চিনি শুধু মিষ্টি নয়
সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে শীতের কাঁচা রোদ্দুরে বসে চাই এক পেয়ালা গরম গরম চা। তার সঙ্গে যদি পিঠে কিংবা এই জাতীয় কিছু টা-ও থাকে তাহলে তো ব্যস! ছেলে-বুড়োর আর কোন কথা নেই! সত্যি বলতে কি, আমরা যেন দিন দিন বেশ চা-প্রিয় হয়ে উঠছি। চা খাওয়া যার অভ্যেস সকালে ঠিকমতো চা না পেলে তার মেজাজটাই কেমন যেন খিঁচড়ে যায়।
আর চায়ের আসরে চিনি না হলে যে চলে না এতো জানা কথাই কিন্তু শুধু কি চায়ের আসরে? চিনি দিয়ে যেসব জিনিস তৈরি হয় তার দু-চারটের নাম করলেই হয়তো আর জিভের পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। যেমন ধর সন্দেশ, রসগোল্লা, পান্তুয়া, আইসক্রীম, লজেষ্ণুস, চকোলেট, কেক, জেলি–মোরব্বা আর কতো নাম করব।
কিন্তু চিনি এমন সুখাদ্য হলেও তার দাম অনেক; আবার সব জায়গায় সব সময় পাওয়াও যায় না। তখন চিনির কাজ গুড় দিয়ে চালাতে হয়। লোভনীয়তার চিনি শুধু মিষ্টি নয় দিক দিয়ে পাটালি গুড় চিনির চেয়ে কিছু কম যায় না; কোন কোন জায়গার পাটালি গুড় তো স্বাদে-গন্ধে চিনিকে টেক্কা দিতে পারে।
আসলে চিনির গোড়াপত্তন তো গুড় থেকেই! যেসব গাছ বা ফলের রস মিষ্টি–যেমন আখ, খেজুর, আঙ্গুরতার রস জ্বাল দিয়ে সঙ্গে চুনের পানি এবং আরো কয়েকটা জিনিস মিশিয়ে ময়লাটা কাটিয়ে ফেললেই তৈরি হয় পরিষ্কার চিনি। চিনির কলে অনেক সময় হাড়ের কয়লার ভেতর দিয়ে রসকে চালিয়ে দিয়েও চিনি পরিষ্কার করা হয়।
এই উপমহাদেশে আখের গুড়ের চল হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে সেই আর্যদের সময়ে। গোড়াতে আখের চাষ হত কেবল বাংলাদেশে, তারপর ক্রমে তা সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আজ থেকে তেইশ শো বছর আগে আলেকজাণ্ডারের অভিযানের এক বর্ণনায় দেখা যায় সেকালে সিন্ধু নদ অঞ্চলে এক রকম ‘মধুঝরা নলখাগড়া জন্মাত। বলা বাহুল্য এখানে আখের কথাই বলা হয়েছে।
সাদা চিনির আবিষ্কার হয় প্রথমে চিন দেশে; সেখান থেকেই এর নাম হয়েছে ‘চি-নি’। চীন দেশ থেকে চিনি আমাদের দেশে আসে, তারপর ক্রমে ক্রমে আরব আর মিসরে। মিসর দেশে চিনির আর একটু রকমফের হয়, চিনি থেকে তৈরি হয় মিসরি; এই মিসরি কথাটাও এসেছে মিসর দেশের নাম থেকে। আরব আর মিসর দেশের কাছ থেকে ক্রমে ক্রমে ভূমধ্যসাগরের ধারে ধারে ইউরোপের দেশগুলোতেও আখের চাষ ছড়িয়ে পড়ে।
আজ থেকে উনিশ শো বছর আগে রোম সম্রাট নিরোর সময়কার একজন বৈদ্য লিখেছেন, “ভারতের আখ থেকে এক ধরনের শক্ত মধু পাওয়া যায়। এগুলো নুনের মতো দানাদার আর দাঁতের নিচে গুড়ো হয়ে যায়, কিন্তু স্বাদ মধুর মতোই মিষ্টি।” সেকালে মধু আর চিনি এই দুটো জিনিসই ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
মধ্যযুগে উইরোপে বহুদিন পর্যন্ত আখের চাষ হতো শুধু স্পেনে। স্পেন দেশের লোকেরা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিয়ে সেখানে দাস-শ্রমিকদের দিয়ে আখের চাষ শুরু করে। তারপর এই আখের চাষ আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে যায়। আজকালও প্রশান্ত মহাসাগরের ফিজি প্রভৃতি কতকগুলো দ্বীপের লোকদের বিশ্বাস, আদি মানুষের জন্ম হয়েছিল আখের গাছ থেকেই। তারা বলে : সৃষ্টির প্রথমে একটা আখের গাছ থেকে দুটো ডাল বেরোয়; তারপর এই ডাল দুটো ফেটে গিয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসে একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে।
আখের চিনি আজকাল সব চাইতে বেশি চলে; তা’ বলে আখের চিনিই একমাত্র চিনি নয়। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ফরাসি দেশে বীট নামে এক রকম মূলা জাতীয় গাছের শেকড় থেকে চিনি তৈরি করা শুরু হয়-তাকে বলে বীট চিনি। তাছাড়া কানাডায় মেপল নামে এক রকম গাছের রস থেকেও চিনি তৈরি হয়।
বলছিলাম, চিনি থেকে কত রকমের মজাদার জিনিস তৈরি হয় আর তা আমাদের কাছে খু-উ-ব ভাল লাগে। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছ মিষ্টি জিনিস আমাদের এত ভাল লাগে কেন?
তার জবাবে বলতে হয় মিষ্টি আমাদের শরীরের জন্যে নেহাত দরকারি, তাই। আমরা যে এত রকমের খাবার-দাবার খাই তার আসল কারণ তো হল শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখা, আর তার পুষ্টি হওয়া। আমাদের শরীরটা দিন রাত খাটছে ইঞ্জিনের মতো। আর যে কোন ইঞ্জিন চলবার জন্যেই জ্বালানি দরকার, তাপের দরকার। এই তাপের বড় অংশটা আসে আমাদের খাবার-দাবারের চিনির ভাগ থেকে।
আমাদের শরীরের জন্যে দরকারি কতটা তাপ কোন খাবার থেকে তৈরি হয় তা মাপা হয় ক্যালরির হিসাবে। এই হিসাব মতো অন্যান্য ভাল খাবারের তুলনায় চিনি শুধু মিষ্টি নয় চিনির ক্যালরির পরিমাণ কত বেশি সেটা দেখলেই বোঝা যাবে চিনি কেন এত দরকারি জিনিস। এক কেজি গোল আলুতে যেখানে আছে ৯০০ ক্যালরি, আর মুরগির মাংসে ১১০০ ক্যালরি, সেখানে এক কেজি চিনিতে কত ক্যালরি আছে, শুনবে? প্রায় ৩৯০০ ক্যালরি। চাট্টিখানি কথা নয়।
এ-থেকে আরো বোঝা যায়, ছোট ছেলেমেয়ে যারা ছুটোছুটি করে বেড়ায় তাদের শরীরে চিনির দরকার সব চাইতে বেশি। দুঃখের কথা হল, এই সোজা ব্যাপারটা বড়রা সব সময় বুঝতে পারেন না!
চিনি মানুষের শরীরে শক্তি যোগায়। অনেক দূরের পথ হেঁটে একজন যদি খুব হয়রান পেরেশান হয়ে আসে, তাহলে তাকে এক গ্লাস চিনির শরবত দেবার নিয়ম; সঙ্গে সঙ্গে হয়রানি দূর হয়ে গিয়ে সে চাঙ্গা হয়ে ওঠবে।
কিন্তু শুধু খাওয়ার জন্যেই নয়। চিনির আজকাল নিত্য নতুন ব্যবহার বেরুচ্ছে। সব এক সঙ্গে করে বলা যায়, খাওয়া ছাড়াও মানুষ আজ চিনিকে প্রায় তিন হাজার রকম উপায়ে ব্যবহার করছে। তার মধ্যে ধর একটা হচ্ছে কাঁচা চামড়া ট্যান করতে। যে ওষুধ দিয়ে চামড়া পাকা করতে হয় তার সাথে একটুখানি চিনি মিশিয়ে দিলে চামড়া নাকি অনেক ভাল ট্যান হয়। কাঁচের শিল্পে কাঁচ থেকে কলাই করে আয়না তৈরি করতেও আজকাল যথেষ্ট পরিমাণে চিনি ব্যবহার করা হচ্ছে।
চিনির সাহায্যে প্লাস্টিককে করা হচ্ছে মজবুত আর কম ভঙ্গুর। অ্যান্টিসেপটিক ওষুধ, বিষ, কৃত্রিম রবার, কাগজ, রঙ, বিস্ফোরক দ্রব্য পেনিসিলিন, প্রসাধনী এ সব জিনিস তৈরিতেও চিনির ব্যবহার আছে। এমন কি আখের ছোবড়াও বাদ যায় নি; নানা রকম রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে ছোবড়া থেকে তৈরি হচ্ছে দামী নাইলন।
তাছাড়া আরো ব্যাপার রয়েছে। যে সব জিনিস টক তাদের এক কথায় অ্যাসিড বা অম্ল বলা যেতে পারে। রসায়নশাস্ত্রে এই অ্যাসিড না হলে এক মুহূর্ত চলে না, এমনি দরকারি জিনিস এটা। তার মধ্যে ল্যাকটিক অ্যাসিড বলে এক রকমের অ্যাসিড গোড়াতে তৈরি করা হত দুধ থেকে; এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, খালি দুধ থেকে নয়, ওই ল্যাকটিক অ্যাসিড চিনি থেকেও তৈরি করা যেতে পারে।
এমনি আর একটা অম্ল সাইট্রিক অ্যাসিড; আগে পাওয়া যেত শুধু টক লেবুজাতীয় ফল থেকে। এখন এটাও চিনি থেকে তৈরি করবার উপায় বেরিয়েছে।
এতদিন লোকে ভাবতো, মিষ্টি খেলে বাচ্চাদের দাঁত খারাপ হয়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। অন্তত তোমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, বেশি মিষ্টি খেলেই যে দাঁত বেশি ক্ষয় হবে এমন কোন কথা নেই। সেটা অনেকখানি নির্ভর করে খাদ্যের সাধারণ পুষ্টির ওপর; আর মিষ্টি খেয়ে দাঁত পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা তার ওপর।
ডাক্তারি শাস্ত্রে ও চিনির অনেক ব্যবহার রয়েছে। বেশি রক্তপাতের ফলে রোগীর অবস্থা সঙ্গিন হয়ে দাঁড়ালে তার শরীরে বাইরে থেকে ইঞ্জেকশন করে রক্ত দিতে হয়, তা বোধ হয়, তোমরা জানো। সুস্থ মানুষের রক্ত নিয়ে তার সারাংশ–প্লজমা বা রক্তরস বোতলে পুরে হাসপাতালে জমিয়ে রাখা হয়। এই রক্তরস খুব তাড়াতাড়ি জমাট বেঁধে যায়, আর তা হলেই জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেল। একে সংরক্ষণ করবার জন্যে চিনি ব্যবহার করা হয়।
তাহলেই এখন বোঝ, চিনি যে শুধু খাবার জন্যেই দরকার তা নয়। অন্যান্য যে সব কাজে আজকাল চিনির ব্যবহার হচ্ছে দরকারের দিক দিয়ে সেগুলোও কিছু কম যায় না।
প্রায় সব গাছপালাই চিনি তৈরি করে কোন গাছ বেশি, কোনটা বা কম। গাছের সবুজ পাতা সূর্যের আলো থেকে নেয় শক্তি, মাটি থেকে নেয় পানি, আর হাওয়া থেকে নেয় কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস। তারপর এক আশ্চর্য রাসায়নিক উপায়ে এসবের সাহায্যে তৈরি করে চিনি আর অক্সিজেন। এই গাছ থেকেই মানুষ বের করে নেয় তার দরকারি চিনি।
সব চেয়ে সুখের কথা হল, বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে যত রকমের গাছপালা আছে তার চার ভাগের তিন ভাগ থেকেই চিনি সগ্রহ করা যায় তাহলে আমরা অন্তত এটুকু আশা অনায়াসেই করতে পারি যে, দুনিয়ার বুকে চিনির মতো একটা অতি উপাদেয় জিনিসের অভাব কোনদিনই হবে না। কি বল তোমরা?