রহস্যের ঝাঁপি
টক্ টক্…. টক্ টক্…টক্ টক্… অচিন দেশের রাজকুমার তার তাজী পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় তেপান্তরের মাঠে।
মাঠ-নদী-বন, ধূ-ধূ মরুভূমি ডিঙ্গিয়ে….মায়ার পাহাড়, হাড়ের জাঙ্গাল পেরিয়ে কত দিন কতো রাত পরে সে এসে পৌঁছয় সেই রহস্যের পুরীতে যেখানে মন্ত্রের ঘুমে ঘুমিয়ে আছে অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা।
কতকালের যে সে ঘুম তা কেউ যানে না। দুষ্টু ডাইনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসে চারদিক সুমসাম, নিঝঝুম!….।
রাজ্যের হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, কাকাতুয়ার দাঁড়ে কাকাতুয়া …. কিন্তু সে সবই দাঁড়িয়ে আছে ঠায় নিথর নিঝুম হয়ে। মরণ-কাঠির ছোঁয়ায় সারা পুরী অচেতন।
কবে আসবে সেই রাজপুত্র, সোনার কাঠি ছোঁয়াবে রাজকন্যার শিয়রে!….তবে জাগবে সেই পুরীর প্রাণ….হাজার বছরের মন্ত্রের ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবে রাজ্যের হাজার হাজার পাষাণ হয়ে যাওয়া মানুষ।….
এ সবই হল পুরনো দিনের রূপকথা। মায়ার কাঠি ছুঁইয়ে যেদিন রাজপুত্র পাষাণপুরীর ঘুম ভাঙ্গাত সে তো আজকের কথা নয়!
সেদিন রাজপুত্র রহস্যের খোঁজে বেরুত দেশ ছেড়ে দেশান্তরে। সাপের মাণিক, দুষ্টু রাক্ষস, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি আর অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যার দেখা মিলত বহু দূরের রাজ্যে, বহু পাহাড়-নদী-সাগর-মরুভূমি ডিঙ্গিয়ে।
সেদিনের রাজপুত্ররা তো আসলে থাকত সোনার খাঁচায় বন্দী হয়ে। সেই খাঁচার বাঁধন কেটে বেরিয়ে যেতে না পারলে তারা দেশের কথা, দুনিয়ার কথা, প্রকৃতির নানা রহস্য আর কতটুকুই বা জানতে পেতো!
আজ আর সেদিন নেই : সেদিনের সে রাজপুত্রের জায়গা নিচ্ছে আজকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই। আর রূপকথার সেই মায়ার পুরী হচ্ছে আসলে আমাদের চারপাশের এই দুনিয়াই।
তোমরা বলবে? সে কি কথা? তা কি করে হবে?
হ্যাঁ, তাই। সাদা চোখে দেখলে আমাদের চারপাশের সব জিনিসই ঘুমিয়ে আছে মন্ত্রের ঘুমে, রহস্য আর মায়া ঘিরে আছে সব কিছুকে। কিন্তু আসলে সবারই রয়েছে অনেক গোপন কথা, সোনার কাঠির ছোঁয়ায় ভাষা পাবার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই।
এই রহস্য আর মায়ার বেড়াজাল ভাঙ্গবে তোমরাই। পাষাণ হয়ে যাওয়া প্রকৃতির বুকে নতুন মন্ত্রের জীয়নকাঠি ছোঁয়াবে তোমরাই।
বুঝি ভাবনায় পড়লে। সত্যি কি তাহলে আমরাই? ….আমরা কি সত্যি পারব এই রহস্যের মায়াজাল ভাঙ্গতে, পাষাণের বুকে ভাষা ফোঁটাতে? কিন্তু সে সোনার জীয়নকাঠি কোথায় আমাদের?
সেই জীয়নকাঠির এ-যুগের নাম হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ছোঁয়া পেলে প্রকৃতির রহস্যের ঝাঁপি আপনা আপনি খুলে যায়….নিঝুম নিথর ঘুমের দেশ যেন প্রাণ পায়।
বিজ্ঞানের জীয়নকাঠি বোবা দুনিয়াকে কথা বলায়। আমাদের চারপাশে যে চেনা-জানা দুনিয়া, এই জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় তার সম্পূর্ণ আর এক নতুন রূপ দেখতে পাওয়া যায়।
সে যেন এই দুনিয়ার মধ্যেই আর এক দুনিয়া….তার জন্যে ঘোড়া ছুটিয়ে বহু দূরে তেপান্তরের মাঠে যাবার কোন দরকার হয় না।
আমাদের ঘরের কোণের নুন, চিনি, আগুন, কয়লা এগুলো আমরা রোজই দেখি কিন্তু কখনও হয়তো ভেবে দেখি নে এদের মধ্যে লুকিয়ে আছে কতো নতুন নতুন জানবার কথা। যুগ যুগ ধরে মানুষ এদের কতো রহস্যই যে ভেদ করেছে। আর ঠিক মতো কাজে লাগাতে পারলে এগুলো মানুষের কতো কাজেই না লাগতে পারে।
ঘরিটা টিক্ টিক করে কথা বললে চলে অনবরত ….দিন নেই রাত নেই কাজ করে চলে একটানা! হয়তো সে তার কাহিনী তোমাদের কাছে বলতে চায়, কিন্তু সেই জীয়নকাঠির অভাবে তার টিক্ টিক্ কথার ভাষা তোমরা বুঝতে পারো না। কিন্তু তার কথা বুঝলে দেখতে নিজের সম্বন্ধে কতো কথাই যে তার বলার রয়েছে!
আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে আসে নানা পরিবর্তন। শীতের হিমেল হাওয়া যেন একটা দুষ্ট দানবের নিঃশ্বাস…এই নিঃশ্বাসের ছোঁয়া গাছের সবুজ পাতাগুলোকে ঝরিয়ে দেয়। কুঁকড়ে যাওয়া রাতের কান্না বুঝি শিশির হয়ে ঝরে পড়তে থাকে….আবার শীতের পরে বসন্ত আসে গাছে গাছে কচি পাতা আর নতুন প্রাণের আশ্বাস নিয়ে।
বর্ষার আকাশে গুড়-গুড় মেঘের ডাক হয়তো আসলে বিজলি দৈত্যের দাঁত কড়মড়ানি ঝড় আর বজ্র হয়তো আসলে ‘দেবতা’ আর ‘দৈত্যদের লড়াই!
বৃষ্টিতে বন্যায় কখনও কখনও সারাটা দেশ সয়লাব হয়ে যায়। যতদূর চোখ যায় থৈ থৈ পানিতে ভাসতে থাকে চারদিক….কখনও বা ভূমিকম্পের একটা দৈত্য দুপদাপ হুড়মুড় করে দুনিয়াকে কাঁপিয়ে সব কিছু ভেঙ্গেচুড়ে জনজ করে দিয়ে যায়।
এগুলো মানুষের কম ক্ষতি করে না। এসবের মধ্যেই বা লুকিয়ে আছে কোন্ রহস্য?
আর এই দৈত্যের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোই বা যায় কি করে? কি করে অন্ধ প্রকৃতিকে মানুষের বশে আনা যায়?
তারও জবাব ইল এ যুগের জীয়নকাঠি সেই বিজ্ঞানই। বিজ্ঞানের আলোতে যখন প্রকৃতির রহস্য ভেদ করা যাবে, তখনই কেবল এই সব দৈত্যের প্রাণ-ভোমরাকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে ফেলা সম্ভব হবে। আর এই সব দৈত্যের প্রাণভোমরাকে পিষে মারলেই মায়ার জাল ছিন্নভিন্ন হবে, নতুন জীবনের আনন্দে হেসে উঠবে সমস্ত প্রকৃতি।
তাই এসো আমরা বিজ্ঞানের জীয়নকাঠি নিয়ে প্রকৃতির রহস্যের ঝাঁপি খুলি।
এসো সবাই মিলে এক জোট হয়ে আমাদের চারপাশের চেনা-জানা প্রকৃতির রহস্যের জালকে ভেদ করি।