রাজপুত নন্দিনী – ৬

দিল্লির আকাশে সেদিন চাঁদ ওঠেনি। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। নিকটের মীনার বা গম্বুজের অস্তিত্বও চোখে পড়ে না। রাজপথ জনশূন্য। মাঝে মাঝে শুধু রক্ষীদের পদশব্দ আলস্য-ভরা মন্থর গতিতে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মহারাজ যশোবন্ত সিংহের মহারানির নতুন প্রাসাদে সবাই নিদ্রামগ্ন। শুধু পার্শ্ববর্তী শিবিরে জন পঁচিশেক সৈন্য জাগরিত। তারা দুর্গাদাসের নির্দেশে শুধু রাজপথ নয়, সবদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন অশ্বারূঢ় অবস্থায় মুঘল রক্ষীদের দৃষ্টির অলক্ষ্যে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে শহরের মধ্যে। নিদ্রিত সৈনিক পুরুষরাও যুদ্ধসাজে সজ্জিত। আক্রান্ত হলে জাগরিত হয়েই যাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

আর জেগে রয়েছে রানির প্রাসাদের ছাদের ওপর দুটি প্রাণী। আজ তাদের উভয়ের চোখই অশ্রু ভারাক্রান্ত। আজ আর কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ তাদের ভাগ্য দুর্গাদাস শক্ত হাতে নির্ধারিত করে দিয়েছে।

ভোর হতে আর বাকি নেই বেশি। সারারাত ওরা ওইভাবে বসে থেকেছে। ভেবেছিল অনেক কথা বলবে পরস্পর পরস্পরকে। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। তবু উভয়ে উভয়েরই বক্ষের স্পন্দন অনুভব করে মনের কথা জেনে নিয়েছে।

রত্না শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, —আমার এই যৌবন তোমার। তোমায় যখন উৎসর্গ করতে পারলাম না, জীবনে তখন আর কেউ ভোগ করতে পারবে না। হারেমে যে মুহূর্তে তেমন কিছু ঘটবার সম্ভাবনা হবে, সে মুহূর্তে শুধু আমার দেহই পড়ে রইবে—প্রাণ থাকবে না।

—না, না, রত্না। তা কেন হবে? হয়তো বাদশা তোমায় ছেড়ে দেবেন। হয়তো আবার তুমি দেশে ফিরে যেতে পারবে।

—কিন্তু কেন যাব? কিসের আশায়? কার কাছে?

বীরসিংহ অতিকষ্টে মিথ্যে কথা বলে,—আমি—আমি তোমার পথ চেয়ে থাকব।

—এ শুধু আশার ছলনা। তুমি আমার প্রাণ বাঁচাতে চাও। কেন এত নিষ্ঠুর হচ্ছ। আমি কি জানি না ভাবছ যে, তোমার দেহ দিল্লির মাটিতে পড়ে রইবে? আমি কি জানি না, তুমি ততক্ষণ শত্রুসেনা ধ্বংস করবে, যতক্ষণ তাদের বল্লম, তলোয়ার কিংবা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি তোমার বক্ষ না ভেদ করবে? আমি কি জানি না, তুমি উপায় থাকলেও, আমায় ছেড়ে কিছুতেই দিল্লি ত্যাগ করবে না?

বীরসিংহ স্তম্ভিত হয়। সে ভেবে পায় না কীভাবে রত্নার কাছে তার মন এমন উদ্ঘাটিত হলো। কখন হলো? সে নিজে থেকে তো কিছুই বলেনি কখনও। হতাশ কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে বলে,—তোমার কাছে আমি কিছুই লুকোতে পারি না রত্না।

কী করে পারবে গো। তুমি যে আমার।

বীরসিংহ জানে, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই যে সে একান্ত রত্নার। যদি সন্দেহ থাকে, তবে কিছুক্ষণ পরেই রাতের শেষ প্রহরে পুবের আকাশে রক্তিমাভা দেখা দেবে না। যদি সন্দেহ থাকে তবে দিল্লির মানুষ নিঃশ্বাস নেবার হাওয়ার অভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। যদি সন্দেহ থাকে, তবে যমুনার জল শুষ্ক হয়ে যাবে রাত না পোহাতেই। যদি সন্দেহ থাকে দেখা যাবে আগামীকাল লালকেল্লা গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

—বীরসিংহ।

রত্নার ডাকে সে সজাগ হয়। এ পর্যন্ত কখনও এভাবে নাম ধরে তাকে ডাকেনি সে।

—তুমি তো এভাবে কখনও নাম ধরে আমায় ডাকো না রত্না।

—ডাকি। মনে মনে শত সহস্রবার ডাকি। কিন্তু মুখ ফুটে ডাকতে বড় লজ্জা হয়। তোমার নাম আমার ইষ্টমন্ত্র। তবু আজ ডাকলাম। ডেকে মনটাকে ভরিয়ে নিলাম। তোমার সামনে ওভাবে ডেকে যে কী সুখ—নারী হয়ে জন্মালে বুঝতে। তবে নারী হতে তোমায় বলি না। তুমি পুরুষ-ই হও আবার। মাড়োয়ারের মাটিতে আবার তোমার জন্ম হোক। দেশের যেখানেই তুমি থাকো না কেন, পরজন্মে ঠিক তোমায় খুঁজে নেব। আমি সেদিন তোমায় দেখতে পেলে কৈশোরের সংকোচ নিয়ে দূরে সরে যাব না। যৌবনের অহংকার নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবার ছলনা করব না। তোমাকে দেখতে পেয়েই আমি ছুটে যাব—আমি সমস্ত শরীর মন নিয়ে ছুটে গিয়ে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমায় তখন প্রত্যাখ্যান কোরো না বীরসিংহ

—আমি সেই মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করব রত্না। সেই মুহূর্তের জন্যে এই জীবনের বাকি প্রহরগুলি প্রার্থনা করব কায়মনোবাক্যে—সেই মুহূর্তের জন্যে পরজন্মে তপস্যা করব।

পুবের আকাশ ফিকে হয়। দুর্গাদাসের কড়া নির্দেশ অন্ধকার থাকতে থাকতেই শিবিরে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। বীরসিংহ উঠে দাঁড়ায়। রত্না দুই বাহুদ্বারা তার কণ্ঠদেশ জড়িয়ে ধরে কেঁদে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,–না, না, যেও না তুমি।

স্তব্ধ বীরসিংহ কিছুই বলতে পারে না প্রথমে। শেষে অতি ধীরে অশ্রু সংবরণ করে বলে, —আর ক’টা দিনই বা।

—জানি। তারপরে আবার আমাদের মিলন হবে। কিন্তু কত বছর-কত বছর অপেক্ষা করতে হবে।

—হ্যাঁ। অনেক বছর। আমাদের মতন এমন অনেকেই অনেকের জন্যে অপেক্ষা করবে। তাদের আমি চিনি না, তুমিও চেনো না। কিন্তু তারাও রয়েছে। ওই যে শিবির-শ্রেণি দেখছ, ওর ভেতরে এবং বাইরেও কত যুবক রয়েছে যারা এই মুহূর্তে দেশের কুটিরের মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে নিদ্রিত অবস্থায়। তাদেরও রত্না রয়েছে সেইসব কুটিরে। তবু তাদের মধ্যে অধিকাংশ‍ই বোধহয় ফিরতে পারবে না দেশে। ওইসব বীরসিংহের সঙ্গেও রত্নাদের আর দেখা হবে না। তোমার আর আমার ভাগ্য ওদের চেয়ে অনেক ভালো। তাই ওরা যখন শুধু স্বপ্ন দেখছে আমরা তখন জীবনের শেষক্ষণে উভয়ের উষ্ণ সান্নিধ্য অনুভব করছি। ওদের জন্যেও একটু চোখের জল ফেলো রত্না।

বীরসিংহের কণ্ঠ ছেড়ে দেয় রত্না। কোমর থেকে একটা তীক্ষ্ণ অস্ত্র বের করে বলে,—দেখো তো এটা ঠিক আছে কিনা?

বীরসিংহ সেটা হাতে নিয়ে সযত্নে পরীক্ষা করে বলে,—সুন্দর।

সে রত্নাকে দেখিয়ে দেয় বুকের কোন জায়গাটায় বিঁধলে অবশ্যম্ভাবী ফল পাওয়া যায়—

—চলি রত্না।

—এসো বীর—

রত্না লুটিয়ে পড়ে বীরসিংহের পায়ের কাছে। অনেকক্ষণ পরে মাথা তুলে দেখে তার বীর অন্তর্হিত হয়েছে।

.

বাদশাহ আওরঙ্গজেব দুর্গাদাসকে দরবারে ডেকে পাঠান একদিন। এই দিনটার জন্যে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল দুর্গাদাস। সে তার বহু চিন্তিত জবাব পাঠায় লোক মারফত বাদশাহের কাছে। জবাবে বলা হয়,—মহারাজ যশোবন্ত সিংহের শিশুপুত্রকে মাড়োয়ারের অধীশ্বররূপে বাদশাহ অনুগ্রহপূর্বক ঘোষণা করলে, সে গর্বের সঙ্গে বাদশাহ সমীপে উপস্থিত হতে পারে।

এ যে কতখানি ধৃষ্টতা দুর্গাদাস জানত। স্বয়ং বাদশাহের ইচ্ছাই যেখানে আদেশ সেখানে স্পষ্ট আদেশকে লঙ্ঘনের কোনো মার্জনা নেই, এ-কথা অতি নির্বোধ দেশবাসীরও অজানা নয়। তবু দুর্গাদাসকে ঝুঁকি নিতে হলো। কারণ দরবারে উপস্থিত হবার পর তাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করলে শিশু-রাজাকে উদ্ধারের সব আশা বিসর্জন দিতে হতে পারে। তাকে বন্দি করার চেয়ে সম্মুখ সমর অনেক গুণে ভালো।

আওরঙ্গজেব ক্রোধে কম্পিত হন। তাঁর গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল আগুনের মতো দেখায়। ওই সুন্দর রং বড়ই প্রসিদ্ধ। বাদশাহ শাহজাহান যখন দিল্লির তখত্‌তাউসে তখন একজন ভবিষ্যদ্বক্তা বলেছিল,—তাঁর সব চাইতে গৌরবর্ণ পুত্রই তাঁর সর্বনাশের কারণ হবে।

ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণে বর্ণে ফলেছিল। কিন্তু দুর্গাদাসের সঙ্গে সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো সম্পর্ক নেই। তবু দুর্গাদাস কল্পনার চোখে একবার তার জবাবের প্রতিক্রিয়ায় বাদশাহের মুখখানা দেখে নিল।

খবর এল বাদশাহের কাছ থেকে, —যশোবন্তের পুত্র শুধুমাত্র একটি শর্তে পিতৃসিংহাসন লাভ করতে পারেন। শর্তটি হলো, তাঁকে ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে হবে।

দুর্গাদাস এত বিপদের মধ্যেও একটু না হেসে পারে না। মহারাজের পাশে থেকে থেকে বাদশাহ চরিত্র সে-ও ভালোরকম জেনে ফেলেছে। এমনটি হতে পারে কত আগে থেকে সে ভেবে রেখেছে। মনে মনে বাদশাহ আকবর থেকে শুরু করে শাহজাহান পর্যন্ত সমস্ত মুঘল সম্রাটের কথা ভাবে। তাঁরা কত মহান ছিলেন—কত উদার। আওরঙ্গজেব এতবড় বীর ও তীক্ষ্ণধী হয়েও উদারতার অভাবে দেশটাকে ভেঙে দিতে বসেছেন।

বাদশাহ বড়ই অবহেলাভরে প্রস্তাবটি ছুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন মুঘল রাজধানীর বুকে বসে মুষ্টিমেয় রাজপুতের পক্ষে সাহস হবে না তাঁর প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করার। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আওরঙ্গজেব মনুষ্যচরিত্র সবিশেষ চিনতেন। শুধু রাজপুতদের চিনতে তাঁর বারবার ভুল হয়েছে। সেই ভুল না হলে কত শান্তিতে তিনি আসমুদ্রহিমাচলের মালিক হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারতেন।

দুর্গাদাস বিনীতভাবে সংবাদ পাঠাল যে, বাদশাহের প্রস্তাব তার পক্ষে মেনে নেওয়া দুঃসাধ্য। কারণ ধর্মকে অধিকাংশ রাজপুত যখের ধনের মতো আঁকড়ে রাখে। ধর্ম চলে গেলে জগৎ তাদের কাছে শূন্য হয়ে যায়। সুতরাং সহৃদয় বাদশাহ আর একবার বিবেচনা করুন এবং তাঁর আশ্রিত শিশুকে স্বদেশ-যাত্রার অনুমতি দান করুন।

স্তম্ভিত আওরঙ্গজেব কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর তাঁর মুখে ফুটে উঠল ফিকে হাসি। সে হাসির পরিচয় দরবারের অনেকেই জানত। যারা যশোবন্তের পুত্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন সেই হাসি তাদের হৃৎকম্পের সৃষ্টি করল। আর যারা তার প্রতি বৈরী-ভাবাপন্ন তারা মনে মনে আনন্দিত হয়ে উঠল। বুঝল সর্বনাশ কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু তেমন লোকের সংখ্যা দরবারে খুব কম। কারণ যশোবন্ত সিংহের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদের অনেকেই যুদ্ধ করেছে—দেখেছে কতখানি বীরত্ব সাহসিকতা ও আনুগত্য দিয়ে তিনি এককালে লড়েছেন। কিন্তু মুখ ফুটে সহানুভূতি প্রকাশের উপায় নেই। বাদশাহের খড়্গহস্ত নেমে আসবে।

বাদশাহ দুর্গাদাসের দূতকে শান্তকণ্ঠে বললেন,—ইসলামধর্ম গ্রহণ করতেই হবে যশোবন্ত সিংহের পুত্রকে এবং আমার প্রথম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার শাস্তি-স্বরূপ শিশুর মাকেও মুঘল প্রাসাদে এসে থাকতে হবে। এর অন্যথা যেন না হয়।

বাদশাহের আমীর ওমরাহের মনে যা-ই থাকুক মুখে একবাক্যে বলে উঠল,—বাদশাহ মহানুভব। নইলে দাম্ভিক দুর্গাদাসের বেঁচে থাকবার কোনো অধিকার নেই।

আওরঙ্গজেবের মুখে আবার হাসি ফুটল। এই হাসির জাত আলাদা। তিনি বুঝলেন আমীর ওমরাহরা মুখে যে কথাই উচ্চারিত করুক না কেন তাদের অধিকাংশ তাঁর এ জাতীয় কার্যকে মনে মনে চায় না। তারা বিরক্ত হয়। দারাশুকো তাদের মাথাগুলো খেয়ে রেখেছে।

.

দুর্গাদাসের বুদ্ধিমান দূত ছুটে গিয়ে আওরঙ্গজেবের চরম প্রস্তাব জানাল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাদাস প্রধানদের ডেকে বলল,—প্রস্তুত হও। সবাইকে প্রস্তুত রাখো। আক্রমণ শুরু হবে।

রানির প্রাসাদে প্রবেশ করে দুর্গাদাস বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে সোজা কাছে গিয়ে বলে,—আপনার যাত্রার সময় উপস্থিত।

—এখনি?

—হ্যাঁ মা। এই মুহূর্তেই। আপনি পুরুষের বেশ পরিধান করুন।

—আমার পুত্র? অজিত?

—তিনিও সঙ্গে যাবেন আপনার। মিষ্টির ঝুড়ি কিনে রেখেছি। সেটি বয়ে নিয়ে যাবে আমার বিশ্বস্ত দুজন কর্মচারী। আপনাদের পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে পঞ্চাশজন যুদ্ধনিপুণ প্রবীণ যোদ্ধা। তাদের পেছনে যাবে দুশো জন যোদ্ধা। কখনও ভাববেন না আপনি নিঃসঙ্গ—অসহায়। আপনার সহায় মাড়োয়ারের প্রতিটি মানুষ। শিশুরাজা অজিত সিংহের জন্যে রক্ত দিতে শুধু মাড়োয়ার নয়—মেবারও প্রস্তুত।

—আমি নিশ্চিন্ত দুর্গাদাস। এখনি প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি।

দুর্গাদাস রানির কক্ষ থেকে বাইরে আসবার সময় পেছনে ডাক শোনে,—কাকাবাবু।

—ও, রত্না। তোমায় তো নির্দেশ দেওয়াই আছে। কিন্তু এ কী বেশ? এত মলিন? না, না, রানির উপযুক্ত এ-বেশ মোটেই নয়। পালটে ফেলো। তোমার চোখে জল! ছিঃ রত্না। দেশকে ভুলে যেও না। বীরসিংহের চোখে নিশ্চয়ই জল নেই এখন। তুমি বীরসিংহের উপযুক্ত নারী। ওই যে দেখছ নীল আকাশ ওপরে—ওই আকাশও ছাড়িয়ে বহু যোজন দূরে রয়েছে একটি স্থান। সেখানে যায়, যারা দেশের জন্যে প্রাণ দেয়, যারা পাপবিদ্ধ নয়। ওখানে তোমার স্থান নির্দিষ্ট—বীরসিংহও সেখানে যাবে ভুলে যেও না! ওখানে দুঃখ নেই, দৈন্য নেই, হতাশা নেই, বিরহ নেই—চির-আনন্দের দেশ, ভুলে যেও না রত্না।

—আমি চোখের জল মুছে ফেলেছি কাকাবাবু।

—ঠিক করেছ মা। তবে ওরা তোমায় নিয়ে যাবার সময় কাঁদলে ক্ষতি নেই। সেটাই স্বাভাবিক হবে। দুর্বলতার অশ্রুকে প্রশয় দিও না রত্না।

—আপনার আদেশ আমি মানব কাকাবাবু —শিশুটি ঠিক আছে?

—হ্যাঁ। সে-ও রাজপুত

—ঠিক। কিন্তু সে রাজার প্রাণ বাঁচাচ্ছে। তাই তার আত্মোৎসর্গ মহৎ।

—ভবিষ্যতে সে রাজপুতদের পরম শত্রু হয়ে উঠতে পারে। কারণ সে কখনও নিজেকে রাজপুত বলে জানবে না। জানলে নতুন ধর্মের প্রতি তার আকর্ষণ বেশি হবে।

—তোমার কথা সত্যি। তুমি বুদ্ধিমতী। তবে তখন মহারাজা অজিত সিংহও শিশু থাকবেন না।

রত্না নীরব থাকে।

—শিশুটির জন্যে তোমার সমবেদনা আমি অনুভব করছি রত্না। কিন্তু উপায় নেই।

দুর্গাদাস দ্রুতপদে চলে যায়। অনেক কাজ বাকি পড়ে রয়েছে বাইরে। কীভাবে মুঘলদের ঠেকিয়ে রাখলে শিশু-রাজা রাজধানী থেকে দূরে নিরাপদ ব্যবধানে চলে যাবার সুযোগ পাবেন সবই সে চিন্তা করে রেখেছে। এবারে গিয়ে ছক কেটে বুঝিয়ে দিতে হবে সবাইকে।

বাইরে সৈন্যদল কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেল মিষ্টান্নের ঝুড়ি নিয়ে তিনজন কর্মচারী রানির প্রাসাদ ছেড়ে বের হয়ে আসে। হয়তো রাজধানীর কোনো রাজপুত মহিলাকে পাঠানো হচ্ছে ভেবে তারা অন্য কাজে মন দিল। ধারণাও করতে পারল না তারা, তাদেরই ভেতর থেকে একজন দুজন করে পঞ্চাশজন বীর নানান অছিলায় ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। তারা লক্ষ্য করল না সকাল থেকে পথের ধারে যে অন্ধ ভিক্ষুকটি বসেছিল, যে ভিস্তিওয়ালা বারবার জল এনে দিচ্ছিল, যে নাচনেওয়ালী নেচে সৈন্যদের মন ভোলাচ্ছিল, তাদের মৃতদেহ রানির প্রাসাদের একপাশে পুঁতে ফেলা হলো। বাদশাহের গুপ্তচর তারা।

দুর্গাদাস সবই দেখল। ঠিক ঠিক কাজ হয়ে গেল। সে আলোচনায় রত। তাকে ঘিরে রাঠোর সেনাপতিগণ। এরা প্রত্যেকেই বিপক্ষের কাছে বিভীষিকা স্বরূপ। তবে অসংখ্য মুঘল সৈন্যের বিরুদ্ধে তাদের বীরত্ব এবং নিপুণতা কতটা স্থায়ী হবে, কে বলতে পারে!

তখত্‌তাউসের সামনে দাঁড়িয়ে একা বাদশাহ আওরঙ্গজেব। একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন ময়ূর সিংহাসনের দিকে। অপূর্ব! সত্যিই অপূর্ব।

মৃত পিতার সমঝদারির সুখ্যাতি না করে উপায় নেই। কিন্তু বড় বাজে খরচ। তিনি হলে কখনোই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ এ-ভাবে জলে ফেলতেন না। এর বদলে যদি ব্রহ্মদেশ দখল করার তোড়জোড় করা যেত তা-ও ছিল ভালো। এর পরিবর্তে রাজস্থানকে ভস্মীভূত করতে পারলেও লাভ হত।

তখত্‌তাউস! সত্যিই কথাটার মধ্যে উন্মাদনা রয়েছে। অথচ কাউকে বুঝতে দিলে চলবে না। ওরা জানে আওরঙ্গজেব নিজের জন্যে কিছুই করে না। ওরা ঠিকই জানে। আওরঙ্গজেব বিলাসিতা পছন্দ করে না। কিন্তু ওরা কি জানে আওরঙ্গজেব ক্ষমতাকে কতটা ভালোবাসে?

না জানে না। ওরা শুধু একটি জিনিসই সঠিকভাবে জানে যে বাদশাহ ইসলাম ধর্মকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। হ্যাঁ, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই নিঃসন্দেহে ওরা আওরঙ্গজেবের নাম দিয়েছে পীর-ই-দস্তগীর অর্থাৎ সেই পবিত্র মানব যিনি জগতের সমস্ত দুঃখদুর্দশার অবসান ঘটান।

হ্যাঁ, তাই তিনি ঘটাবেন। কিন্তু এত বাধা বিপত্তি থাকলে সেই প্রার্থিত দিন সুদূর পরাহত। বিবেক বলে জিনিস কিছুটা ঠিকই আছে আওরঙ্গজেবের। না থাকলে দারাশুকোর কনিষ্ঠ পুত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখলেন কেন? কেন তাঁর কন্যা জানি বেগমকে সস্নেহে মানুষ করেছিলেন?

কিন্তু মানুষ আওরঙ্গজেব আর বাদশাহ আওরঙ্গজেব এক নয়। এক হতে পারে না।

মনুষ্যত্ব যেখানে বাদশাহীকে ছাপিয়ে ওঠে সেখানে বাদশাহীর অপমৃত্যু ঘটে। সেই দোষে অতবড় শাহানশাহ শাহজাহানকে শেষ জীবনে বন্দি হয়ে থাকতে হলো এবং দারাশুকোকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। মুরাদকে তাই গোয়ালিয়র কিল্লায় দিনের পর দিন আফিমের বিষে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর দিন গুণতে হলো। সুজার কথা থাক।

হ্যাঁ, বাদশাহীগিরি করতে হলে, ওইসব ঠুনকো আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলে না। লোকে বলে আওরঙ্গজেব বড় নিষ্ঠুর! মুখে বলে না, মনে মনে বলে। মুখে বলতে ভয় পায়। মজা মন্দ নয়। তবু অট্টহাসি হাসা যায় না। মনে মনে উপভোগ করতে হয় মজাটুকু।

ওমরাহদের মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায়, অতি সহজেই বোঝা যায়, ওরা সবসময় অন্তরে থর থর করে কাঁপে। সেটাই দরকার।

হিন্দু বিদ্বেষ? বলুক ওরা। দেখাতেই হবে। নইলে রাজস্থান ঠান্ডা হবে না। ওদের জন্য বড় ভয়। ওরা সাংঘাতিক। হিন্দু বিদ্বেষের নামেই ওদের শায়েস্তা রাখতে হবে। ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে একটা ধুয়ো তুলতে হয়।

তাই বলে কি হিন্দু রমণীর ক্রন্দন প্রাণস্পর্শ করে না? কোথায় তফাত হিন্দু-মুসলমানের ক্রন্দনে? কিন্তু স্বীকার করলেই মুশকিল। চেপে থাকতে হয়। চেপে থাকার মতো এই স্নায়ুর জোর রয়েছে বলেই আওরঙ্গজেব আজ আলমগীর হতে পেরেছে। নইলে দারাশুকোর মতো মরুপ্রান্তরে, গিরিপথে বিতাড়িত শৃগালের মতো এতদিনে ছুটে বেড়াতে হত।

মানুষ হচ্ছে আওরঙ্গজেব, আর বাদশাহ হলো আলমগীর। আশমান-জমিন্ ফারাক! নইলে হিন্দুস্তান যে আওরঙ্গজেবের জন্মভূমি একথা তার চেয়ে দারাশুকোও বেশি জানত না। তাই মরতে হয়েছে তাকে। আর আওরঙ্গজেব আজ আলমগীর বলেই তখত্‌তাউসের পাশে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখতে পারছেন। অথচ তিনি জানেন তার নিজের ঔরসজাত জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদ এই মুহূর্তে মুরাদের মতোই গোয়ালিয়রে বন্দিদশায় অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করছে। তাই বলে আলমগীর বিচলিত নন। আওরঙ্গজেব বিচলিত হলেও আলমগীর তাকে অস্বীকার করার হিম্মত রাখে।

আওরঙ্গজেব একবার তখত্‌তাউস-এর চারদিকটা ঘুরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে তির্যক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে মনে মনে বলেন,–তোমার রক্ততৃষার শেষ নেই আমি জানি। মানুষের লোভ, শোক, প্রেম, কামনা, হাসি কান্নার মতো তোমার তৃষ্ণারও পরিমাপ করা বৃথা। তুমি অনেক রক্তক্ষয়ের কারণ হয়েছ। আরও হবে। তুমি রক্তাক্ত। আবার তুমি অফুরন্ত শক্তির উৎস। আমি শেষেরটির জন্যে তোমাকে দখলে রাখতে চাই। তার জন্যে যদি প্রথমটি ঘটে তবে আমি নাচার। শক্তি আর রক্ত ভাই-ভাই। না, না, বাদশাহ-বেগম।

আওরঙ্গজেব তখত্‌তাউসের ওপর বসেন। তিনি আপন মনে বলে চলেন,—তাই আমি যশোবন্ত সিংহের শেষ দেখতে চাই। আমি জানি, যে-শিশু জন্মগ্রহণ করেছে সে একটি স্ফুলিঙ্গ। একদিন এই স্ফুলিঙ্গই আগুন ছড়াবে। আমি চাই না—চাই না।

আওরঙ্গজেব তততাউস ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন।

—কৌন হ্যায়?

নেক-দিল এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ায়।

—মীরজা সুলতান।

নেক-দিল ছুটে চলে যায়।

কালই দুর্গাদাসের আত্মগরিমাকে ধূলিসাৎ করতে হবে। বেশি সময় দেওয়া চলবে না। ওকে একবিন্দুও বিশ্বাস নেই। বিপজ্জনক মানুষ। সময় দিলে ও অঘটন ঘটাতে পারে। বাদশাহ আলমগীর মানুষ আওরঙ্গজেবের মতো শত্রুকে দিল্লিতে পেয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না। আওরঙ্গজেব তুমি বারবার আলমগীরের পথের কাঁটা হতে চেও না।

মীরজা সুলতান অভিবাদন করে এসে দাঁড়ায়।

—কালই।

—জো হুকুম।

—দরকার হলে কামান দাগবে। শিশুকে বন্দি করতে না পারলে সমস্ত বাড়িটা মাটিতে মিশিয়ে দেবে।

—জো হুকুম।

—দাঁড়াও। বলো তো কাল কখন?

—সকালে।

—বেওয়াকুক। সকাল নয়, সন্ধ্যায়।

—জো হুকুম।

—যাও। কাল রাত্রে খবর দেবে আমায়। দুর্গাদাস আর সেই ছেলেটাকে বন্দি অবস্থায় দেখতে চাই। কিংবা তাদের মৃতদেহ।

—জো হুকুম জাঁহাপনা

মীরজা সুলতান উত্তেজনায়, আবেগে, ভয়ে আর কৃতিত্ব দেখাবার সুযোগ লাভে থর থর করে কাঁপতে থাকে।

—যাও। চিৎকার করে ওঠেন আওরঙ্গজেব।

মীরজা সুলতান বাদশাহের দিকে মুখ রেখে কুর্নিশ করতে করতে পেছু হটতে থাকে। সে ভুলে যায় দেওয়ান-ই-খাসের প্রান্ত শেষ হয়ে গিয়েছে।

সশব্দে নীচে পড়ে যায় সে।

নেক-দিল দাঁত বের করে হাসতে থাকে।

.

আক্রমণ আসে সন্ধ্যার প্রাক্কালে। এই আক্রমণের ব্যাপারে বাদশাহ কোনোরকম হীনতা দেখাননি। তিনি দুর্গাদাসকে শেষবারের মতো—তলব করেছিলেন দুপুরের দিকে কিংবা শিশু ও মাকে প্রেরণ করতে বলেছিলেন। দুর্গাদাস প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং আক্রান্ত হওয়া ছাড়া গতি ছিল না। অসীম ক্ষমতার অধিকারী যে সম্রাট তিনি যত শান্তই হন না কেন তাঁরই রাজধানীর বুকে বসে তিন-তিনবার তাঁর আদেশ অমান্য করবে এমন ব্যক্তিকে কিছুতেই সহ্য করবেন না। এই বেয়াদপি সহ্য করেন যে সম্রাট, বুঝতে হবে তাঁর সাম্রাজ্যের পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে। সুতরাং আওরঙ্গজেবের আক্রমণ যুক্তিযুক্ত। দুর্গাদাস নিজেও মনে মনে সেকথা একশোবার স্বীকার করে। সাম্রাজ্য অটুট রাখতে হলে এইসব বেয়াদপি সহ্য করা যায় না। বাদশাহও করলেন না।

যশোবন্তের পুত্র অজিত সিংহ ততক্ষণে রাজধানী থেকে বহুদূরে চলে গিয়েছেন। কারণ তাঁদের জন্য অশ্ব মজুত ছিল নানা জায়গায়। সেই অশ্বে মহারানি সৈন্যদের নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছেন রাজপুতানার দিকে। কতদিনে মাড়োয়ার আসবে—কতদিনে সেখানকার মরুভূমি সেখানকার পর্বত কন্দর ওই ক্ষুদ্র রাজপুত্রকে আশ্রয় দেবে! মাড়োয়ারের রাজধানী মুঘলের করতলগত—সেখানকার সব কিছুই মুঘলদের তত্ত্বাবধানে। তবু মরুদেশের সীমানার ভেতরে একবার প্রবেশ করতে পারলে নিরাপত্তার অভাব নেই। কারণ রাঠোররা সেখানকার পথ-ঘাট, প্রতিটি গুপ্ত গহ্বরের খবর রাখে। মুঘলের সাধ্য নেই রাজপুত্রকে খুঁজে বার করবে।

এদিকে মুঘল সৈন্য দিল্লিতে যশোবন্তের মহারানির প্রাসাদ-সংলগ্ন ক্ষুদ্র প্রান্তরে প্রবল বাধা পেয়ে মুহ্যমান। সংখ্যায় তারা অনেক ভারী। অবহেলা- ভরে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হলো। দিল্লির বাদশাহ সে-সংবাদ শুনে ক্রুদ্ধ হলেন। মীরজা সুলতানকে সেই মুহূর্তে পদচ্যুত করলেন। আগের দিনের পতনের ফলে তার গায়ে ব্যথা হয়েছিল। এবারে সে মুর্ছা গেল। নতুন সেনানায়কের অধীনে আরও শক্তিশালী সৈন্যদল পাঠালেন বাদশাহ। বাদশাহের মনে খুশির জোয়ার বইল। বাইরে ক্রোধ প্রকাশ করলেও রাজপুতদের কার্যে মনে মনে তিনি আনন্দিত। কারণ সহজ জয়ে কোনোদিনই তাঁর সন্তুষ্টি নেই। রাজপুত-বীরত্বে তিনি প্রফুল্ল। খাঁচার ভেতরে আবদ্ধ হিংস্র ব্যাঘ্র যত বীরত্বই দেখাক না কেন—সেটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। খাঁচার বাঘ আর বনের বাঘ এক নয়।

দ্বিতীয় আক্রমণ সেই রাতে না হয়ে শুরু হয় পরদিন সকালে। প্রথমে ঠিক ছিল দুর্গাদাস এখানে যুদ্ধ করে অন্যান্য বীরদের সঙ্গে প্রাণ দেবে। কিন্তু মুঘলদের প্রথম আক্রমণ প্রতিহত করে সবাই বলল যে দুর্গাদাসের চলে যেতে হবে দেশে। তার মৃত্যু হলে মাড়োয়ারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শিশু অজিত কোনোদিনও আর সিংহাসনে বসবার সুযোগ পাবেন না। দলপতিরা সবাই মিলে দুর্গাদাসকে স্থানত্যাগ করবার জন্য চাপ দিতে শুরু করল।

রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ কথাটা যুক্তিসঙ্গত। সে নিজেও জানে, তার সাহায্য ব্যতীত মহারানির পক্ষে পুত্রকে মানুষ করে তোলা অসম্ভব। তাই সঙ্গী হিসাবে আরও একশো জনকে সে নির্বাচিত করল। লোকবল থাকা চাই রাজপুতের। নইলে অনেক বিপদ ঘটতে পারে।

যুদ্ধের মোহ অসীম। তবু ছেড়ে যেতে হয় দুর্গাদাসকে। প্রতিজ্ঞা করে গেল, প্রতিশোধ সে নেবেই নেবে। যে সমস্ত বীর এখানে আত্মবিসর্জন দেবে, তাদের প্রতিজনের জন্য ফলভোগ করতে হবে বাদশাহকে।

বীরসিংহকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুর্গাদাস তাকে কাছে ডেকে বলে,—তুমিও চলো।

—না। অসম্ভব। আপনি তো জানেন।

—জানি। তবু তোমায় অনুরোধ করছি।

—আপনার আদেশ সবসময়ই আমার শিরোধার্য। তাতেই আমি অভ্যস্ত। তাই আজ আপনার কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা এ-আদেশ করবেন না। শুধু শুধু কেন যন্ত্রণা দেবেন?

দুর্গাদাস চলে যায়। যাবার সময় দেখতে পায় মুঘল সেনারা দ্বিতীয়বার এগিয়ে আসবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। এবারে তাদের সঙ্গে হাতিও রয়েছে। ছত্রভঙ্গ করে দেবে রাজপুতদের। কিন্তু ক্ষতি নেই। রাজপুত্র প্রতি মুহূর্তেই স্বদেশের নিকটবর্তী হচ্ছেন। চলতে চলতে দুর্গাদাস মনে মনে আওরঙ্গজেবকে সম্বোধন করে বলে,—আমরা তোমার সাম্রাজ্য অধিকার করতে চাইনি বাদশাহ। আমরা শুধু চেয়েছিলাম স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অস্তিত্ব অটুট রাখতে। আত্মসম্মান আমাদের বড় প্রবল। তুমি তা-ও দিলে না। ভবিষ্যতে এর জন্য হয়তো তোমাকে আফশোস করতে হবে।

দুর্গ নয়—ছোট্ট একটি অট্টালিকা। সেটা অধিকার করবার জন্যে এতবড় আয়োজন বাদশাহকে আর কখনো করতে হয়নি। আর সেই অট্টালিকা তাঁরই রাজধানী দিল্লি নগরীতে।

বাদশাহের বিরুদ্ধ-দল মুখ টিপে হাসল। বুঝল, বাইরে প্রবল প্রতাপান্বিত হলেও, ভেতরে কোথাও ঘুণ ধরেছে—যে ঘুণ এত বড় সাম্রাজ্যের গোড়াকে অশক্ত করে তুলেছে দিনের পর দিন। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সাম্রাজ্যের ভিত্তি টলে উঠবে—মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়বে। মুঘল সাম্রাজ্যের এই পরিণতিতে মনে মনে বিষণ্ণ না হয়েও পারে না তারা। কারণ মুঘলরাই ভারতবর্ষকে বহু যুগ পরে পৃথিবীর কাছে গৌরবান্বিত করেছে।

রাজপুতদের অসি ঝলসে উঠল প্রভাতের প্রথম সূর্যকিরণে। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র বিপক্ষের আগ্নেয়াস্ত্রের জবাবে গর্জে উঠল। তাদের বল্লম হাতি ঘায়েল করতে শুরু করল।

যুদ্ধ চলল বহুক্ষণ ধরে। মুঘল সেনাপতির বুক কেঁপে ওঠে। সে দেশের জন্যে যুদ্ধ করছে না—করছে পদোন্নতির মোহে। অসম সাহসিক রাজপুতদের বীরত্ব দেখে তারও ভয় হয়, মীরজা সুলতানের মতো তার চাকরিটিও বুঝি যাবে। মরিয়া হয়ে এগিয়ে আসে সে। সৈন্যদের উৎসাহ দেয়—এগিয়ে যাও। চূর্ণ করো ওদের প্রতিরোধ শক্তি।

সে দেখতে পায় না একটি তরুণ রাজপুত এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছাকাছি। সর্বাঙ্গ দিয়ে তার রক্ত ঝরছে, ঘর্মাক্ত কলেবর—অনেক মুঘলকে হত্যা করে এতটা পথ আসতে পেরেছে। তরুণটি তার বর্শা তুলে সেনাপতির বুকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেয়। অব্যর্থ লক্ষ্য। মুঘল সেনাপতি লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। পদোন্নতি তার হলো না এ-জীবনে।

কিন্তু তরুণটিকে ঘিরে ধরেছে তখন দশ-বারোজন মুঘল সৈন্য। তাদের হাতে অসি। তরুণের তলোয়ার ঘুরে চলেছে সমানে। কিছুদিন আগে এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে এসেছে সে গিরিপথে। আজ এরা তার শত্রু। তাই এদের রক্তে তার তলোয়ার রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে একা। তাকে উদ্ধার করবার জন্যে আশেপাশে একটি রাজপুতও নেই। সে জানে সেকথা, নিজেকে শত্রুমুক্ত করবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। বিপদ সম্বন্ধে সচেতন হয়েও তাই নির্বিকারযেন মৃত্যুকে বরণ করবার অতি-আগ্রহে একা এগিয়ে এসেছে শত্রুব্যূহের মধ্যে। ব্যূহ ভেদ করে কেউ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে, মহাভারতের অভিমন্যুর মতো এ-আশা তার নেই। উদ্ধার লাভের আশা নেই দেখে সে অতিমাত্রায় উল্লসিত। তার বিক্রম অতিমানবীয় এক পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় মুঘল ব্যূহে। তাই দেখে বীরসিংহ হাসতে থাকে।

বন্দুকের একটিমাত্র গুলির আওয়াজ। তরুণের তলোয়ার হাত থেকে খসে পড়ে। তার হৃদপিণ্ডের কাছের পোশাক লাল হয়ে ওঠে। একবার শুধু চোখ ফিরিয়ে দেখতে চেষ্টা করে মহারানির প্রাসাদ কতটা দূরে—পরমুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে কী যেন বলতে থাকে।

একে একে অধিকাংশ রাজপুত বীরের মৃত্যু হয়। বহুক্ষণ যুদ্ধের ফলে সমস্ত প্রতিরোধ শক্তি চূর্ণ হয়ে যায় রাঠোরদের। এবারে মুঘল সেনা এগিয়ে আসে প্রাসাদের দিকে। তাদের উল্লাসধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। সেনাপতি তাদের হত হলেও বিন্দুমাত্র তাতে পরিতাপ নেই। বৃহৎ যুদ্ধে সেনাপতি হত হলে সৈন্যদলে ত্রাসের সঞ্চার হয়। এখানে তা হয়নি। কারণ এটি যুদ্ধক্ষেত্র নয়। তাছাড়া রাজপুতদের সৈন্যসংখ্যা কত—এ খবর তাদের অজানা ছিল না।

তবু প্রাসাদের চারপাশটা দেখে তারা বিস্মিত না হয়ে পারল না। রাজপুত এবং মুঘল মিলিয়ে অসংখ্য হত এবং আহত সৈনিকে ক্ষুদ্র প্রান্তর পরিপূর্ণ! অসম যুদ্ধের এমন ফলাফল তারা জীবনে দেখেনি।

মহারানির প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এল একটি শিবিকা। সেই শিবিকায় যশোবন্তসিংহের বিধবা পত্নী এবং তার পুত্র। শিবিকাটিকে ঘিরে রেখেছে বিরাট মুঘল বাহিনী। বলা যায় না কিছুই। রাজপুতদের এতটুকু বিশ্বাস নেই। আকস্মিকভাবে হানা দিয়ে হয়তো মহারানিকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে।

শিবিকার পর্দার আড়াল থেকে দুটি অশ্রুভারাক্রান্ত নয়ন নিহত রাজপুত শবদেহ একটি একটি করে দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অস্ফুট স্বরে শুধু বলে,—বীরসিংহ! আমার বীর! কোথায় তুমি? একবার শেষ দেখাও হবে না? ওরা কি তোমায় পদদলিত করে চলে যাচ্ছে? আমার শিবিকা কি তোমার দেহের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে?

শিশুটি কেঁদে ওঠে। এতক্ষণ নিদ্রিত ছিল। ঘুম ভেঙেছে তার।

সেই সময় বারুদের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয় পশ্চাতে। সেই ভীষণ শব্দে বাদশাহের তখত্‌তাউসও কেঁপে ওঠে। মুঘল সৈন্যরা চমকিত হয়। কান বধির হয়ে যায় ক্ষণকালের জন্য। রত্না বুঝতে পারে রাজপুত বীরদের সতী সাধ্বী পত্নীরা আত্মাহুতি দিলেন। তাঁরাও চললেন স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্যে। কাঠের প্রাচুর্য নেই দিল্লিতে। বয়ে আনাও নিরাপদ নয়। তাই দুর্গাদাসের নির্দেশে এই ব্যবস্থা হয়েছিল।

রত্না যেতে পারল না ওদের সঙ্গে। তার ভাগ্য শিশু-রাজের মায়ের মতো। কর্তব্য পালনের জন্যে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে শত্রুপুরীতে অনেক বিপদের হাতছানির মধ্যে। কোমরের ক্ষুরধার অস্ত্রটি একবার দেখে নেয় সে। ঠিক আছে। বীরসিংহ শিখিয়ে দিয়েছে বুকের কোথায় বিঁধলে সে এই জীবনের মতো নিশ্চিন্ত হবে।

চলি বীরসিংহ। কর্তব্য যতদিন জীবিত রাখবে ঠিক ততদিনই এই হৃদপিণ্ডের কম্পন থাকবে। যেই মুহূর্তে কর্তব্য শেষ হবে, তোমার কাছে চলে যাব। আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। যদি মাড়োয়ারের ভূমিতে জন্মাও আমার আগে, তোমার রত্নার জন্যে চোখ মেলে থেকো। আমাকে চিনে নিও।

শিশুটি আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

শকট এগিয়ে চলে।

শকটবাহীদের চরণ রক্ত-পিচ্ছিল হয়ে ওঠে।

বীর মুঘলসেনারা এগিয়ে চলে জয়ের গান গাইতে গাইতে।

তারা সাধারণ নাগরিক। তারা রাজনীতি বোঝে না। তারা জানে, যুদ্ধ জয় করেছে তারা। বাদশাহ খুশি হবেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *