নুনের মতন ভালবাসা
রূপকথাটা আদতে ছিল পাঞ্জাব দেশের; এখন ক্রমে ক্রমে আমাদের দেশেও চালু হয়ে গিয়েছে।
বাদশাহর একদিন কি খেয়াল চাপল, তাঁর শাহজাদীদের ডেকে শুধালেন : আচ্ছা, বল দেখি, তোমরা আমাকে কে কেমন ভালবাসো?
বড় রাজকন্যে জবাব দিলেন : ঠিক চিনির মতো।
মেঝো রাজকন্যে বললেন : মধুর মতো।
সেজো রাজকন্যের জবাব : খুব মিষ্টি আর খোশবুদার শরবতের মতো।
আর সবচেয়ে ছোট যে টুকটুকে কন্যাটি তিনি কি জবাব দিলেন, জানো? তিনি বললেন : বাবা, আমি তোমাকে ভালবাসি নুনের মতো।
শুনে তো বাদশাহ একেবারে থ খেয়ে গেলেন। বলে কি! শুধু নুনের মতো? ….
হ্যাঁ, নুনের মতো। রাজকন্যা তেমন বেয়াড়া কিছু বলেন নি। সত্যি সত্যি পানি আর হাওয়াকে বাদ দিলে আমাদের শরীরের জন্যে নুনের চেয়ে দরকারি জিনিস আর কি আছে? নুন এত দরকারি বলেই না কথায় বলে: “নুন খাই যার। গুণ গাই তার।”
আগের দিনে মিসর দেশে অবাধ্য গোলামদের সাজা দেওয়া হতো নির্জন কুঠরির মধ্যে ফেলে রেখে তাদের নুন খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে। শুনতে খুব সোজা মনে হলেও এ কিন্তু ভারি জবর সাজা। আলুনী খাবার খেয়ে খেয়ে ক’দিনের মধ্যেই লোকগুলো একেবারে নির্জীব মরার মতো হয়ে পড়তো। এই ভয়েই তাদের আর মালিকদের কোন রকম অন্যায় হুকুমও অমান্য করবার সাহস হতো না।
সেই রূপকথার রাজাও একদিন অবস্থাগতিকে পড়ে থরে থরে সাজানো বহু রকমের ভাল ভাল খাবার সামনে রেখেও নুন দেওয়া হয়নি বলে কোনটাই মুখে তুলতে পারলেন না; তখন ছোট মেয়ের কাছে শিক্ষা পেয়ে তিনি বুঝলেন আমাদের রোজকার জীবনে নুন সত্যি সত্যি কতখানি দরকারি জিনিস।
মানুষের ইতিহাস যেমন পুরনো, নুনের ইতিহাসও কিন্তু তেমনি পুরনো। হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মেরও ২,৭০০ বছর আগে চীনদেশের একখানা বইতে প্রথম নুনের ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। সেই কোন্ পুরনো যুগ থেকে মিসর দেশে উটের পিঠে করে নুনের ব্যবসা চলতো, ইতিহাস থেকে তার কথাও আমরা জানতে পাই।
যতদূর জানা যায়, এশিয়া-মাইনর, আরব এসব দেশে আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে নুনের ব্যবসা চালু ছিল। আরবরা নুনকে একটা সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করতো। তাই বাণিজ্যের পসরা নিয়ে ধূ-ধূ মরুভূমির বুকে অনেক দূরের পথে কোন কাফেলা পাড়ি দেবার আগে যাতে ব্যবসায় খুব লাভ হয়, আর যাত্রীরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে, সে জন্যে তারা খানিকটা নুন পুড়িয়ে নিতো।
সে-সময়ে এসব মুন সবই তৈরি হত সমুদ্রের লোনা পানি রোদে রেখে বা জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে ফেলে। সমুদ্রের পানি হল পৃথিবীতে নুনের এক বিশাল ভাণ্ডার। সমুদ্রের নুন দেখতে একটুখানি কালচে রকমের আর মোটা দানার। আমাদের দেশে বাজারে যে নুন বিক্রী হয় তার বেশির ভাগই সমুদ্রের পানি থেকে তৈরি। চট্টগ্রামে সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকায় লোনা পানি শুকিয়ে প্রচুর নুন তৈরি হয়। মাটির নিচে যে আবার বিরাট বিরাট জমাট নুনের কাড়ি পাওয়া যায় এটা আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পোলাও দেশে। পোলাত্রে এই নুনের খনি এত বিরাট যে, হাজার বছর ধরে এখান থেকে অনবরত নুন তোলা হচ্ছে, কিন্তু আজও তার শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই।
আজকাল যেমন ইচ্ছে হলেই বাজার থেকে যত খুশি নুন কিনতে পাওয়া যায়, আগেকার দিনে কিন্তু মোটেই এমনি ছিল না। তখন নুন ছিল একটা বেজায় রকমের দামী জিনিস, আর তার মর্যাদাও ছিল তেমনি। ১৯২৯ সালে ফরাসি দেশে একটা আইন করে বলে দেওয়া হয় যে সাধারণ লোকেরা আর নিজেদের খুশিমতো নুন তৈরি করতে পারবে না। দেশের খরচ চালাবার জন্যে নুনের ওপর এমনভাবে ট্যাক্স বসাবার ব্যবস্থা করা হয় যাতে গরিব লোকেরা নুন কিনতে না পারে, কেবল যাদের অনেক টাকা-কড়ি আছে তারাই কিনতে পারে।
কিন্তু এ-রকম বিদঘুঁটে আইনের ফল মোটেই ভাল হয় নি। নুনের মতো এমন একটা দরকারি জিনিস নিয়ে এমন ছেলেখেলা লোকে মানতে চাইবে কেন? এমনি নানা অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে ক্রমে ক্রমে দেশের লোক এমন ক্ষেপে ওঠে যে, আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে এক বিপ্লব হয়।
১৮৫৬ সালে ভারতবর্ষেও বিদেশী শাসকরা নুনের ওপরে চড়া ট্যাক্স বসিয়ে দেয়, সমুদ্রের ধারের লোকদের নুন তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফরাসি দেশের মতো এ-দেশেও লোকের মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয়। সে সময়কার সিপাহী বিদ্রোহ, তারপর গান্ধীজীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন এসবের কথা তোমরা নিশ্চয় শুনেছ।
তবে দেখ, জিনিসটা দেখতে সামান্য মনে হলেও আসলে এটা মোটেই হেলাফেলার জিনিস নয়–এই সামান্য নুন নিয়ে সারা দেশজোড়া কতো কি এলাহী ব্যাপার ঘটে যেতে পারে!
কিন্তু তোমরা হয়তো শুনলে তাজ্জব হবে এমন দরকারি যে নুন তা আমাদের পেটে নাকি হজম হয় না। কথাটা একেবারে মিছে নয়। একজন লোকের ওজন যদি হয় পঞ্চাশ কেজি তাহলে তার শরীরে মোটামুটি আধ কেজি নুন রয়েছে। জানো তো আমাদের শরীর হচ্ছে খুব ছোট ছোট অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের শরীরের বেশির ভাগ কোষের মধ্যেই নাকি নুনের তেমন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না, বেশির ভাগ গাছের কোষেও না। নুন থাকে শুধু আমাদের রক্তের মধ্যে।
তোমরা হয়তো অমনি ফস করে জিজ্ঞেস করে বসবে? আর কোথাও না, কেবল রক্তের মধ্যে? তাহলে আমরা যে নুন খাই তা যায় কোথায়? আর তা দিয়ে শরীরের হয়ই বা কি?
সে এক মজার ব্যাপার। বলছি, শোন।
সমুদ্রের মধ্যেকার নিচুস্তরের যে-সব প্রাণী–যেমন, জেলি-ফিশ, অ্যানিমোনি, ঝিনুক, চিংড়ি–এদের গায়ে কোন রক্তই নেই। অর্থাৎ, রক্ত বলতে যা আছে তা আসলে সমুদ্রের পানিরই শামিল। এদের সারা গা দিয়ে সমুদ্রের পানি শরীরের ভেতর ঢুকে যায়। এই পানিই এদের সমস্ত হজম করা খাবার-দাবার শরীরের কোষে নিয়ে পৌঁছে দেয়।
সমুদ্রের উঁচুদরের মাছ আর ডাঙ্গার প্রাণীদের গায়ে যে রক্ত তা রীতিমতো নোনতা–এক ভাগ সমুদ্রের লোনা পানি আর তিন ভাগ সাধারণ মিঠে পানি মেশালে যেমন হবে অনেকটা তেমনি। ডাঙ্গার প্রাণীদের মধ্যে মানুষও পড়ে, কাজেই মানুষের রক্তও এমনি।
কিন্তু আমাদের রক্তের মধ্যে নুনের দরকারটা কি তাহলে? সে-কথা বুঝতে হলে একটু পৃথিবীর পুরনো ইতিহাসের কথা জানতে হবে।
আমরা সবাই আজকাল ডাঙ্গায় বসবাস করলে কি হবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজ থেকে বহু কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই জেলিফিশের মতোই সমুদ্রের তলায় থাকতো। সমুদ্রের তলায় থাকার তুলনায় প্রাণীদের ডাঙ্গার ওপর ওঠে থাকার সময়টা নেহাতই কম। বহু কোটি বছর ধরে সমুদ্রের তলায় থাকতে থাকতে জীবকোষগুলোর যে নোনা পানিতে ডুবে থাকার স্বভাব হয়ে গিয়েছে ডাঙ্গায় ওঠেও তা আর ছাড়ানো যায় নি। হয়তো তাই সমুদ্রের নিচুস্তরের জীবদের মতো আমাদের শরীরের কোষগুলোও অনেকটা নোনা পানিতেই ডুবে থাকতে চায়; আর সেই জন্যেই আমাদের রক্তের মধ্যে নুন না থাকলে এক দণ্ড চলে না।
কলেরা হয়ে কারো শরীর থেকে যদি খুব বেশি পানি আর নুন বেরিয়ে যায় তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে ডাক্তাররা নুন-গোলা পানির স্যালাইন ইঞ্জেকশন দেন। আজকাল ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্যে ওরাল স্যালাইন বা লবণ-গুড়ের শরবত বেশ কাজ দিচ্ছে।
এই একই কারণে মানুষের মতো কুকুর, বেড়াল বা পাখিদেরও নুনের দরকার হয়। তবে এরা নুন ছাড়াও বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে পারে; কিন্তু মানুষ, ঘোড়া বা গরু তা পারে না। তার কারণ মানুষ, ঘোড়া বা গরুর বেলায় আরো একটা ব্যাপার আছে। গরমের দিনে ঘেমে ঘেমে আমাদের শরীর ঠাণ্ডা রাখতে হয়। সারা শরীরের লোমকূপের গোড়া দিয়ে রোজ প্রচুর ঘাম বেরিয়ে আসে; এই ঘামের পানিটুকু বাষ্প হয়ে উবে গিয়ে শরীরকে ঠাণ্ডা করে। কিন্তু ঘামের সাথে শরীর থেকে প্রচুর নুনও বেরিয়ে যায়। অনবরত গা থেকে এমনি করে নুন বেরিয়ে যায় বলেই আমাদের রোজকার খাবারের সঙ্গে নিয়মিত নুন না খেলে চলে না।
সব জানোয়ার কিন্তু ঘামে না। যেমন, কুকুর বা বেড়ালের কেবল পায়ের তলায় আর মুখের খানিকটা জায়গা ছাড়া সারা গায়ে আর কোথাও ঘামের গ্রন্থি নেই। খুব বেশি গরমে ঠাণ্ডা হবার দরকার হলে কুকুর তাই জিব বার করে হাঁপায়। জিব থেকে যে বাষ্প বেরোয় তাতেই তার ঘামবার কাজ হয়, তাকে খানিকটা আরাম দেয়।
গরু বা ঘোড়ার শরীরে অনেক সময় নুনের টান পড়ে যায়। তাই গরমের দিনে তারা একে অন্যের গা চেটে চেটে নুন খায়। এদের শরীর ভাল রাখার জন্যে খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে নুন দিতে মানুষের মধ্যে যারা আবার খুব বেশি খাটুনির কাজ করে–যেমন খনির কাজ, জাহাজের বয়লারে কয়লা ঠেলার কাজ, কল-কারখানা বা মাঠের কাজ–তাদের সারা দিন অনবরত ঘামতে হয়। তাই তাদের শরীরে ঘাটতি মেটাবার জন্যে নুনের দরকার হয় খুব বেশি।
বিলেতে বা অন্যান্য ঠাণ্ডা দেশে লোক ঘামে কম, তাই সেখানে নুন খুব কম খেলেও চলে। কিন্তু আমাদের মতো গরম দেশের ব্যাপার ঠিক তার উলটো। তাই নুনের অভাব হলেও সারা দেশ জুড়ে হাহাকার পড়ে যায়-নুনের দাম দশ-বিশ টাকা কেজি বা তার বেশিও ওঠে।
বছরে সারা দুনিয়ায় চার-পাঁচ কোটি টন নুন খরচ হয়, অর্থাৎ মাথাপিছু প্রায় আট-ন’ কেজি করে পড়ে। এর সবটা যে খাওয়ার জন্যে খরচ হয় তা কিন্তু নয়।
খাওয়া ছাড়াও নুন যে আমাদের রোজকার জীবনে আরো কত শত কাজে লাগে তা আর বলে শেষ করা যায় না। জুতোর চামড়া পাকা করতে; কাঁচ, সাবান, কাগজ, বরফ, রুটি, কৃত্রিম রবার, প্লাস্টিকের জিনিস তৈরি করতে; মাছ-মাংস, ফলমূল জমিয়ে রাখতে; এ ছাড়া নানা রকম রাসায়নিক জিনিস আর ওষুধ-পত্র তৈরি করতে আজকাল নুন ছাড়া চলে না।
বরফের সাথে নুন মেশালে বরফের তাপমাত্রা আরো কমে যায়। তাই পানি থেকে বরফ তৈরি করার জন্যে বরফের কারখানায় নুন ব্যবহার করা হয়। একই ভাবে আইসক্রীম জমাবার জন্যেও নুন মেশানো অতি ঠাণ্ডা বরফ কাজে লাগে।
আমাদের দেশে অনেকে নুন আর তেল মিশিয়ে দাঁত মাজে। ডাক্তাররা বলেন এটা দাঁতের পক্ষে ভাল, কেন না নুন জীবাণু নষ্ট করে। আর সেই জন্যেই মাছ-মাংস বা বাটা মসলায় নুন মিশিয়ে রাখলে তা সহজে নষ্ট হয় না। নুন জীবাণু নষ্ট করে। বলে গরম পানিতে সামান্য নুন মিশিয়ে গড়গড়া করলে গলার ব্যথা তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়।
নুনের খনি থেকে দু’রকমভাবে নুন তোলা যায়। এক হচ্ছে কয়লা খনির মতো খনির ভেতরে নেমে কেটে কেটে নুন তোলা। তফাত কেবল এই যে, কয়লা খনির ভেতরটা হল কুচ কুচে কালো, আর নুনের খনির ভেতরটা ধবধবে সাদা। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে : খনির ভেতরে লম্বা নল দিয়ে পানি ঢুকিয়ে দিলে নুন গলে যায়; তখন সেই পানিকে আবার পাম্প করে ওপরে তুলে রোদে শুকিয়ে নিলেই নুন পাওয়া গেল। এতে খনির ভেতরে আর মানুষ নামবার দরকার হয় না।
খাবার নুনের একটা বৈজ্ঞানিক নাম আছে সেটা হল সোডিয়াম ক্লোরাইড। অর্থাৎ সোডিয়াম ধাতুর একটা পরমাণু আর ক্লোরিন গ্যাসের একটা পরমাণু (এ দুটোর একটাও কিন্তু মানুষের খাবার নয়) হাত ধরাধরি করে হয় একটা নুনের অণু। সোডিয়ামের ল্যাটিন নাম ন্যাট্রিয়াম; সাংকেতিক চিহ্ন Na। আর ক্লোরিনের সাংকেতিক চিহ্ন Cl। তাই বিজ্ঞানীরা সোডিয়াম ক্লোরাইডকে সংক্ষেপ করে লেখেন NaCl। কথাটা শিখে রাখো, সময়মতো বন্ধুবান্ধব ভাই-বোনকে শুনিয়ে অবাক করে দিতে পারবে।