রাজপুত নন্দিনী – ৫

ওরা এগিয়ে চলে। দিল্লি ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে। বিপদও ততই ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ সমস্ত কিছু জেনেশুনে বাদশাহের কব্জার মধ্যে গিয়ে পড়ছে ওরা। পরিত্রাণের দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

মহুয়া বনের ধারে ওদের শিবির পড়ে। মহুয়া ফুলের মাতাল গন্ধে যেন চারদিক আমোদিত।

দুর্গাদাস হাসতে হাসতে সবাইকে বলে,—দেখো, নেশা করে তোমরা বুঁদ হয়ে থেকো না। এখন চারদিকে শুধু শত্রুচর।

পরিহাসচ্ছলে সে কথাটা বললেও গুরুত্ব উপলব্ধি করতে কারও অসুবিধা হলো না। ফলে মহুয়া-আসক্ত ব্যক্তিরাও মনে মনে সংযত হলো।

রাত্রিতে যথারীতি বীরসিংহ পাহারায় নিযুক্ত হলো। রানিমায়ের শিবির- শ্রেণির দিকে সে লক্ষ্য রাখছিল। অন্য দিকে রয়েছে মাধব, ভীমসিংহ ও আরও অনেকে।

এ-রাতে রত্নার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। দুর্গাদাস সাবধান করে দিয়েছেন, ভালুকের আবির্ভাবের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মহুয়ার গন্ধে ওরা পাগল হয়। সেই সময় কোনোরকম বাধা বিপত্তি ঘটলে হিংস্র হয়ে ওঠে।

সুতরাং রত্নার শিবিরে অবস্থানই শ্রেয়। তবু বীরসিংহ বারবার সেদিকটা টহল দেয়। বলা যায় না, যদি কোনো কারণে রত্নার প্রয়োজন হয়। শিশুপুত্র নিয়ে রানিমা একা রয়েছেন। রত্না ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ নেই তাঁকে দেখবার। যদিও সে এখন থেকেই মূল্যবান পোশাক পরে দিবালোকে মহারানির মহড়া দিচ্ছে। রাতের বেলায় এখনও সে রানিমার একনিষ্ঠ সেবিকা। কারণ আসল রাজপুত্র তারই হেফাজতে—যে রাজপুতকে জীবিত রাখতে পারলে মাড়োয়ারের স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের কোনো এক দিনে।

শিশুর ক্রন্দন রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে।

বীরসিংহ তড়িৎ-পদে শিবিরের কাছে এসে দাঁড়ায়।

এ কোন শিশুর কান্না? সেই অতি সাধারণ রাজপুত সৈনিকের মাতৃহারা সন্তান? অথবা অতি অসাধারণ পিতৃহারা পুত্রসন্তান? ক্রন্দন শুনে জানা মুশকিল। বিধাতা সবাইকে একইভাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। কে রাজা আর কে প্রজা সেটা তার নিয়তি। রাজগৃহে জন্মালে রাজা হবার সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু না-ও হতে পারে। আবার দরিদ্রের সংসারে জন্ম নিয়েও মস্তকে রাজমুকুট ধারণের সৌভাগ্য হতে পারে কারও।

দুই শিশু এখন রয়েছে একই শিবিরে। মাঝখানে হয়তো শুধু পর্দার ব্যবধান। কার ভাগ্যে কী রয়েছে কেউ কী বলতে পারে এখন? ওই মাতৃহারা শিশুটি হয়তো যশোবন্ত সিংহের পুত্র হিসাবে মুঘল হারেমে যথেষ্ট সমাদরের সঙ্গে দিন কাটাবে। আবার ওই যে শিশুপুত্র, যার নাম ঠিক হয়েছে অজিত সিংহ, সে হয়তো—। না না। কিছুতেই না। তাকে দেশে ফিরিয়ে নিতেই হবে।

ধপ।

একটা সন্দেহজনক শব্দ। শিবিরের ঠিক বিপরীত দিকে মনে হলো।

বীরসিংহ ছুটে অন্য দিকে যায়। একটি ছায়ামূর্তি চোরের মতো এগিয়ে আসছে অন্ধকারে। ভালুক? না। যদিও ভালুকের মতোই গুটিগুটি আসছে। কিন্তু ভালুকের পায়ের শব্দ হয় না। কেউ নিশ্চয় পাশের মহুয়া গাছে আত্মগোপন করে বসেছিল। রাত গভীর হতেই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ হাসিল করতে আসছে।

আততায়ী! শিশুপুত্রকে হত্যা করতে আসছে? বীরসিংহের শরীরের শিরা- উপশিরার রক্ত দ্রুত চলতে থাকে। সে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।

লোকটি আরও এগিয়ে আসছে। দু’পা এগিয়ে থেমে থেমে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আবার দু’পা আসছে।

বীরসিংহ ধীরে ধীরে কোষ থেকে তলোয়ার বের করে অপেক্ষা করতে থাকে।

লোকটি শিবিরের একেবারে পাশে এসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

শিশুটি তখনও ফুঁপিয়ে চলেছে। খুব নীচু কণ্ঠে কে যেন তাকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত। রত্না নিশ্চয়ই। তবে কণ্ঠস্বর চেনার উপায় নেই। খুবই চাপা। এই সময় অধিকাংশ নারীর গলা একই রকম মনে হয়।

লোকটির কোমরে কোনো অস্ত্র নেই। বীরসিংহ নিশ্চিন্ত হয়। কারণ তলোয়ার থাকলে এখনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হত।

লোকটি আরও একটু এগিয়ে শিবিরের গায়ে কান লাগিয়ে শোনে। শিশুর কান্না থেমে গিয়েছে। নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে যে তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত ছিল, সে-ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

আশ্চর্য! আজই এখানে এসে তারা পৌঁছেছে, অথচ এরই ভেতরে শত্রু- পক্ষ জেনে ফেলেছে কোন শিবিরে মহারাজ যশোবন্ত সিংহের একমাত্র জীবিত পুত্র রয়েছে। ভীমসিংহ ঠিকই বলেছিল। চেতন সিংহের মতো আরও কিছু নিমকহারাম রাজপুতদের ভেতরে রয়েছে যারা গুপ্ত সংবাদ শত্রুপক্ষকে নিয়মিতভাবে পাচার করে চলেছে। একবার তাদের মুখোশ খুলতে পারলে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া যেত।

লোকটি হঠাৎ আস্তিনের ভেতর থেকে একটা ছুরিকা বের করে শিবির কাটতে শুরু করে।

এক মুহূর্তও দেরি না করে বীরসিংহ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। লোকটি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় দু’হাত পেছিয়ে যায়। বীরসিংহ তলোয়ার চালায়। বুঝতে পারে লোকটির বাঁ হাতের কয়েকটি আঙুল কেটে মাটিতে পড়ল।

কিন্তু সেই একই সময়ে ডান হাতে সে একটি ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র বের করে বীরসিংহকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।

বারুদের শব্দ হয়। অস্ফুট আর্তনাদ হয় বীরসিংহের মুখ দিয়ে।

লোকটি চোখের পলকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

শিবিরের ভেতর থেকে রত্না ছুটে বেরিয়ে আসে। অন্ধকারেও বীরসিংহকে চিনতে তার

এতটুকুও ভুল হয় না।

ছুটে কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় আকুল হয়

—চুপ চুপ রত্না। আমি মরিনি।

যেন জাদু স্পর্শে মূক হয়ে যায় রত্না।

—আমি আহত হয়েছি। সরে যাও, কেউ দেখে ফেলবে। শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যেতে পারে কারও।

রত্না সরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,—কোথায় লেগেছে তোমার?

—কাঁধে। অল্প। হাত থেকে তলোয়ারটা খসে গেল।

সেই সময় দূরে আবার আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। বীরসিংহ বাঁ হাতে কাঁধ চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর রত্নার অবরোধকে অস্বীকার করে সেদিকে ছুটতে থাকে।

আরও কিছু রাজপুত ছুটে চলে সেদিকে। এবারে অনেকের ঘুম ভেঙেছে।

বীরসিংহ কাছে গিয়ে দেখতে পায়, একজন নয়, দুজন পড়ে রয়েছে ভূতলে। সে আততায়ীকে চিনতে পারে। বাঁ হাতের একটি আঙুলও নেই। তারই তলোয়ারের আঘাতে শিবিরের পাশে ফেলে রেখে এসেছে। কিন্তু এবারে নিজেকেই ফেলে রাখতে হয়েছে। এবারে তলোয়ারের আঘাত পড়ছে তার মস্তকে।

অপর ব্যক্তি ছটফট করছে। আততায়ীর হত্যাকারী। নিজেও বীরসিংহের মতো আহত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে। আরও মারাত্মকভাবে আহত মনে হচ্ছে।

বীরসিংহ তার কাছে যায়। সে দেখে ভীমসিংহ আহত।

—ভীম?

—কে? বীর?

—হ্যাঁ ভাই।

—ও মরেছে?

—হ্যাঁ। রাজপুত্রকে হত্যা করতে এসেছিল।

—আরও আসবে। সাবধান বীরসিংহ।

বীরসিংহ ভীমের ওপর ঝুঁকে পড়ে। ভীম হাত দিয়ে তার নিজের বুক চেপে ধরে রেখেছিল।

—আমাকে ধরে উঠতে পারবে ভীম?

—নাঃ, আর আমি কোনোদিন উঠব না বীর। গুলি আমার বুকে লেগেছে।

কথাটা শুনেই দুজন রাজপুত ছুটে যায় শিবিরের দিকে। দুর্গাদাসকে ডেকে আনতে হবে। বাতি আনতে হবে।

—বীরসিংহ, আমি চলি ভাই। বড় দুঃখ রইল, সবটা দেখে যেতে পারলাম না। শেষে এক গুপ্তঘাতকের—

—লজ্জা নেই ভাই। আমিও মরতে পারতাম। গুলি আমার বুকে না লেগে কাঁধ ছুঁয়ে চলে গিয়েছে। তবে একটা কথা বলতে পারি, এই গুপ্তঘাতক সাধারণ মানুষ নয়। তার ক্ষিপ্রতা অসাধারণ।

—আমিও দেখেছি।

কথা বলতে বলতে ভীমসিংহ যেন ঘুমিয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। একবার যন্ত্রণার অস্ফুট আর্তনাদও করল না। অথচ সে অসহ্য বেদনা অনুভব করছিল। তার হৃদপিণ্ড ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে আসছিল। ভেতরে রক্তক্ষরণের ফলে কথা বলার সময় তার গলা দিয়ে অদ্ভুত এক ঘরঘর আওয়াজ বার করছিল। তবু সে থামেনি। একবারও বলেনি তাকে সাহায্য করতে।

চেতনসিংহকে জলের ভেতরে হত্যা করে পাড়ে উঠেও সে কোনোরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ করেনি। এবারও করল না। সেবারে সে ছিল বিজয়ী। এবারেও বিজয়ী। সে দেখে গেল শত্ৰু তার হাতে নিহত। সেই পরিতৃপ্তিতে সে ধীরে ধীরে চিরনিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল।

দুর্গাদাস এসে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ভীমসিংহের দিকে। বাতির আলোয় তার চোখ দুটো একটু চিকচিক করে উঠল। তারপর নতজানু হয়ে সে ভীমসিংহের কপালে চুম্বন রেখা এঁকে দিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুর্গাদাস বলে,—রাজপুতরা তো সবাই যোদ্ধা, সবাই বলতে গেলে বীর। কিন্তু ভীমসিংহের ভেতরে আমি যা দেখেছি তাতে মাঝে মাঝে চমকে উঠতে হয়েছে। আমি যে অভিজ্ঞতা এতদিনে সঞ্চয় করেছি সেই অভিজ্ঞতা শুধু ওর ছিল না। থাকলে ওর ওপর নিশ্চিন্তে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমি ওর অনুগত সৈনিক হয়ে কাজ করতে পারলে গর্ব অনুভব করতে পারতাম।

রাজপুতরাও কাঁদে। দুর্গাদাস থামলে সবাই কেঁদে ফেলল। এতবড় কথা একজন সৈনিক সম্বন্ধে কোনো সেনাপতিকে বলতে শোনা যায়নি।

বীরসিংহ মনে মনে ভাবে, সে অন্তত ভীমসিংহকে ঠিকই চিনেছিল।

সেই রাতেই চিতা প্রজ্বলিত করা হলো। ভীমসিংহের দেহ ভস্মীভূত হলো। পৃথিবীতে তাকে আর সশরীরে কখনও দেখা যাবে না। দুর্গাদাস সম্ভবত আগের মতো অতটা নিশ্চিন্তে রাত্রিতে নিদ্রা যেতে পারবে না।

এখন রয়েছে শুধু বীরসিংহ। ভীমসিংহের চেয়েও বয়সে ছোট। সুতরাং অভিজ্ঞতা আরও কম। তবে বীরসিংহ এটাই বুঝল যে রত্নার আকর্ষণে নয়, রাজপুতকে রক্ষা করার তাগিদেই এবার থেকে তাকে রানিমার শিবিরের পাশে রাতের পর রাত বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হবে।

.

অবশেষে দিল্লি।

দিল্লি তাদের অপরিচিত নয়। তবু এ-দিল্লি সে-দিল্লি নয়। এ-দিল্লিতে মহারাজ যশোবন্তের অস্তিত্ব নেই। তাই মুঘল রাজধানীর প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ আর তাদের অবশিষ্ট নেই।

রাজধানী যত নিকটবর্তী হচ্ছিল, দুর্গাদাসের দৃষ্টি ততই তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠছিল। দিল্লিতে এসে সেই দৃষ্টি আরও সজাগ। দু-চোখে এক লহমায় সে অনেক কিছু দেখে নিচ্ছিল। চন্দ্রভান, যোধসিং এবং বরমল প্রমুখকে ডেকে বলে,—খুব সাবধান। শত্রুপুরী এটা।

—জানি। আমরা প্রতি মুহূর্ত প্রস্তুত দুর্গাদাস।

মহারাজ যশোবত্তের পুরোনো অট্টালিকার সামনে এসে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়। প্রাসাদ অন্যের অধিকারে। কোনো আমীর সে প্রাসাদে বসবাস শুরু করেছে।

দুর্গাদাসের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

সেই প্রাসাদের সামনে বাদশাহের একজন লোক দাঁড়িয়েছিল। সে দুর্গাদাসের কাছে এসে বিনীতভাবে বলে,—বাদশাহ মহারানি এবং তাঁর শিশুপুত্রকে নিজ প্রাসাদে বসবাস করবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

দুর্গাদাসের মাথায় রক্ত ওঠে। আওরঙ্গজেবের মতলব রাজধানীর ভূমিতে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়। উঃ, কী চতুর এই বাদশাহ! এই সঙ্গে অন্যান্য বাদশাহদের মতো রাজপুতদের প্রতি যদি সমবেদনা থাকত কত কিছু হতে পারত। মৃদুস্বরে সে লোকটিকে বলে,—তা সম্ভব নয়। মহারানি হিন্দু রমণী। তাঁর পুজো-অর্চনা, ব্রত-তর্পণ ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে যা বাদশাহী প্রাসাদে সম্ভব হয়ে উঠবে না।

লোকটি মৃদু হেসে বলে, —বাদশাহ বিবেকবান। এমন হতে পারে তিনি দূরদৃষ্টি দ্বারা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তিনি অন্য একটি ক্ষুদ্র অট্টালিকাও খালি রেখেছেন। আপনারা আমার সঙ্গে চলুন।

দুর্গাদাস বীরসিংহকে কাছে ডাকে। খুবই গোপনে বলে,—তুমি আর শংকর সিংহ সৈন্য দিয়ে সবার অলক্ষ্যে ব্যূহ রচনা কর রত্নার শকটকে ঘিরে। প্রতি মানুষের দৃষ্টি যেন সেদিকে আকৃষ্ট হয়। মহারানিকে অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে অরক্ষিত রাখো। আমি জানি না কোথায় চলেছি আমরা। হয়তো মৃত্যুর গহ্বরে।

বীরসিংহ সরে যায় দুর্গাদাসের পাশ থেকে। সে খুব তৎপরতার সঙ্গে ব্যূহ তৈরি করে। রত্না পর্দার আড়াল থেকে বীরসিংহকে দেখে। সে তাকে ঘিরে রাজপুত সৈন্যদলকেও দেখতে পায়। বুঝতে পারে আসল অভিনয় শুরু হয়ে গেল নকল রানি আর রাজপুত্রকে কেন্দ্র করে।

এগিয়ে চলে মাড়োয়ার বাহিনী।

লোকটি বলে,—বাড়িটা ক্ষুদ্র। এত লোকের স্থান হবে না। ওদের রাজপুত সেনানিবাসে পাঠিয়ে দিতে পারেন।

দুর্গাদাস বলে,—দেব! এখন পাঠিয়ে দিলে মহারানিকে অসম্মান করা হবে। তাকে পৌঁছে দেবার পর, তাঁর অনুমতি নিয়ে ওদের পাঠিয়ে দেব।

একটা বাড়ির সামনে এসে লোকটি থামে। দুর্গাদাসের দৃষ্টি নিমেষে চারদিকটা পর্যবেক্ষণ করে নেয়। না, আক্রমণের কোনো আয়োজন নেই। এমনকী অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনাও কম। কারণ বাড়িটার চারদিকে ফাঁকা। হয়তো বাদশা ভেবে নিশ্চিন্ত আছেন যে সামান্য কয়েকজন রাঠোরকে দিল্লির ভেতরে শায়েস্তা করতে বেগ পেতে হবে না।

রত্নার শকট বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে মহারানিও প্রবেশ করে। বীরসিংহ দূর থেকে রত্নাকে দেখে ভাবে, রানির বেশে রানির মতোই মানিয়েছে তাকে। রানি হবার জন্যই জন্ম তার এই পৃথিবীতে। বহু ভাগ্যগুণে সে রত্নার সঙ্গে মিশতে পেরেছিল। আর হয়তো পাবে না। তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা কে বলতে পারে? দিল্লির চরিত্র বড় দুর্বোধ্য। এখানে সব কিছুরই দ্রুত পরিবর্তন হয়। আজকের রানিবেশী রত্না আগামীকাল সত্যিই রানি হবে কিনা কেউ বলতে পারে না। যদি সত্যিই তা হয় তবে কি রত্না তাকে ভুলে যাবে? বীরসিংহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

কিংবা রত্না যা আশঙ্কা করেছে, তাই যদি সত্যি হয়? যদি তাকে জোর করে হারেমে নিয়ে যাওয়া হয়? বাদশা অথবা বাদশাজাদার লালসার আগুনে যদি তাকে আহুতি দেওয়া হয়?

ভাবতে পারে না বীরসিংহ। কারণ একবার রত্না হারেমের অন্তরালে চলে গেলে সে কিছু করতে অক্ষম। নিষ্ফল ক্রোধ দেখিয়ে বা হা-হুতাশ করে কোনো লাভ নেই। হারেম থেকে তাকে উদ্ধার করবার জন্যে জীবনপণ করা যেতে পারে। কৌশলে হারেম থেকেও হয়তো মুক্ত করা যায়।

বাদশাহের লোকটি দুর্গাদাসের কাছে বিদায় নেবার জন্য এগিয়ে আসে। তার একটা হাত চেপে ধরে একটু একান্তে নিয়ে গিয়ে বলে,—আমি নোকর। কাজের বদলে অর্থ পাই। আমি মুসলমান, কিন্তু বাদশাহ নই। আপনার মতোই মানুষ। মানুষের সুখ দুঃখ মানুষই বোঝে শুধু—বাদশাহ নয়। একথা কখনও ভাববেন না, বাদশাহ আপনাদের খাতির করবার জন্য এনেছেন। বিপদ ঘনিয়ে আসছে। জানি একথা প্রকাশ করে নিমকহারামী করলাম। তবু না বলে পারলাম না।

লোকটি দ্রুত প্রস্থান করে।

দুর্গাদাস সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে,—মানুষই বটে। মানুষের জাত ধর্ম নেই। সে যখন ভুলে যায় যে সে মানুষ, তখনই তার মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে ওঠে।

লোকটি বলে গেল,—বিপদ ঘনিয়ে আসছে। দুর্গাদাসও জানে সে-কথা। কিন্তু সেই বহু আশঙ্কিত বিপদের রূপ যে কেমন হবে সে এখনও জানে না। সেটা আকস্মিক হতে পারে—এই মুহূর্তেও ঘটতে পারে। আবার ধীরে ধীরে ফাঁস পরাতে পারেন বাদশা। দুর্গাদাস স্থির করে সৈন্যরা সবাই রানির প্রাসাদের পাশে শিবিরে থাকবে। অন্যত্র তাদের সরিয়ে দেওয়া আত্মহত্যার শামিল।

স্পষ্টভাবে দলপতিদের সব কিছু বুঝিয়ে বলে সে। প্রতিটি মুহূর্ত তৈরি থাকতে হবে। দিল্লিতে প্রবেশের আগে থেকেই সৈন্যবাহিনীতে গুপ্তচরের অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলেছে। তবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রতিটি রাজপুত তাদের মধ্যে অচেনা মুখের আবির্ভাব সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। যার ফলে এ পর্যন্ত পাঁচজন বাদশাহী গুপ্তচর প্রাণ হারিয়েছে। তবু বলা যায় না কার মনে কী আছে। তাই অতি বিশ্বস্ত পাঁচশো রাঠোর বীরকে বেছে নিয়ে তাদের ঠিকভাবে নির্দেশ দিয়ে রাখে দুর্গাদাস। পাঁচশো রাজপুতের অসি যদি সূর্যকিরণে ঠিকমতো ঝলসে ওঠে, তাহলে মুঘল রাজধানী থেকেও শিশুরাজকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, এ দৃঢ় বিশ্বাস দুর্গাদাসের আছে।

বিশ্রামের পর দুর্গাদাস অন্তঃপুরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মহারানির দর্শনপ্রার্থী হয়। পর্দার আড়ালে মহারানি উপস্থিত হলে রত্না মহিষীর বেশে এসে বলে,—কাকাবাবু, রানিমা আপনার কথা শুনতে প্রস্তুত।

দুর্গাদাস মহারানিকে অবস্থার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে বলে,—আপনাকে পুরুষের বেশে দিল্লি নগরী ছাড়তে হতে পারে। আপনি কি প্রস্তুত?

মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে যশোবন্তের সহধর্মিণী বলেন—হ্যাঁ। রাজপুত বীরাঙ্গনা সব সময়ে সব কিছুতে প্রস্তুত, একথা আপনার চাইতে আমি কি ভালো জানি দুর্গাদাস? তাছাড়া সহমরণে যখন যেতে পারিনি, তখন পুত্রকে জীবিত রাখতে আমি সব করতে পারি।

—আমি জানতাম রানিমা। তবু একবার অনুমতি চাইতে আমি বাধ্য। আমি জানি রাজপুত রমণীর পুরুষের পরিধান এই প্রথম নয়—শেষও নয়।

—কিন্তু আমার পুত্রকে কীভাবে উদ্ধার করবেন?

—মিষ্টান্নের ঝুড়িতে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাঁকে আমরা নিয়ে যাব। তাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আপনাকে চিনতে না পারলে শিশু-রাজাকেও ওরা চিনবে না। তবে সব কিছু নির্ভর করছে একজনের ওপর।

দুর্গাদাস রত্নার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে। রত্নার চোখে-মুখে কর্তব্যবোধের দৃঢ়তা। নিজেকে উৎসর্গ করে একটা গোটা জাতিকে রক্ষা করবার প্রেরণায় সে উদ্বুদ্ধ। তবু—তবু তার সমস্ত দৃঢ়তার অন্তরালে অতি সংগোপনে ব্যথিত অশ্রুধারা ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে। দুর্গাদাস সেই বেদনার ইতিহাস জানে না; পৃথিবীতে একজন শুধু জানেন—তিনি রানিমা

দুর্গাদাসের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে রত্না বলে,—আমার কর্তব্য জীবন দিয়েও যথাযথ পালন করব কাকাবাবু।

—জানি মা। তোমার পিতৃ-পরিচয় আমার জানা নেই। তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয়। কিন্তু যে-মুহূর্তে প্রথম তোমায় দেখেছি, সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি কোনো বীর বংশের ললনা তুমি। আমার ধারণা, অতি অল্পবয়সে, খ্যাতি লাভের আগেই তোমার পিতার মৃত্যু হয়েছে। তা যদি না হত, তবে তাঁর পরিচয় এতদিন অজানা থাকত না–তোমার পরিচয়ও না।

—মহারাজা যশোবন্ত সিংহের সেনা হিসাবে তরুণ বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। আমিই তাঁর প্রথম এবং শেষ সন্তান। মা, বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েই আগুনে আত্মাহুতি দেন

—আমার অনুমান নির্ভুল। নইলে দুর্গাদাসের স্নেহ আদায় করা সহজসাধ্য নয়। এই যে হৃদয় দেখছ আমার, এ বড় কঠিন হৃদয়। স্নেহ আর মমতার স্থান এখানে বড় একটা নেই। ঈশ্বর এইভাবেই সৃষ্টি করেছেন আমায় কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। তোমাকে দেখেও প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল আমার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে তোমাকে দিয়ে। সেদিন বুঝতে পারিনি কী সেই উদ্দেশ্য। আজ বুঝছি।

রানির মুখে নিজের প্রশংসা শুনেছে রত্না। কিন্তু দুর্গাদাসের মতো বীরের মুখে শুনে মস্তক আনত হয়ে পড়ে তার। সেই অবস্থাতে একটি অদেখা মানুষের কল্পনা করতে চেষ্টা করে সে—তার শিশু বয়সে যে মানুষটি তাকে কোলে করেছে, আদর করেছে—যে মানুষটা বেঁচে থাকলে সে শৈশবের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হত না। অস্পষ্টও মনে পড়ে না সেই মানুষের মুখ। ছয় মাসের শিশু কি পিতার মুখকে মনের ভেতর বেঁধে রাখতে পারে?

পর্দার আড়াল থেকে মহারানি বলে,—বীরসিংহ সারা পথটা আমাদের নিরাপদে নিয়ে আসতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে।

—হ্যাঁ, সে প্রকৃতই একজন উচ্চশ্রেণির সৈনিক

—তাকে একটু পাঠিয়ে দেবেন।

দুর্গাদাস প্রশ্ন না করে পারে না—আপনি কি তাকে ভালোভাবে চেনেন?

—চিনি না তেমন। দু-একবার দেখেছি। তবে রত্না চেনে।

—কীভাবে?

রত্নার কান্না পায়।

মহারানি গম্ভীর হয়ে বলেন,—তেমন যদি কিছু ঘটেই, তবে তার কাছ থেকে রত্নার বিদায় নেওয়া উচিত।

দুর্গাদাস কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমত, ব্যাপার বুঝতে তার একটু বিলম্ব হয় দ্বিতীয়ত, বোঝবার পর রানির সম্মুখে কী জবাব দেবে সহসা ভেবে পায় না।

শেষে রত্নার আনত মস্তকের দিকে চেয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে, ও, আচ্ছা, আমি তাকে পাঠিয়ে দেব। নিশ্চয় দেব।

শিবিরের দিকে চলতে শুরু করে দুর্গাদাস। তার মাথা সামনে ঝুঁকে পড়ে। অজ্ঞাতে একটা প্রস্ফুটিত ফুলকে সে দলে পিষে ফেলেছে। তার কঠোর হৃদয়ও একটু যেন দ্রবীভূত হয়। সে বুঝতে পারে একটা অনভিপ্রেত দুর্বলতা ধীরে ধীরে তার মধ্যে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তার মনকে আচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা উঁচু করে সে আপন মনে বলে ওঠে, এমন কতশত ফুল পদদলিত হচ্ছে, আর ঝরে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শিশু- রাজাকে রক্ষা করতে না পারলে আরও কত ঝরবে। তার চাইতে শ্রেষ্ঠ ফুলটি যদি তার নিংড়ে নেওয়া রক্তবর্ণ রসের পরিবর্তে দেশমাতৃকার নিরাপত্তা এনে দেয় তাহলে ভবিষ্যতে রাজস্থানের উদ্যানে সহস্র ফুল আপন খেয়ালে ফুটে উঠবে, সৌরভ ছড়াবে।

এদিকে রানির পাশে দাঁড়িয়ে রত্না। দু’চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু। সে কোনো- মতে বলে, —আপনি আমায় রানির বেশে দেখতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বর আপনার সে ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন মহারানি। আসল না হতে পাই, নকল তো হলাম। আজ বুঝলাম আপনি কত ভালোবাসেন আমায়।

মহারানি রত্নাকে বুকে নিয়ে বলেন,–এই ঘোর বিপদের দিনে আমি আর মহারানি নই। আমি তোমার বড় বোন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *