এক সমুদ্র অনেক ঢেউ

এক সমুদ্র অনেক ঢেউ

টিভি সিরিয়ালের সাম্প্রতিক কাহিনি

ব্যস ফুরিয়ে গেল বেড়ানো! শুরু হয়ে গেল ফেরার তোড়জোড়! দু-মাস একমাস নয়, কুড়ি কী পনেরো দিনও নয়, মাত্র চারদিন। চারটি দিন মাত্র সমুদ্র দেখতে পেল শানু। এক্ষুনি ফেরার জন্যে ফের বাক্স-বিছানাগুলো বাঁধা হচ্ছে।

ফেরা মানেই তো সেই বিচ্ছিরি কলকাতায়, যেখানে একবার একলা রাস্তায় বেরোবার জো নেই। এক সময়ও যা খুশি তা করবার উপায় নেই।

আশ্চর্য! আশ্চর্য! সেই কলকাতাই যদি এত ভালো লাগে তোমাদের তো এত ঘটা করে আসা কেন! দু-মাস আগে থেকে তো কথা চলছে। মাতে আর বাবাতে রোজ একবার করে তর্ক আর পরামর্শ।

বাবা বলেন, ‘দেশের বাড়ি’, মা বলেন, ‘দিঘা’!

দিঘা, দিঘা!

এই অদ্ভুত সুন্দর নামটা জীবনে সেই প্রথম শুনল শানু। তবু তখনও জানত না জায়গাটা কত সুন্দর! উঃ ভাগ্যিস মা তর্কে আর ঝগড়ায় জিতেছিলেন তাই না শানুর জীবনে সমুদ্দুর দেখা হল! অবিশ্যি সেই অনেকদিন আগে সেবার দেশের বাড়িও শানুর ভালো লেগেছিল। খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু দিঘার কাছে? কীসে, আর কীসে!

পৃথিবীতে নাকি আরও অনেক ভালো ভালো দেশ আছে, মাস্টারমশাই গল্প করেছেন। তা ছাড়া স্কুলের বন্ধুরাও তো কম গল্প করে না পুজোর ছুটির পর। ছুটিতে ওরা কত কত জায়গাতেই যে বেড়াতে যায়।

শানুদের পুজোর সময় কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই, শানুর মামার বাড়িতে মা দুর্গার পুজো হয়। আর মামার বাড়িটা তো কলকাতাতেই। মা দুর্গাকে শানু অভক্তি করছে না, সেই ঝকঝকে চালচিত্তির-ঘেরা টানা-টানা-চোখওয়ালা মা দুর্গার মূর্তিটি যখন মামাদের ঠাকুর-দালানে এসে বসেন, দেখতে দেখতে আহ্লাদে চোখে জল এসে যায় শানুর। কিন্তু মামার বাড়িটা যে মোটেই ভালো লাগে না। কীরকম যেন নীচু নীচু ছাদ, অন্ধকার দালান, আর কত যে লোক! তাদের কাউকে শানু চিনতে পারে না, আর পুজোর সময় ওদের সঙ্গে মিশে চেনা লোকগুলোও যেন তালগোল পাকিয়ে যায়।

দিদিমা, বড়োমামি, সেজোমামা আর ছোটোমামা, যাদের নাকি শানু সত্যিকার ভালোবাসে, তারা যেন এই পুজোর সময় কোথায় হারিয়ে যায়, আর বদলেও যায় যেন। শানুকে দেখেও দেখতে পায় না, কথা বললে শুনতে পায় না।

তা ছাড়া মা?

মামার বাড়িতে গেলেই মা যেন অন্য লোক। মার এত কথা, এত হাসি, এত হই চই, দেখে অবাক লাগে। আর খারাপ লাগে শানুর সঙ্গে ব্যবহারে। পুজোবাড়িতে শানু যেন মার কেউ নয়, মামার বাড়ির ওই চেনা অচেনা অনেকগুলো ছেলের মধ্যে শানুও একটা ‘লোকের ছেলে’।

শানুর যদি কিছু দরকার হল, মাকে বলতে গেলেই মা বলবেন, ‘আঃ দেখেশুনে নাও না। বলো গে না বীণা মাসিকে, আমায় জ্বালাতন করতে এসেছ কেন? দেখো দিকি আরও সব ছেলেদের! কেউ তাদের মাকে জ্বালাতন করছে?

এই—এইসবের জন্যেই পুজোর সময়কার মামার বাড়িটা ভালো লাগে না শানুর। মনে হয় তার থেকে স্কুলের বন্ধুদের মতো ভালো ভাল দেশে বেড়াতে গেলেই অনেক ভালো হত। মা দুর্গা যদি ওই পুজোর ছুটির সময়টায় না আসতেন, তা হলে সব দিক থেকেই ভালো হত।

কিন্তু এটা অন্য ছুটি।

অন্য ছুটির সঙ্গে রবিবার জুড়ে গিয়ে নাকি ছুটিটা লম্বা হয়ে গেছে। ঠিক জানে না শানু, মোটকথা ওইসব কথাই শুনত রোজ মা আর বাবার তর্কের মধ্যে। দুমাস আগে থেকে যা চলছিল। কিন্তু এর নাম বড়োছুটি? লম্বা ছুটি? ছি:! এমন জানলে শানু কক্ষনো আসত না। …ভাবতে ভাবতে হঠাৎ থেমে গেল শানু। আসত না? তাহলে কী করেই বা জানতে পারত পৃথিবীতে দিঘার মতো সুন্দর দেশ আছে। দেশের বাড়ি আর দিঘা, এই দুটো জায়গা দেখল শানু, কিন্তু যেন আকাশ আর পাতাল!

দেশের বাড়িতে তো তিনদিন মাত্র ছিল। আসবার সময় মন কেমনও খুবই করেছিল, তা বলে এখানকার মতো? আজকের মতো?

আশ্চর্য! বাবার কি মন বলে কিছু নেই? নইলে ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে’ বলে অত লাফালাফি করছেন কেন? দুদিন চারদিন পরে অফিসে গেলেই বা কী ক্ষতি হয়? আসলে ওই অফিস-টাই বাবার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা! কে জানে অফিসে কী আছে! কিন্তু কোনোকিছুই কি দিঘার চাইতে ভালো হওয়া সম্ভব?

ওই সমুদ্দুর, ওই ঝাউবন, এই বালি আর বালি, এটা কি পৃথিবীর কোনো জায়গা? নাকি স্বর্গের? আর বাতাসটা? সমুদ্দুরের ডাক মেশা কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া এই হাওয়া? বুকের মধ্যে কীরকম যেন করতে থাকে! ঝাউবনের শর-শর-শন-শন শব্দটাও যেন আহলাদ আর দুঃখ মেশানো। এই দুঃখু দুঃখু আহলাদটা কীসব যেন বলে যায়, কোথা থেকে যেন ডাকে, পড়ার বই, মাস্টারমশাই, স্কুল আর স্কুলের বন্ধুরা হাজার হাজার মাইল দূরে চলে যায়, মা-বাবা মামার বাড়িটাড়ি সব ঝাপসা হয়ে যায়। শানুর মনে হয় অনেক অনেক বছর ধরে শানু যেন এইখানেই বসে আছে এই সমুদ্দুরের ধারে বালির ঢিপির ওপর।

রামচন্দ্র তো এই সমুদ্দুর পার হয়েই সীতা উদ্ধার করেছিলেন? এই সমুদ্দুর দিয়েই তো চলে যাওয়া যায় বিলেতে, আমেরিকায়, আরও সব কত কত দেশে। আর বিবেকানন্দ নাকি—

‘শানু?’

পেছন থেকে মা ডেকে ওঠেন, ‘কী রে! কী ছেলে তুই? সক্কাল থেকে দুধটুধ না খেয়েদেয়ে এই বালির গাদায় এসে বসে আছিস? বাব্বা: খুব সমুদ্দুর দেখাতে এনেছিলাম বটে! এই চার চারটে দিন শুধু এই ঝোড়ো হাওয়া গায়ে লাগিয়ে বালির গাদায় ঘুরলি, জানি না বাবা অসুখ-বিসুখ করবে কি না। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচি।’ শানুর হাতটা ধরে টান দেন মা।

শানু অবশ্য এ টানে হেলে দোলে না, বরং এক ঝটকায় হাতটাই টেনে নিয়ে বলে, ‘ছাই কলকাতা, পচা কলকাতা!’

মা হেসে ফেলে বলেন, ‘তা বেশ বাবু, তোকে না হয় এখানেই শ্বশুরবাড়ি করে দেব, কেবল কেবল আসবি। এখন তো সেই ছাই কলকাতা, পচা কলকাতায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

‘না গেলে কী হয়?’ শানু বিরক্ত হয়ে বলে।

এ কথায় যে এত হাসির কী আছে শানুর বুদ্ধির অগম্য। মা একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়লেন। ‘না গেলে কী হয়? তাই তো! ওইটাই ঠিক বুঝতে পারছি না। এই শুনছ?’

‘এই’ মানে আর কেউ নয়, শানুর বাবা।

ইত্যবসরে তিনিও বাংলো থেকে বেরিয়ে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছেন। এই এটাও দু-চক্ষের বিষ শানুর, মার কাছে একটু যদি মনের কথা খুলে বলল, মা অমনি বাবাকে ডাক দেবেন, ‘এই—এই শুনছ?’

বাবা এসেই কিন্তু শানুর মার কথায় কান না দিয়ে শানুকে বকে ওঠেন, ‘কী, তোমার আর সমুদ্র দেখে আশ মিটছে না? সারাক্ষণ এইভাবে বালির ঝড়ের মুখে পড়ে থেকে থেকে—! যা বুঝছি গিয়ে আমাকেও অগাধ সমুদ্র দেখিয়ে ছাড়বে আর কী! এই ছেলেটির এইটি হচ্ছে মহাদোষ, যা করবে তা একেবারে বেদম!’

মা বোধ করি শানুর মুখের রাগ-অভিমান-দুঃখ-হতাশা-মেশানো ছায়াটাকে দেখতে পেলেন, তাই তাড়াতাড়ি বললেন, ‘কখন আবার বেদম কী করল বাপু?’

‘কখন না করছে, আর কোনটা না করছে? ভেবে দেখো। বাবু ঘুড়ি ওড়ানো শিখলেন তো এমন ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হল যে আহার-নিদ্রা বন্ধ। জ্বরেই পড়ে গেলেন রোদে পুড়ে পুড়ে। বল খেলা ধরলেন তো—’

‘না কেউ কিছু করবে না—’ শানু ভারি মুখে জোর দিয়ে বলে ওঠে ‘কেউ কিছু খেলবে না, খালি তোমার মতন শুধু অফিস যাবে। পৃথিবীতে যেন অফিস ছাড়া আর কিছু নেই।’

শানুর মা এ কথায় হেসে ওঠেন, কিন্তু শানুর বাবাটি হেসে ফেলবার লোক নয়। তিনি বলে ওঠেন, ‘ওই দেখছ তো? সাধে বলি ছেলেটি সবেতেই একেবারে বেদম। কথা বলছে দেখো! মাত্রাজ্ঞান বলে কিছু নেই। ওহে ছোকরা, আমি তোমার বাবা, বুঝলে? একটু মান্য করে কথা বলতে শেখো।

‘আচ্ছা বাপু শিখবে বড়ো হলেই শিখবে।’ বলে মা আবার হাত ধরেন, ‘চল, সকাল থেকে যে একটু জল পর্যন্ত মুখে দিসনি!’

শানু ভেবে দেখল সত্যিই বটে, ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে সেবাংলোবাড়ির ওই ছোট্ট ঘর দুখানার জেলখানা থেকে। ‘খাওয়া’ বলে যে জগতে একটা ব্যাপার আছে, ভুলেই গিয়েছিল। এখন টের পাচ্ছে খিদেয় পেটের মধ্যেটাও সমুদ্দুরের মতো তোলপাড় করছে।

অগত্যাই গেল মায়ের সঙ্গে গুটিগুটি।

গেল, দুধ আর খাবার যা কিছু মা দিলেন, খেয়েও নিল এক নিমিষে। তারপর হাত ধুয়ে আবার যেই চলে আসছে বাইরে বাবা ফেললেন ধরে।

‘উঁহু, উঁহু, আর না। আর বাইরে না। এখন বাড়িতে ঠাণ্ডায় বসে থাক, একটু পরেই খাওয়া-দাওয়া করে বেরোতে হবে।’

‘বা: শেষকালে একবার বেড়াব না বুঝি?’ শানু বলে।

‘না। আর ঝড়ের হাওয়া লাগাবে না।’

বলে বাবা বাড়ির বাইরে বেরোবার দরজাটাই বন্ধ করে দিলেন শানুর নাকের সামনে—যে দরজার ছিটকিনিটা হচ্ছে দরজার মাথার দিকে, শানুর নাগালের বাইরে। আর এখানে টুলই বা কোথায়?

কলকাতার বাড়ির টুলটা যদি আসার সময় লুকিয়ে নিয়ে আসত শানু!

লুকিয়ে!

শানুর মা-বাবার চোখ থেকে লুকিয়ে কিছু করা সম্ভব? আজপর্যন্ত তো দেখল না শানু সেটা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু সম্ভব করা কি যায় না?

জানালা দিয়ে দেখতে থাকে শানু বাইরের খাঁ খাঁ করা বেলাভূমি। দূরে দূরে এক একটা কাঁটাঝোপ, মাঝে মাঝে বালির পাহাড়, আর ঝাউবন! কী অদ্ভুত সুন্দর ওই ঝাউবনের মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে দোলা, দুলছেই দুলছে! রাত্রে ঘুম নেই, দিনে বিশ্রাম নেই, সমুদ্রের গানের সঙ্গে তাল রেখে নেচেই চলেছে।

ওই বাঁ-দিকটায় কোনোদিন যাওয়া হল না।

কাল মাকেও একথা বলেছিল শানু। কিন্তু মা আমল দিলেন না, বললেন, ‘ওদিকে কোথায় যাবি, ও দিকটা কোথায় না কোথায় চলে গেছে অজানা দিকে, গিয়ে কাজ কী বাবু! এই ডানদিকেই তো সব।’

সব মানে আর কিছুই না, এইরকম কতকগুলো ছোটো ছোটো বাড়ি, দু-চারটে কীসের যেন দোকান, কীসের যেন একটা অফিস। পরশু আর একটু বেশি বেড়াতে গিয়ে কোথাকার যেন রাজার বাড়ি দেখেছিল। উঃ ওই রাজার বাড়ি দেখেই মা-বাবা কী খুশি, কীসব কথা বলাবলি!’

ভারি রাজার বাড়ি!

অমন বাড়ি যেন কখনো দেখেনি শানুরা। কলকাতায় ওরকম হাজার হাজার রাজার বাড়ি আছে। কিন্তু কে দেখতে চায় রাজার বাড়ি?

শানু অন্তত না। না, শানু নয়, শানুর মতন কল্পনায় মন ভাসানো ছেলেরা নয়।

রাজপুত্রেরা চিরদিনই তেপান্তরের মাঠের হাতছানিতে ছোটে।

মাকে বলেছিল শানু, ডানদিকে কী ছাই সব! ওই বাঁ-দিকটায় কত ঝাউবন!’

‘সেইজন্যেই তো ভয় রে বাপু! কীসের মধ্যে কী থাকে, কোনো জন্তু-জানোয়ার আছে কি না—’

‘আস্তে আস্তে উঁকি দিতে দিতে চল না? জন্তু টন্তু দেখতে পেলে পালিয়ে আসব।’

মাকে অনেক খোশামোদ করেছিল শানু। আর মা বলেছিলেন, ‘না রে শানু, অজানার দিকে গিয়ে কাজ নেই।’

অজানার দিকে গিয়ে কাজ নেই, তবে কি যত কাজ জানা কথায় আর জানা জায়গায়? তা হলে এতসব যারা আবিষ্কার করল? কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন, তেনজিং হিমালয়ের চুড়ো, সব কি জানা জায়গায় বসে থেকে থেকে?

জানলা থেকে উঠে এল শানু।

দেখল বাবা নিবিষ্টমনে দাড়ি কামাচ্ছেন। যাক কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্দি। শানুর বাবার জীবনে ওই একটি মাত্র শখ, আরাম করে বসে একঘণ্টা ধরে দাড়ি কামানো! তার কতরকম সরঞ্জাম!

কামানো হয়ে গেলে একটা ফটকিরি নাকি, তার চাক্তি গালে ঘসতে থাকবেন আস্তে আস্তে বুলিয়ে বুলিয়ে, তারপর পাউডার ঘসা চলতে থাকবে। এতক্ষণ দাড়ি আর মুখ নিয়ে বসে থাকা দেখলে শানুর বিচ্ছিরি লাগে, কিন্তু আজ খুব ভালো লাগল। আজ এক কৌটো পাউডার নিয়ে গালে ঘসুন বাবা।

মায়ের সন্ধান করতে এদিকে এল—এই ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট রান্নাঘরটায়। উঠোন থেকে চার-পাঁচটা সিঁড়ি উঠে উঁচুমতন দাওয়ার ওপর রান্নাঘর।

মা শানুর মুখটা দেখে ফেলে এ ইচ্ছে ছিল না শানুর, কিন্তু মুখ নীচু করে রাঁধতে রাঁধতেও কেমন করেই যে শানুর ওই একটু উঁকিমারাটা দেখে ফেললেন।

বললেন, ‘কীরে শানু?’

অগত্যাই শানুকে বলতে হল ‘জল খাব।’ নইলে শানু জানে, ‘না, কিছু না’ বললেই মা সন্দেহে আকুল হয়ে উঠবেন, আর কিছু না’ মানে কী, এই প্রশ্ন করে শানুকে অস্থির করে তুলবেন। তার থেকে এই ভালো।

‘জল খাব।’

সঙ্গে সঙ্গে মা বলে ওঠেন, ‘এখানে এসে এত জল খাওয়া বেড়েছে তোর!’

শানু জানে বলবেই। ছোটোরা যা কিছু করতে চাইবে, বড়োরা তা নিয়ে কিছু বলবেই। এত কথাও কইতে ভালোবাসে বড়োরা! কথা, কথা, খালি কথা। বালির মাঠে বেড়াতে গেছ, সমুদ্দুরের শব্দ শুনছ, চুপচাপ তাই শোনো, তা নয়, বাবাতে আর মা-তে সারারাস্তা চলবে খালি গল্প আর গল্প।

আর তাই কি ভালো গল্প? সেই পচা কলকাতার পচা লোকদের গল্প।

কাল সারাবিকেল তো মা ওদের কলকাতার পাশের বাড়ির গিন্নি কত রাগি তার গল্প করলেন বাবার সঙ্গে সমুদ্দুরের ধারে বসে বসে। আর বললেন কি না—বাব্বা: এত শুনি দিঘা দিঘা! এমন জানলে কে আসত! তিনদিনেই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে। কিছু নেই, শুধু বালি আর বালি।

শুনে শানু স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

শানুর মা যদি শানুর মতো হতেন!

জল দিয়ে মা বললেন, ‘কোথায় ছিলি? বোস এখানে, বোস আমার কাছে।’

‘না’ আমি জানলায় বসব।’ বলে শানু চলে এল।

মায়ের কাছে এই মিথ্যে কথাটুকু বলতে অবশ্য শানু মনে মনে একবার ঠাকুরকে নমস্কার করে নিয়েছে, যেমন অনেক সময়ই করে।

জল খেয়ে রান্নাঘর থেকে নেমে এল শানু উঠোনের পাশের দিকে।

কেন এল? শানু জানে এই দিকে একটা ছোট্ট দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে ওদের যে ঝিটা দু-তিন দিন বাসন মাজল, সেআসে।

এই ছোট্ট দরজার খিল শানুর নাগালের মধ্যে। আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে বেরিয়ে পড়ল শানু। বুকটা ভয়ংকর ঢিপ-ঢিপ করছে, পা-টা কাঁপছে যেন।

লুকিয়ে শুধু একটু বাড়ি থেকে বেরোলেই এত ভয় করে? যাক গে করুক গে ভয়, বাঁ-দিকের ওই ঝাউবনের ওপারের রহস্য ভেদ করতেই হবে তাকে। মার রান্না শেষ হতে এখনও দেরি আছে, দেখে এসেছে শানু। শুধু ভাত রান্না হচ্ছে, আর সব কত কী কুটনো ফুটনো পড়ে।

আর বাবার তো কথাই নেই। কামানো শেষ হতে অনেক দেরি।

এরমধ্যে ঘুরে আসতে পারবে শানু। বড়োগলায় বলতে পারবে মাকে—বাঁ-দিকটা কেমন মজা করে দেখে এলাম আমি। তুমি তো খালি বোকার মতো রাঁধলে বসে বসে।

আস্তে আস্তে এগোতে থাকে শানু ভয় ভয় উত্তেজনা নিয়ে।

অন্যদিন শানুর মা চটপট রান্না সেরে ফেলেন, তাড়া লাগান ‘শানু, আয় চান করে নে শানু, বেলা হয়ে গেল রে—’ আজ কিন্তু অত চটপট হল না শানুর মার। কারণ? কারণ আজই এখানের ‘শেষদিন’ বলে শানুর বাবা জেলেদের কাছ থেকে দেদার মাছ কিনে ফেলেছেন।

দেদার খেতে যে কেন এত ভালো লাগে মানুষের, সেটা অবশ্য শানুর বুদ্ধির অগম্য। শানুর তো বেশি বেশি খাবার জিনিস দেখলেই ভয় করে। কিন্তু শানুর বাবার ওতেই পরম আনন্দ। বরাবর তো শানু তাই দেখে এল। আর জিনিস সস্তা হলে? সেতো বলতে গেলে ফুরোবে না।

বাজারে আম সস্তা হয়েছে, শানুর বাবা মুটের মাথায় চাপিয়ে এক ঝাঁকাই আম এনে হাজির করলেন। বাজারে ছানা সস্তা হয়েছে, এসে গেল শানুদের বাড়িতে তাল তাল ছানা। আর শানুর বাবার পকেটের টাকা যেদিন সস্তা হয়?

সেদিন তো আর কথাই নেই। মাছ মাংস রাবড়ি রাজভোগ—কী নয়? বন্ধুদের নেমন্তন্ন খাইয়ে, তবে সেসব ফুরোনো যায়। কিন্তু মজাটি এই, জগতের যে দুটি সেরা খাদ্য, আইসক্রিম আর চকোলেট শানুর বাবা তার দিক দিয়েও যাবেন না। বরং আইসক্রিম-চকোলেট, খেতে দেখলেই বকাবকি। অথচ যদি একদিন মুটের মাথায় চাপিয়ে চকোলেট নিয়ে আসতেন? শানু হয়তো তার বাবাকে পুজোই করতে শুরু করত তারপর থেকে।

তা পুজো পাওয়ার ইচ্ছে বিশেষ দেখা যায় না শানুর বাবার। ওই মাছ আর আম ছাড়া আর ছানার জিলিপি, এই সবেই মন ওঁর।

কাজে কাজেই শানুর মাকেও সেই সবে মন দিতে হয়! তা মন দিয়েই রাঁধলেন শানুর মা অনেক বেলা অবধি, মাছের সাতরকম। তারপর ডাক দিলেন, ‘শানু, শানুরে, এইবার চান করবি আয়।’

বুঝতেই পারছ, ডাকে সাড়া পেলেন না। কাজেই রান্নাঘর থেকে নেমে এলেন শানুর মা। চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী রে শানু কানে তুলো দিয়ে বসে আছিস নাকি? কত বেলা হয়ে গেল, আয়! নাইবি খাবি না?’

সমুদ্রের শব্দে আর ঝড়ের চাপা গোঁ-গোঁ শব্দে ডাকটা অবশ্য হালকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, তবু শানুর বাবা উঠোনের ওপারের ঘর থেকে শুনতে পেয়ে বলে উঠলেন, ‘শানু তো ওদিকেই আছে, ডাকাডাকি করছ কেন?’

শানুর মা ব্যস্ত হয়ে চলে এলেন, বললেন, ‘সেকী, এখানে তো নেই! আমি ভাবছি তোমার কাছে।’

‘আমার কাছে বসে থাকবারই ছেলে তোমার!’ বললেন শানুর বাবা।

‘তাহলে নির্ঘাত আবার বেরিয়ে গেছে, এই দুপুর রোদ্দুরে।’

কিন্তু বেরিয়ে যাবে কোথা দিয়ে? শানুর বাবা তো দরজা বন্ধ করে রেখেছেন! আর সেদরজার ছিটকিনি যেমন বন্ধ তেমনিই রয়েছে।

‘পাখি তো নয়, যে জানলা দিয়ে উড়ে যাবে!’ বললেন শানুর বাবা।

তা যাবে না সত্যি, কিন্তু গেলই বা কোথায়, আর কী করেই বা! সাত-মহলা রাজপুরী নয় যে খোঁজবার অনেক জায়গা আছে, একই ঘরে সাতবার ঘোরাঘুরি করে শানুর মা উদ্ভ্রান্তের মতো উঠোনের ধারে নেমে পড়েন আর কাঁদো-কাঁদো গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘এই যে খিড়কির দরজা খোলা!’

‘খিড়কির দরজা খোলা! খিড়কি বলে আরও একটা দরজা আছে নাকি? শানুর বাবা ছুটে গিয়ে দেখে রেগে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘ওঃ এইখান দিয়েই তাহলে বেরিয়ে যাওয়া হয়েছে বাবুর! দেখো—দেখো তোমার ছেলের আসপদ্দা! আমি বারণ করেছি লুকিয়ে পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে। উঃ এই প্রচন্ড রোদ্দুর! ভোগাবে, বেশ বুঝছি ও আমাকে দস্তুরমতো ভোগাবে। কলকাতায় গিয়ে স্রেফ ‘ডাক্তার বাড়ি আর ঘর’ করতে হবে আমায়। সাধে বলেছিলাম দেশের বাড়িই ভালো! তা তো পছন্দ হল না তোমার? কী শখ, না, ‘ছেলেকে সমুদ্র দেখাব’। দেখিয়েছ তো সমুদ্র ছেলেকে? এইবার ছেলেই আমাদের সমুদ্র দেখাবে!’

কিন্তু এত কথা দাঁড়িয়ে শুনছে কে?

শানুর মা তো তখন বেরিয়ে পড়েছেন। আর চোখে হাত ঢাকা দিয়ে রোদ আড়াল করে জোর চিৎকার করে ডাকছেন, ‘শানু, শানু, শানুরে!’

কিন্তু কোথায় শানু?

এবারে ভয় পেয়ে শানুর বাবাও বেরিয়ে পড়েন, আর সেই ধু ধু বালির মাঝখানে ঘোরাঘুরি করেন আর ডাক দেন, ‘শানু, শানু!’

সেডাকাডাকির উত্তর মেলে না। শানু নেই।

‘নিশ্চয় ওই দোকানটায় গিয়ে জমিয়ে বসেছে’ শানুর বাবা বলে ওঠেন, ‘যেখান থেকে সেদিন দেশলাই কিনলাম আমরা। মহা আড্ডাবাজ ছেলে তো! যার সঙ্গে দেখা হবে, তার সঙ্গেই জমিয়ে বসবে! উঃ এত জ্বালাতেও পারে! যাও তুমি বাড়ির মধ্যে যাও, আমি দেখছি’—

বলে সেই ডানদিকে এগোতে থাকেন তিনি। যেদিকে ‘সব’ আছে।

কিন্তু বাড়ির মধ্যে কে যাচ্ছে?

শানুর মা?

ছেলেকে খুঁজে না পেলে মা কখনো পারে বাড়ির মধ্যে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে? আর শানুর মার নিশ্চিত ধারণা হতে থাকে, ডানদিকে যায়নি শানু—গেছে সেই বাঁ-দিকে যে দিকটা ওকে অবিরত টানত।

কিন্তু এই দুপুররোদে কতদূর যেতে পারে ওইটুকু ছোট্ট ছেলে!

শানুর মা সেই বালির চড়ায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়ান, আর সমুদ্রের শব্দ ছাপিয়ে চেঁচান, ‘শানু, শানুরে! শানু!’

সেশব্দকে আবার চাপা দিয়ে ফেলে সমুদ্র। যেন একটা চাপা আর্তনাদের মতো আওয়াজ করতে থাকে ‘গোঁ গোঁ গোঁ’!

‘ওই যে! ওই যে বসে রয়েছে।’

বালির গাদায় ছুটতে গিয়ে আছাড় খেতে খেতেও দৌড়োতে থাকেন শানুর মা। অনেক দূরে সমুদ্রের একেবারে কোণ ঘেঁসে বসে আছে দুষ্টুটা ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে।

শানুর মার চুলের রাশি বালিতে ভরে ওঠে, শাড়ির আঁচল বাতাসের ঝাপটে গা থেকে উড়ে বেরিয়ে যেতে চায়। ধুলোর ঝড়ে চোখ অন্ধ হয়ে ওঠে শানুর মার তবু ছুটতে থাকেন! সমুদ্রের অত কাছে কাছে হতভাগা ছেলেটা!

‘না দোকানে নেই। যায়নি! ওদিকেই যায়নি!’ বলতে বলতে ওদিক থেকে ঘুরে এসে শানুর বাবা অবাক হয়ে দেখেন শানুর মা ছুটছেন। আছাড় খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন আবার ছুটছেন।

‘কী হল ওদিকে?’

এ কথার উত্তর কেউ দিল না।

অগত্যা শানুর বাবাও ছুটতে থাকেন। কিন্তু বুঝতে পারেন না কেন ওদিকে যাচ্ছেন শানুর মা। ছুটতে ছুটতে কাছাকাছি এসে যান, হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, এদিকে কী?’

‘ওই যে:! বঃসে রহহেছে’—বাতাসে উড়ে যাওয়া কথা থেকে এইটুকু বুঝতে পারা যায়।

‘কোথায় কোথায়?’

‘ওই তো!’

সমুদ্রের দিকে মুখ করে হতাশ-দৃষ্টি ফেলেন শানুর বাবা, ‘কই?’

‘দেখতে পাচ্ছ না? রেগে ওঠেন শানুর মা। ‘সর্বনেশে দুষ্টুটা একেবারে পাড়ে গিয়ে বসেছে, যদি ঢেউ এসে নিয়ে চলে যায়!’ একটু দাঁড়িয়ে পড়েন শানুর মা, ‘একে কিন্তু তুমি বকতে পারবে না। বড্ড তুমি বক ওকে। এখন ওর নাওয়া খাওয়ার সময়—’

‘আচ্ছা বাবা বকব না। তোমার ওই আহ্লাদে গোপাল এলে রাজভোগ খাইয়ো তুমি। কিন্তু কোথায় তুমি দেখছ ওকে? আমি তো খালি কাঁটাগাছের ঝোপ দেখতে পাচ্ছি!’

কিন্তু শানুর মাও কি শেষপর্যন্ত তা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন? কাঁটাছোপ ছাড়া? সমুদ্রের ধারে এখানে সেখানে ছোটো ছোটো কাঁটাগাছের ঝাড় দূরে থেকে দেখাচ্ছে ঠিক ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে বসে থাকা একটা মানুষ। যেন সেমানুষটা রোদ গ্রীষ্ম সহ্য করে নিথর বসে থেকে সমুদ্রের ঢেউ গুনছে!

শানু ভাবা সেই কাঁটাগাছটার কাছে গিয়ে ভুল ভাঙতেই শানুর মা হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন, নিশ্চয় সমুদ্রে ডুবে গেছে শানু!’

‘কী আশ্চর্য, ওরকম করছ কেন?’ শানুর বাবা নিজে কাতর হয়েও ধমকে ওঠেন, বালি রাস্তা, হল চোরা রাস্তা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলে, সোজা চলছি মনে করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতে হয় সম্পূর্ণ উলটো দিকে। একলা পথে বেরিয়ে দিকহারা হয়েছে মনে হচ্ছে, ওই ওদিকটা দেখি! কিন্তু এতক্ষণে বাড়ি ফেরেনি তো?’

কিন্তু এত কথা শানুর মার মাথায় ঢোকে না, তিনি সেই কাঁটাঝোপের কাছটায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকেন, ‘ওরে শানু, আমি কেন মরতে দিঘায় এসেছিলাম?’

দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে পড়ে, শানুর মা-বাবার মুখ-চোখ বসে কালো হয়ে ওঠে, ওঁরাও দিকহারার মতো ঘুরে বেড়ান, বুঝতে পারছেন না কোনদিকে যাচ্ছেন। শুধু ডেকে বেড়াচ্ছেন, ‘ও শানু শানুমণি, আমরা তোকে আর বকব না বাবা। তুই চলে আয়।’

ক্রমশ হতাশ হন।

বুকের মধ্যে কাঁপুনি ধরে। তবে কি সত্যিই শানুর মা যা বলেছিলেন, তাই? লোনা জলের একটা বড়ো ঝাপট এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মিষ্টি ছোট্ট ছেলেটাকে?

কিন্তু সন্দেহ হলেই কি বিশ্বাস করা যায়? না, বিশ্বাস করে বসে বসে কাঁদা যায়? কান্নাকাটি করতে করতেই ছুটোছুটি করতে হয় শানুর বাবাকে। ছেলে হারিয়ে গেলে যা যা করতে হয় তাই করেন রাত্তির অবধি।

তা এ তো আর কলকাতা নয় যে, ঝপাঝপ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন, হাসপাতালে হাসপাতালে ফোন করবেন, আত্মীয়-বন্ধু যে যেখানে আছে সব্বাইর বাড়ি খোঁজ করে বেড়াবেন, আর মোটরগাড়ি চড়ে দিগবিদিক চষবেন!

এখানে না আছে মোটরগাড়ি, না আছে এত এত হাসপাতাল, না আছে কোনো চেনা-জানা বাড়ি, আর খবরের কাগজের অফিসের কথা তো বাদই দাও।

শুধু টিম-টিম করছে একটা পোস্ট-অফিস, সেখানে গিয়ে টেলিগ্রাম করে এলেন শানুর বাবা, শানুর মামার বাড়ি আর চেনা-জানাদের বাড়ি।

‘শানুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

স্টেশনারি দোকানের দোকানিটা বলল, ‘দেখুন, কেউ ভুলিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে কি না। জগতে তো বদলোকের অভাব নেই। ওই দূরের দিকে জেলেবস্তিতে খোঁজ করুন গিয়ে কাল সকালে।’

‘কাল সকালে কেন?’ শানুর মা জোরে বলে ওঠেন, ‘আজ এক্ষুনি যাব। কোথায় সেই জেলেবস্তি, দেখিয়ে দাও আমাদের—’

লোকটা একটু দুঃখের হাসি হাসল।

‘এখন কোথায় যাবেন? দেখছেন তো অন্ধকারের অবস্থা! খুঁজেও পাবেন না, তা ছাড়া রাত দুপুরে তাদের ঘরে হানা দিয়ে ছেলে খুঁজতে গেলে, জেলেরা খুন করে দেবে। এরা এমনিতে নিরীহ, কিন্তু যদি মনে ভয় ঢোকে, আর সন্দেহ আসে অকারণ ওদের উত্যক্ত করা হচ্ছে, তাহলে খেপে যায়। কাল সকালে যাবেন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে।’

‘এখানে পুলিশ কোথায় পাব?’ হতাশ হাহাকার করে ওঠেন শানুর বাবা।

‘পাবেন, ফাঁড়িতে পুলিশ আছে।’ দোকানিটা বিষণ্ণভাবে বলে, ‘দেখুন দিকি কী মুশকিল! আজই চলে যাবার কথা ছিল বলছেন, আর আজই কিনা—’

বাড়ির বাড়িওলাও ওই কথা বললেন।

বাড়িওলা নয় অবিশ্যি, সরকারি বাংলোর ম্যানেজার।

চারদিনের জন্যে বাড়ি বুক করেছিলেন শানুর বাবা, এই খবর জানিয়ে বলতে গেলেন, যে-ক-দিন না ছেলের সন্ধান পাচ্ছি, এ জায়গাটাকে তো ছেড়ে যেতে পারছি না। কাজেই আরও কয়েকদিন বাড়িটা—’

ভদ্রলোক বলে ওঠেন, ‘বিলক্ষণ নিশ্চয়, এ আর বলতে! ছেলে হারানো বলে কথা। তা আপনি একটা দরখাস্ত করে দিন। তবে কিনা হারানো ছেলে পাওয়া বড়ো শক্ত মশাই! ও আপনার মিথ্যে আশা। এই যে কাগজে এত নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন দেখেন, শুনেছেন কখনো তাদের কেউ ফিরে এসেছে? আসে না। আমি তো মশাই কাগজের ওই পৃষ্ঠাটাই তন্ন তন্ন করে পড়ি। অবিশ্যি আরও সবই পড়ি। কাগজ পড়া আমার নেশা। তা কই মশাই, আজপর্যন্ত তো কখনো দেখলাম না নিরুদ্দিষ্টের প্রত্যাবর্তন। কাজেই বুঝছেন কিনা—’

‘চুপ করুন। এসব অপয়া কথা বলছেন কেন?’ চেঁচিয়ে ওঠেন শানুর মা।

ভদ্রলোক থতোমতো খেয়ে বলেন, ‘অন্যায়টা কী বললাম মা লক্ষ্মী, অন্যায়টা কী বললাম?’

তা ভদ্রলোক বলছেন ঠিকই! অন্যায় আর কী করেছেন তিনি? অপয়া কথা বলতে বারণ করলেও শানুর মা-বাবা তো সেই অপয়া কথাই ভাবছেন বসে বসে।

ভাবছেন আর ফিরে পাব না শানুকে।

কলকাতা শহর নয় যে, আশা থাকবে কোথায় না কোথায় হয়তো আছে। কলকাতার হাজার হাজার বাড়ি, হাজার হাজার রাস্তা, লক্ষ লক্ষ দোকানপসার, গলিঘুঁজি, আর দলে দলে বদলোকের মাঝখানে একটা ছোটো ছেলে আটকে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু এখানে এই ছোট্ট দেশটুকুর মধ্যে?

যেখানে বাড়ির সংখ্যা আঙুলে গুনে শেষ করা যায়, মানুষ চোখে দেখাই যায় না, পথঘাট গলিঘুঁজি বলতে কিছুই নেই, সেখানে আর আশা করবার কী আছে?

সকালবেলার সেই সাতরকম মাছরান্না পড়ে পড়ে শুকোয়, আধবাঁধা বিছানা আর আধ-গোছানো বাক্স-সুটকেস ডাঁই করে পড়ে থাকে, শানুর মা-বাবার মুখে একটু জলও পড়ে না। তাঁরা শুধু মাটিতে শুয়ে পড়ে পড়ে ভাবতে থাকেন, খিড়কি বলে আর একটা দরজা আছে সেটা কেন আগে দেখিনি! ভাবতে থাকেন দিঘায় বেড়াতে আসার শখ না করে ছুটিটা কলকাতাতেই কেন থাকিনি!

আর শানু?

সেকি সত্যিই সমুদ্রের তলায় তলিয়ে গেছে? নাকি কোন ছেলে-চোরের খপ্পরে পড়েছে? আর নাকি এখনও ধু ধু বালির চড়ায় পথ হারিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

ছুট! ছুট! ছুট!

বালির গাদায় দৌড়োনো সহজ নয়। তবু প্রাণপণে ছুটতে থাকে শানু বালির গাদায় পা ডুবিয়ে আর বালির গর্ত থেকে পা টেনে তুলে তুলে। মুখটা ওর লাল হয়ে ওঠে, বুকটা ওঠা-পড়া করতে থাকে। কেউ যদি তখন শানুকে দেখত, নির্ঘাত ভাবত শানুর পেছনে গুণ্ডা, পুলিশ কিংবা পাগলা কুকুর তেড়ে আসছে।

আসলে কিন্তু শানুর মনের পেছনে তাড়া করে আসছিল বাবার ভয়। বাবা যদি হঠাৎ বাড়ির পেছনের সেই ছোট্ট দরজায় এসে দাঁড়ান, আর দেখেন শানু তাঁর বারণ-টারণ না শুনে দুপুর রোদ্দুরে বাইরে বেরিয়েছে, তা হলে কী হতে পারে শানুও বলতে পারবে না। কাজেই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বাড়ির কাছ থেকে মিলিয়ে যাওয়া।

অনেকক্ষণ ছুটে পা যখন আর কিছুতেই চলল না, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠল, তখন একবার সাহস করে পেছন ফিরে তাকাল শানু। তাকিয়ে ওদের বাড়ি, কী বাড়ির সেই পেছনের দরজাটার চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে একটু বসে পড়ল।

বসে পড়ল একটা ঝাউগাছের নীচে বালির ওপর পা ছড়িয়ে। এখানটা বোধ হয় সমুদ্রের ধার থেকে নীচু জমি, তাই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না—শুধু তার সেই চির অশ্রান্ত কলরোল কানে এসে বাজছে। আর সেশব্দ শানুকে যেন সবকিছু ভুলিয়ে হাজার হাজার বছর পার করে নিয়ে যাচ্ছে দূর অতীতে।

রামচন্দ্র তিরধনুক নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সমুদ্রকে শাসন করবেন বলে, সমুদ্রদেবতা জল থেকে উঠে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে কাতর প্রার্থনা করছেন, বেঁধো না—আমাকে বেঁধো না।

রামচন্দ্র বাণ সংবরণ করলেন। দলে দলে বানর সেনা পাথরের চাঁই হাতে করে এনে ফেলতে লাগল সমুদ্রের জলে। শিলা ভাসতে থাকল রামচন্দ্রের মহিমায়। তারপর এল কাঠবেড়ালি, সেও যোগ দিল সমুদ্রবন্ধনে।

আর তারপর?

পায়ে হেঁটে রামচন্দ্র চললেন লঙ্কায়।

ব্যাকুল শানু ভাবতে থাকে একালে কেন রামচন্দ্রের মতন ভয়ানক বীরেরা থাকেন না—যাঁরা ইচ্ছে করলেই সমুদ্র বন্ধন করতে পারেন। রাক্ষস মেরে সীতা উদ্ধার করতে পারেন। পারেন মেঘের আড়ালে থাকা ইন্দ্রজিৎকে বাণ মারতে।

শানু মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘ছাই! একালে বীর বলে কিছু নেই।’

নিজের কথাটা নিজের কানে যেতেই হঠাৎ কেমন অস্বস্তি হল শানুর। একা একা কথা বলা অবশ্য ওর খুবই অভ্যেস, খেলতে খেলতে কী গল্পের বই পড়তে পড়তে মনের কথা মুখে বলে ওঠে ও। কিন্তু সেতো এমন তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে নয়। এখানে সমুদ্রের শব্দ আর ঝাউবনের শব্দের মাঝখানে নিজের গলার শব্দে গা ছমছম করে উঠল।

তবু ভাবতে লাগল শানু—একালের যুদ্ধু-টুদ্ধু সব ফক্কিকারি। আকাশ থেকে বোমা ফেলায় আবার বীরত্ব কী? রাক্ষসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাণ মেরে তাকে নাস্তানাবুদ করে ফেলার মতো বীরত্ব নাকি সেটা?

একাল সম্পর্কে হতাশ হয়ে উঠে পড়ল শানু। আর সেই কেমন একরম ভয়-ভয় আর গা ছম-ছমানি নিয়ে এগোতে থাকল কোনো একটা দিক ধরে। ‘বাঁ দিক’ নামক সেই অজানা দিকটা যেন হঠাৎ কীরকম গোলমাল হয়ে গেছে।

ঝাউবনের পেছন দিকটাই কি সেই বাঁদিক?

আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, ওই ধু ধু বালির মাঠ পেরিয়ে অনেক অনেক দূরে সত্যিই একটা অজানা দেশ আছে! পৃথিবীর সব লোকেরা এখনও আবিষ্কার করেনি সেই দেশ! জানে না, তাই কেউ যায়ও না ওদিকে।

কিন্তু শানু হাঁটতে হাঁটতে সেইখানে গিয়ে পড়বে। আর অদ্ভুত-পোশাক-পরা অদ্ভুত অদ্ভুত সব লোক শানুকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াবে। আর শানু—

গল্পের বইতে ঠিক ওইরকম জায়গায় গল্পের ছেলেরা কী করে ভেবে নিল শানু। কী আর করে, হাত-মুখ নেড়ে ইশারায় তাদের সঙ্গে কথা চালায়। শানুও তাই করবে। তারপর তারা শানুর সঙ্গে গল্প করবে। শানু যা চায় দেবে।

আচ্ছা কী-ই বা ওদের আছে?

হয়তো পাখির পালক, নয়তো জন্তুর ছাল, কী সমুদ্রের কড়ি-ঝিনুক। আর কী থাকা সম্ভব?

কিন্তু ওরা যে স্রেফ অসভ্য বুনো। মাথায় পাখির পালক গোঁজে আর কোমরে হরিণের চামড়া জড়ায়, একথা কে বলল শানুকে? শানু ভাবে, এমনও তো হতে পারে বিরাট এক ঐশ্বর্যশালী রাজার রাজত্ব আছে ওখানে। শানু গিয়ে হকচকিয়ে যাবে।

শানু গিয়ে দেখবে সেখানে লোকেরা সবাই হিরে-বসানো সোনার জামা পরে, মুক্তো-বসানো রুপোর জুতো পায়ে দেয়, নীচু পান্না নাকি—সেইসব পুঁতে পুঁতে বাড়ির দেয়ালের বাহার করে।

কে জানে বা সেই দ্বাপর যুগের যুধিষ্ঠিরের স্ফটিক প্রাসাদের মতো প্রাসাদ আছে কি না ওখানে!

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে পাবে শানু রোদে ঝলমলে সেই স্ফটিক প্রাসাদের মাথায় সোনার চুড়ো ঝকমকাচ্ছে। সেই প্রাসাদের দারোয়ান প্রহরীরা পর্যন্ত ঝকমকে ঝলমলে।

আর সেখানের রাজা?

সেতো শানু ভাবতেই পারছে না কত সুন্দর! একালে নাকি রাজা নেই! শানুর ছোটো মামা একদিন বলেছিলেন, ‘রাজা নেই, রাজা থাকতেও নেই। অনেক প্রজার ওপর একজন রাজা হয়ে বসে রাজত্ব করা অন্যায়।’

কথাটা শানুর ভালো লাগেনি।

রাজা হওয়াই যদি অন্যায়, তাহলে রাজ্যটা চালাবে কে? আর চকচকে ঝকঝকে ঝলমলে সুন্দর মুকুট টুকুট পরবে কে? পৃথিবীসুদ্ধু মানুষ সবাই শার্ট কোট ধুতি পাজামা এইসব পরে ঘুরে বেড়াবে? পায়রার ডিমের মতো বড়ো বড়ো মুক্তোর মালাই বা তবে কাদের জন্যে তৈরি হবে, যদি রানি আর রাজকুমারী থাকবে না?

তা কিছুই যদি থাকবে না, তাহলে কাদের নিয়ে গল্প তৈরি হবে? আর বীরত্বই বা দেখাবে কারা?

না: ছোটোমামার সেই কথাটা মোটেই ভালো লাগেনি শানুর। তাই শানু কল্পনা করতে থাকে, ছোটোমামার চোখের আড়ালে রাজপ্রাসাদ, রাজা-রানি, রাজকন্যা সবই আছে। ছোটো মামা জীবনে কখনো দিঘায় আসেননি বলেই, আর দেখেননি বলেই—

আচ্ছা, ওই প্রাসাদের রাজা হঠাৎ শানুর মতো ছোট্ট একটি অন্য রাজ্যের ছেলেকে দেখে কী রেগে মারতে আসবেন, না ভালোবাসবেন?

শানুর তো নিশ্চিত বিশ্বাস হচ্ছে—ভালোই বাসবেন। বাসবেন না কেন, ওই অনাবিষ্কৃত দেশের রাজার মেজাজটা তো খুবই ভালো হওয়া উচিত। তাঁকে তা পৃথিবীর সেরা বিচ্ছিরি জায়গা কলকাতায় থাকতে হয় না!

না, না। রাজা বা তেমনি বড়োসড়ো জমকালো কারও চোখে যদি পড়ে যায় শানু, তিনি শানুকে আদর করে বলবেন, ‘বলো তোমার কী চাই? যা চাইবে তাই পাবে।’

বলে ধনভান্ডার খুলে ধরবেন শানুর সামনে। কিন্তু যদি— হঠাৎ একটা কথা ভেবে বেজায়রকম ভাবনায় পড়ে যায় শানু।

হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায় শানু। ঠোঁটটা চেটে নেয়। একটু হাঁপায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একবার, তাকিয়ে দেখে সামনের দিকে। তারপর ভাবে যদি সেই রাজামশাই বলেন, ‘তোমাকে কিন্তু কেবলমাত্তর একটা জিনিস দেওয়া হবে—মাত্তর একটা। সেতুমি যা চাও। এক ঘড়া মোহর, এক তাল সোনা, এক থলে হিরে-মুক্তো, কী এক থালা—’

সেসব কথা কি কান দিয়ে শুনবে শানু? ওই সব হিরে-মুক্তো সোনার কথা? না, শুনবে না। শানু চাইবে শুধু এক গেলাস জল— ঠাণ্ডা কনকনে বড়ো এক গেলাস জল!

হ্যাঁ, এখন আর ওর থেকে ভালো কোনো জিনিসের কথা মনে আসছে না শানুর। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেরা জিনিস হচ্ছে ‘জল’।

আচ্ছা বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মার কাছে জল চেয়েছিল শানু? বলেছিল না, জল খাব?

খেয়েছিল কি? মনে করতে পারল না। শুধু মার রান্নাঘরের সেই জল-টইটুম্বুর বালতিটার কথা মনে মনে পড়তে লাগল তার।

তবে কি সেই বালতির দিকেই ফিরে যাবে শানু? আর হাঁটবে না? সন্ধান করে দেখবে না, কী আছে আরও অনেক—অনেক দূরে?

তা হলে তো শানু ভীরু কাপুরুষ ছাড়া আর কিছুই হবে না। একটু তেষ্টা পেলেই যে কাতর হয়ে সংকল্পচ্যুত হয় তাকে কি কেউ মানুষ বলবে? ভয়ানক ভয়ানক বীরেরা যখন মরুভূমি পার হয়, যখন উটের গলার জলটিও ফুরিয়ে যায়—তা ছাড়া রণক্ষেত্রে জলের অভাবে সৈনিকদের কী হয়?

আর আবিষ্কারকদের তো শুধুই কষ্ট—শুধুই কষ্ট।

কত ডাকাতদের হাতে পড়তে হয় তাদের, কত বাঘের মুখে।

কুমিরের কামড়ও খেতে হয় কত সময়। তা ছাড়া খেতে না পাওয়া, জল না পাওয়া, এ সব তো নিয়ম।

কিন্তু—

ভাবল শানু, তেষ্টার সময় জল না পাওয়ার মতন কষ্ট বোধ হয় কুমিরের কামড়েও নয়। এখন যদি ভগবান রাখাল বালকের বেশ ধরে এক কুঁজো জল নিয়ে আসতেন!

ক্রমশ আর জলের গেলাসের কথা ভাবছে না শানু, কুঁজোর কথাই ভাবছে।

আর শুধুই কি কুঁজোর কথা? মামার বাড়ির দালানের কোণটায় বসে থাকা বিরাট সেই পেটমোটা জালাটার কথা ভাবছে না? যে জালাটা শানু জন্মানোর আগে থেকে সেখানে আছে। উঃ জালাটার গা-টাই কী ঠাণ্ডা। গায়ে হাত বুলোলে খানিকটা তেষ্টা ভাঙে!

কিন্তু তেমন বেশি করে জল তো কোনোদিন খায়নি শানু।

ইস কী বোকামিই না হয়ে গেছে!

সেই একজালা জল যদি শানু সবটা খেয়ে রাখত, তা হলে হয়তো এখন এত তেষ্টা পেত না। পেটের ভেতরটা বেশ জোলো জোলো হয়ে থাকত।

গলার ভেতর থেকে জিভ ঠোঁট সব কিছু শুকিয়ে উঠে যেন পেটের ভেতর দিকে টানছে। এতক্ষণ ঢোক গিলে গিলে মুখটা ভেজা রাখছিল, তাও আর হচ্ছে না। গায়ের মধ্যে কীরকম যেন বমিভাব আসছে।

ক্রমশ শানু আর মামার বাড়ির জালাটার কথাও ভাবছে না, ভাবছে দেশের বাড়ির সেই প্রকান্ড ইঁদারাটার কথা। কলসি বা বালতিতে দড়ি বেঁধে কপিকলের সাহায্যে জল টেনে তোলা হয় ইঁদারা থেকে। শানুকে এখন যদি তেমনি করে কেউ কোমরে দড়ি বেঁধে ইঁদারার মধ্যে নামিয়ে দেয়! শানু তা হলে সেই কলসিগুলোর মতো ‘বক-বক’ শব্দ করতে করতে ইঁদারার সমস্ত জলটা খেয়ে শেষ করে ফেলে।

অনেকক্ষণ পরে শানুর খেয়াল হয় এক পাও আর হাঁটছে না সে! শুধু হাঁটু ধরে উবু হয়ে বসে হাঁপাচ্ছে।

মাথার ওপর ‘দুপুরে সুয্যি’র গনগনে আগুন, আর পায়ের নীচে তার থেকেও গনগনে বালি! পেটের মধ্যেটা খিদেয় খাক হয়ে যাচ্ছে, আর সমস্ত শরীরটা ঝাঁই-ঝাঁই করছে। অজানা দেশ আবিষ্কার করা যে এতই কষ্ট তা কে জানত!

আচ্ছা শানু যদি একবার ছুট্টে বাড়ি গিয়ে যত পারে জল খেয়ে নিয়ে আবার কাজে লাগে তাহলে নিশ্চয় নতুন জোর পেয়ে অনেক অনেক হাঁটতে পারে।

কিন্তু বাড়ি ফিরলে আবার বেরোবার আশা আর কোথায়? তা ছাড়া বাবা! বাবা যখন দেখবেন শানু তেপান্তরের মাঠ ঘুরে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি এসে কথা বলতে পারছে না, শুধু জল খাচ্ছে—বালতি বালতি জল, তা হলে? তা হলে বাবা কী করবেন শানু ভাবতে পারে না। তবু—তবু সেই বাড়িই তাকে যেন হাজারটা হাত বাড়িয়ে টানতে থাকে।

বাড়ি ফিরলেই এক্ষুনি কলকাতায় ফিরতে হবে। জীবনে আর কখনো দিঘায় আসা হবে না শানুর সমুদ্দুর আর সমুদ্দুরের পারের দেশ যেমন পড়ে ছিল তেমনিই পড়ে থাকবে চিরকাল। তবু ফেরা ছাড়া উপায় কী! তেষ্টায় মরে গিয়ে শানুও যদি সেখানে পড়ে থাকে, কী লাভ হবে তা হলে পৃথিবীর?

রোদে আর বালি ঝাপটায় চোখের মধ্যে করকর করছে, জ্বালা করছে শুধু চোখ নয়, সমস্ত গা। আবিষ্কারক হবার ইচ্ছেটায় আর যেন কোনো জোর থাকছে না। অন্তত জল না খেয়ে যেকোনো কিছুই হওয়া যাবে না, এক মাত্তর ‘মড়া’ হয়ে যাওয়া ছাড়া, এটা টের পাচ্ছে শানু।

হায় ভগবান!

রাখাল বালক সেজে জলের জালা মাথায় নিয়ে একবার যদি এদিক এসে পড়তে তুমি, কতটুকু আর কষ্ট হত তোমার? তুমি তো ইচ্ছে করলেই সব কিছু করতে পারো। অথচ সেই ইচ্ছেটুকু তুমি করো না। মানুষ মরে গেলেও তোমার যেন কিছু ক্ষেতি নেই! ছি ছি? ‘ভগবান’ নাম নিয়ে আকাশে চড়ে বসে থাকার তোমার দরকার কী তা হলে?

ভগবানের দয়ার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে হাঁটু ধরে উঠে পড়ল শানু। বাড়ি গিয়ে জল খেয়ে যা হয় হবে।

যেদিকে চলছিল শানু তার উলটো দিকে চলতে শুরু করে হাঁটু ধরে ধরে, চোখ কুঁচকে কুঁচকে।

কিন্তু কোথায়? কোনদিকে? কোনদিকে বাড়ি শানুদের? যেদিকে চোখ ফেলছে, দেখছে শুধু রোদলাগা আরশির মতো জ্বল-জ্বলে মাঠ। তাকানো যায় না।

তবু কষ্ট করে করে দেখে শানু সেই ছোট্ট লাল রঙের বাড়িখানির আভাসও দেখা যায় কি না।

কিন্তু কোথায় কী? কোনদিক দিয়ে এসেছিল শানু?

কোনদিকটা ছিল ডানদিক আর কোনদিকটা বা বাঁদিক? তাকাতে তাকাতে অবশেষে পাগলের মতো চতুর্দিকে ছুটোছুটি করতে থাকে সে।

ক্রমশই সব ধোঁয়া হয়ে আসে, দিকহারা শানু আর পাগলের মতো ছুটতেও পারে না, হাঁটু দুমড়ে দুমড়ে পড়ে, আর এতক্ষণে হঠাৎ মনে হয় তার—সেহারিয়ে গেছে।

শানু হারিয়ে গেল?

খবরের কাগজের ছেলেরা যেমন হারিয়ে যায়! যে ছেলেদের কথা বাবা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ে মাকে শোনান, ‘শুনছ, শুনতে পাচ্ছ— এই দেখো! সাধে কী আর তোমার আদুরে গোপালকে একা খেলতে যেতে মানা করি? কীভাবে দিনে দু-দশটা ছেলে হারাচ্ছে, খোঁজ রাখো না তো।’

শানু তা হলে সেই হারানো ছেলেগুলোর মতো হারিয়ে গেল!

হঠাৎ ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ওঠে শানু, ‘মা মাগো! মা!’

শানু হারিয়ে গেলে মার কীরকম কষ্ট হবে তাই ভেবে ডুকরোনো বেড়েই যেতে লাগল শানুর।

কিন্তু শানু কি আর ভাবতেই পারছে?

কাঁদতে কাঁদতে ক্রমশ শানুর চোখ থেকে বিশ্ব চরাচর লুপ্ত হয়ে যায়, মুছে যায় আকাশের আলো।

শরীরের মধ্যে যে অসহ্য একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল তারও আর সাড়া থাকে না।

সেই গরম বালির ওপর অজ্ঞান হয়ে গড়িয়ে পড়ে শানু। শুধু যতক্ষণ পর্যন্ত চৈতন্যের রেশটুকু থাকে তার, মনশ্চক্ষে ভাসতে থাকে শুধু মার মুখ। মা ফুলে ফুলে কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে গিয়ে উঠছেন, কেঁদে কেঁদে বলছেন, ওরে শানুরে, কেন মরতে আমি দিঘায় এসেছিলাম!

মার এই যন্ত্রণায় বুক ফেটে যেতে থাকে শানুর।

আবার বাবার নিষ্ঠুরতায় চৌচির হয়ে যাক বুক। বাবা নিশ্চয়ই মার সেই কষ্টের ওপর বকুনি লাগাচ্ছেন! বলছেন, ‘হবেই তো। আগেই জানতাম আমি এসব হবে। দিঘা দিঘা দিঘা! হল তো দিঘায় আসার সুখ! বেশ হয়েছে!’

গাড়ি ছেড়ে দেবে।

শানুর মা-বাবা মোটমাট বাক্স-বিছানা নিয়ে দিঘা ছেড়ে চলে যাবেন, আর শানু পড়ে থাকবে। পড়ে থাকবে এই তেপান্তরের মাঠে।

পড়ে থেকে থেকে মরেই যাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে। কেউ তুলবে না শানুকে……কেউ একটু জল দেবে না….রোদে শুকিয়ে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাবে….ঝড়ে বালি উড়ে উড়ে ঢাকা পড়ে যাবে সেকঙ্কাল …….যদি কোনোদিন শানুকে খুঁজতে আবার দিঘায় আসেন মা, জানতেও পারবেন না শানু কোনখানটায়….ভয়ানক একটা কান্নার আবেগে হৃৎপিন্ডে ধুকধুকুনিটা ঝপ করে থেমে গেল।

ভাবনার জগৎ থেকে খসে পড়ে গেল শানু। সমুদ্রের শব্দও স্তব্ধও হয়ে গেল তার কাছে।

ক্রমশ রোদের তাত কমে এল, বেলা গড়াতে গড়াতে সন্ধ্যায় পৌঁছোল, সন্ধে থেকে পৌঁছোল রাত্রে। গরম বালি ঠাণ্ডা হতে হতে মায়ের কোলের মতো স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। এ সবের কিছুই টের পেল না শানু।

টের পেল না কখন সেই গভীর অন্ধকার আবার ফিকে হয়ে এল, আর সেই আবছা অন্ধকারে জন তিন-চার কালো কুৎসিত বেঁটে লোক, লম্বা লম্বা এক একখানা বাঁশ ঘাড়ে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ‘হুমহুম’ করে সেখান দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দাঁড়িয়ে পড়ার সময় তারা সমস্বরে যে একটা দুর্বোধ্য শব্দে চিৎকার করে উঠল, তাও শানুর কানে ঢুকল না।

লোকগুলো কাঁধের বাঁশ মাটিতে নামিয়ে শানুর খুব কাছে এসে ঝুঁকে বসল, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকাল, মাথা নাড়ল।

সাহস করে গায়ে হাতও দিতে পারল না কেউ, অথচ ছেড়েও যেতে পারল না। শানুকে ঘিরে বসেই রইল অনেকক্ষণ। আর নিজেদের মধ্যে ইশারায় ইঙ্গিতে কথা চালাতে লাগল।

ধীরে ধীরে আবছা কেটে গেল।

ধীরে ধীরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত চরাচরে।

আর এতক্ষণে একটা লোক সাহস করে শানুর গায়ে হাত ঠেকলে, আর ঠেকানোর সঙ্গে সঙেই চমকে চেঁচিয়ে উঠল সে।

এ চেঁচানিটা যেন উল্লাসের। কিন্তু উল্লাস হলেই বা কী, বিষাদ হলেই বা কী। শানু তো কিছুই টের পাচ্ছে না।

টেলিগ্রাম পেয়ে শানুর দুই মামা ছুটে এলেন দিঘায়। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার!’

শানুর বাবা শুধু কপালে একটা হাত ঠেকালেন।

আর শানুর মা?

থাক, সেকথা আর বেশি লিখে কাজ নেই। পড়ে তোমাদের কান্না পেয়ে যাবে। বুঝতেই তো পারছ সেই মনের অবস্থায় ভাইদের দেখে কী করলেন তিনি। মামারা বোনকে থামাতেই পারেন না।

ভাইরা এসেছে, তারা কী খাবে না খাবে, সেদিকেও দৃকপাত নেই শানুর মার। শানু হারানো পর্যন্ত এই তিন-তিনটে দিন তো রাঁধাও নেই, খাওয়াও নেই শানুর মা-বাবার।

খাওয়া-দাওয়া নেই, খালি পরামর্শ আর পরামর্শ। বড়োমামা বললেন, ‘কলকাতার পুলিশকে জানানো হোক। আর তাদের জানিয়ে দাও তাদের ডিটেকটিভ কুকুর ‘লাকি’ কিংবা ‘মিতা’কে যেন আনে, তাদের নাকের কাছে শানুর একটা ছাড়া জামা ধরে দিলেই ব্যস— শানুকে চিন-জাপান-তিব্বত-রাশিয়া-হাওড়া- চব্বিশ পরগনা যেকোনো জায়গা থেকে হোক, খুঁজে বার করবেই।

‘আর যদি—’ শানুর মা কেঁদে উঠলেন, ‘সমুদ্রের তলায় গিয়ে থাকে শানু?’

‘কেন সমুদ্রের তলাতেই বা যাবে কেন?’ বকে উঠলেন ছোটোমামা, ‘তোর খালি যত কুভাবনা! বেড়াতে বেরিয়ে পথ হারিয়ে কোনো বদলোকেদের পাল্লায় পড়েছে মনে হচ্ছে।’

‘বদলোকেদের হাতে পড়া, আর সমুদ্রের তলায় গিয়ে পড়ায় তফাত কী ছোড়দা?’ চেঁচিয়ে উঠলেন শানুর মা, ‘যদি কোনো নরখাদক জাতির হাতে পড়ে থাকে?’

‘না: তোদের নিয়ে আর পারা যাবে না,’ বড়োমামা বললেন ধমকে, ‘নরখাদক! মাথায় আনাকেও বলিহারি। এ কী আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে পড়েছে? কলকাতার এত কাছে কিনা নরখাদক।’

শানুর মা ভাইদের সঙ্গে কথায় নিজের তার্কিক স্বভাব ফিরে পান, কাঁদো-কাঁদো ঝংকারে বলেন, ‘থাকে না। আফ্রিকার জঙ্গল ছাড়া নরখাদক থাকে না? কলকাতার এত কাছে থাকে না। তাহলে সেবার রাঙাদিরা ঝাড়গ্রামে বেড়াতে গিয়ে নরখাদকের হাতে পড়েছিল কেন? মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল না? মনে নেই?’

‘না মনে নেই।’ আর একবার ধমকে ওঠেন বড়োমামা, ‘মেয়েদের এই এক বিশ্রী স্বভাব, খালি খারাপটাই ভাববে। আরে আমি বলছি—এমনও হতে পারে, পথ হারিয়ে ফেলে, শানু বুদ্ধি করে কাউকে বলেকয়ে বাসে গিয়ে চড়ে বসে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়েছে।’

‘হায় ভগবান! তেমনি বুদ্ধিই যদি থাকত।’ শানুর বাবা বললেন, ‘বুদ্ধি বলে কোনো বস্তু ওর মধ্যে আছে নাকি? শাস্ত্রে যে বলে—নরাণাং মাতুলক্রমঃ, সেটা সত্যি। ও ঠিক ওর মামাদের মতো হয়েছে।’

অন্য সময় হলে এই নিয়ে শানুর মার সঙ্গে শানুর বাবার লেগে যেত একখানা। ভাইদের ‘বোকা’ অপবাদ সহ্য করতেন না শানুর মা। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। তাই চুপ করে থাকলেন শানুর মা।

শুধু শানুর বড়োমামা বললেন, ‘বোকারা তবু নিজেদের ছেলেমেয়েগুলোকে না হারিয়ে গুছিয়ে রাখে, আর বুদ্ধিমানেরা—’

শানুর মা বলে উঠলেন, ‘এই তো দাদা, ঠিক বলেছ! রাতদিন খালি শাসন আর শাসন। অতটুকু বাচ্চা, পারে কখনো সহ্য করতে? মনের দুঃখে তাই সমুদ্রের জলে—’

শানুর মার সব কথাই শেষ অবধি চোখের জলে ভেসে সমুদ্রের জলে ডুবে যাচ্ছে।

শানুর বাবা মলিনমুখে বসে বসে ভাবেন, হে ঈশ্বর, একবার যদি ফিরিয়ে দাও শানুকে, চিরজীবনে আর কখনো শাসন করব না। পাঁচ টাকার আইসক্রিম, ছটাকার ফুচকা, সাড়ে আট টাকার আলুকাবলি খেতে চাইলেও না।

অতঃপর কলকাতার পুলিশ …লাকি..মিতা…ট্রাঙ্ককল ইত্যাদি নানা কথা চলতে থাকে।

শানুর মা কোনো একসময় ঘুমিয়ে পড়েন, আর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেন, শানুকে খুঁজতে বেরিয়েছেন তিনি, কত পাহাড়-পর্বত নদনদী পার হচ্ছেন, কত রাস্তাঘাট, কত বড়ো বড়ো ব্রিজ সব পার হচ্ছেন হেঁটে হেঁটে, কোথাও পাচ্ছেন না। তারপরে যখন একেবারে আর হাঁটতে পারছেন না, বসে পড়েছেন, তখন কোথা থেকে কে জানে শানু এসে মার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ডাক দিয়ে উঠেছে—মা মা মা/!

জ্ঞান অজ্ঞানের ঝাপসা ঝাপসা মাথায় জ্ঞানটা যেই স্পষ্ট হয়ে উঠল, শানু আস্তে চোখ খুলে ডাকল, ‘মা!’

ওইটুকু পরিশ্রমেই আবার চোখ বুজতে হল বেচারাকে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করল, আবার একটু জোরে ডাকল ‘মা!’ ভাবল এইবার মা ছুটে আসবেন। তাড়াতাড়ি বলবেন, ‘কী রে শানু? কী বলছিস? জল খাবি? কষ্ট হচ্ছে? মাথায় বাতাস দেব?’

শানু যে কোথায় আছে, শানুর ওপর দিয়ে যে কত ঝড় বয়ে গেছে, এসব আর কিচ্ছু মনে নেই শানুর। মনে পড়ছেও না। ও ভাবছে কলকাতার বাড়িতে আছে, অসুখ করেছে ওর। সেই সেবার দেশ থেকে আসার পর যেমন ম্যালেরিয়া জ্বর হত মাঝে মাঝে। প্রবল জ্বর। তার পরদিন জ্বর ছাড়ার দিন যেরকম শরীরের অবস্থা থাকত, ঠিক তেমনি মনে হচ্ছে শানুর।

মা শুনতেই পাচ্ছেন না!

ভারি অভিমান হল শানুর। খুব চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘মা!’ আর সেই চেঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখটা তার ভালো করে খুলে গেল।

কিন্তু এ কী! এ কী!! এ কী!!!

চোখ খুলে গেল, না চোখ বুজে শুয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছে শানু? এ কোথায় শুয়ে আছে সে? এ কীরকম ঘর? ঘরের দেয়ালে ওসব কী ঝুলছে? কী বিশ্রী বিছানায় শুয়ে আছে সে!

দেখেশুনে আর তো ‘মা’ বলে ডাকবারও সাহস নেই? কী এসব বোঝবারও ক্ষমতা নেই। শানু আবার চোখ বুজল, আর ভাবতে আরম্ভ করল। ব্যাপারটা কী! এসব কোথা থেকে কী হচ্ছে? ভাবতে ভাবতে ক্রমশ সব স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। মনে পড়ে যায় শানুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেনতুন দেশ আবিষ্কার করতে যাচ্ছিল, মাঝখান থেকে কোথা থেকে কী হয়ে গেল? মনে পড়ছে শানু গরম বালিতে হাঁটতে হাঁটতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

এরা তাহলে কুড়িয়ে এনেছে তাকে।

কিন্তু রো কারা? নরখাদক জাতি নয় তো? মা যে সেই একবার গল্প করেছিলেন, রাঙামাসিরা নরখাদক জাতির হাতে পড়েছিলেন।! অবিশ্যি তারা রাঙামাসিদের খেয়ে ফেলেনি। কারণ খেয়ে ফেললে আর চোখ-মুখ গোল করে সেই ভয়ংকর কান্ডের গল্পটা করত কে?

কিন্তু শানু কি আর তেমন দিন পাবে? চোখ-মুখ গোল করে গল্প করবার দিন? চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে শানুর।

একটু পরে সেই গত কালকের কালো কালো বেঁটে বেঁটে রামবিচ্ছিরি লোকগুলোর দুটো এসে ঘরে ঢুকল।

অজানা একটা ভাষায় দুর্বোধ্য একটা শব্দ করল, তারপর শানুর মাথার কাছে এসে উবু হয়ে বসে কত কিছু বলল। শানু তো সেই বিকটদর্শন লোকগুলো কাছে বসাতেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ফিরে পাওয়া জ্ঞান—আবার হারায় আর কী।

কিন্তু লোক দুটোর মুখ দুঃখু দুঃখু, নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর নয়। কথা বলে ওরা বোধ হয় বুঝতে পারল কথা কওয়াটা মিথ্যে খাটুনি। এই ক্ষুদে খোকাটা বুঝতে পারবে না। তখন হাত-মুখ নেড়ে ইশারা করে বোঝাতে চেষ্টা করল—‘কেমন আছ? খিদে পেয়েছে কি না, কী খাবে?’

হঠাৎ শানুর ভয়টা একটু ভেঙে গেল। ওর মনে পড়ল ও আবিষ্কারে বেরিয়েছে, আর একটা অজ্ঞাত দেশে অজ্ঞাত মানুষদের হাতে এসে পড়েছে। এখন ওকে বুদ্ধির জোরে এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে হবে, আর নয় তো বুদ্ধির কৌশলে এদের হাত থেকে পালাতে হবে।

তখন শানুও মাথাটা নেড়ে জানালে, হ্যাঁ, সেভালো আছে, আর তার খিদেও পেয়েছে।

ওরা যেন বেশ প্রসন্ন হল। খুশি-খুশি, মুখে কী যেন বলে চলে গেল।

তারপর এল একটা আধ-বুড়ি মতন মেয়েমানুষ। তার একটা হাতে কাঁচা শালপাতার ঠোঙায় করে কী যেন, আর একটা হাতে মাটির একটা ছোট্ট হাঁড়িতে কী।

শানু তখন সত্যিই খিদেয় যাকে বলে চোখে কানে দেখতে পাচ্ছে না। ও হাত বাড়াল। কিন্তু বুড়িটা মাটিতে পাতাটা আর ভাঁড়টা নামিয়ে রেখে ইশারায় বলল, ‘খাও, আমি যাচ্ছি।’

কিন্তু ঝপ করে খাবে কী করে?

জিনিসটা কী?

মাটির ছোট্ট ওই হাঁড়ি মতনটায় অবশ্য দুধ রয়েছে দেখা যাচ্ছে কিন্তু খাবে কী করে শানু? হাঁড়িসুদ্ধু গলায় ঢালবে নাকি? তা ছাড়া পাতায় ওই যেটা রয়েছে? মনে হচ্ছে কিছুর মাংস। কিন্তু একেবারে কেলেকিষ্টি, আর শুকনো শুকনো। কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে।

খাবার ইচ্ছে মনেই রেখে শানু বোকার মতো বসে রইল, আর একটু পরে ভগবানের আশীর্বাদের মতো একটা জিনিস ঘরে এসে পড়ল।

ঠিক ‘জিনিস’ অবিশ্যি বলা চলে কি না জানি না। মানুষকে যদি জিনিস বলা যায় তো জিনিস। একটা প্রায় শানুর বয়সি ছেলে ব্যাঙের মতো থপাস করে লাফিয়ে ঝুপ করে এসে পড়ে বলে উঠল, ‘কি রে খাসনি?’

ছেলেটা যে একটা কেলে বিচ্ছিরি ধাঙড়-মেথরের মতো শুধু একটু কোপনি পরা, আর সেই ছেলেটা যে শানুকে ‘তুই বলছে, সেকথা মনে পড়ল না শানুর। ও শুধু মোহিত হয়ে হয়ে শুনল ছেলেটা বাংলা কথা কইল। সেইটাই ভগবানের আশীর্বাদের মতো।

‘তুই বাংলা কথা জানিস?’ বিগলিত আনন্দে বলে উঠল শানু।

‘বাংলা? হি: জানি!

বলল ছেলেটা। তারপর বলল, ‘আমরা তো বাঙালিই হই।’

‘তুই কাদের ছেলে!’

‘এই এদের।’

‘ধেৎ! এরা বুঝি বাঙালি?’

‘হি: তো!’

বলে ছেলেটা হঠাৎ একটা পাক খেয়ে মস্ত একটা ডিগবাজি মেরে হি হি করে হেসে উঠল।

‘সত্যি বল না রে!’ শানু কাতরভাবে বলে।

‘সত্যি বলছি তো রে! এরা সব বাঙালি। ওই বুড়িটা আমার দিদিমা হয়। আর ওরা আমার মামা হয়।’

শানু বলে, ‘তা হলে ওরা অন্য বিচ্ছিরি ভাষায় কথা বলে কেন?’

ছেলেটা বোধ হয় ‘ভাষা’ কথাটা বুঝতে পারে না, চোখ কুঁচকে বলে, ‘কী বলছিস?’

শানু বলে, ‘বলছি ওরা তোর মতন কথা বলতে পারে না কেন?’

‘ওরা? ওরা যে এখেন থেকে কক্ষনো কোথাও যায় না। আমি একবার পালিয়ে গেছলাম। হুই কলকেতায় চলে গেছলাম!’

‘কলকাতায়! কলকাতায় গিছলি তুই?’

‘হি:! মানিকতলাও বলে একটা জায়গা আছে, ওখানে একটা ফলওলার কাছে রইলাম কেতক দিন! আর কেতক দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। তারপর মায়ের লেগে মন উদাস হল, চলে এলাম।’

‘মায়ের লেগে মন উদাস,’ শুনেই শানুর চোখ দুটো আবার ভিজে ওঠে। তারপর মন ভালো করে নিয়ে বলে, ‘কই তোর মা?’

‘হুই ওদিকে আছে।’

‘বাংলা কথা বলতে পারে?’

‘না:!’ ছেলেটা আর একবার একটা ডিগবাজি খেয়ে বলে, ‘কিন্তুক আমরা বাঙালি।’

‘কী নাম তোর?’

‘আমার নাম নারায়ণ।’

‘নারায়ণ! নারায়ণ তোর নাম? তোর বাবার নাম?’

‘বাবা নেই। বাবা মরে গেছে।’

বাবা মরে গেছে!

শুনেই শানুর বুকটা ধড়াস করে ওঠে। বাবা আবার মরেও যায় লোকের!

‘কেন, মরে গেছে কেন?’ আস্তে সাবধানে বলে শানু।

কিন্তু নারায়ণের মধ্যে কোনো দুখের বালাই নেই। সেঅবহেলাভরে বলে, ‘কে জানে। মরে গেছে বলে। আমি তো তখন এইটুকু ক্ষুদে।’

শানু মলিনমুখে বলে, তোর কষ্ট হয় না?’

‘কষ্ট?’ ও আর এক পাক ঘুরে বলে, ‘হলে কী হবে? বাবাটা কি চলে আসবে হুই ওখান থেকে?’ বলে আকাশের দিকে আঙুল বাড়িয়ে ছেলেটা নিজস্ব স্বভাবে হি হি করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, ‘তোর নাম কী?’

‘আমার নাম শ্রীশান্তনু রায়!

ছেলেটার চোখ-মুখ আবার কুঁচকে যায়।

‘কী বললি?’

শানু গম্ভীরভাবে বলে, ‘আমার নাম শানু।’

‘শানু! তোর নাম শানু! বেশ নাম। তুই খাবি না?’

‘এসব কী?’

‘এটা তো দুধ। দুধ খাস না তুই? কলকেতায় তো মানুষেরা দুধ খায়।’

‘খাই। এইরকম বিচ্ছিরি হাঁড়িতে খাওয়া যায়?’

নারায়ণ গম্ভীর হয়ে যায়, বলে, ‘আমাদের ওই আছে।’

‘আমি খেতো পারব না।’

‘তবে কী করবি? পাতার দোনা করে দেব? ঢেলে খাবি?’

‘জানি না।’

নারায়ণ দুঃখিতভাবে বলে, ‘না খেয়ে তুই যে মরে যাবি? দুধ খেয়ে ফেল। কিন্তুক এই মাংসটা তুই খেতে পারবি না। কলকেতায় কাকের মাংস কেউ খায় না।’

‘কীসের মাংস?’ শিউরে ওঠে শানু।

‘কাক! কাক জানিস না?’ কলকাতায় তো কত আছে। তুই দেখিসনি? হুই আকাশে ওড়ে। এই আমার মাথার মতন রংদার—?’

নিজেরে কালো চুলে ভরা মাথাটায় হাত বুলোয় নারায়ণ।

‘কাকের মাংস খেতে দিয়েছিস আমায়!’

চেঁচিয়ে ওঠে শানু। চোখ ফেটে জল আসে তার।

নারায়ণ না হেসে বলে, ‘আমরা যে কাকমারা! কাকের মাংস খাই আমরা। আমার মামারা রোজ সুয্যিদেবতা উঠলেই কাক মারতে চলে যায়। আর ওই খায়।’

‘এঃ ছি:!’ শানু চোখ পাকিয়ে বলে, ‘আবার বলছিস কি না বাঙালি!’

‘ওটা সত্যি বলছি, ঠিক। ‘কাকমারা’রা বাঙালি।’

‘আচ্ছা বেশ! খুব জানিস তুই। এখন বল তো, আমি কী করে যেতে পারব?’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার!’ শানু বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আমার মার কাছে, বাবার কাছে!’

‘কোথায় থাকে তোর মা?’

‘বাড়িতে থাকে। আবার কী?’

‘তোকে ভালোবাসে?’

‘ভালোবাসে না? খুব ভালোবাসে।’

‘তবে তুই পালিয়ে গেলি কেন? আমার মা দুই-একদিন আমাকে মারল, তাই আমি পালিয়ে গেলাম।’

‘আমি কি পালিয়ে এসেছি নাকি? আমি তো হারিয়ে গেছি।’

নারায়ণ মুখ গম্ভীর করে বলে, ‘ও!’

তারপর মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘তুই মরে গিয়েছিলি। বড়োমামাটা তোকে ‘বিশলাই’ পাতার রস দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

শানু হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তোর বড়োমামা মরা লোককে বাঁচিয়ে দিতে পারে?’

‘পারে তো!’

‘তা হলে তোর বাবাকে বাঁচিয়ে দিল না কেন?’

‘ইস! বাঁচিয়ে দেবে! বাবার সঙ্গে লড়াই না! কিন্তুক তুই দুধটা খা।’

শানুর তখন একটু কিছু খাবার জন্যে প্রাণের মধ্যে কী যেন করছে। তাই ‘খাব না’ বলে রাগ না করে কাতরভাবে বলে, ‘কী করে খাব? পড়ে যাবে।’

‘তুই তবে হাঁ কর, আমি ঢেলে দিই।’

অগত্যাই হাঁ করে শানু, আর জিজ্ঞেস করে, ‘এ কীসের দুধ?’

‘গাই! গাই! গাই জানিস না? গোরু।’

‘ওঃ!’

হঠাৎ হেসে ফেলে শানু বলে, ‘তোরা তো কাকের মাংস খাস, তবে গোরুর দুধ খাস কেন? কুকুরের দুধ খেতে পারিস না?’

কুকুরের দুধ শুনে ছেলেটা হেসে লুটিয়ে পড়ে। তারপর সামলে নিয়ে বলে, ‘এই শোন, এসব কথা ওদের বলবি না। তা হলে ওরা তোকে মারবে। হাঁ কর।’

নাক-মুখ সিঁটকে একটু দুধ খেয়ে শানু বলে, ‘গন্ধ! আর খাব না। তুই আমাকে রাস্তা চিনিয়ে দিতে পারবি? ওই অনেক দূরে যেখানে দোকান আছে, হোটেল আছে, রাজবাড়ি আছে—’

নারায়ণ মাথা নেড়ে বলে ‘জানি না!’

‘জানিস না?’ শানু রেগে লাল হয়ে বলে, ‘তা জানিস না, আর কলকাতার মানিকতলা জানিস?’

‘ইস তুই রাগ করছিস’

‘না রাগ করব না! ভীম নাগের সন্দেশ খাওয়াব তোকে!’

‘কী খাওয়াবি?’

‘কিছু না! আমি এক্ষুনি চলে যাব।’

নারায়ণ তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপি চুপি বলে, ‘এই চুপ। ওরা শুনতে পেলে বেঁধে রাখবে তোকে।’

‘বেঁধে রাখবে! ইস! বেঁধে রাখলেই হল! পুলিশে ধরিয়ে দেব না!’

সতেজে বলে শানু অর্থাৎ নারায়ণের কাছে তেজ দেখায়।

‘পুলিশ!’

নারায়ণের মুখে একটি বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, বলে, ‘কোথায় পাবি? ওরা তো তোকে আটকে রেখেছে। যেই পালাতে যাবি, ধরে ফেলবে। আমার ওই দিদিমা বুড়িটা না ভারি শয়তান! ও মামাদের বলেছে, তোকে আটকে রেখে অনেক টাকা করতে!’

শানু আরও রেগে উঠে বলে, ‘আমায় আটকে রেখে টাকা কোথায় পাবে রে? আমার কাছে কি টাকা আছে?’

‘না না—’ নারায়ণ বেশ কায়দায় মাথাটি ঘুরিয়ে বলে, ‘দিদিমা বলেছে, তুই হারিয়ে গেছিস বলে তোর মা-বাবা পুলিশকে বলবে, যে তোকে খুঁজে দেবে, অনেক টাকা দেবে তাকে। তখন বড়োমামাটা তোকে ‘খুঁজে’ দিয়ে আসবে। বলবে —মরে গিয়েছিল, বাঁচিয়ে দিয়েছি। বেশি বখশিশ চাই!’

শানু এবার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

এ কী অদ্ভুত কান্ড! ওই বিচ্ছিরি কোপনি-পরা লোকগুলো আর ওই বিচ্ছিরি হাঁদার মতো বুড়িটা, তাদের মধ্যে এত চালাকি!

কাতরভাবে বলে, ‘তুই তো ওদের মতো না, তুই তো বেশ ভালো। তোকে আমার বন্ধু করে নেব।’

‘করে নিলি তো কী হল?’

‘তা হলে তুই আমায় নিয়ে যাবি?’

‘আমায় মারবে।’

‘রাত্তিরবেলা, লুকিয়ে লুকিয়ে যাব।’

‘ধরে ফেলবে!’

‘না ধরে ফেলবে না’, চেঁচিয়ে ওঠে শানু, ‘তুই সব বানাচ্ছিস।’

‘কী করছি?’

‘তুই মিছিমিছি বলছিস।’

‘বেশ তাই ভালো।’ বলে নারায়ণ আর একটা ডিগবাজি খেয়ে বলে, ‘আমাকে বন্ধু করার তোর দরকার নেই। আমি চলে যাচ্ছি।’

আরে আরে সত্যিই যে চলে যায়। শানু হঠাৎ সেই কালো নোংরা ছেলেটার একটা হাত ধরে বলে ওঠে, ‘রাগ করিসনি ভাই।’

নারায়ণ গম্ভীরভাবে বলে, ‘বেশ রাগ করছি না। বন্ধু হচ্ছি। তোকে আমি এদের কাছ থেকে পালিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু তাড়াতাড়ি হবে না। দু-চার দিন দেরি হতে পারে।’

‘আমি তো তা হলে না খেয়ে মরেই যাব।’

নারায়ণ আরও গম্ভীরভাবে বলে, ‘কেন! দুধটা খাবি। দুধ হচ্ছে ভগবান! ওটা খেলেই বেঁচে থাকে মানুষ।’

‘বেশ খাব। তুই আমায় নিয়ে যাবি?’

‘বলছি তো!……এই এই—বুড়ি আসছে। যদি বলে, মাংস খাসনি কেন? তুই পেটে হাত দিয়ে বলবি, পেটে দুখ হচ্ছে।’

নিজের পেটে হাত দিয়ে দেখিয়ে, একপাক ডিগবাজি খেয়ে হি হি করে হাসতে থাকে নারায়ণ।

এরপরই ঠকঠক খটখট করতে করতে বুড়িটা আসে। বুড়ির কোমরে একটা কাপড়ের টুকরো আছে বটে, কিন্তু সেটা আর হাঁটুর নীচে নামেনি। পা দুটো কেলে সরু বিচ্ছিরি। শানু ভাবল কাক খেয়েই বোধ হয় বুড়ির কাকের মতো পা।

নারায়ণ চুপি চুপি বলে, ‘এই শোন। বুড়ি আমায় ডিংলাই ডাকে। কান রাখ, বুঝে যাবি কী বলবে বুড়ি।’

শানু কান রাখে। কিন্তু কচুপোড়া! বুড়ি এসেই ভাঙা কাঁসির মতো শব্দে নারায়ণকে উদ্দেশ করে যে একগাদা কথা বলে যায়, শানু তার এক বর্ণও বুঝতে পারে না। শুধু বারে বারে ওই ‘ডিংলাই’ শব্দটা কানে আসে।

শানু ভাবে, আবার বলে কিনা বাঙালি! তা হতেও বা পারে। রাঙামাসিরা যে নরখাদকের হাতে পড়েছিল তারাও নাকি বাঙালি। মানে বাংলাদেশেরই তো লোক। শুধু এখনও আদিবাসীত্ব ঘোচেনি বলেই—

বুড়ি এবার নিজের নাতিকে ছেড়ে শানুর দিকে চোখ পাকিয়ে, আর সেই কেলেকিষ্টি মাংস চচ্চড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে কী যেন বলে ওঠে।

শানু ডিংলাইয়ের কথামতো পেটে হাত দিয়ে পেটব্যথার ইশারা করে।

বুড়ি থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা বলে ওঠে। আর ডিংলাই বা নারায়ণ তেমনি এক পাক নেচে নিয়ে ব্যাঙের মতো ঝুপ করে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পড়ে।

এরপর বুড়ি নাতির একটা হাত ধরে হিড়-হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায়। অবশ্য তার সঙ্গে বকতে বকতে যায়।

শানুর মনে পড়ে যায় তার দিদিমা আর ছোটোমামার ছেলেটার কথা। ভীষণ দুষ্টু ছেলেটা! চান করতে, খেতে, সাজতে, চুল আঁচড়াতে, সবসময় ঝুলে পড়ে। আর দিদিমা তাকে অমনি করে টানতে টানতে আর বকতে বকতে নিয়ে যান।

কিন্তু দিদিমার কথাগুলো কেমন সুন্দর বোঝা যায়। আর এই বুড়িটার? ইস! কথা বলেই মনে হচ্ছে না। যেন বাজে বাজে চেঁচাচ্ছেই শুধু। আচ্ছা পৃথিবীতে এতরকম ভাষা কেন? সবাই যদি এক ভাষায় কথা বলত তা হলে তো কারুরই কোনো কষ্ট থাকত না!

পৃথিবীর সবাই তো খিদে পেলে খায়, ঘুম পেলে ঘুমোয়, রাগ হলে চেঁচায়, দুঃখু হলে কাঁদে, আহ্লাদ হলে হাসে, তবে কথায় এত তফাত কেন? অন্য জাত থাকবার দরকার কী? সবাই এক জাত হলেই তো বেশ হয়।

শানুর মনে হয়, শানু যদি বড়ো হয়ে পৃথিবীর রাজা হয়ে যায়, তা হলে পৃথিবীর সমস্ত লোককে সমান বড়োলোক, সমান বিদ্বান, আর সমান জাত করে দেবে।

কিন্তু হায়, শানু আর কিছু হয়েছে! শানু এই বুনোদের হাতেই মরে শেষ হয়ে যাবে।

ধপাস!

ঘরে এসে পড়ল সেই প্রকান্ড কোলাব্যাংটা! তার গলায় একটা ছোটো মাটির ভাঁড় মাদুলির মতো দড়ি দিয়ে ঝুলছে।

শানু চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুই ওরকম করে হাঁটিস কেন রে? তুই কি ব্যাং?’

‘ব্যাং’ কথাটার মানে বুঝল না ডিংলাই। গোড়ার কথাটা ধরেই বলল, ওইটা আমার ইচ্ছে।’

‘আহা কী চমৎকার ইচ্ছে! গলায় কী ঝুলিয়েছিস?’

‘তোর ওষুধ! মিঠে মিঠে আঃ!’ জিভের জলটা টেনে নিল সে।

‘বিচ্ছিরি ওষুধ!’—বলল শানু।

‘তোদের কলকেতার মতন ডাকতর ওষুধ দেয় নাকি এখেনে? ফলওলা আমায় একদিন ডাকতরের ওষুধ দিয়েছিল, এ্যা: থু! বুকে জ্বালা লাগে। এটা ভালো। মাছির রস হচ্ছে এটা।’

মাছির রস!

মাছির রস এনেছে শানুর জন্যে! তার থেকে একটু বিষই কেন এনে দিক না—যা খেলে মানুষ মরে যায়। মাছির রসকে ওষুধ বলে না চালিয়ে—

শানু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোরা বুঝি একানড়ে? তাই কাকের মাংস খাস, মাছির রস খাস!’

নারায়ণ বোধ হয় বুঝতে পারে শানুর ঘেন্না করছে। তাই গলার ভাঁড় খুলে নামিয়ে নিজে একটুখানি হাতে ঢেলে বলে, ‘এই দেখ আমি চেটেপুটে খেয়ে দিচ্ছি।’

হাতের জিনিসটা শানুকে দেখায় সে।

কী ওটা!

শানু চোখ কুঁচকে দেখে। মধু নাকি? সেইরকমই দেখতে লাগল। আর যেরকম চেটে পুটে খাচ্ছে ডিংলাই!

ডিংলাই। হ্যাঁ ওইটাই ওর উপযুক্ত নাম। ব্যাংলাফাই হলে আরও ঠিক হত।

নারায়ণ বলবে না হাতি করবে!

‘দেখছিস তো? খেয়ে দিলাম।’

শানু তীব্রস্বরে বলে, ‘তুই খাবি না কেন? নোংরা অসভ্য ভূত একানড়ে!’

ডিংলাই হঠাৎ যেন কীরকম ভ্যাবাগঙ্গা হয়ে যায়। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘তুই বন্ধু হলি না?’

এবার শানুর লজ্জার পালা।

অপ্রতিভ হয়ে গিয়ে শানু বলে, ‘তা বন্ধু তো। কিন্তু তুই অমন অসভ্য কেন?’

‘আমরা অমনি! আমরা যে কাকমারা। তোদের কলকেতার মতো সভ্য হলে আমাদের মন্দ বলে।’

‘তোরা কাকমারা হতে গেলি কেন?’

‘আমরা কী হয়েছি? ওই আকাশের দেবতা করেছে।’

‘তুই যদি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাস, তোকে আমি ‘বাবু’ করে দিতে পারি।’

‘না:!’ ডিংলাই মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে বলে, ‘বাবুটা হতে মন নেই আমার।’

‘এইরকম করে থাকতে মন?’

‘তাই তো! বাবুটা হয়ে কী হবে?’

‘তোর কথাগুলো ভারি বোকার মতো। লেখাপড়া শিখবি, মানুষ হবি, আবার কী হবে?’

ডিংলাই আর লম্ফঝম্ফ করে না, বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে বলে, ‘মা-টা যে কাঁদবে!

মা! মা কাঁদবে!

ঘুরেফিরে সেই মাকে মনে পড়িয়ে দেওয়া কথা! মা, মাগো!

হঠাৎ শানু উপুড় হয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

ডিংলাই কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে তেমনি বিষণ্ণভাবে আপনমনে মাথা নেড়ে নেড়ে বিজ-বিজ করে কী যেন বলে, তারপর আস্তে আস্তে উঠে যায়।

অনেকক্ষণ পরে আবার নিজেই চোখ মেলে উঠে বসে শানু। ভোলাবার কেউ না থাকলে নিজে নিজেই ভুলতে হয়। শরীর দুর্বল, ঘুমুতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী করে ঘুমোবে? বিশ্রী একটা আঁশটে আঁশটে পচা চামড়ার মতো গন্ধে শরীরের মধ্যে পাক দিচ্ছে।

ঘরটার মধ্যেই গন্ধ!

কী দিয়ে তৈরি করেছে ঘরখানা? শানু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, এই ঘরে ওরা চিরকাল থাকে? বৃষ্টি পড়লে কী অবস্থা হয়? ঝড় হলে কী অবস্থা হয়?

ছোটোছেলেরা যেন খেলাঘর বানিয়েছে—না তো কার্নিশের গায়ে পাখির বাসা!

হেন জিনিস নেই, যা এই ঘরখানার গায়ে মাথায় নেই। নেই শুধু যা দিয়ে ঘর বানাতে হয়। ইট, চুন, সুরকি, সিমেন্ট তো ছেড়েই দাও, বাঁশ বাখারি খড় মাটি এসবও নেই। আছে গাছের ডালপালা, ছেঁড়া চট, টিনের টুকরো, ভাঙা দরমার খন্ড, টায়ারের রবার, জন্তুর চামড়া, এইসব হরেক মাল। কোথা থেকে যে জোগাড় করেছে এসব কে জানে।

হরেক মাল দিয়ে ঘর তৈরি, তাই হরেক ফুটো-ফাটা। সেসব ফুটো-ফাটা দিয়ে বাইরের আলো ঢুকছে। কোনো জিনিসটাই তো সোজা নয়। সোজা দেয়াল হবে কোথা থেকে?

অন্য সময় হলে, মা-বাবার সঙ্গে এসে দেখলে এরকম ঘরের দৃশ্যে হেসে কুটিকুটি হত শানু। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। এখন কান্না পাওয়া ছাড়া কিছুই পাচ্ছে না শানুর।

তবু বসে থাকতে থাকতে শানু হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ওর মনে হয় সত্যিই যেন ও দূর-দূরান্তরে কোনো অজানা দেশে চলে এসেছে ; পৃথিবীর এক অনাবিষ্কৃত দেশে। ইস! শানু যদি আর একটুখানি বড়ো হত। যদি মায়ের কথা মনে করতে গেলেই চোখে জল না আসত!

আবার তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল শানু, বৃষ্টির সময় কী করে এরা?

কিন্তু শানুর তো আর জানে না, সারাবছর এরা এখানে থাকেই না। কোনোখানেই ঘর-সংসার নিয়ে থাকে না এই ‘কাকমারারা’। কিছুদিন এমনিভাবে পাখির বাসার মতো বাসা বানায়, কাক মেরে, মাছ মেরে পেট ভরায়, আবার হঠাৎ একদিন মেয়ে-পুরুষে বাঁশের আগায় পুঁটুলি বেঁধে যার যা সম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসা ভেঙে।

হয়তো গিয়ে আশ্রয় নেয় কোনো হাটতলায় কী কোনো মেলার বাজারে। এদিক ওদিক ঘোরে, মেয়েরা চেয়েচিন্তে কাচের চুড়ি জোগাড় করে হাতে পরে, চিরুনি জোগাড় করে চুল আঁচড়ায়, ছেলেরা জোগাড় করে ছেঁড়া চট, ভাঙা দরমা, ফুটো টায়ার, তারপর আবার লাঠির আগায় পুঁটুলি বাঁধে।

চাষবাসের ধার দিয়েও যায় না এরা। তবু বারে বারে শহর-বাজারের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে পেটে পেটে সেয়ানা হয়ে উঠেছে এরা বেশ। তাই নারায়ণের দিদিমা যুক্তি করে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেটাকে আটকে রেখে ওর মা-বাপের কাছ থেকে বকশিশ আদায় করতে।

শানু এত কথা কিছুই জানে না।

শানুর ভরসা এখন শুধু ডিংলাই—যার ভালো নাম নারায়ণ।

আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল শানু মনে নেই। অত বিশ্রী গন্ধের মধ্যেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। খিধেয়-তেষ্টায়-কষ্টে অবসন্নতার ঘুম আর কী! তারপর কখন বেলা পড়ে এসেছে, ডিংলাইয়ের মামারা শিকার করে বাড়ি ফিরে কাকের পালক ছাড়াতে বসেছে, আর ডিংলাইয়ের মা-দিদিমা গাছের ডালপালা জ্বেলে তাই রান্না করবার ব্যবস্থা করেছে। গোটা-চারেক মরা কাক এক পাশে রাখা আছে, ওইগুলো বদলে ডিংলাইয়ের দিদিমা কোথা থেকে যেন দুধ নিয়ে আসবে ভোরবেলা গিয়ে।

ডিংলাই একবার চারদিক দেখেশুনে শানুর কাছে এসে উপস্থিত হল। আস্তে আস্তে ওর মাথাটা ঠেলে চুপি চুপি বলল ‘এই, ভাগবি?’

ভাগবি!

শানু ঘুম-চোখে উঠে প্রথমটায় মানে বুঝতে পারল না। বলল, ‘কী বলছিস?’ ডিংলাই এবার চোখ-মুখ আর হাতের ইশারায় প্রস্তাবটা বুঝিয়ে দিল।

শানুর শরীরে তখন শুধু ক্লান্তি আর দুর্বলতা। তবু শুনেই ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর বলল, ‘ওরা দেখতে পাবে না!’

‘না:। ওরা উদিকে রইছে।’

‘আমার জুতোটা!’ কাতরভাবে এদিক ওদিক দেখতে লাগল শানু।

‘ইটা?’

ডিংলাই কোথা থেকে টেনে আনল জুতো দুটো। একপাটি মোজা একটা জুতোর মধ্যে রয়েছে, আর একপাটি কোথায় কে জানে।

কিন্তু চুলোয় যাক মোজা!

খালি জুতো পরেই আস্তে আস্তে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল শানু। দেখল খানিকটা দূরে একটা বালির গাদায় বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটা আগুন জ্বলছে, গোটাকতক লোক সেই আগুনটাকে ঘিরে বসে হাত মুখ নাড়ছে, কথা বলছে।

এদিকে কারও দৃষ্টিই নেই।

কুঁড়ে ঘরের পেছন দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়ল ওরা— যেমন করে সেদিন রান্নাঘরের পেছন দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল শানু মা-বাবার চোখে ধুলো দিয়ে।

বেলা পড়ে গিয়েছিল। সন্ধে হয় হয়।

খানিকটা গিয়ে শানু ডিংলাইকে বলে, ‘এক্ষুনি তো অন্ধকার হয়ে যাবে, কী করে রাস্তা চেনা যাবে?’

ডিংলাই ইশারায় বলে, ‘চাঁদের আলো উঠবে এখুনি। কথা বলবে না, কে জানে কে কোনদিকে কান পেতে রেখেছে।’

শানু জানে না; কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে ডিংলাই। ডিংলাই জানে কোথায় যেতে হবে। ওই যেখানে লম্বা লম্বা বড়ো বড়ো গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে—মানুষগুলোকে পেটের মধ্যে ভরে ফেলে গোঁ-গোঁ করে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে কলের গাড়ির কাছে তাদের পৌঁছে দিতে। সেইখানে বন্ধুটাকে নিয়ে যাবে ডিংলাই। ওই গাড়ির পেটের মধ্যে বন্ধুটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসবে।

কিন্তু মুশকিল ওই, ওরা এমনি শুধু নিতে চায় না। পয়সা চায়।

কলকাতায় গিয়ে পয়সা জিনিসটাকে বেশ চিনে এসেছে ডিংলাই। আর—এটাও জেনে এসেছে কাকমারারা বাদে জগতের আর সবাই যা কিছু করে পয়সা নিয়ে।

‘তোর পয়সা আছে?’ অনেকটা দূরে এসে প্রশ্ন করে নারায়ণ।

পয়সা! আকাশ থেকে পড়ে যেন শানু।

পয়সা আবার এখানে কোথা? সেতো আছে বাড়িতে কাটা বাক্সয়। অনেক পয়সা! কাটা বাক্সটা ভারী হয়ে উঠেছিল ইদানীং।

কিন্তু পকেটে? না:!

আস্তে মাথা নাড়ে শানু। আর তাই না দেখে নেংটিপরা— ডিংলাই হঠাৎ পথের মাঝখানেই এক পাক নেচে নিয়ে মাথার ওপর হাত তুলে বুড়ো আঙুল দুটো দুলিয়ে হি হি করে ওঠে, অর্থাৎ তা হলে যাওয়ার আশায় কলা!

শানু রেগে উঠে বলে, ‘হি হি করে হাসছিস যে?’

‘তবে কী করব? কানব?’

‘মারব তোকে।’

‘মার।’

আরও দাঁত বার করে হাসে ডিংলাই। হেসে বলে, ‘পয়সা না দিলে টিকিস দেবে?’

শানু হঠাৎ বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি বলব—এখন আমাকে অমনি টিকিট দাও। বাড়ি পৌঁছে ডবলের ডবল টাকা পাঠিয়ে দেব।

‘কী দিবি?’ চোখ কুঁচকে বলে ডিংলাই।

‘ইস! কী বোকা! বলছি অনেক টাকা দেব।’

অনেক টাকা।

দিনের আলো নিভে গেছে! কিন্তু শুক্লপক্ষের চাঁদ একটু একটু আলো ছড়াচ্ছে। ডিংলাইকে একটা ছায়ামূর্তির মতো দেখাচ্ছে। সেই ছায়ামূর্তি থেকে কথা বেরোয়, ‘তোর অনেক টাকা আছে?’

‘আছে। কেন থাকবে না? বাড়িতে আছে।’—সজোরে বলে ওঠে শানু।

ডিংলাই মনমরাভাবে বলে, ‘তুই রাজার বেটা?’

‘বা! রাজা কি!’

‘হ্যাঁ: তুই রাজা! তুই আমার বন্ধু না।’

ওর এই মনমরা কথায় শানুরও হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর গায়ে একটা হাত রেখে বলে, ‘না রে, আমি তোর খুব বন্ধু হব। চল না তুই আমার সঙ্গে।’

ডিংলাই কী উত্তর দিত কে জানে, হঠাৎ পেছন থেকে কর্কশ গলার বিশ্রী আওয়াজে দু-জনেই চমকে ওঠে।

পেছনে আর কেউ নয়—ডিংলাইয়ের ছোটোমামা।

ভাগনের মাথাটা ধরে প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে ধমক দিতে থাকে সে, হাত নাড়ে মুখ নাড়ে, তারপর একহাতে শানুর একটা হাত আর অপর হাতে ডিংলাইয়ের একটা কান ধরে হিড়-হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায় নিজেদের আস্তানায়!

শানুর হাত-পা ছোড়া, এবং ‘ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও’ চিৎকার কিছুই কাজে লাগে না।

আবার ওদের আস্তানায়?

সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে যায় শানু। দেখে ঘরটা ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে ডিংলাইয়ের বড়োমামা। বুড়ি তার থেকে চটের টুকরো, ন্যাকড়ার ফালি, রবারের পাত বেছে বেছে জড়ো করছে।

এদিকে সেই পাতার জ্বাল দিয়ে দিয়ে রান্না হচ্ছে। ভাত ফোটার গন্ধ বেরোচ্ছে। ভাত! হঠাৎ শানুর মনে হয় জীবনে কখনো এমন সুগন্ধ সেপায়নি।

মামার কাছে কান হিঁচড়ানো খেয়ে গোঁজ হয়ে বসেছিল ডিংলাই। খানিক পরে ওর মা ডাকতে আসে। শানুকেও ডাকে, অবশ্য ইশারায়।

ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছিল শানুর, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিল না কী দিয়ে খেতে দেবে। তবু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। ডিংলাইও দু-চার বার ‘যাব না’ ‘খাব না’ গোছের তেজ দেখিয়ে উঠে গেল।

বালির ওপর কাঁচা শালপাতা পেতে পেতে ভাত সাজিয়েছে ডিংলাইয়ের মা—সারি সারি নয়, গোল করে ঘিরে।

অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকের ভাতের ওপরই সেই কেলেকিষ্টি খানিকটা মাংস। শুধু শানুর ভাতের ওপর?

অবাক হয়ে দেখল শানু। শানুর বাবা মা যেমন আস্ত আস্ত মাছভাজা খান তেমনি একটা আস্ত মাছ। কে জানে ভাজা না সেদ্ধ।

কিন্তু ও তো কাঁটা মাছ।

ও মাছ তো শানু খেতেই পারে না। মা কাঁটা বেছে দিয়ে খাবার জন্যে সাধেন, তবু খায় না। পাতার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে আকৃষ্ট হয়ে। তবুও এদের ওপর একটু কৃতজ্ঞ না হয়ে পারে না। তারজন্যে বিশেষ ব্যবস্থা দেখে। কাকের মাংস যে দেয়নি তাকে এই ঢের।

ডিংলাই চুপি চুপি বলে ‘খেয়ে নে। না খেয়ে খেয়ে মরে যাচ্ছিস যে তুই। তোর লেগে ভাত করেছে। আমরাও তোর লেগে মজা করছি।’

শানু আস্তে আস্তে বসে পড়ে। আর বসে এক গ্রাস ভাতও মুখে পুরে দেয়।

কেমন একরকম ধোঁয়া-ধোঁয়া গন্ধ। তবু চোখ-কান বুজে খেয়ে নেয় একটু। মাছটায় হাত দিতে ভরসা পায় না কাঁটার ভয়ে, শুধু ভাতই খায়! যে শানুকে ভাত খাওয়াতে হিমশিম খেয়ে যান মা, দুধ সন্দেশ ছানা ফল নিয়ে পিছু পিছু ঘোরেন!

শানুর একটা নিশ্বাস পড়ে।

দু-চার বার খাবার পর আর খেতে পারে না। আর অবাক হয়ে দেখে ডিংলাই সমস্ত চেটেপুটে খেয়ে নিয়ে ওর মাকে ইশারা করছে আরও ভাত দেওয়ার জন্যে। ওর মাও ইশারা করে জানায়, ‘আর নেই।’

ডিংলাইয়ের মামারা তখন খেয়েই চলেছে। অবাক হয়ে ভাবে শানু—ছেলে ভাত চাইল, আর মা দিল না! তবু ওই মাকে ভালোবাসে ডিংলাই! আর কী বিচ্ছিরি মা! ঠিক বুড়িটার মতোই খাটো কাপড় পরা, অমনি শুকনো কালো কালো হাত-পা!

এই মাকেই এত ভালোবাসে ডিংলাই! যদি শানুর মাকে ও দেখত!

তারপরই মনটা বদলে গেল শানুর। ভাবল, আহা কী করবে— ওইরকমই মা ওর, তবু মা তো!

ওর মামারা ভাত শেষ করে পাতাগুলো তুলে চাটতে লাগল, তারপর উঠে চলে গেল। তারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিংলাইয়ের মা ছেলের পাতে চারটি ভাত দিয়ে দিল।

এতক্ষণে রহস্য ধরা পড়ল।

ওই পাজি মামাগুলোর ভয়েই ছেলেকে একটু ভাতও দিতে পারে না ওর মা বেচারা! হঠাৎ ওই ময়লা কাপড় পরা বিচ্ছিরি মাকেও ভালো লাগল শানুর। মায়া হল তার ওপর। ডিংলাইকে আর তার মাকেও যদি নিয়ে যেতে পারত শানু! সেখানে অবিশ্যি ডিংলাই বলবে না ‘নারায়ণচন্দ্র’ বলবে।

কিন্তু কোথায় কী? পালাতে গেলেও তো ধরে ফেলবে এরা।

‘ঘর ভেঙে ফেলছে কেনরে?’—জিজ্ঞেস করল শানু!

ডিংলাই বলল, ‘এখান থেকে চলে যাবে বলে।’

‘চলে যাবে? এখন?’

‘হ্যাঁ ধুপকালে আঁধারেই হাঁটতে হয়। নইলে সূর্যিঠাকুর গা পুড়িয়ে দেয়!’

‘ঘর ভেঙে নিয়ে চলে যাবে?’

‘যাবে না? না ভাঙলে—’

কী ভেবে ডিংলাই আশ্চর্যভরে বলে, ‘ঘর পড়ে থাকলে মন্দ দেবতারা এসে বাসা করবে না?’

‘আমি যাব না তোদের সঙ্গে।’ দৃপ্তভাবে বলে শানু।

এত ভয়ের মধ্যে সাহসটা হারায় না ও।

‘না গেলে মারবে।’ ডিংলাই বলে, ‘ওরা বলছে, তোকে আমার মতন ট্যানা পরিয়ে নিয়ে যাবে।’

‘কী পরিয়ে?’ তীক্ষ্ম চিৎকার করে ওঠে শানু।

‘চুপ চুপ! শুনলে আমায় মারবে। ট্যানা, এই যে আমার মতন।’ নিজের পরনের নেংটিটুকু দেখায় ডিংলাই।

‘কক্ষনো না! আমি মরে যাব। সমুদ্দুরে ডুবে যাব। আমি এইখানে বসে থাকব।’

ডিংলাই ম্লানভাবে বলে ‘এই, তুই ওদের সঙ্গে পারবি না। ওই ছোটোমামাটা ভারি মন্দ আছে। মারবে। এখন কিছু বলবি না। যা বলে শুনে নে। তোকে আমি পালিয়ে দেব। হক বলছি, দেব। তোকে রাজার বেটার সাজ করে মামারা সাথে নেবে না। তাদের পুলিশে ধরবে। ছেলেচোর বলবে।’

হঠাৎ চুপ করে যায় ডিংলাই। তার বড়োমামা এসে দাঁড়ায় ময়লা একটুকরো ন্যাকড়া হাতে নিয়ে।

ডুগ ডুগ—ডুম ডুম, ডুগ ডুগ—ডুম ডুম। বাজছে ডুগডুগি—বোল কেটে কেটে।

তার সঙ্গে বোল কাটছে—ভালুকওয়ালা নিজে। ‘দেখো বাবু খেল দেখো। জাহাঙ্গির কা খেল দেখো।’

‘জাহাঙ্গির আর নুরজাহান’ ভালুক আর ভালুকনি। ওদের নিয়ে যত মজাদার কথা। ওরা সম্রাট হয়ে দিল্লির মসনদে বসছে। আবার জ্বর হয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুচ্ছে। জ্বরের জন্যে ডাগদার আসছে, নানাকথার ফুলঝুরি ঝরাচ্ছে ভালুকওয়ালা।

ডুগডুগির বোলে আর ভালুকওয়ালার বোলচালে মেলাতলার একটা দিক জমজমাট সরগরম। রাজ্যের ছেলেমেয়ে এসে ঝুঁকে পড়েছে সেখানে।

এই ভিড়ের মধ্যে শানু আছে, ডিংলাই আছে। ওরা এসেছে এই কাঁথির মেলায়। মানে ওদের দলই এসেছে—ডিংলাইয়ের মা, দিদিমা, মামারা। ঘর ভেঙে তুলে নিয়ে এমনিই বেরিয়ে পড়ে ওরা মেদিনীপুর জেলার এখানে সেখানে। মাঝে মাঝে আসে মেলাতলায়।

না আছে ক্যালেণ্ডার, না আছে পাঁজিপুথি, তবু ওরা ঠিক বুঝতে পারে কোন ঋতু কোন মাস, আর মুখস্থ আছে ওদের কোথায় কোথায় কবে কবে মেলা বসে।

মেলায় অবিশ্যি ওরা কিছু বেচতেও আসে না, কিনতেও আসে না। আসে আসলে কনে খুঁজতে। হ্যাঁ কনে খোঁজার জন্যেই ওদের মেলায় আসা!

তা হাসবার কী আছে বাপু? ওদের কি আত্মীয়-সমাজ আছে যে, অন্য আর একজনের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে এসে, কী বেড়াতে এসে, কার বাড়িতে ছেলেমেয়ে আছে তার সন্ধান হবে? নাকি ওদের খবরের কাগজই আছে যে ‘পাত্র-পাত্রী’র বিজ্ঞাপন দেখবে?

মেলাতলার মতো জায়গাই ওদের ভরসা। মেলার আশপাশে কোনো চালার ছাঁচতলায় চট বিছিয়ে পড়ে থাকে। উঞ্ছবৃত্তি করে খায়, আর কনে খোঁজে।

মানে ওদেরই মতো আরও ‘কাকমারা’র দল তো আসে অন্য কোথাও থেকে! তাই থেকেই বেছেগুছে নেওয়া।

ডিংলাইয়ের দিদিমার অনেকদিন থেকে ইচ্ছে যে এবার ছেলেদের বিয়ে দেয়, কিন্তু মেয়ে পাচ্ছে না। এবার তাই কাঁথির এই বড়মেলায় এসে হাজির হয়েছে।

শানুকেও ওরা এনেছে, কড়া নজরবন্দিতে রেখেছে!

ডিংলাইয়ের দিদিমার আগের মতলব আর নেই। মানে পুলিশের কাছে ‘হারানো ছেলে’ জমা দিয়ে টাকা সংগ্রহের মতলবটা। এখন ওর ইচ্ছে ছেলেটাকে ‘মানুষ’ করবে। তাই এত পাহারা।

অবিশ্যি নিজেদের সেই ছেঁড়া ন্যাকড়ার টুকরোটুকু পরিয়ে ফেলতে পারেন শানুকে ওরা। শানু চেঁচিয়ে লাফিয়ে হাত-পা ছুড়ে এমন কান্ড করেছিল যে, ওরা ভয় পেয়ে গেল ছেলেটা পাছে মরে যায়।

নিজের জামাতেই আছে শানু। যদিও সেটা একেবারে ময়লা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে, তা আর কী করা? কাবলিওয়ালারা তো যে পোশাকটা পরে, সেটা না ছেঁড়া পর্যন্ত আর একটা কেনে না! শানু বরং কাবলিওয়ালা হবে, তবু ওই কাকমারা হবে না।

ভালুক নাচ হচ্ছে, ডিংলাইয়ের মামা-দিদিমাদের তাতে ভ্রূূক্ষেপ নেই। ওরা তখন আর এক কাকমারার দলের সঙ্গে ভাব করতে ব্যস্ত। কারণ দু-দুটো বড়োসড়ো মেয়ে আছে ওদের। অতএব আশা হচ্ছে, ডিংলাইদের দু-দুটো মামার একসঙ্গে ‘হিল্লে’ হয়ে যাবে।

বিয়ে অবিশ্যি নিখরচায় হবে না, কনের বাবাকে একখানা নতুন কাপড় দিতে হবে, আর কনেকে একখানা নতুন শাড়ি। দুটো ছেলের বিয়ে দেওয়া মানেই চারখানা নতুন কাপড়-জোগাড় করা!

সোজা কথা নয়!

ভরসা শুধু একটু হাত সাফাইয়ের। মেলার বাজারে ধুতি-শাড়ির দোকান তো কম খোলেনি, আর বাহার দিয়ে ঝুলিয়েও রেখেছে রাস্তার ওপর।

ডিংলাইয়ের দিদিমা ছেলেদের জানিয়েছে সবাই মিলে চেষ্টা দেখতে। অনেক ভিড়ের মধ্যে ঝপ করে একখানা সরিয়ে ফেলতে পারলেই ব্যস, বিয়ে একটু এগিয়ে যায়।

তা ডিংলাইয়ের দিদিমা কনে দেখার আর ছেলেদের ধুতি শাড়ি দেখার কাজে লাগিয়ে ঘুরছে শানু। শানু আর ডিংলাই কোথায় কী করছে অতটা খেয়াল নেই। ইত্যবসরে এরা চলে এসেছে ভালুক নাচে।

ভালুকের সঙ্গে সঙ্গে ডিংলাইও নাচছে থুম থুম থুম থুম। আর তার মুখে চোখে স্ফূর্তিটা যা ফুটে উঠেছে তা দেখবার মতো।

কিন্তু শানু তখন আর এক চিন্তায় বিভোর। ও ভাবছে এই ভিড় আর গোলমালের মধ্যে যদি পালাতে পারত। হ্যাঁ, একপাশে সরতে সরতে এর ওর তার পেছন দিয়ে কোনোপ্রকারে একবার যদি কোনো পাশ দিয়ে মেলাতলার বাইরে চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু কোন পাশ দিয়ে?

ডিংলাইয়ের মামারা আর মা-দিদিমা কোনদিকটায় যে তাদের ছেঁড়া চট বিছিয়ে রাজ্যস্থাপন করেছে, তা তো ঠিক ঠাহর হচ্ছে না। এই মেলাতলার সবই যেন কেমন গোলমেলে। শানু তো এই তিন দিন ঘুরছে এদের সঙ্গে, বুঝতেই পারছে না কোনটার পর কোনটা।

এইতো এখানটায় সাইকেলের দোকান, ওদিকটায় ধামা কুলো ঝুড়ি চুপড়ি। তার পাশ দিয়ে কোনখানটায় যে সারি সারি বাসনের দোকান, আর কোনদিকে মাটির পুতুল, কোনদিকে কাঁচের চুরি, কোনদিকে প্লাস্টিকের খেলনা, কোনদিকে বা সেই গাদা গাদা জামা কাপড়ের দোকান, কোনদিকে জ্যাম জেলি, আচার মোরব্বা, পানে খাবার সেইসব জর্দা, মশলা, ধূপকাঠি! জিনিস জিনিস—কত অজস্র জিনিস।

ডিংলাই এসব জিনিসের নাম তবু কিছু কিছু জানে, কিন্তু ওর মা-দিদিমারা তিন ভাগ জিনিস চেনেই না। শানু দেখেছে সেসব, আর ডিংলাই এদিক ওদিক ঘুরছে, কিন্তু ওরা কেবল সেই একই জায়গায় ঘুরঘুর করছে।

তা জায়গাটা? অবিশ্যি শানুর অপছন্দের নয়, কিন্তু হাতে পয়সা না থাকলে আর পছন্দ হয়েই বা কী হবে।

বুঝতেই পারছ, জায়গাটা হচ্ছে রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকানের দিক। সেদিকের কাছাকাছি যেতে না যেতেই জিলিপি ভাজার, কচুড়ি শিঙারা ভাজার, পানতুয়ার রস ফোটার, ঘুগনি সেদ্ধ হবার প্রাণ-আমোদ-করা গন্ধে মাথা-টাতা খারাপ হয়ে যায়।

আশ্চর্য! এই সমস্ত জিনিস কলকাতায় রাশি রাশি ছিল, আর শানুর কাছে কত পয়সা ছিল!

জীবনে যদি কখনো আবার শানু বাবা-মার কাছে ফিরতে পারে, তা হলে শুধু ঝুড়ি ঝুড়ি জিলিপি, বস্তা বস্তা কচুরি, গামলা গামলা পানতুয়া, থালা থালা দরবেশ আর গজা, বালতি বালতি মিহিদানা—

হঠাৎ চমকে উঠল শানু, এ কী! কোথায় ভালুক নাচ? কোথায় ডিংলাই? সত্যিই যে সরতে সরতে শানু মেলার বাজার ছাড়িয়ে একেবারে সার্কাস পার্টির তাঁবুর পেছনে এসে গেছে!

এই তাঁবুর মধ্যে যে কী হচ্ছে না হচ্ছে বাইরের কারুর দেখার জো নেই। আলাদা পয়সা দিয়ে ওর মধ্যে ঢুকতে হয়। দলে দলে ঢুকছেও। শানু সেদিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়াল।

উঃ এত লোক ঢুকছে ওর মধ্যে, ভিড়ে গিসগিস করে ঢুকছে, অথচ ছোটো একটা ছেলে যদি ওর মধে নেহাতই নিজের কাছে পয়সা নেই বলে ওদের মধ্যে গুঁজে গিয়ে ঢুকে পড়তে চায়, ঠিক বুঝতে পারবে ওরা।

কী করেই বা পারে?

অথচ পারে, দেখেছে ও আর ডিংলাই মোটা হাতির মতো দুটো লোকের পেছন পেছন ঢুকে পড়তে গিয়ে দেখেছে কাল, খপ করে ধরে ফেলেছে ওদের। ‘হঠ যা হঠ যা’, করে ভাগিয়ে দিয়েছে!

আবার একটা লোক বলেছে, ‘উঃ এইটুকু ছেলে এক্ষুনি থেকে ফাঁকিবাজ আর চোর হয়ে উঠেছে! বড়ো হয়ে নির্ঘাত গাঁটকাটা হবে।’

শানু যে কে, তা যদি ওরা জানত!

কিন্তু সেযাক, ভয় ওই মানুষের চোখকে! শানুর মতো ছোট্ট একটা ছেলেও পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারবে কি না সন্দেহ। হয়তো যেই সেএই তাঁবুর পেছনের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ওই পুকুরটার ধার দিয়ে রাস্তার দিকে চলতে শুরু করবে, হয়তো ঠিক দেখবে ডিংলাইয়ের দুই মামার চারখানা চোখ গুলিভাঁটার মতো এগিয়ে আসছে!

ডিংলাই আবার বলে কিনা, শানুকে ওদের ভালো লেগেছে, তাই পুষবে। শানু, গোরু কুকুর না পাখি যে তাই পুষবে? পুষলেই হল! মজা পেয়েছে! শানু যখন—

উঃ! কাঁটাতারের ঘসটানি লেগে হাঁটুর ছাল ছিঁড়ে গেল!

কখন যে শানু বেড়া ডিঙিয়ে মেলাতলার বাইরে এসে পড়েছে নিজেই জানে না। হাঁটুর জ্বালায় খেয়াল হল।

কেটে গেলে তক্ষুনি ডেটল লাগাতে হয় শানু জানে, কিন্তু এখানে কোথায় কী? হাত দিয়ে চেপে ধরেই শানু একবার ভয়ানক ভয় পাওয়া আর ভয় ছাড়ার একটা নিশ্বাস নিল।

ডিংলাইকে কিছু বলে আসা হল না।

ডিংলাই কি এখুনি শানুকে খুঁজতে শুরু করেছে? না ‘থুম-থুমা-থুম’ নাচ দেখছে এখনও?

ও কি শানুকে ভালোবেসে খুঁজবে? নাকি মামাদের ধমকে—

দাঁড়িয়ে থাকায় যে বিপদ আছে, একথা ভুলে গেল শানু। সেভাবতে লাগল ডিংলাই একসময় হঠাৎ তাকে দেখতে না পেয়ে কী করবে?

পাগলের মতন ছুটোছুটি করবে?

‘শানু শানু’ করে চিৎকার করে আকাশ ফাটাবে? নাকি ভাববে—ভালোই হয়েছে শানুটা পালিয়ে যেতে পেরেছে।

কিন্তু শানুকে কী নিষ্ঠুরই ভাববে ডিংলাই! ওকে একবার না বলে চলে আসা খুব অন্যায় হয়েছে। আর একবার কি ওইখানে গিয়ে বলে আসবে শানু—‘ডিংলাই আমি পালাচ্ছি!’

কাঁটাতারের জ্বালাটা যন্ত্রণা দিচ্ছে।

আর সেই ওর মামাদের ভাঁটা চক্ষুর কাঁটা!

না: বলে যাওয়া আর হবে না।

জীবনে হয়তো আর দেখা হবে না ডিংলাইয়ের সঙ্গে!

নিশ্বাস ফেলে ভাবল শানু।

কালো কোলাব্যাঙের মতো দেখতে, নেংটিপরা কাকমারাদের ছেলেটার জন্যে শানুর মনটা উদাস হয়ে উঠল।

তারপর ভাবল যদি কখনো দেখা হয় ডিংলাইয়ের সঙ্গে, অনেক অনেক জিনিস দেবে তাকে! আদর করে বাড়িতে নিয়ে এসে মাকে দেখিয়ে বলবে, এই দেখো, আমার সেই বুনো বন্ধুটি! শানুর চোখটা জলে ভরে এল।

তারপর হঠাৎ চৈতন্য হল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। আস্তে আস্তে এগোতে লাগল শানু পুকুরপাড়ের সরু একটা পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে।

এদিকটা নির্জন নিস্তব্ধ। বোধ হয় গ্রামের মেয়েরা কদাচই এ পুকুরে জল নিতে আসে। পায়ে-চলা রাস্তায় ঘাস জন্মে গেছে মাঝে মাঝে।

মেলাতলার যে সমস্ত শব্দ-মিশ্রিত একটা রোল অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়, আস্তে আস্তে কমে আসছে সেটা—ক্ষীণ হয়ে আসছে।

পথের দুপাশের গাছ থেকে সির-সির শব্দ উঠছে। দূরে কোথায় যেন কুকুর ডাকছে। দিনদুপুরটাই রাতদুপুরের মতো গা-ছমছমে কেমন কেমন! শানু কোথায় চলেছে? ভাবতে থাকে শানু—এ কোন দেশ, কোন জেলা, কোন গ্রাম?

একটা পোষ্টকার্ড যদি পায় শানু আর একটা পেনসিল, মাকে তো চিঠি লিখে দিতে পারে, ‘মা আমি হারিয়ে গিয়েও বেঁচে আছি। আমাকে তোমরা নিয়ে যাও।’

কিন্তু কোথায় আসবে মা-বাবা?

হারিয়ে যাওয়া শানু নিজের ঠিকানা কার কাছে পাবে?

‘পাওয়া গেছে। সন্ধান একটা পাওয়া গেছে।’ পুলিশ অফিসার বলেন শানুর বাবাকে। ‘দিঘার ওই দিকে কাঁথির কী একটা গ্রামের মেলাতলার দিকে যেতে দেখেছে কেউ কেউ একদল বেদে ক্লাসের লোককে—যাদের পেশা হচ্ছে পাখিমারা, কাকমারা, মানে একেবারে ‘লো’ ক্লাশ আর কী! তাদের সঙ্গে নাকি একটি ওই বয়সের ভদ্রঘরের ছেলেকে দেখা গেছে—’

শানুর মা চিৎকার করে ওঠেন—‘তা চলুন কাঁথি!’

‘আহা ধৈর্য ধরুন, শুনুন। যারা দেখেছে তারা এমন কিছু রেসপেকটেবল নয়। কী দেখতে কী দেখেছে হয় তো—’

‘আপনি তো বলছেন ভদ্রঘরের ছেলেকে দেখেছে—’ শানুর মা কাঁদতে থাকেন, ‘ওরা ওই বেদেরা তেমন ছেলে কোথায় পাবে?’

‘ঠিক কথা! সেটাই এখন আমাদের সন্ধানের বিষয়—’

‘আমি জানি না। আমি যাব কাঁথি!’ শানুর মা জোরে জোরে বলেন, ‘কেন আপনারা আমাকে নিয়ে এলেন কলকাতায়?’

শানুর বাবা ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘আঃ কী হচ্ছে? ওঁরা কী করবেন? খোঁজা তো চলছে—’

‘না না, ওঁদের খোঁজায় কিচ্ছু হবে না। আমি নিজে যাব। নিজে খুঁজব। আমি এক্ষুনি কাঁথির সেই মেলায় যাব!’ অস্থির হয়ে ওঠেন শানুর মা।

অনেক কষ্টে ভোলাবার চেষ্টা করা হয় তাঁকে, কিন্তু তিনি প্রায় পাগল। শেষ অবধি তাঁকে নিয়ে আবার রওনা হতে হয় শানুর বাবাকে কাঁথির মেলার উদ্দেশ্যে। আবার চাবি পড়ে বাড়িতে।

শানুর বাবার কাজকর্ম? সেতো মাথায় উঠেছে।

ক-দিন পরে আবার ওঁরা ফিরে আসেন বিফল মনোরথ হয়ে।

মেলাতলায় যত ওই ধরনের লোক জড় হয়েছিল কেউই স্বীকার করতে চায় না যে তাদের সঙ্গে কোনো ভদ্দরলোকের ছেলে ছিল।

শুধু একটা শুকনো মুখ কালো কিষ্টি ছেলে মেলার বাইরে ঘুরছিল। সেওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত-মুখ নেড়ে কোনো রকমে বোঝাল একটা ভদ্দরলোকের হারানো ছেলে তাদের দলে ছিল, কিন্তু সেআবার হারিয়ে গেছে।

কোথায় চলে গেছে কে জানে।

বাড়ি ফিরে শানুর বাবা বাইরের দিকের ঘরটার দরজা খুলেই থমকে দাঁড়ালেন। একটা জানালার খড়খড়ি খোলা, সেখান দিয়ে বৃষ্টির জল এসেছে গড়িয়ে, আর সেই জলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা পোস্টকার্ড। ভিজে থসথস করছে।

বাড়ির দরজা বন্ধ দেখে পিয়নে জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে পোস্টকার্ড খানা। তারপর কখন বৃষ্টি এসেছে জোরে আর জল এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। সব লেখাগুলো ধেবড়ে ঝাপসা হয়ে গেছে!

কিন্তু কার চিঠি ও? বড়ো বড়ো অক্ষর, ছাড়া ছাড়া লাইন, ছোটোছেলেদের হাতের লেখার মতো!

শানুর বাবার হাত-পা কাঁপতে থাকে, পোস্টকার্ডখানা হাতে নিয়ে বসে পড়ে চিৎকার করে ওঠেন শানুর বাবা—‘এই শুনছ—শিগগির এসে দেখে যাও এ কার চিঠি!’

কিন্তু কী দেখবেন শানুর মা? তাতে কি দেখবার কিছু আছে? সব তো ভিজে গেছে।

হায় শানু কি একবারও ভেবেছিল তার অত কষ্ট করে জোগাড় করা পোস্টকার্ডটার এই দুর্দশা হবে? ও শুধু দিন গুনছে। চিঠি যেতে কদিন লাগে, চিঠি পেয়ে চলে আসতে কদিন লাগে? একদিন একদিন দুদিন এই তো। কিন্তু এ যে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, আর চায়ের দোকানের হেড চাকরটা তাকে রাত-দিন খিঁচোচ্ছে।

হ্যাঁ, আপাতত শানুর বাসস্থান একটা চায়ের দোকান। খড়গপুর স্টেশনের ধারের এই দোকানটার মালিক সাধন কুন্ডু বলে ‘আমার দোকানের চা যে খাবে, তার আর বয়েস বাড়বে না। বুঝলেন মশাই, যে বয়সের আছেন সেই বয়সেই থাকবেন।’

আর ওদিকে হেড চাকর কানাইকে বলে, ‘একবার চা বানিয়েই ভিজে পাতাগুলো ফেলে দিসনে বাপ কানাই, রোদে মেলে দিয়ে শুকিয়ে নে, আর একদিন চলবে। একটু বেশি করে ফুটিয়ে নিবি।’ নয় তো বলে, ‘সর্বনাশ করলে, সর্বনাশ করলে! পুরো-পুরি চিনি? তোরা কি আমায় ডোবাতে চাস কানাই? আধা-আধি গুড় দিয়ে চা বানালে পুষ্টিকর হয়, এ তোকে কত দিন শেখাতে হবে বাপ? চায়ে চিনি দিবি, দুধ দিবি, এত বায়নাক্কা করলে আমার দোকানে পোষাবে না বাপ! পথ দেখ, পথ দেখ।’

এই সাধন কুন্ডুই স্টেশনের ধারে কাছে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটাকে ধরে এনেছিল। বলেছিল, ‘কলকাতায় যাবি? তা বেশ তো? কিন্তু যেতে হলে তো পয়সা লাগে? রোজগার কর সেপয়সা। আমার দোকানে কাজ কর।’

শানু তো শুনে আগুন। ‘কাজ করব মানে? আমি কি চাকর?’

‘আহা-হা চাকর কীসের চাঁদ, তুমি নয় মালিকই হলে! হুঁ:! বলি বাড়ি থেকে তো পালিয়ে এসেছিস, আর পুলিশে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, জানি না ভেবেছিস?’

আসলে অবশ্য এটা সাধন কুন্ডুর চালাকি। আন্দাজেই বলেছে। দেখেছে ভদ্রঘরের ছেলের মতো চেহারা, অথচ রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ স্রেফ ঘর-পালানো ছেলে। অতএব ভয় দেখিয়ে কবলে আনতে হবে।

আর পুলিশের ভয়ের মতো ভয় আর কীসে আছে?

শানু কিন্তু রেগে আগুন। বলে, ‘ইঃ পুলিশ আমায় ধরবে কেন? আমি কি চোর? আমি তো শুধু হারিয়ে গেছি।’

‘আহা তা বেশ তো। হারিয়ে গেছিস, এবার নিজেকে খুঁজে নে। আমার দোকানে কাজকর্ম কর, আমার কাছে খা, পর, থাক। দেখবি দিব্যি নিজেকে খুঁজে পেয়ে যাবি।’

তা ‘খাওয়া’ শুনে শানুর মনটা নরম হল একটু। দু-দিন তো খাওয়া দাওয়া বন্ধ। আর শুধুই কি দু-দিন? ডিংলাইদের ওখানে কীই বা খেয়েছে এতদিন?

আর পরা? সেও একটা কিছু পেলে ভালো হয়। গায়ের জামা-প্যান্টটা তো গায়ের চামড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে!

তাই গম্ভীরভাবে শানু বলে, ‘বেশ খেতে পরতে পারি, কিন্তু কাজ টাজ করতে পারব না, তা বলে দিচ্ছি।’

শুনে সাধন কুন্ডু এ্যায়সা হাসি হাসতে লাগল যে, শানু তো ‘হাঁ’। এদিকে সাধন কুন্ডুর হাসির হাঁ আর বোজে না। আর যদি বা বুজল তো শুরু হল কথার তুবড়ি।

‘খেতে পারবি? পরতে পারবি? ওরে আমার সোনার চাঁদ রে, পারবি আমার তিন পুরুষের মাথা কিনতে? কিন্তু তোকে আমি অমনি খাওয়াব কেন? কী তুই আমার গুরুপুত্তর!’

শানু রেগে গিয়ে ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘ছেড়ে দাও, আমি যাব না তোমার সঙ্গে।’

‘যাবি না? হা: হা: হা:! তবে পুলিশের হাতে যা। চল নিয়েই যাই থানায়!’

‘থানা’ শুনেই শানুর কেমন ভয় ভয় করে। তবু মুখে তো হারবে না সে। তাই বুক ফুলিয়ে বলে, ‘বেশ চল না! থানায় যেতে ভয়টা কি আমার? আমি তো আর দোষ করিনি!’

‘না দোষ করিসনি!’ সাধন কুন্ডু খিঁচিয়ে ওঠে ‘বড়ো গুণ করেছিস! মা-বাপের মনে কষ্ট দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস।’

এক হ্যাঁচকা টান মারে সাধন। শানুর চোখে জল আসে, গলা বুজে আসে। ভাবে সত্যিই তো আমি কী কম পাজি? কিন্তু এত কান্ড হবে, তা কী জানত শানু, যখন সেই দিঘার বাসা থেকে ‘একটুখানি’ শুধু বেরিয়েছিল?

সাধন কুন্ডু গিয়ে কানাইকে ডাক দেয়, ‘এই নে। দোকানের জন্যে একটা অ্যাসিস্টেন্ট চাইছিলি। এনে দিলাম অ্যাসিস্টেন্ট। চায়ের বাসনপত্তর ধুতে দিসনি। ভেঙে চুর করবে। শুধু টেবিল মোছা, ঘরঝাড়া এই সব করাবি আর শোন, এই নে তিনটে টাকা নে। অনন্ত নন্দীর দোকান থেকে একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি কিনে নিয়ে আয়।’

অতঃপর সেই তিন টাকার গেঞ্জি-প্যান্ট পরিয়ে শানুকে কাজে বহাল করিয়ে নেয় সাধন কুন্ডু।

কিন্তু কাজ শানু পারলে তো?

কানাই আর সাধন একসঙ্গে খিঁচোতে থাকে, ‘ওরে আমার নবাবপুত্তুর, বসে বসে খাবে তুমি? কী আমার সগগে বাতি পড়বে তোকে খাইয়ে?’

শানুর চলে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না।

কানাইয়ের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এইটা পোস্টকার্ড জোগাড়ের আশায় এত কষ্ট করে পড়ে আছে শানু।

অবশেষে একদিন সেআশা সফল হল। দেখল কানাই একটা পোস্টকার্ড নিয়ে চিঠি লিখছে। আহ্লাদে চোখ জ্বলে উঠল শানুর। বলল, ‘আমায় একটা পোস্টকার্ড দেবে?’

কানাই খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘পোস্টকার্ড? সেআবার তুই কী করবি?’

‘চিঠি লিখব!’

‘ওব বাবা! বলি তুই লিখতে জানিস?’

‘জানি না মানে? ‘আমি ইস্কুলে পড়ি না বুঝি?’

‘ও বাবা! তাই নাকি? দেখি তো কেমন লিখতে পারিস!’ বলে পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড দেয় কানাই। দোয়াত-কলমটাও এগিয়ে দেয়।

কলমে হাত দিয়ে শানুর হাত কাঁপতে থাকে, ‘মা’ লিখতে মাথা ঝিমঝিম করে, তবু লিখেও ফেলে শেষপর্যন্ত। ঠিকানাও লেখে। আর ভাবে শুধু এই একখানি পোস্টকার্ডের অভাবে এত কষ্ট করে পড়ে আছে শানু, এতদিন এত কষ্ট পেয়েছে।

পোস্টকার্ডটার মাথায় এখানের ঠিকানা লেখে শানু বড়ো বড়ো করে। সেঠিকানা সাধন কুন্ডুর চায়ের দোকানের সাইন-বোর্ড থেকে সংগ্রহ করেছে:

ওরিয়েন্টাল রেস্টুরেন্ট,

স্টেশন রোড, খড়গপুর

প্রো শ্রীসাধনচন্দ্র কুন্ডু।

কুন্ডু শুনলেই শানুর ইচ্ছে করে ওর মুন্ডুটা ধরে ঘুরর করে লাট্টুর মতো ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু সেইচ্ছে তো আর মেটে না। তবে এবার ঘুরে যাবে মাথা। যখন চিঠি পেয়ে শানুর মা আর বাবা আসবেন সুন্দর জামাকাপড় পরে, আর এত এত টাকা নিয়ে আসবেন, তখনই ওই সাধনটা নিশ্চয় ভাববে, ‘হায় হায় এ কী করেছি! কাকে দিয়ে আমি টেবিল মোছাতে গিয়েছি! কাকে আমি এত বকেছি!’ মাথা ঘুরে যাবে তখন সাধনের।

কিন্তু সেচিঠির কী অবস্থা হল, সেতো আগেই বলেছি।

শানু দিনের পর দিন ভাবতে থাকে, ওই বাবা আসছেন, ওই মা আসছেন। রাস্তায় একটা গাড়ির শব্দ হলেই যেখানে থাকে ছুটে আসে।

কিন্তু কোথায় মা? কোথায় বাবা?

তাঁরা তো তখন সেই জল পড়ে অক্ষর মুছে যাওয়া চিঠিটা নিয়ে পাগল হয়ে বেড়াচ্ছেন, যদি কেউ পড়ে উদ্ধার করে দিতে পারে।

ম্যাগনিফাইং গ্লাস, জোরালো আলো, রাসায়নিক পরীক্ষা কিছুতেই কিছু হল না। যে লেখা মুছে গেছে, সেলেখা কি আর পড়া যায়?

শানুর মামার বাড়ি সবাই একে একে দেখতে থাকে। সকলেরই ধারণা কেউ পারেনি বটে, কিন্তু আমি পারব। কিন্তু চিঠিটা হাতে নিয়ে সবাই হেরে যায়।

অবশেষে শানুর ছোটোমামি আবিষ্কার করেন, এর ডাকের ছাপে একটা ‘পি’ আছে।

কিন্তু শুধু ‘পি’তে কী হবে? ‘পি’ দিয়ে কত নাম!

আর ‘পি’টা যে নামের ঠিক কোথায় আছে, তাও তো জানা নেই? আগেও থাকতে পারে, শেষেও থাকতে পারে, মাঝেও থাকতে পারে।

তবু টাইম টেবল, ব্রাডশ, ভারতবর্ষীয় পোস্টাফিস সমূহ নিয়ে পড়া হল। কোন কোন দেশে আছে ‘পি’।

ওরে বাবা ক-টা দেশ গুনবে?

‘পি’ দেখতে দেখতে মাথা ঝিমিয়ে আসে। এত দেশে কী খোঁজা যায়?

শানুর দিদিমা বলেন, ‘থানা পুলিশ, খবর কাগজ, ওসব কোনো কর্মের নয়। খোঁজ যদি কেউ দিতে পারে তো গনতকার। গনতকারেরাই গুনে বলতে পারে হারানো জিনিস কে নিয়েছে, হারানো ছেলে কোথায় আছে।’

তা গনতকারের কাছে কি আর যাননি শানুর মা-বাবা? কত গিয়েছেন। কিন্তু আসলে তো বেশির ভাগই ভন্ড, আর সাজা গনতকার। খালি পয়সা নিতেই ওস্তাদ।

তবু আশা নিয়েই তো বাঁচা!

কে নাকি বলেছে শানুর দিদিমাকে—বেহালার ওদিকে কী নাকি ‘জানবাড়ি’ আছে, সেখানের গনতকার সব জানিয়ে দেন। আর সবচেয়ে ভালো কথা হচ্ছে—পয়সা টয়সা কিছু নেন না তিনি।

তবে?

তা হলেই তো! পয়সা নেন না মানেই আসল খাঁটি! শুধু পরোপকারের তরে ‘বাড়ি’র দরজা খুলে বসে আছেন।

শানুর দিদিমা বললেন, পাঁচটি সুপুরি, একটি পইতে—ব্যস।’

ট্যাক্সি চড়ে চললেন শানুর মা, বাবা দিদিমা ছোটোমামা।

শানুর মা ভাবছেন এইবার পেয়েছি, এইবার শানু আমার কাছে আসবে।

তা গনতকারটি ভালো। বললেন, ‘ওই সুপুরি কটি রেখে যান, ও আমি ছোঁব না। দক্ষিণা আমি ছুঁই না। তবে একটা নিয়ম আছে—’

‘কী!’

‘আর কিছু না, একখানি নতুন গরদের ধুতি পাট করে তার ওপর বসে গণনা করতে হয়।’

শানুর বাবা বলেন, ‘এই কথা! এক্ষুনি আনছি।’ ট্যাক্সি করে আনতে যান।

গনতকার বলেন, ‘আর একটি নিয়ম—’

‘কী বলুন?’

‘বড়ো টিনের একটিন ভালো খাঁটি ঘি! আগামীকাল গভীর রাত্রে হোম করতে হবে।’

‘ঠিক আছে!’—বলেন শানুর বাবা।

বিনা দক্ষিণায় যিনি গণনা করছেন, তিনি যা বলবেন করতে হবে বই কী! মা পাঁচটি সুপুরি নিয়ে এতবড়ো কাজ! তা-ও সেসুপুরি হাত দিয়ে ছোঁন না!

শানুর বাবা বললেন, ‘এক্ষুনি যাচ্ছি।’

‘আর শোনো বাবা, সের আড়াই কাশীর চিনি। ওটা হোমে লাগবে।’

‘ঠিক আছে।’

‘ওহো হো, রোসো—রোসো! পাঁচটি উৎকৃষ্ট ফল।’

আরও অনেকবার, ‘আরে শোনো শোনো’—শুনে শেষ অবধি গেলেন শানুর বাবা।

গনতকার জিজ্ঞেস বাদ করতে লাগলেন—‘কত বড়ো ছেলে, কী করে, কবে হারিয়েছে।’ আর তারপর কী আশ্চর্যের কথা—চোখ বুজে থাকতে থাকতেই হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ছেলেটি এখন রেলগাড়ি চড়ে কোথাও যাচ্ছে—’

‘এ্যাঁ রেলগাড়ি চড়ে’! যাচ্ছে!’

শানুর মা চিৎকার করে ওঠেন, ‘যাচ্ছে—না আসছে?’

‘রোসো।’

আর একবার চোখ বুজে গনতকার বলেন, ‘বোধ হয় আসছে। দেখলাম ……ট্রেনে চড়া, পাশে অন্য একটি লোক। কী যেন কথা বলছে তারা।

‘এও দেখতে পান আপনি?’—বলে ওঠেন শানুর মা।

‘পাই বই কী! কোনদিকে মুখ করে বসে আছে তাও, দেখতে পাচ্ছি।’

‘ঠাকুরমশাই, তাকে আনিয়ে দিন।’

‘আসবে আসবে।’ গনতকার বলেন, ‘আমি বলে দিয়েছি। আসতে তাকে হবেই। শুধু একটু দেরি হবে।’

‘দেরি! আর কত দেরি হবে?’

‘তা হবে দু-ছমাস। গনতকার অম্লানবদনে বলেন—‘এক বছরও হতে পারে।’

‘ও বাবা, তা হলে আমি কী করে থাকব গো।’ শানুর মা কান্না জুড়ে দিলেন।

গনতকার বলেন, ‘কাঁদলে কী হবে। ছেলে পড়েছে বদলোকের পাল্লায়। সেওকে যা বলছে, তাই করছে। এখন একমাত্র উপায় মন্ত্রবলে তাকে আকর্ষণ করা।’

‘তা তাই করুন।’

‘করব। করতে হবে। কিন্তু কিছু জিনিস চাই যে!

‘তা’ চান না—‘শানুর মা বলে, ‘নিজে তো একটু কিছুও নিচ্ছেন না। যা লাগবে, তা নেবেন বই কী।’

‘আর কিছু না’ একখানি নতুন কম্বল। কালো কম্বল হলে চলবে না। ভালো নরম কম্বল লাল, নীল, সবুজ যা হোক।’

তাও এল।

গনতকার মন্ত্র পড়লেন, চালপড়া ছুড়লেন, তারপর বললেন, ‘সাত দিনের মধ্যে ছেলে এসে যাবে!’

‘সা-ত দিন!’

শানুর মা বলেন, তিনদিনে হয় না?’

গনতকার হাসেন, বলে, ‘পাগলি বেটি! তাই কী হয়? এই মন্ত্রের-আলো আকাশে উঠবে। তারপর পথ খুঁজে খুঁজে দেখে ঠিক জায়গায় নামবে। তারপর তার মনে যন্ত্রণা ধরাবে।’

‘যন্ত্রণা ধরাবে? সেকী?’

‘আহা ধরাবে না? তার মনে সর্বদা এই হতে থাকবে মা-বাপ ছেড়ে কোথায় বসে আছি। তবে না ছুটে আসবে? সেটাই যন্ত্রণা।’

‘তা ঠাকুরমশাই, সেকি ইচ্ছে করে আসছে না?’

ঠাকুরমশাই মাথা নেড়ে বলেন, ‘না না, তা কেন? তাহলে তো চিঠি লিখত না। কেউ আসতে দিচ্ছে না। লুকিয়ে চিঠি লিখেছে।’

ভগবান তার সুমতি হোক।

‘ঠাকুরমশাই, তবে ওই সাতদিনই।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সাত দিন।’ ঠাকুরমশাই আশ্বাস দেন, দেখতে পাচ্ছি রেলগাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

তা গনতকার যেমনই ‘খাঁটি’ হোক, তাঁর একটা কথা কিন্তু মিথ্যে নয়।

ঠিক সেইসময় রেলগাড়ি চড়েই বেড়াচ্ছিল শানু। আর সঙ্গে একজন ছিলও। কী সেকি বদলোক?

চিঠির উত্তর অথবা মা-বাপের আসার আশায় হতাশ হয়ে, অবশেষে একদিন শানু মরিয়া হয়ে উঠে বসেছিল কলকাতায় যাওয়ার ট্রেনে।

না থাক টাকা, না থাক টিকিট—সেএমনিই যাবে। দেখি কে তাকে আটকাতে পারে! এই রেলগাড়িটায় চড়লেই তো ক-ঘণ্টায় কলকাতা যাওয়া যায়। আর শানু কিনা এইখানে বসে সাধন-বাবুর গালাগাল খাচ্ছে?

যদি তাকে রেলের টিকিট চেকার ধরে, সেবলবে, ‘বেশ তো আমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে চলো। দশ ডবল টাকা দিচ্ছি তোমায়।’

তখন যদি জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় তোদের বাড়ি?’ শানু ঠিকানা বলে দেবে। বিপদে পড়লেই ভালো। বিপদে পড়তেই চায় শানু। বিপদে পড়লেই তাকে পুলিশে ধরবে।

তা গাড়িতে বসে একটু যেতে না যেতেই বছর কুড়ির একটা ছেলে ওর কাছে এসে বসে আর হেসে বলে, ‘কি, রে তুই-ও বুঝি আমার মতন বিনা টিকিটের যাত্রী?’

শানু রাগ-রাগ ভাব দেখিয়ে বলে, ‘আমার টিকিট নেই, এ কথা কে বললে তোমায়?’

‘বললে? বললে তোর মুখ।’ হা-হা করে হেসে উঠল ছেলেটা।

ছেলেটার সঙ্গে তক্ষুনি ভাব হয়ে গেল শানুর, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেশানুর জীবন-কাহিনি শুনে নিল! আর শুনে বলল, ‘তোর মা-বাপ কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়নি?’

‘বিজ্ঞাপন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ পুরস্কার ঘোষণা করে বিজ্ঞাপন দেয় না কেউ হারিয়ে টারিয়ে গেলে? জানিস না বুঝি?’

শানু ঘাড় নাড়ে, ‘দেখেছি। খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় থাকে। হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশে’—

‘এই তো জানিস। তা তুই যদি আদরের ছেলে হবি, তোর বাবা তোর জন্যে বিজ্ঞাপন দেবে না? খুঁজে দিলে পুরস্কার দেবে।’

শানু তো হারবে না। তাই সতেজে বলে, ‘দেবে না কেন, নিশ্চয় দিয়েছে। আমি কি খবরের কাগজ দেখেছি? যেমন ডিংলাইরা, তেমনি হচ্ছে সাধন কুন্ডু। খবরের কাগজ কেনেই না। কোন ডাক্তারবাবুর ওষুধের দোকানে নাকি কাগজ কেনা হয়, সেখানে যত রাজ্যের লোক গিয়ে পড়ে আসে। আমি তো আর যাইনি।’

সেই ছেলেটার হাতে কিন্তু একটা পাকানো খবরের কাগজ ছিল, সেসেইটাকে নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে করতে বলে, ‘আচ্ছা ধর যদি দেখিস তোর বাবা তোর জন্যে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে?’

শানু গম্ভীরভাবে বলে, ‘আর দেখে কী হবে? আমি তো নিজেই যাচ্ছি এখন। আরও আগেই চলে যেতাম, শুধু সাধন কুন্ডু ইস্টিশান থেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল বলে—’

‘কিন্তু তুই যে বললি, মাকে চিঠি দিয়েছিলি, তা ওরা নিতে এল না কেন?’

শানু ঝপ করে যেন নিভে যায়। মলিন চোখে তাকিয়ে বলে, ‘মা বোধ হয় এখনও দিঘায় পড়ে আছে!

‘তবে সেই দিঘাতেই চিঠি দিলি না কেন?’

‘বা:! সেখানের ঠিকানা আমি জানি? আর আরও একটা পোসটোকাড আমাকে কে দেবে শুনি। ওই কানাইকে কত বলে বলে—’

ছেলেটা শানুকে খুব নিরীক্ষণ করতে করতে বলে, ‘তা বটে।’ তারপর হাতের খবরের কাগজখানার পাক খুলে তাতে চোখ রাখে।

শানু একটু চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘তা তোমার কথা তো কিছু জানলাম না। নাম কী, বাড়ি কোথায় সব তো বললে না?’

ছেলেটা হেসে উঠে বল, ‘তুই কি জিজ্ঞেস করেছিস?’

শানু অপ্রতিভ হাস্যে বলে, ‘এই তো জিজ্ঞেস করছি। তোমার বাড়ি কোথায়, কোথায় বা যাচ্ছ, নাম কী—’

‘হুঁ:। আমি আবার একটা মানুষ, তার আবার কথা! আমি কি তোর মতন মা-বাপের আদরের ছেলে রে? আমি হচ্ছি একটা সংসারের জঞ্জাল।’

‘জঞ্জাল? মানুষ আবার জঞ্জাল হয়?’

‘তা’ হয় বই কী! মা নেই, বাপ নেই, জ্ঞাতি-কাকার বাড়িতে চাকরের মতন থাকতে হয়। উঠতে বসতে বকুনি, লেখাপড়া শেখাতে খরচ বলে ইস্কুলে দেয়নি—মুখ্যু হয়ে বসে আছি, মনের ঘেন্নায় তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। নিরুদ্দেশ হয়ে গেছি।’

পালিয়ে এসেছ? ইচ্ছে করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছ?’

‘তবে না তো কী?’

‘তা তোমার বাড়ির লোকেরা—ওই যে বিজ্ঞাপনের ঘোষণা নাকি, দেয়নি?’

‘আহারে! তা আর নয়? লাখ টাকা পুরস্কার দেবে!

বরং ভাবছে, হতভাগা-মুখপোড়া গেছে বালাই গেছে। আর খেতে পরতে দিতে হবে না।’

শানু আহতভাবে বলে, ‘যা:! তাই আবার কেউ ভাবে নাকি? মানুষ বুঝি ভূত?’

‘মানুষ ভূত প্রেত যক্ষ রক্ষ সাপ ব্যাং সিংহী সব।’ ছেলেটা কাগজটা আবার মুড়ে ফেলে বলে, ‘যত বড়ো হবি বুঝবি।’

‘আমি অতসব বুঝতে চাই না। তোমার নাম কী, তাই বলো।’

‘নাম? বটু! বটুক ভৈরবের দোর-ধরা ছেলে কিনা। তাই এত কপাল-জোর। এই তো বেরিয়েছি, পকেটে নেই একটা পয়সা, দেখি ক-দিন যায়! তারপর না খেয়ে মরব।’

শানু ব্যথিতভাবে বলে, ‘তা তুমি তো বড়ো হয়েছ, চাকরি টাকরি করতে পারো না?’

‘চাকরি? চাকরি কে দিচ্ছে আমায়? হ্যাঁ দিতে পারে তোর ওই সাধন কুন্ডুর মতন লোক। তা’ তেমন চাকরি করার চাইতে না খেয়ে মরাও ভালো।’

তা যে ভালো সেকথা শানুও বলবে। যা না খিঁচোয় ওরা!

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শানু বলে ওঠে, ‘মরে গিয়ে কোনো লাভ নেই। হ্যাঁ যুদ্ধুটুদ্ধু করে মরো, সেআলাদা কথা। না হলে বেঁচে থাকাই ভালো। মরে গেলে আর কী হল? কথাও বলতে পারবে না, হাতও নাড়তে পারবে না, কিছু দেখতেও পাবে না, লোকেরা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেবে। এ তোমার ভালো লাগে?’

বটু হেসে ফেলে বলে, ‘ভালো কী আর লাগে? কিন্তু কী উপায় বলো? বাঁচবার জন্যে তো টাকা চাই? এখন যদি বেশ কিছু টাকা পাই তা হলে একটা দোকান খুলি। কাচের বাসনের দোকান। সুন্দর সুন্দর সব কাচের বাসন সাজিয়ে রাখব তাকে তাকে, লোকেরা এসে কিনে নিয়ে যাবে। অনেক লাভ হবে, দেখতে দেখতে বড়োলোক হয়ে যাব।’

শানু দুঃখিতভাবে বলে, ‘কাচের দোকান করতে অনেক টাকা লাগে?’

‘তা লাগে!’

‘আমার যদি অনেক টাকা থাকত, তোমায় দিতাম।’

‘দিতিস! বটু উত্তেজিতভাবে বলে, ‘কেন দিতিস? তুই তো আমার কেউ নয়। তুই তো আমায় চিনিসই না।’

‘বা:! আগে কেউ ছিলাম না, আগে চিনতাম না, এখন তো তোমার বন্ধু হয়েছি।’

বটু মিনিটখানেক চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘ঠিক বলছিস?’

‘বলছিই তো! আমার টাকা থাকলে—’

‘ইচ্ছে করলেই তুই আমাকে টাকা পাইয়ে দিতে পারিস!’

শানু হেসে ওঠে। বলে, ‘ইচ্ছে করলেই? আচ্ছা—এই চোখ বুজছি, ইচ্ছে করছি। হে ভগবান, তুমি আমার বন্ধুকে অ—নে—ক টাকা পাইয়ে দাও।’

বটু বলে, ‘ধেৎ। চোখ বুজে ভগবানকে ডাকলে যদি টাকার থলি পড়ত, তাহলে এতদিনে আমি টাকার থলি পেতে শুতাম। কম ডেকেছি ভগবানকে?

‘তাহলে কী করে পাওয়া যাবে বল?’

‘আছে কৌশল। তুই যদি রাজি হস!’

‘কী? কী?’ ঝড়াৎ করে গাড়িটা একটা স্টেশনে থামে।

‘বলব। গাড়িটা আবার চলুক।’

ইত্যবসরে স্টেশনে চা-খাবারের ধুম পড়ে যায়। সকলেই জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাঁড় নেয়, প্ল্যাটফর্মে নেমে নিয়ে আসে খাবারের ঠোঙা। শিঙাড়া, পানতুয়া, ইয়া বড়ো বড়ো গরম জিলিপি।

শানু আর বটু? দু-জনেরই পেটের মধ্যে দাবাগ্নি জ্বলছে, কিন্তু পকেটে!

নো কানাকড়ি।

একটি নয়া পয়সাও নেই কারুর পকেটে। বটু একটু বোকা বোকা হেসে বলে, ‘তোর কাছে কিচ্ছু নেই, না? দু-আনা চার আনা?’

শানু মুখ লাল করে, মাথা নাড়ে।

‘আমারও ভাই ট্যাঁক গড়ের মাঠ! লোকেরা বেশ খাচ্ছে, না?’

শানুরও তখন তাই মনে হচ্ছিল। তবু মান-মর্যাদা বজায় রাখতে জোর করে বলে, ‘বেশ আবার কী? ইস্টিশানের জিনিস বুঝি ভালো? যতসব পচা ঘিয়ে তৈরি। খেলেই তো অসুখ।’

বলে বটে, তবে প্রায় চোখের জল পড়-পড় অবস্থা।

এদের ঘন ঘন তাকানোর বহরে একটা খাবারওয়ালা কাছে সরে আসে; বলে, ‘নেবেন নাকি?’

শানু বলতে যাচ্ছিল ‘না।’ কিন্তু বটু হঠাৎ আরও এগিয়ে এসে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘নেবার তো ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নেব আর কী? কী আছে তোমার?’

‘আজ্ঞে সবই আছে। কী নেবেন বলুন। শিঙাড়া আছে খাস্তা গজা আছে, রসগোল্লা, পানতুয়া, জিলিপি—’

বটু আর একটু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলে, ‘আছে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু খাদ্যযোগ্য কি? নাকি কেরোসিন তেলে ভাজা?’

‘অ্যাঁ! কী বলছেন? কেরোসিন তেলে ভাজা! কেরোসিন তেলে খাবার আপনাদের কলকেতায় ভাজতে পারে, আমাদের এদিকে ওসবের চল নেই।’

‘বটে নাকি? বেশ বেশ বেশ! তাহলে বলছ যে ঘিয়েরই?’

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আজ্ঞে নিশ্চয়। একেবারে বাড়িতে সরতোলা গাওয়া ঘিয়ে ভাজা।’

‘বটে নাকি? তা তোমার জিলিপির কত করে সের?’

‘সের? সেরের হিসেব নিয়ে কী হবে? ক-আনা নেবেন তাই বলুন।’

‘আরে বাবা ব্যস্ত হচ্ছ কেন—’

‘ব্যস্ত হব না? ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। নেবেন কি না তাই বলুন?’

‘নেব না কী হে খিদেয় পেটের নাড়ি পাক দিচ্ছে। একটু মোটা করেই খেতে হবে। দাও আট আনার শিঙাড়া।’

লোকটা আটখানা শিঙাড়া তুলে পাতায় রাখে।

‘আচ্ছা তোমার ওই পানতুয়া—কত করে পিস?’

‘চার আনা আছে, দু-আনা আছে—, পানতুয়া তুলতে থাকে সে।

‘ওই চার আনারই চারটে, আর জিলিপি দুখানা, তোমার গিয়ে রসগোল্লা দুটো—না না চারটেই দাও, খিদেটা জোর পেয়েছে। আর ওই খাস্তা কচুরি দু-খানা, নিমকি দু-খানা, গজা, খান চারেক—’

লোকটা হঠাৎ হাত থামিয়ে বিরক্তকন্ঠে বলে, ‘কী চান স্পষ্ট করে বলুন না বাবু। একসঙ্গে কতরকম বলছেন?’

‘আহা সবরকমই যে খেতে ইচ্ছে করছে। তা দাও না। খেয়ে দেখি ততক্ষণ’

‘আগে পয়সা বার করুন দাদা—’ লোকটা কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, ‘গাড়িতে তো ঘণ্টা দিয়েছে।

‘দিক না। দিতে দাও। যার যা আছে, সেতা দেবে। তুমি তো দাদা খাবার ছাড়ছ না।’

‘আপনিও তো পয়সা ছাড়ছেন না দাদা। নেবেন না তাই বলুন। ট্যাঁকে নেই পয়সা বুঝতেই পারছি। না-হক হয়রানি।’

গাড়ি নড়ে উঠেছে। বটু শানুর হাতটা চেপে ধরে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠ, ‘আচ্ছা দেখে নেব তোমায়। খদ্দেরকে খাবার দাও না। আমার যা ইচ্ছে আমি তাই চাইব—’

গাড়ি ছেড়ে দেয়।

অন্য আরোহীরা হাঁ হাঁ করে উঠে বলে, ‘কী হল? কী হল?’

‘দেখুন না মশাই। পাঁচরকম খাবার চেয়েছি বলে, বলে কিনা, ‘যা নেবেন এক রকম নিন। শুনুন তো মশাই। আমি আর আমার এই ভাগনে দু-জনে তাড়াতাড়িতে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। ভাবছি নোনতা মিষ্টি মিশিয়ে পেটটা ভরে খাব, বাচ্চা ভাগনেটা তো যা দেখছে তাই বলছে খাব। আমি মামা হই, কোন লজ্জায় ‘না’ করি? তুই বেচতে এসেছিস খদ্দের যা চাইবে দিবি না?’

শানু তো অবাক। শানু আবার কখন বটুর ভাগনে হল? কেন যে বটু অমন আজেবাজে কথা বলল, বুঝতে পারল না শানু, হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

গাড়ির সকলে বলতে লাগল, আজকাল ওই ওলা টোলাদের যা অহংকার হয়েছে। যেন এক একটি নবাব খাঞ্জা খাঁ!’

আর হঠাৎ একটি ভদ্রমহিলা দুটো প্লেটে চারখানা করে লুচি আর দুটো করে বড়োবড়ো রসগোল্লা নিয়ে এসে বটুকে বলেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবা, খাবার তো কিনতে পেলে না, একটু খাও।’

‘না না—এ কী! ছি ছি—’

‘তাতে কী হয়েছে বাবা? সঙ্গে কচি বাচ্চা ছেলেটা। আমাদের বেশি রয়েছে—’

শানুর অবশ্য খুবই খেতে ইচ্ছে করছিল। ঠিক মনে হচ্ছিল সেযেন ইস্কুল থেকে এসেছে, আর মা তার সামনে খাবার দিয়েছেন। ঠিক এইরকম লুচি আর মিষ্টি মা দেন।

অবশ্য তখন শানু মোটেই খেতে চাইত না। মা তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরতেন। কত সেধে তাকে খাওয়াতেন। আহা মাকে কত জ্বালাতনই করেছে শানু।

তবু পরের হাত থেকে খাবার নিতে তার একটু লজ্জা করে, তাই কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু বটু ততক্ষণে হাত বাড়িয়েছে। যদিও মুখে বলছে, ‘বা: আপনারা তো আমাদের জন্যে ভাগ নিয়ে আসেননি?’

ভদ্রমহিলা স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলেন, ‘গাড়িতে খাবার একটু বেশিই নেওয়া হয়ে যায়, সব সময়ই বাড়ে। খাও খাও। ……নাও খোকা!’

‘খোকা’ও নিয়েই ফেলে।

ইস! লুচি যে এমন ভালো খেতে, একথা কে কবে জানত!

জীবনে কত লুচিই ফেলে দিয়েছে শানু!

খাওয়ার আগে আর কোনো কথাই হয় না। খাওয়ার পর, শানু ভুরু কুঁচকে আস্তে আস্তে বটুকে বলে, ‘তুমি অতসব বাজে কথা বললে যে? মিথ্যুক কোথাকার!’

‘বা: বলি তোর কোন ক্ষতিটা করলাম শুনি যে, গাল পাড়ছিস? এই তো কেমন খাসা খাওয়াটি হল।’

‘হোক! তা বলে মিথ্যে কথা বলবে? আমি তোমার ভাগনে? তুমি সত্যি খাবার কিনছিলে?’

‘আরে বাবা, তাতে হয়েছে কী? আমার যদি একটা দিদি থাকত, তোর মতন একটা ভাগনে হতে পারত না? আর পকেটে পয়সা থাকলে কিনতাম না? ওর সব খাবারগুলোই কিনতাম। ভগবান মেরেছে, তাই—’

শানু ঈষৎ নরম হয়ে গম্ভীরগলায় বলে, ‘তা হোক! মিথ্যে কথা বলতে নেই। আর কখনো বোলোনি।’

‘একবার যদি কিছু টাকা পাই, জীবনেও বলব ভাবছিস? কক্ষনো না। দিব্যি ভদ্র সভ্য সাধু হয়ে যাব।’

আর একবার খবরের কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরে বটু।

শানু বিস্মিত হয়ে বলে, ‘তুমি খালি ওই পচা পুরোনো কাগজটায় কী দেখছ বল তো? কাগজটা দেখছ আর আমার দিকে তাকাচ্ছ। বিচ্ছিরি লাগছে আমার।’

‘বিচ্ছিরি লাগছে?’

বটু ম্লানভাবে বলে, ‘দেখছিলাম একটা জিনিস। যাক আর দেখব না।’

শানু বলে, ‘রাগ করছ কেন? এমনি কীরকম যেন করছ তুমি। নইলে এমনিতে তো তোমায় আমার ভালোই লাগছে, তুমি আমার বন্ধু হয়েছ। যদি তুমি রাজি হও তো আমাদের বাড়িতে নিয়েও যেতে পারি তোমায়।’

‘বাড়ি চিনে যেতে পারবি তুই?’

শানু একটু থতোমতো খায়। এ বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

হাওড়া স্টেশনে যখন এসেছিল বাড়ি থেকে, তখন কে ভেবেছিল রাস্তা চিনে রাখতে হবে? ট্যাক্সি করে চলে এসেছে— সমুদ্র দেখবার আনন্দ নিয়ে। আসলে তার ভরসা পুলিশ আর টিকিট চেকার।

যখন টিকিট নেই, নিশ্চয়ই টিকিট-চেকার পুলিশে দেবে তাকে। পুলিশের কাছে জোর গলায় বাড়ির ঠিকানা আর বাবার নাম বলবে শানু। আর বলবে, ‘চলো, নিয়ে চলো আমায় সেখানে। কত টাকা নেবে নিয়ো।’

এইসবই ভেবে রেখেছে সে।

কিন্তু এখন বটুর প্রশ্নে থতোমতো খায়। তারপর বলে, ‘কেন পারব না? ঠিকানা জানি না বুঝি? ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে দেব—’

‘ট্যাক্সি? ট্যাক্সিভাড়া পাবি কোথায়?’

‘বা: বাড়িতেই তো পৌঁছে যাব। বাড়িতে তো কত টাকা!’

বটু আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘তা যেন হল। কিন্তু বাড়ি গিয়ে যদি দেখিস কেউ বাড়ি নেই? তোর মা-বাবা ওই দিঘায় না কোথায় আছে?’

অ্যাঁ! তাইতো! এ কথা তো কই ভেবে দেখেনি শানু!

শুধু ভাবছে পুলিশ ফুলিশ যার সঙ্গেই হোক ট্যাক্সি করে বাড়ি চলে যাবে আর দরজায় নেমেই চেঁচাবে, ‘মা’ শিগগির ট্যাক্সি ভাড়াটা দিয়ে দাও তো। আর এই পুলিশের হাতে ট্রেন ভাড়াটা তারপর সব বলছি!’

কিন্তু যদি দেখে বাড়ির দরজায় তালা বন্ধ? বুকটা কেঁপে ওঠে শানুর।

তখন যদি পুলিশ তাকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়? আবার তো তাহলে হারিয়ে যাবে শানু! হয়তো জীবনে আর কখনোই নিজেকে খুঁজে পাবে না।

বটু ওর দিকে তীক্ষ্ণ চক্ষু ফেলে তাকিয়েছিল। বলে, ‘তোর বুঝি আর কোনো চেনা বাড়ি নেই?’

‘চেনা বাড়ি! চেনা বাড়ি! কেন থাকবে না? মামার বাড়ি আছে।’

‘ঠিকানা জানিস?’

‘নিশ্চয়!’

‘তবে ঠিক আছে, কিন্তু—’

‘কী হল?’

‘ভাবছি তুই কি আর তখন আমায় চিনতে পারবি?’

‘চিনতে পারব না? বা: বেশ তো এতক্ষণ দেখলাম, বন্ধু করলাম, আর ভুলে যাব? কী ভাবছ তুমি আমায়?’

হঠাৎ বটু ওর হাতটা ধরে বলে, ‘সত্যি যদি বন্ধু ভাবিস, ঠিক তুই আমায় টাকা পাইয়ে দিতে পারিস। অ—নে—ক টাকা।’

শানুর দিদিমা যাবেন ‘হারানো কালী’র মন্দিরে পুজো মানতে। রেলে চেপে যেতে হয়। সেখানে মন্দিরের সামনে একটা বটগাছ আছে। সেই বটগাছের কাছে চুপি চুপি নিজের হারানো জিনিসটির নাম বলে গাছের ডালে একটা ঢিল বেঁধে দিতে হয়। যখন হারানো জিনিস আবার পাওয়া যায়, তখন এসে ঢিল খুলে দিয়ে পুজো-টুজো দিতে হয়।

এসব মন্দিরের খবর শানুর দিদিমা তাঁর মামাতো ননদের খুড়শাশুড়ির ভগ্নীপতির বোনের কাছে পেয়েছেন। তিনি নাকি ওই মানত করে একটা হারানো টিয়াপাখি পেয়েছিলেন। খাঁচা খুলে পালিয়ে গিয়েছিল টিয়াটা, আর ঠিক ওই মানত করার পরদিনই দেখা গেল টিয়াটা বারান্দার রেলিঙে বসে।

দিদিমা বললেন, ‘একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাচ্ছে। এও খাঁচা খুলে পালিয়ে গেছে, তবে পাখি নয়—মানুষ, এই যা।’

শানুর ছোটোমামা মায়ের তোড়জোড় দেখে বলেন, যত্তসব রাবিশ! গাছের ডালে ঢিল বাঁধলে হারানো ছেলে ফিরে আসে—’

দিদিমা রেগে গিয়ে বলেন, ‘আসে না তো ওদের এল কী করে?’

‘ওদের তো পাখি!’

‘পাখি আর মানুষ! একই কথা!’

‘একই কথা? তা ভালো। আসলে কিন্তু পাখিটা উড়তে উড়তে হঠাৎ চেনা জায়গা দেখতে পেয়ে বসেছিল। শানু তো আর উড়তে জানে না?’

‘না জানুক! এই তো টুনি জান-বাড়ি, জ্যোতিষ-বাড়ি, এতসব করল! আমিও না হয়—’

‘করল! ফলটা কী হল? যত্তসব রাবিশ!’

দিদিমা গম্ভীরভাবে বলেন, ‘আর এই যে তোরা কাগজে পুরস্কার ঘোষণা করছিস, গোয়েন্দা পুলিশ লাগিয়ে এত এত পয়সা খরচ করছিস, তাতে কাজ হচ্ছে?’

‘এখনও হয়নি। হবেই, এই আশায় চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

দিদিমা জোর দিয়ে বলেন, ‘আমারও সেই আশা! দেখিই না কী হয়।’

ছোটোমামা মুচকি হেসে বলেন, ‘তা দেখো। তবে এক কাজ করো—ঢিল নয়, সোজাসুজি একখানা থান ইটই বেঁধে দিয়ে এসো।’

‘থান ইট! থান ইট কেন?’ দিদিমা হাঁ করে তাকান।

‘আহা বুঝছ না?’ ছোটোমামা মুখটা বেশ ভারিক্কি করে বলেন, ‘টিয়াপাখির জন্যে একটা ঢিলই যথেষ্ট হতে পারে, কিন্তু মানুষ উড়িয়ে আনতে হলে—’

‘থামো তুমি ছোড়দা,’ শানুর মা কেঁদে উঠে বলেন, ‘শানুর কথা নিয়ে ঠাট্টা করছ তুমি?’

ছোটোমামা তো অপ্রস্তুতের একশেষ! তাড়াতাড়ি বলেন, ‘আহা-হা শানুর কথা নিয়ে কেন? মার সেই মামাতো বোনের খুড়শাশুড়ি নাকি—’

‘ওই হল! শানুর কথা নিয়ে তোমরা কেউ ঠাট্টা করতে পারবে না।’

‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা!’ ছোটোমামা বলেন, ‘তুই কান্না থামা। আরশি দিয়ে কোনোদিন দেখেছিস নিজেকে? কী অবস্থা হয়েছে শরীরের?’

শানুর মা চোখ মুছে বলেন, ‘শানুকে যদি ফিরে না পাই, আমার বেঁচে থেকেই বা কী লাভ?’

‘আহা চমৎকার! আর শানু যখন ফিরে আসবে, তখন মরে পড়ে থাকলেই পরম লাভ, কেমন? ছেলেটা ঘরে ফিরলে, তুই তার যত্ন করবি, না সেতোর সেবা করতে বসবে? তা ছাড়া মরে গেলে তো কথাই নেই। তুই কি এটা চাস, শানু এসে দেখুক মা মরে ফর্সা? বাড়িতে শুধু চাকর বাকরের রাজ্য—’

‘আঃ ছোড়দা!’

‘তা, আঃ করলে আর কী হবে? আমার কাছে সোজা কথা। না খেয়ে খেয়ে আর কেঁদে কেঁদে মরে যাব! যত্তসব রাবিশ! এই তো গেল সপ্তাহ থেকে সমস্ত কাগজে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। যদি কেউ লুকিয়ে রেখে থাকে, সেওই টাকাটির লোভে সুড়সুড় করে ফেরত দিয়ে যাবে।’

‘তবে এত দেরি করলে কেন? সেই গোড়ায়—’ শানুর মা বকে ওঠেন।

ছোটোমামা বলেন, ‘হয়েছিল! এক হাজার টাকা বলা হয়েছিল। দেখা গেল তাতে মাছ টোপ গিলল না। তাই—’

দিদিমা বিরক্তভাবে বলেন, ‘তুই থামবি মোনা? তোর পুলিশেই হোক আর কাগজেই হোক আর আমার মানতেই হোক, ছেলেটা ফিরে এলেই তো হল?’

‘বা:! তুমি কি তোমার ‘হারানো কালী’র মহিমাটি ছাড়বে? ঠিক বলবে—ওই বটগাছে থান ইট বেঁধেই—’

‘ছোড়দা!’ শানুর মা বলেন, ‘বাজে কথা রাখো। ওই কাগজে এই কথাটাও জানিয়ে এসো—ওই পাঁচ হাজারের ওপর এক ছড়া সোনার হারও দেওয়া হবে ছেলেচোরকে।’

‘সোনার হার! সেটা আবার কে দেবে?’

‘আমি দেব। আবার কে? শানুকে ফেরত দিলে শুধু হার কেন, আমার গায়ের সমস্ত গয়না তাকে দিয়ে দিতে পারি। তুমি সেই কথাই লিখে দিয়ে এসো।’

ছোটোমামা মাথা চুলকে বলেন, ‘তা আসছি। কিন্তু ভাবছি—’

‘কী ভাবছ?’

‘ভাবছি বড্ড মিস করে ফেলেছি।’

‘মিস করেছ? কী মিস করেছ?’

‘ভাবছি আহা রে! সময়কালে আমিই কেন ছেলেটাকে চুরি করে সরিয়ে ফেলিনি!’ বলেই বেঁা-বেঁা করে পালান ছোটোমামা।

শানুর ছোটোমামার স্বভাবই ওই।

শত দুঃখের কথা নিয়েও ঠাট্টা তামাশা হাসি! বলেন, ‘সবাই মিলে হাঁড়িমুখ করে বসে থাকলে, কিংবা আকাশ ফাটিয়ে কাঁদলে যদি দুঃখের প্রতিকার হয়, তো ত্রিভুবন ফাটিয়ে কাঁদতে রাজি আছি। কিন্তু তা যখন নয়, খামোকা কেঁদে আর হাঁড়িমুখ করে শরীরটাকে নাজেহাল করি কেন?’

কিন্তু শানুর মা তাঁর ছোড়দার এসব ব্যবহার দু-চক্ষে দেখতে পারেন না। ছেলে হারিয়ে গেছে, মা কাঁদবে না? মানুষ কি পাথর?

‘তুই তা হলে যাবি না টুনু?’ বলেন শানুর দিদিমা!

টুনু অর্থাৎ শানুর মা ম্লানমুখে বলেছিলেন, ‘না:! যদি ঠিক আজই শানু এসে পড়ে!’

শানুর আসার ভাবনায় শানুর মা দু-দিন বাপের বাড়িতেও থাকতে পারছেন না। শানুর দিদিমা তো কত বলছেন, ‘তোর এত মন খারাপ, এত শরীর খারাপ, আমার কাছে এসে থাক।

কিন্তু কী করে থাকবেন শানুর মা?

শানু না এলেও, যদি ঠিক সেইদিনই শানুর চিঠি আসে! যদি পিয়নে জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে যায়, আর বৃষ্টি এসে সেচিঠির লেখা মুছে দিয়ে যায়!

রোদে পৃথিবী ফাটছে, আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, শানুর মা ভাবেন যদি বৃষ্টি আসে!

অগত্যা শানুর দিদিমা একাই গিয়েছিলেন। আর এসে গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয়ানক একটা কথা বললেন। ঢিলটি বেঁধে দিয়ে যেই না তিনি তাঁর সেই মামাতো বোনের সঙ্গে ফিরছেন, হঠাৎ মনে হল একটা চলন্ত রেলগাড়িতে শানু।

‘শানু!

চলন্ত রেলগাড়িতে শানু!

‘কোনদিকের গাড়িতে? হাওড়া থেকে চলে যাওয়ার গাড়ি, না হাওড়ায় ফেরার গাড়ি? সঙ্গে কে ছিলে তার? খুব কি রোগা হয়ে গেছে? তোমাকে চিনতে পারল না? দেখেছ তো ঠিক? সত্যই শানু না আর কেউ?’

শখানেক প্রশ্ন করে বসেন শানুর মা।

শানুর দিদিমা বলেন, ‘রোস বাছা, একে একে বলি। হাওড়া থেকে চলে যাওয়ার গাড়ি নয়, হাওড়ার দিকে আসার গাড়ি। সঙ্গে কে ছিল কী করে জানব? গাড়িতে তো মেলাই লোক। রোগা? রোগা হয়ে গেছে কিনা অত ঝপ করে কি বোঝা যায়? এক্সপ্রেস ট্রেন ছুটে আসছে। আমাকে চেনার কথা বলছিস? আমাকে আবার চিনবে কী? আমি তো উঠি-পড়ি করে ছুটে আসছি কালীপুর লোকাল পাছে ধরতে না পারি। আর সে—’

‘তোমার কালীপুর লোকালই বড়ো হল?’ শানুর মা মাকে প্রায় বকেই ওঠেন, ‘শানুর গাড়িটায় উঠে পড়তে পারলে না?’

‘ওমা শোন কথা!’ শানুর দিদিমা গালে হাত দিয়ে বলেন, ‘সেতো চলন্ত গাড়ি—’

—‘তাতে কী? জানলা দিয়েও তো ঢোকা যায়’—শানুর মা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলেন, ‘আমি হলে তাই ঢুকে পড়তাম। ওগো মা গো, আমি কেন গেলাম না গো! আমি দেখতে পেলে—’

শানুর দিদিমা বিপদ গুনে বলেন, ‘আহা অত উতলা হচ্ছিস কেন? ঠিকই যে শানু, তাও তো নিশ্চিত করে বলতে পাচ্ছি না। মনে হল ঠিক শানুর মতন!’

শানুর ছোটোমামা গম্ভীরমুখে বলেন, ‘ও আর দেখতে হবে না —শানুই। এ হচ্ছে ঢিলের অমোঘ শক্তি? যেমন আকাশে ঘুড়িকে ঢিল লঙ্গর করে নামানো হয়, তেমনি—’

‘ছোড়দা!’

‘আচ্ছা বাবা থামছি, থামছি! যত্তসব রাবিশ!’

শানুর মা আবার নিজের মাকে নিয়ে পড়েন। ‘হাওড়ায় নেমে তুমি কেন খুঁজলে না?’

‘ওমা! সেহল গে আগের গাড়ি। তারপর কত গাড়ি এসেছে গিয়েছে, লক্ষ লোকের ভিড়। সেখানে কোথায় সেই একফোঁট্টা ছেলেটাকে খুঁজতে বসব?’

‘পৃথিবীর সমস্ত লোক ভিড় করে দাঁড়ালেও শানুকে খুঁজে পাওয়া যায়’ শানুর মা বলেন, ‘আমি গেলে পেতাম!’

শানুর বাবা এ বাড়ি থেকে শানুর মাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, শুনে বললেন, ‘এমনও হতে পারে, আপনি ভুলই দেখেছেন। শানুর মতো দেখতে অন্য কোনোও ছেলে—’

শানুর মা কেঁদে ফেলে বলেন, ‘আমার শানুকে অন্য ছেলে করে দিচ্ছ?’

শানুর বাবা হতাশদৃষ্টিতে তাকান।

শেষ পর্যন্ত না মানুষটা পাগল হয়ে যায়! রাতদিন শুধু কান্না। শানুর বাবারই কি কষ্ট হচ্ছে না? কিন্তু কী করবেন? চেষ্টার তো ত্রুটি হচ্ছে না।

পুলিশ তো সেই কোথায় পাঞ্জাব, কোথায় মধ্যপ্রদেশ, কোথায় উত্তর ভারত, চর পাঠাচ্ছে। ওইসব জায়গায় নাকি যত সব ছেলে-চোরের এক একটা আড্ডা আছে। ভদ্রলোকের ছেলেদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে গুন্ডা, পকেটমার, চোর, জোচ্চোর এইসব তৈরি করে।

মাঝে মাঝে শানুর বাবারই কি কান্না পায় না? লুকিয়ে লুকিয়ে কি চোখের জল মোছেন না এক-আধবার? উপায় কী? অফিসেও যেতে হচ্ছে, কাজকর্মও করতে হচ্ছে। সবই হচ্ছে।

এখন মাঝে মাঝে ভেবে ভয়ানক আশ্চয্যি লাগে, চিরকাল ধরে প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে ‘নিরুদ্দেশ’ আর ছেলে হারানোর খবর পড়ে আসছেন, কই কোনোদিনই তো বুঝতে পারেননি সেটা এমন ভয়ানক! খবর না খবর, এই ভেবে পাতা উলটে গেছেন, খেলার খবরে মন দিয়েছেন।

একদিনের জন্যেও তো মনে হয়নি তাদের কাছে গিয়ে খোঁজ করি, সেই হারানো ছেলেটাকে তোমরা পেয়েছে কি না? কিংবা কাগজে ছাপানো হারানো ছেলেমেয়ের ছবিগুলো পকেটে রেখে রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে চোখ ফেলে তো খুঁজে খুঁজে দেখেননি মেলে কি না!

হায় হায়!

সেই অপরাধেই বোধ হয় আজ শানুর বাবার এত কষ্ট। এখন এরমধ্যে শানুর বাবা দু-তিন জায়গায় খোঁজ করেছেন। একজন বিজ্ঞাপনে ফোন নম্বর দিয়েছিল। শানুর বাবা ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সেই ছেলেটাকে পেয়েছেন? যারজন্য কাগজে—’

অদৃশ্য থেকে ভদ্রলোক বলেন, ‘হ্যাঁ পেয়েছি। আপনি কে বলুন তো’?’

‘আমি কেউ না। কী করে পেলেন তাই বলুন।’

সেভদ্রলোক জানিয়ে দিলেন, ‘দুষ্টুমি করে দু-তিনটে বন্ধুতে মিলে দুর্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিল বাড়িতে না বলে।’

আর দু-জন জানিয়েছিল পাওয়া যায়নি। খুব আগ্রহ করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি পেয়েছেন কোনো খবর?’

শানুর বাবা শুধু বলেছিলেন, ‘হায় ভগবান!’

পাঁচ হাজার টাকার লোভে, যারা শানুকে নিয়ে আটকে রেখেছে, দেবে না ফিরিয়ে?—এক একবার ভাবেন শানুর বাবা। আর একবার সেই অগাধ সমুদ্রের কথা মনে পড়ে স্তব্ধ হয়ে যান!

সমুদ্রের তলায় কি গোয়েন্দা পুলিশ হানা দিতে পারে? সেখানে কি খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পৌঁছোয়?

হায়, রূপকথা যদি সত্যি হত! তা হলে হয়তো শানু জলের তলায় এক স্ফটিক পুরীর রাজবাড়িতে আশ্রয় পেত! আর একদিন ঝিনুকের নৌকায় চড়ে হুস করে জলের ওপর উঠে আসত!

মেদিনীপুরের মেলায় শানুর মতো একটা ছেলেকে দেখা গিয়েছিল। কে জানে সেকে! বৃষ্টিতে ভেজা চিঠিখানা শানুর? কে জানে সত্যি না ভুল।

শানুর স্কুল থেকে মাস্টারমশাইরা আসেন খোঁজ নিতে, আসেন পাড়ার লোকেরা। ত্রিজগতে যতরকম ছেলে হারানোর ঘটনা তাঁদের জানা আছে, তার বিবরণ দিতে থাকেন, আর শানুর বাবা বসে থাকেন পাথরের পুতুলের মতো।

কিন্তু হঠাৎ আবার এক নতুন চাঞ্চল্য আনলেন, শানুর দিদিমা। ছুটন্ত রেলগাড়িতে নাকি দেখেছেন শানুকে। সেই জ্যোতিষীমশাইও কিন্তু বলেছিলেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন শানু রেলে বসে আছে। সেতো অনেক দিনের কথা! একমাস ধরে শানু রেলেই বেড়াচ্ছে?

ধ্যেৎ সব বাজে! জ্যোতিষীও বাজে ধাপ্পা দিয়েছেন। শানুর দিদিমাও ভুল দেখেছেন। শানু সেই দিঘার সমুদ্রে—

ওদিকে বটু আর শানুর কথাবার্তা চলছে। বটু বলল, ‘এই হচ্ছে ব্যাপার! এখন তুই যদি আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে নিজে নিজে বাড়ি চলে যাস, আমার কিছু করবার নেই—শুধু ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। তবে যদি ওই যা বললাম, তাতে রাজি থাকিস—’

শানু ভুরু কুঁচকে দাঁত কামড়ে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে তারপর প্রশ্ন করে ‘তাতে মা-বাবাকে ঠকানো হবে না?’

‘কেন? ঠকানো কীসের? ওঁরা তো তোর জন্যে খরচ করতেই চান।’

‘বেশ! তুমি যা বলছ, তাই হবে।’

‘ইস! কী লক্ষ্মী ছেলে! বাঁচলাম তোর কথা শুনে। ভাবছিলাম তুই হয়তো রাজি হবি না—হয়তো ছিটকে পালিয়ে গিয়ে—’

শানু গম্ভীরভাবে বলে, ‘না তা করব না। তুমি যে বলেছ অনেক টাকা পেলে তুমি আর মিথ্যে কথা বলবে না।’

‘সেতো এখনও বলছি! মিথ্যে কথা বলা, ধাপ্পা দেওয়া, এসব কি আমার সাধ? নেহাত তখন পেটের জ্বালায়—তা ছাড়া তোকে আমার ঠিক নিজের ভাগনে বলেই মনে হচ্ছে রে শানু! ইচ্ছে হচ্ছে তোকে আমার কাচের বাসনের দোকানের শাকরেদ করে নিই। তোতে আর আমাতে বড়োবাজারে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সুন্দর সুন্দর সব বাসন কিনব—

শানু হঠাৎ বলে ওঠে, ‘তাহলে ডিংলাইকেও নিতে হবে।’

বটু শুনতে না পেয়ে থতোমতো খেয়ে বলে, ‘কাকে নিতে হবে?’

‘আমার একজন বন্ধুকে!’ দৃঢ়গলায় বলে শানু।

‘নাম কী বললি বন্ধুর?’

‘ডিংলাই—ডাকনাম। ভালো নাম নারায়ণ।’

‘বটু হেসে উঠে বলে, ‘ডাকনামটি বড়ো খাসা! থাকে কোথায় সে? তোদের পাড়ায়?’

‘পাগলের মতো কথা বোলো না। সেতো দিঘায় থাকত। তারপর বাড়ি ভেঙে উঠে গিয়ে মেলায় চলে এল। ওর কথা ভেবে মন কেমন করছে।’

বটু অবাক হয়ে বলে, ‘তোর এ কথাগুলো তো মোটেই সহজ লাগছে না। কেমন যেন গোলমেলে। বাড়ি ভেঙে চলে যাওয়া মানে?’

শানু বিরক্তস্বরে বলে, ‘মানে আবার কী? ওদের ওইরকমই নিয়ম। ওরা যে কাকমারা!’

‘কাকমারা!’

‘হ্যাঁ’। বটু এ নাম ওর জন্মেও শোনেনি।

শানু আরও রেগে উঠে বলে, ‘তুমি যে একেবারে অবাক হয়ে গেলে? কাকমারা জান না?’

শানু নিজেও যে মোটেই জানত না, আর শানুর মা-বাবা-দিদিমা মামারা যে যেখানে আছে, কেউ জানে কি না সন্দেহ, সেকথা মনে পড়ে না শানুর। শানু বটুর বোকামিতে চটে ওঠে।

বটু কিন্তু হেসেই অস্থির।

‘না বাপু জানি না। কী করে তারা? কাক মারে?’

‘মারেই তো!’

‘মেরে কী করে? খায়?’

‘খায়ই তো!’

‘ওঃ মা:! আর সেতোর বন্ধু? ছি ছি!’

বন্ধুর নিন্দেয় আগুন হয়ে উঠে শানু বলে, ‘ছি ছি বলবার কী আছে? লোকে বাঘ মারে না? সিংহ মারে না?’

‘মারে তার কী? খায় না তো? সেতো শিকার।’

‘ইস ভারি তর্ক শিখেছ। আর মাছ মারাটা কী? মাছ মারা, মুরগি মারা, হাঁস মারা, পাখি মারা—’

‘ওসব তো মানুষের খাবার জিনিস। কাক কি খাবার জিনিস?’

‘তা কে বলেছে মানুষের ওসব খাবার জিনিস?’ শানু রেগে আরও আগুন হয়ে বলে, ‘ভগবান বুঝি মানুষকে পৃথিবীতে পাঠাবার সময় বলে দিয়েছেন, ওইসব খাবার জিনিস, আর কাক খাবার জিনিস নয়! চিনারা তো আরশোলা খায়, ব্যাং খায়—’

‘ঘাট হয়েছে বাবা! আর তর্ক করব না। মানছি তোর বন্ধু খুব ভালো। কিন্তু তুই এত রাগি কেন বল তো? বাব-বা:!’

শানু এবার একটু লজ্জিত হয়ে বলে, ‘বা: তুমি তো রাগিয়ে দিলে! বন্ধুকে বিচ্ছিরি বললে বুঝি রাগ হয় না?’

‘আর বলব না। কিন্তু তাকে পাচ্ছিস কোথায়? বলছিস তো বাড়ি ভেঙে চলে গেছে।’

শানু বিষণ্ণমুখে বলে, ‘সেই তো! কে জানে আর কক্ষনো দেখতে পাব কি না।’

কিছুক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ থাকে। তারপর বটু আস্তে আস্তে বলে, ‘আমি চেষ্টা করব তোর বন্ধুকে খুঁজে বার করতে।’

‘না—থাক।’

‘কেন রে, থাক কেন?’

‘তাকে দেখলে হয়তো তোমরা হাসবে। আমি বড়ো হয়ে খুঁজে বার করব।’

এরপর আর কথা বেশি জমল না।

শুধু বটু পকেট থেকে কাগজ পেনসিল বার করে শানুদের বাড়ির আর মামার বাড়ির ঠিকানাটা লিখে নিল।

কিন্তু, এ কী, গাড়ি যে হাওড়াতে এসেই গেল, টিকিট-চেকার কই?

চেকার উঠলই না শানুদের কামরায়।

বটু বলে, ‘তুই বেশ পয়মন্ত। নইলে ওই চেকার উঠে আমায় কম নাজেহাল করত!’

নেমে পড়ল ওরা। কলকাতায়। সেই হাওড়া স্টেশন— যেখান থেকে শানু মার সঙ্গে বাবার সঙ্গে রাজপুত্তুরের মতো আদরে দিঘায় যাওয়ার জন্যে ট্রেনে চড়েছিল।

কী আশ্চর্য! সব ঠিক তেমনি আছে! একেবারে অবিকল! শানু যে কোন অজানা রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে কী না কান্ড করে এল—কিছুই জানল না এরা! কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!

‘বটুদা! শিগগির একটা ট্যাক্সি নাও।’ বলে শানু।

‘নিচ্ছি রে বাপু, নিচ্ছি।’

‘বটুদা, আমি আর এক মিনিটও দেরি সইতে পারছি না!’

বটু বলে, ‘রোস, একজন বাঙালি ড্রাইভারের গাড়ি নিই। ওই দাড়িওলা পাঁইজিদের দেখলেই আমার কেমন ভয় ভয় করে।’

‘আরে ভয় কী? হেসে ওঠে শানু।

‘তা হোক। বাঙালিই দেখি।’

কিন্তু হায়! কে জানত এই বাঙালি দেখাই কাল হবে বটুর!

১০

ড্রাইভার ওদের দিকে একবার বেশ ভালো করে তাকিয়ে বলল, কোথায় যাবেন? বলল শানুর দিকেই তাকিয়ে।

শানুকে ‘আপনি’ বলায় পুলকিত শানু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘কেয়াতলা’। সতেরোর সি ‘কেয়া—’

সঙ্গে সঙ্গে বটু করুণভাবে বলে, ‘সেকীরে, কলকাতার মাটিতে পা দিয়েই সব প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলি?’

শানুর মনে পড়ে যায়। লজ্জিতমুখে বলে, ‘ইস! একদম ভুলে গেছি। না না, কেয়াতলা নয়, এখন আমরা ইয়েতে—কোথায়? মানে কোথায় যাচ্ছি?’

‘চালতাবাগান! চালতাবাগান ফার্স্ট লেন।’

ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আত্মীয়তার সুরে বলে, ‘কোথা থেকে আসছেন?’

‘খড়গপুর থেকে।’—তাড়াতাড়ি বলে ওঠে শানু।

কলকাতায় পা দিয়ে তার বুকের মধ্যে এত তোলপাড় করছে যে, চুপ করে থাকতে পারছে না। বটুই যেন কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। অথচ বটু এ পর্যন্ত শেখাতে শেখাতে এল তাকে, ‘তুই চুপচাপ থাকবি, যাকে যা বলবার আমি বলব।’

ড্রাইভার খানিকটা চালিয়ে আরও অমায়িকভাবে বলে, ‘বেড়াতে গিয়েছিলেন?’

এবার বটুই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ। পিসির বাড়ি।’

‘ওঃ! দুই ভাই বুঝি?’

ড্রাইভারের এই আত্মীয়তায় শানু খুশি হলেও বটু হয় না। সেমনে মনে প্রমাদ গোনে। চুপচাপ চল না বাবা, বেশি কথায় কাজ কী!—এই তার মনোভাব। তবু কথার উত্তর না দেওয়াটা সন্দেহজনক। তাই শুধু বলে, ‘হ্যাঁ’।

কিন্তু ততক্ষণে শানু ছিটকে উঠেছে—‘এ কী! নিজে বলে নিজেই ভুলে মেরে দিচ্ছ? কী ঠিক হয়েছিল? মামা আর ভাগনে না? আমি মামা—না না, ইনি মামা আমি ভাগনে। …ড্রাইভার, এ হচ্ছে আমার মামা, আমি ভাগনে, বুঝতে পেরেছ?’

ড্রাইভার মৃদু হেসে বলে, ‘পেরেছি’। বলে এবং গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়।

ওদিকে বটু ফিসফিসিয়ে বলে, ‘অত কথা কইছিস কেন? মনে হচ্ছে লোকটা সুবিধের নয়।’

‘ধ্যেৎ! বেশ ভালো, বাবুর মতন দেখতে।’

‘সেটাই অসুবিধের। পাঁইজির গাড়ি নিলেই হত!’

ড্রাইভার যদি ওদের কথায় মন না দিত, তা হলে এই চুপি চুপি কথা শুনতে পেত না। কিন্তু কেন কে জানে সেওদের কথায় মন-প্রাণ-কান সব দিচ্ছে, কাজেই শুনতে পাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে, যখন রাস্তায় আলোর নির্দেশে গাড়ি থামিয়ে থাকছে, তখন বুকপকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবুকের মাঝখানটা খুলে খুব সন্তর্পণে কী যেন দেখছে।

‘লোকটা নোটবুক খুলে ছবির মতন কী যেন দেখছে রে?’— বটু বলে আস্তে।

শানু সবজান্তার ভঙ্গিতে বলে, ‘বোধ হয় লাইসেন্স।’

‘খালি খালি দেখবে কেন?’

‘বোধ হয় নম্বর ভুলে গেছে।’

বটুর কিন্তু ভালো লাগে না। সেএকমনে ড্রাইভারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। আর সেএক মনে গাড়ি চালিয়ে চলে।

হঠাৎ এক সময় বটু যে চমকে উঠে ড্রাইভারকে বলে, ‘কোনদিকে যাচ্ছেন আপনি?’

‘কেন! যেখানে বলেছেন।’

‘কিন্তু রাস্তাটা এত অচেনা অচেনা লাগছে কেন? চালতাবাগান তো ভবানীপুর। এটা কি ভবানীপুরের দিকে যাচ্ছে?’

ড্রাইভার চমকে উঠেছে, এইভাবে বলে, ভবানীপুরে? বলেন কী? বরানগরে একটা চালতাবাগান আছে না?’

বটু বিচলিতভাবে বলে, ‘থাকতে পারে। শুধু চালতাবাগান কেন, আমবাগান, কাঁঠালবাগান, কচুবাগান, কলাবাগান সব কিছু থাকতে পারে। কিন্তু আমার দরকার ভবানীপুরে। এ কি আপনি বরানগরের দিকে যাচ্ছেন নাকি?’

‘আপাতত!’

‘আপাতত!’ তার মানে?’

‘মানে, আর কিছু নয়। একদিকে আমার বাসা। আবার ভবানীপুরের দিকে যেতে হলে তো টাইম লাগবে। আমি বাসায় একটা কথা বলে যাব।’

‘না না, তোমার এখন বাসায় টাসায় যাওয়া হবে না।’

উত্তেজনার চোটে বটু ভদ্রতা ভুলে ‘তুমিই শুরু করে দেয়, আগে আমাদের পৌঁছে দিয়ে এসো। তুমি এদিকে এলে কেন? যাব দক্ষিণে, তুমি নিয়ে এলে উত্তুরে। এর মানে।’

ড্রাইভারের চটে ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু যতদূর সম্ভব নরমগলায় বলে, ‘তা আপনারাও তো আগে বললেন না। যাক নিয়ে তো যাচ্ছি। শুধু বাসায় একবার, মানে আমার মায়ের খুব অসুখ, ডাক্তারকে আসতে বলেছিলাম, এসেছে কিনা তাই দেখে যাব।’

বটু চটে উঠে বলে, ‘দরকারের সময় অমন অনেক ‘মায়ের অসুখ’ গজায়। ‘মায়ের অসুখ’ যে কী জিনিস, আমার আর জানতে বাকি নেই। ওসব হবে না। বেশ তুমি তোমার এই পর্যন্তর ভাড়া মিটিয়ে নাও, আমরা অন্য গাড়ি—’

ব্যস! বটুর তড়পানির মূলে কুঠারাঘাত করে শানু বলে ওঠে, ‘ভাড়া কোথা থেকে দেবে শুনি? পকেট তো গড়ের মাঠ। বাড়ি না পৌঁছোলে—’

বটুর হাতের একটা প্রবল চিমটিতে চুপ করে যেতে হয় শানুকে।

আর ড্রাইভার বেশ একটু দুষ্টুহাসি হেসে গাড়ির স্পিডটা আরও বাড়িয়ে দেয়।

‘এই এই এত জোর চালাচ্ছ কেন?’ বটু চেঁচায়।

ড্রাইভার একবার ওদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘এত ভয় পাচ্ছেন কেন? সঙ্গে অনেক টাকা আছে বলে তো মনে হল না। গায়ে গয়না নেই। আশ্চর্য তো! তাড়াতাড়ি খবরটা দিয়েই ফিরব বলে—’

বলতে বলতে সেএদিক সেদিক ঘুরিয়ে একটা পচা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। অতিকষ্টে গাড়িটা ঢোকে সেখানে, এখানে এসে গাড়ি থামায় সে।

‘ভীরু’ বলে উপহাস করায় শানুর হয়ে গিয়েছে রাগ। তাই চড়াগলায় বলে ওঠে, ‘এখানে ঢুকলে যে? এইখানে তোমার বাড়ি নাকি?’

‘তা গরিবের বাড়ি কি আর চৌরঙ্গিতে হবে?’ বলে, ড্রাইভার নেমে পড়ে এবং গলির মধ্যেই একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ে।

বটু বলে, ‘এই শোন। মনে হচ্ছে লোকটার মতলব ভালো নয়।’

শানু অবাক হয়ে বলে, ‘কেন? খারাপের কী দেখলে তুমি? ওর মার অসুখ করেছে, ও দেখবে না ডাক্তার এল কি না?’

‘ওসব অসুখ টসুখ মিথ্যে কথা।’

‘মিথ্যে কথা!’ শানু উত্তেজিতভাবে বলে, ‘মিথ্যে করে কেউ বলতে পারে মায়ের অসুখ? তুমি পাগল নাকি?’

‘তুই জগতের কী-ই বা দেখেছিস? ওরকম বলে অনেকে। আমি বলছি এখানে বসে থাকলে বিপদ হবে। চল নেমে পড়ে পালাই।’

বটু নেমে পড়ে।

নেমে পড়ে একেবারে রাস্তার পাশে জড়ো-করা জঞ্জালের ওপর।

‘এঃ ছি ছি! কী নোংরা। এখানে পা দেব কী করে?’

শানু নাক সিঁটকে ওঠে।

কিন্তু ততক্ষণে বটু উঠেছে ভীষণ রেগে। সবলে ওর একটা হাত ধরে টান মেরে বলে, ‘তুই আসবি কি না? নোংরা! এঃ ভারি পুরুতঠাকুর এসেছে! চল বলছি শিগগির—’

অগত্যাই শানু নেমে পড়ে।

ঠিক সেইমুহূর্তে ড্রাইভার এসে পড়ে এবং ব্যাপারটা বুঝে ফেলেই ওদের যাওয়ার পথ আটকে চিৎকার করে ওঠে, ‘চোর চোর।’

সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটে সেবোধ করি আর বলতে হবে না।

‘চোর চোর’ শুনলেই যা হয়।

যেন মাটি ফুঁড়ে লোক উঠে শানুকে আর বটুকে ঘিরে ধরে ‘কী! কী ব্যাপার?’ বলে ড্রাইভারের দিকে তাকায়। তার হচ্ছে চেনা পাড়া।

ড্রাইভার বোঝায়’ ‘ব্যাপার আর কিছুই না। বাছাধনদের ট্যাঁকে নেই পয়সা, এদিকে ট্যাক্সি চড়ার শখ। এই এতক্ষণ গাড়ি চড়ে সাড়ে চার টাকা মিটার উঠিয়ে কেটে পড়তে যাচ্ছিলেন।’

‘এ্যাঁ! এইটুকু ছেলে, তাদের মধ্যে এত চালাকি!’

‘ওইরকমই দিনকাল পড়েছে ভাই। যাক পুলিশে দিয়ে কোনো লাভ নেই, খালি নিজেরাই হাঙ্গামায় পড়া। একটি বেলা উপোস দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখাই হচ্ছে বেস্ট। তোমরা একটু সাহায্য করো তো, একবার আমার ওই ঘরটায় পুরে ফেলি।’

ভারি যেন মজার কথা। এইভাবে হি হি করে হাসতে হাসতে ওরা ঠেলাঠেলি করে বটুকে আর শানুকে সেই বিচ্ছিরি বাড়িটার একটা ঘরে পুরে ফেলে।

শানু যতই হাত-পা ছোড়ে, ‘আঃ ছেড়ে দাও’ বলে, কে শোনে কার কথা! বরং সবাই আরও হাসে আর বলে, ‘গাড়ি চড়ার বাসনা মিটে যাক।’

ওদের দু-জনকে ঘরের মধ্যে পুরে বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দিয়ে হাসাহাসি করতে করতে চলে যায় ওরা। একজন আবার বলে, ‘তুমি বারণ করলে রবিদা। নইলে দিতাম একবার দাদুদের মামার বাড়ি দেখিয়ে।’

‘এই না না থাক। থাকুক খানিক জব্দ হয়ে, তারপর ছেড়ে দেব।’ বলে ড্রাইভারটা হেসে চলে যায়।

ভ্যাপসা-ভ্যাপসা ঘরের মধ্যে শুধু বটু আর শানু।

একটা চৌকিতে বিছানা পাতা, দেয়ালে একটা জানালা। এদিকে ওদিকে দু-একটা টুকিটাকি। বোঝা গেল, এইটাই লোকটার ঘর।

বটু বিছানাটা তালগোল পাকিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে চৌকির ওপর বসে পড়ে বলে, দেখলি? বলেছিলাম কিনা ‘লোকটার মতলব ভালো নয়?’

শানু এই এত দুঃখের পর, এত ঢেউ পার হয়ে কলকাতায় এসে পড়ে, আবার এভাবে জব্দ হয়ে যাওয়ায় একেবারে ভেঙে খান-খান হয়ে যাচ্ছিল। তবু বটুর কথায় সজোরে বলে, ‘তুমি পালাতে গেলে কেন? তাই তো ওর রাগ হল। যদি না পালাতে, ও কক্ষনো আটকে রাখত না।’

ভারি বুঝিস তুই! গোড়া থেকেই ও কীরকম যেন করছিল দেখছিলি না? আমার মনে হচ্ছে অন্য ব্যাপার।’

‘কী ব্যাপার?’

‘ও লোকটাও নিশ্চয় কাগজের বিজ্ঞাপন দেখেছে। তোকে ভাঙিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পেতে চায়!’

‘ভাঙাবে মানে? আমি কি নোট?’

‘হ্যাঁ রে বাবা, তুই এখন মস্ত দামি ব্যাংকনোট।’

‘তুমি যদি আগেই কেয়াতলায় যেতে, কক্ষনো এমন হত না।’ বলেই হঠাৎ কেঁদে ফেলে শানু। অনেক সহ্য করেছে বেচারা আর পারে না।

এ যে একেবারে কুলে এসে তরি ডোবা।

বটু নিজের মাথায় একটা কিল মেরে বলে, ‘সবই আমার কপাল, বুঝলি? হতভাগার কপাল। এ কপালে পাঁচ হাজার টাকা সয় কখনো? এ যেন কাকের সংগ্রহ করা মাংসের টুকরো। চিলে ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল।’

শানু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ‘ও যখন আমাকে নিয়ে যাবে, আমি বাবাকে বলব, কক্ষনো ওকে টাকা দিয়ো না।’

‘ও কি আর তোকে নিয়ে যাবে ভেবেছিস?’

‘নিয়ে যাবে না?’

‘না:! মনে হচ্ছে অন্য কৌশল করবে।’

শানু ভাবে, কী আশ্চয্যি! শানুকে নিয়েই বা সবাইয়ের এত কৌশলের ইচ্ছে কেন? হারিয়ে যাওয়া শানু ঠিকই খুঁজে খুঁজে হেঁটে হেঁটে রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে নিজেকে মার কাছে পৌঁছে যেতে পারত! দিঘার সেই সমুদ্রতীর থেকেই পারত। কিন্তু শানুর ওপরই সবাইয়ের নজর!

কেনই যে এ নজর! বটুর অনুমান কি সত্যি?

এ লোকটা কি আর আসবে?

না শানুদের এই ঘরের মধ্যেই বন্দি করে রেখে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলবে?

কিন্তু শানুরা কীই বা এত দোষ করেছে ওর কাছে?

না: বটুর কথাই ঠিক। প্রথম থেকেই ওর মতলব খারাপ। নইলে ভুল দিকে নিয়ে আসছিল কেন? শানুরা তো কত ট্যাক্সি চড়েছে, কই কখনো তো দেখেনি, ট্যাক্সিওলা নিজের বাড়িতে এসে ঢোকে মার অসুখ বলে!

বটু চোখের উপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। কোনো কথা বলছে না। দেখে ভারি মন কেমন করে শানুর।

ও কেয়াতলায় যেতে দেয়নি বলে যে রাগ হচ্ছিল সেটা চলে যায়। ভাবে, আহা বেচারি! কাচের বাসনের দোকান করা ওর আর হল না!

কিন্তু শানু কি পারবে না ওর ভালো করতে? হায় ভগবান!

কী না পারত শানু! সবই পারত যদি একটি বারের জন্যে বাবার সঙ্গে মার সঙ্গে, কী নিদেন পক্ষে ছোটোমামার সঙ্গেও দেখা হত!

আস্তে ডাকে শানু, এই তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?

‘না রাগের কী আছে? আর করিয়ো যদি তো, তোর ওপর করব কেন? করছি আমার ভাগ্যের ওপর।’

‘আচ্ছা ও কি আমাদের না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে চায়?’

‘তোকে চাইবে না। আমাকে চাইতে পারে।’ বলে পাশ ফিরল বটু।

শানু মনে মনে ভাবতে লাগল ডিংলাইয়ের দিদিমা আর মামাদের কবল থেকে ছাড়ান পেলাম, সাধন কুন্ডুর কাছ থেকে ছাড়ান পেলাম, আর কলকাতায় এসে এই দুষ্টু লোকটার কবলে মরে যাব? ভাবতে ভাবতে সেও গুটিশুটি হয়ে বটুর পাশে চৌকিতে শুয়ে পড়ল।

আর কেমন একটু তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়ল—খিদেয় তেষ্টায় কাতরতায়।

একটু পরে ঘুম ভেঙে গেল ঠক-ঠক শব্দে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে হাঁ করে তাকিয়ে রইল দু-জনেই, কোথায় আছে, কেন আছে বুঝতে সময় লাগল।

ততক্ষণে সেই ড্রাইভার, রবি যার নাম, সেজানালার শিকের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে দু-গেলাস চা।

‘বলি শুনছ হে খোকারা, একটু গলা ভিজিয়ে নাও।’

বটু তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে চা-টা নেয়, কিন্তু নিয়েই বলে, ‘কী দাদা, বিষ-মিশ্রিত চা? যাতে এক মিনিটেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়?’

লোকটা হা হা করে হেসে উঠে বলে, ‘না:! সেশখ নেই। দু-দুটো লাশ পাচার করাও শক্ত। একটা কাজ করিয়ে নিতে চাই। তারপর ছেড়ে দেব।’

‘কাজ? কী কাজ?’

‘বলছি। আগে একটু খেয়ে দেয়ে ঠাণ্ডা হও।’

বলে সেহাত গলিয়ে দু-খানা কেক আর দুটো সন্দেশ বাড়িয়ে ধরে।

‘তোমার জিনিস আমরা খাব না।’ শানু তীব্রস্বরে বলে।

বটু গম্ভীরভাবে দুটো কেক আর দুটো সন্দেশই নিয়ে খেতে শুরু করে দিয়ে বলে, ‘ওকে আর কিছু দাও। আমার তো এটুকু নস্যি।’

‘আরে। আরে! তুমি সব খেয়ে নিলে?’ লোকটা হেসে ফেলে, আবার কিছু নিয়ে এসে বলে, ‘নাও খোকা, তুমি খেয়ে ফেলো। নচেৎ তোমার এই রাক্ষস বন্ধুটি সব খেয়ে ফেলবে। খাও। তারপর এই নাও কাগজ আর কলম। একটা চিঠি লিখে ফেলো।’

‘চিঠি? কার চিঠি? কীসের চিঠি?’

‘আহা আস্তে। সবুরে মেওয়া ফলে। আমি এদিক থেকে বলে দেব, তুমি লিখে ফেলবে।’

‘তোমার কথা আমি শুনব না।’

‘তা হলে এই ঘরে চিরকাল বন্দি।’ লোকটা মৃদু হাসতে থাকে।

‘বেশ বন্দি তো বন্দি।’

‘ভালো! ভুল করলাম খেতে দিয়ে। পেট কাঁদলেই আপনিই কথা শুনবে।’

বটু বলে, ‘কী লিখতে হবে?’

‘তোমাকে নয়। শুধু একে। এই নাও—ধর না কাগজ-কলম। লেখো—

বাবা, আমি কলকাতায় এসেছি। এসেই একটু অসুবিধেয় পড়ে গেছি। তুমি এই পত্রবাহকের হাতে, তোমার ঘোষণামত পাঁচ হাজার টাকা অবিলম্বে দিয়ে দেবে। তা হলেই ইনি আমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু একটি কথা, তুমি যেন চালাকি করে আবার পুলিশ-টুলিশ ডেকে এনো না। তা হলে আমারই বিপদ আছে। টাকা দিলেই ইনি আমাকে খুব যত্ন করে পৌঁছে দেবেন।

 ইতি—তোমাদের শান্তনু

শানু চমকে ওঠে। ‘কে বললে আমার নাম শান্তনু?’

‘জানি। সব জানতে হয়। দেখ লিখবে তো?’

‘লিখতে পারি, যদি সত্যি পৌঁছে দাও।’

‘আরে দেব বলেই তো এত ব্যবস্থা!’

‘তুমি বাবার চেনা নয়, বাবা টাকা দেবেন কেন?’

‘দেবেন দেবেন। তুমি লেখ না।’

শানু বটুর দিকে তাকায়।

বটু অগ্রাহ্যভাবে বলে, দে লিখে। যা হয় হোক।’

শানু কাগজটা আর কলমটা টেনে লিখতে শুরু করে—

‘শ্রীচরণেষু,

বাবা! আমি অনেক কষ্ট করে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি—’

১১

‘টু! টু!’

শানু আর বটু চমকে উঠল এই ‘টু টু’ শুনে! তাকিয়ে দেখল জানলায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে ‘টু’ করছে। জানলা পর্যন্ত তার চোখ পৌঁছোবার কথা নয়! বোধ হয় উঁচু পিঁড়ির ওপর উঠেছে।

বটু বলে উঠল, ‘তুই কে রে?’

মেয়েটা হি-হি করে হেসে বলল, ‘তুই কে রে?’

‘আমরা মানুষ।’

‘আমি খুকু।’

শানু একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেয়ে যেন বর্তে গিয়ে বলে, ‘তুই বুঝি এদের বাড়ির খুকু?’

‘ধ্যেৎ বোকা। এটা তো রবি কাকাদের বাড়ি।’

‘তবে তোদের বাড়ি কোথায়?’

‘ওই ওইখানে।’

কোনখানে তা অবশ্য বোঝা গেল না। তবু একটা ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি কথা ওদের যেন প্রাণটা ঠাণ্ডা করে দিল।

শানু বলল, ‘আমাদের সঙ্গে খেলবি?’

‘কী করে?’ মেয়েটা চোখ গুলি করে বলে, ‘তোমাদের ঘর তো বন্ধ করে রেখেছ। দরজাটা খুলে দাও তাহলে।’

‘বা:রে আমরা কীকরে খুলব? দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ। তোর ওই রবিকাকা না কে, সেতো আমাদের বন্দি করে রেখেছে!’

‘বন্দি করে রেখেছে তোমাদের?’

মেয়েটা জানালা থেকে নেমে দরজার দিকে চলে যায়। দেখতে পায় দরজার কড়ায় তালা ঝুলছে। আবার জানলায় এসে বলে, ‘কেন বন্দি করে রেখেছে গো? তোমরা বুঝি চোর?’

‘মোটেই না।’ শানু সতেজে বলে, ‘ওই তোর ওই রবিকাকাই চোর। আমাদের চুরি করে এনে বন্দি করে রেখেছে।’

মেয়েটা আর একবার হি-হি করে হেসে বলে, ‘মানুষকে বুঝি চুরি করা যায়? মানুষ বুঝি টাকাপয়সা?’

‘তাই তো দেখছি’—বটু বলে, ‘তোকেও একদিন নিয়ে যেতে পারে।’

‘ইঃ! আমার মা কাঁদবে না?’

শানু মাথা নেড়ে ছলছল চোখে বলে, ‘মায়েরা তো কাঁদবেই! আমার মাও তো কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন।’

‘তা তুমি চলে যাচ্ছ না কেন? বোকা বুদ্ধু! তোমার মা কাঁদছে, তোমার মনে দুঃখু হয় না?’

‘কী করে যাব শুনি?’ শানু রেগে ওঠে, ‘তুইও একটা বুদ্ধু গাধা ভূত। বললাম না আমরা বন্দি হয়ে আছি।’

মেয়েটার চোখে হঠাৎ যেন একটা আলো খেলে যায়! বলে, ‘আমি খুলে দেব দরজা?’

‘তোর ভারি সাধ্যি, পুঁচকে চড়াই। তালায় তোর হাত যাবে?’

‘টুলে উঠে হাত দেব।’

‘হুঁ:! তার মানে পড়ে হাত পা ভাঙবি।’

ইস! ভাঙব বই কী। একদিন বুঝি আমি টুলে ওঠে ভাঁড়ার ঘরের তালা খুলিনি? একদিন মা না, আমাকে না বামুনদির কাছে কাছে ফেলে রেখে না,—মেয়েটা হি-হি করে হেসে ওঠে, ‘মামার বাড়ি চলে গিয়েছিল। আর বামুনদি না ঘুম লাগিয়েছিল। আমি তখন ভাঁড়ার ঘরের তালা খুলে আমের মোরব্বা আর কিশমিশের আচার—হি হি হি! আবার বলে কিনা পড়ে পা ভাঙব।’

হঠাৎ বটুর মনে একটা আশার সঞ্চার হয়। ব্যগ্র হয়ে বলে, ‘বা:রে তুই তো তাহলে খুব ওস্তাদ মেয়ে! তা দে না আমাদের দরজাটা খুলে।’

‘আচ্ছা চাবি আনছি—’ বলে মেয়েটা জানলার কাছ থেকে নামে।

‘এই এই শোন—’ বটু বলে, ‘চাবি কোথায় পাবি?’

‘আমাদের বাড়িতে অনেক চাবি আছে। মা-বাবার বামুনদির’— ছুট দিতে যায়।

বটু আবার ডাকে। জানলার কাছে এসে চুপি চুপি বলে, ‘সেচাবিতে হবে না! তোর রবি-কাকার চাবি কোথায় আছে তা জানিস?’

‘হুঁ’-উ-উ! ওই তো রবিকাকার বালিশের তলায়।’

‘সেই চাবি নিয়ে আয়, বুঝলি!’

‘আচ্ছা।’ বলে মেয়েটা হাওয়া হয়।

অনেকক্ষণ আর পাত্তা পাওয়া যায় না মেয়েটার। বটু বলে, ‘মেয়েটা পাজির পাঝাড়া। মিছিমিছি করে আমাদের ভুলিয়ে পালিয়ে গেল।’

শানু দুঃখিত হয়। বলে—‘অমন সুন্দর ছোট্ট মেয়ে কখনও পাজি হয়? ও নিশ্চয় চাবি খুঁজে পাচ্ছে না।’

‘চাবি খুঁজতে খুঁজতে যম এসে যাবে।’

যম মানে অবশ্যই সেই ড্রাইভার। যে নাকি নেহাতই অনেকগুলো টাকার লোভে এদের আটকে ফেলেছিল। সেতখন সেই চিঠি হাতে করে গিয়েছে শানুদের বাড়ি!

সেও বোকারাম।

এ বুদ্ধি নেই, ছেলে চক্ষে না দেখে কেউ টাকা দেয়? অথচ ও ভাবছে ‘আমি বাবা খুব চালাক। ছেলে পেয়ে যদি আর টাকাকড়ি না দেয়, তার থেকে আগেই টাকাটা নিয়ে নিই।

যে যার নিজের কথা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। এদিকে কষ্ট শুধু শানুদের।

বটু বলে, নির্বুদ্ধির দশা ধরেছিল আমার, তাই টাকার আশায় তোর সঙ্গ ধরেছিলাম। আমার ভাগ্যে আবার টাকা! জন্মের হতভাগা আমি। বাড়ার ভাগ এখন কপালে হাজার কষ্ট।’

শানু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বসে থাকে।

হঠাৎ সেই মেয়েটা ছুটে এসে হাজির। হাতে একটা দড়িতে বাঁধা চাবি। সেটা হাতে ঝুলিয়ে বলে, ‘এই যে চাবি। উঃ এমন লুকিয়ে রেখেছিল রবিকাকা! খুঁজেই পাই না। রোসো এইবার দিচ্ছি খুলে।’

তারপর শানুরা একটা টুল টানাটানির ঘর-ঘর আওয়াজ আর চাবি নাড়াচাড়ির কুড়কুড়ুং আওয়াজ পায়, আর একটু পরেই খুলে যায় দরজাটা!’

বটু বেরিয়ে এসে ‘ওরে আমার সোনারে!’ বলে মেয়েটাকে কোলে তুলতে যায়, কিন্তু সেতিড়বিড়িয়ে ওঠে, ‘আঃ! …..এতবড়োমেয়েকে আবার কোলে করা কী? ছাড়ো শিগগির।’

‘ওরে বাবা, এ যে সাংঘাতিক মেয়ে!’ বটু বলে।

শানু বলে, ‘এই, তুই দরজা খুলে দিলি, তোর রবিকাকা মারবে না?’

‘ইস! মারবে বই কী। আমি আরও জোরে মেরে দেব না তাহলে? লোককে বন্দি করে রেখে দেবে, আর আমি খুলে দেব না? আবদার!’

‘তাহলে আমরা পালাচ্ছি, বুঝলি?’

‘যাও না।’ মেয়েটা শানুর গায়ে একটা ধাক্কা দেয়।

শানু আর বটু বেরিয়ে গলিতে আসে।

ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গলি ছাড়ে, যেন তারাই চোর। বাইরে এসে বটু বলে, ‘মেয়েটা যেমনি লক্ষ্মী, তেমনি দুষ্টু! কী জানি বেচারা বকুনি টকুনি খাবে কি না। রবিবাবু তো পাঁচ হাজার টাকার আশায়—হি হি হি। কিন্তু কী চালাক—ওইটুকু মেয়ে!’

‘ইস মেয়েটার নামটাই জানা হল না।’

‘এই শানু নাম পরে ভাবিস, পা চালিয়ে চল।’

শানু বলে, ‘এবার আমি নিশ্চয় বাড়ি চলে যাব। বটুমামা, তুমি আর কোথাও আমায় নিয়ে যেতে পারবে না।’

বটু বিষণ্ণভাবে বলে, ‘না: আর কোথাও নিয়ে যাব না। কিন্তু কী করে যাব তোদের বাড়ি তাই ভাবছি। পকেটে তো একটাও পয়সা নেই। আর ট্যাক্সি চড়তেও ভরসা হচ্ছে না। এদিকে তোর কোনো আপনার লোকের বাড়ি আছে যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়?’

শানু অবাক হয়ে বলে, ‘এদিকটা কোনদিক জানি আমি?’

বটু বলে, ‘এটা হচ্ছে বরানগর।’

‘বরানগর! বরানগর কী? নামই শুনিনি আমি।’

‘মুশকিলে ফেললে! তোর নিজের বাড়ি ছাড়া মাসি-পিসি মামা কেউ কোথাও নেই?’

‘থাকবে না কেন?’ শানু জোর দিয়ে বলে, ‘আছে না আবার? খুব আছে।’

‘কোথায় থাকে তারা?’

‘বড়োমাসি থাকে বাচিতে, মেজোমাসি থাকে শিলিগুড়িতে, আর পিসিমা তো এলাহাবাদে—’

‘থাম থাম, আর বলতে হবে না। চমৎকার! একেবারে পায়ে হেঁটে চলে যাবার পথ! বলি কলকাতায় তোর কেউ কোথাও নেই?’

‘নেই বই কী! খালি খালি বাজে কথা। শ্যামবাজারে মামার বাড়ি নেই? বলিনি তোমায়?’

‘ওরে আমার সোনা ছেলে, আছে? শ্যামবাজারে আছে? তাহলে চল হাঁটা মারি। বলেছিলি বুঝি? মনে নেই তো! কত নম্বর—কোণ রাস্তা?’

‘বারো নম্বর অনাদি মিত্তির লেন।’

‘সেটা কোনখানে হবে কে জানে। যাক এগোনো তো যাক।’

কিন্তু এগোলেই কী হল?

শানু পারে অত হাঁটতে? একটু গিয়েই সেকাতর হয়ে পড়ে।

‘তবে না হয় একটা রিকশো করি—’ বটু বলে, ‘তোর মামার বাড়িটা চিনতে পারবি তো?’

‘মামার বাড়ি চিনতে পারব না? তুমি পাগল না মাথা খারাপ? পাঁচ মাথার মোড়ের কাছেই সেই লাল-চুড়োওলা বাড়িটার পাশের গলি না?’

অতএব বটু একটা রিকশোই নেয়।

চড়ে বসে বলে, ‘যদি তিন-চার টাকা ভাড়া চেয়ে বসে, তোর মামারা দেবে তো? না দিলে তো মহা বিপদে—’

‘দেবে না? একশো, দুশো, হাজার টাকা দিয়ে দেবে। এতদিন পরে এলাম আমি। দিদিমা তো ছুটে এসে—’

‘ঠিক আছে, চল বাবা! এখন বাড়িটা পেলে বাঁচা যায়! এই রিকশোওলা, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়।’

এদিকে তখন শানুর বাবা মাথায় হাত দিয়ে রয়েছেন। সেই ড্রাইভার রবিদাস, সেএসেছে শানুর চিঠি নিয়ে। পাঁচটি হাজার টাকা আগে পকেটে পুরে, তবে সেশানুর বাবাকে নিয়ে যাবে তাঁর ছেলের কাছে।

সাফ সাফ কথা তার।

‘ছেলে পেয়ে আপনি যদি টাকা দেবার বদলে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেন? যদি বলেন আমিই ছেলেচোর? তখন? টাকাটি দিন, এই আমার ট্যাক্সিতেই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। সেখানে আপনার ছেলে আছে, আর একটি ধুরন্ধর ছোকরা আছে।’

‘ছোকরা? তারসঙ্গে আবার কোন ছোকরা?’

‘কী জানি। মনে হচ্ছে সেই ছোকরাটা ভুলিয়ে-ভালিয়ে আপনার ছেলেকে—মানে হাওড়া স্টেশন থেকে তারা যখন আমার ট্যাক্সিতে উঠল, তখনই ছোকরার কথাবার্তা শুনে—’

‘দেখ সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি যখন আমাকে সন্দেহ করছ, আমিই বা তোমাকে বিশ্বাস করি কী করে? তার চেয়ে চলো আমরা, তোমার সঙ্গে যাই, টাকাটাও নিয়ে যাই। আমি যেই আমার ছেলেকে হাতে পাব, সঙ্গে সঙ্গে তুমিও টাকাটা পেয়ে যাবে।’

কিন্তু রবিদাসের এটা পছন্দ হচ্ছে না।

টাকাটা না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। তা ছাড়া ‘আমরা যাই’ কথাটাও ভারি অপছন্দের। আমরা আবার কেন, শুধু ‘আমি’ হলেই তো ছিল ভালো। কে জানে বাবা ওই ‘রায়ের মধ্যে পুলিশি ব্যাপার কিছু থাকবে কি না। তাই সেবলে ওঠে, ‘আপনারা মানে? কে কে?’

ঠিক এইকথার মাঝখানে শানুর মা এসে ঢুকলেন বাইরে থেকে। পাশেই একটা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন শানুর মা। ‘বেড়াতে’ আর কি সেই শানুর জন্যেই পাগলামি। কে যেন বলেছে কোন খবরের কাগজে একটা ভিড়ের ছবি ছাপা হয়েছে, তারমধ্যে একটা ছেলের ঠিক শানুর মতো মুখ! সেই কাগজ দেখতে গিয়েছিলেন শানুর মা। দেখে তো রেগেই উঠেছিলেন, ‘এই আমার শানু? শানুর এইরকম মোটা খ্যাঁদা নাক? এইরকম খোঁচা খোঁচা চুল? শানু আমার এতবড়ো নাকি? এত একটা বারো-চৌদ্দ বছরের ছেলে!’

সেই রাগ-রাগ মুখ নিয়ে বাড়ি এসেই শানুর মা থমকে দাঁড়ালেন। এ কে!

‘দেখ এই চিঠিটা ইনি এনেছেন।’ শানুর বাবা শানুর লেখা সেই চিটিটা এগিয়ে ধরেন।

‘এ কী! এ কী! এ যে আমার শানুর হাতের লেখা!’

বসে পড়লেন শানুর মা ধুলোর ওপর।

রবিদাস তো থতোমতো।

তারপর শানুর মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ চিঠি কোথা থেকে এল? কোথায় আমার শানু? চিঠিটা এনেছ তো শানুকে আনোনি কেন? টাকার জন্যে আমার শানুকে তুমি আটকে রেখেছ? শিগগির নিয়ে চলো আমায় শানুর কাছে, যত টাকা চাও দেব। বাবু যদি না দেন, আমি আমার সব গহনা-টহনা দিয়ে দেব। চলো চলো শিগগির। দেরি করছ কেন তোমরা?’

শানুর বাবা গম্ভীরভাবে বলেন, ‘ইনি বলছেন আগে টাকা নেবেন, তবে শানুকে—’

‘কী? আমার শানুকে নিয়ে এইসব দরাদরি ব্যাবসাদারি? শানুর মা ফেটে পড়েন, ‘আমি এক্ষুনি পুলিশে ফোন করছি, দেখি কেমন না আমায় নিয়ে যাও।’

ছুটে ফোনের কাছে গিয়ে শানুর মা ডায়াল ঘোরাতে বসেন। তখন শানুর বাবাই বাধা দেন, বলেন, ‘উতলা হয়ো না, মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি যা বলছি, তাই হোক। শুনুন আপনি, আমি আর এই ছেলের মা দু-জনে আপনার সঙ্গে যাই। দেখি সত্যি আমার ছেলে ঠিকমতো আছে কি না, এ চিঠি জাল কি না। তারপর ওই যা বলেছি—এ হাতে ছেলে নেব, ও হাতে টাকা দেব। নচেৎ থানা পুলিশ করে একটা ঝঞ্ঝাট শুরু হয়ে যাবে।’

অগত্যাই রবিদাসকে এঁদের দু-জনকে ট্যাক্সিতে তুলতে হয়। তবে দেখে নিতে ভোলে না শানুর বাবা টাকা সঙ্গে নিচ্ছেন কি না।

এদিকে শানুর বাবার ভাবনা হচ্ছে কী জানি লোকটা গুণ্ডার আড্ডার কি না। চিঠিটা জাল কি না। আমাদের দু-জনকে নিয়ে যদি ওদের আড্ডায় তুলে টাকা গহনা কেড়ে নেয়?

কিন্তু একটা কথা!

শানুর হাতের লেখা জাল করবে কী করে? জীবনে ও কী শানুর হাতের লেখা দেখেছে? তাই কী সম্ভব? যাক যা করেন ভগবান!

গাড়ি এগোতে থাকে। বালিগঞ্জ থেকে বরানগর কম রাস্তা তো নয়।

কিন্তু দূর ক্রমশ কাছে এল। পৌঁছে গেল গাড়ি।

শানুর মা নেমে পড়ে আকুল হলেন, ‘কই? কোথায়? কোন বাড়িতে আটকে রেখেছ তুমি আমার শানুকে?’

‘আহা হা আটকে রাখব কেন?’ রবিদাস বলে, ‘বাড়ির মধ্যেই আছে। আনছি।’

আসল কথা চাবি বন্ধ দরজার দৃশ্যটা আর দেখাতে ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু কে করছে অপেক্ষা? শানুর মা ওর পেছন-পেছন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে শুরু করেছেন। অগত্যা শানুর বাবাও।

কিন্তু? কিন্তু যে কী সেতোমরা আগেই জানো। শানুর মা আর বাবা দেখলেন শুধু একটা অন্ধকার মতো ঠাণ্ডা একতলা ঘর, তাতে একটা ময়লা বিছানাসমেত চৌকি পাতা, ঘরের মেঝেয় দুটো শালপাতার ঠোঙা গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর ঘরের দরজায় একটা কড়ায় একটা চাবিসুদ্ধু ভারি তালা ঝুলছে।

‘কই কোথায়? কোথায় ছেলে?’ শানুর মা-বাবা দু-জনেই চেঁচিয়ে ওঠেন।

রবিদাসের তো মাথায় বজ্রাঘাত!

এ কী! পাঁচ পাঁচ হাজার টাকা হাতে এসে পিছলে পালিয়ে গেল? তালা কে খুলে দিল? কোথায় চলে গেল ছেলে দুটো?

‘তোমায় আমি পুলিশে দেব।’ বললেন শানুর বাবা। তুমি ছেলেকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নিয়ে তাকে সরিয়ে ফেলে পুরস্কারের টাকাটি বাগাতে গিয়েছিলে। দেখছি—আমার এই এত টাকা পুরস্কার ঘোষণাই ভুল হয়েছিল।’

রবিদাস দুই হাত জোড় করে বলে, ‘বাবু, বিশ্বাস করুন, এই একঘণ্টা আগেও ছিল। আমি যখন বেরিয়েছি তখন বলে গেছি—’

‘তবে কোথায় গেল সে? পাখি হয়ে উড়ে গেল?’

‘পাখি হবে কেন? এই তো দিব্যি দরজা খোলা। ভগবান জানেন কে তালা খুলে—’

‘থাক তুমি আর ভগবানের নাম মুখে এনো না—শানুর মা বলে ওঠেন, ‘বল শিগগির কোথায় গেল আমার ছেলে?’

শানুর বাবা বলেন, ‘চালাকি পেয়েছ তুমি? আমাকে বোকা বোঝাচ্ছ? এখন বুঝতে পাচ্ছ কেন তোমার হাতে আগেই টাকাটা দিইনি?’

রবিদাস যতই বোঝাতে চেষ্টা করে, আসলে সেনিজেই জানে না কে দরজা খুলে দিয়েছে, শানুর বাবা ততই বকাবকি চেঁচামেচি করতে থাকেন। পাড়ার লোকজন এসে দাঁড়ায়। রবিও সকলের দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে থাকে, ‘কে এ ঘরের তালা খুলে ছেলে-দুটোকে বার করে নিয়ে গেছে? বল—বল শিগগির। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যেই কেউ ওই পুরস্কারের লোভে এই কাজটি করেছ। বল বল—কে?’

ঠিক এই সময় পাশের বাড়ির দোতলা থেকে পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে আসে সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটা। এসে দাঁড়িয়ে দুই চোখ পাকিয়ে ডান হাতের আঙুল তুলে জোরগলায় বলে ওঠে, ‘মিছিমিছি সবাইকে বকছ কেন রবিকাকু? তুমি ওদের বন্দি করে রেখে দেবে, আর আমি খুলে দেব না? আবদার!’

শানুর মা ছুটে এসে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে বলেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। খুব লক্ষ্মী মেয়ে তুমি। কিন্তু দরজা খুলে না দিলে, সেতো চলে যেতে পারত না! কোথায় সেচলে গেল বল? কোনখান থেকে আবার তাকে খুঁজে পাব আমি?’

মেয়েটা শানুর মার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি বুঝি ওদের মা?’

‘ওদের কি! শুধু তো আমার শানু।’ শানুর মা আবার কাঁদছেন।

মেয়েটা গম্ভীরভাবে বলে, ‘বুঝেছি, তুমি সেই ছোট্ট ফর্সা ছেলেটার মা। কিন্তু তুমি এত বোকা কেন? তোমার ছেলে বন্দি থেকে খোলা পেয়ে অন্য আবার কোথায় যাবে? তোমাদের বাড়িতেই গেছে।’

‘হে ভগবান তাই যেন হয়। ওগো চলো চলো,—যাই বাড়িতে।’

শানুর বাবা বলেন, ‘সেআশা নেই। ওই শুনছ না আর একটা ছেলে আছে সঙ্গে। সেইটাই নিশ্চয় আসল বদ। আমাদের ইনি চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে গিয়েছিলেন, সুবিধে করতে পারলেন না। সেছোকরা আবার কোথায় ভুলিয়ে নিয়ে গেছে কে জানে। তা ছাড়া—শানু কি আর এখান থেকে পথ চিনে সেখানে যেতেই পারত! ভগবান কূলে এনে তরি ডোবালে?’

হঠাৎ মেয়েটা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এ কী তুমি এমন কাঁপছ কেন? তুমি যে পড়ে যাচ্ছ।’

হ্যাঁ সত্যিই শানুর মা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাচ্ছিলেন, সবাই ধরে ফেলল। অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

‘এখন উপায়! গাড়ি—গাড়ি চাই একটা।’ বলেন শানুর বাবা।

একটা লোক বলে ওঠে, ‘আরে এই তো রবিরই গাড়ি রয়েছে—’ কিন্তু কোথায় রবি?

সেএই গোলমালের মধ্যে এক ফাঁকে সরে পড়ে গাড়ি নিয়ে হাওয়া। শানুর মায়ের অবস্থা দেখে তার চৈতন্য হয়েছে, কেন শাস্ত্রে বলে ‘লোভে পাপ’। তার লোভের জন্যই তো আজ এই ভদ্রমহিলার এই অবস্থা। ও যদি টাকার লোভ না করে সোজাসুজি গাড়ি চালিয়ে ছেলেদুটো যেখানে বলছিল সেখানেই নামিয়ে দিত, এত ঝঞ্ঝাটে পড়তে হত না। আর এই ছেলে-হারানো মায়ের কষ্টটাও দেখতে হত না। হয়তো পুরস্কার কিছু পেতও।

পাপ হয়েছে তার—অনেক পাপ হয়েছে।

এখন পুলিশ এসে হাজির হলে, শাস্তির সবটুকুই ফলে। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’—পুলিশের হাতে পড়া মানেই মৃত্যু। তার থেকে সরে পড়াই ভালো।

ও যখন বেঁা করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেইসময় অনাদি মিত্তির লেনের একটা পুরোনো আমলের প্রকান্ড বাড়ির সামনে একটা রিকশো গাড়ি থামল।

আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মধ্যে হাসি-কান্না-চেঁচামেচির মিক্সচার একটা বিরাট শোরগোল উঠল—‘শানু!—শানু এসেছে।—শানু বেঁচে আছে, ভালো আছে।’

শানুর দিদিমা ছুটে আসতে আসতে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে তোরা কে কোথায় আছিস—শিগগির কেয়াতলায় খবর দে।— বউমা, শাঁখ বাজাও—শাঁখ বাজাও।’

১২

হাসিকান্না আদর বকুনি শোরগোল শঙ্খরোল সবের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছে শানু, আর বটু বেচারা সরে গিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই কলকল্লোলের মধ্যে যে তার কোনো জায়গা নেই তা সেবুঝে ফেলেছে। চলেই যেত সে, শুধু শানুর সঙ্গে একবার শেষ দেখা না করে তো আর যাওয়া যায় না! তাই অপেক্ষা করছে—কখন একটু একা পাবে শানুকে।

কিন্তু কোথায় শানু? তাকে তো প্রায় রবারের বলের মতো এ হাত থেকে ও হাতে লোফালুফি করা হচ্ছে। এরই মাঝখানে প্রশ্নের পর প্রশ্ন: কোথায় ছিলি এতদিন? কী করেছিলি? কী খেয়েছিলি? কে তোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল? কে তোকে চুরি করেছিল?—সেএকেবারে প্রশ্নের শরশয্যা!

এরই মাঝখানে কে একজন এসে বলল, ‘শানুদের বাড়িতে ফোন করে সাড়া পাওয়া গেল না, বাড়িতে কেউ নেই।’

শানুর দিদিমা হই চই করে উঠলেন, ‘ওমা ওমা, ছেলে ছেলে করে পাগল হচ্ছিল, আর ছেলে যখন নিজে এসে হাজির হল তখন আর পাত্তা নেই? কোথায় গেল এমন সময়?’

কোথায় গেল তা আর কে জানবে? তাই পাঁচ মিনিট অন্তর টেলিফোনের ডায়াল ঘোরানো হতে থাকে, শানুর মা-বাবাকে খবর দেওয়ার জন্যে।

এরই অবসরে বটু আস্তে আস্তে এসে উঁকি মারে। শানু কাছে আসে, বলে, ‘এ কি তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছ যে। ভেতরে এসো। চলো আমার দিদিমাকে চিনিয়ে দিই।’

বটু ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘না রে ভাই না, আমি পালাই। তোর সঙ্গে একবার দেখা করব বলে—’

‘পালাবে মানে?’ শানু ওর হাত চেপে ধরে বলে, ‘মা-বাবার সঙ্গে দেখা না করে—’

‘না না, আমি দেখা করব না! এমনিতে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার—’

‘মাথা কাটা যাচ্ছে? মাথা কাটা যাচ্ছে তোমার?’ হি-হি করে হেসে ওঠে শানু, ‘দিব্যি আস্ত মাথাটাই তো রয়েছে দেখছি। এক ইঞ্চি চুলও তো কাটা যায়নি। লজ্জা! লজ্জা কীসের? তুমি আমার বন্ধু না?’

বটু মলিনমুখে বলে, ‘আগে তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি তা হয় না।’

‘হয় না? হয় না মানে?’ শানু অবাক হয়ে তাকায়।

বটু গম্ভীর-বিষণ্ণমুখে বলে, ‘বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। তুই আর আমি কি সমান? তুই কত বড়োলোকের ছেলে, সকলের কত আদরের ছেলে, আর আমি? জগতের ওঁচা। তুই হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলি বলে শাঁখ বাজল, আর আমি যদি এখন এই মুখ নিয়ে আবার বাড়ি ঢুকি বাড়ির লোক জুতো নিয়ে তেড়ে আসবে। আমি হব তোর বন্ধু! হুঁ!’ চোখ ছলছল করে আসে বটুর।

শানু একটুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, ‘হব’ আবার কী? হয়েই তো গেছ। একবার বন্ধু হয়ে গেলে, আবার বদলানো যায় নাকি? ডিংলাই তো কত কালো, একেবারে অন্যরকম, তা বলে কি ডিংলাই আমার বন্ধু নয়?’

‘ডিংলাই!’ বটু বলে, ‘ওঃ সেই সাঁওতাল না কাদের যেন ছেলেটার কথা বলছিস? তা তারসঙ্গে আর তোর দেখা হচ্ছে কোথায়? জীবনেও হবে না হয়তো।’

‘হবে না? ইস! হবে না বই কী! আমি বড়ো হয়ে নিজে নিজে রেলে চড়ে যেতে পারব না বুঝি? খুঁজে বার করব না বুঝি তাকে?’

‘তুই বড়ো হয়ে তাকে খুঁজে বার করবি?’

হেসে ওঠে বটু। বলে, ‘তুই এখনও নেহাত বাচ্চা আছিস। পৃথিবীটা যে কী তা এখনও টের পাসনি! বড়ো হয়ে তোর এসব কথা মনে করে হাসি পাবে।’

‘হাসি পাবে? তুমি আমায় ভেবেছ কি তাই শুনি? দেখ না বড়ো হলে।’ শানু জোরালো গলায় বলে ওঠে।

বটু কী যেন একটু উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ বাইরের দিকে মস্ত একটা শোরগোল ওঠে অনেকগুলো গলায় একটা কথা বেজে ওঠে, ‘সেকী! সেকী! কী কান্ড!’

কান্ডই সত্যি। শানুর মাকে ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে।

আর দাঁড়ায় শানু?

সেবিদ্যুতের মতো ছুটে গিয়ে দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে, ‘মা মা!’

সেই কতদিন আগে দিঘায় মাকে না বলে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বালির চরে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর এই দেখা!

‘মা মা মা!’ মার বুকে মুখ-মাথা ঘষতে থাকে শানু।

আর শানুর মা? শানুর বাবা?

তাঁদের অবস্থা তোমরা নিজেরাই বুঝে নাও। অনেক কথা আর অনেক চোখের জলের পর আবার যখন সবারই মুখে হাসি ফোটে, তখন শানু ছুটে দেখতে আসে বটু কোথায়।

বটু তখন বাড়ির বাইরের রোয়াকে চুপটি করে বসে আছে। চলে যাবে করে পা বাড়াচ্ছে আর মনটা টানছে শানুর দিকে। শানু বলেছে শানুর মা-বাবাকে না দেখে যাওয়া চলবে না। সত্যি, সেটা উচিতও। একবার অন্তত তাঁদের বলে যেতে হবে এমন ছেলে বটু কখনো দেখেনি। স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবদূত যেন। বলবে এ ছেলের মা-বাপ ধন্য।

তাই ভিড়ের পেছনে একটি পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

তখন শানুর মা বসে পড়ে ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদছেন, ‘শানু শানুরে, কত দুঃখু তুই দিলিরে আমায়! শানু সোনা কী চেহারা হয়েছে রে তোর?’

এসব কথার শেষ নেই।

শানুর ছোটোমামা এসে বলেন, ‘তা তোর সঙ্গের ওই ছোঁড়াটা কে রে?

‘ছোঁড়া মানে?’ শানু সবেগে দাঁড়িয়ে ওঠে, ‘ও তো আমার বন্ধু।’

‘বন্ধু? আহা-হা চুক চুক। তুই যেমন হাঁদা। ওই তোকে ভুলিয়ে নিয়ে পালিয়েছিল না?’

‘কক্ষনো না! ওর সঙ্গে তো আমার রেলগাড়িতে দেখা। ও আমাকে খুঁজে এনেছে।’

‘খুঁজে এনেছে?’

‘না তো কী? আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম না? বটুদাই তো আমাকে খুঁজে নিয়ে এসেছে।’

বটু শুনতে পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে। ভাবে শানুটা সরল শিশু ও যা হোক বলছে। কিন্তু বাড়ির বড়োরা তো আর সরল শিশু নয়! তারা যে বটুর জন্যে কী ব্যবস্থা করবে কে জানে? উত্তম-মধ্যম, কিংবা শ্রীঘর। সকলেই তো কেমন সন্দেহ-সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বটুর দিকে।

শানুর বাবা তো সাতশো জেরা করলেন, শানুর বড়োমামাও চুপি চুপি কীসব বলছিলেন ওর দিকে তাকিয়ে।

ওঁদের ধারণা বটু একটা হতচ্ছাড়া রাস্তার ছেলে, শানুকে ভুলিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল, নেহাত পাকেচক্রে শানু উদ্ধার হয়েছে। যাক উদ্ধার তো হয়েছে! ওঁরা তাই চুপি চুপি বলাবলি করেন, ‘থাক, থানা পুলিশ করে আর দরকার নেই, শানুকে তো দেখছি বেজায় হাত করেছে। ওকে এখন পুলিশে হ্যাণ্ডওভার করতে গেলে শানু খেপে যাবে। বরং দুটো সন্দেশ-রসগোল্লা খাইয়ে ছেড়ে দাও।’

‘হাঁ তাই দিচ্ছিলেন সবাই, কিন্তু হঠাৎ শানু চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘ও কী চলে যাচ্ছ যে বটুদা? টাকা নিয়ে যাও।’

টাকা! ওকে আবার টাকা দিয়ে বিদেয় করতে হবে নাকি? সদ ব্রাহ্মণ?

ভোজন-দক্ষিণা? শানুর মামারা তেড়ে আসেন, ‘টাকা কীসের?’

‘বা: তোমরা খবরের কাগজে লেখনি, যে আমাকে খুঁজে দেবে, তাকে তোমরা পাঁচ হাজার টাকা দেবে?’

হ্যাঁ তা তাঁরা লিখেছিলেন! স্বীকার করেন।

কিন্তু বটু কি শানুকে খুঁজে এনে দিয়েছে?

‘শানু, নিজেই তুমি বলনি রেলগাড়িতে দেখা।’— বলেন বড়োমামা।

‘তাতে কী?’ শানু সতেজে বলে, ‘আমি বলছি— ও আমায় খুঁজে দিয়েছে।’

‘তোকে বোকা বুঝিয়েছে ছোঁড়া—!’

‘ছোঁড়া! আবার ওইসব বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথা? ঠিক আছে, তোমরা দিয়ো না টাকা, আমি আবার চলে যাচ্ছি বটুদার সঙ্গে—’

শানু বীরবিক্রমে গিয়ে বটুর হাত চেপে ধরে, ‘চলো বটুদা— আমরা আবার হারিয়ে যাই। মিথ্যুকদের সঙ্গে থাকবার দরকার নেই আমাদের। দেবে বলে দেয় না—’

এখন বুঝতেই পারছ ব্যাপার!

পাঁচ পাঁচ হাজার টাকা, কম তো নয়! যখন শানুকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন মনে হয়েছিল, তার বদলে পৃথিবী দেওয়া যায়, কিন্তু এখন ঘরের ছেলে ঘরে এসে গেছে, এখন মনে হচ্ছে খামোকা ওই রাস্তার হতভাগা ছোঁড়াটাকে অতগুলো টাকা দিতে যাব কেন? ও কি সত্যি খুঁজে এনেছে শানুকে? শুধু-দৈবক্রমে পথে দেখা হয়ে গিয়ে ভারি দেখি মাথা কিনেছে! শানুটা বোকা।

কিন্তু বোকা কি বটুই নয়?

সেও তো শানুর হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে মিনতি করছে, ‘ছাড়, ভাই ছাড়, আমার টাকা চাই না। তুই যে তোর মার কাছে এসে পৌঁছেছিস এই আমার আনন্দ।’

‘ইস ছাড়ব বই কী? টাকা না হলে তুমি কাচের দোকান করবে কী করে শুনি?’

‘শানু চলে এসো।’—বড়োমামা গম্ভীরকন্ঠে বলেন।

ছোটোমামা বলেন, ‘শানু ছেড়ে দাও ওকে, বেশি গোলমাল করলে ওকে পুলিশে দেওয়া হবে।’

দিদিমা বলেন, ‘ছোঁড়া আমার শানুকে তুকতাক কিছু করে নি তো?’

শানুর বাবা বলেন, ‘শানু, তুমি ছেলেমানুষি করো না। আমি বলছি টাকা ওর পাওনা হতে পারে না।’

আর শানুর মা বলে ওঠেন, ‘ওগো শানু যখন বলছে, দাও না ওকে কিছু—দু-তিন শো চারশো যা হোক।’

শানুকে এঁরা টেনে আনতে যান, বটুও শানুকে ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু শানুর মুঠো তখন বজ্র।

‘কক্ষনো না! যাব না তোমাদের সঙ্গে, থাকব না তোমাদের কাছে। মিথ্যুকদের কাছে থেকে দরকার নেই আমার। খবরের কাগজে লেখা হল পাঁচ হাজার টাকা, এখন কি না ‘আহা-হা দিয়ে দাও না দু-তিন শো!’ কেন? বটুদা কি ভিখিরি? চলো বটুদা, চলো। আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিগে।’

‘রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি?’ শানুর মা কেঁদে ফেলেন। ‘এতদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তোর আশ মেটেনি শানু? আমাকে ছেড়ে আবার চলে যাবার কথা মুখে আনছিস তুই? আনতে পারছিস?’

‘তা কী করব?’ শানুর বুনো গোঁ, ‘তোমরা যেমন, তেমনি শাস্তি।’

‘শানু, আমায় ছাড় ভাই।’ টানাটানি করছে বটু।

শানু প্রবল ; বলে, ‘না না! আমরা চলে যাব।’

শানুর বাবা এসে গম্ভীরভাবে বলেন, ‘শানু, আমাদের চেয়ে ও তোমার বেশি আপন হল?’

‘হলই তো। ও আমার বন্ধু।’

দিদিমা কপালে হাত চাপড়ে বলেন, ‘আর কিছু না, ছোঁড়া নির্ঘাত তুক করেছে। সেই যে কী যেন বশীকরণ মন্তর আছে, তাই পড়েছে। নইলে এতদিন পরে মা-বাপ পেয়েও এমন করে?’

অতঃপর বড়োরা চুপি চুপি পরামর্শ করেন, ‘শানু যখন অত খেপেছে, দেওয়াই হোক টাকাটা, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশেও খবর দেওয়া হোক, যাতে বাড়ির বাইরে যেতেই পুলিশের হাত দিয়ে টাকাটা আবার কেড়ে নেওয়া যায়। সত্যি, শানু পাগল হয়েছে বলে তো আর বড়োরা পাগল হননি যে পাঁচ হাজার টাকা—’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, টাকা দিচ্ছি—’ শানুর বাবা গম্ভীরভাবে বলেন শানুকে, কিন্তু তুমি প্রতিজ্ঞা করো, আর কক্ষনো মিশবে না ওর সঙ্গে। এই শেষ দেখা—’

হঠাৎ বটু কেঁদে ফেলে বলে, ‘মিনতি করি আপনাদের, তার থেকে বরং টাকা দেবেন না আমাকে, শুধু মাঝে মাঝে শানুর সঙ্গে দেখা করতে দেবেন—’

কথা শেষ হয় না! শানু চড়া গলায় বলে ওঠে, ‘টাকাও দেবেন, দেখাও করতে দেবেন। দেবেন না মানে? আবদার নাকি?… বাবা, দাও দাও শিগগির টাকা নইলে এই আমি চললাম।’

‘শানু, তুই এত নিষ্ঠুর?’

‘আহা-হা, আর নিজেরা কী দয়ালু? কেন বলতে পারছ না—বটু, তুমি আমাদের বাড়িতেই থাকো, টাকা নিয়ে দোকান টোকান করে তুমি বড়োলোক হও। তুমি আমাদের শানুর বন্ধু। …তা নয়—তুমি চলে যাও। তোমায় টাকা দেব না! ছাই ভালোবাস আমায় তোমরা। টাকা দিতে হাত সরছে না! আর দেখ বটুদাকে? বটুদা শুধু আমার সঙ্গে একটু দেখা করবার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা ছেড়ে দিচ্ছে! এখন বুঝছি, বন্ধুই হচ্ছে আসল। …ব্যস বটুদা, চলো আমরা আবার ঘুরে ঘুরে বেড়াইগে। ঘুরতে ঘুরতে ডিংলাইকে খুঁজে বার করব। তিন বন্ধুতে এক-সঙ্গে থাকব।’

‘শানু, তুই পাগল?’

‘বেশ তো তাই। পাগলই আমি। আর এঁরা সব খুব বুদ্ধিমান। চারটি টাকার জন্যে এতদিনের হারিয়ে-যাওয়া ছেলেটাকে আবার হারিয়ে ফেলছেন।’

‘না আর হারিয়ে ফেলব না’—শানুর মা কাছে সরে আসেন। রবিদাস ড্রাইভারকে দেওয়ার জন্যে যে টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন শানুর বাবা, সেই টাকাভরা পোর্টফোলিয়োটা তুলে দেন বটুর হাতে, ছলছল চোখে বলেন, ‘আজ থেকে তুমিও আমার আর একটি ছেলে। শানুর মতো আদরেই থাকবে আমার কাছে। আর এই টাকা নিয়ে দোকান টোকান যা করতে চাও করবে।’

শানুর মা বটুর হাত ধরেন।

ব্যস সকলে একেবারে আঁকা ছবি! কারও মুখে কথা নেই।

শানুর মা নিজেই যদি পাগলামি করে বসেন, কার কী বলার আছে! এখন শুধু চুপি চুপি মন্তব্য—ছোঁড়াটা কী ‘লাকি’!

অনেকক্ষণ পরে খাওয়া-দাওয়ার পর শানুদের বাড়িতে এসে ওর পড়ার ঘরে বসে বটু বলে, ‘এসব কী করলি বল দিকি?’

‘ঠিকই তো করলাম। ছোটোরা ভুল করলে বড়োরা যেমন বুঝিয়ে ঠিক করে, বড়োরা ভুল করলে ছোটোরাও তেমনি ঠিক করে দিতে পারে। বুঝলে বটুদা?’

‘কিন্তু শানু, আমি কোন লজ্জায় তোদের বাড়িতে তোর বন্ধু হয়ে থাকব? আমি তো তোদের চাকরের মতো।’

‘ছি: বটুদা!’ নিজেকে অত নীচু ভাবতে আছে?’ শানু সতেজে বলে, ‘ওতে ভগবান রাগ করেন, তা জান? আর—হি হি—তাই যদি হয়, তুমিও তোমার কাঁচের দোকানে আমাকে চাকর রেখো।—হি হি—আমি বাসনের ধুলোটুলো ঝাড়ব, আর লোকে কিনতে এলে বলব—তিন টাকায় হবে না—দশ টাকা চাই।’

বটু একটুক্ষণ ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘নারে শানু, তোর তো আর আমার মত মুখ্যু হয়ে থাকলে চলবে না, তোকে লেখাপড়া শিখতে হবে, মানুষ হতে হবে। আমি ঠিক করেছি তোর সেই ডিংলাইকে খুঁজে এনে দু-জনে দোকান চালাব।’

‘সত্যি বটুদা? ইস! তুমি কী ভালো!…….’

শানু উজ্জ্বল চোখে বটুর হাত ধরে। আর তারপরই আস্তে আস্তে ওর মুখটা ম্লান আর চোখটা উদাস উদাস হয়ে যায়। বলে, ‘কিন্তু বটুদা, সত্যি কথা কি জান? বাড়ি ভালো—খুবই ভালো, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া আরও ভালো।’

‘হারিয়ে যাওয়া আরও ভালো! বলিস কী শানু?’

‘সত্যি বটুদা! আবার আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে— সমুদ্দুরের ধারে ধারে বনে জঙ্গলে পাহাড়ে, না-দেখা সব জায়গায়।’

‘ইস! ভয় করে না তোর?’

‘করে, কিন্তু ভয়ের মধ্যেও মজা আছে। দেখ বড়ো হয়ে আবার হারিয়ে যাব।’

‘আবার হারিয়ে যাবি? চমৎকার! আর তোর মা?’

শানু মহোৎসাহে বলে, ‘সেআমি ভেবে ফেলেছি। হারাবার সময় মাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *