আটকে গেলো দম!
কতক্ষণ থাকতে পারো তুমি দম আটকে?
আধ মিনিট! পঁয়ত্রিশ সেকেণ্ড! চল্লিশ সেকেণ্ড! পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড, আচ্ছা, না হয় ধরো পঞ্চাশ সেকেণ্ডই থাকলে!
কি? ও সব আন্দাজের ওপর বুঝি হচ্ছে না? বেশ! তাহলে যোগাড় কর একটা ‘চুপ-ঘড়ি’। চাই কি, তোমাদের স্কুলেও থাকতে পারে। স্পোর্টসের সময় খেলার মাঠে দরকার হয়। ইংরেজিতে একে বলে ‘স্টপ-ওয়াচ’। আমরা বাংলায় তার নাম দিলাম ‘চুপ-ঘড়ি’!
এই চুপ-ঘড়ি দিয়ে সময়ের হিসাব মাপা হয় কেমন করে বলি। মনে কর একজন দৌড়চ্ছে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব। তার দৌড়তে ক’ মিনিট, ক’ সেকেণ্ড আর এক সেকেণ্ডের ক’ ভাগ সময় লাগল তা সাধারণ ঘড়ি দিয়ে খুব নিখুঁতভাবে মাপা যায় না। তাই তখন চুপ ঘড়ি ব্যবহার করতে হয়। চুপ ঘড়িকে ঠিক সময়ে টুক করে চালিয়ে দেওয়া যায়, আবার ঠিক সময়ে ঝট করে বন্ধ করা যায়। তাই এটা ঠিক ঠিক বলে দেয় মিনিট আর সেকেণ্ডের হিসাব।
চুপ ঘড়ির কাটা প্রথমে শূন্যতে রাখতে হবে। এখন ঘড়ি চালিয়ে দিয়ে দম বন্ধ কর। আগেই অনেকটা শ্বাস বুকের ভিতর টেনে নিয়েছিলে তো? এবার চোখও বন্ধ করে ফেল। কেউ হয়তো হাসিয়ে দেবে; কিংবা ঘড়ির দিকে তাকালে, চাই কি, নাভাসও হয়ে পড়তে পারো।
কি? মনে হচ্ছে বুঝি চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো–আলো নেই, বাতাস নেই, চারদিক কেবল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। উঃ! দম বুঝি এক্ষুণি আটকে গেলো।
এমনি যখন লাগবে তখন টুক করে চুপ-ঘড়িতে টোকা দিয়ে দম ছেড়ে দাও। চোখ মেলে দেখ এবার। ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটা যেখানে থেমেছে সেখানে গুনে দেখ ক’ সেকেণ্ড হয়েছে। অবশ্য চুপ-ঘড়ি না পেলে সেকেণ্ডের কাটাওয়ালা অন্য ঘড়ি দিয়েও পরীক্ষাটা করা চলবে।
আচ্ছা, কেউ একজন এসে যদি বলে, এক্ষুণি এক সাধু বাবাজীকে দেখে এলাম, তিনি যোগবলে চব্বিশ ঘণ্টা দম বন্ধ করে থাকতে পারেন, তাহলে শুনতে কেমন লাগবে তোমার প্রথম চোটে খবরটা বিশ্বাসই করতে চাইবে না তুমি। তুমি কিনা পুরো একটা মিনিটও দম বন্ধ করে থাকতে পারছোনা মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে খালি সরষে ফুল ফুটছে। আর ওই সাধু বাবাজী চব্বিশ ঘণ্টা দম আটকে নিয়ে বসে থাকবে!
কিন্তু তোমার বিশ্বাস না হলেও মাঝে মাঝে এ-রকম সব ব্যাপার নিয়ে পশ্চিমের দেশে দারুণ রকমের হইচই হয়। ওদেশের লোকেরা এসব শুনে মনে করে, পুবদেশের লোকেরা সবাই বুঝি আশ্চর্য যোগ আর জাদুবিদ্যা দেখাতে ওস্তাদ।
কয়েক বছর আগে এমনি একটা ব্যাপার নিয়ে বিলেতের সবগুলো খবরের কাগজে খুব লেখালেখি হয়েছিল। রহমান বে নামে এক মিসরীয় জাদুকর যোগবলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চারদিক বন্ধ লোহার তৈরি ছোট গোসলের চৌবাচ্চার মধ্যে এক ঘণ্টা শুয়ে থেকে সমস্ত লোককে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। রহমান বে জানায় যে, সে ভারতীয় যোগীদের কাছে এই আশ্চর্য যোগবিদ্যা শিখেছে। সে চৌবাচ্চাসুদ্ধ তার ছবি আর জাদুর বিস্তারিত বিবরণ বিলেতের বড় বড় সব খবরের কাগজে ছাপা হয়ে বেরুলো।
আসলে ব্যাপারটার মধ্যে কিন্তু ভৌতিক বা অলৌকিক কিছু নেই। চৌবাচ্চাটা খুব ছোট হলেও তার আয়তন দেওয়া হয়েছিল লম্বায় ৮ ফুট, চওড়ায় ১ ফুট ৬ ইঞ্চি আর উঁচুতে ২ ফুট। তার মানে ওতে সবসুদ্ধ বাতাস ধরে ২৪ ঘন ফুট( প্রায় ৬৮ ঘনমিটার)। লোকটার আয়তন হিসাবে ৪ ঘন ফুট বাদ দিলেও রহমান বে-র জন্যে আরো তো অন্তত ২০ ঘনফুটের মতো হাওয়া বাকি থাকে।
এদিকে আমরা জানি, হাওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণ হল মোটামুটি পাঁচ ভাগের এক ভাগ; বাকি প্রায় সবটা নাইট্রোজেন। অর্থাৎ ২০ ঘন ফুট হাওয়ায় অক্সিজেন থাকে ৪ ঘন ফুটের একটু ওপরে।
এবারে দেখা যাক এক ঘণ্টায় রহমান বে-র জন্যে কতটুকু অক্সিজেনের দরকার। সাধারণ একজন লোক অল্পসল্প কাজ করলে ২৪ ঘণ্টায় ২৪ ঘন ফুটের মতো অক্সিজেন ব্যবহার করে। কাজ না করে একদম চুপচাপ পড়ে থাকলে এই পরিমাণ কমে অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়।
তা হলে দেখা যাচ্ছে এক ঘণ্টায় রহমান বে-র দরকার ছিল মাত্রই আধ ঘন ফুটের মতো অক্সিজেন। অর্থাৎ তার জন্যে যথেষ্ট বাড়তি অক্সিজেন রয়ে যাচ্ছে এই এক ঘণ্টার শেষে। ইচ্ছে করলে এর পর আরো ঘণ্টা দুই সে অনায়াসেই ঐভাবে কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তাতে শেষের দিকে বাতাসে অক্সিজেনের ভাগ কম থাকতো বলে তার বিচ্ছিরি রকম মাথা ধরার সম্ভাবনা ছিল। বন্ধ সিনেমা হলে তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর বেরোলে যেমন অনেক সময় মাথা ধরে যায় তেমনি।
তাহলে এবার বুঝতে পারলে বন্ধ কবরে কিম্বা চৌবাচ্চার ভেতরে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়ে পুরস্কার বা বাহবা নেবার মধ্যে খুব বাহাদুরির ব্যাপার কিছু নেই। মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের কতকগুলো সাধারণ জ্ঞানের দস্তুরমতো অভাব রয়েছে বলেই আমরা এগুলো দেখলে, বা এসবের কথা শুনলে এমন অবাক হই।
আর এই জ্ঞানের অভাবের জন্যেই বিশুদ্ধ খোলা হাওয়ার দাম আমরা বুঝি নে। শহরে খোলামেলা ময়দান না রেখে ঘন ঘন ঘড়-বাড়ি উঠিয়ে আমরা শহরকে ঘিঞ্জি করে তুলি। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখে হাওয়ার পথ আগলে রাখি। আর গাড়ির ধোঁয়ায় বা কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়ায় চারদিকের হাওয়া বিষাক্ত হয়ে ওঠলেও তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করি নে।
দূষিত হাওয়া যে কত মারাত্মক হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লণ্ডন শহর প্রচণ্ড কুয়াশায় ঢেকে যায়। আর এই কুয়াশায় ধোঁয়া এবং ময়লা আটকে গিয়ে শ্বাস নেবার এমন অসুবিধে ঘটায় যে, তাতেই পাঁচ দিনে প্রায় চার হাজার লোক মারা পড়ে।
হয়তো ভাবছ, এত সব হিসাব-পত্তর করে এই কথাগুলো বলার কী এমন দরকার ছিল? হ্যাঁ, ছিল বৈকি! মানুষের শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে কতখানি হাওয়ার দরকার, হাওয়ায় অক্সিজেনের ভাগ কতখানি থাকা চাই, এসব ব্যাপার খনিতে বা কল-কারখানার বাতাস চলাচলের অবস্থা করার জন্যে খুব কাজে আসে। যুদ্ধের সময় বিষাক্ত গ্যাসের প্রতিরোধেও কাজে লাগে।
দিন রাতের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের হাওয়া না হলে চলে না। হাওয়ায় রয়েছে আমাদের জীবনের প্রধান অবলম্বনঅক্সিজেন গ্যাস। বিশুদ্ধ হাওয়া ছাড়া তাই সুস্থ জীবনের কথা কল্পনা করা যায় না।
আমাদের দেশে ক্রমে ক্রমে নানা রকম শহর বন্দর কল-কারখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে। শহরে বন্দরে মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে কল-কারখানার চিমনি থেকে বেরোনো ধোঁয়া, দৃশ্য আর অদৃশ্য ধুলো, হাওয়ায় নানা রকম বিষাক্ত গ্যাস। আর তেমনি বাড়ছে আমাদের চারপাশের হাওয়া দূষিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। কাজেই দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে এসব কথা ভাবতে হবে বৈ কি!