এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে

এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে

দুর্যোগময় শীতের রাতের কুয়াশাঢাকা নোংরা অন্ধকারকে ভেদ করে পুবের আকাশে দেখা দেয় সুবেহ সাদেকের প্রথম আলোর আভাস। কতো প্রাণান্ত তপস্যার পর কী আশ্চর্য আশা-ভরসা-আশ্বাস নিয়ে আসে সেই আলো!

সেই প্রথম আলোর শিশুই তো বয়ে আনে নতুন সূর্যের প্রাণ-মাতানো আলোর বন্যার খবর। নতুন আলোর সাথে সাথে আসে নতুন কথা, নতুন গান, নতুন জীবন। বুঝি তাই কিশোর কবির কাছে “সকালের এক টুকরো রোদ্দুর এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী।”

প্রথম দু-একটি আলোর কণা হয়তো হারিয়ে যায় কোন গহীন অরণ্যের অন্ধকারে হয়তো ছিটকে পড়ে কোন পাহাড়ের খাদে। রাতের অন্ধকার হটতে চায়

সহজে। কিন্তু তারপর আলোর রাশি আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে, হাজারে হাজারে। বিভীষিকাময় অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে, নিঃশেষে মুছে দিয়ে ঝলমল করে হাসতে থাকে নতুন দিনের দিগন্তজোড়া সোনার সকাল।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন ইস্কুলের ছাত্র। এক কৃষক ভাইকে নিয়ে পড়েছিলাম ভারি বিপদে। কথায় কথায় তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম যে, আমাদের পৃথিবীটা গোল, পৃথিবীটা ঘুরছে, আর এই পৃথিবীর জন্ম হয়েছে সূর্য। থেকে। কিন্তু কথাগুলো কিছুতেই বুঝতে পারছিল না সে।

আমাদের গ্রামের কছির শেখ নেহাত একজন দিনমজুর। মাঝারি বয়স–কামলা খেটে তার দিন চলে। সকাল বেলা বেরিয়েছে শহরের পথে, দুধ বেচতে। বেড়াতে বেড়াতে আমিও তার সঙ্গ নিয়েছিলাম।

আমার বয়স তখন খুব কম। কিন্তু তা হলেও আমি ইস্কুলে পড়ি- কতো কী বই-কেতাব ঘেঁটেছি। আর কছির শেখ জীবনে কখনোও ছাপার হরফে চোখ বোলায় নি, পেনসিল দিয়ে কাগজের পাতায় দাগ কাটে নি কোনদিন। তাই আমার কাছে সে অনেক কিছু জানতে চায়, জিজ্ঞেস করে নানান অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন। অথচ বিজ্ঞানের নিতান্ত সহজ কথাগুলোও কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না তাকে।

পৃথিবী যে গোল তার যতগুলো প্রমাণ ইস্কুলের বইতে পড়া ছিল, খুব সোজা করে সব একে একে বললাম তাকে। বয়স আর দুঃখের ভারে জরাজীর্ণ ভাবলেশশূন্য মুখে সে শুধু চুপ করে শুনে গেল।

বললাম : ওই যে সূর্যটা, দেখতে গনগনে আগুনের গোলার মতো, ওটা হচ্ছে একটা ছোটখাট তারা’, আর ওটা আছে আমাদের পৃথিবী থেকে ন’কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল দূরে। সোনার থালার মতো গোল ওই বিরাট সূর্যটা আবার ছোটখাট তারা কি রকম? অনেকক্ষণ ধরে তাকে বোঝাতে হল ন’ কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল ব্যাপারটা কত বড়। বললাম : আজ যদি পৃথিবী থেকে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে ট্রেন ছাড়া যায়, তবে দিন, রাত চব্বিশ ঘণ্টা একটানা নাক বরাবর চলেও তার সূর্যে গিয়ে পৌঁছতে দু’শো বছর পেরিয়ে যাবে।

তারপর বললাম কি করে ওই সূর্যের গনগনে আগুনের গোলা থেকেই হল আমাদের পৃথিবীর জন্ম–ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে পৃথিবী কি করে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছল।

কছির শেখ যখন শুনল সূর্য আমাদের পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে না, পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারধারে, তখন সে দস্তুরমতো অবাক হয়ে গেল। গাছপালা, মানুষ, গরুবাছুর, জমিজমা সব কিছু নিয়ে এই পৃথিবীটা যে কমলা লেবুর মতো গোল (খালি গোল না, ওপর-নিচে নাকি আবার খানিক চ্যাপটাও), আর এই বিরাট পৃথিবীটা যে শূন্যের মধ্য দিয়ে শোঁ শোঁ করে ছুটে বেড়াচ্ছে, একথা তার কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। পৃথিবী যদি গোল হবে তবে আমরা পড়ে যাই নে কেন? পৃথিবী যদি শূন্যের ওপর দিয়ে ঘুরছে, ছুটছে তাহলে আমরা তা একেবারেই বুঝতে পারি নে কেন?

কথায় কথায় মাঠের আলের পথ পেরিয়ে আমরা বাঁধানো সড়কে এসে পড়েছি। সড়কের মাঝখানে রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং, আড়াআড়িভাবে সড়ক ডিঙ্গিয়ে রেল লাইন পাতা, সেখান দিয়ে আমাদের সামনেই হুস হুস করে একটা ট্রেন চলে গেল।

শেষকালে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এই রেলগাড়ি দিয়েই তাকে বোঝাবার চেষ্টা করি। রেলগাড়িতে বসে জানালা দিয়ে দূরে তাকালে মনে হবে, বুঝি আমরা চুপচাপ আছি, বাইরের গাছপালা বাড়িঘড়গুলোই আমাদের ফেলে দৌডুচ্ছে পেছনের দিকে। পৃথিবীর বেলাতেও তেমনি। পৃথিবী পশ্চিম দিক থেকে পুব দিকে ঘুরছে, অথচ আমরা দেখি ঠিক তার উলটো, যেন সূর্যই পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে পুব থেকে পশ্চিমে।

কিন্তু এত সব কথা আমি শোনাচ্ছি কাকে? কছির শেখ তো জীবনে কোনদিন রেলগাড়িতেই চড়ে নি।

সে জিজ্ঞেস করে, রেলগাড়ির মতো বিরাট দৈত্যটা কি করে চলে?–আগুনে পানি গরম করলে যে বাষ্প তৈরি হয় তার বিপুল শক্তির কথা বলি তাকে। এই শক্তিতে রেল চলে, জাহাজ চলে, কত বড় বড় কলকারখানা চলে। শুনে কছির শেখ ভারি তাজ্জব হয়। কিন্তু কী আসে যায় এই বাষ্পের শক্তিতে তারা কামলা খেটে দিন আনে দিন খায় যে কছির শেখ, বাস্পের শক্তিতে তার কোন্ লাভটা?

এমন সোজা ব্যাপারগুলো তাকে বোঝাতে না পারায়, সত্যি বলতে কি, দুঃখে আমার কান্না পায়। এতক্ষণে কী ভাবল সে? এই ইংরেজি পড়া ছেলেগুলো যেন আরেক দুনিয়ার মানুষ। সেখানে পৃথিবীটা কমলা লেবুর মতো গোল, পৃথিবী সূর্যের চারধারে ঘোরে, সূর্য একটা ছোটখাট তারা, সেখানে বাষ্পের শক্তিতে হরেক রকম কল চলে? একদম আরেক দুনিয়া সেটা। তার জীবনের সাথে এই দুনিয়ার কোনরকম যোগই নেই।

কিন্তু সত্যি কি তাই? সত্যি কি কছির শেখ আরেক দুনিয়ার মানুষ?

আমার ছোটবেলার দেখা সেই কছির শেখ আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু আজো এমনি হাজার হাজার লাখ লাখ কছির শেখ ছড়িয়ে আছে আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে, আমাদের আশেপাশে চারধারে। তাদের চোখে শিক্ষা আর সভ্যতার আলো এখনও গিয়ে পৌঁছে নি, বিজ্ঞানের দান তাদের জীবনে আনে নি কোন আশীর্বাদ। তাদের চোখে এখনও অন্ধকার –এই অন্ধকার আমাদের চারপাশের এই দুনিয়ারই অন্ধকার।

কিন্তু এই অন্ধকার কি আমাদের দুনিয়াতে চিরদিনই থাকবে? ইচ্ছে করলে এই অন্ধকারকে কি হটানো যায় না?

এসো অতীতের সমস্ত অন্ধকার আর গ্লানির জগৎকে পেছনে ফেলে আমরা আলোর রাজ্যে বিজ্ঞানের রাজ্যে পা দিই।

বিজ্ঞানের রাজ্যে, এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও নয়, সেখানে যেতে হলে চোখে স্বপ্নের ফুলিও পরতে হয় না। আমাদের আশেপাশে চারধারে ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির কতো বিস্ময়, বিজ্ঞানের কতো বৈচিত্র্য। চোখ খোলা রাখলেই সে-সব দেখতে পাওয়া যায়। রাতের আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে যায়। দিনে সূর্যের আলোয় পৃথিবীর বুক ঝলমল করে। বর্ষার দিনে আকাশ ছেয়ে মেঘ করে, অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে; বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে মাঠে কচি কচি ধানের শীষগুলো হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে হেসে ওঠে। রামধনুকের সাতটি রঙ পেখম ছড়ায় আকাশ জুড়ে। এ সব কিছুর মধ্যেই; হ্যাঁ, সব কিছুর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের আশ্চর্য জাদু।

কছির শেখের চোখে এই জাদু সব ধরা পড়ে না–এর অনেক রহস্যই তার অজানা। তাই তার মন কুয়াশায় ঢাকা, তাই তার মনে অন্ধকারের বাসা।

এই সব রহস্যকে জানা, প্রকৃতির নিয়ম-কানুন জেনে তাকে বাগ মানানো, প্রকৃতিকে মানুষের বশ করা–এই হল বিজ্ঞানের কাজ। বশ করা জীবনেরই জন্যে–অন্ধকার, দুঃখ আর বিভীষিকার পুরনো জীবনকে হটিয়ে দিয়ে নতুন জীবনের জন্যে, সুখ, সৌন্দর্য আর প্রাচুর্যের জন্যে।

তাই বিজ্ঞান হল একটা হাতিয়ার জীবনকে, দুনিয়াকে বদলাবার হাতিয়ার।

তাই এসো আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মশাল জ্বালি। কেননা যেখানেই আমরা এই মশাল জ্বালি না কেন, আর আজ তা যত ছোটই হোক, আমরা তো জানি, এই মশাল একদিন জ্বলে উঠবে দেশের দিকে দিকে; তার উজ্জ্বল আলো গিয়ে ছড়িয়ে পড়বে কছির শেখের মতো আমাদের দেশের হাজার হাজার, লাখ লাখ ভাইবোনের চোখে–আর তাদের চোখের অন্ধকার, মনের অন্ধকার যাবে কেটে।

তখন তারা দেখবে, জীবনকে সুখী আর সুন্দর করার কী অফুরন্ত আয়োজনই রয়েছে এই দুনিয়াতে। বিজ্ঞানের রাজ্যে শুধু বাষ্পের শক্তিই নয়, আছে সূর্যের অপরিমেয় আলো, মাটির সীমাহীন উর্বরতা, আছে হাওয়া আর পানির শক্তি, বিদ্যুৎ আর পরমাণুর শক্তি। আর এ সমস্তই আছে মানুষের সেবার জন্যে। এতদিন কতো অফুরন্ত শক্তিই না ছিল তার নাগালের বাইরে।

সেদিন আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষ যদি বলতে শুরু করে? দুঃখ-গ্লানির অন্ধকারে আমরা আর বন্দী থাকব না, বিজ্ঞানের হাতিয়ার নিয়ে সুখ-শান্তি-আনন্দের নতুন জীবন আমরা কায়েম করব; আর সেই হাজার হাজার মানুষ যদি পরিশ্রম করতে শুরু করে তার জন্যে, তখন? তখনও কি আমাদের জীবনের চারপাশ থেকে এই অন্ধকার না হটে পারবে?

তাই এসো, নতুন জীবনের জন্যে আমরা এক হই। এসো, আমরা বিজ্ঞানের রাজ্যে পা দিই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *