আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
মাঠে যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজের বন্যা। কচি কচি ধানের চারাগুলো মাথা তুলেছে। সারা মাঠ জুড়ে কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে বিরাট একখণ্ড সবুজ মখমল। মাঠভরা ফসলের দিকে তাকিয়ে কৃষাণের বুক আনন্দে আশায় গর্বে ভরে যায়।
কিন্তু এ আনন্দ তার বেশি দিন টিকে না। আকাশে এক ফোঁটা মেঘের দেখা নেই; ছোট ছোট ধানের চারাগুলো বৃষ্টির অভাবে কুঁকড়ে কালো হয়ে ওঠে; বৈশাখের আগুন-ঢালা রোদের তাতে সারাটা মাঠ ঝলসে যায়। বৃষ্টির জন্যে মানুষ তখন আকুল হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাতে থাকে। কেননা এই অনাবৃষ্টি আকালেরই পূর্বাভাস, সারা বছরের খোরাক রয়েছে তার ওই মাঠের বুকে।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যের পর আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে ছড়া কেটে কাপড়ের খুঁটে গেরো বাধে। অসহ্য গরম পড়লে পাড়াময় ঘুরে চাল তোলে; একজনকে সাজিয়ে সুর করে ছড়া কেটে তার মাথায় ঘড়ায় ঘড়ায় পানি ঢালে; তারপর বৃষ্টির জন্যে মাটিতে গড়াগড়ি যায়। তবু বৃষ্টি হয়তো নামে, হয়তো বা নামে না।
এখনকার মতো মানুষের যখন এতটা বুদ্ধি-শুদ্ধি হয় নি তখন সেই আদিম যুগের মানুষেরা মনে করতো বৃষ্টির বুঝি একটা দেবতা আছে, তিনি যখন কোন কারণে অসন্তুষ্ট হন তখনই অনাবৃষ্টি আর আকাল নামে। বৃষ্টি যে কখন কেন হয় সে সব কিছুই তারা বুঝত না; শুধু জানতো, বৃষ্টি নামলে ফসল ফলে, নইলে চাষ বাস সব নষ্ট হয়ে যায়। তাই বৃষ্টি না হলেই দল বেঁধে নেচে, গান গেয়ে তারা বৃষ্টির দেবতাকে খুশি করবার চেষ্টা করতো। সেই সব আচার অনুষ্ঠানের রেশ আজো মানুষের মধ্যে এখানে সেখানে কিছুটা রয়ে গিয়েছে।
কিন্তু আজ তো বৃষ্টি কি করে হয় তা আমরা জানি। সাগর থেকে বাষ্প হয়ে ওঠা পানির ঝাঁপি নিয়ে মেঘ উড়ে আসে। পাহাড়ের বাধা পেয়ে আকাশের ওপরে উঠতে উঠতে ঠাণ্ডা হয়ে বাতাসের ধুলোর কণায় বৃষ্টির ফোঁটা জমে। তারপর সেই ভারি হয়ে ওঠা ফোঁটাগুলোকে মেঘ যখন আর ধরে রাখতে পারে না তখনই নামে বৃষ্টির ধারা।
এমনি বৃষ্টি বয়ে আনা মৌসুমী হাওয়া কখন কোন দিক থেকে বইবে আবহাওয়া অফিস তাও আজ বলে দিতে পারে। তাই বৃষ্টি বা আবহাওয়ার ব্যাপার-স্যাপার আজ আর মোটেই রহস্যময় নয়; মানুষ আজ ঝড়বৃষ্টির কারণ বোঝে। আর তাই কখন বৃষ্টি হবে না হবে, আবহাওয়া কখন কিভাবে বদলাবে না বদলাবে, তাও বেশ আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়।
কিন্তু একটা ব্যাপার কখন কিভাবে ঘটবে শুধু আগে থেকে বলতে পারা এক কথা, আর নিজেদের দরকার এবং ইচ্ছে মতো সেটাকে বদলাতে পারা একেবারে অন্য কথা।
বিজ্ঞানীরা হয়তো বলতে পারলেন, আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে কোন বৃষ্টি হবে না। কিন্তু সেটা জানাই তো শুধু যথেষ্ট নয়। প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে না থেকে মানুষ কি নিজের ইচ্ছে মতো বৃষ্টি নামাতে পারে না? আজকের বিজ্ঞানীরা বলছেন? হা পারে–অনিচ্ছুক প্রকৃতির কাজ থেকে মানুষ বৃষ্টি আদায় করে নিতে পারে।
এটা জানা কথা? আকাশের ওপরের স্তরে বেশি ঠাণ্ডা পেলেই মেঘের বাম্প। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ওঠে; আরো বেশি ঠাণ্ডা হলে একেবারে বরফের শিল হয়ে যায়। হয়তো দেখা গেল আকাশে মেঘ ভেসে যাচ্ছে অথচ নিচে মাটি একেবারে ফুটিফাটা, বহুদিন বৃষ্টি হচ্ছে না। তার অর্থ–ওপরে মেঘ এখনও যথেষ্ট ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া পাচ্ছে না, যাতে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা জমতে পারে। এখন প্রশ্ন হল কি করে আকাশের ওপর ঐ মেঘকে যথেষ্ট পরিমাণে ঠাণ্ডা করে তাকে বৃষ্টি ঝড়াতে বাধ্য করা যায়। আশ্চর্যের কথা, ব্যাপারটাকে খুব কঠিন মনে হলেও বিজ্ঞানীরা আজ একে সম্ভব করে তুলেছেন।
বাতাসে একটা গ্যাস আছে তার নাম কার্বন ডাই-অক্সাইড। আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে বুক থেকে যে হাওয়া বেরিয়ে আসে, তার বেশির ভাগই হচ্ছে এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। পানিকে যেমন ঠাণ্ডা করতে করতে বরফ করে ফেলা যায়, তেমনি এই কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকেও বেজায় রকমের ঠাণ্ডা করলে বরফের মতো জমাট শক্ত হয়ে যায়। দেখতে অনেকটা বরফের মতো আর অত্যন্ত ঠাণ্ডা বলে এর সাধারণ নাম হচ্ছে ‘dy ice’ বা শুকনো বরফ’। জ্বরের ঘোরে কেউ যখন প্রলাপ বকতে থাকে তখন তার গায়ের তাপ ওঠে একশো পাঁচ কি ছ’। ডিগ্রী। কিন্তু শুকনো বরফের তাপ ফারেনহাইড থার্মোমিটারের শূন্যেরও ১০৯ ডিগ্রী নিচে। তাই একে সব সময় ঠাণ্ডা জায়গায় রাখতে হয়, বাইরে খোলা রাখলে সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া হয়ে উড়ে যায়।
এমনি জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইডের গুঁড়ো উড়োজাহাজে করে মেঘের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বিজ্ঞানীরা বৃষ্টি নামানোর কায়দা আবিষ্কার করেছেন। শুকনো বরফ মেঘের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উবে যেতে থাকে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসের চেয়ে ভারি বলে ক্রমে ক্রমে নিচের দিকে নামে। তাতেই সমস্তটা মেঘ তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে জমে যায়। স্পিরিট যখন হাতের ওপর উবে যেতে থাকে তখন হাতে কেমন ঠাণ্ডা লাগে, তাই না? ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম।
সমস্তটা মেঘের স্তর যাতে ঠাণ্ডা হতে পারে তার জন্যে মেঘের স্তরের রকম দেখে ‘শুকনো বরফকে কুচি কুচি টুকরো করে নেওয়া হয়। মেঘ যদি হয় হাজার মিটার পুরু তাহলে ধানের মতো ছোট ছোট কুচি করা হয়, তার চেয়ে পুরু হলে কুচির আকারও তেমনি বড় হয়।’
কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়া সিলভার আয়োডাইড নামে আর একটা রাসায়নিক উপাদান দিয়েও কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানো সম্ভব হয়েছে। তবে এটাকে ধোঁয়ার আকারে ছাড়া হয় মাটি থেকে। সিলভার আয়োডাইডের সূক্ষ্ম কণাগুলো যখন মেঘের স্তরে গিয়ে পৌঁছায় তখন এই কণার গায়ে গায়ে পানির ফোঁটা জমতে থাকে। তারপর ফোঁটা বড় হলে এক সময় বৃষ্টি শুরু হয়।
জমাট কার্বন ডাই-অক্সাইড় ছড়িয়ে বৃষ্টি নামাতে যে বেশি খরচ পড়বে তা নয়। ‘শুকনো বরফ জিনিসটা খুব সস্তায় পাওয়া যায়। অবশ্য এর জন্যে এরোপ্লেন রাখবার ঝামেলা আছে, সেগুলো সরকারি খরচায় রাখা হবে, দরকার মতো সেখান থেকে ভারা পাওয়া যাবে। কিন্তু এভাবে সময়মতো বৃষ্টি নামিয়ে অনাবৃষ্টির হাত থেকে যে পরিমাণ ফসল বাঁচানো যাবে তার দাম এই খরচার চেয়ে বহু গুণ বেশি।
এভাবে বৃষ্টি নামাতে হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে খুব বেশি ছড়াতে হবে তাও নয়। অবশ্য পরিমাণটা নির্ভর করে মেঘের ধরনের ওপর। সাধারণত প্রত্যেক কিলোমিটারে দুশো থেকে তিনশো গ্রাম শুকনো বরফ ছড়ানো হয়। বেশি ছড়ালেই যে বৃষ্টি বেশি হবে তার কোন মানে নেই, বরং ফল উলটো হবারই সম্ভাবনা।
কার্বন ডাই-অক্সাইড পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘের মধ্যেকার পানির কণাগুলো হঠাৎ ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে যায়; তাতে কয়েক মূহূর্তের মধ্যে তুষারকণা জমতে শুরু করে তারপর চারপাশ থেকে আরো সব পানি এসে তার ওপরে জমতে থাকে। পানির কণাগুলো হঠাৎ এত বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার ফলে আশেপাশের বাতাসে অনেকখানি তাপ ঢেলে দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিরীহ শান্ত মেঘ পরিণত হয় ঝড়ো বাতাস আর শিলাবৃষ্টির অট্টরোলে।
আর তারপর তৃষ্ণার্ত, উন্মুখ পৃথিবীর বুকে ঝম ঝম করে নামে স্নিগ্ধ, শীতল বৃষ্টির ধারা। প্রকৃতির করুণার দান নয়, মানুষের হাতে গড়া বৃষ্টি।