রাজপুত নন্দিনী – ৪

সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। অস্ত যাবার আগে গা ঢাকা দিয়েছে। বীরসিংহ জলের কিনারায় সুকোমল তৃণশয্যায় চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আকাশ-পাতাল ভেবেছে। কূল-কিনারা পায়নি কোনো। শেষে বিরক্ত হয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চিন্তা যখন নিষ্ফল হয়, তখন কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়া শ্রেয়। সে এগিয়ে যায় বহু শিবিরের পাশ দিয়ে কেন্দ্রস্থলের দিকে। ভেতরটা ফাঁকা। মহিষীর শিবির দু-চারটে বড় বড় গাছ এবং ঝোপঝাড়ের একটু আড়ালে-প্রাকৃতিক পর্দা-প্রথা। এটুকু না রইলে মহিষীর পক্ষে বাইরে আসা একেবারেই সম্ভব নয়—বিশেষ করে এখন তার যে অবস্থা। এ অবস্থা না হলেও, সর্বসাধারণের দৃষ্টির সম্মুখে অতি সাধারণভাবে আসা কোনোকালেই অভ্যাস থাকে না রানিদের।

বীরসিংহ ভেবে নেয়, একটা অজুহাত বের করতে হবে রানির শিবিরের দিকে যাবার জন্য। যাকগে শেষ মুহূর্তে মাথায় যা আসবে, তাই বললেই হবে।

এগোতে থাকে সে। সহসা রানির শিবিরের সম্মুখভাগে দৃষ্টি পড়ায় সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। দেখে রত্না দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। তাকে দেখে স্পষ্ট ইশারায় এগিয়ে আসতে বলছে। রত্নার মুখ হাসি হাসি কিনা অতটা বুঝতে পারে না। তবে তার আহ্বানের মধ্যে হাসি ঝরে পড়ছে। ব্যাপারখানা কী? মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি রত্নার? তার মতো লজ্জাশীলা তরুণীর পক্ষে এ ধরনের স্পষ্ট আহ্বান অস্বাভাবিক। তাছাড়া ডাকছে সে রাজমহিষীর শিবিরে। কেউ দেখতে পেলে সাংঘাতিক পরিণতি হবে।

কিন্তু রত্না মূর্খ নয়। তার মাথা যদি ঠিক থাকে তাহলে বুঝতে হবে রানিমার শিবিরে গেলে তারও কোনো অনিষ্ট হবে না।

সৈন্যদলের অধিকাংশই শিবির ছেড়ে সরোবরের তীরে চলে গিয়েছে। সেখানে কেউ জলের মধ্যে সাঁতার কাটছে, কেউ মাছ ধরতে বসে গিয়েছে। কেউ বা মোটা কাঠের ভেলা তৈরি করে তাতে চেপে সরোবর পারাপার করার কষ্ট-কল্পনা করছে।

বীরসিংহ এগিয়ে যেতে থাকে রত্নার দিকে। প্রতিমুহূর্তেই সে আশঙ্কা করে, এবারে রত্না ভয় পেয়ে তাকে চলে যাবার জন্যে হাত নাড়াবে। কিন্তু আশ্চর্য, তা তো নয়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সে আগের মতো।

সত্যিই পাগল হয়নি তো সে? পাগল অবশ্য দুজনেই হয়েছে। দুজনের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য পাগল। কিন্তু সেই পাগলামী, অন্যান্য কর্তব্যকর্মে ছাপ না ফেলা পর্যন্ত কেউ ধরতে পারে না।

বীরসিংহ শিবিরের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রত্না ফিসফিস করে বলে, –তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি।

—অনেকে দেখতে পাবেন। রানিমা রয়েছেন ভুলে যেও না।

—জানি। তুমি দাঁড়াও।

রত্না ছুটে চলে যায় শিবিরের অভ্যন্তরে। বীরসিংহ নিদারুণ বিস্মিত হয়। তবু সে স্থানটি পরিত্যাগ করতে পারে না। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। ধারণাও করতে পারে না আড়াল থেকে স্বয়ং রানিমা এতক্ষণে তাকে দেখছেন।

একটু পরে রত্না বাইরে আসে।

বীরসিংহ বলে,—কী ব্যাপার বলো তো? তোমার চাল-চলন একটু বিদঘুটে ধরনের মনে হচ্ছে। ভরসা পাচ্ছি না ঠিক। মাথা ঠিক আছে তো তোমার?

রত্না হেসে বলে,—হ্যাঁ, খুব ঠিক আছে। শোনো, রানিমা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

—রানিমা!

—হ্যাঁ।

পর্দার আড়াল থেকে রাজমহিষী বলেন,—বীরসিংহ তোমার বীরত্ব আর সাহসের কথা আমি শুনেছি। আজ তোমায় দেখে সন্তুষ্ট। শোনো, কী কঠিন কর্তব্য তোমাদের ওপর ন্যস্ত তুমি জানো। অনাগত শিশুটির জীবন প্রতিটি মুহূর্তে বিপন্ন। আমার ইচ্ছা, যতদিন পর্যন্ত দিল্লিতে না পৌঁছোই ততদিন দিনে এবং রাতে আমার শিবিরের নিরাপত্তা তুমি দেখবে।

বীরসিংহ অন্তরালে দণ্ডায়মানা মহিষীকে অভিবাদন জানিয়ে বলে,—আপনার আদেশ আমি মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু দুর্গাদাসের অনুমতি ব্যতীত আমার পক্ষে কিছু করা একটু অসুবিধাজনক। আপনার আদেশ তাঁর মুখ থেকে পেলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম।

—দুর্গাদাসকে আমি আজকেই বলে দেব।

সে রাতে মহারানির শিবিরের অনতিদূরে পিপুল গাছের নীচে দুই তরুণ-তরুণী মিলিত হল। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মিলন—ফলে অনেকটা সময় বাক্যহারা হয়ে পরস্পরের হৃদয়স্পন্দন অনুভব করতেই কেটে গেল। তারপর মিলনের প্রথম ঢেউ অতিক্রান্ত হয়ে বিচ্ছেদের আশঙ্কার পরবর্তী লগ্ন হয়ে উঠল অশ্রুসজল।

—কেঁদো না রত্না। দিল্লিতে আর কতদিন? আমাদের রাজা জন্মালে দুর্গাদাস কখনোই তাঁকে দিল্লির বাদশাহের দয়ার উপর ফেলে রাখবেন না। আমার বিশ্বাস যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে তিনি রাজপুতানার ভূমিতে নিয়ে যাবেন। মরুভূমির উষ্ণ আবহাওয়ায় মানুষ না হলে মরুরাজার বীরত্বের স্ফুরণ হয় না। দিল্লিতে মানুষ হয়ে রাজপুতানার অনেক রাজপুত্র অপদার্থে পরিণত হয়েছে। তারা বাদশাজাদাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে আলস্যপরায়ণ হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারে না, বাদশাজাদাদের ঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলবার অনেক ব্যবস্থা রয়েছে।

রত্না বীরসিংহের বুকে মাথা রেখে বলে,—আমি অতশত ভাবি না। আমার শুধু একটা ভয়, তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে। তোমায় আমি কিছুতেই ফিরে পাব না।

কেন এ ভয় রত্না? এসব ভাবো কেন?

—ভাবি না। স্বপ্ন দেখি। অন্তত চারটি রাতে আমি এই একই স্বপ্ন দেখে কাঁদতে কাঁদতে জেগে উঠেছি।

—কী সেই স্বপ্ন?

—কে যেন আমায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—দূরে-বহুদুরে—যেখানে থেকে তোমার কাছে ফিরে আসা অসম্ভব। আমি তোমায় ডাকতে চেষ্টা করি-কণ্ঠস্বর কে যেন রোধ করে রাখে। কিছুতেই ডাকতে পারি না। আমি ধীরে ধীরে দূরে সরে যাই। আমার চোখে অশ্রুর প্লাবন। তোমার মূর্তি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই প্লাবনে। তবু তারই মধ্যে দেখতে পাই, তুমি একা অসংখ্য মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করছ। আমার দিকে তোমার লক্ষ্য নেই। তাদের বিনাশ করতে তুমি ব্যস্ত। একজনের পর একজনকে হত্যা করে রক্তাক্ত তরবারি নিয়ে তুমি চিৎকার করে উঠছ। তোমার অসি চালনায় বিদ্যুতের স্পর্শ। আমাকে দেখছ না তুমি কিছুতেই। আমি যে আরও দূরে চলে যাচ্ছি। একবার দেখো। তুমি বুঝতেও পারছ না তোমার রত্না চলে গেল। ওরা জন্মের মতো নিয়ে গেল আমায়।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রত্না।

বীরসিংহ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার বলে,–এ শুধু স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন রত্না। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না।

—তা যদি না হয়, তবে আমার মতো সৌভাগ্যবতী নারী পৃথিবীতে নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হয় সত্যি হবে। সেইজন্যেই মনে হয় ভগবান আমার মনকে দৃঢ় করে তোলবার জন্যে একবার মিথ্যে ভয় দেখিয়েছিলেন। তুমি যদি সেদিন সত্যিই না ফিরতে গিরিপথ থেকে, তবু তো আজ এই মুহূর্তে আমি বেঁচে থাকতাম

ভাবতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে তার সর্ব শরীর। তারপর আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেঁদেও কত সুখ—যদি বীরসিংহের বুকে মাথা রাখা যায়। কিন্তু না—আর সে কাঁদবে না। এই সুন্দর রাতটা ব্যর্থ হয়ে যেতে সে দেবে না। অনাগত ভাগ্যলিপিতে যা লেখা থাকে থাক, এই দুর্লভ সময়টুকুর অপব্যয় হতে দেবে না। যে জীবনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে নিহিত তার বর্তমানটুকু বহুমূল্য। নারীত্বের দুর্বলতায় সেই বর্তমানকে ব্যর্থ হতে কিছুতেই দেবে না। পাহাড়ের ওপর থেকে চাঁদ উঁকি দেয়। সেই চাঁদের আলো সরোবরের জলে অস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। পিপুল গাছের পাতায়, ডালে রুপোলি আলোর আবছা স্পর্শ।

রত্না ঘুরে বসে দু’হাতে বীরসিংহের গাল দুটো চেপে ধরে বলে,—বলো, এ ক’দিন তোমার কষ্ট হয়নি? আমার জন্যে?

—খুব।

—এত অল্প কথায় নয়। একটু বেশি করে বলো।

—খুব কষ্ট হয়েছে রত্না।

—উঁহু এর চেয়েও বেশি করে বলো। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।

—এর চেয়ে বেশি আমি বলতে পারিনে রত্না। বীরসিংহের মুখে অসহায়তার ছাপ ফুটে ওঠে। রত্না হেসে বীরসিংহের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে বলে,—ও, তুমি বীরপুরুষ। ভুলে গিয়েছিলাম! যুদ্ধ করতে পারো খালি। তাই না?

—তা পারি। তবু, এখনো অনেক কিছু শিখতে বাকি। মহারাজ যশোবন্ত সিংহের প্রবীণ বয়সের অসি চালনাও দেখেছি—দেখেছি তাঁর অশ্ব চালনা। নিজেকে নগণ্য বলে মনে হয়।

–তোমার কত কম বয়স সেটা ভুলে যেও না। অভিজ্ঞ হতে হলে সময়ের প্রয়োজন। তুমি পুরুষসিংহ। তুমি আমার গর্ব।

বীরসিংহ চুপ করে থাকে।

রত্না বলে,–দিল্লিতে গিয়ে তুমি কী করবে?

—জানি না রত্না।

—কবে আমাকে দেশে নিয়ে যাবে?

—যেদিন তুমি বলবে।

—তোমার ইচ্ছে নেই কোনো?

—আমার? হ্যাঁ—

—কী?

—আমার ইচ্ছে আছে।

—কী ইচ্ছে।

—আমার—

বীরসিংহ আমতা আমতা করে।

রত্না খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে—

—তুমি কী সুন্দর!

—আমি? ধ্যেৎ। আমি সুন্দর হতে যাব কেন?

—তুমি জানো না। তাই। তুমি সুন্দর বীরসিংহ

চারদিক স্তব্ধ। শুধু দূরের প্রহরীরা সজাগ। পথশ্রান্ত সেনারা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় নিদ্রায় অচেতন। সরোবরের ঝিরঝিরে হাওয়ায় গাছের পাতায় কাঁপন লাগায়।

—রত্না।

—বলো।

—রানিমা, কী করে আমার কথা জানতে পেলেন?

—আমার চোখে জল দেখে সন্দেহ করলেন। তারপর চেপে ধরলেন।

—তুমি বলে দিলে?

—তাঁর কাছে মিথ্যে বলা যায়? তিনি আমায় ভালোবাসেন।

—জানি। নইলে এভাবে সুযোগ করে দিতেন না। রানিমার মঙ্গল হোক। তিনি যেন তাঁর পুত্রকে সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখেন।

—তা দেখবার বাসনা তো সবারই।

—হ্যাঁ। তবু তিনি মা। স্বয়ং মুঘল বাদশাহ তাঁর পুত্রের শত্রু। আমার এই প্রার্থনার চাইতে বড় প্রার্থনা মাড়োয়ারের কেউ করতে পারে না রত্না।

—জানি।

—রত্না।

—বলো।

—তোমার চোখে এত জল আসে কেন?

—তোমার জন্য।

বীরসিংহ চুপ করে যায়।

—কি, কিছু বললে না তো?

—না। কাঁদতে তোমার ভালো লাগে?

—কখনো কখনো—হ্যাঁ, খু—ব।

—আমার কান্না পায় না।

—তুমি যে পুরুষ! তুমি কাঁদলে আমার কান্না কে দেখবে!

দূরে প্রহরীর চিৎকার—হেই, হুঁশিয়ার।

বীরসিংহ লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুহূর্তের মধ্যে প্রেমিক বীরসিংহ পরিণত হয় যোদ্ধা বীরসিংহে।

—আমি চলি রত্না। ওরা কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। রত্নার জবাবের অপেক্ষা না করে সে ছুটতে থাকে। রাতের নীরবতায় তার পদশব্দ বেশ কিছুক্ষণ কর্ণগোচর হয়। তারপর দূরে মিলিয়ে যায়।

.

বীরসিংহ হুঁশিয়ারী শব্দ লক্ষ্য করে সরোবরের ধারে এসে উপস্থিত হয়। দেখতে পায় দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তাদের কাছে এগিয়ে যায়। তাদের দৃষ্টি সরোবরের জলের দিকে। বীরসিংহ সেদিকে তাকায়।

ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কে যেন সাঁতরে আসছে পাড়ের দিকে। এই নিশীথে সরোবরের অগাধ জলে কেউ শখ করে সাঁতার দিতে নামে না। এটি নদীও নয় যে, ওপার থেকে অন্য শত্রু এগিয়ে আসবে অলক্ষ্যে, কিংবা আসবে নিজেদের কোনো গুপ্তচর জরুরি সংবাদ বহন করে। ইচ্ছে করলে সরোবরের পাশ কাটিয়ে তারা যেতে-আসতে পারে।

তীব্র কৌতূহল নিয়ে তিনজন চেয়ে থাকে। জলের মানুষটিকে চাঁদের আবছা আলোয় ভালোভাবে দেখা যায় না। বোঝা যায় না সে শত্রু অথবা মিত্র। তবে দুশ্চিন্তা নেই এদের, কারণ সংখ্যায় এরা গরিষ্ঠ।

লোকটি অবশেষে পাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দম নিয়ে ধীরে সুস্থে জল থেকে ওপরে উঠে আসে। সে ক্লান্ত। নিঃশ্বাস তখনো স্বাভাবিক নয়।

বীরসিংহ প্রহরী দুজনকে ডেকে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। তারপর বিস্মিত কণ্ঠে বলে ওঠে,– ভীমসিংহ, তুমি!

—হ্যাঁ।

এই ভীমসিংহের পাশাপাশি সে কত যুদ্ধ করেছে। এর যুদ্ধকৌশল এবং বীরত্বে কত সময় মুগ্ধ না হয়ে সে পারেনি। বয়সে তার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও ভীমের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল গিরিপথে। সেই ভীম কী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে?

—এই রাতে—জলে?

—হ্যাঁ। শেষ করে দিয়ে এলাম।

ভীমসিংহ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।

দূরে ফেউ ডাকছে। বাঘ বেরিয়েছে শিকারের খোঁজে। পাশের গাছের ঘুমন্ত বানরের দল কিচির মিচির করে জেগে ওঠে সেই ডাকে।

সেদিকে খেয়াল নেই কারও।

বীরসিংহের দৃষ্টি তীব্র হয়ে ওঠে। তার মনের সন্দেহ বিন্দুমাত্র অপসারিত হয় না। লৌহকঠিন কণ্ঠে বলে—তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে ভীমসিংহ।

ভীমসিংহ ঘুরে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় তার চোখের তারা চকচক করে ওঠে। বলে—কৈফিয়ত? তুমি কৈফিয়ত চাও বীরসিংহ? ও হ্যাঁ, দেব বৈকি। একজন রাজপুতকে হত্যা করেছি যখন, কৈফিয়ৎ দিতে হবে বইকি।

—চলো, দুর্গাদাসের কাছে।

এতক্ষণে ভীমের সিক্ত মুখে হাসি ফোটে। বলে,—এত রাতে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে লাভ নেই বীরসিংহ। যদিও জানি তুমি উপযুক্ত কথাই বলেছ। বাকি রাতটুকু আমায় বরং বন্দি করে রাখো।

ভীমের যুক্তি অস্বীকার করা যায় না।

—তোমার কোমরে ছোরা দেখছি।

—হ্যাঁ, জলে ধুয়ে না গেলে রক্ত দেখতে পেতে। মানুষের বুকের টাটকা রক্ত।

—ঘটনাটা খুলে বলো ভীম।

—বলেছি তো, শেষ করে দিয়ে এলাম একজনকে। কিছুদিন থেকে তার ওপর আমার সন্দেহ হয়। নজর রাখি, আলাপ জমাই। বুঝতে পারি, মাড়োয়ারের এই কুলাঙ্গার বাদশাহের হয়ে কাজ করছে। এখানকার গোপন খবর লোক মারফত বাদশাহের কাছে পাচার করে। কয়েকজন অচেনা ব্যক্তি কিছুদিন পর পর তার সঙ্গে দেখা করে। আজ ধরা পড়ে গেল হাতে-নাতে। সে পালাতে চেষ্টা করছিল। পেছু ধাওয়া করলাম। ইচ্ছে করলে সে আমাকে হত্যা করতে পারত, কারণ তার কাছে তলোয়ার ছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের বোধ হয় মনের বল বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই আমি ধাওয়া করতেই সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মস্ত ভুল করে বসল সে। তবু জলের মধ্যেও বোধ হয় আমাকে মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু তার পোশাক ছিল অনেক ভারী। নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ডুবে যাবার ভয়। তবু কতকটা সাঁতরে গিয়েছিল।

—কে সে?

—তাকে কি চিনবে? এত সেনার মধ্যে তার নাম জানা সম্ভব নয়।

—তবু বলো শুনি।

—চেতন সিংহ।

বীরসিংহ চমকে ওঠে। তার সঙ্গেও কিছুদিন থেকে লোকটা ঘনিষ্ঠতা করছিল। বোধ হয় কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কোনো খবর। আফশোস হয়।

—তুমি ঠিক করেছ ভীম। সকালে ঘটনাটা আমিই বলব দুর্গাদাসকে। তুমি ক্লান্ত–বিশ্রাম করোগে।

প্রহরীরা আরও সজাগ হয়। বীরসিংহ টহল দিয়ে বেড়ায়। রত্নার কাছে আর যাওয়া হয় না। চেতনসিংহের মতো আরও কতজন বিশ্বাসঘাতক রয়েছে কে জানে—রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে শিবির ছেড়ে দিল্লির পথে যাবার সুযোগ খুঁজছে। এই বিশ্বাসঘাতকদের জাত নেই, দেশ নেই, বিবেক নেই—কিছু নেই। সে স্বচক্ষে দেখেছে কত মুঘল সৈন্য এসে দুর্গাদাসের সঙ্গে দেখা করে। ফিসফিস করে কত কথা বলে চলে যায়। সে আরও দেখেছে গিরিপথে যুদ্ধের সময় শত্রু সেনাদের অনেকে মহারাজা যশোবন্ত সিংহকে গোপন খবর বলে দিয়ে কৃতার্থ হয়েছে। ওদের দিকে চাইলে নাসিকা কুঞ্চিত হয়। ওদের কথা ভাবলে গা ঘিনঘিন করে।

.

দুর্গাদাসের মুখে সে শুনেছে গুপ্তচর নিয়োগের কলাকৌশল আওরঙ্গজেবের মতো আর কেউ জানে না ভারতবর্ষে। দুর্গাদাস মনে মনে আওরঙ্গজেবকে শ্রদ্ধা করে। শুধু যশোবন্ত সিংহের প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর প্রকৃতির মিল হল না বলে এই সংঘর্ষের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে মাড়োয়ার।

.

দিল্লি আর দূরের পথ নয়। পঁচিশ দিন—বড় জোর একমাস।

সেই সরোবরের ধারে যেভাবে বিশ্রাম নিয়েছিল দলটি, তেমনি বিশ্রাম আরও অনেকবার নিয়েছে। কালক্ষেপ করেছে দুর্গাদাস। তবু রানির সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়নি। সবাই ভেবেছিল পথের পরিশ্রমে নির্ধারিত সময়ের আগেই হয়তো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে! তাদের প্রত্যাশা ভুল প্রমাণিত হল। ঠিক সময়ে দিল্লির কাছাকাছি এসে শিশু ভূমিষ্ঠ হল।

প্রতি সন্ধ্যাতেই শঙ্খধ্বনি শোনা যায় রানির শিবিরে। সবাই সে শব্দ শুনে কপালে হাত ঠেকায়। সেদিন তারা দেখল তাদের দলনেতা ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত মুখে দ্বিপ্রহরের আগেই সহসা যাত্ৰা স্থগিত রাখল। সৈন্যদের হুকুম দিল বিশ্রাম নিতে। তাড়াতাড়ি শিবির স্থাপিত হল।

সন্ধ্যার অনেক আগেই সেদিন শাঁখ বেজে উঠল। প্রশ্নের উদয় হলো সাধারণ সৈনিকদের মনে—রানি কি বিশেষ কোনো ব্রত উদ্‌যাপন করছেন? সম্ভবত তাই। নইলে অসময়ে শিবির স্থাপন এবং শঙ্খধ্বনি হবে কেন?

এদিকে দুর্গাদাস রানির শিবির থেকে কিছুটা দূরে অস্থিরভাবে পদচারণা করছিল। সঙ্গে ছিল তার চন্দ্রভান, বরমল, রঘুনাথ ইত্যাদি। আজ বিধাতার রায় প্রকাশিত হবে। জানা যাবে, মাড়োয়ারের প্রতি তিনি মুখ তুলে চেয়েছেন কিনা। শুধু একটি পুত্র-সন্তান চাই। একটি শিশু—যাকে রাজা বলে ঘোষণা করা যাবে। তারপর বাকি সব দুর্গাদাস দেখবে। তার পার্শ্ববর্তী বীরদের দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে ভাবে, এরা যাঁর জন্যে রক্ত দিতে প্রস্তুত তাঁকে সহসা নাগালের মধ্যে পাওয়া দিল্লির বাদশাহের পক্ষেও সম্ভব নয়। হয়তো একেবারেই অসম্ভব।

কিন্তু অদূরবর্তী শিবিরে কী ঘটতে চলেছে কে জানে! মহারানির কাতরধ্বনি কর্ণগোচর হয়। লজ্জিত হয়ে পড়ে দুর্গাদাস। একটা অপরাধবোধ তাকে পীড়া দেয়। সে সবাইকে নিয়ে আরও কিছুটা দূরে সরে যায়। রমণীর এই পবিত্রতম মুহূর্তে তাঁর সমস্ত গোপনীয়তা অটুট থাকাই বাঞ্ছনীয়।

সেই সময় শঙ্খধ্বনি।

দুর্গাদাসের পদচারণা স্তব্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য দলনেতারাও দুর্গাদাসের পাশে চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়েও যাদের বুক কাঁপে না, এই সন্ধিক্ষণে তাদের বুক ধ্বক ধ্বক করে কাঁপতে থাকে। ওরা চেয়ে থাকে শিবিরের দিকে। কিন্তু কেউ বাইরে আসে না। অনেকেই রয়েছে সেখানে। সেনাপতি গোবিন্দের স্ত্রী রয়েছে এবং ভগিনী রয়েছে, ধ্রুব সিংহের মা রয়েছে। অথচ সবাই যেন স্থবির।

দুর্গাদাস চেঁচিয়ে ওঠে,—কী করছে ওরা! বাইরে আসতে পারছে না কেউ! খবরটা জানাতে পারছে না?

চন্দ্রভান ঘোরতম বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলে,—একেই বলে স্ত্রী জাত। ছেলে হয়েছে দেখে নিজেরাই আনন্দে পাগল হয়ে হইচই করছে। আমাদের কথা ভুলে বসে আছে। কিংবা —কিংবা মেয়ে হয়েছে দেখে ভয়ে এদিকে এসে জানাতে সাহস পাচ্ছে না হয়তো। যেন ওদেরই মস্ত অপরাধ। স্ত্রীলোক আর কাকে বলে?

বীরসিংহ খুব আস্তে বলে,—শাঁখ বাজানো উচিত হয়নি।

সবার দৃষ্টি একসঙ্গে তার দিকে পড়ে। দুর্গাদাস বলে,—হুঁ, কথাটা ঠিক বলেছ। এত ঢাক পেটাবার দরকার ছিল না। আমারই ভুল হয়েছে। নির্দেশটা ভালোভাবে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

সেই সময় ওরা দেখতে পায় মহারানির পরিচারিকা মাথায় ওড়না দিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে ব্যগ্র প্রতীক্ষার অবসান হবে।

ওরা সংবাদের কথাই ভাবে। কিন্তু বীরসিংহের মনে আর এক চিন্তা। রত্নাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! চলবার ভঙ্গি কী চমৎকার! রানির শিবিরে মহিলাদের মধ্যে রত্নাই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমতী। তাই আর কারও মনে না থাকুক, তার ঠিক মনে রয়েছে, বাইরে প্রতীক্ষারত রাঠোর বীরগণের কথা, যাদের কাছে সংবাদটি সর্বাগ্রে পৌঁছনো উচিত—সুখের সংবাদ হোক বা না হোক।

রত্না দুর্গাদাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। বীরসিংহ লক্ষ করে, তার দিকে ভুলেও একবার দৃষ্টি ফেলে না। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠলেও মনে মনে ওর সংযম ও কর্তব্যবোধের প্রশংসা না করে পারে না।

—কী সংবাদ?

মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ে রত্নার। সুমধুর অথচ সংযত কণ্ঠে বলে,—আজ রাতে আকাশে চাঁদ উঠবে না। সেই চাঁদ ঝরে পড়েছে রানির কোলে।

—সত্যি?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু মেয়ে না ছেলে!

সবার দৃষ্টি রত্নার মুখের দিকে। ওর কথার ওপর মাড়োয়ারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সুতোয় ঝুলছে সেই ভবিষ্যৎ।

—আমি হাসছি কাকাবাবু। মেয়ে হলে কি হাসতাম?

বীরেরা একসঙ্গে জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। সৈন্যেরা সেই জয়ধ্বনি শুনে সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে এসে জড়ো হতে থাকে।

বীরসিংহ ধীরে কণ্ঠে বলে,—জয়ধ্বনি না দিলেই ভালো হত।

দুর্গাদাস চারদিকে সচকিতে চেয়ে বলে,—ঠিক। আমারই ভুল।

রত্না এতক্ষণে বীরসিংহের দিকে অপাঙ্গে চেয়েই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সেই মুহূর্তটুকুতেই তার কপোল রাঙা হয়ে ওঠে। সে বলে,–এ সংবাদ কখনও চাপা থাকে না। কথাটা আমি চিন্তা করেছিলাম। শেষে নিরর্থক ভেবে শাঁখ বাজাই। রাজপুত্রের জন্মক্ষণে শাঁখ বাজবে না?

বরমল বলে ওঠে,—তাঁর জন্মলগ্নে জয়ধ্বনি হবে না?

অন্যান্য বীরেরা বলে,—ঠিক ঠিক।

এবারে তারা আরও জোরে চিৎকার করে ওঠে। দুরের সৈন্যরা বুঝে না-বুঝে জয়ধ্বনি দেয়। তারপর নিকটে এসে সব জেনেশুনে নাচতে শুরু করে।

বীরসিংহ হাল-চাল দেখে শুনে গম্ভীর কণ্ঠে বলে—তাহলে আমারই হয়তো ভুল। সবাই যখন বলছে ঠিক।

রত্না ওড়নার প্রান্ত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে হাসি সামলাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দ্রুতপদে ফিরতে থাকে শিবিরের দিকে।

.

সে রাতে প্রহরীর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও, সৌভাগ্যক্রমে বীরসিংহ রত্নার সঙ্গে মিলিত হবার উপযুক্ত নির্জন স্থান খুঁজে পেল। রত্নাকে একটা নতুন খবর জানাবার ছিল। দুর্গাদাসকে বীরসিংহ সুনিপুণ যোদ্ধা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ হিসাবে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু জানত না, কতখানি দূরদর্শী সে। কিছুদিন আগে সেনাবাহিনীর একজনের স্ত্রীর সন্তান প্রসবের ঠিক পরেই মৃত্যু হয়। দুর্গাদাস সেই সৈনিকের কাছে গিয়ে বলে,–তোমার পুত্রটিকে আমায় দান করো।

স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত ব্যক্তিটি শিশুসন্তান নিয়ে মহা দুর্ভাবনায় পড়েছিল। দলনেতার প্রার্থনায় কৃতার্থ হয়ে বলল,—আমার পরম সৌভাগ্য যে একজন নগণ্য সৈনিকের পুত্রকে আপনি অযাচিতভাবে গ্রহণ করছেন।

—কিন্তু তোমার যেন কোনোরকম আশা না থাকে যে একে আমি পুত্র হিসাবে গ্রহণ করছি।

—আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না সর্দার।

—দেশের মঙ্গলের জন্য একে যদি আমি উৎসর্গ করি তাহলে তোমার আপত্তি আছে? সৈনিকটির সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলে,—একে আপনি বলি দেবেন?

—যে অর্থে তুমি ‘বলি’ কথাটা ব্যবহার করছ, সে অর্থে না হলেও ‘বলি’ বৈকি। তুমি কি দেশের জন্যে নিজেকে বলি দিতে চাও না?

—চাই সর্দার।

—তবে? আমি কাপালিক নই। কাপালিকের আচরণেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ‘বলি’ কথাটাকে আমি বিশ্বাস করি। তোমার ছেলেকে আমি দেশের জন্যে ‘বলি’ হিসাবেই নিলাম। হয়তো, ওকে প্রয়োজন না-ও হতে পারে। যদি না হয়, তবে কথা দিচ্ছি আমি আমার নিজের পুত্রের মতন ওকে গড়ে তুলব। সত্যি কথা বলতে কি এই শিশুর বয়সি আমার কোনো পুত্র থাকলে, এভাবে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতাম না।

সৈনিক পুরুষটি লজ্জিত কণ্ঠে বলে—আমি জানি সর্দার। ওকে আপনি গ্রহণ করুন। আমি জানি ওকে আপনি ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করবেন না।

—তুমি তো দেশপ্রেমিক। তাই আর একটা নির্মম সত্য জেনে রাখো। দেশের স্বার্থে একদিন একে হয়তো ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে হতে পারে।

সৈনিকটি দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সহসা ছুটে গিয়ে তার পুত্রটিকে তুলে এনে দুর্গাদাসের হাতে সমর্পণ করে বলে,—দেশের চাইতে বড় কিছুই নেই আমার কাছে। থাকলে আমার স্ত্রীর এই স্মৃতিটুকুকে কখনোই দিতাম না আপনাকে। তাছাড়া ধর্মের কথা বলছেন? শৈশব থেকে যে যেই ধর্মের আবেষ্টনীতে মানুষ হয়, সেই ধর্ম তার কাছে শ্রেষ্ঠ। আমি জানি সবই এক।

সৈনিকের চোখ শুকনো। দুর্গাদাসের চক্ষুদ্বয় কিন্তু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তার পাশে দণ্ডায়মান বীরসিংহ নিজেকে শক্ত রাখতে পারেনি।

মাত্র কয়েকদিন আগের এই ঘটনাটি। বীরসিংহ বুঝতে পারছে, দুর্গাদাস কোন গভীর কৌশল অবলম্বন করতে চলেছে। আজ রত্নাকে কথাটা বলতে হবে।

রত্না বসে ছিল নির্দিষ্ট স্থানটিতেই। বীরসিংহের স্পর্শে সে কিন্তু বিগলিত হলো না। তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল না।

—সম্রাজ্ঞী আজ এত গম্ভীর যে! এত দিন থাকতে, এই বিশেষ দিনটিতে? যেদিন সমস্ত বাহিনী আনন্দে মাতোয়ারা!

রত্না তবুও অনড়।

বীরসিংহ তার পাশে বসে দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,—ইস্, কী সুন্দর দেখতে যে লাগছিল তোমায়, যখন তুমি রাজার জন্মের সংবাদটি দিতে গেলে। ইচ্ছে হচ্ছিল; তখুনি সবার সামনে—

বীরসিংহ তবু কোনোরকম সাড়া না পেয়ে রত্নার মুখখানা দু’হাতে তুলে ধরে। ধরেই বুঝতে পারে সে কাঁদছে।

—কাঁদছ?

অতি কষ্টে রত্না বলে,—হ্যাঁ। আজকের দিনেও কাঁদছি। আমি নারী। তাই বোধহয় নিজের স্বার্থটা বড় হয়ে ওঠে।

—এমন কী হয়েছে যে এতটা উতলা হলে?

—তোমাকে আমি অনেকবার বলেছি যে আমাদের মিলন সম্ভব না। ঈশ্বর চান না যে আমরা দুজনে সুখে ঘর করি। তিনি চান না, তোমার সন্তানের জননী হয়ে, তাদের মানুষ করে তুলে পরম তৃপ্তি পাই।

—তোমায় তো বলেছি রত্না স্বপ্ন স্বপ্নই। ক্বচিৎ কখনও দু-একটা সত্যি হয়ে যায়। অনেক অবাস্তব কল্পনাও তেমনি কত সময় সত্যি হতে দেখা গিয়েছে।

রত্না ভাঙা গলায় বলে,—এবারে আর স্বপ্ন নয়।

—তার মানে?

—আজ রাতে কাকাবাবু আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

—তোমাকে? ও রাজার দেখাশোনার ভার তোমায় দিতে বুঝি? তাই ভয় পেয়েছ। ভাবছ বুঝি, সারাজীবনে সে ভার বইতে হবে? এ তো সৌভাগ্য। এর জন্যে আমাদের মিলনের বাধা কোথায়? মহারানি তো তোমায় স্নেহ করেন।

বীরসিংহ ভেবেছিল, অনেক কথা একসঙ্গে বলে রত্নার সমস্ত দুশ্চিন্তা ভাসিয়ে দিয়ে এই মুহূর্তের মিলনকে মধুর করে তুলবে। কিন্তু তার কথা রত্নার মনে এতটুকু রেখাপাত করতে পারল না।

বীরসিংহ চুপ করলে সে বলল—তা নয় গো। রাজপুত্র নয়। অন্য একটি ভার।

—ও, এবারে বুঝেছি। সেই শিশুটি—।

—তুমি জানো?

—জানি বৈকি। আমিও তো গিয়েছিলাম দুর্গাদাসের সঙ্গে তাকে আনতে। আহা, বেচারা মাতৃহারা! তোমার যত্নে যদি বেঁচে যায়। দুর্গাদাসের হাবভাবে মনে হয় তাকে বাঁচানো খুবই প্রয়োজন।

রত্না উত্তেজিত হয়ে বলে,—হ্যাঁ, প্রয়োজন। এত বেশি প্রয়োজন যে তার একজন মায়ের দরকার। সত্যিকারের মা-যে মা বরাবর তার সঙ্গে থাকবে। সেই মা হব আমি।

বীরসিংহ হেসে বলে,—বাঃ সুন্দর। বেশ তো তোমার সঙ্গে ওটিকে ঘরে নিতেও আমার আপত্তি নেই।

—তুমি হাসছ, কারণ এখনও সবটা শোনোনি। কাকাবাবু আমায় যা বলেছেন আর কেউ তা জানে না। তুমি নিশ্চয় জানতে পাবে তাঁর কাছ থেকে, তাই তোমায় বলছি। নইলে জিনিসটি এত গোপনীয় যে এই গাছের নীচেও মুখ খোলা নিরাপদ নয়।

কথাটা শুনে বীরসিংহ একবার গাছের প্রতিটি ডাল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যাচাই করে নেয়। বলা যায় না, গুপ্তচরের গতি সর্বত্র। সেই সরোবরে ভীম সিংহ যাকে শেষ করে দিয়ে এসেছিল, তেমন আরও কত রয়েছে কে জানে! রাজার জন্মের খবর হয়তো দিল্লির পথে এতক্ষণ অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছে।

—বলো রত্না, সবটা বলো। আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি।

—আমি মহারানি, আর ওই শিশুটি হলো মহারাজা যশোবন্ত সিংহের পুত্র।

—সে কী! বলছ কী তুমি!

—হ্যাঁ। আসল রাজপুত্রের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা। কাল থেকে মহারানির চেয়েও আমার বেশভূষা মূল্যবান হবে।

তবু সবটা বোধগম্য হয় না বীরসিংহের। সে এ সম্বন্ধে তলিয়ে ভাবতে চেষ্টা করেনি। যুদ্ধ করাটাই তার পেশা, আর রত্নাকে ভালোবাসা তার নেশা। এই দুই পেশা আর নেশা নিয়ে জীবন কাটাতে পারলে সে সবচেয়ে সুখী হবে। চিন্তা করতে সে-ও পারে। কিন্তু দুর্গাদাস থাকতে চিন্তা করবার প্রয়োজন হয় না। সব চিন্তার সূত্রপাত ওই একটি মস্তিষ্কে। তাছাড়া দুর্গাদাসের কঠোর আদেশ কেউ যেন চিন্তা না করে। কাজ—শুধু কাজ।

—আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না রত্না। বুঝিয়ে বলো।

—কাকাবাবু আশঙ্কা করছেন, রাজপুত্রের ওপর আক্রমণ হতে পারে। তেমন কিছু সত্যিই ঘটলে নকল রাজপুত্রই যেন ফলভোগ করে এবং সেইসঙ্গে তার মা। আর আসল রাজমাতা এবং রাজা সেই সুযোগে বহুদূরে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারবেন।

—বুঝেছি। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তবু কাঁদবার কী রয়েছে জানি না। তেমন কিছু ঘটবার সম্ভাবনা আদৌ আছে কিনা তাই বা কে জানে!

—কাকাবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস এমন ঘটনা ঘটবেই। তাই তিনি আমাকে এই বলে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন যে বন্দিনী অবস্থায় বাদশাহী হারেমেও সারাটা জীবন কাটাতে হতে পারে। উঃ! তুমি তখন কত দূরে। ভাবতে পারি না। হয়তো জীবিত থেকেও তোমার কাছে আমি রইব মৃত।

রত্না কেঁদে ফেলে বলে, তার চাইতে ওরা যখন আক্রমণ করবে তখনি যদি আমার মৃত্যু হয়, খুব ভালো হবে। সবাই ভাববে মহারানির মৃত্যু হয়েছে।

—তুমি বড্ড বেশি ভেবে ফেলেছ রত্না। সম্ভাবনার কথাই শুধু বলা হয়েছে। আসলে তো না-ও হতে পারে।

—দেখে নিও, ঠিক হবে। আমার মন ডেকে বলছে। আমি দেখতে পাচ্ছি রক্তাক্ত তরবারি। আমি দেখতে পাচ্ছি মুঘল হারেমের দৃশ্য। আমায় তুমি এখনই মেরে ফেলো।

বীরসিংহ গম্ভীর স্বরে বলে, ফেলতাম হয়তো। কিন্তু কর্তব্য? তুমি কর্তব্য দেখে ভয় পাও রত্না?

—না। আমায় ভুল বুঝো না। আমি জানি বীর দুর্গাদাসের আমার ওপর কতখানি বিশ্বাস, যার ফলে এই কঠিন কর্তব্যভার আমার ওপর অর্পণ করেছেন। মুঘলদের আওতায় পড়ে ওদের অমানুষিক অত্যাচারের মুখেও আমি সত্য গোপন রাখব এ কথা বিশ্বাস করেই তিনি আমার ওপর নির্ভর করেছেন। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি। কিন্তু যখনই তোমার কথা মনে পড়ে—

রত্না ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

বীরসিংহ তাকে চেপে ধরে রাখে। সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পায় না। তার নিজের বুকের ভেতরেও একটা অব্যক্ত ব্যথা ঠেলে উঠছে।

দূরের কোনো গাছে রাতের শিকারি পাখি ডেকে ওঠে। বিকট শব্দে নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে যায়।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *