২
মাতঃ শৈলসুতাসপত্নি বসুধা-শৃঙ্গারহারাবলি
স্বর্গারোহণবৈজয়ন্তি ভবতীং ভাগীরথীং প্রার্থয়ে।
ত্বত্তীরে বসতত্ত্বদম্বু পিবতত্ত্বদ্বীচিমুৎপ্রেক্ষতঃ
স্বপ্নাম স্মরতত্ত্বদর্পিতদৃশঃ স্যাম্মে শরীরব্যয়ঃ ॥
—মা, তুমি শৈলসুতা পার্বতীর সপত্নী। পৃথিবীর বিলাসহারস্বরূপা। তুমি স্বর্গারোহণের বিজয়পতাকা। হে ভাগীরথি, তোমার কাছে এই প্রার্থনা—আমি যেন তোমার তীরে বাস করতে পারি। তোমারই জল যেন পান করতে পারি। তোমার তরঙ্গ দেখতে দেখতে, তোমার নাম উচ্চারণ করতে করতে, তোমাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে যেন আমার শরীরব্যয় হয়।
সেই জটা-নিঃসৃত গঙ্গা আজও বয়ে চলেছেন। গঙ্গার যত কথা পুরাণে আছে তার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল ও অমিল দুই-ই পাওয়া যায়। কারণ কোথাও বলা হয়েছে গঙ্গা ব্রহ্মার কমণ্ডলু থেকে বেরিয়েছেন।
এই গঙ্গা হিমালয় ও মেনকার প্রথম কন্যা। দেবগণের চেষ্টায় মহাদেবের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এদিকে মেনকা মেয়েকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ক্রোধান্বিতা হলেন এবং গঙ্গাকে অভিশাপ দিলেন যে গঙ্গা জলে রূপান্তরিতা হবেন। মাতৃশাপ বিফল হওয়ার নয়। গঙ্গা জলে পরিণত হয়ে ব্রহ্মার কমণ্ডলুতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে ভগীরথ গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে এলেন। মহাদেব গঙ্গার বেগ মস্তকে ধারণ করলেন। মহাদেবের জটা থেকে নিঃসৃত হয়ে গঙ্গা বিন্দুসাগরে গিয়ে পড়লেন। সেখান থেকে সৃষ্টি হল তাঁর সপ্তধারা। হ্লাদিনী, পাবনী, নলিনী, সীতা, সিন্ধু, কুচক্ষু ও ভাগীরথী। প্রবাহপথে জহ্নু মুনির যজ্ঞক্ষেত্র বিধৌত করলে ঋষি গঙ্গাকে উদরস্থ করলেন। শেষ পর্যন্ত রাজা ভগীরথের অনুরোধে ঋষি আপন জানু হতে মুক্তি দিলেন গঙ্গাকে। তখন গঙ্গার আরও এক নাম হল জাহ্নবী।
সঠিক কত বৎসর পূর্বে ভগীরথ গঙ্গা আনয়ন করেছিল তা বলা যায় না। তবে এ-কাল তার বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে পুরাণের এই কাহিনিকে দিতে চেয়েছে এক নতুন ব্যাখ্যা। সে-ব্যাখ্যায় বলে, রাজা ভগীরথ নদীবিজ্ঞান জানতেন। গোমুখ থেকে বেরিয়ে স্বচ্ছতোয়া নদীটি হরিদ্বারে প্রশস্তা হয়েছিল, তাকে আপন রাজ্যের সেচকর্মের সুবিধায় প্রয়োগ করেছিলেন ভগীরথ। প্রতীকী কাহিনির অন্তরালে হয়তো লুকিয়ে আছে এমনই সত্য।
গঙ্গা সদা মান্য করেনি ভগীরথের শাসন। শোনেনি শিবের উপদেশ। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসের শক্তিও সে প্রয়োগ করেছে পুরোপুরি। গোমুখ থেকে সাগর পর্যন্ত যে সুদীর্ঘ অববাহিকা—তার একটি মোটামুটি স্থিতি থাকলেও চলতে চলতে গঙ্গা তার পুরনো পথ ফেলে নগর বন্দর ধানক্ষেত ভেঙে তৈরি করেছে নতুন পথ। অর্থাৎ নতুন নতুন জনপদের জন্ম যেমন দিয়েছে দুই তীরে, তেমনই ধ্বংসের ইতিহাসও সে রচনা করেছে। মানুষ কখনও মেনে নিয়েছে নদীর খেয়াল, কখনও বাঁধ দিয়ে নদীকে বেঁধেছে কঠিন শাসনে। কিন্তু বাঁধের বন্ধনে দেবতার অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় না। তাঁর হাতে বেড়ি পড়ে। দেবতার হাতে বেড়ি পরিয়ে ধরে রাখবে, মানুষের তা সাধ্য কী। তার চেয়ে ভাল বেড়ি খুলে দেওয়া। কিন্তু বেড়ি যিনি পরেন তিনি সঙ্কটমোচনের পরিবর্তে স্বয়ং এসে সঙ্কট হয়ে দাঁড়ান—তাঁকে প্রমাণ করবে কে? মানুষের শুভবুদ্ধি তার নাগাল পায় না। কলিকালে দেবতারাও সেই যে লুকোলেন, আর তাঁদের সাড়া নেই। শাসনে অদৃশ্য, পূজনেও। সুতরাং এ কালে অবিসংবাদী সত্যের দেবতা বলে আর রইল না কিছু। বিজ্ঞানী জ্ঞানের অহংকারে ভাবলেন— আমি শাসক হলাম।’ প্রযুক্তিবিদ পারদর্শিতার অহংকারে ভাবলেন, ‘আমি প্রকৃতি যন্ত্রে বাঁধলাম মানুষেরই কল্যাণে।’ সেখানে মানুষের যতখানি সাধ্য তার মধ্যে রইল কল্যাণ। কিন্তু সাধ্য অতীত হলে কল্যাণ প্লাবিত হল।
.
মানুষের অভিজ্ঞতা নবতম যে উপলব্ধি দেয়, তার দ্বারা তৈরি হয় নতুনতম জ্ঞান। নতুন জ্ঞান পুরনো জ্ঞানকে অপসারিত করে। কিন্তু গঙ্গা যেমন এক দিনে হিমালয় হতে উৎসারিত হয়ে সাগরে আসেনি, তেমনই মানুষের জ্ঞানও এক দিনে তৈরি হয় না। বরং আহৃত জ্ঞান প্রযুক্ত হতে লাগে সুদীর্ঘ সময়। এই সময়ে বয়ে যায় কত কাল, কত যুগ। এক জ্ঞান হতে অন্য জ্ঞানে উপনীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি হয় সাধারণ মানুষের ইতিহাস।
নদীর ইতিহাস ও মানুষের ইতিহাস সমান্তরাল। এই যে বঙ্গদেশের এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ—এর ইতিহাসের ব্যবস্থা করলেই ব-দ্বীপের প্রাচীন জনপদের ইতিহাস উঠে আসবে পাশাপাশি। আবার ভৌগোলিক আলোড়ন ও গঠনের বিষয়ে অবহিত না থাকলে ইতিহাস হয়ে যাবে অসম্পূর্ণ। ইতিহাস ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। ভূ-ত্বকের অন্তরালে এর ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া আজও সক্রিয়। এই ব-দ্বীপ ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে হেলে যাচ্ছে। তার ফলে নদীগুলিও তার খাত এবং অভিমুখ পাল্টাচ্ছে। আর নদীর অববাহিকার পরিবর্তন তৈরি করছে জনপদ ভাঙা ও গড়ার নিত্যনতুন ইতিহাস।
পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে ও পূর্বে পদ্মা-মেঘনা এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর—এই ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ডই গঙ্গার ব-দ্বীপ। গঙ্গার যে-অংশ থেকে ভাগীরথী উৎপন্ন হয়েছে, সেই স্থানটি গঙ্গা-বদ্বীপের উচ্চতম অঞ্চল। ভাগীরথীর প্রবাহ উচ্চভূমি বরাবর। গঙ্গার এই দ্বিধা হওয়া, গঙ্গার এই ভাগীরথী ও পদ্মায় বিভাজিত হওয়া ঘটেছে দেশ ভারতবর্ষের সুজলা সুফলা অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন জেলা মুর্শিদাবাদে। সমগ্র ভারতের ভূগোল হতে চোখ তুলে এই প্রাচীন জেলাটির দিকে তাকালে মুহূর্তেই তা অসামান্য হয়ে ওঠে ইতিহাস ও ভূগোলের বৈশিষ্ট্য সমন্বয়ে। সারা মুর্শিদাবাদ জুড়ে রয়েছে গঙ্গার বহু উপনদী আর শাখানদী।
সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিয়োজিত বঙ্গের দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ হয়তো এই নদীর টানেই এসেছিলেন এ অঞ্চলে। তখন মুর্শিদাবাদের নাম ছিল মখসুদাবাদ। আর মুর্শিদকুলির নাম করতলব খাঁ। অবশ্য মখসুদাবাদ অঞ্চলে করতলব খাঁয়ের আগমনের হেতু হিসেবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বঙ্গের তৎকালীন সুবাদার, ঔরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-শানের ঈর্ষাগ্নির কোপ থেকে দূরে থাকতেও করতলব খাঁ মখসুদাবাদকে কর্মকেন্দ্র হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। আর মখসুদাবাদকেই পছন্দ করার প্রথম কারণ, করতলব খাঁ তখন মখসুদাবাদের ফৌজদার। সেই শক্তি তাঁর পক্ষে সহায়ক ছিল। আর দ্বিতীয় কারণ, নদীবেষ্টিত এই শ্যামল ভূখণ্ড যার নিকটে, ভাগীরথীর তীরে, জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠেছিল ফরাসি, ব্রিটিশ, আর্মানিদের কুঠি।
করতলব খাঁ প্রচুর রাজস্ব তুলে দিয়ে তুষ্ট করেছিলেন সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে এবং সম্রাটের কাছ থেকে মুর্শিদকুলি উপাধি পেয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর ওই করতলব খাঁ নামটিও সম্রাটপ্রদত্ত ছিল। তার আগে মুর্শিদকুলির নাম ছিল মহম্মদ হাদি। এবং এখানেই শেষ নয়। এরও আগে মুর্শিদকুলির একটি হিন্দু নাম ছিল। সে নাম ইতিহাস জানে না। কারণ যে-পিতা বালক মুর্শিদকুলিকে এক মুসলমান বণিকের কাছে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন, তাঁরও সন্ধান ইতিহাস মনে রাখেনি। মুর্শিদকুলি খাঁ নিজের নামে তাঁর কর্মকেন্দ্রের নাম রেখেছিলেন মুর্শিদাবাদ এবং এই কেন্দ্র বঙ্গের রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। রাজধানীর সে-গৌরব আজও ভগ্ন অবস্থায় লেগে আছে ইটে, পাথরে, মসজিদের কারুকার্যে।
মুর্শিদকুলির রাজত্বের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটিয়েছিল নদীপথ, তা অনস্বীকার্য। আসলে এই অঞ্চলের ওপর গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথীর গভীর প্রভাব। এমনকী গঙ্গার শাখানদী এবং উপনদীগুলিও এ অঞ্চলের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ভাগীরথী। কারণ এই নদী মুর্শিদাবাদ জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। পূর্বপারের নাম বাগড়ি। ত্রিভুজাকৃতি বক্রদ্বীপ থেকে হয়েছে বাগড়ি। কেউ বলেন, এই অঞ্চলের নাম ছিল ব্যাঘ্রতটী। তার থেকে বাগড়ি। আর ভাগীরথীর দক্ষিণপার রাঢ় অঞ্চল। শোনা যায়, ভারতবর্ষের ষোড়শ জনপদের এক জনপদ লাঢ়া ছিল এ অঞ্চলেই। লাঢ়া থেকেই বাচনসূত্রে রাঢ়া বা রাঢ়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী নাগাদ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চল ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। নদীর প্রবাহই গড়ে তোলে ব-দ্বীপ। অতএব গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহপথ ব-দ্বীপ নির্মাণের কাজে সক্রিয় ছিল। সেই আদি ধারা বঙ্গে প্রবেশ করার পূর্বে কৌশিক ও মগধ রাজ্যে প্রবাহিত ছিল। কৌশিক ও মগধ পার হয়ে গঙ্গা বিন্ধ্যপর্বতের গায়ে প্রতিহত হয়। অতঃপর সে ব্রহ্মোত্তর, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্ত দেশের মধ্যে দিয়ে আপনার পথ করে নেয়।
কৌশিক এখনকার উত্তর বিহার। আর মগধ দক্ষিণ বিহার। বিন্ধ্যপর্বত হল সম্মিলিত রাজমহল, সাঁওতালভূম, ছোটনাগপুর, মানভূম ও ধলভূমের পাহাড়শ্রেণি। গঙ্গা এই সকলই অতিক্রম করেছিল এবং রাজমহল পার হয়ে কিছুদূর পর্যন্ত পূর্বে প্রবাহিত হয়ে সে উত্তরে বাঁক নেয়। এই সময় গৌড়কে পশ্চিমে রেখে সে রাঢ়বঙ্গে প্রবেশ করে। এবং দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। কিন্তু এর পর সহস্র বৎসর ধরে গঙ্গা ধীরে ধীরে তার পথ বদলেছে। পুরনো পথের চিহ্ন হিসেবে রেখে গেছে বহু বিল, ঝিল, অশ্বক্ষুরাকৃতি পুকুর। নিম্নজলাভূমিময় বিস্তৃত অঞ্চল। এই সমস্ত জলাভূমি সংযুক্ত করে একটি কাল্পনিক রেখা টেনে দিলে সেই রেখা এক নদীর প্রবাহপথকে চিহ্নিত করবে।
কিন্তু পথ যতই বদলাক, জনমানসে গঙ্গা আজও ধ্বংসরূপিণী নয়। ভাঙা কুলো দিয়ে কেউ তাকে বিদায় করতে তৎপর নয়। বরং গঙ্গার প্রতি ভক্তি জনমানসে আজও অবিচল।
গঙ্গা গঙ্গেতি যো ব্রূয়াৎ যোজনানাং শতৈরপি।
সর্ব-পাপ-বিনিমুক্তো বিষ্ণুলোকম সা গচ্ছতি ॥
এই কলুষনাশিনী মুক্তিদায়িনী গঙ্গার বিপুল জলরাশি তার বৈভব একা রচনা করেনি। গঙ্গায় যুক্ত হয়েছে বহু উপনদীর জল। আবার গঙ্গা তার প্রবাহকে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়েও দিয়েছে। রামগঙ্গা, গোমতী, ঘর্ঘরা, গণ্ডক, বাগমতী, কামলা, কোশী, বুড়িগণ্ডক, টনস, শোন, কর্মনাশা প্রভৃতি নদীর জলে সমৃদ্ধ গঙ্গা আবার সৃষ্টি করেছে ভাগীরথী, জলঙ্গী, শিয়ালমারি, ভৈরব প্রভৃতি বহু শাখানদী।
ভাগীরথী নিয়ে এক দ্বন্দ্ব তা হলে রয়েই যায়। জন্মলগ্নেই যে-গঙ্গা ভগীরথদুহিতা ভাগীরথী—সে-ই আবার ভাগীরথী নামে শাখানদী হয় কেন!
এর কোনও সদুত্তর নেই। কেউ বলে পদ্মাই গঙ্গার মূল স্রোতের অধিকারিণী, কারও মতে ভাগীরথীই মূল। পবিত্রতার অধিকারও সে-ই পেয়েছে। গোমুখ থেকে সাগরদ্বীপ পর্যন্ত পুরোটাই গঙ্গা। তবে কোথাও তার ডাকনাম হুগলী, ভাগীরথী—এইরকম।
ভৈরব গঙ্গার এক শাখানদী। কেননা ভৈরব বেরিয়ে এসেছে পদ্মা থেকে। পদ্মার পূর্বপারে এসে মিশেছে মহানন্দা। আর ঠিক উল্টোদিকে পদ্মার পশ্চিমপার থেকে উৎসারিত নদ ভৈরব। পদ্মার খাত আশ্রয় করে যখন গঙ্গা তার জলস্রোত বইয়ে দেয়নি তখন মহানন্দাই স্বয়ং ভৈরবের অববাহিকায় প্রবাহিত হত। পরে পদ্মাই যখন গঙ্গার মূল প্রবাহপথ হয়ে উঠল তখন মহানন্দা ও ভৈরব হয়ে গেল দুই বিচ্ছিন্ন নদ-নদী। যেন কোনও তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ দাম্পত্যে ঘটিয়ে দিল বিচ্ছেদ।
ফরাক্কার পঁচিশ মাইল দক্ষিণে গঙ্গা থেকে ভাগীরথীর জন্ম। উৎপত্তিস্থল হতে প্রায় দু’ মাইল পর্যন্ত ভাগীরথী পদ্মার সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলেছে। যেন ভগীরথের সেই কাহিনির পরিচয় বহন করছে সমান্তরাল এই প্রবাহ। যেন পদ্মার শঙ্খধ্বনি শুনে এখানেই পথ ভুলেছিল গঙ্গা। আর প্রত্যাবর্তন করেছিল ভাগীরথী খাতে। পদ্মা ভগিনীর টানে সমান্তরাল ছুটেছিল প্রায় মাইল দুয়েক। শেষ পর্যন্ত বোনের সঙ্গে গলাগলি হতে পারল না যখন, ক্ষুব্ধ পদ্মা মুখ ফেরাল আর তীব্র রোষে মাঠ, ঘাট, পথ, জনপদ ভেঙে গুঁড়িয়ে চলতে চলতে নাম নিল কীর্তিনাশা। আর শুধু তা-ই নয়, গঙ্গার মূল স্রোতকে সবলে নিজের কাছে টেনে এনে ভাগীরথীকে করে দিল ক্ষীণকায়া।
অবশ্যই এর আছে এক ভৌগোলিক ব্যাখ্যা। ভাগীরথীর তুলনায় পদ্মার অববাহিকা নিম্নভূমিতে। ফলে গঙ্গার জলস্রোত পদ্মার দিকে গড়িয়ে যেতে চায়। আর ভাগীরথীর উৎসমুখে ক্রমশ পলি জমে। শেষ পর্যন্ত ভাগীরথীর অপুষ্টি সারিয়ে তোলার জন্য ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে আটত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি জলভরনি খাল কাটা হল। অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে নয়। গঙ্গা হতে ভাগীরথীর জলপ্রবাহের ধারা অবধারিত করল মানুষ। ভাগীরথী আবার পেল পর্যাপ্ত জল। তবু অববাহিকায় চর জাগে। জেগে ওঠা বালুপৃষ্ঠে পলি পড়ে চাষের উপযুক্ত হলেই দলে দলে মানুষ এসে চরে বসবাস করে। যেমন বহরমপুর শহরের অদুরে ভাগীরথীর বুকে জেগে উঠেছে পেতনির চর। চরের পঞ্চাশ মাইল পূর্বে চালতিয়া বিল। এই পেতনির চরে মানুষ বাস করে। যেমন শহর-গাঁয়ের মানুষ তেমনই সেই চরের মানুষ
গোটা গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথীর পাড়ে অনেক গ্রাম-গঞ্জ-শহর-নগর। তেমনই ছোট ছোট নদীগুলির পাড়েও। হয়তো নগর নয়। হয়তো শহর। ছোট ছোট গঞ্জ। গ্রাম। তবু গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে আছে মানুষের বসবাস। যেমন ভৈরবের পাড়ে তেকোনা গ্রামে। যেমন ভাগীরথীর পাড়ে চতুষ্কোনায় আর পেতনির চরে।