৬
আল্লা, পরথম কার্তিক গো মাসে
যাদু যায় গো রণে।
আসিব কি না আসিব
অরষিত মনে ॥
সোনার পালং জোড়মন্দির
খালি রইল পড়িয়া।
কোথায় গেল ইমাম উছেন
জননী ছাড়িয়া ॥
সারা দিন জ্বরের ঘোরে পড়ে রইল ময়না বৈষ্ণবী। রামি, প্রমি, কেতকী বৈষ্ণবী যা পথ্য দিল খেল। যা সেবা-যত্ন করল তা-ই তাকে দিল আরাম। চুন-হলুদ গরম করে পায়ে লাগিয়ে দিল তারাই। জ্বর বাড়লে কপালে জলপটি দিল।
এই তিনটি মেয়েমানুষের জন্য ময়না বৈষ্ণবী আলাদা করে কোনও টান কখনও অনুভব করেনি। এই অসুস্থতার মধ্যে সে তাদের নতুন চোখে দেখল। নির্বিবাদে বলরাম বাবাজির সেবা করে বলে তাদের প্রতি ছিল তার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের করুণা। নিজেকে সে ভাবত পৃথক একজন। এবং উঁচু মর্যাদার। কিন্তু তাদের আন্তরিক শুশ্রূষা পাবার পর তার ভাবনা ভিন্ন খাতে বইল। যেমন বয় ভাগীরথী, ভৈরব, বাঁশলই, যেমন অন্যান্য নদ ও নদীরা। ভাবনার ধারা যেন নদ-নদীর জলধারার মতোই। ঘটনা ও সময়ের অনুষঙ্গে তারও খাত পালটে পালটে যায়। তার ইচ্ছে করে, এই তিনটি মেয়েমানুষকে কাছে বসাতে। কথা বলতে। জেনে নিতে ইচ্ছে করে তাদের জীবনের কথা যেমন জেনেছিল কমলির আর এক অশিব সত্যকে আবিষ্কার করেছিল। হতে পারে, হতে পারে এই কেতকী, প্রমি, রামিরও আছে কমলির মতো ইতিহাস। হতে পারে, এখানকার জীবন-যাপন অগৌরবের হওয়া সত্ত্বেও এক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা তাদের ঠেলেছে নিশ্চিত্ত আত্মসমর্পণে। এবং হয়তো শরীরের যে দাবি, তাকেও তারা তৃপ্ত করতে তৎপর এমনই প্রেমহীন, বাধ্যতামূলক, অবমাননাকর দেহসংসর্গে।
সব মিলিয়ে এই মেয়ে তিনটির মধ্যে এক বৃহদাকার অসহায়তাই আবিষ্কার করে সে। আর ভাবতে ভাবতে এক অপূর্ব সহমর্মিতায় প্রবেশ করে। মাঝে-মাঝে সে প্রত্যাশা করছিল কমলি নামের দুঃখী মেয়েটি তাকে দেখতে আসবে একবার। তার কাছে বসে এই পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে ময়না বৈষ্ণবীর সঙ্গে তার ঘটে আছে গভীর আত্মীয়তা। কিন্তু সেই মেয়ে আসেনি। রাতেও সে এল না আর ময়না বৈষ্ণবীও প্রাণ খুলে জিগ্যেস করতে পারল না তার কথা। আর এভাবেই সে কাটিয়ে দিল দু’দিন। তৃতীয় দিনে তার পায়ের ব্যথা কিছু কমল আর জ্বর নেমে গেল অনেকখানি। সকালবেলার পথ্য নিয়ে কেতকী এসে বসল তার কাছে। সে বলল— আজ একটু ভাল বোধ হচ্ছে কেতকী। আজ নীচে নামতে পারব। একবার স্নানও করব।
—আর একদিন বিশ্রাম নাও। সারাক্ষণ টই-টই করে বেড়াও। পা দু’টিকে একটু আরাম দাও দেখি।
—তোরা যা করলি আমার, আপন বোনের মতো।
—তুমি ভাবলেই আপন। খেয়ে নাও দেখি।
—তোর মুখখানা এত শুকনো কেন! খাসনি?
—তুমি অমনি দেখো! খাও তাড়াতাড়ি।
—কাজ আছে বুঝি কিছু?
—কাজ না কাজ! পালা সাধা হবে নীচে।
—কেন?
— এম এল এ ভবরঞ্জন বিশ্বাসকে জানো তো? কংগ্রেসের? তাঁর বাড়িতে অষ্টপ্রহর। নৌকাবিলাস হবে। আমি রাধা সাজব। প্রমি শ্যাম।
— কারা করবে এত গান? নাম-গানে হবে? না পদে?
—পদে হবে। তোমাকে গাইতে বলবে। যাবে তো দিদি?
—সে হবে ‘খন। তা শংকর দুটো মেয়ে এনেছিল, তাদের সখী সাজিয়ে নে।
— তারা কি আছে নাকি? কালই তো চলে গেল সব।
—দু’জনেই?
—দু’জনেই তো গেল।
ময়না বৈষ্ণবী চুপ করে থাকল। বুকের মধ্যে বড় কষ্ট খচ খচ করছে। চলে গেল। মেয়েটা চলে গেল। না খেতে পাবার চেয়ে এক অপমানকর জীবনের দিকে চলে গেল সে। ময়না বৈষ্ণবী আর কী করবে! সে তো জানে সব। সব ব্যভিচার। সব নষ্টামি। কিন্তু কোথাও গিয়ে বলতে পারছে না। রুখতেও পারছে না কিছু।
তাকে নীরব দেখে কেতকী বলল— মেয়েটা বড় কাঁদছিল যাবার সময়।
—কোন মেয়েটা?
—একজন তো বড়। বয়স্কমতো। আরেকজন রোগা করে মেয়ে ছিল। সে।
আর কোনও কথায় মন দিতে পারল না ময়না বৈষ্ণবী। সে কেবল ভাবতে লাগল সেই মেয়ের মুখ। করুণ, ক্লিষ্ট, কান্না ভরা। দুর্বল লাগছে এই অজুহাতে সে শুয়ে পড়ল আবার। তার পথ্য পড়ে রইল পাশে। কিছু সুজির পায়েস। ‘খেয়ে নিয়ো’ বলে কেতকী চলে গেল নীচে। কিছুক্ষণ পর খোল-করতালের শব্দসহ গানের সুর ভেসে এল। সঙ্গে জোরদার হারমোনিয়ম। অনুষ্ঠান হতে এখনও সময় আছে দিন সাতেক। বিধায়কের বাড়ির ব্যাপার বলেই বোধহয় প্রস্তুতি জোরদার। সে স্থির করল, গাইতে যাবে না। এখানে এসে অবধি সে এখানকার প্রভাতী নামসংকীর্তনে বেরোয়নি। কোনও অনুষ্ঠানও করেনি। যা করেছে সবই পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে। সেখানকার অনুষ্ঠানের মাত্রা আলাদা। সেখানে কীর্তনের অনুষ্ঠান মানে শুধুই পদাবলী কীর্তন। নাম সংকীর্তনের নামে সাধারণত যা গাওয়া হয়, সে সইতে পারে না। ‘দম মারো দম’ বাক্যবদ্ধ বাদ দিয়ে তার সুরে বসিয়ে দেওয়া হবে হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে। কিংবা আরও সব প্রচলিত চটুল গানের সুর। বিধায়কের বাড়ির অনুষ্ঠানে এমন হবে না সে আশা করে। কিন্তু কোনও বারোয়ারি অনুষ্ঠানে যখন রাধাবেশী, কৃষ্ণবেশী মেয়েগুলির জামায় সেফটিপিন দিয়ে আটকে দেওয়া হয় দু’টাকা— পাঁচটাকা— দশটাকার নোট- সে সইতে পারে না। কীর্তনীয়া দলের মেয়েগুলির সঙ্গে শোবার জন্য বায়না নিয়ে আসবে এলাকার অর্থবান প্রভাবশালী লোকগুলি— সে সইতে পারে না।
সে এই সমস্ত ভাবে আর তার মাথায় আগুন দাপিয়ে বেড়ায়। পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে আর যা-ই হোক, শ্রীপাটের কোনও মেয়েমানুষকে অপমান করার ক্ষমতা বাইরের কারও নেই। সে অতএব পড়ে থাকে চুপ করে আর পরিকল্পনা রচে। এই সমস্ত ঘটনাই সে বলে বেড়াবে গ্রামে-গ্রামে। রটনা করবে। এটুকুই তার প্রতিবাদ। হয়তো এই প্রতিবাদ একদিন লক্ষ আগুন হয়ে জ্বলে উঠবে।
সে স্থির করে, কাল থেকে আবার যাবে মাধুকরীতে। সে পাশ ফেরে। একবার ওঠে। একবার বসে। কৈফিয়ৎ এড়াবার জন্য খেয়ে নেয়। তার কেবলই এই মঠের দেওয়ালগুলিকেও অপবিত্র লাগে। তার ইচ্ছে করে পঞ্চবুধুরি চলে যায়। বাঁশুলি চলে যায় বা তেকোনা গ্রামে। তার মন কেবলই উড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে পথে আর পরিচিত মানুষগুলির সঙ্গে কথা কয়ে বেড়ায়। নীচের খোল-করতাল-হারমোনিয়াম-গীতের শব্দ ভুলে তার মন আপন সুর ভজে। সে কৃষ্ণচিন্তার মানুষ। দানবচিন্তা তার সয় না বেশিক্ষণ। যেখানে যেমন থাকো, হা-কৃষ্ণ, হা-কৃষ্ণ বলে তাঁকে ডাকো। এরই নাম ভক্তি রসামৃত। সে গুনগুন করে—
শ্রীকৃষ্ণের দুটি পদ যার ধনসম্পদ
সে জানে ভকতি রস সার।
কৃষ্ণের মধুর লীলা কর্ণে যার প্রবেশিলা
হৃদয় নির্মল হল তার ॥
যে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কয় তার হয় প্রেমোদয়
তারে আমি যাই বলিহারী।
শ্রীকৃষ্ণ নয়নে ঝুরে নিত্যলীলা তার স্ফুরে
সে জন ভকতি অধিকারী ॥