরেই যেতে চাই।’
বদু তখন হি হি করে একটু হাসির শব্দ শুনতে পেল। …ও, সেই মাছপরিটা মানে সেই রাজকন্যেটা বদুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে হাসছে।
বদু আরও রেগে গেল, বলল, ‘শুধু শুধু হাসছ কেন?’
সোনালি লালচে ল্যাজটা ঝাপটা মেরে মেয়েটা হি হি করে বলল, ‘হাসছি তোমার রাগ দেখে। বাব্বা:। রুটি না পেয়ে— আচ্ছা বাবা আচ্ছা—রুটি পাবে।’
বদু বলল, ‘আমি কিছু চাই না। আমরা, মানুষরা যখন এত খারাপ, তখন আমাকে মেরেই ফেলো, বলছি তো।’
এবারে মাছের রানি কথা বললেন।
বললেন, ‘আহা, ছেলেমানুষকে অমন কষ্ট দিচ্ছ কেন তোমরা? ওকে ঘুমুতে দাও।’
মাছের রাজা গোঁফের ফাঁকে একটু হেসে বলেন, ‘আরে বাবা ঘুমোতে না দেবার জন্যেই তো এত কথা! অনেক ঘুমিয়েছে। এখন জেগে থাকা দরকার।’
বদু রেগে চেঁচিয়ে বলে, ‘কে বলেছে দরকার? আমি ঘুমোব না, ব্যস!’
মাছ-রাজা দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, ‘বেশ ঘুমিয়ো না, আমার দারুণ ঘুম পেয়েছে, আমি যাচ্ছি ঘুমোতে—’ বলেই বিরাট একটা হাই তোলেন।
হাই দেখে বদুর মাথা ঘুরে যায়।
মুখটা মানুষের মতো হলেও, হাঁ-টা ঠিক প্রকান্ড রুই মাছের হাঁয়ের মতো।
ওই হাই তোলার সঙ্গে সঙ্গে, রাজার মাথার হিরের মুকুট ঝমমকিয়ে উঠল, গায়ের রঙিন ঝিনুক বসানো সোনার জামা ঝলমলিয়ে উঠল, গলার মুক্তোর মালা দুলদুলিয়ে উঠল, বদু সেইদিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, এখন হঠাৎ মহারানিও হাই তুললেন। বদু ভয়ে চোখ বুজে ফেলে বালিশে মাথা গুঁজল।
আর সেই সময় বদুর কপালে কে একটা ঠাণ্ডা হাত রাখল। বদুর মনে হল, হাতটা ঠিক মার মতো। যদিও বদু জানে, এখানে মা আসতেই পারে না, তবু বদুর কপালটা যেন জুড়িয়ে গেল। যদু ওই জুড়িয়ে যাওয়াটাকে অনেকক্ষণ ভোগ করবে বলে, চোখটা বুজেই থাকল। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে চোখ খুলে বদু যা দেখল তাতে অবাক হয়ে গেল।
বদু কি স্বপ্ন দেখছে?
বদু নামের ছোট্ট ছেলেটা ঝড়ের ধাক্কায় কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ার পর তার বাবা মার অবস্থা বোঝা শক্ত নয়। পিসঠাকুমা বুড়ি তো মাথার যে কটা চুল ছিল ছিঁড়ে ছিঁড়ে শেষ করে ফেলে বুক চাপড়াচ্ছেন আর আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছেন, ওরে আমি কেন মরতে তোদের এখেনে টেনে নে এলাম। হে জগন্নাথ, কেন তুমি এমন করলে। ওরে সর্বনেশে সমুদ্দুর। ওই একফোঁটা ছেলেটুকুকে গ্রাস করে তোর কী লাভ হল রে?
এইরকম সব কথা।
কান্না তার ফুরোয় না।
ওদিকে বদুর নতুন পাওয়া বন্ধু আর তার মেজোমামা ও বাড়ির আর সকলের মুখ চুন! কী হতে কী হল।
বদুর মা তো অনেকক্ষণ থেকেই বলছিলেন এবার ওঠা যাক। বড়ো বেশি হাওয়া। তাঁরাই তো হেসে হেসে বলেছেন, বসুন না, আর একটু বসুন। হাওয়া খেতেই তো পয়সা-কড়ি খরচ করে আসা, হাওয়া দেখে ভয় পেলে চলবে কেন?
কথা আর গল্পের মাঝখানে হঠাৎ এই বালির ঝড়টা উঠল। কে জানত সমুদ্রের ধারে এমন হঠাৎ ঝড় ওঠে।
উঠল, উঠল— তা বলে আস্ত একটা ছেলেকে হাপিস করে দিল?
সারারাত ধরে চলল খোঁজাখুঁজি।
সকালবেলা পুলিশে খবর দেওয়া হল, নুলিয়াদের বখশিশ দিয়ে দিয়ে চারিদিকে জেলেডিঙি পাঠানো হল, কিন্তু বদুকে আর পাওয়া যায় না।
বদুর বাবার যে ছুটি ফুরিয়ে গেছে সেকথা আর মনে থাকে না তাঁর, তিনি এই পুরীতেই পড়ে আছেন। কিন্তু বদুর বন্ধুরা তো আর চিরকাল পড়ে থাকতে পারে না? তাদের চলে যেতেই হল। আর ‘মেজোমামার’ জিম্মায় পাঠিয়ে দেওয়া হল বদুর বাবার পিসিকে। বুড়োমানুষ কী আর করবেন বিদেশে পড়ে থেকে, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, কেবলই কান্নাকাটি।
পড়ে আছে শুধু বদুর মা-বাবা।
তাদের তো প্রতিজ্ঞা, ছেলেকে না পেলে চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে এই শ্রীক্ষেত্রেই পড়ে থাকবে। ভগবান যদি খেতে দেন তো খাবে, যদি না দেন, না খেয়েই মরবে। বদুকে হারিয়ে ফেলে আবার জীবনপুরে ফিরে লোকের সামনে মুখ দেখানো? অসম্ভব!
বদু না থাকলে আর রইল কী তাঁদের?
এখন একমাত্র লক্ষ্য রইল তাঁদের বদুকে খোঁজা।
তা সাধনার সিদ্ধি হয়।
অবশেষে প্রায় দু-সপ্তাহ পরে বদুকে পাওয়া যায়।
একটা নুলিয়া এসে খবর দেয়, অন্য একটা বুনো নুলিয়ার বাড়িতে নাকি একটা ছেলে রয়েছে। ছেলেটাকে তারা একদিন সমুদ্রের ধারে বালির ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে।
কোনদিন তা অবশ্য বলতে পারল না।
ছুটে চলে গেলেন বদুর বাবা, সঙ্গে পুলিশ, কী জানি ওই বুনো নুলেরা যদি না ছাড়ে ছেলেটাকে। যদি বলে, সমুদ্রের দেবতা তাদের দিয়েছে, তারা দেবে কেন?
বদুর বাবার এই ভয়টা অবশ্য খুব অমূলক নয়। প্রথমে তারা তাই ভেবেছিল, চাঁদের মতো ফুটফুটে একটা ছেলে হঠাৎ সমুদ্রের ধারে পড়ে আছে, ধারে পাশে কেউ কোথাও নেই, এমন তো কখনো দেখেনি। ঝড় তো কতই হয়। এ নিশ্চয় দেবতার দান।…
কিন্তু ছেলেটা যে অজ্ঞান অচৈতন্য। নিজেদের বুদ্ধিমতো অনেক চিকিৎসা তারা করেছে, কিন্তু ফল কিছু হয়নি। ছেলেটা জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, অথচ কত কী কথা কয়ে যাচ্ছে।
বিকারের রোগী যেমন কথা কয়ে ওঠে, আপনমনে বিজ বিজ করে, তেমনি। কিন্তু ছেলেটার ভাষা নুলিয়াদের কাছে দুর্বোধ্য, কাজেই বুঝতে পারছে না কিছু।
বদুর বাবা সেই সংবাদদাতা-নুলিয়াটাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন এদের কুঁড়েঘরের সামনে। জেলেপাড়া, শুঁটকি মাছের গন্ধে চারিদিক ভরতি। …এখানে ওখানে মাছধরার জাল শুকোচ্ছে, তা থেকেও আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে।
বদুর বাবা নাকে রুমাল দেন।
কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে আসে একটা কালো কুচুকুচে ঢ্যাঙামতো লোক। মাথার তার নানান-রঙা পাখির পালক গোঁজা কাগজের মুকুট, গলায় গোছা ভরতি মালা— নানান রঙের কড়ির ঝিনুকের , আর পাথরের।
বুনো প্যাটার্নেরই বটে।
ওর ভাষা ওদের দেশের লোকই বুঝবে, কাজেই খবরদাতা, নুলিয়াটা দোভাষীর কাজ করে ব্যাপারটা দু-পক্ষকেই বোঝাল। এবং এই ভদ্রলোকই যে ছেলের বাবা তা বলে ছেলেকে এঁদের দিয়ে দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলল, এদের সঙ্গে পুলিশ আছে।
পুলিশকে ভয় সকলেরই, অসাধুরও—সাধুরও। চোর ডাকাত না হলেও,এদেরও ভয়ভয় ভাব।
বলল, ‘নিয়ে যাবে যাও, তোমাদের ছেলে বলছ যখন তবে সাবধান, জেনো ছেলেকে অপদেবতায় ভর করেছে। দেখবে মাথা চাল্লি করবে, নিজমনে কথা বলবে, কখনো হাসবে, কখনো কাঁদবে।’
বদুর বাবা জানেন, এই সব আদিবাসী বা বুনো লোকেরা কোনো শক্ত অসুখ দেখলেই ভাবে অপদেবতা ভর করেছে।
তবে এদের সন্তুষ্ট করতে বললেন, ‘বলো বাপু, কী করে এর শাস্তি হয়?’
ওরা যা বলল তার অর্থ হচ্ছে— সমুদ্রের কাছে জানিয়ে অবদেবতার নামে কিছু প্রাণী উৎসর্গ করতে হবে। মুরগি হোক, পায়রা হোক, কাক হোক।
বদুর বাবা বললেন, ‘ওসব তো আমার জানা নেই বাপ তোমরাই দিয়ে দিয়ো। —এই নাও পঁচিশ টাকা আর এতদিন যে ছেলেটা তোমাদের কাছে ছিল, সেবা যত্ন করেছ, তার জন্যে’— বলে আরও একশো টাকা দিতে যান, ভেবেছিলেন খুব খুশি হয়ে যাবে বুনো নুলিয়াটা।
কিন্তু তা না হয়ে, হল উলটো কান্ড।
রেগেই উঠল লোকটা।
দেবতা ওর ঘরে অতিথি পাঠিয়েছেন, ও সাধ্যমতো যত্ন করেছে, তারজন্যে টাকা নেবে কেন? ও কি চোর? না ভিখিরি?
বদুর বাবা ওর ভাষা জানেন না, তবু এসব আর দোভাষীকে দিয়ে বুঝতে হল না। লোকটার হাত পা নাড়া আর মুখভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললেন।
তাই এবার আবার অন্যপথ ধরতে হয়, নুলিয়াকে বলতে হয়, বাবু হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন তাই আনন্দ করে ওর ছেলে মেয়েকে মিঠাই খেতে দিচ্ছেন।
তখন বুনো নুলিয়াটা নরম হল।
কী একটা নাম ধরে অদ্ভুত সুরে ডাক দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল বদুরই বয়সি একটা মেয়ে।
লোকটা বোধ হয় মেয়েটাকে বলল হাত পাততে, কারণ মেয়েটা এগিয়ে এসে ডানহাতটা পাতল। এই নুলিয়াটা একটু হেসে বলল, ‘বাবু, আপনি বলেছেন ছেলেমেয়ে মেঠাই খাবে তাই মেয়ের হাত দিয়ে নেবে। নিজে নেবে না।’
কিন্তু মেয়েটা কী পরে বসে আছে? ঠিক মনে হচ্ছে যেন মানুষ-মুখো একটা মাছ। পায়ের কাছে ল্যাজটা লটপটাচ্ছে!
চেনা নুলিয়াটা হেসে বলল,‘তা তো মনে হবেই বাবু। আসলে ওটা জামা টামা কিছু নয়। স্রেফ একটা মস্ত বড়ো মাছের চামড়া।’
এ একরকমের বিরাট সামুদ্রিক মাছ, প্রায় কুমিরের মতোই তার শক্ত চামড়া।… সেই মাছের তেল থেকে ওষুধ তৈরি হয় বলে ব্যাপারীরা ওই তেল বার করে নিয়ে যায়। তারপর নুলিয়া জেলেরা মাছের মাংসটা কুরে বার করে নিয়ে খায়, আর চামড়াটা শুকিয়ে নিয়ে নানা কাজে লাগায়। জল ভরে আনবার থলি করে, জিনিসপত্র রাখবার ব্যাগ করে আবার ঠাণ্ডার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে ছোটো ছেলেমেয়েদের ওই চামড়ার খোলটার মধ্যে পুরেও রাখে।
শুনে বদুর বাবার এত দুঃখ হয়। আহা! বদুর যদি জ্ঞান থাকত, কী মজাই না পেত ও এসব দেখে শুনে।
যাক কী আর করা।
কোনোমতে সাবধানে গাড়িতে তোলা হল বদুকে, তারপর নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। বিদেশ বিভুঁই, হাসপাতাল ছাড়া গতি কী? তবে ঠিক হাসপাতাল নয়, নার্সিং হোমই বলা চলে।
ডাক্তার সামন্তর হাসপাতাল বলেই সবাই চেনে। এ খবরটা দিলেন হোটেলের ম্যানেজার বাবু।
যে হোটেলে পুরীতে এসেই উঠেছিল বদুরা। বদুর মা-বাবা তো সেখানেই থেকে গেছেন।
ওদের দুঃখ দেখে সকলেই মায়া মমতা দেখাচ্ছে।
বদুকে ডাক্তার সামন্তর হাসপাতালে ভরতি করে দেওয়া হল।… দিন রাত্তির কাটতে থাকে।… বদু শুধু স্বপ্ন দেখে।
সেই সমুদ্রের ঝড়ের দিন থেকে শুধু স্বপ্নই দেখে চলেছে বদু।
বদুর ছোট্ট মাথাটার মধ্যে যেন কারখানা চলছে একটা।
স্বপ্নাচ্ছন্ন বদুর মনে হল, সেস্বপ্নই দেখছে।
তা না হলে এই জলের রাজ্যে একটা বুড়ো থুড়থুড়ে মানুষ এল কোথা থেকে?
বদু চোখ দুটো আরও স্পষ্ট করে খুলতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখ দুটো যেন পাথর চাপানো রয়েছে। তবু টেনে খুলে দেখতে পেল, আরে। তার চারপাশে তো আর সেই জলের ঢেউ নেই। মাছ-রাজপরিবারও কোথায় হাওয়া।
দিব্যি শুকনো খটখটে একটা ঘরের মধ্যে ধবধবে একটা বিছানায় শুয়ে আছে বদু।তার খাটটা খুব সরুমতো আর ঘরের ধবধবে দেয়ালগুলোর কোনোখানে কিছু টাঙানো নেই। ছবি নয়, আরশি নয়, কোনো পুতুল টুতুলও নয়, এমনকী একখানা ক্যালেণ্ডার পর্যন্ত নয়।
এ ঘরটা কি বদু কখনো দেখেছে? মনে করতে পারল না।
বদুর দেখা সব বাড়িতেই তো দেয়ালে এইসব থাকে। এমন খাঁ খাঁ করা দেয়াল তো কই দেখেনি কখনো। তা ছাড়া ওই বুড়োটাই বা কে? বদু একে জীবনে কখনো দেখেনি, অথচ বুড়োটা তার শাদা ধবধবে লম্বা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বদুর দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে ফিক ফিক করে হাসছে, যেন সেবদুকে কতই দেখেছে।
বদুর এখন কারুর হাসি দেখলেই রাগ হচ্ছে, তাই বদু চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘হাসছেন কেন? আপনি?’
বুড়ো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, ‘হাসছি তোমার রকম সকম দেখে।’
বদু বলল, ‘আমার রকমটা কি খুব খারাপ?’
‘খারাপ নয় অদ্ভুত।’
‘অদ্ভুত? আমি অদ্ভুত?’ বদু তেড়ে উঠে বলে, ‘আমি যদি অদ্ভুত হই, আপনি তা হলে কিম্ভূত।’
বুড়ো এখন ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বলে উঠল, ‘শুধুই কিম্ভূত? আমি হচ্ছি গোভূত, মামদো ভূত, ফাঁকি ভূত, ঝাঁকি ভূত, আমার নামের কি শেষ আছে?’
‘তা আপনি আমার এখানে এসেছেন কী করতে?’
বুড়ো আরও ফ্যাক-ফেকিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘বা, বা, এ তো আচ্ছা মজা। তুমি এলে আমার এখানে— বলা নেই, কওয়া নেই, এখন আবার আমার উপরে উলটো চাপ। জান এইসব ঘরবাড়ি আমার।’
বদু ডাঁটের সঙ্গে বলে, ‘ঠিক আছে আমি আপনার বাড়িতে থাকতে চাইও না। আমায় ছেড়ে দিন, আমি আমার নিজের বাড়িতে চলে যাই।
বুড়ো বলল, ‘ওরে বাবা, এ যে দেখছি বড্ড বেশি মেজাজ। তাই আমি তো বাপু তোমায় ধরে রাখিনি, যাবে যাও। ওই তো দরজা, খোলাই রয়েছে।’
খোলা দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে দেয় বুড়ো।
বদু তাকিয়ে দেখে বাইরে একটা টানা লম্বা করিডোর, তার বাইরে ফুলের কেয়ারি করা বাগান, সেখানটা রোদে ঝকঝক করছে।
দেখে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করল, কিন্তু বদু কি জানে এ জায়গাটা কী? এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায় কী করে? আর কোনদিকেই বা তার বাড়ি?
বদু শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরেটা দেখে।
বদুকে চুপ করে থাকতে দেখে বুড়ো আবার মিষ্টি মিষ্টি হেসে বলে উঠল, ‘কই যাচ্ছ না যে? উঠে পড়ো।’
বদু এই অপমানে রেগে উঠে পড়তে গেল, কিন্তু পারল না। আর কে যেন ওর কপালে একটা হাত রেখে আস্তে বলল, ‘থাক থাক, এখন উঠতে হবে না।’
বদু চমকে উঠল। এই হাতটা কার? এত ঠাণ্ডা, এত নরম, এত মায়ায় ভরা। এই গলার স্বরটা কার? যেন কত চেনা, অথচ কতকাল যেন শোনা হয়নি। কত মাস কত বছর।
বদু উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ‘তুমি কে?’
সেই গলার স্বরটা আরও কোমল হয়ে এল, আরও যেন দুঃখে ভারী ভারী কাঁদো কাঁদো—‘আমায় চিনতে পাচ্ছিস না?’
বদু বলে উঠল, ‘তোমায় দেখতে পাচ্ছি না যে—’
‘এই তো, এই তো আমি। চিনতে পাচ্ছিস না?’ বলে ওই শান্ত মিষ্টিগলার মানুষটি মাথার কাছ থেকে সামনে সরে এল, বলল, ‘বুঝতে পাচ্ছিস না?’
বদু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল, কিন্তু হঠাৎ যেন সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে এল, তবুও বদু আসতে চোখ বুজে বলল, ‘পাচ্ছি।’
‘বল, বল তো, আমি কে?’
বদু চোখ বুজেই বলল, ‘জানি না। অনেক অ-নে-ক দিন আগে তোমায় দেখেছি।’
‘আমি কে মনে পড়ছে না?’
বদু আবার চোখ খুলল বলল, ‘আগে বোধ হয় তোমাদের কাছে থাকতাম।’
‘আগে? কোন আগে? অ-বদু?—’
ওই নরম গলার স্বরটা যেন কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তখন ওই বুড়োটা বলে ওঠে, ‘আহা, এখন থাক না এসব কথা।’
বদু। বদু। এই নামটা কতদিন যেন শোনেনি বদু। এরা বদুর এই নামটা জানল কী করে? বদু আবার ওই সামনে ঝুঁকে পড়া মুখটার দিকে খুব মন দিয়ে তাকিয়ে দেখে। বড়োই তো চেনা। যেন একশোহাজার বার দেখেছে, অথচ বুঝতে পারছে না কে! …এই কি তবে বদুর সেই আগের জন্মের মা? চিরকাল বদু যে জন্মটাকে ছায়াটাকে ছায়াছায়া ভাবে দেখেছে।
মাছ রাজকুমারী কি তাকে দয়া করে জল থেকে তুলে এনে এইখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে? বদু বলল, আগের জন্মে।
বদু এখন সেই কান্না কান্না গলার একটা কথা শুনতে পেল, ও কি তাহলে এইরকমই থেকে যাবে মিস্টার সামন্ত?
মিস্টার সামন্ত!
সেটা আবার কে? এই বুড়োটা বুঝি?
তাই হবে। বদু ভাবল, যেমন ছিরির দেখতে তেমন ছিরির নাম। আর কথাও তেমনি ছিরির। যেন বকে বকে বলে উঠল, অত অস্থির হচ্ছেন কেন? এইজন্যেই তো আপনাকে আটকানো হচ্ছিল। কান্না-টান্না করবেন না। তাহলে এ ঘরে আসতে দেওয়া হবে না।
তখন বদুর সেই আগের জন্মের মা চোখ মুছে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘আচ্ছা আর কিছু বলব না।’
বদুর এবার রাগ হল। বদু তেড়ে উঠে বলল, ‘না তুমি কথা বলবে, তুমি থাকবে।’ …আর তারপর বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই ঘরবাড়ি আপনার নিজের বলে কী মাথা কিনেছেন? চলে যান না বাইরে। ওই তো ওখানে অনেক ফুল টুল রয়েছে, নিনগে না।’
বুড়ো হাসতে হাসতে উঠে পড়ে বলে, ‘চলে গেলে তা চলবে না, এখন তোমায় ছুঁচ ফোটাতে হবে যে—।’
‘কী? কী বললেন? আমায় ছুঁচ ফোটাবেন?’
‘তা ফোটাবো বই কী বাপু? এই তো আমার পেশা।’
—বলে বদুর মাথার কাছে রাখা টেবিলটার কাছে সরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন করতে শুরু করে দিলেন।
বদু চোখ দুটো ট্যারা করে দেখবার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না কী করছে বুড়ো। বদু রাগে ‘ধ্যাৎ’ করে উঠল।
বদুর আগের জন্মের মা তখন নীচু গলায় বললেন, ‘ওকে এত রাগানো ভালো?’
বুড়োও নীচু গলায় বলল, ‘ভালো বই কী। না বুঝে সুঝেই কি করছি? রাগালে লাভ আছে, তবে— দোহাই আপনার মেমারির ওপর চাপ দেবার চেষ্টা করবেন না। ওতে অনিষ্ট হবে।’
নীচু গলা হলেও বদু শুনতে পেল। কিন্তু মানেটা ঠিক বুঝতে পারল না।
অনিষ্ট মানে কী? বদু কি একথা আগে কখনো শুনেছে? ‘মেমারি’ মানেই বা কী? চাপ দেওয়া বলতে কী বোঝায়? দুর বাবা… আর ভাবতে পারে না বদু। তার থেকে ঘুমোনো ভালো।
ঘুম ঘুম। এত যে ঘুম কেন বদুর চোখে?— জীবনপুরে তো বদুকে ঘুম পাড়াবার জন্যেই লাঠালাঠি করত মা।… মার কথা মনে হতেই বদুর কান্না পেল। আর কখনো কি সেই মাকে দেখতে পাবে বদু? হয়তো পাবে না। বদু যে এখন আগের জন্মের মায়ের কাছে চলে এসেছে।
এই মা-ও অবশ্য খুব ভালো। কী নরম হাত, কী মিষ্টি গলা। কিন্তু এ মা কখনো বদুদের জীবনপুরের দিকে সেই রেল কলোনির বাড়িটা দেখেছে?
ইচ্ছেটা না থাকলেও আবার ঘুমিয়েই পড়ল বদু। আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নরা সব মাথার মধ্যে কিলবিল করতে লাগল। জীবনপুর, সেখানে বন্ধুরা, রেলের বাঁশির প্রাণ হুহু-করা ডাক, লম্বা ঠ্যাকঠেকে কী যেন এক ঠাকুমা, পুরী—জগন্নাথ—মেজোমামা—সমুদ্র।
সমুদ্র মনে করতেই, তার ঢেউ গর্জন ঝড় আর ভয়ংকর একটা শব্দের দাপটে ওলট পালট হয়ে গিয়ে মাছেদের রাজ্যে চলে যাওয়া। মনে পড়ে যায়। পরপর নয়, এলোমেলো ভাবে— কিলবিলিয়ে বেড়াচ্ছে। যেমন কিলবিলোচ্ছে সাপগুলো, কাঁকড়াগুলো।… তার সঙ্গে মাছ রাজারানির মুকুটের ঝিলমিলানি।
বদু ওদের দেখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। হঠাৎ শুনতে পেল কে যেন বলছে, এত চেঁচাচ্ছে কেন?
গলার শব্দটা ভয় ভয়।
কিন্তু এই স্বরটাও তো বদুর চেনা। যেন বহুকালের ওপার থেকে ভেসে আসা এই স্বরটা শুনে আবার চমকে জেগে উঠল বদু আর অবাক হয়ে দেখল ঘরভরতি লোক।
সবই যেন চেনা মুখ, অথচ যেন আবার চেনা নয়ও। চুলটা রুক্ষু রুক্ষু, মুখটা দুঃখু দুঃখু গোঁফটা ঝোলা ঝোলা।
বদু খুব চেষ্টা করতে লাগল ভাবতে, কেন চেনা লাগছে কবে দেখেছে বদু এঁকে।
বদু সেটা ভেবে বার করবার আগেই ভদ্রলোক গম্ভীর মৃদু গলায় বললেন, ‘তার মানে আমরা ওর পূর্বজন্মের বাপ-মা?’
ধরে নাও তাই।
আর সেই সামন্ত বুড়ো বলে উঠল, ‘অত অধৈর্য হচ্ছেন কেন আপনারা? তাই যদি হয় ক্ষতি কী? হারানো মানিক তো ফিরে পেয়েছেন? এ জন্ম আগের জন্ম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ আছে কিছু?’
লাভ নেই সত্যি।
বদু তাই তার আগের জন্মের মা-বাপের কাছেই থেকে যায়। বদুর ক্রমশ আর সব সময় ঘুম পায় না। বদু বালিশে ঠেস দিয়ে বসে থাকে। আর বলে, ‘আচ্ছা আমি কেন সব সময় শুয়ে থাকি?’
‘তোমার যে খুব অসুখ করেছিল সোনা।’
‘এ বাড়িটা তো ওই দুষ্টু বুড়োর, তোমরা এ বাড়িতে থাকো কেন?’
‘ছি বাবা, ‘দুষ্টু’ বলতে নেই। উনি খুব দয়ালু লোক। এটা হাসপাতাল। উনিই এর মালিক। দয়া করে তোমাকে এতদিন থাকতে দিয়েছেন। তাই না তুমি সেরে উঠছ।’
বদু কেমন আনমনা গলায় বলে, তোমাদের বাড়িটা কোথায়?’
বদুর ‘আর জন্মের বাবা’ বলে ওঠেন, ‘সেঅনেক দূর।’
‘তাহলে তোমরা সেখানে থাক না কেন?’
‘আমরাও এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। তারপর তোমার অসুখ করল—’
বদু অবাক হয়ে বলে, ‘আমার অসুখ করল তো তোমাদের কী? তোমরা কি আমায় চিনতে?’
বদু তার পিঠের দিকে একটা চাপা শব্দ শুনতে পেল। —হাসি চাপার? না কান্না চাপার?
ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি যদি আমাদের চিনে থাক আমারই বা চিনব না কেন তোমাকে?’
বদু ঝাপসা গলায় বলে, ‘আমি তো তোমাদের আগের জন্মে চিনতাম। তখন তোমরা বোধ হয় আমার নিজের লোক ছিলে।’
এখন বদুর পিঠের দিক থেকে একটি হাসি কান্নায়-মাখা মুখ এদিকে উঁকি দিয়ে বলে ওঠে, ‘নিজের লোক ছিলাম? কীরকম নিজের বল তো?’
বদু আরও আবছা গলায় বলে, ‘কী জানি! হয়তো মা, বাবা।’
‘তা তোর নাম কী বল তো।’
বদু আস্তে বলে, ‘অনেকদিন আগে আমার নাম ছিল ‘বদু’। ’
‘এ মা! বদু আবার কী নাম? ভালো নাম নেই। ইস্কুলের নাম?’
বদু আস্তে মাথা নেড়ে বলে, ‘কী জানি।’
বদুর মধ্যে আবার চলে দুরন্ত একটা আলো আঁধারির খেলা। আগের জন্মের সঙ্গে এ জন্ম যায় গুলিয়ে।
বদুর নতুন পাওয়া এই আগের জন্মের মা যখন বলে, ‘হ্যাঁরে আমি তো তোর আগের জন্মের মা। তা এ-জন্মের মা-টি তোর কেমন বল না একটু শুনি?’
বদু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,‘ঠিক তোমারই মতন।’
‘আমার মতন ফর্সা?’
হেসে হেসে বলে সে। বদু জোর দিয়ে বলে, ‘তোমার চাইতেও ফর্সা। অনেক অনেক সুন্দর।’
‘তাহলে আমিই হেরে গেলাম?’
বদু চোখ কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করে, কখন বদু এ জন্ম থেকে আগের জন্মে এসে পৌঁছে গেল।
বদু ক্রমশ সেরে উঠছে, এখন আর শুধু ওষুধ আর ফলের রস নয়, ডাক্তার বলে গেছেন আজ ওকে একটু মাছের ঝোল দিতে।
কিন্তু খাওয়ানো নিয়েই বিপদ।
বদু কিছুতেই মাছের ঝোল খাবে না।
বদু ঝোলের বাটিটা হাত দিয়ে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘খাব না আমি মাছ। মাছ খেতে তোমাদের লজ্জা করে না? ওরা মানুষ নয়? তাই ওদের নিজেদের রাজ্য থেকে জাল ফেলে ফেলে তুলে এনে কেটে কুটে খাওয়া হয়।’
‘বা:, ওরা তো মাছই। মাছ আবার মানুষ হল কখন? ওরা তো মানুষের খাদ্য।’
বদু রেগে বলে, ‘কে, কে বলেছে মানুষের খাদ্য? ভগবান তোমাদের বলে গেছেন বুঝি? জানো ওরা, মানে মাছেরা, মানুষদের কত ঘেন্না করে। করবেই তো। মানুষেরা যে নিষ্ঠুরের রাজা। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে মানুষ সব্বাইকে জ্বালাতন করে। কেটে কুটে রান্না করে খায়। মেরে মেরে চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে জিনিস টিনিস বানায়, পিঠে চড়ে, গাড়িতে জুড়ে চাবুক মেরে মেরে ছোটায়, আরও কত কী করে। পৃথিবীর সব প্রাণীই মানুষকে ঘেন্না করে তা জানো?’
ওই ভদ্রমহিলাটি হেসে ফেলে বলে, ‘এত তো জানতাম না বাবা। তা তুই এত সব জানলি কী করে?’
বদু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ‘ওরাই বলেছে, যাদের একজনকে তুমি কেটে ভেজে ঝোল করেছ।’
‘কী কান্ড! তুই ওদের পেলি কোথায়?’
‘বা:, আমি বুঝি সমুদ্রে ডুবে যাইনি। রাজকুমারী আমায় ওর মা-বাবার কাছে নিয়ে যায়নি বুঝি?’
বদুকে দেখে ভদ্রমহিলার একটু নিশ্বাস পড়ে।
বদু অবাক হয়ে ভাবে, সব জন্মেই কি মা বাবা একইরকম হয়?
হাসপাতালের অন্যঘরে আলোচনা চলছিল তখন। ডাক্তার সামন্ত বলছিলেন, ‘জোর করে ওর ভুল ভাঙাতে যাবেন না আপনারা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু এই যে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া, মাছের রাজারানি— হ্যানো ত্যানো কীসব বলছে, এটা কেন?’
ডাক্তার বলেন, ‘দেখুন, হিসেব আছে তো, প্রায় ছ সপ্তাহ ও অজ্ঞান অবস্থায় ছিল, তখন মাথার মধ্যে কত কী কলকারখানা চলেছে তা কে জানে। মানুষের ব্রেন কখনো নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ঘুমন্ত আর অঘুমন্ত, চেতনে আর অচেতনে, সব অবস্থায় ব্রেন কাজ করে চলে। অবশ্য অচেতন অবস্থায় সব কিছু জট পাকিয়ে যায়, তাই মাথা মুন্ডুহীন সব কান্ডের ছবি দেখে। হয়তো কেউ কখনো কোথাও কোনো মেলা দেখেছে, কী সিনেমা থিয়েটার দেখেছে, স্টেশনের ভিড় দেখেছে, যাত্রায় রাম রাবণের যুদ্ধ দেখেছে। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে তার মাথার মধ্যে কারখানা খুলে বসবে। একবার এক টাইফয়েড রোগী এসেছিল আমার এখানে—বাচ্চা। সেদিব্যি ভালো আছে, খেয়ে-দেয়ে মোটা হয়ে উঠেছে। অথচ বলে চলেছে সামনেই তার এম. এ. পরীক্ষা, পড়ানোর জন্যে মাস্টার চাই নইলে ফেল করবে। এই নিয়ে রাগারাগি কান্নাকাটি। …মিছিমিছি একজনকে মাস্টার সাজিয়ে আনাও হল তার কাছে, ইচ্ছে করে দেওয়া হল শক্ত শক্ত মোটা মোটা ইংরেজি বই, তখন সেবলল, এখন পরীক্ষা হচ্ছে না, কলেজ বন্ধ আছে, পড়ে কী হবে।’
‘তারপর?’
‘তারপর— আর কী, কিছুকাল পরে ভালো হয়ে গেল।’
‘এমনি?’
‘এমনিই। তবে টাইম একটা লাগে।’
‘তখন তাকে নিয়ে হাসা হত?’
‘হত। কিন্তু সেকিছুতেই বিশ্বাস করত না এইসব বলেছিল। তার মানে— ভুলে গিয়েছিল।’
‘বদুও তাহলে এসব ভুলে যাবে?’
‘যাবে তো নিশ্চয়।’
বদুর মা হতাশ হয়ে বলে, ‘তার মানে আমাদেরও ভুলে যাবে?’
ডাক্তার সামন্ত নির্বিকার গলায় বলে,‘যেতেও পারে, না যেতেও পারে।’
‘যেতেও পারে?—তাহলে কী হবে?’
ডাক্তার সামন্ত মিটিমিটি হেসে বলেন, ‘কী আর হবে। আপনাদের শুধু ওর আগের জন্মের মা-বাপ হয়ে থাকতে হবে।’
জীবনপুর রেল-কলোনিতে আজ দারুণ উৎসব। কতদিন পরে বদুরা ফিরেছে পুরী থেকে। আহা বদু নামের সেই ফুটফুটে ছেলেটাকে কতদিন সবাই দেখেনি। মুখচোরা আর অন্যমনস্ক বটে ছেলেটা, কিন্তু রাজেনবাবুর একমাত্র ছেলে তো। দেখতেও সুন্দর,তাই সকলেই তাকে ভালোবাসে।…তা সেই যে মাত্র দু-সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বদুর বাবা রাজেনবাবু পুরী গেলেন, তারপর কেবলই অফিসে চিঠি আসছে ছেলের অসুখ, আসতে পারা যাচ্ছে না, আরও ছুটি চাই।
রাজেনবাবুর অফিসের সব বন্ধুরা এতদিন মনমরা হয়ে রয়েছিলেন, আজ আনন্দের দিনে সবাই দেখা করতে আসছেন।
আর নাণ্টু?
সেযখন জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসে শুনেছিল বদু পুরীতে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ বালির ঝড়ে উড়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে, বদুর বাবা পুরী শহর তোলপাড় করে খুঁজেছেন তবুও পাওয়া যায়নি, তখন নাণ্টু বেচারা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেছিল থামানোই যায় না।
নাণ্টুর বাবা বদুর বাবার বন্ধু বলেই বিদুর বাবা তাঁকে চিঠি লিখে সব খবর জানিয়েছেন।
কিছুদিন পরে অবশ্য আবার চিঠি এল, খুঁজে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেএখন অজ্ঞান অচৈতন্য। চোখ বুজে পড়ে আছে তার তার মধ্যেই ভুল বকছে। কারণ দারুণ জ্বরও তো চলছে।… নেহাত নাকি একটা নুলিয়া-সর্দার বদুকে সেই ঝড়ের পরদিন ভোরে সমুদ্রের ধারে বালির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখে মায়া করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আর নিজেদের লতা-পাতা শিকড়-বাকড়ের ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে যত্নআত্তি করেছিল, তাই না ফিরে পাওয়া। না হলে কি আর পাওয়া যেত, না বাঁচানো যেত?
তবু সহজে তো সারিয়ে তোলা যায়নি,কতদিন লেগেছে। তা ওখানের এক হাসপাতালের ডাক্তারও খুব দয়া মায়া করেছেন। এ সমস্ত খবরই নান্টুদের বাড়িতে চিঠি মারফত এসে পৌঁছছে, আর নাণ্টুদের বাড়ি থেকে কলোনির সকলের বাড়ি বাড়ি।
তবে আর কেন বদুর ফেরাটা জীবনপুর রেল-কলোনিতে একটা উৎসবের মতো হবে না? কেন দলে দলে সবাই দেখতে আসবে না বদুকে?
কিন্তু একটি খবর বদুর মা জীবনপুরে জানাতে দেয়নি, সেহচ্ছে বদুর ওই এজন্ম আর আগের জন্ম গুলিয়ে ফেলার খবর।
কাতর হয়ে বলেছে মা, ‘ওই কথাটি কাউকে বোলো না, দেখ না পুরোনো জায়গায় গিয়ে বদু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায় কি না।’
বদুর বাবা ম্লান হাসি হেসে বলেছেন, ‘তা তোমার ছেলেটি কি পুরো স্বাভাবিক ছিল কোনোদিন? যখন তখনই তো উলটো পালটা কথা বলে বসত।’
তা ঠিক। কিন্তু সেটা তো অন্য লোকেরা জানত না। তাই বদুর মার ইচ্ছে নয় যে, সবাইকে বলে, বেড়ানো, বদু এ জন্ম আর আগের জন্ম গুলিয়ে ফেলে আমায় ‘আগের জন্মের-মা’ বলে।
বদুর মা’র এখন আশা হঠাৎ পুরোনো জায়গায় এসে পড়ে স্মৃতির ওপর একটা ধাক্কা খেয়ে বদুর যদি ওই ভুলভাল কথা সেরে যায়।
তাই বদুকেও বলা হয়নি বদুরা এখন জীবনপুরে ফিরছে।
মিস্টার সামন্তের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে খুব সাবধানে পুরী স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছিল বদুকে। যাতে সেসমুদ্রকে আর দেখতে না পায়।
কে জানে বাবা আবার সমুদ্র দেখে মাথা আরও গুলিয়ে যায় কি না!
মিস্টার সামন্তকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না বদু, তাই ট্রেন ছাড়ার পর সেহাঁফ ছেড়ে বাঁচল, আর বেশ আহ্লাদ আহ্লাদ ভাব দেখা গেল তার।
জানলার ধার আর ছাড়ে না, যা দেখে তাতেই চেঁচিয়ে ওঠে, বলে— ‘মা,মা, দেখো এইসব আমি আগের জন্মে দেখেছি।’
বদুর বাবা বলেন, আগের জন্মে কেন এজন্মেই দেখেছিস। এই পথ দিয়েই তো আমরা পুরী এসেছিলাম।’
বদু জোর গলায় বলে—‘বা:, তোমরা আসবে কেন? সেতো আমি এ জন্মের মা-বাবার সঙ্গে এসেছিলাম।’
‘আচ্ছা বাবা তাই তাই—’
বলে ওরা থেমে যান।
কী জানি কীসে কী হয়।
কিন্তু জীবনপুরে এসে পৌঁছোল যেদিন?
জীবনপুর স্টেশনে নেমেই বদু হঠাৎ যেন চমকে ওঠে।
দু-খানা কাঠের খুঁটিতে ঢিলে হয়ে ঝুলে থাকা টিনের ফলকটায় বাংলা হিন্দি দু-ভাষায় লেখা ‘জীবনপুর’। বাংলাটার মাঝখানের ‘ব’ অক্ষরটা রোদেজলে মুছে গিয়ে মনে হচ্ছে জী… নপুর।
খুঁটির কাছে স্টেশনের তারের বেড়ার গায়ে লতিয়ে থাকা ফুলে ছাওয়া কাগজ ফুলের গাছ। ঝোড়ো বাতাসে ফুলের পাপড়িগুলো খসে খসে এখানে ওখানে জমা হয়ে পড়ে আছে, হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন পিঁয়াজের খোসা।
চমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে চারিদিকে তাকায় বদু। বদুর মধ্যে যেন সমুদ্দুরের মতোই উত্তাল ঢেউ।
‘কী হল? আয়।’ বলেন বদুর বাবা।
বদু তার মার আঁচলটা চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,‘মা।’।
মা-র মধ্যেই কম ঢেউ উঠছে না। তবু মা শান্ত গলায় বলে—‘দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।’
‘মা আমরা কোথায় এসেছি?’ —বদুর স্বর রুদ্ধ, অথচ উত্তেজিত।
বাবা কৌতুকের গলায় বলেন, ‘তু-ই বল না কোথায় এসেছি।’
‘তুমি বলো!’
‘তা, তুই তো বাপু পড়তে জানিস না তা তো নয়,দেশের নাম তো লেখাই রয়েছে, পড়।’
বদু আরও উত্তেজিত গলায় বলে, ‘জীবনপুর’।
বাবা মজা দেখবার জন্যে হেসে উঠে বলেন, ‘জীবনপুর কোথায়? লেখা রয়েছে তো জী-নপুর।’
বদু তো প্রতিবাদ শুনলেই রেগে ওঠবার জন্য এক পায়ে খাড়া। তাই চেঁচিয়ে বলে, ‘ব’-টা তো মুছে গেছে?’
‘কে বলল, তোকে মুছে গেছে?’
‘আহা ,আমি যেন জানি না। রোজ যেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখিনি?’
‘আরে ব্যস। তাই বুঝি? এখানে তো আমরা এইমাত্র এলাম। তুই আবার কবে দেখলি?’ বদু রাগত গলায় বলে,‘ইস। তোমরা নিয়ে এলে তাই আমি এই মাত্তর এখানে এলাম, না? আমি তো চিরকালই এখানে থেকেছি। মানে বাবা ‘নন্দিনী’ থেকে বদলি হয়ে আসার পর থেকে রোজ রোজ। রোজ বারান্দা থেকে দেখিনি যেন।’
বদুর বাবার চোখে জল, মুখে হাসি।
তবু হাসি চেপে বলেন, ‘আমি তো বাপু এত কথা জানি না। তাই কই সেই বারান্দা?’
বদু হঠাৎ ওদের সঙ্গে থেকে ছিটকে বেশ কয়েক পা গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওই তো, ওই তো আমাদের বাড়ি।’
বদুর মা-র চোখে জল, মুখে হাসি।
তিনিও হাসি চেপে বলেন, ‘তাহলে তো খুব ভালোই হল। আমরা ভেবে মরছিলাম নতুন জায়গায় কোথায় গিয়ে উঠব, কোথায় খাব শোব। তা তোদের বাড়িতেই যাই চল।’
বদুর প্রাণে গৌরব উথলে ওঠে।
বদু কর্তার মতো গলায় বলে, ‘চলো না। কোনো অসুবিধে হবে না। দুটো তো ঘর আছে, একটা তোমরা নিয়ো।’
ও বাবা!
বদুর মা ভয়ের ভান করে বলে, ‘নিলে যদি বাড়ির লোক রাগ করে?’
বদু অগ্রাহ্যের গলায় বলে, ‘বাড়ির লোক মানে? শুধু তো মা-বাবা আর আমি। তাঁরা হচ্ছে আমার এ জন্মের মা-বাবা। ওঁরা কী ভীষণ যে ভালো। এত ভালো তোমরা জানোই না। দেখো তোমাদের খুব যত্ন করবেন।’
‘তবে চল।’
বদুর বাবা হাসি চেপে বলেন, ‘কিন্তু ভাবনা দু-দু জোড়া মা-বাপ নিয়ে তুই করবি কী?
সামলাবি কী করে?’
শুনে বদু হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠে বললে, ‘সামলানো আবার কী? তোমারা কি নাণ্টুর পুঁচকে ভাইটির মতন পুঁচকে? তাই সামলাতে হবে?’
হ্যাঁ, জীবনপুরের মাটিতে পা দিয়েই বদুর সব মনে পড়ে যাচ্ছে। এমনকী নাণ্টুর সেই পুঁচকে ভাইটার কথাপর্যন্ত। মনে পড়ে যাচ্ছে বাড়ির মধ্যে কোথায় কী আছে।
এদের হাত এড়িয়ে তিরবেগে বাড়ির দরজায় পৌঁছে যায় বদু, আর পৌঁছে গিয়েই থমকে দাঁড়ায়। বাড়ির দরজায় তালা লাগানো।
কোথায় গেছেন মা-বাবা?
নিশ্চয়ই সেই পিসঠাকুমা বাবাকে বকে বকে কোথাও নিয়ে গেছেন। কিন্তু এখন উপায়? যাঁদের এত আশ্বাস দিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল তাঁদের কী বলে এখন?
বদুর তো রাগে দুঃখে প্রায় চোখে জল এসে গেল।
ততক্ষণে বদুর মা-বাবা এগিয়ে এসেছেন।
বদুর বাবা অবোধের মতো করে বলেন, ‘আরে, এ যে দেখি তালাচাবি দেওয়া! তাহলে?’ বদুর মাও কষ্টে হাসি চেপে বলেন, ‘আশা করেছিলাম বদুদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে একটু আরাম করে, খাব শোব চান করব, তা সেআশা তো গেল। কী আর করা যাবে, আবার ফিরেই যেতে হবে।’
বদু চমকে উঠে বলে, ‘ফিরে যাবে? কোথায় ফিরে যাবে?’
বদুর মা হাসি চেপে খুব সরল গলায় বলেন, ‘কোথায় আর? যেখান থেকে এসেছি।’
বদু চোখ পাকিয়ে বলে, ‘কী? সেই ডাক্তার বুড়োর বাড়িতে? কক্ষনো না। তোমরা এখানেই থাকবে। যতক্ষণ না চাবি খোলা পাও ততক্ষণ আমার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বসবে চলো।’
‘ততক্ষণ? আহা! তাদের বাড়ির লোকেরা যদি বিদেশে গিয়ে বসে থাকে? কবে ফিরবে কে জানে!’
বদু তবু হারে না, জোর গলায় বলে, ‘তাহলে নাণ্টুদের বাড়িতেই থাকবে। ও তো আমার চেনা। এখানে সবাই আমার চেনা। আচ্ছা দাঁড়াও তো ওকে জিজ্ঞেস করে আসি কোথায় গেছেন মা-বাবা, দরজায় তালা লাগিয়ে।’
বদুর এই অদ্ভুত অবস্থাটি খুবই কৌতুকের হলেও ভাবনা না হয়ে পারছে না— এখানে এসে সবই তো চিনতে পারছে, তবে আমাদের চিনতে পারছে না কেন? ভাবেন বদুর বাবা। এখনও যেন ওর ধারণা এই বাড়িটার মধ্যে ওর এজন্মের মানে সত্যিকারের মা বাবা রয়েছে, আমরা হঠাৎ পাওয়া আগের জন্মের। এ ভুল কী করে ভাঙবে বদুর?
যাকগে, যখন ভাঙবে তখন ভাঙবে, এখন তো বাড়িতে ঢুকতে হবে। ব্যাগ থেকে চাবি বার করে দরজার তালা খুলতে এগিয়ে যান বদুর বাবা রাজশংকর। দেখে বদু চমকে উঠে বলে, ‘ও কী!
ওটা কী হচ্ছে। যে সেচাবি ঢুকিয়ে তালা খোলার চেষ্টা? তুমি চোর নাকি?’
বদুর মা হেসে বলে, ‘চোর ডাকাত হোক, যাই হোক, তালাটা কিন্তু খুলে ফেলে ভালোই করেছেন উনি। গিয়ে তো এখন ইঁদারার ঠাণ্ডা জল তুলে চান করে বাঁচি।’
বাবার টুক করে চাবি খোলা দেখেই বদু হাঁ হয়ে গিয়েছিল, আরও হাঁ হয়ে গেল, ইঁদারার কথা শুনে।
অবাক হয়ে বলল, ‘ইঁদারা আছে তুমি জানলে কী করে?’
বদুর মা মিষ্টি হাসি হেসে বলে, ‘জানিস না বুঝি, আমি যে হাত গুনতে জানি। …আমি এখন হাত গুনে গুনে বলতে পারি, বাড়ির মধ্যে ঢুকেই সামনে একটা বেঞ্চি পাতা আছে, তার পাশ দিয়ে সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়েই দু-পাশে দুটো ঘর, সামনে বারান্দা—’
শুনে বদুর চোখ তো ছানাবড়া।
‘তুমি এত জানো? হাত গোনা তো জ্যোতিষ শাস্ত্রের কাজ। তার মানে তুমি জ্যোতিষ শাস্ত্র জানো।’
বদুর মা মুখ টিপে হেসে বলে, ‘তা একটু একটু জানি বোধ হয়।’
বদু এবার পাকড়াও করা গলায় বলে, ‘তাহলে তো হাত গুনেই বলে দিতে পারো কোথায় গেছেন ওঁরা দরজা বন্ধ করে?’
বদুর মা হাসিহাসি মুখে বলে, ‘আমি তো দেখছি কোথাও যায়নি, এখানেই আছে।’
‘আহা, বললেই হল। যাকগে আমি নাণ্টুকে জিজ্ঞেস করে আসি—’
ভাগ্য ভালো বদুর। যেতে হল না, বলতে না বলতে নাণ্টুই এসে হাসির। সেতাদের বারান্দা দিয়ে দেখেছে বদুরা এসেছে। পেছনে মোট ঘাট মাথায় কুলি।
রেলের কুলি, আর বদুর বাবা হচ্ছেন রেলবাবু, তাই কিছু বলছে না। তাড়া দিচ্ছে না দেখেই না নাণ্টু ছুটে চলে এসেছে। তখন দরজাটা খুলেছেন রাজশংকরবাবু। কিন্তু ভেতরে ঢোকেননি।
নাণ্টু রেলগাড়ির বাঁশির মতোই তীক্ষ্ণ তীব্রস্বরে বলে ওঠে—‘এই বদু। তোরা এলি শেষপর্যন্ত? যা ভাবনা হচ্ছিল আমাদের। কী হয়েছিল রে তোর?’
বদুকে জড়িয়ে ধরে নাণ্টু।
বদু হাসি হাসি মুখে বলে, ‘ও একটু অসুখ। তুই এলি,আমরা তো তোদের বাড়িতেই চলে যাব ভাবছিলাম। এই ইয়ে— মানে ইনি অন্য চাবি দিয়ে তালাটা খুললেন তাই।’
‘ইনি।’
শুনে নাণ্টুর চোখ কপালে ওঠে। বাবাকে ইনি বলছে কেন বদু!
অবাক হয়ে বলে, ‘কে তালা খুলল?’
বদু বিরক্তির গলায় বলে, ‘বললাম তো! …তা ওঁরা কি এখন পুরী থেকে আসেননি?’
এবার আর নাণ্টু অবাক হয় না, হি হি করে হেসে উঠে বলে, ‘বাব্বা:, এত ঠাট্টাও করতে শিখেছিস বদু। ওরা এখন পুরী থেকে আসেননি? ও কাকাবাবু, ও কাকিমা, বদুর মা-বাবা এখন পুরীতে বসে আছেন। তাহলে তোমরা কে?—ভূত?’
বদুর বাবা হেসে ফেলে বলেন, ‘ঠিক বলেছিস। ভূতই। আমরা হচ্ছি বদুর আগের জন্মের বাপ-মা। ওর আসল মা-বাপ এখানে আছে।’
নাণ্টু এটাকে একটা মজার কথা ভেবে আরও হেসে উঠে বলে, ‘যাই মাকে বলে আসি তোমরা এসেছ।’
নাণ্টু চলে গেলে বদু কেমন সন্দেহ চোখে মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। …ততক্ষণে তো বদুর মা বাড়ির কাজ করতে লেগে গেছে। কতদিন বাড়ি বন্ধ, কত ধুলো বালি।
বদুর বাবা দরজা জানলাগুলো খোলাখুলি করতে লেগে যান, আর বদুর মা খাটের তলা থেকে ঝাঁটা বার করে ঝাড়তে থাকে। আর বলে, বদু সরে দাঁড়া বাবা, চোখে-মুখে ধুলো লাগবে!
বদু তাকিয়ে দেখে। এ দৃশ্যও যে বদু কতবার দেখেছে।
বদুর চোখের সামনে থেকে যেন একটা ছায়াপর্দা সরে যায়। বদু হঠাৎ ধুলোটুলো অগ্রাহ্য করে সরে এসে মাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, মাগো, ‘সত্যি করে বলো না, তুমি আমার কোনজন্মের মা?’
বদুর মা ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে গভীরগলায় বলে, ‘আমি? আমি তোর চিরজন্মের মা।’ ‘চিরজন্মের?’
‘হ্যাঁ তো! একশো জন্মের, হাজার জন্মের।’
তারপরেই তো এই জীবনপুর রেল-কলোনিতে উৎসব শুরু। …সবাই দেখা করতে আসছে, একদিন করে নেমন্তন্ন করছে, আর জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছিল বদুর। …এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে বদু। অনেকদিন ধরে সেযা কিছু দেখেছে, সবই জ্বরের ঘোরে, আর সেঅসুখের ঘোরের ব্যাপার। সেই ঘোরের জন্যেই সেতার সত্যিকার মা-বাবাকে আগের জন্মের মা-বাবা ভেবে বোকা বোকা কান্ড করেছে।
তবু বদু সুস্থির হতে পারে না, ওর আবার পুরী চলে গিয়ে সেই জায়গাটা দেখে আসতে ইচ্ছে করছে। …ইচ্ছে করছে সেই রিকশা করে বেরিয়ে বেড়িয়ে সিদ্ধ বকুল, জগন্নাথের মাসির বাড়ি, আর জগন্নাথের মন্দির দেখতে। সেইসঙ্গে থাকবে নতুন পাওয়া বন্ধু সুমন্ত, আর তার মেজোমামা।
তা বদুর সেইচ্ছেটা সবটা পূরণ না হলেও অনেকখানি পূরণ হল। …ওদের সব্বাইকেই দেখতে পেল বদু।
হ্যাঁ বিরাট একটা সমারোহের আয়োজন করে বসেছিলেন রাজশংকর।
যেন একটা বিয়েবাড়ি।
এ নেমন্তন্নে এসেছেন সেই সুমন্তদের পরিবার। মা-বাবা সুমন্ত, ছোটোবোন, মেজোমামা, আর বুড়ি ঠাকুমা।
এদিকে এ বাড়ির বুড়ি পিসঠাকুমাও এসেছেন। দুই বুড়িতে আবার দেখা হওয়ায় ফুর্তি দেখে কে।…
সুমন্তর বাবা ভিড়ে গেছেন বদুর বাবার সঙ্গে। সুমন্তর মা বদুর মার সঙ্গে। সুমন্ত তো বদুর সঙ্গেই ঘুরবে। শুধু মেজমামা আছেন সর্বত্র। ঝোলেঝালে অম্বলে।
এসেছেন সামন্ত ডাক্তারও। না এসে পারবেন কী করে?
এত করে মাথার দিব্যি দিয়ে চিঠি দিয়েছে বদুর মা! না এলেই নয় বলে। হ্যাঁ সবাইকে দেখাতে হবে একজন ডাক্তার কত ভালো হতে পারেন। যদিও বদু ওঁকে দেখতে পারে না। তাই ওঁকে দেখেই বদু স্রেফ মেজোমামার ছায়ায় ছায়ায় ঘুরছে।
কিন্তু আসল নেমন্তন্নের দিনের আগের দিন বিকেলে এ আবার কী কান্ড? এরা কারা? এরা কোথা থেকে এল? এদের কী পরিচয়? কে ডেকে এনেছে?
এদের দেখে রেল-কলোনির সবাই হাঁ!
এরা কে জান?—
সেই নুলিয়া পরিবার।
জ্বরের ঘোরে বদু যাদের দেখে মাছের রাজা, মাছের রানি আর মাছ রাজকুমারী ভেবেছিল।
তারাও তো বদুকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। তাই বদুর বাবা আসবার সময় নেমন্তন্ন করে এসেছিলেন।
ওরা তো বদুকে দেখে খুব খুশি।
বদু অবশ্য একটু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিন্তু যখন তারা এক গাদা রঙিন ঝিনুক আর শাঁখের মালা-টালা দিল, তখনই ভাব হয়ে গেল। কলোনির সবাইকে বিলোল বদু সেসব।
তবে পিসঠাকুমা নগেন্দ্রনন্দিনী কড়া গলায় বললেন, ‘ও সব ভালো করে ধুয়ে তবে ঘরে তোল বাছা, আঁশটে গন্ধ ছাড়ছে।’
অনেক রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়েছে। যত অতিথি এসেছিল সবাই তো আর ছোট্ট কোয়ার্টার্সে ধরেনি তাই তারা এ বাড়ি ও বাড়িতে শুয়েছেন। তখন নিজেদের বারান্দায় বদু সুমন্ত আর নান্টু মেজোমামার কাছে গল্প শুনতে বসেছে। নান্টু আজ এ বাড়িতে থাকবে রফা হয়েছে।
কত দেশ বিদেশের গল্প করেন মেজোমামা।—শুনতে শুনতে বদু যেন ভেসে যায়। তারপর—আস্তে বলে, ‘এত সব শুনলাম মেজোমামা, তবু কেবলই মনে হচ্ছে আমি যেন আর কোথাকার ছেলে। অন্য কোথাও আমার নিজের বাড়ি আছে।’
মেজোমামা একটু হেসে বলেন, ‘তার মানে তুই অবিকল আমার মতো। ছেলেবেলায় আমারও ঠিক তাই মনে হত, তাই তো সারাজীবন কোথাও তিষ্ঠোতে পারি না, দু-দশ দিন কোথাও স্থির হয়ে থাকলেই যেন কোথা থেকে কে ডাক দেয়।’
এই সময় রাজশংকর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে ওঠেন, ‘এই সেরেছে, তোরা এখনও এই ভদ্রলোককে জ্বালাচ্ছিস?’
ভদ্রলোক অর্থে মেজোমামা হেসে বলেন, ‘না জামাইবাবু, আমিই বরং ওদের ঘুমোতে না দিয়ে জ্বালাচ্ছি। যাক— খুব আমোদ আহ্লাদ করা গেল। কাল চলে যেতে হবে। তাই যাবার আগে বলে যাচ্ছি—এই ছেলেটাকে আপনি একটু অন্যভাবে মানুষ করবেন। এক একটা ছেলে জন্মায়, তারা ঠিক কোনো একটা বাড়ির বা পাড়ার বা বিশেষ দেশের মানুষ নয়, তারা পৃথিবীর মানুষ।—এ হচ্ছে সেই ছেলে। বড়ো হলে একে নেভিতে কাজ করতে দেবেন। কেবল জাহাজে জাহাজে ঘুরবে। আর পৃথিবীকে দেখে বেড়াবে।’
তারপর সবাই ঘুমোতে যায়।
বদু ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সেযেন জাহাজে চড়ে কোন দূর সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে।—কত কত দেশ দেখছে কতকত মানুষ দেখছে।—এইসব বিচিত্র দেশ কীকরে বদুর স্বপ্নে ধরা পড়ছে, বদু যদি ওসব কখনো না দেখেছে?—
এ প্রশ্ন অবশ্য বদুর মনে জাগে না, বদু তখন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিচিত্র আনন্দের স্বাদ পায়।