১
স্তব্ধ মহিষীর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ল।
তারই সামনে দিয়ে একে একে অন্যান্য রানিরা চিতায় গিয়ে আরোহণ করে। নয়ন তাদের শুষ্ক। মুখে তাদের প্রত্যাশার পরিতৃপ্তি। স্বামী মৃত। কিন্তু মৃত্যুতেই তো সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যায় না। আছে পরকাল—আছে স্বর্গ। স্বামী তাদের অপেক্ষা করছেন সেখানে। তাঁর সাধ্বী পত্নীরা চলেছে এক নতুন অভিসারে। ক্ষণেক বিরহের পর অগ্নির সাহচর্যে পবিত্র আত্মা নিয়ে চিরমিলনের পথে এই অভিসার।
শুধু একজন ছাড়া। তাই তার নয়নে আজ তপ্ত অশ্রুর ধারা। শেষ মহিষী চন্দ্রাবতী এগিয়ে এল কাছে। ওড়নায় তার চোখের জল মুছিয়ে বিদায় নেবার বেলায় বলে গেল,–কেঁদো না ভাই কর্তব্য তোমায় আরও কিছুদিন এই পৃথিবীতে রাখতে বাধ্য করল। বড় পবিত্র এই কর্তব্য। তোমার গর্ভে যে রয়েছে সে ছাড়া আর তো কেউ রইল না রাজার বংশে।
—কিন্তু কী করে থাকব আমি? উনি আমায় যেতে না দেখে কী ভাববেন? ভাববেন, আমি সতী নই।
—ছি ছি। ওকথা মুখে এনো না। তুমিই শ্রেষ্ঠ সতী। তোমার জন্য রাজা অপেক্ষা করবেন। নিশ্চিন্তে থেকো। আর মাত্র কয়েকটি বছর। মহাকালের তুলনায় পৃথিবীর এই সময়ের দৈর্ঘ্য কতটুকুই বা।
ওই তো স্বামীর শবদেহ। সজ্জিত চিতার ওপর শান্তভাবে নিদ্রিত রয়েছেন যেন। বয়সে প্রবীণ, অথচ যৌবনের দীপ্তি এখনো সুস্পষ্টভাবে লেগে রয়েছে সর্ব অবয়বে। সবাই তাঁর সঙ্গিনী। শুধু সে পড়ে রইল। পড়ে রইল রাজার প্রেমের শেষ ফুল ফোটবার অপেক্ষায়।
রাজা যশোবন্ত কি জানতেন না তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সে হিন্দুস্থানের সীমান্তে অরণ্যসঙ্কুল পার্বত্য অঞ্চলে কেন পাঠানো হয়েছে? জানতেন ঠিকই। কিন্তু জেনেও কিছু বলতে পারেননি। কারণ বাদশাহ আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তাঁকে বেশ কয়েকবার অস্ত্রধারণ করতে হয়েছিল তিনি তখত্তাউসে বসবার আগে। এবং পরেও কয়েকবার বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে ধাতুগত পার্থক্য যা কখনও মিশ খাবে না। তেলে আর জলে কখনও কি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে?
অথচ শাহানশাহ শাহজাহানের সময়ে তাঁর দিন কত সুখে কেটেছে। শাহানশাহের জন্যে একবার নয়, অসংখ্যবার তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জীবন বিপন্ন করেছেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশুকোর প্রতিও যশোবন্তের সহানুভূতির অভাব ছিল না। দারাশুকো যদি একটুখানি বাস্তব-বুদ্ধিসম্পন্ন হত, কল্পলোকে বিচরণ করা কিছুটা হ্রাস করত তাহলে হয়তো বৃদ্ধ শাহজাহানকে শেষজীবনে বন্দিজীবন যাপন করতে হত না।
আওরঙ্গজেব ভালোভাবেই জানতেন যশোবন্তের মনোভাব। তিনি জানতেন বিধর্মীর প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণাকে যশোবন্ত মনে মনে কখনও বরদাস্ত করতে পারবেন না।
কত সময়ে যশোবন্ত বলেছেন,—বাদশাহ, এই দেশের সবাইকে কখনও আপনি ইসলামধর্ম গ্রহণ করাতে পারবেন না। শুধু শুধু কেন এতটা অধৈর্য হয়ে ওঠেন।
—দেখা যাক পারি কি না।
—একটা জিনিস শুধু লক্ষ্য করবেন বাদশাহ, কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ আর কোন ধর্ম নিকৃষ্ট এ প্রশ্ন না তুলেও আপনি দেখতে পাবেন মানুষ তার শৈশবের ধর্মকে সহসা ছাড়তে চায় না।
—কেন মহারাজা, আপনাদের প্রিয়তম দারাশুকো তো ছেড়েছিল।
—ছি ছি বাদশাহ, ওকথা বলবেন না। ইসলাম ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। শুধু তার অদম্য জ্ঞানতৃষ্ণা অন্য ধর্মের ভেতর থেকে রত্ন খুঁজে দেখতে উৎসাহী হয়েছিল।
—রত্ন! আপনি কি বিশ্বাস করেন মহারাজ অন্য ধর্মে রত্ন বলে কিছু আছে?
—জানি না।
—আপনার জবাবটা ক্রোধের নামান্তর।
—আপনার সম্মুখে ক্রোধ প্রকাশ অমার্জনীয় অপরাধ।
—আমিও তাই মনে করি।
এর কিছুদিন পরেই বাদশাহ যশোবন্তকে আবার ডেকে পাঠালেন। তিনি হুকুম দিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধযাত্রা করতে।
যশোবন্ত সেই আদেশ শিরোধার্য করে নিলেন। না নিয়ে উপায় ছিল না। ঘাতকের হস্তে প্রাণ বিসর্জনের সমুহ সম্ভাবনা ছিল। তাঁর গগনচুম্বী প্রতিষ্ঠা আওরঙ্গজেবকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত করেছিল। কারণ তাঁর মতো চতুর শাসনকর্তা বুঝতে পেরেছিলেন সবাইকে যেভাবে অনায়াসে পৃথিবী থেকে সরিয়েছেন, যশোবন্তকে ঠিক সেভাবে সরানো যাবে না। তাঁর পেছনে রয়েছে রাজস্থানের অনেক নৃপতি। এইসব নৃপতিরা আর কিছু না পারুক, দিল্লিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে। এটা তিনি চান না।
এতদিনে আওরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। ওই তো শায়িত রয়েছেন বৃদ্ধ মহারাজ। নয়নদ্বয় নিমীলিত। মুখে বিন্দুমাত্র ক্ষোভের চিহ্ন নেই। চিতার উপর যেন তিনি নিশ্চিন্তে নিদ্ৰা যাচ্ছেন।
দেখে যাও আওরঙ্গজেব। তোমার চিরশত্রু আর তোমার পথের কাঁটা হয়ে দেখা দেবেন না। তুমি নিশ্চিন্তে এগিয়ে চলো। সম্মুখে রয়েছে তোমার জয়যাত্রার সুদীর্ঘ পথ। তুমি তোমার পিতাকে ক্ষমা করোনি। ভ্রাতাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুকম্পা জাগেনি তোমার মনে। তাদের রক্ত তোমায় আনন্দ দিয়েছে। নিজের পুত্রকেও তুমি ভয় পাও। ঘুমের মধ্যে কেঁপে ওঠো। ভাবো, তুমিও বুঝি হবে দ্বিতীয় শাহজাহান—বন্দিশালায় বন্দি অবস্থায়।
ভয় নেই বাদশাহ। তোমার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। তুমি অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলবে। শুধু ভয় হয়, তোমার প্রভাব যদি পরবর্তীকালের অপর কোনো বাদশাহের ওপর গিয়ে পড়ে।
মহিষী একাকী মৃত স্বামীর দিকে অপলকদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আর হাজার চিন্তা তার মাথার ভেতরে তালগোল পাকাতে থাকে।
আওরঙ্গজেব কবে এই মৃত্যুসংবাদ পাবেন? পেয়ে নিশ্চয়ই আনন্দে চিৎকার করে উঠবেন। দারার হত্যার পরও তিনি নাকি সব সংযমকে বিসর্জন দিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
সহসা মহিষীর চিন্তাস্রোত স্তব্ধ হয়। চিতার পাশের রাজপুতরা সবাই একটি করে মশাল জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে দাঁড়ায়। এইবার—এইবার তার স্বামীর নশ্বর দেহ চিরকালের জন্যে বিলুপ্ত হবে। ওই দেহকে কত ভাবে যে সে সেবা করেছে। হায় ভগবান। ওই দেহ নশ্বর জেনেও এত মোহ কেন?
ওই যে রানি চন্দ্রাবতী এগিয়ে চলেছেন। তাঁরই জন্যে এতক্ষণ সবাই অপেক্ষা করছিল। অন্যান্য নারীরা চিতার পাশে গিয়ে বসে রয়েছে। সবাই একসঙ্গে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।
রানি চন্দ্রাবতী সবশেষে চিতায় গিয়ে ওঠেন। অগ্নি প্রজ্বলিত হলো। মুহূর্তের মধ্যে সেই আগুন ধুম উদ্গীরণ করতে করতে তার লেলিহান শিখায় গগন স্পর্শ করতে চাইল। চারদিকে জয়ধ্বনি। সতীদের কারও এতটুকু চিৎকার, ক্ষীণ আর্তনাদও শোনা গেল না। তারা করজোড়ে যেভাবে বসেছিল, সেইভাবেই দগ্ধ হলো। আর একমাত্র জীবিত মহিষীর মনে হলো ইহসংসারে সে একেবারে একা–নিঃসঙ্গ।
তার গর্ভে রয়েছে বটে স্বামীর একমাত্র বংশধর। কিন্তু কতদিন—কতদিন পরে ডাক পড়বে তার? কবে শেষ হবে সুকঠিন কর্তব্য?
জানে না সে। গর্ভের সন্তানের চাঞ্চল্য তার মাতৃহৃদয়কে কী মধুর আবেশে এতদিন ভরিয়ে তুলত। এই মুহূর্তেও সেই চাঞ্চল্য অনুভূত হচ্ছে। অথচ সেই আকর্ষণ আর নেই যেন। মহিষী চন্দ্রাবতী শেষ বিদায় নেবার বেলায় ঠিক কথাই বলে গেল। কর্তব্য। কর্তব্য বইকি। আজ যে রয়েছে ভ্রূণাবস্থায়, পরাক্রান্ত দিল্লির বাদশাহের কাছে এককালে সে বিষাক্ত কাঁটা হয়ে দেখা দিতে পারে। কথাটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। দু’হাতে দেহাভ্যন্তরস্থ শিশুকে চেপে ধরে সে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,–না না, ওকে রক্ষা করতেই হবে। মহারাজ যশোবন্ত সিংহের ধমনীর উষ্ণ রক্তস্রোত পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হতে দেবে না সে। কিছুতেই দেবে না।
—মহারানি।
—কে?
—আমি রত্না।
—ও। আমি কি প্রলাপ বকছিলাম রত্না?
—না মহারানি। যাকে আপনি প্রলাপ বলে ভাবছেন, তার চাইতে যুক্তিপূর্ণ কিছু এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারে না।
—আমার ভয় হচ্ছে রত্না। ভীষণ ভয়।
—জানি রানি এ ভয় শুধু আপনার নয়। এ ভয় সমস্ত রাঠোরের আর মাড়োয়ারের। এ ভয় হয়তো সমগ্র রাজপুতনার।
আরও বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে। কারও মুখে কথা নেই। দুজনেই চিন্তায় বিভোর। রানি ভাবে রাজার কথা, আর নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। রত্নাও সেকথা ভাবে—সেইসঙ্গে তার মনে ভেসে ওঠে এক তরুণ বীরের ছবি। খাইবার গিরিপথে হয়তো এখন সে যুদ্ধে লিপ্ত। চিতার আগুন স্তিমিত হয়ে আসে ধীরে ধীরে। তারপর একসময় নিভে যায় একেবারে। রাজা আর রানিদের দেহের ভস্মাবশিষ্ট কাঠের ছাই-এর সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
—মহারানি।
—কে? ও রত্না।
—চলুন মহারানি, ওরা চলে যাচ্ছে। আগুন নিভে গিয়েছে।
—নিভে গিয়েছে? ও, তাই তো। আমায় ফেলে উনি সত্যিই চলে গেলেন। ওঁকে আর খুঁজে পাবে না পৃথিবীর মানুষের মধ্যে।
—আপনি সহমরণে গেলে মহারাজ যশোবন্ত সিংহ কি স্বর্গে বসেও ক্ষমা করতে পারতেন আপনাকে?
রত্নার কথায় রানি চিন্তান্বিত হয়। শেষে বলে,—ঠিক। ক্ষমা করতেন না। তুমি ঠিক কথা বলেছ রত্না। আজ থেকে আমি পাষাণ। আমি আর কাঁদব না।
সে-রাতে রত্না নানান কথায় রানির শোক সংযত রাখতে চেষ্টা করে। সফলও হয় কিছুটা। বাইরে মসীলিপ্ত অন্ধকার। চারদিকে স্তব্ধতা বিরাজমান। মাঝে মাঝে শুধু প্রহরারত বীরদের অস্পষ্ট পদশব্দ ও বর্মের অতি মৃদু আওয়াজ কানে ভেসে আসে।
ঘরের ভেতরে একটি দীর্ঘ মোমবাতি জ্বলছে শুধু। রাত দ্বিপ্রহর পার হয়ে গিয়েছে। রানি বসে রয়েছেন। চোখে জল নেই। পার্শ্বে উপবিষ্টা রত্না।
এক সময় রানি বলে,—এত বুদ্ধিমতী তুমি, অথচ সামান্য একজন পরিচারিকা হয়ে রয়েছ কেন রত্না? তোমার কি কোনোই উচ্চাশা নেই?
—মহারাজ যশোবন্তের মহিষীর সেবা করায় অপার আনন্দ রানি।
—কিন্তু ইচ্ছে করলে কি তুমি মহারাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতে না? হতে পারতে না তাঁর মহিষীদের একজন?
—তিনি পিতৃতুল্য।
—আমার বয়স তোমার চেয়ে কতই বা বেশি। অথচ তাঁকেই তো আমি জন্ম জন্ম ধরে স্বামীরূপে পেতে চাই। বীরের আবার বয়স রত্না?
—সে কথা নয়। কিন্তু তাঁকে যে পিতার মতোই দেখে এসেছি শৈশব থেকে। চিরকাল সেইভাবে শ্রদ্ধা করেছি।
—কিন্তু পৃথ্বীসিংহ? মহারাজের বড় ছেলে? আজ সে-ও জীবিত নেই যদিও। চেষ্টা করলে কি তার অনুগ্রহ লাভ করতে পারতে না? তোমার মতো সুযোগ সবাই পায় না রত্না।
—রানি, হয়তো আমি বুদ্ধিমতী, হয়তো আমি সুন্দরীও। তাই বলে রাজার দৃষ্টিতে পড়বার জন্যে লালায়িত হতে যাব কেন? রাজপুতনায় কি বীরের এতই অভাব? রাঠোররা কবে বীরশূন্য হয়েছে রানি?
—সত্যি—খুবই সত্যি। কিন্তু আমার বরাবর একটা গোপন ইচ্ছা ছিল, তোমায় মহিষীর বেশে দেখি। কেন, বলতে পারি না।
—যে ঘরে যাব, সেই ঘরের মহিষী হব আমি। দরিদ্রের ঘরের দরিদ্র মহিষী! আমার স্বামীও বীর হবেন। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে তিনিও অসি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তাঁর বক্ষে আর বাহুতে অলংকারের মতো শোভা পাবে শতযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। পৃষ্ঠে তাঁর অস্ত্রাঘাতের চিহ্নমাত্র থাকবে না।
—আমায় ক্ষমা করো রত্না। মাথার ঠিক নেই।
—এ আপনি কী বলছেন? ভালোবাসেন বলেই আমার সম্বন্ধে আপনার এই কল্পনা। এ তো আমার সৌভাগ্য। তাছাড়া আপনার এই কথাবার্তা প্রমাণ করছে কত দৃঢ়চেতা আপনি। মহারাজের মৃত্যু হলে ভাবতেও পারিনি এভাবে সামলে উঠতে পারবেন আপনি। হয়তো পারতেন না। যদি এই সুকঠিন কর্তব্যভার আপনার ওপর ন্যস্ত না হত।
মাড়োয়ারের ঘোর দুর্দিন। মহারাজ যশোবন্ত সিংহ মৃত। শুধু তিনি নন, তাঁর পুত্রগণও কেউ জীবিত নেই। থাকবার মধ্যে রয়েছে একটি সন্তান—মাতৃগর্ভে রয়েছে বলে এখনো সে পৃথিবীর আলো দেখবার অবকাশ পায়নি। ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না, সে সন্তান পুত্র না কন্যা।
.
মহারাজ যশোবন্তকে বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাঁর রাজ্য থেকে বহুদূরে আফগানিস্থান সীমান্তে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে। এর পশ্চাতে ছিল একটি গূঢ় উদ্দেশ্য।
যশোবন্তের প্রতি তীব্র প্রতিহিংসার জ্বালায় তিনি চিরকাল জ্বলেছেন। এখনো জ্বলছেন। কারণ যশোবন্ত তাঁর মৃত পিতার অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ছিলেন। মহারাজকে বধ করবার জন্য অনেক বিনিদ্র রজনীর চিন্তাপ্রসূত ষড়যন্ত্র-জাল বারবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সুচতুর এবং বীর যশোবন্তের গায়ে আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। বাদশাহ গোপনে দন্তঘর্ষণ করেছেন। এই যশোবন্ত এমনই এক চরিত্র যাঁর বিরুদ্ধে সর্বসমক্ষে কিংবা খোলাখুলিভাবে কিছু করায় বিপদের সম্ভাবনা প্রচুর। তাই সবার অজ্ঞাতে বারবার তিনি আউড়েছেন,—খুতান, খুতান আমার সর্বনাশ করবে। সে বেঁচে থাকতে আমি বিন্দুমাত্র নিশ্চিন্ত হতে পারি না।
যশোবন্তকে আওরঙ্গজেব ‘খুতান’ বলেই ডাকতেন। তাই শেষবার তাঁকে তিনি পাঠালেন রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। ভাবলেন মহারাজ তাঁর পুত্রদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবেন এবং সেই সুযোগে তিনি মাড়োয়ার অধিকার করে নেবেন।
কিন্তু যশোবন্ত মূর্খ নন। বিশেষত আওরঙ্গজেবকে তিনি যতটা চিনেছিলেন ভারতের আর কেউ ততটা চিনতে পারেনি। বাদশাহ চরিত্র তাঁর নখদর্পণে বলেই যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। সম্রাট শাহজাহান এবং দারাশুকোর মতো উদারচেতা পুরুষদের সংস্পর্শে এসে আওরঙ্গজেবকে কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। সবাই সবাইকে সহ্য করতে পারে না। আওরঙ্গজেব যেমন পারেননি যশোবন্তকে।
আওরঙ্গজেবের বীরত্ব আর রণকৌশল যশোবন্তকে মুগ্ধ করত। কতবার ভেবেছেন দারাশুকোর চেয়ে শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র অনেক বেশি যোগ্য। কিন্তু সেইসঙ্গে মনে হয়েছে এত যে পরিশ্রম করলেন মুঘল সম্রাটের জন্য সারাজীবন, এর প্রতিদানে তাঁর রাজ্যটুকু স্বাধীনভাবে পরিচালিত করতে দেবার ঔদার্য নেই কেন আওরঙ্গজেবের? তাঁর কুটিলতা বারবার পীড়া দিত মহারাজকে। তাই বাদশাহজাদা মোয়াজ্জেমকে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার উস্কানি দিতেও তিনি পরাঙ্মুখ হননি। কিন্তু তাঁদের উভয়েরই জন্মতিথি রাশি নক্ষত্র ইত্যাদির অবস্থান এমনই যে সর্বনাশ কারও ঘটেনি।
যশোবন্ত বাদশাহের আদেশমতো যুদ্ধযাত্রায় গেলেন। যাবার সময় জ্যেষ্ঠপুত্র পৃথ্বীসিংহকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে গেলেন। পিতার যোগ্য পুত্র পৃথ্বীসিংহ।
সংবাদ শুনে আওরঙ্গজেব মনে মনে চটলেন। কিন্তু তিনিও আওরঙ্গজেব—যে আওরঙ্গজেব কুটবুদ্ধিতে অতুলনীয়—যে আওরঙ্গজেব যুদ্ধবিদ্যায় ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের সঙ্গে তুলনীয়। তবু একটি জিনিস বারবার তাঁর মনের মধ্যে সাপের মতো পাক দেয়। সেটি হলো তাঁর পিতা, পিতামহের অথবা প্রপিতামহের মতো চিত্তের প্রসারতার দৈন্য। সেই দৈন্য তাঁকে পিতৃপুরুষের উদার পথ নিতে প্রশ্রয় না দিয়ে বারবার কূটনীতির সর্পিল পথের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। তাই যশোবন্ত যখন তাঁরই সৈন্যদলের অধিকর্তা হিসাবে, খাইবার গিরিপথে শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে ঘোরতর সংগ্রামে লিপ্ত, যখন তাঁর রণকৌশল আর সাহসিকতায় বিরুদ্ধপক্ষ নাজেহাল, সেই সময় তিনি মাড়োয়ারের নতুন নৃপতি যশোবন্ত-পুত্র পৃথ্বীকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন দিল্লিতে।
পৃথ্বীসিংহ বিনা দ্বিধায় নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্যে চলে এল। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যশোবন্তের পুত্রের কোনো ক্ষতি করা ভারতের বাদশাহের সাধ্য নেই। কিন্তু তার বিশ্বাস তার পিতার মতো অভিজ্ঞতা-জাত নয়।
আওরঙ্গজেব তখত্তাউস ত্যাগ করে এগিয়ে এসে পৃথ্বীকে অভ্যর্থনা জানালেন। দরবার কক্ষে তার জন্য সম্মানের আসন নির্দিষ্ট হলো। পরদিন দরবারে শত আমির ওমরাহের মধ্যে মাড়োয়ার রাজের প্রতিই বাদশাহের দৃষ্টি বারবার আকৃষ্ট হলো। তিনি ভাবলেন পিতার মতোই বলিষ্ঠ বটে। চোখের দৃষ্টিও তেমনি তীক্ষ্ণ। কিন্তু সাহসিকতায় কি পিতার সমতুল্য হবে? সম্ভবত নয়। পরখ করতে ইচ্ছে হলো বাদশাহের। কারণ পৃথ্বীসিংহ যদি কাপুরুষ হয় তবে যোধপুর রাজ্যকে নিজের অধিকারে আনা আদৌ কষ্টসাধ্য হবে না। কিন্তু যদি না হয় তবে অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
দরবারকক্ষে ময়ূর সিংহাসনে বসেও আওরঙ্গজেবের মন চলে যায় অন্য এক বিচিত্র রাজ্যে, যে-রাজ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাটরা মনে মনে যুগ যুগ ধরে বিচরণ করেছেন। সাধারণ মানুষ অনেক শাহানশাহ অনেক সম্রাটকে ধার্মিক এবং আদর্শবান বলে জানলেও, যোগ্য শাসনকর্তা এবং সেনাপতি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, এ রাজ্যে না গিয়ে উপায় নেই।
দরবারকক্ষের সবাই একদিন যখন চলে গেল, আওরঙ্গজেব পৃথ্বীসিংহকে অপেক্ষা করতে বললেন। তারপর সিংহাসন থেকে নেমে এলেন।
—চলুন রাজা আমরা একসঙ্গে যাই। ভালোভাবে আলাপই করতে পারছি না আপনার সঙ্গে। কতটা ব্যস্ত থাকতে হয় নিজের চোখেই দেখছেন।
—খুবই স্বাভাবিক বাদশাহ। এতবড় সাম্রাজ্যের অধীশ্বরের বিশ্রামের অবকাশ পাওয়া কঠিন। আওরঙ্গজেব একটু হেসে বলেন,—আপনার পিতা দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে পারবেন না।
—তিনি আগে থেকেই জানতেন সেকথা। তিনি জানতেন, কোনোদিনই হয়তো দেশে ফিরতে পারবেন না। সেইভাবে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছেন তিনি।
আওরঙ্গজেব কথাটা শুনে মনে মনে চমকে উঠলেন। ভাবলেন, খুতান সত্যই অতুলনীয়। তার বীরত্বের মতো বুদ্ধিরও পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু মনের ভাব গোপন রেখে তিনি বললেন, —চলুন সামনের ওই বাগে। আমার পিতার সৃষ্টি। আপনার পিতা তো আমার পিতার প্রশংসায় সর্বদাই পঞ্চমুখ। সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে ওখানে। আপনার সঙ্গে আলাপ করার যোগ্য পরিবেশ।
পৃথ্বীসিংহ বাদশাহকে সামনে এগিয়ে যাবার জন্যে সরে দাঁড়ায়।
—না না, আপনি আগে চলুন রাজা। আপনি আমার মহামান্য অতিথি।
পৃথ্বীসিংহ এগিয়ে যেতেই বাদশাহ সহসা পেছন থেকে তার হাত দুটো চেপে ধরেন। বিস্মিত পৃথ্বী পেছন ফিরে চাইতে আওরঙ্গজেব মুচকি হেসে বলে ওঠেন,—শুনেছি আপনার হাত দুটো আপনার পিতার মতোই স্নায়ু-পীড়িত।
অপমানে মাড়োয়াররাজের মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে ক্রোধ সংবরণ করে গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে,—ভগবান আপনাকে রক্ষা করুন। বাদশাহের হাত যখন রক্ষাকবচের মতো দরিদ্রকে স্পর্শ করে, তখন সে নতুন জীবন পায়। কিন্তু সেই হাতই যখন আমার হাত দুটোকে নেবার চেষ্টা করে, তখন এমন এক অসীম শক্তি অনুভব করি যে মনে হয় যেন দশজন পৃথিবীর অধীশ্বরকে আমি এক লহমায় পরাজিত করতে পারি।
আওরঙ্গজেবের হাত থেকে পৃথ্বীসিংহের হাত দুটো স্খলিত হয়ে পড়ে। তাঁর মুখ দিয়ে অজ্ঞাতে অস্ফুটস্বরে উচ্চারিত হয়,—ঠিক খুতান—হুবহু
—না বাদশাহ। তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা করবেন না। তাঁর পায়ের যোগ্যও আমি নই, একথা এখন মর্মে মর্মে অনুভব করছি। তাঁর যোগ্য হলে এবারে অন্তত দিল্লিতে আসতাম না।
কপট আনন্দে পৃথ্বীসিংহকে জড়িয়ে ধরে বাদশা বলেন,—বড়ই আনন্দ পেলাম আপনার পরিচয় পেয়ে।
তিনি তখনই রাজার জন্যে বহুমূল্য পরিচ্ছদ প্রস্তুতের আদেশ দিলেন। কোনো নৃপতিকে দিল্লির শাহানশাহ কর্তৃক বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের সময় এই রকমের পোশাক উপহারের প্রথা নতুন নয়।
মুগল বাগ থেকে ফেরার সময় পৃথ্বীসিংহের মন অস্থির হয়ে ওঠে। বাদশাহের বিচিত্র ব্যবহারের কথা বারবার তোলপাড় করতে থাকে তার মস্তিষ্কের ভেতরে।
তার জন্যে নির্দিষ্ট আলয়ে পৌঁছে সে বহুক্ষণ আনমনা থাকে। বুঝতে পারে জীবনের সব চাইতে মারাত্মক ভুল সে করেছে রাজধানীতে পদার্পণ করে।
আচ্ছা! সে তো পালিয়ে যেতে পারে। তাকে কি বন্দি করে রেখেছেন আওরঙ্গজেব?
পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হয় পৃথ্বীসিংহের। কেউ যদি তাকে বাধা না দেয়, বুঝতে হবে আওরঙ্গজেব খেয়ালের বশে অমন ব্যবহার করে ফেলেছেন। কাজের অস্বাভাবিক চাপে অতি বুদ্ধিমান ব্যক্তিও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অদ্ভুত ব্যবহার করে ফেলে অনেক সময়ে।
আপন কক্ষে প্রবেশ করে পৃথ্বীসিংহ পোশাক পরিবর্তন করে। সামান্য এক রাজপুতের বেশ পরিধান করে সে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়।
আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। তার পরিচর্যার জন্য যে ব্যক্তিটি এখানে রয়েছে সে শুধু একবার তার দিকে চেয়ে অভিবাদন জানায়।
পৃথ্বীসিংহ রাজপথে নামে। সে একজন ভিক্ষুক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না। এগিয়ে চলে পৃথ্বীসিংহ! রাজধানীতে দেখবার এবং সওদা করবার জায়গার অভাব নেই। কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর পৃথ্বীসিংহ লক্ষ্য করে ভিক্ষুকটি তখনো তার পেছনে। সে দ্রুত একটি ছোট্ট রাস্তায় বেঁকে যায়। সর্পিল গতিতে রাস্তাটি এগিয়ে চলে কিন্তু ভিক্ষুক তেমনি রয়েছে।
পৃথ্বীসিংহ ক্রোধে উন্মত্ত হয়। আর এগিয়ে যাবার চেষ্টা না করে সোজা ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে চলতে থাকে। চিৎকার করে সে তখন ভিক্ষা চাইছে।
পৃথ্বীসিংহ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়—ভিক্ষা চাও?
—হ্যাঁ, হুজুর। তিনদিন পেটে কিছু পড়েনি।
—পেট তো ভর্তি বলেই মনে হচ্ছে।
—হুজুর, আপনি রসিকতা করছেন। অন্যের কষ্টে রসিকতা করতে নেই হুজুর।
—না ছিঃ। তাই কি কেউ করে? সে তো মানুষই নয়।
—তবে? আপনি সব জানেন। আপনি মহৎ ব্যক্তি।
—তা যা বলেছ।
পৃথ্বীসিংহ একটি মুদ্রা বের করে সেটি ভিক্ষুকের সামনে তুলে ধরে।
ভিক্ষুকটি তার থলির মুখ খোলে।
পৃথ্বীসিংহ মুচকি হেসে বলে,—অনেক তো পেয়েছে আজ। আর কেন?
—কাল যদি বের হতে না পারি? যদি অসুখ হয়?
—তা বটে। দেখি কি পেলে আজ?
ভিক্ষুক ভয় পেয়ে তার থলি দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে।
পৃথ্বীসিংহ গায়ের জোরে সেটি ছিনিয়ে নিয়ে রাস্তার ওপর উপুড় করে ফেলে। সে যা অনুমান
করেছিল হুবহু সত্যি। পাথরের টুকরো ছাড়া থলিতে আর কিছুই নেই। রয়েছে শুধু একটি মূল্যবান ছোরা।
—অনেক পেয়েছ আজ—তাই না?
ভিক্ষুক বলে,—তাই বলে আমাকে মেরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না পৃথ্বীসিংহ।
আশেপাশে অনেক চোখ রয়েছে আপনাকে পাহারা দেবার।
—অর্থাৎ আমি বাদশাহের বন্দি। তাই তো?
—আপাতত বন্দি তো বটেই। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না।
ভিক্ষুকের মুখে রহস্যের হাসি ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
পৃথ্বীসিংহ আবার ফিরে চলে নিজের আলয়ে। মনস্তাপে দগ্ধ হতে থাকে সে। কীভাবে আওরঙ্গজেবের থাবা থেকে নিজেকে বাঁচাবে ভেবে পায় না।
নিজের কক্ষে প্রবেশ করে সে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়। বাদশাহ তাকে কার্যত বন্দি করে রেখেছেন। অথচ তাকে সম্মান প্রদর্শনে কোনো ত্রুটি দেখাচ্ছেন না। কী মতলব তাঁর? তার জন্যে তিনি দরবারকক্ষে উপস্থিত হবার যোগ্য নতুন পোশাক তৈরি করার বন্দোবস্ত করেছেন। দু’দিন পরে সেই পোশাক তৈরি হয়ে যাবে।
পরিচারক খাবার নিয়ে আসে—সেই সঙ্গে সরবত।
পৃথ্বীসিংহ হঠাৎ বলে ওঠে,—এতে কি বিষ আছে?
পরিচারক আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে,–না মহারাজ। আমার আনা খাবারে বিষ থাকে না। আমি নিজে খেয়ে দেখি।
—বিশ্বাস নেই।
—হয়তো নেই। কিন্তু আমি আনলে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমি ধর্ম মানি।
—তুমি তো হিন্দু–তাই না?
—আমাকে দেখে কি আপনার সন্দেহ হয়?
—না। কিন্তু তুমি রাজপুত নও।
—না। আমি মারাঠি।
—এখানে কতদিন আছ?
—বাদশাহ, যখন বাদশাহজাদা ছিলেন তখন আমায় নিয়ে এসেছেন। তিনি আমাকে ভালোবাসেন।
—হিন্দুকে তিনি ভালোবাসেন?
—আমি মানুষটাকে তিনি ভালোবাসেন। আপনারা বাদশাহকে যতটা গোঁড়া ভাবেন তিনি
বোধহয় ততটা নন। কিন্তু কাজী মহম্মদ জালান তাঁকে ইন্ধন জুগিয়ে এইরকম করে তোলে।
—লোকটি কে?
—একজন মৌলবি।
—আচ্ছা তুমি যাও।
—আপনার সঙ্গে দু’জন নর্তকী দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে।
—নর্তকী? কে পাঠালো?
—জানি না।
—এই অবেলায়? অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। এখন তো তাদের এখানে এলে ক্ষতি।
—পাঠিয়ে দেবো?
—দাও। হয়তো চেনে। হয়তো আমার দেশের মানুষ। কিংবা
পরিচারক চলে গেলে পৃথ্বীসিংহ ভাবে, কিংবা হয়তো পিতাকে ওরা চিনত। তাই কোনো গুপ্ত সংবাদ বহন করে এনেছে।
একটু পরেই পায়ের মলের ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ওরা আসছে। ওরা কি সারাক্ষণই পায়ে মল বেঁধে থাকে? বোধহয় না। মনে নেই পৃথ্বীসিংহের। ছেলেবেলায় যে পিতার সঙ্গে একবার নওরোজের দিনে শাহানশাহ শাহজাহানের কাছাকাছি এসেছিল। সেই সময়ে অনেক নর্তকীকে দেখেছিল। তারপরে নর্তকীদের সঙ্গে আর সংস্রব নেই। তার নিজের রাজধানীতে নর্তকী রয়েছে। কিন্তু তারা মহারাজের তুষ্টি বিধানের জন্যে নিয়োজিত হয় না। তাদের আলাদা এলাকা রয়েছে।
নর্তকীরা প্রবেশ করে নৃত্যের তালে অভিবাদন করে দাঁড়ায়। অপূর্ব পরিচ্ছদ তাদের। মাথা থেকে ওড়না নেমে এসেছে। সেই ওড়নার মধ্য দিয়ে তাদের মুখ দেখা যায়। মুখে তাদের অতি মিষ্টি হাসি।
পৃথ্বীরাজ স্তম্ভিত হয়ে যায় ওদের রূপলাবণ্যে। এরা কি নর্তকী? হারেমে কি তবে এদের চেয়েও রূপসি রয়েছে?
—মহারাজ।
কী সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর। পৃথ্বীরাজ মুহূর্তের জন্যে ভুলে যায় যে সে কার্যত আওরঙ্গজেবের বন্দি।
—তোমরা আমায় চেনো?
—পরাক্রান্ত মহারাজ যশোবন্ত সিংহের পুত্রকে কে না চেনে মহারাজ?
—ও। তোমরা কি জন্যে আমার কাছে এসেছ?
এবারে দ্বিতীয়জন বলে,—আমরা আপনার নাম শুনে আসছি কতদিন থেকে। আপনার বীরত্বে আমরা মুগ্ধ। তাই এসেছি দেখা করতে।
—বেশ তো। আমার খুব ভালো লাগল। তোমাদের নাম কী?
—আমার নাম চঞ্চলবাঈ। আর ওর নাম—
দ্বিতীয়জন বলে,—আমার নাম মহারাজ সুন্দরবাঈ।
—চমৎকার। তোমাদের নাম সত্যিই সার্থক।
চঞ্চলবাঈ বলে—আপনার প্রশংসা শুনে নিজেদের ধন্য মনে করছি।
—কিন্তু সত্যিই তোমরা অপরূপ রূপসি। তোমাদের মতো রূপসি তো আমি দেখিনি।
সুন্দরবাঈ হেসে বলে,–কেন, মহারানি সাহেবা?
পৃথ্বীসিংহ একটু চুপ করে থাকে। শেষে সামান্য হাসে। সে বলে,–তোমরা কি কোনো বিশেষ সংবাদ দিতে এসেছ? কারণ আমি ভাবছিলাম, এই সময়ে এখানে না এসে প্রাসাদে গেলে তোমাদের লাভ হত। তোমাদের সন্তুষ্ট করার মতো অর্থও আমি সঙ্গে আনিনি।
চঞ্চলবাঈ দ্রুত পৃথ্বীসিংহের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলে,—আমরা লাভের আশায় আসিনি মহারাজ।
—তবে।
—শুনতে পেলাম আপনি একা রয়েছেন। আমাদের দুজনের মন কেঁদে উঠল। তাই পালিয়ে এলাম।
—তোমাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমাদের নাচবার কিংবা গাইবার কোনো আয়োজন যে এখানে নেই।
—প্রয়োজন নেই।
—তবে?
—আপনি অনুমতি করলে, আপনি যতদিন দিল্লিতে থাকবেন আমরা দুজনে আপনার সঙ্গে থাকব। কিংবা ইচ্ছা করলে আমাদের একজনকে পছন্দ করে নিন। যতদিন দিল্লিতে রয়েছেন আপনাকে নিয়ত সঙ্গ দেব। রানি নেই এখানে। আপনার কষ্ট হচ্ছে। রাতে আপনার সেবা করব।
চঞ্চলবাঈ পৃথ্বীসিংহের মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
একটা আচ্ছন্নভাব পৃথ্বীসিংহকে গ্রাস করতে থাকে। সে অনুভব করে সুন্দরবাঈ তার পায়ের কাছে বসে তার কোলের ওপর মাথা রেখেছে।
কিন্তু এটা কি আওরঙ্গজেবের চক্রান্ত?
ছিটকে উঠে দাঁড়ায় পৃথ্বীসিংহ। নর্তকী দুজন দু’পাশে গড়িয়ে পড়ে।
—কেন এসেছ তোমরা সত্যি বলো।
—আমরা তো বলেছি। চঞ্চলবাঈ কম্পিতকণ্ঠে বলে।
—বিশ্বাস করি না। বাদশাহ পাঠিয়েছেন?
—না।
—তবে আমার ওপর এত সদয় হলে কেন? রাজধানীতে অনেক রাজা মহারাজ আমির নবাব রয়েছেন।
—সেকথাও বলেছি। আপনার পিতাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। আপনার বীরত্বে আমরা মুগ্ধ। আপনার রূপে আকৃষ্ট
সুন্দরবাঈ ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,—নারীকে কি শুধু ছলনাময়ী বলেই জানতে হয় মহারাজ? মমতাময়ী কি তাদের হতে নেই? অন্তত রাতের বেলাটুকু আপনার মনের দুঃসহ জ্বালাকে কি আমরা ভুলিয়ে দিতে পারি না?
—না। প্রয়োজন নেই। মনের জ্বালা নিভিয়ে দিলে আমি ভেড়া হয়ে যাব।
সহসা চঞ্চলবাঈ খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে বলে,—চলরে সুন্দর। আমাদের কাজ ফুরিয়েছে। তখনই বলেছিলাম, এরা সব একরোখা। ওসব মেয়েলি জিনিস দিয়ে এদের কাবু করা যায় না। বিশ্বাস করল না সালাম। খোজার বুদ্ধি আর কত হবে?
পৃথ্বীসিংহের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে ওরা মল বাজিয়ে ঝমঝম করতে করতে মিলিয়ে যায়।
দুদিন পরে পরিচারক এসে খবর দেয় বাদশাহের আদেশক্রমে দুই ব্যক্তি মহারাজের পোশাক নিয়ে এসেছে।
—হ্যাঁ, আজই আসবার কথা ছিল বটে। ওই পোশাক পরে আজ দেওয়ান-ই-খাসে যেতে হবে। পাঠিয়ে দাও।
দুজন প্রবেশ করে। একজনের হাতে বহুমূল্য পরিচ্ছদ। অত্যন্ত মনোরম। সমস্ত পোশাক জুড়ে সোনার কাজ। চোখ ফেরানো অসম্ভব।
—বাদশাহ পাঠিয়েছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—রেখে যান।
—বাদশাহ বলেছেন, আমাদের সামনে পরতে। যদি ছোট-বড় হয় ঠিক করে দেব এখনি।
—আপনার নাম কি?
—হাকিম-ই-মোমিন।
—হাকিম! পোশাক পরাতে হাকিম কেন?
বাদশাহ বললেন, যদি এই পোশাকে আপনার অসুবিধা হয়, তাহলে কী ধরনের পোশাকে সুবিধা হবে আমি জানতে পারব। এই পোশাক পরার পর নাড়ির গতি দেখে বুঝব। যদি নাড়ির গতি স্বাভাবিক থাকে তাহলে এতেই হবে।
—ও। বেশ দিন।
ওরা দুজনে মিলে পৃথ্বীসিংহকে পোশাক পরিয়ে দেয়। পৃথ্বীসিংহ পোশাক পরে উপবেশন করে। একটু পরেই তার অস্বস্তি হতে থাকে। হাকিম নাড়ি ধরে থাকে।
বলে,—গতি একটু দ্রুত। অসুবিধা হচ্ছে?
—হ্যাঁ।
—আর একটু অপেক্ষা করুন।
সহসা পৃথ্বীসিংহের সর্বাঙ্গ যেন জ্বলতে থাকে। সে চিৎকার করে ওঠে,—উঃ জ্বলে গেল। খুলে দিন—খুলে দিন।
হাকিম এবং অপর ব্যক্তি তাকে চেপে ধরে রাখে। সে ছটফট করে পাগলের মতো তাদের হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। পারে না।
—উঃ, মরে গেলাম। আওরঙ্গজেব আমাকে শেষে বিষ দিয়ে মারল?
হাকিম শান্তকণ্ঠে বলে,—এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরুন।
পৃথ্বীসিংহ নিস্তেজ কণ্ঠে বলে,—হ্যাঁ, ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক তো হবেই। তোমরাও পুরস্কার পাবে হাকিম।
আরও কিছুক্ষণ হাকিম পৃথ্বীসিংহকে চেপে ধরে রাখে।
স্থির হয়ে যায় রাজপুত বীর।
অবশেষে হাকিম নাড়ি দেখে বলে—গতি থেমে গিয়েছে।
এতক্ষণে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে—ঠিক তো?
—হ্যাঁ। কোনো সন্দেহ নেই। চল। বেচারা অন্তত দুটি দিন চঞ্চল আর সুন্দরকে নিয়ে ভোগ করতে পারত। কপালে নেই।
পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে যশোবন্ত সিংহ জীবনের প্রচণ্ডতম আঘাত পেলেন। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। এতটা পথ অতিক্রম করে দিল্লি তছনছ করবার মতো শক্তিও অবশিষ্ট রইল না তাঁর। তবু আঘাতের আরও বাকি ছিল। তাঁর অপর পুত্র জগৎসিংহ, যে তাঁর সঙ্গী হয়ে এসেছিল রণক্ষেত্রে তারও মৃত্যু ঘটল একদিন। যশোবন্ত বুঝলেন আওরঙ্গজেবের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল এতদিনে। তাঁর মায়ের রাজ্য তাঁর মাতৃভূমি মুঘল আওতায় চলে যাবে। শুষ্ক চোখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বিদেশবিভুঁই-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক-পুরুষ।
শুধু রানি নয়। উপপত্নীরাও সেদিন চিতার আগুনে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল। উপপত্নীও পত্নী। পত্নীর কর্তব্য তারাও পালন করে কিছুটা। তবে কেন স্বামীর সহযাত্রী হবে না? অগ্নিদেবকে ধর্মসাক্ষী করেনি বলে? হয়তো করেনি। সে সৌভাগ্য করে তারা আসেনি। কিন্তু শেষ বেলায় অগ্নিকে সাক্ষী রেখে স্বামীর সঙ্গে পরলোকে যাত্রা করার কি বাধা আছে? না নেই। বাস্তবকে মেনে নেওয়াই সঙ্গত। তাই মহিষীদের কেউ বাধা দিল না তাদের একই চিতার সঙ্গিনী করে নিতে। এই জন্মের পুণ্যফলে পরের জন্মে তারা নিশ্চয় পত্নীর মর্যাদা পাবে।
.