আওরঙ্গজেব শাসনকালের মহা পথ-পরিক্রমা

৩. আওরঙ্গজেব শাসনকালের মহা পথ-পরিক্রমা

সম্প্রসারণ ও ন্যায়বিচার

আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে শ্রেষ্ঠ বিজয়ীরা সবসময় শ্রেষ্ঠ রাজা হন না। দুনিয়ার জাতিগুলো প্রায়ই স্রেফ অসভ্য বর্বরদের অধীনস্ত হয়, সবচেয়ে বিপুল বিজয়ও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সে-ই সত্যিকারের রাজা, যার জীবনের প্রধান কাজ হয় সাম্যের সাথে তার প্রজাদের শাসন করা ।
-–আওরঙ্গজেব, সদ্য সিংহাসনচ্যুত শাহ জাহানকে লেখা পত্ৰ

আওরঙ্গজেব একটি সম্পদশালী, সমৃদ্ধশীল ও সম্প্রসারণমুখী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার বাবা শাহ জাহানের আমলে মোগল রাষ্ট্রের রাজস্ব বেড়েছিল। শাহ জাহান খ্যাতিমান ছিলেন নির্মাণ প্রকল্পের জন্যও। তিনি আগ্রার তাজ মহল ও দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নির্মাণে অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর আওরঙ্গজেবের কৃতিত্ব ছিল রাজকীয় সীমান্ত সম্প্রসারণে ।

শাসনকালজুড়ে আওরঙ্গজেব একের পর এক বিদ্রোহ দমন করেছেন, ঠাণ্ডা মাথায় সম্প্রসারণ যুদ্ধ করেছেন, নির্দয় অবরোধ তদারকি করেছেন। তিনি বিশেষ করে তার রাজত্বের প্রথম ভাগে (১৬৫৮-৮১) মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণে কূটনীতির প্রয়োগ করে প্রায়ই খুশি থাকতেন। তবে মোগল এলাকা আরো বড় করতে শক্তিপ্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৬০-এর দশকে মোগল রাজ্যের প্রতি মারাঠা হুমকি দমন করার জন্য মারাঠা নেতা শিবাজিকে রাজকীয় চাকরিতে যোগদান করতে প্রলুব্ধ করেছিলেন। ওই প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর আওরঙ্গজেব সহিংস হয়ে ওঠেন, বাকি জীবন মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এতে তিনি সীমিত সফলতা পেয়েছিলেন। মোগল কব্জা থেকে যারা শিবাজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল বলে তার মনে হয়েছিল, তাদেরকেও তিনি শাস্তি দিয়েছেন, বেনারাস ও মথুরার মন্দির ধ্বংস করেছেন ।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের প্রথমার্ধে মোগল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার প্রতি আরো অনেক সশস্ত্র হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি এসবের প্রতি সামান্যই কোমলতা প্রদর্শন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোগল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্য ১৬৭৫ সালে তিনি শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। রাঠোর ও সিসোদিয়া রাজপুতেরা ১৬৭০-এর দশকের শেষ দিকে বিদ্রোহ করেছিল। আওরঙ্গজেব উভয় গ্রুপকে দমন করে রাজকীয় পতাকাতলে আনার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে আপসকারী পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধেও আওরঙ্গজেব কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ছেলে যুবরাজ আকবর ১৬৮১ সালে বিদ্রোহ করলে তাকে ধাওয়া করা হয়। বাবার ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই তিনি ১৭০৪ সালে মারা যান ।

আওরঙ্গজেব ১৬৮১ সালে তার পুরো রাজদরবার নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হন। এটি ছিল নজিরবিহীন পদক্ষেপ। তার লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যকে রাজকীয় কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে আসা। আকবরের আমল থেকেই দাক্ষিণাত্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছিল মোগলেরা। কোনো কোনো সম্রাট দক্ষিণ দিকে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব প্রথম সম্রাট হিসেবে দাক্ষিণাত্যের বেশির ভাগ অংশে মোগল শক্তি সম্প্রসারণ করেন।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধ (১৬৮১-১৭০৭) দক্ষিণ ভারতে ব্যয় করে মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেন। তিনি ১৬৮০ এর দশকে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা অবরোধ করেন, উভয় সালতানাতকে তার অধীনে আনার ব্যবস্থা করেন। ১৬৯০ ও ১৭০০-এর দশকে তিনি মারাঠাদের বজ্রমুষ্টি থেকে তামিল নাড়ু ও দক্ষিণে অনেক পাহাড়ি দুর্গ দখল করেন। অবশ্য এসব কাজে তিনি প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব যখন মারা যান, তত দিনে মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা সমসাময়িক ইউরোপের দ্বিগুণ হয়ে গেছে, মোগল ভৌগোলিক এলাকা সর্বকালের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে ।

যুদ্ধ ও শক্তির প্রতি সংকল্পবদ্ধ থাকার দিক থেকে আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষদের চেয়ে সামান্যই ভিন্ন ছিলেন। তবে তিনি ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন, উল্লেখযোগ্য সফলতা প্রদর্শন করেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ মোগল সাম্রাজ্য সমুন্নত রাখার গুরুভার ও সম্ভব হলে এর সীমান্তগুলো সম্প্রসারণ করার দায়িত্ব আওরঙ্গজেবের কাঁধের ওপর ভারী বোঝা চাপিয়ে তার মধ্যে আগ্রাসী সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তুলেছিলেন। তবে মোগল সিংহাসনে বসার মধ্যে কেবল রক্তপাত ঘটানো ও মানচিত্র ক্রমাগত বড় করার চেয়েও বেশি কিছু সম্পৃক্ত ছিল। আওরঙ্গজেবের মধ্যে জাগতিক শক্তির জন্য তার আকাঙ্ক্ষার সাথে ছিল ন্যায়বিচার (আদল) নিশ্চিত করার ধারণা ।

অনেক সময় আওরঙ্গজেব নিজেকে ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণকারীর মতো নয়, বরং তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকা পক্ষপাতহীন, নৈতিক শাসক দাবি করতেন। সম্প্রসারণবাদী একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে এ ধরনের দাবি বিস্ময়করই। একবার দাক্ষিণাত্য ও বাঙলায় অকার্যকরভাবে সৈন্য মোতায়েনের জন্য সদ্য সম্রাট হওয়া আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করেছিলেন শাহ জাহান। এর জবাবে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন যে দক্ষ বিজয়ীরা সবসময় দক্ষ শাসক হয় না। দক্ষ শাসকেরা প্রধানত ন্যায়পরায়ণ শাসনের দিকেই নজর দেন ।

সমসাময়িক অনেক দলিল-দস্তাবেজে ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের ঘোষিত ভক্তির জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ইতালির পর্যটক নিকোলাও মানুচির কথা বলা যেতে পারে। তিনি কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের প্রতি ইতিবাচক ছিলেন না। সেই তিনিও বাদশাহ সম্পর্কে বলেছেন : ‘তিনি বিষণ্ন মেজাজের, সবসময় কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকেন, ন্যায়বিচার করতে আগ্রহী থাকেন, সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে চান।’ হিন্দু জ্যোতিষী ঈশ্বরদাস ১৬৬৩ সালে সংস্কৃত ভাষায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি বাদশাহকে ধর্মপরায়ণ (ধর্মায়া) হিসেবে অভিহিত করে এমনকি উল্লেখ করেছেন যে তার করনীতি ন্যায়সঙ্গত (বিধিত)।

সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের সামগ্রিক মূল্যবোধ ছিল ন্যায়বিচার নিয়ে তার বদ্ধমূল ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যদিও চাতুর্যপূর্ণ রাজনীতি ও ক্ষমতার অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বেশ বড় মাত্রার কৌশল তাতে জড়িয়ে ছিল। এ কারণে আমরা যদি আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসন সম্পর্কে কোনো কিছু (হিন্দুস্থানের বাদশাহ হওয়ার জন্য তার ভাইদের পদদলিত করা, হিন্দু মন্দিরের প্রতি তার আচরণ ও সুফি মাজারে তার সমাধি হওয়া নিয়ে তার ধারণা) বুঝতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই একজন কার্যকর, সাম্যবাদী নেতার অর্থ তিনি কী চিন্তা করেছিলেন, তা পুনঃনির্মাণ করতে হবে। এ দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই ব্যাপারগুলোর ওপর আলোকপাত করা, যেখানে আওরঙ্গজেব মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজের আদর্শের বিরুদ্ধেই গেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে তার বাবাকে উৎখাত করা ও দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। বাস্তব রাজনীতিতে তাড়িত হয়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে আওরঙ্গজেব প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে যেতেন। তার অস্বস্তি ন্যায়পরায়ণ শাসনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে গভীরতা ও সীমারেখা উভয়ের ইঙ্গিতই দেয়।

মহান মোগল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী

হিন্দুস্তান অঞ্চলে রুটির এই সামান্য টুকরাটি [তথা মোগল সাম্রাজ্য] হলো মহামান্বিত তৈমুর ও আকবরের উদার উপহার ।
-–আওরঙ্গজেব, নাতি বিদার বখতকে লেখা চিঠিতে

একটি সাম্রাজ্যের পাশাপাশি আওরঙ্গজেব এমন একটি বর্ণাঢ্য মোগল অতীতের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন যাতে ছিল সমৃদ্ধ অনুকরণীয় আদর্শ ও ভয়ানক দায়িত্ববোধ। একজন মহান রাজা কিভাবে হওয়া যায়, তার উদাহরণ দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পূর্বপুরুষদের নাম উল্লেখ করেছেন তার লেখালেখিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব তার নাতিদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে মোগল সাম্রাজ্য হলো তৈমুর ও আকবরের উপহার, পরবর্তী প্রজন্মগুলোর দায়িত্ব হলো এর সামগ্রিক গৌরব সমুন্নত রাখা ।

পূর্বসূরীদের মাধ্যমে আওরঙ্গজেব একটি বিশাল, নানা মাত্রিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে মোগল বাদশাহরা চমকপ্রদ ভবনরাজি নির্মাণ করেছিলেন, কবি-পণ্ডিতদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, পাণ্ডুলিপির জন্য বিশাল বিশাল পাঠাগার তৈরী করেছেন, চিত্রকর ও শিল্পীদের সহায়তা করেছেন। এসব শিল্প, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্থাপত্য ধারার অনেকগুলোকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন আওরঙ্গজেব, আবার কোনো কোনোটিকে বাতিল করেছেন, পরিমার্জিত করেছেন। তিনি কখনো তার মোগল উত্তরাধিকারকে লঙ্ঘন করেননি, তবে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র সৃষ্টিতে পরিশীলিত করেছেন ।

শুরুতে শাহ জাহান ও অন্যান্য মোগল সম্রাটের অনুসরণ করা সাংস্কৃতিক ও দরবারি কার্যক্রম কঠোরভাবে অনুসরণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাদশাহ হিসেবে প্রথম কয়েক বছর সময়কালের মধ্যে আওরঙ্গজেব তার প্রথম স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমের জন্য আওরঙ্গবাদে একটি স্মারক সমাধি নির্মাণ করেন। তার এই স্ত্রী ১৬৫৭ সালে পঞ্চম সন্তান জন্মদানকালে প্রসবজনিত জটিলতায় পরলোকগমন করেছিলেন। উজ্জ্বল শ্বেতশুভ্র এ সমাধি ক্ষেত্রটি বিবি কা মাকরাবা (রানির সমাধি) নামে পরিচিত। এটি ছিল শাহ জাহানের তাজ মহলের দৃশ্যমান অনুকরণ। অবশ্য আকারে ছিল অর্ধেক এবং বাইরের দিকে মার্বেল পাথর না দিয়ে প্রলেপ দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। বর্তমানে এর নাম গরিবের তাজ। আওরঙ্গজেব এখানে স্বীকৃত মানসম্পন্ন মোগল সমাধি দিয়ে স্ত্রীকে সম্মানিত করার স্বপ্নাবিভাবের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।

আওরঙ্গজেব তার প্রথম ১০ বছরের শাসনকালে হিন্দু রীতিনীতি থেকে উদ্ভূত অনেক মোগল রাজকীয় প্রথা বহাল রেখেছিলেন। তার রাজকীয় চেহারার দর্শন তথা শুভ দৃষ্টিপাত দিতে তিনি প্রতিদিন সকালে ঝরোকা প্রাসাদের জানালায় দৃশ্যমান হতেন। চান্দ্র ও সৌর জন্মদিনে তিনি প্রকাশ্যে সোনা ও রুপা দিয়ে ওজন করিয়ে তা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। আকবরের আমল থেকে এ হিন্দু প্রথাটি মোগলরা অনুসরণ করত ৷

হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি ১৬৬১ সালে মহান্ত আনন্দ নাথকে একটি চিঠি লিখে যোগ শাস্ত্রানুসারে তাকে একটি ওষুধ লিখে দিতে বলেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকে তিনি পাঞ্জাবে একটি গ্রামে আনন্দ নাথের ভূসম্পত্তি বাড়িয়ে দেন। এ ধরনের যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের হিন্দু যোগী যদরূপের সাথে বৈঠক ও আকবরের মথুরার বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে ভূমিদানের মতোই ।

কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের বিনোদনমূলক কার্যক্রম তার পূর্বপুরুষদের মতোই ছিল। মোগল সম্রাটদের প্রিয় অবকাশকেন্দ্র কাশ্মিরে তিনি গ্রীস্মকালটি কাটাতেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন। ওই আমলের স্বল্প-উদ্ধৃত তবে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ বখওয়ার খানের ভাষ্যানুযায়ী, বাদশাহ সঙ্গীত কলার ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখতেন। ফকিরুল্লাহর ১৬৬৬ সালের সঙ্গীত গবেষণা গ্রন্থ রাগ দর্পণে আওরঙ্গজেবের প্রিয় শিল্পী ও বাদ্যকারদের তালিকা দেওয়া হয়েছে।

শাসনকালের দ্বিতীয় দশকে আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় আচরণ বদলাতে শুরু করেন। হিন্দু উৎস থেকে আসা অনেক রাজকীয় প্রথা তিনি বাতিল করেন, সঙ্গীতের মতো কিছু কিছু ব্যবস্থার ওপর থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি সরকারি দরবারি ইতিহাসবিদের পদটিই বিলুপ্ত করে দেন। আওরঙ্গজেবের দরবারের কঠোরতর নীতিপরায়ণ পরিবেশের কারণেই এমনটা হয়েছিল। তবে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানে এসব পরিবর্তন সামান্যই অনুভূত হয়েছিল ।

আওরঙ্গজেব ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত দরবারি ইতিহাসলেখক মোহাম্মদ কাজিমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। মোগল পাঠাগার ও সরকারি নথিপত্রে প্রবেশগম্যতা ভোগ করতেন কাজিম। মোগল সম্রাটেরা সবসময় দরবারি ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেননি। বাবর ও জাহাঙ্গীর নিজেরাই তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, হুমায়ূনের রাজত্ব সম্পর্কে বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে তার মৃত্যুর পর। তবে আকবর ও শাহ জাহান সাধারণ নিয়ম হিসেবে বেতনভোগী ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেছিলেন। পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের মধ্যে এ দুজনই ছিলেন তর্কসাপেক্ষে আওরঙ্গজেবের কাছে প্রধান দুই দৃষ্টান্ত । মোহাম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা (আওরঙ্গজেব আলমগিরের ইতিহাস) হাতে পাওয়ার পর এই রীতি থেকে বের হয়ে আসেন আওরঙ্গজেব। এ গ্রন্থটি আওরঙ্গজেবের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস। এরপর কাজিমকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়।

দরবারি ইতিহাসলেখকের প্রতি কেন বিরূপ হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব তা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তার হঠাৎ করে সরকারি ইতিহাসের প্রতি বিরূপ হওয়ার কারণ নির্ণয়ে অনেক গবেষক প্রয়াস চালিয়েছেন। তারা নানা কারণ অনুমান করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বাদশাহর অতিমাত্রায় ধার্মিক হয়ে পড়ার ফলে ধর্মতত্ত্ব ছাড়া অন্য সব বইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়া, রাজকোষাগার খালি হয়ে যাওয়া। রাজদরবারে এর পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দেওয়া হলে এসব যুক্তি টেকে না। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আওরঙ্গজেব আর কোনো ইতিহাসবিদকে নিয়োগ করেননি, তবে তিনি ইতিহাস লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেননি। যদিও পরবর্তীকালের ইতিহাস লেখকদের ভ্রান্ত পাঠের কারণে ২০ শতকের অনেক ইতিহাসবিদ আওরঙ্গজেব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনেক মোগল কর্মকর্তা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময়ে বা এর সামান্য পরপরই ফারসি ভাষায় ইতিহাস লিখেছেন। এগুলো আজও আমাদের কাছে রয়েছে।

আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকে অনেক দরবারি সৌজন্যবিধিতে পরিবর্তন করেছেন। ১৬৬৯ সালে তিনি দৈনন্দিন দর্শনে হাজির হওয়ার প্রথা বাতিল করেন । প্রায় একই সময়ে তিনি সোনা ও রুপা দিয়ে জন্মদিনে ওজন করার প্রথা রদ করেন বলে জানা যায়। তিনি দরবারের অনেক অনুষ্ঠান থেকে সঙ্গীতজ্ঞদের সরিয়ে নেন, তাদেরকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। মজার ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব পরিবর্তনের অনেকগুলো হয়তো সাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত জ্ঞান থেকে করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ঝারোকা জানালায় প্রতিদিন আবির্ভূত হওয়ার কথা বলা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজকীয় উত্তেজনা এড়াতেই এই প্রথা থেকে সরে আসেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার অসুস্থতার খবর চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি ঝারোকায় হঠাৎ করেই অনুপস্থিত হয়ে পড়েছিলেন । শাহ জাহান বিছানায় ছিলেন মাত্র ১০ দিন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই মোগল রাজপুত্রদের মধ্যে সঙ্ঘাতের চাকা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল ।

অবশ্য আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের ১০ বছর পূর্তির সময়কালের দিকে যেসব পরিবর্তন করেছিলেন, সবই বিচক্ষণ ছিল, তা বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে সঙ্গীতের কথা বলা যেতে পারে। এটা সম্ভবত করা হয়েছিল ব্যক্তিগত কারণে। তিনি এ থেকে হয়তো বাস্তব উপকার পাচ্ছিলেন না, এবং ব্যক্তিগত রুচির বিষয়টিও এতে ছিল। মূল্যবান ধাতু দিয়ে ওজন করানোর প্রথার ব্যাপারেও একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকতে পারেন। অবশ্য শেষ জীবনে তিনি এ ব্যাপারে তার মন পরিবর্তন করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তার নাতি বিদার বখতের জন্য ওজন পরিমাপ প্রথা অনুসরণের সুপারিশ করেছিলেন, সম্ভবত নিজের জন্যও তা শুরু করেছিলেন। এ ব্যাপারে ১৬৯০ সালে ইউরোপিয়ান পর্যটক জন অভিঙ্গটনের একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। আওরঙ্গজেবের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি তার প্রথম বয়সের উদ্দীপনা আর ফিরে না এলেও শেষ জীবনে তিনি কিন্তু এটিকে যথার্থ রাজকীয় প্রথা বলে অভিহিত করে তার ছেলেকে উপভোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরও ১৬৬৯ সালের দিকে আওরঙ্গজেব হিন্দু মূল থেকে প্রাপ্ত অনেক প্রথাসহ মোগল সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক অনুষ্ঠান রাজদরবার থেকে উঠিয়ে দেওয়ায় এর সামগ্রিক পরিবর্তনের নিট প্রভাব অস্বীকার করা যায় না ।

দ্বিতীয়ত, এবং সম্ভবত অভাবিত বিষয় হলো এই যে আওরঙ্গজেবের নতুন নীতির ফলে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা তার ছেলে ও মোগল অভিজাতদের দরবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব নিজে সঙ্গীত থেকে বিরত থাকলেও তার কয়েকজন ছেলে উৎসাহভরে সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ক্যাথেরিন স্কফিল্ড উল্লেখ করেছেন যে আওরঙ্গজেবের আমলে সঙ্গীতের ওপর এত বেশি ইন্দো-ফারসি আকর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, যা পূর্ববর্তী ৫০০ বছরের ভারতবর্ষের ইতিহাসেও হয়নি। চিত্রকলার ব্যাপারেও একই কথা বলা যেতে পারে। সমসাময়িক প্রমাণে দেখা যায়, ১৬৬০-এর দশকের পর আওরঙ্গজেব চিত্রশিল্পীদের নিয়মিত তহবিল প্রদান করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বৃদ্ধ বয়সের অনেক ছবি এখনো টিকে আছে। বর্ষীয়ান আওরঙ্গজেবের ছবিগুলো খুব সম্ভবত যুবরাজদের দরবার থেকে এসেছে। এসব দরবারে চিত্রকলা শিল্প বিকশিত হচ্ছিল। এই আমলে ফারসি কবিতাও সমৃদ্ধ হয়েছিল। আর আওরঙ্গজেবের নিজের মেয়ে জেবুন্নিসা ছিলেন প্রখ্যাত কবি। তিনি মাখফি (আড়ালে থাকা ব্যক্তি) ছদ্মনামে লিখতেন ।

সংস্কৃত পণ্ডিতদের দিক থেকে আওরঙ্গজেবের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলেও প্রতিভাগুলো উপ-রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৫০-এর দশকের শেষ দিকে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর কবিন্দ্রাচার্য মোগল অভিজাত দানিশমন্দ খানের দরবারে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তিনি ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ারকে সহায়তা করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান সংস্কৃত বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃত-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাঙলার গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে তিনি আকবরের আমলে অনূদিত মহাভারতের ফরাসি পাণ্ডুলিপির সূচিপত্র তৈরী করার নির্দেশ দেন বসন্ত রাইকে। শায়েস্তা খান নিজে সংস্কৃত কবিতা রচনা করেছিলেন। তার কবিতাগুলো রসকল্পক্রমে সংরক্ষিত রয়েছে। আর সংস্কৃত কবিরা কখনো আওরঙ্গজেবকে স্বীকৃতি দিতে বিরাম দেননি। উদাহরণ হিসেবে দেবদত্তের কথা বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন গুজরাতি নারীদের প্রেমবিলাস নিয়ে লেখা গুজারিশতাকামের লেখক। এই গ্রন্থের সূচনায় তিনি আওরঙ্গজেব ও তার ছেলে আযম শাহের কথা উল্লেখ করেছেন।

আওরঙ্গজেবের দরবার ১৬৬৯ সাল থেকে ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতে থাকে, কিছু কিছু ব্যাপারে কম কম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। তবে তারপরও শাহ জাহানের আমলে থাকা মোগল সংস্কৃতির অনেক কিছু অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে আদালতের শাস্ত্রাচার ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ।

ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা আওরঙ্গজেবের দরবারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। দরবার পরিচালিত হতো কঠোর বিধিবিধান ও আদেশের মাধ্যমে। সম্রাট আসন গ্রহণ করতেন একটু উঁচু মঞ্চে, দিল্লিতে থাকলে বসতেন ময়ূর সিংহাসনে। এতে যত মনি-মানিক্য ছিল, তা দরবারের দর্শকেরা গুণেও শেষ করতে পারত না। সম্রাট নিজে সিল্কের পোশাক পরতেন, সোনায় মোড়ানো পাগড়ি মাথায় দিতেন, মুক্তা ও রত্নপাথরের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। মোগল ক্রমপরম্পরা নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী অভিজাতেরা দাঁড়াতেন, এই উজ্জ্বল ঝলমলে প্রদর্শনীতে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন । মেঝগুলোতে থাকত মহামূল্যবান কার্পেট, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত পর্দা । রাজকীয় বাদকদল (নওবাত) আওরঙ্গজেবের সঙ্গীত-বিধিনিষেধের বাইরে ছিল। তারা সদা-প্রস্তুত থাকত। এই বিলাসবহুল পরিবেশে আওরঙ্গজেব উপহার প্রদান করতেন, গ্রহণ করতেন, পর্যটক ও অভিজাতদের স্বাগত জানাতেন, সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন ।

আওরঙ্গজেবের স্বকীয় আগ্রহে পূর্ববর্তী মোগল সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৬৭০-এর দশকে কয়েকটি বিশালাকার রাজকীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজদরবারে আলেমরা বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প ফতোয়া-ই আলমগিরি সম্পন্ন করেন। আট বছর পরিশ্রমের পর হানাফি মাজহাবের শাস্ত্রাচার অনুযায়ী ১৬৭৫ সালে এর রচনার কাজ শেষ হয়। এই সঙ্কলন কাজটি করার সময় মাঝে মাঝে এমনকি জোরে করা পাঠ আওরঙ্গজেব শুনতেন, মাঝে মাঝে সংশোধনের কথা বলতেন। এর পর থেকে সাম্রাজ্যজুড়ে বিচারকেরা এই বই থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। বইটি আরবিতে লিখিত হলেও এর পরপরই তা ফারসিতে অনূদিত হয়। এ বইতে আওরঙ্গজেবের ধর্মভক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের আগ্রহ পরিষ্কার আইনি বিধান প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। অবশ্য আকবর থেকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার প্রতি বৃহত্তর মোগল ধারাবাহিকতা আওরঙ্গজেবের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। পূর্বপুরুষদের মতো আওরঙ্গজেবও বিশাল একটি রাজকীয় পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, এমনকি তার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য ১০ লাখ রুপি পর্যন্ত ব্যয় করেছিলেন ।

আওরঙ্গজেব ১৬৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে লাহোরের বিশাল বাদশাহি মসজিদের (চিত্র ৩) নির্মাণকাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দিলরাসের গরিবের তাজের বিপরীতে এখানে শাহ জাহানের সৃজনী ক্ষমতার সমকক্ষ হন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেবের কৃতিত্বগাঁথা এই মসজিদে ফুলের মটিফ, মার্বেল পাথর ও বাঁকানো কার্নিশসহ চমকপ্রদ ছোঁয়া ছিল। নির্মাণের সময় বাদশাহি মসজিদ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখানে ৬০ হাজার মুসুল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি এখনো দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে। সময়ের পরিক্রমায় এবং ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎ সিংয়ের গোলন্দাজ ভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহারের ফলে ভবনটি কিছু ক্ষতির শিকার হয়েছিল। বর্তমানে এটি আবারো মসজিদ হিসেবে বিরাজ করছে। এর প্রগাঢ় সৌন্দর্য দর্শকদের মধ্যে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে, মোগল নান্দনিক রুচিবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ সালে দিল্লি ত্যাগ করেন, আর কখনো উত্তর ভারতে ফিরে আসেননি। ১৬৮১ সাল থেকে তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন, বিরামহীনভাবে অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন বিশাল অস্থায়ী লাল তাঁবুতে বাস করে। আওরঙ্গজেবের পূর্বপুরুষেরা প্রায়ই তাঁবুতে (মোগল রাজকীয় চিহ্ন লাল রঙের) বাস করতেন, এখানেও আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন। মোগল জীবনযাত্রা যাযাবর শেকড়ে ফিরে যাওয়ায় আওরঙ্গজেব অতুচ্চ মোগল সংস্কৃতির অনেক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসহ তার নিজের অগ্রাধিকার ও রুচির ওপর জোর দিয়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অর্ধ শতকজুড়ে শাসনকালে আওরঙ্গজেব প্রতিদিন এবং কখনো কখনো দিনে দুবার করেও দরবার ডাকতেন। তিনি ন্যায়বিচার করা নিয়ে গর্ব করতেন, অনেক সময় আবেদনকারীর জবাব নিজে লিখতেন। তিনি জ্যোতিষীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এটি ছিল মোগল রাজকীয় কার্যক্রমের অন্যতম অনুষঙ্গ। এমনকি আঠার শতকেও তা অব্যাহত ছিল। ১৬৯০-এর দশকে ভারতবর্ষ সফরকারী ইতালির পর্যটক গেমেলি ক্যারেরি লিখেছেন যে ‘সম্রাট [আওরঙ্গজেব] তার জ্যোতিষীদের পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজই করেন না।’ ১৭০৭ সালে মৃত্যুর সামান্য আগে এক জ্যোতিষী সুপারিশ করেন যে জ্বর ভালো করার জন্য সম্রাটকে একটি হাতি ও একটি হীরা দান করতে হবে। হাতি দান করার হিন্দু ও ফারসি রীতি অনুসরণ করার পরামর্শটি অযৌক্তিক বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করেন আওরঙ্গজেব । তবে তিনি গরিবদের মধ্যে ৪০০০ রুপি দান করেন। উল্লেখ্য, ৪৯ বছরের শাসনকালজুড়ে এ ধরনের জ্যোতিষী সম্রাটের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে ।

আরো সাধারণভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব জীবনের শেষ দিকে তার শাসনের অনেক আগে থেকেই মোগল রাজকীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া হিন্দু আদর্শ, ধর্মগ্রন্থ ও সংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই দূরে ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকে চন্দ্রমান নামের এক কবি রামায়ণের ফরাসি ভাষ্য নারগিসিস্তান (নার্সিসাস উদ্যান) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। ১৭০৫ সালে অমর সিং একই কাজ করে তার গদ্য ফারসি রামায়ণ (অমর প্রকাশ নামে) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। আকবর প্রথম ফারসি রামায়ণের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এটি দুই মহান সংস্কৃত মহাকাব্যের অন্যতম ও ষোড়শ শতকের শেষ দিকের এই সময়কালে ছিল অনেক হিন্দুর কাছে প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ। পরের শত বছরে কবিরা অসংখ্য স্বতন্ত্র ফারসি রামায়ণ রচনা করেন, এগুলোর কিছু কিছু ক্ষমতায় থাকা মোগল সম্রাটদের উৎসর্গ করেন। এমনকি রাজত্বের শেষ দিকেও আওরজঙ্গজেব মোগল রাজত্ব ও রামের মহাকাব্যিক কাহিনীর মধ্যকার কথিত সম্পৃক্ততার অবসান ঘটিয়ে মোগল সাংস্কৃতিক প্রথা থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাননি ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *