রাজপাট – ৯

কার্তিকেতে বিষাউষ 
কালীপূজার রাতি। 
মায়ের চরণে মলুয়া 
করিল মিন্নতি ॥ 
কার্তিকের বিষাউষ 
না লাগে তার গায়। 
এই বর দাও মাগো 
ধরি তোমার পায় ॥

চাটুজ্যেদের বাড়ি আর বরকত আলির বাড়ি—এই দুইমাত্র বাড়িতে আছে দোতলা দালান। সেনদের বাড়ি পাকা ঠিকই, তবে একতলা। বর্ষায় ভৈরবের জল উপচে ওঠে বলে এ গ্রামের সম্পন্ন বাড়িগুলি উঁচু ভিতে গড়া। সেই ভিতের হিসেবে ধরলে চাটুজ্যেদের বাড়ি শহরের তিনতলা বাড়ির সমান। 

বরকত আলির বাড়ি অত বড় নয়, উঁচুও নয় অত। আয়তনে ও উচ্চতায় চাটুজ্যেবাড়ির এই যে উঁচু হয়ে ওঠা—তার জন্য দায়ী তাদের ব্যবসার কারণে ধন ও সম্পন্নতার প্রতিষ্ঠা। বাণিজ্যলক্ষ্মী চাটুজ্যেদের প্রতি সদয় হয়েছেন সেই নবাবি আমল থেকে। এই পরিবার তখন রেশমের ব্যবসাদার হয়ে ওঠে। মুর্শিদাবাদের রেশমি বস্ত্রের তখন পৃথিবীজোড়া নাম। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন মুর্শিদাবাদের পত্তন করেন, তার আগে থেকেই এখানে তুঁত চাষ ও রেশম উৎপাদন হত। মুর্শিদাবাদ মূল শাসনকেন্দ্র হয়ে উঠলে প্রচুর দেশি ও বিদেশি বণিক এখানে আসা-যাওয়া শুরু করল। কাশিমবাজারে তো বিদেশিদের বসবাস ছিলই, এবার মুর্শিদাবাদ ও কাশিমবাজার একযোগে হয়ে উঠল রেশম ও রেশমজাত বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল। সমগ্র ভারতবর্ষ, এশিয়া ও ইউরোপে এই বস্ত্রের চাহিদা ছিল। 

ভাল রেশম উৎপাদনের জন্য চাটুজ্যেরা তেকোনা গ্রামে রেশম তাঁতি ও তুঁত চাষিদের বসত গড়তে জমি দিয়েছিলেন। তাঁতি পরিবার তেকোনা গ্রামে এখন আর একটিও নেই। কিন্তু তুঁতচাষি আজও দু’ঘর আছে। 

রেশম ব্যবসা করে চাটুজ্যেদের মতো সেনরাও কেন দু’পয়সা করে নেয়নি, সে এক আশ্চর্য। অথচ তখন রেশম ব্যবসায়ীদের হাতে সোনা ফলত। এমনকী রেশমকে কেন্দ্র করে এই বিশাল ব্যবসা, নবাবি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে সুদৃঢ় করেছিল। রাজশক্তির সঙ্গে অর্থসম্পদের সমন্বয় ঘটলে তবেই পূর্ণ শক্তি তৈরি হয়। অর্থাৎ শক্তি সম্পূর্ণতা লাভ করে। 

চাটুজ্যে পরিবার আদিতে বানিয়া ছিল না। পূজারী ব্রাহ্মণ হিসেবেই তাঁদের আগমন। কিন্তু কালক্রমে তাঁরা বানিয়া হয়ে ওঠেন। যুগে যুগেই তাঁদের দালান-কোঠা উঠেছে এবং পড়েছে। পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন বাড়ি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে রেশমের ব্যবসা তার রমরমা হারিয়েছে কিন্তু চাটুজ্যেরা থেমে থাকেননি। কাপড়ের ব্যবসা তাঁরা চালিয়ে গিয়েছিলেন বংশ পরম্পরায়। তার প্রমাণ হিসেবে বহরমপুরে আজও আছে তাঁদের নির্ভরযোগ্য বস্ত্র বিপণি লোকেশ্বর বস্ত্রালয়। 

নয়া ঠাকুমা এ বাড়ির বধু হয়ে আসার আগে পর্যন্ত কৃষি এবং ব্যবসাই ছিল এই পরিবারের মূল প্রতিপাদ্য। লক্ষ্মীই ছিলেন তাঁদের একমাত্র আরাধ্যা। নয়া ঠাকুমা এলেন সরস্বতীকে সঙ্গে করে। লক্ষ্মীর পাশাপাশি ঘটল সরস্বতীরও প্রতিষ্ঠা। নয়া ঠাকুমার ছ’টি সন্তানের মধ্যে দু’জন বিদেশে, দু’জন কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁরা পুত্রসন্তান। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি থাকেন দক্ষিণ ভারতে। এখন নয়া ঠাকুমার কাছে রয়ে গেছেন মাত্র একজন। তৃতীয় পুত্র সোমেশ্বর। ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। জমি-জমা চাষবাসের দেখাশোনার দায়িত্বও। লক্ষ্মী এ পরিবারে অদ্যাবধি অচলা। তবে জমিজমা দেখাশোনার জন্য সোমেশ্বর অন্ধভাবে নির্ভর করেন আবদুস মল্লিকের ওপর। আবদুস মল্লিক ধর্মপ্রাণ, বিচক্ষণ, নির্লোভ মানুষ। বয়সে সোমেশ্বরের চেয়ে কিছু বেশি। তবে গ্রামের হিসেবে তাঁদের সম্পর্কে বাল্যবন্ধুত্বের তকমা দিলে কিছুমাত্র ভুল হয় না। আজও, তাঁদের সম্পর্কে আছে পারস্পরিক অন্তরঙ্গ নির্ভরশীলতা। 

রাজার পতন ও প্রজার বিকাশ পাশাপাশি ঘটতে থাকা যেন এক কথা বলা ইতিহাস। তেকোনা গ্রামের দ্বিতীয় হিন্দু পরিবার সেনদের সম্পর্কে এ বাক্য প্রযোজ্য। শোনা যায় উদ্ধব সেন সঙ্গে এনেছিলেন বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ এবং শিবমূর্তি। শিবলিঙ্গটি ছিল কষ্টিপাথরের তৈরি এবং তিন ফুট উঁচু। একটি সাপ তাকে জড়িয়ে থাকত সারাক্ষণ। আর শিবের মূর্তিটি ছিল শ্বেত পাথরের। পাঁচ ফুট উঁচু এই মূর্তির মাথায় বসানো ছিল হিরে-পান্নার টুকরো। আর ওই শিবের মন্দিরের চূড়ায় বসানো ছিল এক সোনার কলস। উদ্ধব সেনের পারিবারিক নিয়ম ছিল গৃহের উচ্চতা মন্দিরের উচ্চতার অধিক হবে না। যে গম্বুজওয়ালা বাড়ির কথা লোকে আজও বলে, তা হল ওই মন্দিরেরই গম্বুজ। উদ্ধব সেন সযত্নে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কদম মণ্ডল নামে এক রাজমিস্ত্রি এই মন্দির গড়ে দিয়েছিল। তেকোনা গ্রামে আজও আছে রজব মণ্ডলের পরিবার। গ্রামের সবাই জানে, রজব মণ্ডল কদম মণ্ডলের উত্তরপুরুষ। তবে তফাত হল, কদম মণ্ডল হিন্দু ছিল, রজব মণ্ডল মুসলমান। কবে তাদের কোন পুরুষ হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিল সে-ইতিহাস আজ আর রজব মণ্ডলের পরিবারে লেখা নেই। তবে রজব মণ্ডলের দুই ছেলে করম মণ্ডল ও গজব মণ্ডল এখন কৃতী। করম মণ্ডল বংশসূত্রে পেয়েছে নির্মাণ শিল্পের দখল। আর গজব মণ্ডল চাষি। 

ভৈরবের পাড়ে ভৈরবের সেই মন্দির ছিল পবিত্র স্থান। শোনা যায়, গাভীগুলি দিনে অন্তত একবার এসে শিবলিঙ্গের গায়ে বাঁট থেকে আপনি ঝরিয়ে যেত দুধ। কেমন করে তিনফুট উঁচু লিঙ্গে সে-দুধ ঝরে পড়ত সে-কথা কোথাও বলা নেই। তবে মানুষ এমত বিশ্বাস করে। এবং বিশ্বাসের মাত্রা বহুগুণ হয়ে পৌঁছে যায় সেই সর্পে—যে লিঙ্গ জড়িয়ে থাকত। তার দৈর্ঘ্য ছিল দশ ফুট। 

এসব সত্যি হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। তবে জনগণের প্রত্যক্ষে যা গোচর তা হল, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সেনদের বাড়িটি নতুন করে গড়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন ভিত খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল প্রাচীন ইট। সেই ইট সেন যুগেরই কি না তা আর পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। কিন্তু ওই ইট দেখে লোকের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, সোনার কলস বসানো গম্বুজওয়ালা যে মন্দিরের কথা শোনা যায় তা সত্য। 

গৃহের উচ্চতা মন্দিরের চেয়ে উঁচু হবে না—এ নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলেন উদ্ধব সেনের পৌত্র। তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অপূর্ব প্রাসাদোপম বাড়ি যার চূড়া মন্দিরের চূড়া ছাড়িয়ে গেল। সে বছর বর্ষায় উত্তাল হয়ে উঠল ভৈরব। উত্তুঙ্গ তার জলরাশি সর্বাংশে আছড়ে পড়ল সেনদের প্রাসাদের ওপর। ভেঙে পড়ল বাড়ি ও মন্দির। প্রায় এক পক্ষকাল বিপুল জলরাশি থেমে থাকল তেকোনার মর্মে মর্মে। জল যখন নামল, দেখা গেল প্রাসাদ ভগ্ন। মন্দির তলিয়ে গেছে ভৈরবের গর্ভে। প্রাসাদের গা ঘেঁষে, যেখানে মন্দির ছিল তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভৈরব। প্রাসাদের সেই ভাঙা ইটের স্তূপ–সেও তলিয়ে গিয়েছিল অচিরেই। সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিল তাদের সমৃদ্ধি। 

এ এক আশ্চর্য এবং অলৌকিক কাহিনি বটে। তবে ঈশ্বর স্বয়ং মানুষের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহ হয়ে উঠলে কারও কিছু বলার বা করার থাকে না। মানুষের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ করা যায়। কিন্তু স্বয়ং ভৈরব মহেশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেবে কোন মহান্যায়াধীশ? 

অতএব, সেই প্রচণ্ড আঘাতের পর সেন পরিবার হয়ে গেল প্রতিবাদহীনভাবে সাধারণ। ধন গেল। মান গেল। আর গেল রাজন্যসমান হওয়ার ইচ্ছা। একেবারে সাধারণের চেয়েও সাধারণ হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার থাকল না। শিব তাঁদের ত্যাগ করলেন। তাঁরাও শিবকে চিরতরে হারালেন। 

চাটুজ্যেদের সঙ্গে সেনদের সদ্ভাব বজায় আছে সেই আদিকাল থেকেই। আদিতে তা ছিল রাজা ও প্রজা সম্পর্কের ভিত্তিতে। কালক্রমে গোটা গ্রামে এই দুই মাত্র হিন্দু পরিবার, পরস্পরের প্রতি সুভদ্র থাকতে বাধ্য হল। পালা-পার্বণে এই দুই পরিবারের আদান-প্রদান সম্ভব হয়। 

এ গ্রামে হিন্দু-মুসলমান কখনও পরস্পরবিরোধী হয়নি। আর চাটুজ্যেবাড়িতে হিন্দু-মুসলমানে মানামানি নেই। এ বাড়ির শারদীয় দুর্গোৎসবে সারা গ্রাম অংশ নেয়। গ্রামের পক্ষে এ এক সার্বজনীন উৎসব। হরিহরপাড়া থেকে গোরুর গাড়িতে প্রতিমা আনা হতে শুরু করে, সব কাজে সকলেই হাত লাগায়। কী করে এই ঔদার্য সম্ভব হল, সে প্রশ্ন বৃথা। কারণ এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের লাঠালাঠি দাঙ্গা যা হয়েছে, তার কোনওটাই স্বতোৎসারিত ছিল না। রাজনৈতিক সুবিধার্থে ব্রিটিশ যার সূচনা করেছিল, পরবর্তীকালে তা বারবার ব্যবহৃত হয়েছে ওই দেশীয় রাজনীতিকদের দ্বারা, একই স্বার্থ ও সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে। হিন্দু-মুসলমান মানেই সৰ্বত্ৰ পরস্পর দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে মুখোমুখি—এমন হয়নি। তেকোনা গ্রাম তারই মধ্যে পড়ে। 

যদিও সেনদের মধ্যে আজও আছে কিছু গোঁড়ামি। বহু সংস্কার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাষ-বাস করলেও আচার-অনুষ্ঠানগুলিতে তারা স্বতন্ত্র। গ্রামের মানুষ শান্তভাবেই এই স্বাতন্ত্র্য মেনে নিয়েছে। এমন হয় সব জায়গাতেই। কোনও পাড়ায়, কোনও গ্রামে। এক-একটি পরিবার হয়ে ওঠে বড় প্রিয় বা আসা-যাওয়া আড্ডা-উৎসবের কেন্দ্রস্থল। আবার কোনও পরিবার সকলেরই কাছে নিন্দনীয়, সকলেরই চক্ষুশূল। চাটুজ্যে ও সেন পরিবারে এতখানি মেরুকরণের প্রয়োজন নেই। তবে একথা মেনে নিতেই হবে, জনপ্রিয়তায় চাটুজ্যেদের ধারে-কাছে নেই সেনরা। 

সেনবাড়িতে এখন আছেন তিন ভাই। যুধিষ্ঠির সেন, ভীম সেন, অর্জুন সেন। এঁরা দশরথ সেনের ছেলেপুলে। দশরথ সেন জীবিত নেই। তবে জীবৎকালে অঞ্চলে মান্যগণ্য ছিলেন তিনি। কংগ্রেসের সেবক ছিলেন দশরথ সেন। কৃষিকর্মের মধ্যেই তাঁর জীবনযাপন থেমে ছিল না। রাজনীতি করতেন এবং রাজনীতিকে জনসেবারূপে গ্রহণ করেছিলেন। দশরথ সেনের ছেলেরা পিতৃগৌরব রাখতে পারেননি। তবে অর্জুন সেন আজও কংগ্রেসের সেবক। সেই খ্যাতি নেই, সেই শক্তি নেই তাঁর দশরথ সেনের মতো। তবু তাঁর ক্ষীণ আত্মঘোষণা দশরথ সেনকে মনে করিয়ে দেয়। এটুকু ছাড়া জমিজমা চাষকর্ম দেখাশোনা করেন তিন ভাই। লোকে বলাবলি করে, তিন ভাইয়ের সদ্ভাব ও ভালবাসা মহাভারত-বর্ণিত পাণ্ডবপুত্রদেরই মতো। 

একথা সত্য, সেনভাইদের কেউ কখনও প্রকাশ্যে বিবাদ করতে দেখেনি। যুধিষ্ঠির সেন পিতৃবৎ দু’ ভাইকে আগলে রাখেন। তবে কুটিল প্রতিবেশীদের সন্দেহ, আড়ালে মতান্তর মনান্তর হয় ঠিকই, কেন না তিন বিবাহিত ভাই স্ত্রী সন্তানাদিসহ একত্র বসবাস করেন, অথচ মনান্তর নেই, এমন এই বিশ্বে সম্ভব! আসলে সেনদের নীতি হল—বাইরে ফাটল, ভিতরে আঁটল। বাইরের লোকের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি যাই হোক, গৃহের সম্পর্ক যেন অটুট থাকে। তবে এই তিনভাই যে গ্রামের প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিত্য বিবাদমান, এমন নয়। স্বভাবে তাঁরা শান্ত। শুধু মজাগঙ্গা বিলের লাগোয়া দশ কাঠা জমি নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ বিবাদ বরকত আলির সঙ্গে। আদালতে কাজিয়া চলছে। জমিটাও নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পড়ে থাকছে নিষ্ফলা। তবে জমি-জিরেত নিয়ে এর-ওর সঙ্গে লাঠালাঠি গ্রামে হয়েই থাকে। 

.

ময়না বৈষ্ণবী সেনবাড়ির ছায়া মাড়ায় না। সেনবধুরাও যে তাকে খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখেন এমন নয়। ময়না বৈষ্ণবী তার সকল অনুভূতি দ্বারা এই অপছন্দ টের পায়। অতএব যেখানে সে মন খুলতে পারে, সেখানেই যায়। এখন, চাটুজ্যেবাড়ির রোয়াকে সে বসল আর খঞ্জনিতে শব্দ তুলে বলল—জয় রাধে। জয়গুরু। কেমন আছ গো সব! 

অন্দরে যেতে বাধা নেই, তবু বরাবর এটাই করে ময়না বৈষ্ণবী। প্রথমে এসে রোয়াকে বসে। তারপর ডাক পেলে বাড়ির ভিতরে যায়। আজ সে খঞ্জনিতে হালকা শব্দ তুলল কেবল। গান ধরল না। রোদ্দুর চড়া হচ্ছে। প্রত্যেকেই কর্মব্যস্ত এখন। গ্রামের মানুষ দিনের আলোই ব্যবহার করে যতখানি সম্ভব। 

সাধারণত ময়না বৈষ্ণবী সারাক্ষণই গুনগুন করে। কিন্তু এখন সে লক্ষ করল, তার গানের ইচ্ছা হচ্ছে না। এ এক বিরল ব্যাপার। সে বুঝতে পারছে কমলির ঘটনা তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোথায় গেল মেয়েটা? কোন অন্ধকারে? এর একটা বিহিত না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই। সে বড় বেশি প্রভাবিত হয়েছে ওই ঘটনার দ্বারা। খানিক আগে সে দুলুক্ষ্যাপার আখড়ায় গান গেয়েছিল ঠিকই, হয়তো দুলুক্ষ্যাপার সুর তার হৃদয়ের সংগীতকে আকর্ষণ করেছিল, কিংবা মানুষের সঙ্গ পেয়ে যে সাময়িক একাকিত্ব ঘুচেছিল তার, সেই উদ্বেল সময়ে সে ভুলেছিল বিষণ্ণতা। এখন, একা হয়ে যাবার পর সে সম্পূর্ণ গীতরহিত হয়ে বসে আছে। এখন গাইলে রসাভাস ঘটবে। সে অতএব খঞ্জনির মাধ্যমেই তার উপস্থিতি জানান দিতে থাকল। 

মাঝে মাঝে ওপর থেকে ভেসে আসছে পুরুষালি হাসির শব্দ। একযোগে একাধিক পুরুষের সহজ হাস্য পরিবেশকে দেয় এক তাজা উদ্দীপনা। ময়না বৈষ্ণবী তার বিষণ্ণতা তাড়িয়ে উদ্দীপিত হয়ে ওঠার চেষ্টা করল প্রাণপণ। তখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নয়াঠাকুমা। অশীতিপর বৃদ্ধা। অথচ এখনও তাঁর চলাচল বড় সহজ। গলা পাওয়া গেল তাঁর কখন এলে গো বোষ্টুমি? 

—এই তো। 

ময়না বৈষ্ণবী নয়াঠাকুমার দিকে তাকাল। পরনে সবুজ পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। গলায় ভারী সোনার হার। কানে মাকড়ি। লোল চামড়ার লতি থেকে ঝুলে আছে। সাদা চুল তলায় গিঁট বেঁধে খুলে দেওয়া। কপালে চন্দনের টিপ। ধবধবে ফর্সা নয়াঠাকুমার গড়ন ভারীর দিকে। কিন্তু আজও তিনি সুন্দর। এই সৌন্দর্যে আর ঝাঁঝ নেই। বরং রয়ে গেছে মন শীতল করা পরিপূর্ণ স্নিগ্ধতা। ময়না বৈষ্ণবীর নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয়। এই ক’ বছরে গাঁয়ে-গাঁয়ে তার কত আপনজন! সে দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল—প্রণাম। 

নয়াঠাকুমা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন—আ মোলো যা! আমাকে আবার প্রণাম কী বোষ্টুমি? এসো। ভেতরে এসো। বরকতের ঘরে আজ বড় মোচ্ছব লেগেছে। জানো তো? 

—শুনলাম। পথে দেখা হল মাসুদার সঙ্গে। বলল। 

—কোন মাসুদা? 

—ইদরিশ মিঞার বউটা গো। 

—ও। দাফালিদের মেয়েটা? বড় ভাল মেয়ে। 

—হ্যাঁ। সে-ই বলল। 

—তা বেশ। এসো। ভেতরে এসো। মুখখানা শুকনো দেখি তোমার। খাওনি সকাল থেকে?

—না, না। খাওয়ার জন্য না। ক’দিন পায়ের বেদনায় বড় কষ্ট পেলাম গো ঠাকরেন।

নয়াঠাকুমা সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওঠেন। ময়না বৈষ্ণবী তাঁর পিছনে পিছনে যায়। একতলায় শুধু রান্নাঘর, কলঘর, গোয়াল, অতিথিদের জন্য দু’ চারখানা ঘর ছড়ানো-ছিটানো। এখন নয়াঠাকুমার সুবিধার্থে ওপরেও রান্নাঘর আছে। দৈনিক সেখানেই সব হয়। নীচের সেইসব ঘরে শোবার চৌকি ছাড়া আর কিছু নেই। ময়না বৈষ্ণবী এ গাঁয়ে রাত্রিবাস করলে ওই ঘরেই থেকেছে। আগে কলঘর ছিল কেবল একতলাতেই। সে পুরনো ব্যবস্থা। নয়াঠাকুমার ছেলেরা দোতলায় সব ব্যবস্থাই করেছেন। ওপরে লম্বা নলযুক্ত টিউকল বসিয়ে জলের ব্যবস্থাও আছে। কারণ এ গাঁয়ে আজও বিদ্যুৎ নেই যে রোজ পাম্প চালিয়ে জল তোলা যাবে। নয়াঠাকুমার ছয় ছেলেমেয়ে একযোগে থাকতে পারে, এমন এই বাড়ি। বেশিরভাগ ঘরই তাই অধিকাংশ সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। এত বড় বাড়িতে অধিক কাল একযোগে কাটান দুটি মাত্র মানুষ। নয়াঠাকুমা এবং সোমেশ্বরের স্ত্রী নন্দিনী। ব্যবসাসুত্রে সোমেশ্বর সারা সপ্তাহ থাকেন বহরমপুরেই। যেমন লেখাপড়ার জন্য মোহনলালও থাকত বাবার সঙ্গে। এক সপ্তাহ বা দু’ সপ্তাহ পর পর আসত। 

নয়াঠাকুমা শুধোলেন—তা পায়ে হল কী! বাতে ধরল? 

—না গো। বাত-বেদনা আপনাদের আশীর্বাদে নেই। পথে চলতে চলতে সেদিন চটিটা গেল ছিঁড়ে আর পা উল্টে মচকাল এমন যে চলতে-ফিরতে পারি না। পা ফুলে ঢোল। ব্যথা-বেদনা। জ্বর। বড় কষ্টে পড়েছিলাম। 

—আহা! তা এখন কেমন? সেরেছ তো? 

—সেরেছি। তবে কিনা মন ভাল নেই। 

—মনও ভাল নেই? আহা! শরীরে-মনে বড় দোলা খেয়েছ গো বোষ্টুমি। চল বসি। তারপর শুনব। 

দোতলার পুবের ঘর থেকে হই হই হাসির ছররা বাজল আবার। ময়না বৈষ্ণবী তাকাল ওদিকে। বলল—এতসব কারা গো? আপনার ছেলেরা এলেন বুঝি? 

—না না। তারা সব আসবে সামনের বছর পুজোয়। আমার পাঁচ ছেলে এক জায়গায় হবে।

—পাঁচ কেন? মেয়ে আসবে না? 

—পাঞ্চালি আসতে পারবে না। ওর ছোটছেলের স্কুল ফাইনাল তার পরের বছর। 

—বাবাঃ! কত বড় বড় হয়ে উঠল সব দেখতে দেখতে। তা এরা কারা? 

—সব আমার নাতির বন্ধু। কলেজ ইউনিভার্সিটি পাশ দিয়ে নরক গুলজার করা হচ্ছে। এসেছে দু’ দিন হল। আজ যাবে বলেছিল। কিন্তু বরকতের বাড়ি পঞ্চরস হবে শুনে সব থেকে গেল। 

হাসির শব্দ ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গীতহরা মনে প্রলেপ হয়ে উঠছিল। সে বলল—

পণ্ডিতে পণ্ডিতে হয়
প্রতি কথায় ছন্দ। 
বালকে বালকে হয় 
প্ৰতি কথায় দ্বন্দ্ব ॥
বুড়ায় বুড়ায় হয় 
প্রতি কথায় কাশি। 
জুয়ানে জুয়ানে হয় 
প্রতি কথায় হাসি ॥ 

নয়াঠাকুমা হাসলেন। বললেন—এই তো হাসির বয়স। ছেলেগুলো এসেছে, ঘর যেন ভরে উঠেছে। ইচ্ছে করে সব ক’টাকে এইখানে ধরে রাখি। 

—তা রাখো না ধরে। মনে মনে রাখো। মনে রাখাই যে সব রাখা। 

—না গো বোষ্টুমি। এই বয়সে মনে ধরা থাকলেই সব ধরা হয় না। কখন ডাক এসে যাবে। সবাইকে কাছে পেতে বড় ইচ্ছে করে। 

—বালাই ষাট। ডাক আসুক তোমার শত্তুরের। 

—না গো। এখন আর শত্তুরের মরণ কামনা করতেও মন চায় না। বেঁচে-বর্তে থাকুক সব

—তা বলেছ ঠিক। কে যে কখন পরপারে যাবে! 

—যে-রাস্তা অজানা তাকে বড় লাগে। একবার দেখা হয়ে গেলেই সে-রাস্তা ছোট হয়ে যায়। গোটা জীবন দেখে এই যে শেষকালে এসে ঠেকলাম, তাতে মনে হয় কত অনাবশ্যক রাগ করেছি, বিবাদ করেছি। অকারণে কত ভুল কাজ করেছি। আর একবার জীবনটা পেলে আর কোনও ভুল করতাম না। এখন শুধু নাতি-নাতনিগুলোকে দেখলে প্রাণ ঠান্ডা হয়। 

—অনেকদিন দেখিনি তোমার নাতিকে। 

—তা দেখবে কী করে! সে তো বর্ধমানে এম এ পড়তে গিয়েছিল। দাঁড়াও ডাকি। ও মোহন! মোহন! এই যে, একবার এসো ভাই। ময়নাপিসি ডাকে। 

ভারী গলায় সাড়া দিল মোহন। ময়না বৈষ্ণবী সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। সেদিনের কিশোরপ্রতিম ছেলেটি কখন এমন যুবক হয়ে উঠল। তার দৈর্ঘ্য দরজার মাথা ছুঁয়েছে। রং নয়াঠাকুমার মতোই উজ্জ্বল। ছোট ছোট চোখ। তীক্ষ্ণ নাক আর মাথাভরা কালো কোঁকড়ানো চুল। সব মিলিয়ে বড় সুন্দর পুরুষ সে এখন। ময়না বৈষ্ণবীর মনে হল, চেনা ছেলেটি হঠাৎ এক দূরের পুরুষ হয়ে গেছে। 

মোহনলাল যৌবভরে হাসল। বলল—ভাল আছ তো পিসি? কত দিন পরে দেখা হল!

ময়না বৈষ্ণবী হাসল। এই যুবককে দেখে তার বুকে বড় আনন্দ জেগেছে। তারুণ্যের দীপ্তি যেন দুঃখহরণ রূপে উপস্থিত হয় সর্বত্র। সে বলল— বাবা! কত বড়টি হয়েছ। ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেখাই হয় না। এই পিসিকে মনে ছিল তোমার? 

—থাকবে না? কী সুন্দর গান করো তুমি। বন্ধুদের কত বলেছি তোমার কথা। একবার তো ভেবেছিলাম ইউনিভার্সিটি ফেস্ট-এ তোমায় নিয়ে যাব। কিন্তু তোমার দেখাই পাওয়া যায় না। 

নয়াঠাকুমা হাসলেন—শোন কথা! ময়না গাইবে ইউনিভার্সিটি ফেস্ট-এ! 

মোহনলাল বলল—কেন গাইবে না? আমি তো আখড়ার দুলু বাউলকেও বলেছিলাম। উনি যেতে রাজি হলেন না। পিসি, আজ একটু গান শোনাও। আমার বন্ধুরা আছে। শুনবে। 

ময়না বৈষ্ণবী হাসে। সতৃপ্ত শব্দ তোলে খঞ্জনিতে। হৃদয়ে ফিরে এসেছে গান, এই যুবার সন্দর্শনেই সম্ভবত। আর মোহনলালের আহ্বানে আরও তিনজন এসে দাঁড়াল সামনে। 

লোহার জালে ঘেরা দোতলার এই বারান্দা। জালের মধ্যে দিয়ে রোদ্দুর ঢুকছে বারান্দায় আর চার তরুণকে উজ্জ্বল করে তুলছে। মোহনলাল ছাড়া বাকি তিনজন সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, হারাধন সরকার ও রেজাউল মণ্ডল। তিনজনকেই দেখতে দেখতে সিদ্ধার্থর দিকে নজর পড়ল যখন—ময়না বৈষ্ণবীর বুকে উথাল-পাথাল উঠল। যুগান্তর পেরিয়ে সে যেন তার তরুণ স্বামীকেই দেখল চোখের সামনে। কিংবা এ সেই মহানায়কেরই শ্রীরূপ— যা সে প্রতীক্ষা করে আসছে অসুরদলনের জন্য। 

সে কাঁপা হাতে খঞ্জনির শব্দ তুলল। বলল—’জয় রাধে’। আর সিদ্ধার্থের চোখে চোখ ফেলল। তার মনে হল, এই তরুণ এখনই তার হাতে হাত রেখে বলবে—চলো! 

সিদ্ধার্থ হাসল তখন ময়না বৈষ্ণবীকে দেখে। বলল—পদাবলী জানেন আপনি? 

ময়না বৈষ্ণবী কোনও মতে ঘাড় কাত করল। তার অর্থ যা-কিছুই হতে পারে। সে নিজের উদ্ভূত আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছিল প্রাণপণ। কেন এমন হয়! কেন হয়! একজন মানুষের আদলে চলে আসে অন্য মানুষ! চলে আসে আর অজান্তে ভাসিয়ে দেয় অন্য এক হৃদয়। সে উথালি-পাথালি সামলে হাসতে চাইল। নিজে সে বসেছে মেঝেতে। নয়াঠাকুমা বসেছেন বেতের চেয়ারে। আর ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। মোহনলাল একটি মাদুর এনে পেতে দিল মেঝেয় আর বসে পড়ল তারা চারজন। ময়না বৈষ্ণবী সিদ্ধার্থর দিকে পরিপূর্ণ চোখে তাকাল একবার আর চোখ বন্ধ করল। তার বন্ধ চোখের তলায় যে শ্রীমুখ, সে কার, তার স্বামীর, নাকি ওই তরুণের—সে ঠাহর করতে পারল না। চেহারায় বৈশিষ্ট্যহীন এই তরুণ। মধ্যম উচ্চতা। হরিদ্রাভ দেহবর্ণ। সাধারণ নাক-মুখ। আর চোখ? ময়না বৈষ্ণবী বন্ধ চোখের আড়ালে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে থাকল সিদ্ধার্থ নামে ওই যুবার চোখ। সাধারণ। তবু সাধারণ নয়। ওই চোখের দৃষ্টিতে আছে এক ঝলক। এক তেজস্বিতা। এই ব্যতিক্রমটুকু বাদ দিলে সিদ্ধার্থ নামের ওই যুবা আর সব তরুণের ভিড়ে মিশে যায়। না। আরও এক বিশেষত্ব তার আছে। সে তার কাঁধ। চওড়া বলিষ্ঠ স্কন্ধ। নির্মেদ নাতিউচ্চ সে-দেহের কাঁধ দেখে মনে হয়-জগতের ভার বুঝি এই কাঁধ বয়ে চলতে পারে। এই দুই বাদ দিলে আর কিছু নেই। আর কোনও নজর-কাড়া বৈশিষ্ট্য নেই। এবং ময়না বৈষ্ণবী উপলব্ধি করে, তার স্বামীরও আর কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না। সাধারণের ভিড়ে সেও ছিল এক সাধারণ। আর সে ছিল এক মায়াময় দৃষ্টিসম্পন্ন। সিদ্ধার্থের সঙ্গে তার সাধারণ্যে মিলেছে। 

ময়না বৈষ্ণবীর চোখ বন্ধ করে নীরব থাকাকে যুবকবৃন্দ ভাবছিল ‘সংগীত শুরু করার পূর্বেকার মনঃসংযোগ। সে চোখ খুলল তখন। দেখল একে একে অবশিষ্ট তিনজনকেই। হারাধন কালো, গোলগাল, সাদামাটা। কিন্তু মোহনলাল ও রেজাউল রীতিমতো সুপুরুষ। রূপলোভী নারী তাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করবে সহজেই। 

.

নয়াঠাকুমা এবার নড়ে-চড়ে বসেন। বলেন—ধরো গো বোষ্টুমি। গান ধরো।

ময়না বৈষ্ণবী মৃদু গুনগুনাল প্রথমে। তারপর সুকণ্ঠ মেলে দিল অনায়াসে। 

ত্যেজ সখী কানু আগমন আশা। 
যামিনী শেষ ভেল সবহুঁ নৈরাশ ।।
তাম্বুল চন্দন গন্ধ উপহার।
দূরহি ডারহ যমুনাকে পার ।।
কিশলয় সেজ মণি মানিক মাল। 
জলমাহা ডারহ সবহু জঞ্জাল ।। 

স্তব্ধ হয়ে শুনছিল সকলে। কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ নেই। কেবল খঞ্জনি সঙ্গতে এমন পরিপূর্ণ গান তাদের বিবশ করেছিল। কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। ময়না বৈষ্ণবী স্তব্ধতা ভেঙে বলল—বিপ্রলব্ধা রাধার গান। শ্রীশ্রীবলরাম দাসের পদ। 

হারাধন বলল—মানে কী এর? 

ময়না বৈষ্ণবী বলল— শ্রীমতী অপেক্ষা করে আছেন তাঁর দয়িতের জন্য। সারা রাত অপেক্ষা করে আছেন। সেজেগুজে, সুগন্ধি গায়ে মেখে। রাত্রি ভোর হয়ে গেল। দয়িত এলেন না। শ্রীমতী তখন আক্ষেপ করছেন। এই হল গানের ভাব। আর অর্থ হল, সখী, কানু আসবে বলে সারারাত অপেক্ষা করে রইলাম। কিন্তু সব আশা দুরাশা। যত সুগন্ধি মেখেছিলাম, সব যমুনার পারে চলে গেল। যত অলংকার পরেছিলাম, সব এখন জঞ্জাল বলে বোধ হচ্ছে। সব জলে ফেলে দিলাম। 

চকিতে একটি থরোথরো আবেগভেজা মুখ মনে পড়ে গেলে হারাধন বলল—খুব সুন্দর গান করেন আপনি। কোথায় শিখলেন? এত চমৎকার ব্যাখ্যা করলেন। আপনি কি লেখাপড়া জানেন? 

ময়না বৈষ্ণবী হাসল। সারাক্ষণ সিদ্ধার্থের দিকেই তার দৃষ্টি। সে সংবিৎ হারায়নি। সে জানে, এই তরুণ প্রায় তার অর্ধবয়সী। সে কোনও লঙ্ঘন মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করল না। এ কেবল, যতক্ষণ পারা যায়, মুখচন্দ্রের সুধাপান। সে বলল— লেখাপড়া আর হল কোথায় বাবা! তবে ছোট থেকে শ্রীপাটে যাতায়াত করেছি। দশ বছর ছিলাম পঞ্চধুরি শ্রীপাটে। পঞ্চবুধুরি শ্রীপাট জানো তো বাবা? মহাপ্রভু গোপীদাসের মঠ। পুণ্যতীর্থ সে ক্ষেত্র। সেখানে আছে মহাপ্রভু গোপীদাসের গুরু শ্রীশ্রীজগন্নাথ গোস্বামীর হাতে লেখা পুঁথি। জানো তো? সেখানে নিত্য শাস্ত্রকথা হয়। নিত্য কীৰ্তন হয়। যা শুনেছি, তা-ই শিখেছি। শ্রীপাটে বাবা, সারাক্ষণই সংকীর্তন। কান পাতলেই শিখতে পারা যায়। 

সিদ্ধার্থ কথা বলল এবার। আর ময়না বৈষ্ণবী যেন তারই কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। সিদ্ধার্থ আরও একটি গানের অনুরোধ জানিয়েছে। ময়না বৈষ্ণবী বলল— কৃষ্ণ গিয়েছিলেন অন্য কুঞ্জে। রাত ফুরোলে তিনি রাধার কুঞ্জে এলেন। রাধার সখীরা তাঁকে কটুকথা বলতে ছাড়ল না। এ গানের কথা তোমরা সহজেই বুঝবে। 

শুন শুন মাধব নিরদা দেহ। 
ধিক রহু ঐছন তোহারি সুলেহ ॥
কাহে কহলি তুহুঁ সঙ্কেত বাত।
যামিনী বঞ্চলি আনহি সাথ ॥
কপট লেহ করি রাইক পাশ। 
আন রমণী সঞে করহ বিলাস ॥ 

সকালের জলখাবার প্রস্তুত করে ডাকতে এসেছিলেন নন্দিনী। শান্ত, কম কথার মানুষ তিনি। আড়ালে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কেবল শাশুড়ি-সংসর্গে কাটিয়ে, তাঁর অন্তরাত্মা কবে শুকিয়ে এসেছে—এ খবর কেউ রাখেনি। তিনি কেবল এক যন্ত্রবৎ কর্তব্য পালন করে চলেন। অতএব তাঁর মনের সন্ধান কেউ করে না। কেবলই গুরুত্বহীনভাবে জীবনাতিপাত করে, সংসারে এমন মানুষ কম নেই। তবে মাতৃহারা সিদ্ধার্থর নিকট নন্দিনী মহামায়া মাতৃস্বরূপিণী। এবং এই সম্পর্ক উভয়ত প্রগাঢ়। রক্তের ভিন্নতা সত্ত্বেও নন্দিনীর সিদ্ধার্থর প্রতি আছে এক নাড়ি-ছেঁড়া টান 

ময়না বৈষ্ণবীকে দেখে নন্দিনী বললেন—অনেকদিন আসোনি এদিকে। 

জবাব দিলেন নয়াঠাকুমা-—ওর শরীরটা খারাপ ছিল। ওর খাবারটা এখানেই দিয়ে যাও নন্দিনী। আমি দুটো কথা বলি ওর সঙ্গে। 

নন্দিনী খাবার ঘরের দিকে গেলেন। ছেলেরাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যেতে থাকল। মোহনলাল ছাড়াও বাকিরা সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচ কারণ মোহনলালের সঙ্গে এ-বাড়িতে তারা এসেছে এবং থেকেছে বারংবার। বিশেষত সিদ্ধার্থ। এ-বাড়িতে তার আসার কোনও সীমা-সংখ্যা নেই। এই বাড়ির মানুষই শুধু নয়, এ গ্রামের বহুজন, বিশেষত সেনরা তার পরিচিত। 

তারা যখন খাবার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে তখন ময়না বৈষ্ণবী ডাকল —বাবারা! 

ঘুরে দাঁড়াল চারজন। কৌতূহলী। সপ্রশ্ন মুখচোখ। এই ডাকের ভিতর যেন-বা আছে কোনও আর্তি। যেন-বা প্রার্থনা। এই আকস্মিক আবাহনে নন্দিনী এবং নয়াঠাকুমাও বিস্মিত। ময়না বৈষ্ণবী বলল—গান শোনালাম, এবার সিধে চাই যে। 

নয়াঠাকুমা গম্ভীর হলেন। নন্দিনীর ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ময়না বৈষ্ণবীকে যা দেবার নয়াঠাকুমাই দেবেন। কিন্তু তাকে এমন কাঙালপনা করতে কখনও দেখা যায়নি। মোহনলাল হাসছিল। কী করতে হবে বুঝতে না পারা অসহায় হাসি। সিদ্ধার্থ তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল বৈষ্ণবীকে। সে অনুভব করছিল, চাল-ডাল সিধে নয়, পয়সাকড়ি নয়। ময়না বৈষ্ণবী অন্য কিছু প্রার্থনা করবে। কী সে জানে না। সে বলল— কী সিধে চান আপনি বলুন। আমরা সাধ্যমতো দেবার চেষ্টা করব। 

ময়না বৈষ্ণবীকে অন্যরকম দেখাল একটু। যেন-বা হঠাৎ বিষাদে আক্রান্ত সে। তার অন্তরে কথা বলে উঠছে আকুল অভিপ্রায়। এ-ই উপযুক্ত পাত্র, এই উপযুক্ত স্থান বলবার। যার মুখে সে দেখতে পাচ্ছে হৃদয়েশ্বর- সে ছাড়া আর ভার নেবে কে? সে আবেশমাখা গলায় বলল— এসো। খেয়ে এসো। তারপর বলব। 

ময়না বৈষ্ণবীর খাবার এল। লুচি আর আলুর দম। নয়াঠাকুমা বললেন—তোমার মন খারাপ কেন হল শুনি। 

ময়না বৈষ্ণবী লুচি ছিঁড়ে মুখে পুরতে পুরতে বলল—সেই হল গিয়ে কথা ঠাকরেন। মানুষের আর ধর্ম বলে কিছু নেই গো। মঠ বলো, মন্দির বলো, সর্বত্র অনাচার। 

নয়াঠাকুমা ধৈর্য ধরলেন। বেশি প্রশ্ন করা তাঁর স্বভাব নয়। ময়না যখন বলার, বলবে। তিনি উঠে গিয়ে ঘর থেকে একটি পত্রিকা নিয়ে এসে বসলেন। পত্রিকাটি উদ্বোধন’। বহরমপুরে লোকেশ্বর বস্ত্রালয়ের ঠিকানায় আসে। 

ময়না বৈষ্ণবী নীরবে খেয়ে নিল সমস্তটা। বারান্দার এক ধারে রাখা বালতির জলে থালা ধুয়ে রাখল। মগে জল নিয়ে কোণের দিকে বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিল সে। মোহনলাল বন্ধুদের নিয়ে খেয়ে ফিরল তখন। ময়না বৈষ্ণবী মুখে হাসি টেনে বলল–বসো বাবারা। আমার সিধে চাই। ঠাকরেন আপনেও শোনেন। আমার মন খারাপ কেন তা বলি। 

ময়না বৈষ্ণবী নয়াঠাকুমার পদপ্রান্তে চার তরুণের মুখোমুখি হয়ে বসল। আর বলে গেল কমলির কাহিনি। ব্রতপালন করার মতো করে বলে গেল। এই এক কাহিনি সকল চেনা মানুষকে না বলে তার শান্তি নেই। এর থেকে সে কী সিধে চাইবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। নয়াঠাকুমাসহ চারজন স্তব্ধ হয়ে শুনছে। তার বৃত্তান্ত শেষ হলে নয়াঠাকুমা বললেন-তোমার কথা সত্যি হলে এ তো বড় অন্যায় চলছে ঘোষপাড়া মঠে! 

ময়না বৈষ্ণবী করুণ মুখে বসে আছে। নয়াঠাকুমার মন্তব্য তাকে ধন্দে ফেলেছে। তার কথা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না? সকলেই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের নিজের যুক্তি দ্বারা বক্তব্য স্থির করছিল। ময়না বৈষ্ণবী অযথা মিথ্যা বলবে কেন! অকারণেই কি সে ঘোষপাড়া মঠ সম্পর্কে এমন সব অনৃতভাষ উপস্থিত করবে! তা ছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকে মেয়ে চলে যাচ্ছে কোনও দুষ্টচক্রের মাধ্যমে এ খবর জানা। কিন্তু এরকম প্রত্যক্ষভাবে তা তাদের কাছে পৌঁছয়নি। গোটা ঘটনাটির মধ্যে আছে এক অভাবনীয় দারিদ্র্যের ছবি। হারাধনের মুখ শুকিয়ে গেছে। কারণ সে নিজেও পেতনির চরের দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। তারও আছে একটি কিশোরী বোন। যদিও সে কমলি নামের মেয়েকে চিনে উঠতে পারছে না। বরং পেতনির চরের মানুষ হিসেবে রেজাউল মণ্ডল যেন কমলি নামের মেয়েটিকে আবছা মনে করতে পারছে। কমলি নামের রোগা মেয়েটি। তার বাবা মাঝে মাঝে জন খাটে তাদের জমিতে। সে-ও এক রোগা রুগ্‌ণ মানুষ। বেশি পরিশ্রম করতে পারে না। রেজাউলের বাবা এক ধর্মপ্রাণ মানুষ, যতখানি সম্ভব কাজ দিয়ে দরিদ্রকে সাহায্য করেন। মেয়েটি তার বাবার জন্য দুপুরবেলায় ভাত আনত। তবু সে নিশ্চিত হতে পারে না। হতে পারে সেই মেয়েটিই। কিংবা অন্য কেউ। এক যুবক রেজাউল, সে কখনও গ্রামের সকল যুবতী মেয়ের সন্ধান রাখতে পারে না। অতএব সে চুপ করে থাকে। পেতনির চরে যে চরম দারিদ্র্য ও অসহায়তা তা সর্বজনবিদিত। 

এক দীর্ঘ নীরবতার পর ময়না বৈষ্ণবী বলল—তোমাদের অনেক ক্ষমতা বাবা। তোমরা কিছু করো। এই আমার সিধা। আজ তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে তা তো জানতাম না। ঠাকুর তোমাদের মিলিয়েছেন। 

 মোহনলাল সিদ্ধার্থর দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে আছে সিদ্ধার্থ। মোহনলাল তার এই ভঙ্গি চেনে। সিদ্ধার্থ গভীরভাবে বিষয়টি অনুধাবন করার চেষ্টা করছে। সিদ্ধার্থ তার স্কুলের বন্ধু। কলেজে এসে তারা পেয়েছিল হারাধনকে। রেজাউল স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। কিন্তু হারাধনের বন্ধু হিসেবে সে-ও তাদের ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এই দু’জনের চেয়ে মোহনলাল সিদ্ধার্থের বিষয়ে অনেক বেশি নিশ্চিত। সিদ্ধার্থর প্রতি বন্ধুসুলভ ভালবাসা ছাড়াও আছে মোহনলালের শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু নিজের মধ্যে সে টের পায় বরাবর এক অস্ফুট জ্বলন। সে কি ঈর্ষা? সে স্বীকার করে না। সিদ্ধার্থর ওপর নির্ভর করেও মনে মনে সে পুরোপুরি সিদ্ধার্থ হতে চায়। শ্রদ্ধা-ভালবাসার সঙ্গে মিশে গেছে সরু ঈর্ষার জট পাকানো অনুকরণেচ্ছা! স্কুলে পড়ার সময়ই সিদ্ধার্থ যখন গভীর আত্মবিশ্বাসে বক্তৃতা করত ছাত্রদের মধ্যে, তারও অদম্য ইচ্ছা হত ওইভাবে দাঁড়াবার, কথা বলবার। কিন্তু সাহস হয়নি। কী এক জড়তা তাকে বাধা দিত। ক্রমে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সিদ্ধার্থর অনুসরণ করতে করতে সে তার জড়তার কিছু অপসারণ করেছে। সিদ্ধার্থকে সে চেনে অন্তরঙ্গ এবং গভীরভাবে, এমনকী সে জানে তার মা নন্দিনীর প্রতি সিদ্ধার্থর গভীরতম শ্রদ্ধা ও নির্ভরতার কথা। সি পি আই এম-এর সারাক্ষণের কর্মী সে এখন। স্কুল থেকেই সরাসরি রাজনীতি করছে। কলেজও ছিল সিদ্ধার্থের সম্পূর্ণ করায়ত্ত। এক ভয়ংকর পারিবারিক দুর্ঘটনার পর সে কিছুদিন বড় অস্থিরচিত্ত ছিল। কোনওক্রমে কলেজ পার করে সে সারাক্ষণের পার্টিকর্মী হয়ে যায়। অথচ ছাত্র হিসেবে নিশ্চিতই মেধাবী ছিল সিদ্ধার্থ। 

মোহনলাল ও হারাধন সিদ্ধার্থের রাজনৈতিক পর্বেও বন্ধু ছিল কলেজে পড়ার সময়। বিশ্ববিদ্যালয়েও মোহনলাল এই চর্চা বজায় রেখেছিল। কিন্তু হারাধন রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল একের পর এক। সম্প্রতি জীবনবিমা নিগমের একটি চাকরি সে পেয়ে গেছে। পনেরো দিন পর সে যোগ দেবে বহরমপুর শাখায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে একমাত্র রেজাউল ছাড়া তাদের তিনজনেরই বহরমপুরে থাকার কথা। সিদ্ধার্থ এখন রাসুদার অত্যন্ত কাছের লোক। বহরমপুরে রাসুদা সি পি আই এম-এর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। 

ছাত্রাবস্থায় পড়াকালীন মোহনলাল সবসময় সিদ্ধার্থের অনুগমন করত। সে দেখল, সেই অভ্যাস তার রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সে ভেবেছিল সিদ্ধার্থর প্রভাবমুক্ত হয়ে সে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ময়না বৈষ্ণবীর বিষয়ে সিদ্ধার্থকে ভাবতে দেখে সে বিশ্লেষণবিহীন হয়ে বসে আছে কেমন! সম্পূর্ণ সিদ্ধার্থর মুখাপেক্ষী হয়ে! মনে মনে সংকুচিত হয়ে গেল সে। তখন সিদ্ধার্থ বলল—আপনাকে যদি বলি থানায় গিয়ে এই কথাগুলো বলতে, বলবেন? 

দৃঢ় শোনায় ময়না বৈষ্ণবীর কণ্ঠস্বর। সে বলে—কেন বলব না? তুমি যা বলবে, তাই করব।

সিদ্ধার্থ মোহনলালের দিকে ফিরে বলল—ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা দরকার। মুর্শিদাবাদে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় 

ময়না বৈষ্ণবী শুনছিল তার কথা। মোহনলাল এবার সিদ্ধার্থকে দেখিয়ে বলল— পিসি, ওকে দেখে রাখো। ওকে বলেছ যখন, কিছু একটা হবেই। ও কে জানো? 

সিদ্ধার্থ বাধা দিল মোহনলালকে— কী হচ্ছে মোহন! সারক্ষণ তোর পেছনে লাগা!

ময়না বৈষ্ণবী বলল— ও কে তা জানি না বাবা! শুধু জানি, ওর কাঁধে ভার পড়বে অনেক। ও আমার মহাপ্রভুর অংশ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *