২
সংবাদ পৌঁছল দিল্লিতে। যে পাষাণ ভার চিরকাল আওরঙ্গজেবের বুককে চেপে রাখত, এতদিনে তা নেমে গেল। সেই কবেকার সম্রাট শাহজাহানের অতিপ্রিয় সেনানায়ক যশোবন্ত সিংহ এতদিনে তাঁকে নিষ্কণ্টক করলেন। অবশ্য তিনি তাঁকে নিষ্কণ্টক করতেন-ই একদিন না একদিন। কারণ অক্ষয় আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আসে না কেউ। তবু এতদিন প্রতিটি মুহূর্ত বিপদের ছায়া দেখে চমকে উঠতেন। সেই অনভিপ্রেত ছায়া কেটে গেল এতদিনে। এই অতি সুনিপুণ সেনাপতি তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা দারাশুকোকে বড়ই ভালোবাসতেন। ফলে ততাউস দখলের সংগ্রামে বেগ পেতে হয়েছিল যথেষ্ট। সেদিন বিপরীত কিছু ঘটে যাবার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তেমন ঘটলে, ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হত। সেই ইতিহাস শাহানশাহ শাহজাহানের এক অখ্যাত পুত্র হিসাবে আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করত—যেমন করবে দারাশুকো, সুজা আর মুরাদকে।
কিন্তু আওরঙ্গজেবের এই আত্মসন্তুষ্টি দেখে যুগ যুগ ধরে বিধাতা যেমন সবার অগোচরে হেসে থাকেন, বোধ হয় তেমনি হেসেছিলেন। তিনি বাদশাহের ললাটে নতুন করে লিখে দিয়েছিলেন,—কুটিলতার দ্বারা সাময়িক সাফল্য লাভ করা যায়—দীর্ঘস্থায়ী সমাধান অসম্ভব। তাই তিনি ভগ্ন-হৃদয় যশোবন্তের মহিষীর গর্ভে এনে দিলেন তাঁর বৃদ্ধবয়সের সর্বশেষ ফলটি, ইতিহাসে যে অজিত সিংহ নামে খ্যাত।
কিন্তু অজিত সিংহের চরিত্র বর্ণনা করা এক্ষেত্রে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তার মা কিংবা অন্য কোনো চরিত্র, যাদের মূল্য ঐতিহাসিকদের কাছে অসাধারণ এবং যাদের জন্য বহু চরিত্র উপেক্ষিত এবং অবহেলিত তাদের দু-একজনের জীবনের খণ্ডাংশ মাত্র ধরে রাখবার চেষ্টা করা হবে এই স্বল্প পরিসরের কাহিনীটিতে। একে ঐতিহাসিক আখ্যা দিলে ইতিহাস-প্রণেতারা রুখে উঠতে পারেন; কিন্তু ইতিহাস-আশ্রয়ী আখ্যা দিলে তাঁদের শাণিত যুক্তি অব্যবহৃত থেকে যেতে বাধ্য।
.
রানিকে সান্ত্বনা দিয়ে রত্না ফিরে আসে আপন প্রকোষ্ঠে। ভেবেছিল, একান্তে বসে মহারাজের জন্যে চোখের জল ফেলে একটু হালকা হয়ে নেবে। কিছুদিনের মধ্যে যেন প্রলয় কাণ্ড ঘটে গেল। পৃথ্বীসিংহের মৃত্যু-সংবাদ, জগৎ সিংহের মৃত্যু এবং সর্বশেষে মহারাজের তিরোধান। সমগ্র মাড়োয়ার অতি দ্রুত অনাথ হয়ে পড়ল। সৌন্দর্যমণ্ডিত যোধপুর যেন প্রচণ্ড ভূমিকম্পে মুহূর্তের মধ্যে ধুলোয় মিশে গেল। অথচ এমন ছিল না। ছিল না বলেই এই সুদূর দেশকে পরভূমি বলে মনে হয়নি। এখানকার অজানা অচেনা বৃক্ষগুলি ফুল ও ফলভারে নুয়ে পড়লে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছে এতদিন। আর সেইসঙ্গে একটা অভাববোধ সারা মন এবং শরীরকে বিষাদে ভরিয়ে তুলেছে। এক বহুশ্রুত অথচ অদেখা গিরিপথের বিপদ-সঙ্কুল অন্ধকারের ছায়া তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেখানে যুদ্ধরত সহস্র সহস্র মুঘল এবং রাজপুত সেনানীর মধ্যে রয়েছে তার বীরসিংহ।
এই বীরসিংহকে ঘিরে তার বর্তমানের চিন্তার রোমন্থন এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বীরসিংহ। বলিষ্ঠ দীর্ঘদেহী তরুণ বীরসিংহ। যুদ্ধক্ষেত্রে সে নাকি শত্রুর ত্রাস সৃষ্টি করে। অথচ দেখলে মনে হয় না। ওই কোমল মুখ, ওই সরল আয়ত চোখ দেখে কল্পনাতেও আসে না অসিহাতে সে অমন ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।
শেষবার এসেছিল মাসখানেক আগে। এসে বলেছিল—আর বেশিদিন নয় রত্না। ওরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এবারে ঘরে ফেরার পালা।
কথাটার মধ্যে কত রঙিন স্বপ্ন মিশে ছিল। সেই স্বপ্নের ছোঁয়া রত্নার মনে লেগে তাকে লাজে রাঙিয়ে তুলেছিল। উপযুক্ত উত্তরও দিতে পারেনি সেদিন, যে উত্তর বীরসিংহকে খুশিতে চঞ্চল করে তুলতে পারত। অথচ মহিষী বলেন, সে নাকি বুদ্ধিমতী। ধিক অমন বুদ্ধিতে—যে বুদ্ধি জীবনের সুন্দরতম মুহূর্তে আড়ষ্ট হয়ে থাকে।
সেই ঘরে ফেরার পালা সত্যিই এগিয়ে এল। অথচ কত পার্থক্য। যুদ্ধ- ক্লান্ত রাঠোর সেনারা নেতাহীন অবস্থায় ভগ্নহৃদয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরবে—যে ঘর এখন মুঘলদের অধীন। সেখানে স্বেচ্ছায় ঘোরাফেরা করবার স্বাধীনতাটুকুও সম্ভবত অবশিষ্ট থাকবে না।
যশোবন্ত সিংহের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করে রত্না। গাল বেয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে। বীরসিংহকে ঘিরে কল্পনার যে অপরিসীম সুখের সৌধ তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল, তা যেন ভেঙে যেতে বসেছে। বার বার মন থেকে কে যেন ডেকে বলতে লাগল—না, না, অত সুখ সইবে না, অত সুখ সইবে না। দুঃখ–পোড়া কপালে তোর রয়েছে শুধু দুঃখ।
বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে রত্নার। করজোড়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলে,—আমি ধনদৌলত চাই না ভগবান। রানি হতেও চাই না। আমি চেয়ে এসেছি শুধু বীরসিংহকে আর তার ভালোবাসাকে। আর—আর আমিও যেন ভালোবাসায় তাকে ঘিরে রাখতে পারি। হোক সে দরিদ্র। ক্ষতি নেই। মরুভূমির বাসিন্দারা কবে ক’জন ধনী হয়? তার বীরত্বটুকু শুধু নিয়ে সে একজন পরিপূর্ণ পুরুষ। সেই বীর পুরুষের বীরাঙ্গনা আমায় হতে দাও।
ঘরের কোণে একটা শব্দ হয়। চমকে ফিরে চায় রত্না। দুচোখে তার আতঙ্ক ফুটে ওঠে। এ কী দেখছে! চেয়ে দেখে বেদির ওপর স্থাপিত শিবের পটটি নীচে গড়িয়ে পড়েছে।
সে কেঁদে ওঠে।
দিল্লির বাদশাহের আদেশ এসে পৌঁছোয়। যশোবন্ত সিংহের যে সমস্ত মহিষী জীবিত রয়েছে তাদের এবং তার পরিবারবর্গের সবাইকে অবিলম্বে দিল্লিতে প্রেরণ করা হোক। আদেশ শুনে মহারাজার বিশ্বস্ত অনুচর দুর্গাদাসের ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে ওঠে চিন্তায়। বাদশাহ কি মহারানির ভাবী সন্তানের বিষয় অবগত হয়েছেন? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সে সংবাদ তো কেউ জানে না এ পর্যন্ত। জানে শুধু কয়েকজন অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি। অনেক চিন্তার পর দুর্গাদাস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে বাদশাহের সন্দেহপ্রবণ চিত্ত যাচাই করে নিতে চায় মহারাজের পরিবারে এমন কেউ রয়েছে কিনা ভবিষ্যতে যে তাঁর পথের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে। থাকলে নিশ্চয় তাকে ধ্বংস করবেন তিনি। এতে সমূহ বিপদ রয়েছে। কারণ দিল্লিতে পৌঁছাবার আগেই রানির সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে এবং সে কথা গোপন রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। রাজপুতদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বিরল বটে, তবে বিপুল অর্থের বিনিময়ে কোনো দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি প্রলোভনে পড়ে আসল সত্য বলে দিতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে
দুর্গাদাসের চিন্তার সূত্রপাত এইখানেই। মহারাজের সন্তান কন্যা হলে কিছু করবার নেই। কিন্তু সে যদি পুত্র হয় তবে তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। মাড়োয়ার এখন মুঘলের করতলগত। যে মাড়োয়ারের প্রতিটি ধূলিকণার জন্যে বীরেরা প্রাণ দিতে পারে সেই পবিত্র এবং অতিপ্রিয় মাতৃভূমি শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খল ছিন্ন করবার একটি মাত্র পথই রয়েছে। তা হল মহারাজের বংশধরকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে সাবালক করে তোলা। ভবিষ্যতে কোনো একদিন সেই তরুণ রাজা যদি রাঠোরদের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বলে—আমার জন্যে তোমরা আত্মবিসর্জন দাও, তোমাদের মাতৃভূমি আমি উদ্ধার করব। সেদিন বীরের পদভরে সমগ্র রাজস্থান প্রকম্পিত হয়ে উঠবে।
ভাবতে ভাবতে দুর্গাদাস দৃঢ়হস্তে তার তলোয়ার কোষমুক্ত করেন সম্মুখে উপবিষ্ট চন্দ্রভান কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,—কি হল?
দুর্গাদাস যথাস্থানে তলোয়ার রেখে ধীরে ধীরে বলে,—হল অনেক কিছুই।
চন্দ্রভান একটু সময় নিয়ে বলে,—আমি জানি
—কী?
—বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
—ঠিক। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বাঁচাতে হবে। রাজি?
—আমায় প্রশ্ন করছ?
—হ্যাঁ চন্দ্রভান, তোমাকে দিয়েই শুরু করছি।
—দুর্গাদাস, রাঠোরদের বড় ছোট করে দেখছ তুমি। চলে যাও দেশে। দিনের পর দিন অনাহারে থেকে যে মানুষটি কঙ্কালসার হয়েছে, তাকে গিয়ে এই একই প্রশ্ন কর—সে-ও রাজি।
দুর্গাদাসের চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে—জানি ভাই। কিন্তু এত ব্যাপকভাবে সবাইকে জানালে তো চলবে না এখন। গোপন রাখতে হবে। অতি বিশ্বস্ত কয়েকশত রাঠোর যাদের কাছে টাকাপয়সা ধনদৌলত তৃণবৎ, শুধু তাদেরই জানাতে হবে। কারণ তারাই হবে আজ থেকে অন্তত ষোলোবছরের জন্য ভাবী মহারাজের রক্ষক। জানি না তিনি সত্যিই মহারাজা হিসাবে ভূমিষ্ঠ হবেন কিনা
—ভগবান আমাদের নিরাশ করতে পারেন না দুর্গাদাস
—আমারও মনে সেই বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে।
উভয়ের আলোচনা চলছিল—যশোবন্ত সিংহরে অস্থায়ী আবাসে যেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সেই অপ্রসিদ্ধ গ্রামে তখন সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসছিল। দূরে মসজিদে মসজিদে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। অন্যদিন হলে মহারাজের আবাসেও চাপা শঙ্খধ্বনি শ্রুত হত। কিন্তু কিছুদিন থেকে সেই পরিচিত মঙ্গলধ্বনি কর্ণগোচর হয় না। মহারাজের মৃত্যু শঙ্খের কণ্ঠরোধ করেছে।
দ্বারদেশে রত্না এসে উপস্থিত হয়। মহিষীর পরিচারিকাকে ওরা চেনে। অন্তত এ-কয়েকদিনে খুব ভালোভাবেই চিনেছে। কারণ মহিষীর সেবাযত্ন সবকিছুই সে করছে। তাঁর সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্রও বলতে গেলে সে। মেয়েটির নম্র স্বভাব তাদের আকৃষ্ট করে—পছন্দ করে তাকে।
—কাকা।
—কী মা।
—মহারানি জানতে চাইলেন কবে নাগাদ আমাদের রওনা হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
—যত শিগগির সম্ভব। হয়তো দু-তিন দিনের মধ্যেই।
রত্নার বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে। এত তাড়তাড়ি? কিন্তু সে যে এল না এখনো। তাকে মুঘলসৈন্যের মধ্যে ফেলে রেখেই কি এরা দিল্লি অভিমুখে রওনা হবে?। এরা গেলে যে আমাকে ও যেতে হবে।
সে অতি শান্ত কণ্ঠে বলে,—যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সব রাঠোরই কি চলে এসেছে?
—তুমি কি বলতে চাইছ বুঝলাম না।
রত্না লজ্জিত হয়। তার সারা মন জুড়ে রয়েছে আশঙ্কা। তাই বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। উচিত হয়নি এভাবে বলা। ব্যক্তিগত স্বার্থ দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় হতে পারে না। তাড়াতাড়ি বলে,—রানিমা কি অরক্ষিত অবস্থায় রওনা হবেন?
—উপযুক্ত ব্যবস্থা একটা করতে হবেই। রানিমার কোনোরকম দুশ্চিন্তার কারণ নেই
রত্না চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে মহাবীর দুর্গাদাসকে অবান্তর প্রশ্ন করা সম্ভব নয়। মহিষীর নাম করেও নয়। একটি প্রশ্ন করেই বুঝতে পেরেছে কতখানি মূর্খ হলে অমন কথা মুখ থেকে বের হতে পারে। কারণ যার গর্ভে ভবিষ্যতের রাঠোর-নৃপতি রয়েছে, তাকে অরক্ষিত অবস্থায় দুর্গাদাস কখনোই নিয়ে যেতে পারে না। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে।
—আর কিছু জানবার আছে মা?
—সবাই কবে নাগাদ ফিরবে কাকাবাবু?
—কোথা থেকে?
—যুদ্ধক্ষেত্র থেকে।
—সেখানে মুঘল সেনারা থাকবে কিছুদিন। নতুন সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছেন। প্রয়োজন হলে তিনি তাদের চালিত করবেন।
—আমি রাজপুতদের কথা বলছি।
দুর্গাদাস কঠিন স্বরে বলে ওঠে—যারা যুদ্ধক্ষেত্রে ভূমি নেয় তারা কখনও ফিরে আসে না! বাকি সবাই ফিরেছে।
রত্না ছুটে বের হয়ে যায়। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সমস্ত পৃথিবী তার চোখের সামনে বনবন করে ঘুরতে থাকে। সে দু’হাতে বুক চেপে ধরে। খুব স্পষ্ট আর সোজা উত্তর সে পেয়ে গিয়েছে। দুর্গাদাস জানল না ওই উত্তর রত্নার বুকের পাঁজর ভেঙে দিয়ে, তার জীবনের সব সাধ, সব কল্পনা, সব আশাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
অন্তরে হাহাকার, চোখে উদ্যত অশ্রু-হয়তো এখনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়বে রত্না। এই অবস্থায় ছুটতে ছুটতে সে মহারাজের বাসস্থানের অনতিদূরে এক নির্জন স্থানে গিয়ে ধুলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে দুই হাত দিয়ে প্রাণপণে মাটি আঁকড়ে ধরে। তার চোখে অশ্রুর বন্যা।
বীরসিংহ নেই? সবাই ফিরে এসেছে। শুধু তারাই আসেনি যারা খাইবার গিরিপথের অপ্রশস্ত স্থানে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। বীরসিংহ আসেনি। সে ফিরে আসেনি। পড়ে রয়েছে অন্যান্য বীরের সঙ্গে রাক্ষসী খাইবারে।
হায় বীরসিংহ! কেন তুমি এমন করলে! মুক্ত অসি হস্তে যখন উন্মত্তের মতো শত্রুর দিকে ধাবিত হলে একবারও কেন তখন তোমার অভাগীর কথা মনে পড়ল না? তাহলে তো অমনভাবে ধেয়ে যেতে না। তুমি বলতে, বাইরের শত্রুরা যখন আক্রমণ করতে আসে তখন গোটা ভারতবর্ষকেই দেশ বলে মনে হয়। মুঘল-রাজপুত ভেদ থাকে না। কিন্তু তবু নিজের মাতৃভূমির জন্যে যুদ্ধের মতো তীব্র প্রেরণা পাওয়া যায় না। তবে কেন এমন করলে? কেন এতটুকু সংযত হলে না। আমি তো জানি, তুমি যদি একটু সাবধান হতে তবে তোমার কেশাগ্র স্পর্শ করবার মতো ক্ষমতাবান পুরুষ বিরল। তোমার এই নিপুণতার জন্যেই তুমি শেষ পর্যন্ত মহারাজের মুষ্টিমেয় পার্শ্বচরদের মধ্যে এত অল্প বয়সে স্থান পেয়েছিলে। তুমি বলতে, মাড়োয়ারের জন্যে না হলেও মহারাজের সম্মানের জন্য এ যুদ্ধ। কিন্তু মহারাজ যখন অসুস্থ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এলেন, সঙ্গে যখন দুর্গাদাস, চন্দ্রভান, শংকর সিংহ, বরমল, যোধা সিংহ প্রভৃতি বীরেরা ফিরে এলেন তখন তুমিও কেন চলে এলে না তাঁদের সঙ্গে? আমি যে প্রতিটি দিন, প্রতিটি পল তোমারই অপেক্ষায় বসেছিলাম। আমার হৃদয় প্রতিটি মুহূর্ত তোমারই বিরহে কেঁদেছে। তুমি কি সেই ক্রন্দন শুনতে পাওনি? নিশ্চয়ই পেয়েছিলে। তবে?
রত্নার ক্রন্দনধ্বনি সন্ধ্যার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও বেশি দূর যায় না। বড় চাপা সেই ক্রন্দন—তারই স্বভাবের মতো চাপা।
বীরসিংহ! জানি না, হয়তো মহারাজ তোমারই ওপর সৈন্যদলের ভার দিয়ে এসেছিলেন। কিংবা—কিংবা তুমি কি স্বেচ্ছায় আত্মবিসর্জন দিলে? বন্দিনী মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার কথা চিন্তা করতে তোমার বক্ষ কি বিদীর্ণ হত? জানি না। এখন তুমি বহু ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের স্নেহচ্ছায়ায় বসে রয়েছ। রত্না নামে ধরিত্রীর এক অখ্যাতা অভাগিনীর স্মৃতি এর মধ্যেই তোমার কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সত্যিই যদি স্বেচ্ছায় মরণের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে থাকো, তবে কার ওপর মাতৃভূমি উদ্ধারের ভার সঁপে গেলে? তোমার ভূমিকা এ ব্যাপারে নেহাৎ নগণ্য হত না। দুর্গাদাস, শঙ্কর সিংহ, চন্দ্রভান—এঁরা বীর হলেও তোমার মতো তরুণ নন। কতদিন এঁরা সক্ষম থাকবেন?
আলো জ্বলে ওঠে অল্প দূরে মহারাজার অস্থায়ী আবাসের প্রকোষ্ঠগুলিতে। রাজমহিষী নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাঁকে খুঁজছেন। সে ছাড়া তাঁকে তেমনভাবে আর কেউ প্রবোধ দিতে পারে না। অথচ রত্নার খেয়াল নেই। তার অশ্রুর প্লাবন শুষ্ক ভূমি শুষে নিতে থাকে। তার তপ্ত দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় গিয়ে মেশে। তার বক্ষের উত্থান-পতন বিন্দুমাত্র কম্পন জাগাতে পারে না সীমান্তের ভূমিতে। সে নিজেও জানে, সব বৃথা—যে যায় সে আর ফেরে না। যে ফুল একবার ঝরে পড়ে তা আর ফোটে না। তবু যতদিন বেঁচে থাকবে এইভাবেই কাটাতে হবে তাকে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় রত্না। কর্তব্য। মহিষী যেমন কর্তব্যের খাতিরে জীবিত রয়েছেন তাকেও তেমনি বাঁচতে হবে। তার কর্তব্য মহিষীর কর্তব্যের তুলনায় কিছুই নয়—তবু বেঁচে থাকতে হবে। যতদিন রানি তাকে তাঁর পাশে চাইবেন থাকতেই হবে তাকে। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মাতৃভূমির ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছু।
রত্না চলতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে তার পদক্ষেপ নিয়মিত নয়—তার সমস্ত শরীর অবশ। তবু জোর করে সে এগিয়ে যায়। সে দেখতে পায় দুর্গাদাস যে-ঘরে চন্দ্রভানের সঙ্গে আলোচনায় রত ছিলেন সেখানে বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ হয়নি। বাদশাহের আদেশ অবিলম্বে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। সেই আদেশ সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করতে অনেক কিছু ব্যবস্থার প্রয়োজন
রত্না আর একটু সেদিকে এগিয়ে যায়। সে বাতায়ন-পথে দেখতে পায় কম্পিত প্রদীপশিখা দেওয়ালে ছায়া ফেলেছে একটি মনুষ্য-মূর্তির। দুর্গাদাসের অথবা চন্দ্রভানের? কিন্তু না—তা তো নয়। দণ্ডায়মান ছায়াটির আকৃতি অন্যধরনের। দীর্ঘদেহী, ঋজু, পেশিবহুল—অথচ আদৌ স্থূল নয়।
না, না, এভাবে অলীক কল্পনা করে বারবার আঘাত পেয়ে লাভ নেই। দীর্ঘদেহী পুরুষের অভাব নেই রাজপুতানায়। তবু দাঁড়িয়ে থাকে রত্না। সরে যেতে পারে না। ইচ্ছে হয় আর একটু এগিয়ে যেতে—কণ্ঠস্বর যদি শোনা যায়। হে ঈশ্বর! পৃথিবীতে অনেক কিছু অসম্ভবই তো তুমি সম্ভব করাও। তেমন কিছু কি ঘটাতে পারো না যার ফলে বীরসিংহ আবার জীবন পায়?
দীর্ঘ ছায়াটি সরে যায়। এদিকের দরজা খুলে যায়। অন্ধকারের মধ্যে পুরুষটি এগিয়ে আসে। রত্না তাড়াতাড়ি পাশে সরে যাবার চেষ্টা করে। এই স্থানে, এ অবস্থায়, এই সময়ে তাকে দেখে নিশ্চয়ই ভাববে পুরুষটি, মহিষীর পরিচারিকা দুশ্চরিত্রা।
দ্রুত এগিয়ে আসে পুরুষ। রত্না ওড়নায় মুখ ঢেকে ঘুরে দাঁড়ায়।
পুরুষ থেমে যায় তার পাশে। রত্নার বুক কাঁপে—যদি চিনতে পারে?
পুরুষ প্রশ্ন করে—কে তুমি?
রত্নার মুখের ওড়না খসে পড়ে। সে-ও কোনোমতে মানুষটির দিকে ঘুরে বলে—কে?
—রত্না!
পুরুষটি দেখতে পায় রত্নার দেহ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। তৎপরতার সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলে। অন্ধকারের মধ্যেও সে বুঝতে পারে রত্না জ্ঞান হারিয়েছে।
—রত্না—রত্না! তুমি কি অসুস্থ? রত্না একবার চেয়ে দেখো, আমি বীরসিংহ। আমি ফিরে এসেছি রত্না।
বীরসিংহ একদৃষ্টে রত্নার মুখের দিকে চেয়ে থাকে অস্পষ্ট অন্ধকারে। রত্নার দেহ মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। অনেক যুদ্ধের রক্ত-ঝরানো বীরের বক্ষও দুরুদুরু করে। রত্না কি অসুস্থ? সে কি মৃত্যু-পথ-যাত্রিণী?
অনেকক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রত্না। তার চোখ উন্মীলিত হয়।
বীরসিংহ দু’হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে ডাকে,—রত্না কথা বলো। আমি বীরসিংহ। আমাকে তুমি ভুলে গিয়েছ রত্না?
রত্না তার দুর্বল হাত তুলে বীরসিংহের মুখের ওপর বুলিয়ে চলে—তার সর্বাঙ্গে হাত দিয়ে দেখে।
অবশেষে কেঁদে উঠে বলে,—তবে যে ওরা বলল তুমি নেই
—আমি নেই? কোথায় যাব আমি তোমাকে ছেড়ে? দেশে?
-–না, না, তা নয়। আমি ঠিক উচ্চারণ করতে পারছি না।
—ও বুঝেছি। কিন্তু একথা কে বলল তোমায়?
—না না, কেউ বলেনি। শুধু বলল, সবাই ফিরে এসেছে গিরিপথ থেকে—সব রাজপুত। কিন্তু তোমায় যে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
—আমি সবার শেষে এসেছি রত্না। দুর্গাদাস আমাকে একটা বিশেষ কাজে সেখানে রেখেছিলেন।
অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়। শুধু দুই তরুণ-তরুণী নগ্ন প্রকৃতির বুকে বহুক্ষণ একইভাবে থাকে। রত্নার উঠে বসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তখনও তার মনে মনে ভয় হয়তো স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন টুটলেই নিষ্ঠুর সত্যের সম্মুখীন হতে হবে। এই মধুর স্বপ্ন তবু ভালো। উঠে বসলে যদি ঘুম ভেঙে যায়?
তাছাড়া বীরের প্রেয়সীদের বড় জ্বালা। তাদের কোন মিলন যে শেষ মিলন কেউ বলতে পারে না। স্বয়ং বিধাতাও কি পারেন? তার চেয়ে এই ভালো—যতক্ষণ বীরসিংহের নিকটতম সান্নিধ্যে থাকা যায় ততক্ষণই সুখ।
—রত্না। এবারে যে আমাদের উঠতে হবে। রাত অনেক হতে চলল।
—হ্যাঁ। উঠতে হবে। কিন্তু উঠতে যে ইচ্ছে হয় না বীরসিংহ।
—জানি রত্না। অথচ উপায় নেই। আজ রাতের মধ্যে আমাকে অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের রওনা হতে আর দেরি নেই বেশিদিন।
—কবে যাব আমরা?
—জানি না। দুর্গাদাস বলতে পারেন।
রত্না এবারে উঠে বসে। অন্ধকারের মধ্যে বীরসিংহের গ্রীবাদেশ দু’হাতে বেষ্টন করে তার মুখের ভেতরে কী দেখতে চায় সে-ই শুধু বলতে পারে।
তারপর সহসা উঠে দাঁড়ায়। বলে ওঠে,—আমার খুব অন্যায় হয়ে গিয়েছে। মহিষী এতক্ষণ একা রয়েছেন। হয়তো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়েছেন। আমি স্বার্থপর। মহিষীর দুঃখের চেয়ে আমার সুখই বড় হল?
—তুমি যাও রত্না। অন্যায় কিছু করোনি। তুমি সুস্থ ছিলে না। কাল আবার দেখা হবে। রত্না ধীরে ধীরে চলে যায়। বীরসিংহ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রত্নাকে নিয়ে নিজের দেশে গিয়ে ঘর বাঁধার কল্পনা চিরকাল কল্পনাই থেকে যাবে হয়তো। এর মধ্যে কত বিপদ রয়েছে, কত রক্তক্ষয়। তারপরেও কি দুজনা একসাথে গ্রামে ফিরতে পারবে? বিধাতা জানেন। তবে আশা নিয়েই তো বেঁচে থাকে সবাই। সে-ও বাঁচবে। আশাই তার প্রেরণা।
বাইরে পদশব্দ। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন—কে ওখানে?
—আমি।
—আমি কে?
—আমি বীরসিংহ।
—বীরসিংহ? অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? দুর্গাদাস কাছে আসেন।
—ভাবছিলাম।
—সেটা অপরাধ। চিন্তার ভারটা আপাতত আমিই নিয়েছি। তোমরা শুধু কাজ করে যাও। চিন্তা মানুষকে ক্লিষ্ট করে, দুর্বল করে। যাও অবশেষে যাত্রা শুরু হয়। দিল্লি অনেক দূরের পথ। মুঘল সৈন্য নবনিযুক্ত সেনাপতির অধীনে থেকে যায়। শুধু রাজপুতেরা যশোবন্ত সিংহের পরিবারের সঙ্গে রওনা হয়।
শকটের ব্যবস্থা হয়েছে রমণী শিশু আর আহত ব্যক্তিদের জন্য। অবশিষ্ট সবাই পায়ে হেঁটে চলেছে। পায়ে হাঁটায় তারা অভ্যস্ত। এইভাবে কতবার তারা সারা ভারতবর্ষের দিকে দিকে অসি হাতে ছুটে গিয়েছে শাহনশাহ শাহজাহানের আমলে। তখন তাদের ধমণীর শোণিতস্রোত ছিল উষ্ণ, অন্তরে ছিল প্রবল প্রেরণা, কারণ যশোবন্ত সিংহ তখন ছিলেন যুবক।
তারপর দিল্লির মসনদে বসেছেন নতুন বাদশা। তাঁর কূটনীতি, দৃষ্টিভঙ্গী সবকিছুই অন্যধরনের। তাছাড়া মহারাজাও আর যুবক ছিলেন না। তাই তাঁর চিরকালের সাথী এখনকার প্রবীণ যোদ্ধারা আর আগের মতো উৎসাহভরে পথ চলতে পারে না। দেশে প্রত্যাবর্তনের মোহও নেই। দেশ পরাধীন।
তবু মাঝে মাঝে তারা তরুণ সৈন্যদের উৎসাহের বাণী শোনায়। বলে, অ্যাইসা দিন নেহি রহেগা। দিন কখনও সমান যায় না। উত্থান-পতনই সংসারের নিয়ম-পৃথিবীর নিয়ম। সেই নিয়মকে সংযতভাবে স্থিরচিত্তে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। রাজ্য বা সাম্রাজ্যও সে নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। তাই ভগ্নোদ্যম হওয়া কাজের কথা নয়। ভগ্নোদ্যম হওয়ার অর্থই হল নিশ্চিত পরাজয়ের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া।
—বীরসিংহ। দুর্গাদাস ডাকে।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে বীরসিংহ।
—মহারানির শকটের পেছনে পেছনে চলবার প্রয়োজন নেই তোমার। তুমি বরং আরও একটু পেছনে থাকো।
রৌদ্রতপ্ত বীরসিংহের গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল এমনিতেই রক্তবর্ণ ছিল তাই তার লজ্জা দৃষ্টিগোচর হল না কারও। মহারানির শকটের একেবারে পেছনে বসে রয়েছে রত্না। রত্নার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করতে করতে বিনা আয়াসে সে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসেছে—এতটুকু ক্লান্তি অনুভব করেনি। খাবার কথাও মনে পড়েনি। গতকাল রত্নাই ইসারায় তাকে খেয়ে নিতে বলেছিল। নইলে খাওয়াই হত না। রত্নার নিজেরও কি মনে পড়ত? রানিমার খাবার সময় হয়েছিল বলেই মনে পড়ে গিয়েছিল।
দুর্গাদাসের আদেশে রত্নার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করতে করতে পথ চলবার উপায় রইল না। বিষণ্ণ হল বীরসিংহ। কিন্তু কর্তব্য সবার আগে। দুর্গাদাস সব কিছু ভেবেচিন্তে স্থির করে। হয়তো সে ভেবেছে, দিল্লিতে ডেকে পাঠালেও মনে মনে অন্য মতলব রয়েছে বাদশাহের। পথিমধ্যে যশোবন্ত পরিবারকে নির্মূল করে দেবার প্রচেষ্টাও বিচিত্র নয়। তাই এত সাবধানতা। তাছাড়া নবজাতকের ভূমিষ্ঠ হবার সংবাদ যতটা সম্ভব গোপন রাখবার চেষ্টা করতে হবে। লোক জানাজানি হলে, ততাউসের সামনে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে সেই বার্তা সর্বপ্রথম ঘোষণা করবার বাহাদুরি নেবার মানুষের অভাব নেই। অর্থলোভ সাংঘাতিক জিনিস।
পেছনে চলে যাবার সময় রানির শকটের দিকে দৃষ্টি পড়ে বীরসিংহর। দেখতে পায় রত্না উদ্বেগাকুল চোখে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। হাত উলটে ইশারায় বীরসিংহ বলে, সবার পেছনে চলে যাচ্ছে সে–দেখা হবার সুযোগ রইবে না আপাতত। তবে প্রথম যেখানে বিশ্রাম নেবে সবাই, শকটের বলীবর্দ এবং অশ্বদের যেখানে দীর্ঘ বিশ্রাম দেওয়া হবে, সেখানে তারা মিলিত হবে।
এতক্ষণ ইশারায় বলা সম্ভব নয় বলে মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু একই সুরে যদি বাঁধা থাকে দুটি প্রাণ, তবে এর চেয়ে আরও অনেক গভীর এবং বেশি কথা শুধু চোখের ভাষায় বোঝানো যায়।
বীরসিংহ ভাবতে ভাবতে পেছনের দিকে সরে যায়। ক’দিন আগের সন্ধ্যার ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারে না সে। সে-দৃশ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সজীব রইবে। রত্না ঢলে পড়েছিল মাটিতে—তার অচেতন দেহ বুকে নিয়ে সেইখানেই বসে পড়েছিল সে। বহুক্ষণ পরে চোখ মেলেছিল রত্না। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। তার বিচিত্র আচরণের কারণ কিছুতেই অনুমান করতে পারেনি বীরসিংহ। কারণ এতদিন অনেক কথা, অনেক ইশারার মধ্যে এভাবে ধরা দেয়নি সে। বীরসিংহ জানত না মুহূর্তকাল পূর্বেও রত্নার কাছে সে ছিল মৃত।
.