যুবরাজ আমল

২. যুবরাজ আমল

ভারতবর্ষীয় যুবরাজের শৈশব

আশা করা যায়, তার শুভাগমন এই শ্বাশত রাজবংশের জন্য সৌভাগ্যময় আর শুভ প্রমাণিত হবে ।
–নাতি আওরঙ্গজেবের জন্মের পর জাহাঙ্গীরের শুভেচ্ছা

দাদা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে গুজরাতের দোহাদে ১৬১৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আওরঙ্গজেব। এর কয়েক সপ্তাহ পর আওরঙ্গজেবের বাবা যুবরাজ খুররম (পরে শাহ জাহান নামে পরিচিত) জন্ম-উৎসবের আয়োজন করেন। এ সময় তিনি সদ্য জন্ম নেওয়া তার ছেলেকে গর্বের সাথে প্রদর্শন করেন, রাজকোষাগারে বিপুল পরিমাণে মণি-মানিক্য ও কয়েক ডজন হাতি পাঠিয়ে দেন। তবে এ ধরনের সুপ্রশন্ন সূচনা সত্ত্বেও বাবার আনুকূল্য নিশ্চিত করাটা আওরঙ্গজেবের জন্য সহজ হয়নি।

আওরঙ্গজেব ছিলেন শাহ জাহানের তৃতীয় ছেলে। তার বড় দুই ভাই হলেন দারা শুকোহ ও শাহ সুজা। এক বছর পর শাহ জাহানের চতুর্থ ছেলে মুরাদের জন্ম হয়। চারজনই ছিলেন আপন ভাই, শাহ জাহানের প্রিয় স্ত্রী মোমতাজের ছেলে। অন্য ভাইদের মতো আওরঙ্গজেবও নানা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যে পরিব্যপ্ত রাজকীয় শিক্ষালাভ করেন ।

পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আওরঙ্গজেব কোরআন ও হাদিস, ধর্মীয় জীবনীসহ ইসলামি ধর্মীয় পুস্তকাদি অধ্যায়ন করেন। তিনি তুর্কি সাহিত্যও পাঠ করেন, ক্যালিগ্রাফির শিল্প-সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। মোগলদের রাজকীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ফারসি ক্লাসিক, বিশেষ করে সাদি, নাসিরউদ্দিন তুসি ও হাফিজের মতো বর্তমানেও অত্যন্ত প্রিয় মহান কবি ও পণ্ডিতদের রচনাবলী বেশ গুরুত্ব পেত। গুঞ্জন রয়েছে যে আওরঙ্গজেবের বিশেষ প্রিয় গ্রন্থ ছিল রুমির মসনবি। এসব ফারসি সাহিত্য মোগল রাজপুরুষদের নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে দিত, বিশেষ করে ন্যায়বিচার, আদব, আখলাক ও রাজত্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা বিকশিত করত ।

আওরঙ্গজেবকে সম্ভবত মহাভারত ও রামায়ণের মতো সংস্কৃতি গ্রন্থরাজির ফারসি অনুবাদের সাথেও ভালোভাবে পরিচিত করানো হয়েছিল। এসব অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের দাদার বাবা আকবর। আমরা জানি যে আকবর তার এক ছেলের কাছে রাজকীয় শিক্ষার জন্য মহাভারত উপকারী বলে সুপারিশ করেছিলেন। শৈশব থেকেই আওরঙ্গজেব অনর্গল হিন্দি বলতে পারতেন। মোগল পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে তিনি এই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি হিন্দি সাহিত্যবিষয়ক নিবন্ধগ্রন্থে দক্ষ ছিলেন, তা ছিল সম্ভবত তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণেরই অংশবিশেষ। এমনকি প্রাক-আধুনিক হিন্দির সাহিত্যিক বাহন ব্রজ ভাষায় তিনি মৌলিক রচনাও করেছেন বলে বলা হয়ে থাকে। মোগল রাজকীয় পাঠ্যক্রমে তরবারি, ছোরা, গাদা বন্দুক, সামরিক কৌশল ও প্রশাসনিক দক্ষতার মতো বাস্তব অনুশীলনও অন্তর্ভুক্ত ছিল ।

শিক্ষার বাইরে মোগল রাজপুরুষের শৈশবের অনুষঙ্গ ছিল ভাইদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আওরঙ্গজেবের বেড়ে ওঠাও ব্যতিক্রম ছিল না।

অল্প বয়স থেকেই শাহ জাহানের চার ছেলে মোগল সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিলেন। মোগলরা মধ্য এশিয়ার উত্তরাধিকার প্রথা অনুসরণ করত। এই প্রথায় পরিবারের সব পুরুষ সদস্যই রাজনৈতিক ক্ষমতা দাবি করতে পারত, বয়স এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতো। আকবর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমিয়ে আনেন বৈধ উত্তরাধিকারের তালিকা কেবল ছেলেদের মধ্যে আবদ্ধ রেখে (এর ফলে ভাতিজা ও ছেলে কাজিনরা বাদ পড়ে যায়)। প্রথম সন্তানই উত্তরাধিকারী হবে, এমন আইন না থাকায় শাহ জাহানের দীপ্তিময় ময়ুর সিংহাসন একদিন আওরঙ্গজেবের অধিকারে আসতেই পারে, যদি তিনি তার দাবিদার ভাইদের পেছনে ফেলে দিতে পারেন। অবশ্য শৈশবেই ভাইদের থেকে আওরঙ্গজেব যে আলাদা তা প্রমাণ করার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন খুবই সামান্য ।

শাহ জাহান প্রকাশ্যে তার বড় ছেলের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দারা শুকোহর প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠানটি মোগল ইতিহাসের অন্য সব আয়োজন ছাপিয়ে যায়। এতে খরচ হয়েছিল ৩২ লাখ রুপি। আর কোনো বিয়েতে এত অর্থ ব্যয় হয়নি। ১৬৩৩ সালে রাজপরিবার এত জৌলুসময় আয়োজন করেছিল, যা আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে। ইউরোপিয়ান পর্যবেক্ষক পিটার মান্ডের মতে, সম্ভ্রম-জাগানিয়া আতশবাজির প্রদর্শন আগ্রার আকাশে আধা মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। শাহ জাহানের শাসনকাল সম্পর্কে সরকারি কার্যবিবরণী পাদশাহনামায় ওই বিবাহ অনুষ্ঠানের চিত্র শোভিত হয়ে আছে। গ্রন্থটি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে ইংল্যান্ডের উইন্ডসর ক্যাসলে। স্পন্দমান দৃশ্যাবলীতে রাজকীয় সঙ্গীতজ্ঞ, উপহারবাহক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়া বিশাল জনস্রোতকে বর্ণাঢ্য সাজে শাহ জাহানের প্রিয় ছেলের সম্মানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় আওরঙ্গজেবের বয়স ছিল ১৪ বছর। অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন বলেই জানা যায়। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে পাদশাহনামায় যেসব ছবি রয়েছে, তাতে স্থান পাওয়ার মতো উপযুক্ত বিবেচিত হননি তিনি ।

দারা শুকোহর বিয়ের কয়েক মাস পর আওরঙ্গজেব তার বাবার নজরে পড়ার একটি বিরল সুযোগ লাভ করেন। রাজকীয় প্রিয় বিনোদন হাতির লড়াইয়ের আয়োজন করতে বলেছিলেন শাহ জাহান। সুধাকর ও সুরত সুন্দর (মোগল হাতিদের নাম প্রায়ই হিন্দিতে রাখা হতো) মুখোমুখি হলো। খুব কাছ থেকে লড়াই দেখার জন্য বাদশাহ ও তার তিন বড় ছেলে লড়াই ঘোড়ার পিঠে কাছাকাছিই অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করেই সুধাকর পাশবিক রোষে আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করে বসে। আওরঙ্গজেব হাতির মাথায় বর্শা বিদ্ধ করেন। এতে হাতিটি আরো ক্ষেপে যায়। সুধাকর তখন আওরঙ্গজেবের ঘোড়াটিতে কাবু করে, ফলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। অন্যরা সাহায্য করার চেষ্টা করেন। সুজা ও রাজা জয় সিং (যথাক্রমে আওরঙ্গজেবের ভাই ও প্রখ্যাত রাজপুত) অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসেন, আতশবাজি নিক্ষেপ করে হাতিকে লক্ষ্যচ্যুত করার চেষ্টা করে প্রহরীরা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কেবল সুরত সুন্দরই আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে সুধাকরকে ফিরিয়ে আবার লড়াইয়ে মত্ত করতে সক্ষম হয় ।

উল্লেখ্য, এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে দারা শুকোহকে কোথাও দেখা যায়নি। এই ঘটনার লিখিত বিবরণে তার ভূমিকার কোনো কথা নেই, আর টিকে থাকা ছবিতে দারাকে পেছনে ওঁত পেতে থাকতে দেখা যায়, তিনি তখন ক্ষতি ও গৌরব উভয় থেকেই নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন।

ফারসি কবিতার মাধ্যমে আওরঙ্গজেবের সাহসিকতা স্মরণীয় করে রেখেছেন শাহ জাহানের রাজকবি আবু তালেব কালিম। তিনি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে আওরঙ্গজেবের বর্শা বিদ্যুৎ গতিতে সুধাকরের মাথায় আঘাত করেছিলেন। তারপর যুবরাজের বর্শার আঘাতে হাতির মনকে বিষিয়ে পাগল করে দিলো।’ আওরঙ্গজেবের সাহসিকতার প্রশংসা করেন শাহ জাহান, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি তার নিজের ছবি দেখেছিলেন তার ছেলের মধ্যে। শাহ জাহানের দরবারি ইতিহাস লেখকেরা একমত হয়ে আওরঙ্গজেবের ভয়হীন এই কৃতিত্বের সাথে ১৬১০ সালে শাহ জাহানের সাথে ক্রুদ্ধ এক সিংহের মোকাবিলার তুলনা করেন। ওই ঘটনা দেখেছিলেন শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর।

কয়েক বছর পর সাম্রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য আওরঙ্গজেবকে দরবার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন শাহ জাহান। তখন আওরঙ্গজেবের বয়স মাত্র ১৬ বছর। ১৬৩৫ থেকে ১৬৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্য চষে বেড়ান; বলখ, বুন্দেলখন্ড ও কান্দাহারে লড়াই করেন; গুজরাত, মুলতান ও দাক্ষিণাত্য পরিচালনা করেন ।

যুবরাজ এসবের মধ্যেও উপভোগের জন্য সময় বের করে নিতেন, হিরাবাই জৈনাবাদির সাথে ঝড়ো রোমান্সে মেতে ওঠার সময়ও বের করে নিয়েছিলেন। ১৬৫৩ সালে আওরঙ্গজেব বুরহানপুরে তার মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গাছ থেকে আম পাড়ার খেলায় মত্ত হিরাবাইকে দেখে তার প্রেমে বিভোর হয়ে পড়েন। মেয়েটি ছিলেন গায়িকা ও নর্তকী। দুজনে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন । গুঞ্জন রয়েছে যে আওরঙ্গজেব এই তরুণীর এতটাই অনুগত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি এমনকি সারা জীবনের জন্য মদ্যপান না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (প্রথম ফোঁটা মদ আওরঙ্গজেবের ঠোঁট দিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন)। কিন্তু হায়, হিরাবাই এক বছরের কম সময়ের মধ্যে মারা যান, তাকে আওরঙ্গাবাদে সমাহিত করা হয়। এ ধরনের চমকপ্রদ মুহূর্ত সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব তার প্রাপ্তবয়স্ক রাজপুরুষালী আমলে রাষ্ট্রীয় কাজেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন।

রাজপরিবার থেকে আওরঙ্গজেবের দূরে থাকাও তাকে তার বাবার হৃদয়কে স্নেহসিক্ত করতে পারেনি। তিনি তার ২২ বছরের এই সময়কালে খুব কমই রাজদরবারে এসেছেন। বিশেষ বিশেষ ঘটনায়, যেমন ১৬৩৭ সালে তার প্রথম বিয়ের সময় এসেছিলেন। প্রশাসনিক ও সামরিক অভিযান- উভয় দিক থেকেই নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে প্রায়ই দিল্লির সিদ্ধান্তে হতাশ হতেন। দৃশ্যত তার সাফল্য ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এমনটা করা হতো। উদহারণ হিসেবে ১৬৫০-এর দশকের ঘটনা বলা যায়। দাক্ষিণাত্যে তার কয়েকটি প্রায় জয়ের মুহূর্তে তাকে বাধ্য করা হয় প্রত্যাহারের জন্য। দারা শুকোহর তাগিদে এই আদেশ জারি করেছিলেন শাহ জাহান ।

আওরঙ্গজেব তার ২০ ও ৩০-এর কোঠার বয়সকালে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করছিলেন, প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছিলেন, দুর্ধর্ষ খ্যাতি অর্জন করছিলেন, তখন দারা শুকোহ রাজদরবারে আয়েসী জীবনযাপন করছিলেন। শাহ জাহানের বড় ছেলে পরিচিত ছিলেন দার্শনিক আগ্রহের জন্য, হিন্দু ও মুসলিম সাধু-সন্ন্যাসীদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় দিন কাটাত তার। কাগজে-কলমে দারা সবসময়ই আওরঙ্গজেবের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বড় ভাই মোগল মনসব ব্যবস্থায় (এতে রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন) ছিলেন উচ্চতর পদবির অধিকারী। শাহ জাহান তাকেই সিংহাসনে আসীন দেখতে চান বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতো। কিন্তু দারা কেন্দ্রীয় রাজদরবারের অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে থাকা প্রকৃত দুনিয়ার অভিজ্ঞতার অভাবে ছিলেন। আর এটিই পরে মারাত্মক অসুবিধা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল ।

লোকরঞ্জক স্মৃতিতে প্রায়ই দারা শুকোহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়, ভারতীয় ইতিহাসের বড় ‘কী হতো যদি’ বিবেচনা করা হয় তাকে। ‘ধর্মান্ধ’ আওরঙ্গজেবের বদলে ষষ্ট মোগল বাদশাহ যদি হতেন ‘উদার’ দারা, তবে কী হতো? ইতিহাস কি ভিন্ন দিকে মোড় নিত? সাম্প্রতিক সময়েও অনেকে শহিদ নাদিমের দারা নাটকে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, বাদশাহ হলে কি দারা ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষের নৃশংস বিভক্তি অনেক আগেই নাকচ করতে পারতেন? অযাচিত নস্টালজিয়া সরিয়ে রাখা রেখে বলা যায়, বাস্তবতা হলো এই যে জয়ী হতে বা মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না দারার। হিন্দুস্তানের মুকুটের জন্য চার ভাইয়ের মধ্যকার অনিবার্য মোকাবিলায় দারার অসুস্থ বাদশাহকে সাথে রাখাটা আওরঙ্গজেবের জোট, কৌশলগত দক্ষতা, 3 মোগল সাম্রাজ্য কয়েক দশক ধরে ঘুরে ঘুরে যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অর্জন করেছিলেন, তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো ছিল না ।

বিশ্ব জয় করলেন আওরঙ্গজেব

ইয়া তখত ইয়া তাঁবুত
হয় সিংহাসন নয়তো কবর
–মোগল রাজত্বের একটি মন্ত্র

শাহ জাহান ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে জেগে মারাত্মক অসুস্থতা বোধ করলেন, প্রাসাদের বারান্দায় প্রজাদের সামনে হাজির হওয়ার দৈনন্দিন কাজটিও করতে পারলেন না। তিনি ওই দিনের দরবারও বাতিল করে দিলেন। শাহ জাহান এক সপ্তাহেরও বেশি সময় জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হতে পারলেন না। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। বাদশাহর অসুস্থ হওয়ার খবর তীব্র বেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। দোকানদারেরা আতঙ্কিত হলো, লুটপাট বেড়ে গেল। শাহ জাহানের চার ছেলে মনে করলেন, তাদের বাবা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। ফলে তারা ক্ষমতার এই শূন্যতার সুযোগ গ্রহণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। প্রচলিত মোগল প্রথা অনুযায়ী, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে যিনি জয়ী হবেন, তিনিই হবেন হিন্দুস্তানের পরবর্তী সম্রাট ।

সঙ্ঘাত বন্ধ হতে লাগল প্রায় দুই বছর এবং আওরঙ্গজেব অবিসংবাদিত বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সিংহাসনে উত্তরণের পরিক্রমায় আওরঙ্গজেব তার তিন ভাই- দারা শুকোহ, শাহ সুজা ও মুরাদ- ও বাবা শাহ জাহানকে পরাভূত করেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকের শেষ দিকে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার প্রক্রিয়ায় আওরঙ্গজেব তার দুই ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন, আরেকজনকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন, বাবাকে (তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন) আটকিয়ে রাখেন আগ্রার লাল কেল্লায়। অবিভক্ত মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য একমাত্র আওরঙ্গজেবই এই সহিংসতা থেকে অক্ষতভাবে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন!

ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা মোগল রাজপরিবারকে নিমজ্জিত করা নৃশংস, রক্তাক্ত উত্তরাধিকার লড়াইয়ে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কয়েক দশক পর মোগল ভারত সফরকারী ইতালির জেমেলি ক্যারেরি পারিবারিক দ্বন্দ্বকে ‘অপ্রাকৃতিক যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে সুরাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চ্যাপলিন জন অভিংটন ‘এ ধরনের বর্বর আত্মদানের’ নিন্দা করেছেন, বিষয়টিকে ‘অমানবিক’ হিসেবে অভিহিত করে সমাপ্তি টেনেছেন। ফ্রান্সিস বার্নিয়ার ও নিকোলাও মানুচির মতো অন্যান্য ইউরোপিয়ান পর্যটন লেখক এসব ঘটনা নিয়ে জালিয়াতপূর্ণ ও বিভীষিকাময় দমবন্ধ করা বক্তব্য দিয়েছেন, চার ভাইয়ের, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের ‘আধিপত্য বিস্তারের লোলুপতা’ নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরাও এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তবে তারা ঘটনায় অনেক কম আশ্চর্য হয়েছেন, অন্তত শুরুতে এর নির্মমতা সম্পর্কে কম সরব ছিলেন।

মোগল রাজকীয় ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই সুস্পষ্টভাবে ফরাসি বাক্য ইয়া তকত ইয়া তাঁবুত (হয় সিংহাসন নয়তো কবর) নীতিতে পরিচালিত হতো। শাহ জাহান তার দুই ভাইকে (১৬২২ সালে খসরু ও ১৬২৮ সালে শাহরিয়ার) খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি দুই ভাতিজা ও দুই কাজিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ১৬২৮ সালে সিংহাসন দখল করার পর। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সাক্ষী দিচ্ছে যে শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর দায়ী ছিলেন জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই দানিয়েলের মৃত্যুর জন্য। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে দানিয়েল মারা গিয়েছিলেন বিষাক্ত মদ পানে। এমনকি বাবর ও হুমায়ূনের মতো মোগল শাসনের প্রাথমিক যুগেও ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, বাবার বিরুদ্ধে ছেলের সহিংস সঙ্ঘাত দেখা গেছে।

অবশ্য আওরঙ্গজেব ও তার ভাইদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে লড়াই প্রত্যাশিত থাকলেও সময় বা সঙ্ঘাতের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

শাহ জাহান ১৬৫৭ সালে ছিলেন ৬৫ বছর বয়স্ক। তখনই তার আগের অন্য চার মোগল সম্রাটের চেয়ে তিনি অনেক বেশি দিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার অসুস্থতা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। কী কারণে শাহ জাহান মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকেরা একমত নন। ইতালির ভ্রমণকারী নিকোলি মানুচি তার বিশেষ রংচং মাখানো কায়দায় দাবি করেছেন যে অসংবৃত এই শাসক অতিরিক্ত মাত্রায় যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন। মানুচির স্বদেশী ক্যারেরিও উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে অসম্ভব আবেগের বশবতী শাহ জাহান একজন বুড়ো মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি যৌনতায় মজে গিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে তার অসুস্থতার মূল কারণ হতে পারে মুত্রথলি বা আন্ত্রিক কোনো রোগ। যে কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে থাকুন না কেন, এর ফলেই উত্তরাধিকার লড়াই শুরু হয়েছিল, তবে চার যুবরাজের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ভিত্তি আরো অনেক আগেই প্রস্তুত হয়েছিল।

আওরঙ্গজেব ১৬৫০-এর দশকের প্রথম দিকে দারা শুকোহর বিরোধিতার লক্ষ্যে শাহ সুজা ও মুরাদের সাথে গোপন মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন ছোট ভাই জানতেন যে তাদের বাবা তার বড় ছেলেকেই পছন্দ করছেন এবং দারাও হয়তো একই সময় তার ভাইদের খুন করার নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করছিলেন। সেই ১৬৫২ সালের দিকেও সমসাময়িক একটি ফরাসি ভাষ্যে দারাকে ‘তার ভাইদের রক্ত পান করতে তৃষ্ণার্ত নেকড়ে’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে বলা হয়ে থাকে, শাহ জাহানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব আবারো দারার খুনে প্রবৃত্তির কথা বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের নির্দোষ রক্ত নিতে তার ব্যগ্রতার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়, ভ্রাতৃহত্যার কাজটি করেছিলেন আওরঙ্গজেবই ।

শাহ জাহানের অসুস্থতার সময় দিল্লির দরবারে উপস্থিতি ছিলেন একমাত্র দারা শুকোহ। তার ভাইয়েরা তখন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ন্ত্ৰণ করছিলেন। পূর্বে শাহ সুজা নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলা, পশ্চিমে মুরাদ পরিচালনা করতেন গুজরাত, আর দক্ষিণে আওরঙ্গজেব নিয়োজিত ছিলেন দাক্ষিণাত্যে। ভাইদের কাছে সংবাদপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় দারা চরদের আটকিয়ে ও রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর শুনেই তিন ছোট ভাই দারার ক্ষমতা গ্রহণ, তাদের খুন করার ষড়যন্ত্র ও তাদের বাবাকে বন্দী করা নিয়ে গুজব দিয়ে তাদের কান ভারী করে ফেললেন । চার মাত্রিক প্রতিযোগিতা দানা বেঁধে ওঠার প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যের অভিজাতেরাও পক্ষাবলম্বন করেন। শাহ সুজা ও মুরাদ ছিলেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, উভয়ের হাতে ছিল বিপুল সমর্থন। তবে মূল প্রতিযোগিতা হয়েছিল দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে। বেশির ভাগ মোগল অভিজাত এই দুজনের কোনো একজনকে সমর্থন করতেন। রাজপরিবারের নারীরাও মোগল উত্তরাধিকার লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শাহ জাহানের তিন মেয়ে তাদের প্রিয়জনকে সিংহাসনের বসানোর জন্য বাছাই করে নেন। বড় মেয়ে জাহানারা সমর্থন করতেন দারা শুকোহকে, মেজ মেয়ে রোশানারা সমর্থন করতেন আওরঙ্গজেবকে। আর সবার ছোট মেয়ে গৌহারারা ছিলেন মুরাদের পক্ষে। দারার বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুরাদের সাথে শিথিল মিত্রতায় আবদ্ধ হন আওরঙ্গজেব ।

বাবার মৃত্যু নিয়ে ভুল খবর বিশ্বাস করে ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বরে মুরাদ নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন, গুজরাতে অভিষেক অনুষ্ঠানও আয়োজন করলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে আগেভাগে মুরাদের নিজেকে সম্রাট ঘোষণার চেয়েও বেশি হুমকিপূর্ণ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য গুজরাতে মুরাদের শক্তিশালী অবস্থান ও তার হাতে থাকা বিপুলসংখ্যক সৈন্য । ছোট ভাইকে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে গুজরাত থেকে বের করার জন্য আওরঙ্গজেব তাকে প্রতিশ্রুতি দেন (তিনি সম্ভবত এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার কোনো ইচ্ছা তিনি পোষণ করেননি) : আওরঙ্গজেব ওয়াদা করেন যে দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে পরাজিত করার পর তিনি মোগল সাম্রাজ্যের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ মুরাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেবেন। ইতিহাসবিদ ঈশ্বরদাস জানান যে আওরঙ্গজেব এমনকি তার ভাইকে একটি ফরাসি প্রবাদবাক্যের উদ্ধৃতিও দেন : দুই হৃদয় একসাথে হলে চিড়ে যায় পর্বত।’ এই কপটতায় কাজ হয়। গুজরাত থেকে বের হয়ে আসেন মুরাদ। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সাথে তার বাহিনী মিলে ১৬৫৮ সালের এপ্রিলে উজ্জায়িনির কাছে ধারমতে রাজকীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। দুই ভাইয়ের পরবর্তী গন্তব্য ছিল দিল্লি। তখন তাদের লক্ষ্য মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র জয় করা।

আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী ১৬৫৮ সালের মে মাসের এক প্রচণ্ড উত্তপ্ত দিনে আগ্রার ঠিক পূর্ব প্রান্তে দারা শুকোহর ৫০ হাজার সদস্যের শক্তিশালী বাহিনীর মুখোমুখি হয়। সামুগড়ের লড়াই (ছবি ১) হিসেবে বর্তমানে পরিচিত এই প্রচণ্ড সঙ্ঘাতই মোগল উত্তরাধিকার সঙ্কটের ফয়সালাসূচক মুহূর্ত বিবেচিত হয়। সংঘর্ষের আগের দিন আওরঙ্গজেব তার ও মুরাদের বাহিনীকে বিশ্রামে রাখেন। আর দারার সৈন্যরা ভারী যুদ্ধসাজে প্রচণ্ড রোদে তাদের শত্রুর বাহিনীর প্রতীক্ষায় থাকে। তাদের শক্তি ক্ষয় হয়, দারার সেনাবাহিনীর অনেকে গরমেই কাবু হয়ে পড়ে, তাদের শেষ করার জন্য শত্রুর আঘাতের প্রয়োজন পড়েনি ।

পরের দিন ভোরে শুরু হলো যুদ্ধ, উভয় পক্ষই গোলন্দাজ বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ, যুদ্ধ হাতি বাহিনী ও পদাতিক বাহিনীতে সুসজ্জিত ছিল। আওরঙ্গজেব ও দারা উভয়ে নিজ নিজ হাতিতে সওয়ার হয়ে তাদের বাহিনীর শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। তাদের বাহিনী প্রবল যুদ্ধ করছিল, আঠার শতকের এক ইতিহাসবিদের ভাষায় ‘যুদ্ধের তীব্র শব্দ ওই সন্ত্রাস-জর্জরিত ময়দানের ওপরে ওঠে গিয়েছিল।’ দিনের শেষভাগে আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা দারা শুকোহকে বহনকারী যুদ্ধহাতিকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা ও রকেট নিক্ষেপ করার মতো অবস্থানে অগ্রসর হয়ে পড়ে। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় দারা হাতি থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তিনি পেছনে রেখে যান একটি বিশৃঙ্খল ও মনোবল হারা বাহিনী। এই বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয় ।  

দারা শুকোহ আগ্রায় পালিয়ে যান, সেখানে লাল কিল্লায় শাহ জাহান আয়েসে অবস্থান করছিলেন। দারা এরপর দিল্লি হয়ে লাহোরে আত্মগোপন করেন। বড় ভাই যখন বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে ছুটছেন, তখন আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রার লাল কিল্লার দিকে অগ্রসর হন। শাহ জাহান তখন সুস্থ হয়ে ওঠলেও ছিলেন নামমাত্র সম্রাট।

শাহ জাহান চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের সাথে সাক্ষাত করার। তিনি এমনকি ইউসুফ নবী ও ইয়াকুব নবীর কয়েক বছরের বিচ্ছেদের পর মিলন হওয়া নিয়ে পবিত্র কোরআনে থাকা ঘটনার উদ্ধৃতিও দেন। তিনি চাচ্ছিলেন ছেলেকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে। প্রতারিত হওয়ার শঙ্কায় আওরঙ্গজেব তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর বদলে ১৬৫৮ সালের জুনের শুরুতে তিনি ও মুরাদ আগ্রা দুর্গ অবরোধ করে এর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। শাহ জাহান ছিলেন দুর্গের ভেতরে। কয়েক দিন পর তিনি দুর্গের ফটক খুলে দিয়ে তার কোষাগার, অস্ত্রভাণ্ডার ও নিজেকে তার ছোট দুই ছেলের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। বড় মেয়ে জাহানারাকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ব্যবহার করে শেষ চাল হিসেবে শাহ জাহান সাম্রাজ্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করার একটি প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবকে। তিনি তিন ভাইকে সাম্রাজ্যের তিন অংশ এবং আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মোহাম্মদ সুলতানকে (মৃত্যু ১৬৭৬) একটি অংশ প্রদান করার প্রস্তাব করেন। শাহ জাহানের অবশিষ্ট সমর্থকদের অনেকে দ্রুততার সাথে আওরঙ্গজেবের বিজয়কে মেনে নেন। এমনকি তাদের অবরোধ সম্পন্ন করার আগেই তারা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন ।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আওরঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। মুরাদ তার সৈন্যদের বেতন বাড়িয়ে দেন, দ্রুত পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দেন, আনুগত্য বদল করার জন্য আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের অনেককে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। বড় ভাইয়ের তাগিদ সত্ত্বেও দারা শুকোহর পিছু ধাওয়ার ব্যাপারে গড়িমশি করতে থাকেন মুরাদ। তিনি এমনকি আওরঙ্গজেবের সাথে বৈঠকও এড়িয়ে যান। আওরঙ্গজেব তখন সিদ্ধান্ত নেন যে মুরাদ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছেন ।

আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ সালের গ্রীস্মে ছোট ভাইকে তার সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে প্রলুব্ধ করতে অসুস্থতার ভান করেন। খাওয়া দাওয়ার পর মুরাদ বিশ্রাম নিতে রাজি হয়ে নিরস্ত্র হন। এই কাহিনীর পরবর্তীকালের সংস্করণগুলোতে বলা হয় যে মুরাদ মদ্য পান করেন (আর আওরঙ্গজেব সংযত ছিলেন) বা মর্দনকারীদের দক্ষ হাতের কারসাজিতে আয়েসের জগতে চলে যান, তরুণ যুবরাজের চিন্তাভাবনা বিনাশ করে দেওয়া ভোগে লিপ্ত হন, তাকে গভীরভাবে অবচেতন করে ফেলা হয়। প্রতিরক্ষাহীন হওয়া মাত্র আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা মুরাদকে গ্রেফতার করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলে। ছোট ভাইয়ের ২০ হাজার সদস্যের বাহিনীকে আত্মস্ত করে নিতে বিলম্ব করেননি আওরঙ্গজেব।

হিন্দুস্তানের সম্রাট

উৎসব যখন খোদ বেহেশতের মতো সজ্জিত হয়, তখন আকাশও তাদের আসন ছেড়ে নৃত্য করে ।

-–কাফি খানের উদ্ধৃতি। আওরঙ্গজেবের প্রথম অভিষেকের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন আঠার শতকের এই ইতিহাসবিদ

মুরাদ কারারুদ্ধ, শাহ জাহান বন্দী, দারা পলাতক- এমন অবস্থায় প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যথেষ্ট বেশি সময়ই নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৮ সালের ৩১ জুলাই জ্যোতিষীদের কাছে শুভ বলে বিবেচিত দিনটিতে দিল্লির শালিমার গার্ডেন্সে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে আলমগীর (বিশ্বজয়ী) রাজকীয় পদবি গ্রহণ করেন তিনি ।

আওরঙ্গজেব মোগল প্রথা অনুসরণ করে সঙ্গীতের আয়োজন করার নির্দেশ দেন, উপহার বণ্টন করেন। তবে নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন ও জুমার নামাজে খুতবা প্রদানের রীতি অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকেন। স্বল্প পরিসরের অনুষ্ঠান হলেও এর মাধ্যমেই আওরঙ্গজেব যুগের সূচনা ঘটে। কয়েক বছর পর আঁকা প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠানের ছবিতে একইসাথে সরলতা ও উদ্দীপনার সমাবেশ দৃষ্টিগোচর হয়। ছবিতে কালো দাড়িতে তরুণ আওরঙ্গজেব হাঁটু ভাজ করে রয়েছেন। রাজদরবার সফরকারী পরবর্তীকালের লোকজন তার উঁচু নাসিকা ও জলপাই রঙের যে ত্বকের বর্ণনা দিয়েছে, এই ছবিতে তাকে তেমনই দেখা যায়। ছবিতে তিনি সোজা হয়ে বসে ছিলেন, শেষ বয়সে তার কাঁধ ঝুঁকে পড়ার যেসব চিত্র দেখা যায়, তা এতে অনুপস্থিত। ছবিতে আর মাত্র দুটি মানুষ দৃশ্যমান। এতে অনুষ্ঠানটি যে সংক্ষিপ্ত ছিল, তার ইঙ্গিত মেলে। অখণ্ড মোগল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ, মানসম্পন্ন শাসনের উচ্চাশায় আঁকা ছবিতে বেহেশতি অনুমোদনের চিহ্ন হিসেবে উপরে কালো মেঘ ভেদ করে সদ্য মুকুট পরা সম্রাটের ওপর আলোর ঝরনাধারা নেমে আসতে দেখা যায় (ছবি-২)।

প্রাথমিক অভিষেকের পর আওরঙ্গজেব তার তখনো মুক্ত থাকা দুই ভাই দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে বাগে আনার কাজ শুরু করলেন ।

আওরঙ্গজেব কয়েক মাস ধরে দারাকে অনুসরণ করে গেলেন। তাকে তিনি প্রথমে লাহোরে শনাক্ত করেন, তারপর তাকে মুলতানে তাড়িয়ে নেন, পরে আরো দক্ষিণে সিন্ধু নদ পথে এগিয়ে চলেন। ধরা পড়া এড়ানোর জন্য দারা শুকোহ তার ক্রমশ ছোট হতে থাকা বাহিনীকে দুর্গম এলাকা দিয়ে পরিচালিত করেন, কখনো বিশুদ্ধ পানির ধারা এড়িয়ে জঙ্গল কেটে সফর করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গুজরাতে তার পথচলার সমাপ্তি টানেন, তত দিনে অনেক সমর্থকই তার সাথে ছিল না। ১৬৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে দারাকে ধরার কাজটি তার অনুগত কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত করে আওরঙ্গজেব দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করেন শাহ সুজাকে সামাল দেওয়ার জন্য ।

শাহ সুজা আগের বছরটি অত্যন্ত ব্যস্ত কাটিয়েছিলেন। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে জাঁকজমকপূর্ণ আবুল ফৌজ (বিজয়ের পিতা) নাসরুদ্দিন (বিশ্বাসের রক্ষক) মোহাম্মদ তৃতীয় তৈমুর দ্বিতীয় আলেকজান্ডার শাহ সুজা বাহাদুর গাজি পদবি ধারণ করেন। তবে শাহ সুজার মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার স্বপ্ন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। ১৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (ওই বছরের মে মাসে সামুগড়ের যুদ্ধের আগে, যেখানে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী দারা শুকোহর বাহিনীকে হারিয়েছিল) শাহ সুজা যুদ্ধে নামেন দারা শুকোহর বাহিনীর বিরুদ্ধে। বেনারাসের কাছে হওয়া ওই যুদ্ধে দারার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তার ছেলে সোলায়মান শুকোহ । যুদ্ধে শাহ সুজা শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হন । এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে এত রক্ত ঝড়েছিল যে ঘাসগুলো টিউলিপ ফুলের রঙ ধারণ করেছিল। ১৬৫৮ সালের মে মাসে সুজাকে এক চিঠি লিখে আওরঙ্গজেব জানালেন, তিনি যদি সম্রাট ঘোষণা থেকে সরে আসেন, তবে তার ওপর আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসনভার ন্যস্ত করবেন। সুজা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।

আওরঙ্গজেব ও শাহ সুজা ১৬৫৯ সালের জানুয়ারিতে এলাহাবাদের উত্তর পশ্চিম দিকে খাজওয়ায় যুদ্ধে নামলেন। শেষ মুহূর্তে শাহ জাহানের সাবেক অনুগত রাজপুত যশোবন্ত সিং দল ত্যাগ করা সত্ত্বেও সুজার চেয়ে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ছিল অনেক বড়, ২:১। কিন্তু তবুও তীব্র লড়াই হয়। জানা যায়, একপর্যায়ে আওরঙ্গজেব তার হাতির পাগুলো বেঁধে ফেলার হুকুম দেন প্রাণিটির পলায়ন রোধ করার জন্য। আওরঙ্গজেবের দৃঢ়তা তার লোকদের মনোবল চাঙ্গা করে, তারা সুজার বাহিনীকে পরাজিত করে। সুজা পালিয়ে যান। পরের দেড় বছর ধরে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ক্রমাগত সুজাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে, শেষ পর্যন্ত তাকে ভারতবর্ষই ত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৬৬০ সালের মে মাসে শাহ সুজা তার পরিবার নিয়ে নৌপথে ঢাকা ছাড়েন। তারা বার্মায় যান। সেখানে তারা আরাকানের শাসকের হাতে মারা পড়েন। আরাকানের শাসক সম্ভবত আশঙ্কা করেছিলেন যে মোগল যুবরাজ অভ্যুত্থান করতে পারেন। তবে এসব ঘটনার সত্যতা ও সুজার মৃত্যু নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

এদিকে ভারতবর্ষে উত্তরাধিকার লড়াইয়ের শেষ বড় যুদ্ধটি হয় ১৬৫৯ সালের মার্চের তিন দিন। দারা ২০ হাজার লোকের একটি বাহিনী (এদের বেশির ভাগ গুজরাত থেকে সংগ্রহ করা) গঠন করে আজমিরের বাইরে পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি আশা করেছিলেন, এই বন্ধুর এলাকা, পরিখা ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর তার সৈন্য স্বল্পতা কাটাতে সহায়ক হবে। আওরঙ্গজেব গোলন্দাজ বাহিনী দিয়ে লড়াই শুরু করেন। দুদিন ধরে এই আক্রমণ শানানো হয়। ফলে পুরো এলাকা ঘন ধোয়ায় ঢেকে যায় ৷ আওরঙ্গজেবের দরবারি ইতিহাসবিদের ভাষায়, ‘বারুদের ধোয়া বজ্রসহ প্রবল মেঘের মতো যুদ্ধক্ষেত্র অন্ধকার করে ফেলে। এমনভাবে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো, ভূমি জ্বলে ওঠল যে মনে হলো পরশ পাথরের শক্তি দেখছি আমরা।’ আওরঙ্গজেব তৃতীয় দিনে দারার একটি অংশের দিকে আক্রমণ কেন্দ্ৰীভূত করলেন। রাজকীয় বাহিনীর বেশির ভাগ অংশ সামনাসামনি যুদ্ধ করলেও একটি অংশ গোপনে পেছনে চলে গিয়েছিল। তারাই যুদ্ধকে আওরঙ্গজেবের অনুকূলে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর পেছনে অবস্থান নিয়ে নিজের বাহিনীর কচুকাটা অবস্থা দেখে আবারো জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান দারা ।

তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়ালেন দারা। তারপর ভুল করে মালিক জিওয়ান নামের এক আফগান গোত্রপতির আশ্রয় কামনা করলেন। কয়েক বছর আগে তিনি শাহ জাহানের কাছে করুণা ভিক্ষা করে এই লোকের জীবন রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ভাবাবেগে আক্রান্ত না হয়ে মালিক জিওয়ান দ্রুত দারাকে গ্রেফতার করে আওরঙ্গজেবের বন্দী হিসেবে তাকে দিল্লি পাঠিয়ে দেন ।

জীবন ও মৃত্যু

একজন সম্রাটকে কোমলতা ও কঠোরতার মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করতে হয় ৷
–আওরঙ্গজেব

আওরঙ্গজেব প্রথমবারের মতো নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করার প্রায় এক বছর পর ১৬৫৯ সালের ১৫ জুন তার দ্বিতীয় অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। এবার মোগল সম্পদের বিপুল জৌলুস প্রদর্শিত হয় । গায়কদের দল আওরঙ্গজেবের বিশালত্ব ঘোষণা করে, সঙ্গীতজ্ঞরা মনি-মানিক্য উপহার লাভ করেন, আর এত পরিমাণ কাপড় ব্যবহৃত হয় যে ‘সাত মহাদেশের বণিকেরা বিপুল পরিমাণে লাভবান হয়।’ এবার মুদ্রা প্রচলন করা হয়, আওরঙ্গজেব আলমগীরের (বিশ্বজয়ী সিংহাসন উজ্জ্বলকারী) নামে খুতবা পাঠ করা হয়।

এখন ৪০ বছর বয়স্ক আওরঙ্গজেব তার ক্ষমতা লাভের দুই বছরের দ্বন্দ্বের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিরসন করতে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রথমে দারা শুকোহর বিষয়টি ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছিলেন সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী ও উত্তরসূরীর লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রবল শত্রু ।

দারা শুকোহ ১৬৫৯ সালের গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে বন্দী হিসেবে দিল্লি পৌঁছেন। আওরঙ্গজেব তাকে ও তার ১৪ বছর বয়স্ক ছেলে সিপহর শুকোহকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানোর নির্দেশ দেন। পরাজিত দু’জনকে খোলা, রোগাক্রান্ত হাতির পিঠে চড়ানো হয়। সেপ্টেম্বরের ঝলসানো রোদে এমন করুণ দৃশ্য দেখা কঠিন ছিল। তাদের পেছনে উপস্থিত ছিল এক সৈনিক। তারা যাতে পালানোর বেপরোয়া কোনো চেষ্টা না করেন, সেটা জানাতেই সে ছিল তৈরী। অবশ্য, মোগল প্রজারা আগেও এ ধরনের মর্যাদাহানিকর প্রদর্শনী দেখেছে। দারা বছর দেড়েক আগে শাহ সুজার পক্ষের কয়েকজনকে আগ্রায় অবমাননাকরভাবে ঘুরিয়ে ছিলেন। কিন্তু মোগল যুবরাজদের সাথে এমন অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ার বলেছেন যে সমবেত লোকজন দারা শুকোহ ও তার কিশোর ছেলের প্রকাশ্য অবমাননার এই দৃশ্য দেখে গুটিয়ে গিয়ে ছিল ।

পরের দিন আওরঙ্গজেবের সরাসরি নির্দেশ দারা শুকোহর শিরোশ্ছেদ করা হয়। কোনো কোনো সূত্র উল্লেখ করেছে যে মৃত্যুদণ্ডাদেশের যৌক্তিকতা প্ৰতিপন্ন করতে দারার ইসলাম থেকে কথিত মুরতাদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে অন্যরা কেবল মৃত্যুদণ্ডাদেশের কথাই উল্লেখ করেন। এর কয়েক বছর পর পূর্ববর্তী একটি খুনের বদলার অজুহাতে মুরাদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এতে মনে হয়, যত ঠুনকো অজুহাতই হোক না কেন, ভাইদের হত্যা করার বিষয়টি যৌক্তিক করতে চেয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। সম্ভবত ন্যায়বিচারভিত্তিক শাসন পরিচালনাকারী রাজার জন্য এ ধরনের ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে দারার দুই ছেলের বড় জন তথা সোলায়মান শুকোহর জন্য কোনো যুক্তি দেওয়ার দরকার মনে করেননি আওরঙ্গজেব। ১৬৬১ সালে তার জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় আফিম পানি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি ।

আওরঙ্গজেবের খুনে পদক্ষেপগুলো আধুনিক পাঠকের কাছে সন্দেহাতীতভাবে কঠোর মনে হতে পারে। তবে তার ভাইয়েরাও ভিন্ন কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতেন না। মানুচি বিষয়টি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর দিন দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের ভূমিকা বিপরীত হলে তিনি কী করতেন? দেয়ালের লিখন দেখতে পেয়ে দারা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন যে তিনি আওরঙ্গজেবের লাশ চার টুকরা করে দিল্লির চার প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে রাখতেন। তুলনামূলকভাবে আওরঙ্গজেব সংযমের পরিচয়ই দিয়েছিলেন। তিনি দারা শুকোহর লাশ দিল্লির হুমায়ূনের সমাধিতে কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন। দারা সেখানেই বিশ্রামে রয়েছেন।

কঠিন মোগল নজির অনুসরণ করার পর আওরঙ্গজেব করুণা প্রদর্শন করেন, এমনকি দারা শুকোহ ও অন্য ভাইদের বেশির ভাগ সাবেক সমর্থকের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন, এমনকি তাদের যোগ্যতার মূল্যায়নও করেন। তিনি প্রতিহিংসার পথ অবলম্বন না করে তার ভাইদের সৈন্য ও প্রধান উপদেষ্টাদের তার নিজের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিয়ে আসেন। ধনী গুজরাতি জৈন বণিক শান্তিদাসের কাছ থেকে মুরাদ যে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তা পরিশোধ করেন। ১৬৭০ এর দশকে আওরঙ্গজেব এমনকি তার মেয়ে জুবেদাতুন্নিসাকে দারা শুকোহর ছোট ছেলে সিপিহর শুকোহর সাথে বিয়ে দেন এবং তার ছেলে যুবরাজ আকবরের সাথে সোলায়মান শুকোহর মেয়ের বিয়ে দেন। দারার মাত্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর প্রতি কোনো দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এদের একজন হলেন সারমাদ। আর্মেনিয়ান ইহুদি সন্ন্যাসী সারমাদ উদ্ভট আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দারা শুকোহই সিংহাসনে আসীন হবেন। আওরঙ্গজেব ১৬৬১ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।

দারা শুকোহর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপর আওরঙ্গজেব অনেক বেশি শানিত আক্রমণ চালিয়েছিলেন। ১৬৪৯-এর দশক ও ১৬৫০-এর দশকে শাহ জাহানের দরবারে অবস্থানকালে দারা শুকোহ ধর্ম, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের একটি দলকে ৫০টি উপনিষদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। এই অনুবাদ পরে ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল। এর মাধ্যমেই সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিল ইউরোপ। পাঞ্জাবি আধ্যাত্মিক নেতা বাবা লালের সাথে তার দার্শনিক কথোপকথন হয়েছিল। দারা ফারসিতে গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘দুই সাগরের মোহনা’ রচনা করেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন যে হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্ম একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছে। গবেষণা গ্রন্থটি সমুদ্রসঙ্গম নামে সংস্কৃতে অনুবাদ হয়েছে ।

সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিটির হিন্দু দর্শনের, বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণেই আওরঙ্গজেব এর সুস্পষ্ট বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। তিনি দারা শুকোহর আন্তঃসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন, বেনারসের ব্রাহ্মণ কবিন্দ্রচার্য সরস্বতীর রাজকীয় বৃত্তি বাতিল করে দিয়ে শাহ জাহান ও সংস্কৃত সাংস্কৃতিক বিশ্বের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটান। বৃত্তি আবার চালুর জন্য চেষ্টা করেছিলেন কবিন্দ্রচার্য। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এসবের মাধ্যমে বড় ভাইয়ের সাংস্কৃতিক অনুরাগ থেকে নিজেকে আলাদা করতে চেয়েছেন আওরঙ্গজেব।

শাহ জাহানের অস্পষ্ট উপস্থিতি যে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছিল, সে তুলনায় দারা শুকোহ ও তার কীর্তি সামাল দেওয়া ছিল নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। আওরঙ্গজেব যখন সিংহাসনে বসেন, তত দিনে শাহ জাহান সুস্থ হয়ে গেছেন। মূলত, আওরঙ্গজেব তার বাবাকে আগ্রার লাল কেল্লায় বন্দী করে রেখেছিলেন। অনেকে মর্জিমতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে তাজমহল দেখানোর লোভ দেখিয়ে তাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে চাবি ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চম মোগল বাদশাহ তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দিতেন তার বড় মেয়ে জাহানারা। অনেকে শাহ জাহানকে সিংহাসনচ্যুত করা ও বন্দী করার তীব্র নিন্দা করে। তবে তার কারাবন্দী বাবার ট্রাজেডি তার শাসনের প্রথম দিকে তার জন্য জ্বালাতন সৃষ্টিকারী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন ।

সিংহাসনের জন্য ভাইদের মধ্যে লড়াই মোগলদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য রীতি হিসেবে বিদ্যমান থাকলেও ক্ষমতাসীন বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করা খারাপ কাজ বিবেচিত হতো । প্রধান কাজি (মুসলিম বিচারপতি) বিষয়টিকে এত কঠোরভাবে নিয়েছিলেন যে তিনি রাজকীয় ক্রোধের ঝুঁকি নিয়েই শাহ জাহানের জীবিতকালে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণকে অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানান। আওরঙ্গজেব তাকে বরখাস্ত করে ওই পদে আরো নমনীয় আবদুল ওয়াহাবকে নিযুক্ত করেন ।

ভারতবর্ষের বাইরেও শাহ জাহানের প্রতি আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। মক্কার শরিফ আওরঙ্গজেবকে হিন্দুস্তানের যথার্থ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান, এমনকি তিনি শাহ জাহানের প্রতি অসদাচরণ করার কারণে কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের আর্থিক উপহার গ্রহণ করেননি। আওরঙ্গজেবের রাজকীয় পদবি ‘আলমগীর’ (বিশ্বজয়ী) নিয়ে বিদ্রূপ করে সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মান (শাসনকাল ১৬৬৬-৯৪) এক তিক্ত পত্র লিখেন। নিজেকে ভুলভাবে বিশ্বজয়ী (আলম-গিরি) হিসেবে অভিহিত করার জন্য আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করে শাহ সোলায়মান বলেন, তিনি তো কেবল তার বাবাকে জয় (পিদর-গিরি) করেছেন। আওরঙ্গজেব তার ন্যায়বিচারের অবস্থান প্রতিপন্ন করার জন্য সিংহাসনে আরোহণের সময় অনেক ধরনের কর (কয়েকটি সূত্র মোট ৮০টির কথা জানিয়েছে) মওকুফ করে দিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেব তার বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তার জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তা ছিল ডাহা অসত্য ঘোষণা। তিনি সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মানকে (ভুলভাবে) জানিয়েছিলেন যে শাহ জাহান স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করে আওরঙ্গজেবকে মুকুট প্রদান করেছেন ।

পিতার সাথে অন্যায় আচরণের বিষয়টি কোনোভাবেই সামাল দিতে পারেননি আওরঙ্গজেব। এই ঝঞ্ঝাটময় সূচনা তার পুরো শাসনকালে সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে, এমনকি তার ধর্মানুরাগেও প্রভাব ফেলেছে বলে আমরা দেখতে পাব। প্রথম দিকের এই ঘটনাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আওরঙ্গজেবের প্রতিশ্রুতিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে, অবশ্য তা উচ্চাকাঙ্ক্ষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ শাসনকালে আওরঙ্গজেব তার নীতি ও তার রাজনীতির মধ্যে নানা সঙ্ঘাতময় অবস্থার মুখে পড়েছেন, খুব কমই নীতি জয়ী হয়েছে।

সূচনায় আওরঙ্গজেবের ঝামেলায় ও সমস্যায় থাকলেও ১৭০৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ৪৯ বছর মোগল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি প্রায়ই বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন। তবে এমন অবস্থায় সব মোগল শাসকই পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম বাদশাহ ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *